ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা বৈদিক বিশ্লেষণ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

08 November, 2022

ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা বৈদিক বিশ্লেষণ

ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা বৈদিক বিশ্লেষণ
 অদ্বৈতবাদের তত্ত্ব হল- ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। 

(১) ব্রহ্মা সত্যং জগন্মিথ্যা এটি বেদান্তের মূল তত্ত্ব। আচার্য শঙ্কর বলতেন অর্দ্ধ শ্লোকে প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ_অর্থাৎ কোটি কোটি গ্রন্থে যা লেখা আছে তা আধখানা শ্লোকে আমি বলছি______

"ব্রহ্ম সত্য অগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ। 

ইদমেব তু সাত্রমিতি বেদান্ত ডিণ্ডিমঃ।।" ২১ (ব্রহ্ম জ্ঞানাবলী মালা )

এই শ্লোকের সরল অর্থ- "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব স্বরূপ, ব্রহ্ম হতে জীব ও জগতের পৃথক কোন সত্তা নাই। এই হল সমস্ত বেদান্তের উচ্চনিনাদ বা ঘোষণা'।।

ব্রহ্মা সৎ চিৎ আনন্দস্বরূপ, নির্বিশেষ, স্বপ্রকাশ, দেশ কাল পাত্র দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন এক অন্বয় পরমতত্ত্ব আশা করি এই ঋষিবাক্যে কারো কোন (আস্তিকদের) সংশয় নাই। এই দৃশ্যমান জগৎ, আপনাদের ভাষায় এত সুখের ও সাধের পৃথিবী মিথ্যা – এই কথাটি নিয়ে অনেক গোল বেধেছে। কিন্তু আচার্য এখানে কোন নঞর্থক (Negative) ভাবে 'মিথ্যা' শব্দটি প্রয়োগ করেন নি। 

মিথ্যা মানে আত্যত্ত্বিক সত্তার অভাব। জলের কাছে দাঁড়ালে আপনাদের ছায়া পড়ে। আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে ছায়াকেও দণ্ডায়মান দেখা যাবে, বসে থাকলে ছায়াও বসবে, আপনারা জলের কাছ হতে দূরে সরে যান, তাহলে জলের মধ্যে আর ছায়া দেখা যাবে না। তাহলেই বুঝে দেখুন আপনাদের ছাড়া ছায়ার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা সত্তা নাই। এই অর্থে জগৎ মিথ্যা। জগৎ যে মিথ্যা তা জগৎ শব্দের মধ্যেই প্রতিপাদিত রয়েছে। গচ্ছতীতি জগৎ (গম্ + ড) – যা নিয়ত গমন করে, নিয়ত পরিবর্তিত হয়, ever fleeting ever changing, always inconstant, তাকে মিথ্যা ছাড়া আর কি বলা যাবে ?

সত্য আমরা কাকে বলি ? কালত্রয়মবাধিতং সত্যং – যা ত্রিকালে অবাধিত। যা পূর্বে ছিল, এখন এবং পরেও থাকবে তারই নাম ঋষিরা দিয়েছেন "সত্য"। যা পূর্বে ছিল, এখন নাই, তা সত্য নয়। পূর্বে ছিল না কিন্তু পরে হয়ত দেখা যাবে তাও সত্য নয়। আজ যে ৭৫ তলা বা ১৫০ তলা বিশিষ্ট আকাশচুম্বী অট্টালিকার কথা শুনে আমাদের বিস্ময়ে হতবাক হতে হচ্ছে, বিশ পঁচিশ বা  পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে ঐরকম ছিল না, কয়েক বৎসর পরে হয়ত দেখবেন তার রূপ এবং আকৃতি সবই বদলে গেছে। আপনারা আপনাদের স্থানেও দেখতে পাবেন এখানেও নানা পরিবর্তনের ধারা। জগতের প্রতি বস্তু সম্বন্ধেই এই কথা প্রয়োজ্য। জাগতিক যে কোন বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখুন, বিচার করলেই বুঝতে পারবেন, এখানে কোন বস্তুই নিত্য স্থির নয়। দৃশ্যপট, তার রূপ, রঙ প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে। এইভাবে যার উৎপত্তি বৃদ্ধি, বিবর্তন ও বিলুপ্তি ঘটে, তা স্বভাবতই মিথ্যা।

কোন কোন টীকাকারের মতে, জগৎ শব্দের অর্থ যা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের বিষয়। এই অর্থে তাবৎ দৃশ্য পনাই জগৎ পদবাচ্য। ব্রহ্ম জ্ঞেয় বা দৃশ্য হন না আবার যা সোনার পাথরবাটি, কাঠালের আমসত্ত্ব এবং বন্ধাপুত্রাদির ন্যায় অসৎ তাও দৃশ্য হয় না। সুতরাং জগৎ সৎ নয়, অসৎও নয়। মিথ্যা বলতে যা সৎ নয়, অসৎ নয় এবং সদসৎ নয় তাকে বুঝায়। 

যেমন রজ্জুতে যে সর্পের জ্ঞান হয়, সেই সৰ্প মিথ্যা। মিথ্যা বস্তু তিনকালেই থাকে না অথচ তা জ্ঞানের বিষয় হয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে জ্ঞান হয় এখনা এটি সৎ কিন্তু তিনকালে বিদ্যমান থাকে না, এজন্য এটি অসৎ। আবার অধিষ্ঠানের জ্ঞানে (রজ্জুকে রজ্জু বলে বুঝামাত্রই) এর নিবৃত্তি হয় বলে একে অসৎও বলা যায় না। এইভাবে এটি সদস্য হতে ভিন্ন বস্তু। যা সদসৎ হতে ভিন্ন তা মিথ্যা। জগৎ এইরূপ মিথ্যা বস্তু। যাইহোক, আমি আর একটি উদাহরণ দিয়ে পুনরায় তত্ত্বটি পরিস্ফুট করার চেষ্টা করছি। মনে করুন কোন মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে সন্ধোবেলা নর্মদার ধারে বেড়াতে গেছেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ছেলেটি নিতান্ত খেলার ছলে জলে একটা ঢিল ছুঁড়ল। ঢেউ উঠল। বাচ্চা ছেলেটা তার মাকে বলল, দেখ দেখ মা জলের ভিতর চাঁদ নাচছে। ভেবে দেখুন ছেলেটার ঐ কথা কি ঠিক। আকাশের চাঁদ আকাশেই আছে, পুকুরে চাঁদ নাই, সে নাচছে না, মা হয়ত ভুল শুধরে দিবার জন্য বললেন না না চাঁদ নাচছে না, জলের নীচে চাদের প্রতিবিম্বটাই নাচছে'। কিন্তু একথাও যথার্থ নয়। বিম্বে যা থাকে প্রতিবিম্বে ত তারই প্রতিফলন ঘটে। কাজেই চাঁদ যখন নাচছে না, তখন তার প্রতিবিম্বও নাচতে পারে না। বল বা গতি জ্বলে বাধা পেয়ে  wave length সৃষ্টি করেছে, সেটাই কেঁপে কেঁপে চলেছে। পুকুরে চাঁদ নাই, তা নাচছে না, তার প্রতিবিম্বও নাচছে না। এই উদাহরণ থেকে তাহলে একথাটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হল যে চর্মচক্ষুতে যা প্রত্যক্ষ দেখা যায়, সর্বদা তা সত্য হয় না। তাই আচার্য শঙ্করের অভিমত -জগৎ মিথ্যা। 

যোগী যার স্বরূপ জ্ঞান হয়, তাঁর চোখে একমাত্র ব্রহ্মাই সত্য। ব্রহ্ম ছাড়া জড় এই জগৎ নিজ হতে কোন কার্য সম্পাদন করতে পারেনা এটাই মূখ্য বিষয়। এই দৃশ্যমান ব্যবহারিক জগৎ অবিদ্যামানোঽপি অবভাসতে। বাস্তবিক পক্ষে নাই অথচ আছে বলে মনে হয়. এই প্রাপ্ত জ্ঞানের উপরই জগৎ চলছে। এটি কেমন ? না – শঙ্কর জী বলেছেন যেমন, রজ্জুতে সর্পজ্ঞানবৎ। সত্যি সত্যি সাপ নাই অথচ একগাছি দড়ি দেখে মনে হল সেটা সাপ। ভ্রাক্তিবশে দড়িতে সাপের চিত্র ভেসে উঠল। পরম বৈজ্ঞানিক ঋষিরা বলেছেন। এই যে অবস্পন্দিত দৃষ্টি, এই যে ভ্রান্তি দর্শন, এর কারণ আপেক্ষিকতা (due to Relativity)। আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে একমাত্র তুরীয় ভূমিতে জীবাত্মার সদখান ঘটলে তবেই বুঝা যায় যে নাভাবো বিদ্যতে সতঃ -সৎএর বিদ্যমানতার কখন অভাব ঘটে অর্থাৎ কিনা যা সৎ তা সদৈব অবিনাশী। আমরা সাংখ্য সূত্র ৫।১৩ অনুযায়ী জানি ব্রহ্ম অবিকারী তিনি কোন পদার্তের সংয়োগে উৎপন্ন হন না অথবা কোন পদার্থ তাঁহার সাথে যুক্ত হয়ে তাঁকে বিকারী করতে পারে না। সর্বব্যাপী ব্রহ্মে রজ্জুতে সর্পবৎ জগৎ ভাসে, কেবল প্রতীত হয়। প্রকৃতপক্ষে জগতের ব্রহ্মনিরপেক্ষ কোন আন্তরিক সত্তা নাই। কাজেই জগৎ যে মিথ্যা - এটি যক্তিদিদ্ধ এবং অনুভবসিদ্ধ তত্ত্ব।।

জৈনদের প্রকাশিত মত সৃষ্টি কর্ত্তা অনাদি ঈশ্বর কেউ নাই, এই জগৎ এবং জীব অনাদি এবং এই উভয়ের উৎপত্তি এবং কখনো নাশ হয় না। শঙ্করাচার্যের মত এর বিরূদ্ধ ছিল। তিনি বলতেন যে অনাদি সরদ্ধ পরমাত্মাই জগতের কর্ত্তা; এই জগৎ এবং জীব মিথ্যা, কারণ উক্ত পরমেশ্বর আপনার মায়া হতে জগতের নির্মান ধারণ এবং প্রলয় করে থাকেন এবং এই (জগৎ) প্রপঞ্চ ও জীব স্বপ্নবৎ মাত্র। পরমেশ্বর স্বয়ংই সমস্ত জগৎরূপ হয়ে লীলা বিস্তার করেন। স্বামী দয়ানন্দ জীর মতে শঙ্করাচার্য জী জৈনমত খণ্ডনের জন্য ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মের একতা ব্যাখ্যা করে ছিলেন। বিচার্য জীব ও ব্রহ্মের একতা এবং জগৎ মিথ্যা ইত্যাদিরূপ যে শঙ্করজীর মত ছিল তা উৎকৃষ্ট নয়। তবে যদি তিনি জৈনমত খণ্ডনের নিমিত্ত উক্ত মত স্বীকার করে থাকেন তবে অপেক্ষাকৃত ভাল [সত্যার্থ প্রকাশঃ]।

নবীন বেদান্তীরা যে বিবর্ত্তবদের কথা বলে অর্থাৎ রজ্জুতে সর্পের প্রতীতি হওয়ার দৃষ্টান্ত ব্রহ্মে জগতের প্রতীতি হওয়ার পক্ষে প্রদর্শন করে তাও সমীচীন নয়। ব্রহ্মে জগতের ভান জীবের অজ্ঞানতা হতে আসে, অবিদ্যা অজ্ঞানতা সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বজ্ঞের গুণ হতে পারে না। পরমেশ্বর নিরাকার এবং সর্ব্বত্র আকশবৎ ব্যাপক বলে ব্রহ্ম হতে কোন পদার্থ এবং কোন পদার্থ হতে ব্রহ্ম পৃথক হতে পারে না। তদ্রুপ ব্যাপ্য ব্যাপক সম্বন্ধ বশতঃ (ব্রহ্ম অন্য পদার্থের সাথে) একও হতে পারে না। অর্থাৎ অন্বব্যতিরেকানুসারে দেখলে ব্যাপ্য ও ব্যাপক মিলিত হয়েও সর্ব্বদা পৃথক থাকে। যদি এক হয় তবে নিজ মধ্যে ব্যাপ্য় ও ব্যাপক সম্বন্ধও ঘটতে পারেনা। ব্রহ্মের আভাসও পতিত হতে পারে না কারণ আকার ব্যতিরেকে অভাস হওয়া অসম্ভব। যদি অন্তঃকরণোপাধি বশতঃ ব্রহ্ম কে জীব বলে মনে কর, তাও বালকের মত কথন, কারণ অন্তঃকরণ চঞ্চল এবং সখণ্ড কিন্তু ব্রহ্ম অচল এবং অখণ্ড। অন্তকরণ যেখানে যেখানে চলে যাবে, সেই সেই স্থানের ব্রহ্মকে অজ্ঞানী এবং যে যে দেশ ছেড়ে যাবে, সেই সেই স্থানের ব্রহ্মকে জ্ঞানী করে দেবে কি না ?!

অখণ্ড ব্রহ্মের একদেশীয় অবরণের প্রভাব সর্ব্দেশে প্রসূত হওয়ায় সমস্ত ব্রহ্মই অজ্ঞানী হয়ে যাবেন;কারণ তিনি চেতন। তদ্ব্যতীত দিল্লীত যে অন্তঃকরণস্থ ব্রহ্ম যে বস্তু দেখেছেন, তার স্মরণ উক্ত অন্তকরনস্থ ব্রহ্মের কোলকাতায় হতে পারে না। কারণ "অন্যদৃষ্টমণ্যো ন স্মরতীতি ণ্যায়ং" একের দৃষ্ট অন্যের স্মরণ হয় না। যদি বলেন যে ব্রহ্ম এক এবং এই জন্য স্মরণ হয়, তাহলে এক স্থানে অজ্ঞান বা দুঃখ হলে সমস্ত ব্রহ্মের অজ্ঞান অথবা দুঃং হওয়া আবশ্যক। জীব এবং ব্রহ্ম ভিন্ন। উভয়েই চৈতন্য হলেও পরস্পর বিজাতীয় চৈতন্য। দুইএর মধ্যে এই ভেদ পাওয়া যায়, জীবাত্মা অজ্ঞ, পরমাত্মা / ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, জীব কেবল চৈতন্য স্বরূপ, ব্রহ্ম জ্ঞান ও আনন্দ স্বরূপ, জীবাত্মা অনু ও একদেশী, ব্রহ্ম অনন্ত ও সর্বব্যাপী এবং অমূর্ত্ত অর্থাৎ কোন স্থান অধিকার করেন না, জীবাত্মা বহু এবং পরমাত্মা এক-জীব ও ব্রহ্মে এই ভেদ। জীবাত্মা সচ্চিৎস্বরূপ এবং ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ [সাংখ্য ৫।৬৬]। এই সৃষ্টি কার্যপরূপ বলে অসৎ, কারণ কার্য্য কখনোও নিত্য হতে পারে না [সাংখ্য ৫।৫৬]। যা প্রত্যক্ষ হচ্ছে তা অসৎ হতে পারে না [সাংখ্য০ ৫।৫২] কারণ কার্য্য পরিবর্তনশীল ও নশ্বর কিন্তু মূল কারণ নিত্য। মূল কারণ নিত্য না হলে কোন কার্য্যই উৎপন্ন হতে পারে না। উপাদান কারণ (প্রকৃতি) ব্যতীত কোন কার্য্যই হতে পারে না তখন মূল কারণ নিশ্চয় নিত্য ও সত্য হবে।   

ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা
কপিরাইট





No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ