আজকাল কোন বিদ্যার্থী বিদ্যাধ্যয়নের জন্য বিদ্যালয়ে হেড মাস্টারের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাহাকে ভর্তি করিবার সময় বিদ্যার্থীর নাম জিজ্ঞাসা করিয়া সেই নাম রেজিস্ট্রার করিতে বহিতে লিপিবদ্ধ করেন। নামটি রেজিস্ট্রার বহিতে লিপিবদ্ধ হইলে বালকেন ভর্তি হওয়া কার্য সম্পূর্ণ হয়। প্রাচীনকালের গুরুকুলে আচার্য সমীপে কোন বিদ্যার্থী উপস্থিত হইলে আচার্যদেব তাহাকে সর্ব প্রথমে সযত্নে বিধিপূর্বক বিদ্যাচিহ্ন পৈতা(১) ধারণ করাইয়া ভর্তি করিতেন। তৎকালে ভর্তি হইবার পদ্ধতি কিরূপ ছিল, তাহা উল্লেখ করা যাইতেছে-
এইরূপে আচার্যদেব ব্রহ্মচারীর নাম স্বীয় মানসপটে অঙ্কিত (৩) করিয়া মৃত্যুকাল পর্যন্ত স্মরণ রাখিতেন। তৎসঙ্গে বালকও গুরুদেবের নাম জিজ্ঞাসা করিয়া মনে মনে স্মরণ রাখিত। এইরূপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া উভয়ে পরস্পরের নিকট চিরস্মরণীয় থাকিতেন। এখনকার ন্যায় তখন কাগজের রেজিস্ট্রার বহি ছিল না। মনরূপী রেজিস্ট্রার বহিতে নাম লিপিবদ্ধ থাকিত। তখনকার যুগে একমাত্র যজ্ঞসূত্রই ছিল গুরুকুলের প্রবেশপত্র যাহাকে চলতি ভাষায় পৈতা বলে।
এখন যেমন বলা হয় বালক স্কুলে ভর্তি হইয়াছে, তখন বলা হইতো বালকের উপনয়ন হইয়াছে অর্থাৎ বালক আচার্য সমীপে গিয়াছে। এখন যেমন বিদ্যালয় হইতে দূরে মাতাপিতা বা আত্মীয়স্বজনের গৃহে ছাত্রাবাস নির্ধারিত হয়, তখনকার যুগে ছাত্রাবাস ও বিদ্যালয় একত্র রচিত হইত, যাহার নাম ছিল গুরুকুল। এখন যেমন দিবাভাগে ৫-৬ ঘন্টা বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিবার পর ছাত্রেরা স্ব স্ব গৃহে মাতাপিতার নিকট ফিরিয়া আসে, তখন তাহা হইত না। তৎকালে ব্রহ্মচারীকে গুরুকুলে (ব্রহ্মচর্যাশ্রমে) আচার্যদের স্নেহ ও প্রীতিপূর্ণ তত্ত্বাবধানে নিরন্তর অবস্থান করিয়া নিয়মিত কাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বেদবিদ্যা অধ্যয়ন সমাপনপূর্বক গৃহস্থাশ্রমে প্রত্যাবর্তন করিতে হইত। এখনকার ন্যায় তখন মাতাপিতার নিকট থাকিয়া দূরস্থ গুরুকুলে অধ্যয়ন করিবার প্রথা ছিল না। তৎকালে বালক সংসারের নানাবিধ উদ্বেগ ও অশান্তিজনক কলুষিত দৃশ্য ও ঘটনাবলী (যাত্রা, থিয়েটার, বায়স্কোপ, ব্যাধি ও বৈষয়িক বিবাদ-বিসংবাদ প্রভৃতি) হইতে মুক্ত থাকিয়া নিশ্চিন্ত মনে সানন্দে বিদ্যাভ্যাস করিত। যদি কাহারও নির্দিষ্ট কালের মধ্যে উপনয়ন সংস্কার না হইত, তাহা হইলে তাহাকে মনু মহারাজের আইন অনুসারে সাবিত্রীপতিত, ব্রাত্য ও আর্য-বিগর্হিত (মনুস্মৃতি ২।৩৯) বলিয়া ঘোষণা করা হইত। বিধি অনুসারে প্রায়শ্চিত্ত না করিলে এই শ্রেনীর পতিত, ব্রাত্য ও নিন্দিত ব্যক্তিদিগকে কোন গুরুকুলে প্রবেশ করিতে দেওয়া হইত না। উপরন্তু সমাজে ইহাদের সহিত বৈবাহিক আদানপ্রদানও বন্ধ করা হইত। বিধিপূর্বক দীক্ষিত হইয়া বাধ্যতামূলক বিদ্যাভ্যাস না করিলে ইহারা কোন মতে এইরূপ দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইত না। বর্তমান সময়ে এতদ্দেশে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ হিন্দুগণ অধিকাংশই পতিত, ব্রাত্য ও নিন্দিত অবস্থায় জীবন যাপন করিতেছে। শাস্ত্রানুসারে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া প্রত্যেকেরই এই অবস্থা থেকে মুক্ত হইয়া যজ্ঞোপবীত ধারণপূর্বক দীক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য। এখন যেমন ইউরোপে Boarding School এ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হইয়াছে, প্রাচীন ভারতে তদ্রুপ গ্রামের বাহিরে দূরে দূরে গুরুকুল প্রতিষ্ঠা করিয়া বিদ্যাদানের ব্যবস্থা করা হইত। তৎকালে আর্য ঋষিগণের ব্যবস্থায় একমাত্র যজ্ঞোপবীত সংস্কার দ্বারা গুরুকুলে প্রবেশ করিবার নিয়ম ছিল। "প্রবেশপত্রের নাম ছিল "উপনয়ন। বেদাধ্যয়নের জন্য গুরুর (উপ) সমীপে (নী) নীত হওয়া যায় যে কর্ম দ্বারা তাহাই উপনয়ন সংস্কার- যাহাকে চলতি ভাষায় পৈতা লওয়া বলে॥
পৈতা ও পুরোহিত
বেদচর্চা হতে বঞ্চিত হওয়ায় একদিকে দেশ যেমন পরাধীন হইয়াছে, অপরদিকে তেমনই বামমার্গী গুরু পুরোহিতগণের হস্তে রীতি, নীতি, নিয়ম ও আচারাদির ব্যবস্থা ন্যস্ত থাকায় সমাজ ও ধর্মজীবনে যৎপরোনাস্তি অধোগতি ঘটিয়াছে। সামাজিক, ধর্মসম্বন্ধীয় ও রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা হইতে মুক্তিলাভ করিতে হইলে পুনরায় বেদের দিকে ফিরিয়া চলিতে হইবে। একমাত্র বেদেই সর্বজনীন মুক্তির মন্ত্র ঘোষণা করে-
ঈশ্বরের আদেশ
সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জাতনাম্।
দেবাভাগং যথাপূর্বে সংজানানা উপাসতে।।
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহচিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভি মন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি।।
সমানীব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ। সমানমন্ত্র বো মনো যথা বঃ সু সহাসতি।।
ঋগ্বেদ ১০। ১৯১।১-৩
এই মন্ত্রে পরমেশ্বর আজ্ঞা করিতেছেন- "হে মনুষ্য! তোমরা সকলে একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলিয়া আলোচনা কর, তোমাদের সকলের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হউক, পূর্বকালীন জ্ঞানী পুরুষেরা যেরূপ কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করিয়াছেন, তোমরাও তদ্রুপ কর। তোমাদের সকলের মত এক হউক, মিলনভূমি এক হউক, মন এক হউক, সকলের চিত্ত সম্মিলিত হউক, তোমাদের সকলকে একই মন্ত্রে সংযুক্ত করিয়াছি, তোমাদের সকলের জন্য অন্ন ও উপভোগ একই প্রকারে দিয়াছি। তোমাদের সকলের লক্ষ্য সমান হউক, তোমাদের হৃদয় সমান হউক, তোমাদের মন সমান হউক। এইভাবে তোমাদের সকলের শক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। ঈশ্বরের এই বাণী কোন দেশ, প্রদেশ বা মহাদেশের জন্য নহে। পৃথিবীর সমগ্র মনুষ্যজাতির জন্য এই উপদেশ বাণী বিতরিত হইয়াছে।
বেদের ভিত্তিতে সামাজিক, ধর্মসম্বন্ধীয় ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনশক্তির প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে আমাদের সকলের দীক্ষামন্ত্র এবং দীক্ষামূত্র একরূপ হওয়া দরকার। আমাদের চিত্ত, আমাদের শিক্ষা, আলোচনা, সভাসমিতি, ভোজনাগার, পানাহার এবং আমাদের লক্ষ্য একরূপ হওয়া দরকার। ইহাই বেদের সার্বভৌমিক মুক্তির একমাত্র পন্থা। বৈদিক ভাষার এই নিয়ম বাণীগুলিকে এক বাক্যে যজ্ঞ বলা হয়। যথাবিধি দীক্ষাসূত্র ধারণপূর্বক একই দীক্ষামন্ত্রে অনুপ্রাণিত হইয়া যাঁহারা বেদের উপরিউক্ত মুক্তিমন্ত্রের অনুসরণে আত্মনিয়োগ করেন, সেই সব যজমানের যজ্ঞ সুসম্পাদিত হওয়ায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অশেষ কল্যাণ সাধিত হয়। যাঁহার নেতৃত্বে এই সব যজমানের যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, অধিকন্তু যজমানদের যাবতীয় যজ্ঞের (শুভ কর্মের) যিনি যাজক (পরিচালক), তিনিই হন তাঁহাদের প্রকৃত পুরোহিত। পুরোহিত বলিতে অগ্রগামী অগ্রণী নেতা বুঝায়। পুরঃ (অগ্রে) শব্দপূর্বক ধা (ধারণ বা স্থাপন করা) ধাতু+ক্ত প্রত্যয় করিলে "পুরোহিত, শব্দ সিদ্ধ হয়। নিরুক্তকার যাস্ক বলেন "পুরোহিতঃ পুরঃ এনং দধাতি, অর্থাৎ যাঁহাকে (পুরঃ) অগ্রভাগে (দধাতি) ধারণ করা হয়, তিনিই হন পুরোহিত। প্রত্যেক যজ্ঞের (সংঘের) অগ্রণীকে (Leader) পুরোহিত বলা হয় এবং প্রত্যেক যজ্ঞে পুরোহিত যজমানের পুরোভাগে অবস্থান করেন। একমাত্র পরম জ্ঞানী, তেজস্বী, বীর অগ্রণী এবং উচ্চাশয় ব্যক্তিকে পৌরহিত্য পদে বরণ করা যাইতে পারে। বেদও তাহাই বলিতেছে-
সংশিতং ম ইদং ব্রহ্ম সংশিতং বীর্যং বলম্। সংশিতং ক্ষত্রমজরমত্ত জিঞ্চর্যেষামস্মি পুরোহিতঃ।। তীক্ষ্ণীয়াংসঃ পরশোরগ্নেস্তীক্ষ্ণতরা উত। ইন্দ্রস্য বজ্রত্তীক্ষ্ণীয়াংসো যেষামস্মি পুরোহিতঃ।।
অথর্ববেদ ৩। ১৯। ১,৪ অর্থাৎ (মে ইদং ব্রহ্ম) আমার এই জ্ঞান (সংশিতম্) অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হউক, (বীর্যম্ বলম্ সংশিতম্) বল ও বীর্য প্রভাবশালী হউক। আমি (যেষাম্) যাহাদের (জিষ্ণুঃ) বিজয়শীল (পুরঃ হিতঃ) অগ্রণী বা অগ্রভাগে স্থিত নেতা (অস্মি) হইয়াছি, তাহাদের (সংশিতং ক্ষত্রম্) তীক্ষ্ণ ক্ষাত্রতেজ (অজরং অন্তু) অজর হউক। আমি (যেষাম্) যাহাদের (পুরঃ হিতঃ অস্মি) পুরোভাগস্থিত নেতা বা অগ্রণী হইয়াছি, তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র (পরশোঃ) কুঠার হইতে (তীক্ষ্ণীয়াংসঃ) অধিক তীক্ষ্ণ, (অগ্নেঃ তীক্ষ্ণতরা) অগ্নি হইতে অধিক তীক্ষ্ণ (উত) এবং (ইন্দ্রস্য বজ্রাৎ) ঐশ্বর্যময় পরমাত্মার বিদ্যুৎ হইতেও (তীক্ষ্ণীয়াংসঃ) অধিক তীক্ষ্ণ হউক।
মন্ত্রদ্বয়ের ভাবার্থ এই যে- ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠান দ্বারা বেদবিদ্যা লাভ করিয়া স্বীয় বলবীর্যের বৃদ্ধিসাধন করা এবং তদনুরূপ যজমানদেনও বল, বীর্য এবং ক্ষাত্রতেজকে ক্রমাগত প্রচণ্ড করিয়া তোলাই পুরোহিতগণের প্রধান কর্তব্য। এইরূপে বেদের নিগূঢ় তত্ত্বগুলিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করিয়া এবং স্বীয় জীবনকে তদনুকূল মার্গে পরিচালিত করিয়া যিনি বেদের প্রচারে আত্মোৎসর্গ করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ পদবাচ্য হন এবং সেই ব্রাহ্মণই হন চারিবর্ণের পুরোহিত।
আঙু পূর্বক "চর গতিভক্ষণয়ো, এই ধাতু হইতে আচার্য শব্দ সিদ্ধ হয়। যিনি অপরকে সত্য আচার গ্রহণ করান এবং সর্বপ্রকার বিদ্যা প্রাপ্তির হেতু হইয়া সকল বিদ্যা লাভ করান, তিনিই হন আচার্য(১)। "গৃ শব্দে, এই ধাতু হইতে গুরু শব্দ সিদ্ধ হইয়াছে। যিনি সত্যধর্মের প্রতিপাদক এবং সকল বিদ্যাযুক্ত বেদের উপদেশক, তিনিই হন গুরু(২) বেদের ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি এই ত্রিবিধ তত্ত্বকে নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করিবার জন্য উপরিউক্ত লক্ষণযুক্ত আচার্য বা গুরুপুরোহিতের নিকট উপনীত (দীক্ষিত) হইয়া পূর্বোক্ত নিত্য নৈমিত্তিক যজ্ঞের (৪) অনুষ্ঠান করাই বিধেয়। এইরূপে যজ্ঞসূত্র যদি স্কন্ধে ধৃত না হইল, যদি বৈদিক যজ্ঞে অধিকার লাভ না হইল, তাহা হইলে বেদের মতে দীক্ষায় হইল না। দীক্ষাসূত্র ধারণ না করিয়া দীক্ষা গ্রহণের কোন বিধিই যখন বেদে নাই, তখন উপনয়নবিহীন ব্রাহ্মণেতর জাতির হিন্দুরা নিজদিগকে গুরুপুরোহিতগণের শিষ্য বা যজমান বলিয়া পরিচয় দেন কিরূপে? ইহা কি আত্মপ্রতারণা নহে। বেদ বিরুদ্ধ শৈব, শাক্ত, সৌর, জৈন, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও গাণপত্যাদি সাম্প্রদায়িক মতবাদীরাই এই বিধি প্রচলন করিয়াছে। আমরা আর্যাবর্ত দেশের অধিবাসী আর্য এবং আমাদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ। সুতরাং বেদ বিধি অনুসারে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া বৈদিক আচার, রীতি, নীতি ও পদ্ধতির অনুসরণে জীবনযাপন করাই ধর্ম এবং যে সকল বেদ বিরুদ্ধ পৌরাণিক বিধি- ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তৎসমুদয় পরিত্যাগ করাই কর্তব্য। সাম্প্রদায়িক মত মতান্তর একদিকে যেমন ধর্মজীবনকে বিকৃত করিয়া তোলে, অন্যদিকে তেমনই সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধ্বংস আনয়ন করে। ফলে মনুষ্য সমাজ পশু সমাজে পরিণত হয়। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি ইহারই একমাত্র পরিচয়। ইহার প্রতিকার করিতে হইলে পরস্পরের ভেদবৈষম্য ভুলিয়া সাম্প্রদায়িক মতবাদগুলিকে বৈদিক সিদ্ধান্তের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া বৈদিক সাম্যবাদের মন্ত্র বিশ্বের সমগ্র মানবজাতিকে শুনাইতে হইবে। বেদ শুধু হিন্দুর নহে, ইহাতে সর্বদেশের সর্বজাতির সমান অধিকার ঘোষিত হইয়াছে। বেদ বলিতেছেঃ
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ। ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায়।। প্রিয়ো দেবনাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভূয়াসময়ম্। মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।
যজুর্বেদ ২৬।২ এই মন্ত্রে পরমেশ্বর সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতি উপদেশ দিতেছেন- "ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র, স্বীয় স্ত্রী, ভৃত্যাদি, এমনকি অতিশুদ্র প্রভৃতি সকল মনুষ্যকেই যেমন আমি এই কল্যাণকারিণী বেদবাণীর উপদেশ দান করিয়াছি, তোমরাও সেইরূপ কর। যেমন আমি বেদবাণীর উপদেশ দান করিয়া বিদ্বানগণের প্রিয় হইয়াছি, তোমারাও সেইরূপ হও। দানের জন্য আমি এই সংসারের দানশীল পুরুষদের নিকট যেমন প্রিয় হইয়াছি, তোমরাও সেইরূপ হও। আমার ইচ্ছা বেদবিদ্যার প্রচার বৃদ্ধি হউক। আমার মধ্যে যেমন সর্ববিদ্যাহেতু সুখ রহিয়াছে, তোমরাও সেইরূপ বিদ্যার গ্রহণ ও প্রচার দ্বারা মোক্ষসুখ লাভ কর। এইরূপ সাম্যবাদের ভিত্তিতে সমাজ সংগঠন, রাষ্ট্রসংগঠন ও ধর্মজীবনের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে এবং আমাদের সকলকে একই বেদমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া একই দেবতার উপাসনায় আত্মত্মনিয়োগ করিতে হইবে, যাহাতে আমরা দূর্জয় এবং সংঘশক্তি লাভ করিতে পারি। কেবল কতিপয় গুরু ও পুরোহিত ব্রাহ্মণদের যজ্ঞোপবীত থাকিবে, অবশিষ্ট সকলে শুদ্রবৎ জীবনযাপন করিয়া নামেমাত্র যজমান আখ্যা বহন করিবে, তাহার নহে। শুদ্রত্ব পরিহারপূর্বক কার্যতঃ যজ্ঞোপবীত ধারণ করিয়া এবং বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া প্রকৃত যজমান আখ্যা লাভ করিতে হইবে।
সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিরাট যজ্ঞস্বরূপ এবং এই যজ্ঞের আদিপুরোহিত পরমেশ্বর এবং মানবজাতি তাহার যজমান। এই বিধান বেদের প্রথম মন্ত্রেই দৃষ্ট হয়। যথা-
সৃষ্টির আদি পুরোহিত তথা আদি গুরু
অগ্নিমীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্। হোতারং রত্নধাতমম্।। ঋগ্বেদ ১।১।১
অর্থাৎ "বিশ্বব্রহ্মাণ্ডরূপ যজ্ঞের প্রকাশক, ঋত্বিক, হোতা ও পুরোহিত হইতেছেন সেই সর্বরত্নাধার জ্ঞানস্বরূপ পরমেশ্বর, আমরা একমাত্র তাঁহারই স্তুতি করি। তাঁহারই প্রকাশিত বেদ অনন্ত জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনাযজ্ঞের আধারস্বরূপ। সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর আদিগুরুরূপে ঋত্বিকদিগকে বেদবিদ্যা প্রদানপূর্বক মুক্তিসুখ প্রদর্শন করিয়া সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সেই বিদ্যা প্রচারের উপদেশ দিয়াছিলেন। ঋষিগণের নিকট হইতে সেই বিদ্যা মনুষ্যজাতির বংশ পরম্পরায় চলিয়া আসিতেছে। বেদজ্ঞ পুরুষেরাই সর্বসাধারণের মধ্যে সেই বিদ্যার প্রচার করিয়া থাকেন। এ বিষয়ে ঋষি পতঞ্জলি বলিয়াছেন-
স এষ পূর্বেষামপি গুরু কালেনানবচ্ছেদাৎ।। যোগদর্শন ১।২৬
অর্থাৎ সেই পরমেশ্বর আমাদের পূর্বজ ঋষিগণেরও গুরু, যিনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান- এই ত্রিকাল কর্তৃক অবচ্ছেদিত হন নাই। সেই গুরু প্রদত্ত বিদ্যা পুনঃ প্রচারিত হইলে মানব জাতির কল্যাণ হইবে। যাঁহারা বেদবিদ্যাহীন হইয়াও গুরু এবং পুরোহিতরূপে সমাজে স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন, তাঁহারাই অবৈদিক বিধিতে দীক্ষা দিয়া এবং স্ব স্ব সম্প্রদায়ের কলেবর বৃদ্ধি করিয়া ভারতবর্ষকে রসাতলে পাঠাইয়াছেন। ইহার পরিণাম আজ ভারতবাসী মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে। এইরূপ দূরাবস্থাকে উপেক্ষা করিয়া আমাদিগকে এই বিরাট যজ্ঞের পুরোহিত সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরমাত্মার উপাসনা করিতে হইবে।
_______________________________________________________________________________
(১) মনুঃ ২।১৪০, নিরুক্ত ১।৪।৭।২০
(২) সত্যার্থ প্রকাশ ১ম সমুল্লাসঃ
(৩) কম্মেদ ১।১৬৪।২০
(৪) মনু ৩।৭০
সেই পরমাত্মা মানব জাতির আদিগুরুরূপে যজ্ঞোপবীত ধারণের বিধান প্রণয়ন করিয়াছেন। বেদই তাঁহার বিধানগ্রন্থ। তাহাতে লিখিত আছে-
গুরুকুলে প্রবেশ
আচার্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিণং কৃণুতে গর্ভমন্তঃ।
তং রাত্রীপ্তিস্র উদরে বিভর্তি তং জাতং দ্রষ্টুমভি সংযন্তি দেবাঃ।।
অথর্ববেদ ১১।৫।৩
অর্থাৎ (১) (উপনয়মানঃ আচার্যঃ) উপনয়নদাতা আচার্য- গুরু (ব্রহ্মচারিণম্) ব্রহ্মচারী- শিষ্যকে (অন্তঃ গর্ভম্ কৃণুতে) নিজের মধ্যে রাখেন। (২) (তম্) সেই ব্রহ্মচারীকে (উদরে) গর্ভে (তিস্রঃ রাত্রীঃ বিভর্তি) তিন রাত্রি পর্যন্ত ধারণ করেন। (৩) যখন সেই ব্রহ্মচারী গর্ভে (জাতম) দ্বিতীয় জন্ম লাভ করিয়া বাহিরে আসে, তখন (তম্) তাহাকে (দ্রষ্টুম্) দেখিবার জন্য (দেবাঃ) বিদ্বানেরা (অভিসংযন্তি) চতুর্দিক হইতে সমবেত হন। মন্ত্রটির প্রথমার্দ্ধে বলা হইয়াছে যে আচার্য ব্রহ্মচারীকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়া নিজের মধ্যে রাখেন। এইরূপ বলিবার তাৎপর্য এই যে শিষ্যকে কেবল স্বীয় পরিবারভুক্ত বা স্বীয় কুলের অন্তর্ভুক্ত করিয়া রাখেন নাই, উপরন্তু তাহাকে আপন হৃদয়ের মধ্যে স্থান দিয়া রাখেন। এস্থলে নিজের মধ্যে বা গর্ভের মধ্যে বলিবার তাৎপর্য এই যে স্বীয় কুলের অন্তর্ভুক্ত বা পরিবারভুক্ত বিদ্যার্থীর নিকট গুরুদেবের কোন কথায় গোপন থাকে না। হৃদয়ের সমস্ত কথা শিষ্যকে স্পষ্টভাবে খুলিয়া বলেন, ছল বা কপটতাদি দ্বারা কোন কিছুই গোপন রাখেন না। যে বিদ্যা স্বয়ং প্রাপ্ত হইয়াছেন, সেই বিদ্যা শিষ্যকে সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করাইয়া থাকেন। এইরূপে গুরু-শিষ্যে সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে। শিষ্যও গুরুদেবের উদরের মধ্যে থাকিয়া তাহাকে কোন প্রকার ক্লেশ দেন না।
এই মন্ত্রের দ্বিতীয় বিষয় এই যে আচার্য ব্রহ্মচারীকে নিজের উদরের মধ্যে (তিস্রঃ রাত্রীঃ) তিন রাত্রি পর্যন্ত ধারণ করিয়া থাকেন। উদরে ধারণ করিবার তাৎপর্য পূর্বে বলা হইয়াছে। এস্থলে "তিন দিন" না বলিয়া তিন রাত্রি বলা হইয়াছে। "রাত্রি" শব্দ "অন্ধকার" বোধক। অন্ধকার বলিতে "অজ্ঞানতা" বুঝায়। এই অজ্ঞানতা দূর করিবার জন্যই গুরুর নিকট তিন রাত্রি বাস করিবার কথা বলা হইয়াছে। প্রথম- আত্মবিষয়ে অজ্ঞানতা, দ্বিতীয়- স্থল-সূক্ষ্ম সৃষ্টি বিষয়ে অজ্ঞানতা এবং তৃতীয়- আত্মার ও অনাত্মার সম্বন্ধ বিষয়ে অজ্ঞানতন, এই তিন প্রকার অজ্ঞানতা নাশ করাই বিদ্যাধ্যয়নের উদ্দেশ্য। ত্রিবিধ অজ্ঞানতা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত শিষ্য গুরু গৃহে বাস করিতে থাকে। গাঢ় অজ্ঞানান্ধকারের রাত্রিতে জীব শয়ন করিয়া থাকে। গুরুর কৃপায় জ্ঞানসূর্য উদয় হইলে প্রবুদ্ধ শিষ্য রাত্রিকাল অতিবাহিত করিয়া স্বচ্ছ সুন্দর উজ্জ্বল প্রকাশ্য দিবালোকে আসিয়া উপস্থিত হয়। গুরুগৃহে তিন রাত্রি বাসের তাৎপর্য কঠোপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে। এস্থলে সংক্ষেপ দু একটি কথা বলিতেছি। যম নচিকেতাকে বলিলেন-তিস্রো রাত্রীর্যদবাৎসীগৃহে মেহনশন্ ব্রহ্মন্ অতিথির্নমস্যঃ. ত্রীন্ বরান্ বৃনীস্ব।। কঠোপনিষদ ১।৯
অর্থাৎ তুমি নমস্য ব্রাহ্মণ অতিথি, আমার গৃহে তিন রাত্রি বাস করিয়াছ। অতএব তিন বর প্রার্থনা কর। নচিকেতা পর পর তিনটি বর প্রার্থনা করায় যম তাহাকে (১) আত্মবিদ্যা, (২) সৃষ্টিবিদ্যা এবং উভয়াত্মক (৩) কর্মবিদ্যা দান করিলেন। এই উপনিষদে যম বিদ্যাদাতা গুরুরূপে এবং নচিকেতা শিষ্যরুপে বর্ণিত হইয়াছে। জ্ঞান বা বিদ্যা যেমন মুক্তির কারণ, অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা তেমনই বন্ধনের কারণ। ত্রিবিধ অজ্ঞানতারূপ বন্ধনের কথা স্মরণ রাখিবার জন্য তিন তার পৈতার বন্ধন শিষ্যের স্কন্ধে ঝুলাইয়া দেওয়া হয় এবং সেই ত্রিবিধ বন্ধন হইতে মুক্তি লাভের জন্য তাহাকে উপরিউক্ত ত্রয়ী বিদ্যা দান করা হয়। গুরুকুলে এইরূপ তিন রাত্রি বাসের জন্য তিন তার পৈতা ধারণের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
এই মন্ত্রের তৃতীয় বিষয় এই যে যখন ব্রহ্মচারী জন্মগ্রহণ করিয়া গুরুর উদর হইতে বাহির হইয়া আসে, তখন তাহাকে দেখিবার জন্য বিদ্বানেরা আসিয়া একত্র সমবেত হন। তৎকালে ত্রয়ী বিদ্যা লাভ করিয়া বিদ্যার্থী স্বতন্ত্রভাবে জগতে বিচরণ করিবার যোগ্য হয়। মন্ত্রের শেষ উচ্চারণে "জাতং” শব্দ রহিয়াছে, যাহার অর্থ জন্মগ্রহণ করা বুঝায়। গুরুরূপী পিতা এবং বিদ্যারূপিণী মাতা হইতে শিষ্যের দ্বিজত্ব লাভ বা দ্বিতীয় জন্ম লাভ হয়। সেইজন্য সূত্রকার ঋষি বলিয়াছেন-
সহি বিদ্যাতস্তং জনয়তি। তজ্জেষ্ঠং জন্ম। শরীরমেব মাতাপিতরৌ জনয়তঃ।। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১।১।১৫-১৭
অর্থাৎ সেই আচার্য ব্রহ্মচারীকে বিদ্যা হইতে উৎপন্ন করেন। ইহাই শ্রেষ্ঠ জন্ম। মাতাপিতা কেবল শরীরকেই উৎপন্ন করিয়া থাকেন। এইরূপে আচার্য দ্বারা ব্রহ্মচারীর দ্বিজত্ব লাভ হয়। এবিষয়ে মহর্ষি মনু স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন-
দ্বিজত্বই মুক্তির দ্বারস্বরূপ
কামান্মাতা পিতা চৈনং যদুৎপাদয়তো মিথঃ।
সস্কৃতিং তস্য তাং বিদ্যাদ্যদ্যোনাবভিজায়তে।।
আচার্যন্তস্য যাং জাতিং বিধিবদ্বেদপারগঃ।
উৎপাদয়তি সাবিত্র্যা সা সত্যা সাজরামরা।।
মনুস্মৃতি ২।১৪৭-১৪৮
অর্থাৎ মাতাপিতা পরস্পর কামপরবশ হইয়া বালকের যে জন্ম দান করেন- মাতৃকুক্ষি হইতে জন্ম লাভ হয়, তাহার সেই জন্মমাত্রকেই জানিবে অর্থাৎ এইরূপ জন্মকে মনুষ্যের সাধারণ জন্মমাত্র বলিয়া বুঝিতে হইবে। পরন্তু বেদজ্ঞ আচার্য যথাবিধি সাবিত্রী দ্বারা এই বালকের যে জন্ম দান করেন, সেই জন্মই সত্য- সেই জন্মই অজর অমর। ইহার তাৎপর্য এই যে মাতাপিতার সংযোগে যে জন্ম লাভ হয়, তাহা অনিত্য। কারণ, তাঁহাদের প্রদত্ত শরীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। পরন্তু গায়ত্রী মাতা ও আচার্য পিতা পিতা হইতে বালকের যে দ্বিতীয় জন্ম (দ্বিজত্ব) লাভ হয়, তাহা ইহলৌকিক অভ্যুদয় ও পারলৌকিক মুক্তির কারণ হইয়া থাকে। গুরুকুল হইতে দ্বিজত্ব লাভ করিয়া স্নাতক যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে, তখন তাহাকে দেখিবার জন্য চতুর্দিক হইতে বিদ্বানেরা আসিতে থাকেন। এই মন্ত্র অবলম্বনে মহর্ষি মনু দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৬৯-১৭১ শ্লোকে যাহা বলিতেছেন, তাহা অতীব সরল ও সুস্পষ্ট। যথাস্থানে তদ্বিষয়ের আলোচনা করা যাইবে।
তিন তার সুতার পৈতা স সূর্যস্য রশ্মিভিঃ পরিব্যত তন্ত্রং তন্বানন্ত্রিবৃতং যথাবিদে।
নয়মৃতস্য প্রশিষো নবীয়সীঃ পতির্জনীনামুপ যাতি নিষ্কৃতম্।।
ঋগ্বেদ ৯।৮৬। ৩২
এই মন্ত্রে সেই যজ্ঞোপবীতধারী ব্রহ্মচারীর বর্ণনা রয়িয়াছে, যিনি গুরুকুল হইতে বাহির হইয়া বেদবিদ্যা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন- (স) সেই ব্রহ্মচারীকে (যথাবিদে) জ্ঞানপূর্বক (ত্রবৃতং তন্ত্রং তন্বানঃ) তিন তার সুতার পৈতা ধারণ করিয়া (সূর্যস্য রশ্মিভি পরিব্যত) যেন সূর্যকিরণে উদ্ভাসিত হন। (ঋতস্য প্রশিষঃ নবীয়সীঃ নয়ন) ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়মের প্রসংশাময়ী নূতন নূতন বাণী প্রচার করিয়া (জনীনাম্ পতিঃ) জনসমূহের নেতা (নিষ্কৃতং উপযাতি) স্বাধীনভাবে বিতরণ করেন। এই মন্ত্রে স্পষ্টই বর্ণিত হইয়াছে যে ব্রহ্মতেজধারী স্নাতক (Graduate) ত্রিবেষ্টন সূত্রের পৈতা ধারণ করেন। ত্রি (তিন) শব্দপূর্বক বৃ (আবৃত করা) ধাতু+কিপ্ প্রত্যয় করিলে ত্রিবৃৎ শব্দ সিদ্ধ হয়, যাহার অর্থ তিনগাছা বুঝায় এবং তন্তু অর্থে সুতা বুঝায়।
পৈতা যজ্ঞের অলংকারস্বরূপ
যো যজ্ঞস্য প্রসাধনস্তন্তুর্দে বেষাততঃ।
তমাহুতং নশীমহি।। ঋগ্বেদ ১০।৫৭।২
এই মন্ত্রে যজ্ঞোপবীতের মহিমা বর্ণিত হইয়াছে- (যঃ) যে (যজ্ঞস্য) যজ্ঞের (প্রসাধনঃ) অলঙ্করণ (তন্ত্রঃ) সূত্র (দেবেষু) বিদ্বানদের মধ্যে (আততঃ) প্রচলিত আছে (তম) সেই (আহুতম্) পূজিত সূত্রকে (নশীমহি) আমরা প্রাপ্ত হই।
ইহার তাৎপর্য এই যে যজ্ঞোপবীত বিদ্বানদের নিকট অতীব প্রযোজনীয় ও আদরণীয় বস্তু। ইহা ব্যতিরেকে যজ্ঞকার্য সম্পূর্ণ হয় না। এই জন্য তখনও পৌরাণিক শ্রাদ্ধাদিকালে পৈতাস্বরূপ কোন প্রকার উত্তরীয় ধারণ না করাইয়া মন্ত্রোচ্চারণই করান হয় না। কারণ, ইহা যজ্ঞের প্রসাধন অর্থাৎ সম্পাদন, আভরণ, ভূষণ বা অলঙ্কার।
যজ্ঞসূত্রধারী স্নাতক
যুবা সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎ স উ শ্রেয়ান্ ভবতি জায়মানঃ।
তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো মনসা দেবয়ন্তঃ।। ঋগ্বেদ ৩।৮।৪
অর্থাৎ (সুবাসাঃ) সুবন্ত্রশোভিত (পরিবীতঃ) যজ্ঞোপবীত পরিহিত (যুবা) নবযুবক ব্রহ্মচারী (আগাৎ) গৃহস্থাশ্রমে প্রত্যাবর্তন করেন। (স উ) তিনিই (জায়মানঃ) দ্বিতীয় জন্ম লাভ করিয়া (শেয়ান) সংসারের হিতসাধক (ভবতি) হইয়া থাকেন। (স্বাধ্যাঃ) উত্তম ধ্যানশীল (মনসা) মনন শক্তি দ্বারা (দেবয়ন্তঃ) বিদ্যাবৃদ্ধির প্রকাশক (ধীরাসঃ) ধৈর্যশালী (কবয়ঃ) বিদ্বানেরা (তম) সেই ব্রহ্মচারী যুবাকে (উন্নয়ন্তি) উন্নীত করিয়া থাকেন।
প্রাগুক্ত মন্ত্রদ্বয়ে বিদ্বান ব্রহ্মচারীকে যেরূপ সূত্রধারী বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে, সেইরূপ এই মন্ত্রে তাহাকে পরিবীত অর্থাৎ সূত্রবেষ্টিত বলা হইয়াছে। পরি- চারিদিকে+বীত- বেষ্টিত। উপবীত ও পরিবীত এক পর্যায়বাচী শব্দ।
উপবীতীর ঈশ্বরানুগ্রহ লাভ
তস্মাৎ প্রাচীনোপবীতস্তিষ্ঠে প্রজাপতেনু মা বুধ্যস্বেতি।
তন্বেনং প্রজা অনু প্রজাপতিবূধ্যতে য এবং বেদ।।
অথর্ববেদ ৯।১।২৪
অর্থাৎ (তস্মাৎ) এইজন্য (প্রাচীন উপবীতঃ) সম্মুখে যজ্ঞোপবীত ধারণ করিয়া (তিষ্ঠে) দাঁড়াইবে এবং প্রার্থনা করিবে যে (প্রজাপতে) হে ঈশ্বর! (মা) আমার প্রতি (অনুবুধ্যস্ব) কৃপা করুন। (এনং) এরূপ পুরুষের প্রতি (প্রজা) মনুষ্য ও (প্রজাপতিঃ) ঈশ্বর (অনুবুধ্যতে) কৃপা করেন (য এবং বেদ) যিনি এই রহস্যকে জানেন।
মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে যিনি বিধিপূর্বক উপবীত ধারণ করিয়া ব্রহ্মচর্যপূর্বক বিদ্যালাভ করেন এবং ঈশ্বরোপাসনাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, ঈশ্বর ও মনুষ্য সকলেই তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হন।
সৌত্রামণী যজ্ঞ এতাবদ্ রূপং যজ্ঞস্য যদ্ দেবৈব্রহ্মহ্মণা কৃতম্।
তদেতৎ সর্বমাপ্নোতি যজ্ঞে সৌত্রমণী সূতে।। যজুর্বেদ ১৯। ৩১
অর্থাৎ (যৎ দেবেঃ) যে সকল বিদ্বান এবং (ব্রহ্মণা) পরমেশ্বর কর্তৃক (যজ্ঞস্য) যজ্ঞের (এতাবৎ রূপম্) এত রূপ (কৃতম্) প্রকাশিত হয়, (তৎ এতৎ সর্বম) তিনি এই সমস্তকে (সুতে) অনুষ্ঠিত (সৌত্রামণী যজ্ঞে) গ্রন্থিযুক্ত সূত্রধারণ যজ্ঞে (আপ্নোতি) প্রাপ্ত হয়, যদ্বারা তাহার দ্বিজত্ব সূচিত হয়। মহর্ষি দয়ানন্দ স্বীয় ভাষ্যে "সৌত্রমণী" শব্দের অর্থ এইরূপ লিখিয়াছেন- "সূত্রানি যজ্ঞোপবীতাদীনি মণিনা গ্রন্থিনা যুক্তানি প্রিয়ন্তে যস্মিংস্তস্মিন্ অর্থাৎ যজ্ঞোপবীতাদি সূত্রের গ্রন্থি প্রস্তুত করিয়া যাহাতে পরিধান করা হয়, সেই যজ্ঞ। তিনি এই মন্ত্রের অন্বয় করিতে গিয়া লিখিয়াছেন- "যো মনুষ্য যদ্ দেবেব্রক্ষণা যজ্ঞস্যেতাবদ্ রূপং কৃতং তদেতৎ সর্বং সৌত্রামণী সূতে যজ্ঞে আপ্নোতি স দ্বিজত্বারম্ভং করোতি, অর্থাৎ সৌত্রামণী যজ্ঞে মনুষ্য দ্বিজত্ব লাভ করে। ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সৌত্রামণী যজ্ঞ "উপনয়ন সংস্কারকেই, বলে। বৈদিক শব্দ মালায় সূত্র শব্দ যজ্ঞোপবীতেরই বাচক। "শিখাসূত্র, শব্দেই ইহা প্রকটিত হয়।
উপরিউক্ত বেদ বিধি হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে পৈতা কেবল কোন জাতি, সমাজ বা সম্প্রদায় বিশেষের জন্য নহে। ইহা সমগ্র মানবজাতির জন্য নিরূপিত হইয়াছে।
পৈতার কালাকাল নিরূপণ
পূর্বাধ্যায়ে যে মন্ত্র (অথর্ব ৯।১।২৪) উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে "প্রাচীনোপবীত, শব্দ আসিয়াছে। শতপথ ব্রাহ্মণে (২। ৬।১) প্রাচীনোপবীতী ও যজ্ঞোপবীতী শব্দ অনেকবার আসিয়াছে। কোন কোন কর্মে যজ্ঞোপবীত সম্মুখে রাখিবার বিধান আছে। এইরূপ সম্মুখে যিনি যজ্ঞোপবীত ধারণ করিতেন, তাহাকে প্রাচীনোপবীতী বলা হইত। গোপথ ব্রাহ্মণে গায়ত্রী মন্ত্রের দ্বিতীয় পাদের ব্যাখ্যয় ব্রতের মহিমা এইভাবে বর্ণিত হইয়াছে-
অখণ্ড যজ্ঞোপবীত
ব্রতেণ বৈ ব্রাহ্মণঃ সংশিতো ভবতি অশূন্যো ভবতি অবিচ্ছিন্নো ভবতি। অবিচ্ছিন্যোহস্য তন্ত্রঃ। অবিচ্ছিন্নং জীবনং ভবতি।। গোপথ পূর্ব ১।৩৫
অর্থাৎ ব্রত দ্বারাই বেদজ্ঞ বিদ্বান নিষ্ঠাবান হন, অখণ্ড হন। তাঁহার যজ্ঞোপবীত খণ্ডিত হয় না। তাঁহার জীবন খণ্ডিত হয় না। এখানে বলা হইয়াছে- বিদ্বান ব্রত পালন করেন, তাঁহার তন্তু অর্থাৎ যজ্ঞসূত্র খণ্ডিত হয় না। তাঁহার জীবনকে পরিপূর্ণ বলিয়া জানিবে। ব্রতপালনের জন্যই বিদ্বানেরা যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন- এই কথাই বলা হইয়াছে। ইহাতে আরও বলা হইয়াছে- "উপনয়েতৈনম্, (গোপথ পূর্ব ২।৪) অর্থাৎ আচার্য ব্রহ্মচারীর উপনয়ন সংস্কার করিবে। মনুস্মৃতিতেও ২। ১৪০ এই ভাবই বলা হইয়াছে।
এমন কোন বিদ্বান নাই যিনি গৃহ্যসূত্রের বিধানকে অস্বীকার করিতে পারেন। কারণ, বিদ্বানেরা গৃহ্যসূত্রের বিধান অনুযায়ী উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা দিয়া থাকেন। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে লিখিত আছে-
উপনয়ন কাল
অষ্টমে বর্ষে ব্রাহ্মণমুপনয়েৎ। গর্ভাষ্টমে বা। একাদশে ক্ষত্রিয়ম্। দ্বাদশে বৈশ্যম্।।
আশ্বঃ গৃহ্যসূত্র ১।১৯।১-৪
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বালকের উপয়ন সংস্কার জন্ম হইতে অষ্টম বর্ষে বা গর্ভাষ্টম বর্ষে করিবে। ক্ষত্রিয় বালকের জন্ম বা গর্ভ হইতে একাদশ ও বৈশ্য বালকের জন্ম বা গর্ভ হইতে দ্বাদশ বর্ষে করিবে। পারস্করাদি গৃহ্যসূত্রেও এইরূপ প্রমাণ লিখিত আছে। গোভিলীয় গৃহ্যসূত্র বিস্তারপূর্বক বলিতেছে-
দক্ষিণং বাহুমুষ্কৃত্য শিরোৎবধায় সবোৎসবে প্রতিষ্ঠাপয়তি।
দক্ষিণং কক্ষমন্বলম্ব্য ভবত্যেবং যজ্ঞোপবীতী ভবতি।। গোভিল গৃহ্যসূত্রঃ প্রপা ১।২।২
অর্থাৎ দক্ষিণ বাহু উদ্ধৃত করিয়া মস্তকের উপর হইতে বাম স্কন্দে দক্ষিণ কক্ষের সহিত যজ্ঞোপবীত দিতে হয়। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে লিখিত আছে-
উপনয়নং বিদ্যার্থস্য শ্রুতিতঃ সংস্কারঃ। প্রপাঃ ১।।
অর্থাৎ বেদবিধি অনুসারে বিদ্যার্থীর উপনয়ন সংস্কার হইয়া থাকে। এখানে "শ্রুতিতঃ, শব্দ হইতে জানা যায় যে আপস্তম্ব ঋষি বেদবিধি অনুসারে উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা দিয়াছেন। এক্ষণে এই সব প্রমাণ হইতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে বেদে, ব্রাহ্মণ গ্রন্থে, গৃহ্যসূত্রে এবং ধর্মসূত্রে জ্ঞানী, বিদ্বান ও বিদ্যার্থী মাত্রেরই যজ্ঞোপবীত ধারণের বিধি নিরূপিত হইয়াছে। কারণ, যজ্ঞোপবীত ব্যতিরেকে যজমানের যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয় না। বৈদিক স্মৃতিশাস্ত্রেও অনুরূপ বিধি উক্ত হইয়াছে-
গর্ভাষ্টমেহব্দে কুর্বীত ব্রাহ্মণস্যোপনায়নম্।
গর্ভাদেকাদশে রাজ্ঞো গর্ভাত্তু দ্বাদশে বিশঃ।। মনুস্মৃতি ২।৩৬
অর্থাৎ বাহ্মণপুত্রের গর্ভাষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়পুত্রের গর্ভ একাদশ এবং বৈশ্যপুত্রের গর্ভদ্বাদশ বর্ষে উপনয়ন সংস্কার করিবে। সাধারণতঃ ইহাই হইল দ্বিজ বালকের উপনয়নের মূখ্যকাল।
বর্তমান সময়ে স্কুলে কোন বালক বেশ মেধাবী এবং অতিশয় বুদ্ধিমান বলিয়া প্রতিপন্ন হইলে মাষ্টার মহাশয় যেমন তাহার যোগ্যতানুসারে ডবল প্রমোশন দিয়া থাকেন, প্রাচীনকালেও তেমনই বালক অত্যন্ত মেধাবী, বলশালী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং শীঘ্র বেদাধ্যয়নে সমর্থ হইলে তাহার আরও শীঘ্র শীঘ্র উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা হইত। ঋষি এইরূপ বালকের কালক্ষয় না করিয়া সেই ব্যবস্থাই দান করিয়াছেন-
ডবল প্রমোশন
ব্রহ্মবচস্ কামস্য কার্যং বিপ্রস্য পঞ্চমে।
রাজ্ঞোবলার্থিনঃ ষষ্ঠে বৈশ্যস্যহার্থিনোহষ্টমে।। মনুস্মৃতি ২।৩৭
অর্থাৎ ব্রহ্মতেজকামী ব্রাহ্মণ গর্ভ পঞ্চম বর্ষে, বলকামী ক্ষত্রিয় গর্ভ ষষ্ঠ বর্ষে এবং ধনকামী বৈশ্য গর্ভাষ্টম বর্ষে স্ব স্ব পুত্রের যজ্ঞোপবীত সংস্কার করাইবে।
কত বৎসর পর্যন্ত বালকের উপনয়ন সংস্কার হইতে পারে, তাহারও বিধান তাহারা গৃহ্যসূত্রাদি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। যদি কেহ শাস্ত্রবিহিত কালের মধ্যে যজ্ঞোপবীত ধারণ না করে অর্থাৎ বেদবিধি অমান্য করিয়া গুরুকুলে অধ্যয়ন করিতে না যায়, তাহা হইলে তজ্জনিত অপরাধের জন্য শাস্ত্রকার তাহাকে পাতিত্যদোষে দুষ্ট বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন-
উপনয়নের উর্দ্ধকাল, অন্যথায় পাতিত্যদোষ আষোড়শ্রাদ্বাক্ষণস্যানতীতঃ কালঃ। আদ্বাবিংশাৎ ক্ষত্রিয়স্য, আচতুর্বিংশাদ্বৈশ্যস্য, অত উর্দ্ধং পতিতসাবিত্রীকা ভবস্তি।।
আশ্বঃ গৃহ্যসূত্র ১। ১৯।৫-৬
অর্থাৎ ব্রাহ্মণের ১৬ বৎসর বয়ঃক্রম পর্যন্ত, ক্ষত্রিয়ের ২২ বৎসর পর্যন্ত এবং বৈশ্যের ২৪ বৎসর পর্যন্ত উপনয়ন কাল অতীত হয় না। ইহাই হইল উপনয়নের গৌণকাল। এই বিহিত কালের মধ্যে উপনয়ন না হইলে দ্বিজপুত্রেরা সাবিত্রীপতিত অর্থাৎ বেদের গায়ত্রী মন্ত্র হইতে ভ্রষ্ট বা বন্ধযজ্ঞাদি কর্ম হইতে রহিত হওয়ায় সমাজে দূষিত, অপবিত্র এবং ধর্মহীন অনার্য পুরুষ বলিয়া পরিগণিত হয়। এবিষয়ে মহর্ষি মনুর উক্তি আরও সুস্পষ্ট। তিনি বলিয়াছেন-
আষোড়শাদ্বাহ্মণস্য সাবিত্রী নাতিবর্ততে।
আদ্বাবিংশাৎ ক্ষত্রবন্ধোয়া চতুর্বিংশতে বিশঃ।।
অত উর্দ্ধং ত্রয়োহপ্যেতে যথাকালমসংস্কৃতাঃ।
সাবিত্রীপতিতা ব্রাত্যা ভবস্ত্যার্যবিগর্হিতা।। মনুস্মৃতি ২।৩৮-৩৯
অর্থাৎ ব্রাহ্মণের গর্ভ ষোড়শ বর্ষ পর্যন্ত, ক্ষত্রিয়ের গর্ভ দ্বাবিংশতি বর্ষ পর্যন্ত এবং বৈশ্যের গর্ভ চতুর্বিংশতি বর্ষ পর্যন্ত উপনয়ন কাল অতিক্রান্ত হয় না। যদি এই তিন বর্ণের পুত্রেরা যথাকালে সংস্কৃত না হয় অর্থাৎ পৈতা ধারণ না করিয়া পবিত্র না হয়, তাহা হইতে নির্দিষ্টকাল উত্তীর্ণ হইলে তাহারা গায়ত্রী মন্ত্রের অধিকার হইতে ভ্রষ্ট, ব্রতহীন ও আর্যনিন্দিত হইয়া থাকে। ইহারা যদি এবম্বিধ অপবিত্র অবস্থা হইতে মুক্ত হইয়া শুদ্ধিলাভ করিতে চায়, তাহা হইলে তজ্জন্যও শাস্ত্রকার ব্যবস্থা দিতে কৃপণতা করেন নাই। ঋষির হৃদয় অতীব সরল, সত্যময় ও উদার। তিনি বলিয়াছেন-
পতিতোদ্ধার নৈতৈরপুতৈবিধিবদাপদ্যপি হি কহিচিৎ।
ব্রাহ্মন্যোনাংশ্চ সম্বন্ধানাচরেদ্বাহ্মণঃসহ।। মনুস্মৃতি ২।৪০
অর্থাৎ (ন বিধিবৎ) বিধি অনুসারে প্রায়শ্চিত্ত অর্থাৎ দণ্ডগ্রহণ না করিলে (ব্রাহ্মণঃ) বেদাচার্য (কর্হিচিৎ আপদি অপি হি) আপদকালেও কখনই (এতৈঃ অপূতৈঃ সহ) এই সকল অপবিত্র ব্যক্তিগণের সহিত (ব্রাহ্মান্ চ যৌনান্ সম্বন্ধান) যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপনাদি বৈদিক সম্বন্ধ এবং কন্যাদানাদি যৌন সম্বন্ধ (ন আচরেৎ) রাখিবেন না।
মহর্ষির এইরূপ তাৎপর্য এই যে যাহারা ব্রাত্য, পতিত ও গায়ত্রীভ্রষ্ট হইয়া শূদ্রবৎ জীবনযাপন করিতেছে, তাহারার যদি পুনরায় শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করিয়া আত্মশুদ্ধি লাভে যত্নবান হয়, তাহা হইলে আচার্যগণ তাহাদের যজ্ঞোপবীত সংস্কার করিয়া বৈদিক গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষাদানপূর্বক বেদাধ্যাপনাদি যাজনক্রিয়া করিবেন এবং তাহাদের সহিত পুত্রকন্যার বৈবাহিক আদান-প্রদান করিবেন তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আর্য ঋষিগণ এই বিধি দ্বারা স্বীয় সমাজকে সুশাসনে পরিচালিত করিয়া সমগ্র আর্যাবর্ত নিবাসীদিগকে এরূপ সংঘবদ্ধ রাখিতেন যে তাহাতে অনার্যদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন হইতে প্রত্যেক ব্যক্তি ধর্মগত, সমাজগত ও রাষ্ট্রগত জীবনে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকিতে পারিত। যখন হইতে এই বেদবিধির অবমাননা করিয়া স্ব স্ব কপোলকল্পিত মতের প্রচলন করা হইয়াছে, তখন হইতে সমাজ ও রাষ্ট্র পরাধীন হইতে চলিয়াছে। বেদবিধির পুনঃ প্রচলন হইলে দেশ ও জাতি সর্বাঙ্গীন মুক্তি লাভে সমর্থ হইতে পারে। স্মার্ত রঘুনন্দনের "যুগে জঘন্যে দ্বেজাতি ব্রাহ্মণশূদ্র এব চ. এই কটুক্তি হইতে বুঝা যায় যে বাংলাদেশে আজ যাঁহারা "ব্রাহ্মণজাতি (ব্রাহ্মণ বর্ণ নহে) বলিয়া পরিচয় দেন, তাহারা যত হিন্দু আছে, তাহারা সকলেই একই জাতির অন্তর্ভুক্ত- তাহাদের সকলকে শূদ্র বলা হয়। রঘুনন্দনের এইরূপ নূতন বিধিরচনার মূলে কোন যুক্তি নাই। পূর্বোক্ত মনুবিরচিত শুদ্ধি ব্যবস্থা হইতে শূদ্রত্বের মোচন অনায়াসে হইতে পারে। প্রত্যেকের জানিয়া রাখা উচিত যে জাতি ও বর্ণ একার্থবোধক শব্দ নহে। প্রথমটি "জন" ধাতু হইতে সিদ্ধ হয়- যাহার অর্থ "জন্মগ্রহণ করা" বুঝায় এবং দ্বিতীয়টি "বৃ" ধাতু হইতে সিদ্ধ হয়- যাহার অর্থ "বরণ করা" বুঝায়। বেদাদি শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শদ্র শব্দগুলি সর্বত্রই গুণ ও কর্মবাচক শব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে, কৃত্রাপি জন্ম বাচকরূপে নাই। গুণ ও কর্মের যোগে যাহা গ্রহণ করা যায়, তাহাকে বর্ণ বলে। বর্ণ বলিতে বরণ, নির্বাচন বা মনোনয়ন (Election) বুঝায়। জাতি বলিতে জন্ম (Birth) বুঝায়। এই দুইটি শব্দের পরিষ্কার ধাতুগত যৌগিক অর্থ রঘুনন্দনের মস্তিষ্কে কেন স্থান পাইল না, তাহা বুঝি নাই। তাঁহার কলোলকল্পিত নব্য স্মৃতিশাস্ত্র গুলি বাংলার হিন্দু সমাজকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দূর্বল করিয়া দিয়াছে। এক্ষণে সমাজশরীরকে সবল, সুস্থকায় ও দৃঢ় করিতে হইলে কল্পিত শাস্ত্রগুলি পরিহার করিয়া বেদের দিকে ফিরিয়া তাকাইতে হইবে। বেদকে মানিয়া চলিলে সমাজসংগঠন সুনিশ্চিত। সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিপ্লবের যুগ হইতে একই অখণ্ড আর্যজাতির বহুলোক বৈদিক সংস্কার বিহীন হইয়া বেদ বিরুদ্ধ শত সহস্র কল্পিত জাতি ও উপজাতিতে বিভক্ত হইয়া শূদ্রবৎ জীবনযাপন করিতেছে। তাহারাই আজ সাবিত্রীপতিত, ব্রাত্য, অসংস্কৃত ও আর্য-বিগর্হিত শূদ্র। এই সুযোগে একদল স্বার্থান্বেষী গুরুপুরোহিতরূপে এইরূপ শুদ্র দিগকে নামে মাত্র যজমান সাজাইয়া ও বিবিধ কল্পিত দীক্ষামন্ত্র দ্বারা স্ব স্ব সম্প্রদায় পুষ্ট করিয়া জীবিকার্জন করিতেছে। যজমানেরাও সরল সুগম মুক্তিপথের স্বপ্ন দেখিতেছে। এই সব পুরোহিত ও যজমানদের সহিত বেদাদিশাস্ত্রের কোন সম্বন্ধ দেখা যায় না। ইহারা যাহা কিছু আচরণ করিয়া আসিতেছে, সবই নাকি বেদ সম্মত- এইরূপ ইহাদের উক্তি। ব্রাত্য যজমানেরা শাস্ত্রের কোন খোঁজই রাখে না। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মুখে যাহাই বলেন, তাহারা তাহাই বিশ্বাস করে। এত অন্ধ বিশ্বাস! এই ব্রাত্য পতিতগণের শুদ্ধি ও সংশোধনের জন্য শাস্ত্রকার যে দণ্ডবিধি প্রণয়ন করিয়াছেন, আর্যাবর্তবাসীরা তাহা মানিয়া চলিলে সর্বাঙ্গীন দূরবস্থা হইতে মুক্ত হইয়া পুনরায় বৈদিক ধর্মে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া পূর্ববৎ এক অখণ্ড বিরাট সঙ্ঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত হইতে পারে।
মনুষ্যত্ব লাভের প্রথম সোপান
বিশ্ব প্রেমিক মন্ত্রদ্রষ্টা (নিরুক্ত ১/২০) ঋষিরা জানিতেন যে বেদ ঈশ্বরের বাণী (অথর্ববেদ ১০।২৩।৪।২০) এবং ইহা মানিয়া চলিলে মনষ্যজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হইবে। সেই উদ্দেশ্যেই তাঁহারা পূর্ববর্ণিত বিধিগুলি (Law) প্রণয়ন করিয়া গিয়াছেন। বিধি প্রণেতা মহর্ষি মনু আরও কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া একমাত্র বেদকে আশ্রয় করিয়া বলিয়াছেন।
পৈতা বিদ্যার্থীর বাহ্যচিহ্ন মাতুরগ্রেহধিজননং দ্বিতীয়ং মৌঞ্জীবন্ধনে।
তৃতীয়ং যজ্ঞদীক্ষায়াং দ্বিজস্য শ্রুতিচোদনাৎ।।
তত্রযন্ত্রহ্মজন্মাস্য মৌঞ্জীবন্ধনচিহ্নিতম্।
তত্রাস্য মাতাসাবিত্রী পিতাত্বাচার্য উচ্যতে।।
বেদপ্রদানাদাচার্যং পিতরং পরিচক্ষতে।
নহ্যস্মিন্ যুজ্যতে কর্ম কিঞ্চিদামৌঞ্জীবন্ধনাৎ।। মনুস্মৃতি ২।১৬৯-১৭১
অর্থাৎ (শ্রুতিচোদনাৎ) বেদের প্রেরণানুসারে (দ্বিজস্য) ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বালকের প্রথম জন্ম মাতৃগর্ভ হইতে, দ্বিতীয় জন্ম উপনয়ন সংস্কারে এবং তৃতীয় জন্ম যজ্ঞদীক্ষাতে হইয়া থাকে। এই তিন জন্মের মধ্যে দ্বিজ বালকের (ব্রহ্মজন্ম) বেদ অধ্যয়নের জন্য যে জন্ম লাভ হয় অর্থাৎ দীক্ষাপ্রাপ্তি হয়, তাহা উপনয়ন দ্বারা চিহ্নিত হইয়া থাকে। তৎকালে (অস্য মাতা সাবিত্রী) গায়ত্রী ইহার মাতা এবং (পিতা তু আচার্য) আচার্যই ইহার পিতা বলিয়া কথিত হন।
প্রশ্নঃ পিতা কেন বলা হয়?
উত্তরঃ (বেদপ্রদানাৎ) বৈদিক দীক্ষাদান ও বেদের অধ্যাপনের জন্য আচার্যকে পিতা বলা হয়। (আমৌঞ্জীবন্ধনাৎ) উপনয়ন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত বালকের পক্ষে কোন কর্মই যুক্তিযুক্ত হয় না অর্থাৎ উপনয়নবিহীন বালক সন্ধ্যাপাসনাদি কোন প্রকার বৈদিক যজ্ঞাদি কর্মে অধিকার প্রাপ্ত হয় না।
উল্লিখিত মনুপ্রোক্ত বচনগুলি হইতে বুঝা যায় যে প্রাচীনকালে গুরুকুলে যিনি বৈদিক ধর্মে দীক্ষাদান করিতেন বা বেদের অধ্যাপনা করিতেন, সেই আচার্যকে ব্রহ্মচারী বালকদের পিতা বলা হইত। বর্তমানে অধঃপতিত হিন্দু জাতির স্কুল, কলেজ বা টোলে সেরূপ কোন বিধি-ব্যবস্থার প্রচলন নাই; পরন্তু খ্রিস্টানদের স্কুলে দেখা যায় যে যিনি খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষাদান করেন বা তাঁহাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের অধ্যাপনা করেন, সেই খ্রিষ্টান ধর্মগুরু পাদরি সাহেবকে বালকেরা Father বলিয়া সম্বোন্ধন করে। ইহাদের এই কথাটি পূর্বোক্ত প্রাচীন বিধি হইতে অনুসৃত হইয়াছে সন্দেহ নাই।
সংস্কৃত ভাষায় "পিতরঃ" শব্দের অপভ্রংশে ফার্সী ভাষায় Pidar, গ্রীক্ ও ল্যাটিন ভাষায় Pater, সুইডেন ও ডেনমার্কের ভাষায় Fader এবং ইংরেজিতে Father বলা হইয়াছে। সুতরাং Father শব্দটি "পিতা" শব্দেরই অপভ্রংশ এবং একার্থবোধক শব্দ, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।
বৈদিক ধর্ম যাজক আচার্যকে সংস্কৃতে যেমন "পিতৃ" আখ্যা দেওয়া হইয়াছে, খ্রিষ্টান ধর্মযাজক পাদরিকেও তেমনই ইংরেজিতে Priest বলা হইয়াছে। Priest শব্দটি "পিতৃ" শব্দেরই অপভ্রংশ বলিয়া মনে হয় এবং শব্দ দুইটি স্ব স্ব ভাষায় একই ভাবে "যাজক" অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে।
মহর্ষির শ্রুতিচোদনাৎ শব্দ হইতে পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে যে তিনি বেদের নির্দেশ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের জন্যই যজ্ঞোপবীত ধারণের বিধি প্রণয়ন করিয়াছেন, বঙ্গদেশের মাত্র কতিপয় ব্রাহ্মণের জন্য নহে। বেদ যদি আর্য জাতির ধর্মগ্রন্থ হয় এবং ইহাকে ঈশ্বরের বাণী বলিয়া স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে আস্তিক্যবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রেরই যজ্ঞোপবীত ধারণ করা একান্ত কর্তব্য। নতুবা ঈশ্বরাজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া মহাপাপে লিপ্ত হইতে হয়। অব্রাহ্মণ হিন্দুদের ধর্ম, কর্ম ও ঈশ্বর চিন্তা এতকাল ধরিয়া যে ভুল পথে পরিচালিত হইতেছে, তাহা উপরিউক্ত প্রমাণগুলি হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়। আমাদের কর্তব্য-পথ নির্ণয় করিবে বেদ ও বৈদিক সাহিত্য এবং যাহা কিছু অবৈদিক, তাহা অবিলম্বে বর্জন করিতে হইবে।
বেদের আধারে মহর্ষি মনুর প্রবর্তিত দীক্ষা বিধি অতীব সরল ও সুগম, ইহাতে জটিলতার লেশমাত্র নাই। তিনি বলিয়াছেন-
পৈতা দীক্ষার চিহ্ন উপনীয় গুরুঃ শিষ্যং শিক্ষয়েচ্ছৌচমাদিতঃ।
আচারমগ্নিকার্যঞ্চ সন্ধ্যোপাসনমেব চ।। মনুস্মৃতি ২। ৬৯
অর্থাৎ গুরু শিষ্যের উপনয়ন সংস্কার করিয়া প্রথমে শৌচবিধি শিক্ষা দিবে। তৎপরে আচার, অগ্নিহোত্র এবং সন্ধ্যোপাসনার বিধি শিক্ষা দিবে।
মহর্ষি মনুর এই বিধি পূর্বকথিত অথর্ববেদের ১১।৫। ৩ মন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত- ইহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। আজও যাঁহারা অনুপনীত থাকিয়া সাম্প্রদায়িক গণ্ডীতে জীবনযাত্রা করিতেছেন, তাঁহারা সেই গণ্ডীর মোহ ত্যাগ করিয়া একই বেদমন্ত্রে যজ্ঞোপবীত ধারণ করিয়া সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রসংগঠনে আত্মনিয়োগ করিলে মুক্তির পথ সরল ও সুগম হইবে। আজ যাঁহারা গুরু পুরোহিত নামে পরিচিতি, শাস্ত্রকার তাঁহাদের অনেককে গুরু বলিয়া স্বীকার করেন না, বরং তাহাদিগকে নাস্তিক বলিয়াছেন। "নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ (মনু ২।১১) অর্থাৎ যাঁহারা বেদ বিরুদ্ধ কার্য করেন, বা করান তাঁহারাই নাস্তিক নামে পরিচিতি। প্রকৃত গুরু, পুরোহিত বা আচার্য কাহাকে বলা যায়, শাস্ত্রকার তাঁহারও নির্দেশ দিয়াছেন-
গুরুই আচার্য
উপনীয় তু যঃ শিষ্যং বেদমধ্যাপয়েৎ দ্বিজঃ।
সকল্পং সরহস্যঞ্চ তমাচার্যং প্রচক্ষতে।। মনুস্মৃতি ২।১৪০
অর্থাৎ যিনি শিষ্যের যজ্ঞোপবীত সংস্কার করিয়া যজ্ঞবিধি ও উপনিষদসহ বেদের অধ্যাপনা করেন, তাঁহাকে আচার্য বলে। বর্তমানের গুরুপুরোহিতরা এসব জানেনও না এবং করেনও না। সুতরাং তাঁহারা বর্জনীয়। শব্দবিজ্ঞানবিৎ ঋষি যাস্ক বলিয়াছেন-
যাঁহারা বিধিপূর্বক দীক্ষাগ্রহণ ও দীক্ষাসূত্র ধারণ তথা গুরুশুশ্রূষা না করিয়া গুরুর অনুমতি ব্যতিরেকে মুদ্রিত সন্ধ্যা-বিধি, ভজনাবলী, উপাসনা পদ্ধতি, যোগসাধন রহস্য প্রভৃতি মুখস্থ করিয়াই সন্ধ্যোপাসনায় ও ভজন সাধনে রত হন, অথবা মুদ্রাযন্ত্রসুলভ ধর্মগ্রন্থ- বেদবিদ্যা লাভে প্রবৃত্ত হন, মহর্ষি মনুর মতে তাঁহাদিগকে বিদ্যা চোর বলা হয়। বিদ্যার্থী, বিদ্যানুরাগী বা বিদ্যালাভেচ্ছু ব্যক্তিমাত্রেরই মুদ্রিত পুস্তক অধ্যয়নে অধিকার আছে- ইহা যেমন সত্য, শাস্ত্রের "বিধি-নিষেধগুলি, মানিয়া চরা কর্তব্য- ইহাও তেমনই সত্য; তাহা না মানিলে ধর্মভ্রষ্ট হইতে হয়। সেইজন্য মহর্ষি বলিয়াছেন-
বিদ্যাপহারকের নরকবাস ব্রহ্ম যন্ত্বননুজ্ঞাতমধীয়ানাদবাণুয়াৎ।
স ব্রহ্মন্তেয়সংযুক্তো নরকং প্রতিপদ্যতে।। মনুস্মৃতি ২।১১৬
অর্থাৎ যে ব্যক্তি অধ্যয়ন বা অধ্যাপনকারীর নিকট হইতে তাঁহার (অননুজ্ঞাতম্) অনুমতি ব্যতিরেকে বেদবিদ্যা লাভ করে, সেই ব্যক্তি (ব্রহ্মস্তেয়সংযুক্তঃ) বেদবিদ্যা অপহরণজনিত পাপে লিপ্ত হইয়া নরক প্রাপ্ত হয়। ইহার তাৎপর্য এই যে ধর্মপিপাসু বিদ্যালাভেচ্ছু ব্যক্তিমাত্রেরই সর্বপ্রথম গুরুর নিকট যথাবিধি দীক্ষালাভান্তে ব্রহ্মচর্য অবলম্বনপূর্বক পারমার্থিক জ্ঞানলাভে অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। ছলনা, বঞ্চনা বা কপটতা দ্বারা বিদ্যার্জন করিতে গেলে পরিণামে হিতকর না হইয়া দুঃখদায়কই হইয়া থাকে।
এতক্ষণ ত শাস্ত্রীয় বিধির কথা বলা হইল। যজ্ঞোপবীতের উপযোগিতা কতটুকু, তাহাও বুঝা দরকার। প্রত্যেক সংস্কার আন্তরিক শুদ্ধির এক একটি বাহ্য চিহ্ন। ইহাতে আধ্যাত্মিক ও আধিদৈবিক- দ্বিবিধ কর্তব্য সম্পাদিত হয়। বাহ্য চিহ্ন বা বাহ্য কৃত্য আত্মিক উন্নতির পরিপোষক। ইহা একেবারে ব্যর্থ হয় না। বাহ্য মনোরম পোশাক পরিচ্ছদ যেমন মনের উপর প্রভাব বিস্থার করে, তেমনই ধর্মের বাহ্য চিহ্ন এবং সংস্কারের ক্রিয়াকলাপও মনের উপর ধর্মের প্রভাব বিস্তার করে। ইহাতে কোন ব্যর্থ আড়ম্বর নাই এবং এত কঠিন নয় যে ইহার উপযোগ করিতে অধিক সময় ও ধন ব্যয় করিতে হয়। মনুষ্যমাত্রই জন্মগ্রহণ করিলে বৈদিক সিদ্ধান্ত অনুসারে তাহাকে তিনটি ঋণে আবদ্ধ হইতে হয় ঋষিঋণ, পিতৃঋণ ও দেবঋণ। রাজনীতির ভাষায় বলা যায়- আমি জন্মভূমির নিকট ঋণী। তাহার জলবায়ুতে পুষ্ঠ হইয়াছি এবং সেগুলিকে সর্বদা দূষিত করি। পৃথিবী, জল, বায়ু ও অগ্নি আদিকে বেদে দেবতা বলা হইয়াছে। মানুষ তাহাদের নিকট হইতে সতত উপকার গ্রহণ করিয়া ঋণী হইতে থাকে। এগুলি ঐসব ঋণের আধিদৈবিক অঙ্গ। এইজন্য দেবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া দেবঋণ পরিশোধের বিধান ব্যবস্থিত হইয়াছে। ইহা ছাড়া মাতাপিতার নিকটও আমরা ঋণী। তাঁহাদের নিকট হইতে জন্ম, পালন, পোষণ ও শিক্ষাগ্রহণ করিয়া এই জগতকে উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছি। তাহাদের জীবদ্দশায় শ্রাদ্ধ ও তর্পণাদি দ্বারা পিতৃযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া পিতৃঋণ শোধ করিতে হয়। তারপর ঋষিদের কৃপাতেই আমরা বেদাদি শাস্ত্রের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি লাভ করিতেছি। সুতরাং যথাবিধি ঋষিযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া ঋষিঋণ পরিশোধের বিধি রচিত হইয়াছে। এইজন্য ঋষিঋণ ও পিতৃঋণকে ত্রিবিধ ঋণের আধ্যাত্মিক অঙ্গ বলা যায়। এইসব ঋণ পরিশোধের প্রযত্নকেই বেদে ব্রত বলা হইয়াছে। এই ব্রত কিরূপ তৎ সম্বন্ধে বেদ বলিতেছে-
বিজানীহ্যার্যান্ যে চ দস্যবো বর্হিম্মতে রন্ধয়া শাসদ্বতাম্। ঋগ্বেদ ১।৫১।৮ হে রাজন! যাঁহারা আর্য, তাঁহাদিগকে জ্ঞান এবং যাঁহারা (অব্রতান) ব্রতহীন দস্যু, তাহাদিগকে জানিয়া ধর্মসাধনের জন্য শাসন ব্যবস্থা কর। তাঁহারাই আর্য যাঁহারা সব্রত এবং তাহারাই দস্যু যাহারা অব্রত। যাহারা ঋণী হইয়াও ঋণকে স্বীকার করেন না, তাহারাই ব্রতহীন দস্যু। যদি কেহ বলেন- "আমি জন্মভূমির নিকট ঋণী কিসের? তাহার উন্নতির জন্য চেষ্টা করিব কেন?" তাহা হইলে এই নয় কি সে ধূর্ত, দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক এবং ভারতমাতার কুপুত্র? বেদ এই ভাবটিকরই "দস্যু" শব্দ দ্বারা প্রকাশ করে। ঋণের দ্বায়িত্ব। বুঝিয়া যিনি তাহা পরিশোধের জন্য সতত উদ্যত থাকেন, তিনিই আর্য। এইরূপ উদ্যত থাকার ব্রতকে মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রারম্ভেই গ্রহণ করতে হয়। ব্রতধারণই আর্যত্ব। ব্রতের বিরোধিতাই দস্যুত্ব। ব্রতধারণের চিহ্নস্বরূপ বিদ্যারম্ভের প্রারম্ভেই তিন গাছা সুতার পৈতা (ত্রিবৃত তন্ত্র) বালকের স্কন্ধে ঝুলাইয়া দেওয়া হয়। এই পৈতা তাহাকে প্রত্যহ সেই তিনটি ঋণের কথা স্মরণ করাইয়া দেয় এবং তাহার কর্ণে ঘোষণাবাণী প্রবেশ করায়- ব্রতসাধনের প্রতি লক্ষ্য রাখ।
যজ্ঞোপবীত ধারণের কোন বাহ্যাড়ম্বর নাই। ইহা আর্যদের প্রাচীন সংস্কৃতির সরলতামূলক আদর্শ। যজ্ঞোপবীত হইতে অধিকতর সরল ও সহজ চিহ্ন আর কি হইতে পারে? এত সরল চিহ্ন আর একটিও কল্পনা করা যায় না। যজ্ঞোপবীত ধারণ করিলে কি আর্য হওয়া যায়? তা নয়। সুন্দর পোশাকপরিচ্ছদ পরিধান করিলে কি মানুষ ভদ্র হয়? তাও নয়। তবে পোশাকপরিচ্ছদ যেমন ভদ্রতার বাহ্য চিহ্ন, উপনয়নও তেমনই আর্যদের ধর্ম জীবনের বাহ্য চিহ্ন। যাঁহারা ভদ্রতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেন, তাঁহাদের পক্ষে যেমন সুন্দর মনোরম পোশাকপরিচ্ছদের আবশ্যক হয় না, তদ্রুপ জ্ঞানমার্গের চূড়ান্ত সীমায় যাঁহারা উপনীত হইয়াছেন, তাঁহাদের পক্ষে যজ্ঞোপবীত ধারণের প্রয়োজন হয় না। বাহ্য চিহ্ন সিদ্ধ পুরুষদের জন্য নয়, পরন্তু অসিদ্ধদের জন্য ত বটেই। ঋষি, মুনি, সাধু ও সন্নাসীরা বাহ্য চিহ্নের সীমাকে অতিক্রম করিয়া এমন স্থানে উপনীত হইয়াছেন, যেখানে যজ্ঞোপবীতের আবশ্যক হয় না। কিন্তু যাঁহারা সেই স্থানের এদিকে রয়েছেন, তাঁহাদের পক্ষে। যজ্ঞোপবীত ধারণ করা অবশ্যই কর্তব্য। সেইজন্য আর্যজীবন চতুরাশ্রমে বিভক্ত ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। বৈদিক জীবনমার্গে অগ্রসর হইতে হইতে মনুষ্য যখন চতুরাশ্রমে উপনীত হয়, শিখাসূত্রের সহিত সম্বন্ধ রহিত হয়। মাত্র তিনটি আশ্রমের সহিত এই ত্রিবৃত তন্তুর সম্বন্ধ চলিতে থাকে। যজ্ঞোপবীতের অতি প্রাচীনতা এবং ইহার সারগর্ভিত ইতিহাসই ইহার গৌরবের পরিচয় দান করে। যে চিহ্নর সহিত ব্যাস, বশিষ্ঠ্য, যাজ্ঞবন্ধ্য, ভরদ্বাজ ও জনকাদি ঋষি মহর্ষিগণের স্মৃতিযুক্ত রহিয়াছে, তাহা কি ত্যাগ করা যুক্তি সঙ্গত হইতে পারে? আজকাল লোকে গান্ধীটুপীর এত সম্মান করে কেন? টুপির মধ্যে কিছু রাখা হইয়াছে নাকি? টুপি ত মহাত্মা গান্ধীর বহুপূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল। পরন্তু এই টুপির এইজন্যই এত সম্মান যে ইহা মহাত্মা গান্ধীর মস্তকে শোভা পাইয়াছে। এই টুপিতে কোন দীক্ষার চিহ্ন নাই, পরন্তু যজ্ঞোপবীতে আছে ব্রত ও দীক্ষার চিহ্ন। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ভীষ্মদেব, যুধিষ্ঠির ও অর্জুনাদির ন্যায় মহা মহা রথিগণের স্কন্ধেও যজ্ঞোপবীত শোভা পাইত। সুতরাং প্রত্যেকেরই প্রাচীন বৈদিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। এই প্রাচ্য ভূমি ভারতবর্ষ ঋষি শাসিত দেশ ছিল। দীর্ঘকাল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার ফলস্বরূপ ইহার অধিবাসীরা প্রচীন ঋষি প্রদর্শিত মার্গ হতে ভ্রষ্ট হইয়া বর্তমানের চরম দুর্দশার সর্বনিম্ন স্তরে। আসিয়া উপনীত হইয়াছে। দূঃখের বিষয়- উহারা এখনও প্রাচীন আদর্শকে সমাদরপূর্বক গ্রহণ করিতেছে না। কিন্তু ঐ যে পাশ্চাত্য ভূমি হরিবর্ষ স্বাধীন জাতির বাসভূমি দেখিতেছেন- তথাকার এক বিখ্যাত মনীষী ম্যাক্সমুলার সাহেব বলিয়াছেন- "A people that can feel no pride in the past, in its history and literature, loses the main stay of its national characte. অর্থাৎ যে লোক তাহার পূর্ব গৌরবের, তাহার পূর্ব ইতিহাসের এবং তাহার পূর্ব সাহিত্যের সমাদর করে না, সে জাতীয় চরিত্র হতে ভ্রষ্ট হয়। মহাপুরুষের এই বাণী ভারতবাসীর পক্ষে বর্ণে বর্ণে সত্য হইয়াছে।
বাস্তবিকই যাঁহারা পূর্বজ পিতৃপুরুষগণের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ- বেদকে পড়েন বা মানেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই পৈতা ধারণ করেন। কারণ, পৈতা ধারণের পর বেদমন্ত্র উচ্চারণ করাই বেদবিধি। যাঁহারা পৈতা ধারণ না করিয়া বলেন- "আমরাও বেদ মানি বা স্বীকার করি" তাহাতে আমরা বলি যে ইহা তাঁহাদের মুখের কথা মাত্র। সেরূপ মানা বা না মানা উভয়ই সমান। কারণ, কেহ কেহ বেদের একাংশ মানেন- অপরাংশ মানেন না, কতকাংশ মানেন- কতকাংশ মানেন না, অধিকাংশ মানেন- অল্পাংশ মানেন না, উত্তরাংশ মানেন- পূর্বাংশ মানেন না এবং প্রথমাংশ ও শেষাংশ মানেন- অথচ মধ্যমাংশ মানেন না। এই শ্রেনীর লোকেরা সুবিধাবাদী, যতটুকু মানিলে সুবিধা হয়য ততোটুকুই মানেন; তার বেশী মানেন না। এরূপ মানিলে বেদ মান্য করা হয় না, প্রকারান্তরে বেদকে অমান্য করাই হয়। সেই হেতু তাঁহাদের পৈতা লওয়াই হয় না। পিতার উপদেশগুলি মান্য করিয়া চলা পুত্রের কর্তব্য। সুবিধামত কয়যেকটি মান্য করিলাম এবং কয়েকটি করিলাম না, বা অমান্য করিলাম। এক্ষেত্রে প্রকৃত প্রস্তাবে পিতাকে সম্মান করা হইল কি? কখনই না। তদ্রুপ পরমপিতা পরমেশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা করা এবং তাঁহার উপদেশগুলি প্রতিপালন করা মনুষ্যমাত্রেরই কর্তব্য। বেদ হইতেছে তাঁহার উপদেশ বাণী, সেই বেদের সর্বাং না মানিয়া সুবিধামত কতকটা মান্য করিলাম এবং কতকটা অমান্য করিলাম। ইহাতে বেদ বা পরমপিতা পরমেশ্বরকে অমান্য বা অপমান করা হইল না কি? নিশ্চয়ই হইল। ঋষি বলিয়াছেন- "সেই বেদের নির্দেশ অনুসারে মনুষ্যকে প্রথমে পৈতা ধারণ করিয়া তৎপরে বেদ অধ্যয়নে অগ্রসর হইতে হয়। পৈতা ধারণ না করিলে দীক্ষায় হয় না।"(মনুস্মৃতি ২।১৭৩) বেদপন্থী বা বেদমার্গীর পৈতা থাকিবেই থাকিবে- ইহা ঈশ্বরের আদেশ। নাস্তিক বা বামমার্গীরা বেদ মানে না এবং পৈতাও ধারণ করে না। যাহারা মুখে বেদ মানে, ঈশ্বর মানে, অথচ কার্যতঃ পৈতা ধারণ করে না, তাহাদিগকে বামমার্গীর মধ্যেই ধরিয়া লইতে হইবে। এই উভয় দলের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করিবে একমাত্র পৈতা। চিহ্ন মাত্রই ভেদসূচক। চিহ্নের কার্য তাহাই। বেদ মানা বা না মানা- এই উভয় ক্রিয়া মূলতঃ হৃদয় দ্বারা সম্পাদিত হয়। দুইটি হৃদয়ের দ্বিবিধ ভাব (আস্তিকতা ও নাস্তিকতা) কার্যকলাপে আচারব্যবহারে এবং চাল চলনে বুঝা যাইবে সত্য; কিন্তু এই উভয় শ্রেণীর মানুষকে বাহ্যতঃ দেখিবামাত্রই বুঝিব কিরূপে যে কে বেদমার্গী বা কে বামমার্গী? সবসময়ত আর কার্যকলাপ ও আচারব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করা চলে না! এস্থলে বেদমার্গীদিগকে সহজে চিনিবার জন্য কোন না কোন একটি চিহ্ন (Badge) বাহ্যতঃ ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। তজ্জন্য এই অনায়াসলভ্য সূত্র চিহ্নস্বরূপ ধারণের ব্যবস্থা হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা সুলভ চিহ্ন আর একটিও চিন্তা করা যায় না। যদি এই চিহ্নটি একেবারেই উঠাইয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নানাবিধ বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইবে, সন্দেহ নাই। প্রত্যেক কার্যের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য এক একটি চিহ্ন থাকা একান্ত প্রয়োজন। এই হেতু যাবতীয় কার্য সুনিয়মে ও মুগমতার সহিত পরিচালনার জন্য জজ, ব্যারিষ্টার, এ্যাডভোকেট, এটর্নি, উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট, সার্জেন পুলিশ, জমাদার এবং স্কাউট প্রভৃতি বিভিন্ন পদস্থ ব্যক্তির বিভিন্ন কার্যের জন্য বিভিন্ন চিহ্নের পোশাক (Uniform) ব্যবহৃত হয়। এইরূপ পার্থক্যসূচক চিহ্ন না থাকিলে কার্যের বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। চিহ্নগুলি উঠাইয়া দিলে কে কোন পদাধিকারী, তাহা বুঝা যাইবে না এবং কার্যেও বিবিধ বিঘ্ন উপস্থিত হইবে। কোন পদাভিষিক্ত ব্যক্তি যদি কর্তব্য কর্মে অবহেলা করিয়া কোন অপরাধ করে, তাহা হইলে যেরূপ দত্তস্বরূপ তাহাকে পদচ্যুত করিয়া তন্নিম্ন পদে অবনমিত করা হয়, অথবা কোন গুরুতর অপরাধের জন্য তাহাকে কর্মস্থল হইতে চিরতরে বহিষ্কৃত করা হয়, পৈতাধারী কোন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য স্ববর্ণানুকূল কর্ম না করিয়া যদি বেদবিরুদ্ধ কর্ম করে, তাহা হইলে তাহাকেও পদচ্যুত করিয়া দণ্ডস্বরূপ তন্নিম্ন পদে অবনমিত করা যাইতে পারে; অথবা কোন গুরুতর অপরাধের জন্য তাহাকে সমাজ হইতে চিরতরে বহিষ্কৃত করা যাইতে পারে। তজ্জন্য মহর্ষি এইরূপ দণ্ডবিধিও প্রণয়ন করিয়াছেন- "যিনি তর্ক শাস্ত্রকে আশ্রয় করিয়া ধর্মের দুইটি মূল বেদ ও বোদানুকূল স্মৃতিশাস্ত্রের অপমান করেন, সেই বেদ নিন্দক নাস্তিককে জাতি, পংক্তি ও দেশ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবে। যে দ্বিজ সায়ংকালে ও প্রাতঃকালে সন্ধ্যা করে না, তাহাকে শুদ্রবৎ জানিয়া সমস্ত দ্বিকার্য হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবে। এই ধর্মভ্রষ্ট দ্বিজ সেবা কার্য করিবে এবং তাহার বিদ্যার চিহ্নস্বরূপ যজ্ঞোপবীত রাখা কর্তব্য নহে। (পরমহাযজ্ঞবিধি) যে দ্বিজ বেদ পাঠ না করিয়া অন্য বিষয়ে শ্রম করে, সে জীবদ্দশাতেই সবংশে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। (মনুস্মৃতি ২০১১, ১০৩, ১৬৮) বেদমার্গী ও বামমার্গীর মধ্যে পার্থক্য বুঝিবার জন্যই পৈতা ধারণের ব্যবস্থা হইয়াছে। ইহা এমন কিছু ব্যয়সাপেক্ষ নয় যে উহা সকলের পক্ষে ধারণ করা যায় না। ধনী হইতে দরিদ্র এবং রাজা মহারাজা হইতে প্রজা পর্যন্ত সকলেই উহা ধারণ করিতে পারে এবং যোগ্যতানুসারে সকলেরই উহা ধারণ করিবার ক্ষমতা আছে। মহর্ষির বচন অনসারে বুঝা যায় যে যাঁহারা আস্তিক, বেদভক্ত, বেদপন্থী বা ব্রহ্মজন্মলাভেচ্ছু, অথবা বেদবিদ্যানুরাগী, পৈতা কেবল তাহাদের জন্যই ব্যবহৃত হইতে পারে, অন্যের জন্য নহে। পরমেশ্বর বেদমন্ত্রেও এইরূপ উপদেশ দিয়াছেন, যথাস্থানে তদ্বিষয়ের আলোচনা করা হইয়াছে।
পৈতা ধারণ করিলে অনেকে মনে করেন দ্বিজে ও শূদ্রে ভেদই যখন রহিল, তখন আর বৈদিক সাম্যবাদ টিকিল কিরূপে? আমরা বলি- ইহা তাঁহাদের নিতান্তই ভুল। দেখুন ভকিলের গাউন কি ননভকিলের সহিত ভেদ সৃষ্টি করে না? স্কাউটের পোশাক কি ননস্কাউটের সহিত ভেদ সৃষ্টি করে না? নিশ্চয়ই তা করে। চিহ্নমাত্রই ত ভেদসূচক, চিহ্নের পরিচয় ত তাহাই। ততক্ষণই তা চিহ্ন, যতক্ষণ ইহা ভেদ সৃষ্টি করিতে পারে। তজ্জন্য ভকিলে ও ননভকিলে, স্কাউটে ও ননস্কাউটে কি দলাদলি হয়? কখনই নয়। কারণ, বাহ্যচিহ্ন (Uniform) কর্তব্য কর্মের পার্থক্য ঘোষণা করে মাত্র, দলাদলি সৃষ্টি করে না। ননভকিলের যেমন যোগ্যতানুসারে ভকিল হইবার অধিকার আছে, শূদ্রেরও সেভাবে দ্বিজ হইবার অধিকার আছে। তদ্বিষয়ে বিধিপ্রণেতা বড়ই উদারতার সহিত প্রত্যেকেরই গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুসারে বর্ণান্তর প্রাপ্তির বিধিও প্রণয়ন করিয়াছেন।
বর্ণ জন্মগত নয়
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্। ক্ষত্রিয়জ্জাতমেবস্তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ।।
মনুস্মৃতি ১০।৬৫ অর্থাৎ শূদ্রকুলে উৎপন্ন হইলেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সমান গুণ, কর্ম ও স্বভাবযুক্ত শূদ্র যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য হইয়া থাকে। তদ্রুপ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকুলে উৎপন্ন হইয়াও শূদ্রের সমান গুণ, কর্ম ও স্বভাবযুক্ত হইলে শূদ্র হইয়া থাকে এবং ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যকুলে উৎপন্ন হইয়াও ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্রের সমান গুণ, কর্ম ও স্বভাবযুক্ত হইলে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্র হইয়া থাকে (সত্যার্থ প্রকাশ)। কর্মক্ষেত্রে অধিকার সকলেরই সমান এবং সেই অধিকার নির্ণীত হয় একমাত্র স্বীয় যোগ্যতার উপর। অধিকার আর যোগ্যতা একই বস্তু নহে, সম্পূর্ণ পৃথক।
এস্থলে দার্শনিক পণ্ডিত স্বামী দর্শনানন্দের গবেষণামূলক বচনগুলি বাস্তবিকই প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্বীয় গ্রন্থমালার পূর্বার্ধে ব্রহ্মবচসকামস্য কার্যং- এই মনু বাক্য অনুসারে গৃহ্যসূত্রের অষ্টম বর্ষে ব্রাহ্মণমুপনয়েৎ- এই বচনের অর্থ এইরূপ লিখিয়াছেন যে ব্রাহ্মণবালকের অর্থাৎ ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বালকের উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে হওয়া উচিত। এইরূপ মন্ত্র বেদ মন্ত্রের অনুকূল অথচ যুক্তিসিদ্ধ। ব্রাহ্মণ বালক বলতে ব্রাহ্মণের বীর্যোৎপন্ন বালক নহে, পরন্তু ব্রাহ্মণপদ লাভের যোগ্য যে বালক, তাহাকেই বুঝিতে হইবে। কারণ, বেদমন্ত্রের বিরুদ্ধার্থ করিলে সমূহ সূত্র অপ্রামাণিক হইয়া যাইবে। বালক যদি শূদ্র সন্তান হইয়াও মেধাবী হয়, তাহা হইলে ব্রাহ্মণপদের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইলে তাহার উপনয়ন সংস্কার অষ্টম বর্ষে, ক্ষত্রিয়পদের যোগ্য হইলে একাদশ বর্ষে এবং বৈশ্যপদের যোগ্য হইলে দ্বাদশ বর্ষে হইবে। পরন্তু যেন স্মরণ থাকে যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য (পদের যোগ্য) হইবার জন্যই উপনয়ন সংস্কারের প্রয়োজন হইয়া থাকে, শূদ্র হইবার জন্য উপনয়নের আবশ্যক হয় না। উপনয়নের পূর্ব সকলেই শূদ্রই থাকে, ততকালে কাহারও দ্বিজ সংজ্ঞা হয় না। দুইবার জন্মগ্রহণের পর দ্বিজ আখ্যা হইয়া থাকে। প্রথম জন্ম মাতাপিতা হইতে এবং দ্বিতীয় জন্ম বিদ্যা-মাতা ও গুরু-পিতা হইতে হয়। যে বিদ্যারূপিণী মাতার গর্ভে প্রবেশ করে নাই, তাহাকে দ্বিজ বলা যাইবে কিরূপে? যে দ্বিজই হয় নাই, সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য হইবে কিরূপে? কারণ, দ্বিজ হওয়া বলিতে উপনয়ন সংস্কারের পর বেদারম্ভ সংস্কার দ্বারা ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বালকের দ্বিজত্বের পরিপক্কতা বুঝায়। বিদ্যাধ্যয়ন সমাপ্তির পর স্ব স্ব গুণ, কর্ম ও স্বভাবের যোগ্যতানুসারে কেহ ব্রাহ্মণপদ, কেহ ক্ষত্রিয়পদ, কেহ বা বৈশ্যপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। গীতাতেও এরূপ উক্তি আছে। যে ব্যক্তি ২৫ বৎসর বয়ক্রম পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন না করিয়া এবং বৈদিক শিক্ষা প্রাপ্ত না হইয়া উপনয়ন হইতে বঞ্চিত থাকে, সেই ব্যক্তিই শূদ্র এবং উপনয়ন সংস্কারের পূর্বে সকলে শূদ্রই থাকে (দর্শনানন্দ গ্রন্থমালা, পূর্বার্দ্ধ পৃ ১৫২-১৬৩)। এক কথায় শূদ্রের যজ্ঞোপবীত সংস্কার মূর্খ বালককে বাল্যাবস্থায় বিদ্যাধ্যয়নের জন্য বৈদিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা বুঝায়। মহর্ষি মনুর কামান্মাতা পিতা চৈনং- এই বচন হইতেও বুঝা যায় যে মনুষ্যেরা জন্মমাত্রই শূদ্র হইয়া থাকে। পণ্ডিতেরাও বলেন- জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ। দ্বিজ পুত্রই বা শূদ্র পুত্রই হোক, সকলে স্ব স্ব মেধা, বলবিক্রম বা ব্যবহার অনুযায়ী যথাযথকালে বৈদিক দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়া বিদ্যার্জনের জন্য বৈদিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। তথায় অধ্যয়ন সমাপনান্তে সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ স্নাতকেরা ব্রাহ্মণ, দ্বিতীয় বিভাগে ক্ষত্রিয় এবং তৃতীয় বিভাগে বৈশ্য আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অনুত্তীর্ণ যুবকেরা শূদ্র থাকিয়া যায়, বিদ্যালাভে অসমর্থ হওয়ায় তৎকালে তাহারা বিদ্যাচিহ্ন (পৈতা) পরিত্যাগ করে। প্রাচীনকালে বৈদিক পরীক্ষার রীতি বোধ হয় এইরূপই ছিল। এইরূপে বিদ্যাবিহীন মূর্খ শূদ্রের একজন্ম এবং বিদ্যাবান্ বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের দ্বিজন্ম প্রতিপাদিত হইয়া থাকে। বিধিকর্তাও তাহাই বলিয়াছেন-
ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়োবৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিন্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।। মনুস্মৃতি ১০।৪
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য দ্বিজাতি চতুর্থ বর্ণস্থ শূদ্রেরা একজাতি। এই তিন বর্ণস্থ (পদস্থ) মনুষ্যেরা পঞ্চম বর্ণই নাই। এইরূপ দ্বিজাতির বাহ্যচিহ্ন পৈতা ধারণ করা একান্ত আবশ্যক, পরন্তু একজাতি শূদ্রের ঐরূপ চিহ্নের কোন প্রয়োজন নাই। ইহা অতীব সরল ও সত্য কথা।
এস্থলে কিঞ্চিৎ বর্ণ-বিভাগের কথা বলা দরকার। আর্যদের চতুরাশ্রের মধ্যে একমাত্র গৃহস্থাশ্রমটিই বৈদিক অনুসারে চারিবর্ণে (Division) বিভক্ত হয়। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রহ্মচর্যাশ্রম (গুরুকুল) যেমন বিদ্যার্জনের জন্য, গৃহস্থাশ্রমও তেমনই জীবিকার্জনের জন্য। বিদ্যার্জন সমাপ্ত করিয়া গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করাই বেদবিধি। এই আশ্রমে বাস করিয়া মনুষ্যগণ স্ব স্ব যোগ্যতানুসারে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম দ্বারা জীবিকার্জন করে। এখানে একই ব্যক্তির পুত্রগণ পৃথক পৃথক কর্মে দক্ষতার পরিচয় দান করে এবং ইহা স্বাভাবিক। সকলেই একই কর্ম করিতে পারে না এবং প্রত্যেকে সকল প্রকার কর্ম করিতে সমর্থ হয় না। ইহা সৃষ্টির নিয়মানুকূল, সেইজন্য বর্ণ পরিবর্তন হওয়াও স্বাভাবিক। বর্ণ বলিলে বুঝিতে হইবে- কর্ম বিভাগ (Division of Profession) সম্বন্ধে বলা হইতেছে। গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করিয়া জীবিকার্জনের জন্য গুণ, কর্ম ও স্বভাব এর অনুকূল যোগ্যতানুসারে কেহ ব্রাহ্মণ (Thinker), কেহ ক্ষত্রিয় (Warrior), কেহ বৈশ্য (Trader) এবং কেহ শূদ্র (Labourer) হয়। একই বাড়ীতে ক্ষত্রিয় সন্তানগণ প্রত্যেকেরই অজেয় দুর্দ্ধর্ষ শক্তিশালী বীর পুরুষ হইয়া জন্ম গ্রহণ করে না। তন্মাধ্যে কেহ না কেহ শক্তিহীন হইয়াও অত্যন্ত মেধাবী পুরুষরূপে জন্ম গ্রহণ করে। সেই ব্যক্তি সুতীক্ষ্ণ মেধাশক্তি বলে বেদবিদ্যা অর্জন করিয়া প্রচণ্ড ব্রহ্মতেজ ধারণপূর্বক ব্রাহ্মণ হইয়া যায়। এইরূপে এক বর্ণের সন্তান স্বীয় গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুসারে অন্য বর্ণ প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ যে পিতা ক্ষত্রিয় বিভাগে কর্ম করিয়া বীর যোদ্ধার পরিচয় দান করে, তাহারই স্নাতক পুত্র গৃহস্থাশ্রমে সমাবর্তন করিয়া স্বীয় যোগ্যতানুসারে ব্রাহ্মণ বিভাগে অথবা ক্ষত্রিয় বিভাগের কর্ম করিয়া জীবিকার্জন করিতে সক্ষম হয়। স্বভাবতঃ এইরূপে বর্ণ পরিবর্তিত হইয়া যায়। শাস্ত্রে ইহার বহুল উদাহরণ আছে। কুরুবংশীয় ক্ষত্রিয় ঋষ্টিসেনের পুত্র দেবাপি স্বীয় ভ্রাতা শান্তনুর পৌরোহিত্য করিয়াছিলেন (নিরুক্ত ২।১০)। সিন্ধুদীপ, দেবাপি ও বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হইয়াও ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন (মহাভারত শল্য পর্ব ৪০)। ক্ষত্রিয় জনক ব্রাহ্মণত্ব লাভ করিয়াছিলেন (শতপথ ব্রাহ্মণ)। বেশ্যার গর্ভজাত সন্তান বশিষ্ঠদেব ইক্ষাকু কুলের পুরোহিত ছিলেন। বারবিলাসিনী জবালার পুত্র সত্যকাম ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন (ছান্দোগ্য উপনিষদ)। অন্য বর্ণের সন্তান হইয়াও ইহারা স্বীয় গুণ, কর্ম ও স্বভাবের যোগ্যতানুসারে ব্রাহ্মণ বিভাগে কর্ম (Service) করিয়া জীবিকার্জন করিতেন।
চাতুব্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চাতুর্বণ্য সৃষ্ট হইয়াছে- যোগীরাজ শ্রীকৃষ্ণেরও এইরূপ উক্তি। জীবিকার্জনের সহিত গৃহস্থাশ্রমের সম্বন্ধ থাকায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র স্ব স্ব গুণ ও কর্মানুকূল জীবিকার্জন দ্বারা স্ব স্ব আশ্রমের কার্য পরিচালনা করে। সমাজকে উত্তমরূপে অথচ সুদৃঢ়ভাবে রক্ষার জন্য লৌকিক কর্মের পার্থক্য হেতু বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের উপর এই বর্ণভেদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা কেবল ইহলৌকিক কর্মের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য ব্যবস্থিত হইয়া থাকে। পরন্তু স্বাধ্যায়, যজ্ঞ ও দানাদি পারলৌকিক কর্মে সকলের সমান অধিকার ঘোষিত হইয়াছে। ইহাই বৈদিক সম্যবাদ।
এমন কি বেদে পুরুষের ন্যায় নারীরও যজ্ঞোপবীত ধারণের এবং ব্রহ্মবিদ্যালাভের সমানাধিকার ঘোষিত হইয়াছে। প্রাচীনকালে মহিলারাও যজ্ঞোপবীত ধারণ করিত। ঋণের কথা ধরিলে পুরুষও যতটা ঋণী, নারীও ততটা ঋণী। তাহারাও দেবঋণ, ঋষিঋণ ও পিতৃঋণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাহাদের পক্ষেও যজ্ঞ করা, বেদবিদ্যা লাভ করা ও উন্নতি করা আবশ্যক। বেদ বলিতেছে-
নারীজাতির যজ্ঞোপবীত সংস্কার ব্রহ্মচর্যেণ কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।
অথর্ববেদ ১১। ২৪। ৩।১৮
অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত মন্ত্রে বালক (পুরুষ) যেরূপ ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠান দ্বারা পূর্ণ বিদ্যা লাভ করিয়া অনুকূল তথা অনুরূপ বিদুষী, প্রেয়সী ও যুবতী স্ত্রীকে বিবাহ করে, তদ্রুপ কন্যা (কুমারী) ও (ব্রহ্মচর্ষেণ) বেদাদিশাস্ত্র অধ্যয়নপূর্বক পূর্ণ বিদ্যা লাভ করিয়া পূর্ণ যৌবনে নিজ সদৃশ প্রিয়তম বিদ্বান (যুবানম্ পতিম্) পূর্ণ যুবক স্বামী (বিন্দতে) প্রাপ্ত হয়। এই প্রমাণ দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে স্ত্রীলোকের পক্ষেও যজ্ঞোপবীত ধারণপূর্বক পুরুষের ন্যায় গুরুকুলে প্রবেশ করিয়া বিদ্যাগ্রহণের বিধি নিরূপিত আছে। গৃহ্যসূত্রে লিখিত আছে-
প্রাবৃতাং যজ্ঞোপবীতিনীমম্যুদানয়ন জপেৎ।
সোমোহদদদ্ গন্ধর্বায়েতি।। গোভিল গৃহ্যসূত্র ২।১।১৯
অর্থাৎ সুবস্ত্রশোভিতা (যজ্ঞোপবীতিনীম্) যজ্ঞোপবীত পরিহিতা কন্যাকে দান করিয়া "সোমোহদদদ্" আদি মন্ত্র জপ করিবে। পারস্কর গৃহ্যসূত্রে লিখিত আছে "স্ত্রিয় উপনীতা অনুপনীতাশ্চ” অর্থাৎ মহিলাদের যজ্ঞোপবীত হইয়াও থাকে, নাও হইয়াও থাকে। পারস্করের সময় উভয় রীতিই প্রচলিত ছিল। কেহ উপনয়ন ধারণ করিত এবং কেহ নাও করিত। পুরুষ যেমন সব্রত বা অব্রত হইতে পারে, স্ত্রীও তেমনই সব্রতা বা অব্রতা হইতে পারে। যে পুরুষ বা স্ত্রী ব্রত গ্রহণ করিতে চায় না, বা ঋণ পরিশোধ করিবার দায়িত্বও অনুভব করিতে অসমর্থ, তাহাদের যজ্ঞোপবীত ধারণের প্রশ্নই আসেনা। ব্রাহ্মণকুলোৎপন্নই হৌক বা শূদ্রকুলোৎপন্নই হৌক, যিনি কর্তব্য পালন করিতে পারেন, তাঁহারই উপবীত ধারণে পূর্ণ অধিকার আছে।
উপবীতীকে স্মরণ রাখিতে হইবে
উপরে বেদ ও বৈদিক সাহিত্য হইতে যে সকল সুদৃঢ় প্রমাণ উদ্ধৃত হইল, তদ্দ্বারা স্পষ্টই উপলব্ধি করা যাইতেছে যে যজ্ঞোপবীত ধারণ না করিয়া দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করা যায় না এবং যতদিন পর্যন্ত উপবীত না হইবে, ততদিন পর্যন্ত বেদাধ্যয়নে বা বৈদিক যজ্ঞাদি কর্মে অধিকার হইবে না। আপদকাল বশতঃ যাহাদের উপনয়ন সংস্কার হয় নাই, তাহারা বিধি অনুসারে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া উপনয়ন ধারণ করিতে পারেন। বেদবিরুদ্ধ পৌরাণিক শ্রাদ্ধাদি কার্য করাইবার সময় পুরোহিত অনুপনীত যজমানের বাম স্কন্ধে ক্ষণকালের জন্য নব বস্ত্রের উত্তরীয় যজ্ঞোপবীতের ন্যায় ঝুলাইয়া দেন এবং তৎপরে মন্ত্রোচ্চারণ করাইয়া কার্য সমাপ্ত করেন। সমাপ্তির পর পুনরায় নকল পৈতাখানি খুলিয়া লন। পরোহিতের এবম্বিধ কর্ম দ্বারা প্রমাণিত হয় যে যজ্ঞোপবীত ধারণ না করাইয়া কোন শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞাদি কর্ম করাইতে নাই। ইহাই যদি বিধি হয়, তাহা হইলে স্থায়ীভাবে যজমানের উপনয়ন সংস্কার করিতে আপত্তি কি? বরং উপনয়ন ধারণ না করিলে মনু মহারাজের কঠোর দণ্ডাদেশ এইরূপ যে অনুপনীত ব্যক্তি বিধিবৎ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া উপবীত ধারণ না করিলে ব্রাহ্মণ (আচার্য) তাহাকে বিদ্যাদান করিবে না এবং তাহার সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধাদি বন্ধ করিয়া তাহাকে সর্বতোপ্রকারে সমাজচ্যুত করিবে। মহর্ষির এই বিধান এখনও পুরোহিতেরা মানিতে রাজী হইবেন কি? পৈতা কেবল ব্রাহ্মণের থাকিবে, তা নয়। সকলেরই যজ্ঞোপবীত ধারণে। এবং বেদাধ্যয়নে অধিকার আছে। এখনও যদি গুরুপুরোহিতেরা মনুর বিধান মতে যজমানদিগকে উপনয়ন দান করিয়া শাস্ত্রাচার শিক্ষা দেন, তাহা হইলে সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে, সন্দেহ নাই। ইহাতে ব্রাহ্মণ সমাজের মুখউজ্জ্বল হইবে। কিন্তু পঠন পাঠন দ্বারা যাহার কিছুই হয় না, সে নির্বুদ্ধি এবং মূর্খ বলিয়া তাহাকে শূদ্র বলা হয়। উহার পক্ষে পঠন পাঠন ব্যর্থ। বিদ্যাহীন এবং মূর্খ হওয়ার জন্য শূদ্র কোন বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় কার্য করিতে পারে না, পরন্তু শারীরিক কার্য সকলই করিতে পারে। এইজন্য শূদ্রের পক্ষে সেবাধিকার (Social Service) নিরূপিত হইয়াছে। শূদ্রগণ সর্বপ্রকারে সেবাচতুর এবং পাকবিদ্যায় নিপুণ হইবে। শ্রদ্ধার সহিত দ্বিজাতির সেবা করিবে এবং উহাদের নিকট হইতে নিজের উপজীবিকা লাভ করিবে। এ বিষয়ে ঋষিরা বলিয়াছেন-
পাচকবৃত্তি শূদ্রের, ব্রাহ্মণের নহে অশত্রু বংস্তু শুশ্রূষাং শূদ্রঃ কর্তৃং দ্বিজম্মনাম্।
পুত্রদারাত্যয়ং প্রাপ্ত জীবেৎ কারুক কর্মভিঃ।। মনুস্মৃতি ১০।৯৯
আর্যাধিষ্ঠিতা বা শূদ্রা সংস্কর্তার স্যুঃ। আপস্তম্ব ২।২। ৩।৪
অর্থাৎ (দ্বিজন্মনাং শুশ্রূষাং কর্তৃং অশবন্) দ্বিজাতির অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের শুশ্রূষা করিতে অক্ষম (তু) অথচ (পুত্রদারাত্যয়ং প্রাপ্তঃ শূদ্রঃ) পুত্র পরিবার বর্গসহ অন্নাভাবগ্রস্থ শূদ্র (কারুক কর্মভিঃ জীবেৎ) কারুক কর্ম অর্থাৎ পাচকাদি বৃত্তি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিবে। মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্ট "কারুক কর্ম" অর্থে পাচকাদি বৃত্তির নির্দেশ দিয়াছেন। আর্যদের অধ্যক্ষতায় শূদ্রেরাই রন্ধন করিবে।
ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের গৃহে শূদ্রেরাই রন্ধন কার্য করিবে। কিন্তু এখন দেখা যায় যে যেকোন জাতির ধনী ভদ্র গৃহস্থ বাড়ীতে, হোটেলে, মেসে অথবা কোন কর্মবাড়ীতে ব্রাহ্মণেরাই শূদ্রের পদাধিকারী হইয়া জীবিকার্জন করিতেছে। এই সব পাচক বামনেরাই আবার সমাজে গুরুপুরোহিত সাজিয়া শূদ্র যজমানদের পূজার্চনা ও দীক্ষাদানাদি যাজন কার্য করিয়া থাকে। যেমনই পুরোহিত, তেমনই যজমান! ধন্য হিন্দু সমাজ! এক্ষেত্রে উভয়েই শূদ্র ব্যতিরেকে আর কি হইতে পারে? যে সব দীক্ষাগুরু শিষ্যের বাড়ী বাড়ী ঘুরিয়া বার্ষিক (দক্ষিণা) আদায় করেন, তাঁহারাই আবার শিষ্যের স্পৃষ্ট রন্ধিত অন্ন ভক্ষণ না করিয়া স্বহস্তে পাক করিয়া ভোজন করেন। উপরিউক্ত বিধিমতে এক্ষেত্রে এই সব গুরুকে শূদ্র ছাড়া আর কি বলা যাইতে পারে? কোন কোন সময় গোপনে শিষ্যবাড়ীর পক্কান্ন ভক্ষণ করিয়াও বাহিরে লোকসমাজে বলেন "আমরা কাহারও স্পৃষ্ট অন্ন ভক্ষণ করিনা, বরং স্বহস্তে পাক করিয়া ভোজন করিয়া থাকি। এই সব বচন দ্বারা প্রকারান্তরে গুরুপুরোহিতেরা এইরূপ স্বীকার করিলেন যে তাঁহারা স্বয়ং শূদ্রবৃত্তি অবলম্বনপূর্বক জীবিকার্জন করিয়া থাকেন। অতএব, গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুসারে তাহারা যে শূদ্র (পদাধিকারী বা বর্ণান্তর্গত), তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
পৈতা পরিচয়
বাঙ্গলা দেশের চলতি কথায় "পৈতা বা পইতা" বলা হয়। ইহা সংস্কৃত ভাষার "পবিতা বা পবিত্র" শব্দের অপভ্রংশ শব্দ। ইহা ধারণ করিলে মানুষ পবিত্র হয় বলিয়া ইহার নাম "পবিত্র" হইয়াছে। ইহা স্বয়ং মন্ত্রপূত পবিত্র এবং অপরকেও পবিত্র করিয়া তোলে। ইহার আরও বহু নাম আছে। যথা- দীক্ষাসূত্র, যজ্ঞসূত্র, ব্রহ্মসূত্র, সাবিত্রীসূত্র, উপনয়ন, উপনয়, উপবীত, পরিবীত,যজ্ঞোপবীত, ব্রতচিহ্ন, ব্রতবন্ধ, দ্বিজচিহ্ন, স্মৃতিচিহ্ন, বিদ্যাচিহ্ন, দ্বিজায়নী, ত্রিকী, ত্রিবৃত তন্তু, বাস্ (ব্রাহ্মণ গ্রন্থে) ও সুবাস।
দীক্ষাসূত্র- দীক্ষা গ্রহণকালে আচার্যদেব দীক্ষার চিহ্নস্বরূপ যে সূত্র যজমানের স্কন্ধে ঝুলাইয়া দেন, তাহাই দীক্ষাসূত্র।
যজ্ঞসূত্র- বিধি অনুসারে যজ্ঞানুষ্ঠান করিবার জন্য আচার্যদেব যে সূত্র ধারণ করাইয়া থাকেন, তাহারই নাম যজ্ঞসূত্র।
ব্রহ্মসূত্র- ব্রহ্ম অর্থাৎ বেদ অধ্যয়নের জন্য উপনয়ন সময়ে যর সূত্র ধারণ করান হয়, তাহাই ব্রহ্মসূত্র।
সাবিত্রীসূত্র- গুরুদেব সাবিত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত করিবার সময় যে সূত্র ধারণ করাইয়া থাকেন, তাহাই সাবিত্রীসূত্র
যজ্ঞোপবীত- যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ অর্থাৎ সর্বব্যাপক পরমাত্মার নাম যজ্ঞ।
উপ সমীপে, বি- বিশেষ প্রকারে, ই (গমন করা) ক্ত করিলে উপবীত শব্দ সিদ্ধ হয়। যজ্ঞ নামক পরমাত্মার সামীপ্য লাভার্থ অর্থাৎ ব্রহ্মযজ্ঞের জন্য এবং তৎসহ দেবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ ও নৃযজ্ঞাদি করিবার জন্য আচর্যদেব যে সূত্র ধারণ করান, তাহাই যজ্ঞোপবীত। যজ্ঞ শব্দে "মিলন বা একতাবন্ধন" বুঝায়। যেমন ঈশ্বরে ও জীবে মিলন সাধিত হয়, তেমনই সমস্ত মনুষ্যকে একতাসূত্রে আবদ্ধ করিবার জন্য তাহাদিগকে একই মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়া যে দীক্ষাসূত্র ধারণ করান হয়, তাহারই নাম যজ্ঞোপবীত বা মিলনসূত্র। বেদবিধি অনুসারে সকলে এইরূপ মিলনসূত্র ধারণ করিলে অস্পৃশ্যতা বর্জন সিদ্ধ হয়, সর্বনাশকর জাতিভেদ প্রথা বিদূরিত হয়, সাম্প্রদায়িকতা বিলুপ্ত হয় এবং প্রাদেশিক ভেদভাবও দূরে সরিয়া যায়। যজ্ঞোপবীত শব্দটির মধ্যে বহু নিগূঢ় অর্থ নিহিত আছে। সতত উদ্যত থাকিয়া কর্তব্য পালনের প্রযত্ন করাকে ব্রত বলা হয়। এই ব্রতকে সর্বদা স্মৃতিপথে উজ্জ্বল রাখিবার জন্য অধ্যাপক বালককে বিধিবৎ যে চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করেন, তাহার নাম ব্রতবন্ধ, ব্রতচিহ্ন ও বিদ্যাচিহ্ন ইত্যাদি।
পরিবীত- পইতার প্রসিদ্ধ বৈদিক নাম। ঋগ্বেদের ১।১২৮।১, ১।১৬৪। ৩২, ৩।৮।৪, ৪।১।৭, ৪।৩।২, ১০/৬/১ এবং ১।১৩০।৩ মন্ত্রগুলিতে ইহা দৃষ্ট হয়।
উপবীত- বৈদিক নাম। অথর্ববেদের ৩।১। ২৪ এবং যজুর্বেদের ১৬।১৭ মন্ত্রে এই শব্দ দৃষ্ট হয়।
উপনয়ন- বৈদিক নাম। অথর্ববেদের ১১। ৩।৫। ৩ মন্ত্রে দৃষ্ট হয়। ত্রিবৃত তন্তু- বৈদিক নাম। ঋগ্বেদের ৯।৮৬। ৩২ এবং ১০।৫৭। ২ মন্ত্রে ইহা দৃষ্ট হয়।
শিক্ষা ও দীক্ষায় পার্থক্য
সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা ও দীক্ষা শব্দ দুইটির পার্থক্য ইংরেজি শব্দ দ্বারা বেশ পরিষ্কার বুঝা যায়। ইংরেজিতে Education Instruction এই দুটি শব্দ আছে। মূলতঃ ইহারা ল্যাটিন ভাষার Educo এবং Instruo হইতে যথাক্রমে গৃহীত হইয়াছে। E= out+duco= to draw অর্থাৎ আত্মার স্বাভাবিক জ্ঞানকে ভিতর হইতে বাহিরে আনিয়া প্রকাশ করার নাম Education বা শিক্ষা। In= ভিতর+ Struo= to collect সংগ্রহ করা অর্থাৎ বাহির হইতে জ্ঞান লইয়া ভিতরে জমা করার নাম Instruction বা দীক্ষা। শিক্ষা অর্থে আত্মার স্বাভাবিক জ্ঞান বুঝায় এবং দীক্ষা অর্থে নৈমিত্তিক জ্ঞান বুঝায়। দীক্ষার নিমিত্তকারণ গুরুর নিকট হইতে ইহা সংগ্রহ করিতে হয় এবং সৃষ্টির আদি হইতে আজ পর্যন্ত মানবজাতির বংশপরম্পরায় এইরূপ দীক্ষা চলিয়া আসিতেছে। সৃষ্টির আদিতে এইরূপ দীক্ষা নৈমিত্তিক জ্ঞান বেদ পরমেশ্বর কর্তৃক শুদ্ধান্তঃকরণ ঋষিদের হৃদয়ে প্রদত্ত হইয়াছিল। পরমেশ্বর মনুষ্যজাতির আদি দীক্ষাগুরু বলিয়াই ঋষি পতঞ্জলি বলিয়াছেন-
স এষ পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ।
যোগদর্শন ১।২৬
অর্থাৎ পরমেশ্বর সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন অগ্নি আদি ঋষিদের গুরু হইয়াছিলেন। এইরূপে পরমাত্মা হইতে সৃষ্টির আদি সময়ে বিদ্যাশিক্ষা প্রাপ্তি হওয়াতে উত্তরোত্তর মনুষ্যজাতি বিদ্বান হইয়া আসিতেছে। এক্ষণে দেখুন- অবৈদিক দীক্ষা আমাদিগকে কতদূর মহাপাতকের দিকে লইয়া চলিয়াছে। স্রষ্টার সৃষ্টিতে বাস করিয়া তৎপ্রদত্ত ভোগ্য বস্তু ভোগ করিয়া তাঁহারই উপদেশামৃত বেদ না মানিয়া আমরা কতদূর যে পাপকার্য করিতেছি, তাহার ইয়ত্তা নাই। যাহাতে আমরা সকলেই তাঁহারই বিধান অনুযায়ী তাঁহারই প্রবর্তিত দীক্ষামন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া একই যজ্ঞ (মিলন) ভূমিতে সমাজ ও রাষ্ট্রসংগঠনে আত্মনিয়োগ করিতে পারি, তজ্জন্য যাবতীয় সাম্প্রদায়িক মতবাদ পরিত্যাগ করিতে হইবে। যজ্ঞোপবীত ধারণের মূখ্য উদ্দেশ্য এইরূপ জানিতে হইবে।
যজ্ঞের স্বরূপ
বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞ শব্দের অর্থ অতি ব্যাপক। বেদে ইহার মহিমার সীমা নাই। পূর্বে কিছু বলিয়াছি এবং এস্থলেও সংক্ষেপে দু একটি কথা বলিব। ইহার ধাতুগত যৌগিক অর্থ হইতেছে মাত্র তিনটি। যথা- (১) পূজা- সৎকার (Honour, Respect), (২) সঙ্গতি (Unity) এবং (৩) দান
(Charity)। (১) বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরু, শ্রেষ্ঠ ও সজ্জন মহাত্মাদের সৎকার, সম্মান, পূজা, শ্রাদ্ধ ও তর্পন (Regard, Respect, Satisfaction) বুঝায়। (২) সমগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিদের সহিত মিলন, মিত্রতাস্থাপন, মৈত্রীবন্ধন ও প্রেমপ্রীতিপূর্ণ সম্বন্ধস্থাপন (Union, Love, Friendliness, Firm Relation) বুঝায়। (৩) দান- দীন হীন ও নীচ ব্যক্তিগণের প্রতি উপকার ও ঔদার্যভাব (Charitable Disposition) বুঝায়। প্রত্যেক মনুষ্যের হৃদয়ে যজ্ঞ অর্থাৎ পূজা মৈত্রী উপকার এই তিনটি ভাব থাকা একান্ত দরকার। সমাজের প্রত্যেকের ব্যষ্টিগত জীবনে। এইরূপ যজ্ঞ না থাকিলে সমাজ ও রাষ্ট্রসংগঠন অসম্ভব।
মহর্ষি যাস্কের নির্ঘন্টুতে (৩।১৭) যজ্ঞবাচক ১৫ টি শব্দ আছে। তন্মধ্যে অধ্বর, বিষ্ণু ও প্রজাপতি- এই তিনটি শব্দের অর্থ দেখা যাউক। ধ্বরতি হিংসা কর্মা, তৎপ্রতিষেধঃ অধ্বরঃ অর্থাৎ "ধ্বর" শব্দে হিংসা বুঝায়। তাহারই প্রতিষেধ অর্থাৎ নিবারণ হয় যে কার্যে, তাহাই অধ্বর। তাহা হইলে বৈদিক সিদ্ধান্ত এইরূপ যে কার্যে জীবজগতের কোন প্রকার হিংসা সাধিত হয় না, বরং সতত তাহাদের পরম কল্যাণ সাধিত হয়, সেই কার্যের নাম যজ্ঞ। মহর্ষি বেদব্যাস অহিংসার লক্ষণ সম্বন্ধে বলিয়াছেন- তত্রাহিংসা সর্বথা সর্বদা > সর্বভূতানামদ্রোহঃ অর্থাৎ সর্ব প্রকারে এবং সর্ব সময়ে সমস্ত প্রাণীর সহিত দ্রোহ না করার নাম অহিংসা। এইরূপ সমগ্র অহিংসাময় কর্মকে বেদের পরিভাষায় যজ্ঞ বলা হইয়াছে।
প্রজা-সমূহ জীবজগত এর পতি- পালনশক্তি যে কর্মে নিহিত আছে অর্থাৎ যে কর্ম দ্বারা যাবতীয় অশান্তি দূরীভূত হয় এবং জীবজগত পুষ্ট ও পালিত হইয়া শান্তিতে বাস করিতে পারে, সেই কার্যের নাম প্রজাপতি অর্থাৎ যজ্ঞ।
বেদে যজ্ঞের মহিমাকে বহুপ্রকারে বহুভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে। সামাজিক জীবনে, ধর্মজীবনে তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে পূজা, সঙ্গতি ও দানের দৃষ্টিতে যাহা কিছু শুভ কার্য সম্পাদিত হয়, বেদে তাহারই নাম যজ্ঞ রাখা হইয়াছে। মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রারম্ভেই গুরুর নিকট এইরূপ যজ্ঞের ব্রত পালনের জন্য ব্রত চিহ্ন ধারণ করিতে হয় এবং সেই ব্রতকে স্মরণ রাখিবার জন্য গুরুদেব বালকের স্কন্ধে তিন গাছা সুতার পৈতা ঝুলাইয়া দেন ইহাই সেই যজ্ঞোপবীত, যদ্দ্বারা নিন্মোক্ত মহাযজ্ঞের (১) নিত্যানুষ্ঠান সূচিত হয়।
ব্রহ্মযজ্ঞ- "ব্রহ্ম" অর্থে বেদ ও পরমেশ্বর বুঝায়। যে কর্ম দ্বারা ঈশ্বরপূজা স্তুতিপ্রার্থনা উপাসনা, ঈশ্বরের সহিত জীবের মিলন তথা বেদের প্রচার অধ্যয়ন অধ্যাপন হয়, তাহার নাম ব্রহ্মযজ্ঞ।
দেবযজ্ঞ- "দেব" শব্দের অর্থ বিদ্বান। সেই বিদ্বানগণের পূজা, সৎকার, সম্মান, সহবাস ও সম্মেলনের নাম দেবযজ্ঞ। যে সকল কর্মদ্বারা পার্থিবামি ও বিদ্যুৎঅগ্নি হইতে নানা প্রকার শিল্প বিদ্যার উৎকর্ষ সাধিত হইয়া থাকে, যাহাতে মনুষ্যের স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে অর্থাৎ সুখলাভ হয়, তাহার নাম দেবযজ্ঞ। অগ্নিতে ঘৃত ও ব্যাধিনাশক হবনীয় ঔষধি আহুতি দিলে জল, বায়ু ও বৃষ্টির বিশুদ্ধতা সম্পাদিত হয়। তদ্দ্বারা জীবজগতের কল্যাণ সাধিত হয় বলিয়া হোম করাকে দেবযজ্ঞ বলে।
পিতৃযজ্ঞ- যাঁহারা সত্য বিজ্ঞান প্রদান করিয়া লোকসমূহকে পালন করেন, তাঁহারাই পিতৃপদবাচ্য। সোমসদ্, অগ্নিশ্বাত্তা, বহিষদ, সোমপা, হবির্ভুজ, আজ্যপা, সুকালিন, যম, পিতা, পিতামহ, প্রপিতমহ, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতা, স্ত্রী, ভগিনী, আত্মীয় কুটুম্ব, ভদ্র পুরুষ এবং বৃদ্ধ প্রভৃতি জীবিত পিতৃগণের তৃপ্তির জন্য প্রীতিপূর্বক যে সেবা করা যায়, তাহাকে পিতৃযজ্ঞ এবং শ্রদ্ধাপূর্বক যে সেবা করা যায়, তাহাকে পিতৃশ্রাদ্ধ বলে। ইহাই পিতৃযজ্ঞ (ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকা)।
নৃযজ্ঞ- যাঁহার গমনাগমনের কোন নিশ্চিত তিথি নাই, তাঁহাকে অতিথি বলে। কোন ধার্মিক, সত্যোপদেশক, সর্বহিতসাধক, পূর্ণ বিদ্বান, পরম যোগী বা সন্ন্যাসী অকস্মাৎ গৃহস্থ বাটীতে সমাগত হইলে তাঁহাকে পাদ্য, অর্থ ও আচমনীয় জল প্রদান করিয়া সৎকারপূর্বক আসনে উপবেশন করাইবে। পরে উত্তম পানীয় ও ভোজনীয় পদার্থ দ্বারা সেবা করিয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিবে। তদনন্তর তাঁহার নিকট ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষসাধক জ্ঞানোপদেশ শ্রবণ করিবে এবং তদনুসারে স্বীয় আচার ও ব্যবহারের অনুষ্ঠান করিবে (সত্যার্থ প্রকাশ)।
ভূতযজ্ঞ- ভোজনার্থ প্রস্তুত অন্ন হইতে কিঞ্চিৎ পাকামিতে আহুতি দিবে। তৎপরে কিঞ্চিৎ অন্ন দূঃখী, বুভুক্ষিত প্রাণী, কুকুর, চণ্ডাল, পাপরোগী, কাক, কৃমি ও পিপীলিকা প্রভৃতিকে দান করিবে। হবন করিবার প্রয়োজন এই যে পাকশালাস্থ বায়ু শুদ্ধ হইবে এবং অজ্ঞাতভাবে অদৃষ্ট জীবের হত্যা হইলে
তাহার প্রত্যুপকার করা হইবে (সত্যার্থ প্রকাশ)।
এই পাঁচটি যজ্ঞকে মহর্ষি মনু পঞ্চমহাযজ্ঞ নামে আর্যদের নিত্যকর্মের মধ্যে স্থান দান করিয়াছেন। ইহা ব্যতিরেকে আরও বহুবিধ যজ্ঞের বিধান আছে। আর্যদের জীবন যজ্ঞময়।
___________________________________________________________________________________
(১) মনুস্কৃতি ৩।৭০-৭১
(২) শিল্প বণিতে শিল্পণয় (Machine), বায়শিয়, স্থাপত্যশিল্প (Architecture), অমরণিয় (Sculpture), প্রামণিয় (Inhntry) ও সৃদ্ধশিল্প প্রভৃতি বুঝায়। এগুলি দেবগন্ধের অন্তর্ণত।
পৈতার সহিত ধর্মের ঘনিষ্ট সম্বন্ধ
যজ্ঞোপবীত পরিধান করাইবার প্রাক্কালে আচার্যদেব নিম্নোক্ত মন্ত্রটি বলেন এবং তৎপরে বালকের বাম স্কন্ধ হইতে দক্ষিণ কটিদেশ পর্যন্ত কোনাকুনি তিন গাছা সুতার পৈতাখানি ঝুলাইয়া দেন-
পৈতার গুণ
ওঁ যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং প্রজাপতের্যৎ সহজং পুরুস্তাৎ।
আয়ুস্যম্যং প্রতিমুঞ্চ শুভ্রং যজ্ঞোপবীতং বলমন্ত্র তেজঃ।
যজ্ঞোপবীতমসি যজ্ঞস্য ত্বা যজ্ঞোপবীতেনোপনহ্যামি।।
পারস্কর গৃহ্যসূত্র ২।২।১১
অর্থাৎ (প্রজাপতেঃ যৎ সহজম) ঈশ্বরের স্বভাবসিদ্ধ যে উপদেশ (পুরস্তাৎ) পুরাকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, সেই (পরমম্ পবিত্রম্ আয়ুষ্যম্ অগ্রম্ যজ্ঞোপবীতম্) পারমার্থিক জ্ঞানসূচক, পবিত্রতাবোধক, আয়ুবর্ধক এবং শ্রেষ্ঠতাপ্রতিপাদক যজ্ঞসূত্র অদ্য তোমাতে (প্রতিমুঞ্চ) বন্ধন করিতেছি। এই (শুভ্রম্ যজ্ঞোপবীতম্) নির্মলতাবোধক ব্রহ্মসূত্র (বলম্ তেজঃ অন্তু) বল ও তেজ প্রদানকারী হউক। হে দীক্ষাসূত্র! তুমি ব্রহ্মচারিগণের (যজ্ঞোপবীতম্ অসি) মিলনসূত্র হইতেছ। হে বালক! (ত্বা যজ্ঞস্য) তমাকে যজ্ঞের অধিকারী করিবার জন্য এই (যজ্ঞোপবীতেন উপনহ্যামি) যজ্ঞসূত্র দ্বারা বন্ধন করিতেছি।
ঋষির এবম্বিধ বাক্যগুলি হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে যথাবিধি পৈতা ধারণ করিয়া বৈদিক মার্গে চলিলে পবিত্রতা, দীর্ঘায়ু ও ধনেশ্বর্য লাভ হয় এবং তৎসহ জাগতিক ও পারমার্থিক জ্ঞান লাভ হয়। শারীরিক বল ও আত্মিক তেজ বৃদ্ধি পায়। প্রাদেশিক ও সাম্প্রদায়িক ভেদভাব বিদূরিত হয় এবং সকলে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ধার্মিক, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবনে যে প্রকৃত সুখ শান্তি লাভ হয়, তাহার মূল সূত্রপাত হইতেছে ঈশ্বরের সেই অমৃতময় বাণী- "স সূর্যস্য রশ্মিভি পরিব্যত তন্ত্রং তন্বানন্ত্রিবৃতং যথাবিদে" হইতে। এক্ষণে হয়ত কেহ জিজ্ঞাসা করিবেন- পেতায় মাত্র তিন তার হইল কেন? ঈশ্বরই বা মাত্র তিনটি তারের নির্দেশ দিলেন কেন? দুই, চার বা পাঁচ তার হইল না কেন ? তাহা হইলে তিন তার বলিবার কি কোন গূঢ় উদ্দেশ্য আছে? আমরা বলি অবশ্যই আছে। পরমেশ্বর স্বয়ং বেদমন্ত্রে সেই উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াছেন। আবার তিন গাছা সুতার পৈতায় তিনটি গ্রন্থিও ব্যবস্থিত হইয়াছে। তিনটি গ্রন্থি ডেন তিনটি শক্ত বন্ধন। জ্ঞানবিকাশের প্রারম্ভেই বালক গুরুর সমীপে তিনটি গ্রন্থিযুক্ত ত্রিবেষ্টনসূত্র ধারণ করিয়া সর্বাগ্রে বেদের গায়ত্রী মন্ত্র লাভ করে। দেখিতে পাই বালকের একটি বন্ধন চিহ্ন এবং অপরটি মুক্তিমন্ত্রের উপদেশ লাভ হইয়াছে। মনে হয়, তিন তারের বন্ধন যেন তাহাকে তিন প্রকার মুক্তির সূচনা দান করিতেছে। যেন তিনটি নিগূঢ় রহস্যকে উপলব্ধি করিয়া ত্রিবেষ্টন (তিনটি বন্ধন) হইতে মুক্তিলাভের জন্য তাহাকে এই ত্রাণকারিণী গায়ত্রী মন্ত্র প্রদান করা হইয়াছে। ইহাই নিখিল বেদের মূল বীজমন্ত্র। ব্রক্ষর প্রণব- ত্রিমহাব্যাহতি ত্রিপাদ মুক্তিমন্ত্র একদিকে, ত্রিগ্রন্থিসম্বনিত ত্রিবেষ্টনী সূত্রের বন্ধন আর একদিকে। বন্ধন ও মুক্তির সমস্যা লইয়ায় ব্রহ্মচর্য জীবন ক্রমাগত অগ্রসর হইতে থাকে। যজ্ঞোপবীতের তিন তার সুতা যেন সতত তাহাকে এই বলিয়া নির্দেশ করে, "হে ব্রহ্মচারী! তুমি ত্রিবিধ পরমানু সংযোগে রচিত ত্রিবিধ শরীর এর বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া ত্রিবিধ দুঃখ ভোগ করিবার জন্য এই ত্রিগুণাত্মক প্রাকৃতিক জগতে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। দূঃখের অপর নাম বন্ধন।
এই ত্রিবিধ বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিতে হইলে সৃষ্টির ত্রিবিধ অবস্থাকে ত্রয়ী বিদ্যাবলে সম্যকরূপে উপলব্ধি করিয়া এ্যক্ষরাত্মক প্রণবসহ ত্রিমহাব্যাহতিযুক্ত ত্রিপাদ মুক্তিমন্ত্রের অনুসরণ কর।" জীবাত্মার যতকিছু ত্রিবিধ বন্ধনের আদর্শ (নমুনা) স্বরূপ হইতেছে তিন তার পৈতার বন্ধন। তিন তার পৈতার স্মরণ করাইয়া দেয় তাহাকে সংসারের ত্রিবিধ বন্ধনের কথা এবং গায়ত্রী মন্ত্র দেখাইয়া দেয় তাহাকে মুক্তির পন্থা। ইহাই হইল মনুষ্যজীবনের প্রাথমিক কর্তব্য। এইরূপে বৈদিক ত্রিবৃত তন্ত্র (যজ্ঞোপবীত) বহুপ্রকারে নানাভাবে বিবিধ বিষয়ে মাত্র ত্রিবিধ রহস্যেরই দ্বারোদঘাটন করে। ইহা ধারণ করিবার পর সর্ববিদ্যার মূল প্রসবন যে বেদ, তাহা পাঠে মনুষ্যের প্রথম অধিকার জন্মে। সেই বেদে মূলতঃ তিনটি তত্ত্বের সমাবেশ রহিয়াছে-
তিনটি মূলতত্ত্ব
দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে। ২০
ত্রয়ঃ কেশিন ঋতুথা বিচক্ষতে সংবৎসরে বপত এক এষাম্। ৪৪
ঋগ্বেদ ১। ১৬৪।২০,৪৪
এই দুইটি মন্ত্রে ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি- এই ত্রিবিধ তত্ত্বের বর্ণনা দৃষ্ট হয়। মুণ্ডকোপনিষদের ৩।১।২ মন্ত্রে এবং শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদের ৪।১ মন্ত্রেও এইরূপ তিনটি তত্ত্বের উল্লেখ আছে। মূলতঃ এই তিন তত্ত্বের নিগূঢ় রহস্যকে উপলব্ধি করিয়া ত্রিবিধ দূঃখরূপ বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করা মনুষ্যমাত্রেরই চরম উদ্দেশ্য। মুক্তিপথ প্রদর্শক ঋষিও তাহাই বলিয়াছেন-
অথ ত্রিবিধ দূঃখাত্যন্ত নিবৃত্তিরত্যন্ত পুরুষার্থঃ।। সাংখ্যদর্শন ১।১
অর্থাৎ আধ্যাত্মিক, আদিভৌতিক ও আধিদৈবিক- এই ত্রিবিধ দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি করাই মনুষ্য জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। জীবের এইরূপ ত্রিবিধ বন্ধনের স্মারক চিহ্নস্বরূপ হইতেছে- তিনটি গ্রন্থিযুক্ত তিন তার পৈতার বন্ধন, অন্যদিকে সেই বন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য হইল- ত্রিপদা গায়ত্রী মন্ত্রের উপদেশ। মনে হয়, যত কিছ ত্রিবিধ তত্ত্বকে সতত স্মৃতিপথে জাগরিত করিয়া রাখিবার জন্য ঈশ্বর ত্রিবৃত তন্তু অর্থাৎ তিন তার সুতার পৈতা ধারণের উপদেশ দান করিয়াছেন। এককথায় এইরূপ বলা যায় যে এই ত্রিবৃৎ পৈতা সর্বদা জীবকে ত্রিবিধ বন্ধন হইতে ত্রিপাদ মুক্তি মন্ত্র পর্যন্ত স্মরণ করাইয়া দেয়। ত্রিবৃৎ পৈতার সহিত ত্রিবৃৎ বেদ ও ব্রহ্মের অদ্ভুত সামঞ্জস্য রহিয়াছে। এক্ষেত্রে মহর্ষি মনুর নিম্নোক্ত বচনগুলি প্রণিধানযোগ্য-
বেদ, ব্রহ্মহ্ম ও ব্রহ্মসূত্রে অদ্ভুত সামঞ্জস্য যথা মহাহ্রদং প্রাপ্য ক্ষিপ্তং লোস্ট্রং বিনশ্যতি। তথা দুশ্চরিতং সর্বং বেদে ত্রিবৃতি মজ্জতি।। ঋচো যজুংষি চান্যানি সমানি বিবিধানি চ। এষং জ্ঞেয়ন্ত্রিবৃদ্ধেদো যো বেদৈনং স বেদবিৎ।। আদ্যং যৎ এ্যক্ষরং ব্রহ্ম ত্রয়ী যস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতা। স গুহ্যোহপ্যন্ত্রিবৃদ্ধেদো যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।
মনুস্মৃতি ১১।২৬৩-২৬৫
অর্থাৎ যেরূপ নিক্ষিপ্ত লোষ্ট্র মহাহৃদে পতিত হইয়া বিনষ্ট হইয়া যায়, তদ্রুপ (ত্রিবৃতি বেদে) ত্রিবৃৎ বেদে জ্ঞানলাভ হইলে সমূহ পাপরাশি ধংশ হইয়া যায়। এই ত্রিবৃৎ বেদ কিরূপ তাহা পরবর্তী শ্লোকে সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত হইয়াছে। ঋক্, যজুঃ ও সাম (এষঃ ত্রিবৃৎ বেদঃ জ্ঞেয়ঃ) এই ত্রিবৃৎ বেদ জানিবার উপযুক্ত। যিনি উহা জানেন তাহাকে বেদবেত্তা বলে। যে (এ্যক্ষরং ব্রহ্ম) অ+উ+ম= ওম্= ব্রক্ষ্যরাত্মক ব্রহ্ম সর্ব বেদের মূল, যাহাতে (ত্রয়ী) ত্রিবৃৎ বেদ প্রতিষ্ঠিত আছে, সেই নিগূঢ় ওঙ্কার ব্রহ্মও একটি ত্রিবৃৎ বেদ। যিনি সেই ব্রহ্মকে জানেন, তাহাকেও বেদবেত্তা বলা যায়
এক্ষণে দেখুন পৈতাকে যেরূপ ত্রিবৃৎ তন্তু বলা হইয়াছে, বেদ ও ব্রহ্মকেও তদ্রুপ ত্রিবৃৎ বেদ বলা হইয়াছে। এস্থলে শাব্দিক দৃষ্টিতে "ত্রিবৃৎ" শব্দটি "বেদ, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মসূত্র" চমৎকার সৌসাদৃশ্য আনয়ন করিয়াছে। পৈতার তিন তার সুতার বেষ্টনকে ত্রিবৃৎ, বেদের ঋক্, যজুঃ ও সাম- এই ত্রিবৃৎ মন্ত্রের বেষ্টনকে ত্রিবৃৎ এং ব্রহ্মের অ, উ ও ম- এই এ্যক্ষরের বেষ্টনকেও ত্রিবৃৎ বলা হইয়াছে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে ত্রিবৃৎ বেদ ও ব্রহ্মের সহিত ত্রিবৃৎ পৈতার ঘনিষ্ট সম্বন্ধ বিদ্যমান রহিয়াছে। বাহ্য দৃষ্টিতে পৈতার তিন তার সুতা কেবল সুতাই মাত্র, তখন ইহার কোন মূল্য নাই বটে, কিন্তু ইহা ধারণের উদ্দেশ্য অতীব গভীর। ইহা মূলতঃ ধর্মজীবনের শৃঙ্খলাবিধায়ক। এক্ষণে ধর্ম বলিতে আমরা কি বুঝি?
বর্তমান যুগের অসভ্য মনুষ্য জাতির ধর্ম গীর্জা, মন্দির ও মসজিদের প্রাচীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়াছে। ইহার গতি ন্যায়াসন (Court of Law) বা ব্যবহার শালা (Business Room) পর্যন্ত পৌঁছে নাই। স্কুল কলেজের প্রদত্ত শিক্ষার সহিতও ধর্মের কোন সংস্রব নাই। পাশ্চাত্য শিক্ষাভিমানী ব্যক্তিগণ বর্তমান যুগের শিক্ষাকে ধর্ম হইতে পৃথক বলিয়া মনে করেন। তাঁহাদের মতে বিজ্ঞান, ভূগোল, স্বাস্থ্যনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি বা আইনগ্রন্থের সহিত ধর্মের কোন সম্বন্ধ নাই। তাঁহারা বলেন- "এগুলি হইতে ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু"। পরন্তু বৈদিক ধর্মের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বৈদিক ধর্মের বাহিরে কিছুই নাই। জগতে যতকিছু সত্যবিদ্যা প্রচলিত আছে, তৎসমস্তই আর্যদের ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হইয়া একই গ্রন্থের মধ্যে স্থান প্রাপ্ত হইয়াছে এবং গ্রন্থের নাম ধর্মশাস্ত্র। এইজন্য সংস্কৃত ভাষায় পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচিত হয় নাই। আর্যদের এমন কোন নিত্যকর্ম নাই, যাহার সহিত ধর্মের সংস্রব নাই। নিত্য কর্মের মধ্যে আর্যদের সমূহ দিনচর্যা ও রাত্রিচর্যা ব্যবস্থিত হইয়াছে। প্রাতঃকালীন গাত্রোত্থান, শৌচ, স্নান, স্বাধ্যায়, উপাসনা, অগ্নিহোত্র, বাণিজ্য, ব্যবহার ও ভোজনাচ্ছাদন হইতে আরম্ভ করিয়া রাত্রির শযযনকাল পর্যন্ত যাবতীয় কর্মের সহিত ধর্মের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বিদ্যমান রহিয়াছে। এইরূপ ধর্ম বলিতে কি বুঝায়?
"ধর্ম" শব্দের যৌগিক অর্থ "ধূ ধারণে" ধাতু হইতে ধার্যতে ইতি ধর্মঃ হইয়া থাকে। যাহা ধারণ করা যায়, তাহার নাম ধর্ম। এইরূপে অগ্নি আদি পদার্থের উষ্ণতাদি সমস্ত গুণই ধর্ম পদবাচ্য। উষ্ণতা অগ্নির ধর্ম। এইরূপে মনুষ্যের ধর্ম মনুষ্যত্ব এবং পশুর ধর্ম পশুত্ব বুঝায়।
মীমাংসা দর্শনে চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্মঃ- এই সূত্র হইতে বুঝা যায় যে চোদনা অর্থাৎ প্রেরণা অর্থই ধর্মের লক্ষণ বা প্রেরণা অর্থযুক্ত লক্ষণ যাহাতে পাওয়া যায়, তাহার নাম ধর্ম। এই সূত্রানুসারে এইরূপ বলা যাইতে পারে যে, যে সকল কর্ম করিবার জন্য বেদ হইতে প্রেরণা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার নাম ধর্ম। সেইজন্য আদি ধর্মশাস্ত্রকার মহর্ষি মনু বলিয়াছেন-
ধর্ম বলিতে কি বুঝায় ?
বেদোহখিলো ধর্মমূলং স্মৃতিশীলে চ তদ্বিদাম্।
আচারশ্চৈব সাধুনামাত্মনস্তুষ্টিরেব চ।।
বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ।
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষনম্।। মনুস্মৃতি ২।৬, ১২
ধৃতিঃ ক্ষমা দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রধো দশকং ধর্মলক্ষণম্।। মনুস্মৃতি ৬।৯২
অর্থাৎ (১) সমগ্র বেদ, (২) বেদবিৎগণের স্মৃতি ও শীল, (৩) সাধুহণের আচার এবং (৪) আত্মতুষ্টি সত্যভাষণাদি এইগুলি ধর্মের মূল। তিনি আরও বলিয়াছেন- "বেদ, বৈদিক স্মৃতি, সদাচার এবং আত্মপ্রসাদ এই চারিটিকে ধারণ করা বা মানিয়া চলার নাম ধর্ম। বেদ ও স্মৃতি অধ্যয়ন করিলে সাধজনের আচার ব্যবহার দর্শন করিলে বা তাহাদের জীবনী পাঠ করিলে এবং সত্ত্বগুণের আধিক্য বশতঃ সৎকর্ম করিবার জন্য আত্মায় যে প্রেরণা আসে, তাহাকেই ঋষি ধর্মের সাক্ষাৎ লক্ষণ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।" ধর্মের লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি আরও বিশদভাবে বলিয়াছেন- "ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য এবং অক্রোধ- এই দশটি ধর্মের লক্ষণ"। এইগলিকে হৃদয়ে ধারণ করার নাম ধর্ম। গীর্জা, মন্দির ও মসজিদের প্রাচীরের মধ্যে এগুলি আবদ্ধ থাকে না। এগুলি মানবজাতির হৃদয়ের ধর্ম। শুনিতে পাই, যে রাশিয়া ধর্মকে বর্জন করিবার জন্য এত আইনকানুন রচনা করিয়াছে, আজ সেই রাশিয়ার বিখ্যকত বীর সমরনায়ক স্ট্যালিনের হৃদয়েও ধর্মের অনেকগুলি লক্ষণ স্ফুরিত হইয়াছে। ধী, ধৃতি, ক্ষমা ও বিদ্যাদি গুনরাজিকে হৃদয়ে ধারণ করিয়াই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছেন- সন্দেহ নাই। আজ সমগ্র রাশিয়াবাসী সেই বীরের যজ্ঞে আত্মাহুতি প্রদান করিতেছে। ইহা হইতে বুঝা যায় যে আইনের বলে শত চেষ্টা করিয়াও তাহারা ধর্মকে বর্জন করিতে পারে নাই এবং ধর্মও তাহাদিগকে ত্যাগ করে নাই। যিনি বা যাহারা জগতে যত মহৎ মহৎ কার্য করিবেন, ধর্মও তাঁহাকে বা তাঁহাদিগকে ততোধিক ধারণ করিয়া থাকিবেই থাকিবে। মনুপ্রোক্ত দশটি লক্ষণের প্রত্যেকটিকে যদি বর্জন করা যায়, তাহা হইলে জগত হইতে মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। সুতরাং ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিবার কোন উপায় নাই। যাঁহারা বলেন" আমরা ধর্ম মানিনা, ধর্মকে বাদ দিয়া যাহা কিছু ভাল কাজ, তাহাই করি; " তাহাতে আমরা বলি- "তাঁহাদের এবম্বিধ উক্তগুলি নিতান্ত অযৌক্তিক। ধর্মেক তাহারা কিস্তৃত কিমাকার বস্তুবিশেষ বলিয়া মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে তাহারা ধর্ম শব্দটির সত্যার্থ হৃদঙ্গম করিবার চেষ্টা করেন নাই। যাহা হউক, দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র বা স্বীয় আত্মার সর্বাঙ্গীন কল্যাণার্থ যাহা কিছু শুভ কর্মের অনুষ্ঠান করা যায়, অথবা স্বীয় আত্মায় যদ্দ্বারা শুভ কর্মের প্রেরণা উদ্দীপিত হয়, তাহার নাম ধর্ম। প্রত্যেক ব্যক্তি কিছু না কিছু সৎ কর্ম করিয়া ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকে। ধর্মকে সে ত্যাগ করিতে পারে না এবং ধর্মও তাহাকে ত্যাগ করে না। ধর্মের সহিত জীবের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। ধর্ম হইতেছে প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ, যাহার অভাবে সেই জীব বা বস্তুর অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। যথা- অগ্নির ধর্ম উত্তাপ এবং ঔজ্জ্বল্য, জলের ধর্ম শৈত্য ও তারল্য, মানবের ধর্ম মনুষ্যত্ব বা মননশীলতা এবং পশুর ধর্ম পশুত্ব। সেইজন্য মহাভারতকার ঋষি বলিয়াছেন-
ধারণাৎ ধর্মঃ ইত্যাহুঃ ধর্মো ধারয়তি প্রজাঃ।
অর্থাৎ ধার্ণ বা পোষন করাকেই ধর্ম বলা হয়। ধর্মই সমূহ জীবকে ধারণ বা পালন করিয়া থাকে। অগ্নি যেমন স্বীয় ধর্ম- উত্তাপ ও ঔজ্জ্বল্যকে ধারণ না করিয়া পরিত্যাগ করে, তখন যেমন অগ্নি নামক পদার্থের অস্তিত্ব থাকে না, তেমনই মনুষ্য যদি পূর্বকথিত ধর্মের মূল বা ধর্মের লক্ষণগুলিকে ধারণ না করিয়া সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে, তাহা হইলে মনুষ্য নামক জীবের অস্তিত্বই থাকিবে না।
ত্রিবৃৎ বেদ, স্মৃতি ও সদাচার যখন ধর্মের মূল এবং সেগুলিকে ধার্ণ করিয়া বা মানিয়া চলার নাম যখন ধর্ম হইয়াছে, তখন সেই বেদ ও স্মৃতিপ্রতিপাদিত এবং ঋষিগণের আচরিত ত্রিবৃৎ পৈতা (ত্রিবৃত তন্ত্র) ধারণ করাও যে ধর্ম, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। অবশ্য ইহা ধর্মের বাহ্য চিহ্নমাত্র। শুভ মনোরম পোশাকপরিচ্ছদ যেমন মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তদ্রুপ এই বাহ্য ধর্ম চিহ্নটিও মনের উপর ধর্মের প্রতিক্রিয়া সিঞ্চন করে। সুতরাং পৈতাকে কোন মতে ত্যাগ করা মনুষ্যত্বের পরিচায়ক নহে। বেদাধ্যয়নের জন্য যে জন্মলাভ হয়, যাহাকে ব্রহ্মজন্ম বা বৈদিক দীক্ষা বলা হয়, তাহা একমাত্র যজ্ঞোপবীত দ্বারাই চিহ্নিত হইয়া থাকে ইহাই ধর্মশাস্ত্রের বিধি সেইজন্য ত্রিবৃৎ বেদ ও ত্রিবৃৎ ব্রহ্মকে স্মরণ রাখিবার উদ্দেশ্যেই ত্রিবৃৎ পৈতা ধারণের বিধিও নিরূপিত হইয়াছে। এই পৈতা ধারণ হইতেই ব্রহ্মচর্য
ব্রতানুষ্ঠানরূপ কঠোর তপশ্চরণ সূচিত হয়। যথা-
তপস্যা কাহাকে বলে?
ঋতং তপঃ সত্যং তপঃ শ্রুতং তপঃ শান্তং তপোদমস্তপশশমস্তপো দানং তপো যজ্ঞস্তপো ব্রহ্মভূর্ভুবঃ সুবব্রহ্মৈতদুপাস্বৈতত্তপঃ।। তৈত্তিরীয়ারণ্যক ১০।৮
অর্থাৎ হে শিষ্য! তুমি সর্বদা যথার্থের গ্রহণ, সত্যের মনন, সত্যের কথন, সত্যের অনুষ্ঠান, বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও শ্রবনে রত থাকিয়া মনকে কদাপি অধর্মাচরণে প্রবৃত্ত হইতে দিবে না। শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণকে দুরাচার ও দূর্ব্যবহার হইতে নিবৃত্ত করিয়া শ্রেষ্ঠাচারে প্রবৃত্ত করিবে। ক্রোধাদি পরিত্যাগপূর্বক সদা শান্তিচিত্ত থাকিবে। স্বয়ং বিদ্যালাভ করিয়া অপরকে বিদ্যাদি শুভ গুণদানে রত থাকিবে। অগ্নিহোত্র ও বিদ্বানগণের সহিত সৎসঙ্গ করিবে। পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও সূর্যাদি লোকস্ত সমুদয় পদার্থের জ্ঞান ও বিজ্ঞান আহরণে যথাশক্তি চেষ্টা করিবে। যোগাভ্যাস, প্রাণায়াম ও একমাত্র পরব্রহ্ম পরমাত্মারই উপাসনা করিবে। এইসব কর্মকে তপ কহে। পইতার (পবিতার) মূলে এইসব পবিত্রাচারণরূপ তপস্যার ইঙ্গিত লুকায়িত আছে। যাহা হউক, পৈতাকে ত্রিবৃৎ (তিন তার) বলিবার আরও বহু কারণ আছে। নিম্নে যেসকল ত্রিবিধ রহস্য বিস্তৃত হইল (পূর্বেও বলা হইয়াছে), তৎপ্রতি সমাহিত চিত্তে দৃষ্টিপাত করুন-
যজ্ঞোপবীতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি
যজ্ঞোপবীতের তিন গাছি সুতা এইরুপে সর্বথা তথা সর্বদা বহুভাবে ত্রিবিধ তত্ত্বকথা স্মরণ করাইয়া দেয় এবং সেইগুলি স্মরণ রাখিয়া কর্তব্য পথে অগ্রসর হইবার জন্য স্মারক চিহ্নরূপে ইহাকে অবশ্যই ধারণ করিতে হয়। ইহা সমাজের আশ্রমিক নিয়ম, শৃঙ্খলা ও জ্ঞানের প্রবর্তক। যথাক্রমে তিনটি আশ্রমে বাস করিয়া জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনা যোগের সাহায্যে ধর্মমার্গের সর্বোচ্চ স্তরে (চতুরাশ্রমে) উপনীত হইলে শিখাসূত্ররূপ আশ্রমিক বন্ধন পরিত্যক্ত হয়।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে প্রত্নতত্ত্ববিৎ মনীষীগণের মতে বেদ মানব সভ্যতার মূল প্রস্রবন। আর্য ঋষিগণ বেদকে অপৌরুষেয়, স্বতঃপ্রমাণ ও সর্বপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বলিয়া স্বীকার করেন। সেই বেদ ও বৈদিক স্মৃতি শাস্ত্রাদি অনুসারে বর্তমানের প্রচলিত যে কোন জাতিরই সন্তান যথাকালে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া উপনয়ন ধারণ করিতে পারে। যাঁহারা এখনও উপনয়ন হইতে বঞ্চিত আছেন, বা ভ্রমবশতঃ পৌরাণিক সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া জীবনযাপন করিতেছেন, অথবা যাঁহারা আজও নিজদিগকে অস্পৃশ্য জাতি বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছেন, তাঁহারা সকলে বিধি অনুসারে বৈদিক দীক্ষা গ্রহণ করিয়া একই যজ্ঞ (Union) ভূমির বৈদিক পতাকাতলে সমবেত হইলে ধার্মিক রাষ্ট্রিক ও সামাজিক মর্যাদার সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রকৃত স্বর্গ সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। ইত্যোম্-
শান্তি! শান্তি! শান্তি!
এই বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ প্রণীত সংস্কার নিষিতে প্রমাণকরণে নিম্নোক্ত মন্ত্র উদ্ধৃত হইয়াছে-
যেনা সহ্যাং বহসি যেনায়ে সর্ববেদসস্।
তেনেমং যতং নো বহু স্বদেবেহু গন্তবে।। অর্থর্ববেদ ৯১৫।১৭
অর্থাৎ যে বিশ্বান। অগ্নি যন্দারা সমগ্র সংসার ধারণ করিয়া থাকে এবং তুমি যন্ধারা (সর্ববেদসম) গৃহস্থাতামন্থ পদার্থমোহ, যজ্ঞোপবীত এবং শিখা আদিকে ধারণ করিতেছ, তৎসমূদয় পরিত্যাগ করিয়া বিশ্বানগণের নিকট গমনার্থ আমাদের এই সন্ধ্যাসরূপ সুনস্বরূপ যন্ত্রকে প্রাপ্ত হও। এই মন্ত্রের উপর মহর্ষি মযুক্ত বচন উদ্ধৃত হইয়াছে-
প্রাজাপত্যাং নিরপ্যোটিং সর্ববেদসদক্ষিণাম্।
আজন্যমীণ সমারোপ্য ব্রাহ্মণঃ প্ররজেৎ গৃহাৎ।। মনুস্মৃতি ৬।৩৮
প্রজাপতি পরমাত্মার প্রাপ্তির জন্য প্রাজাপত্যেটি (যাহাতে যজ্ঞোপবীত ও শিখা পরিত্যক হয়) করিয়া আহবনীয়, গার্হপত্য ও দাক্ষিণাত্যসংজ্ঞক অগ্নিবয়কে আত্মাতে সমারোপিত করিয়া ব্রাহ্মণ অর্থাৎ বিশ্বান গৃহালম হইতে নির্গত হইয়া সন্ন্যাসী হইবে।
সন্ন্যাস গ্রহণকালে মৌনাবলম্বনপূর্বক শিখার সমস্ত কেশ কর্তন এবং যজ্ঞোপবীত উন্মোচন করিয়া অন্তলিপূর্ণ ফলসহ-
এই মন্ত্র বলিয়া অগুলিস্থ জলসহ শিবা ওমাপো বৈ সর্বী দেবতাঃ স্বাহা।। ও পূঃ স্বাধা।। বলিয়াছেন-
ও যজ্ঞোপবীত জলে নিক্ষেপ করিবে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের বচন উদ্ধৃত কনিয়া মহর্ষি
সর্ববেদসং বা এজৎ সত্রং।। তৈরিঃ ১০।৬৮
অর্থাৎ (সর্ববেদসং বৈ) যাহাতে সর্বস্ব দক্ষিণা অর্থাৎ শিখাসূত্র ধরোপবীত আদি পূর্বাশ্রমগুলির চিহ্নসমূহকে ত্যাগ করিতে হয়, (এতৎ সত্রম)
তাহাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ যজ্ঞ (সন্ধ্যাস প্রকরণম)। ব্যাখ্যানবাচস্পতি রাজত্বে পড়িত আত্মারাম বলিয়াছেন- "বর্জনের প্রয়োজন এই যে শিবা ও সূত্র ধারণের যে উদ্দেশ্য, তামা তিনটি আলমে পূর্ণ হইয়া থাকে (সংস্কার-চন্দ্রিকা, সন্ন্যাস সংস্কার ব্যাখ্যা)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ