বৈদিক ভৌতিকী - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

28 December, 2022

বৈদিক ভৌতিকী

বৈদিক ভৌতিকী

অনুক্রমণিকা 

1. পরিভাষা 

2. সৃষ্টির জ্ঞান কেন আবশ্যক

3. ব্রহ্মাণ্ডের প্রারম্ভিক অবস্থা

4. কাল কি?

5. সৃষ্টি উৎপত্তির প্রারম্ভিক চরণ

6. রশ্মি এবং তাদের গুণ 

7. ছন্দ রশ্মির বর্গীকরণ

8. আকাশ

9. বিভিন্ন প্রকারের বল

10. গুরুত্ব বল

11. আবেশের স্বরূপ

12. তরঙ্গাণু ও মূলকণার উৎপত্তি

13. ঊর্জা 

14. অসুর পদার্থ এবং অসুর ঊর্জা

15. দ্রব্যমান এবং তার কারণ

16. তরঙ্গাণু

17. তারার নির্মাণ

18. বিদ্যুত্ চুম্বকীয় তরঙ্গ 

19. মহাপ্রলয়


সর্বপ্রথম আমরা এই পুস্তকের মধ্যে কিছু মহত্বপূর্ণ পরিভাষাকে জানার চেষ্টা করবো, যাতে পরবর্তী অধ্যায়ে   আপনাদের কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়।

১.১ বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত

বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত হল বৈদিক ভৌতিক বিজ্ঞানের সেই অঙ্গ, যার অন্তর্গত বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ আদি রশ্মির অর্থাৎ কম্পনের দ্বারা কণা, তরঙ্গাণু (Quanta) এবং আকাশ (space) আদি নির্মাণের প্রক্রিয়া, রচনা এবং তাদের গুণের অধ্যয়ন করা হয়। এর সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের দ্বারা সৃষ্টির মূল অবস্থা থেকে তারা পর্যন্ত নির্মাণের প্রক্রিয়াকে বিস্তারভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে বর্তমান ভৌতিকের যেকোনো সিদ্ধান্তের তুলনায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম, বিস্তৃত এবং তর্ক সঙ্গত। এই সিদ্ধান্তের মূল আধার হল ঋগ্বেদের ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, যাকে সহস্র বর্ষের পশ্চাৎ পূজ্য গুরুবর আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক জী বছরের পর বছর কঠোর সাধনার পর বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ এর রূপে স্থাপিত করেছেন।


১.২ রশ্মি কাকে বলে?

মহর্ষি য়াস্কের অনুসারে, সেই সূক্ষ্ম কম্পন, যে নিজের তুলনায় স্থূল কম্পনকে উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত করে, তাকে রশ্মি বলে। রশ্মির মধ্যে সবথেকে সূক্ষ্ম পরা "ওম্" রশ্মি প্রকৃতির সাম্যাবস্থাকে, যারমধ্যে প্রকৃতির তিন গুণ (সত্, রজ আর তম) এর পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা থাকে, তাকে ভঙ্গ করে।


সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড (সমস্ত কণা, তরঙ্গ, আকাশ আদি) এই রশ্মির দ্বারাই নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত। যেকোনো রশ্মি বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা জানা গেছে এমন যেকোনো তরঙ্গের তুলনায় সূক্ষ্ম।

বৈদিক ভৌতিকী

১.৩ বাক্ রশ্মির (বাণী) চারটি রূপ

1. পরা - পরা বাণী হল সব বাণীর মধ্যে সবথেকে সূক্ষ্ম আর মূল। এটা হল এক এরকম সূক্ষ্ম বাণী, যে সর্বাধিক সূক্ষ্ম, সর্বত্র ব্যাপ্ত, অত্যধিক মাত্রা তথা সর্বদা অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান, সকলকে নিজের সঙ্গে বন্ধনকারী, কিন্তু স্বয়ং সবার থেকে মুক্ত এবং সবথেকে উচ্চতম অবস্থার। এই সূক্ষ্ম বাণীকে কান দিয়ে কখনও শোনা সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সূক্ষ্মতম রূপে ব্যাপ্ত থেকে প্রত্যেক কণাকে নিজের থেকে সমন্বিত রাখে। একে অত্যুত্কৃষ্ট য়োগী পুরুষই অনুভব করতে পারে। একে বর্তমানের যেকোনো বৈজ্ঞানিক টেকনিক দিয়ে জানা সম্ভব নয়। মানুষ যেই বৈখরী বাণীকে শোনে বা শোনায়, সেই বাণী আত্ম তত্ব দ্বারা পরা অবস্থাতেই গ্রহণ বা উৎপন্ন করা হয়। এই বাণীর মাধ্যম হল প্রকৃতি (সৃষ্টির সবথেকে মূল উপাদান পদার্থ)।


2. পশ্যন্তী - এই বাণী পরা বাণীর অপেক্ষায় স্থূল তথা এটা বিভিন্ন বর্ণকে তার স্বরূপ প্রদান করে বীজের সমান হয়। এটা পরা বাণীর থেকে স্থূল এবং মধ্যমার থেকে সূক্ষ্ম হয়। পশ্যন্তী বাক্ মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হয় আর এটাই হচ্ছে এর আধার এবং মাধ্যম। সমস্ত প্রাণ ও ছন্দ রশ্মিগুলো এই বাক্ তত্ত্ব দ্বারাই এবং এই মনস্তত্ত্বের মধ্যেই উৎপন্ন হয়। সম্ভবতঃ এই বাণীকে ভবিষ্যতে কোনদিন কোনো সূক্ষ্ম টেকনিক দিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি কান দিয়ে কোনো কথা শোনে, তখন কানের তন্ত্রিকার দ্বারা সংবেদনা মস্তিষ্ক পর্যন্ত পুনঃ মনস্তত্ত্বে পৌঁছায়। সেই সংবেদনার মধ্যে বর্ণ বিদ্যমান থাকে। মনের সহযোগ দ্বারা মস্তিষ্ক বর্ণের শনাক্তকরণ করে। সেই বাণীই হল পশ্যন্তী, যা কান দিয়ে তো শোনা যায় না, কিন্তু মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনস্তত্ত্ব যাকে অনুভব করে।


3. মধ্যমা - এই বাক্ -কে পশ্যন্তীর থেকে স্থূল ও বৈখরীর থেকে সূক্ষ্ম মানা হয়। এরমধ্যে বর্ণের রূপ পশ্যন্তীর অপেক্ষায় স্থূল এবং বৈখরীর অপেক্ষায় সূক্ষ্ম হয়। কর্ণপটহে যে ধ্বনি শোনা যায়, সেটা যে স্বরূপকে প্রাপ্ত করে, তাকে মধ্যমা বলে। মস্তিষ্ক ও কানের মাঝে যেই বাণীর সঞ্চরণ হয়, এটা হচ্ছে সেটাই। এই বাণীর মাধ্যম হল আকাশ তত্ত্ব (space)।


4. বৈখরী - এটা হল সেই স্থূল বাণী, যাকে আমরা বলি ও শুনি। এই বাণীটাই বক্তা ও শ্রোতার মাঝে গমন করে, যা শেষে শ্রোতার মস্তিষ্কে গিয়ে পশ্যন্তীর রূপ নেয়। অর্থাৎ যখন কোনো মানুষ বাণীর উচ্চারণ করে, তখন সামনের বক্তার মুখ থেকে আমাদের কান পর্যন্ত আসা বাণীটা হল বৈখরী, কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত যেটা যায় সেটা হল মধ্যমা, মস্তিষ্ক থেকে মন যেই রূপে গ্রহণ করে, সেটা হল পশ্যন্তী আর মন থেকে চেতন স্বরূপ আত্মা এটাকে পরা রূপে গ্রহণ করে।


উচ্চারণ করার সময় সর্বপ্রথম বাক্ (বাণী) আত্মার ভিতর উৎপন্ন হয়ে মন পর্যন্ত যেই রূপে যায়, সেটা পরা বাণী বলে। মন বা বুদ্ধি সেই পরা বাণীকে পশ্যন্তীতে পরিবর্তন করে দেয়। মস্তিষ্ক পর্যন্ত এটা পশ্যন্তী রূপে প্রেরিত হয়। এর পশ্চাৎ মস্তিষ্ক সেই বাণীকে মধ্যমা স্বরূপে পরিবর্তন করে আর তন্ত্রিকায়ের মাধ্যমে সেই বাণী আমাদের স্বরযন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছায়। শেষে স্বরযন্ত্র সেই মধ্যমা বাণীকে বৈখরীতে পরিবর্তন করে দেয়। এর মাধ্যম হল স্থূল পদার্থ (শক্ত, দ্রব্য, গ্যাস আদি)। এই বাণী চাপের মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে প্রেরিত হয়।

বৈদিক ভৌতিকী

এখানে বাণীর এই পরিবর্তন সেই ভাবে হয়, যেভাবে ধ্বনি ধ্বনিগ্রাহী (মাইক্রোফোন) দিয়ে বিদ্যুৎ সংকেত (ইলেকট্রিক সিগনাল) আর তারপর বিদ্যুৎ সংকেত ধ্বনি-বিস্তারক (লাউস্পিকার) দিয়ে পুনঃ ধ্বনির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

১.৪ বাক্

সামান্য ভাষায় একে ধ্বনি বলা হয়। এটা হল সেই প্রথম কম্পন, যা সৃষ্টির মূল উপাদান পদার্থের মধ্যে চেতন তত্ত্ব দ্বারা উৎপন্ন হয়। একে আমরা পরা বাণী রূপে পরিভাষিত করে এসেছি। এই কম্পন অর্থাৎ রশ্মি হল এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ ও সঞ্চালনের মধ্যে নিয়ন্ত্রক। এই কম্পনের পূর্বে কোনো ধরনের কোনো স্পন্দনের কল্পনা সম্ভব না। অন্য সব রশ্মি হল এরই বিভিন্ন রূপ।

১.৫ ছন্দ 

আচ্ছাদন আর বল দেয় এরকম রশ্মিগুলোকে ছন্দ রশ্মি বলে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সমস্ত রশ্মি কাউকে-না-কাউকে আচ্ছাদিত করে আছে আর বল প্রদান করে, তাই সব রশ্মিকে ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মিগুলো হচ্ছে বাক্-এরই রূপ। সৃষ্টির মধ্যে এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্ত্রী রূপ ব্যবহার করে।

১.৬ প্রাণ রশ্মি

যে রশ্মি বল, গতি আর প্রকাশ দেয়, তাদের প্রাণ রশ্মি বলে। সমস্ত ছন্দ রশ্মির গুণ প্রাণ রশ্মির মধ্যে আর সমস্ত প্রাণ রশ্মির গুণ ছন্দ রশ্মির মধ্যে থাকে, এই কারণে মূলতঃ এটাও হচ্ছে বাক্ রশ্মিরই বিশেষ রূপ। ছন্দ রশ্মির প্রতি এর বিশেষ আকর্ষণ ভাব থাকে আর এটা তাদের সাপেক্ষে পুরুষ রূপ ব্যবহার করে।


মরুত্

ছোটো ছন্দ রশ্মিকে মরুত্ বলে। প্রাণ রশ্মির প্রতি এরও আকর্ষণ ভাব থাকে আর এটা তাদের সাপেক্ষে স্ত্রী রূপ ব্যবহার করে। এই রশ্মি সমূহতে গমন করে।


 সোম 

সোম রশ্মি মরুত্ রূপই হয়। এটা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অপ্রকাশিত অবস্থার মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং বিদ্যুৎ আবেশিত তরঙ্গ আকাশে গমন করার সাথে সোম রশ্মিগুলোকে অবশোষিত করে থাকে। এর তাপমাত্রা অনেক কম হয়।


ঊর্জা 

বৈদিক ভৌতিকীর অনুসারে যারমধ্যে বল ও গতি উভয় বিদ্যমান হবে অথবা যারমধ্যে কার্য করার ক্ষমতা বিদ্যমান হবে, তাকে ঊর্জা বলে। [ঊর্জ বলপ্রাণনয়োঃ]

বৈদিক ভৌতিকী

নিমিত্ত কারণ

যার নির্মাণের দ্বারা কিছু নির্মিত হয় আর না নির্মাণের দ্বারা নির্মিত হয় না অর্থাৎ কোনো কার্যের চেতন কর্তা এটা মুখ্য নিমিত্ত কারণ বলা হয়। এর অতিরিক্ত কিছু এরকম সাধন, যা কোনো কার্যে সহায়ক হয়, তাকেও সাধারণ নিমিত্ত কারণ বলে। যেরকম স্বর্ণ আভূষণ নির্মাণে স্বর্ণকার মুখ্য নিমিত্ত কারণ তথা তার উপকরণ ও গ্রাহক সাধারণ নিমিত্ত কারণ বলা হয়। 

 উপাদান কারণ

যে পদার্থ দিয়ে কোনো কর্তা কোনো পদার্থের নির্মাণ করে, তাকে উপাদান কারণ বলে। যেরকম স্বর্ণ আভূষণ বানাতে সোনা রূপার মতো ধাতু হল উপাদান কারণ অর্থাৎ আভূষণ বানানোর সামগ্রী।


বিদ্যা

যা দিয়ে পদার্থের স্বরূপ যথাযথ জেনে তারথেকে উপকার নিয়ে নিজের আর অন্যের জন্য সমস্ত সুখকে সিদ্ধ করা যায়, তাকে বিদ্যা বলে। [ব্যবহারভানু, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী]


 বিজ্ঞান

বিজ্ঞান তাকে বলে যা কর্ম, উপাসনা আর জ্ঞান এই তিন বিষয় দ্বারা যথাযথ উপযোগ নেওয়া আর পরমেশ্বর থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত পদার্থের সাক্ষাৎ বোধ হওয়া, তার দ্বারা যথাযথ উপযোগ নেওয়া। [বেদ বিষয় বিচার - ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী]


এর দ্বারা সিদ্ধ হচ্ছে যে যেই জ্ঞান দ্বারা নিজের অথবা যেকোনো অন্য প্রাণীর তৎকালিক অথবা দূরগামী হানি পৌঁছায়, তাকে বিদ্যা অথবা বিজ্ঞান বলে না।


 প্রকাশিত কণা 

এরকম কণা, যারমধ্যে নিজের প্রকাশ আছে। যেমন - প্রকাশাণু (ফোটন) এবং অন্য তরঙ্গাণু আদি।


অপ্রকাশিত কণা 

এরকম কণা, যারমধ্যে নিজের প্রকাশ অতি ন্যূন হয়। যেমন - ইলেকট্রন, প্রোটন, কোওয়ার্ক আদি।


 তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) 

প্রকাশের অতিরিক্ত যেকোনো অন্য তরঙ্গ কণা রূপে ব্যবহার করে, সেই কণাকে এই পুস্তকে তরঙ্গাণু বলা হয়েছে।


 প্রকাশাণু (ফোটন)

যখন প্রকাশ কণা রূপে ব্যবহার করে, সেই কণাকে এই পুস্তকে প্রকাশাণু বলা হয়েছে।


 পদার্থ বা তত্ত্ব

বাস্তবে যার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে, তাকে পদার্থ বলে। মহর্ষি কণাদ -এর অনুসারে জড় দ্রব্যের যেকোনো অবস্থা তার গুণ, কর্ম, সংযোগ, বিভাগ আদি সকলকে পদার্থ বলে। ঈশ্বর, আত্মা, মন, কাল, দিশা এবং এদের গুণ তথা কর্মকেও পদার্থ বলে অর্থাৎ এই সৃষ্টির মধ্যে যাকিছু বিদ্যমান আছে, তার নাম হল পদার্থ।

আমরা সবাই রাত-দিন, যেসব আমাদের চারদিকে পরিবেশে দেখি, পৃথিবী এবং তার উপর বিদ্যমান সমস্ত পদার্থ, পৃথিবীর মতো অনেক গ্রহ, তাদের উপগ্রহ, বিভিন্ন তারা, কোটি-কোটি গ্যালাক্সি অর্থাৎ যা কিছু জড় পদার্থ আমরা দেখতে পাই অথবা নাও দেখতে পাই, সেইসব হল সৃষ্টিরই অঙ্গ আর এইসব পদার্থকে মানুষ আদি কাল থেকেই জানার চেষ্টা করছে। এখন প্রশ্ন এটা উঠছে যে সৃষ্টির জ্ঞান কেন আবশ্যক? এই প্রশ্নের উত্তর জানার পূর্বে আমরা জানবো যে সংসার কোন পদার্থ দ্বারা নির্মিত হয়েছে?


২.১ সৃষ্টির মূল কারণ 

সংসার নিম্ন দুই প্রকারের পদার্থ দ্বারা মিলে নির্মিত হয়েছে -

1. যে পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ অর্থাৎ যার দ্বারা মিলিত হয়ে এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে।

2. অন্য সেই পদার্থ, যা এই সৃষ্টির উপাদান কারণ না হয়ে কেবল নিমিত্ত কারণমাত্র।


এরমধ্যে প্রথম প্রকারের পদার্থ হল জড় তথা দ্বিতীয় প্রকারের পদার্থ হল কিছু জড় তথা কিছু চেতন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সৃষ্টির পরিভাষা করে "আর্য়োদ্দেশ্যরত্নমালা"-তে লিখেছেন -

"যা কর্তার রচনা দ্বারা কারণ দ্রব্য কোনো সংযোগ বিশেষ দ্বারা (অর্থাৎ যে কারণ দ্রব্য কর্তার দ্বারা রচনা রূপ হয়ে) অনেক প্রকার কার্যরূপ হয়ে বর্তমানে ব্যবহার করার যোগ্য হয়, তাকে "সৃষ্টি" বলে।"


"স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ"-এ পুনঃ মহর্ষি দয়ানন্দ লিখেছেন -

"সৃষ্টি তাকে বলে, যা পৃথক্-পৃথক্ দ্রব্য সমূহের জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক মিলিত হয়ে নানারূপে গঠিত হয়।"


এই দুই পরিভাষার উপর বিচার করলে নিম্নলিখিত নিষ্কর্ষ প্রাপ্ত হয়ে যায় -

1. সৃষ্টির পদার্থকে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। তার যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারবে। বিনা যথার্থ বিজ্ঞানে যেকোনো পদার্থকে উচিৎ ব্যবহারে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না, এই কারণে পদার্থ বিজ্ঞান অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টি বিজ্ঞান সংসারে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অনিবার্য। সৃষ্টিকে জানা অনৈতিক নয়, বরং এটা ব্যবহারে নিয়ে এসে সকলের উপকার করার জন্যই। সৃষ্টির সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম ও স্থূল থেকে স্থূল পদার্থ অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা এবং তার থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণাদি পদার্থ থেকে বিশাল লোক লোকান্তর সবকিছুর যথার্থ বিজ্ঞানকে সাক্ষাৎ করে তাকে সবার হিতের জন্য উপযোগ করা উচিত। এটাই হচ্ছে সৃষ্টির প্রয়োজন।


2. সৃষ্টি কোনো কারণ পদার্থ দ্বারা নির্মিত হয়েছে। সেই কারণ পদার্থ হল অনাদি ও অনন্ত। সেটা না কখনও নির্মিত হয় আর না নষ্ট হয়। সেই পদার্থের ভাব সর্বদাই থাকে, সেটা শূন্য বা অবস্তু নয়, আর এটাই মহান্ তত্ববেত্তা মহর্ষি কপিল বলেছেন যে -

               নাবস্তুনো বস্তুসিদ্ধিঃ। (সাং০ দ০ 1.78)

অর্থাৎ - অভাব থেকে ভাবের উৎপত্তি হয় না। একেই য়োগেশ্বর মহান্ বেদবিজ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। (গীতা 2.16)

অর্থাৎ - অসত্ -এর কখনও অস্তিত্ব হয় না আর সত্তাবান্ -এর কখনও বিনাশ হয় না। এর মানে হচ্ছে শূন্য (nothing) থেকে কখনও কোনো বস্তুর উৎপত্তি হওয়া সম্ভব না তথা যে বস্তু বিদ্যমান আছে, তারও কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না। সংসারের মধ্যে যদি কোনো সত্তাবানের বিনাশ তথা বিনা কোনো কারণ দ্রব্যে কোনো বস্তুর উৎপত্তি দেখা বা শোনা যায় তার যথার্থ হচ্ছে এটাই যে -

                 নাশঃ কারণলয়ঃ। (সাং০ দ০ 1.121)

অর্থাৎ - স্থূল পদার্থ নিজের কারণভূত সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে লয় বা পরিবর্তন হয়ে যাওয়াকেই বিনাশ বলে। এই ভাবে বস্তুর বিনাশ বাস্তবে হয় না, বরং তার রূপ এতই সূক্ষ্ম হয়ে যায় যে তার বোধ আমাদের হয় না, একেই বিনাশ বা প্রলয় বলে। এর বিপরীত যখন সেই অদৃশ্য, অস্পৃশ্য, অবিজ্ঞেয় কারণ পদার্থ স্থূল রূপে পরিবর্তিত হয়ে কোনো বস্তুর নির্মাণ হতে দেখা যায়, তাকেই কোনো বস্তুর উৎপন্ন হওয়া মানা হয়। বস্তুতঃ সৃষ্টি ও প্রলয় হচ্ছে পদার্থের দুই প্রকারের অবস্থার নাম। এটাও ধ্যানে রাখার যোগ্য যে এই সৃষ্টি-প্রলয় বা কার্য-কারণ (cause and effect) অবস্থাও সাপেক্ষ হয়। এক পদার্থ অন্য কোনো পদার্থের উপাদান কারণ হতে পারে, আবার সেই পদার্থই অন্য কোনো সূক্ষ্ম পদার্থের কার্যরূপও হতে পারে। উদাহরণের জন্য জলের অণু হল জলের উপাদান কারণ, কিন্তু হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের অণু হচ্ছে জলের অণুর উপাদান কারণ। এইভাবে জলের অণু, জলের উপাদান কারণ এবং হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের অণুর কার্যরূপ।


২.২ সৃষ্টি একটি অতি বুদ্ধিমত্তাপূর্বক রচনা

 সৃষ্টি পৃথক-পৃথক সূক্ষ্ম পদার্থের সংযোগ বিশেষ দ্বারা তৈরী হয়েছে। এখানে "বিশেষ" শব্দ এটা বলছে যে সৃষ্টির বিভিন্ন পদার্থের (সূক্ষ্ম বা স্থূল) নির্মাণ য়দৃচ্ছয়া সংযোগ (random combination) দ্বারা হয়নি, বরং জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক সম্যক্ সংযোগ দ্বারাই হয়েছে। সংসারের মধ্যে যদি কোনো ব্যবস্থা আমরা য়দৃচ্ছয়া অর্থাৎ অব্যবস্থা রূপে দেখতে পাই, সেটা আমাদের অল্পজ্ঞানের কারণেই আমাদের প্রতীত হয়, অথচ সেই অব্যবস্থার ভিতরেও একটা সুন্দর উদ্দেশ্য পূর্ণ ব্যবস্থা থাকে, যাকে আমরা নিজের অল্প জ্ঞানের কারণে জানতে পাই না। সমস্ত সৃষ্টি হচ্ছে পূর্ণ ব্যবস্থিত, জ্ঞানপূর্বক নির্মিত, জ্ঞানপূর্বক ও উদ্দেশ্যপূর্ণ সঞ্চালিত। আমাদের অনুভবে যা কিছু আসে অথবা আসে না, সেইসব কিছু নিয়মবদ্ধ হয়ে কার্য করে এবং উৎপন্নও সেই নিয়মের অনুকূলই হয়। সংসারের মধ্যে যেকোনো প্রক্রিয়া বিনা নিয়মে কার্য করে না। একথা পৃথক যে আমরা সেই নিয়মগুলোকে পূর্ণরূপে কখনও জানতে পারি না। একথাটাই প্রসিদ্ধ আমেরিকান বৈজ্ঞানীক রিচার্ড পী০ ফাইনম্যান-ও স্বীকার করেছেন -

বৈদিক ভৌতিকী

"We can imagine that this complicated array of moving things which constitutes "the world" is something like a great chess game being played by the God, and we are observers of the game. We do not know what the rules of the games are; all we are allowed to do is to watch the playing. Of course, if we watch long enough, we may eventually catch on to a few of the rules. The rules of the game are what we mean by fundamental physics. Even if we knew every rule, however, we might not be able to understand why a particular move is made in the game, merely because it is too complicated and our minds are limited."

[Page No.13, Lectures on Physics]


এর মানে হচ্ছে "সম্পূর্ণ সংসার" হল পরমাত্মার খেলা। সংসারের ভৌতিকীর সব নিয়ম হচ্ছে সেই খেলার নিয়ম। আমরা সেই সব নিয়মকে জানতে পারি না। আমরা সেগুলোকে কেবল দেখতেই পাই। আমরা সেই নিয়মগুলোকে বানাতে পারি না। আমরা নিয়মের যতটা অংশকে জানি, ততটুকুই আমাদের বিজ্ঞান বিকশিত মানা যেতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক সীমিত সমর্থ হওয়ায় সংসারের জটিল নিয়মকে পূর্ণতঃ কখনও জানতে পারে না।" সৃষ্টিকে জানার সীমা জিজ্ঞাসুর বুদ্ধি আর তার দ্বারা প্রয়োগে নিয়ে আসা টেকনিক্যাল সংসাধনের উপর নির্ভর করে। এই কারণে ভৌতিকীতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া সর্বদা জারি থাকবে।


মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস-এর বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে সৃষ্টির সমস্ত ক্রিয়া নিশ্চিত ক্রম এবং ব্যবস্থার অনুসারে চরণবদ্ধ ও নিয়মবদ্ধ রীতি দ্বারাই প্রারম্ভ ও সঞ্চালিত হয়। অগোছালো পদ্ধতিতে সৃষ্টির মধ্যে কোনো নির্মাণ কার্য হওয়া সম্ভব নয়। মূল কণার উৎপন্ন হওয়া, তারা, বিভিন্ন তরঙ্গ ও কণা, বিভিন্ন নেব্যুলাদি মেঘ আদি সমস্ত পদার্থ, অণু বা পরমাণু আদির নির্মাণ আদি সবকিছুই নিশ্চিত নিয়মে, চরণবদ্ধ ও ব্যবস্থিত ক্রমের অনুসারে হয়। চেতন তত্ত্বের নিয়মের অনুসারে সৃষ্টি হেতু সমস্ত আবশ্যক তত্ত্বের নির্মাণও চরণবদ্ধ রীতি দ্বারা হতে থাকে।


২.৩ সৃষ্টির মধ্যে অনিশ্চিত কিছুই নেই

প্রসিদ্ধ জার্মান বৈজ্ঞানিক হাইজেনবার্গ-এর অনুসারে "কোনো গতিমান কণার স্থিতি আর আবেগকে এক সঙ্গে একদম ঠিক-ঠিকভাবে মাপা সম্ভব না", একে অনিশ্চিততার নিয়ম বলে। বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আমরা কাউকে নিশ্চিততার সঙ্গে না মাপতে পারলেও, সৃষ্টির মধ্যে অনিশ্চিত কোনো কিছুই হয় না। যেকোনো কণা বা লোক (তারা এবং গ্রহ) উচিত মার্গ এবং উচিত গতিতেই গমন করে। এরমধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় না। যদি কখনও এরকমটা হয়, তাহলে সেটা অল্পকালের জন্যই হয়, অন্যথা অনিষ্ট হতে পারে। পৃথিবীর উচিত গতি ও মার্গে চলার নিশ্চিত নিয়মের কারণেই এই সূর্য লোক পূর্বে উদয় তথা পশ্চিমে অস্ত হওয়া প্রতিত হয় এবং ভিন্ন-ভিন্ন ঋতুগুলো এসে থাকে। এই কারণে কোনো কণা বা লোক আগে উৎকর্ষকে প্রাপ্ত হয়ে, তারপর অপকর্ষকে প্রাপ্ত করে। এটা হচ্ছে সৃষ্টির শাশ্বত ও সার্বদেশিক নিয়ম। যেকোনো জগৎ, প্রাণীর শরীর, বনস্পতি আদি সমস্ত চরাচর জগৎ এই নিশ্চিত নিয়মের উপরেই চলছে। এই উৎকর্ষ ও অপকর্ষের মধ্যকালে প্রত্যেক পদার্থ একটা নিশ্চিত নিয়মেরই পালন করার সাথে গতি করে। এখানে যদৃচ্ছভাব বলে কোনোকিছুই হয় না। যা আমাদের যদৃচ্ছভাব বলে প্রতিত হয়, সেটাও বস্তুতঃ অকস্মাৎ নয়, বরং কোনো নিশ্চিত নিয়মের আধারেই হয়, কিন্তু আমরা আমাদের অল্প সামর্থের কারণে তাকে জানতে পারি না। জানার সামর্থ্য না কেবল প্রত্যেক প্রাণীর, অপিতু প্রত্যেক মানুষেরও পৃথক-পৃথক হয়। যার-যার যত-যতটা সামর্থ্য হয়, সে ততটুকুই মাত্রায় ভৌতিকীর নিয়মকে বুঝতে পারে, যাকে সে বুঝতে পারে না, সেই নিয়ম তাকে যদৃচ্ছভাবই প্রতিত হয়। একজন অজ্ঞানী ব্যক্তি সৃষ্টির প্রত্যেক কার্যকে অনিয়মিত বা আকস্মিকই বলবে, কিন্তু প্রবুদ্ধ বিচারশীল বৈজ্ঞানিকই তার নিয়ম খুঁজে নেয়। আজ সংসারের বৈজ্ঞানিক জগৎ সৃষ্টির নিয়ম বানাচ্ছে না, বরং সৃষ্টিতে চলা নিয়মগুলোকে জানছে মাত্র। এই জানাকেই খোঁজ অথবা বিজ্ঞান বলা হয়, যার জন্য সংসারের লক্ষ-লক্ষ বৈজ্ঞানিক রাতদিন কাজ করছে। আমরা এই নিয়ম জানতে পারিনি, এর মানে এই নয় যে সৃষ্টি বিনা নিয়মেই কাজ করছে। আলবার্ট আইনস্টাইন-ও মানেন যে যদৃচ্ছিকতা বাস্তবিকতার কিছু মৌলিক গুণই হচ্ছে আমাদের অজ্ঞানতার প্রতিবিম্ব©। 


এখন যেহেতু সমস্ত সৃষ্টি উদ্দেশ্য পূর্ণ ও জ্ঞানপূর্বক নির্মিত হয়েছে, এই কারণে এটা অনিবার্য যে তার নির্মাতা কোনো মহান্ সামর্থ্যশালী, মহান্ জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, অনাদি ও অনন্ত কর্তা অদৃষ্টরূপেণ সর্বত্র বিদ্যমান আছে।


যা নিরন্তর গতিশীল অর্থাৎ পরিবর্তনশীল হয়, তাকে জগৎ বা সংসার বলে। এই সৃষ্টির মধ্যে কোনোকিছুই স্থির বা স্থায়ী নেই আর যা স্থির, নির্বিকার বা স্থায়ী আছে, সেটা এই সৃষ্টির অঙ্গভূত তত্ত্ব নয়। সমস্ত জগতের সূক্ষ্মতম থেকে স্থূলতম পদার্থ নিরন্তর গতি করে চলেছে, সেখানেই তারা নিরন্তর গতির কারণে নিজের স্বরূপকেও নিরন্তর পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তন সর্বত্র ও সর্বদা হতে চলা সংযোগ ও বিয়োগের কারণেই হচ্ছে আর সংযোগ বিয়োগেরই কারণ হল গতি। এই সংযোগ বিয়োগও জ্ঞানপূর্বকই হচ্ছে। এই সমস্ত সংযোগ বিয়োগ রূপী সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ, তাদের ব্যবহার আর গুণের ব্যবস্থিত ও বিশিষ্ট জ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলা হয়।


 

২.৪ সৃষ্টি বিজ্ঞানের ব্যাপকতা 

অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের অতিরিক্ত সংসারের অন্য সমস্ত বিজ্ঞান হল সৃষ্টি বিজ্ঞানেরই বিবিধ শাখা। একে এভাবেও বলা যেতে পারে যে সম্পূর্ণ পদার্থ বিজ্ঞান সৃষ্টি বিজ্ঞানের অন্তর্গত এসে যায় কিন্তু সংসারের মধ্যে বিভিন্ন লোক লোকান্তরের রচনার বিজ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলে। একে ইংরেজী ভাষায় কস্মোলজি বলে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক এটুকু অবশ্য মানে ও জানে যে এই কস্মোলজির সঙ্গে সৌর ভৌতিকী, প্লাজ্মা ভৌতিকী, খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি এবং স্ট্রিং থিওরি আদির না কেবল অতি নিকট সম্বন্ধ আছে, অপিতু এগুলো সবই হচ্ছে সৃষ্টি বিজ্ঞানের শাখা। এর অতিরিক্ত কণা-পরমাণু-নাভিকীয় ভৌতিকীকে ছাড়া কস্মোলজির কল্পনাও সম্ভব নয়। ঊষ্মা, প্রকাশ, বিদ্যুৎ, চুম্বক আদির বিজ্ঞানও হচ্ছে কস্মোলজির ব্যাখ্যার জন্য আবশ্যক। এইভাবে এই সমস্ত বিজ্ঞান-শাখা হচ্ছে সৃষ্টি বিজ্ঞানেরই ভাগ। তাছাড়া এইসবের জন্য ভৌতিক বিজ্ঞান শব্দটাও অনেক সার্থক। বিজ্ঞানের অন্য শাখা রসায়ন, ভূগর্ভ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান আদি সবই হচ্ছে বিনা ভৌতিক বিজ্ঞানে অপূর্ণ অথবা ভৌতিক বিজ্ঞান হচ্ছে রসায়ন আদি অনেক শাখার বা ধারার মূল। এইভাবে বর্তমান বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাই হচ্ছে বিজ্ঞানেরই অঙ্গ। এছাড়া বাস্তবিকতা তো এই হচ্ছে যে অধ্যাত্ম বিজ্ঞান ছাড়া সম্পূর্ণ সৃষ্টি বিজ্ঞানই অপূর্ণ।


সৃষ্টির এই প্রয়োজনকে জেনে এই মানব প্রাণী যখন থেকে এই পৃথিবীতে জন্মেছে, তখন থেকেই তারা সৃষ্টির উৎপত্তি এবং সঞ্চালন প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানার চেষ্টা নিরন্তর করে আসছে। এই সময়েও পৃথিবীতে যেখানে- যেখানে মানুষ বসবাস করে, তারা শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, সবাই কোনো-না-কোনো স্তরে এই ব্রহ্মাণ্ডের বিষয়ে বিচার করেই থাকে। এই বিচার তাদের বৌদ্ধিক স্তরের দৃষ্টিতে ভিন্ন-ভিন্ন হয়। কোথাও-কোথাও তারা নিজেদের মত পন্থের মান্যতার সীমায় বাঁধা থাকাতে ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তির বিষয়ে খুব বেশি চিন্তন করে না।


২.৫সৃষ্টি বিজ্ঞানের ইতিহাস

বেদ, মনুস্মৃতি, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মহাভারত, সূত্র-গ্রন্থ, দর্শন, উপনিষদ্, আদি সম্পূর্ণ প্রাচীন বৈদিক বাঙ্ময়ের মধ্যে সৃষ্টির যথার্থ বিজ্ঞানের উপর বিস্তারভাবে গম্ভীর বিচার করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের উদয়ের পূর্বে পশ্চিমী দেশের মধ্যে অরস্তু, প্লেটো আদি বিচারকদের সৃষ্টিবিদ্যা সম্বন্ধীয় বিবিধ বিচারের প্রাদুর্ভাব হয়ে গিয়েছিল। এইসব বিচার এবং দেশী-বিদেশী মত পন্থের মান্যতার মূল স্রোত তো বৈদিক দর্শনই ছিল, যা আজ বিকৃত রূপে সংসারের মধ্যে ছড়িয়েছে।


যাকে আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের উদয় বলতে পারি, সেটা কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও থেকে প্রারম্ভ হয়েছে। এর পর তাদের সময়কার ব্রিটিশ বৈজ্ঞানীক আইজ্যাক নিউটন থেকে আধুনিক সৃষ্টি বিজ্ঞানের যুগের প্রারম্ভ হয়। এর পশ্চাৎ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞান অনেক ক্রান্তিকারী অনুসন্ধান করেছে। সৃষ্টির অনেক গম্ভীর রহস্যকে বুঝতে ও জানতে পারে। এই কালখণ্ডে আধুনিক বিজ্ঞান অতি উচ্চ টেকনিকের এরকম বিকাশ করে যে তার সাহায্যে এই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্যের পর্দা উঠতে থাকে। আইনস্টাইনের পশ্চাৎ আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে জানার অনেক টেকনিক বিকসিত হয়েছে। সারা সংসারের বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ার এই ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে যৌথভাবে প্রচেষ্টা করছে। বর্তমান বিজ্ঞান গত প্রায় 200-300 বছর যাবৎ এই সৃষ্টির উপর পর্যাপ্ত বিচার করেছে। এই দিশাতে সম্পূর্ণ বিশ্বের বৈজ্ঞানিক অহর্নিশ সংগঠিত হয়ে ভারী পুরুষার্থ করছে। তাসত্ত্বেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক জগতের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তির কোনো একটি সর্বমান্য সিদ্ধান্ত স্থাপিত করতে পারেনি, বরং কয়েকটি পরস্পর বিরোধী মত সিদ্ধান্তের নামে প্রচলিত আছে, সেই সমস্ত পক্ষের বৈজ্ঞানিক নিজের-নিজের মতের পুষ্টিতে নিজের-নিজের প্রয়োগ, প্রেক্ষণ এবং গণিতীয় ব্যাখ্যা প্রস্তুত করার সঙ্গে বিরোধী মতের খণ্ডন করতে দেখা যায়। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়! ভারী পুরুষার্থ আর ভারী বিশালকায় ধন রাশি ব্যয় করার পরেও সংসারের বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি উৎপত্তির অনেক রহস্যকে এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি আর যে রহস্য আমাদের ঋষিরা জেনেছিল, সেই জ্ঞান ধীরে-ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়। এখন আমাদের কাছে অনেক বৈদিক গ্রন্থ তো আছে, কিন্তু তাকে বোঝানোর কেউ নেই।  পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেগুলোর মধ্যে কিছু রহস্যকে বৈদিক ভৌতিকীর দ্বারা জানার চেষ্টা করবো।


২.৬ সৃষ্টিকে কেন জানবো?

এখন এটা ভাবা আবশ্যক যে সৃষ্টিকে জানা কেন আবশ্যক? এটা না জেনে মানুষ কি সুখে থাকতে পারবে না? এর উত্তরে আমি বলবো যে হ্যাঁ, এটাকে না জেনে আমরা নিশ্চিতভাবে সুখপূর্বক থাকতে পারবো না। আমরা যত-যতটা সৃষ্টিকে জানবো, আমাদের জীবন তত-ততটা সুখী হতে থাকবে আর এই সুখ কেবল বহিরাগত সুখই হবে না, বরং আমরা শরীর, মন এবং আত্মা হতে না কেবল স্বয়ং সুখী থাকতে পারবো অপিতু প্রাণী মাত্রের হিত করতে পারবো।

আসুন, আমরা এটা বোঝার চেষ্টা করি। ধরে নিন, আপনি একটা গাড়ি কিনেছেন আর তার সম্বন্ধে বিনা কিছু জেনে চালাতে শুরু করেছেন, তখন কি হবে? আমরা কোথাও দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি এবং নিজের শরীরের নাশ করে বসবো। একথায় কারও কি সন্দেহও হতে পারে? যে ব্যক্তি যত-যতটা গাড়ির বিষয়ে তথা যাতায়াতের নিয়মের বিষয়ে অধিক জানবে আর তার অনুকূলই ব্যবহার করবে, তার যাত্রা ততটাই সুগম ও সুখদ হতে থাকবে। এই একটা উদাহরণই আমাদের সৃষ্টি বিজ্ঞানের অনিবার্যতাকে দর্শানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা নিজের শরীর, বনস্পতি, পৃথিবী, বায়ু, জল, সূর্য, চন্দ্রমা, বিদ্যুৎ, চুম্বক, ঊষ্মা, তাপ, ঊর্জা আদি পদার্থের যতটা গভীর জ্ঞান রাখবো, তত-ততটা এর থেকে অধিক লাভ নিতে পারবো। মনে রাখবেন, এটার অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে নিয়েই চলছে এরকম টেকনিক্যাল আবিষ্কার এই পরিবেশ ও আমাদের স্বাস্থ্যকে নষ্ট করছে। যেরকম অসম্পূর্ণ জ্ঞানী বাহনচালক দুর্ঘটনাই ঘটাবে, সেই রকম অসম্পূর্ণ জ্ঞানে আধারিত টেকনিক কোনো-না-কোনো দুষ্প্রভাব ফেলবেই। আজ বিশ্ব, যাকে অত্যন্ত বিকশিত বিজ্ঞান ও প্রৌদ্যোগিকীর বিশ্ব বলে মানা হচ্ছে, অথচ এরমধ্যে এরকম টেকনোলজি নেই, যার কোনো-না-কোনো দুষ্প্রভাব নেই। এরকম কোনো ইংরেজির ওষুধ নেই, যার কোনো-না-কোনো দুষ্প্রভাব হবে না, অথচ বৈদিক কালে বিকশিত সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীর উপর আধারিত টেকনিক পূর্ণ নিরাপদ (দুষ্প্রভাব রহিত) ছিল।

আমাদের কি ভাবা উচিত নয় কেন এমনটা হল? এটার কারণ হল আমরা সুখ সুবিধার লোভে সৃষ্টির পদার্থের বিজ্ঞানকে গভীরভাবে না জেনে টেকনিক্যাল আবিষ্কারকে প্রাথমিকতা দিই। দ্বিতীয়ত, আমাদের অজ্ঞানতা এই ছিল যে আমরা আমাদের সৃষ্টিকে কেবল জড় পদার্থের আপনা-আপনি হওয়া সংঘাত মেনে নিয়েছি। সর্বোচ্চ চেতন সত্তা, যেটা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রিত ও নির্মাণ করে তথা একটা চেতন সত্তা, যেটা আমাদের শরীরের মধ্যে নিবাস করে সমস্ত সৃষ্টির উপভোগ করছে, এই দুটিকে ভুলেগেছি, এর মানে এই হচ্ছে যে তিন প্রকারের পদার্থের মধ্যে কেবল এক পদার্থ জড়-কেই নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা মানব সমাজের ভাগ্য বিধাতা হতে চলেছে, তাহলে অনিষ্ট তো হবেই। একটু ভাবুন যে, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের পরিবারে নিজের মাতা-পিতা আদি বৃদ্ধ তথা নিজের ভাই, বোন, পত্নী ও সন্তানকে ভুলে গিয়ে নিজেকেই পরিবারের একমাত্র সর্বোচ্চ অধিকারী মেনে সম্পূর্ণ সম্পত্তির উপর নিজেরই অধিকার মনে করে বসে, তখন তার ব্যবহার কিরকম হবে? সে সবাইকে দুঃখই দিবে আর তারপর স্বয়ংও কিভাবে সুখ অনুভব করতে পারবে? আজ এরকমই স্থিতি এই মানব জগতের হয়ে গেছে। মানব স্বয়ংকে সৃষ্টির একমাত্র সর্বোচ্চ উপভোক্তা মেনে নিয়ে ব্যবহার করার সঙ্গে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে স্বয়ংই উপভোগ করতে চায়, এইজন্যই সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে, অনেক প্রাণী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, প্রেম - করুণা তথা দয়ার মতো গুণ নষ্ট হয়ে গেছে, এই কারণে সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ রূপে জানা আর তারই অনুসারে ব্যবহার করলে পরেই মানব সুখী থাকতে পারবে আর সমস্ত প্রাণীকেও সুখী করতে পারবে।


1. সংসার দুই প্রকারের পদার্থ দ্বারা মিলে নির্মিত হয়েছে। একটা হল এই সৃষ্টির উপাদান কারণ আর অন্যটা হল এই সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ।

2. সৃষ্টির পদার্থের যথাযথ বিজ্ঞানকে সাক্ষাৎ করে তাকে সবার হিতের জন্য ব্যবহার করা, এটাই হচ্ছে সৃষ্টি বিজ্ঞানের প্রয়োজন।

3. সৃষ্টি যে পদার্থ দ্বারা নির্মিত হয়েছে, সেটা হল অনাদি ও অনন্ত।

4. শূন্য থেকে কখনও কোনো বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে না তথা যে বস্তু বিদ্যমান আছে, তার কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না।

5. সৃষ্টি সূক্ষ্ম পদার্থের জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক সম্যক্ সংযোগ বিশেষ দ্বারা উদ্দেশ্যপূর্বক নির্মিত হয়েছে, য়দৃচ্ছয়া আর নিরুদ্দেশ্য সংযোগ দ্বারা হয়নি।

6. সৃষ্টির সমস্ত ক্রিয়া নিশ্চিত ক্রম এবং ব্যবস্থার অনুসারে চরণবদ্ধ ও নিয়মবদ্ধ রীতি দ্বারাই প্রারম্ভ ও সঞ্চালিত হয়।

7. সৃষ্টির নির্মাতা মহান্ সমর্থকারী, মহান্ জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, অনাদি ও অনন্ত কর্ত্তা অদৃষ্ট রূপেণ সর্বত্র বিদ্যমান আছে।

8. বর্তমান বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত শাখা সৃষ্টি বিজ্ঞানেরই অঙ্গ।

9. আমরা সৃষ্টির পদার্থের যতটা গভীর জ্ঞান রাখবো, ততটাই এরথেকে অধিক লাভ নিতে পারবো। সৃষ্টিকে না জেনে মানব কখনও সুখী থাকবে না।

____________________________________

© Randomness is a reflection of our ignorance of some fundamental property of reality. [Page No. 134, Elements of Quantum Optics by Brice Scott]





গত অধ্যায়ে আমরা, সংসার কোন পদার্থ দ্বারা মিলিত হয়ে নির্মিত হয়েছে? ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান কেন আবশ্যক? আদি মূলভূত প্রশ্ন, যা কখনও না কখনও আপনার মস্তিষ্কে এসেছিল, এর সম্বন্ধে সংক্ষেপে জেনেছি। এই অধ্যায়ে আমরা বর্তমান বিজ্ঞানের সমীক্ষার পশ্চাৎ জানবো যে ব্রহ্মাণ্ডের প্রারম্ভিক অবস্থা কি ছিল? যে পদার্থ দিয়ে সৃষ্টি তৈরি হয়েছে, তার স্বরূপ কি?


৩.১ বর্তমান বিজ্ঞানের সমীক্ষা 

বর্তমানে সৃষ্টি উৎপত্তির সবথেকে প্রচলিত সিদ্বান্ত বিগ-ব্যাং (Big Bang) -কে মানা হয়। এটা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যে এই ব্রহ্মাণ্ড কখন আর কিভাবে হয়েছে?

বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্তের অনুসারে প্রায় 13.8 অরব বর্ষ পূর্বে ব্রহ্মাণ্ড একটা বিন্দুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কেউ জানে না তারপর কি হয় আর এই ব্রহ্মাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে, যার ফল স্বরূপ ব্রহ্মাণ্ডের রচনা হয়। এই বিস্তার আজও জারি আছে, যারজন্য ব্রহ্মাণ্ড আজও ছড়াচ্ছে। প্রারম্ভে অত্যধিক ঊর্জার উৎসর্জন হয়। এই ঊর্জা এত অধিক ছিল, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ড ছড়িয়েই যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়াকে দেখার শ্রেয় এডবিন হবল (1929) নামক বৈজ্ঞানিকের, যিনি বলেছিলেন যে ব্রহ্মাণ্ডের নিরন্তর বিস্তার হচ্ছে, যার মানে এই হল যে ব্রহ্মাণ্ড কখনও সঘন ছিল। জার্জ লেমৈত্রে (1927) ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির প্রসঙ্গে এই সিদ্ধান্তের প্রতিপাদন করেছিলেন, যাকে বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্ত বলা হয়। বিগব্যাং -এর মাত্র 10^-43 সেকেন্ডের পরে, গুরুত্বাকর্ষণ বল অস্তিত্বের মধ্যে এসে গিয়েছিল আর ভৌতিকীর নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া শুরু হয়েছিল। সেকেণ্ডের ছোট্ট অংশের মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড 10^30 গুণ ছড়িয়ে যায় আর কোয়ার্ক, ল্যাপ্টন আর ফোটনের উষ্ণ দ্রব্য হয়ে গিয়েছিল। 10^-6 সেকেণ্ড পর কোয়ার্ক মিলিত হয়ে প্রোটন আর নিউট্রন তৈরি করতে থাকে আর ব্রহ্মাণ্ড এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছিল। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আদির অস্তিত্বের আরম্ভ হওয়া শুরু হয়েছিল আর অন্য ভৌতিক তত্ত্ব নির্মাণ শুরু হয়ে যায়।


বর্তমান বিজ্ঞানের মান্যতা অনুসারে বিগ-ব্যাং এর সময়ে

                       V=0, M=∞, p=∞, T=∞

(এখানে V,M,p,T হচ্ছে ক্রমশঃ ব্রহ্মাণ্ডের আয়তন, দ্রব্যমান, ঘনত্ব আর তাপমাত্রা)


অর্থাৎ আয়তন প্রায় শূন্য তথা দ্রব্যমান, ঘনত্ব তথা তাপ-ঊর্জা অনন্ত ছিল। বিশ্বের অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক এই ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি বিন্দু আকার থেকেই হয়েছে বলে মানে। স্টিফেন হকিং-ও তার পুস্তক "ব্রীফিয়ার হিস্ট্রী অফ টাইম"-এর মধ্যে বিগ-ব্যাং এর সময় ব্রহ্মাণ্ডকে শূন্য ত্রিজ্যার মতো বিন্দুর আকার বলেছেন। এর পশ্চাৎ জুলাই 2010 তে ডিসকভারি টি০ভি০ চ্যানেলে হকিং সেটার আকার অণু থেকেও সূক্ষ্ম বলেন। এখন আমরা এর উপর বিচার করবো যে যদি কখনও বিগ-ব্যাং হয়েও থাকে, তাহলে কি সেই সময় ব্রহ্মাণ্ডের আকার শূন্য আয়তনের হতে পারে? শূন্য আয়তনের অর্থ শূন্য স্থান নয় কি? সেই শূন্য স্থানের মধ্যে অনন্ত পদার্থ ঢোকা তো দূর, বরং কোনো পদার্থই ঢুকবে না। শূন্য আয়তনের মধ্যে দ্রব্যমান, ঊর্জা, তাপ আদির পরিমাণ শূন্যই হতে পারে। একটু ভাবুন, দ্রব্যমান ও ঊর্জার জন্য কি অবকাশের আবশ্যকতাই নেই?


ভারতীয় প্রসিদ্ধ খগোলশাস্ত্রী প্রো০ আভাস মিত্রা সন 2004 -এ নিজের এক শোধ পত্র, যেটা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক পত্রিকার মধ্যে প্রকাশিত হয়, তাতে এই নিষ্কর্ষ দেন যে - কোনো ব্ল্যাক হোলই শূন্য আকারকে কখনও প্রাপ্ত করতে পারবে না। যদি এরকমটা হয় তাহলে তার দ্রব্যমানও শূন্যই হবে। বৈজ্ঞানিক তো প্রারম্ভিক ব্রহ্মাণ্ডের দ্রব্যমান অনন্ত মানে, তাহলে সেটার আয়তন শূন্য কিভাবে মানছে? বর্তমানে মহান্ বৈদিক বৈজ্ঞানিক, আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক আগস্ট 2004 -এ বিশ্ব বৈদিক বিজ্ঞান কংগ্রেস, ব্যাঙ্গালোরে নিজের পত্র বাচনে সিদ্ধ করেছেন যে শূন্য আয়তনের মধ্যে অনন্ত দ্রব্যমান বা অনন্ত ঊর্জার হওয়া সম্ভবই নয়, বরং শূন্য আয়তনের মধ্যে অল্প দ্রব্যমান ও ঊর্জা হওয়াটাও সম্ভব নয়। কিছু বৈজ্ঞানিক যারমধ্যে স্টীবন বীনবর্গ আদি প্রমুখ আছে, তারা বিগ ব্যাং-কে না তো মহাবিস্ফোট নাম দেয় আর না তার প্রারম্ভ শূন্য আয়তন থেকে করে। তাছাড়া তারা সৃষ্টি উৎপত্তির প্রক্রিয়াকে প্রাথমিক অবস্থা থেকেও প্রারম্ভ করে না। তারা পদার্থকে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকাকেই মানে আর তারমধ্যে অকস্মাৎ উত্তেজনা প্রারম্ভ হওয়ার ঘটনাকে, আবার অন্যদিকে কিছু বৈজ্ঞানিক অনন্তের মধ্যে ছড়ানো সঘন পদার্থতে সর্বত্র যৌথভাবে আকাশ প্রসারিত হওয়া আর তার সঙ্গে-সঙ্গে পদার্থের প্রসারিত হওয়ার প্রক্রিয়াকেই বিগ-ব্যাং নাম দিয়ে দেয়, যাই হোক তবে সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থার বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানীক সিদ্ধান্তই কিছু বলার স্থিতিতে নেই।


বিগ-ব্যাং এর সময়ে ঊর্জা কোন রূপে বিদ্যমান ছিল? বিগ-ব্যাং কেন হয়? কাল ও আকাশের উৎপত্তি সেই বিস্ফোরণের সঙ্গে কিভাবে হয়? মহাবিস্ফোট কিসের মধ্যে হয়? শূন্যের মধ্যে কি? সেই সময় যখন কাল ও আকাশ দুটোই ছিল না, তাহলে তখন এই দুটো না থাকা সত্বেও কোনো বিস্ফোরণের সম্ভাবনা কিভাবে হতে পারে? কারণ যেকোনো ক্রিয়ার মধ্যে সময় লাগে। এই রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের কাছে নেই।


স্টিডি স্টেট থিওরি, বাবল ইউনিভার্স, বিগ বাউন্স, মিরর ইউনিভার্স আদি অনেক কল্পিত সিদ্ধান্ত বর্তমানে প্রচলিত আছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই এটা বলতে অসমর্থ যে ব্রহ্মাণ্ডের প্রারম্ভিক অবস্থাটা কি ছিল? বৈজ্ঞানিকরাও স্বীকার করে যে বিগ-ব্যাং -এর আগে কি ছিল সেটা কেউ জানে না। এইজন্য বিগ-ব্যাং সিদ্ধান্ত ব্রহ্মাণ্ডের প্রারম্ভিক স্থিতির ব্যাখ্যা করে না। এইভাবে বর্তমান ভৌতিকীর কোনো সিদ্ধান্তই সৃষ্টির প্রারম্ভিক স্থিতির ব্যাখ্যা করতে সমর্থ নয়।


৩.২ সৃষ্টির প্রারম্ভিক অবস্থার জ্ঞানের অনিবার্যতা 

সর্বপ্রথম আমরা একথা বোঝার চেষ্টা করবো যে, কোনো বস্তুর জ্ঞান প্রাপ্ত করার জন্য সবার আগে আমাদের এটা জানা কেন আবশ্যক যে সেই বস্তুটা কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি?

যেরকম আমরা যদি একটা ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়ার সম্বন্ধে জানতে চাই, তাহলে আমাদের আগে জানা উচিত যে সেই ভবনটা বানাতে কোন-কোন সামগ্রীর প্রয়োগ হয়েছে? যেরকম ভবন তৈরি করার জন্য আমাদের ইট, জল, সিমেন্ট, বালি আদির আবশ্যকতা হয়। দ্বিতীয়ত, এটা জানা আবশ্যক যে সবার আগে কি ছিল? যেমন ভবন তৈরির আগে সেখানে কি ছিল? তাহলেই আমরা নির্মাণের প্রক্রিয়াকে ঠিক-ঠিকভাবে বুঝতে পারবো। এই রকমই যদি আমরা ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধে জানতে চাই, তাহলে আমাদের আগে এটা জানতে হবে যে সেটা কোন মূল পদার্থের দ্বারা তৈরি হয়েছে আর সেই পদার্থ সৃষ্টি তৈরির পূর্বে কোন অবস্থায় ছিল? বর্তমান বিজ্ঞান সৃষ্টির পূর্বের অবস্থার বিষয়ে ভিন্ন-ভিন্ন মত রেখে থাকে, এই কারণে সৃষ্টি উৎপত্তির নানা প্রকারের বিরোধী মত বর্তমান বিজ্ঞানের নামে চলছে আর সবার কাছেই নিজের- নিজের তর্ক, প্রয়োগ তথা গণিত আছে। আমি এখানে একটাই উদাহরণ দিয়েছি। আপনি আপনার জীবনে প্রয়োগে আসে এমন বিভিন্ন বস্তুর উৎপত্তি প্রক্রিয়াকে জানার জন্য তার উপাদান পদার্থের জ্ঞানের অনিবার্যতাকে স্বয়ং বুঝতে পারবেন।


এখন আমরা এটা জানার চেষ্টা করবো যে সেই মূল পদার্থ, যা দিয়ে সৃষ্টির নির্মাণ হয়েছে, সেটা কি? তার স্বরূপ কি? আর ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণের পূর্বে সেটা কোন অবস্থায় বিদ্যমান ছিল? বৈদিক বিজ্ঞান সেই মূল পদার্থকে "প্রকৃতি" শব্দের দ্বারা সম্বোধন করে। আসুন, সবার আগে আমরা এর উপর বিচার করি।


৩.৩ প্রকৃতি

বৈদিক বিজ্ঞান অর্থাৎ বেদ তথা আমাদের ঋষিদের অনুসারে এই সৃষ্টি এক জড় পদার্থ দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে, পদার্থের সেই অবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়। এই পদার্থ হচ্ছে যেকোনো জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম, প্রারম্ভিক এবং স্বাভাবিক অবস্থা। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান অসংখ্য বিশালতম তারা থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম কণা, তরঙ্গ, আকাশ আদি পদার্থ সবই এই প্রকৃতি পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তার মধ্যেই স্থির আছে আর এক নিশ্চিত সময়ের পশ্চাৎ সেই পদার্থের মধ্যে লীনও হয়ে যাবে। এই ভাবে,


[পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম অবস্থা, যা দিয়ে বর্তমানের আকাশ, তরঙ্গ ও মূলকরণ থেকে শুরু করে তারা আদির নির্মাণ হয়, তাকে প্রকৃতি বলা হয়]


আমাদের চারপাশে, যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি অথবা দেখতেও পাচ্ছি না, সেই সব সূক্ষ্ম স্তরে অণু - পরমাণু দিয়ে তৈরি হয়েছে। এর থেকেও অধিক সূক্ষ্ম স্তরে গেলে পরমাণুও অতি সূক্ষ্ম কণা, যাকে বর্তমানে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন বলে, দ্বারা মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে। তারপর প্রোটন ও নিউট্রনকে কোয়ার্ক নামক সূক্ষ্মতর কণার দ্বারা মিশ্রিত হয়ে তৈরি মানা হয়। এখন প্রশ্ন এটা উঠছে যে ইলেকট্রন ও কোয়ার্ক আদি কণা কি দিয়ে মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই, কারণ তার থেকে অধিক সূক্ষ্ম স্তরে আমরা বর্তমানের কোনো টেকনিক দিয়ে জানতে পারবো না। বর্তমান বিশ্বের মধ্যে অনেক বৈজ্ঞানিক এই সূক্ষ্ম পদার্থকে স্ট্রিং নামক সূক্ষ্ম সংরচনার দ্বারাই তৈরি বলে মনে করে, কিন্তু তারা স্ট্রিংয়ের বিষয়ে খুব বেশি ব্যাখ্যা করতে পারে না। বস্তুতঃ তাদের এই কথিত সিদ্ধান্ত গণিতীয় ব্যাখ্যা পর্যন্তই সীমিত।

বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে, যে পদার্থ নিজের থেকে কোনো সূক্ষ্ম তত্ত্ব দ্বারা মিলিত হয়ে তৈরি হয়নি, যার বিভাগ করতে-করতে শেষে যা অবশিষ্ট থাকে আর সমস্ত মূলকণা, এমনকি সমস্ত তরঙ্গ ও আকাশ আদি পদার্থ যে পদার্থ দ্বারা তৈরি হয়, সেটা হল প্রকৃতি পদার্থ।


৩.৪ প্রকৃতির স্বরূপ

আসুন, এখন আমরা এই কথার উপর বিচার করবো যে প্রকৃতি পদার্থের কি-কি গুণ আছে? বৈদিক ভৌতিকীতে আদ্য মহর্ষি ব্রহ্মা এবং মহাদেব শিব আদি মহান্ বেদবিজ্ঞানীদের অনুসারে প্রকৃতি পদার্থ হল নিম্নানুসারে -

1. এই পদার্থের কখনও অভাব হয় না। সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মাণের পরেও এই পদার্থ এখনও আমাদের চারিদিকে বিদ্যমান আছে।

2. এই পদার্থ না জন্ম নেয়, না বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, না পুরোনো হয় আর না নষ্ট হয়। এই পদার্থ সৃষ্টি এবং প্রলয় উভয় অবস্থার মধ্যে সর্বদা সংরক্ষিত থাকে। সৃষ্টিতে যত জড় পদার্থ আছে, তারমধ্যে প্রকৃতিই হচ্ছে এরকম এক পদার্থ, যার কখনও উৎপত্তি হয় না আর না কখনও নাশ হয়। বাকি যত জড় পদার্থ আছে, তাদের নিজের-নিজের আয়ু আছে, আমরা তাদের না জানলেও, সেই সব কখনও না কখনও নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু প্রকৃতির কোনো আয়ু হয় না। সেটা হচ্ছে অনাদি, অনন্ত, অজন্মা এবং অমর।

3. ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির পূর্বে এই পদার্থ সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে সব জায়গায় একরস ভরা থাকে, তারমধ্যে কোনো কম-বেশি হয় না অর্থাৎ কোথাও সঘন কোথাও বিরল, এরকমটা হয় না। যেন সব পদার্থ একটাই। যেমন সমুদ্রের মধ্যে সমুদ্রের জল একরস ভরা থাকে, সেরকমই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এই পদার্থ ভরা আছে। সমুদ্রের মধ্যে ভরা জলের অণুর মাঝে তো রিক্ত স্থানও থাকে, তারমধ্যে গতিও হয়, কিন্তু প্রকৃতি রূপী পদার্থের মধ্যে এইসব হয় না।

4. এটা হল জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম অবস্থা। এর থেকে সূক্ষ্ম জড় পদার্থের অবস্থা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কখনও সম্ভব না। এই পদার্থ কণা, আকাশ, তরঙ্গ আদির রূপে হয় না।

5. মহাপ্রলয়ের অবস্থাতে এই পদার্থ পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়। সেই সময় এই পদার্থের মধ্যে কোনো ধরনের কোনো উত্তেজনা হয় না।

6. এই পদার্থ চেতন তত্ত্বের দ্বারা নির্মিত হয় না। সৃষ্টির নির্মাণ করার জন্য চেতন তত্ত্ব একে প্রেরিত ও বিকৃত করে অবশ্য, কিন্তু তাকে বানায় না আর না সে তাকে বানাতে পারবে।

7. এটা হচ্ছে পদার্থের সেই স্থিতি, যাকে কখনও কোনো টেকনিক দিয়ে জানা বা গ্রহণ করা যাবে না।

8. এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব জড় পদার্থ বিদ্যমান ছিল, আছে বা হবে, সেই সবের উৎপত্তির মূল কারণ হচ্ছে এই জড় পদার্থ। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে এই প্রকৃতি হবে না।

9. সম্পূর্ণ সৃষ্টি এই পদার্থ দিয়েই তৈরি এবং এরমধ্যেই উৎপন্ন হয়। এর থেকে বাইরে কোনো উৎপত্তি আদি ক্রিয়া কখনও হতে পারবে না।

10. এই পদার্থ এরকম অন্ধকার রূপে বিদ্যমান হয়, যে সেই রকম অন্ধকার অন্য কোনো অবস্থাতে হয় না।

11. এই সৃষ্টির মধ্যে যে পদার্থ নষ্ট হওয়ার যোগ্য, সেই পদার্থ নষ্ট হয়ে সবার শেষে তার কারণরূপ প্রকৃতি পদার্থের মধ্যেই লীন হয়ে যায়।

12. এই অবস্থার মধ্যে কোনো কম্পন বিদ্যমান হয় না আর না হতে পারবে।

13. এই অবস্থার মধ্যে কোনো ধরনের কোনো গতি হয় না।

14. এই পদার্থ সৃষ্টি নির্মাণের জন্য পূর্ণ থাকে অর্থাৎ এর অতিরিক্ত অন্য কোনো জড় পদার্থের আবশ্যকতা হয় না।

15. এই পদার্থ সত্ব - রজস্ - তমস্ গুণের সাম্যাবস্থার রূপে হয় অর্থাৎ সেই সময় এই গুণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নিরন্তর নিতান্ত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণে অবিদ্যমানের মতোই হয়।

16. এই প্রকৃতি পদার্থ সমস্ত কণা থেকে শুরু করে লোক এবং আকাশ আদি সমস্ত উৎপন্ন পদার্থকে ধারণ করে।


বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সৃষ্টি উৎপত্তির পূর্বে অর্থাৎ প্রলয় কালে মূল পদার্থ কোন অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, সেটা প্রকৃতির পূর্বোক্ত গুণের দ্বারা জানা যেতে পারে। এইভাবে সৃষ্টির মূল পদার্থ সর্বত্র অর্থাৎ অনন্ত আয়তনে এরকম বিরল অবস্থাতে একরস হয়ে ছড়িয়ে বা ব্যাপ্ত থাকে, যেরকম এই সৃষ্টি কালে কখনও ও কোথাও হতে পারবে না। সেই সময় অনন্ত অন্ধকার বিদ্যমান থাকে। সেই পদার্থ নিতান্ত শূন্য দ্রব্যমান, শূন্য ঘনত্ব এবং সর্বদা ঊর্জারহিত হয় অর্থাৎ সেই সময় ঊর্জা, প্রকাশ, তাপ, দ্রব্যমান, গতি, বল, আকাশ, ধ্বনি, সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম কম্পনাদি কোনো কিছুই বিদ্যমান হয় না।


সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড যেন সেই অব্যক্ত প্রকৃতির মধ্যেই লীন হয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে ডুবে ছিল। পদার্থ বিদ্যমান থাকে অবশ্যই, কিন্তু তার বিদ্যমানতার কোনো লক্ষণ, ক্রিয়া, বল আদি পুরোপুরি বিদ্যমান হয় না। সেই পদার্থ না কণা রূপে হয় আর না তরঙ্গ রূপে হয়। আকাশ নামক পদার্থ, যাকে স্পেস বলা হয়, সেটাও সেই সময় হয় না, বরং সেই সময় বিদ্যমান পদার্থ এই সবের থেকে খুবই সূক্ষ্ম হয়, তার থেকে সূক্ষ্ম অবস্থা কখনও হওয়া সম্ভব না। পদার্থের এই অবস্থার নাম হচ্ছে প্রকৃতি। এটার তিনটি গুণ হওয়ার কারণে এটাকে ত্রিগুণাও বলা হয়েছে। মহাভারতের মধ্যে এটার তিরিশটা নাম বিশেষণের রূপে বর্ণিত আছে।


৩.৫ প্রকৃতির গুণ

প্রকৃতির তিনটি গুণ - সত্ব, রজস্ ও তমস্। এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থাকেই প্রকৃতি বলা হয়। এর দ্বারা স্পষ্ট যে এই গুণের নিষ্ক্রিয় অবস্থাকেই সাম্যাবস্থা বলা হয়। এখন এই তিনটি গুণের উপরে বিচার করা যাক -

1.সত্ব => সত্ব হল সেই গুণ, যার কারণে কালান্তরে প্রকাশ এবং আকর্ষণ বল আদির উৎপত্তি হয় তথা প্রাণীদের ভিতর সুখ আর শান্তির অনুভূতি হয়।

2. রজস্ => রজো গুণের কারণে প্রতিকর্ষণ-প্রক্ষেপক বল এবং গতিশীলতার উৎপত্তি হয় অর্থাৎ এই গুণের মূল কারণ হল রজোগুণ। প্রাণীর মধ্যে এই গুণের কারণে চঞ্চলতা, ক্রিয়াশীলতা, ঈর্ষা-দ্বেষ আদি গুণ উৎপন্ন হয়।

3. তমস্ => তমোগুণের কারণে অন্ধকার, জড়তা, গুরুতা, নিষ্ক্রিয়তা, দ্রব্যমান আদি গুণের উৎপত্তি হয়। এর কারণে প্রাণীদের মধ্যে মূর্খতা, মোহ, অতি কামুকতা, আলস্য ও ক্রোধ আদি গুণের উৎপত্তি হয়।


মহাভারতের মধ্যে মহর্ষি ব্রহ্মার অনুসারে এই তিনটি গুণ পরস্পর একে অপরের সঙ্গে জোড়া সৃজনকারী, একে অপরের আশ্রিত, একে অপরের সহায়তায় থাকার, একে অপরের অনুসরণ করার আর পরস্পর মিশ্রিত বিদ্যমানের হয়। তমোগুণের সংমিশ্রণ সত্বের সঙ্গে, সত্বের রজসের সঙ্গে, রজসের সত্বের সঙ্গে, সত্বের তমসের সঙ্গে হয়ে থাকে। একে বর্তমান ভৌতিকীর ভাষায় এইভাবে বলা যেতে পারে যে যেখানেই দ্রব্যমান আছে, সেখানে  অবশ্যই বল আছে, এমনকি সেটা গুরুত্ব বলই হোক না কেন। যেখানে বল আছে, সেখানে কোনো-না-কোনো ক্রিয়া অবশ্যই হবে। যেখানে ক্রিয়া হবে, সেখানে বল অবশ্যই হবে, যেরকম কোনো বল ফিল্ড ছাড়া হয় না আর ফিল্ড ক্রিয়া ছাড়া হতে পারবে না। এইভাবে যেখানে বল হবে, সেখানে অবশ্যই দ্রব্যমান হবে। এরমধ্যে কেবল কালই হচ্ছে অপবাদ, বস্তুতঃ সেই অপবাদের কারণ হল, যেহেতু সেই বলটি চেতনের হয়, সুতরাং সেখানে এই নিয়ম যথাযথ প্রযোজ্য হয় না। তমোগুণের নিয়ন্ত্রণে রজোগুণ বাড়ে তথা রজোগুণের নিয়ন্ত্রণ করলে পরে সত্বগুণের বৃদ্ধি হয়।


আসুন, একে আমরা এইভাবে জানি, কোনো বস্তুর জড়ত্বকে নিয়ন্ত্রিত করলে পরে তার ক্রিয়াশীলতার মধ্যে বৃদ্ধি দেখা যায়, যেরকম নাভিকীয় সংলোয়নের মধ্যে দ্রব্যমান (জড়ত্ব), ঊর্জা (গতি) -র মধ্যে পরিবর্তন হয় তথা কোনো কণার গতিকে অবরুদ্ধ করে তার থেকে প্রকাশ আদি ঊর্জার বৃদ্ধি হয়। উদাহরণ, উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলের মধ্যে প্রবেশ করলে পরে ঝলমল করা তথা কোনো ইলেকট্রনের প্রবাহের মধ্যে প্রতিরোধ উৎপন্ন করলে পরে প্রকাশ ও ঊষ্মার উৎপন্ন হওয়া (bremsstrahlung)। 

মহর্ষি ব্রহ্মার অনুসারে যতক্ষণ পর্যন্ত সত্ব গুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চয়ই রজোগুণ বিদ্যমান থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তমোগুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চয়ই সতোগুণ ও রজোগুণ বিদ্যমান থাকে। এখানে স্পষ্ট সংকেত পাওয়া যাচ্ছে যে সত্ব ও রজস্ গুণ তো তমোগুণ ছাড়াই বিদ্যমান থাকতে পারে, কিন্তু তমোগুণের বিদ্যমানতার জন্য সতোগুণ ও রজোগুণ উভয়ের বিদ্যমান থাকাটা অনিবার্য। কাল তত্ত্বের মধ্যে দুটি গুণ সত্ব ও রজস্ বিদ্যমান থাকে তথা তমোগুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।


আসুন, আমরা একে এইভাবে বোঝার চেষ্টা করি  -


এই সৃষ্টির মধ্যে যে বস্তুর মধ্যে প্রকাশ ও বল আদি গুণ বিদ্যমান থাকে, তারমধ্যে ক্রিয়া বা গতিশীলতা আর অনেক কম মাত্রায় জড়ত্ব বা দ্রব্যমান আদি গুণ বিদ্যমান  থাকে। সর্বদা গতিশীল থাকা প্রকাশের মধ্যেও অবশ্যই দ্রব্যমান থাকে। এইভাবে প্রকাশের মধ্যে তিনটি গুণই বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে কোনো মূলকণার উপর বিচার করলে পরে, তারমধ্যে দ্রব্যমানের সঙ্গে-সঙ্গে গতি এবং অনেক কম মাত্রায় প্রকাশও বিদ্যমান থাকে, এই কারণে সেটাও তিনটি গুণের দ্বারা যুক্ত থাকে।


এইভাবে আমরা এই অধ্যায়ের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের মূল পদার্থ প্রকৃতি আর তার গুণের বিবেচনা করলাম, যেটা সেই অবস্থায় পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে।


✍️ স্মরণীয় তথ্য

1. সৃষ্টির উৎপত্তি প্রকৃতি নামক পদার্থ দ্বারা হয়েছে।

2. প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে প্রকাশ আর ক্রিয়া আদি কোনো গুণই বিদ্যমান হয় না। এই কারণে সেই সময় বিদ্যমান মূল পদার্থকে না দ্রব্য, না ঊর্জা আর না আকাশ (স্পেস) বলা যেতে পারে।

3. এইভাবে প্রকৃতি অবস্থা নিম্নলিখিত স্বরূপের হয় -

(i) পদার্থের আয়তন অনন্ত হয়।

(ii) পদার্থের দ্রব্যমান শূন্য হয়।

(iii) শীতলতা অনন্ত হয়।

(iv) ঘনত্ব শূন্য হয়।

(v) কোনো ধরনের বল অথবা ক্রিয়া হয় না। এইজন্য সেই পদার্থ পূর্ণতঃ শান্ত, নিতান্ত অন্ধকারযুক্ত এবং অনন্ত আয়তনের মধ্যে পূর্ণতঃ একরস হয়ে ভরা থাকে।

(vi) সেটা না কণা রূপে, না তরঙ্গ আর না আকাশের রূপে হয়।

4. প্রকৃতি হচ্ছে যেকোনো জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম, প্রারম্ভিক এবং স্বাভাবিক অবস্থা।

5. যে পদার্থ নিজের থেকে সূক্ষ্ম তত্ব দ্বারা মিলিত হয়ে তৈরি হয়নি, যার বিভাগ করতে-করতে শেষাংশ থাকে, তাকে প্রকৃতি পদার্থ বলে।

6. প্রকৃতি পদার্থের কখনও অভাব হয় না। এই পদার্থ সৃষ্টি এবং প্রলয় উভয় অবস্থার মধ্যে সর্বদা সংরক্ষিত থাকে।

7. প্রকৃতির তিনটি গুণ (সত্ব, রজস্, তমস্) হয়, যা সৃষ্টি উৎপত্তির পূর্বে অর্থাৎ প্রলয় কালে সাম্যাবস্থা রূপে অর্থাৎ পূর্ণতঃ নিষ্ক্রিয় থাকে।

8. সত্ব হচ্ছে সেই গুণ যার কারণে কালান্তরে প্রকাশ এবং আকর্ষণ বল আদির উৎপত্তি হয়।

9. রজোগুণের কারণে প্রতিকর্ষণ-প্রক্ষেপক বল এবং গতিশীলতার উৎপত্তি হয়।

10. তমোগুণের কারণে অন্ধকার, জড়তা, গুরুতা, নিষ্ক্রিয়তা, দ্রব্যমান আদি গুণের উৎপত্তি হয়।

বেদ বিজ্ঞান আলোক


গত অধ্যায়ে আমরা জানলাম যে প্রকৃতি কি আর তার কি-কি গুণ আছে। প্রকৃতির সেই নিষ্ক্রিয় অবস্থাকে মহাপ্রলয় বলে। আর্ষ গ্রন্থের অনুসারে সৃষ্টির সময়কাল যত হয়, প্রলয়েরও সময়কাল ততই হয়। প্রকৃতির সাম্যাবস্থা ভঙ্গ হলে পরে সৃষ্টির নির্মাণ প্রারম্ভ হয়। এই অধ্যায়ের মধ্যে আমরা জানবো যে সেই জড় রূপী প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি কিভাবে উৎপন্ন হয়? সবার আগে সেই প্রকৃতি থেকে কি উৎপন্ন হয়? বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে সর্বপ্রথম কালের উৎপত্তি হয়, যাকে আমরা সময় (Time) এর রূপে অনুভব করি। প্রথমে আমরা জেনে নিবো যে বর্তমান বিজ্ঞান অনুসারে সময় কাকে বলে, তারপর আমরা এর উপরে বৈদিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করবো।

৪.১ বর্তমান বিজ্ঞানে সময়ের ধারণা

সময় হচ্ছে সেই বিষয়ের মধ্যে একটা, যা আমাদের জন্য এখনও রহস্য হয়ে আছে। কেউ সময়কে দিক্-কালের (spacetime) চতুর্থ আয়াম বলছে, তো কেউ মস্তিষ্কের একটা ভ্রম মাত্র। আবার কিছু মানুষ একে ভূত থেকে ভবিষ্যতে হবে এমন ঘটনার প্রগতি রূপে পরিভাষিত করে। তারা বলে যে যদি কোনো নির্দেশ তন্ত্রের (cordinate system) মধ্যে সময়ের সঙ্গে কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে সেটা সময় রহিত (timeless) হবে। আধুনিক ভৌতিকীর মধ্যে সময়কে দুই ঘটনার অন্তরাল রূপেও পরিভাষিত করা হয়, কিন্তু বাস্তবে সময় কি? এটা কেউ জানে না। বৈজ্ঞানিক এটা মানে যে সময়ের প্রারম্ভ বিগ-ব্যাংয়ের সঙ্গে হয়েছে, কিন্তু আধুনিক ভৌতিকীর মধ্যে এর ক্রিয়াবিজ্ঞান অজ্ঞাত আছে।
বর্তমানে সময়কে একটা নির্দেশাংক (dimension) মানা হয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুসারে ভিন্ন-ভিন্ন নির্দেশ তন্ত্রের (reference frame) মধ্যে সময়ের মান ভিন্ন-ভিন্ন হয়। আকাশের মধ্যে সময় কোথাও ধীরে আবার কোথাও দ্রুত হওয়াকেও বর্তমান বিজ্ঞান স্বীকার করে।
এখানে ∆t^1 গতি করার সঙ্গে নির্দেশ তন্ত্রের মধ্যে দুটি ঘটনার মাঝের সময় আছে, অথচ ∆t সমান ঘটনার স্থির নির্দেশ তন্ত্রের মধ্যে সময় আছে, নির্বাতের মধ্যে প্রকাশের গতি আর v বস্তুর গতি আছে।

যতদিন পর্যন্ত ঘড়ির আবিষ্কার হয়নি, ততদিন পর্যন্ত আমরা সময়ের অনুমান দিন-রাত, আকাশে সূর্যের স্থিতি বা পৃথিবীতে তার ছায়া দিয়ে করতাম।
বর্তমান সময়ে মাপন ঘড়ি দিয়ে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড আদিতে করা হয়, এর SI ইউনিট সেকেণ্ড, যেটা সিজিয়াম (Cs 133) পরমাণুর দুটি অতি সূক্ষ্ম ঊর্জা স্তরের মাঝে বিকিরণের 9,19,26,31,770 সংক্রমণের (transition) সমান হয়। সময়ের সবথেকে সূক্ষ্ম ইউনিট প্লাঙ্ক সময়, যা প্রায় 5.391×10^-44 সেকেণ্ডের সমান, কে মানা হয়।
আর্যবর্তের (ভারতের) কথা বলতে গেলে তো প্রায় 3,500 বছরের পুরোনো জ্যোতিষ শাস্ত্রের মধ্যে কাল গণনার বিষয় বিস্তারভাবে পাওয়া যায়। জ্যোতিষের মধ্যে কালমানের ইউনিট নিম্ন -
1 ত্রুটি= 1 সেকেণ্ডের 33750 তম ভাগ (1/33750সেকেণ্ড)
100 ত্রুটি= 1 তৎপর
30 তৎপর= 1 নিমেষ
18 নিমেষ= 1 কষ্ঠা
30 কষ্ঠা= 1 কলা
30 কলা= 1 ঘটি (নাড়ি, দণ্ড)
2 ঘটি= 1 মুহূর্ত (ক্ষণ)
15 মুহূর্ত= 1 অহর্ (দিন)
30 মুহূর্ত= 1 অহোরাত্র (দিনরাত)
10 গুরু (দীর্ঘ)= 1 অসু (প্রাণ)
6 অসু= 1 পল
60 পল= 1ঘটি
60 ঘটি= 1 অহোরাত্র
30 অহোরাত্র= 1 মাস
12 মাস= 1 বর্ষ
1 সেকেণ্ড= 2.5 গুর্বক্ষর (দীর্ঘাক্ষর) কাল= 1/4 অসু
4 সেকেণ্ড= 10 গুর্বক্ষর (দীর্ঘাক্ষর) কাল= 1 অসু
24 সেকেণ্ড= 1 পল= 6 অসু
1 মিনিট= 2.5 পল= 15 অসু
24 মিনিট= 1 ঘটি (60 পল) = 360 অসু
1 ঘণ্টা= 2.5 ঘটি = 900 অসু
24 ঘণ্টা = 1 অহোরাত্র = 21600 অসু
1 সেকেণ্ড= 11.25 নিমেষ
1 সেকেণ্ড= 337.50 তৎপর
1 সেকেণ্ড= 33750 ত্রুটি
1 নিমেষ= 30 তৎপর
1 অহোরাত্র = 972000 নিমেষ
[সমুল্লাস-12, বেদোক্ত জ্যোতিষ এবং বেদার্থ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী]

৪.২ বর্তমান বিজ্ঞানের "সময়" -এর সমীক্ষা

এখানে একটা বড়ো বিকট প্রশ্ন এই হচ্ছে যে কাল (সময়) কাকে বলে? কাল নিয়ে অনেক ধরনের পুস্তক লেখা হয়েছে, কিন্তু কোথাও এটা বলা হয়নি যে বাস্তবে কাল জিনিসটা কি? যা সর্বত্র সমান বেগে বয়ে চলেছে। নিরন্তর প্রত্যেকটা পদার্থের ক্ষয় করছে আর নিরন্তর আগেই বেড়ে চলেছে। বাস্তবে বর্তমানে আমরা যাকে কাল (সময়) বলে মনে করছি, সেটা হচ্ছে সময়ান্তরাল। যখনই কালের বিষয়টা আসে, তো আমাদের ধ্যান সবার আগে ঘড়ির দিকে যায়। ঘড়ি হচ্ছে একটা যন্ত্র, সেটা কোনো অজ্ঞাত পদার্থকে মাপছে, যাকে আজ পর্যন্ত না তো কেউ দেখেছে আর না কেউ তাকে অনুভব করতে পেয়েছে। ঘড়ি দিয়ে যাকে আমরা মাপছি, সেটা হচ্ছে সময়ের অন্তরাল মাত্র।
বৈদিক ভৌতিকী


চলুন, এবার আমরা কালের উপর পৃথকভাবে বিচার করে দেখি -
যেরকম আমরা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে কোনো বস্তুকে মাপি, ধরে নিন আপেলের ওজন মেপে দেখছি। এই সময় আমরা জানি যে আমরা কোন বস্তুটাকে মাপছি, যেরকম এখানে আমরা আপেলের ওজন মাপছি। এই রকম ভাবে আমরা ঘড়ি দিয়ে কাকে মাপছি? যখন আমরা বলি যে এক ঘন্টা হয়ে গেছে, তখন এই এক ঘন্টা বা এক মিনিট -টা আসলে কি? এর সম্বন্ধে আমরা অনভিজ্ঞ। বর্তমান বৈজ্ঞানিক সময়কে আকাশের সঙ্গেও জুড়ে দেখে, কিন্তু তারা না তো আকাশের সম্বন্ধে কিছু স্পষ্ট করে আর না সময়ের বিষয়ে। এই দুটি শব্দ কি কেবলমাত্র ব্যবহারে প্রয়োগ করার জন্যই নাকি এগুলো কোনো বাস্তবিক পদার্থের নাম, যার ভূমিকা এই ব্রহ্মাণ্ড রচনার মধ্যে আছে? এখন আমরা সেটা জানার চেষ্টা করবো।

৪.৩ কালের বৈদিক ধারণা

পদার্থ বিজ্ঞানের বিশিষ্ট গ্রন্থ বৈশেষিক দর্শনের রচয়িতা মহর্ষি কণাদ না কেবল দ্রব্যকে পদার্থ মানেন, অপিতু তার গুণ, কর্ম আদিকেও পৃথক পদার্থের রূপে মেনেছেন। মহর্ষি নয়টা দ্রব্যের মধ্যে কাল ও আকাশকেও দ্রব্যের রূপে মেনেছেন। তিনি দ্রব্যের লক্ষণ নিয়ে বলেছেন, যেসব পদার্থে ক্রিয়া ও গুণের আশ্রয় হয় অর্থাৎ যার মধ্যে ক্রিয়া ও গুণ বিদ্যমান হয় বা হতে পারে তথা কোনো কার্যরূপ পদার্থের সমবায় কারণ হয়, তাকে দ্রব্য বলে। এখানে সমবায় কারণের অর্থ হচ্ছে, এই দ্রব্য তারসঙ্গে উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে সর্বদা মিশ্রিত থাকে। এখানে আমরা কেবল "কাল" নামক দ্রব্যের উপরে বিচার করবো। মহর্ষি কণাদ কাল, আকাশ ও দিশার বিষয়ে অন্য দ্রব্যের থেকে আলাদা করে লিখেছেন যে কাল, আকাশ ও দিশা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় দ্রব্য। কালের লক্ষণ বলেছেন যে, ছোটো-বড়ো হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শীঘ্র ও বিলম্ব হওয়া আদি ব্যবহার হল কালের লক্ষণ।
মহর্ষি কণাদ প্রথমে তো দ্রব্যকে ক্রিয়া ও গুণকারী বলেছেন, পুনঃ এরমধ্যে তিনটা দ্রব্য কাল, আকাশ ও দিশাকে নিষ্ক্রিয় বলেছেন, এর রহস্যটা কি? এখানে প্রশ্ন এটা উঠছে যে কাল কি সর্বদা নিষ্ক্রিয় এবং কেবল ব্যবহারের প্রয়োগে আসা কাল্পনিক কোনো দ্রব্য ? মহর্ষি কণাদের দৃষ্টিতে কাল হল এরকম দ্রব্য যা ক্রিয়াবান্ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিষ্ক্রিয়ও। অন্যদিকে মহর্ষি য়াস্কের অনুসারে কাল হচ্ছে এরকম পদার্থ যারমধ্যে প্রেরণ, ধারণ, গমন, অধিগ্রহণ আদি কর্ম বিদ্যমান থাকে।
বস্তুতঃ কাল হচ্ছে একটা দ্রব্য যার স্বরূপের চর্চা পরে আমরা এই অধ্যায়ের মধ্যেই করবো। যেহেতু সময় হচ্ছে ব্যবহার করার একটা নির্দেশাংক তো চলুন আমরা এটাকে একটা উদাহরণের দ্বারা বোঝার চেষ্টা করি। ধরে নিন আমরা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে আপেলের ওজন করছি আর আপেলের ওজন 5কেজি হল, তখন এখানে ওজন আপেল নামক দ্রব্যের একটা গুণ হবে আর সেই ওজনের মান হবে 5কেজি আর আপেল হচ্ছে সেই দ্রব্য, যাকে ওজন করেছি। এইভাবে যখন আমরা দুই ঘটনার মাঝে সময়ান্তরালকে মাপি, তখন কালের সঙ্গে সময়ান্তরালের সেই সম্বন্ধ হয় যেটা আপেলের সঙ্গে ওজনের ছিল।

৪.৫ কালের উৎপত্তি

যখন সৃষ্টি নির্মাণের সময় আসে, সেই সময় যে ক্রিয়া সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়, সেটা এই রকম -
সর্বপ্রথম সর্বব্যাপক চেতন তত্ত্বের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তি করার কামনা উৎপন্ন হয়। এটা হল সৃষ্টি উৎপত্তির প্রথম চরণ। এটা ধ্যানে রাখবেন যে, জড় পদার্থের মধ্যে কোনো প্রবৃত্তি স্বতঃ হয় না। যেরকম আমাদের শরীর জড় আর চেতনের কারণে আমাদের শরীরে কাজ করার ইচ্ছা মনের মধ্যে উৎপন্ন হয়। সেইভাবে প্রকৃতি দ্বারা স্বতঃ সৃষ্টি উৎপত্তি হয় না আর না হতে পারবে। এই কামনা উৎপন্ন হওয়ার পরে যে পদার্থ সবার আগে উৎপন্ন হয় সেটা হল কাল।
এখন আমরা সৃষ্টি উৎপত্তির প্রথম চরণের চর্চাকে আগে বাড়াবো। সবার আগে চেতন তত্ত্ব প্রকৃতির সত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থার মধ্যে "ওম্" রশ্মির কম্পনকে সূক্ষ্মতম পরা রূপে সর্বত্র উৎপন্ন করে, এই "ওম্" রশ্মিই সেই তিনটি গুণকে জাগ্রত বা সক্রিয় করে। এদের মধ্যেও সর্বপ্রথম কাল তত্ত্বকে উৎপন্ন করার হেতু সত্ব ও রজস্ এই দুটি গুণকেই জাগ্রত করে। এই দুটি গুণের উৎপত্তি হতেই কাল তত্ত্ব সক্রিয় হয়ে যায়। এই সতত সক্রিয় কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে জাগাতে অর্থাৎ সক্রিয় করতে থাকে। এই কাল তত্ত্ব দুই গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে অব্যক্ত ভাব দ্বারা প্রেরিত "ওম্" রশ্মির রূপে হয়। এইভাবে সেটা "ওম্" -এর সবথেকে সূক্ষ্মতম রূপ মূল প্রকৃতির দ্বারা মিশ্রিত হয়েই কালের রূপ ধারণ হয়।
এই অবস্থার মধ্যে মূল প্রকৃতির মতো গুণের সাম্যাবস্থা থাকে না, এই কারণে একে সর্বথা অব্যক্ত মানা যেতে পারে না। এইজন্য তার মধ্যে অতি সূক্ষ্মতম বলও উৎপন্ন হয়ে যায়। "ওম্" রশ্মি সম্পূর্ণ মূল পদার্থের মধ্যে আকর্ষণকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। এই সময়েও প্রকৃতির সাম্যাবস্থা সর্বথা ভঙ্গ হতে পারে না। প্রকৃতির এই অবস্থাকেই কাল বলে। "ওম্" রশ্মির সঙ্গে চেতনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকে। এই অবস্থা প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন হয়, এই কারণে এটা জড় পদার্থ, কিন্তু যেহেতু এটা চেতন তত্ত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধিত এই কারণে এটা চেতনবত্ ব্যবহার করে।
প্রকৃতির সেটা প্রায় অব্যক্ত (পূর্ণ অব্যক্ত নয়) অবস্থা, যার মধ্যে "ওম্" রশ্মির সর্বাধিক সূক্ষ্ম রূপের অব্যক্ত সঞ্চার হয়ে গেছে, যার দ্বারা প্রকৃতির সত্ব ও রজোগুণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপে ব্যক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তমোগুণ সর্বদা অব্যক্তই থাকে। অতি সূক্ষ্ম আকর্ষণ বল ও গতির উৎপত্তি দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের এই অবস্থার নামই হচ্ছে কাল, যা সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তার দ্বারা উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে সর্বদা প্রারম্ভিক বল উৎপন্ন করতে থাকে।

৪.৬ কালের স্বরূপ

1. কাল তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির সত্ব ও রজস্ গুণ বিদ্যমান থাকে। এরমধ্যে তমোগুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, এইজন্য তার অভাবই হয়। এই কারণে কাল তত্ত্ব সতত গতি করে, এটা কখনও থামে না।
2. কালের অতিরিক্ত অন্য সব পদার্থের মধ্যে তিনটি গুণই ন্যূন বা অধিক মাত্রা অনিবার্যতঃ বিদ্যমান হয়।
3. কাল হচ্ছে সর্বব্যাপক, সতত গমনকারী একরস তত্ত্ব, যা প্রত্যেক পদার্থকে প্রেরিত করে, কিন্তু স্বয়ং সর্বোচ্চ চেতন তত্ত্বের অতিরিক্ত অন্য কোনো পদার্থের দ্বারা প্রেরিত হয় না।
4. কালের প্রেরণা দ্বারাই মন, প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় আর এইসবের থেকে নানা পদার্থের উৎপত্তি হয়।
5. কাল তত্ত্বই হচ্ছে অনেক প্রকারের পদার্থ ও কর্মের বীজরূপ। সৃষ্টির সব দ্রব্য, কর্ম, গুণ আদির বীজ হচ্ছে এই তত্ত্বই, কিন্তু এটা হল তার সাধারণ নিমিত্ত কারণ, উপাদান হয় নয়। এর মানে হল কাল তত্ত্বের মধ্যে স্বয়ং এই পদার্থের একটা অবয়ব নেই।
6. কাল তত্ত্ব মনস্ তত্ত্ব আদিকে প্রেরিত করে সাত ব্যাহৃতি রশ্মিকে (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম্) উৎপন্ন করে। এই সাত রশ্মির দ্বারা কাল তত্ত্ব অগ্রিম রশ্মিদের উৎপন্ন করে।
7. কাল তত্ত্ব নিত্য অর্থাৎ অজন্মা ও অবিনাশী পদার্থকে জীর্ণ করে না আর না করতে পারবে, অথচ অনিত্য পদার্থের মধ্যে কাল ব্যাপ্ত হয়ে তাদের নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।
কাল তত্ত্বই হচ্ছে প্রকৃতির উপর্যুক্ত অবস্থা, এটাই ত্রিগুণা প্রকৃতির মহত্ তত্ত্ব আদির মধ্যে পরিবর্তন করে আর পুনঃ তাকেই প্রেরিত করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কাল তত্ত্ব প্রকৃতির তমোগুণকেও সক্রিয় করে মহত্ তত্ত্বাদি পদার্থের নির্মাণ করে। এইভাবে সেটা বিভিন্ন পদার্থকে নিজের প্রেরণা দ্বারা উৎপন্ন করে আর তারপর তাদের প্রেরিত এবং ধারণও করে। আধুনিক বিজ্ঞানও দ্রব্যের ঊর্জা দ্বারা নির্মিত, প্রেরিত হওয়াকে মানে, তারসঙ্গে ঊর্জা দ্বারা দ্রব্যকে ধারণ করা এবং তার রূপকেও মানে। পরা "ওম্" রশ্মি যুক্ত প্রকৃতি পদার্থ, যাকে কাল তত্ত্ব বলে, সেটা কখনও জীর্ণ হয় না। প্রলয়াবস্থাতে প্রকৃতিকে প্রেরিত না করে অব্যক্ত রূপে এই তত্ত্ব যথাযথ বিদ্যমান থাকে। এরদ্বারা আমরা এটা বলতে পারি যে কালের (বা ওম্ রশ্মির) সক্রিয় হওয়াটাই হচ্ছে সৃষ্টির সর্বপ্রথম চরণ, বাস্তবে কাল অব্যক্ত অবস্থায় সর্বদা বিদ্যমান থাকে।
"ওম্" -এর সূক্ষ্মতম স্বরূপ তথা বিভিন্ন অক্ষররূপ বাক্ তত্ত্বের কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না, এই কারণে এদের অক্ষর রশ্মিও বলে। তবে হ্যাঁ, মহাপ্রলয় কালে এই সর্বথা অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" -এর প্রকৃতি রূপ পদার্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ সক্রিয় সম্বন্ধ হয় না। কাল তত্ত্ব অবশ্য নিজের অব্যক্ততম রূপে বিদ্যমান থাকে। এটা মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত এই রূপেই বিদ্যমান থাকে তথা অন্য প্রকৃতি রূপ পদার্থের মধ্যে এটা বীজরূপে অনাদি এবং অনন্ত রূপে সর্বদা বিদ্যমান থাকে। এই অজর কাল চক্রের কারণেই সৃষ্টি-প্রলয়ের চক্র নিয়মিত ও নিরন্তর চলতে থাকে। অক্ষর রশ্মির সম্বন্ধে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে পড়বো।
সারাংশতঃ এই সৃষ্টির মধ্যে সূক্ষ্মতম থেকে শুরু করে স্থূলতম পদার্থ পর্যন্ত সমস্ত পদার্থ কাল দ্বারাই উৎপন্ন এবং কাল দ্বারাই প্রেরিত হয়।

৪.৭ কালের ক্রিয়া বিজ্ঞান

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কালতত্ত্বের ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? চলুন, আমরা একে বোঝার চেষ্টা করি -
যখন পরা "ওম্" রশ্মি (কাল) সর্বপ্রথম মূল প্রকৃতি তত্ত্বকে সৃষ্টির সবথেকে সূক্ষ্ম প্রেরণ দ্বারা যুক্ত করে তাকে বিকৃত করা প্রারম্ভ করে। প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান বিভিন্ন অক্ষর রশ্মিগুলো জাগ্রত হয়ে ধীরে-ধীরে মূল প্রকৃতিকে মহত্, অহংকার ও মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন করে, কিন্তু সত্ব ও রজস্ গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি তথা "ওম্" -এর কালরূপ স্বয়ং সর্বদা অবিকৃত থেকে তমোগুণের সঙ্গে অন্য দুই গুণে যুক্ত প্রকৃতিকেই সৃষ্টি রচনা হেতু প্রেরিত ও বিকৃত করে। সেই কাল তত্ত্ব "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপকে উৎপন্ন করে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন ও ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন করে সপ্ত ব্যাহৃতি রূপী সূক্ষ্ম রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এর পশ্চাৎ সেই রশ্মিরদের সাধন বানিয়ে প্রাণ, অপান আদি সাত মুখ্য প্রাণ রশ্মি, পুনঃ অন্য প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে সৃষ্টি চক্রকে আগে বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানেও কাল তত্ত্ব প্রত্যেক পদার্থ - মূলকণা, তরঙ্গ, আকাশ আদির ভিতরে বিদ্যমান থেকে তাদের মধ্যে বিদ্যমান "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ, ব্যাহৃতি সূক্ষ্ম রশ্মি থেকে শুরু করে সমস্ত রশ্মিকে প্রেরিত করে সবগুলোকে সক্রিয় করে, তারসঙ্গে সেগুলোর মধ্যে উচিত জীর্ণতাও নিয়ে আসে।
প্রশ্নঃ এই প্রেরণ ও জাগরণ কর্ম কি?
উত্তরঃ আমরা সংসারের মধ্যে প্রেরণা বা জাগরণের ভিন্ন-ভিন্ন রূপ দেখে থাকি। এক ব্যক্তি কোনো পশুকে লাঠি দিয়ে হাঁক দেয়, তখন সে সেই পশুটাকে লাঠি দিয়ে কোনো কার্য করার প্রেরণাই করে। পিতা তার উদ্দণ্ড পুত্রকে তাড়না দ্বারাই প্রেরণা করে, তাকে ধাক্কা মেরে -মেরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়। সেই প্রেরণার কারণে সেই পুত্র যেতে বা কার্য করতে বিবশ হয়। আবার সেই পিতাই বুদ্ধিমান তথা আজ্ঞাকারী পুত্রকে চোখের সংকেত মাত্র দ্বারা প্রেরণা করে ত্বরিত ক্রিয়াশীল বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে এক ব্যক্তি কোনো কার্যকে তীব্রতার সঙ্গে করার সময় কোনো এক শোকের সংবাদ দ্বারা আহত হয়ে নিজেকে দুর্বল মনে করে বসে পড়ে, সে বাস্তবে দুর্বল হয়েও যায়। সারাংশতঃ চেতন তত্ত্ব কালকে অব্যক্ত ও অজ্ঞেয় ভাব দ্বারা প্রেরিত ও উৎপন্ন করে। পুনঃ কাল প্রকৃতির মধ্যে সূক্ষ্ম প্রেরণ ও স্পন্দন প্রারম্ভ করে। প্রকৃতি স্পন্দিত ও বিকৃত হয়ে মহত্-অহংকার ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার পশ্চাৎ এই প্রেরণ স্পন্দন প্রক্রিয়া আগে চলে। যেকোনো পদার্থের মধ্যে তার পূর্ববর্তী পদার্থের প্রেরণ অবশ্যই বিদ্যমান থাকে। এইভাবে সমস্ত সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পদার্থ পরস্পর চেতন তত্ত্ব ও কালের প্রেরণ দ্বারা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে যুক্ত হয়ে কার্য করে। কাল, চেতন তত্ত্ব বা মনস্তত্ত্ব আদির প্রেরণ কর্ম অতি সূক্ষ্ম হয়, তাকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

৪.৮ সময়ের যাত্রা (time travel) করা কি সম্ভব ?

কিছু ব্যক্তি কালের মধ্যে আগে ও পিছনে যাওয়ার (সময় যাত্রার) কথা বলে, কিন্তু সেটা কি সম্ভব? চলুন, জানার চেষ্টা করি -
কালের পিছনে যাওয়া অর্থাৎ ভূতের মধ্যে যাওয়ার অর্থ কি? কোনো বৈজ্ঞানিক কি কালের মধ্যে পিছনে গিয়ে নিজের যুবক বা শিশু রূপকে দেখতে পারবে, আর সে কি সেই রূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে? সে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে কি সাক্ষাৎ করতে পারবে, যারা বর্তমানে মরে গেছে? পারবে কি রামায়ণ, মহাভারত কালের মধ্যে গিয়ে সেই যুগের মানুষ ও অন্য সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে দেখতে এবং এই ভূমিতে উৎপন্ন করতে? এরকম সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, আমি এটা তো স্বীকার করি যে কোনোদিন ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক কোনো টেকনিকের আবিষ্কার করে মহাভারত যুদ্ধের ধ্বনিগুলোকে জানতে পারবে (কারণ বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে শব্দ হচ্ছে নিত্য), তবে বাস্তবে তারা সেই সময়ের সেই পরিস্থিতিকে উৎপন্ন করতে পারবে না। কোনো রাসায়নিক প্রয়োগ দ্বারা বৃদ্ধ ব্যক্তিও যুবক হতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তার কাল পুনঃ ফিরে আসবে। বিজ্ঞান বল ও ঊর্জার কোনো বিশেষ টেকনিকের আধারে কোনো পদার্থ বিশেষের মধ্যে হওয়া প্রক্রিয়াগুলোকে মন্দ বা তীব্র তো করতে পারবে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে কালের গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে এরকমটা করা যাবে।
এখন আমরা ভবিষ্যতে যাওয়া নিয়ে বিচার করবো, তো এটার অর্থ কি ? আপনি কি ভবিষ্যতে হবে এমন প্রত্যেক পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষ দেখতে পাবেন? এটা হচ্ছে একটা কল্পনা মাত্র। ভূত তো নিশ্চিতই হয়, কিন্তু ভবিষ্যত তো নিশ্চিতও নয়, তাহলে তার সাক্ষাৎ কিভাবে হবে? কোনো উচ্চ কোটির য়োগী ভবিষ্যতের কিছু অনুমান করতেও পারেন, এটা সম্ভব, কিন্তু এরদ্বারা এটা মতেই সিদ্ধ হবে না যে তিনি কালের মধ্যে আগে চলে গেছেন। কোনো বৈজ্ঞানিক কি পারবে সময় যাত্রা করে স্বয়ংকে চিতার মধ্যে জ্বলা দেখতে? কিছুক্ষণের জন্যও কি ভবিষ্যতের ভূগোলকে সাক্ষাৎ করতে পারবে? বস্তুতঃ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গণিতকেই সর্বথা সত্য মনে করে কালকে না জেনেই এরকম কথা বলছে। তারা আইনস্টাইনের সাপেক্ষতার সিদ্ধান্তেরও দুরুপয়োগ করছে। বাস্তবে তারা কাল আর সময় অবধির মধ্যে পার্থক্যকেও বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ব্যক্তি লম্বা, চওড়া, উচ্চতাকে অথবা তার মাপক মিটার, ফিট আদিকেই আকাশ মনে করে বসে, তাহলে কি এটা তার ভ্রম হবে না? এরকমই স্থিতি ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড আদি অবধি মাপি মাপককে কাল মেনে নিলে হবে। বৈদিক বিজ্ঞান থেকে অনভিজ্ঞা বর্তমান বিজ্ঞান এরকম ভুল অনেকদিন ধরে করে আসছে আর করতেই থাকবে, এরকমটা আমার মত।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. কাল হচ্ছে একটা নিষ্ক্রিয় দ্রব্য, যা পরা "ওম্" রশ্মির দ্বারা ত্রিগুণা প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয়।
2. কাল তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির দুটি গুণ সত্ব ও রজস্ বিদ্যমান থাকে আর তমস্ গুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
3. কালের মধ্যে তমস্ না হওয়ার কারণে এটা সর্বদা গতিশীল থাকে।
4. কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে মহত্ আদির মধ্যে পরিবর্তিত করে পদার্থের নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করে।
5. কাল তত্ত্ব নিত্য ও অবিনাশী পদার্থকে জীর্ণ করে না, অথচ অনিত্য পদার্থকে নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।
6. কালের পিছনে যাওয়া অর্থাৎ ভূতের মধ্যে যাওয়ার মতো কথা হচ্ছে কল্পনা মাত্র, এরকমটা সম্ভব না।



কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ যে পদার্থ সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়, তাকে বৈদিক ভৌতিকীর মধ্যে মহত্ বলা হয়েছে। এই সৃষ্টির মধ্যে এটাই হচ্ছে সেই প্রাথমিক উৎপন্ন পদার্থ যা বল, ক্রিয়া আদির বীজরূপ হয় তথা যার মধ্যে বিকারের পরিমাণস্বরূপ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নানা পদার্থ উৎপন্ন হয়। মহত্-এর উত্তেজিত অবস্থাকে অহংকার বলে আর অহংকারের উত্তেজিত অবস্থাকে মন বলে। যেরকম কাঁচা আম কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে আধপাকা আমে পরিবর্তিত হয়ে যায় আর তারপর সেই আধপাকা আম পাকা-আম হয়ে যায়।

৫.১ মহত্ তত্ত্ব


বেদ বিজ্ঞান আলোক

মহত্ তত্ত্বও অব্যক্ত প্রকৃতির লক্ষণের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ অব্যক্তের মতোই হয়, কিন্তু এটা সর্বথা অব্যক্ত হয় না। সাংখ্যদর্শনের মধ্যে মহর্ষি কপিল মহত্, অহংকার এবং মন এই তিন পদার্থকে পৃথক-পৃথক মেনেছেন। এখানে মহত্ তত্ত্বের স্বরূপ নিম্নানুসারে দেওয়া হল -
1. এই পদার্থ সূক্ষ্ম, কিন্তু ব্যাপক বল তথা অতি নিস্তেজ অব্যক্ত দীপ্তির সঙ্গে যুক্ত হয়।
2. এই মহত্ তত্ত্বই সর্বপ্রথম সংযোগ বিয়োগ আদি গুণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা পদার্থের নির্মাণ প্রারম্ভ করে।
3. মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর দৃষ্টিতে কারণ বিদ্যুৎ (বিদ্যুতের সূক্ষ্মতম রূপ) হচ্ছে এটাই, যেটা একরস প্রকৃতি অবস্থার কিছু বিক্ষুব্ধ রূপে বিদ্যমান হয়।
4. এই পদার্থ সব পদার্থকে নিয়ন্ত্রণকারী স্বভাবের হয়, অর্থাৎ অতি সূক্ষ্ম বলের উৎপত্তি সর্বপ্রথম এটাই হয়।
5. এখান থেকেই জড় পদার্থ যেন প্রকটাবস্থাতে আসা প্রারম্ভ করে অর্থাৎ প্রকৃতির অব্যক্ত অবস্থা ভঙ্গ হয়ে যায়।
6. এই পদার্থ সব পদার্থকে ধারণ করতে সক্ষম হয়।
7. এর কারণেই প্রত্যেক পদার্থ সংরক্ষিত ও গতিশীল থাকতে পারে।
এই পদার্থের মধ্যে সর্বত্র আকর্ষণ এবং ভেদক বল উৎপন্ন হয়ে ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন হতে থাকে।

৫.২ অহংকার


মহর্ষি কপিলের দৃষ্টিতে মহত্ তত্ত্বের চরম অর্থাৎ অগ্রিম রূপকেই অহংকার বলে। অহংকার তত্ত্ব সত্ব, রজস্ ও তমস্-এর প্রধানতার দ্বারা ক্রমশঃ বৈকারিক, তৈজস এবং ভূতাদি নামের হয়। মহত্ তত্ত্বকে সেই সময় অহংকার বলে যখন এটা সৃষ্টি উৎপত্তির দ্বিতীয় চরণ অর্থাৎ তার প্রকট অবস্থার মধ্যে হয়। এর থেকে নানা দেব পদার্থ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণ, ইন্দ্রিয় ও মন এবং তিন ব্যাহৃতি রূপ সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মি রূপী লোক উৎপন্ন হয়, তার সঙ্গে-সঙ্গে সব ছন্দ রশ্মি এর থেকেই উৎপন্ন হয়। এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি অহংকার রূপই হয় তথা তারই দ্বারা নানা কামনার অর্থাৎ আকর্ষণ আদি বলের সঙ্গে যুক্ত হয়।


এখানে আমরা অহংকার বা মহত্ তত্ত্বের স্বরূপের উপর বিচার করলাম, আর এতে স্পষ্ট হলাম যে এটার মধ্যে বিদ্যুৎ আবেশ, দ্রব্যমান এবং স্পষ্ট ও অপেক্ষিত গতিশীলতা আদির প্রাদুর্ভাব হয় না। এই রকম স্থিতিতে বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষায় এটা না তো দ্রব্য হবে, না ঊর্জা আর না আকাশ। বৈদিক ভাষায় একে দ্রব্য ও ঊর্জা দুটোই বলা যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষায় এই পদার্থ হচ্ছে এখনও কল্পনাতীত।
এবার চলুন, আমরা এটার উপর আরও অধিক বিচার করার চেষ্টা করি। কাল তত্ত্ব সক্রিয় হতেই সম্পূর্ণ ত্রিগুণা প্রকৃতির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হতে থাকে আর "ওম্" রশ্মির পরা অবস্থা অব্যক্ত ভাব দ্বারা সর্বত্র প্রেরিত হতে থাকে অর্থাৎ কাল তত্ত্ব সম্পূর্ণ প্রকৃতির মধ্যে সঞ্চরণ হতে থাকে। এই সঞ্চরণ এই ধরনের হয় যে সত্বাদি তিনটি গুণ সক্রিয় হয়ে ওঠে, এই অবস্থাকেই মহত্ বলা হয়। একে এইভাবে বুঝে নিন যে, যখন পরা "ওম্" রশ্মি সত্ব আর রজস্ এই দুই গুণকেই সক্রিয় করে, তখন মূল প্রকৃতি কাল তত্ত্বের রূপ ধারণ করে আর যখন পরা "ওম্" রশ্মি (কাল তত্ত্ব) সেই মূল প্রকৃতির তিন গুণকে সক্রিয় করে, তখন সেটা মহত্ তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে একরস হয়ে ভরা থাকে অর্থাৎ এরমধ্যে প্রায় কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। "ওম্" রশ্মির পরা অবস্থা সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে এক সঙ্গে ব্যাপ্ত থাকে, যারফলে তিন গুণ সবথেকে সূক্ষ্ম রূপে সক্রিয় বা জাগ্রত হতে থাকে। এতে সেই পদার্থের মধ্যে এরকম মন্দতম দীপ্তি হয় যেটা সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে অন্যত্র কোথাও হয় না। এই সৃষ্টির মধ্যে যে ঘন অন্ধকার আমরা দেখি, তার থেকেও অধিক ঘন অন্ধকার মহত্ তত্ত্বের মধ্যে হয়। মহত্ -এর চরমাবস্থা রূপ অহংকারও এরকম অন্ধকার যুক্ত হয়। এই সময় পরারূপ "ওম্" রশ্মির অতিরিক্ত অন্য যেকোনো সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম রশ্মিও উৎপন্ন হতে পারে না।

৫.৩ মনস্তত্ত্ব

যখন সর্বত্র ব্যাপ্ত অহংকার তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের সঞ্চরণ হয়, তখন অহংকারের সেই অবস্থাকেই মনস্তত্ত্ব বলা হয়। মনও মহত্ তত্ত্ব বা অহংকারের মতো সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। এটা নিজের থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক পদার্থকে বাইরে ও ভিতর থেকে ব্যাপ্ত করে। এই পদার্থ "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের সঙ্গে মিলে তাকে নিজের সঙ্গে ধারণ করে থাকে। মনস্তত্ত্বের সার হল "ওম্"-এর পশ্যন্তী রূপ তথা এই বাক্ তত্ত্ব থেকেই সমস্ত কর্ম উৎপন্ন হয়। বস্তুতঃ এই "ওম্" রশ্মির কারণেই মনস্তত্ত্ব সক্রিয় হয় অথবা অহংকার তত্ত্ব মনস্তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। যদি মহত্ তত্ত্ব, মনস্তত্ত্বকে একটা সূক্ষ্ম ঊর্জার মতো মনে করে বিচার করা হয়, তাহলে এরকমটা মনে হবে যে এই অদৃশ্য ও অগ্রাহ্য ঊর্জা নগণ্য শক্তির হয়, যা একরসবত্ সর্বত্র ভরা থাকে। এটার রশ্মি প্রায় শূন্য অথবা অত্যল্প আবৃত্তি এবং অনন্তের সমকক্ষ তরঙ্গদৈর্ধ্যকারী হয়। এইজন্য এই তত্ত্বও প্রায়শঃ অচল রূপে সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। মনস্তত্ত্বের ভিতরে সমস্ত সংযোগ-বিয়োগ আদি ক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই প্রারম্ভ হয়। এই "ওম্" রশ্মি রূপ বাক্ তত্ত্বই মনস্তত্ত্বকে সর্গ প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করার যোগ্য বানিয়ে তোলে অর্থাৎ তাকে সক্রিয় করে।
এইভাবে সম্পূর্ণ অবকাশরূপ আকাশ সেই সময় মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্"-এর পশ্যন্তী রূপের মিশ্রণে ভরে যায়। সেই সময় সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে কিছু ব্যক্ত, কিন্তু মানবের টেকনিকের দৃষ্টিতে অব্যক্ত দীপ্তি ও সূক্ষ্মতম কম্পনের বিদ্যমানতা হয়। এখানে মনস্তত্ত্ব আগামী পদার্থের উৎপত্তি হেতু যোগ্য হয়ে উঠে। এই পদার্থের মধ্যে এখনও একরসতা ভঙ্গ হয়নি, কিন্তু হওয়ার জন্য অনুকূল স্থিতি হয়ে গেছে। উদাহরণের জন্য যেভাবে বীজ রোপণের পূর্বে খেতে হাল দিয়ে চাষ করা হয় আর সেই বীজ রোপণের জন্য তৈরি থাকে, ঠিক সেইভাবে মনস্তত্ত্ব অগ্রিম স্তরের পশ্যন্তী রশ্মি বানানোর জন্য তৈরি থাকে, তদুপরান্ত অন্য পদার্থের উৎপত্তি প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে প্রারম্ভ হবে।

৫.৪ মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দনের প্রক্রিয়া

মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম সূক্ষ্ম পরিমাণকারক স্পন্দন হয়, যা দৈবী গায়ত্রী আদি সাতটা ভাগে বিভক্ত। এর পশ্চাৎ উত্তরোত্তর বড়ো পরিমাণের মধ্যে স্পন্দন হতে থাকে। এই স্পন্দন অত্যন্ত তীব্র গতিতে এবং অতি ব্যাপক স্তরে পরস্পর মিশ্রিত ভাব রাখার সঙ্গে হয়, তবুও সেই সমস্ত স্পন্দনের পৃথক-পৃথক কিন্তু অজ্ঞেয় অস্তিত্ব সর্বদা বিদ্যমান থাকে। যেভাবে কোনো পুকুরের মধ্যে অনেক স্থানে পাথর ছুড়ে দিল অনেক তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। তারা পরস্পর ধাক্কা মারে, মিশ্রিত হওয়ার মতো মনে হয়, কিন্তু তাদের পৃথক অস্তিত্ব সর্বদা বিদ্যমান থাকে আর যেভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অনেক প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, পরস্পর ধাক্কা লেগে কিছুক্ষণের জন্য সুপার পজিশনের স্থিতিও বানায়, অত্যন্ত তীব্র গতিতে এদিক-সেদিক গতিও করে, তবুও তাদের পৃথক অস্তিত্ব সর্বদা বিদ্যমান থাকে। যদি এরকমটা না হতো তাহলে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অব্যবস্থা ছড়িয়ে দৃশ্য, শ্রব্য এবং সঞ্চার আদি ব্যবস্থাগুলো ধ্বংস হয়ে যেত। ঠিক সেইভাবে সৃষ্টির প্রারম্ভিক চরণের মধ্যে মহত্ তত্ত্বের মধ্যে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি রূপী যে স্পন্দন উৎপন্ন হয়, তা অতি তীব্র গতিশীল এবং পরস্পর ধাক্কা লাগার পরেও নিজের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখে। যদি এরকমটা না হতো তাহলে বিভিন্ন স্পন্দন একে-অপরকে নষ্ট করতে পারতো, যার ফলে কোনো সৃজন কর্ম উৎপন্ন অথবা জারি থাকতে পারতো না।
বিভিন্ন ছন্দ রূপী স্পন্দনের মধ্যে অর্ধেক-অর্ধেক ভাগে একটা অতি সূক্ষ্ম বিরাম থাকে। এই ধরনের বিরামের কারণে অনেক মরুত্ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে যায়। কিভাবে উৎপন্ন হয়? এটা এখনও অনুসন্ধানের বিষয়। এই মরুত্ রশ্মির গতি চার প্রকারের হয়। এই বিরামকে আমরা বেদ মন্ত্রের রচনা দ্বারা বুঝতে পারবো। এখানে আমরা উদাহরণের জন্য প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রকে নিবো -
তত্সবিতুর্বরেণ্যম্ | ভর্গো দেবস্য ধীমহি | ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াত্।।
এখানে " | " এই বিরাম আছে, যেখানে সূক্ষ্ম মরুত্ রশ্মি ("হিম্" এবং ব্যাহৃতি আদি) উৎপন্ন হতে থাকে। পরবর্তীতে এই ছন্দ রশ্মি থেকে অনেক প্রকারের মূল কণা বলা হয় এমন কণা উৎপন্ন হয়, যার মুখ্যতঃ চারটা গুণ হয় -
1. আবেশ
2. দ্রব্যমান
3. ঘূর্ণন
4. গতিশীলতা
এই সবের উৎপত্তি মনস্তত্ত্বের মধ্যে সেই স্পন্দনের কারণেই হয়। এই স্পন্দন কি? এর কি কি গুণ আছে? এইসব বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে চর্চা করবো।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ সর্বপ্রথম মহত্ তত্ত্ব উৎপন্ন হয়।
2. মহত্ -এর উত্তেজিত অবস্থা অহংকার আর অহংকারের উত্তেজিত অবস্থাকে মন বলে।
3. অহংকার হওয়া পর্যন্ত সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুত্, আবেশ, দ্রব্যমান, আকাশ, তরঙ্গ, কণা আদির নির্মাণ হয় না।
4. যখন কাল তত্ত্ব "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের সঞ্চরণ অহংকারের মধ্যে করে, তখন পদার্থের সেই অবস্থাই মনস্তত্ত্ব হয়।
5. মনস্তত্ত্বের মধ্যে ছন্দ রশ্মি রূপী যে স্পন্দন উৎপন্ন হয়, তারা পরস্পর ধাক্কা লাগার পরেও নিজের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখে।
6. মহত্ তত্ত্ব বা মনস্তত্ত্বকে প্রায় শূন্য, অদৃশ্য, একরসবত্ ও অগ্রাহ্য ঊর্জার মতো মানা যেতে পারে।

বেদ বিজ্ঞান আলোক

বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা কথিত সব মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন থেকে হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে। যদি কখনও এরকম কোনো টেকনিক বিকশিত হয়, যা দিয়ে পশ্যন্তী ধ্বনিকে শোনা যেতে পারে, তাহলে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেক স্থানে বেদের সস্বর মন্ত্র শুনতে পারবো। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি একাকী না থেকে সমূহতে থাকে। যখন সেই রশ্মির সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়। যখন সেই রশ্মির সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মূলকণার রূপ ধারণ করে নেয়। যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টার) নির্মাণ করে। এই অধ্যায়ে আমরা এই রশ্মির বর্গীকরণ আর তাদের গুণকে বোঝার চেষ্টা করবো। পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে বোঝার জন্য আমাদের এই রশ্মির গুণগুলোকে বুঝে নেওয়া অতি আবশ্যক।

৬.১ অক্ষর রশ্মি

সব ধরনের রশ্মি সূক্ষ্ম অক্ষর রূপ অবয়ব দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে আমরা সর্বপ্রথম অক্ষর রূপ পদার্থের উপর বিচার করবো।
মহত্ তত্ত্ব এই অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়। কালের উৎপত্তির সময়েই সাম্যাবস্থার মধ্যে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়। এই রশ্মি পূর্ণতভাবে কখনও অবিদ্যামান হয় না, সেটা মহাপ্রলয়াবস্থাই হোক না কেন। এই রশ্মিগুলো ছন্দ রূপ ধারণ তখনই করে, যখন সেগুলো শব্দের রূপ ধারণ করে নেয়। একে এইভাবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, যেরকম কম্পিউটারের স্ক্রিনে অক্ষর অব্যক্ত হয় আর যখন আমরা কিবোর্ডে বটন চাপ দেই, সেটা আমাদের সমক্ষ ব্যক্ত হয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে মহাপ্রলয় অবস্থাতে অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" রশ্মির সঞ্চরণ দ্বারা ব্যক্ত হয়ে যায়। অক্ষর রশ্মি দুই প্রকারের হয় -
1. স্বর = মনস্তত্ত্বের ভিতরে এটা অত্যন্ত লঘু কম্পনের রূপে (যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম হয়) বিদ্যমান থাকে। এই লঘু রশ্মি স্বয়ং প্রকাশিত হয় অর্থাৎ এদের ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য ব্যঞ্জনের আবশ্যকতা হয় না, কিন্তু এটা নিরন্তর লম্বা দূরত্ব পর্যন্ত গতিমান থাকতে পারে না।
2. ব্যঞ্জন = এই অব্যক্ত সূক্ষ্মতম অবয়বও মহত্তত্ত্বেরই রূপ হয়, যা সর্বদা স্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গতিশীল হতে পারে। মহত্ বা অহংকারের মধ্যে অকস্মাৎ সূক্ষ্মতম স্ফোট রূপে উৎপন্ন ব্যঞ্জন, যা এক স্থানে উৎপন্ন হয়ে রয়ে যায়। সেটা কোনো স্বর রূপী সূক্ষ্ম কম্পনের সঙ্গে মিলিত হলে পরে গতি, বল ও প্রকাশের অব্যক্ত রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটা স্বরের সঙ্গে মিলে সূক্ষ্ম ছন্দের রূপ ধারণ করে নেয়। "ওম্", "ভূঃ" আদি ছন্দ রশ্মি হল এর উদাহরণ ।
[যেরকম মোতি দিয়ে মালা তৈরি হয়, ঠিক সেইভাবে অক্ষর ও ব্যঞ্জন রশ্মির সঙ্গে মিলে বড়ো ছন্দ রশ্মি (ঋচা/মন্ত্র) তৈরি হয়।]
ওম্ (অ+উ+ম্)
এরমধ্যে "অ", "উ" দুটি স্বর তথা "ম্" ব্যঞ্জনের যোগ হয়। যদিও "ম্" ব্যঞ্জন "অ" এবং "উ" এই দুটি স্বরের সঙ্গে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে "ম" তথা "অম্" এবং "মু" তথা "উম্" ছন্দের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু "অ+উ"= "ও"-এর সঙ্গে "ম্" সংগত হয়ে যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেটা সর্বাধিক ব্যাপক বল ও গতির দ্বারা সম্পন্ন হয়। "ওম্" ছন্দের মধ্যে মনস্ তত্ত্ব বা মহত্ তত্ত্বের মাত্রা অন্য যেকোনো দৈবী গায়ত্রী ছন্দের তুলনায় অধিক হওয়ায় এর ব্যাপকতা সর্বাধিক হয়।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

🔷 এটা হল অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সব প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মি এর দ্বারাই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
🔷 এই রশ্মি মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করে।
🔷 এই রশ্মিই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করে, আবার বেঁধেও রাখে। মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটা পশ্যন্তী অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, অথচ মহত্ বা কালের মধ্যে পরা অবস্থায়।
মহত্ বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন এটা এক এরকম স্পন্দন, যা এতই সূক্ষ্ম হয়, যেন সেটা স্পন্দনই হয় না অথবা একে এরকম তরঙ্গ বলা যেতে পারে, যার তরঙ্গদৈর্ধ্য প্রায় অনন্ত হবে, তখন আবৃত্তি প্রায় শূন্য হবে। বাস্তবিকতা এই হচ্ছে যে একে অভিব্যক্ত করাই অসম্ভব। এইভাবে বিজ্ঞানের ভাষায় একে অত্যন্ত ক্ষীণ শক্তিসম্পন্ন অব্যক্ত সূক্ষ্মতম এবং সর্বপ্রথম উৎপন্ন ঊর্জার রূপ বলা যেতে পারে।
ধ্যাতব্য হল, সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। উদাহরণ, যেভাবে মস্তিষ্ক বল দ্বারা শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তার থেকে স্থূল বল উৎপন্ন করে দেয়।

6.2 প্রাণ ও ছন্দ তত্ত্ব

যখন "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা অর্থাৎ ঊর্জা বেড়ে যায়, সেই সময় চেতন তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যা সর্বত্র একরসবত্ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মির দ্বারা এরকম স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরের মধ্যে এক সঙ্গে তীব্রতে অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ঢেউ উৎপন্ন করছে, সেইভাবে চেতন তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী ঢেউ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে©। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই ঢেউ (রশ্মি) মুখ্যতঃ চার প্রকারের হয় -
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
(স) মাস ও ঋতু রশ্মি
(দ) অন্য ছন্দ ও মরুত্ রশ্মি।
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
অক্ষর রশ্মির উৎপত্তির পরে নিম্নলিখিত প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -
ব্যাহৃতি রশ্মি
যে রশ্মি বিশেষ রূপে নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে।
প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির মধ্যে সর্বপ্রথম সাত ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি মনস্তত্ত্ব থেকে নিম্নলিখিত ক্রমে হয় -
1. ভূঃ = "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের উৎপত্তির পশ্চাৎ অতি শীঘ্রই এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মিরই উৎপত্তি হয়। যখন কখনও ঋক্® সঞ্জক রশ্মি, পৃথিবী তত্ত্ব বা অপ্রকাশিত কণার উৎপত্তি হয়, তারমধ্যে এই রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মি নানা রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে সক্ষম হয় তথা বাধক সূক্ষ্ম রশ্মিদের নিষিদ্ধ করে ক্রিয়াগুলোকে নির্বাধ বানায়।
2. ভুবঃ = মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভূঃ" রূপ স্পন্দনগুলোকে "ওম্" রশ্মি বিকৃত করে "ভুবঃ" রশ্মিদের উৎপন্ন করে। কালান্তরে এই রশ্মি আকাশ তথা "য়জুঃ" নামক সঞ্জক রশ্মিদের উৎপন্ন করতে সর্বোপরি ভুমিকা পালন করা।
3. স্বঃ = "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বের মধ্যে "স্বঃ" রশ্মি রূপ স্পন্দন উৎপন্ন হয়। কালান্তরে সাম রশ্মি এবং প্রকাশাণুর (ফোটন) নির্মাণের মধ্যে এই রশ্মির ভারী ভূমিকা থাকে।
4. মহঃ= এই সূক্ষ্ম রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পরস্পর সংযুক্ত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
5. জনঃ= এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের মধ্যে সর্বতঃ উৎপন্ন হয়ে তাদের সঙ্গত করে অন্য ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এই রশ্মি বাধক রশ্মিকে প্রতিবন্ধিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
6. তপঃ= এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পৃষ্ঠ ভাগ অথবা কিনারায় অবস্থিত হয়ে তাদের বহির্ভাগে ব্যাপ্ত বা সঙ্গত হয়ে তাদের রক্ষা করে।
7. সত্যম্ = এই রশ্মি সব রশ্মির সঙ্গে সঙ্গত ও পূর্ণ ব্যাপ্ত হয়ে তাদের আধার প্রদান করে তাদের বহির্ভাগে অবস্থিত থাকে।
মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল ব্যাহৃতি রশ্মি বিভিন্ন বেদ-ঋচা রূপী ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দিতে ও সুরক্ষিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই রশ্মির অবিদ্যমানতায় বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি আর তারথেকে নির্মিত বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা আকাশ আদি সবই নির্বল বা নষ্ট হয়ে যাবে।

(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি

উপরিউক্ত সূক্ষ্ম রশ্মির পশ্চাৎ প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এর বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সব প্রাণ রশ্মি অক্ষরের সমুদায় হয়। প্রাণ তত্ত্ব দড়ির সমান নিয়ন্ত্রণকারী হয়, এটা মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির মিলন দ্বারাই উৎপন্ন হয়। প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে একটাই, কিন্তু তার নানা প্রকারের গতির কারণে নানা ভেদ হয়ে যায়। মহর্ষি ব্যাস বলেছেন সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়। এটা হল মুখ্য প্রাণ। বস্তুতঃ এই রশ্মি এগারো প্রকারের হয়। মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন স্পন্দনের তীব্রতা, গতি এবং স্বভাব আদির ভেদ হতে একটা প্রাণ তত্ত্বেরই এগারোটা রূপ হয়। চলুন, এই রশ্মিগুলোর গুণ সংক্ষেপে জেনে নিই -
1. সূত্রাত্মা বায়ু = সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিকে পরস্পর সঙ্গত করার বিশেষ গুণ যুক্ত হয়। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলোই। মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এটা এরকম অব্যক্ত স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়, যা পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জালের সমান বোনা থাকে। এই রশ্মিগুলো এই রকম উৎপন্ন হয় যে প্রত্যেক রশ্মির মধ্যে থেকে আরও সূক্ষ্ম রশ্মি উৎসর্জিত হয়ে একটা জাল বানায়, এই কারণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি নিজের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রূপ সূক্ষ্ম রশ্মির (স্পন্দনের) দ্বারাই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের সঙ্গে তথা পরস্পর বেঁধে রাখে।
সূত্রাত্মা বায়ুকে একটা সুতোর সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে, যা সব কণা বা রশ্মিকে একে-অন্যের সঙ্গে বোনা থাকে। যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির ধনঞ্জয় রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির মধ্যে প্রতিকর্ষণ একদম হয় না।

বেদ বিজ্ঞান আলোক
2. ধনঞ্জয় = এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক তীব্র গতির স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মির গতি প্রকাশের গতির অপেক্ষায় চার গুণ অধিক হয়। যদি প্রকাশের গতি তিন লক্ষ গুণ কিমি প্রতি সেকেণ্ড ধরা হয়, তাহলে ধনঞ্জয় রশ্মির গতি প্রায় বারো লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড হবে। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এরথেকে অধিক গতি কোনো পদার্থের মধ্যে হয় না। এখানে আপনার মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুসারে তো প্রকাশের থেকে বেশি গতি অন্য কারও হতে পারে না, তাহলে ধনঞ্জয় প্রাণের এত গতি কিভাবে হতে পারে? এটা কি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হচ্ছে না? এর উত্তরটা হল এই রকম যে, সেখানে প্রকাশের গতি আকাশের মধ্যে করা হয়েছে অর্থাৎ আকাশের মধ্যে যেকোনো বস্তুর গতি প্রকাশের থেকে অধিক হবে না। অন্যদিকে ধনঞ্জয় রশ্মি হচ্ছে আকাশের থেকে সূক্ষ্ম, এইজন্য তাকে গতি করার জন্য আকাশের আবশ্যকতা হয় না, সেটা তো মনস্তত্ত্বের মধ্যে গতি করে। এইভাবে এই রশ্মি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরোধ করে না।
এই রশ্মির সংযোগ বা আচ্ছাদন দ্বারা যেকোনো রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের গতি তীব্র হয়ে যায়। প্রকাশ বা যেকোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এই ধনঞ্জয় রশ্মির দ্বারাই টেনে নিয়ে আসা হয়, এই কারণে তার গতি ও শক্তি তীব্র হয়। এই রশ্মি যেরকম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং তীব্রগামী সূক্ষ্ম কণার গতির কারণ হয়, সেইরকম সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে মিলে কণার অক্ষের উপর ঘূর্ণনেরও কারণ হয়।
3. প্রাণ = সব প্রাথমিক প্রাণের মধ্যে এই প্রাণ রশ্মির স্থান সর্বোচ্চ মানা হয়, এর নাম দিয়েই সব প্রকারের প্রাণ রশ্মিদের গ্রহণ করা হয়। যখন মনস্ তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো তীব্র বেগ ও বলের সঙ্গে গমন করে, তখন এরথেকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন রূপে উৎপন্ন রশ্মিদের "প্রাণ" বলা হয়। এরমধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য থাকে। এটা সবার আকর্ষক হয়ে সবাইকে আকর্ষণ বলের সঙ্গে যুক্ত করে সেই কণা বা তরঙ্গের মধ্যে ভিতর থেকে বাইরে নিরন্তর সঞ্চারিত হতে থাকে। এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানেই আকর্ষণ বলের শক্তি আছে, সেখানে এই বলের মূল কারণ রূপ এই তত্ত্বের শক্তি অবশ্যই বিদ্যমান আছে। মহর্ষি ব্যাস -এর প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে কথন হল -
"প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্র০ সূ০ 1.3.39)
এর দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রাণ সূক্ষ্ম স্পন্দনের হয়। ধ্যান রাখবেন যে, এই পরিভাষা কেবল এই প্রাণ রশ্মির জন্য নয় বরং সব প্রাণ রশ্মিগুলো জন্য।
4. অপান= এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতর "ওম্" রশ্মির দ্বারা এইরকম স্পন্দন, যার গতি প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণের অপেক্ষায় ঠিক বিপরীত তথা যা বিভিন্ন স্পন্দনকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রাণ ও অপান উভয় রশ্মি যৌথভাবে থাকার পরেও পরস্পর বিপরীত দিশাতে স্পন্দিত হতে থাকে, এই কারণে অপান রশ্মি প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করার মূল কারণ হয়। প্রাণ রশ্মির প্রতি এই রশ্মির আকর্ষণ ভাব থাকে।
প্রাণ রশ্মি সত্বপ্রধান এবং অপান রশ্মি রজস্ প্রধান হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান রশ্মি ক্রমশঃ বল ও ক্রিয়া প্রধান হয়। বস্তুতঃ এই উভয় প্রকারের রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত থাকে। কোথাও এর পৃথক্পন দেখা যায় না। এর সংযুক্ত স্বভাবের দ্বারা প্রত্যেক পদার্থের বল এবং ক্রিয়া দুটোই সম্পন্ন হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে প্রাণের প্রাধান্য তথা অপান গৌণ রূপে বিদ্যমান হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য কিন্তু ক্রিয়াশীলতা গৌণ হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে অপানের প্রাধান্য এবং প্রাণ গৌণ হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে ক্রিয়াশীলতা প্রধান তথা বলের ন্যূনতা হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত বল আকর্ষণ এবং প্রতিকর্ষণ দুই রূপেই বিদ্যমান হয়, কিন্তু গুরুত্বাকর্ষণ বল প্রায়শঃ আকর্ষণেরই প্রভাব রাখে। এর কারণ হল এই বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মির প্রাধান্য তথা অপানের অপ্রাধান্য হওয়া। এইদিকে ক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিতে বিচার করলে পরে, তাহলে যে পদার্থের মধ্যে যত অধিক গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা দ্রব্যমান হবে,সেটা ততই কম সক্রিয় হবে। এই দৃষ্টিতে এখানে অপান প্রাণের ন্যূনতা বা অবিদ্যমানতা সিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে গুরুত্ব বল রশ্মির মধ্যে কেবল আকর্ষণ বলই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সেই রশ্মির ক্রিয়াশীলতা খুবই কম হয়, এই কারণে এটা অত্যন্ত কম আবৃত্তির হয় অর্থাৎ নির্বল হয়।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

প্রশ্ন - যখন প্রাণ এবং অপান উভয় যুগ্মেরই রূপে থাকে তখন এরমধ্যে কারও প্রাধান্য ও কারও অপ্রাধান্যতা কিভাবে বলা যেতে পারে?
উত্তর - যুগ্মের মধ্যেও একটা অধিক বলবান্ হতে পারে আর যেটা বলবান্ হয়, তারই প্রাধান্য মানা হয়। যেরকম কিছু প্রাণীর মধ্যে নর প্রধান হয়, আবার কিছুর মধ্যে মাদা।
5. ব্যান = এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এই ভাবে উৎপন্ন হয় যে প্রাণ ও অপানের মাঝে সন্ধির কার্য করতে পারে। ব্যান রশ্মি ছাড়া প্রাণ ও অপান সঙ্গে-সঙ্গে সঙ্গত থাকতে পারবে না। ব্যান রশ্মি না কেবল প্রাণ ও অপানকে বেঁধে রাখে, অপিতু অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে বাঁধতে প্রাণ ও অপান রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে প্রকাশিত কণাকে অপ্রকাশিত কণার অপেক্ষায় অতি ন্যূন সঘনতা প্রদান করে। যখন "ওম্" রূপী অক্ষর রশ্মি দুই বার আবৃত্ত হয়ে পুনঃ পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন ব্যান নামক প্রাথমিক প্রাণকে উৎপন্ন করে।
6. সমান = যখন "ওম্" রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে সম গতি ও বলের সঙ্গে স্পন্দন উৎপন্ন করে, তখন সেই সময় সমান নামক প্রাণ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির বল ও গতিকে সুষম বানিয়ে রাখে, বিশেষ করে প্রাণ ও অপান নামক প্রাণ রশ্মিদের সুষম বানিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই রশ্মি সমান লয়ের সঙ্গে নিরন্তর গমন করতে থাকে।
7. উদান = যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির স্পন্দন এই ধরনের হয় যে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণের প্রাদূর্ভাব হতে থাকে, সেই সময় উৎপন্ন স্পন্দন ঊর্ধ্ব গমনকারী হয়। এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণ উৎপন্ন করার সঙ্গে গতি করে, এরদ্বারা উৎপন্ন উদান নামক স্পন্দন ঊর্ধ্বগমন যুক্ত হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মির মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণ ( অর্থাৎ কোনো বলের বিরুদ্ধে বল লাগানো। যেমন, ঘর্ষণ বল লাগানো বলের বিরূদ্ধে কার্য করে) উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়। উদান রশ্মি নিয়মিত, নিয়ন্ত্রিত লয়ের সঙ্গে গতি করে আর ব্যাপক স্তরে এক প্রকারের দীপ্তিকে উৎপন্ন করে।
8. নাগ = এটা হচ্ছে প্রাণ নামক প্রাণ তত্ত্বের উপপ্রাণ, যা প্রাণ নামক রশ্মির ক্ষুব্ধ ও অব্যবস্থিত হলে পরে তাদের নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। নাগ প্রাণ রশ্মির প্রাধান্যের মধ্যেই ঊষ্মার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয়। এর স্পন্দন অতি সূক্ষ্ম ও ক্ষীণ হয়, যা অন্য প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্থিরের মতো মানা যেতে পারে।
9. কূর্ম = এই রশ্মি হল অপান প্রাণের উপপ্রাণ, যা অপান রশ্মিদের বল ও প্রেরণ প্রদান করে। আমরা জানি যে, অপান প্রাণ রশ্মিগুলোর প্রতিকর্ষণ বল প্রধান হয়, তবুও ব্যান রশ্মির মাধ্যম দ্বারা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই কূর্ম উপপ্রাণ সংযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে কচ্ছপের মতো অপান রশ্মিদের কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হয়। যেভাবে মস্তক সম্পূর্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেইভাবে কূর্ম রশ্মি প্রাণ ও অপানের মাঝে নিয়ন্ত্রণ বানিয়ে রাখতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
10. কৃকল = এই প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে উদান প্রাণের উপপ্রাণ। ভেদন ক্ষমতা বা তীব্রতাকে প্রদান বা প্রাপ্তকারী প্রাণ তত্ত্বকেই কৃকল বলা হয়। যখন উদান রশ্মির উৎক্ষেপণ বলের মধ্যে কোনো বাঁধা আসে, তখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা কৃকল প্রাণ রশ্মি রূপ স্পন্দন অকস্মাৎ উৎপন্ন হয়ে উদান রশ্মিদের ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে বল প্রদান করে তার উৎক্ষেপণ বলকে সক্রিয় বা নির্বাধ করে দেয়।
11. দেবদত্ত = এটা হচ্ছে সমান প্রাণের উপপ্রাণ। এটা বিদিতই যে, সমান প্রাণ রশ্মিগুলো, প্রাণ তথা অপান রশ্মিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। এই রশ্মি সমান প্রাণের সঙ্গে সমলয় দ্বারা স্পন্দিত হয়ে প্রাণ ও অপানের লয় বানিয়ে রাখে।
জ্ঞাতব্য = বিভিন্ন উপপ্রাণ রশ্মির (স্পন্দনের) গতির দিশা নিজের-নিজের প্রাণ রশ্মির গতির দিশা থেকে বিপরীত হয়, আবার এটার স্পন্দন সম্বন্ধিত প্রাণ রশ্মির স্পন্দনের থেকে সূক্ষ্ম হয়, যা এর নিকট নিরন্তর উৎপন্ন হতে থাকে।
____________________________________________
© "ওম্" ছন্দ রশ্মির সঙ্গত না হলে সমস্ত প্রাণ রশ্মি ডার্ক এনার্জির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
® এই রশ্মির সম্বন্ধে পরে বলা হবে।

(স) মাস ও ঋতু রশ্মি

মাস রশ্মি

মাস হল বিশেষ প্রকারের রশ্মির নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিরিশ বার স্পন্দিত হওয়াতে নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে। (মনে রাখবেন যে, এর মানে এই নয় যে একটা মাস রশ্মির ভিতরে তিরিশ প্রাণ ও তিরিশ অপান হয়ে সব মিলিয়ে ষাট রশ্মি যথাযথ বিদ্যমান হয়, বরং বাস্তবিকতা এই হল যে এই ষাট রশ্মির স্পন্দনের ফলস্বরূপ একটা মাস রশ্মি রূপী স্পন্দন হয়, যা সেই স্পন্দনের থেকে সর্বথা ভিন্ন হয় অথবা সেই ষাট স্পন্দনই একটা নবীন স্পন্দনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়, অনেক রশ্মির মিলিত হওয়ায় কোথাও-কোনো রশ্মির উৎপত্তির চর্চা যেখানে হবে, সেখানে এইভাবেই বুঝে নেওয়া উচিত।) এই যুগ্মের বারো প্রকাশ দ্বারা বিশিষ্ঠ সংযোগের কারণেই তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থেকে বারো মাস রশ্মির নির্মাণ হয়। যদি এরকম না হতো, তাহলে কেবল এক প্রকারেরই মাস রশ্মি উৎপন্ন হতে পারতো। এই মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিকে জুড়ে রাখার কাজ করে।
এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিদের যারা য়োষা ও বৃষা রূপে ব্যবহার করে, তাদের নিশ্চিত বিন্দু রূপ ভাগগুলোকে উত্তেজিত করে পরস্পর সংযোগ করাতে সহায়ক হয়। বারো প্রকারের মাস রশ্মি হচ্ছে নিম্নানুসারে -
1. মধু
2. মাধব
3. শুক্র
4. শুচি
5. নভস্
6. নভস্য
7. ঈষ্
8. ঊর্জ্
9. সহস্
10. সহস্য
11. তপস্
12. তপস্য

ঋতু রশ্মি

ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মির যুগ্মকে ঋতু বলা হয়। ঋতু রশ্মি দিশাকে উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণা ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগ পাওয়া যায়। উৎপন্ন সব পদার্থকেও "ঋতু" বলে, কারণ তারা সবাই সর্বদা নিরন্তর গমন করতে থাকে।
ঋতু রশ্মি প্রকাশ নির্মাণ করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা ঊষ্মার তীব্রতা বৃদ্ধি হয়। এই রশ্মি কণা ও তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) পরস্পর সংযোজন-বিয়োজনের মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মতো স্থানগুলোতে ঊর্জার উৎপত্তি হয়, এই রশ্মির প্রাধান্য সেখানে থাকে। তারার বাইরের বিশাল ভাগের মধ্যেও ঋতু রশ্মির বিশেষ প্রাধান্য থাকে। ঋতু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণাদি রশ্মিকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে, এই কারণে যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা সেই পদার্থ ঊষ্মাকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে। এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে অথবা তাদের আচ্ছাদিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
ছয় ঋতু রশ্মি হচ্ছে এই রকম -
1. বসন্ত (মধু + মাধব)
2. গ্রীষ্ম (শুক্র + শুচি)
3. বর্ষা (নভস্ + নভস্য)
4. শরদ্ (ঈষ্ + ঊর্জ্)
5. হেমন্ত (সহস্ + সহস্য)
6. শিশির (তপস্ + তপস্য)

(দ) অন্য ছন্দ রশ্মি


কাল মাপি রশ্মি

কাল তত্ত্ব হচ্ছে এরকম এক পদার্থ, যারমধ্যে তমোগুণের অভাব থাকে। কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ কাল মাপক প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মিগুলোই হল এরকম রশ্মি যাদের মধ্যে তমোগুণের মাত্রা সর্বথা অভাব তো থাকে না, কিন্তু এর মাত্রা এতই ন্যূন থাকে যে এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়। এই কাল তত্ত্বের সমান তো সতত ও নিরপেক্ষ গমনকারী হয় না, কিন্তু অন্য রশ্মির অপেক্ষায় এর এটাই স্বভাব হয়। এখন আমরা এটা বিচার করবো যে এই কাল মাপক কিভাবে মানা হয়েছে? আসুন, জেনে নিই -
1. প্রাণ = যত অন্তরালের মধ্যে একটা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির স্পন্দন হয়, সেটা অন্তরাল এক প্রাণ বা অহন্ বলে। এই রশ্মি অক্ষর দ্বারা নির্মিত হয়। এরমধ্যে প্রত্যেকটা অক্ষর এক-এক করে স্পন্দিত হয়। সব ছয় স্পন্দনের একটা সংযুক্ত স্পন্দনকে প্রাণ রশ্মি (অহন্) বলা হয়। প্রাণ ঋতু রশ্মির ("ভূঃ", "ভুবঃ", "সুবঃ", তথা "ওম্") ছয় সূক্ষ্ম স্পন্দন দ্বারা মিলিত হয়ে নির্মিত হয়েছে। "ষঙ্ঋতুনা" দৈবী পংক্তি ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে ছয়টা ঋতু রশ্মিকে সঙ্গত করে প্রাণ তত্ত্বকে উৎপন্ন করে।
যেভাবে বর্তমান ভৌতিকবিদ্ সীজিয়ম-133 অ্যাটমের সংক্রমণের (transition) 9,19,26,31,770 আবৃত্তির সময়কে 1 সেকেণ্ড বলে। এরজন্য কেউ এটা বলতে পারবে না যে সেকেণ্ডই হচ্ছে সময়। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে সময়কে মাপার একটা বিধি। আকাশকে মাপার সাধন হল মিটার, কিলোমিটার আদি, ঠিক সেইরকম প্রাণ, অপান আদি যেখানে পদার্থ (রশ্মি) বিশেষ আছে, সেখানে এই পদ কালের মাপকও আছে©।
2. অপান = যত সময়ে একটা অপান রশ্মি একবার স্পন্দিত হয়, সেই সময়কে অপান বলা হয়। এই রশ্মি ষোলো ঋতুর অর্থাৎ চার-চারটা ঋতুর চার আবৃত্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়। এখানে চিত্রানুসারে প্রত্যেক ব্যাহৃতি ঋতু রশ্মিই মানা হয়েছে।
যদি পূর্ববত্ এক অক্ষরকে এক ঋতু রশ্মি ধরা হয়, তাহলে "সুবঃ"-কে ছেড়ে দিয়ে অন্য তিন রশ্মির চার আবৃত্তির থেকে ষোলো অক্ষর মিলে অপান রশ্মিকে উৎপন্ন করে।

ঋষি রশ্মি

অনেক প্রাণ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে। এই ঋষি রশ্মিগুলো অনেক প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন, ধারণ আর সক্রিয় করে। তারদ্বারা উৎপন্ন মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি, সৃষ্টির মধ্যে যারাই কাজ করছে, তাদের মধ্যে এই ঋষি রশ্মিরও সহযোগী ভূমিকা থাকে।
✍️ নোট - অন্য ছন্দ রশ্মির গুণ এবং তাদের বর্গীকরণ পরবর্তী অধ্যায়ে দেওয়া হবে।

ছন্দ রশ্মির 7 প্রকারের প্রভাব

যেকোনো বেদ মন্ত্রের (ছন্দ রশ্মি) নিম্নলিখিত প্রভাব থাকে -
1. দেবতার প্রভাব (দেবতা হল সেই পদার্থের নাম, যা কোনো ছন্দ রশ্মির সঙ্গে সবথেকে বেশি প্রভাবিত হয়। যেমন কোনো ছন্দ রশ্মির দেবতা হল ইন্দ্র, এর অর্থ হল সেই রশ্মির সঙ্গে বিদ্যুতের বৃদ্ধি হবে।)
2. ছন্দের প্রভাব (ছন্দের জন্য পরবর্তী অধ্যায় পঠনীয়।)
3. ঋষির প্রভাব (কোনো ছন্দ রশ্মি যে ঋষি রশ্মির সঙ্গে উৎপন্ন হয়, তারমধ্যে সেই ঋষি রশ্মির কিছু গুণ এসে যায়।)
4. স্বরের প্রভাব
5. পদের প্রভাব (অর্থাৎ শব্দের প্রভাব)
6. অক্ষরের প্রভাব
7. সম্পূর্ণ ঋচা/ছন্দ রশ্মি/মন্ত্রের প্রভাব

রশ্মির সংযোগ প্রক্রিয়া

বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অস্পষ্ট সুতোর টুকরোর সমান আকৃতির হয়, যার দুই মাথা পৃথক-পৃথক গুণের হয়। যেভাবে চুম্বকের দুই মাথা বিপরীত গুণের হয় আর সামনে নিয়ে আসলে একে-অপরকে আকর্ষিত করে। ঠিক সেইভাবে রশ্মির মাথাগুলো পরস্পরের মধ্যে আকর্ষিত হয়ে সংযুক্ত হয়ে যায়।
এই অগ্রভাগগুলো একে-অপরের সঙ্গে রসির মাথার মতো জুড়ে থাকে। এগুলোর সংযুক্ত মাথার মাঝখানে সূক্ষ্ম দৈবী গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি সতত সঞ্চারিত হতে থাকে। বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির এই দুই মাথাই বিভিন্ন বল আর ক্রিয়ার কেন্দ্র ও কারণ হয়। সেই ক্রিয়া আর বলের নিয়মন আর সঞ্চালন সূক্ষ্ম বাক্ রশ্মির সহযোগ দ্বারা এই মাথাগুলোই করে। এই সূক্ষ্ম রশ্মিগুলো অব্যক্ত রূপে এই মাথাগুলোর মাঝে সতত সঞ্চারিত হতে থাকে আর অন্ততঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ এই মূল সিদ্ধান্তের আধারেই হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সুতোর সমান গঠনের তাৎপর্য এই নয় যে সেটা শক্ত মনে করা যাবে। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে সূক্ষ্ম স্পন্দনেরই রূপ, যেরকম জলের মধ্যে ঢেউ। যেভাবে জলের ঢেউ জুড়ে যায় সেইভাবে এদের মাথাগুলো জুড়ে যায় মনে করা উচিত।

রশ্মির সংখ্যা সীমিত নাকি অসীমিত 

যদিও এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ছন্দ রশ্মি স্বরূপের দৃষ্টিতে অনেক সীমিত সংখ্যাতেই বিদ্যমান আছে, কিন্তু বারংবার আবৃত্তি হওয়ার কারণে তাদের সংখ্যা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসীমিত। যেভাবে কোনো গিটার বা বীণার মধ্যে কেবল কয়েকটা তারই থাকে, কিন্তু তাতে উৎপন্ন হওয়া কম্পনের বারংবার আবৃত্তিতে অসংখ্য স্বর উৎপন্ন হতে পারে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মূল কণার সংখ্যাও স্বরূপের দৃষ্টিতে পরিমিতই আছে, কিন্তু সেটা মোট সংখ্যার দৃষ্টিতে অসংখ্যই হয়। এই জন্য এইভাবে বিভিন্ন লোকের রূপে বিদ্যমান মূল কণার মাত্রা মহাকাশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মূল কণার অপেক্ষায় ন্যূনই হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সীমিত প্রকারের মূলকণা আর অ্যাটমস্, অসীমিত প্রকারের অণুগুলোকে উৎপন্ন করে। এরমধ্যেও সেই কণা আর অ্যাটমের মিশ্রণের মাত্রা আর আবৃত্তিরই ভেদ আছে।
প্রাণ নামক প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্বকে উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়, আর সেটা ঊষ্মার উৎপত্তিতেও বিশেষ যোগদান করে। এইসব রশ্মির ব্যবস্থাপনের আধারের উপরেই বিভিন্ন কণার আয়ু নির্ধারিত হয়। যেকোনো ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা এই সূক্ষ্ম প্রাণ রশ্মি কখনও ব্যক্তরূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে না কিন্তু যখন সেটা ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক আদির রূপে উৎপন্ন হয়, তখনই সেটা ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা অভিব্যক্ত হতে পারে। এই ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক পদার্থ হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণ এবং ছন্দাদি রশ্মির ভাণ্ডার। যদিও প্রাণ বা ছন্দাদি রশ্মির সব ক্রিয়া বা বল ভৌতিক টেকনিক দ্বারা অব্যক্তই হয়, তবুও সেটা ব্যক্ত বলের বা ক্রিয়ার মধ্যে নিজের অব্যক্ত এবং অনিবার্য ভূমিকার সঙ্গে বিদ্যমান থাকে। এদের অভাবে কোনো ব্যক্ত বল বা ক্রিয়ার না তো অস্তিত্ব হওয়া সম্ভব আর না এই সৃষ্টির মধ্যে কোনো পদার্থের অভিব্যক্ত হওয়া সম্ভব হবে।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

✍️ স্মরণীয় তথ্য
1.সমস্ত মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন দ্বারা হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে।
2. যখন রশ্মিগুলোর সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়।
3. যখন সেই রশ্মিগুলোর সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মুলকণার রূপ ধারণ করে নেয়।
4. যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) নির্মাণ করে।
5. মহত্ তত্ত্ব অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়।
6. কালের উৎপত্তির সময়ে সাম্যাবস্থাতে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়।
7. "ওম্" ছন্দ রশ্মি হচ্ছে অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সমস্ত প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মিগুলো এর থেকেই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
8. সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
9. যেসব রশ্মি নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের বিশেষ রূপে আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে। এটা সাত প্রকারের (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ আর সত্যম্) হয়।
10. সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ প্রধানতঃ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়।
11. মাস হচ্ছে বিশেষ প্রকারের রশ্মির (মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ঈষ্, ঊর্জ্, সহস্, সহস্য, তপস্ আর তপস্য) নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিনবার স্পন্দিত হওয়ায় নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশটা প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে।
12. মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন রশ্মিকে যুক্ত করার কাজ করে।
13. ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির (বসন্তঃ, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত তথা শিশির) রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মিদের যুগ্ম ঋতু বলে।
14. ঋতু রশ্মি দিশা উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণার ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগিতা পাওয়া যায়। এই রশ্মিগুলো প্রকাশ উৎপন্ন করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
15. প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মির মধ্যে তমোগুণের মাত্রা অত্যন্ত নিম্ন থাকে। এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়।
16. যত অন্তরালে একটা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির স্পন্দন হয়, সেই অন্তরালকে একটা প্রাণ বা অহন্ বলে।
17. যত সময়ে একটা অপান রশ্মি একবার স্পন্দিত হয়, সেই সময়কে অপান বলে।
18. অনেক ছন্দ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মি থেকে উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে।
19. বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অস্পষ্ট টুকরো সুতোর সমান আকৃতির হয়, যার দুটি মাথা পৃথক-পৃথক গুণের হয়।
20. স্বরূপের দৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মি অনেক সীমিত সংখ্যাতেই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু আবৃত্ত হওয়ার কারণে তাদের সংখ্যা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসীমিত হয়।
____________________________________________
© এক প্রাণ আর এক অপান বর্তমান কালের মাপকের মধ্যে কত সময়? এটা এখনও অনুসন্ধানের বিষয়।

বৈদিক ভৌতিকী
ভূমিকা

সৃষ্টি উৎপত্তি প্রক্রিয়াতে ছন্দ রশ্মির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টিটাই হচ্ছে ছন্দ রশ্মির খেলা। এই স্পন্দনকে বাক্ ও প্রাণ বলে। এই বাক্ তত্ত্বকেই "ছন্দ" বলে অর্থাৎ ছন্দ রশ্মি, মনস্তত্ত্বের ভিতরে যে স্পন্দন রূপ হয়, তাকেই বাক্ তত্ত্ব বলে। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি ছন্দ রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণ রূপী রশ্মি সবই হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন সূক্ষ্ম স্পন্দন। ছন্দ রশ্মি -
🔷 প্রকাশ উৎপন্নকারী হয়।
🔷 কোনো কণা বা তরঙ্গাণুকে সর্বতঃ আচ্ছাদনকারী হয়।
🔷 বলের সমন্বয়কারী এবং উৎপন্নকারী হয়।
🔷 প্রাণ রশ্মির সমান ব্যবহার করে।
🔷 বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) এবং সমস্ত লোকের আধার রূপ হয়ে তাদের ধারণ করে।
🔷 সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড এর দ্বারাই বাঁধা আছে।
বৈদিক ভৌতিকী

প্রথম প্রকারের বর্গীকরণ 

চেতন তত্ত্ব "ওম্" ছন্দ রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এই তিন প্রকারের ছন্দ রশ্মির নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ"-এর প্রাধান্য দ্বারা ভূমিকা হয়। এই সমস্ত ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয় যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিদের আচ্ছাদিত করে মিথুন বানাতে থাকে।

বৈদিক ভৌতিকী


1. ঋক্ = এই রশ্মিগুলো সূক্ষ্ম দীপ্তিযুক্ত হয়। যেসব মূলকণা এই সৃষ্টির মধ্যে আছে, সেইসবের উৎপত্তিতে এই ছন্দ রশ্মির মুখ্য ভূমিকা থাকে। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক ঊর্জার মধ্যেও ঋক্ রূপী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন পদার্থ যখন অপ্রকাশিত বা সঘন রূপ ধারণ করে, সেই সময় তারমধ্যে আকর্ষণ বলেরও প্রবলতা হয়ে যায়। এই ছন্দ রশ্মি তথা সাম রশ্মির মধ্যে বাক্ তত্ত্ব অর্থাৎ "ওম্" রশ্মির প্রাধান্য (মনস্তত্ত্বের সাপেক্ষ) থাকে। এই কারণে এই দুই প্রকারের রশ্মি বলের দ্বারা বিশেষভাবে যুক্ত থাকে। এইভাবে এই উপরিউক্ত গুণ যুক্ত ছন্দ রশ্মিদের ঋক্ বলা হয়।
2. য়জুঃ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো বিভিন্ন পদার্থের সংযোগে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আকাশ তত্ত্বের (স্পেস) মধ্যে এর প্রাধান্য এবং ব্যাপকতা থাকে। এই ব্রহ্মাণ্ডতে সব ধরণের গতি এই ছন্দ রশ্মির ভিতরেই নিরন্তর হতে থাকে। একই সঙ্গে এই রশ্মি একটানা গতি করতে থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে বাক্ তত্ত্বের আপেক্ষায় মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য থাকে। এই কারণে এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের আধার প্রদান করে।
বৈদিক ভৌতিকী

3. সাম = এই সৃষ্টিতে সব প্রকারের তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) এবং কথিত মধ্যস্থ কণার (মিডিয়েটর পার্টিকলস্) মধ্যে এরই প্রাধান্য থাকে। ব্রহ্মাণ্ডস্থ সম্পূর্ণ প্রকাশ নিরন্তর সাম রশ্মি দিয়ে পূর্ণতঃ ভরা থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে ভেদন ক্ষমতা বিশেষ থাকে। বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিভাষিত ঊর্জাও দ্রব্যের পালন ও রক্ষণ করে।
বৈদিক ভৌতিকী

"ঋক্" সংজ্ঞক সব ছন্দ রশ্মিতে "ভূঃ" ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে এবং অন্য দৈবী ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে। এইভাবে "য়জুঃ" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "ভুবঃ" আর "সাম" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "স্বঃ" দৈবী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে, অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে।
সব প্রকারের ছন্দ রশ্মি, যা মন্ত্রের রূপে বেদ সংহিতার মধ্যে উপলব্ধ আছে এবং সেগুলোর মধ্যে কিছু অনুপলদ্ধও আছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান আছে। এর দ্বারাই সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে। এই সব প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি উপরিউক্ত তিন প্রকারভাবে বর্গীকৃত করা হয়।

দ্বিতীয় প্রকারের বর্গীকরণ 

এখন আমরা ছন্দ রশ্মির অন্যভাবে বর্গীকৃত হওয়ার উপর বিচার করবো -
এই সৃষ্টির মধ্যে ছন্দ রশ্মি অনন্ত বা অসংখ্য মাত্রায় বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুণ ও কর্মের আধারে তাদের প্রমুখ রূপে সাতটা বিভাগ হয়। এই সাতটা ছন্দ হল - গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী। আবার এই সাতটা রশ্মিরও দৈবী, আসুরী, প্রাজাপত্যা, য়াজুষী, সাম্নী, আর্চী, আর্ষী এবং ব্রাহ্মী, এই আটটা ভেদ মানা হয়েছে।
এখন আমরা এই সাত ছন্দ রশ্মির বিষয়ে ক্রমশঃ বিচার করবো -
1. গায়ত্রী = "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো যখন মনস্তত্ত্বকে প্রেরিত করা প্রারম্ভ করে, সেই সময় সর্বপ্রথম যে রশ্মিগুলো (স্পন্দন) উৎপন্ন হয়, তাদের গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মি তিন প্রকারের গতি যুক্ত হয়। এর গতি অন্য ছন্দের অপেক্ষায় সর্বাধিক হয়। সৃষ্টি রচনার প্রথম চরণের সময়ে সর্বাধিক প্রাধান্য এরই হয়। এই রশ্মি থেকে প্রকাশের উৎপত্তি হয়। পিঙ্গল ছন্দ সূত্রতে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি থেকে উৎপন্ন প্রকাশকে শ্বেত বর্ণের বলা হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মির মুখের সমান হয়। তার মানে হল, যেভাবে মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রেরিত করে, সেইভাবে গায়ত্রী রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মিদের প্রেরিত করে। এই রশ্মি সবাইকে বল প্রদান করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
2. উষ্ণিক্ = এই রশ্মিগুলো গায়ত্রী রশ্মিগুলোকে উপর থেকে আবৃত্ত করে, তাদের মধ্যে তথা অন্য ছন্দ রশ্মির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের ভাব সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির মধ্যে মিশ্রণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলোকে নিজের সঙ্গে ঠিক সেইভাবে জুড়তে সহায়ক হয়, যেভাবে শরীরে গলা, কাঁধ তথা মস্তক জুড়ে থাকে। একইসঙ্গে এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলো থেকে পরিত্যক্ত অতি সূক্ষ্ম রশ্মিদের একটানা গিলে ফেলতে থাকে, এরদ্বারাই য়জন অর্থাৎ যুক্ত হওয়ার ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মিকে আচ্ছাদিত করতে ত্বকের সমান গায়ত্রী রশ্মির উপরে লোমের মতো সংযুক্ত থাকে। এটা অন্য রশ্মিদের প্রকাশশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়। এটা অন্য রশ্মিদের তীক্ষ্ণ বানাতে সহায়ক হয়। এই রশ্মিদের প্রভাবে গায়ত্রী রশ্মিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, যারফলে ঊষ্ণতারও বৃদ্ধি হয়। এরদ্বারা ব্রহ্মাণ্ডতে সারঙ্গ অর্থাৎ রঙিন রূপের উৎপত্তি হতে থাকে।
3. অনুষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিগুলোকে অনুকূলতার সঙ্গে ধরে রাখে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অথবা তাদের উপস্থিতিতে সব ছন্দ রশ্মি নিজের-নিজের কাজ সরলতা এবং সক্রিয়তার সঙ্গে করতে পারে। উদাহরণের জন্য যদি কোনো রশ্মি প্রকাশকে উৎপন্ন করতে নিজের ভূমিকা পালন করে, তখন সেই রশ্মিটাই অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে সরলতার সঙ্গে আরও অধিক প্রকাশ উৎপন্ন করবে। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মির য়োনি রূপ হয়, এর মানে হল এই ছন্দ রশ্মির মধ্যে সব ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে। একই সঙ্গে অনেক ধরনের ছন্দ রশ্মি অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি থেকেই উৎপন্ন হয়। এদের মধ্যেও "ওম্" রশ্মির মাত্রা অপেক্ষাকৃত অধিক হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মি থেকে নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে। এদের মধ্যে ভেদক ক্ষমতা থাকে। আর এর থেকে লাল মিশ্রিত বাদামী রঙের উৎপত্তি হয়।
4. বৃহতী = এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি, বিভিন্ন কণা বা লোকের নির্মাণের সময় পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত ও সংকুচিত করে নির্মাণাধীন কণা বা লোকের পরিধি নির্মাণে সহায়ক হয়। এটা সেইসব লোক বা কণাকে সর্বদিকে ব্যাপ্ত করে থাকে। এই রশ্মির প্রাধান্য আকাশ তত্ত্বতে থাকে। বিভিন্ন তারা আদি প্রকাশিত লোকের কেন্দ্রীয় ভাগেও এর প্রাচুর্য থাকে। এটা মিশ্রিত হওয়া কণার থেকে নির্মিত নবীন কণাকেও পরিধি রূপে ব্যাপ্ত করে তাকে সংঘনিত করে থাকে। প্রাণ রশ্মিগুলো এই বৃহতী রশ্মির উপস্থেন্দ্রিয়ের সমান কাজ করে। বৃহতীর কারণেই জ্বালার সঙ্গে যুক্ত অগ্নিও উৎপন্ন হয়। এই রশ্মি সবাইকে সীমাবদ্ধ করার কাজ করে। এটা হল কৃষ্ণ বর্ণের।
5. পংক্তি = এই রশ্মিগুলোতে পাঁচ প্রকারের গতি বিদ্যমান থাকে। এরা বিভিন্ন রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের দ্বারা সর্বদা অবশোষিত হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিশেষ সৃজনশীল অর্থাৎ জুড়ে যাওয়ার স্বভাব যুক্ত হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির মজ্জার সমান কাজ করে, যেভাবে শরীরের মধ্যে বিদ্যমান অস্তিগত মজ্জা সম্পূর্ণ শরীরের রক্তকে জীবন্ত বানিয়ে শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে, ঠিক সেইভাবে পংক্তি ছন্দ রশ্মির বিদ্যমানতায় প্রাণ রশ্মির সামর্থ্য সমৃদ্ধ হয়। এর থেকে নীল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
6. ত্রিষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো সমস্ত ছন্দ রশ্মি সমূহের নাভিরূপ হয়ে পরস্পর বেঁধে রাখে। এদের কারণে তীক্ষ্ণ বিদ্যুত্ তরঙ্গের উৎপত্তি ও সমৃদ্ধি হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিদের তীব্র তেজ ও বল প্রদান করে। এরা প্রাণ রশ্মির মাংস রূপ হয় অর্থাৎ এদের দ্বারা বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি পূর্ণ বল প্রাপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে তিন রকমভাবে ধরে রাখে, এইজন্য একে ত্রিষ্টুপ্ বলা হয়। এরা অসুর পদার্থ অর্থাৎ ডার্ক ঊর্জা আদির বাধক প্রভাবকে নষ্ট করতে সক্ষম হয়। আকাশ তত্ত্বের মধ্যে এদের প্রাচুর্য থাকে। এর থেকে লাল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
7. জগতী = এই রশ্মিগুলো সর্বাধিক দূর পর্যন্ত গমনকারী হয়। সম্পূর্ণ জগৎ এই রশ্মির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, এই কারণে এদের জগতী বলা হয়। এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন সংযোজক কণা বা তরঙ্গাণুকে (কোয়ান্টা) বেঁধে রাখতে তথা বিভিন্ন কণাকে সংযোগাদি প্রক্রিয়া হেতু সক্ষম করে। ঊর্জা ও ইলেকট্রনের নির্গমন ও অবশোষণের প্রক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই সম্পন্ন হয়। এই রশ্মি সম্পূর্ণ ছন্দ রশ্মি সমূহের মেরুদণ্ডের সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলো সম্পূর্ণ প্রাণ রশ্মি সমূহকে কাঠামোগত আধার প্রদান করে, যার উপর সমস্ত ছন্দ রশ্মি নির্ভরশীল থাকে। এর থেকে গৌর বর্ণের উৎপত্তি হয়।
এইভাবে এই সাত ছন্দ রশ্মির স্বরূপের সাধারণ বর্ণনা করার পর এখন এদের বিভিন্ন বিভাগের বর্ণনা করবো।

ছন্দ রশ্মির আট বিভাগ

সাতটা ছন্দ রশ্মি প্রধানতঃ আট প্রকারের হয়। এই আট প্রকার হল নিম্নানুসারে -
1. দৈবী = এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বপ্রথম এই ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয়। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি মূল ছন্দ রশ্মিগুলোকেই দৈবী ছন্দ রশ্মি বলে। এদের কারণে অব্যক্ত সূক্ষ্মতম জ্যোতি তথা অতি সূক্ষ্ম বলের উৎপত্তি হয়। এরা সর্বত্র ব্যাপ্তবত্ হয়। পূর্বোক্ত সব সাত ছন্দ রশ্মির দৈবী রূপে অক্ষর সংখ্যা নিম্নানুসারে হয় - দৈবী গায়ত্রী-1, দৈবী উষ্ণিক্-2, দৈবী অনুষ্টুপ্-3, দৈবী বৃহতী-4, দৈবী পংক্তি-5, দৈবী ত্রিষ্টুপ্-6 এবং দৈবী জগতী-7 অক্ষর হয়।
2. য়াজুষী = এদের প্রভাবে সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে সূক্ষ্ম ও নিরন্তর গতি ও য়জন ক্রিয়া উৎপন্ন হতে থাকে। এই সময় আকাশ তত্ত্বের উৎপত্তি হতে থাকে। সম্পূর্ণ পদার্থ নিরন্তর কম্পন করতে থাকে।
3. প্রাজাপত্যা = এই ছন্দ রশ্মির উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন রশ্মির সংযোগ-বন্ধন আদির প্রক্রিয়া সমৃদ্ধ হয়ে নবীন রশ্মির উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াও তীব্র হয়। এই রশ্মিগুলো লঘু ছন্দ রূপেই হয় আর তাই এদের মরুত্ বলা হয়, যা ধীরে-ধীরে গতিতে গমন করে।
4. সাম্নী = বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, কথিত মিডিয়েটর পার্টিকলস্ আদির উৎপত্তিতে এদের ভূমিকা থাকে। এর প্রভাবে প্রকাশ, ঊষ্মা এবং বিভিন্ন প্রকারের বলের সমৃদ্ধি হতে থাকে।
5. আসুরী = এই রশ্মিদের প্রভাবে অসুর তত্ত্বের (ডার্ক পদার্থ বা ডার্ক এনার্জি) উৎপত্তি হয় অথবা রশ্মিগুলো স্বয়ংই ডার্ক স্বরূপে বিদ্যমান হয়। এই রশ্মিদের পারস্পরিক আকর্ষণ অত্যল্প বা নগণ্য থাকে, অথচ প্রতিকর্ষণ বা প্রক্ষেপক বলের প্রাধান্য এদের মধ্যে থাকে। এদের মধ্যে মনস্তত্ত্ব এবং অপান প্রাণের প্রাধান্যও থাকে।
6. আর্চী= এই রশ্মিদের প্রভাবে বিভিন্ন অপ্রকাশিত পদার্থ অর্থাৎ নানা মূলকণা ও লোকের নির্মাণ হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন রশ্মি তথা তরঙ্গাণু আদির সংঘনন ও ভেদনের প্রক্রিয়াকে তীব্র বানিয়ে দেয়।
7. আর্ষী = প্রাণাদি রশ্মি দ্বারা উৎপন্ন অধিকাংশতঃ ছন্দ রশ্মিদের আর্ষী বলা হয়। যখন ব্রহ্মাণ্ডে কস্মিক মেঘ এবং তার থেকে নানা লোকের নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, সেই সময় আর্ষী ছন্দ রশ্মির প্রাচুর্য বা প্রাধান্য থাকে।
8. ব্রাহ্মী = এই ছন্দ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির বল ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে।
বৈদিক ভৌতিকী

এই ভাবে এদের মোট আট প্রকারের বিভাগ প্রত্যেক গায়ত্রী আদি ছন্দের হয়। এইভাবে এই পর্যন্ত মোট 56 প্রকারের ছন্দ রশ্মি বর্ণিত হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে অক্ষরের কত সংখ্যা থাকে, সেটা আমার নিম্নলিখিত তালিকার দ্বারা বুঝতে পারবো -
এই তালিকার মধ্যে আপনি যে সমান অক্ষর সংখ্যার ছন্দ দেখতে পাচ্ছেন, তার কারণ হল অক্ষরের বিন্যাসের মধ্যে ভেদ হওয়া। যেমন আপনি সমভারিক (আইসোবার) সমস্থানিক (আইসোটোপ) তত্ত্বের সম্বন্ধে পড়ে থাকবেন। এই বিষয়টাকে ছন্দ শাস্ত্রের সম্পূর্ণ অধ্যয়ন দ্বারাই বোঝা যেতে পারে।

ছন্দের অন্য উপভেদ

এখন আমরা প্রত্যেক প্রকারের ছন্দ রশ্মির অন্য কিছু ভেদগুলোর চর্চা করবো। উপরিউক্ত প্রকারের ছন্দ রশ্মির পুনঃ অক্ষর ভেদের কারণে নিম্ন প্রকারে ভেদ হয় -
1. সামান্য ছন্দ = যেসব ছন্দ রশ্মির মধ্যে অক্ষরের সংখ্যা পূর্বোক্তানুসারে অর্থাৎ তালিকাতে বর্ণিতানুসারে হয়, তাদের আমরা সামান্য ছন্দ বলতে পারি। এই সবের সামান্য প্রভাব ছন্দের প্রভাবই হবে।
2. ভুরিক্ ছন্দ = এই প্রকারের ছন্দ রশ্মির মধ্যে উপরিউক্ত সামান্য ছন্দের তুলনায় একটা অক্ষর অধিক হয়। এই ছন্দ রশ্মির ধারক ও পোষক ক্ষমতা অন্য প্রকারের ছন্দ রশ্মির তুলনায় বিশেষ হয়। এই রশ্মিগুলো বাহুর সমান হওয়ার কারণে ধারণ, আকর্ষণ, প্রতিরোধ আদি গুণকে অপেক্ষাকৃত অধিক সমৃদ্ধকারী হয়।
3. স্বরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে অক্ষরের সংখ্যা সামান্যের তুলনায় 2টা অধিক হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মি স্বরাট্ -এর রূপ ধারণ করে নেয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্যদের অপেক্ষায় প্রকাশ বা বৈদ্যুত প্রভাবকে উৎপন্ন করতে বিশেষ সক্ষম হয়।
4. বিরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে সামান্যের অপেক্ষায় 2টা সংখ্যা কম হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মিকে বিরাট্ বলে। এর সব অক্ষর বিবিধ প্রকারে প্রকাশিত হতে সক্ষম হয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্য ছন্দ রশ্মির প্রতি সংযোগ গুণ দ্বারা বিশেষ রূপে যুক্ত থাকে। এর প্রভাব ক্ষেত্র অতি ব্যাপক হয়।
5. নিচৃত্ ছন্দ = এই রশ্মিগুলো ভেদক ও বন্ধক উভয় প্রকারের বলের সঙ্গে পূর্ণভাবে যুক্ত থাকে। যখন সামান্য ছন্দ রশ্মির থেকে একটা অক্ষর কমে যায়, সেই সময় সেই ছন্দ রশ্মি নিচৃত্ রূপ ধারণ করে নেয় অর্থাৎ সেই সামান্য ছন্দ রশ্মির প্রভাব অধিক তীক্ষ্ণ ভেদক হয়ে যায়।
এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হতে থাকে।

কিভাবে রশ্মির ছন্দ খুঁজে বের করবেন?

কোনো রশ্মির ছন্দ খোঁজার জন্য সেই মন্ত্রতে স্বরের গণনা করবেন, কারণ তাদের সংখ্যার দ্বারাই ছন্দের নির্ধারণ হয়। উদাহরণের জন্য নিম্নলিখিত মন্ত্রতে 23টা অক্ষর (স্বর) আছে। সামান্য (24) থেকে এক অক্ষর কম হওয়ার কারণে এটা নিচৃত্ ছন্দ হবে। এইজন্য এর ছন্দ হল আর্ষী নিচৃত্ গায়ত্রী।
বৈদিক ভৌতিকী

রশ্মির পরিবর্তন

এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন মৃদু এবং তীব্র বল যুক্ত নানা প্রকারের কণা আর বিকিরণ মিলিত হয়ে আর তাদের থেকেও পূর্বে বিভিন্ন প্রাণ আর ছন্দাদি রশ্মি মিলিত হয়ে শেষে তীব্র জ্বালা যুক্ত বিশাল তারা আদি লোকের উৎপন্ন করে। লোক নির্মাণের এই প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন তীব্র ঊর্জাযুক্ত তরঙ্গ যখন নিজের ঊর্জাকে কিছু মাত্রায় হ্রাস করতে থাকে, তখন সেই তরঙ্গগুলোই নিম্ন ঊর্জার অন্য তরঙ্গতে পরিবর্তন হতে থাকে। সেই তরঙ্গ এবং বিভিন্ন প্রকারের কণা নিজের মতো সমান গুণধর্মকারী পদার্থের উৎপন্ন করে। কারণ বিশেষ উপস্থিত হলে পরে বিভিন্ন কণা অন্য কণাতে আর বিকিরণও অন্য বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এইভাবে সৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মিও একে অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সবথেকে অধিক শক্তিশালী হয়। সেটাই ক্ষীণবল হলে পরে গায়ত্রী, জগতী আদি অন্য ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে গায়ত্রী আদি ছন্দ রশ্মিও ত্রিষ্টুপ্ আদি ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে।
একটা ছন্দ রশ্মি দ্বিতীয় একটা ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একটা নবীন তৃতীয় ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন করে। এখানে উদাহরণের জন্য গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি নির্মাণের প্রক্রিয়াতে তিন অক্ষর যুক্ত "শোম্সাবোম্" ছন্দ রশ্মি পাঁচ অক্ষর যুক্ত "শম্সাऽऽমো দৈবোম্" এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আট অক্ষর যুক্ত "প্রাজাপত্যা গায়ত্রী" ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। প্রাজাপত্যা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি তিন বার সংযুক্ত হয়ে আর্ষী গায়ত্রী ছন্দকে উৎপন্ন করে।
এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন নিরাবেশিত (ডিসচার্জ) কণা সূক্ষ্ম এবং সংকুচিত মরুত্ রশ্মির সঙ্গে সংযোগ করে বিদ্যুদাবেশিত কণাতে পরিবর্তিত হতে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা জানা যায় এমন মূলকণা, যা পরস্পর একে-অপরের মধ্যে পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তিত হতে থাকে, এদের পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ার পিছনে এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিই হল উত্তরদায়িনী। এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক "ইলেকট্রন-কোয়ার্ক" আদি কণার দ্বারা সম্বোধিত করে।
বৈদিক ভৌতিকী

সৃষ্টির সমস্ত জড় পদার্থ একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে আর হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূক্ষ্ম রশ্মি অথবা বিকিরণের একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হওয়া সৃষ্টির সামান্য ক্রিয়া নয়, বরং এটা হচ্ছে একটা অসামান্য প্রক্রিয়া, যা হঠাৎই কখনও-কখনও আর কোথাও-কোথাও হয়ে থাকে। সামান্য প্রক্রিয়া এই হচ্ছে যে বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গ নিজেরই স্বরূপকে ধরে রাখে।
এই পর্যন্ত আমরা চেতন তত্ত্বের দ্বারা প্রকৃতি পদার্থ থেকে কাল ও মহত্ তত্ত্ব থেকে শুরু করে প্রাণ ও ছন্দাদি নানা সূক্ষ্ম রশ্মির উৎপত্তি ও স্বরূপের সম্বন্ধে জেনেছি, এখন অগ্রিম পদার্থের উৎপত্তি ও স্বরূপের বর্ণনা করা হবে। বর্তমান বিজ্ঞান কাল বা আকাশের স্বরূপ বা উৎপত্তি বিজ্ঞানের বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ। এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর উৎপত্তি ও গঠন হচ্ছে অজ্ঞাত। এমনকি আমরা যে সৃষ্টি বিজ্ঞানের মধ্যে যে যে বিষয়ের উপর চর্চা করলাম, সেই সব বিষয়ে বর্তমান ভৌতিকীর কোনো কল্পনাই নেই আর এই জ্ঞান ছাড়া সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীর বিকাশ যাত্রা সম্মুখে এগোতে পাচ্ছে না, তারমধ্যে একটা বিরাম এসে গেছে, এই বিষয়টা বৈজ্ঞানিকরা স্বয়ং অনুভব করছে যে আগে যাওয়ার জন্য তারা মার্গ খুঁজে পাচ্ছে না।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি ছন্দ রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণ রূপী রশ্মি সবই হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন সূক্ষ্ম স্পন্দন।
2. ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এর নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ", এবং "স্বঃ" প্রাধান্যের সঙ্গে ভূমিকা হয়।
3. সব ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দন রূপে উৎপন্ন হয়, যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বন্ধনকারী হয়।
4. এই সৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মি অনন্ত বা অসংখ্য মাত্রায় বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুণ ও কর্মের আধারে তাদের প্রমুখ রূপে সাতটা বিভাগ (গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী) হয়।
5. সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মিরও দৈবী, আসুরী, প্রাজাপত্যা, য়াজুষী, সাম্নী, আর্চী, আর্ষী এবং ব্রাহ্মী, এই আটটা ভেদ মানা হয়েছে।
6. সর্বপ্রথম যে রশ্মিগুলো (স্পন্দন) মনস্তত্ত্বতে উৎপন্ন হয়, তাদের গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মিগুলো সবাইকে বল প্রদান করার কাজ করে।
7. আট প্রকারের ছন্দ রশ্মির অক্ষর ভেদের কারণে পুনঃ পাঁচটা (সামান্য, ভুরিক্, স্বরাট্ আর নিচৃত্ ছন্দ) ভেদ হয়।
8. ব্রহ্মাণ্ডতে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
9. কোনো রশ্মির ছন্দ জানার জন্য সেই মন্ত্রতে স্বরের গণনা করা হয়, কারণ তাদের সংখ্যা দিয়েই ছন্দের নির্ধারণ হয়।
10. লোক প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রতে 23 অক্ষর (স্বর) [সামান্য (24) থেকে একটা অক্ষর কম] হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে নিচৃত্ ছন্দ। এইজন্য এর ছন্দ হচ্ছে আর্ষী নিচৃত্ গায়ত্রী।
11. বিভিন্ন কণা অন্য কণাতে আর বিকিরণও অন্য বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যেরকম, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সবথেকে অধিক শক্তিশালী হয়, ক্ষীণবল হলে পরে গায়ত্রী, জগতী আদি অন্য ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।




আকাশ

গত অধ্যায়ে বর্ণিত রশ্মির উৎপত্তি কালেই আকাশের উৎপত্তি হয়। "আকাশ" শব্দটা হচ্ছে দুটি রূপে প্রযুক্ত। প্রথম রূপটা হচ্ছে অবকাশ রূপ আকাশ অভাব বা শূন্য রূপ। অন্যদিকে বেদের মধ্যে অপর ব্যোম নামে দ্বিতীয় আকাশের সংকেত করা হয়েছে, যার সংকেতকে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী "ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা" নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এই আকাশ হচ্ছে একটা পদার্থ বিশেষের নাম, যার চর্চা আমরা এই অধ্যায়ে করবো।

আকাশের উৎপত্তি

মনস্তত্ত্ব থেকেই পাঁচ মহাভূত উৎপন্ন হয়। এই সৃষ্টির উৎপত্তি বিভিন্ন প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির নানা প্রকারের মিলন দ্বারাই হয়েছে। সব পঞ্চ মহাভূত যথা পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ সবই এর দ্বারাই তৈরি হয়েছে, এদের মধ্যে আকাশ মহাভূতের উৎপত্তি সর্বপ্রথম হয়। বর্তমান ভৌতিক বৈজ্ঞানিক আকাশ তত্ত্বের (স্পেস) বিষয়ে নিতান্ত ভ্রম বা সংশয়ের মধ্যে আছে। তারা আকাশকে ত্রিবিমীয় (3D) মানে, কিন্তু আকাশের স্বরূপ কি? রিক্ত স্থানই কী আকাশ? নাকি আকাশ হচ্ছে কোনো পদার্থ? এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর তাদের কাছে নেই। তারা গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা বিদ্যুত্ চুম্বকীয় বলের দ্বারা আকাশের বক্র বা বিকৃত হওয়াকে মানে, কিন্তু তাকে কোনো ধরনের পদার্থ বিশেষ বলার থেকে এড়িয়ে চলে।

যদি আকাশ কোনো পদার্থই না হয়, তাহলে বলের কারণে বিকৃত অথবা বক্রতা কিভাবে হবে? আশ্চর্যের বিষয় হল, বর্তমানে উন্নত মানা হয় এমন ভৌতিক বিজ্ঞান গুরুত্বাকর্ষণ বলকে আকাশের বক্রতার রূপেই মানে ও জানে, অথচ আকাশ কি? এটা তারা জানে না। এইদিকে বৈদিক বিজ্ঞান আকাশ তত্ত্বের বিষয়ে ব্যাপক তথ্য প্রস্তুত করে। বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে আকাশ তত্ত্বের স্বরূপের সারাংশ সংক্ষিপ্ত রূপে নিম্নানুসারে দেওয়া হল -

আকাশের স্বরূপ

আকাশ হচ্ছে একটা পদার্থ, সব ধরনের কণা ও তরঙ্গাণু আকাশ তত্ত্বের মধ্যেই উৎপন্ন হয় ও তারমধ্যেই নিবাস করে। আকাশ প্রাণ রশ্মির রূপেই বিদ্যমান থাকে। প্রাণ, অপান এবং উদান রশ্মিগুলোর এক সহস্র বার আবৃত্তি হয়, তখন বিভিন্ন প্রাণের সঙ্গম দ্বারা অন্য রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্ব রূপে উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন ছন্দ ও প্রাণ রশ্মির মিশ্রণ আকাশ তত্ত্বকে বক্র বা বিকৃত করার ক্ষমতা রাখে। আকাশ স্বয়ং হচ্ছে রশ্মি রূপ, এই রশ্মিগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়। আকাশ তত্ত্ব বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গাণুদের থামিয়ে রাখতে সহায়ক হয়। এরমধ্যে বৃহতী ছন্দ রশ্মিগুলো প্রচুর মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এটা এতই সূক্ষ্ম হয় যে এর স্বরূপ অভাব বা রিক্ততার মতো মনে হয়। এরমধ্যে রশ্মির প্রাচুর্য থাকে তথা এটা সমস্ত পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। এটা ছিদ্রের সমান অর্থাৎ শূন্যতার সমান ব্যবহার করে। এরমধ্যে "ওম্", ত্রিষ্টুপ্, মরুত্, সূত্রাত্মা বায়ু ও ছন্দ আদি রশ্মির প্রাচুর্য থাকে। এটা বিভিন্ন বড়ো ছন্দ রশ্মি, মূল কণা, বিকিরণ আদিকে গতিশীল করার হেতু অবকাশ ও মার্গ প্রদান করে। মহর্ষি কণাদ-এর শব্দে "যারমধ্য দিয়ে বিভিন্ন পদার্থের প্রবেশ করা বা বেরিয়ে যাওয়া হয়, তাকে আকাশ বলে।"
আকাশের মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মিগুলো অত্যন্ত শিথিলাবস্থায় চক্রাকার গতিতে ভ্রমণ করতে থাকে। এদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন অতি নিম্ন হয়। এই কারণে আকাশ তত্ত্বতে বিভিন্ন কণা বা বিকিরণ স্বচ্ছন্দ আর নিরাপদ গতিতে গমন করতে থাকে। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অন্তর্গত যখন "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" -এর অতিরিক্ত অন্য দৈবী ছন্দ রশ্মি এবং সূত্রাত্মা বায়ু সহিত প্রাণ, অপান আদি প্রাণ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হয়ে যায়, সেই সময় সেগুলোর মধ্যে কিছু রশ্মির সংঘাত দ্বারা একটা সূক্ষ্ম ও প্রায়শই একরসবত্ পদার্থের উৎপত্তি হয়। এই পদার্থের উৎপত্তির পূর্বে প্রাণ, অপান এবং উদানের এক সহস্রবার আবৃত্তি আগে থেকেই হয়ে থাকে। তখন দৈবী অনুষ্টুপ্ এবং য়াজুষী (বৃহতী, পংক্তি ও ত্রিষ্টুপ্) রশ্মিগুলোও আগে থেকেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই চার ছন্দ রশ্মি পরস্পর এইভাবে মিশ্রিত থাকে যে দৈবী অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সমান প্রভাব দেখায়। বিভিন্ন প্রাণ, অপান আদি রশ্মি, বিভিন্ন দৈবী ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এরকম দৈবী অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে, যা প্রায়শই নিষ্কম্প হয়। এই রশ্মিগুলো নিজের স্থানেই স্পন্দিত হতে থাকে, না কি মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বত্র গমন করে।
আকাশ তত্ত্বের অবয়বভূত প্রাণ ও মরুত্ রশ্মিগুলো শিথিলাবস্থায় পারস্পরিক সংঘাতের রূপেই বিদ্যমান থাকে। এই সংঘাতের মধ্যে বিদ্যমান সেই রশ্মিগুলো চক্রাকারে ঘূর্ণন করতে থাকে অর্থাৎ সেগুলোর মধ্যে রেখীয় গতি থাকে না, তবে ঘূর্ণন গতি অতি ধীর গতিতে হতে থাকে। এই রশ্মিগুলো আকাশ রশ্মির রূপে পরিচিত। এই রশ্মিগুলো এই অবস্থায় এরকম শিথিল থাকে যে বিভিন্ন বড়ো ছন্দ রশ্মি, কণা বা তরঙ্গাণু সরলতার সঙ্গে এদের মাঝখানে স্বচ্ছন্দ গতি করতে পারে। গতি করতে গিয়ে কণা, তরঙ্গাণু বা রশ্মিগুলো যখন আকাশ তত্ত্বের মাঝখান দিয়ে গমন করে, তখন এরা ঘূর্ণন করতে-করতে পূর্বোক্ত শিথিল আকাশ রশ্মিগুলোর (প্রাণ ও মরুত্) মাঝখান দিয়ে সরলতার সঙ্গে পিচ্ছলিয়ে গতি করে। এতকিছুর পরেও এই শিথিল রশ্মিগুলো সর্বদা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকে। এই কারণে যখন আকাশ তত্ত্ব কোনো বলের দ্বারা সংকুচিত বা বিকৃত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির দ্বারা আকাশ রশ্মির ঘূর্ণন গতি প্রভাবিত হওয়ার কারণেই হয়। এই তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত প্রকাশযুক্ত, সবথেকে হালকা অর্থাৎ নগণ্য দ্রব্যমান এবং বিদ্যুৎ বলের হয়।

এইভাবে আকাশ বিভিন্ন একক দ্বারা নির্মিত জালের সমান হয়। এই একক পরস্পর সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই এককগুলো নিরন্তর নিজের অক্ষের উপর ঘূর্ণন করতে থাকে। এর পারস্পরিক বন্ধন অতি শিথিল হয়, তাই এর মাঝখান দিয়ে কোনো তরঙ্গ অথবা কণা সরলতার সঙ্গে গমন করতে পারে। আকাশ এই তরঙ্গ অথবা কণাগুলোকে গমন করার জন্য রাস্তার কাজ করে। এর অঙ্গভূত কিছু রশ্মি কোনো কণা ও তরঙ্গকে আধার প্রদান করে, তো অন্য কিছু রশ্মি সেই তরঙ্গ ও কণাগুলোকে এরকম ঘর্ষণ প্রদান করে, যেরকম রাস্তায় চললে পরে রাস্তা ঘর্ষণ বল প্রদান করে। যেভাবে রাস্তার ঘর্ষণ বলের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উৎপন্ন বল গাড়ির চাকাকে আগে চলার হেতু বল প্রদান করে, ঠিক সেইভাবে কিছু রশ্মি কোনো কণা ও তরঙ্গকে আকাশে গমন করার সময় প্রতিক্রিয়া বল প্রদান করে তাকে আগে বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে কোনো কণা ও তরঙ্গ মুক্ত রূপে আকাশে গমন করে। কণা ও তরঙ্গের গতি করার সময় আকাশের কিছু রশ্মি, আকাশের এককগুলোকে কিছু বিচলিত করে মার্গ তৈরির কাজ করে।

আকাশ তত্ত্ব প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি এবং সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা নির্মিত হয়। যেকোনো প্রকারের আকর্ষণ-প্রতিকর্ষণ বলের সময় আকাশের সঙ্কুচিত বা প্রসারিত হওয়া এই কারণেই সম্ভব হয়, কারণ আকাশ এই রশ্মিদের দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে।
আকাশ তত্ত্বও সূক্ষ্ম প্রাণ আর মরুত্ রশ্মির মিশ্ররূপ হয়। এরমধ্যে ত্রিষ্টুপ্ আর বৃহতী ছন্দ রশ্মিরও প্রাধান্য বিদ্যমান থাকে, আবার বিভিন্ন কণার ভিতরে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে। আকাশ তত্ত্বের রশ্মিগুলো বিভিন্ন কণার সংযোগ-বিয়োগের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম স্তরে বিভিন্ন কণাকে স্পর্শ বা সেচন করতে থাকে, কিন্তু তাদের নিজের আকর্ষণাদি বল নগণ্যের মতো হয়।

দিশার স্বরূপ

আপনি পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ আদি দশ দিশার সম্বন্ধে জেনে থাকবেন, কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন যে দিশাও হচ্ছে আকাশের মতো এক ধরনের পদার্থ। দিক্-তত্ত্ব (দিশা) হচ্ছে আকাশের অন্তর্গতই অন্তর্ভুক্ত। দিক্-তত্ত্ব হচ্ছে আকাশ তত্ত্বের সেই ভাগ, যা কোনো কণা বা লোক আদি পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত করে থাকে তথা সেই পদার্থের ঘূর্ণন, সংযোজন আদি ক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে। দিক্ তত্ত্বও আকাশ মহাভূতের মতো রশ্মি রূপ হয়। কাল তত্ত্ব হচ্ছে তাদের তুলনায় অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। এই তিন পদার্থের পারস্পরিক সম্বন্ধ এই হচ্ছে যে, তিন মহাভূতকে প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রিত তো করে, কিন্তু এরা কোনো পদার্থের ভাগ হয় না। আজ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নানা পদার্থের নির্মাণ হচ্ছে আর এই জন্য নানা ক্রিয়াও হচ্ছে। এই ক্রিয়াগুলোর মধ্যে এই তিন পদার্থ প্রত্যক্ষ ভাগ না নিয়ে পরোক্ষ রূপে প্রেরণার কাজ করতে থাকে। বিভিন্ন বাক্ অর্থাৎ ছন্দ রশ্মিগুলোই দিক্ তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। দিক্ তত্ত্বের স্বরূপ সংক্ষেপে নিম্নানুসারে -
1. দিক্-তত্ত্বে অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে।
2. দিশা দশটা হয় - চার দিশা, চার অবান্তর দিশা (দুই দিশার মধ্য) তথা ঊর্ধ্ব (উপর) ও ধ্রুব (নিচে) দিশা। সব দশটা দিশার পৃথক-পৃথক ভূমিকা থাকে।
3. ছন্দ বা প্রাণ রূপ দিক্ তত্ত্ব বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা লোকের পরিধি রূপে ঢাকা থাকে।
4. এই তত্ত্ব এই পদার্থগুলোকে ঘূর্ণন গতি প্রদান করতে সহায়ক হয়।
5. এই তত্ত্বে প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, সূত্রাত্মা বায়ু ও ধনঞ্জয় রশ্মিগুলো বিদ্যমান থাকে। এদের মধ্যেও সূত্রাত্মা বায়ু প্রাধান্যের সঙ্গে পরিধির নির্মাণ করে।
6. যেকোনো পদার্থের উপরে বিদ্যমান ছন্দ রশ্মিগুলোই দিক্ তত্ত্বের রূপ হয়।
7. দিক্ রূপ রশ্মিগুলো বিভিন্ন কণা বা লোককে অন্য কণা বা লোক থেকে পরিত্যক্ত রশ্মিগুলোকে হরণ করে তাদের পরস্পর বাঁধতে সাহায্য করে।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. আকাশ হচ্ছে একটা বাস্তবিক পদার্থ, যা সূক্ষ্ম বৈদিক ছন্দ রশ্মির বিশেষ সংযোগ দ্বারা উৎপন্ন হয়।
2. প্রাণ, অপান এবং উদান রশ্মিদের এক সহস্র বার আবৃত্ত হয়, তখন বিভিন্ন প্রাণের সংযোগ দ্বারা অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন হয়।
3. আকাশ তত্ত্ব এতটাই সূক্ষ্ম হয় যে এর স্বরূপ অভাব বা রিক্ততার মতো মনে হয়।
4. আকাশের মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মিগুলো অত্যন্ত শিথিলাবস্থায় চক্রাকার গতিতে ভ্রমণ করতে থাকে। এদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন অতি নিম্ন হয়।
5. সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির দ্বারা আকাশ রশ্মির ঘূর্ণন গতি প্রভাবিত হওয়ার কারণে আকাশ তত্ত্ব সংকুচিত বা বিকৃত হয়।
6. এই তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত প্রকাশযুক্ত, সবথেকে হালকা অর্থাৎ নগণ্য দ্রব্যমানের হয়। এরমধ্যে "ওম্", ত্রিষ্টুপ্, মরুত্, সূত্রাত্মা বায়ু ও ছন্দ রশ্মির প্রাচুর্য থাকে।
7. আকাশ বিভিন্ন এককের দ্বারা নির্মিত জালের সমান হয়। এই এককগুলো পরস্পর সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিদের সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই এককগুলো নিরন্তর নিজের অক্ষের মধ্যে ঘূর্ণন করতে থাকে।
8. এই এককের পারস্পরিক বন্ধন অতি শিথিল হয়, যার জন্য এদের মধ্য দিয়ে কোনো তরঙ্গ অথবা কণা সরলতার সঙ্গে গমন করতে পারে। এই ইউনিটস্ অন্য ছন্দ রশ্মিদের প্রতি মিথষ্ক্রিয়া করে ঘনীভূত, বিকৃত হতে পারে এবং বেঁকা বা প্রসারিত হতে পারে।
9. আকাশ এই তরঙ্গ অথবা কণাগুলোকে গমন করার জন্য রাস্তার কাজ করে।
10. দিক্ তত্ত্ব হচ্ছে আকাশ তত্ত্বের সেই ভাগ, যা কোনো কণা বা লোক আদি পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত করে থাকে তথা সেই পদার্থের ঘূর্ণন, সংযোজন আদি ক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে।
11. দিক্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, সূত্রাত্মা বায়ু ও ধনঞ্জয় রশ্মিগুলো বিদ্যমান থাকে। এদের মধ্যেও সূত্রাত্মা বায়ু প্রাধান্যের সঙ্গে পরিধির নির্মাণ করে।
12. দিক্ রূপ রশ্মিগুলো বিভিন্ন কণা বা লোককে অন্য কণা বা লোক থেকে পরিত্যক্ত রশ্মিগুলোকে হরণ করে তাদের পরস্পর বাঁধতে সাহায্য করে।



আমরা জানি যে সৃষ্টির সঞ্চালনের জন্য সর্বাধিক মহত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে বল। বল হচ্ছে দ্রব্যের সেই মূলভূত গুণ, যার দ্বারা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তথা এর দ্বারা ব্রহ্মাণ্ড উৎপন্নও হচ্ছে আর সময় আসলে পরে এর দ্বারা নষ্টও হবে। সৃষ্টির সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম তথা বিশাল থেকে বিশাল পদার্থের নিয়ন্ত্রণ বল নামক গুণের দ্বারাই হয়।
৯.১ বলের স্বরূপ
বলের গুণের বিষয়ে "নিরুক্ত (3.9)" এরমধ্যে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন -
"বলম্ কস্মাত্ বলম্ ভরম্ ভবতি বিভর্ক্তেঃ"
অর্থাৎ - যেটা কোনো পদার্থের ধারণ ও পোষণ করে, সেই গুণকে বল বলে। আমরা সবাই জানি যে সৃষ্টির সমস্ত লোক থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম কণার পরস্পর ধারণ বলের দ্বারাই হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে বলের দ্বারা পদার্থের পোষণ কিভাবে হয়? "পোষণ" শব্দের অর্থ হচ্ছে সমস্ত পদার্থের অস্তিত্ব বল নামক গুণের উপরে নির্ভর। চলুন, একে এইভাবে জেনে নিই যে, প্রত্যেক স্থূল পদার্থ সূক্ষ্ম কণার সংযোগ দ্বারা উৎপন্ন হয় এবং সেই সংযোগের উপর সেই পদার্থের জীবন নির্ভর করে। যদি সেই পদার্থের অবয়বরূপ সূক্ষ্ম কণার মাঝে কার্যরত বল অকস্মাৎ সমাপ্ত হয়ে যায়, তখন সেই পদার্থের অস্তিত্ব শীঘ্র সমাপ্ত হয়ে যাবে আর সেটা সূক্ষ্ম কণায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এখন সূক্ষ্ম কণার অস্তিত্বও কি বলের উপর আশ্রিত? হ্যাঁ, তাহলে সেটা কিভাবে? একে এইভাবে জানবো যে প্রত্যেক কণা নানা প্রকারের ছন্দ ও প্রাণ রশ্মি তথা সেই রশ্মিগুলো আবার মনস্তত্ত, মহত্ তত্ত্ব ও মূলরূপে প্রকৃতিরূপী মূল পদার্থের দ্বারা নির্মিত। এই কারণে সমস্ত মূল কণা এবং তরঙ্গাণুও সূক্ষ্ম রশ্মিগুলোর মাঝে কার্যরত বলের কারণেই অস্তিত্বতে আসে, এই জন্য তাদের জীবনও বলের উপর নির্ভর করে। তবে মনে রাখবেন, বর্তমান ভৌতিকীর মধ্যে বলের কোনো স্পষ্ট পরিভাষা নেই, অথচ বৈদিক বিজ্ঞানের মধ্যে "বল" শব্দের জ্ঞান থেকেই বল নামক গুণের সমস্ত স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যায়।
৯.২ বলের প্রকার
আধুনিক বিজ্ঞান মূল রূপে চারটা বলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। তারা এই চার বলের জন্য চার প্রকারের মধ্যস্থ কণাকে (মিডিয়েটর পার্টিকলস্) উত্তরদায়ী বলে। এই চারটা বল হচ্ছে এই ধরনের -
1. গুরুত্বাকর্ষণ বল = গ্রেবিটোন
2. বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল = ফোটন
3. নাভিকীয় প্রবল বল (স্ট্রং ফোর্স) = মেসন
4. নাভিকীয় দুর্বল বল (উইক ফোর্স) = W^+, W^-, Z^0

বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল বিদ্যুৎ আবেশিত পদার্থের মাঝে কাজ করে, সেই কারণে বিদ্যুৎ আবেশিত কণা পরস্পর একে-অপরকে আকর্ষিত বা প্রতিকর্ষিত করে। এই বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের ভিতরে ব্যাপ্ত আছে তথা ব্রহ্মাণ্ডকে বানাতে, স্থাপিত করতে ও সঞ্চালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই বলের অভাব হয় তাহলে সৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে সমাপ্ত হয়ে যাবে। এই বলের কারণেই বিভিন্ন অণু আদি পদার্থ সুষম ও গতিশীল থাকে।

দ্বিতীয়টা হচ্ছে গুরুত্বাকর্ষণ বল, যা দুই দ্রব্যমান যুক্ত বস্তুর মাঝে কাজ করে। এই বলের কারণেই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে লোক-লোকান্তর একে-অপরের সঙ্গে বাঁধা আছে। আমাদের মতো সমস্ত প্রাণী আর বনস্পতির অস্তিত্বের জন্যও এই বলের বিশেষ ভূমিকা থাকে।

শেষ দুটো বল নাভিকের ভিতরে কাজ করে, যার কারণে নাভিকের অস্তিত্ব বজায় থাকে, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান এইসবের ক্রিয়াবিজ্ঞানকে এখনও পর্যন্ত জানতে পারে নি। কিভাবে মধ্যস্থ কণা তৈরি হয়? কোন বলটা তাদের বিনিময়ের জন্য উত্তরদায়ী? এই সব আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য অজ্ঞাত। অন্যদিকে বৈদিক বিজ্ঞান নয় প্রকারের বলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে, সেগুলো হচ্ছে এই রকম -
1. অন্তর্য়ামঃ = এই বল বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গের মধ্য ভাগে একটানা সঞ্চারিত হওয়া সূক্ষ্ম রশ্মির রূপে হয়। বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিচিত মূল কণা এবং তরঙ্গাণুর ভিতরে এই বল সূক্ষ্ম রশ্মির রূপে বিদ্যমান থাকে, যা সেই কণাগুলোকে সক্রিয় করতে আর তাদের এই রূপে বজায় থাকার জন্য প্রেরিত করে।
2. ঐন্দ্রবায়বঃ = এই বল তেজ আর গতি দুইয়ের উৎপত্তি, সক্রিয়তা এবং তীব্রতার কারণ রূপ হয়ে দুই আবেশিত কণার মাঝে কাজ করে। আধুনিক বিজ্ঞানের চারটা মূল বলের মধ্যে গুরুত্ব বল বাদে শেষ তিনটা বল এই একটা বলেরই অন্তর্গত চলে আসে।
3. মৈত্রাবরুণঃ = প্রাণ-অপান এবং প্রাণ-উদান যুগ্মের মাঝে সংযুক্ত প্রাণদের সংযোজন করার জন্য এই বল উত্তরদায়ী হয়। এই বল অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপ হয়ে বিভিন্ন প্রকারের বলের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এটা অতি বেগবান্ পদার্থের বলেরও কারণ হয়।
প্রাণ তথা উদানের মাঝে তথা প্রাণ ও অপানের মাঝে মৈত্রাবরুণঃ বল কাজ করে। এই ধরনের বল সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে ব্যাপ্ত আছে তথা এর কারণেই সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মিত ও সঞ্চালিত হয়। এই বল মন তথা সূত্রাত্মা বায়ুর অতি সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মতম রশ্মিগুলোর সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই রশ্মিগুলোর দ্বারা মধ্যস্থ কণার (মিডিয়েটর পার্টিকালস্) স্থানে ব্যান প্রাণ রশ্মিগুলোর উৎপত্তি হয়, যা প্রাণ ও অপান অথবা প্রাণ ও উদানকে পরস্পর বেঁধে রাখার জন্য সেগুলোর মধ্যে একটানা সঞ্চরণ করতে থাকে। সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে সর্বত্র এই বল কাজ করতে থাকে।
4. আশ্বিনঃ = আশ্বিনের অর্থ হচ্ছে ব্যাপক। এই বল বিভিন্ন কণা আর তরঙ্গের মাঝে কার্যরত বল তথা বিভিন্ন সূক্ষ্ম কণার মাঝে অতি নিকট স্তরে একটা সূক্ষ্ম প্রতিকর্ষণ বলের রূপেও হয়। এর কারণে দুই সূক্ষ্ম কণার মাঝে একটা পরিমিত অবকাশ অবশ্যই হয়, যার কারণে ব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো সূক্ষ্ম বা স্থূল পদার্থ পরস্পর পূর্ণতভাবে স্পর্শ করতে পারে না।
একই সঙ্গে গুরুত্বাকর্ষণ বলকেও আশ্বিন বল বলা হয়। এই আশ্বিন বলের কারণেই এই ব্রহ্মাণ্ড স্থির আছে অর্থাৎ দুই ব্যাপক আকর্ষণ আর প্রতিকর্ষণ বলের কারণে।
5. শুক্রঃ = এই বলের রশ্মিগুলো তীব্র ভেদন সামর্থ্য যুক্ত হয় অর্থাৎ অতি উচ্চ ঊর্জাকারক পদার্থে এই বল বিদ্যমান থাকে, যা বিভিন্ন পদার্থকে ছিন্ন-ভিন্ন করে তাদের শুদ্ধ করে দেয়। উদাহরণ হচ্ছে, সূর্যের কেন্দ্রে এই বল বিদ্যমান থাকে।
6. মন্থীঃ = এই বল পূর্বোক্ত শুক্র বলের পূর্বে উৎপন্ন হয়ে পদার্থের সূক্ষ্ম স্তরে গিয়ে তারমধ্যে কম্পন উৎপন্ন করে।
7. আগ্রয়ণঃ = এই বল ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সবথেকে অধিক বিস্তৃত ক্ষেত্রের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ঊর্জার শোষণ আর নিঃসরণেরও মধ্যেও এই বল নিজের ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ হচ্ছে, এই বলের দ্বারাই ইলেকট্রন তরঙ্গাণুগুলোকে শোষণ আর নিঃসরণ করতে পারে।
8. উক্থ্যঃ = এই বল প্রত্যেক ছন্দ রশ্মি, যা স্বয়ং বল স্বরূপ হয়, তাকেও সংঘাত রূপ প্রদান করতে অর্থাৎ তাকে রশ্মি রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই বল খুবই সূক্ষ্ম হয়।
9. ধ্রুবঃ = এই বলের রশ্মিগুলো দূর পর্যন্ত গমন না করে নিকটবর্তী বল রশ্মিগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত করার জন্য অতি ধীর গতিতে এবং অতি সংকুচিত ক্ষেত্রের মধ্যে চেষ্টা করে।
৯.৩ বলের বিষয়ে বিশেষ জ্ঞাতব্য
এই সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন কণা ও তরঙ্গ আদি, যে পদার্থই বিদ্যমান আছে, তারা পরস্পর যেসব ক্রিয়া করে, সেই সবের পিছনে এই 9টা বলের ভূমিকা থাকে, যা সৃষ্টির প্রারম্ভিক কালেই উৎপন্ন হয়ে যায়। এই বলই সমস্ত সূক্ষ্ম পদার্থের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখে, তাদের মার্গ প্রদান করতে ও তাদের পরস্পর সংযোগ ও বিয়োগ করিয়ে স্থূলতর পদার্থের নির্মাণের মার্গ প্রশস্ত করে। এই 9 প্রকারের বল হল যেকোনো সংযোগ-বিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রমুখতম ও নিকটতম ভাগ। বল রশ্মি এবং অন্য কণা ও তরঙ্গগুলো হচ্ছে মূলত একই পদার্থের কার্যরূপ। যখনই সৃষ্টি উৎপত্তি প্রারম্ভ হয়, সেই সময় বলেরই উৎপত্তি সর্বপ্রথম হয়। এর পশ্চাৎই সেই বল থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া, গতি আদি উৎপন্ন হতে থাকে। আবার এর কারণেই বিভিন্ন সূক্ষ্ম পদার্থকে থামাতে, নিয়ন্ত্রণ করতে, গতিহীনকে গতি ও গতিশীলকে স্থিতিশীলতা প্রদান করতে পৃথক-পৃথক স্তরে পৃথক-পৃথক ধরনের বলের দ্বারাই সম্ভব হয়।
এই ব্রহ্মাণ্ডে দুই পদার্থের মাঝে যে বল কাজ করে, সেটা মূলত প্রাণেরই বল। এই প্রাণের ভেদ বা তাদের মধ্যে ব্যবস্থা, ক্রম আদির ভেদ দ্বারা বলও ভিন্ন-ভিন্ন প্রকারের হয়। ধনঞ্জয় বা সূত্রাত্মা বায়ু রূপ রশ্মিগুলো তথা বিভিন্ন ফিল্ড পার্টিকল্সের মাঝে যে বল কাজ করে, তা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি আর প্রাণ রশ্মির মিশ্রণ দ্বারা উৎপন্ন হয়। প্রাণ আর অপান অথবা প্রাণ আর উদানের মাঝে কার্যরত বল মন আর সূত্রাত্মা বায়ু অথবা দৈবী ত্রিষ্টুপ্ আর দৈবী উষ্ণিক্ ছন্দ রশ্মিদের মিশ্রণ দ্বারা উৎপন্ন হয়। কোনো তরঙ্গাণু তথা ইলেকট্রন আদির মাঝে কার্যরত বল পংক্তি, বৃহতী ও ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিদের আবৃত্ত করে সূত্রাত্মা বায়ুর মিশ্রণ থেকে উৎপন্ন হয়। গুরুত্ব বল, যা দুই অপ্রকাশিত, দুই প্রকাশিত কণা বা এক অপ্রকাশিত কণা ও এক প্রকাশিত কণার মাঝে কাজ করে, সেটাও আশ্বিন বলের অন্তর্গতই আসে। ইলেকট্রন আদি ও তরঙ্গের মাঝে কার্যরত বল গুরুত্ব বলের অন্তর্গত মানা যেতে পারে, একই সঙ্গে বৈদ্যুত বলও। এইভাবে উভয় প্রকারে মানা সম্ভব হবে।

৯.৪ সমন্বিত (ইউনিফাইড) বল
এই সৃষ্টির মধ্যে সব ধরনের ঊর্জা তথা দ্রব্যের উৎপত্তি বিভিন্ন প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির দ্বারাই হয়। এই প্রাণ ছন্দাদি রশ্মির উৎপত্তি মনস্তত্ত্বের দ্বারা হয়। বস্তুতঃ মন এবং বাক্ তত্ত্বের মিশ্রণকেই মনস্তত্ত্ব বলা হয়। এই সক্রিয় মনস্তত্ত্বই এই ব্রহ্মাণ্ডের সূক্ষ্মতম প্রত্যেক কণা বা বিকিরণ আর তাদের মধ্যেও সূক্ষ্ম প্রাণাদি রশ্মিগুলোর উপাদান কারণ এবং প্রেরক হয়। প্রলয়ের সময়ে সম্পূর্ণ দ্রব্য, ঊর্জা এবং আকাশ সক্রিয় মনস্তত্ত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে শেষে প্রকৃতিরূপী অন্তিম উপাদানে লীন হয়ে যায়। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মনস্তত্ত্ব সর্বত্র একরস ভরা থাকে, অপবাদের অতিরিক্ত অর্থাৎ রশ্মি আদির ভিতরে বিদ্যমান মনস্তত্ত্বের অতিরিক্ত কোথাও ঘন ও কোথাও বিরল রূপে থাকে না। ঘন বা বিরল তো তার ভিতরে বাক্ তত্ত্ব হয়ে থাকে আর এই কারণেই এই বাক্ তত্ত্বের সঙ্গে মনস্তত্ত্বের মিথুন অবশ্যই পরিবর্তনীয় হওয়াতে ঘন-বিরল হতে থাকে। আর এই কারণে সক্রিয় মনস্তত্ত্ব ঘন-বিরল থেকে স্থানে-স্থানে ভিন্ন-ভিন্ন রচনা এবং ক্রিয়া-বল আদিকে উৎপন্ন করতে থাকে। যদি এরকমটা না হতো তাহলে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রারম্ভই হতো না। এই সক্রিয় মনস্তত্ত্বের বলই হচ্ছে সর্বাধিক সূক্ষ্ম বল। অন্য সমস্ত বল এই একটা বলের দ্বারাই ক্রমশঃ উৎপন্ন হয়। প্রত্যেক বলের ভিতরে এই বল সর্বদা সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান থাকে আর এর দ্বারাই সমস্ত বল প্রেরিত ও সঞ্চালিত হয়। এই মূল বলের পিছনেও চেতন তত্ত্বের বল কাজ করতে থাকে, যা নিত্যই মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে বাক্ তত্ত্বকে উৎপন্ন করতে থাকে। তারপর এই বাক্ তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত মনস্তত্ত্বকেই সক্রিয় মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন করে এই মূল বলকে উৎপন্ন করে। চেতন তত্ত্ব পূর্ববর্ণিত কাল তত্ত্বের দ্বারাই মনস্তত্ত্ব বা বাক্ তত্ত্বের বলকে উৎপন্ন করে। বর্তমান বিজ্ঞান একটা ইউনিফাইড বলের পরিকল্পনা করছে, বস্তুতঃ এই বলটাই হচ্ছে ইউনিফাইড বল, কিন্তু এটাকে কোনো ভৌতিক টেকনিক দ্বারা জানা সম্ভব নয়। পরবর্তী দুই অধ্যায়ে আমরা গুরুত্বাকর্ষণ আর বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলকে বিস্তারিতভাবে জানবো।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. সৃষ্টির সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম তথা বিশাল থেকে বিশাল পদার্থের নিয়ন্ত্রণ সেই পদার্থের বল নামক গুণের দ্বারাই হয়।
2. যে গুণ কোনো পদার্থের ধারণ ও পোষণ করে, তাকে বল বলে।
3. যদি কোনো পদার্থের অবয়বরূপ সূক্ষ্ম কণার মাঝে কার্যরত অকস্মাৎ সমাপ্ত হয়ে যায়, তাহলে সেই পদার্থের অস্তিত্ব মুহূর্তের মধ্যে সমাপ্ত হয়ে সেটা সূক্ষ্ম কণায় বিলীন হয়ে যাবে।
4. আধুনিক বিজ্ঞান মূলত চারটা বলের (গুরুত্বাকর্ষণ, বিদ্যুৎ চুম্বকীয়, নাভিকীয় প্রবল তথা নাভিকীয় দুর্বল বল)
অস্তিত্বকে স্বীকার করে।
5. বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল বিদ্যুৎ আবেশিত পদার্থের মাঝে কাজ করে, যার কারণে বিদ্যুৎ আবেশিত কণা পরস্পর একে-অপরকে আকর্ষিত বা প্রতিকর্ষিত করে।
6. গুরুত্বাকর্ষণ বল দুই দ্রব্যমান যুক্ত বস্তুর মাঝে কাজ করে। এই বলের কারণে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে লোক-লোকান্তর একে-অপরের সঙ্গে বাঁধা থাকে।
7. বৈদিক বিজ্ঞান নয় প্রকার বলের (অন্তর্য়ামঃ, ঐন্দ্রবায়বঃ, মৈত্রাবরুণঃ, আশ্বিনঃ, শুক্রঃ, মন্থীঃ, আগ্রয়ণঃ, উক্থ্যঃ তথা ধ্রুবঃ) অস্তিত্বকে স্বীকার করে।
8. বল রশ্মি এবং অন্য কণা ও তরঙ্গ মূলতঃ একই পদার্থের কার্যরূপ হয়।
9. সৃষ্টি-উৎপত্তির প্রারম্ভে বলেরই উৎপত্তি সর্বপ্রথম হয়।
10. প্রাণের ভেদ বা তাদের মাঝে ব্যবস্থা, ক্রম আদির ভেদ দ্বারা বলও ভিন্ন-ভিন্ন প্রকারের হয়।
11. প্রলয়ের সময়ে সম্পূর্ণ দ্রব্য, ঊর্জা এবং আকাশ সক্রিয় মনস্তত্ত্বে বিলীন হয়ে শেষে প্রকৃতিরূপী অন্তিম উপাদানে লীন হয়ে যায়।
12. সৃষ্টিতে সক্রিয় মনস্তত্ত্বের বলই হচ্ছে সর্বাধিক সূক্ষ্ম বল। অন্য সমস্ত বল এই একটা বল থেকে ক্রমশঃ উৎপন্ন হয়।

বেদ বিজ্ঞান আলোক


ভূমিকা
আমরা দৈনিক জীবনে দেখে থাকি যে, যেকোনো বস্তু পরে গেলে পৃথিবীর দিকে আকর্ষিত হয়, যার কারণ হচ্ছে পৃথিবীর গুরুত্বাকর্ষণ বল। আমাদের পড়ানো হয় যে, নিউটন গুরুত্বাকর্ষণ নিয়ম সংসারকে দিয়েছে আর সেটাকে এইভাবে দেখানো হয় যে, তার পূর্বে কেউই গুরুত্বাকর্ষণ বলের সম্বন্ধে জানতো না, কিন্তু নিউটনের থেকে সহস্র বর্ষ পূর্বে মহর্ষি কণাদ তাঁর গ্রন্থ বৈশেষিক দর্শনের মধ্যে লিখেছেন -
সম্য়োগাভাবে গুরুত্বাত্পতনম্।। (5.1.7)
অর্থাৎ সংযোগ না থাকাতে বস্তু গুরুত্ব বলের কারণে নিচের দিকে পরে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা একটা আপেলকে হাতে ধরে আছি অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আপেল হাতের সংযোগে আছে, সেটা পৃথিবীতে পড়বে না আর যখনই আমরা তাকে ছেড়ে দিবো, সেটা নিচে পড়তে থাকবে। এটাকেই সংযোগের অভাবে বস্তু গুরুত্বের কারণে নিচে পড়ে যায় বলা হয়েছে। পুনঃ বলেছেন -
সম্স্কারাভাবে গুরুত্বাত্ পতনম্।। (5.1.18)
অর্থাৎ সংস্কারের অভাবে কোনো বস্তু গুরুত্ব বলের কারণে নিচে পড়ে যায়। যেমন, ধনুক থেকে ছোড়া বাণ গতিজ ঊর্জা সমাপ্ত হয়ে গেলে নিচে পড়ে যায়।
এখানে বস্তুটার বেগ হচ্ছে তার সংস্কার। ঠিক এই ভাবে আকাশে উড়ন্ত পাখি গুরুত্ব বলের কারণে নিচে পড়ে না, কিন্তু যদি কেউ পাখিটাকে মেরে ফেলে অথবা সে স্বয়ং উড়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে গুরুত্ব বলের কারণে মুহূর্তের মধ্যে নিচে পড়ে যাবে।
গুরুত্বাকর্ষণের সর্বজনীন নিয়ম
নিউটনের অনুসারে -
"এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেকটা পিণ্ড অন্য পিণ্ডকে একটা বলের দ্বারা আকর্ষিত করে, এই আকর্ষণ বল উভয় পিণ্ডের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়।"
(Mathematical Principles of Natural Philosophy, 1687)

গণিতীয় রূপে নিউটনের এই নিয়মকে এইভাবে দেখানো হয় -
F = Gm1m2/r^2
এখানে m1 আর m2 হচ্ছে কোনো দুই পিণ্ডের দ্রব্যমান তথা r হচ্ছে তাদের মধ্যকার দূরত্ব, F হচ্ছে তাদের দ্বারা নিয়ে আসা একে-অপরের উপর লাগিয়ে দেওয়া বল। G (=6.673×10^-11 Nm^2Kg^-2) হচ্ছে একটা স্থিরাঙ্ক, যাকে গুরুত্বাকর্ষণ স্থিরাঙ্ক বলা হয়। এটা সূত্র প্রেক্ষণ আর তর্কের আধারে দেওয়া হয়েছে, এর ব্যুৎপত্তির কোনো প্রক্রিয়া নেই।
এখন এখানে একটা প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, গুরুত্ব বল দ্রব্যমানের সমানুপাতিক তথা তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিকই কেন হয় অর্থাৎ দুই পিণ্ডের মধ্যে দ্রব্যমান অধিক অথবা তাদের মধ্যকার দূরত্ব কম হলে পরে তাদের মধ্যে পরস্পর আকর্ষণ বল অধিক কেন হয়? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন এই হচ্ছে যে, দুই পিণ্ডের মাঝে আকর্ষণের ক্রিয়া-বিজ্ঞানটা কি? দ্রব্যমান গুরুত্বাকর্ষণ বলকে কিভাবে উৎপন্ন করে? বর্তমানে উপলব্ধ টেকনিকের সীমা থাকার কারণে, এইসব প্রশ্নের সম্বন্ধে বর্তমান বিজ্ঞান মৌন আছে।
চলুন! এখন আমরা এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর বৈদিক বিজ্ঞানের দ্বারা জানার চেষ্টা করি।
আমরা জানি যে বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে যেকোনো পিণ্ড (কণা) বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ রশ্মির (স্পন্দনের) দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে সেই পিণ্ড বা কণার মধ্যে রশ্মি, বিশেষ করে বৃহতী ও পংক্তি ছন্দ রশ্মিগুলো চতুর্দিকে নিরন্তর অবশোষিত ও নির্গত হতে থাকে।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

যখন এরকম দুই পিণ্ড পরস্পর নিকটে আসে, তখন তার থেকে বেরিয়ে আসা পংক্তি এবং বৃহতী রশ্মিদের সংযোগ দ্বারা একটা কণা, যাকে বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষায় "গ্রাভিটন" বলা যেতে পারে, তার উৎপত্তি হয়। "গুরুত্বাণু" (গ্রাভিটন) -এর উৎপত্তি "ওম্" রশ্মির সঙ্গে যুক্ত মাস ও ঋতু রশ্মির পংক্তি ও বৃহতীকে সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য হয়। এই গুরুত্বাণু (গ্রাভিটন) পরস্পর নিকটস্থ পিণ্ডের থেকে নির্গত হওয়া অথবা অন্যত্র প্রবহমান বৃহতী ও পংক্তি ছন্দ রশ্মিগুলোকে অবশোষিত করতে থাকে আর এই কারণে এরা সর্বত্র প্রবাহিতও হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াই হচ্ছে গুরুত্বাকর্ষণ বল উৎপত্তির কারণ।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

কোনো পিণ্ডতে যত অধিক দ্রব্যমান হবে, সেই পিণ্ড থেকে তত অধিক বৃহতী ও পংক্তি ছন্দ রশ্মিগুলো নির্গত হয় আর এই কারণে সেই পিণ্ডের ততই অধিক গুরুত্বাকর্ষণ বলও হয়।
ব্যস্তানুপাত বর্গ নিয়মের অনুসারে দ্রব্যমান m থেকে নির্গত হওয়া রশ্মির দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়। কারণ দ্রব্যমান m থেকে রশ্মিগুলো সবদিকে সমান রূপে নির্গত হয়, তখন দ্রব্যমান m থেকে r দূরত্বে রশ্মিগুলোর মতো তীব্রতা হবে, 2r দূরত্বে তার 1/4 রয়ে যাবে।
আসুন , আমরা এটাকে এই চিত্রের দ্বারা বোঝার চেষ্টা করি -

আমরা জানি যে গুরুত্বাকর্ষণ বল বর্তমানে জানা গেছে এমন চারটা বলের মধ্যে সবথেকে দুর্বল হয়, কিন্তু এরকমটা কেন হয়? আসুন, একেও জেনে নিই -
যেরকম আমি উপরে বলেছি যে গুরুত্বাণু (গ্রাভিটনস্) সবদিকে প্রবাহিত হতে থাকে, এই কারণে গুরুত্ব ঊর্জা ঝরতে থাকে তথা দুই পিণ্ড থেকে বৃহতী ও পংক্তি রশ্মিগুলো নির্গত হয়, একই প্রকারের রশ্মির সংঘর্ষে তাদের মধ্যে প্রতিকর্ষণও হয়। পংক্তি আর বৃহতী ছন্দ রশ্মির মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ স্বাভাবিক রূপে অপেক্ষাকৃত দুর্লভ হয়। এই সব কারণের জন্য গুরুত্ব বল সব বলের থেকে দুর্বল, কিন্তু ব্যাপক হয়। গুরুত্বাকর্ষণ বল দুর্বল হওয়ার অন্য আরও একটা কারণ অপান প্রাণের প্রকরণে পঠনীয়। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের মধ্যে তরঙ্গাণু ধনঞ্জয় আদি রশ্মিগুলোকে সামনের দিশা থেকেই অবশোষিত করে তথা স্বয়ং সেই দিশাতেই প্রবাহিত হয়, এই কারণে এই বল গুরুত্ব বলের মতো ঝরে না, যারজন্য এটা তার তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়।
গুরুত্বাকর্ষণ বল এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলকে উৎপন্নকারী প্রাণ রশ্মিগুলো অনন্ত দূরত্ব পর্যন্ত চলার পরেও অন্তরালকে প্রাপ্ত করে না। এই কারণে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিকল্পিত গুরুত্বাণু (গ্রাভিটনস্) এবং প্রকাশাণু (ফোটনস্) অনন্ত দূরত্ব পর্যন্ত উৎপন্ন হয়ে বলের সঞ্চরণ করতে সক্ষম হয়।
এখানে আরও একটা কথা জেনে রাখা উচিত যে গুরুত্বাকর্ষণ বলের সঙ্গে কিছু না কিছু মাত্রায় প্রতিকর্ষণ বলও বিদ্যমান থাকে। এই প্রতিকর্ষণ বল দুই পিণ্ডের অথবা কণার মাঝে অসুর তত্ত্বের কারণ হয়ে থাকে। আকর্ষণ বলের সঙ্গে-সঙ্গে যদি প্রতিকর্ষণ বল না হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড সংকুচিত হয়ে একটা পিণ্ড হয়ে যাবে, কিন্তু এরকমটা কখনও হয় না আর না হওয়া সম্ভব। যদি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আকর্ষণ বল না হয় আর কেবল প্রতিকর্ষণ বল হয়, তাহলেও ব্রহ্মাণ্ড হওয়া তো দূর, একটা কণাও তৈরি হবে না।
গুরুত্বাণু (গ্রাভিটন)
বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা কল্পিত "গুরুত্বাণু (গ্রাভিটনস্)" "ওম্" বাক্ রশ্মিযুক্ত মাস বা ঋতু রশ্মিদের দ্বারা পংক্তি ও বৃহতী-ত্রিষ্টুপ্ ও সূত্রাত্মার রহস্য সংযোগ দ্বারাই উৎপন্ন হয় আর এর দ্বারাই গুরুত্বাকর্ষণ বলের উৎপত্তি হয়।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

তবে মনে রাখবেন যে বর্তমান ভৌতিকী গুরুত্বাণুর বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কেবল জানে না তা নয়, বরং বিভ্রান্তেও আছে। কিছু লোক একে কল্পিত কণা মানে। যদি আমরা একে কল্পিত কণা মনে করি, তাহলে গুরুত্বাকর্ষণ বলও কল্পিত সিদ্ধ হয়ে যাবে। কণাই যখন কল্পিত, তখন তারথেকে উৎপন্ন বলকে আমরা কিভাবে বাস্তবিক বলতে পারি? বর্তমানে বৈজ্ঞানিক এরকমও বলছে যে গুরুত্ব বল কোনো বল না, একটা দ্রব্যমানযুক্ত বস্তু অন্য দ্রব্যমানযুক্তকে আকর্ষিত করে না, বরং আকাশেরই কিছু বিকৃত হওয়ার কারণে এরকমটা হয়। এখানে এই প্রশ্ন দাঁড়ায় যে দ্রব্যমান আকাশকে কোন বল দিয়ে বিকৃত করে? যদি গুরুত্ব বল দিয়ে হয়, তাহলে গুরুত্ব বল আগে নাকি আকাশের বক্রতা? এরকম প্রশ্নের উত্তর বর্তমান ভৌতিকীর কাছে পাওয়া যায় না।
সৃষ্টির মধ্যে গুরুত্ব বলের উৎপত্তির প্রারম্ভ
যখন ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হতে থাকে, সেই ক্রমে -
আপো রেবতীঃ ক্ষয়থা হি বস্বঃ ক্রতুম্ চ ভদ্রম্ বিভৃথামৃতম্ চ।
রায়শ্চ স্থ স্বপত্যস্য পত্নীঃ সরস্বতী তদ্ গৃণতে বয়ো ধাত্।।
(ঋগ্বেদ 10.30.12)
এই নিচৃত্ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির আবৃত্তি তার আগে 100 বার হয়। তখন অনেক প্রকারের ছন্দ রশ্মি সেই সময় পর্যন্ত উৎপন্ন হয়ে যায়। সেই সময় ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পদার্থ অতি সূক্ষ্ম বায়ু রূপ হয়ে সর্বত্র প্রবাহিত হতে থাকে। তবে মনে রাখবেন যে, এখানে বায়ুর অর্থ হাওয়া (Air) নয়, বরং ছন্দ রশ্মি। সেই সময় পর্যন্ত বর্তমান প্রচলিত ঊর্জা উৎপন্ন হয় না। তখন আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা জ্ঞাত কোনো ধরনের কণা প্রতিকণার উৎপন্ন হয় না। যখন অনেক প্রকারের ছন্দ রশ্মিগুলো, বায়ু রূপ যে আছে, উৎপন্ন হয়ে যায়, সেই সময় তাদের জমাট থেকেই সর্বপ্রথম প্রচলিত ঊর্জার উৎপত্তি হয়। যার প্রত্যেক কোয়ান্টার অন্তর্গত অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম রশ্মি আর তাদের এতই সূক্ষ্ম বল বিদ্যমান থাকে। তারপরে সেই ব্রহ্মাণ্ডস্থ পদার্থের মধ্যে এই ছন্দ রশ্মি পুনঃ 260 বার স্পন্দিত হয় আর এই সময়েই 360 প্রকারের অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের ঘনীভূত কণা রূপে সর্বপ্রথম গুরুত্বাকর্ষণ বল উৎপন্ন হয়, যার কারণে সেই পদার্থ ধীরে-ধীরে ঘনীভূত হতে থাকে। সেই সময় বিদ্যুদাবেশিত কণারও উৎপত্তি হয়। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলও উৎপন্ন হয়ে যায়। এই সময় সেই পদার্থ ঘনীভূত হয়ে নেব্যূলার নির্মাণ করতে শুরু করে। আর সেই সময় পদার্থের রং কিছুটা লাল বা তামাটে বর্ণের হয়। আর সেই সময় তারার উৎপত্তির পূর্বেই বিভিন্ন প্রকারের ছোটো নাভিকেরও উৎপত্তি হতে থাকে।
✍️স্মরণীয় তথ্য
1. মহর্ষি কণাদের অনুসারে সংযোগ বা সংস্কারের অভাবে বস্তু গুরুত্ব বলের কারণে নিচের দিকে পড়তে থাকে।
2. পিণ্ড বা কণাগুলো থেকে কিছু রশ্মি, বিশেষ করে বৃহতী ও পংক্তি ছন্দ রশ্মি চতুর্দিকে নিরন্তর অবশোষিত ও নির্গত হতে থাকে।
3. পংক্তি এবং বৃহতী রশ্মির সংযোগ দ্বারা "গুরুত্বাণু" -র উৎপত্তি হয়।
4. কোনো পিণ্ডের মধ্যে যত অধিক দ্রব্যমান হবে, সেই পিণ্ড থেকে তত অধিক বৃহতী ও পংক্তি ছন্দ রশ্মি নির্গত হবে আর ততই অধিক তার গুরুত্বাকর্ষণ বলও হবে।
5. গুরুত্বাকর্ষণ বল এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল উৎপন্নকারী প্রাণ রশ্মিগুলো অনন্ত দূরত্ব পর্যন্ত চলার পরেও অন্তরালকে প্রাপ্ত করে না।
6. গুরুত্বাণুগুলো সবদিকে প্রবাহিত হওয়ার কারণে গুরুত্ব ঊর্জা ঝরতে থাকে, সমান প্রকারের রশ্মিদের সংঘর্ষ হওয়াতে তাদের মধ্যে প্রতিকর্ষণ তথা পংক্তি আর বৃহতী ছন্দ রশ্মিগুলোর মাঝে পারস্পরিক আকর্ষণ স্বাভাবিক রূপে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ার কারণে গুরুত্ব বল সব বলের মধ্যে সবথেকে দুর্বল, কিন্তু ব্যাপক হয়।


আবেশ -এর স্বরূপ

গুরুত্ব বলের পরে এখন আমরা সেই বলের সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করবো, যা বিদ্যুৎ আবেশিত পদার্থের মাঝে উৎপন্ন হয় আর যে বলগুলোর মধ্যে দ্রব্যমানের কোনো ভূমিকা থাকে না, যদিও সে পদার্থ অনিবার্য রূপে দ্রব্যমানের সঙ্গে যুক্তই থাকে। চলুন, আমরা এই বলগুলোর মধ্যে প্রমুখ বল বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের বিষয়ে জানার চেষ্টা করি -

বিদ্যুৎ আবেশ

যখন সিল্কের কাপড়ের সঙ্গে কাঁচের ছড় একসাথে ঘর্ষণ করা হয়, তো কাঁচের ছড় ঘর্ষনের পরে ছোট-ছোট কণা, কাগজের টুকরো ইত্যাদিকে আটকে ধরা প্রারম্ভ করে দেয়, এই ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার (ঘর্ষণ) পর পদার্থ সামান্যের তুলনায় কিছু ভিন্ন ব্যবহার প্রদর্শন করে আর পদার্থের এই বিশেষ গুণকে "বিদ্যুৎ আবেশ" বলে। যখন আমরা সোয়েটার শরীর থেকে খুলে নিই, সেই সময় আপনি চট-চট শব্দ শোনা অথবা স্ফুলিঙ্গ দেখার অনুভব করে থাকবেন। এর কারণও হচ্ছে বিদ্যুৎ আবেশই।

আবেশ -এর বিষয়ে বলা হয় -
"A property of some elementary particles that gives rise to an interaction between them."
(Oxford dictionary of Physics, Pg.No.69)
অর্থাৎ কিছু মূল কণার পারস্পরিক আকর্ষণ-প্রতিকর্ষণ বলের উৎপাদক গুণকেই আবেশ বলে, কিন্তু এই বিদ্যুৎ আবেশটা কি? বর্তমান ভৌতিকীর মধ্যে এই বিষয়টা স্পষ্ট না।
পদার্থ দ্বারা আবেশ (বিশেষ গুণ) গ্রহণ করার পশ্চাৎ পদার্থকে আবেশিত পদার্থ বলে। বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান ধনাত্মক তথা ঋণাত্মক দুই প্রকারের আবেশের কল্পনা করে। এইসব আবেশ দুই বস্তুত মাঝে পরস্পর আকর্ষণ প্রতিকর্ষণের কারণ হয়। কিছু সামান্য প্রয়োগের দ্বারা জানা যায় যে সজাতীয় আবেশ একে-অপরকে প্রতিকর্ষিত তথা বিজাতীয় আবেশ একে-অপরকে আকর্ষিত করে। কিন্তু গভীরভাবে বিচার করলে পরে আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন উপস্থিত হয়। যেমন - আবেশের গুণের কারণ কি? ইলেকট্রনে ঋণাবেশ এবং প্রোটনে ধনাবেশ কেন হয়? সজাতীয় আবেশ একে-অপরকে প্রতিকর্ষিত তথা বিজাতীয় আবেশ একে-অপরকে আকর্ষিত কেন করে অর্থাৎ আকর্ষণ তথা বিকর্ষণের ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? আবেশিত কণার আন্তরিক গঠন কি? আদি প্রশ্ন বর্তমান বিজ্ঞানের জন্য এখনও ধাঁধা হয়ে আছে। এই অধ্যায়ের মধ্যে আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর বৈদিক বিজ্ঞানের আধারে জানার চেষ্টা করবো।

আবেশের কারণ

বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে -
🔷 আবেশ হচ্ছে পদার্থের একটা গুণ।
🔷 যার দ্বারা ক্রিয়াশীলতা ও ঊষ্মার উৎপত্তি হয়, সেই
পদার্থকে বিদ্যুৎ বলে।
🔷 বিদ্যুৎ হচ্ছে পদার্থের নাম আর আবেশ হচ্ছে তার
গুণ।
🔷 যার দ্বারা বল গুণের উদয় হয়, সেই পদার্থকে বিদ্যুৎ বলে।
🔷 বিদ্যুৎ প্রত্যেক কণা আদি পদার্থকে উৎপন্ন ও প্রেরিত করে।
যেমন আমরা জানি যে, কোনো পদার্থ ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন আদি দিয়ে তৈরি আর এদের থেকে প্রোটন ও নিউট্রন তাদের থেকেও সূক্ষ্ম কোয়ার্ক আদি কণা তথা কোয়ার্কস্ ছন্দ রশ্মিগুলো দিয়ে তৈরি। এইজন্য আবেশের কারণ জানার জন্য আমাদের আগে এই রশ্মির ব্যবহারকে ভালো করে জেনে নেওয়া উচিত। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যত রশ্মি আছে, তাদের দুই প্রকারে বিভাজিত করা যেতে পারে - য়োষা এবং বৃষা। এদের মধ্যে কিছু রশ্মি বৃষা (পুরুষ), তো বাকি তাদের সাপেক্ষে য়োষা (স্ত্রী) রূপ ব্যবহার করে। উভয় প্রকারের রশ্মির মধ্যে একে-অপরকে আকর্ষিত করার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, যা তাদের মধ্যে "ওম্" এবং মনস্তত্ত্বের মাত্রার ভিতরের কারণে আসে। রশ্মিগুলো এই গুণের কারণেই পদার্থ অথবা কণা একে-অপরকে আকর্ষিত করতে পারে অথবা আবেশকে উৎপন্ন করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, কিছু কণা নিস্তেজ কেন থাকে? এর কারণ হচ্ছে নিস্তেজ কণাগুলোর ভিতরে উভয় প্রকারের রশ্মি সমান মাত্রায় থাকে।
বিদ্যুৎ আবেশ সর্বদাই কোনো সূক্ষ্ম কণার ভিতরেই বিদ্যমান থাকে। এই বিদ্যুৎ আবেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হওয়া সম্ভব না। বিদ্যুৎ আবেশ ছাড়া কোনো কণার অস্তিত্বও থাকবে না। এই বিদ্যুৎ আবেশের কারণেই সেই কণার মধ্যে গতি, বল, প্রকাশ আদি গুণ বিদ্যমান থাকে।

ধনাবেশ তথা ঋণাবেশের মধ্যে পার্থক্য 

ধনাবেশিত কণা বিভিন্ন প্রকারের প্রাণ রশ্মির দ্বারা নির্মিত হয়। প্রাণ রশ্মি সর্বদা মরুত্ (ছোট ছন্দ রশ্মি) রশ্মিগুলোকে আকর্ষিত করে। আকাশও এই ছন্দ রশ্মির দ্বারাই নির্মিত হয়, এই কারণে আকাশের রশ্মিগুলো প্রাণ রশ্মির সঙ্গে ধনাবেশিত কণাকেও ধরে রাখে। অন্যদিকে, ঋণাবেশিত কণা বিভিন্ন প্রকারের মরুত্ রশ্মির দ্বারা নির্মিত হয়।

মরুত্ রশ্মিগুলো আকাশের রশ্মিদের আকর্ষিত করে। এইভাবে আকাশ সেই উভয় কণার মাঝে এই ধরনের ব্যবহার করে যেন সেটা একটা শীটের মতো আর সেই শীটের উপর দুটো বাচ্চা বসে আছে। একটা বাচ্চা শীটের সঙ্গে আটকে আছে আর অন্য বাচ্চাটা শীটকে ধরে আছে, আর সে শীটকে টানতে-টানতে শীটের সঙ্গে আটকে থাকা বাচ্চাটাকে নিজের দিকে নিয়ে আসে।

বিপরীত আবেশের মধ্যে আকর্ষণের প্রক্রিয়া

কুলম্ব-নিয়মের (coulomb's law) অনুসারে -
"দুইটি বিন্দু আবেশের মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মান সেই দুটো আবেশের গুণফলের সমানুপাতিক হয় তথা সেই আবেশের মধ্যে দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়।"


অর্থাৎ F = Ke × q1q2/r^2
এখানে q1 আর q2 হল দুই আবেশের মান তথা r তাদের মধ্যে দূরত্ব, F হল তাদের দ্বারা একে-অপরের উপরে লাগিয়ে দেওয়া বল। গুরুত্বাকর্ষণ বলের সূত্রের মতো এখানেও একটা স্থিরাঙ্ক আছে, যাকে এখানে Ke (যার মান 9.0 × 10^9 Nm ^2C^-2) দ্বারা দেখানো হয়েছে। এই নিয়মের দ্বারা আমরা দুই আবেশের মাঝে হওয়া বলের মান তো বের করতে পারবো, কিন্তু এর ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? দুটো আবেশে কি একে-অপরকে আকর্ষিত করছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে নেই, তবে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যানের (বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ) মধ্যে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে, তার অনুসারে, ধনাবেশিত কণার মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মিগুলোতে ব্যাহৃতি রশ্মির ("ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ") প্রাধান্য থাকে। যখন দুই ধনাবেশিত ও ঋণাবেশিত কণা পরস্পর একে-অপরের নিকট আসে, সেই সময় সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মিগুলো ঋণাবেশিরত কণার দিকে বৃষ্টি হয়। এদের আকর্ষণ দ্বারা ঋণাবেশিরত কণার মধ্যে বিদ্যমান মরুত্ রশ্মিগুলো বাইরের দিকে আকর্ষিত হয়ে ব্যাহৃতির সঙ্গে-সঙ্গে ধনঞ্জয় রশ্মির দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। যদি এরকমটা না হয়, তাহলে ধনঞ্জয় রশ্মিগুলো, মরুত্ রশ্মিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারবে না।

যে কণার মধ্যে যত অধিক প্রাণ বা মরুত্ রশ্মি হবে, সেই কণার বল ততই অধিক হবে। কোনো আবেশের দ্বারা রশ্মিগুলো গুরুত্বাকর্ষণ বলের মতো চারিদিক সমান রূপে বেরিয়ে আসে, যারফলে এই বলও দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়।
বর্তমান বিজ্ঞান বলের উৎপত্তির কারণ আবেশের মাঝে মধ্যস্থ (মিডিয়েটর) কণা প্রকাশাণুর (ফোটন) বিনিময়কে মানে। এই প্রকাশাণুর ধারাকে বৈজ্ঞানীকেরা ফিল্ড বলে। এখন প্রশ্ন এই হচ্ছে যে, প্রকাশাণু কোথা থেকে আসে অথবা কিভাবে উৎপন্ন হয় আর এর বিনিময় কি হয়?
যেরকম আমি উপরে বলেছি যে ধনাবেশিত কণা প্রাণাদি পদার্থের সংকোচন দ্বারাই উৎপন্ন হয়। এই কারণে তারমধ্যে প্রাণ তত্ত্বের ঘনত্ব অধিক থাকে। আর এই কারণে ধনাবেশিত কণা প্রাণ তত্ত্বের কিছু অংশকে ধনঞ্জয় প্রাণের সঙ্গে আকাশ তত্ত্বতে নির্গত করে, ঋণাবেশিত কণা থেকে নির্গত মরুত্ রশ্মিগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে মধ্যস্থ (মিডিয়েটর) কণার নির্মাণ করে। এই কণা কাল্পনিক নয়, বরং বাস্তবিক, কিন্তু এদের জীবনকাল অত্যন্ত অল্প হওয়ার কারণে এদের বর্তমান কোনো টেকনিকের সাহায্যে জানা অতি দুষ্কর।
মধ্যস্থ কণার মধ্যে প্রাণ এবং মরুত্ উভয় প্রকারের রশ্মি থাকে, এই কারণে সেটা দুই আবেশের দ্বারা আকর্ষিত হয় আর সেই দুইয়ের মাঝে দোলায়মান হতে থাকে, যারফলে সেটা গতিশীল হওয়ায় ধনাবেশিত ও ঋণাবেশিত কণার মাঝে বিদ্যমান আকাশও ধীরে-ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। যখন এই আকাশ অধিকতম সীমা পর্যন্ত সংকুচিত হয়, অর্থাৎ ধনাবেশিত ও ঋণাবেশিত কণার মাঝে নিম্নতম দূরত্ব রয়ে যায়, তখন মধ্যস্থ কণা নিজের অবয়বভূত রশ্মিগুলোতে ছড়িয়ে লুপ্ত হয়ে যায়।



সমান আবেশিত কণার মাঝে প্রতিকর্ষণের ক্রিয়াবিজ্ঞান :-

বর্তমান বিজ্ঞান বিপরীত আবেশের মাঝে আকর্ষণের কারণকে জানার চেষ্টা তো করে, কিন্তু সমান আবেশের মাঝে প্রতিকর্ষণের কারণ জানতে সর্বদাই অক্ষম। বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে, যখন দুই দিকে সমান প্রকারের আবেশ বিদ্যমান থাকে, তখন দুই কণার মধ্য থেকে ধনঞ্জয় প্রাণ অথবা মরুত্ রশ্মিগুলো নির্গত হয়। সমান প্রবৃতি হওয়ার কারণে এই রশ্মিগুলোর মাঝে কোনো আকর্ষণ বল কাজ করে না। অন্যদিকে এটাও একটা তথ্য যে দুই ও দুইয়ের অধিক পদার্থের মাঝে সর্বদা অসুর ঊর্জা, যার প্রভাব সর্বদাই প্রতিকর্ষণ ও প্রক্ষেপক হয়, বিদ্যমান থাকে। যদি সেই পদার্থের থেকে নির্গত হওয়া রশ্মিগুলোর মাঝে কোনো আকর্ষণ বল না হয়, তাহলে অসুর ঊর্জা সেই পদার্থগুলোকে প্রতিকর্ষিত করতে থাকবে। এই কারণে সেই সমান প্রকারের রশ্মিগুলো পরস্পর ধাক্কা লেগে পুনরায় পেছনে ঘুরে যায়, যারফলে দুই কণার মাঝখানে আকর্ষণ না হয়ে প্রতিকর্ষণ বল কাজ করে।

এটা আরও আছে :-

এখানে দুই আবেশিত কণার মাঝে হতে চলা আকর্ষণ প্রক্রিয়ার আরও অধিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক। যেমন আমরা জানি যে অগ্নি (প্রাণ) প্রধান কণা ধনাবেশিত আর সোম (মরুত্) প্রধান কণা ঋণাবেশিত হয়। ধনাবেশিত কণা থেকে অতি তীব্রগামী ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মিগুলো আর ঋণাবেশিত কণা থেকে সূক্ষ্ম মরুত্ রশ্মিগুলো নির্গত হয়ে একে-অপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। সূত্রাত্মা বায়ু এই দুই প্রকারের কণাকে ঢেকে রাখে, কিন্তু কণার পরিধিতে এর ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত অধিক হয়। সূত্রাত্মা বায়ু, ধনঞ্জয় আদি প্রাণ আর মরুত্ রশ্মির মিশ্রণ দ্বারাই তরঙ্গাণু (ফিল্ড পার্টিকলস্) উৎপন্ন হয়। এদের গতি বিদ্যুৎ তরঙ্গের গতির সমান হয়। এই প্রক্রিয়াতে ধনঞ্জয় বায়ু সর্বপ্রথম ঋণাবেশিত কণার কাছে পৌঁছায়, তার সঙ্গে-সঙ্গে তরঙ্গাণুও (ফিল্ড পার্টিকলস্) এর উপর চড়ে ঋণাত্মক কণার দিকে অগ্রসর হয়। এর পশ্চাৎ দুই আবেশিত কণা পরস্পর নিকট আসতে থাকে। সেই স্থিতিতে দুটো কণারই বাইরে আর ভিতরে একটানা প্রবহমান প্রাণ আর অপান রশ্মিগুলো একে-অপরের নিকট আসে। তারপর সর্বশেষে সেই দুই কণা পরস্পর নিকটতম এসে একে-অপরের সঙ্গে বন্ধন হয়ে যায়।
এই বল তরঙ্গাণুর (ফিল্ড পার্টিকলস্) কারণে নয়, বরং এই ধনঞ্জয়, মরুত্ বা সূত্রাত্মা বায়ু আদির রশ্মির এই বলের কারণেই ফিল্ড পার্টিকলসের উৎপত্তি হয়। তারপর তরঙ্গাণু (ফিল্ড পার্টিকলস্) একটা দড়ির মতো আবেশিত কণাগুলোকে বেঁধে রাখে অবশ্য, যেমন দুইজন ব্যক্তি একটা দড়ির দুই মাথাকে দৃঢ়ভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর এটা দিয়েই তারা পরস্পর বাঁধা আছে, সেই সময় তারা দুইজন নিজের বল দ্বারা দড়ির মাধ্যমে একে - অপরের সঙ্গে বাঁধা আছে, নাকি দড়ির নিজের বল দ্বারা। দড়িকে তাদের মাংসপেশির বলই শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঠিক এইভাবে দুই আবেশিত কণা থেকে নির্গত পূর্বোক্ত বিভিন্ন প্রাণাদি রশ্মিগুলোই হচ্ছে বলের মূল কারণ আর সেই রশ্মিগুলোই ফিল্ড পার্টিকলস্ রূপী দড়িকে না কেবল শক্ত করে ধরে রাখে, বরং তাদের উৎপন্নও করে, যেন দুইজন ব্যক্তিই সেই দড়িটাকে তৈরিও করেছে।

এই বলের বিষয়ে একটা অতি গম্ভীর রহস্য এই হচ্ছে যে তরঙ্গাণুর (ফিল্ড পার্টিকলস্) প্রভাবকারী বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মিদের প্রভাবকারী বলের এক চতুর্থাংশ হয়ে থাকে। যখন ধনঞ্জয় প্রাণ, মরুত্ রশ্মি এবং সূত্রাত্মা বায়ুর মিশ্রণ থেকে তরঙ্গাণুর (ফিল্ড পার্টিকলস্) উৎপত্তি হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু থেকে উৎপন্ন একটা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি সেই তরঙ্গাণুকে বল আর তেজ প্রদান করে আর তাকে নিজের সঙ্গে সংযুক্তও করে নেয় আর ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মিগুলো তাকে গতি প্রদান করে। এই গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি সেই ফিল্ড পার্টিকলসকে করার সঙ্গে তাকে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়, যেন সেটা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলোকে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রিত করে দুই আবেশিত কণার মাঝে স্থিত আকাশ তত্ত্বে স্পন্দিত হয়ে সেই কণার মাঝে প্রবাহিত হতে থাকে। সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে দুই কণার মাঝে আকর্ষণের এই ক্রিয়াই হতে থাকে। এইভাবে নির্মিত সংযুক্ত কণা এই সৃষ্টির মধ্যে সর্বত্র বিচরণ করতে থাকে।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. যার দ্বারা ক্রিয়াশীলতা ও ঊষ্মার উৎপত্তি হয়, সেই পদার্থকে বিদ্যুৎ বলে।
2. বিদ্যুৎ হচ্ছে এক প্রকারের পদার্থের নাম আর আবেশ হচ্ছে তার গুণ।
3.যার দ্বারা বল গুণের উদয় হয়, সেই পদার্থকে বিদ্যুৎ বলে।
4. এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে য়োষা এবং বৃষা দুই প্রকারের রশ্মি আছে।
5. দুই প্রকারের রশ্মির মধ্যে একে-অপরকে আকর্ষিত করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থাকে, যা তাদের মধ্যে "ওম্" এবং মনস্তত্ত্বের মাত্রার পার্থক্যের কারণে আসে।
6. বিদ্যুৎ আবেশের কারণেই কোনো কণার মধ্যে গতি, বল এবং প্রকাশ আদি গুণ বিদ্যমান থাকে।
7. ধনাবেশিত কণা বিভিন্ন প্রকারের প্রাণ রশ্মির দ্বারা তথা ঋণাবেশিত কণা বিভিন্ন প্রকারের মরুত্ রশ্মির দ্বারা তৈরী হয়।
8. মরুত্ রশ্মিগুলো আকাশের রশ্মিগুলোকে আকর্ষিত করে।
9. ধনাবেশিত কণার মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মিগুলোতে ব্যাহৃতি রশ্মির ("ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ") প্রাধান্য থাকে।
10. যে কণার মধ্যে যত অধিক প্রাণ বা মরুত্ রশ্মিগুলো হবে, সেই কণার বল ততই অধিক হবে।
11. প্রাণ তত্ত্ব মরুত্ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে মধ্যাস্থ (মিডিয়েটর) কণার নির্মাণ করে।
12. সমান প্রবৃত্তির রশ্মির মাঝে কোনো আকর্ষণ বল কাজ করে না।
13. ফিল্ড পার্টিকলের প্রভাবকারী বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মির প্রভাবকারী বলের এক চতুর্থাংশ হয়।


তরঙ্গাণু ও মূলকণার উৎপত্তি


বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান সৃষ্টি প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হওয়ার সময়েই তরঙ্গাণু ও মূলকণার উৎপত্তিকে স্বীকার করে। এটাও মানে যে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর থেকে সূক্ষ্ম কোনো পদার্থের কোনো সম্ভাবনা নেই, অথচ বৈদিক ভৌতিকীর অনুসারে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর উৎপত্তি সৃষ্টি উৎপত্তি প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটা চরণের পশ্চাৎ অগ্নি মহাভূতের উৎপত্তি থেকে প্রারম্ভ হয়। এর উৎপত্তি হওয়ার পূর্বে এই সৃষ্টিতে কাল ও মহত্ থেকে শুরু করে বায়ু মহাভূত পর্যন্ত কত প্রকারের পদার্থ উৎপন্ন হয়, আমরা পূর্বে এসব নিয়ে জেনেছি।
পৃষ্ঠা - 17 তে দেওয়া চিত্রানুসারে অগ্নি মহাভূত, যাকে বর্তমান ভাষায় তরঙ্গাণু ও মূলকণা বলা যেতে পারে, তার উৎপত্তি দশম চরণে হয়, এতে পাঠক স্বয়ং বুঝতে পারবে যে সৃষ্টির মূল পদার্থকে জানার থেকে বর্তমান ভৌতিকী কতটা দূরে আছে?

তরঙ্গাণু ও মূলকণার সংক্ষিপ্ত স্বরূপ

মন, বাক্, প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলো সৃষ্টিকালে নষ্ট হয়ে যায় না। এই পদার্থ নিরন্তর গতি করে বল ও হালকা অদৃশ্য দীপ্তি যুক্ত থাকে আর সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে ছড়িয়ে থাকে। এই পদার্থ অন্য স্থূল পদার্থের উপর নিজের অত্যন্ত সূক্ষ্ম রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এই রশ্মিগুলোর কারণেই সৃষ্টির সমস্ত পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ আদি বল উৎপন্ন হয়। এই রশ্মিগুলোর অনুপাতে ভেদ, দিশার ক্রম ভেদ, মাত্রা ভেদের কারণেই সৃষ্টির বিভিন্ন কণা ও তরঙ্গের নির্মাণ হয়।
এই ব্রহ্মাণ্ডে বিভিন্ন কণা সূত্রের (দড়ি) সমান কম্পন করা সূক্ষ্ম অবয়বের ঘন রূপ হয়। কোনো কণাই পূর্ণতঃ দৃঢ় তথা নিশ্চিত আকৃতির হয় না। এইসব কণা স্বতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই বন্ধনের কারণেই এরা পরস্পর আকর্ষণ-বিকর্ষণ আদি ব্যবহার করে নানা তত্ত্বের নির্মাণ করতে পারে। মূলকণাতে বিদ্যমান প্রাণাদি রশ্মিগুলো পরস্পর অতি সুদৃঢ় বন্ধনে বাঁধা থাকে, যার কারণে সেই কণা নিজের কণীয় অবস্থাকে প্রাপ্ত করে। যদি প্রাণ রশ্মির এই প্রকারের সুদৃঢ় বন্ধন না হতো, তাহলে মূলকণা বা অন্য যেকোনো কণার উৎপত্তিই হতে পারত না।
এই দুই প্রকারের পদার্থ হচ্ছে অগ্নি মহাভূতের রূপ। এই দুই প্রকারের পদার্থের নির্মাণ প্রক্রিয়া মৌলিক রূপে সমান হয়। অগ্নি মহাভূতের উৎপত্তি বায়ু মহাভূতের পশ্চাৎ সেই সময় পর্যন্ত উৎপন্ন পদার্থের বিশিষ্ট মিশ্রণ ও জমাট থেকে হয়। মূলকণা ও বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের উৎপত্তির পূর্বে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড অনেক প্রকারের প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির রূপে উপস্থিত থাকে। এইসব রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে সূক্ষ্মতম ছন্দ রশ্মি "ওম্" -এর কারণে উৎপন্ন হয়। এই রশ্মির তুলনা বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিচিত কোনো তরঙ্গের সঙ্গে করা সম্ভব না, বরং এটা হচ্ছে সেই সবের উৎপত্তির কারণ।

বায়ুতত্ত্ব (ভ্যাক্যুম ঊর্জা) থেকে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর নির্মাণ :-

বিভিন্ন প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির মিশ্রণ বায়ু নামক সর্বত্র প্রায় একরস ভরা থাকে। একে বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষায় ভ্যাক্যুম ঊর্জা বলা যেতে পারে। এখানে একরসের তাৎপর্য এটা নয় যে কোথাও কোনো গতি বা হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না, বরং এটা বিদ্যমান থাকার পরেও পদার্থ কোথাও না তো ঘন রূপকে ধারণ করে আর না সেটা কোনো তরঙ্গের ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো সূত্রাত্মা বায়ু, নিবিদ্ (মাস) এবং বৃহতী ছন্দ আদি রশ্মিদের প্রেরিত করে বায়ু তত্ত্বে অসংখ্য স্থানে চক্রণ উৎপন্ন করতে থাকে, যেভাবে নদীতে প্রবাহিত জলের মধ্যে চক্রণ (ঘূর্ণি) উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াতে তিনটা চরণ থাকে। যার মধ্যে ক্রমশঃ গায়ত্রী, ত্রিষ্টুপ্-বৃহতী এবং জগতী ছন্দের বিশেষ ভূমিকা থাকে। কণার তুলনায় তরঙ্গাণুতে রশ্মির জমাট বা মাত্রা নিম্ন থাকে, কিন্তু দুটোর নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় সমান হয়। চক্রণ প্রারম্ভ হওয়ার পূর্বে একটা নিচৃত্ ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সম্পূর্ণ বায়ু তত্ত্বতে একশ বার সর্বত্র স্পন্দিত হয়, তার পশ্চাৎই চক্রণ প্রারম্ভ হয়ে অনেক প্রক্রিয়া চলার পশ্চাৎ সর্বপ্রথম তরঙ্গাণু উৎপন্ন হয়। তার পশ্চাৎ ল্যাপটন ও কোয়ার্ক আদি অন্য সব মূলকণা বলে পরিচিত এমন কণার উৎপত্তি হয়। ছন্দ রশ্মিগুলোকে সংকোচকারী কেবল সূত্রাত্মা বায়ু, নিবিদ্ আদি রশ্মিগুলোই হয় না, বরং প্রাণ, অপান, ব্যান আদি প্রাণ রশ্মিগুলোও এরমধ্যে ভূমিকা পালন করে। যখন এই সংকোচকারী প্রাণ রশ্মিগুলো সংকুচিত রশ্মিগুলোর তুলনায় দুর্বল হয়, তখন সংকোচন ক্রিয়া সম্ভব হয় না আর যখন সেটা অতীব সবল হয়, তখন সংকোচন ক্রিয়া তীব্র হয়ে মূলকণাগুলোকে উৎপন্ন করে। যখন সংকোচকারী রশ্মিগুলো সংকুচিত রশ্মির তুলনায় সবল তো হয় কিন্তু খুব অধিক সবল হয় না, তখন তরঙ্গাণুর নির্মাণ হয়। বিভিন্ন মূলকণা, আকাশ তত্ত্ব তথা তরঙ্গাণুতে অর্থাৎ সর্বত্রই বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিগুলো সংমিশ্রণ রূপে বিদ্যমান থাকে। এদের মধ্যে তরঙ্গাণুর ভিতরে বিদ্যমান সংমিশ্রণের মধ্যে দুটো ছন্দ রশ্মি সমান রূপে তীক্ষ্ণ, সক্রিয় ও প্রকাশিত থাকে। এর বিপরীত আকাশ তত্ত্ব এবং মূলকণার মধ্যে বিদ্যমান সংমিশ্রণে দুটো ছন্দ রশ্মির প্রকাশশীলতা এবং সক্রিয়তার মাত্রার মধ্যে কিছু ভেদ থাকে অর্থাৎ এই দৃষ্টিতে আকাশ এবং মূলকণার মধ্যে কিছু সমতা আছে। এই কারণেই তরঙ্গাণুর তুলনায় মূলকণা নিজের দ্রব্যমান বা বিদ্যুৎ আবেশের দ্বারা আকাশ তত্ত্বকে অধিক প্রভাবিত করতে পারে। আর এই কারণেই কণা ও তরঙ্গাণু তথা তরঙ্গাণু ও আকাশ তত্ত্বের পারস্পরিক আকর্ষণ আদি ক্রিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়।
বৈদিক বিজ্ঞান বিভিন্ন মূলকণার বিষয়ে একটা মহান রহস্যোদ্ঘাটন এই করে যে এই কণা ও তারার গঠনে কিছুটা সমতা থাকে। দুটোর মধ্যেই কেন্দ্রীয় ভাগ শেষ বিশাল ভাগ থেকে পৃথক হয়ে পরস্পর পৃথক-পৃথক গতিতে ঘূর্ণন করে। দুটোর বিভিন্ন ভাগের মধ্যে প্রাণাদি রশ্মির অস্তিত্ব সর্বদা সমান থাকে না, বরং কিছু ভেদ থাকে।
বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে যেকোনো কণা নিম্ন প্রকারের হয় -
1. প্রাণাদি সূক্ষ্ম রশ্মিরূপ পদার্থের অপেক্ষাকৃত ঘন, সংকুচিত রূপ হয়, যা সবদিক থেকে একটা সীমা দ্বারা আবদ্ধ থাকে। সেই ঘেরা সূত্রাত্মা বায়ু আদি রশ্মির হয়।
2. সূত্রাত্মা বায়ুর ঘেরা উপরেই হয়, ভিতরে হয় না।
3. সেই সূত্রাত্মা বায়ু তার ভিতর অবরুদ্ধ প্রাণাদি পদার্থকে থামিয়ে রাখে অর্থাৎ সেই কণাকে ছড়িয়ে যেতে দেয় না।
4. সেই ঘেরা ওই কণাকে বহিরাগত সর্বব্যাপ্ত প্রাণাদি পদার্থ থেকে বিভক্ত করে। সেই কণা ওই আবরণকে এরকমভাবে ধারণ করে থাকে, যেরকম কোনো মানুষ বস্ত্রকে ধারণ করে।
5. এই ঘেরা কোনো দৃঢ় বস্তুর তথা স্পষ্ট হয় না, বরং এটাও রশ্মিরূপ সূত্রাত্মা বায়ু আদি রশ্মির হয়, যাকে প্রায়শঃ অনুভব করা যায় না।
6. সেই পরমাণু নিজের এই অদৃশ্য পরিমাপের কখনও লঙ্ঘন করে না, যদি বা করে, তাহলে সেটা অত্যল্প কালের জন্যই।
এখানে যেকোনো কণার স্বরূপের এমন গম্ভীর, কিন্তু সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞান প্রকাশিত করা হয়েছে, যাকে আজ পর্যন্ত বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান বুঝতে পারেনি।

প্রকাশাণুর নির্মাণ

ব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান প্রাণ এবং বাক্ রশ্মির মিশ্রিত রূপ বায়ু তত্ত্ব আকাশ তত্ত্ব দ্বারা আবৃত হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। তারপর সেই সংকুচিত বায়ু ঘনীভূত হয়ে চকমক করতে থাকে। এই সংকুচিত ও চকমক করা কণাকেই বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রকাশাণু (ফোটন) বলা হয়। এই প্রকাশাণু প্রাণ, অপান আদি সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে থাকে। এরপরে একটা দৈবী ত্রিষ্টুপ্ তথা একটা নিচৃদ্ দৈবী ত্রিষ্টুপ্ অথবা দৈবী পংক্তি ছন্দ রশ্মির প্রভাবে সূত্রাত্মা বায়ু বিভিন্ন প্রকাশাণুকে পরিধি রূপে ঘিরে ধরে একটা পরিমিত রূপ প্রদান করে। যখন প্রাণ, অপান পদার্থ বিস্তৃত ক্ষেত্রের মধ্যে গমন করতে থাকে অর্থাৎ তার গতি সীমিত ক্ষেত্রের মধ্যে কম্পন করা পর্যন্তই সীমিত থাকে না, ঠিক সেই সময় তারা পরস্পর সঙ্গত ও সংকুচিত হয়ে প্রকাশাণুর (ফোটনস্) রূপ ধারণ করে। তারপর সেই প্রকাশাণু সূত্রাত্মা বায়ু দ্বারা আবৃত হয়ে ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মির দ্বারা অত্যন্ত তীব্র গতি প্রাপ্ত করে সম্পূর্ণ মহাকাশে গমন করতে থাকে, যারফলে সম্পূর্ণ মহাকাশ প্রকাশিত হয়ে ওঠে। এই প্রাণ তথা ঊর্জার গতি খুবই তীব্র অর্থাৎ প্রকাশ বেগের সমান হয় না, কিন্তু যখন ঊর্জা ধনঞ্জয় প্রাণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তরঙ্গাণুর রূপে গমন করে, তখন এর গতি ধনঞ্জয় প্রাণকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সবাই নিজের স্তরের পদার্থ থেকে অধিক এবং একই মাধ্যমে সর্বদা অপরিবর্তনীয় থাকে। এখানে প্রকাশের গতি এবং প্রাণ রশ্মির গতির স্থিরতাও সিদ্ধ হচ্ছে।

প্রশ্ন - যদি প্রকাশাণুর গতির কারণ ধনঞ্জয় রশ্মি হয়, তাহলে প্রকাশাণুর গতি ধনঞ্জয়ের সমান কেন হয় না?
উত্তর - প্রকাশাণু হল অনেক রশ্মির ঘনীভূত রূপ, যারফলে এরমধ্যে কিছু না কিছু দ্রব্যমান অবশ্যই থাকে আর আকাশে গতি করলে পরে তার সঙ্গে অত্যন্ত অল্প ঘর্ষণও হয়, কারণ আকাশও হচ্ছে এই রশ্মির দ্বারাই নির্মিত একটা পদার্থ। অন্যদিকে ধনঞ্জয় রশ্মি হচ্ছে মনস্ তত্ত্বের মধ্যে এমন একটা কম্পন, যার গতি অত্যন্ত তীব্র হয় আর মনস্ তত্ত্বের সঙ্গে এর ঘর্ষণও নগণ্য হয়।

মূলকণা নির্মাণের প্রক্রিয়া

চলুন, এখন মূল কণা বলে পরিচিত কণার রচনার প্রক্রিয়াকে জানার চেষ্টা করা যাক। যখন নিবিদ্ রশ্মিগুলো গায়ত্রী আদি রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়, সেই সময় মূলকণার নির্মাণ হেতু নিবিদ্ রশ্মির বহিরাগত ও অগ্রভাগে মূলকণার কেন্দ্রের নির্মাণ হতে থাকে। তার পশ্চাৎ সেই গায়ত্রী রশ্মিগুলো ত্রিষ্টুপ্ ও বৃহতীতে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই সময় মূলকণার নির্মাণের কেন্দ্র তাদের মাঝখানে স্থিত হয়ে যায়। তার পশ্চাৎ জগতী ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই রশ্মি পূর্ব নির্মিত ত্রিষ্টুপ্ ও বৃহতী থেকেই নির্মিত হয়। এর নির্মাণের সময়ে মূলকণার নির্মাণের কেন্দ্র জগতী রশ্মির পিছনের ভাগে এসে যায় আর সেখানে এসে মূলকণার নির্মাণের কাজ পূর্ণ হয়ে যায়। উৎপন্ন হতেই সেই মূলকণা জগতী ছন্দ রশ্মির গতির বিপরীত দিশায় গতিশীল হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ার দ্বারাই প্রকাশাণু, ন্যুট্রিনো, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক আদি সবার নির্মাণ হয়। বর্তমান বিজ্ঞান মূলকণার নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিশেষ জ্ঞান নেই। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া আকাশ দ্বারা বায়ু তত্ত্বের সঙ্কোচন দ্বারাই সম্পন্ন হয়।


মূলকণা তৈরির তিন চরণে নিবিদ্ রশ্মি একটাই থাকে, যা সূর্যের উদয় অস্তের সমান যাত্রা করতে থাকে। যেরকম সূর্যের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না, সেই রকম এই রশ্মির মধ্যেও কোনো ভিন্নতা আসে না। এটা বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন চরণ অতিক্রম করে নতুন-নতুন কণার নির্মাণ করে।
1. সর্বপ্রথম এক-একটা ঋক্ ও সামের সূক্ষ্মতম রশ্মিগুলো উৎপন্ন হয়ে পরস্পর সংযুক্ত হয়।
2. তার পশ্চাৎ প্রাণ-অপান আদি প্রাণ ও গায়ত্রী ছন্দ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হয়ে পরস্পর সঙ্গত হতে থাকে। সেই সময় অনুষ্টুপ্ রশ্মিও উৎপন্ন হয়।
3. তারপর তৃতীয় চরণে বিভিন্ন রশ্মিকে যুক্তকারী মাস অর্থাৎ নিবিদ্ রশ্মির উৎপত্তি তথা তারথেকে প্রাণ ও বাক্ রশ্মিগুলো সংযুক্ত হতে থাকে আর উষ্ণিক্ ও পংক্তি রশ্মি উৎপন্ন হয়ে মাস আদি রশ্মিদের সঙ্গে সঙ্গত হতে থাকে।
4. এর পশ্চাৎ ডার্ক ঊর্জাকে অপসারণকারী রশ্মি তথা ত্রিষ্টুপ্, বৃহতী এবং জগতী উৎপন্ন হয়ে সঙ্গত হতে থাকে। এই সময় আকাশ তত্ত্ব বিস্তৃত হতে থাকে।
5. এরপর বিভিন্ন মূলকণা, ফোটন, কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, ন্যুট্রিনো আদি নির্মিত হতে থাকে। এই সময়েই ডার্ক ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রণকারী তীব্র শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎ তরঙ্গের উৎপত্তি হয়।

চলুন, এই প্রক্রিয়াকে আরও গভীরভাবে জেনে নিই -

উপরিউক্ত পাঁচ চরণের প্রক্রিয়ার প্রারম্ভিক কালে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে আরও একটা অন্য প্রক্রিয়াও চলতে থাকে, যা মূলকণা এবং তরঙ্গাণুর নির্মাণ হেতু আবশ্যক ছন্দ রশ্মিসমূহের নির্মাণ করে আর সেই রশ্মি সমূহই সংকুচিত হয়ে উপরিউক্তানুসারে কণা আদির রূপে উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়া এইভাবে হয় -
দুই অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি, যা বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দেয়, সেই দুই সংযুক্ত তৃতীয় ছন্দ রশ্মির সঙ্গে স্বয়ংই পরস্পর সংযুক্ত থাকে। এই প্রকারের সংযোগ দ্বারা তিন ছন্দ রশ্মির একটা ত্রিক নির্মিত হয়। এইরকম অসংখ্য ত্রিক রশ্মিসমূহ এই ব্রহ্মাণ্ডে বিচরণ করে বিভিন্ন পদার্থের নির্মাণ প্রক্রিয়াকে প্রারম্ভ করে। এই দুই অনুষ্টুপ্ রশ্মি তৃতীয় যেকোনো ছন্দ রশ্মির সঙ্গে দুই কিনারে এক-একটা পৃথক-পৃথক মাথার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়।

এই ত্রিকের উৎপন্ন হওয়ার পশ্চাৎ অন্য দুই প্রকারের ত্রিক আরও উৎপন্ন হয়। এরমধ্যে প্রথম প্রকারের ত্রিক উষ্ণিক্ আর বৃহতী ছন্দ রশ্মির কোনো অন্য ছন্দ রশ্মির দুই মাথায় পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয়। এই ত্রিক জন্ম নিলে পরে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গাণু আর মূলকণার নির্মাণ হতে থাকে। বিদ্যুৎ আবেশের উৎপত্তি হয়ে এই মূলকণা আকর্ষণ আর প্রতিকর্ষণ বলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। প্রকাশ আর ঊষ্মা সমৃদ্ধ আর তীব্র হতে থাকে। এই চরণের পশ্চাৎ রশ্মির তৃতীয় ত্রিক উৎপন্ন হয়, যা কোনো ছন্দ রশ্মির দুই মাথায় একটা শক্বরী আর একটা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মিকে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হওয়ার দ্বারা উৎপন্ন হয়। এর কারণে বিভিন্ন মূলকণা এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের ঊর্জা অতি উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়, যার ফলে সেইসব মূলকণা আর বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, সেটা ডার্ক ঊর্জা আদির সম্পর্কে আসলে পরে তাকে নষ্ট করে দেয়। এই বিক্ষোভের অবস্থাকে এই ত্রিকের একটা ভাগ রূপ গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি নিয়ন্ত্রিত এবং সুষম করে। এই সময় ব্রহ্মাণ্ডে তীব্র ধ্বনি তরঙ্গও উৎপন্ন হতে থাকে∆। এই প্রকারের প্রক্রিয়া বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং মূলকণার নির্মাণের পূর্বে প্রারম্ভ হয়ে তারার নির্মাণ পর্যন্ত নিরন্তর চলতে থাকে। দ্বিতীয় ত্রিকের উৎপন্ন হওয়া থেকেই রশ্মি আদি পদার্থ ঘন হতে থাকে। তারার নির্মাণের সময়ে যদি এই প্রক্রিয়াই তীব্র গতিতে নিরন্তর চলতে থাকে অর্থাৎ এরকম আরও ত্রিক নিরন্তর উৎপন্ন হতে থাকে, তাহলে নেব্যুলা ও তারার নির্মাণের জন্য ঘনীভূত পদার্থ অত্যধিক দ্রব্যমান আর গুরত্বাকর্ষণ বলকে প্রাপ্ত করে অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে বিস্ফোরণের দ্বারা সমাপ্ত হতে পারে। এই কারণে দ্রব্যমান আর গুরত্বাকর্ষণ বলের নিশ্চিত সীমা তার আকারের সঙ্গে ভারসাম্য বসিয়ে, যখন নির্মিত হয়ে যায়, সেই সময় পূর্বোক্ত ত্রিক রশ্মির নির্মিত হওয়ার প্রক্রিয়া বিপরীত হয়ে যায়, যার ফলে পদার্থ আরও ঘন হওয়া বন্ধ হয়ে তারার উচিত আকার তৈরি হয়ে যায়। এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত তারার নির্মাণ এই প্রক্রিয়া দ্বারাই হয়েছে। এই ত্রিকের নির্মাণ এবং স্বরূপ দ্বারা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে সুষম করতে চেতন তত্ত্বেরই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনিবার্য ভূমিকা থাকে, কারণ অচেতন রশ্মিগুলো স্বয়ং এইসব করতে পারবে না।
_____________________________________
∆ যদি এর উপর অনুসন্ধান করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই ধ্বনি তরঙ্গ খোঁজা যেতে পারে।

মূলকণার গঠন :

বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত মূলকণার (যেমন ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, ফোটন আদি) গঠনকে কোনো টেকনিক দিয়েও জানতে পারেনি আর ভবিষ্যতে হয়তো কোনোদিন জানতে পারবে। অন্যদিকে বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে মূলকণার গঠন নিম্নানুসারে হয় - 1. তেজস্বী কণার (ল্যাপটোনস্) ভিতরে সর্বপ্রথম মন, বাক্ তত্ত্বের স্তর হয়, পুনঃ প্রাণাদি দশ প্রাণের, পুনঃ ছন্দ রশ্মির ঘন রূপের, পুনঃ ছন্দ রশ্মির তেজস্বী আবরণ আর শেষে তার উপর মন, বাক্, সূত্রাত্মা বায়ু এবং প্রাণাদি দশ প্রাণের নিরন্তর বৃষ্টি হতে থাকে। ছন্দ রশ্মির আবরণ দ্বারা সেই কণা তেজস্বী হয়। 2. প্রকাশাণুর (ফোটন) গঠনে বহিরাগত ছন্দ রশ্মির আবরণ অধিক হয় তথা ঘন ছন্দ রশ্মির আবরণ খুবই পাতলা হয়, এই কারণে এদের দ্রব্যমান খুবই কম আর প্রকাশ অধিক হয়। 3. তাছাড়া কিছু কণা এরকম হয়, যা কম প্রকাশিত। তাদের গঠনে বহিরাগত ছন্দ রশ্মির আবরণ থাকে না। এই কণা অল্প প্রকাশিত হওয়ার পরেও ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জির হয় না। বর্তমান বিজ্ঞানের ল্যাপটোনস্ (তেজস্বী কণা), ফোটন (প্রকাশাণু) তথা কোয়ার্কসের (অল্প প্রকাশিত কণা) গঠন নিচে দেওয়া চিত্রানুসার হতে পারে।

কণার নিজের অক্ষে ঘূর্ণন :

বিভিন্ন দৃশ্য কণা এবং লোক তিন প্রকারের গায়ত্রী রশ্মি দ্বারা আবৃত থাকে আর সেই রশ্মির সঙ্গেই সেই কণা বা লোকের চারিদিকে বিদ্যমান আকাশ তত্ত্বও কিছু সংকুচিত হয়ে সেই লোক বা তরঙ্গকে বিশেষ রূপে আবৃত্ত করে নেয়। এই তিনটা ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি প্রাণ নামক প্রাণ তত্ত্বের দ্বারাই হয়। এই রশ্মির সঙ্গে কিছু অন্য রশ্মি আর আকাশ তত্ত্বের প্রভাবে সেই কণা আর লোক নিজের কক্ষের উপর ঘূর্ণন করার জন্য প্রেরিত হয়। একই সঙ্গে সেই রশ্মির আবরণও সেই লোক বা কণার চতুর্দিকে পরিধি রূপে পরিক্রমণ করে। এই প্রক্রিয়ার প্রভাবে তাদের মধ্যে আকর্ষণ বলও অধিক প্রবল হয়ে যায়।

কণার সংযোগের প্রক্রিয়া :

এই সৃষ্টিতে প্রত্যেক মূলকণা, অণু, আয়ন বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা ছয়টা স্তরে আচ্ছাদিত থাকে। এদের মধ্যে কিছু পদার্থ এই কণার ভিতরে আর বাইরে দুটো স্থানেই বিদ্যমান থাকে। ব্যবহারিক দৃষ্টিতে এইসব পদার্থ কণার ভিতরে আর বাইরে দুটো স্থানেই প্রভাবী থাকে। যখন এই কণা অন্য কোনো কণার সঙ্গে সংযোগ করে, তখন সেই দুই কণার মাঝখানে ডার্ক এনার্জির সূক্ষ্ম রূপ উৎপন্ন হয়ে প্রতিকর্ষণ বল উৎপন্ন করার চেষ্টা করে। সেই সময় দুই কণার মাঝে ছয় স্তরের পদার্থ অতি সক্রিয় হয়ে যায়। এই ক্রমে সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে দুটো অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির মধ্যে প্রবেশ হয়ে যায় আর সেই সময় বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের লক্ষণ অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে কারণ যে যখন ধনাবেশিত আর ঋণাবেশিত দুই কণা পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন তাদের দুই প্রকারের আবেশ লুপ্ত হয়ে বিদ্যুৎ আবেশ বিহীন নবীন কণাকে জন্ম দেয়। তার পরবর্তী চরণে বিদ্যুৎকে নিজের ভিতরে শোষণকারী অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সূক্ষ্ম মরুত্ রশ্মিতে লীন হয়ে যায়। এই মরুত্ রশ্মির মধ্যে "হিম্" রশ্মিও বিদ্যমান থাকে। এই সময় অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির লক্ষণও সমাপ্ত হয়ে যায়। তার পশ্চাৎ "হিম্" রশ্মির সঙ্গে যুক্ত সোম রশ্মি কণাতে বিদ্যমান বৃহতী, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী, যা "স্বঃ" রশ্মির সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাতে বিলীন হয়ে নিজের লক্ষণকে ত্যাগ করে দেয়। এর পশ্চাৎ সেই বৃহতী আদি রশ্মিগুলো "ভূঃ" রশ্মির সঙ্গে সম্পন্ন গায়ত্রী ছন্দ রশ্মিতে বিলীন হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই গায়ত্রী ছন্দ রশ্মিগুলোই ডার্ক এনার্জির সূক্ষ্ম প্রভাবগুলোকে নষ্ট করে। এইভাবে ডার্ক এনার্জির প্রতিকর্ষণ প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। শেষে এই গায়ত্রী রশ্মিগুলোও "ভুবঃ" রশ্মির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রাথমিক প্রাণ রশ্মিতে বিলীন হয়ে যায়, যেখানে ডার্ক এনার্জির কোনো প্রভাব থাকে না। এইভাবে দুই কণা অথবা তরঙ্গাণুর মাঝে অথবা এদের স্বয়ংয়ের পারস্পরিক (যেমন কণার সঙ্গে কণার এবং তরঙ্গাণুর সঙ্গে তরঙ্গাণুর) সংযোগ বিনা কোনো বাধায় সম্পন্ন হয়ে যায়। এই সংযোগ প্রক্রিয়ার এরকম গম্ভীর আর সূক্ষ্ম রহস্যকে বর্তমান বিজ্ঞান একদমই জানে না। যখন কোনো দুটো কণা পরস্পর সংযুক্ত হতে চলে, তখন তারা সোজা সংযুক্ত না হয়ে একে-অপরের চক্কর কেটে এবং কম্পন করে সংযুক্ত হয়। যখন সেই কণা পরস্পর নিকটে আসে, তখন তাদের মাঝে অপ্রকাশিত ঊর্জা বাঁধক রূপে উপস্থিত হয়ে যায়, যার ফলে সেই কণার গতি হঠাৎ করে থেমে যায়। মনে রাখবেন, প্রাণ আর অপান আদির গতিকে অপ্রকাশিত ঊর্জা, যা সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে, বাধাপ্রাপ্ত করতে পারে না। প্রাণ ও অপান থেকে উৎপন্ন সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ সেই ডার্ক ঊর্জাকে নষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত করে সেই কণার আগে - আগে চলতে থাকে এবং তাদের সুরক্ষিত মার্গও প্রদান করতে থাকে। সেই সুরক্ষিত মার্গে সেই কণা পরস্পর একে-অপরের দিকে গতিশীল হয়ে যায়। প্রত্যেক সংযোজক কণার সঙ্গে বিদ্যুৎ ধন, ঋণ অথবা উদাসীন আবেশ অবশ্যই থাকে। সেই আবেশই দুটোকে পরস্পর আকর্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন সেই দুটো কণা নিকটে আসে, তখন তাদের মাঝে উপস্থিত আকাশ তত্ত্ব এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র কিছুটা ছড়িয়ে যায়। আর এই কারণে সেই দুটো কণা একে-অপরের থেকে প্রসারিত বিদ্যুৎ তরঙ্গকে গ্রহণ করতে থাকে আর অপ্রকাশিত ঊর্জা তরঙ্গ থেকে মুক্ত হতে থাকে। সংযুক্ত হতে চলা দুটো কণার পরস্পর বিপরীত ধ্রুবই সংযুক্ত হয়। যখন দুটো কণা পরস্পর মিলিত হয়, তখন তাদের মধ্যে একটা কণা অতি সক্রিয় আর গতিশীল হয়। সেটা নিজের উত্তরী ধ্রুবের দিশায় তীব্র বেগে ধাবিত হয়ে নিজের সম্মুখ বিদ্যমান অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় কণার দক্ষিণ ধ্রুবের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। এই সময় দুটো কণার ছন্দ রশ্মি সংযুক্ত হতে থাকে। যখন দুটো কণা পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন তারা নিজের চতুর্দিকে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম রশ্মিগুলোকেও নিজের সঙ্গে আকর্ষিত করতে থাকে। এইভাবে দুটো কণার সংযোগের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

যখন কোনো তরঙ্গাণু কোনো ইলেকট্রন ও নাভিক আদি থেকে নির্গত বা সংযুক্ত হয়, সেই সময় তিনটা অন্য গায়ত্রী রশ্মিও তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। সেই সময় তরঙ্গাণু ও ইলেকট্রনাদিদের মাঝে এই রশ্মিগুলো গলার মতো আকৃতির নির্মাণ করে অর্থাৎ আকাশ তত্ত্ব সংকুচিত হয়ে চিত্রানুসার আকৃতি বানিয়ে নেয়। সেই আকৃতির ক্ষেত্রের মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম রশ্মি উপস্থিত হয়ে যায়, যা ডার্ক এনার্জির প্রতিরোধী বা প্রতিকর্ষক প্রভাবকে নিয়ন্ত্রিত করে নেয়। এই গায়ত্রী রশ্মিগুলো ইলেকট্রনাদি ও তরঙ্গাণুকে এরকম বল প্রদান করে, যারফলে তারা পরস্পর সংযুক্ত বা বিযুক্ত হওয়ার সামর্থ্য প্রাপ্ত করতে পারে। এর পশ্চাৎ গ্রীবানুমা আকৃতি মুছে গিয়ে সেই সংযোগ বা বিয়োগ সম্পন্ন হয়ে যায়।

যখন কোনো বড়ো অণুর নির্মাণ হয়, তখন তার প্রক্রিয়া এই হয় যে সর্বপ্রথম দুটোই আয়নের সংযোগ হয় আর সেই সংযোগটাতেও অনেক সূক্ষ্ম রশ্মির অংশগ্রহণ থাকে। তার পশ্চাৎও সেই দুটো সংযুক্ত আয়ন অতৃপ্ত হয়েও নিজের নিকটে বিদ্যমান অন্য আয়ন আর রশ্মিগুলোকেও ধীরে-ধীরে এবং ক্রমশঃ আকর্ষিত করতে থাকে আর এইভাবে বড়ো-বড়ো অণুর নির্মাণ হয়। এখানে একথা মনে রাখার উচিত যে, যেকোনো বড়ো অণু অকস্মাৎই অনেক আয়নের একসঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার দ্বারা কখনও নির্মিত হতে পারে না, বরং তার নির্মাণের একটা ক্রমবদ্ধ প্রক্রিয়াই থাকে।

সৃষ্টির সর্বাধিক গতিশীল তত্ত্ব :

সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে সবথেকে অধিক গতি ধনঞ্জয় নামক সূক্ষ্ম প্রাণের হয়। এর গতি হচ্ছে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের তরঙ্গের গতির তুলনায় চার গুণ। বিশেষ দ্রষ্টব্য যে, বর্তমান ভৌতিকী সমস্ত বলের তরঙ্গের গতি প্রকাশের গতির সমান মানে। এই ধনঞ্জয় রশ্মিগুলোই সমস্ত বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলোকে বহন করে নিয়ে যায়। এদের পশ্চাৎ নিম্নতর গতি বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এদের গতিকে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পদার্থের মধ্যে সবার অধিক মানে, যা শূন্যস্থানে প্রায় 3 লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড মানা হয়। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাপেক্ষতার সিদ্ধান্তের অনুসারে এর থেকে অধিক গতি অন্য কোনো পদার্থের সম্ভব না। যেকোনো কণা যদিও এর থেকে অধিক গতি প্রাপ্ত করতে পারে না, কিন্তু এই দুটোর থেকে সূক্ষ্ম ধনঞ্জয় প্রাণ তত্ত্ব এর থেকে অধিক গতিযুক্ত হয়। এই ধনঞ্জয় প্রাণ যখন ইলেকট্রন আদি সূক্ষ্ম কণা অথবা তরঙ্গাণুকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গতি করে, তখন সেটা সেই কণা অথবা তরঙ্গাণুর তুলনায় সেই রকম অধিক গতিশীল হয়, যেরকম ধূলিকণা অথবা খড়কে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হাওয়া সেই ধূলিকণা অথবা খড়ের থেকে অধিক গতিশীল হয়। বর্তমান বিজ্ঞান কোনো টেকনিক দ্বারাও ধনঞ্জয় আদি প্রাণগুলোকে দেখতে পারবে না। এই কারণে তার গতির কোনো বোধ বর্তমান বিজ্ঞানের দ্বারা হওয়া সম্ভব না।

বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল এবং প্রবল নাভিকীয় বলের মধ্যে, ধনাবেশিত কণার থেকে যে ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মিগুলো নির্গত হয়, তাদের গতি বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ অথবা বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা কল্পিত মধ্যস্থ কণার (মিডিয়েটার পার্টিকাল) তুলনায় অধিক হয়। তৃতীয় তীব্র গতি, যা উপরিউক্ত দুটো গতির থেকে কিছুটা নিম্ন হয়, সেটা হচ্ছে প্রাণ-অপানের অথবা প্রাণোদানের গতি। এই সূক্ষ্ম প্রাণ সংমিশ্রণ বিভিন্ন কণার বা তরঙ্গাণুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাদের বাইরে আর ভিতরে নিরন্তর চক্রের রূপে প্রবাহিত হতে থাকে। এদের গতি সেই কণা বা তরঙ্গাণুর গতিকে বিশেষ প্রভাবিত করে না, বরং এরা সেই কণা বা তরঙ্গাণুকে বল আর তেজ প্রদান করতে থাকে। এদের গতি সব প্রকারের কণার তুলনায় অধিক হয়। এর পশ্চাৎ সমস্ত প্রকাশিত আর অপ্রকাশিত পদার্থের কণার গতি হয়। এর দ্বারা এটা সিদ্ধ হচ্ছে যে, বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিকল্পিত ডার্ক ম্যাটার তথা ইলেক্ট্রন আদি প্রকাশিত কণার গতি এদের মধ্যে সবথেকে কম হয়।

জ্ঞাত সৃষ্টির সর্বাধিক ভেদন-ক্ষমতাযুক্ত কণা :

এই সৃষ্টিতে কিছু কণা ন্যুট্রিনো আদি এরকম কণা আছে, যার ভেদন ক্ষমতা অত্যধিক হয়। এই কণা পৃথিবী আদি গ্রহকে পার করেও আরামে চলে যায়। এই কণা গ্রহ আদি লোকের কেন্দ্রতেও উৎপন্ন হয়। এরা সেখান থেকে যাত্রা প্রারম্ভ করে সূর্যাদি তারার কেন্দ্র পর্যন্তও নির্বিঘ্নে যাত্রা করে তথা সূর্য আদির কেন্দ্রতে উৎপন্ন হতে চলা ন্যুট্রিনো পৃথিবী আদি লোকগুলোকে পার করে বিনা কোনো বাধায় যাত্রা করে। এই কণা অন্য কণার প্রতি পারস্পরিক ক্রিয়া প্রায়শঃ করে না, এই কারণে এদের ভেদন ক্ষমতা অতি তীব্র ও যাত্রা অতি সহজ হয়। এই আশ্চর্যজনক শক্তির মুখ্য কারণ হচ্ছে এটাই যে এরকম কণা দুটো অনুষ্ঠপ্ ছন্দরূপ তরঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত বা আবৃত্ত হয়ে যাত্রা করে। এই অনুষ্ঠপ্ ছন্দ তরঙ্গের মধ্যে মোট বিদ্যমান 64 মনস্ বা অহংকার রশ্মিগুলো যাত্রার সময় নিরন্তর বিভিন্ন অন্য ছন্দরূপ তরঙ্গকে উৎপন্ন করে ও বাক্ তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করতে থাকে, যার ফলে এদের মার্গে আসা প্রত্যেক অবরোধ ও আকর্ষণকে এরা নিষ্ক্রিয় করতে থাকে কিংবা সেই অবরোধ ও আকর্ষণকে এরা নবীন উৎপন্ন ছন্দরূপ প্রাণের রশ্মিগুলো নিজের দিব্য কবচ থেকে দূরে রাখে আর সেই কণা অর্থাৎ ন্যুট্রিনো আদি অতি তীব্রতার সঙ্গে সবাইকে অতিক্রম করে নির্দ্বিধায় আগে চলতে থাকে।

কণার চতুর্দিকে সূক্ষ্ম রশ্মির আবরণ :

এই সৃষ্টিতে বিদ্যমান বিভিন্ন কণা আর তরঙ্গাণু সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা সর্বদা আবৃত্ত থাকে। বিভিন্ন অণু, পরমাণু, আয়নও বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ আদির দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। একই সঙ্গে সেটা সেই তরঙ্গের দ্বারাই গতিশীল আর ক্রিয়াশীলও হয়। এই তরঙ্গগুলোর মধ্যে অনেক স্তর থাকে। সূক্ষ্ম তরঙ্গ সর্বদাই নিজের থেকে স্থূল তরঙ্গকে আচ্ছাদিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। এই তরঙ্গের মধ্যে ক্রমশঃ ছন্দ রশ্মি, প্রাণ রশ্মি আর শেষে "ওম্" ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে। যখন দুই বা দুইয়ের অধিক কণার সংযোগ হয়, তখন সেই সংযোগ ক্রমশঃ সূক্ষ্ম আচ্ছাদিকা রশ্মি থেকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত স্থূল রশ্মির মধ্যে হয়ে কণা পর্যন্ত পৌঁছায়। যখন এদের বিয়োগ হয়, তখনও এই ক্রম থাকে। যদি এই আচ্ছাদন রশ্মিগুলো কোনোভাবে সরে যায়, তাহলে সেই কণাগুলোকে ডার্ক ঊর্জা আচ্ছাদিত করে নেয়, যার ফলে সেই কণার মধ্যে সংযোগ, একীকরণ আদি প্রক্রিয়া হতেই পারে না। একই সঙ্গে কখনও এরকমটা হওয়া সম্ভব নয় যে, কোনো দুটো কণা এই আবরক রশ্মিদের ছাড়াই পরস্পর সংযোগ বা একীকরণ ক্রিয়াকে প্রাপ্ত করতে পারে। এইভাবে আমরা এই অধ্যায়ে মূলকণা এবং তরঙ্গাণুর স্বরূপ এবং উৎপত্তি প্রক্রিয়ার উপর বিচার করলাম, যা বর্তমান ভৌতিকীর তুলনায় অধিক গম্ভীর আর সূক্ষ্ম তথ্যকে প্রস্তুত করে। ✍️ স্মরণীয় তথ্য : 1. ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন কণা সূত্রের (দড়ি) সমান কম্পন করা সূক্ষ্ম অবয়বের ঘন রূপ হয়। 2. বিভিন্ন প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির মিশ্রণ বায়ু নামে সর্বত্র প্রায় একরস ভরা থাকে। একে বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষায় ভ্যাক্যুম ঊর্জা বলা যেতে পারে। 3. "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো সূত্রাত্মা বায়ু, নিবিদ্ (মাস) এবং বৃহতী ছন্দ আদি রশ্মিদের প্রেরিত করে বায়ু তত্ত্বের মধ্যে অসংখ্য স্থানে চক্রণ উৎপন্ন করে। 4. কণার তুলনায় তরঙ্গাণুর মধ্যে রশ্মির ঘনত্ব ও মাত্রা নিম্ন থাকে। 5. যখন সংকোচকারী প্রাণ রশ্মি সংকোচনশীল রশ্মির তুলনায় দুর্বল হয়, তখন সঙ্কোচন ক্রিয়া সম্ভব হয় না আর যখন সেটা অতীব সবল হয়, তখন সঙ্কোচন তীব্র হয়ে মূলকণাকে উৎপন্ন করে। 6. যখন সংকোচকারী রশ্মিগুলো সংকোচনশীল রশ্মির তুলনায় সবল হয়, কিন্তু খুব অধীন সবল হয় না, তখন তরঙ্গাণুর নির্মাণ হয়। 7. যেকোনো কণা প্রাণাদি সূক্ষ্ম রশ্মিরূপ পদার্থের অপেক্ষাকৃত ঘন, সংকুচিত রূপ হয়, যা সবদিক দিয়ে একটা সীমার দ্বারা ঘেরা থাকে। সেই ঘেরা সূত্রাত্মা বায়ু আদি রশ্মির হয়। 8. ব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান প্রাণ এবং বাক্ রশ্মির মিশ্রিত রূপ বায়ু তত্ত্ব আকাশ তত্ত্বের দ্বারা আবৃত্ত হয়ে সংকুচিত এবং ঘনীভূত হয়ে চকমক করতে থাকে আর এটাই বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রকাশাণু (ফোটন) বলা হয়। 9. প্রকাশাণু সূত্রাত্মা বায়ু দিয়ে আবৃত হয়ে ধনঞ্জয় প্রাণ রশ্মির দ্বারা অত্যন্ত তীব্র গতি প্রাপ্ত করে। 10. দুই অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি, যা বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দেয়, সেই দুই জুড়ে থাকা তৃতীয় ছন্দ রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একটা ত্রিক নির্মাণ করে। 11. একটা ত্রিক উষ্ণিক্ আর বৃহতী ছন্দ রশ্মির কোনো অন্য ছন্দ রশ্মির দুটো মাথায় পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয়। এই ত্রিকের জন্ম হলে পরে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গাণু আর মূলকণার নির্মাণ হতে থাকে। 12. বিভিন্ন দৃশ্য কণা এবং লোক তিন প্রকারের গায়ত্রী রশ্মির দ্বারা আবৃত্ত থাকে আর এই রশ্মির প্রভাবে সেই কণা আর লোক নিজের অক্ষে ঘূর্ণন করার জন্য প্রেরিত হয়। 13. এই সৃষ্টির মধ্যে প্রত্যেক মূলকণা, অণু, আয়ন বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা ছয়টা স্তরে আচ্ছাদিত থাকে। 14. যখন কোনো দুটো কণা পরস্পর সংযুক্ত হতে যায়, তখন সেটা সোজা সংযুক্ত না হয়ে একে-অপরের চক্কর কাটে এবং কম্পন করে সংযুক্ত হয়। 15. সংযুক্ত হওয়ার দুটো কণার পরস্পর বিপরীত ধ্রুবই সংযুক্ত হয়। 16. যখন দুটো কণা পরস্পর মিলিত হয়, তখন তাদের মধ্যে একটা কণা অতি সক্রিয় আর গতিশীল হয়। 17. যখন কোনো তরঙ্গাণু কোনো ইলেকট্রন ও নাভিক আদির থেকে নির্গত বা সংযুক্ত হয়, সেই সময় তরঙ্গাণু ও ইলেকট্রনাদির মাঝে আকাশ তত্ত্ব সংকুচিত হয়ে গলার মতো আকৃতি বানিয়ে নেয়। 18. যেকোনো বড়ো অণু আচমকাই অনেক আয়নের একসঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার দ্বারা কখনও নির্মিত হতে পারে না, বরং তার নির্মাণের একটা ক্রমবদ্ধ প্রক্রিয়া থাকে। 19.
সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে সবথেকে অধিক গতি ধনঞ্জয় নামক সূক্ষ্ম প্রাণের হয়। এর গতি হচ্ছে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের তরঙ্গের গতির তুলনায় চার গুণ। 20. সূক্ষ্ম তরঙ্গগুলো সর্বদাই নিজের থেকে স্থূল তরঙ্গগুলোকে আচ্ছাদিত ও নিয়ন্ত্রিত করে।

ঊর্জা 

বর্তমান সংসার ঊর্জার ভরপুর উপভোগ করছে, কিন্তু আমরা এখনও এর স্বরূপের বিষয়ে অনভিজ্ঞ আছি। ঊর্জার অনেক রূপকে বিজ্ঞান স্বীকার করে, যেমন - স্থিতিজ ঊর্জা, গতিজ ঊর্জা, বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ঊর্জা, ডার্ক এনার্জি, ভ্যাক্যুম এনার্জি, ধ্বনি, ঊষ্মা আদি। এইসব ঊর্জা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একে-অপরের মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পরিবর্তনের ক্রিয়াবিজ্ঞানটা কি, এটা বর্তমান বিজ্ঞানের মধ্যে স্পষ্ট না। এই পরিবর্তনের কারণ কি, এটাও বিজ্ঞান জানে না। বস্তুতঃ যতক্ষণ পর্যন্ত ঊর্জার স্বরূপ ও গঠনের বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ক্রিয়াবিজ্ঞানকে জানা অসম্ভব।

ঊর্জার স্বরূপ

চলুন, এখন আমরা "ঊর্জার" উপর বৈদিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করি। বৈদিক বিজ্ঞানের মধ্যে বল এবং প্রাণের সঙ্গে যুক্ত পদার্থকেই ঊর্জা বলে। 1. বল হচ্ছে সেই গুণ, যা কোনো পদার্থকে ধারণ ও পোষণ করে। 2. বল কোনো পদার্থের ভিতরে আত্মারূপ হয়ে বিচরণ করে। 3. সমস্ত প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মি বলরূপ হয়। 4. বলের কারণে পদার্থ একে-অপরের দিকে গতিশীল হয়, বিশেষ করে আকর্ষণ বলের কারণে এবং প্রতিকর্ষণ বলের কারণে একে-অপরের থেকে দূরেও যায়। এইভাবে ঊর্জা হচ্ছে সেই পদার্থ, যার কারণে বিভিন্ন পদার্থ ধারণ করে বা গতি করে থাকে। একই সঙ্গে ঊর্জার কারণেই পদার্থের অস্তিত্ব স্থির বা সার্থক থাকে। এই ঊর্জা মূলত চেতন তত্ত্বের দ্বারা প্রকৃতিরূপী জড় পদার্থের মধ্যে উৎপন্ন হয়। জড় জগতে এটা "ওম্" রশ্মি ও মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন হয়। তার পশ্চাৎ প্রাণ ও ছন্দ বা মরুত্ আদি রশ্মির রূপে বৈদিক স্বরূপের ঊর্জা উৎপন্ন হয়। এই ঊর্জার তুলনা বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা জ্ঞাত বা প্রযুক্ত ঊর্জার সঙ্গে করা সম্ভব না। প্রাণ আর মরুত্ বা ছন্দ রশ্মির সংমিশ্রণই হচ্ছে বর্তমান বিজ্ঞানের দ্বারা পরিচিত ঊর্জার উৎপত্তির কারণ। এখন আমরা বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিচিত কিছু ঊর্জার বিষয়ে ক্রমশঃ বৈদিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করবো - 1. স্থিতিজ ঊর্জা = প্রত্যেক কণা বা পিণ্ড বিভিন্ন ছন্দ, মরুত্ বা প্রাণ রশ্মির মিলন দ্বারা উৎপন্ন হয় তথা সেই স্বরূপে সেটা বিদ্যমান থাকে, এমনকি সেটা গতিশীল হোক বা স্থির হোক। তারমধ্যে এই রশ্মিগুলো সংঘর্ষ রূপে বিদ্যমান থাকে। এদের প্রভাবে সেই কণা, তরঙ্গাণু বা পিণ্ডের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই কণা বা পিণ্ডকে সূত্রাত্মা বায়ু ও বৃহতী ছন্দ রশ্মিগুলো সবদিক থেকে আবৃত্ত করে থাকে অথবা এই রশ্মিগুলোই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলোকে ঘনীভূত করে সেই কণা বা পিণ্ডকে উৎপন্ন করার জন্য উত্তরদায়ী হয়। যেকোনো কণা বা পিণ্ড সর্বদা সেই স্থিতিতে থাকতে চায়, যারমধ্যে রশ্মির মাঝে নিম্নতম পারস্পরিক ক্রিয়া বা চাপ থাকবে। বিরাম অবস্থাতে কোনো কণা পিণ্ডের সবদিকে প্রাণ ও অপান রশ্মিগুলোর বিদ্যমানতা থাকে, যাদের মধ্যে অপান রশ্মিগুলো তার ভিতরের দিকে এবং প্রাণ রশ্মিগুলো বাইরের দিকে স্পন্দিত হতে থাকে। যখন সেই কণা বা পিণ্ডের উপর কোনো বহিরাগত বল লাগানো হয়, সেই সময় বলপ্রয়োগকারী কারক সেই পিণ্ডের মধ্যে ঊর্জার সঞ্চরণ করে। এই ঊর্জা সেই কণা বা পিণ্ডের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে তারমধ্যে বিদ্যমান প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির বিন্যাসকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে। একে এই চিত্রের দ্বারা বোঝার চেষ্টা করবেন।

যখন আমরা কোনো স্প্রিংকে টানি বা চাপ দিই অথবা কোনো পাথরকে হাত দিয়ে উপরে তুলে নিই, সেই সময়ে স্প্রিং বা পাথরের ভিতরে বিদ্যমান প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির বিন্যাস প্রভাবিত বা পরিবর্তিত হয়ে যায়। যখন আমরা স্প্রিংকে ছেড়ে দিই, তখন তার ভিতরে বিদ্যমান প্রাণ বা ছন্দাদি রশ্মির বিন্যাস পুনঃ নিজের পূর্ব রূপকে প্রাপ্ত করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন স্প্রিংয়ের মধ্যে কম্পন হতে থাকে। অন্যদিকে যখন আমরা পাথরকে হাত থেকে নিচে ফেলে দিই, তখন পৃথিবীর গুরুত্বাকর্ষণ বল তাকে নিচের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকে অর্থাৎ সেই পিণ্ডের উপর বল কাজ করতে থাকে। এরফলে সেই পিণ্ডের ভিতরে ও বাইরের রশ্মি বিন্যাস পুনঃ প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হতে থাকে। এরফলে তার স্থিতিজ ঊর্জা গতিজ ঊর্জাতে পরিবর্তিত হতে থাকে। 2. গতিজ ঊর্জা = যখন পাথরকে আমরা নিচে ফেলে দিই অথবা কোনো পাথরকে আমরা ছুড়ে ফেলি, সেই সময় সেই পাথরের উপর পৃথিবীর গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা পৃথিবীর গুরুত্ব বলের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের প্রক্ষেপক বলও কাজ করে। এরফলে সেই পাথরের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন ছন্দ ও প্রাণাদি রশ্মির বিন্যাস পরিবর্তিত হতে থাকে। আমার দৃষ্টিতে এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে নিম্ন ক্রমানুসারে প্রভাব থাকে - (অ) যখন পদার্থ নিচের দিকে পড়ে, তখন পৃথিবীর দ্রব্যমান ও গুরুত্বাকর্ষণ বলের রূপে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মি ও ত্রিষ্টুপ্ ছন্দাদি রশ্মিগুলো পাথরের মধ্যে বিদ্যমান অপান রশ্মিগুলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এরফলে যে অপান রশ্মিগুলো পাথরের ভিতরের দিকে যাওয়ার সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছিল, তারা গুরুত্ব বলের দিকে উন্মুখ হয়ে স্পন্দিত হতে থাকে। অপান রশ্মির ক্রিয়া প্রধান হওয়ায় সেই পাথর পৃথিবীর দিকে গতি করতে থাকে। সেই পাথর যত-যতটা পৃথিবীর নিকট আসতে থাকে, তত-ততটা পৃথিবীর প্রাণ ও ত্রিষ্টুপ্ রশ্মিগুলো পাথরের অপান রশ্মির প্রতি আকর্ষণের গুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, এটাই হচ্ছে কারণ যে পৃথিবীর গুরুত্বাকর্ষণ বল সেই পাথরের মধ্যে ত্বরণ উৎপন্ন করে, নাকি সেই পাথর সমান গতিতে পড়ে যায়। বর্তমান বিজ্ঞান এই ক্রিয়াবিজ্ঞানকে বুঝতে পারেনি। (ব) যখন আমরা সেই পাথরকে কোনো দিশায় ছুড়ে ফেলে দিই, তখন আমাদের হাতের প্রক্ষেপক বল সেই পাথরের বাইরে এবং ভিতরে বিদ্যমান রশ্মি বিন্যাসকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করতে থাকে। আমাদের প্রক্ষেপক বলের মধ্যে অপান রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এরফলে সেই পাথরের বিন্যাস এই প্রকার হয়ে যায় যে পাথর ভিতরের দিকে স্পন্দিত হওয়ার সঙ্গে অপান রশ্মিগুলো প্রক্ষেপক বলের দিশায় স্পন্দিত হতে থাকে। এই কারণে সেই পাথর ওই দিশায় গতিশীল হয়ে ওঠে। তার গতিশীল অবস্থায় পৃথিবীর দ্রব্যমান ও গুরুত্বাকর্ষণ বলের প্রাণ ও ত্রিষ্টুপ্ আদি রশ্মিগুলো পূর্বোক্তানুসারে নিজের প্রভাব দেখাতে থাকে, যারফলে সেই পাথর বর্তুলাকার (parabolic) মার্গের অনুসরণ করে অবশেষে নিচে পড়ে যায়। এরজন্য নিচে দেওয়া চিত্রটাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করবেন -
প্রশ্ন = পাথর যখন নিচে পড়ে, তখন পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা অথবা কোনো দেয়ালে পাথর ছুড়লে পরে ঊষ্মা, প্রকাশ ও ধ্বনিরও উৎপত্তি হয়। এইভাবে পাথরের গতিজ ঊর্জা ঊষ্মা, প্রকাশ ও ধ্বনি ঊর্জাতে কিভাবে পরিবর্তিত হয়? উত্তর = চলুন, এটাকে আমরা এইভাবে জেনে নিই। যখন পাথর কোনো বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা লাগে, তখন সেই বস্তুর চারিদিকে বিদ্যমান রশ্মিগুলোর সঙ্গে পাথরের চারিদিকে বিদ্যমান রশ্মিগুলোর ধাক্কা লাগে, বিশেষ করে সেই পাথরের বহিরাগত ভাগে অবস্থিত ক্রিয়াশীল অপান রশ্মিগুলো সেই বস্তুর রশ্মির সঙ্গে অধিক বিজড়িত দুই বস্তুরই সব রশ্মিগুলোকে ক্ষুব্ধ করে দেয়। এই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষণে কিছু রশ্মি ঘনীভূত হয়ে প্রকাশাণুর রূপ ধারণ করে প্রকাশের রূপে দেখা যায়। কিছু রশ্মি দুই বস্তুর অণুগুলোকে কম্পিত করে তাদের তাপ প্রদান করে, আবার কিছু ছন্দ রশ্মি পরস্পর বিজড়িত এরকম বৈখরী ধ্বনির রূপ ধারণ করে, যা তীব্র ধ্বনির রূপে শোনা যায়। এই সংঘর্ষণে দুটো বস্তুর ভিতরেই রশ্মির বিন্যাস ও সূত্রাত্মা প্রাণ ও বৃহতী রশ্মির আবরণ বিকৃত হয়ে যায়, যার ফলে সেই বস্তু ভেঙে যাওয়া বা বিকৃত দেখা যায় বা দেখা যেতে পারে। প্রশ্ন = আমরা কোনো পাথরের তুলনায় কোনো কম ঘনত্বের বস্তুকে কম বেগের সঙ্গেই কেন ফেলতে পাই, এমনকি যদি আমাদের সমান শক্তি লাগানোর পরেও? উত্তর = যেমন আমরা ব্যাখ্যা করে এসেছি যে, কোনো পিণ্ডকে ফেলে দিলে পরে সেই পিণ্ডের ভিতরে ও বাইরে বিদ্যমান প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির বিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তনে অপান রশ্মির দিশা প্রক্ষেপক বলের দিশাতে হওয়ার জন্য তার গতি সেই দিশাতে হয়। যখন পিণ্ড অধিক ঘন হয়, তখন তারমধ্যে অপান রশ্মির মাত্রা অধিক হওয়া তথা তাদের দ্বারা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মিও তাদেরই দিকে উন্মুখ হওয়ার কারণে অধিক ঘনত্বযুক্ত পিণ্ড অধিক বেগের সঙ্গে গতি করে। এর বিপরীত যখন পিণ্ড হালকা হয়, তারমধ্যে প্রাণ তথা ছন্দাদি রশ্মির মাত্রা ও ঘনত্ব কম হয়, কিন্তু দুটো পিণ্ডের সমান আয়তনের হওয়ায় আকাশের মধ্যে বিদ্যমান অবরোধক রশ্মিগুলো ততই মাত্রায় বিদ্যমান থাকে, যত মাত্রায় পূর্বোক্ত অধিক ঘন পিণ্ডের সম্মুখে বিদ্যমান থাকে। এই কারণে অবরোধক বল তো দুই পিণ্ডের উপর সমান লাগে, কিন্তু আমাদের হাত দ্বারা প্রক্ষেপণ বল থেকে স্থানান্তরিত ঊর্জার মাত্রা নিম্নই হতে পারে। বস্তুতঃ কম মাত্রায় বিদ্যমান রশ্মিগুলো প্রেক্ষপক অপান রশ্মিগুলোকে কম মাত্রাতেই সঞ্চিত করতে পারে তথা অপান রশ্মিগুলো সেই পিণ্ডের মধ্যেও কম মাত্রায় থাকার জন্য বেগের মাত্রা ঘন পিণ্ডের তুলনায় নিম্নতম হয়। একইভাবে এই হালকা পিণ্ডের ধাক্কার জন্য ঊষ্মা, ধ্বনি ও প্রভাবের মাত্রাও অপেক্ষাকৃত নিম্নই হয়। 3. ধ্বনি ঊর্জা = বর্তমান বিজ্ঞান বাণীর বৈখরী রূপকেই ধ্বনি ঊর্জার নাম দেয়। বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে যেকোনো ধ্বনি পরা, পশ্যন্তী আর মধ্যমার স্তর দিয়ে যাওয়া বৈখরী অবস্থাকে প্রাপ্ত করে। আমরা এখানে বৈখরীর সংক্ষিপ্ত চর্চা করবো। বর্তমান বিজ্ঞান ধ্বনিকে কোনো পদার্থের মধ্যে চাপের রূপেই মানে। যে পদার্থ যত ঘন হয়, তারমধ্যে ধ্বনি ততই অধিক গতিতে প্রবাহিত হয়, কিন্তু কোনো পদার্থের মধ্যে চাপকে উৎপন্নকারী পদার্থটা কি? আমরা যখন বলি, তখন বায়ুমণ্ডলে চাপ কিভাবে উৎপন্ন হয়? এটা বর্তমান ভৌতিকীর মধ্যে অজ্ঞাত। বৈদিক বিজ্ঞানের মান্যতা হল আমাদের স্বরযন্ত্র মধ্যমা ছন্দ রশ্মিগুলোকে বৈখরীতে পরিবর্তিত করে বাইরে নির্গত করে। সেই ছন্দ রশ্মিগুলো বায়ুমণ্ডল অথবা কোনো অন্য পদার্থ রূপী মাধ্যমে বিদ্যমান বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে চাপ উৎপন্ন করে। এই চাপের গতিকেই বর্তমান বিজ্ঞান ধ্বনি তরঙ্গ বলে। যখন পদার্থ ঘন হবে, তখন তারমধ্যে ছন্দ রশ্মির ঘনত্বের কারণে চাপ ক্ষেত্র অধিক তৈরি হয়ে যাবে, যার ফলে তাদের গতি অধিক প্রতিত হবে অর্থাৎ ধ্বনি তরঙ্গের গতি অধিক হবে। যখন নির্বাত (vacuum) হবে, তখন তারমধ্যে ছন্দ রশ্মিগুলো নির্বাতের মধ্যে অবস্থিত বিরলাবস্থায় বিদ্যমান প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির মধ্যে সেই চাপ উৎপন্ন করতে পারবে না, যা আমাদের কান দ্বারা শোনা যেতে পারে। এর কারণ এই হচ্ছে যে আমাদের কান রশ্মির কম্পনগুলোকে গ্রহণ করতে পারে না, অথচ অণুর কম্পনের অনুভব করতে সক্ষম। এর ফলে আমাদের এই ভ্রম হয় যে ধ্বনির জন্য কোনো পদার্থ রূপী মাধ্যমের হওয়াটা অনিবার্য। বস্তুতঃ এটা আমাদের কানের শোনার ক্ষমতার একটা সীমার কারণে হয়, বাস্তবে এমনটা হয় না। এখানে এটাও মনে রাখা উচিত যে ধ্বনি ঊর্জা অর্থাৎ বৈখরী বাণী বিনা মাধ্যমে গমন করতে পারে না। তার জন্য দৃঢ়, দ্রব বা গ্যাস কিছু না কিছু পদার্থ মাধ্যমের রূপে হওয়াটা আবশ্যক, কিন্তু শব্দ আকাশের গুণ মানা হয়েছে, এই কারণে বাণীকে এই স্থূল মাধ্যমের প্রত্যাশা নয়, বরং তার স্থানই হচ্ছে আকাশ। আর এই কারণে পশ্যন্তী ও মধ্যমা বাণীর গমন আকাশও হয়, এটা মানা উচিত। তবে হ্যাঁ, বৈখরীর গমন হয় না। 4. ভ্যাক্যুম ঊর্জা = বর্তমান বিজ্ঞান এটার ভিতরেই বিভিন্ন ফিল্ড কণার (পার্টিকলস্) উৎপত্তির বিষয়কে স্বীকার করে। এই কণা এটার থেকেই উৎপন্ন হয়, এরকমটাও মানা হয়, কিন্তু এই এনার্জি স্বয়ং কোন রূপে কিসের দ্বারা নির্মিত হয় তথা এর দ্বারা ফিল্ড কণা কিভাবে নির্মিত হয়?এসব বর্তমান বিজ্ঞান জানে না। আমার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ আকাশের মধ্যে সূত্রাত্মা বায়ু এবং বিভিন্ন প্রকারের প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মির মিশ্রণ ভরা থাকে। রশ্মির এই মিশ্রণই হল ভ্যাক্যুম ঊর্জার রূপ। দুই সমন্বিত পদার্থ নিকটে আসলে পরে তাদের মাঝে অবস্থিত ভ্যাক্যুম ঊর্জা থেকে ফিল্ড কণার উৎপত্তি হয়। দুই পদার্থ থেকে নির্গত প্রাণ, বিশেষ করে ধনঞ্জয় ও মিরুত্ রশ্মিগুলো ভ্যাক্যুম ঊর্জার রূপে বিদ্যমান প্রাণ, মরুত্ ও গায়ত্রী আদি ছন্দ রশ্মির মিলন থেকে মধ্যস্থ কণাকে উৎপন্ন করে। সেই কণা কাল্পনিক হয় না, যেমনটা বর্তমান বিজ্ঞান মনে করে, তবে তার আয়ু অত্যল্প হয়, এটা সত্য। মনে রাখবেন, প্রাণ ও মরুত্ এবং প্রাণ ও ছন্দের মিথুনই হচ্ছে বল ও ঊর্জার রূপa, একাকী কোনো রশ্মি ভ্যাক্যুম ঊর্জার রূপ হতে পারে না। এই ঊর্জা সম্পূর্ণ আকাশকে একরস রূপে ভরে থাকে। একে ভ্যাক্যুম ঊর্জা এই কারণে বলা হয়, কারণ এটা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ রিক্ত স্থানকে ভরে থাকে। সামান্য রূপে এরমধ্যে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না, কিন্তু যখনই দুই কণা বা পিণ্ডের মাঝে আকর্ষণ ও প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করতে হয় অর্থাৎ যখনই সেই দুটো পদার্থ পরস্পর নিকটে আসে, তখনই তাদের মাঝে বিদ্যমান ভ্যাক্যুম ঊর্জার মধ্যে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে থাকে। যদি এই হ্রাস-বৃদ্ধি না হয়, তাহলে আকর্ষণ ও প্রতিকর্ষণ বল আর মধ্যস্থ কণা উৎপন্নই হবে না। 5. ডার্ক ঊর্জা = এর বিষয়ে অসুর ঊর্জাতে লেখা আছে। তবে হ্যাঁ, এটা নিশ্চিত যে ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তার ও মহাবিস্ফোরণ দিয়ে সৃষ্টির সূচনাকারক কোনো ডার্ক ঊর্জা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে না তো কখনও বিদ্যমান ছিল আর না এখন আছে। বৈদিক ডার্ক এনার্জির গঠন, স্বরূপ এবং তার গুণধর্মের আলোচনা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে করবো। ☘️ স্মরণীয় তথ্য
1. এইভাবে ঊর্জা হচ্ছে সেই পদার্থ, যার কারণে বিভিন্ন পদার্থ ধারণ বা গতি করে। 2. জড় পদার্থের মধ্যে ঊর্জা "ওম্" রশ্মি ও মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন হয়। পশ্চাৎ প্রাণ ও ছন্দ বা মরুত্ আদি রশ্মির রূপে ঊর্জা উৎপন্ন হয়। 3. প্রত্যেক কণা বা পিণ্ড বিভিন্ন ছন্দ, মরুত্ ও প্রাণ রশ্মির মিলন দ্বারা উৎপন্ন হয় তথা সেই স্বরূপে সেটা বিদ্যমান থাকে, এমনকি সেটা গতিশীল হোক বা স্থির হোক না কেন। 4. কোনো কণা বা পিণ্ডকে সূত্রাত্মা বায়ু ও বৃহতী ছন্দ রশ্মিগুলো সবদিক দিয়ে আবৃত্ত করে থাকে। 5. বিরাম অবস্থাতে কোনো কণা বা পিণ্ডের সবদিকে প্রাণ ও অপান রশ্মিরও বিদ্যমানতা থাকে, যার মধ্যে অপান রশ্মিগুলো তার ভিতরের দিকে এবং প্রাণ রশ্মিগুলো বাইরের দিকে স্পন্দিত হতে থাকে। 6. যখন সেই কণা বা পিণ্ডের উপর কোনো বহিরাগত বল লাগানো হয়, তখন সেই পিণ্ডতে ঊর্জার সঞ্চার হয়। এই ঊর্জা সেই কণা বা পিণ্ডের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে তাদের মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির বিন্যাসকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে। 7. সম্পূর্ণ আকাশের মধ্যে সূত্রাত্মা বায়ু এবং বিভিন্ন প্রকারের প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মির মিশ্রণ ভরা থাকে। রশ্মির এই মিশ্রণই হচ্ছে ভ্যাক্যুম ঊর্জার রূপ। 8. প্রাণ ও মরুত্ এবং প্রাণ ও ছন্দের জোড়াই হচ্ছে বল ও ঊর্জার রূপ, একাকী কোনো রশ্মি ভ্যাক্যুম ঊর্জার রূপ হতে পারে না।

অসুর পদার্থ এবং অসুর ঊর্জা


আমরা গত অধ্যায়ের মধ্যে এমন একটা পদার্থের অনেক জায়গায় চর্চা করেছি, যেটা বিভিন্ন সংযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে বাধা উৎপন্ন করে। এই অধ্যায়ে আমরা সেই পদার্থের কিছু বিস্তারভাবে চর্চা করবো।

অসুর পদার্থের স্বরূপ

এই সৃষ্টিতে পঞ্চমহাভূত পদার্থের সঙ্গে-সঙ্গে কিছু এরকম পদার্থও বড়ো মাত্রায় উৎপন্ন হয়, যা প্রায়শঃ অপ্রকাশিতই থাকে তথা যারমধ্যে প্রতিকর্ষণ, প্রক্ষেপণ আদি বলের প্রাধান্য থাকে। এই পদার্থকে সমস্ত রূপে অসুর নামে জানা যায়। এই পদার্থ প্রক্ষেপক ও প্রতিকর্ষণ বল দ্বারা যুক্ত হওয়ার পরেও অতি নিম্ন মাত্রায় আকর্ষণের ভাবও রাখে। এই আকর্ষণের ভাব স্বয়ংয়ের প্রতি অর্থাৎ অসুর পরমাণুগুলোর একে-অপরের প্রতি অবশ্যই হয়, তা না হলে এটা পদার্থ রূপে কখনও বিদ্যমান হতো না, বরং সম্পূর্ণরূপে ছড়িয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয়ে যেত। দুই সূক্ষ্ম কণা থেকে শুরু করে বিশাল লোক পর্যন্তর মাঝে সংযোগের সময়ে এই ঊর্জা বাধক হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দৃশ্য ঊর্জার প্রহারে এটার চেষ্টা বিফল হয়ে যায়, তবুও কণা বা লোকের পারস্পরিক সংঘাতের মধ্যেও এই সূক্ষ্ম ঊর্জা তাদের মাঝে একটা অন্তরাল (অবকাশ) বানিয়ে রাখতে সহায়ক হয়। যদি এরকমটা না হতো, তাহলে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড একটা ঘনতম সংঘাতকে প্রাপ্ত করে নিম্নতম আয়তনকে প্রাপ্ত করে নিতো। এই পদার্থের অন্য গুণ নিম্নানুসারে হয় -
1. দৃশ্য এবং অদৃশ্য দুই প্রকারের পদার্থ একই উপাদান পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয়।
2. মনস্ তত্ত্ব এবং বাক্ তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন অসুর পদার্থ অন্ধকার যুক্ত থাকে।
3. অসুর পদার্থে মনস্তত্ত্ব অতিরিক্ত থাকে, কিন্তু সেই মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দেব পদার্থের তুলনায় নিম্ন থাকে, এই কারণে এই পদার্থ দেব পদার্থের তুলনায় প্রকাশহীন হয়।
4. সৃষ্টির প্রত্যেক কর্মের মধ্যে আকর্ষণ ও ধারণ বলের সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিকর্ষণ ও প্রক্ষেপণ বলও মূলত সক্রিয় থাকে। কোথাও-কোথাও এই দুই বলের সংঘর্ষ হয়, তো কোথাও-কোথাও দুই পদার্থ মিলিত হয়ে সৃষ্টি রচনাতে নিজের-নিজের ভূমিকাও সঙ্গে-সঙ্গে পালন করে। কেবল আকর্ষণ ও ধারণ বলেরই আধারে সৃষ্টির রচনা কখনও সম্ভব নয়। এই সৃষ্টিতে কখনও দুই বা দুইয়ের অধিক পদার্থ (লোক, কণা বা রশ্মি আদি) যেকোনো প্রবলতম আকর্ষণ বলের প্রভাবে পূর্ণতঃ মিলিত হয়ে এক হতে পারবে না। এমনকি তারা পরস্পর সরাসরি স্পর্শও করতে পারে না, বরং তাদের মাঝে কিছু না কিছু অবকাশ অবশ্যই থাকে। একই সঙ্গে এই সৃষ্টিতে ছেদন, ভেদন, সংমিশ্রণ এবং বিয়োজনের ক্রমও সর্বত্র চলতে থাকে। এই ক্রমের মধ্যে দেব ও অসুর দুই প্রকারেরই পদার্থের অবদান থাকে। অসুর পদার্থ নিজের প্রতিকর্ষণ বলের প্রভাবে বিভিন্ন লোকের মাঝে সঠিক অবকাশ বানিয়ে রাখতে সহযোগী হয়ে তাদের ধারণ বা স্থায়ীত্ব প্রদান করতেও সহযোগী হয়। দেব এবং অসুর পদার্থের মধ্যে দেব পদার্থের উৎপত্তি আগে তথা অসুর পদার্থের উৎপত্তি তার পশ্চাৎ হয়।
5. এই পদার্থ হচ্ছে অপ্রকাশিত বায়ু রূপ, যা অপবাদ পরিস্থিতিকে ছাড়া কখনও প্রকাশিত অবস্থাকে প্রাপ্ত করতে পারে না।
6. "ওম্" রশ্মিবিহীন মনস্তত্ত্বও হচ্ছে অসুর তত্ত্বের রূপ।
7. এই পদার্থের মধ্যে আসুরী ছন্দ রশ্মি ছাড়া অন্য কোনো ধরনের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে না, বরং কেবল প্রাণ রশ্মিগুলোই বিদ্যমান থাকে।
8. যে ছন্দ রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্ব দ্বারা প্রেরিত আর সংযুক্ত থাকে, তারাই দৃশ্য পদার্থের অঙ্গ হয়ে সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে ভাগ নিতে পারে। এর বিপরীত যে ছন্দ রশ্মিগুলো মনের দ্বারা প্রেরিত হয় না, তারা অপ্রকাশিত ঊর্জা বা পদার্থের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
9. সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে কিছু ছন্দ রশ্মির কিছু সার ভাগ আকাশের মধ্যে রষে যায়। তারপর সেই সার ভাগ হতে রহিত থাকা রশ্মিগুলো আসুর তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন হয় অথবা সেই অসুর তত্ত্বকে উৎপন্ন করে।
10. যখন ব্যান রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের দ্বারা পূর্ণতঃ সঙ্গত ও প্রেরিত হয় না, তখন প্রাণ-অপান এবং প্রাণোদান রশ্মিগুলো অসুর রশ্মির রূপ ধারণ করে নেয়।
11. প্রলয়কালের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হলে পরে অসুর পদার্থ নিরন্তর শক্তিশালী হওয়া প্রারম্ভ করে তথা তাকে নষ্ট ও নিয়ন্ত্রণকারী রশ্মিগুলো নিরন্তর দুর্বল বা নষ্ট হতে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন লোক আদি পদার্থের বিনাশ হতে থাকে। সুপারনোবা আদির বিস্ফোরণেও অসুর পদার্থের অনিবার্য অবদান থাকে।
12. যে ছন্দ রশ্মির সঙ্গে অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিগুলো সংযুক্ত থাকে না, সেই রশ্মিগুলো অসুর রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
13. যে ছন্দ রশ্মিগুলোর সঙ্গে প্রাণ রশ্মিগুলো পরস্পর ছড়িয়ে থাকা অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, সেই ছন্দ রশ্মিগুলো দেব পদার্থকে উৎপন্ন করে তথা যে ছন্দ রশ্মির মধ্যে প্রাণ পরস্পর অতি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হয়, সেগুলো আসুরী ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়ে অসুর পদার্থকে উৎপন্ন করে।
14. যখন প্রাণ এবং অপান তত্ত্বের মধ্যে পারস্পরিক সামঞ্জস্য হতে পারে না, সেই সময় বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিগুলো ছন্দ রশ্মির সঙ্গে সঠিক সংযোগ করতে পারে না আর তার পরিণামস্বরূপ সেই প্রাণ রশ্মিগুলো সূক্ষ্ম অসুর রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
15. অসুর তত্ত্বের মধ্যেও বিশেষ প্রকারের বিধ্বংসী ও প্রতিকর্ষক বিদ্যুৎ বিদ্যমান থাকে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এই পদার্থেরও ধারা সর্বত্র নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে।
16. যে ছন্দ রশ্মিগুলো নিজের ধারক ধায়্যা বিশেষ্য ছন্দ রশ্মির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না তথা যে প্রাণ রশ্মিগুলো মরুত্ রশ্মির সঙ্গে সংমিশ্রণ বানাতে পারে না, তারা আসুরী পদার্থের জন্মদাতা হয়ে যায়।
এই সম্পূর্ণ প্রকরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে এই সৃষ্টির মধ্যে সেই পদার্থ, যার দ্বারা সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে, সেটা ছাড়াও এমন একটা পদার্থও বিদ্যমান থাকে, যেটা হচ্ছে অদৃশ্য বা অপ্রকাশিত। দৃশ্য পদার্থ সৃষ্টিতে নানা লোক নির্মাণের মুখ্য কারণ হয়, অথচ অদৃশ্য পদার্থ কোনো লোকের নির্মাণ করতে পারে না। এতকিছু হওয়ার পরেও দৃশ্য ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণে অদৃশ্য পদার্থের অনিবার্য ভূমিকা থাকে। বৈদিক ভৌতিকীর মধ্যে দৃশ্য পদার্থকে দেব তথা অদৃশ্য পদার্থকে অসুর বলা হয়। বর্তমান বিজ্ঞানও দুই প্রকারের পদার্থকে স্বীকার করে। তারা অপ্রকাশিত পদার্থকে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি নাম দেয়। বর্তমান ভৌতিকী এই ডার্ক পদার্থকে এখনও পর্যন্ত ভালো করে সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি আর না এর কার্য ও অস্তিত্বকে পূর্ণভাবে সিদ্ধ বা স্পষ্ট করতে পেরেছে।

বর্তমান বিজ্ঞান এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে 4.6% দৃশ্য পদার্থ ও দৃশ্য ঊর্জা, 24% ডার্ক ম্যাটার তথা 71.4% ডার্ক এনার্জি মানে।∆

ডার্ক ম্যাটারের সমান পদার্থ

এখানে এরকমটা স্পষ্ট মনে হচ্ছে যে পূর্ব পৃষ্ঠাতে বর্ণিত প্রথম চার প্রকারের অসুর পদার্থ কণার অবস্থাকে প্রাপ্ত করে। এই কণার মাঝে আকর্ষণ বল অত্যল্প মাত্রায় থাকে। এটা হচ্ছে বর্তমান বিজ্ঞানের ডার্ক ম্যাটারের অনুরূপ পদার্থ। এদের মধ্যে ছন্দ রশ্মিগুলো স্বয়ং দুর্বল বন্ধন যুক্ত হওয়ার কারণে সবল বন্ধন যুক্ত দৃশ্য পদার্থের (দেব পদার্থ) কণার প্রতি আকর্ষণের নগণ্য ভাব দর্শায়, তবুও এদের প্রাণ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রণ থাকায় এরা ঘন রূপ প্রাপ্ত করে কণার রূপে উৎপন্ন হয় অবশ্য। এই কণা এত ঘন হয় না, যেরকমটা দৃশ্য পদার্থের (দেব পদার্থ) কণা হয়। এই কারণে এই কণা সৃষ্টির প্রত্যক্ষ অঙ্গ হতে পারে না। যদিও এই পদার্থ দৃশ্য পদার্থ দ্বারা আকৃষ্ট হয় না অথবা নগণ্য হয়, কিন্তু এদের পরস্পর স্বল্প আকর্ষণ থাকে অবশ্য, তা না হলে সম্পূর্ণ অসুর পদার্থ ছড়িয়ে যেত এবং সেটা কোনো কাজই সম্পাদিত করতে পারতো না। আজ ডার্ক ম্যাটার দ্বারা গ্যালাক্সির ধারণে অবদানের কথা বলা হয়, সেই ধারণ গুণও সেই সময় বিদ্যমান হতে পারবে না, যখন সেই কণার মধ্যে পরস্পর আকর্ষণের বল শূন্য হবে। এই কণার পরিচয় করা এই জন্য কঠিন, কারণ এদের কণা দুর্বল বন্ধনকারী রশ্মির দ্বারা নির্মিত হওয়ায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম ঘন হয়।
বর্তমান বিজ্ঞান ডার্ক ম্যাটারের বিষয়ে এখনও অনুসন্ধান করছে। সেটা আমাদের এই অসুর পদার্থের স্বরূপকে জানলে পরে তার অনুসন্ধানে অবশ্যই সহযোগ পাবে। সৃষ্টির সমস্ত পদার্থের জ্ঞান হয়ে যাক, এটা আবশ্যক নয়। বিজ্ঞানকে সর্বত্র পরীক্ষামূলক বানানোর চেষ্টা করা তথা সেই সীমার মধ্যে থাকা বাস্তবিক বিজ্ঞানকে সংকুচিত করা হবে। তর্ক, যুক্তি আদির আধারেও সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীর পর্যাপ্ত বিস্তার করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, এটার তাৎপর্য এই নয় যে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান থেকে প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাকেই বের করে দেওয়া উচিত, বরং এই সীমার বাইরেও বিচার করা আবশ্যক।

____________________________________________

☘️ অসুর পদার্থের বর্গীকরণ অসুর পদার্থকে নিম্নানুসারে বর্গীকৃত করা যেতে পারে। এরকম ছন্দ রশ্মিগুলো - 1. যারা মনস্তত্ত্ব দ্বারা প্রেরিত হতে পারে না, তারা যখন প্রাণ রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন তাদের থেকে অসুর তত্ত্বের উৎপত্তি হয়। 2. যাদের কিছু সার ভাগ আকাশের মধ্যে রোষে গেছে, তারা যখন প্রাণ রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখনও তারা অসুর তত্ত্বকে উৎপন্ন করে। 3. যারা ধায়্যা বিশেষ্য ছন্দ রশ্মি অথবা অনুষ্টুপ্ রশ্মি হতে রহিত হয়, তারা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে অসুর তত্ত্বকে জন্ম দেয়। 4. যারা অব্যবস্থিত রূপে বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তারাও অসুর তত্ত্বকে উৎপন্ন করে। বৈদিক বিজ্ঞানের মধ্যে উপরে বর্ণিত অসুর তত্ত্বের প্রথম চার প্রকারের পদার্থ আমরা বর্তমান বিজ্ঞানের ডার্ক ম্যাটারের প্রায় সমতুল্য মেনেছি। বৈদিক অসুর তত্ত্বের চার শ্রেণী দেখানো হয়েছে, অথচ বর্তমান বিজ্ঞানের দ্বারা পরিকল্পিত ডার্ক ম্যাটারের স্পষ্ট শ্রেণীর বিষয়ে এখনও কোনো মত আমাদের কাছে নেই। তবে হ্যাঁ, তারা গরম ও ঠান্ডা এই দুই প্রকারের ডার্ক ম্যাটারকে মানে অবশ্য। প্রথম শ্রেণীর রূপে বর্ণিত অসুর তত্ত্ব সবথেকে দুর্বল হয়, কারণ সেটা মন এবং বাক্ তত্ত্ব দ্বারা একটুকুও প্রেরিত হয় না। আমাদের চতুর্থ শ্রেণীর অসুর তত্ত্ব, যার মধ্যে ছন্দ রশ্মিগুলো অব্যবস্থিত প্রাণ রশ্মির সঙ্গে মিলন করে, সর্বাধিক তীক্ষ্ণ হয়, কারণ এরমধ্যে ছন্দ রশ্মিগুলো অব্যবস্থিত প্রাণ রশ্মির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকতে পারে না। শেষ দুই প্রকারের অসুর পদার্থ (ক্রমাঙ্ক 2 ও 3) দুর্বল হয়ে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সম্ভবত এটা নিজের দ্রব্যমানের কারণে বিভিন্ন লোককে প্রভাবিত করে তাদের থামিয়ে রাখতে নিজের ভূমিকা পালন করে। সৃষ্টির মধ্যে এই অপ্রকাশিত হিংসক অসুর পদার্থ নিম্ন রূপেও পাওয়া যায় - 1. অত্রিণঃ = এটা এরকম পদার্থ, যা সমন্বয়কারী কণার ভক্ষণ করে নেয়। 2. রক্ষাম্সি = এই পদার্থ এরকম আক্রামক হয়, যার থেকে সমন্বয় কণার রক্ষা করা আবশ্যক হয়, অন্যথা সর্গ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। 3. পাপ্মা = এটা হচ্ছে এক এমন পদার্থ, যেটা কোনো উপযুক্ত পদার্থের উপর আঘাত করে তার কণাকে সংযোগ প্রক্রিয়া থেকে বিরত করে দেয়, যার ফলে সেটা বারংবার বিপরীত দিশাতে পতিত হতে থাকে। এরকম তত্ত্ব সোম তত্ত্ব, ইলেকট্রন বা ফোটনস্-এর উপরে বারংবার পড়ে তাকে নষ্ট বা বিচলিত করতে চায়। 4. ময়ু (কিম্পুরুষ) = এই নামের পদার্থ হচ্ছে এক এমন পদার্থ, যা অত্যন্ত প্রক্ষেপক ক্ষমতা যুক্ত এবং অত্যন্ত ব্যাপকশীল হয়, তাছাড়া এটা সূক্ষ্ম ধ্বনিও উৎপন্ন করতে থাকে। আমাদের দৃষ্টিতে এই পদার্থই সবথেকে সূক্ষ্ম এবং প্রারম্ভিক অসুর তত্ত্ব (অপ্রকাশিত হিংসক বাধক পদার্থ) বলা হয়। 5. কিল্বিষ = এটা হচ্ছে সেই বাধক তত্ত্ব, যারা সর্বত্র অসুর নামে পরিচিত। এই অসুর তত্ত্ব যেকোনো কণার সামঞ্জস্য বা একীকরণে অবরোধ উৎপন্ন করে। 6. দ্বিষন্তম্ = এটা এমন তত্ত্ব, যা সোম তত্ত্বকে প্রতিকর্ষিত করে নিজের থেকে দূরে রাখতে চায়। 7. ভ্রাতৃব্য = অগ্নি আর বায়ু তত্ত্বের এরকম বিকার, যা অন্য কণাগুলোকে হরণ করে অর্থাৎ তাদের আকর্ষিত করে নষ্ট করার প্রবৃত্তি রাখে। 8. বৃত্র = এই নামের অসুর পদার্থ মেঘরূপ হয়, যা অপ্রকাশিত বায়ুর রূপ হয়। যখন বিভিন্ন কণার পরস্পর সংযোগ হতে চলে, তখন তাদের মাঝে বৃত্র নামক অপ্রকাশিত সূক্ষ্ম বায়ুর মেঘ তুল্য ঘেরা তারমধ্যে বাধক হতে থাকে। বিশাল স্তরে এটা সমস্ত লোককে ঘিরে ফেলার ক্ষমতা রাখে। 9. অমিত্র = এগুলো হচ্ছে সেই রশ্মি, যা স্বয়ং সংযোজক গুণ হতে রহিত বা অল্প গুণবতী হয়। এদের প্রভাবে আসা অন্য রশ্মিগুলোও সংযোজক গুণের নিস্তেজ গ্রস্ত হয়ে যায়। 10. দস্যু = এটা হচ্ছে সেই রশ্মি, যা শক্তিশালী হওয়ার কারণে সংযোগোন্মুখ অন্য কোনো পদার্থগুলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে সেই সংযোগকে হতে দেয় না। 11. সপত্ন = এটা হচ্ছে অসুর তত্ত্বের মধ্যম রূপ, যা বিভিন্ন সমন্বয় কণার সংযোগে বাধা উৎপন্ন করে। ☘️ আসুরী ঊর্জা (কথিত ডার্ক এনার্জি) বৈদিক অসুর তত্ত্বের পশ্চাৎ এখন আসুরী ঊর্জার চর্চা করবো। 1. এরকম প্রাণ-অপান অথবা প্রাণোদান রশ্মি, যা মনস্তত্ত্বের সঙ্গে ভালো করে সঙ্গত না হয়ে ব্যান প্রাণের সঙ্গে সঙ্গত হয়, তখন সেই প্রাণ-অপান অথবা প্রাণোদান রশ্মিগুলো সূক্ষ্ম অসুর রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে। 2. এরকম প্রাণ রশ্মিগুলো যা ছন্দ অথবা মরুত্ রশ্মিদের সঙ্গে সঙ্গত হতে পারে না, তারাও সূক্ষ্ম অসুর রশ্মিগুলোকে জন্ম দেয়। উপরিউক্ত অসুর পদার্থ হল আসুরী ঊর্জার রূপ। এদের মধ্যে প্রথম ঊর্জা মন থেকে অনিয়ন্ত্রিত ব্যান থেকে সম্বদ্ধ প্রাণ-অপান ও প্রাণোদান থেকে নির্মিত হয় তথা অন্য ঊর্জা ছন্দ রশ্মি ছাড়াই কেবল প্রাণ রশ্মির রূপে হয়। এই দুই প্রকারের ঊর্জা হল অপ্রকাশিত ঊর্জার রূপ। বর্তমান বিজ্ঞান যাকে ডার্ক এনার্জি বলে, তার সঙ্গে এটার এতটুকু সাদৃশ্য আছে যে বৈদিক ডার্ক এনার্জিও প্রতিকর্ষিত প্রভাব দর্শায়। এর কারণ এই হচ্ছে যে এরমধ্যে কেবল প্রাণ রশ্মিগুলোই থাকে, ছন্দ রশ্মিগুলো থাকে না। বর্তমান বিজ্ঞান ডার্ক এনার্জির স্বরূপ হতে অধিকাংশতঃ অপরিচিত আর না তাদের এই বিষয়ের জ্ঞান আছে যে ডার্ক এনার্জির প্রভাব কেন কেবল প্রতিকর্ষক হয়? আমাদের বৈদিক বিজ্ঞান এটার বিষয়ে পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট প্রকাশ তুলে ধরে। ☘️ দুই কণার মাঝে প্রতিকর্ষণের কারণ যখন একটা অ্যাটম বা মূল কণা বা অণু পরস্পর অতি নিকটে আসে, তখন তারা পরস্পর আকর্ষিত হওয়ার পরেও একটা নিশ্চিত সীমাতে এসে থেমে যায় আর একে-অপরকে প্রতিকর্ষিত করতে থাকে।
কখনও দুটো কণা পূর্ণতঃ স্পর্শ করতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে এটাই যে প্রত্যেক কণা সর্বদা ডার্ক এনার্জির সূক্ষ্ম আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। সেই আবরণই কোনো কণাকে অন্যের সঙ্গে সর্বদা সংযুক্ত হতে দেয় না। যত-যতটা দূরত্ব কম হয়, সেই আবরণ কম হওয়ার কারণে হয়। সংযুক্ত কণার মধ্যেও কিছু না কিছু অবকাশ থাকেই। বর্তমান বিজ্ঞানও একথা স্বীকার করে যে একটা নিশ্চিত দূরত্ব (R০) থেকে কম হওয়ার পর দুটো পরমাণুর মাঝে প্রতিকর্ষণ বল প্রভাবী হয়ে যায়, কিন্তু তারা এর কারণগুলো থেকে অনভিজ্ঞ।
☘️ অত্যল্প কালের জন্য আপেক্ষিকতার উলঙ্ঘন যে সময় তীব্র ঊর্জার বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো ডার্ক এনার্জির উপরে প্রহার করে, সেই সময় তাদের বেগ অকস্মাৎ বেড়ে যায়, এর থেকে অধিক বেগ বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অন্যত্র কোথাও হয় না। এখানে আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সিদ্ধান্তের উলঙ্ঘন মনে হয়, কারণ এই পরিস্থিতির মধ্যে স্বয়ং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো নিজের সর্বমান্য নির্বাতের মধ্যে গতি 3 লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেণ্ডের অতিক্রমণ করে অধিকতম গতিকে প্রাপ্ত করে নেয়। এই গতিকে অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। উল্লেখনীয় যে এই অধিকতম গতি বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের জন্য হয়, না কি প্রাণাদি রশ্মির জন্য হয়। যেমনটা আমি পূর্বে লিখেছি যে এই সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক গতি হচ্ছে ধনঞ্জয় প্রাণের, যার অতিক্রমণ কেউই করতে পারবে না। ডার্ক এনার্জির উপরে প্রহার করার সময়ে বিভিন্ন তরঙ্গাণু নিজের পূর্ব ভাগ থেকে শক্তিশালী মরুত্ রশ্মিগুলোর প্রক্ষেপণ করে। এই প্রক্ষেপণের কারণে ডার্ক এনার্জিকে নষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত করা যেতে পারে, এই মরুত্ রশ্মির তীব্র প্রক্ষেপণের কারণে তরঙ্গাণুর গতি বিপরীত দিশাতে প্রতিক্রিয়াবশ আরও তীব্র হয়ে যায়। এখানে আপেক্ষিকতার উলঙ্ঘন স্থায়ী রূপে নয়, বরং অত্যল্প কালের জন্যই হয়। ✍️ স্মরণীয় তথ্য 1. এরকম পদার্থ, যা প্রায়শঃ অপ্রকাশিতই থাকে তথা যারমধ্যে প্রতিকর্ষণ, প্রক্ষেপণ আদি বলের প্রাধান্য থাকে, তারা অসুর নামে পরিচিত। 2. অসুর পরমাণুর একে-অপরের প্রতি আকর্ষণের ভাব অবশ্যই থাকে। 3. দৃশ্য এবং অদৃশ্য দুই প্রকারের পদার্থ একই উপাদান পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয়। 4. অসুর পদার্থে মনস্তত্ত্ব অতিরিক্ত থাকে, কিন্তু সেই মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দেব পদার্থের তুলনায় নিম্ন থাকে, এই কারণে এই পদার্থ দেব পদার্থের তুলনায় প্রকাশহীন হয়। 5. এই সৃষ্টির মধ্যে ছেদন, ভেদন, সংযোজন এবং বিয়োজন, এই সব কর্মের মধ্যে দেব ও অসুর দুই প্রকারের পদার্থেরই অবদান থাকে। 6. অসুর পদার্থ নিজের প্রতিকর্ষণ বলের প্রভাবে বিভিন্ন লোকের মাঝে সমুচিত অবকাশ বানিয়ে রাখতে সহযোগী হয়ে তাদের ধারণ বা স্থায়ীত্ব প্রদান করতেও সহযোগী হয়। 7. দেব এবং অসুর পদার্থের মধ্যে দেব পদার্থের উৎপত্তি আগে তথা অসুর পদার্থের উৎপত্তি তার পশ্চাৎ হয়। 8. "ওম্" রশ্মিবিহীন মনস্তত্ত্বও হচ্ছে অসুর তত্ত্বের রূপ। 9. অসুর পদার্থ আসুরী ছন্দ রশ্মিগুলো থেকে নির্মিত হয়। 10. যে ছন্দ রশ্মিগুলো মনের দ্বারা প্রেরিত হয় না, তারা অপ্রকাশিত ঊর্জা বা পদার্থের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। 11. সুপারনোবা আদির বিস্ফোরণে অসুর পদার্থের অনিবার্য অবদান থাকে। 12. বৈদিক ভৌতিকীর মধ্যে দৃশ্য পদার্থকে দেব তথা অদৃশ্য পদার্থকে অসুর বলা হয়। 13. মন থেকে অনিয়ন্ত্রিত ব্যান থেকে সম্বদ্ধ প্রাণ-অপান ও প্রাণোদান থেকে নির্মিত ঊর্জা তথা বিনা ছন্দ রশ্মির কেবল প্রাণ রশ্মির রূপে উৎপন্ন ঊর্জা অপ্রকাশিত ঊর্জার রূপ হয়। 14. যে সময় তীব্র ঊর্জার বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো ডার্ক এনার্জির উপরে প্রহার করে, সেই সময় তাদের বেগ অকস্মাৎ বেড়ে যায়, এর থেকে অধিক বেগ বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো অন্যত্র কোথাও হয় না। 15. এই অধিকতম গতি হচ্ছে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের জন্য, না কি প্রাণাদি রশ্মির জন্য। এখানে আপেক্ষিকতার উলঙ্ঘন স্থায়ী রূপে হয় না, বরং অত্যল্প কালের জন্যই হয়।

দ্রব্যমান এবং তার কারণ 


আমরা সংসারের সব বস্তুর মধ্যে কিছু না কিছু ভার অনুভব করি। একই সঙ্গে আমরা এটাও অনুভব করি যে সব বস্তু স্থিতির মধ্যে পরিবর্তনের বিরোধ করে। বস্তুর মধ্যে এই দুই প্রকারের প্রবৃত্তির কারণ হল তাদের দ্রব্যমান নামক গুণ। চলুন, এই দ্রব্যমান গুণের বিষয়ে আলোচনা করি।

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে দ্রব্যমান 

দ্রব্যমান হল কোনো পদার্থের সেই মূল গুণ, যা সেই পদার্থের ত্বরণের বিরোধ করে। বর্তমান বিজ্ঞানের মধ্যে দ্রব্যমানের পরিভাষা আর এর উৎপত্তির কারণ স্পষ্ট নয়। হিগ্স বোসনকে কণার দ্রব্যমান বা ভারের জন্য উত্তরদায়ী মানা হয়। 1961 সালে আমেরিকান ভৌতিক শাস্ত্রী পিটার হিগ্স (মূল রূপে স্কটল্যান্ডের পিটার বেয়ার হিগ্স) বিচার করেন যে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অনেক প্রকারের কণা বা তরঙ্গাণু বিদ্যমান আছে, তাদের মধ্যে কারও মধ্যে দ্রব্যমান আছে, তো কারও মধ্যে নেই আর যাদের মধ্যে দ্রব্যমান আছে, তাদের মধ্যেও সবার মধ্যে সমান মাত্রায় হয় না। এই কারণে তিনি বিচার করেন যে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কোনো এমন সার্বত্রিক ক্ষেত্র (ফিল্ড) হওয়া উচিত, যার কারণেই কোনো কণার মধ্যে দ্রব্যমানের অস্তিত্ব হওয়া উচিত। পিটার হিগ্স সেই কল্পিত ক্ষেত্রের (ফিল্ড) তরঙ্গাণুর নাম হিগ্স বোসন রাখেন। বিশ্বের বৈজ্ঞানিকেরা সংসারের মধ্যে ভৌতিকীর সবথেকে বড়ো প্রয়োগশালার CERN (European Council for Nuclear Research) মধ্যে LHC (Large Hadron Collider) মেশিনের নির্মাণ করে 2012 সালে হিগ্স বোসনকে খোঁজার দাবি করে। বৈজ্ঞানিক এটার দ্রব্যমান প্রোটনের দ্রব্যমান থেকে 133 গুণ মানে। এখন প্রশ্ন এটা হচ্ছে যে যদি সৃষ্টির সব কণার মধ্যে দ্রব্যমানের কারণ হিগ্স বোসন হয়, তাহলে হিগ্স বোসনের দ্রব্যমানের কারণটা কি? বর্তমান বৈজ্ঞানিক হিগ্স বোসনের পুষ্টির জন্য নানা প্রকারের কল্পনা প্রস্তুত করে। তাদের কথা হল সব কণার মধ্যে দ্রব্যমানের কারণ হচ্ছে হিগ্স ফিল্ড আর হিগ্স বোসন, কিন্তু হিগ্স বোসনের দ্রব্যমানের কারণ হচ্ছে হিগ্স ফিল্ডই। যদি এর উপর আমরা এই প্রশ্ন করি যে হিগ্স বোসন থেকে পৃথক হিগ্স ফিল্ড কি পদার্থ? যদি কোনো কণার মধ্যে হিগ্স ফিল্ড থেকেই দ্রব্যমান আসতে পারে, তাহলে অন্য কণার দ্রব্যমানের জন্য হিগ্স বোসনের কেন আবশ্যকতা হবে? আর তাছাড়া হিগ্স ফিল্ডের স্রোত কি? এইসবের কোনো উত্তর আধুনিক ভৌতিক বৈজ্ঞানিকদের কাছে নেই। হিগ্স বোসনের বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞানের মত হচ্ছে এইরকম -
Higgs filed must exist everywhere in space. The Higgs field has an additional significance with it, particles acquire their characteristics masses. The stronger the interaction, greater the mass. We can think of the Higgs field an exerting a kind of viscous drag on particles that move through it; this drag appears as inertia, the defining property of mass. (Pg.496, Arthur Beiser, Concept of Modern Physics)
অর্থাৎ হিগ্স ফিল্ড কোনো কণার উপর সেই রকম বল লাগায়, যেরকম কোনো দ্রবের মধ্যে কোনো কঠিন পদার্থ যেতে হলে সান্দ্রতা বল লাগে। এখানে প্রশ্ন এটা হচ্ছে যে যখন দ্রবের মধ্যদিয়ে কোনো কঠিন পদার্থ যায়, তখন সান্দ্রতা বল এইজন্য লাগে কারণ দ্রব তথা কঠিন দুটোর মধ্যেই দ্রব্যমান গুণ থাকে। যদি এদের মধ্যে একটা পদার্থের মধ্যেও দ্রব্যমান না থাকে, তাহলে সান্দ্রতা বল উৎপন্ন হবে না। যখন ইলেকট্রন আদি কণার উৎপত্তির সময় তাদের মধ্যে দ্রব্যমান ছিলই না, তাহলে হিগ্স ফিল্ড সান্দ্রতা বল কিভাবে (জড়ত্ব - দ্রব্যমান) উৎপন্ন করতে পারে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই হচ্ছে যে যদি প্রোটন থেকে 133 গুণ দ্রব্যমানের হিগ্স বোসনের মধ্যে দ্রব্যমান কোনো মধ্যস্থ কণা ছাড়াই হিগ্স ফিল্ড থেকে স্বয়ংই আসতে পারে, তাহলে সেই দ্রব্যমানের 133 তম ভাগের সমান প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে দ্রব্যমানের উৎপত্তি বিনা হিগ্স বোসনের সাহায্যে সরাসরি কেন হতে পারবে না? তথা হিগ্স বোসনের দ্রব্যমানের 2,45,421 তম ভাগের সমান ইলেকট্রনের মধ্যে দ্রব্যমান কেবল হিগ্স ফিল্ড থেকে কেন আসতে পারবে না? বোসন সর্বদা দুটো কণার মাঝখানে মধ্যস্থ কণার রূপে থাকে, যা সেই দুটো কণার মাঝে বল উৎপন্ন করে, যেরকম আবেশিত কণার মাঝে প্রকাশাণু, দুই কোয়ার্যের মাঝে গ্লুয়ন, দুই দ্রব্যমান যুক্ত পিণ্ডের মাঝে গুরুত্বাণু, আদি তখন হিগ্স বোসন কোন দুই পদার্থের মাঝে কাজ করে?
তৃতীয় প্রশ্ন আমাদের সামনে এটা উপস্থিত হয় যে যেরকম দ্রব্যমান, যা হচ্ছে কোনো পদার্থের একটা মূলভূত গুণ, তার বিষয়ে এই ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে এর পিছনে কোনো ফিল্ডই কারণ হবে আর সেই ফিল্ডকে হিগ্স বোসন বলা হয়েছে, তাহলে পদার্থের অন্য এরকমই গুণ বিদ্যুৎ আবেশের বিষয়ে যদি আমরা এই তর্ক প্রস্তুত করি যে এটার কারণও কোনো ফিল্ড বিশেষ হওয়া উচিত। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ফিল্ড তো স্বয়ং বিদ্যুৎ আবেশের কারণে উৎপন্ন হয়, তাহলে বিদ্যুদাবেশের কারণ কি? যখন দ্রব্যমান উৎপন্নকারী ফিল্ড হবে, তাহলে বিদ্যুৎ আবেশকে উৎপন্নকারী ফিল্ডও মানা উচিত নয় কেন?

দ্রব্যমানের বৈদিক স্বরূপ

আসলে দ্রব্যমানের উৎপত্তির কারণ হিগ্স ফিল্ড নয়, বরং সবার দ্রব্যমানের কারণ হল এইরকম -
বৈকুণ্ঠ ইন্দ্র বিশেষ্য সর্বাধিক সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ, যা প্রাণ ও অপান রশ্মির বিশেষ যোগ দ্বারা উৎপন্ন হয়, তার প্রাণ, ব্যান ও ধনঞ্জয় রশ্মির সঙ্গে সম্মিশ্রণ হয়। এদের মধ্যে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দের অস্তিত্বও থাকে, সেই সময় দ্রব্যমান গুণ উৎপন্ন হয়। এটা বিদ্যুৎ বিশেষ রূপে নিস্তেজ হয়। এই মিশ্রণের মধ্যে অপানের অপেক্ষায় প্রাণের প্রাধান্য থাকে। ধনঞ্জয় মিশ্রিত ব্যান রশ্মির মিশ্রণ দ্বারা প্রাণ তত্ত্বের আকর্ষণ বল প্রধান থেকে অপানের প্রতিকর্ষণকে গৌণ বানিয়ে দেয়। এই রশ্মির এটা এরকম বন্ধন হয় যে এর কারণে যেকোনো পদার্থ আকর্ষণেরই ভাব রাখে তথা কোনো গতি বা স্থিতিতে পরিবর্তনের প্রতিরোধ করে। এই প্রতিরোধী গুণকেই বর্তমান বিজ্ঞান জড়ত্ব রূপী দ্রব্যমান নাম দেয়। এর স্বরূপ ও ক্রিয়াবিজ্ঞান হল এইরকম -
অপান এবং তার পেক্ষায় প্রাণের অধিকতার সঙ্গে-সঙ্গে ব্যান, এইসব রশ্মিগুলোকে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিগুলো তিন দিক দিয়ে আবদ্ধ করে। এর পশ্চাৎ সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির জাল সবাইকে সব দিক থেকে ঘিরে বেঁধে দেয়। এইভাবে এটা একটা সংঘাত রূপ ধারণ করে। এই সংঘাত কণা বা তরঙ্গাণু দুটোর মধ্যে যে কেউ হতে পারে। যখন এই সংঘাত গতি করে, তখন আকাশের মধ্যে বিদ্যমান সূক্ষ্ম প্রাণাদি রশ্মির সঙ্গে সেই সংঘাতের প্রতিরোধ হয়। যদিও আকাশ তত্ত্বের রশ্মিগুলো প্রাণ ও ছন্দাদি সমূহের মধ্যদিয়ে সহজে এপারওপার আবাগমনে সক্ষম হয়, কিন্তু সূত্রাত্মা ও ত্রিষ্টুপের বিশেষ জালের কারণে এরমধ্যে তাদের প্রতি অবরোধ উৎপন্ন হয়ে যায় আর এটাকে অবরোধ দ্রব্যমান বলে। যে সংঘাতে যত অধিক রশ্মি এবং যত মাত্রায় সেই জালের দ্বারা বাঁধা ও ঘনীভূত হয়, সেই কণার দ্রব্যমান ততই অধিক হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এই সূক্ষ্ম বিজ্ঞানকে একটুকুও বোঝে না।
বৈকুণ্ঠ ইন্দ্র বিশেষ্য ব্যাপক বিদ্যুৎ আর প্রাণ তত্ত্ব দুটোর মিশ্রণ দ্বারা, তারসঙ্গে ধনঞ্জয় আর ব্যানের যোগ দ্বারা পদার্থের মধ্যে দ্রব্যমান আর জড়ত্বের গুণ উৎপন্ন হয়। বিদ্যুৎ তত্ত্বের কারণে ব্রহ্মাণ্ডের সব পদার্থ পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু বিদ্যুতের মধ্যে অপান বিদ্যমান থাকাতে একটা নিশ্চিত অবকাশের সঙ্গে একে-অপরের থেকে আলাদাও থাকে। এই ধরনের বিদ্যুৎ তত্ত্ব আর অপান প্রাণ পরস্পর সমন্বিত হয়ে কাজ করে। এই বিদ্যুৎ তত্ত্ব ডার্ক এনার্জির প্রক্ষেপক প্রভাবকে নষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত করে। এটা পদার্থের মাঝে কার্যরত অনিষ্ট বলকে থামিয়ে বিকৃত পদার্থের উৎপত্তিকে থামিয়ে দেয়। এটা ডার্ক এনার্জি দ্বারা আক্রান্ত বিভিন্ন কণা বা রশ্মিগুলোকে আকৃষ্ট করে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে যায়।

দ্রব্যমান ও ঊর্জার সংরক্ষণ সিদ্ধান্ত

এই সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের বিভিন্ন প্রকারের তত্ত্বের অর্থাৎ প্রাণাদি পদার্থের সঙ্গে নিকট সম্বন্ধ থাকে। বায়ু বা প্রাণাদি পদার্থই সংকুচিত হয়ে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ অর্থাৎ ঊর্জাকে উৎপন্ন করে। বর্তমান বিজ্ঞান বায়ু বা প্রাণাদি পদার্থের স্বরূপকে নিজের টেকনিক দিয়ে অনুভব করতে পারবে না। ঊর্জা ও দ্রব্যমানের সংরক্ষণ যেখানে ভঙ্গ হতে দেখা যায়, সেখানে দুটোর প্রাণ তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তিত হওয়ার পরিণাম মানা উচিত। ভ্যাক্যুম ঊর্জা হচ্ছে বায়ু তত্ত্বেরই রূপ। যখন এর সংকোচন দ্বারা তরঙ্গাণু বা কণার নির্মাণ হয়, তখন দ্রব্যমান ও ঊর্জার সংরক্ষণ সিদ্ধান্ত ভঙ্গ হওয়ার মতো মনে হয়। বস্তুতঃ বায়ু তত্ত্ব ও ঊর্জা একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তনীয় হওয়ায় মূলতঃ একই হয় তথা একই মূল উপাদান কারণ থেকে উৎপন্ন ও তারমধ্যেই লয় হয়। প্রায়শঃ যেখানে-যেখানে বায়ু আছে, সেখানে-সেখানে ঊর্জাও বিদ্যমান আছে। এছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেক প্রকারের কণা ও তরঙ্গ আদি সবার মধ্যে কোনো না কোনো মাত্রায় ঊর্জা অবশ্যই বিদ্যমান থাকে অর্থাৎ ঊর্জাবিহীন কোনো পদার্থ এই সৃষ্টির মধ্যে হওয়া সম্ভব নয়। কিছু পদার্থ ঊর্জার রুপান্তরণ দ্বারা দ্রব্যাদিতে পরিবর্তিত হয়েছে, তো কিছু পদার্থ (বায়ু আদি) ঊর্জার রূপে পরিবর্তিত হয়েছে।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. দ্রব্যমান হচ্ছে কোনো পদার্থের সেই মূল গুণ, যা সেই পদার্থের ত্বরণের বিরোধ করে।
2. বৈকুণ্ঠ ইন্দ্র বিশেষ্য সর্বাধিক সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ প্রাণ ও অপান রশ্মির বিশেষ যোগ দ্বারা উৎপন্ন হয়।
3. আকাশ তত্ত্বের রশ্মিগুলো প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মি সমূহের মধ্যদিয়ে সহজে এপারওপার আবাগমনে সক্ষম হয়, কিন্তু সূত্রাত্মা ও ত্রিষ্টুপের বিশেষ জালের কারণে এরমধ্যে তাদের প্রতি অবরোধ উৎপন্ন হয়ে যায় আর এটাকে অবরোধ দ্রব্যমান বলে।
4. অপান, প্রাণ এবং ব্যান এইসব রশ্মিগুলোকে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ আর সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিদের বাঁধার দ্বারা হওয়া সংঘাত রূপ (কণা বা তরঙ্গাণু) যখন গতি করে, তখন আকাশের মধ্যে বিদ্যমান সূক্ষ্ম প্রাণাদি রশ্মির সঙ্গে সেই সংঘাতের প্রতিরোধ হয়।
5. যে সংঘাতের মধ্যে যত অধিক রশ্মি এবং যত মাত্রায় সেই জালের দ্বারা বাঁধা ও ঘনীভূত হয়, সেই কণার দ্রব্যমান ততই অধিক হয়।
6. বৈকুণ্ঠ ইন্দ্র বিশেষ্য ব্যাপক বিদ্যুৎ আর প্রাণ তত্ত্ব দুটোর মিশ্রণ দ্বারা, তারসঙ্গে ধনঞ্জয় আর ব্যানের যোগ দ্বারা পদার্থের মধ্যে দ্রব্যমান আর জড়ত্বের গুণ উৎপন্ন হয়।
7. বিদ্যুৎ তত্ত্বের কারণে ব্রহ্মাণ্ডের সব পদার্থ পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু বিদ্যুতের মধ্যে অপানের বিদ্যমান হওয়ায় একটা নিশ্চিত অবকাশের সঙ্গে একে-অন্যের থেকে আলাদাও থাকে।
8. বায়ু বা প্রাণাদি পদার্থই সংকুচিত হয়ে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ অর্থাৎ ঊর্জাকে উৎপন্ন করে।
9. ঊর্জা ও দ্রব্যমানের সংরক্ষণ যেখানে ভঙ্গ হতে দেখা যায়, সেখানে দুটোর প্রাণ তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তিত হওয়ার পরিণাম মানা উচিত।
10. বায়ু তত্ত্ব ও ঊর্জা একে-অপরের মধ্যে পরিবর্তনীয় হওয়ায় মূলতঃ একই হয় তথা একই মূল উপাদান কারণ থেকে উৎপন্ন ও তারমধ্যে লয় হয়।



আমরা জানি যে কোনো কণার দ্বারা ঊর্জার নির্গমন ও শোষণের প্রক্রিয়া এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে উদ্দীপ্ত নির্গমন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্গমন, প্রস্ফুরণ, আদি এরকম ঘটনাগুলো আছে, যাদের পিছনে এই প্রক্রিয়ার ভূমিকা থাকে। সূর্যের কেন্দ্র থেকে বিকিরণের পৃষ্ঠতল পর্যন্ত আসার জন্যও এই প্রক্রিয়া উত্তরদায়ী। আমরা জানি যে এই প্রক্রিয়া কিভাবে হয়, কিন্তু কেন হয়? এর ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? এর উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই। বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়াগুলোকে জানার চেষ্টা করা যাক। এই ক্রমে সর্বপ্রথম প্রকাশের দ্বিরূপ প্রবৃত্তিকেও জানাটা আবশ্যক।
☘️ প্রকাশের দ্বিরূপ (তরঙ্গ-কণা) প্রবৃত্তি
চলুন, এখন আমরা প্রকাশের প্রকৃতিকে জানবো। কিছু প্রয়োগ প্রকাশের তরঙ্গ প্রকৃতি দর্শায়, তো আবার কিছু প্রয়োগ কণীয় প্রকৃতি দর্শায়। আধুনিক ভৌতিক বিজ্ঞান প্রকাশের দ্বৈত প্রকৃতির হওয়াকে মানে অর্থাৎ প্রকাশ গমন করার সময় তরঙ্গের অবস্থার মধ্যে হয় আর শোষিত আর নির্গত হওয়ার সময় কণা, যাকে তরঙ্গাণু বলে, তার রূপ ধারণ করে নেয়। বৈদিক বিজ্ঞানের মধ্যেও প্রকাশের দ্বৈত প্রকৃতি হওয়া বলা হয়েছে, কিন্তু এমনটা কেন হয়? এর উপর আধুনিক বিজ্ঞান মৌন।

বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে বলতে গেলে তো, তরঙ্গাণু তরঙ্গ রূপ হয়ে গমন করে, সেই সময় তারা ছড়িয়ে থাকে, তাদের আকার অস্পষ্ট হলেও বেলনাকারের মতো হয়। যখনই তাদের কোনো কণার দ্বারা শোষিত করা হয়, তখনই তৎকাল ঘনীভূত হয়ে যায় আর শোষিত হয়ে সেই কণার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। এইভাবে তরঙ্গাণু কেবল শোষিত আর নির্গত হওয়ার সময়েই কণার রূপ ধারণ করে। বৈদিক রশ্মি থিওরির অনুসারে এরকম ক্রিয়াগুলোকে সম্পন্ন করার জন্য সময়ে-সময়ে বিভিন্ন প্রকারের বৈদিক ছন্দ রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হতে থাকে। বৈদিক ছন্দ রশ্মিগুলো সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম ক্রিয়ার মধ্যেও নিজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে তরঙ্গাণুকে ঘনীভূত করার কাজ -
অগ্নীষোমা হবিষঃ প্রস্থিতস্য বীতম্ হর্য়তম্ বৃষণা জুষে থাম্। সুশর্মাণা স্ববসা হি ভূতমথা ধত্তম্ য়জমানায় শম্ য়োঃ ।। (ঋঃ 1|93|7)
এই রশ্মির কারণে হয়। তাছাড়া অগ্নির বিকিরণ অর্থাৎ কোনো কণার সঙ্গে তরঙ্গাণুর নির্গমন ও শোষণের মধ্যে তেরো ছন্দ রশ্মি প্রেরকের কাজ করে, কিন্তু ঊর্জাকে কণার রূপ দেওয়ার হেতুই এই ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির বিশেষ ভূমিকা থাকে। ধরে নিন, এই রশ্মি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অকস্মাৎ সমাপ্ত হয়ে গেলে, তাহলে কি হবে? যেরকম লাইটের সুইচ বন্ধ করে দিলে সবদিকে অন্ধকার হয়ে যায়, সেই রকম সবদিকে অন্ধকার ছেয়ে যাবে। এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ের মধ্যে এই সংসার নষ্ট হয়ে যাবে।

এই কণাগুলোর চারিদিকে দুটো আবরণ বিদ্যমান থাকে, যাদের মধ্যে একটা আবরণ তাদের গতি, তেজ আদির তীব্রতা সুনিশ্চিত করে আর দ্বিতীয়তা অতিসূক্ষ্ম আবরণ উপরের আবরণকে গ্রহণ করতে বা ত্যাগ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই আবরণই যেকোনো কণার বিশেষত্বকে সংরক্ষিত রাখে। যদি এই আবরণও সংযোগের সময়ে সমাপ্ত হয়ে যায়, তাহলে বিভিন্ন কণার বিয়োগের সময়ে পূর্ব কণা কখনও উৎপন্ন হতে পারবে না। একথা ধ্যান দেওয়ার যে তরঙ্গাণু, ইলেকট্রন থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে সূক্ষ্মকারী আবরণ, দুর্বল হওয়া আবরণকে পুনঃ উৎপন্ন করে বাইরে আসে, যারদ্বারা সেই তরঙ্গাণু পূর্বের মতো তেজ, বল, গতি প্রাপ্ত করে নেয়।
যখন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো বিভিন্ন সোম্য কণার (ইলেকট্রনস্) সঙ্গে সংযুক্ত হয়, সেই সময় ইলেকট্রনসের উপরে বিভিন্ন প্রাণের যে আবরণ থাকে, ঊর্জার নির্গমন ও শোষণের পিছনে সোম্য কণার সেই আবরণগুলোর ভেদক একটা অনিবার্য কারণ হয়। যদি এই ভেদন না হয়, তাহলে ঊর্জার শোষণ ও নির্গমন হবেই না। এই নির্গমন ও শোষণের অভাবে ঊর্জার সঞ্চারণ ও উৎপাদন আদি কোনো কিছুই হতে পারবে না, আর না ঊর্জার পরিবর্তন, প্রতিসরণ এবং বিসরণ সম্ভব হতে পারবে। এরকম স্থিতিতে সবকিছু অন্ধকারময় হয়ে যাবে। এই আবরণগুলোকে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো একটা জগতী ছন্দ রশ্মির কারণেই ভেদ করতে পারে। এই ভেদনের পশ্চাৎই ঊর্জা সেই সোম্য কণার মধ্যে ব্যাপ্ত হতে পারে। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের ভিতরে ব্যাপ্ত সূক্ষ্ম বিদ্যুৎই এই প্রকারের ভেদন করে আর সেই বিদ্যুৎ এই রশ্মির কারণে অধিক সক্রিয় হয়।
☘️ তরঙ্গাণু আর ইলেকট্রনের সংযোগ-বিয়োগের ক্রিয়াবিজ্ঞান☘️
যখন একটা ফোটন কোনো পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা লাগে আর সেই তরঙ্গাণুর ঊর্জা, ইলেকট্রনের দুটো স্তরের ঊর্জার ভিতরের সমান হয়, তখন কম ঊর্জা স্তরের ইলেকট্রন, তরঙ্গাণুকে শোষিত করে উচ্চ ঊর্জা স্তরের মধ্যে চলে যায় আর অত্যল্প কালের মধ্যেই পুনঃ কম ঊর্জা স্তরের মধ্যে এসে যায়।

উদাহরণের জন্য লেজার হচ্ছে একটা এরকম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বিকিরণ, যাকে প্রেরিত নির্গমনের (Stimulated Emission) প্রক্রিয়া দ্বারা উৎপন্ন করা হয়। এরমধ্যে তরঙ্গাণুকে শোষিত করে উচ্চ ঊর্জা স্তরের মধ্যে চলে যায় আর প্রায় 10^-9 থেকে 10^-12 সেকেণ্ড পশ্চাৎ তরঙ্গাণুকে নির্গত করে পুনঃ কম ঊর্জা স্তরের কক্ষের মধ্যে এসে হয়, কিন্তু এরকমটা কেন হয়? এটার সম্বন্ধে বর্তমান বিজ্ঞান অনভিজ্ঞ। চলুন, বৈদিক বিজ্ঞানের দ্বারা এটাকে সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি। যখন তরঙ্গাণু আর ইলেকট্রনের সংযোগ হয়, তখন তিনটা রশ্মির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এদের মধ্যে প্রথম হল -
অগ্নে বীহি হবিষা য়ক্ষি দেবান্ত্স্বধ্বরা কৃণুহি জাতবেদঃ।। (ঋঃ 7.17.3)
এটার কারণে অগ্নি পরমাণু (ঊর্জা কণা) কোনো কণার মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে যায় আর তাকে গতি প্রদান করে। এরপর দ্বিতীয় ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -
য়দুস্রিয়াস্বাহুতম্ ঘৃতম্ পয়োऽয়ম্ স বামশ্বিনা ভাগ আ গতম্। মাধ্বী ধর্তারা বিদথস্য সত্পতী তপ্তম্ ঘর্মম্ পিবতম্ রোচনে দিবঃ।। (অথর্বঃ 7.73.4)
এটার প্রভাবে প্রাণ-অপান সক্রিয় হয়ে তরঙ্গাণুকে ইলেকট্রনের মধ্যে শোষিত হতে সহায়তা পায়। আর তৃতীয় হয় -
অস্য পিবতমশ্বিনা য়ুবম্ মদস্য চারুণঃ।
মধ্বো রাতস্য ধিষ্ণ্যা।। (ঋঃ 8.5.14)
এটার প্রভাবে বায়ুবিদ্যুৎ অর্থাৎ ভ্যাক্যুম ঊর্জা তীক্ষ্ণ হয়ে ইলেকট্রন আর তরঙ্গাণু থেকে নির্গত প্রাণগুলোকে শোষিত করে নেয়, যারদ্বারা এই দুটো ছন্দ রশ্মি মিলিত হয়ে সেই দুইয়ের সংযুক্ত রূপকে আবৃত করে নেয়। উপরিউক্ত তৃতীয় ছন্দ রশ্মির দ্বারা, যে দুটো কণার সংযোগ হয়, সেটা তৎকালই বিয়োগে বদলে যায় আর কণার বিযুক্ত হওয়ার সময় পূর্বোক্ত "অগ্নে বীহি" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে উত্তর বা দক্ষিণ দিশা থেকে দুটো কণাকে পৃথক-পৃথক করে। যেকোনো তরঙ্গাণু যখন ইলেকট্রনের উপরে পরে, তখন সেটা ইলেকট্রনের উত্তর বা দক্ষিণ ভাগ দিয়েই প্রবেশ করে আর যখন সেটা ফিরে ইলেকট্রন থেকে নির্গত হয়, তখন সেটা সেই দিশা দিয়েই নির্গত হয়। দিশার এই নিয়ম প্রথম ছন্দ রশ্মির কারণে হয়। বাকি দুটো রশ্মিগুলো তরঙ্গাণুকে ইলেকট্রনের দ্বারা পূর্ণ রূপে শোষিত করতে কাজে লাগে, যা দিয়ে তরঙ্গাণুর ঊর্জা ইলেকট্রন, যা স্বয়ং সূক্ষ্ম কণার সমূহ হয়, তার মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে যায় আর যখন ইলেকট্রন থেকে সেই তরঙ্গাণু ফিরে নির্গত হয়, তখন সেই দুটো ছন্দ রশ্মির প্রভাবে সেই ঊর্জা একত্র হয়ে প্রথম রশ্মির সহযোগে ইলেকট্রনের সেই দিশা থেকে ঘনীভূত রূপে বাইরে নির্গত হয়ে যায়।
যখন কোনো ইলেকট্রন ও তরঙ্গাণুর পরস্পর সংযোগ হয়, ঐ সময় সেই তরঙ্গাণু সেই ইলেকট্রন আদি কণার উপরে সূক্ষ্ম মরুত্ রশ্মিগুলোকে প্রক্ষিপ্ত করে আর সেই মরুত্ রশ্মির উপরেও সূক্ষ্ম প্রাণ রশ্মিগুলো মাছির মতো গুঞ্জন করতে থাকে। এটা সেই মরুত্ রশ্মিগুলোকে পরস্পর সঙ্গত ও সমন্বিত রাখে। এই মরুত্ রশ্মিগুলো ডার্ক এনার্জির সূক্ষ্ম স্তরে বাধক প্রহারকে নষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত করে। ইলেকট্রনকে এইভাবে বিভিন্ন স্তরের ঊর্জা প্রদান করে নানা প্রকারের আয়নের পরস্পর একাধিক অভিক্রিয়া করে। এই মরুত্ রশ্মিগুলোই বিভিন্ন ঊর্জা স্তরের তরঙ্গাণুগুলোকে কোনো ইলেকট্রন আদি কণার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য প্রধানত প্রেরিত করে ও সেই কণাগুলোকে সন্ধান করে। যখন কোনো তরঙ্গাণু কোনো কণার দিকে সঙ্গতিকরণ হেতু গমন করে, তখন সেটা সেই কণার নিকটে এসে তার পরিক্রমা করতে-করতে সংযুক্ত ও ব্যাপ্ত হয়ে যায়, নাকি সোজা ও অকস্মাৎ পরে গিয়ে। ঊর্জা ও দ্রব্যের এই সঙ্গতিকরণ এই সৃষ্টির মধ্যে নিরন্তর চলতে থাকে। এদের সঙ্গতিকরণের অভাবে সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলতেই পারবে না। আসলে ঊর্জা ও দ্রব্য দুটো পৃথক-পৃথক হওয়া সত্ত্বেও মূলত একটাই হয়, কারণ এই দুটোই মূলত একই কারণ পদার্থ দ্বারা নির্মিত। একইসঙ্গে আকাশ তত্ত্বও এই দুটোর থেকে ভিন্ন নয় আর না দ্রব্য ও ঊর্জা আকাশতত্ত্বের থেকে ভিন্ন। আসলে এইসব প্রাণ ও লঘু ছন্দাদি রশ্মি রূপ সূক্ষ্ম পদার্থের দ্বারাই উৎপন্ন হওয়ায় এদের মধ্যে অনেকত্ব হওয়ার পরেও এরা হচ্ছে একত্ব। বৈদিক বিজ্ঞানের মধ্যে এইসবের নাম দ্রব্যই হয়।
এখানে কোনো ইলেকট্রন আদি কণা এবং কোনো তরঙ্গাণুর সংযোগের চর্চা করা হয়েছে। যখন এদের পরস্পরের সংযোগ হয়, তখন সেটা ইলেকট্রন আদি কণা একটা নিচৃত্ অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিকে তরঙ্গাণুর উপরে ছেড়ে দেয় আর সেই তরঙ্গাণু এক প্রকারের বৃহতী ছন্দ রশ্মিকে ইলেকট্রন আদির উপরে ছেড়ে সেই কণার মধ্যে প্রবেশ করে। এই ছন্দ রশ্মি সেই তরঙ্গাণু সহিত ইলেকট্রন আদিকে সবদিক দিয়ে আবৃত্ত করে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। কোনো ইলেকট্রন থেকে তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) নির্গমনের মধ্যেও এই প্রকারের ক্রিয়া হয় অর্থাৎ ছন্দ রশ্মির আদান প্রদান হয়। যখন তরঙ্গাণু কোনো কণার মধ্যে সংযুক্ত হয়, তখন অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির কারণে একটা দীপ্তি উৎপন্ন হয়।
যেকোনো তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) একা বা অনেক বিকিরণ সমূহের রূপেও ততক্ষণ পর্যন্ত দীপ্তি উৎপন্ন করে না, যতক্ষণ তার কোনো দ্রব্য কণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হয়। এইভাবে তরঙ্গাণু যুক্ত ইলেকট্রন কিংবা ঊর্জার মধ্যে বৃদ্ধি হলে পরে ইলেকট্রন কোনো অ্যাটম থেকে নির্গত হয়ে অন্য কোনো আয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় বা এরকমটা করার চেষ্টা করে। এদের পৃথক হওয়ার ক্রিয়াতে ইলেকট্রনাদি কণা নিচৃত্ অনুষ্টুপ্ এবং তরঙ্গাণু উপরিউক্ত বৃহতী ছন্দ রশ্মিকে মুক্ত করে। যখন এই দুই প্রকারের কণার সংযোগ তথা বিয়োগ হয়, সেই সময় ইলেকট্রনাদি কণা স্বয়ংও কম্পন করে আর তরঙ্গাণুকেও কাঁপায় অর্থাৎ দুটোর মাঝে কম্পন হয়। যখন তরঙ্গাণু কোনো ইলেকট্রন আদি কণার সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখন সেটা এইভাবে সেই কণার মধ্যে প্রবেশ করে, যেরকম বর্ষার জল ভূমির দ্বারা শোষিত হয়।

এই ধরনের ক্রিয়ার মধ্যে অনেক প্রকারের প্রাণ ও মরুত্ রশ্মির একে-অপরের মধ্যে হস্তান্তরণ হয়। এই রশ্মিগুলো ইলেকট্রন ও তরঙ্গাণুর মধ্যে বিদ্যমান থাকে। যখন কোনো ইলেকট্রন আদি কণা থেকে কোনো তরঙ্গাণু মুক্ত হয়, সেই সময় সেটা সম্পূর্ণ কণা থেকে সংকুচিত হয়ে এরকমই বাইরে নির্গত হয়, যেরকম বৃষ্টির কোনো ফোঁটা মেঘ থেকে পড়ে, কিন্তু বাইরে বের হওয়ার সময় সেই তরঙ্গাণু ছড়িয়ে পড়ার মতো সুদূর যাত্রায় চলে যায়। একইভাবে যখন সেটা পুনঃ কোনো কণার উপর পড়ে, তখন সেটা আগে ফোঁটার মতো আকার বানিয়ে সেই কণার উপরে পরে, কিন্তু দ্রুত সেই আকারকে ত্যাগ করে ফিরে সম্পূর্ণ কণার মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে যায়।
এই সৃষ্টির মধ্যে বিনা ঊর্জার কোনো দ্রব্য কখনও কোনো প্রকারের সংযোগ-বিয়োগ ক্রিয়াকে সম্পাদিত করতে পারবে না। এমনকি ঊর্জার অভাবে যেকোনো কণাকে কখনও কোনো টেকনিকের দ্বারা দেখা যাবে না। এই ক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমান সংযোগতাকারী কণারই সংযোগ স্থায়ী হয়, অসমানের হয় না। এই কারণে এরকম সংযোগই প্রাথমিকতার আধারে হয়।

বিভিন্ন কণা ও তরঙ্গাণুর গমন

বিভিন্ন প্রকাশাণু, ইলেকট্রনস্ আদির উপরে একটা এমন দীপ্তিযুক্ত তীব্র আবরণ থাকে, যেটা যেখানে সেই কণার স্বরূপ ও মাত্রার রক্ষা করে, সেখানেই তার কারণ সেই কণা একে অপরের চক্কর কেটে বা স্বয়ং নিজের অক্ষের উপর চক্রণ এবং কম্পন করতে-করতে চলে। এই আবরণ যেখানে বিশেষ ছন্দ রশ্মির হয়, সেখানেই এর মূল কারণ সূত্রাত্মা বায়ু থাকে। এই আবরণ সেই কণাগুলোর চারিদিকে থাকে। এই কারণে যেখানে সেই কণাগুলোর বহিরাগত বাধক রশ্মির থেকে রক্ষা হয়, সেখানেই তাদের ভিতরে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রাণাদি সূক্ষ্ম পদার্থও বহির্গমন করতে পারে না। এই বহিরাগত আবরণের মধ্যে বিদ্যুৎ- বায়ুরও সমাবেশ থাকে, তার কারণেও সেই কণা কম্পন করতে-করতে আগে চলতে থাকে। এক স্থানে বাঁধা ঠোস বা দ্রব্য আদি পদার্থের মধ্যে সব কণা এই কারণেই কম্পন বা নিরন্তর গতি করতে থাকে, যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় কম্পনীয় গতি বলা যেতে পারে।
যখন কোনো ইলেকট্রন অথবা নাভিক থেকে কোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গাণু নির্গত হয়, সেই সময় সেই তরঙ্গাণু অনিয়মিত গতি এবং তীব্র গতিতে কম্পন করে। তার গতি ও দিশা কি হবে? এটা অনিশ্চিত থাকে। সেই সময় কিছু গায়ত্রী রশ্মি তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে, একই সঙ্গে ধনঞ্জয় প্রাণকে সঙ্গে নিয়ে সেই তরঙ্গাণুকে দ্রুত আকাশ তত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করে অতি তীব্র গতি (3 লক্ষ কিমি/সেকেণ্ড) প্রদান করে দেয়। তারপর সেই তরঙ্গাণু ব্রহ্মাণ্ডের সুদূর বা অনন্ত যাত্রায় বেরিয়ে পরে। এখানে জানার যোগ্য বিষয় হল যখন তরঙ্গাণু ইলেকট্রন আদির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, সেই সময় সেটা ইলেকট্রনের গতি ও ঊর্জার মধ্যে নিজের গতি ও ঊর্জার লয় করে দেয়। যখন সেই ইলেকট্রন কোনো গতিশীল তরঙ্গাণুকে গ্রহণ করে, সেই সময়েও উপর্যুক্ত গায়ত্রী রশ্মিগুলো তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাকে ইলেকট্রনের চারিদিকে বিদ্যমান আকাশ তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গত করে দেয়, যারফলে সেটা ইলেকট্রনের নিকটে চলে আসে আর তারপর তার গতি ও দিশা অনিয়মিত ও অগোছালো হয়ে যায়। এরপর সেটা সেই ইলেকট্রনের দ্বারা শোষিত করা হয়।

প্রকাশাণুর (ফোটন) গঠন

সব প্রকারের সূক্ষ্ম কণা, প্রকাশাণু অথবা বল-রশ্মি আদি পদার্থ নিজের সূক্ষ্ম শক্তি অর্থাৎ "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি দৈবী গায়ত্রী ছন্দের সঙ্গে সর্বদা সংযুক্ত থেকে নিজের কাজ করতে এবং বাধক রশ্মি অর্থাৎ তথাকথিত ডার্ক ঊর্জাকে দূর করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন প্রকারের প্রকাশাণু গায়ত্রী আদি সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মি, মন আর বাক্ তত্ত্ব, মূল প্রকৃতি আর প্রাণ অপান আদি প্রাথমিক প্রাণের সঙ্গেও যুক্ত থাকে। বিভিন্ন মরুত্ রশ্মি বড়ো ছন্দ রশ্মি, প্রকাশাণু, ইলেকট্রনস্, আদি কণা অথবা মধ্যস্থ কণা (মিডিয়েটর পার্টিকলস্) সবাইকে তাদের স্বরূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। প্রকাশাণু ধনঞ্জয় প্রাণের সঙ্গে আকাশ তত্ত্বের উপর গমন করে। যেকোনো তরঙ্গাণু আকাশ তথা বায়ুর বিভিন্ন রশ্মির সংযুক্ত রূপ হয়ে থাকে। এরমধ্যে সূক্ষ্ম প্রাণ থেকে শুরু করে ছন্দ রশ্মি পর্যন্ত সব তত্ত্ব বিদ্যমান থাকে। এটা প্রায় সৃষ্টি কাল পর্যন্ত নষ্ট হয় না। এটা নিজের গতির দিশাতে নিম্ন চিত্রের মধ্যে দেখানো আকারের হয়।

এর দুই সমকোণ দিশার মধ্যে কিছু বিশেষ সূক্ষ্ম রশ্মির ধারা নির্গত হতে থাকে, সেই দিশাগুলোর মধ্যে সেই তরঙ্গাণুগুলোর ভিতরে কিছু বিশেষ প্রাণ আদি দেব পদার্থ অব্যক্ত রূপে লুকিয়ে থাকে। এই দুই ধারা যেকোনো তরঙ্গাণুর গতিকে সুষম রাখে। সেই দুই ধারাকে জুড়ে রাখার জন্য তরঙ্গাণুর মাঝে সূক্ষ্ম প্রাণ দ্বারা নির্মিত যে কেন্দ্র থাকে আর সেই কেন্দ্র ঘূর্ণায়মান হয়ে সেই দুই ধারাকে নিয়ন্ত্রিত রাখে।

আধুনিক বিজ্ঞান কোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের দুই দিকে বৈদ্যুত ক্ষেত্র তথা চুম্বকীয় ক্ষেত্রের হওয়া তথা এদের ক্রমশঃ পরস্পর লম্ববত্ দিশার মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে চলাকে স্বীকার করে। যদিও এই দুই প্রকারের ক্ষেত্র বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের সঙ্গে মেল খায়, কিন্তু সেই ক্ষেত্র পরস্পর লম্ববত্ দিশার মধ্যে কেন তৈরি হয়, এর উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই।

কম্পটন প্রভাব

আধুনিক বিজ্ঞানের অনুসারে যখন উচ্চ আবৃতির বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বিকিরণের (অর্থাৎ তরঙ্গাণু) পদার্থের সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া হয়, তখন মুক্ত ইলেকট্রন থেকে প্রকীর্ণিত হয়ে তরঙ্গাণুর ঊর্জার মধ্যে কিছু হ্রাস হয় আর তার তরঙ্গদৈর্ধ্যের মধ্যে বৃদ্ধি হয়ে যায়। এই ক্রিয়াকে কম্পটন প্রভাব বলে।
এখন এখানে এই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে, তরঙ্গাণুর দ্বারা ইলেকট্রনকে ঊর্জা প্রদান করার ক্রিয়াবিজ্ঞানটা কি, সেটা নিজের থেকে কিছু ঊর্জা ইলেকট্রনকে কিভাবে দেয়?

চলুন, এখন আমরা জেনে নিই, বৈদিক বিজ্ঞান এই বিষয়ে কি বলে? বাক্ তত্ত্ব (ওম্ রশ্মি) যা অতি সূক্ষ্ম অবস্থায় বিদ্যমান থাকে এবং সূক্ষ্ম মরুত্ রশ্মিগুলো দ্রব্য এবং ঊর্জার সঙ্গেই সর্বদা সংযুক্ত থাকে। প্রকাশাণু অতি সূক্ষ্ম রশ্মিগুলোকে ধারণ করে। যখন প্রকাশাণু কোনো ইলেকট্রন আদির সঙ্গে ধাক্কা লাগে, তখন সেটা সেই সূক্ষ্ম রশ্মিগুলোকে সেই কণার মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করে। কারণ যেকোনো তরঙ্গাণু স্বয়ং 360 প্রকারের রশ্মি সঙ্গে যুক্ত থাকে, এটাই হল কারণ যে, কোনো তরঙ্গাণু অন্য কোনো কণার সঙ্গে যখন ধাক্কা লাগে, তখন কিছু ঊর্জা তাকে দিয়ে বাকি থাকা ঊর্জার রূপে আগে বেরিয়ে পড়ে। কম ঊর্জা থাকা তরঙ্গাণুগুলোর ভিতরে বিদ্যমান ছন্দ ও প্রাণ রশ্মির সংখ্যা খণ্ডিত হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছন্দ রশ্মির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই কারণেই সেই তরঙ্গাণুর ঊর্জাতে নিম্নতা আসে। আর এই কারণে কোনো তরঙ্গাণুই নুন্যতম ঊর্জার একক হয় না।
যখন কোনো ফোটন কোনো ইলেকট্রন দ্বারা শোষিত হয়ে পুনঃ আবার নির্গত করা হয়, তখন ঊর্জার অনেক সূক্ষ্ম অংশ ইলেকট্রন নিজের কাছে রেখে দেয় আর অধিকাংশ ভাগ নির্গত হয়ে যায়। এটাই হল কারণ যে, সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে উৎপন্ন গামা (γ) কিরণগুলো সূর্যের তলে আসতে-আসতে দৃশ্য প্রকাশ, অবরক্ত কিরণ, পরাবেগুনী কিরণ আদিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ঊর্জার এই সূক্ষ্ম শোষণ একটা জগতী ছন্দ রশ্মির কারণে হয়।

ফোটো ইলেকট্রিক প্রভাব

মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস এখন থেকে প্রায় 7000 বছর পূর্বে নিজের গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন যে ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি ঊর্জাকে তরঙ্গাণুর রূপে বেঁধে রাখে, যারফলে বিভিন্ন প্রকাশাণু ঊর্জার একটা বিশেষ মাত্রাকেই ধারণ করে, বিশেষ করে যখন প্রকাশাণু কোনো ইলেকট্রনের উপরে পরে, তখন ঊর্জার একটা বিশেষ মাত্রার সঙ্গেই ইলেকট্রনের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে, না কি নিরন্তর প্রবাহমান ঊর্জা। এই ছন্দ রশ্মি কোনো ইলেকট্রনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে এমন অন্য ছন্দ আদি প্রাণগুলোর মাঝে স্থির হয়ে চলে, যেটা মুক্ত অবস্থায় ঊর্জার নিরন্তর প্রবাহের মধ্যে বাধক হয় না, কিন্তু নির্গমন ও শোষণের সময়ে ঊর্জাকে বেঁধে কণার রূপে বদলে দেয়।
এই কথাই আইনস্টাইন 1905 সালে প্রস্তাবিত করেন যে, প্রকাশ আসলে ঊর্জার আলাদা-আলাদা বান্ডিলের রূপে গমন করে। একই সঙ্গে আইনস্টাইনের ফোটো ইলেকট্রিক সমীকরণের -
hf = hf^1 + Kmax
অনুসারে যখন প্রকাশকে কোনো বিশেষ পদার্থের উপর ফেলা হয় আর যদি ঊর্জা hf^1 এর অধিক হয়, তাহলে Kmax গতিজ ঊর্জার সঙ্গে উলেকট্রন সেই পদার্থ থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।

তরঙ্গাণুর ভিতরে সূত্রাত্মা বায়ুর ব্যাপ্তি

যখন কোনো কণার সঙ্গে কোনো তরঙ্গাণুর সংযোগ হয়, তখন সেই তরঙ্গাণুর ঊর্জা সেই সম্পূর্ণ কণার ভিতরে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। এইভাবে তার ব্যাপ্তি সেই কণার সীমা পর্যন্ত হয়, কিন্তু যখন সেই কণা সূত্রাত্মা বায়ু দিয়ে ঘেরা থাকে, তখন সেই সূত্রাত্মা বায়ুর ব্যাপ্তি একটা ভাগ সেই কণার সীমার ভিতরে আর তিনটা ভাগ সেই কণার পরিধির চারিদিকে থাকে। এইভাবে সূত্রাত্মা বায়ুর ব্যাপ্তি তরঙ্গাণুর ব্যাপ্তির থেকে চার গুণ হয়।

কণার সংযোগের নিয়ম

এই সৃষ্টির মধ্যে যখনই কোনো কণা বা তরঙ্গাণুর পারস্পরিক সংযোগ হয়, তখন একটা সময়ের মধ্যে দুটোই কণা বা তরঙ্গাণুর সংযোগ হতে পারে, এর অধিক নয়। এই সৃষ্টির মধ্যে অনেক অণুর মধ্যে অনেকগুলো অ্যাটমস্ দেখতে পাওয়া যায়, এদের বিষয়েও আমার মত হচ্ছে এটাই যে সেইসব অ্যাটম পরস্পর একসঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে না, বরং শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে ক্রমশঃ দুই, তিন আদি বর্ধমান ক্রমের মধ্যে সংযুক্ত হয়। অ্যাটমসের রচনার সময়েও এই নিয়ম জারি থাকে। এইভাবেই একটা ইলেকট্রন থেকে যখন কোনো তরঙ্গাণু সংযুক্ত বা নির্গত হয়, তখনও একসঙ্গে কেবল একটাই নির্গমন বা শোষণ হতে পারে, একসঙ্গে অনেকের হওয়া সম্ভব নয়।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে তরঙ্গাণু তরঙ্গ রূপে গমন করার সময়ে ছড়িয়ে থাকে আর যখনই সেটা কোনো কণার দ্বারা শোষিত করা হয়, তখনই দ্রুত ঘনীভূত হয়ে যায় আর শোষিত হয়ে সেই কণার মধ্যে ছড়িয়ে যায়।
2. তরঙ্গাণু কেবল শোষিত আর নির্গত হওয়ার সময়ই কণার রূপ ধারণ করে।
3. কণার চারিদিকে দুটো আবরণ বিদ্যমান থাকে, যাদের মধ্যে একটা আবরণ তাদের গতি, তেজ আদির তীব্রতা সুনিশ্চিত করে আর দ্বিতীয়টা অতিসূক্ষ্ম আবরণ উপরের আবরণকে গ্রহণ বা ত্যাগ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
4. যখন কোনো তরঙ্গাণু কোনো কণার দিকে সঙ্গতিকরণ হেতু গমন করে, তখন সেটা সেই কণার নিকট এসে তার পরিক্রমা করতে-করতেই সংযুক্ত ও ব্যাপ্ত হয়ে যায়, নাকি সোজা ও অকস্মাৎ পরে গিয়ে।
5. ঊর্জা ও দ্রব্য দুটো পৃথক-পৃথক হওয়ার পরেও মূলতঃ একই হয়, কারণ এরা দুটোই মূলতঃ একই কারণ পদার্থ দ্বারা নির্মিত।
6. বিভিন্ন প্রকাশাণু, ইলেকট্রনস্ আদির উপর একটা এমন দীপ্তিযুক্ত আবরণ থাকে, যা সেই কণাগুলোর স্বরূপ ও মাত্রার রক্ষা করে।
7. এই আবরণ বিশেষ ছন্দ রশ্মির হয়, এই কারণে যেখানে সেই কণাগুলোর বহিরাগত বাধক রশ্মিদের থেকে রক্ষা হয়, সেখানে তাদের ভিতরে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রাণাদি সূক্ষ্ম পদার্থ বহির্গমনও করতে পারে না।
8. যখন তরঙ্গাণু ইলেকট্রন আদির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, সেই সময় সেটা ইলেকট্রনের গতি ও ঊর্জার মধ্যে লয় করে দেয়।
9. বিভিন্ন প্রকারের প্রকাশাণু গায়ত্রী আদি সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মি, মন আর বাক্ তত্ত্ব, মূল প্রকৃতি আর প্রাণ অপান আদি প্রাথমিক প্রাণের সঙ্গেও যুক্ত থাকে।
10. তরঙ্গাণু থেকে দুটো সমকোণ দিশার মধ্যে কিছু বিশেষ সূক্ষ্ম রশ্মির ধারাগুলো নির্গত হতে থাকে। এই দুই ধারা যেকোনো তরঙ্গাণুর গতিকে সুষম রাখে।
11. যেকোনো তরঙ্গাণু স্বয়ং 360 প্রকারের রশ্মির সঙ্গে যুক্ত থাকে।
12. ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি ঊর্জাকে তরঙ্গাণুর রূপে বেঁধে রাখে, যারফলে বিভিন্ন প্রকাশাণু ঊর্জার একটা বিশেষ মাত্রাকেই ধারণ করে।
13. যখনই কোনো কণা বা তরঙ্গাণুর পারস্পরিক সংযোগ হয়, তখন এক সময়ের মধ্যে দুটোই কণা বা তরঙ্গাণুর সংযোগ হতে পারে, এর অধিক নয়।

তারার নির্মাণ 

অমাবস্যার রাতে ঝিলমিল করতে থাকা তারার সৌন্দর্য দেখতে বড়োই অদ্ভুত লাগে। সামান্য বুদ্ধির ব্যক্তি এটা ভাবতেও পারে না যে তারা কতটা বড়ো হতে পারে? বস্তুতঃ অনেক তারা সূর্যের সমান আয়তনের, কয়েকটা কিছু ছোটো, আবার কিছু অনেক বড়ো আকারের হয়। এই বিশাল আকাশের মধ্যে প্রায় দুই অরব গ্যালাক্সি আর এক-একটা গ্যালাক্সির মধ্যে প্রায় দুই-তিন অরব তারা আছে। এই আকার তো বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা দৃশ্য ব্রহ্মাণ্ডের মানা হয়েছে। আসলে ব্রহ্মাণ্ড কত বিশাল, এটা কেউই জানে না আর না জানতে পারবে। এইসব তারা কিভাবে তৈরি হয়? এর উপর বৈজ্ঞানিক দীর্ঘ কাল ধরে অনুসন্ধান করে আসছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা এদের তৈরির প্রক্রিয়াকে খুবই কম জানতে পেরেছে।

দুই প্রকারের লোক 

এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্তরিক্ষের অতিরিক্ত প্রধানত দুই প্রকারের লোক আছে। এদের মধ্যে প্রথম লোক হল সেটা যা অত্যন্ত তেজ আর ঊষ্মার পুঞ্জ হয়, যাদের আমরা তারা বলি। এই তারা যখন নির্মিত হতে থাকে, সেই সময় তাদের মধ্যে প্রকাশ আর ঊষ্মার মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকে, কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে তাদের কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে নাভিকীয় একীকরণের ক্রিয়া প্রারম্ভ হওয়ার পশ্চাৎ ঊষ্মা আর প্রকাশ দুটোর মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। যতক্ষণ তারা জীবিত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সেই রূপে থাকে। এই তারাগুলো নিজের-নিজের আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের মধ্যে অবস্থিত কোনো বিশালতম আর প্রবলতম তারার পরিক্রমা করতে থাকে।
অন্য লোক সেইসব হয়, যেসব নির্মাণাধীন অবস্থায় অগ্নির পিণ্ডের রূপে থাকে, কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে গ্রহ-উপগ্রহ আদিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এদের কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে তীব্র তাপ সর্বদা থাকে, কিন্তু তার তীব্রতা এতটা হয় না যে সেখানে নাভিকীয় একীকরণ হতে পারে। সব গ্রহ নিজের নিকটস্থ কোনো তারার গুরুত্বাকর্ষণ বলের দ্বারা বাঁধা অবস্থায় তার নিরন্তর পরিক্রমা করতে থাকে। বিভিন্ন তারা, গ্রহ আর উপগ্রহ আদি লোক নিজের উৎপত্তি কালের সময় থেকে কিছু কাল পশ্চাৎ পর্যন্ত নিজের-নিজের নিকটস্থ বিশাল লোকের পরিক্রমা নিশ্চিত গতির সঙ্গে নিশ্চিত কক্ষের মধ্যে করতে পারে না, বরং তাদের গতি আর মার্গ দুটোই অনিশ্চিত, অব্যবস্থিত আর অস্থির থাকে, কিন্তু সেইসব লোক ধীরে-ধীরে কক্ষ আর নিশ্চিত গতিকে প্রাপ্ত করার জন্য নিরন্তর প্রয়ত্নশীল থাকে।

তারার গঠন 

তারার মুখ্য পাঁচটা ভাগ হয়। সেই পাঁচটা ভাগের নাম লোম, ত্বক, মাংস, অস্থি ও মজ্জা বলা হয়েছে।
1. লোম = বৈদিক বৈজ্ঞানিক স্বরূপে তারার বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিগুলো হচ্ছে তারার লোম।
2. ত্বক = তার ভিতরে করোনা, তাদেরও আধার রূপ অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো রূপ প্রাণ এবং সূত্রাত্মা বায়ু আদি প্রাণের আবরণ সম্পূর্ণ তারাকে ঢেকে থাকে। এটাই তারার ত্বকের সমান হয়। এই ভাগের মধ্যে অসুর তত্ত্ব, যা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আকাশ তত্ত্বের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে, এটাও এই ছন্দাদি রশ্মিগুলোর নিকটে হয়। এইসব মিলিত হয়ে তারার পরিধির নির্মাণ করে। এখানে ছন্দ ও প্রাণাদির ঘনত্ব হতে তারার পরিধি অতি উষ্ণ হয়।
3. মাংস = এর পশ্চাৎ তারার ভিতরের ভাগ (যা কেন্দ্রীয় ভাগের উপর নিরন্তর স্খলিত হতে থাকে) হয়। এই ভাগ মাংস রূপ হয় অর্থাৎ এরমধ্যেই তারার নির্মাণের সম্পূর্ণ সামগ্রী (হাইড্রোজেনের নাভিক অত্যধিক মাত্রায় ভরে থাকে তথা ইলেকট্রনস্ও সেই অনুপাতে থাকে, তবে সেটা মুক্তাবস্থায়) অবস্থিত থাকে তথা তারার অধিকাংশ বল এই ভাগের মধ্যেই কাজ করে। আর এই ভাগের মধ্যেই মাস ও ঋতু বিশেষ্য রশ্মিগুলো অনেক ছন্দাদি প্রাণের সঙ্গে বিদ্যমান থাকে।
4. অস্থি = উপরিউক্ত ভাগের মধ্যে বিভিন্ন প্রক্ষেপণশীল কিরণ অস্থিরূপ হয়, যা সম্পূর্ণ তারাকে যেন ধারণ করে। ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী রশ্মিগুলো এই কাজকে সম্পাদিত করে।
5. মজ্জা = তারার কেন্দ্রীয় ভাগ, যা বিভিন্ন প্রাণ ও কণার ভাণ্ডার হয় তথা জ্যোতির্ময়ী সংযোগ রশ্মিগুলো দিয়ে ভরা থাকে, তাকে মজ্জা বলে। এই ভাগই হল সম্পূর্ণ তারার বলের কেন্দ্র এবং এটাই হচ্ছে জ্যোতির কেন্দ্র। এই ভাগের মধ্যে বহিরাগত পদার্থ, বিশেষ করে হাইড্রোজেনের নাভিক প্রবাহিত হতে থাকে, যা মিশ্রিত হয়ে হিলিয়ামে পরিবর্তিত হয়ে ঊর্জা উৎপন্ন করতে থাকে। অনেক তারার মধ্যে হিলিয়াম আদিও মিশ্রিত হয়ে অন্য বড়ো নাভিকের নির্মাণ করে।
এইভাবে পাঁচ প্রকারের পদার্থ দিয়ে তারা নির্মিত হয়। এখানে অগ্নিই হল সব প্রকাশিত ও আকর্ষণযুক্ত পদার্থের উৎপত্তি ও নিবাস স্থান। যদিও সব তারা প্রধানত অগ্নি তথা সোম, এই দুই প্রকারের পদার্থ দ্বারা মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে, যখন সোমও অগ্নির সমান হয়ে যায়, তখনই তারার স্বরূপ নির্মিত হতে থাকে। বিভিন্ন প্রকারের কণা, যা তারার বিভিন্ন ভাগের মধ্যে দূর-দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে, তারার অতি তেজস্বী কেন্দ্রীয় ভাগের দিকে পৌঁছাতে থাকে। সেখানে পৌঁছে সেটা বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পরস্পর সঙ্গত হয়ে নানা তত্ত্বের নির্মাণ করতে থাকে।

তারার পাঁচটা ক্ষেত্র 

এখানে আমরা যেকোনো তারার আন্তরিক গঠনের অন্য প্রকারে কিছু স্থূল ব্যাখ্যা করবো -
1. এন্ট্রি (কেন্দ্রীয় ভাগ) = এরমধ্যে নাভিকীয় একীকরণের ক্রিয়া হয়ে তীব্র ঊর্জার বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং বিদ্যুদাবেশিত তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। এদের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল বিদ্যমান থাকে। এটা হল যেকোনো তারার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাগ।
2. য়ামী = কেন্দ্রীয় ভাগের বাইরে সেই লঘু ভাগ, যারমধ্যে অগ্নি আর বায়ুর এমন সম্মিশ্রণ বিদ্যমান থাকে, যা কেন্দ্রীয় ভাগ আর বাইরের ভাগের মাঝখানে সুষম বজায় রাখে। এই ভাগের উপরেই তারার দুটো ভাগ পরস্পর স্খলিত হতে থাকে। এই ভাগের পদার্থকে কোনো চাকার মধ্যে বিদ্যমান bearing -এর রূপে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

3. বারুণী = এটা হল bearing রূপী ভাগের উপরের লঘু ক্ষেত্র, যারমধ্যে ঊষ্মার অতি উচ্চ অবস্থা বিদ্যমান থাকে। এই পদার্থ একীকরণ কণাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত করে আর কেন্দ্রীয় ভাগ থেকে আসা বিভিন্ন তরঙ্গকে বাইরের দিকে নিক্ষেপ করে।
4. সৌমী = এটা হল তারার সবথেকে বিশাল ভাগ, যার ত্রিজ্যা সম্পূর্ণ তারার ত্রিজ্যার প্রায় 75% হয়। এই ভাগের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের পদার্থ আয়নের রূপে বিদ্যমান থাকে। এর থেকেই বিভিন্ন কণা কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে পৌঁছে মিশ্রিত হয়ে নানা প্রকারের পদার্থের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এই ভাগের তাপ অন্য ভাগের তুলনায় সবথেকে কম হয়।
5. ঊর্ধ্বা = এটা হচ্ছে যেকোনো তারার সবথেকে বহিরাগত পরিধি, যেখানে অগ্নির উঁচু-উঁচু জ্বালাগুলো নিরন্তর উঠতে থাকে। এই ভাগের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র বিদ্যমান থাকে, যাদের স্থিতিও নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকে।

তারার ভিতরে পাঁচ প্রকারের বল আর পদার্থ 

তারার কেন্দ্রীয় ভাগ নির্মাণের সময় যেমন-যেমনটা করে পদার্থের সংকোচন হয়, তেমন-তেমনটা গুরুত্বাকর্ষণ বল এবং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বলের মধ্যে বৃদ্ধি হতে থাকে। যে পদার্থের কেন্দ্র যতটা নিকটে থাকে, সেখানে এই বল ততই অধিক প্রবল হয়। এই সময় তারার ভিতরে পাঁচ প্রকারের মুখ্য বল কাজ করে -
1. প্রাণ এবং সূক্ষ্ম বাক্ রশ্মির মাঝে কার্যরত বল
2. প্রাণ এবং বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির মাঝে কার্যরত বল
3. বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির মাঝে কার্যরত বল
4. বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল
5. গুরুত্বাকর্ষণ বল
এই তারার ভিতরে বিদ্যমান পদার্থেরও পাঁচটা শ্রেণী আছে -
1. প্রাণ রশ্মি
2. ছন্দ রশ্মি
3. আকাশ রশ্মি
4. বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ
5. বিভিন্ন প্রকারের কণা
এইসব প্রকারের বল আর পদার্থ তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। বিভিন্ন প্রকারের রশ্মি যেখানে তারার ভিতরে নানা প্রকারের বলের উৎপত্তি করে উচ্চ তাপ আর চাপকে উৎপন্ন করে, সেখানে কিছু ছন্দ রশ্মি এই তাপ আর চাপকে নিয়ন্ত্রিতও করতে থাকে, যার কারণে নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া ব্যবস্থিত চলতে থাকে। কিছু ছন্দ রশ্মি কেন্দ্রীয় ভাগের পরিধির মধ্যে নিরন্তর সঞ্চারিত হয়ে সেই পরিধিকে সুনিশ্চিত বজায় রাখে, যারফলে কেন্দ্রীয় ভাগ অন্য ভাগ থেকে পৃথক থাকা সত্বেও তারসঙ্গে জুড়ে থাকে।
তারা নির্মাণের প্রক্রিয়া জানার পূর্বে, আমরা এখানে এটা জানার চেষ্টা করবো যে কণা আর প্রতিকণার সংযোগ দ্বারা ঊর্জার উৎপন্ন হওয়ার ক্রিয়া বিজ্ঞানটা কি? বর্তমান বিজ্ঞান কণা আর প্রতিকণা দিয়ে মিলিত তরঙ্গাণুর নির্মাণের কথা তো বলে, কিন্তু তার ক্রিয়াবিজ্ঞানটা কি, এটা তারা জানে না। ধ্যাতব্য হল, তারার নির্মাণের পূর্বে বিভিন্ন কণা এবং অনেক প্রতিকণার নির্মাণ আগে থেকে হয়ে থাকে। নির্মাণাধীন তারার কেন্দ্রের নির্মাণের মধ্যে তাদের সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এই কারণে এদের ক্রিয়াবিজ্ঞান জানাটা অতি আবশ্যক।

কণা ও প্রতিকণার সংযোগ দ্বারা ঊর্জার উৎপত্তির ক্রিয়াবিজ্ঞান 

নেব্যুলার নির্মাণাধীন কেন্দ্রের মধ্যে কণা আর প্রতিকণার সঙ্গে মিলিত হয়ে ঊর্জার উৎপত্তি এবং বহিরাগত পদার্থের কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হওয়ার গম্ভীর বিজ্ঞান এখানে দেওয়া হয়েছে। ইলেকট্রন এবং পোজিট্রন, কোয়ার্ক এবং প্রতিকোয়ার্ক আদির সংযোগ দ্বারা ঊর্জা কেন এবং কিভাবে উৎপন্ন হয়? সম্ভবত এই বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান মৌন আছে। এখানে সেই গুপ্ত বিজ্ঞানের উন্মোচন করা হয়েছে। যখন কোনো কণা আর প্রতিকণা, উদাহরণের জন্য ইলেকট্রন এবং পোজিট্রন পরস্পর নিকটে আসে, তখন নিম্ন ঘটনা ঘটিত হয় -
পোজিট্রন আগ্নেয় তত্ত্ব (প্রাণ) প্রধান হওয়ার কারণে প্রাণের তুলনায় ঘন তথা মরুত্ রশ্মির বিরল রূপ হয় এবং ইলেকট্রন সোম তত্ত্ব প্রধান হওয়ার কারণে প্রাণের বিরল এবং মরুত্ রূপ রশ্মির ঘন রূপ হয়। যখন এই দুই কণা নিকটে আসে, তখন এদের মধ্যে প্রবল আকর্ষণ ক্রিয়া হয়। যখন দুই প্রকারের কণা সমান মাত্রায়, কিন্তু বিপরীত গুণকারক আবেশের অতিরিক্ত দ্রব্যমান আদি গুণের মধ্যেও অসমান হয়, তখন সেই কণা পরস্পর একে-অপরকে বেঁধে অপেক্ষাকৃত একটা স্থূল এবং সংযুক্ত কণার নির্মাণ করে। যেরকম ইলেকট্রন ও প্রোটন সংযুক্ত হয়ে হাইড্রোজেনের নির্মাণ করে। এই ধরনের কণাকে পরস্পর কণা এবং প্রতিকণা বলা যেতে পারে না।
যখন ইলেকট্রন ও পোজিট্রনের মতো সমান মাত্রা, কিন্তু বিপরীত বিদ্যুৎ আবেশের অতিরিক্ত অন্য সব গুণ সমান হয়, তখন সেই কণা পরস্পর কণা প্রতিকণার রূপে পরিচিত হয়। এদের অর্থাৎ ইলেকট্রন, পোজিট্রন আদির সংযোগের প্রক্রিয়া ইলেকট্রন এবং প্রোটনের সংযোগ প্রক্রিয়ার থেকে ভিন্ন হয়। ইলেকট্রন যখন কোনো পোজিট্রনের নিকট যায়, তখন তাদের আকর্ষণের প্রক্রিয়া এতই তীব্র হয় যে সেই দুই কণা পরস্পর পূর্ণ রূপে মিশ্রিত হয়ে যায়। সেই দুইয়ের মাঝে কোনো অবকাশ বা আকাশ তত্ত্ব বিদ্যমান থাকে না, সেই সময় ইলেকট্রনের মরুত্ রশ্মিগুলো এবং পোজিট্রনের ধনঞ্জয় আদি প্রাণ রশ্মিগুলো দ্রুত একে-অপরের দিকে প্রবাহিত হয়ে সম্পূর্ণ পদার্থকে মিশ্রিত করে দেয়। প্রাণ-অপান এবং বাক্ তত্ত্বের দ্বারা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মিগুলো থেকে এমন তীব্র ভেদক খদির রূপ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, যা ইলেকট্রন আর পোজিট্রন অথবা যেকোনো কণা ও প্রতিকণার পূর্ণ মিশ্রিত পদার্থকে একসঙ্গে আচ্ছাদিত করে তরঙ্গাণুর রূপ প্রদান করে। এই তরঙ্গাণু অত্যধিক শক্তি এবং গতি যুক্ত হয়। এই তরঙ্গগুলোর অনুপস্থিতিতে যেকোনো কণা আর প্রতিকণাও তরঙ্গাণুর রূপ ধারণ করতে পারে না।
যখন নিরাবেশিত নিউট্রন আদি কণার সঙ্গে তাদের প্রতিকণার সংযোগ হয়, তখন তাদের বিপরীত ঘূর্ণনের কারণে উৎপন্ন বল দুটোকে পরস্পর জুড়ে দেয়। তারপর তাদের থেকে তরঙ্গাণু তৈরির প্রক্রিয়াও উপরিউক্তানুসারে হয়। এইভাবে গামা কিরণ উৎপন্ন হয়ে অতি ভেদক ক্ষমতার সঙ্গে বহির্গমন করে যায়।
এই প্রক্রিয়াকে নিম্ন চিত্রানুসারেও জেনে নেবেন -

এরপর নেব্যুলার সম্পূর্ণ ভাগের মধ্যে মন, বাক্ বা প্রাণ থেকে এক প্রকারের পলাশ নামক তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। এদের উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ আবেশিত কণা উৎপন্ন হতে থাকে। এদের সঙ্গে বিল্ব তরঙ্গগুলো যোগ দ্বারা সূক্ষ্মতম বৈদ্যুত আবেশিত কণার সংযোগ হয়ে অন্য স্থূল আবেশিত কণার নির্মাণ হতে থাকে। এই সময় সূক্ষ্ম নাভিকের উৎপত্তি হওয়া শুরু করে। এই কারণে নেব্যুলা বা তারার মধ্যে বিদ্যুৎ আবেশিত কণার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কণা প্রতিকণা দিয়ে মিলিত হয়ে ঊর্জা উৎপন্ন করার ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায় তথা বড়ো-বড়ো বৈদ্যুত-ক্ষেত্র উৎপন্ন হতে থাকে। এই সবের কারণে সম্পূর্ণ পদার্থ অতি তেজস্বী হয়ে ওঠে। যেকোনো নেব্যুলা বা তারার পৃথক-পৃথক শনাক্তকরণ তাদের দ্বারা নির্গত কিরণগুলো দিয়েই হয়। এখনও পর্যন্ত নাভিকীয় একীকরণের মতো ক্রিয়া প্রারম্ভ হতে পারে না। এই তরঙ্গগুলোর প্রভাব নেব্যুলা বা তারার আকর্ষণ বলের উপরেও হয়।
তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে দুই প্রকারের ঊর্জা থাকে। একটা হল সেই ঊর্জা, যা নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করার পূর্বে উৎপন্ন হয়। সেই ঊর্জা নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করার জন্য অনিবার্য হয়। তারপর যে ঊর্জা নাভিকীয় একীকরণ থেকে উৎপন্ন হয়, সেই নতুন ঊর্জাও পূর্ব বিদ্যমান ঊর্জার মধ্যে মিশ্রিত হতে থাকে আর একটা বিশেষ সীমার পশ্চাৎ অতিরিক্ত ঊর্জা তারা থেকে বাইরে নির্গত হয়ে যায়। এই কাজের মধ্যে একটা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মির বিশেষ অবদান থাকে।
নাভিকীয় একীকরণ থেকে উৎপন্ন ঊর্জা তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে বিদ্যমান ঊর্জার তুলনায় অতি তীক্ষ্ণ হয়। এই ঊর্জা পূর্ব বিদ্যমান ঊর্জার ক্ষেত্রের মধ্যে নিরন্তর গমন করে আর তারপর সেই ঊর্জার ছেদন করে তারার অন্য ভাগের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে অন্তরিক্ষের মধ্যে নির্গত হয়ে যায়। এই সম্পূর্ণ কাজের মধ্যে একটা সাম্নী ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি বিশেষ উপযোগী হয়। এই দুই প্রকারের ঊর্জার সুষম বজায় রাখতে সহায়ক হয়।
তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে বিদ্যমান দুই প্রকারের ঊর্জা নিজের - নিজের সীমার ভিতর প্রত্যেক কণাকে প্রদীপ্ত করে। এই দুই প্রকারের ঊর্জার মধ্যে সমতা আছে। এই দুটোর মধ্যে অসমতা এই হল যে একীকরণের পূর্বে উৎপন্ন ঊর্জা তারার কেন্দ্রীয় ভাগ পর্যন্ত সীমিত থাকে আর সেখানে বিদ্যমান প্রত্যেক পদার্থকে ব্যাপ্ত করতে থাকে, অথচ একীকরণ থেকে উৎপন্ন ঊর্জা না কেবল কেন্দ্রীয় ভাগ, বরং সম্পূর্ণ তারা মণ্ডলকে ব্যাপ্ত করে। এই দুই ঊর্জাকে সমৃদ্ধ করার জন্য একটা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি ভারী ভূমিকা পালন করে।

তারার নির্মাণ 

বস্তুতঃ বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্র তথা সেগুলোর মধ্যে বিদ্যমান তারা একটা লম্বা আর জটিল প্রক্রিয়ার পশ্চাৎই নির্মিত হয়, এরপর নিজের স্থায়ী কক্ষ আর গতিকে প্রাপ্ত করতে পারে। এই প্রক্রিয়াতে লক্ষ-লক্ষ বছর লেগে যায়, এমনটা নয় যে এই প্রক্রিয়া কোনো চমৎকার দ্বারা অকস্মাৎই হয়ে যায়। যেটা যত বড়ো লোক হয় অথবা যেটা নিজের কেন্দ্রীয় তারা থেকে যতটা অধিক দূরে থাকে, তাকে স্থায়ী কক্ষ প্রাপ্ত করতে ততই সময় লাগে। এদের মধ্যে যেটাই কেন্দ্রীয় আর আধার রূপ তারা হয়, সেটা নিজের অধীনস্থ লোকের তুলনায় আকার, তাপ, প্রকাশ আর দ্রব্যমানের দৃষ্টি দিয়েও অনেক বড়ো হয়।
যখন ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অগ্নি আর সোম পদার্থ কিংবা ধনাবেশিত বা ঋণাবেশিত কণা সর্বত্র উৎপন্ন হয়ে যায়, সেই সময় কোনো বিশেষ ভাগ অথবা আগামী কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে অকস্মাৎ কিছু এমন বজ্র রূপ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে যায়, যা ধনাবেশিত আর ঋণাবেশিত কণার ঊর্জাকে সেই স্তর পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেখানে তারা পরস্পর মিলিত হয়ে ঊর্জাতে পরিবর্তিত হতে লেগে যায়। অন্য কণা আর প্রতিকণাও এই প্রক্রিয়াকে পুনরাবৃত্তি করে। যখন এই ঊর্জা সেই নবনির্মিত কেন্দ্রীয় ভাগ থেকে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়, সেই সময় সেই বজ্র রূপ কিরণগুলোও তার সঙ্গে বহির্গমন করে। তারপর মনুষ্য নামক কণা, যাদের গতি অনিয়মিত হয় তথা যা অল্প প্রকাশবান্ এবং অল্পায়ু হয়, সেগুলো এবং বিভিন্ন ঋষি প্রাণ বজ্র রূপ কিরণের প্রভাব দ্বারা দেদীপ্যমান হয়ে সেই কিরণগুলোকে পুনরায় কেন্দ্রীয় ভাগের দিকে প্রতিবিম্বিত করে দেয় আর তারপর সেগুলো তাদের সঙ্গেই কেন্দ্রীয় ভাগের দিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নেব্যুলার জন্ম কিভাবে হয়? কিভাবে ব্যাপক ক্ষেত্রের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা পদার্থ ঘনীভূত হওয়া শুরু করে? কিভাবে গুরুত্বাকর্ষণ বল অকস্মাৎ কেন্দ্রীভূত হওয়া প্রারম্ভ করে? এই ধরনের অতি গম্ভীর প্রশ্নের অতি গম্ভীর সমাধান এখানে দেওয়া হয়েছে। কণা আর প্রতিকণা দ্বারা মিলিত হয়ে ঊর্জার মধ্যে বদলাতে আর তারপর সেই ঊর্জার নির্গত হওয়ার কারণে হওয়া রিক্ত স্থান সম্পূর্ণ পদার্থকে নিজের দিকে আকর্ষিত করার কারণ হয়ে যায়।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম তাদের কেন্দ্রের নির্মাণ প্রারম্ভ হয়। তারার কেন্দ্রের নির্মাণের প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পন্ন হয়, সেগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম সূক্ষ্ম বিদ্যুৎ আর তার থেকেও সূক্ষ্ম ধনঞ্জয়, ব্যান এবং সূত্রাত্মা বায়ুর দ্বারা কোনো একটা স্থান বিশেষের মধ্যে আকাশের সংকুচণ প্রারম্ভ হয়। এরপর সেই কেন্দ্রের চতুর্দিকে বিদ্যমান পদার্থের মধ্যে হালকা প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, যার কারণে বিভিন্ন কণা কম্পিত হওয়া শুরু করে। তার পরবর্তী ধাপে আকর্ষণের প্রক্রিয়া তীব্র হয়, তারপর সেগুলো পরস্পর বিভিন্ন মরুত্, ছন্দ এবং প্রাণ রশ্মির কারণে আবেশিত হয়ে ওঠে আর তাদের পরস্পর সঙ্গম প্রারম্ভ হওয়া শুরু করে। ধীরে-ধীরে গুরুত্বাকর্ষণ বলের প্রভাব বেড়ে গিয়ে পদার্থ আরও দ্রুত ঘনীভূত হতে থাকে আর গুরুত্বাকর্ষণ বলের চাপের কারণে সেই ক্ষেত্রের মধ্যে তাপ এবং চাপ এত বেড়ে যায় যে বিভিন্ন নাভিক পরস্পর মিশ্রিত হয়ে ভারী মাত্রায় ঊর্জাকে উৎপন্ন করা শুরু করে। এই সময় তারার নির্মাণাধীন কেন্দ্রের চতুর্দিকে ভারী কম্পন হয়ে সম্পূর্ণ পদার্থ দ্রুত সেই কেন্দ্রীয় পদার্থের দিকে প্রবাহিত হয়। ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটারের বাধক প্রভাব ধীরে-ধীরে প্রায় সমাপ্ত হয়ে যায়। এই সময় অত্যন্ত গম্ভীর ধ্বনি তরঙ্গও উৎপন্ন হয়। বাইরের দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে পদার্থ গ্যাসের রূপে এবং জলধারার সমান দ্রুত কেন্দ্রের দিকে চলে। এই সময় বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মিও তেজযুক্ত হয়ে পরস্পর সঙ্গত আর মিশ্রিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াতে অনেক প্রকারের নবীন কণা এবং তরঙ্গ তথা ন্যুক্লিওসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার দ্বারা অনেক প্রকারের নাভিক বা অণুর নির্মাণও তীব্র গতিতে হয়। এই সময় সূত্রাত্মা বায়ু আর মনস্তত্ত্বের কারণে বিদ্যুৎ বিশেষ সক্রিয় হয়। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে না কেবল নাভিকীয় মিশ্রণের প্রক্রিয়া হয়, অপিতু বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সংকোচন দ্বারা নানা প্রকারের মূল কণারও উৎপত্তি হয়।
তারা নির্মাণের সময় কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে হওয়া নাভিকীয় মিশ্রণের ক্রিয়াও এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যায়। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে বিভিন্ন কণার একীকরণের জন্য পৃথক-পৃথক বিশেষ উচ্চ তাপের মাত্রা অনিবার্য হয়। এই মাত্রা থেকে কম তাপ হলে পরে কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে নাভিকীয় একীকরণের ক্রিয়া সম্পন্ন বা প্রারম্ভ হতে পারে না আর আবশ্যক মাত্রা থেকে অধিক তাপ হলে পরে নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া অনেক তেজ হওয়ার জন্যও বিকিরণের চাপ অত্যধিক হতে পারে। এর পরিণামস্বরূপ তারার মধ্যে বিস্ফোরণ হতে পারে। এই কারণে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অনেক শ্রেণীর তারা বিদ্যমান আছে, যাদের কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন প্রকারের কণার একীকরণ হয় আর এর জন্য তাদের কেন্দ্রের মধ্যে তাপ আর চাপের মাত্রাও ভিন্ন-ভিন্ন হয়।
তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে অথবা তাদের দিকে যাওয়া বিভিন্ন প্রকারের কণা অনেক প্রকারের তীব্র ঊর্জা যুক্ত রশ্মিকে শোষণকারী হয়। যখন কোনো কোস্মিক মেঘের ভিতরে কোনো তারার জন্ম হয়, তখন সর্বপ্রথম একটা বিন্দুরূপ কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণ এবং বাক্ রশ্মি তীক্ষ্ণ বল যুক্ত হয়ে পরস্পর দ্রুত সঙ্গত হতে থাকে। ধীরে-ধীরে সেই বিন্দুরূপ স্থান বিস্তারকে প্রাপ্ত করে কোস্মিক মেঘকে নিজের দিকে দ্রুত আকৃষ্ট করতে থাকে। একইসঙ্গে কোস্মিক মেঘের থেকে রোষে-রোষে অনেক প্রকারের রশ্মি সেই কেন্দ্রীয় ভাগের দিকে আসতে থাকে। ধীরে-ধীরে এই ভাগ অতি তীব্র তপ্ত হয়ে একটা তারাকে জন্ম দিতে থাকে।

কণা আর তারার মধ্যে সমতা 

যেকোনো বিদ্যুদাবেশিত কণা অভ্যন্তরীণ গঠনের দৃষ্টিতে একটা তারার সমান হয়, যদিও এই সমতা পূর্ণরূপে নয়, বরং অল্পাংশের মধ্যেই হয়। দুটোর মধ্যেই উত্তরী আর দক্ষিণী ধ্রুব চুম্বকীয় ধ্রুবের মতো ব্যবহার করে। তারা তথা কণার পূর্বাঞ্চলীয় ভাগের মধ্যে প্রাণ-অপান আদি প্রাথমিক প্রাণ রশ্মিগুলো মৃদুরূপে বিদ্যমান থাকে, অথচ দক্ষিণ দিশা অর্থাৎ দক্ষিণী ধ্রুবের দিকে এই প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত তীব্র অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। পশ্চিম দিশাতে সংযোগ বল যুক্ত বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে। উত্তর দিশাতে কিছু এমন ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে, যাদের কারণে সেই কণা এই দিশাতে বিশেষ ক্রিয়াশীলতা আর ধারণ শক্তিকে ব্যক্ত করে।
বেদ বিজ্ঞান আলোক

তারার উত্তর দিশাতে এই গুণ যুক্ত কণা আর তরঙ্গ অতিরিক্ত থাকে। তারার ভিতরে নাভিকীয় একীকরণ ক্রিয়া দ্বারা যুক্ত কেন্দ্রীয় ভাগ তথা শেষ বিশাল ভাগের মাঝে যে সন্ধি ভাগ বিদ্যমান থাকে, সেখানেই দুটো ভাগ স্খলিত হয়ে গতি করতে থাকে, এরকমই গঠন প্রত্যেক বিদ্যুদাবেশিত কণারও হয়। সেই কণা ইলেকট্রন অথবা কোয়ার্ক যেকোনো হতে পারে। বর্তমান বিজ্ঞান ইলেকট্রনকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিদ্যুদাবেশিত কণার মেঘরূপে এখন মানা শুরু করেছে, কিন্তু তারা কোয়ার্কের গঠনের বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ। বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই দুটো কণার গঠন তারার মতোই হয়। এদের মধ্যেও কেন্দ্রীয় ভাগ আর শেষ বিশাল ভাগের মাঝে একটা সন্ধি ভাগ বিদ্যমান থাকে, যার উপর দুটো ভাগ স্খলিত হয়ে ঘুরতে থাকে। এই সন্ধি ভাগ স্থির অথবা অতি ন্যুন গতি যুক্ত হয়। এই ভাগের মধ্যেও বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ রশ্মি এই কণা অথবা তারা, দুটোর মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। এই রশ্মিগুলোর সুদৃঢ় বল দুই ভাগকে একসাথে থামিয়ে রাখে। দুটোর কেন্দ্রীয় ভাগ বিভিন্ন প্রাথমিক প্রাণ আর মরুত্ রশ্মি দ্বারা বিশেষ সমৃদ্ধ থাকে।

আমাদের সূর্যের কেন্দ্রের ত্রিজ্যা 

মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস আমাদের সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের ত্রিজ্যার মাপেরও বর্ণনা করেছেন -
সহস্রমনূচ্যম্ স্বর্গকামস্য সহস্রাশ্বীনে বা ইতঃ স্বর্গো লোকঃ
(ঐতরেয় ব্রাহ্মণ 2.17.3)
অর্থাৎ সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের ত্রিজ্যা হল একটা আশ্বীন আর সূর্যের কেন্দ্রের বহিরাগত ভাগ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হল এক সহস্র আশ্বীন। এইভাবে পৃথ্বী থেকে সূর্যের কেন্দ্রের দূরত্ব 1001 আশ্বীন হবে।
অর্থাৎ সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের ত্রিজ্যা ত্র*সূর্য= দ*পৃথ্বী -> সূর্য / 1001
এখানে দ*পৃথ্বী -> সূর্য = পৃথ্বীর পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের কেন্দ্রের দূরত্ব আছে।
উদাহরণ - যদি সূর্যের উপরের পৃষ্ঠ এখান থেকে প্রায় 15 কোটি কিমি দূরত্বে হয় তথা সূর্যের ত্রিজ্যা 6,96,000 কিমি হয়। তাহলে পৃথিবীর উপরের পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের কেন্দ্রের দূরত্ব 15,06,96,000 কিমি হবে। উপরিউক্ত সূত্র দ্বারা সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের ত্রিজ্যা ত্র*সূর্য= 1,50,545 কিমি.
বেদ বিজ্ঞান আলোক

ব্রহ্মাণ্ডের গুরূত্বপূর্ণ সপ্তক 

ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তারার মোট সাতটা শ্রেণী আছে। বর্তমান বৈজ্ঞানিকও তারার অনেক শ্রেণীকে মানে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কণাও সাতটা শ্রেণীতে বিভাজিত করা যেতে পারে। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পদার্থ প্রাথমিক প্রাণ, ছন্দ প্রাণ, আকাশ তত্ত্ব, বায়ু, অগ্নি, জল এবং পৃথিবীর রূপে হয়, যা হচ্ছে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলকণার বিভাজনের অপেক্ষায় অধিক ব্যাপক আর মৌলিক। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে গ্যালাক্সিও সাত প্রকারের হয়, যার উপর বর্তমান বিজ্ঞানকে অনুসন্ধান করা উচিত। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতুর মতো লোকও সাত প্রকারের হয়। এই সবগুলোর নির্মাণ, নিয়ন্ত্রণ আর সঞ্চালনে প্রধানতঃ সাত প্রকারের ছন্দ প্রাণ এবং সাত প্রকারের প্রাথমিক প্রাণ যেমন - প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, ধনঞ্জয় এবং সূত্রাত্মা বায়ুর ভুমিকা থাকে।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. তারার মুখ্য পাঁচটা ভাগ, সেই পাঁচটা ভাগের নাম হল লোম, ত্বক, মাংস, অস্থি আর মজ্জা।
2. বিভিন্ন প্রকারের রশ্মি তারার ভিতরে নানা প্রকারের বল উৎপন্ন করে উচ্চ তাপ আর চাপ উৎপন্ন করে।
3. কিছু ছন্দ রশ্মি এই তাপ আর চাপকে নিয়ন্ত্রিতও করে রাখে, যার কারণে নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া ব্যবস্থিত চলতে থাকে।
4. কিছু ছন্দ রশ্মি কেন্দ্রীয় ভাগের পরিধিকে সুনিশ্চিত করে রাখে, যারফলে কেন্দ্রীয় ভাগ অন্য ভাগ থেকে পৃথক থাকা সত্ত্বেও তারসঙ্গে জুড়ে থাকে।
5. যখন দুই প্রকারের কণা সমান মাত্রা, কিন্তু বিপরীত গুণকারী আবেশের অতিরিক্ত দ্রব্যমান আদি গুণের মধ্যেও অসমান হয়, তখন সেই কণা পরস্পর একে - অপরের সঙ্গে বেঁধে অপেক্ষাকৃত একটা স্থূল এবং সংযুক্ত কণার নির্মাণ করে।
6. যখন দুই কণার মধ্যে সমান মাত্রায়, কিন্তু বিপরীত বিদ্যুৎ আবেশের অতিরিক্ত অন্য সব গুণ সমান হয়, তখন তাদের আকর্ষণের প্রক্রিয়া এতই তীব্র হয় যে সেই দুটো কণা পরস্পর পূর্ণ রূপে মিশ্রিত হয়ে পদার্থকে একসঙ্গে আচ্ছাদিত করে তরঙ্গাণুর রূপ প্রদান করে।
7. যখন নিরাবেশিত নিউট্রন আদি কণার সঙ্গে তাদের প্রতিকণার সংযোগ হয়, তখন তাদের বিপরীত ঘূর্ণনের কারণে উৎপন্ন বল দুটোকে পরস্পর জুড়ে দেয়।
8. তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মধ্যে দুই প্রকারের ঊর্জা থাকে। একটা হল সেটা, যা নাভিকীয় একীকরণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হওয়ার পূর্বে উৎপন্ন হয় আর দ্বিতীয়টা হল সেটা, যা ঊর্জা নাভিকীয় একীকরণ থেকে উৎপন্ন হয়।
9. তারা একটা লম্বা আর জটিল প্রক্রিয়ার পশ্চাৎই নির্মিত হয়, তারপর নিজের স্থায়ী কক্ষ আর গতিকে প্রাপ্ত করতে পারে। এই প্রক্রিয়াতে লক্ষ-লক্ষ বছর লেগে যায়।
10. যেটা যত বড়ো লোক হয় অর্থাৎ যেটা নিজের কেন্দ্রীয় তারা থেকে যতটা অধিক দূরত্বে থাকে, তাকে স্থায়ী কক্ষ প্রাপ্ত করতে ততই অধিক সময় লাগে।
11. মনুষ্য নামক কণা অল্প প্রকাশবান্, অল্পায়ু এবং অনিয়মিত গতির হয়।
12. সূর্যের কেন্দ্রীয় ভাগের ত্রিজ্যা ত্র*সূর্য= দ*পৃথ্বী -> সূর্য / 1001 (এখানে দ*পৃথ্বী -> সূর্য = পৃথ্বীর পৃষ্ঠ থেকে সূর্যের কেন্দ্রের দূরত্ব আছে।)


বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ 

সৃষ্টি উৎপত্তি ক্রিয়ার মধ্যে তরঙ্গাণুর উৎপত্তির ঘটনা হল বর্তমান ভৌতিকীর দৃষ্টিতে সবথেকে প্রথম এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বৈদিক ভৌতিকীর দৃষ্টিতে এই ঘটনা অনেক চরণের পশ্চাৎ হয়, তবুও এই ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, তারার নির্মাণের পূর্বেই বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সংকোচন দ্বারা উৎপন্ন হয়ে যায়। তার পশ্চাৎ তিন প্রকারের ছন্দ রশ্মিসমূহ উৎপন্ন হয়ে তারা নির্মাণের প্রক্রিয়াকে জন্ম দেয়। এই তিনটা ছন্দ রশ্মির উৎপত্তিরও একটা নিশ্চিত ক্রম থাকে। সৃষ্টির প্রারম্ভে বিভিন্ন মূলকণার উৎপত্তির পূর্বে ছন্দ রশ্মি এবং প্রাণ রশ্মিগুলোর সংকোচন দ্বারা বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। এরপর এই বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ থেকেই বিভিন্ন মূলকণার উৎপত্তি হয়।

তরঙ্গের বিভাগ 

কালী করালী চ মনোজবা সুলোহিতা যা চ সুধূম্রবর্ণা।
স্পুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী বিশ্বরূপী চ দেবী লেলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বাঃ।। মণ্ডকো-১/২/৪

অর্থ-( কালী) কালী ( করালী) তীক্ষ্ণ ( মনোজবা) মনের মতো গতিশীল ( সুলেহিতা) লাল বর্ণযুক্ত ( যা) যা ( সুধূব্রবর্ণা) ধূসর বর্ণডুক্ত ( স্ফুলিঙ্গিণী) ম্ফুলিঙ্গ যুক্ত ( বিশ্বরূপী) বহু বর্ণযুক্ত ( দেবী) প্রকাশময়ী ( লেলায়মানা) প্রদীপ্ত ( সপ্তজিহ্বাঃ) সাত জিহ্বাসমূহ অগ্নির।।

ব্যাখ্যা-অগ্নির শিখা,যা যজ্ঞের জন্য প্রজ্জ্বলিত হয় এই সাত রূপ থেকে কোনও না কোনও রূপ হয়।।
( ভাষ্যকার-মহাত্মা নারায়ণ ম্বামী)
বিদ্যুৎ চুম্বকীয় এবং বিদ্যুৎ আবেশিত তরঙ্গের কিছু বিভাগের এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই বিভাগ নিম্নানুসারে - 1. কালী = এটা হল শুক্লাদি রঙের প্রকাশকারী বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। এর তাৎপর্য এই হল যে এই কিরণগুলো দৃশ্য প্রকাশ তরঙ্গ হয়, যাদের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান সাতটা রঙ যথা বেগুনি, নীল, আকাশী, হলুদ, সবুজ, গেরুয়া ও লাল রঙকে স্বীকার করে। এইসব মিলিত হয়ে সাদা রঙের রূপ ধারণ করে নেয় তথা সব রঙ শোষিত হলে পরে কালো রঙের রূপ উৎপন্ন করে। 2. করালী = এই কিরণগুলো খুবই ঊর্জাযুক্ত ভেদক শক্তি-সম্পন্ন হয়। গামা কিরণ, বিশেষ করে কোস্মিক গামা কিরণকে এই শ্রেণীর কিরণের মধ্যে রাখা যেতে পারে। অন্য গামা ও এক্স-রে এই শ্রেণীর মধ্যে মানা যেতে পারে। 3. মনোজবা = অর্থাৎ মনের সমান বেগশালী। আমরা জানি যে মনের রশ্মি বিনা কোনো বাধায় সর্বত্র গতি করে। তাদের কোনো ধরনের বাধা দিয়ে থামানো সম্ভব না। ব্রহ্মাণ্ড থেকে আসা ন্যুট্রিনোকে এই শ্রেণীতে রাখা যেতে পারে। 4. সুলোহিতা = অর্থাৎ সুন্দর লাল রঙের কিরণ। আমরা পূর্বে কালী কিরণের মধ্যে লাল রঙের দৃশ্য প্রকাশ কিরণেরও গ্রহণ করেছি। এরমধ্যে অবরক্ত তরঙ্গকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই কিরণের রঙও লাল হয়, কিন্তু একে চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব না। সব রঙ, রূপ প্রকাশযুক্ত হয়েও আমাদের দ্বারা দৃশ্য প্রকাশের শ্রেণীতে আসে না, এই কারণে তাদের দেখতে পাওয়া সম্ভব হয় না। এর মানে এই নয় যে তাদের কোনো রঙ হয় না। 5. সুধূম্রবর্ণা = অর্থাৎ সুন্দর ধোঁয়া রঙের। পরাবেগুনী কিরণ এই শ্রেণীতে আসতে পারে। সম্ভবত এদের রঙ সুন্দর বেগুনী হতে পারে, কিন্তু দৃশ্য প্রকাশের শ্রেণীতে না আসার জন্য দেখা যায় না। এই বেগুনীর মধ্যে নীল, সাদা, শ্যাম আদিরও কিছু মিশ্রণ হতে পারে। 6. স্ফুলিঙ্গিনী = অর্থাৎ যারমধ্যে অনেক প্রকারের কণা তরঙ্গ রূপে প্রবাহিত হয়। আমাদের মতে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বা যেকোনো তারা থেকে ইলেকট্রন, প্রোটনস্ আদি বিদ্যুদাবেশিত কণাও নিরন্তর এই অন্তরিক্ষের মধ্যে নির্গত হতে থাকে। সেটাও নিজের একটা প্রকাশ উৎপন্ন করতে থাকে। পৃথিবীর উত্তরী ও দক্ষিণী ধ্রুবে ধ্রুবীয় জ্যোতির (অরোরা) রূপে সুন্দর প্রকাশ এদেরই রূপ সর্ববিদিত হয়।

7. বিশ্বরূপী = এদের মধ্যে উপরিউক্ত কিরণের সব গুণ কিছু-কিছু অংশে বিদ্যমান থাকে। রেডিও তরঙ্গ এই শ্রেণীতে মানা যেতে পারে।

তিন প্রকারের অতি তীব্রগামী পদার্থ 

এই সৃষ্টির মধ্যে নিম্ন তিন প্রকারের পদার্থ অতি তীব্রগামী ও প্রকাশযুক্ত হয় - 1. বিভিন্ন ছন্দ ও প্রাণ রশ্মি 2. বিভিন্ন চুম্বকীয় তরঙ্গ 3. অন্য ব্রহ্মাণ্ডীয় বিকিরণ বর্তমান বিজ্ঞান বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গকে সর্বাধিক তীব্রগামী মানে, কিন্তু আমাদের মত হল কিছু ছন্দ ও প্রাণ রশ্মি বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তুলনায় অধিক তীব্রগামী হয়। বর্তমান বিজ্ঞান যেকোনো টেকনিক দিয়ে এই রশ্মিগুলোকে না তো প্রত্যক্ষ অনুভব করতে পারবে আর না তাদের গতিকে মাপতে পারবে। তবে হ্যাঁ, এটুকু হবে অবশ্যই যে যখন বিজ্ঞান অতি বিকশিত হয়ে যাবে, তখন তারা ছন্দ ও প্রাণ রশ্মির স্থূল প্রভাবগুলোকে অবশ্যই জানতে পারবে। এইসব পদার্থ বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম প্রাণ রশ্মির জাল দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে। সেই প্রাণ-জালই সেই বিকিরণ, রশ্মিগুলোকে গতি প্রদান করে আর একটা সীমায় বেঁধে রাখে। এদের মধ্যে প্রথম সর্বাধিক গতিশীল রশ্মির সঙ্গে মনস্তত্ত্ব পূর্ণ রূপে সংযুক্ত থাকে, আবার প্রাণাদি প্রাথমিক প্রাণ তত্ত্বের সঙ্গে আচ্ছাদন পূর্ণ রূপে থাকতে পারে না। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মধ্যে ছন্দ রশ্মিরও সংযোগ থাকে আর প্রাণাদিরও। ধনঞ্জয় প্রাণের কারণে এদের গতি তীব্র হয়। এই তিন প্রকারের পদার্থ বিভিন্ন সূক্ষ্ম কণাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে, সংযোগাদি ক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে এবং তাদের বল ও তেজ প্রদান করতে সক্ষম হয়।

বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের উৎপত্তি 

এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যখন বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিভিন্ন প্রাথমিক প্রাণ এবং আকাশ তত্ত্বের দ্বারা সংকুচিত হয়, তখন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের নির্মাণ হয়। সর্বপ্রথম দুর্বল তরঙ্গের উৎপত্তি হয়, যাদের আধুনিক ভৌতিক বিজ্ঞানের ভাষায় রেডিও তরঙ্গ বলা যেতে পারে। এরপর ঊষ্মা আর প্রকাশের তরঙ্গের উৎপত্তি হয়, যাদের মধ্যে বিভিন্ন বর্গ (রঙ) বিদ্যমান থাকে। শেষে এক্স-রে এবং গামা কিরণগুলো উৎপন্ন হয়, যা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। এই কিরণগুলোর তরঙ্গাণু প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি এবং আকাশ তত্ত্বের দ্বারা বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সংকোচন থেকে উৎপন্ন হয়। সব প্রকারের তরঙ্গাণু প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির দ্বারা, বিশেষ করে প্রাণ, অপান আর উদান নামক রশ্মির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে ধনঞ্জয় প্রাণ দ্বারা গতিশীল হয়। এই ধনঞ্জয় প্রাণের কারণে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গগুলো সর্বাধিক গতিশীল হয়। বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের ঊর্জা অর্থাৎ আবৃত্তি একথার উপর নির্ভর করে যে সেই তরঙ্গের তরঙ্গাণু কোন ছন্দ রশ্মির সংকোচন দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে, আর একথারও উপর নির্ভর করে যে প্রাণ, অপান, উদান আদি রশ্মির সঙ্গে সেই ছন্দ রশ্মির সমূহ কিভাবে নির্মিত আর নিয়ন্ত্রিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের পৃথক আবৃত্তির আধারে প্রকাশ, ঊষ্মা, পরাবেগুনী, গামা, রেডিও আদি তরঙ্গের বিভাজন মানে আর তাদেরও পরস্পর অসংখ্য স্তরকে স্বীকার করে। প্রকাশের প্রধানতঃ সাতটা রঙ, বস্তুতঃ অসংখ্য রঙ এই তরঙ্গের আবৃত্তির উপর নির্ভর করে, কিন্তু আবৃত্তিগুলোর ভেদ আর তরঙ্গাণুর নির্মাণের কারণ আধুনিক বিজ্ঞান জানে না, কিন্তু বৈদিক বিজ্ঞান এর থেকে অনেক আগে গিয়ে নানা ছন্দ রশ্মির সংকোচন দ্বারা নানা তরঙ্গের উৎপত্তি, বিশেষ করে তরঙ্গাণুর উৎপত্তির গম্ভীর বিজ্ঞান প্রস্তুত করে।

তরঙ্গাণুর সুপার পজিশনের ক্রিয়াবিজ্ঞান 

ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া তরঙ্গ বা কণা একটা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত মার্গের মধ্যেই গমন করে। অ্যাটমের ভিতরে ইলেকট্রন অথবা ব্রহ্মাণ্ডের গতিশীল বিভিন্ন তরঙ্গ বা কিরণ যেকোনো অন্য তরঙ্গের সঙ্গে ধাক্কা লাগার পরেও নিজের মার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয় না। আধুনিক বিজ্ঞান তরঙ্গের ক্ষণিক মিশ্রণকে যে সুপার পজিশন নাম দেয়, সেই সুপার পজিশনের দ্রুত পশ্চাৎ তরঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের পূর্ব মার্গে আগে চলে। যদি এমনটা না হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বনি সঞ্চার ব্যবস্থা অবরুদ্ধ হয়ে যেত।
বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কিছুই স্পষ্ট দেখা যেত না, অন্য আরও উপদ্রব হয়ে যেত, কিন্তু সর্বনিয়ন্ত্রক চেতন তত্ত্বের সুব্যবস্থার কারণে সবার মার্গ সুরক্ষিত থাকে। এই সুরক্ষার কারণ হল প্রাণযুক্ত সূত্রাত্মা বায়ু। উপরিউক্ত চিত্রের 18.3 মধ্যে প্রথম স্থিতিতে তরঙ্গাণু 1 এবং তরঙ্গাণু 2 নির্দিষ্ট দিশায় আগে চলে যাচ্ছে। সূত্রাত্মা বায়ু তরঙ্গ রূপে সবাইকে ব্যাপ্ত করে আছে দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে তরঙ্গাণুর পরিধিরূপেও সূত্রাত্মা বায়ু বিশেষতঃ বিদ্যমান আছে। দুটো কণাকেই ধনঞ্জয় প্রাণ নির্দিষ্ট দিশায় আগে নিয়ে যাচ্ছে। স্থিতি দুটোর মধ্যে দুটো তরঙ্গাণু অতি নিকটে পৌঁছায়, কিন্তু তারা পরস্পর সম্পূর্ণ রূপে স্পর্শ করতে পারে না। দুটোর মাঝখানে সূত্রাত্মা বায়ু ও অন্য কিছু প্রাণের ঘেরা কিছু দূরত্ব অবশ্যই রাখে, কিন্তু সূত্রাত্মা বায়ুর অন্য একটা ঘেরা দুটো তরঙ্গাণুকে সংযুক্ত রূপে আচ্ছাদিত করে নেয়, যার কারণে দুই তরঙ্গাণুর আকৃতি সংযুক্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য পরিবর্তিত হয়ে যায় কিন্তু সেই দুটোর দিশাকে ধনঞ্জয় প্রাণ বাধাপ্রাপ্ত হতে দেয় না, এই সংযুক্ত আকৃতিই সুপার পজিশনের রূপে দেখা যায়। তারপর তৃতীয় স্থিতি উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে দুটো কণা পূর্ববত্ আকৃতি এবং দিশা প্রাপ্ত করে বিনা কোনো পরিবর্তন করে আগে চলে যায়। এইজন্য বলা হয়েছে যে মার্গ সুনিশ্চিত আছে। এই মার্গ অনন্ত দূরত্ব পর্যন্ত চলে যায় আর সর্বত্র এই নিয়মই কাজ করে। ✍️ স্মরণীয় তথ্য 1. যখন বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ রশ্মি, বিভিন্ন প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি এবং আকাশ তত্ত্বের দ্বারা সংকুচিত হয়, তখন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের নির্মাণ হয়। 2. কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী ও বিশ্বরূপী এই হল বিদ্যুৎ চুম্বকীয় এবং বিদ্যুৎ আবেশিত তরঙ্গের সাতটা বিভাগ। 3. কিছু ছন্দ ও প্রাণ রশ্মি বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তুলনায় অধিক তীব্রগামী হয়। 4. বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মধ্যে ছন্দ রশ্মিরও সংযোগ থাকে আর প্রাণাদিরও। ধনঞ্জয় প্রাণের কারণে এদের গতি অতি তীব্র হয়। 5. সর্বপ্রথম দুর্বল তরঙ্গের উৎপত্তি হয়, তারপর ঊষ্মা আর প্রকাশ আর শেষে এক্স-রে আর গামা কিরণের উৎপত্তি হয়। 6. বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের ঊর্জা অর্থাৎ আবৃত্তি এই কথার উপর নির্ভর করে যে সেই তরঙ্গগুলোর তরঙ্গাণু কোন ছন্দ রশ্মির সংকোচন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। 7. ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রেরিত হওয়া তরঙ্গ বা কণা একটা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত মার্গের মধ্যেই গমন করে আর এই সুরক্ষার কারণ হল - প্রাণযুক্ত সূত্রাত্মা বায়ু। 8. সূত্রাত্মা বায়ুর ঘেরার কারণে, দুটো তরঙ্গাণু একে অপরকে পূর্ণরূপে কখনও স্পর্শ করতে পারে না। 9. সূত্রাত্মা বায়ুর ঘেরা দুটো তরঙ্গাণুকে সংযুক্ত রূপে আচ্ছাদিত করে নেয়, যার কারণে দুটো তরঙ্গাণুর আকৃতি সংযুক্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য পরিবর্তিত হয়ে যায়, যাকে আধুনিক ভৌতিকীর ভাষায় সুপার পজিশন বলা যেতে পারে।

মহাপ্রলয় 


এটা এক দ্রুব সত্য যে, পদার্থ যেটাই উৎপন্ন হয়, তার কখনও না কখনও বিনাশ অর্থাৎ কারণ রূপ পদার্থে অবশ্যই লয় হয়। এই সৃষ্টিরও এক দিন বিনাশ হয়ে যাবে আর এটা নিজের মূল উপাদান কারণে লীন হয়ে যাবে। এই অধ্যায়ের মধ্যে আমরা এটাই জানবো যে সৃষ্টির বিনাশ কিভাবে হয়?
সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত মূলকণা, প্রকাশাণু, আকাশ তত্ত্ব তথা ডার্ক পদার্থ প্রায়শঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টি কাল পর্যন্ত বজায় থাকে। কিছু মূলকণা উৎপন্ন বা নষ্ট হতে থাকে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াও সম্পূর্ণ সৃষ্টি কাল পর্যন্ত যথাযত চলতে থাকে। সম্পূর্ণ সৃষ্টি এদের দিয়েই নির্মিত হয়, কিন্তু এই তত্ত্বও মন, বাক্, প্রাণাদি পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয় আর এই কারণ-কার্যের (cause and effect) শৃঙ্খলা মূল উপাদান প্রকৃতি তত্ত্বের উপর সমাপ্ত হয়। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সাধারণত সৃজন বিনাশের চক্র চলতে থাকে। যথা - তারার বিস্ফোরণ হয়ে পদার্থের ছড়িয়ে যাওয়া, কোথাও তারার সৃজন, গ্রহ-উপগ্রহের সৃজন-বিনাশ, বিভিন্ন কথিত মূলকণার উৎপত্তি প্রলয় আদি ক্রম নিরন্তর চলতে থাকে। বিভিন্ন বনস্পতি, প্রাণী-শরীর, নদী, পর্বত, দ্বীপ আদির সৃজন ও বিনাশ, অণু, কোষিকারও এইভাবে সৃজন-বিনাশ দেখা যায়। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও এই খেলা কথিত মূল কণা, ঊর্জা, আকাশের অন্তর্গতই এদের মধ্যে এদেরই দ্বারা চলে। শেষে এই খেলা মহাপ্রলয় কালে বন্ধ হয়ে যায়।

সৃষ্টি-প্রলয়ের প্রবহমান চক্র 


এইসব ক্রিয়া হল ক্রমশঃ সৃষ্টি ও প্রলয়েরই লঘু রূপ, যা চক্রের মতো সর্বদা চলতে থাকে। পূর্বে আমি দুটো কণার আকর্ষণের প্রক্রিয়াকে বুঝিয়ে প্রতিকর্ষণ বলের ক্রিয়াকেও সংকেত রূপে বুঝিয়েছি। একটা সময় এমনও আসে, যখন বিনাশের প্রক্রিয়ার প্রাধান্য থাকে, বিশেষ করে কেবল বিনাশের প্রক্রিয়াই চলে। আকর্ষণ বলের ক্ষয় আর প্রতিকর্ষণ বলের বৃদ্ধি হতে থাকে। অন্যদিকে যখন সৃষ্টির নির্মাণ প্রারম্ভ হয়, সেই সময় আকর্ষণ বলেরই অস্তিত্ব থাকে, প্রতিকর্ষণ বলের উদয় কিছু কালের পশ্চাৎ হয়। যেসব গায়ত্রী রশ্মি থেকে আকর্ষণ ও সৃজন কর্মের বিবেচনা করা হয়েছে, সেই রশ্মিগুলোই কিছু বিকৃতির সঙ্গে বিনাশ কর্মকেও উৎপন্ন করে।

মহাপ্রলয়ের প্রক্রিয়া 


অপান রশ্মি ছন্দ রশ্মি থেকে পৃথক থাকা বা হওয়ার পরেও বিভিন্ন রশ্মি ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যখন বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি থেকে বিয়োগ হবে, সেই সময় আসুরী গায়ত্রী ও আসুরী ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সংমিশ্রণের উৎপত্তি হয়, যার কারণে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির বিয়োগ হওয়া শুরু করে। যার ফলে সমস্ত ছন্দাদি রশ্মিও পরস্পর বিযুক্ত হতে থাকে। দৃশ্য পদার্থের পতন তথা ডার্ক পদার্থ ও ডার্ক এনার্জির ভারী উৎকর্ষ হতে থাকে। এই কারণে মূল কণা তথা তরঙ্গাণুর আন্তরিক গঠন থেকে শুরু করে বড়ো-বড়ো লোক লোকান্তরের গঠনের মধ্যে বিক্ষোভ হওয়া প্রারম্ভ হয়। ধীরে-ধীরে সেই লোক লোকান্তর বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এদের মধ্যে বিদ্যমান অণু, অ্যাটম ও তাদের থেকেও সূক্ষ্ম কণা ও তরঙ্গের প্রকৃতি ও গঠন অগোছালো হওয়া শুরু করে। বলের স্বরূপ ও স্বভাব পরিবর্তিত হয়ে যায়, যার ফলে আকর্ষণ ও ধারণ বলের হ্রাস, পুনঃ ধীরে-ধীরে পূর্ণ বিনাশ হয়ে যায় তথা প্রতিকর্ষণ ও প্রক্ষেপক বলের মধ্যে নিরন্তর ভারী বৃদ্ধি হতে থাকে।

এদের দ্বারাই তারা, গ্রহ, উপগ্রহ আদি থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম কণা পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের মধ্যে বিস্ফোরণ ও বিক্ষিপ্তের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়ে যায়। অন্ততঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে ডার্ক পদার্থ ও ডার্ক এনার্জিরই সাম্রাজ্য হয়ে যায়। এই কারণে সম্পূর্ণ দৃশ্য পদার্থের অতিরিক্ত সম্পূর্ণ ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিও নিজের কারণভূত মনস্তত্ত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
সম্পূর্ণ সৃষ্টির আয়ুর মধ্যে মনস্তত্ত্ব সর্বদা একরস তথা নিশ্চিত মাত্রাতেই বিদ্যমান থাকে। এরমধ্যে ন্যূনতা বা অধিকতা আসে না। মনস্তত্ত্বের অনেক বড়ো ভাগ সৃষ্টি রচনার প্রক্রিয়াতে ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, দৃশ্য রূপ সম্পূর্ণ কণা বা বিকিরণের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। সৃষ্টি কালে মনস্তত্ত্ব বিকৃত হয়ে যেখানে পদার্থের ন্যূনতার পূর্তি করতে থাকে, সেখানেই অতিরিক্ত পদার্থকে নিজের মধ্যে বিলয়ও করতে থাকে। সৃষ্টির সূক্ষ্মতম কণা থেকে শুরু করে স্থূলতম লোক তথা তরঙ্গের নির্মাণ ও বিনাশ কর্ম মনস্তত্ত্বের প্রেরণা দ্বারা তারই ভিতরে নিরন্তর হতে থাকে। শেষে এই মনস্তত্ত্বও সমস্ত পদার্থ জগতের সঙ্গে নিজের বা সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মূল উপাদান কারণ প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়।
এই সৃষ্টির মধ্যে সৃজন-বিনাশের চক্র সর্বদা চলতে থাকে। বিভিন্ন সংযোগ প্রক্রিয়াকে ডার্ক এনার্জি নিজের প্রবল প্রতিকর্ষণ বলের দ্বারা বাধিত করার প্রয়াস করে। এই বাধাকে দূর করার জন্য অনেক রশ্মির উৎপত্তি সর্বদা হতে থাকে। যখন প্রলয় কাল আসে, তখন এই রশ্মিগুলোর মধ্যে বাধা উৎপন্ন হয়। সেগুলো অব্যবস্থিত রূপে উৎপন্ন হয়, যার কারণে তাদের সংযোগ প্রভাব ভ্রষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে তারা ডার্ক এনার্জির বাধক প্রভাবকে থামিয়ে রাখতে পারে না। এই কারণে আবেশিত কণার মাঝে আকর্ষণ বল সমাপ্ত হয়ে যায় অথবা আমরা বলতে পারি যে আবেশও সমাপ্ত অথবা উদাসীনতাকে প্রাপ্ত করে ফেলে। বিদ্যুৎ আবেশ যেই রশ্মির কারণে উৎপন্ন হয়, সেটা নিজের প্রভাব হারিয়ে ফেলে। এরফলে বিভিন্ন পদার্থের সৃজন কর্ম সমাপ্ত হয়ে বিনাশ ক্রম উৎপন্ন হয়। আবেশিত কণার মাঝে বল সমাপ্তির জন্য সেই রশ্মিগুলোকে বাধিত করা হয়, যা তার উৎপাদনে সহায়ক হয়।
যখন প্রাণ-অপান আদির মাঝে কার্যরত বল সমাপ্ত করতে হয়, যখন কোনো তরঙ্গাণু ও ইলেকট্রন আদির মাঝে আকর্ষণ বল অথবা বিভিন্ন কণার মাঝে নিশ্চিত দূরত্ব রাখার বল সমাপ্ত করতে হয়, যখন কোনো তরঙ্গাণুর নির্গমন ও শোষণের প্রক্রিয়াকে থামাতে বা সমাপ্ত করতে হয় (এই কারণে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের নির্গমন, শোষণ বা গমন-আগমনের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অন্ধকারময়ী অবস্থা উৎপন্ন হয়ে যায়), যখন ঊর্জার বিকিরণ রূপকে সমাপ্ত করতে হয়, যখন এদের শক্তিকে (আবৃত্তি) কম করতে হয়, তখন সেই বলগুলোর উৎপাদিকা গায়ত্রী রশ্মিকে উচ্ছৃঙ্খল করা হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান অথবা প্রাণ ও উদানের মাঝে কার্যরত সূত্রাত্মা বায়ু অথবা মনস্তত্ত্ব নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আকাশ তত্ত্ব দুই সংযোজক কণার (প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত) মধ্য থেকে পৃথক হয়ে যায়, বল সমাপ্ত হয়ে যায়। এরকমটা হলে সেই রশ্মিগুলোর যেসব প্রভাব আছে, সেগুলো থাকতে পারে না।
এই সৃষ্টির মধ্যে যখন প্রলয় কাল আসে অথবা কোনো ক্ষেত্র বিশেষের মধ্যে প্রবল ও ব্যাপক বিনাশের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন কিছু রশ্মি এরকম উৎপন্ন হয়, যা বিভিন্ন কণার চারিদিকে বিদ্যমান বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির আবরণকে নষ্ট বা আলাদা করে দেয়। ডার্ক এনার্জির অত্যধিক প্রক্ষেপক বা প্রতিকর্ষণ বলকে যেসব রশ্মি নিয়ন্ত্রিত বা নষ্ট করে বিভিন্ন প্রকারের সংযোগাদি প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে সহায়ক হয়, তাদেরও এই রশ্মিগুলো নষ্ট করে দেয়। এই কারণে সব কণা বা তরঙ্গ অসুরক্ষিত হয়ে ডার্ক এনার্জির প্রহার দ্বারা খণ্ড-খণ্ড হতে থাকে। বিভিন্ন পরমাণু বা মূলকণার আকর্ষণ বল নিষ্প্রভাবী হয়ে যায়, যারফলে সব প্রকারের সংযুক্ত কণা বা লোক বিক্ষিপ্ত হতে থাকে আর ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড মূল সাম্যাবস্থার রূপে বিলীন হয়ে যায় অথবা কোথাও ক্ষেত্রীয় স্তরে খণ্ড প্রলয়ের মতো স্থিতি হয়ে যায়। সুপারনোবা আদির বিস্ফোরণের সময়েও অল্পকালের জন্য এই রশ্মিরই প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মিগুলো অত্যন্ত বিধ্বংসক হয়।
এখানে এটা ধ্যানে রাখার যোগ্য বিষয় হল যে মহাপ্রলয় বা খণ্ড প্রলয়ের প্রক্রিয়া সেইভাবে পূর্ণ ব্যবস্থিত, ক্রমবদ্ধ এবং বৈজ্ঞানীক পদ্ধতিতে হয়, যেভাবে সৃষ্টি নির্মাণের প্রক্রিয়া ব্যবস্থিত, বৈজ্ঞানিক এবং ক্রমবদ্ধ পদ্ধতিতে হয়। এই কারণে এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে চেতন সত্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে, এই প্রক্রিয়া মোটেও উচ্ছৃঙ্খলভাবে হয় না।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. সৃষ্টির মধ্যে উৎপন্ন পদার্থের কখনও না কখনও নিজের কারণ রূপ পদার্থে লয় অবশ্যই হয়।
2. এমন একটা সময় আসে, যখন আকর্ষণ বলের ক্ষয় আর প্রতিকর্ষণ বলের বৃদ্ধি হতে থাকে।
3. সৃষ্টি উৎপত্তির সময়ে আকর্ষণ বলেরই অস্তিত্ব থাকে আর প্রতিকর্ষণ বলের উদয় কিছু সময় পশ্চাৎ হয়।
4. যে গায়ত্রী রশ্মিগুলো আকর্ষণ ও সৃজন কর্মকে উৎপন্ন করে, সেই রশ্মিগুলোই কিছু বিকৃতির সঙ্গে বিনাশ কর্মকেও উৎপন্ন করে।
5. অপান রশ্মি ছন্দ রশ্মি থেকে পৃথক হলে পরে বিভিন্ন রশ্মি ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
6. সৃষ্টির অন্তিমে মনস্তত্ত্বও নিজের মূল উপাদান কারণ প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়।
7. যখন প্রলয় কাল আসে, তখন রশ্মির মধ্যে বাধা উৎপন্ন হয়। সেগুলো অব্যবস্থিত রূপে উৎপন্ন হয়। এই কারণে -
i. সেগুলো ডার্ক এনার্জির বাধক প্রভাবকে থামাতে
পারে না।
ii. আবেশিত কণার মাঝে আকর্ষণ বল সমাপ্ত হয়ে
যায়।
iii. আবেশ সমাপ্ত অথবা উদাসীনতাকে প্রাপ্ত করে।
iv. বিদ্যুৎ আবেশ যে রশ্মির কারণে উৎপন্ন হয়,
সেগুলো নিজের প্রভাব হারিয়ে ফেলে।
8. বিভিন্ন বলের উৎপাদিকা গায়ত্রী রশ্মিগুলোকে উচ্ছৃঙ্খল করে। এই কারণে বল সমাপ্ত হয়ে যায়।
9. সুপারনোবা আদির বিস্ফোরণের সময়ে অল্পকালের জন্য বিধ্বংসক রশ্মির প্রাধান্য থাকে।
10. মহাপ্রলয়ের প্রক্রিয়া পূর্ণ ব্যবস্থিত, ক্রমবদ্ধ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়, এই প্রক্রিয়া মোটেও উচ্ছৃঙ্খলভাবে হয় না।


অনুবাদকঃ আশীষ আর্য


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ