বেদ হল পরমেশ্বর প্রদত্ত এবং শুরুতে বেদের অধ্যাপক, আচার্য্য বেদ পড়ানোর জন্য গ্রন্থাত্তরের প্রয়োগ করতেন না। পরে বেদের অর্থকে বোঝার জন্য বেদের শাখাগুলিতে পাঠগুলিকে কোথাও কোথাও সরল শব্দ দিয়ে সুগম করা হয়েছে। ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহতেও এক ধরনের বিশেষ প্রকারের বেদের উপক্রম উপলব্ধ হয়।
নিঘন্টুতে বেদের কিছু শব্দের পর্যায় সংগ্রহ রয়েছে। নিরুক্ত পদ্ধতি থেকে বেদার্থকে সুস্পষ্ট বোধগম্য করার জন্য মহত্ত্বপূর্ণ যোগাদান হয়েছে। ব্যাকরণ শব্দসমূহের ব্যুৎপত্তি বলে দেয় এবং নিরুক্ত ব্যাখ্যা পদ্ধতির নির্দেশ করে। এই সমস্ত প্রয়াস বেদকে সুগম বোধগম্য করতে সহযোগী ছিল। কিন্তু ঐ সব ভাষ্য নয়। এতে ক্রমশঃ সমস্ত মন্ত্রের পদ-পদার্থ, অন্বয়, ব্যাখ্যা আদি উপলব্ধ
হয় না।




“এই ভাষ্য প্রাচীন আচার্য্যদের ভাষ্যের অনুকূল করা হচ্ছে। পরম্ভ যা রাবণ,উব্বট, সায়ণ এবং মহীধর আদি ভাষ্য করেছেন, তাঁরা সব মূলমন্ত্র এবং ঋষিকৃত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধ। আমি সেই ধরনের ভাষ্য করছি না। কেননা তাঁরা বেদের সত্যার্থতা এবং অপূর্বতা কিছুই জানতেন না। এবং এটা আমার যে ভাষ্যটি হচ্ছে সে তো বেদ বেদাঙ্গ, ঐতরৈয়, শতপথ ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের অনুসারে হচ্ছে। কেননা যা যা বেদের সনাতন ব্যাখ্যা, সে সব প্রমাণের দ্বারা যুক্ত করা হচ্ছে—এটি হল এর অপূর্বতা...এবং দ্বিতীয়তঃ এর অপূর্ব হওয়ার কারণ এইটি যে এতে কোন কথা অপ্রমাণ বা ব্যক্তিগত নিজের রীতিতে লেখা হয় না। এবং যে যে ভাষ্য সায়ণ, উব্বট, মহীধরাদি করেছেন, সে সব মূলর্থ এবং সনাতন বেদ ব্যাখ্যা রিরুদ্ধ। তথা যে যে এই নবীন ভাষ্যের অনুসারে ইংরেজি,জার্মানী, দক্ষিণী এবং বাংলাভাষা আদিতে হয়েছে, তারাও হল অশুদ্ধ।
“যেমন দেখো—সায়ণাচার্য্য বেদের শ্রেষ্ঠ অর্থকে না জেনে বলেছেন যে —সমস্ত বেদ ক্রিয়াকান্ডের-ই প্রতিপাদন করে। এটি তাঁর মিথ্যা কথা। এর উত্তর যা কিছু এই ভূমিকার পূর্ব প্রকরণে লিখেছি—তাকে দেখে নিও।”

স্বামী দয়ানন্দ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং শতপথ ব্রাহ্মণের প্রমাণ প্রস্তুত করে এই মন্ত্রের পরমেশ্বর পরক এবং রাজধর্মপরক ভাষ্য করেছেন। স্বামীজী উপসংহার রূপে লিখেছেন—
“এই কার্য্য ঐতরেয়, শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে। বিচার করা উচিৎ যে এই সত্য অর্থের লুপ্ত হওয়ায় মানুষকে ভ্রমিত করে বেদকে কতখানি অপমান করা হয়েছে—যেভাবে এই দোষ খন্ডিত হয়েছে ঠিক সেভাবে এই ভাষ্যের প্রবৃত্তি থেকে সেই দোষের নিবৃত্তি হয়ে যাবে।”
কথা আখ্যানগুলির বৈদিক স্বরূপঃ কিছু আখ্যানের সূত্র মূলরূপে বেদ সংহিতাতে পাওয়া যায়। বামমার্গী তন্ত্রগ্রন্থে এবং পুরাণ গ্রন্থ ব্রহ্মাবর্ত ভাগবৎ আদিতে শৃংগার প্রধানযুগে বামমার্গী, শৈবশাক্ত,ভাগবৎ আদি পৌরাণিক গ্রন্থে সেইসব কথাগুলির অত্যন্ত অশ্লীল, লজ্জাস্পদ,ভ্রষ্ট নগ্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আচার্য্য সায়ণ এবং মহীধর আদি সাম্প্রদায়িক তান্ত্রিক বিদ্বানেরা নিজেদের বেদভাষ্যে তাকে পল্লবিত করেছে। ইউরোপের খ্রীষ্টান মিশনারী বিদ্বানেরা সেই কথাগুলিকে আরও প্রকাশিত করেছে। সাথেই বেদ-ঋষিদের, ভারতীয় পরম্পরাগুলির নিন্দাত্মক ব্যাঙ্গকরেছে এবং বৈদিক সংস্কৃতি এবং বৈদিক কালের ঐতিহাসিকতার লজ্জাস্পদ পরম্পরাগুলি থেকে পরিপূর্ণ বর্ণনা প্রচারিত করেছে। স্বামী দয়ানন্দ বৈদিক মূল এবং স্বরূপের
সত্যার্থপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন। এক-দুটির উদাহরণ দ্রষ্টব্যঃ—

ঋগ্বেদে মন্ত্র আছে—–(১) দ্যৌর্মে পিতা জনিতা...পিতা দুহিতুৰ্গৰ্ভমাদধাত্৷৷ (ঋগ্বেদ ১।১৬৪।৩৩) এই কথা রূপক অলংকারে ছিল—এখানে প্রজাপতি বলছেন সূর্য্যকে, যার দুইটি কন্যা—একটি হল প্রকাশ, দ্বিতীয়টি হল ঊষা। কেননা যে যার থেকে উৎপন্ন হয়, সে তারই সন্তান হয়। এইজন্য উষা যে নাকি তিন চার ঘন্টা রাত্রি অবশেষ থাকায় পূর্ব দিকে লালিমাযুক্ত দেখা যায়,সে সূর্য্যের কিরণে উৎপন্ন হওয়ার কারণে তারই কন্যা হয়। তার থেকে ঊষার সম্মুখে যে প্রথম সূর্যকিরণ গিয়ে পড়ে, সেইটাই বীৰ্য্যস্থাপন(তেজস্থাপন)-র সমান। তাদের দুজনের সমাগমে পুত্র অর্থাৎ দিবস উৎপন্ন হয়।”
স্বামীজীর এই ব্যাখ্যা হল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ প. ৩, কন্ডিকা. ৩৩-৩৪র আধারের উপর। (২) “পিতা দুহিতুৰ্গৰ্ভমাদধাত্॥” (স-১-১৬৪-৩৩)—এই
রূপক অলংকার যুক্ত কাহিনীর নিরুক্তে ব্যাখ্যাকে স্বামীজী প্রস্তুত করেছেন—
‘“তত্র পিতা দুহিতুগর্ভম্ দধাতি পর্জন্যঃ পৃথিক্যাঃ” (নিরক্ত ৪। ২১)নিরুতে রূপকালংকারের কাহিনী লেখা আছে যে—–পিতার সমান পর্জন্য অর্থাৎ জলরূপ যে মেঘ, তাঁর পৃথিবীরূপ দুহিতা অর্থাৎ কন্যা। কেননা পৃথিবীর উৎপত্তি জল থেকেই। যখন সে সেই কন্যা (পৃথিবী)-তে বৃষ্টি দ্বারা জলরূপ বীর্য্যকে ধারণ
করে তখন তাঁতে গর্ভ হয়ে ঔষধি আদি অনেক পুত্র উৎপন্ন হয়।”

৬-৪-১৮) রাত্রিরহল্যা। কস্মাদহর্দিনং লীয়তেঽস্যাং, তস্মাদ রাত্রিঃ অহল্যা উচ্চ্যতে। স চন্দ্ৰমাঃ সর্বাণি ভূতানি প্রমোদয়তি, স্বস্ত্রিয়া অহল্যয়া সুখয়তি।
স্বামী দয়ানন্দ লিখেছেন যে এই কাহিনীকে পুরাণে বিকৃত করে লেখা হয়েছে। সত্য গ্রন্থে এইরকম নাই। ওতে এই রীতিতে আছে—
“সূর্য্যের নাম ইন্দ্র, রাত্রির অহল্যা তথা চন্দ্রমার নাম হল গৌতম। এখানে রাত্রি এবং চন্দ্রমার স্ত্রী-পুরুষের সমান রূপক-অলংকার রয়েছে। চন্দ্রমা নিজের স্ত্রী রাত্রির দ্বারা সমস্ত প্রাণীকে আনন্দ করায় এবং সেই রাত্রির জার হল আদিত্য অর্থাৎ যার উদয়ের কারণে রাত্রি অন্তর্ধান হয়ে যায় এবং জার অর্থাৎ এই সূর্য্যই রাত্রির রূপশৃঙ্গারকে খারাপ এবং বিকৃত করে দেয়। এইজন্য এই স্ত্রী-পুরুষের রূপক-অলংকার বাঁধা হয়েছে যে যেমন স্ত্রীপুরুষ মিলেমিশে থাকে ঠিক তেমনি চন্দ্রমা এবং রাত্রিও সাথে সাথে থাকে। চন্দ্রমার নাম গৌতম এইজন্য যে, সে অত্যন্ত বেগের সাথে চলে। এবং রাত্রিকে ‘অহল্যা'এইজন্য বলে যে তাতে দিন লয় হয়ে যায় তথা সূর্য্য রাত্রিকে নিবৃত্ত করে দেয়, এইজন্য এ তার ‘জার’ বলে কথিত হয়। এর শুদ্ধ-শ্লীল অর্থ লিখে স্বামীজী লিখেছেন যে—“এই উত্তম রূপকালংকার বিদ্যাকে অল্পবুদ্ধি পুরুষেরা বিকৃত করে সমস্ত মানুষকে হানিকারক ফল ধরে দিয়েছে। স্বামী দয়ানন্দজী অনেক পৌরাণিক কাহিনীর প্রাচীন শাস্ত্রানুমোদিত রূপকে প্রস্তুত করেছেন। উনি বিকৃত পৌরাণিক মিথকীয় (মিথ্যা) স্বরূপকে ত্যাগ করে প্রাচীন স্বরূপের পক্ষধর ছিলেন।
ঋগ্বেদের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে সায়নাচার্যের নাম বিখ্যাত হলেও তাঁর আগেও বিভিন্ন ভাষ্যকার, যেমন স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, উদ্গীথ, প্রমুখ, ঋগ্বেদের ভাষ্য করেছেন।
ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণ দুটি, ঐতরেয় ও কৌষীতকী, এদের মধ্যে ঐতরেয় প্রাচীনতর, যার ভৌগোলিক পটভূমিকা কুরুপাঞ্চাল ও বশঊশীনর অঞ্চল। কৃষ্ণ যজুর্বেদের একটি মাত্র ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় – তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বহু গবেষিত হচ্ছে শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণ। এর রচয়িতা হিসেবে দুজনের নাম পাওয়া যায়, শাণ্ডিল্য ও যাজ্ঞবল্ক্য। শাণ্ডিল্য রচিত অংশটির ভৌগোলিক পটভূমিকা ভারতের উত্তর-পশ্চিম আর যাজ্ঞবল্ক্য রচিত অংশটিতে বিদেহর মতো দক্ষিণ-পূর্বের উল্লেখ আছে। তাই মনে করা হয় এই ব্রাহ্মণ সুদীর্ঘ কাল ধরে রচিত। প্রত্যেক সংহিতার এক বা একাধিক ব্রাহ্মণ থাকলেও প্রতি সংহিতার নিজস্ব আরণ্যক বা উপনিষদ নেই। শুধু তিন ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম – ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকী এবং যজুর্বেদের তৈত্তিরীয়, যাদের নিজস্ব সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রয়েছে।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ