অত ঊর্ধ্বম্ ত্রয়োऽপ্যেতে য়থাকালমসম্স্কৃতাঃ।
সাবিত্রীপতিতা ব্রাত্যা ভবন্ত্যার্য়বিগর্হিতাঃ।।
(মনুঃ ২|১৪)
অর্থাৎ - যে আর্য সন্তান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গুরুর দ্বারা দীক্ষিত হয়ে ব্রহ্মচর্যব্রতের পালন করবে না, সে ব্রাত্য হয়ে যাবে আর আর্যসমাজ থেকে বের করে দেওয়া হবে।
আর্য সভ্যতার আদিম রাজনীতিজ্ঞ ভগবান্ মনু বলেছেন -
এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ।
স্বম্ স্বম্ চরিত্রম্ শিক্ষেরন্পৃথিব্যাম্ সর্বমানবাঃ।।
(মনুঃ ১|১৩৯)
অর্থাৎ - ব্রহ্মাবর্ত্তের ব্রাহ্মণদের থেকে সমস্ত সংসারের মানুষ সদাচারের শিক্ষা প্রাপ্ত করবে।
প্রাচীন আর্য ঋষি নিজের এরকম বৈদিক শিক্ষা আর সদাচার দ্বারা সংসারের সমস্ত জাতিকে নিজের শিষ্য বানিয়ে তাদের উপর নিজের প্রভাব জমাতেন। আজও বৈদিক বিচারের প্রচার দ্বারা আর আর্য-আচরণকে নিজের সরল আর তপস্বী ব্যবহারের দ্বারা আমরা অন্য সভ্য জাতিদের নিকট পৌঁছাতে পারি আর তাদের প্রভাবিত করতে পারি। এরকমটা করা আমাদের সভ্যতার একটা বিশেষ অঙ্গ।
আর্যবর্ত্তে যুদ্ধকে #আপদ্ধর্ম মানা হয়েছে। যেভাবে ভিন্ন বিপদের সময়ে ভিন্ন আপদ্ধর্মের যোজনা হয়ে থাকে, সেইভাবে অসভ্য, বর্বরকে শিক্ষিত করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োগও স্বীকার করা হয়েছিল। যুদ্ধের দ্বারা আর্যরা সর্বদা আততায়ী, বর্বরদের বশ করে রাখতো। এই কারণেই আর্যসভ্যতার মধ্যে যুদ্ধনিপুণ যোদ্ধার বড়ো মান রয়েছে। যে আর্য যুদ্ধে ভয় পেতো সে আর্য বলার অধিকারী থাকতো না। এই কারণেই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধের থেকে সরে যেতে দেখে বলেছিলেন যে - "অনার্য়জুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন" (গীতাঃ ২|২)
অর্থাৎ হে অর্জুন! তোমার এই কথাগুলো অস্বর্গ্য, অপ্রীতিকর আর অনার্যদের মতো। এখানে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা ভীতুকে অনার্য বলা হয়েছে আর দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি আর এরকমই অন্য আততায়ীদের বর্বর বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা জ্ঞাত হচ্ছে যে যুদ্ধ হল আর্যসভ্যতার একটা বিশেষ অঙ্গ, কারণ বিনা যুদ্ধ করে - বিনা বর্বরদের শিক্ষা দিয়ে সরল সাধারণ আর্যসমাজ সুখ-শান্তি পাবে না আর না চক্রবর্তী রাজ্য স্থাপিত হতে পারবে। এই কারণেই আর্যরা নিজেদের সভ্যতার মধ্যে যুদ্ধকে অবশ্যক বলে মেনেছে।
সভ্য শত্রুদের প্রতি আর্যদের সর্বদা এই রীতিটাই ছিল তারা সর্বদা বর্বরদের দণ্ড দ্বারা আর সভ্যদের উপদেশ ও তপ দ্বারা - সরলতা আর ধার্মিকতার দ্বারাই বশ করে নেওয়ার আয়োজন করেছে, তাই তারা শুদ্ধধর্মের কেন্দ্র পরিব্রাটের দ্বারা পরাস্ত করেছে আর সর্বদা স্বতন্ত্রতার ধ্যেয় নিজেদের সম্মুখে রেখেছে। তারা স্বতন্ত্রতাকে নিজেদের সভ্যতার মূল মেনেছে আর একথাকে সারা জীবনে কখনো ভুলেনি যে "সর্বম্ পরবশম্ দুঃখম্ সর্বমাত্মবশম্ সুখম্" (মনুঃ ৪|১৬০), অর্থাৎ পরবশতাই হল মহান দুঃখ আর স্বতন্ত্রতাই হল মহান সুখ। এটাই হচ্ছে কারণ যে আর্যদের এই মনোবৃত্তিকে সফল বানানোর জন্য ভগবান্ মনু উপদেশ করেছেন -
স্ববীর্য়াদ্রাজবীর্য়াচ্চ স্ববীর্য়ম্ বলবত্তরম্।
তস্মাত্ স্বেনৈব বীর্য়েণ নিগৃহ্ণীয়াদরীন্ দ্বিজঃ।।
(মনুসংহিতাঃ ১১|৩২)
অর্থাৎ - আত্মবল আর রাজবলের মধ্যে নিজের আত্মবলই হচ্ছে মহান, এইজন্য আর্যদের উচিত যে তারা নিজের সভ্য শত্রুকে নিজের আত্মিক বল দ্বারাই নিবারণ করবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম আর আপদ্ধর্মের সারাংশ।
আর্যসভ্যতার মধ্যে যুদ্ধের জন্য স্থান তো রয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের মর্যাদাও রয়েছে। "কখন, কার সঙ্গে, কিভাবে যুদ্ধ করা উচিত" - এই সব কথা আর্যদের সভ্যতার মধ্যে বিশেষ স্থান রাখতো, কারণ আর্যরা যুদ্ধের অর্থ এরকমটা মনে করতো না যে বিনা চিন্তাভাবনা করে যেখানে দেখো সেখানেই যুদ্ধ করে মরো। এইজন্য যুদ্ধের বিষয়ে ভগবান্ মনু লিখেছেন -
অনিত্যো বিজয়ো য়স্মাদ্ দৃশ্যতে য়ুদ্ধমানয়োঃ।
পরাজয়শ্চ সম্গ্রামে তস্মাদ্যুদ্ধম্ বিবর্জয়েত্।।
এবম্ বিজয়মানস্য য়েऽস্য স্যুঃ পরিপন্থিনঃ।
তানানয়েদ্বশম্ সর্বান্ সামাদিভিরুপক্রমৈঃ।।
য়দি তে তু ন তিষ্ঠেয়ুরুপায়ৈঃ প্রথমৈস্ত্রিভিঃ।
দণ্ডেনৈব প্রসহ্যৈতাঁশ্ছনকৈর্বশমানয়েত্।।
(মনুঃ ৭|১৯৯, ১০৭, ১০৮)
অর্থাৎ - সংগ্রামের মধ্যে যুদ্ধকারীর জয় আর পরাজয় অনিত্য, তাই যুদ্ধ করা উচিত নয়। সবার আগে তো বিরোধীকে সাম, দান, ভেদ উপায়ের দ্বারাই বশ করা উচিত, কিন্তু যদি সামাদি তিনটি উপায় দ্বারা শত্রু না মানে তাহলে দণ্ড (যুদ্ধ) করেই বশ করা উচিত।
এই প্রমাণগুলোর দ্বারা বোঝা যায় যে যুদ্ধ খুব বিশেষ কোনো আবশ্যক বস্তু নয়। সেটা তো সেই মূর্খ, জংলী, বর্বর আর অত্যাচারীদের বশ করার জন্য যারা না জ্ঞান জানে, না বিজ্ঞান, না নীতি জানে, না ধর্ম আর না হানি-লাভ জানে, প্রত্যুত লোকেদের উপর অত্যাচার করাই যাদের উদ্দ্যেশ্য। যুদ্ধ তাদের জন্য নয় যারা প্রত্যেক বিষয়কে ভালো করে বুঝতে পারে। এটাই হল কারণ যে আর্যরা সর্বদা বর্বরদের সঙ্গেই যুদ্ধ করেছে আর তাদেরই পরাস্ত করেছে। রাবণ থেকে শুরু করে সিকন্দর, গোরী, গজনী আর ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত দের সঙ্গে আর্যরা যুদ্ধ করতে থাকে আর সকলকে পরাস্ত করেছে। যদিও মুসলমানদের পরাস্ত করতে তাদের চারশ বছর লেগেছিল তথাপি শেষে তাদেরও পরাস্ত করে দেয়। বাকি রইলো ইউরোপবাসী, তারাও শুরুতে ব্যবসায়িক রূপে এখানে আসে আর ধীরে-ধীরে দেশের স্বামী হয়ে যায়, অতঃ এদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সঠিক ভাবে সুযোগই আসেনি। এরা শুরুতেই নিজেদের সভ্যতা, প্রবন্ধ, জ্ঞান আর কলাকৌশলের প্রভাব আমাদের উপরে এমনভাবে জমায় যে আমরা এদের নিজের শত্রুই মনে করিনি। শত্রু না মনে করার কারণ এটা ছিল যে এরা বর্বর নয় তবে সভ্য আর উদাত্ত চিন্তাবিদ ছিল। আর্যদের বিশ্বাস ছিল যে এরকম লোকেদের থেকে অধিক ভয় নেই। আর্যদের এই অনুমান ভুল ছিল। তাদের অনুমানের প্রমাণ সময়-সময়ে পাওয়া যায় আর বিশেষরূপে এইসময় পাওয়া যাচ্ছে। আজ সমস্ত সংসারের মধ্যে সাম্যবাদের যে চর্চা ছড়াচ্ছে, জার্মান যুদ্ধের সময় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের উপরে অধিকার করার জন্য চেষ্টা করেনি, ইংল্যান্ডের অনেক অধীন দেশ ধীরে-ধীরে স্বতন্ত্র হচ্ছে আর ভারতবর্ষের মধ্যেও স্বতন্ত্রতার শঙ্খনাদ চতুর্দিকে বাজছে, এই সমস্ত সংসারব্যাপিনী স্বতন্ত্রতার জন্মদাতা আর বিস্তারকর্তা কে? আমরা, নাকি চীনারা, নাকি আমেরিকানরা, নাকি আফগানিস্থানের পাঠানরা?
যুদ্ধের সাথে ধর্ম প্রচারের দ্বারা আর্যরা নিজেদের বিচার আর আচরণ সংসারের মধ্যে প্রচার করতো। যেভাবে যুদ্ধের দ্বারা আততায়ী, বর্বরদের আর্যদের রাজা শিক্ষিত করতো, ঠিক সেইভাবে ধর্ম প্রচারের দ্বারা সভ্য মানুষদের আর্যদের পরিব্রাট্ শিক্ষিত করতো। যখন কোনো বর্বর তাদের অত্যাচার করতো তখন তাকে যুদ্ধের দ্বারা পরাস্ত করতো আর যখন কোনো সভ্যজাতি কোনো রাজনৈতিক চাতুর্য দ্বারা তাদের বা তাদের সভ্যতার নাশ করতে চাইতো তখন তারা তাকে নিজেদের ধার্মিক আচরণ-প্রচারের দ্বারা বশ করতো আর নিজের সভ্যতার রক্ষা করে নিতো। একথার উদাহরণ আজ আমরা নিজের চোখে দেখছি। আজ আমরা প্রাচীন আর্যসভ্যতার কেবল একটা ছোট্ট অঙ্গ চরকা আর তাঁতের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপের সভ্যজাতিদের যান্ত্রিক কুচক্রকে ঢিলে করে দিয়েছি। এই ভাবেই যদি আমরা বৈদিক আচরণ-ব্যবহারের অনুসারে অর্থ আর কাম সম্বন্ধিত প্রত্যেক ব্যবহারের মধ্যে নিজেদের প্রাচীন আর্যদের মতো সরল জীবনযাপন বানিয়ে নেই, আর নিজেদের প্রাচীন আর্যদের মতো তপস্বীজীবন যাপন করি তাহলে বিনা কোনো কামান-বন্দুক, বিনা কোনো যুদ্ধোপকরণে আমরা না কেবল ইউরোপের বর্তমান নীতিকে পরাস্ত করে তার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো, প্রত্যুত সংসারের অর্থ আর কাম-সম্বন্ধীয় একটা অনেক বড়ো আর আবশ্যক সমস্যাকে সমাধান করতেও সক্ষম হতে পারবো, যেই সমাধানের খোঁজে ইউরোপের উচ্চ মস্তিষ্ক এক শতাব্দী ধরে ব্যগ্র আর নানা প্রকারের শিক্ষা, সভ্যতা আর ব্যবস্থার প্রচার করে-করে সংসারকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে.....
ঋগ্বেদ ৬|৪৭|৭ এরমধ্যে খুবই স্পষ্ট রীতির সঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে যে "ভবা সুনী তিরুত বামনীতিঃ", অর্থাৎ সুনীতি - ধর্ম দ্বারা অথবা বামনীতি - আপদ্ধর্ম দ্বারাই সর্বদা কাজ সিদ্ধ করা উচিত। এর কারণ স্পষ্ট যে, যখন দুষ্ট মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হয় আর দুঃখের থেকে ত্রাস উৎপন্ন হয় - আসন্ন মৃত্যুর ভয়ংকর দুঃখ সামনে দেখা যায় তখন আপদ্ধর্মের দ্বারাই নিজের রক্ষা করা যেতে পারে। বলা হয় যে, হিন্দু আর মুসলমানদের লড়াইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ মুসলমান সেনাধ্যক্ষ নিজের সেনার সামনে অনেকগুলো গাভীকে দাঁড় করিয়ে দিতো। এর ফল এই হতো যে, হিন্দু সৈনিক গোবধের ভয়ে গুলি চালানো বন্ধ করে দিতো আর মুসলমান সৈনিক তাদের উপরে গুলি চালিয়ে বিজয় প্রাপ্ত করে নিতো, কিন্তু যদি হিন্দু সৈনিক আপদ্ধর্মের অনুসারে সেই সময় গোবধকে পাপ না মনে করতো আর গুলি চালানোর আজ্ঞা দিয়ে দিতো তাহলে আজ দেশের মধ্যে হিন্দুদের সামনে এত বড়ো গোসংহার হতো না। এর উপরে আপদ্ধর্মের জ্ঞাতা কোনো এক নীতিনিপুণ সত্যই বলেছিল যে, "ব্রজন্তি তে মূঢ়ধিয়ঃ পরাভবম্ ভবন্তি মায়াবিষু য়ে ন মায়িনঃ" (কিরাতার্জুনীয়ম্ ১|৩০), অর্থাৎ যে মায়াবিয়দের মায়াকে বুঝতে পারে না সে মূঢ়বুদ্ধি অবশ্যই পরাজিত হয়, এইজন্যই বলা হয়েছে যে "য়স্মিন্যথা বর্ত্ততে য়ো মনুষ্যঃ তম্স্মিস্তথা বর্তিতব্যম্ স ধর্মঃ" (মহাভারত শান্তি০ ১০৯|৩০), অর্থাৎ যে যার সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করে তার সঙ্গে সেই ধরনের ব্যবহার করাই হল ধর্ম, কারণ "শঠস্য শাঠ্যম্ শঠ এব বেত্তি" অর্থাৎ শঠকে শঠই শিক্ষা দিতে পারে। এর কারণ এই হল যে, আপত্তির সময় কর্তব্য-অকর্তব্য আর অকর্তব্য কর্তব্য হয়ে যায়। এইজন্য ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে (৪|১৮) বলেছেন যে -
কর্মণ্যকর্ম য়ঃ পশ্যেদকর্মণি চ কর্ম য়ঃ।
স বুদ্ধিমান্মনুষ্যেষু স য়ুক্তঃ কৃত্স্নকর্মকৃত্।।
অর্থাৎ - যে কর্মের মধ্যে অকর্ম আর অকর্মের মধ্যে কর্ম দেখে, মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান সে হয়, এইজন্য যখন যেখানে যেরকম আবশ্যকতা হবে তখন সেখানে সেরকমই ব্যবহার করা উচিত। এটাই হল আপদ্ধর্মের রহস্য আর এটাই হল তার তাৎপর্য।
আর্যশাস্ত্রের মধ্যে বেদের অতিরিক্ত যেসব স্মৃতিগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোও এক ধরনের আপদ্ধর্মেরই থলি। শ্রুতির সামনে স্মৃতির কোনো গণনা নেই, কিন্তু কখনও-কখনও স্মৃতি দিয়েই কাজ করা হয়ে থাকে, আপদ্ধর্মই হল এর কারণ। একথাটা মান্য যে, মানুষের সেই সমাজই উন্নত থাকতে পারে যারমধ্যে ঋত আর সত্যের তত্বকে সঠিকভাবে বোঝা হয়েছে আর উভয়ের ব্যবহারের কুঞ্জী বলে দেওয়া হয়েছে। আপদ্ধর্ম বা নীতিধর্মের মধ্যে কত দূর পর্যন্ত পাপ রয়েছে আর কত দূর পর্যন্ত ধর্ম রয়েছে, একথার নির্ণয় করা সহজ। শুদ্ধধর্মের উপরে আসা বাঁধার নিবারণ করার জন্য যে বামনীতির দ্বারা কাজ করা হয়েছে যদি সেটা ধর্মোদ্ধারের পরেই ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তো সেটা সংযত আপদ্ধর্ম, অর্থাৎ ঋত নামের নীতিই বলা হবে, কিন্তু যদি ধর্মোদ্ধারের পরেও সেই নীতি ব্যবহারের মধ্যে রেখে দেওয়া হয় তাহলে সেটা ঋত নয় বরং পাপই বলা হবে। ঋতের মধ্যে অর্থাৎ আপদ্ধর্মের মধ্যে বা বামনীতির মধ্যে পাপাংশ রয়েছে, কিন্তু সেটা ধর্মোদ্ধারের কারণ হওয়ার জন্য পাপ বলা হয় না, কিন্তু সেটাই যদি নিজের মনোরঞ্জনের জন্য, অন্যের হানির জন্য সর্বদা ব্যবহারে নিয়ে আসার জন্য নিযুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে অবশ্যই পাপ হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মনুস্মৃতির ১১|৩০, ২৮ এরমধ্যে লেখা রয়েছে যে -
প্রভুঃ প্রথমকল্পস্য য়োऽনুকল্পেন বর্ত্ততে।
ন সাম্পারায়িকম্ তস্য দুর্মতের্বিদ্যতে ফলম্।।
আপত্কল্পেন য়ো ধর্মম্ কুরুতেऽনাপদি দ্বিজঃ।
স নাপ্নোতি ফলম্ তস্য পরত্রেতি বিচারিতম্।।
(মনুসংহিতাঃ ১১|৩০, ২৮)
অর্থাৎ - ধর্ম পালনের শক্তি থাকার পরেও যে আপদ্ধর্মের সেবন করে সে পরলোকে ফল পায় না, একইভাবে আপত্কালের ধর্মকে যে ধর্মের সময়ে করে, তার কর্মও পরলোকে নিষ্ফল হয়ে যায়, অর্থাৎ তাদের দুজনকেই পাপী মনে করা হয়।
এইসব প্রমাণের দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ধর্ম আর আপদ্ধর্মের ব্যবহার নিজের-নিজের সময়েই করা উচিত।
আপদ্ধর্মের উত্তম উপযোগ হল এটাই যে, তাকে ধর্মোদ্ধারের জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ধর্মোদ্ধার হয়ে যাওয়ার পরে, ধর্ম সংকট নিবৃত্তির পরে আর মৃত্যুভয় সরে যাওয়ার পরে বামনীতি অথবা আপদ্ধর্মের ব্যবহার ছেড়ে দেওয়া উচিত, এটাই হল ধর্ম আর আপদ্ধর্মের ব্যবস্থা। এর একটি উত্তম উদাহরণ ছান্দোগ্য উপনিষদ ১|১০|৩ এরমধ্যে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে যে, কুরুদেশের মধ্যে শিলাবৃষ্টির জন্য অকাল পরে যায়। অকালের কারণে উষস্তি ঋষি নিজের স্ত্রী সহিত মাহুতের গ্রামে যায় আর মাহুতকে নোংরা পাত্রে খেতে দেখে ভিক্ষা চায়। মাহুত বলে যে আমার কাছে আর কোনো পাত্র নেই, কেবল এই পাত্রটাই রয়েছে যারমধ্যে আমি খাচ্ছি। উষস্তি বলে যে এটাতেই আমাদের কিছু দাও। মাহুত উষস্তিকে সেই বাসনের মধ্যেই আহার আর জল দেয়। উষস্তি বলে যে এই জলটা এঁটো। এতে মাহুত বলে যে "ন স্বিদেতেऽপ্যুচ্ছিষ্টা ইতি", অর্থাৎ তাহলে কুল্মাষ কি এঁটো ছিল না? তখন উষস্তি বলে যে "ন বা অজীবিষ্যমিমানখাদন্নিতি, কামো মে উদপানমিতি", অর্থাৎ এই আহার না পেলে আমরা বাঁচতে পারতাম না, কিন্তু জল তো সর্বত্র ভরে পরে রয়েছে।
এই কাহিনীর মধ্যে ধর্ম আর আপদ্ধর্মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে আহারের অভাবে মৃত্যুর ভয় ছিল তা আপদ্ধর্মের দ্বারা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু যে জলের অভাবে মৃত্যুর ভয় ছিল না, তারজন্য শুদ্ধধর্মের ব্যবহার করা হয়েছে আর এঁটো জল গ্রহণ করা হয়নি। এটাই হল আপদ্ধর্মের আসল পরীক্ষা।
প্রাচীন ঋষিরা এই ধরনের আপদ্ধর্মকে প্রত্যেক সময়ের জন্য খুব যত্ন সহকারে স্থির রেখেছে, এইজন্য সংস্কারের সময় নিশ্চিত করা পর্যন্ত তারা "সর্বকালমিত্যেকে" এর সিদ্ধান্ত স্থির রেখেছে। এটাই হল ধর্ম আর আপদ্ধর্মের রহস্য, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এরকম সময় না আসে যে এখন ধর্মই চলে যাচ্ছে, মৃত্যুই নিকট চলে আসছে অথবা জাতি বা রাষ্ট্রেরই নাশ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার অনুষ্ঠান করা উচিত নয়। অথর্ববেদের আজ্ঞানুসারে প্রজা দুঃখী হলে পরে, রাষ্ট্র দুঃখী হলে পরে আর নিজের ধর্মে সংকট আসলে পরেই ঋতের ব্যবহার করা উচিত, এটাই হল নীতি।
ভগবান্ মনু বলেছেন যে -
বিশ্বৈশ্চ দেবৈঃ সাধ্যৈশ্চ ব্রাহ্মণৈশ্চ মহর্ষিভিঃ।
আপত্সু মরণাদ্ভীতৈর্বিধেঃ প্রতিনিধিঃ কৃতঃ।।
(মনুসংহিতা ১১|২৯)
অর্থাৎ - সকল দেব, সাধ্য, ব্রাহ্মণ আর ঋষিগণ আপদ্কালের সময় মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য ধর্মের প্রতিনিধি এই আপদ্ধর্মের রচনা করেছে।
একে নীতিও বলা হয়। এই নীতি শুদ্ধ সত্যের আস-পাশেই থাকে। একেই বেদের মধ্যে ঋত বলা হয়েছে। বেদের মধ্যে "ঋতম্ চ সত্যম্ চ" (ঋঃ ১০|১৯০|১), এর মতো এই ঋত সত্যের সঙ্গেই আসে, কারণ সত্য হল শুদ্ধধর্ম আর ঋত হল আপদ্ধর্ম। এই আপদ্ধর্ম ধার্মিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক তিন প্রকারের হয়ে থাকে। অথর্ববেদের ৮|৯|১৩ এরমধ্যে লেখা রয়েছে যে -
ঋতস্য পন্থামনু তিস্র আগুস্রয়ো ঘর্মা অনু রেত আগুঃ।
প্রজামেকা জিন্বত্যূর্জমেকা রাষ্ট্রমেকা রক্ষতি দেবয়ূনাম্।।
অর্থাৎ - ঋতের তিনটি মার্গ চলে আর তিনটিকে অনুধর্মা বলে - প্রথমটি প্রজা (সমাজের) বলের রক্ষা করে, দ্বিতীয়টি রাষ্ট্র (রাজনীতির) রক্ষা করে আর তৃতীয়টি ব্যক্তি (ধর্মের) রক্ষা করে, অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধার্মিক তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে অনুধর্ম অর্থাৎ ঋতের তিনটি মার্গ চলে।
অহিম্সকৈরাত্মবিদ্ভিঃ সর্বভূতহিতে রতৈঃ।
ভবেত্ কৃতয়ুগপ্রাপ্তিরাশীঃ কর্মবিবর্জিতা।
(মহা০ শা০ ৩৪৮|৬৩)
অর্থাৎ - আত্মজ্ঞানী, অহিংসক, একান্ত ধর্মের জ্ঞানী আর প্রাণীমাত্রের শুভকারী পুরুষদের দিয়ে যদি এই জগৎটা ভরে যায় তাহলে আশীঃকর্ম অর্থাৎ কাম্য অথবা স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা করে থাকা সমস্ত কর্ম এই জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়ে পুনঃ কৃতযুগ প্রাপ্ত হয়ে যাবে। কারণ এরকম স্থিতিতে সমস্ত পুরুষ জ্ঞানবান হওয়ার কারণে কেউ কারও ক্ষতি তো করবেই না প্রত্যুত প্রত্যেকটা মানুষ সকলের কল্যাণের উপর ধ্যান দিয়ে তদনুসারেই শুদ্ধ অন্তঃকরণ আর নিষ্কামবুদ্ধির দ্বারা নিজের-নিজের ব্যবহার করবে। আমাদের শাস্ত্রকারের মত হল, অনেক প্রাচীনকালে সমাজের এরকমই স্থিতি ছিল আর সেটা পুনঃ কখনও না কখনও প্রাপ্ত হবেই।"
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ