ন্যায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা কিবৃণুতে তণূঁ স্বাম।। কঠোপনিষদ্-১/২/২৩
পদার্থ-( অয়ম্) এই পূর্বোক্ত ( আত্মা) সর্বত্র ব্যাপক পরম- ব্রহ্ম ( প্রবচনেন) অধ্যাপন বা উপদেশ দ্বারা ( ন, লভ্যঃ) প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য নয় ( ন, মেধয়া )১ শাস্ত্রের অর্থকে ধারণ করে বুদ্ধি দ্বারা প্রাপ্ত হয় না ( ন, বহুনা, শ্রেতেন) বহু শাস্ত্রকে পড়ে তথা শাস্ত্রসম্বন্ধী উপদেশকে শুনা থেকেও প্রাপ্ত হয় না। তাহলে ব্রহ্মের প্রাপ্তি কিরূপ হয়? তার উপায় বলা হয়েছে-( এষঃ) এই পরমব্রহ্ম ( যম্,এব) যে উপাসকেই ( বৃণুতে) অনুগ্রহ করে স্বীকার করেন ( তেন) সেই যোগ্যাধিকারী পুরুষ দ্বারা ওই ব্রহ্ম ( লভ্যঃ) প্রাপ্ত করার যোগ্য হয় ( এষঃ,আত্মা) এই ব্যাপক পরমব্রহ্ম ( তস্য) সেই যোগসাধনা সম্পন্ন পুরুষের জন্য ( তনূম্ )২ আত্মস্বরূপ অথবা ব্যাপকজ্ঞানকে ( বৃণুতে) সত্য প্রেরণাদি দ্বারা প্রকাশিত করেন।
টিপ্পণী-
১,মেধা=মতৌ ধীয়তে। ( নিরুক্ত ৩/১৯) মেধৃ সঙ্গমে ( ভ্বা০) মেধা আশুগ্রহণে ( কণ্ডবা০) ধার্তোবা "অঙ্" প্রত্যয়ে স্ত্রিয়াম্ টাপি রূপম্। মেধায়া ধারণাবত্যা বুদ্ধয়া ( ঋ০ ভূ০ ১৪৯) যথার্থ ধারণকারী বুদ্ধিকে। ( আর্যাভিবিনয়০ ২/৫৩)
২,মহর্ষি-দয়ানন্দকৃতেভাষ্যে- "তনু) পদস্যার্থাঃ-শরীরবদ্ বিস্তারকম্ ( যজু০ ১৫/৭) বিস্তৃতা ব্যাপ্তিঃ ( যজু০ ৫/৬) বিদ্যাবিস্তৃতিঃ ( যজু০ ৫/৪০) আত্মা বৈ তনুঃ।। ( শত০ ৬/৭/২/৬)
ভাবার্থ-সর্বজ্ঞ,অনন্ত,সর্বান্তর্যামী,সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মাদি বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পন্ন পরমব্রহ্ম কেবল পঠন-পাঠন তথা শ্রবণ- শ্রাবণ ( শুনে-আবৃত্তি) দ্বারা জানা যায় না। এবং বেদাদি শাস্ত্রকে শ্রবণ করে বহুশ্রুত অনুভবী বিদ্বান্ হয়েছে,তারাও পরমব্রহ্মের প্রাপ্তির যোগ্যাধিকারী হতে পারে না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত শমদমাদি সাধনকে অবলম্বন করে যোগাঙ্গের অনুষ্ঠান দ্বারা নিজের বাহ্যিক তথা অভ্যান্তরীণ অশুদ্ধির ক্ষয় করতে সক্ষম নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আভিধানিক জ্ঞান অসম্পূর্ণই থেকে যায়। যেমন কাউকে সৎমার্গের পথ জিজ্ঞাসা করে সেই মার্গের উপর না চলে তবে সে লক্ষ্য প্রাপ্তি করতে পারবে না,তেমনই ব্রহ্ম-প্রপ্তির জন্য সত্য-জ্ঞান,প্রবচনাদিও আবশ্যক হয় কিন্তু তাদের পূর্ণতা অন্তঃকরণেরর শুদ্ধি তথা ঈশ্বরানুগ্রহের ব্যতীত সম্ভব নয়। যোগদর্শনকার ব্রহ্মপ্রাপ্তির যোগ্যতা বর্ণনা করে লিখেছেন-
সত্ত্বশুদ্ধিঃ সৌমনস্যৈকাগ্রয়েন্দ্রিয়জয়াত্মদর্শনযোগ্যত্বানি চ।
( যো০ ২/৪১)
তার ব্যাখ্যায় যোগীরাজ মহর্ষি দয়ানন্দ লিখেছেন-"শৌচ দ্বারা অন্তঃকরণের শুদ্ধি মনের প্রসন্নতা এবং একাগ্রতা ইন্দ্রিয়াদির জয় তথা আত্মার দেখা অর্থাৎ জানার যোগ্যতা প্রাপ্ত হয়।" এবং ব্রহ্মকে প্রাপ্তির জন্য ব্রহ্মের অনুগ্রহ প্রাপ্ত করাও আত্মাববশ্যক। মহর্ষি লিখেছেন-"পূর্বোক্ত স্বাধ্যায় দ্বারা ইষ্ট দেবতা অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে সম্প্রয়োগ অর্থাৎ সংযোগ হয় তেমনই পরমেশ্বরের অনুগ্রহের সহায় আপনার আত্মার শুদ্ধি,সত্যাচরণ,পুরুষার্থ এবং প্রেমের সম্প্রয়োগ দ্বারা জীব শীঘ্রই মুক্তিকে প্রাপ্ত হয়। "( ঋ০ ভূ০ উপাসনাবিষয়ঃ) এই জন্য বিদ্বান্ ব্রহ্মের উপাসকে ব্রহ্মের অনুগ্রহ-সহায় প্রাপ্ত তথা অন্তঃকরণের শুদ্ধি করা পরমাবশ্যক।
সমীক্ষা-নবীন বেদান্তের প্রবর্তক স্বামী শঙ্করাচার্য এই শ্রুতি দ্বারা নিজে নিজেকে ব্রহ্ম মান্যকারীই বর্ণনা হিসেবে লিখেছেন-"যমেব স্বাত্মানমেষ সাধকো বৃণুতে প্রার্থয়তে তেনৈবাত্মনা বরিত্রা স্বয়মাত্মা লভ্যো জ্ঞায়ত।" অর্থাৎ যে নিজের আত্মার এই সাধক প্রার্থনা করেন,সেই শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমেই আত্মা লাভ করা যায়। শ্রী শঙ্করাচার্যের এই বর্ণন মূল থেকে বিপরীত। সাধনাকারী এবং উপাস্য দুই এক কখনও হতে পারে না। আত্মা কি নিজে নিজের উপরই অনিগোহ করেন, তখন নিজেকে জানতে পারেন। এমন ভাব এই শ্রুতি থেকে প্রকট হয় না। উপাস্য-উপাসক দুই এক হতে পারে না। অন্যথা উপাসনা করা নিরর্থক। যোগদর্শনে "ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা" জীব ব্রহ্মকে ভিন্ন-ভিন্ন মান্য করে ভক্তের উপর ঈশ্বরের অনুকম্পিত হওয়া স্পষ্ট রূপে বলা হয়েছে। এখানে শ্রুতি "বৃণুতে=বরণ করে হয়। ক্রিয়া থেকে স্পষ্ট হয় যে বরণকারী বরণীয় থেকে পৃথক হয়। এই ক্রিয়ার "প্রার্থয়তে" অর্থ মিথ্যা তথা অসঙ্গত হয় এবং "যমেবৈষ বৃণুতে" এই বাক্যে কর্ত্তা তথা কর্মের পৃথক নির্দেশাবলী আছে শঙ্করাচার্যের মান্যতার স্পষ্ট খণ্ডন করা হয়েছে।
( ভাষ্যকার-পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রী)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ