ঈশ্বরে বিশ্বাস - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

03 April, 2023

ঈশ্বরে বিশ্বাস

 বিশ্বাস হল কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তার অনুভূতি। যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে নিশ্চিত, ঈশ্বরকে সে বাস্তব বলে মনে করে।

বিশ্বাস হল বাস্তবতার ধারণা বা চেতনা। মনোবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্বাস হল তাই সদর্থক বা ভাবাত্মক (positive) মানসবৃত্তি। বিশ্বাসের বিপরীত হল সংশয়, অবিশ্বাস নয়। অবিশ্বাস বলতে আসলে বিশ্বাসের অভাবকে বোঝায় না, বরং সেটার বদলে অন্য কিছুতে বিশ্বাসকে বোঝায়। তাই অবিশ্বাসও আসলে সদর্থক মানসবৃত্তি। যার মনে ভূত-প্রেতে অবিশ্বাস আছে, সে ভূত-প্রেতের অস্তিত্বহীনতায় বিশ্বাস করে। নৈঞর্থক বা অভাবাত্মক (negative) মানসবৃত্তি হল সংশয়। সংশয় মানে হল বিশ্বাসের অভাব।

তো এই বিশ্বাস জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক নাকি কর্মপ্রবৃত্তিমূলক ? এটা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ মনে করেন বিশ্বাস জ্ঞানমূলক। হিউম, জেমস প্রমুখ মনে করেন বিশ্বাসকে ফেলা উচিৎ অনুভূতিগুলোর তালিকায়। আবার বেইন এর মত কারও কারও মতে বিশ্বাস হল কর্মমূলক। আবার অনেকে মনে করেন বিশ্বাসের মধ্যে তিনটি উপাদানেরই অস্তিত্ব আছে।

যাই হোক, এই উপাদানগুলো সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক –

(১) জ্ঞানমূলক (cognitive) উপাদান
যেকোন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ধারণা বা জ্ঞানের অস্তিত্ব আছে বলে এটা মনে করা হয়। যখন কেউ কোন কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করে তখন সেই সম্পর্কে তার মনে কোন ধারণা থাকে। যে লোক অলৌকিক বিষয়বস্তুতে বিশ্বাস করে, তার মধ্যে সেই অলৌকিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা আছে। ঈশ্বরের ধারণা না থাকলে ঈশ্বরে বিশ্বাস করা যায় না। দিবাস্বপ্ন বা অলীক কল্পনা ছাড়া যে কোন চিন্তনের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাসের অস্তিত্ব দেখি। অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে চিন্তন বা ধারণার অস্তিত্বই বিশ্বাসের একমাত্র অঙ্গ নয়। নিছক চিন্তনের তুলনায় বিশ্বাসের ধারণাটি বেশি ব্যাপক, অবশ্য সব চিন্তনই বিশ্বাস নয়।

(২) অনুভূতিমূলক (Affective) উপাদান
এই অনুভূতি আবার দুইরকম –

(ক) বিশ্বাসের মধ্যে একটি বাধ্যবাধকতার ভাব বা ফিলিং অফ কমপালশন বা ফিলিং অফ কনস্ট্রেইন্ট থাকে। বিশ্বাস করা বা না করা আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। যা আমরা বিশ্বাস করি, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হই।

(খ) বিশ্বাসের মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত হওয়ার ভাব বা স্বস্তির ভাব (এ ফিলিং অফ রিলিফ) থাকে। মন যখন সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকে, তখন মনে একটা অস্বস্তির ভাব জাগে। কিন্তু মন থেকে সন্দেহ দূর করে আমরা যখন বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তখন মনের এই অস্বস্তির ভাব দূর হয়ে যায়। একারণে কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বিশ্বাসকে কেবলই অনুভূতি বলে মনে করেন।

(৩) কর্মপ্রবৃত্তিমূলক (Conative) উপাদান
ঘটনা বা পরিবেশের সাথে সঙ্গতি সাধনের জন্য বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করার জন্য বিশ্বাস আমাদেরকে প্রবৃত্ত করে। ধরা যাক, আমি বিশ্বাস করি যে আমার পরিচিত কোন ভদ্রলোকের চুরির স্বভাব আছে। সেক্ষেত্রে আমি সব সময় তার সম্পর্কে সতর্ক হয়ে চলি। আবার আমার বিশ্বাস আছে যে, আমার কোন এক বন্ধু বেশ দায়িত্বশীল। সেক্ষেত্রে তার উপর কোন একটি কাজের ভার অর্পন করে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। এটা হল বিশ্বাসের কর্মমূলক উপাদান।

মনোবিজ্ঞানী স্টাউটের মতে বিশ্বাস কর্ম করার অন্যতম শর্ত, আবার কর্মের মূলে রয়েছে বিশ্বাসের অস্তিত্ব। মনোবিজ্ঞানী বেইন বলেন, “কোন কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করলে আমরা কাজে প্রবৃত্ত হতে পারি।” বিশ্বাস যেম্ন কর্ম করার শরতস্বরূপ, তেমনি কর্মও বিশ্বাসের শর্তস্বরূপ। আমাদের প্রয়োজন এটা নির্ধারণ করা যে আমরা কিসে বিশ্বাস করব বা করব না। কাজেই বিশ্বাস কর্মের উপর নির্ভরশীল, আবার কর্মও বিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

বিশ্বাসের কারণগুলোকে, অর্থাৎ যেসব কারণে বিশ্বাস উৎপন্ন হয় বা যেসব অবস্থার উপর বিশ্বাস নির্ভরশীল থাকে তাদেরকে চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে –

(ক) জ্ঞানমূলক অবস্থা বা কারণ (cognitive conditions)
(১) প্রত্যক্ষকরণ (perception):
কোন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবস্থা বা কারণ হল পারসেপশন বা প্রত্যক্ষকরণ। কোন কিছুকে আমরা প্রত্যক্ষ করলে বা পারসিভ করলে তাতে সহজেই আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি। কোন কিছু সম্পর্কে মনে কিছুটা অবিশ্বাস থাকলেও তা দেখে বা স্পর্শ করে আমরা সেই বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসকে আরও শক্ত করি। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা প্রত্যক্ষ করি। চোখের সাহায্যে দেখে, ত্বকের সাহায্যে স্পর্শ করে, নাকের সাহায্যে গন্ধ নিয়ে, জিভের সাহয্যে স্বাদ নিয়ে, কানের সাহায্যে শব্দ নিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ অরি। আবছা অন্ধকারে দেখছি সামনে একজন মানুষ আছে, সন্দেহ থাকলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখি আসলেই মানুষ কিনা। তাই প্রত্যক্ষকরণ বা পারসেপশন আমাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি ও নির্ধারণ করে।

(২) স্মৃতি (memory):
স্মৃতি আমাদের মনের মধ্যে যে প্রতিরূপ বা ইমেজগুলোকে জাগরিত অরে সেগুলোর মাধ্যমে আমরা অতীত ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করি। স্মৃতি এই বিশ্বাস উৎপন্ন করে যে, প্রতিরূপগুলো হচ্ছে অতীতে প্রত্যক্ষকরণ করা বিষয়গুলোরই যথার্থ প্রতিরূপ।

(৩) অনুমান (inference):
দূরে পাহাড় থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে অনুমান করি যে সেখানে আগুন আছে। অনুমানের লক্ষণ হল জানা সত্যের উপর ভিত্তি করে ও তার দ্বারা সমর্থিত হয়ে অজানা সত্যে উপনীত হওয়া। মানে, আগে কোন বিষয় প্রত্যক্ষ করেছি বলে মনে যে বিশ্বাস জেগেছে, তার উপর ভিত্তি করে অজানা কোন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় অনুমান বা ইনফারেন্স এর সাহায্যে।

(৪) আপ্তবাক্য বা শব্দ (testimony):
নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যে আমরা সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করি। কোন বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ জাগলেও যখন শুনি কোন প্রামাণ্য গ্রন্থে বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে, তখন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করি।

(৫) জ্ঞান ও শিক্ষণ (knowledge and learning):
কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান সেই সম্পর্কে আমাদের মনে বিশ্বাস উদ্রেক করে। বিশ্বাস হল জ্ঞানের এক অনিবার্য উপাদান। আণবিক শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করলে, আণবিক বোমার ধ্বং সকারিতা সম্পর্কে মনে বিশ্বাস তৈরি হয়। কাজেই শিক্ষণও বিশ্বাস উৎপাদন করে। যে বিষয় আমরা শিক্ষণ করি, সেই শিক্ষণের ভিত্তিতে পরে কোন একটি কাজ করতে হলে সেটা ভালভাবে করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।

(৬) অবিচ্ছেদ ধারণার অনুষঙ্গ (Inseparable association of ideas):
যদি দুটি বস্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় এমনভাবে অনুষঙ্গবদ্ধ বা এসোসিয়েটেড হয়ে পড়ে যে তাদের আমরা অবিচ্ছেদ্য বা ইনসেপারেবল বলে মনে করি, তবে ঐ দুই ধারণার একটির কথা মনে হলে অপরটিও তার সাথে জড়িত এমন বিশ্বাস মনে জাগে। যেমন খাদ্যের সাথে ক্ষুধার সম্পর্ক, জলের সাথে তৃষ্ণার সম্পর্ক। খাদ্য যে ক্ষুধার নিবৃত্তি করে, জল যে তৃষ্ণানিবারণ করে, এই প্রত্যক্ষে খাদ্য ও ক্ষুধা, বা জল ও তৃষ্ণার প্রতিরূপ অবিচ্ছেদ্যভাবে অনুষঙ্গবদ্ধ হয়ে এদের সম্পর্কে বিশ্বাস উৎপাদন করে।

(৭) অভিভাবন (Suggestion):
কোন কথা বারবার বলা হলে বা আভাসে, ইঙ্গিতে, সঙ্কেতে কোন কথা বারবার উল্লেখ করা হলে তার সম্পর্কে আমাদের মনে বিশ্বাস জাগে। “জনি চোর” এই কথাটা যদি পরিচিত সবার মুখ থেকে বারবার শুনতে পাই তাহলে আমাদের মনে বিশ্বাস জাগ্রত হয় যে জনি আসলেই চোর। এভাবে অলীক ঘটনার চিত্তাকর্ষক উচ্ছসিত বর্ণনাও মনে বিশ্বাস উৎপাদন করে। (পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে এত চিত্তাকর্ষকভাবে কেন বর্ণনা করা হয় ভেবে দেখুন)

(খ) অনুভূতিমূলক অবস্থা বা কারণ (Affecive or emotional conditions)
(১) মনে ভয় জাগলে আমরা আজগুবি ঘটনাও বিশ্বাস করি।

(২) অনেক সময় অহঙ্কার মানুষকে এতই অন্ধকারে ফেলে যে, সে নিজেকে সবার থেকে বেশি বুদ্ধিমান বলে মনে করে।

(৩) যদি কোন ব্যক্তি অন্যের উপর রেগে যায় তাহলে সে তার বিরুদ্ধে যে কোন অভিযোগকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে।

(৪) শ্রদ্ধার আতিশয্যে আমরা কোন ব্যক্তির যে-কোন কথাতেই বিশ্বাস করি, তিনি যতই অবাস্তব কথা বলুন না কেন।

(৫) গিল্ডফোর্ড বলেন, “There is a tendency for the masses to accept the judgments of an expert in a single field when he utters opinions upon any question whatsover.” অর্থাৎ, “কোন ব্যক্তি, যিনি বিশেষ কোন এক ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, তিনি যখন যেকোন প্রশ্ন সম্পর্কেই অভিমত প্রকাশ করেন, সাধারণের মধ্যে তার বক্তব্যে বিশ্বাস স্থাপন করার এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।” একজন ব্যক্তি করোনাভাইরাস সম্পর্কে সাধারণের বক্তব্যের চেয়ে একজন ডাক্তার বা ভাইরোলজিস্ট বা ইমিউনোলজিস্ট বা জিনেটিসিস্ট এর কথা বেশি বিশ্বাস করবে। (মিশেল ফুকো তার ডিসকোর্স এর পাওয়ার এর সম্পর্ক আলোচনায় এই প্রসঙ্গটা টেনেছিলেন।)

(৬) গিল্ডফোর্ড বলেন, “We often believe what we wish to believe, even when we know better”। অর্থাৎ, “আমরা প্রায়ই তা বিশ্বাস করি যা আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা নিজে সেই সম্পর্কে (অন্য কিছু) ভালভাবে জানলেও যা আসলে বিশ্বাস করতে চাই সেটাই বিশ্বাস করি।” (confirmation bias নামে একটি বায়াস এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দেয়, সেটা নিয়ে পরে লেখা হবে)।

(৭) ব্যক্তির মনের গঠনগত প্রকৃতি অনেক সময় তার মনে বিশ্বাস উদ্রেক করার কারণ হয়। আশাবাদী ব্যক্তি নিজের ভবিষ্যৎ সাফল্যে বিশ্বাস স্থাপন করে।

(গ) কর্মপ্রবৃত্তিমূলক অবস্থা বা কারণ (Conative conditions)
(১) ব্যক্তির ইচ্ছা বা কর্মপ্রবৃত্তি মনে বিশ্বাস উৎপাদন করে। অসুস্থ শিশুকে সারিয়ে তোলার জন্য মায়ের মনে এমন তীব্র ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা জাগে যে, হাতুড়ে ডাক্তারের উপদেশে অতি সহজেই তিনি বিশ্বাস স্থাপন করেন। বিপদে পড়ে যখন কেউ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন ও বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার প্রবল ইচ্ছা তার মনে জাগে, তখন যেকোন ব্যক্তির যেকোন উপদেশে সেই ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করেন।

(২) সংকল্প মনে বিশ্বাস উদ্রেক করে। জীবনে উন্নতি করার জন্য ব্যক্তি যখন কঠিন সংকল্প গ্রহণ করেন, তখন নিজের গৌরবময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সহজেই তার মধ্যে বিশ্বাস জাগে।

(৩) কয়েকটি বিশ্বাসের মূলে রয়েছে সহজাত প্রবৃত্তি বা ইনস্টিংক্ট (instinct)। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীগণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের পেছনের বিবর্তনীয় কারণ বের করতে চান। (এই বিষয়ে পরে লেখা হবে)

(ঘ) সামাজিক অবস্থা বা কারণ (Social conditions)
সামাজিক প্রভাবে সমাজের রীতি-নীতি, আদর্শ, ভাবধারা, প্রথা প্রভৃতিতে মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করে। অনেক সময় নানারকম কুসংস্কারে মানুষ বিশ্বাস করে এসব সামাজিক কারণেই, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সেসব কুসংস্কারের যথার্থতা প্রমাণ করা যায়না। ছোটবেলা থেকে শুরু করে পরিণত বয়স পর্যন্ত আমাদের এই বিশ্বাসগুলো অনেক সময় অটুট থাকে। সমাজ ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ছোট-বড় সংগঠন যেমন পরিবার, সংঘ, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমাদের মনে নানাভাবে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি করে।

তথ্যসূত্র

১। মনোবিদ্যা; লেখক – প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত
২। General psychology by J. P. Guildford

বিশ্বাস যার অপর নাম ভরসা। যে জায়গায় বা যে মানুষের ওপর ভরসা করতে পারবেন ওখানে আপনি বিশ্বাস এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবেন। তবে বিশ্বাস কখনো যুক্তি দিয়ে প্রমান করা যায় না । 
কোনো বিষয় সত্য না মিথ্যা তা বিচার ক’রে – সত্য মনে হলে তা “বিশ্বাস করা” অথবা মিথ্যা মনে হলে অবিশ্বাস করা আর মিথ্যা হবার সম্ভাবনা বেশী মনে হলে সন্দেহ করা হয় । বিশ্বাস মানে হতে পারে আস্থা (faith) , ভরসা (trust) । বিশ্বাসের দৃঢ়তা (বিশ্বাস যত বেশি সন্দেহ তত কম) যা খুব বেশি হলে তাকে বলা যায ভক্তি বা অন্ধবিশ্বাস । আবার বিশ্বাস মানে হতে পারে আশা (hope) বা আশ্বাস (assurance) বা বিশ্বাস করার ইচ্ছা (willingness to trust)।

বিশ্বাস হতে পারে কোন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ অনুভুতির সচেতন অনুধাবন; বা কোনো তথ্য (information) বোধগম্য হওয়া; এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যাচাই করার পর এই বোধের নিশ্চয়তা সম্বন্ধে প্রত্যয় বা প্রতীতি জন্মালে (সত্য বলে স্থায়ী ধারণা) হলে তাকে জ্ঞান (knowledge) বলা যায়। পর্যবেক্ষণের উপর যুক্তির (ও পূর্বলব্ধ জ্ঞানের) সাহায্যে বিচার (deduction) করে কোন বিষয় সত্য বলে সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে নতুন জ্ঞান জন্মায়। এইভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধ সত্যগুলিকে জুড়ে যে তত্ত্বের জাল বোনা হতে থাকে তাদের বিষয়বস্তুগুলি সামগ্রিকভাবে হল জ্ঞান আর তাদের গ্রহণযোগ্যতার সচেতন অনুমোদন হল বিশ্বাস। জ্ঞানের বিশেষত্ব হল শুধু পূর্বের অভিজ্ঞতাই নয় ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও অজ্ঞাত পরিস্থিতি সম্বন্ধেও এর দ্বারা (induction) ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব ও সেই ভবিষ্যৎবাণীর সাফল্য বিশ্বাসকে বজায় রাখে। জ্ঞানের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাকে প্রয়োগ করে ভালো ফল লাভের সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে জ্ঞান ক্ষেত্রবিশেষে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা(wisdom) বা দূরদৃষ্টি (insight) ইত্যাদি হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।

বিশ্বাস হতে পারে একজনের ব্যক্তিগত কষ্ট কল্পনা। যেমন সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা অনেক কিছু দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখালে সেই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়ে যেতে থাকে। এই ধরণের ভিত্তিহীন বা যুক্তির অতীত বদ্ধমূল অন্ধবিশ্বাসকে বলে ডিলিউসন (delusion)। আবার বিশ্বাস হতে পারে কোন জনতার সম্মিলিত জনমত। যেমন নানা ধরণের ধর্ম[রিলিজিয়াস]বিশ্বাস।
বিশ্বাসের সঙ্গে মূল্যবোধ ও ভালোমন্দ বিচারও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কোন কিছুকে ভালো বলে বিশ্বাস না হলে তাকে খারাপ বলেই সন্দেহ হবে। সন্দেহ (বিশ্বাস করার অনিচ্ছা) খুব জোরালো হলে এবং অন্যান্য চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে দিলে তাকে বলে প্যারানইয়া, যার বিশেষণ হল প্যারানয়েড। সিজোফ্রেনিয়ার চারটি প্রধান ধরণের মধ্যে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া একটি।
আমি ঈশ্বর তত্ত্বের উপর নিষ্পক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে থাকি। আমি সংসারের সকল ঈশ্বরবাদীকে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, ঈশ্বর নামের কোনো পদার্থ এই সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান আছে কি, নাকি নেই? যেমন কোনো অজ্ঞানী ব্যক্তিও সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, নক্ষত্র, আকাশগঙ্গা, উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের অস্তিত্বের উপর কোনো শঙ্কা করবে না, সেই রকম এইসব বাস্তবিক পদার্থের মূল নির্মাতা ও সঞ্চালক ঈশ্বর তত্ত্বের উপর সকল ঈশ্বরবাদী শঙ্কা বা সন্দেহ থেকে মুক্ত কি? সংসারের বিভিন্ন পদার্থের অস্তিত্ব ও স্বরূপ কোনো আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কি? যদি না হয় তাহলে এই পদার্থের নির্মাতা যাকে ঈশ্বর বলে মানা হয় তিনি কেন কোনো আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল? আমাদের আস্থা না হলে কি ঈশ্বর থাকবে না? আমাদের আস্থা দিয়ে সংসারের কোনো ছোটো থেকে ছোটো পদার্থও না তো নির্মাণ হতে পারে আর না আস্থা সমাপ্ত হলে পরে কোনো পদার্থের অস্তিত্ব নষ্ট হতে পারে, তাহলে আমাদের আস্থার দ্বারা ঈশ্বর কিভাবে নির্মাণ হতে পারে আর কেনই বা আমাদের আস্থা সমাপ্ত হলে পরে ঈশ্বর মুছে যেতে পারে? সৃষ্টির কোনো পদার্থের স্বরূপও কি আমাদের আস্থার দ্বারা পরিবর্তন হতে পারে? যদি তা না হয়, তাহলে কেন আমরা নিজের-নিজের আস্থার কারণে ঈশ্বরের রূপ পরিবর্তনের কথা বলে থাকি? সংসারের সমস্ত ভৌতিক ক্রিয়ার বিষয়ে কোথাও কোনো বিরোধ নেই, কোথাও আস্থা, বিশ্বাসের বৈশাখীর আবশ্যকতা নেই, তাহলে কেন ঈশ্বরকে এরকম দুর্বল ও অসহায় বানানো হল, যা আমাদের আস্থার মধ্যে বিভক্ত মানব ও মানবের মাঝে বিরোধ, হিংসা ও দ্বেষকে বৃদ্ধি করছে। আমরা সূর্যকে একটা মানতে পারি, পৃথিবী আদি লোক, নিজের- নিজের শরীরকে এক সমান মেনে আধুনিক ভৌতিক বিদ্যাকে মিলেমিশে পড়তে ও পড়াতে পারি, তাহলে কেন আমরা ঈশ্বর আর তাঁর নিয়মকে এক সমান মেনে পরস্পর মিলেমিশে থাকতে পারি না? আমরা ঈশ্বরের তৈরি সৃষ্টি এবং তাঁর নিয়মের উপর বিনা কোনো পূর্বাগ্রহে সংবাদ ও তর্ক-বিতর্ক প্রেমপূর্ণক করে থাকি, তাহলে কেন এই সৃষ্টির রচয়িতা ঈশ্বর তত্ত্বের উপর কোনো চর্চা, তর্ক করতে ভয় করি? কেন কিঞ্চিৎ মতভেদ হওয়া মাত্রই ফাতয়া জারী করা হয়, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, হিংসায় উদ্যত হয়ে যায়। সৃষ্টির নির্মাতা ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্ব কি কারও শঙ্কা ও তর্ক মাত্রতেই কেঁপে উঠবে, মুছে যাবে?

যদি ঈশ্বর তর্ক, বিজ্ঞান বা বিরোধী পক্ষের আস্থা ও বিশ্বাস তথা নিজের পক্ষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস দিয়েই মুছে যায়, তাহলে এরকম ঈশ্বরের মূল্য কি? এরকম পরজীবী, দুর্বল, অসহায়, ঈশ্বরের পূজা করে কি লাভ? তাঁকে কেন মানা হবে? কেন সেই কল্পিত ঈশ্বর আর তাঁর নামে প্রচলিত কল্পিত ধর্মের মধ্যে ব্যর্থ একগুঁয়ে হয়ে ধন, সময় ও শ্রমের অপব্যয় করা হবে?

🌸ঈশ্বরপ্রসূত ভৌতিকীর নিয়ম🌸

আমার প্রবুদ্ধ পাঠকগণ! একটু ভাবুন যে যদি ঈশ্বর নামের কোনো শক্তি বাস্তবে এই সংসারের মধ্যে বিদ্যমান আছে, তাহলে সে আমাদের বিশ্বাস, আস্থার সাহায্যে জীবিত থাকবে না। সেই শক্তি নিরপেক্ষ রূপে যথার্থ বিজ্ঞানের দ্বারা জানার যোগ্যও হবে। তাঁর একটা নিশ্চিত স্বরূপ হবে, তাঁর নিশ্চিত নিয়ম হবে। ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়মের বিষয়ে Richard P. Feynman বলেছেন -
"We an imagine that this complicated array of moving things which constitutes 'the world' is something like a great chess game being played by the Gods, and we are observed of the game. We do not know what the rules of the games are, all we are allowed to do is to watch the playing. Of course, if we watch long enough, we may eventually watch on to a few rules. The rules of the game are whats we mean by fundamental physics." (Lectures on Physics Pg.13)
এর মানে হল, এই সংসার নিশ্চিত নিয়ম দ্বারা নির্মিত ও নিশ্চিত নিয়ম দ্বারা চলছে। সেই নিয়ম ঈশ্বর দ্বারা বানানো হয়েছে আর সেইসবকে সে প্রযোজ্য করে সংসারকে তৈরি করে আর চালায়। বৈজ্ঞানিক সেই অসংখ্য নিয়মের মধ্যে কয়েকটিকে জানতে তো পারবে, তাদের তৈরি বা প্রযোজ্য করতে পারবে না। এখানে ফাইনম্যান একটা বড় ভুল অবশ্য করে দিয়েছেন, সেটা God এর স্থানে Gods লিখে দিয়েছেন। যদি নিয়মের নির্মাতা অনেক Gods হয়, তাহলে নিয়মের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকবে না। সকল Gods কে সমন্বিত ও নিয়ন্ত্রণকারী কোনো Supreme God অর্থাৎ God এর অস্তিত্ব অবশ্যই মানতে হবে আর মূলভূত ভৌতিক নিয়মের নির্মাতা একটাই God (ঈশ্বর) হবে।

এখন আমরা বিবেচনা করবো যে সেই 'God' অর্থাৎ ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়মই হচ্ছে মূলভূত ভৌতিক বিজ্ঞান নামে পরিচিত। এই বিজ্ঞানের উপরেই সম্পূর্ণ ভৌতিক বিজ্ঞান, খগোল, রসায়ন, জীব, বনস্পতি, ভূগর্ভ, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল সাইন্স আদি সমস্ত শাখাগুলো আশ্রিত। মূলভূত ভৌতিকী ছাড়া সংসারের মধ্যে বিজ্ঞানের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। যখন ঈশ্বরের ভৌতিক নিয়ম যারদ্বারা এই সংসারকে জানা যায়, যা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের বুদ্ধিবাদী প্রাণী বা মানুষের জন্য সমান, তাহলে সেই ঈশ্বরকে জানার জন্য আবশ্যকতা তাঁরই নির্মিত আধ্যাত্মিক নিয়ম অর্থাৎ অধ্যাত্ম বিজ্ঞানও (যাকে প্রায়শঃ ধর্ম বলা হয়ে থাকে) তো সকল মানুষের জন্য সমানই হবে। আশ্চর্যের বিষয় যে সাধারণ তর্ক বোঝার বুদ্ধিও ঈশ্বরবাদীদের মধ্যে আর নেই, তাহলে নিশ্চয়ই এটা তাদের কল্পনাপ্রসূত ঈশ্বরীয় ধারণা ও কল্পিত উপাসনা - পূজা পদ্ধতিরই ফল, যেখানে সত্য অন্বেষণের বৈজ্ঞানিক মেধা কোথাও পালিয়ে গেছে।

ঈশ্বরবাদী বৈজ্ঞানিক কেবল Feynman -ই নন বরং অনেক প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিক ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন আর করেন। কারণ বর্তমান বিজ্ঞান কেবল প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ও গণিতীয় ব্যাখ্যার সাহায্যেই জীবিত আছে আর তার স্বরূপও হচ্ছে এটাই। এই কারণে সেটা ঈশ্বরের ব্যাখ্যা এইসবের দ্বারা তো করতে পারবে না আর না সেটা এর ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে Stephen Hawking তো The Grand Design পুস্তকের মধ্যে যেন বিশ্বের সকল ঈশ্বরবাদীদের মূর্খ মেনে নিরর্থক ব্যঙ্গ করেছেন। বিজ্ঞানের নাম নিয়ে স্বয়ং অবৈজ্ঞানিকতারই পরিচয় দিয়েছেন। এই পুস্তকের পূর্বে তারই পুস্তকের মধ্যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, তারপর যেন অকস্মাৎ তিনি ভারী খোঁজ করে সংসারের মধ্যে ঘোষণা করেন যে ঈশ্বর নামের কোনো অস্তিত্ব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নেই। অপরদিকে আজ সংসারের মধ্যে এরকম ভয়ংকর পাপ প্রবাহ চলছে যে যারা নিজেকে ধার্মিক বলে তারাও এরকম ব্যবহার করছে, যেন তাদের উপর ঈশ্বর নামের কোনো অস্তিত্বই নেই, সেই অহংকারী মানব স্বয়ংকেই সর্বোচ্চ সত্তার মতো ব্যবহারের প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এই কারণে আমি সারা সংসারের বৈজ্ঞানিক অনীশ্বরবাদী ও ঈশ্বরবাদী উভয়কেই আহ্বান করতে চাইবো যে তারা যেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর খোলা মন দিয়ে চিন্তা করতে উদ্যত হয়ে যান। আজ অনেক ঈশ্বরবাদী বিদ্বান ঈশ্বরবাদী বৈজ্ঞানিকদের প্রমাণ দিতে দেখা ও শোনা যায়, কিন্তু আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ কোনো বৈজ্ঞানিকের থেকে নেওয়াটা আবশ্যক বলে মনে করি না। এখন সেই সময় আসবে যখন বর্তমান বৈজ্ঞানিক আমার মতো বৈদিক বৈজ্ঞানিকদের প্রমাণকে মানা প্রারম্ভ করে নতুন বৈজ্ঞানিক যুগের সূত্রপাত করবেন অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে মিলে কাজ করবেন। আমি আজ সারা বিশ্বের সমস্ত প্রবুদ্ধ সমাজের কাছে ঘোষণাপূর্বক বলতে চাই যে, যদি ঈশ্বর না থাকে, তাহলে সব ঝঞ্ঝাট ছেড়ে দিয়ে নাস্তিক ও স্বচ্ছন্দ হয়ে যান আর যদি ঈশ্বর সিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাঁর আজ্ঞায় চলে নির্দিষ্ট জীবনযাপন করার সঙ্গে সংসারকে সুখী বানানোর চেষ্টা করুন, কারণ সম্পূর্ণ সংসার হচ্ছে সেই ঈশ্বরেরই রচনা আর এই কারণে সব মানুষই নয় বরং সকল প্রাণীমাত্র হচ্ছে পরস্পরের ভাই-ভাই।
এখন আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর পুনর্বিবেচনা করবো -

আমরা এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকদের থেকে যেসব চর্চাই সৃষ্টি বিজ্ঞানের উপর করেছি, সেই সব থেকে এই একটি বিচার সামনে আসে যে বৈজ্ঞানিক "কেন" প্রশ্নের উত্তর দেয় না কারণ তাদের দৃষ্টিতে এটা বিজ্ঞানের বিষয় নয়। আমরা সংসারের মধ্যে নানা স্তরের উপর নিম্ন প্রশ্নবাচক শব্দের সম্মুখীন হয়ে থাকি -
১. কেন
২. কে
৩. কার জন্য
৪. কি
৫. কিভাবে আদি

এই প্রশ্নের মধ্যে "কি", "কিভাবে" -এর উত্তরের বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান বিচার করার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। যদিও এই দুটো প্রশ্নেরও পূর্ণ সমাধান বিজ্ঞানের কাছে তো নেই কিন্তু প্রচেষ্টা অবশ্য নিষ্ঠাপূর্বক হচ্ছে। অন্য প্রশ্ন "কেন", "কে" এবং "কার জন্য" এই তিনটি প্রশ্নের বিষয়ে বিচার করারও একটুখানি আগ্রহের বিষয় আধুনিক বিজ্ঞানের নেই। আমরা এই প্রশ্নের অভিপ্রায়ে ক্রমশঃ বিচার করবো -

📒 কেন - এই প্রশ্ন প্রয়োজনের সন্ধানের জন্য প্রেরিত করে। আমরা অবশ্যই সারা জীবন ধরে নানা প্রকারের কর্ম করে থাকি এবং নানা দ্রব্যের সংগ্রহ করে থাকি। এইসবের কোনো না কোনো প্রয়োজন অবশ্যই থাকে। যেকোনো বুদ্ধিমান প্রাণী কোনো না কোনো প্রয়োজন হেতুই প্রবৃত্তি রাখে। মূর্খ মানুষ যদিও বা নিষ্প্রয়োজন কর্মের মধ্যে প্রবৃত্তি রাখতে পারে, বুদ্ধিমান তো কখনও এরকমটা করবে না। সংসারের উপর বিচার করুন যে এটা কেন নির্মিত হয়েছে আর কেন সঞ্চালিত হচ্ছে? এটার প্রত্যেক গতিবিধির কোনো না কোনো প্রয়োজন অবশ্যই আছে। "কেন" প্রশ্নের উপেক্ষাকারী কোনো বৈজ্ঞানিক কি এটা মানে যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড হচ্ছে নিষ্প্রয়োজন রচনা? আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষকে সর্বপ্রথম "কেন" প্রশ্নের উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। যেরকম কেউ কোনো কাজ করার পূর্বে তার প্রয়োজনকে সে জানে, সেইরকম এই সৃষ্টির উৎপত্তি হওয়া, কোনো শরীরধারীর জন্ম নেওয়ার প্রয়োজনটাকে জানারও চেষ্টা করা উচিত। বর্তমান বিজ্ঞান এই প্রশ্নের থেকে দূরে থাকার কারণেই আজ সেটা অনেক অনুসন্ধান করার পরেও তার উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুষ্প্রভাবের উপর বিচার করছে না। এই কারণে মানবকে নিজের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ, এমনকি বেঁচে থাকার প্রয়োজনেরও জ্ঞান না থাকায় ভোগের অতি তৃষ্ণাতে বিচরণ করে অশান্তি ও দুঃখের জালের মধ্যে ফেঁসে যেতে হচ্ছে।

📒 কে - এই প্রশ্নটি "কেন" -র সঙ্গে যুক্ত। কোনো কাজ কি প্রয়োজনের জন্য হচ্ছে, এর সাথেই এরসঙ্গে যুক্ত থাকা অন্য প্রশ্ন এটাও উৎপন্ন হয় যে, কে সেই কাজটিকে সম্পন্ন করেছে অথবা কে সম্পন্ন করছে অর্থাৎ তার প্রয়োজনটা কি? এই সৃষ্টির প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি নিশ্চিত প্রয়োজন আছে, সেই সঙ্গে তার প্রযোজক কোনো চেতন তত্ব আছে। কোনো জড় পদার্থ প্রযোজক হয় না। জড় পদার্থ প্রয়োজনের সামগ্রী তো হতে পারে কিন্তু তার কর্তা অর্থাৎ প্রযোজক নয়। চেতন তত্ত্বই জড় তত্ত্বের উপর সাম্রাজ্য ও নিয়ন্ত্রণ করে। চেতন তত্ত্ব স্বতন্ত্র হওয়ায় কার্যকর্তার অধিকারী হয়, অন্যদিকে জড় পদার্থ স্বতন্ত্র না হওয়ায় কর্ত্তৃত্ব সম্পন্ন হতে পারে না।

📒 কার জন্য - এই প্রশ্ন একথার বিচার করে যে, কোনো কর্তা কোনো কাজ করেছে বা করছে, তাহলে কি সেই কাজটা নিজের জন্য করেছে বা করছে অথবা অন্য কোনো চেতন তত্ত্বের জন্য করছে? এখানে কোনো উপভোক্তা হবে আর উপভোক্তাও কেবল চেতনই হয়। জড় পদার্থ কখনও না তো নিজের উপভোগ করতে পারে আর না সেটা অন্য জড় পদার্থের উপভোগ করতে পারে।

📒 কি - এই প্রশ্ন পদার্থের স্বরূপের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করে। জগৎ কি? এর স্বরূপ কি? মূল কণা কি? ঊর্জা ও দ্রব্য কি? বল কি? এইসব প্রশ্নের সমাধান হচ্ছে এই ক্ষেত্রের বিষয়। বর্তমান বিজ্ঞান তথা দর্শন শাস্ত্র দুটোই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করে। এর ক্ষেত্র হচ্ছে খুবই ব্যাপক। বর্তমান বিজ্ঞান এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে সক্ষম নয়। যেখানে বিজ্ঞান অক্ষম হয়ে যায়, সেখানে বৈদিক বিজ্ঞান কিংবা দর্শন শাস্ত্র এর উত্তর দিয়ে দেয়।

📒 কিভাবে - যেকোনো ক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হয়? জগৎ কিভাবে নির্মাণ হয়েছে? দ্রব্য ও ঊর্জা কিভাবে ব্যবহার করে? বল কিভাবে কাজ করে? এইসব প্রশ্নের সমাধান হচ্ছে এই ক্ষেত্রের বিষয়। বর্তমান বিজ্ঞান এই ক্ষেত্রে কাজ করে কিন্তু এটারও পূর্ণ সন্তোষজনক উত্তর তার কাছে নেই। অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর না জেনে এটার সন্তোষজনক উত্তর পাওয়াও যাবে না।

এই পাঁচটি প্রশ্নের অতিরিক্ত অন্য আরও কিছু প্রশ্ন আছে, যাদের সমন্বয় এই পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যেই প্রায় হতে পারে।

এখন আমরা সৃষ্টি উৎপত্তির প্রেক্ষাপটে কেন ও কে প্রশ্নের উপর ক্রমশঃ বিচার করবো -

📚 Big Bang Theory এর প্রেক্ষাপটে -
পূর্বোক্ত Big Bang Theory -র মধ্যে অনেক প্রশ্ন নিম্নানুসারে উপস্থিত -

• অনন্ত ঘন ও অনন্ত তাপযুক্ত শূন্য আয়তনকারী পদার্থের মধ্যে অকস্মাৎ বিস্ফোরণ কেন হয়েছে তথা একে কে করেছে?

• যদি Steven Weinberg এর Big Bang -এর উপর বিচার করা হয়, তাহলে সেখানেও কেন ও কে প্রশ্ন উপস্থিত হবেই। যদি চেতন নিয়ন্ত্রক সত্তাকে স্বীকার করা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে যে সে করেছে আর জীবদের ব্যবহারে আসার যোগ্য বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ করার জন্য বিস্ফোরণ করে কিন্তু অনীশ্বরবাদী এটার উত্তর কখনও দিতে পারবে না। একজন বৈজ্ঞানিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে যদি ঈশ্বরকে মানা হয়, তাহলেও এই প্রশ্নটা উঠবে যে ঈশ্বর অকস্মাৎ আজ থেকে প্রায় 13.6 অরব বছর পূর্বেই কেন বিস্ফোরণ করেছে? তো এটার উত্তরে ঈশ্বরবাদী তো উচিত উত্তর দিতে পারবে। চেতন তত্ত্ব ইচ্ছা ও জ্ঞান শক্তি সঙ্গে সম্পন্ন হয়। সে কোনো কাজের সময় ও প্রয়োজন নিজের বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চিত করতে পারে। কোনো পাখি বৃক্ষ থেকে অমুক সময়ে কেন উড়ে গেল? আমি অমুক সময়ে অমুক কাজ কেন করেছি? আমি খিদে পেলে ভোজন করবো নাকি করবো না, এটা আমার ইচ্ছা ও বিবেকের বিষয় হবে, এখানে "কেন" প্রশ্ন উচিত হবে না কিন্তু বৃক্ষ থেকে পাতা কেন পড়েছে? এখন বৃষ্টি কেন হচ্ছে? জল নিচের দিকে কেন বইছে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দেওয়ার যোগ্য হবে, কারণ এখানে ইচ্ছা এবং বিবেক নেই।

এই কারণে ঈশ্বরবাদী Big Bang -এর সময় ও প্রয়োজনের ন্যায্যতাকে সিদ্ধ করতে পারে, অনীশ্বরবাদী কখনও করতে পারবে না। আমার বলার মানে এই নয় যে ঈশ্বরের দ্বারা Big Bang হওয়া সম্ভব অর্থাৎ যদি Big Bang Theoriest ঈশ্বরের সত্তাকে মেনে নেয়, তাহলে Big Bang Theory সত্য হতে পারে। একদমই না, ঈশ্বর তত্ত্বটাও বর্তমান বৈজ্ঞানিকতার Big Bang -কে সম্পন্ন করতে পারবে না। Big Bang কিভাবে হয়? এটার সমাধান ঈশ্বরবাদ দ্বারাও হওয়া সম্ভব নয়। ঈশ্বরও নিজের নিয়মের অর্থাৎ মূলভূত ভৌতিকীর নিয়মের বিরুদ্ধ কাজ করতে পারে না। আমি Big Bang থিওরীর সমীক্ষাতে দেখিয়েছি∆ যে এই থিওরীতে ভৌতিকীর কত মূলভূত নিয়মের উলঙ্ঘন হয়? তবে হ্যাঁ, যদি কোনো লোকে বিস্ফোরণ মানা হয়, সেই লোকটিও অনাদি না মানা হয়, একইসঙ্গে ভৌতিকীর পূর্বোক্ত নিয়মের উলঙ্ঘন না হয়ে থাকে, তাহলে ঈশ্বর দ্বারা বিস্ফোরণ করা যেতে পারে কিন্তু সেই একটা বিস্ফোরণ দিয়েই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ হওয়াটা সম্ভব নয়। শূন্য থেকে ঈশ্বরও সৃষ্টির রচনা করতে পারবে না। সৃষ্টি রচনার জন্য অনাদি জড় উপাদান কারণের আবশ্যকতা অবশ্যই হবে কিন্তু জড় পদার্থের মধ্যে স্বয়ং গতি, ক্রিয়া হয় না, এই কারণে এদের উৎপন্ন করতে ঈশ্বরের ভূমিকা অবশ্যই হয়। অনন্ত পদার্থ (অনন্ত তাপ অনন্ত দ্রব্যমান) দ্বারা সীমিত ঊর্জা ও সীমিত দ্রব্যমানকারী ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি কেন হয়? এর উত্তর অনীশ্বরবাদী দিতে পারবে না, অথচ ঈশ্বরবাদী এটার উত্তর দিতে গিয়ে বলতে পারে যে ঈশ্বর তার নিজের প্রয়োজনানুসারে অনন্ত পদার্থের দ্বারা কিছু পদার্থকে ব্যবহারে নিয়ে এসে ব্রহ্মাণ্ডের রচনা করতে পারে। যেভাবে সংসারের মধ্যে কোনো ব্যক্তি পদার্থ বিশেষ দ্বারা কিছু ভাগ নিয়ে নিজের ইচ্ছার প্রয়োজনানুসারে কোনো বস্তু বিশেষের নির্মাণের জন্য স্বতন্ত্র হয়, তার ইচ্ছা বা প্রয়োজনের উপর অন্য কোনো ব্যক্তি প্রশ্ন উপস্থিত করতে পারে না, সেইভাবে অনন্ত পদার্থের দ্বারা কিছু পদার্থকে নিয়ে পরমাত্মা সীমিত দ্রব্যমান ও ঊর্জাকারী ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ করে থাকে। আমরা এর উপর এই প্রশ্ন করতে পারি না যে তার অনন্ত পদার্থের শেষ ভাগের ব্যবহার কেন করেনি অথবা অনন্ত দ্রব্যমান বা ঊর্জা যুক্ত ব্রহ্মাণ্ড কেন নির্মাণ করেনি? তাছাড়া এখন তো এই প্রশ্নটাও অনুত্তরিত যে ব্রহ্মাণ্ড সীমিত নাকি অনন্ত? আমাদের দৃষ্টিতে ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বরের অপেক্ষায় সীমিত তথা আমাদের অপেক্ষায় অনন্ত। আমরা যে পদার্থকে এমনটা মনে করি যে সেটা ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণের কাজে লাগেনি, সেটা আমাদের অল্পজ্ঞতাই হবে। বস্তুতঃ যে পদার্থটা এরকম সেটাও ব্রহ্মাণ্ডের সঞ্চালন আদিতে পরোক্ষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। সেই পদার্থই প্রাণ, মন, ছন্দ ও মূল প্রকৃতি রূপে বিদ্যমান থাকে। দ্বিতীয় কথা হল এটাও যে প্রারম্ভে দ্রব্যমান, ঊর্জার মতো লক্ষণ বিদ্যমানই হয় না।

• দূরে ছড়িয়ে যাওয়া পদার্থ ঘনীভূত হওয়া কিভাবে প্রারম্ভ করে? অনীশ্বরবাদী দূরে ছুটতে থাকা পদার্থের ঘনীভূত হওয়ার যথার্থ কারণ বলতে পারবে না কিন্তু ঈশ্বরবাদী এটার এইভাবে সমাধান করতে পারে যে দূরে ছুটতে থাকা পদার্থকে ঈশ্বর সৃষ্টি সৃজন হেতু তারথেকে সূক্ষ্ম তরঙ্গ রূপ শক্তিশালী পদার্থের দ্বারা অবরোধ করে ঘনীভূত করতে পারে অর্থাৎ সংকীর্ণ প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করতে পারে।

📚 Eternal Universe
এই মতের উপর আমি একমাত্র এই প্রশ্ন তুলে ছিলাম যে, যেকোনো কণা বা কোয়ান্টা, যারমধ্যে যেকোনো প্রকারের বল অথবা ক্রিয়া বিদ্যমান থাকে, সেটা অনাদি হতে পারে না। একইসঙ্গে আমি এটাও বলেছি যে, যে পদার্থ কোনো অন্য সূক্ষ্মতম পদার্থের সংযোগ দ্বারা নির্মাণ হয়েছে, সেটা অনাদি হতে পারে না। এটার কারণও আমি এই সিদ্ধান্তের সমীক্ষার সময়ে বলে দিয়েছি। এখন আমরা সৃষ্টির অনাদিত্বের উপর কিছু অন্য পদ্ধতি দিয়ে বিচার করবো। গতি কি অনাদি? "সৃষ্টি" শব্দের অর্থ হল - "নানা পদার্থের বুদ্ধিপূর্বক - মিশ্রণ দ্বারা নতুন-নতুন পদার্থের উৎপত্তি হওয়া", এই মিশ্রণের ক্রিয়াতে বল আর গতি হওয়াটা অনিবার্য। প্রশ্ন এই হচ্ছে যে, জড় পদার্থের মধ্যে কি স্বয়ং বল অথবা গতি হওয়া সম্ভব? এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব বল ও গতি দেখতে পাওয়া যায়, সেই সব কি মূলতঃ তাদের নিজেরই? এই বিষয়ে মহর্ষি বেদব্যাস বলেছেন "প্রবৃত্তেশ্চ (অনুপপত্তেঃ)" (ব্র০সূ০ 2|2|2) অর্থাৎ জড় পদার্থের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো ক্রিয়া ও গতি আদি হতে পারে না। তারমধ্যে গতি ও ক্রিয়াকে উৎপন্নকারী কোনো চেতন তত্ত্ব অবশ্যই থাকে। আমরা আমাদের চতুর্দিকে নানা প্রকারের গতিগুলো নিরন্তর দেখি, যাদেরমধ্যে কয়েকটি বস্তুর গতির দাতা চালক দেখা যায়, তো কয়েকটির গতির চালক দেখা যায় না। এখন আমরা বিচার করবো যে, কোন-কোন পদার্থ আছে যাদের চালক দেখা যায় না আর কোন-কোন পদার্থ এরকম আছে যাদের চালক দেখা যায়, কিংবা দেখা যেতে পারে। আমরা শুধু রেলগাড়ী, গাড়ি আদির বাহনের চালককে প্রত্যক্ষ দেখে থাকি, তাদের ইচ্ছা বা চেষ্টা আদি ক্রিয়াগুলোর অনুভব করে থাকি। আমরা বাহনের গতিকে প্রারম্ভকারী চেতন বাহন চালককে দেখি কিন্তু বাহনের ইঞ্জিনের মধ্যে হতে থাকা ক্রিয়াগুলোকে মাত্র জ্বালানী দ্বারা উৎপন্ন বলে মনে করি। জ্বালানী বা তারদ্বারা উৎপন্ন ঊর্জা বাহনকে কিভাবে গতি দেয়, বিদ্যুৎ বড়-বড় যন্ত্রকে কিভাবে চালায়, বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল কিভাবে কাজ করে, ঊর্জা ও বল কি? এইসব প্রশ্নের স্পষ্ট জ্ঞান আমাদের নেই। বর্তমান বিজ্ঞানও এই কথাকে স্বীকার করে। Richard P. Feynman লিখেছেন -
"It's important to realise that in physics today, we have no knowledge of what energy is." (Lectures on Physics- P. 40)
"If you insist upon a precise definition of force you will never get it." (id. P. 147)
"Why things remains in motion when they are moving or why there is a law of gravitation was, of course not known." (id. P. 15)
এরদ্বারা এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে আধুনিক ভৌতিক বিজ্ঞান বল এবং ঊর্জাকে ঠিক -ঠিক বুঝতে পারছে না। সেটা কিভাবে কাজ করে, এটা অজ্ঞাত আছে। সূক্ষ্ম পরমাণু অণু অথবা তরঙ্গ কিভাবে একটানা চলছে? এটাও সর্বদা অজ্ঞাত। Feynman -এর এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি প্রশংসনীয়। বস্তুতঃ বর্তমান বিজ্ঞানের কার্যশৈলীর একটা সীমা আছে। Science শব্দের অর্থ করে Chambers Dictionary -তে লেখা আছে যে -
"Knowledge ascertained by observation and experiment, critically tested, systematized and brought under general principles, esp in relation to the physical world, a department or a branch of such knowledge or study."

Oxford advanced learners dictionary -র Indian Edition -এর মধ্যে Science -এর অর্থ এইভাবে করেছে-
"Organised knowledge esp when obtained by observation and testing of facts, about the physical world, natural laws."

এই উভয় পরিভাষার দ্বারা এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে ভৌতিক জগতের যে জ্ঞান প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ আর বিবিধ পরীক্ষণের দ্বারা তত্ত্বাবধান এবং ব্যবস্থীত হয়, সেটা আধুনিক বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে মানা হয়। এরদ্বারা এটাও স্পষ্ট হচ্ছে যে, আমাদের কাছে পরীক্ষণের যত অধিক সাধন উপলব্ধ হবে, আমাদের বিজ্ঞান তত অধিক পরীক্ষণ করে সৃষ্টির পদার্থকে জানতে পারবে। নিজের টেকনিক্যাল সাধনের সীমার বাইরে কোনো পদার্থ, সেটা যত যথার্থই হোক না কেন, তাকে বিজ্ঞান স্বীকার করতে পারে না। আইজ্যাক নিউটনের পূর্বে গুরুত্বাকর্ষণ বলের জ্ঞান পশ্চিমী দেশের বিজ্ঞানের ছিল না, গ্যালিলিও এবং কোপারনিকাসের পূর্বে পৃথিবীর আকার ও পরিক্রমণের জ্ঞান ছিল না, ততক্ষণ তাদের জন্য গুরুত্বাকর্ষণ বল, পৃথিবীর গোলাকৃতি হওয়া তথা সূর্যের চতুর্দিকে পরিক্রমণ করা আদি বিষয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের মধ্যে আসতো না অর্থাৎ এইসব তথ্য কল্পনামাত্র ছিল। কিন্তু যখন এই বৈজ্ঞানিকরা এগুলোর উপর পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগ করে, তখন এইসব তথ্য বৈজ্ঞানিক সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আজ সংসারের মধ্যে যা যা নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, সেইসব আজকের পূর্বে কল্পনার বিষয় ছিল কিন্তু এখন বিজ্ঞান ও টেকনিক হয়েছে। এই কারণে বলা হচ্ছে যে বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। এটাকে বর্তমান বিজ্ঞানের বিশেষত্ব বলা হবে নাকি অপূর্ণতা, এটা বৈজ্ঞানিকদের স্বয়ং ভাবা উচিত। আমি সূর্যকে দেখতে পারি আর না পারি, এরদ্বারা সূর্য আর তার বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না, তাহলে আমি এটাকে নিজের পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের সীমার মধ্যে কঠোরভাবে কেন বেঁধে রাখার জিদ করবো? স্থূল রূপে জ্ঞানের দুটো ক্ষেত্র আছে। একটা হল, যার পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের টেকনিক বর্তমানে উপলব্ধ আছে, দ্বিতীয়টা হল, যার প্রয়োগ ও পরীক্ষণের টেকনিক মানুষ দ্বারা বিকশিত করার সম্ভাবনা হতে পারে। এছাড়া জ্ঞানের একটা ক্ষেত্র এরকমও আছে যার প্রয়োগ ও পরীক্ষণ কোনো টেকনিক দ্বারা সম্ভব নয়, বরং যাকে য়োগ সাধনাজন্য দিব্যদৃষ্টি দ্বারাই জানা যেতে পারে। এই তিন প্রকারের জ্ঞানের মধ্যে উচিত তর্ক হওয়াটা অনিবার্য হবে। যে কথা সামান্য সুতর্ক তথা ঊহার দৃষ্টি দ্বারাও অসম্ভব মনে হবে, সেটা উপরোক্ত তিন প্রকারের জ্ঞানের মধ্যে একটাও জ্ঞানের ক্ষেত্রের মধ্যে আসবে না। এখানে ঊহা ও তর্কের যথার্থ অভিপ্রায়ও গম্ভীর বিচারকই জানতে পারবে, সামান্য ব্যক্তি নয়। যে যে ব্যক্তির প্রতিভা, সাধনা যত-যত অধিক হবে, তার-তার তর্ক ও ঊহা শক্তি তত-তত অধিক যথার্থ হবে। এই কারণে বর্তমান বিজ্ঞানকে তার নিজের সীমার বাইরে গিয়ে সুতর্ক ও ঊহার দৃষ্টি দিয়েও বিচার করা উচিত। যদি কোনো সজ্জন এটা বলে যে সুতর্ক ও ঊহা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো গুরুত্ব নেই, আমি সেই সজ্জনকে বলতে চাইবো যে, বিজ্ঞানের জন্ম সুতর্ক এবং ঊহা দিয়েই হয় আর যেখানে বিজ্ঞানের সামর্থ্য বা সীমানা সমাপ্ত হয়ে যায়, সেখানে তার সমাপ্তি সুতর্ক ও ঊহা রূপ দর্শনের মধ্যেই হয়ে যায় কিংবা বিজ্ঞানের চরম সীমা অতিক্রম করে দর্শনের সীমা পুনঃ প্রারম্ভ হয়ে যায়।
_________________________________
∆Big Bang এর উপর আচার্যজীর সমীক্ষা আপনি "বেদ-বিজ্ঞান আলোকঃ" গ্রন্থে পড়তে পারেন বা Vaidic Physics YouTube Channel এ ভিডিও দেখতে পারেন।
যখন নিউটন আপেলকে গাছ থেকে নিচে পড়তে দেখেন, সেই সময় তার মনে এই ঊহা ও তর্কের উৎপত্তি হয়েছিল যে আপেলটা নিচেই কেন পড়েছে? তার এই ভাবনার দ্বারা গুরুত্বাকর্ষণের সন্ধান আর এতদর্থ করা প্রয়োগ, পরীক্ষণ ও প্রয়োগের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। আপেল পড়তে অনেকেই দেখেছে বা সেই সময়ও দেখতো কিন্তু এই ভাবনা নিউটনের মস্তিষ্কেই এসেছিল, কারণ তিনি তর্ক ও ঊহা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। দর্শনকে ইংরেজি ভাষায় Philosophy বলা হয়, যার পরিভাষা করে Chambers Dictionary -তে লেখা আছে যে -

"In pursuit of wisdom and knowledge, investigation contemplation of the nature of being knowledge of the causes and laws of all things. The principles Underlying any sphere of knowledge, reasoning."

Oxford Advanced Learners Dictionary -তে এটাকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে -

"Search for knowledge and understanding of the nature and meaning of the Universe and human life."

আজ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বস্তু, তাদের কারণ তথা কাজ করার সিদ্ধান্ত আদিকে তর্ক ও ঊহার আধারে জানার চেষ্টা করাকেই দর্শন বলা হয়। এরদ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ের উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মাণ্ডকে জানার চেষ্টা করা। উভয় প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু ভেদ আছে অবশ্য কিন্তু উভয়ের উদ্যেশ্যটা হল সমান। বিজ্ঞানের ক্ষেত্র মানব টেকনিকের সামর্থ্য পর্যন্ত সীমিত আর দর্শনের ক্ষেত্র চিন্তন, মনন, ঊহার সীমানা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। কোথাও বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণাদি কর্মের বিদ্যমানতার মধ্যেও মূল কারণ বা নিয়মাদি বিষয়ের মধ্যে বিভ্রান্ত হতে পারে, তো কোথাও দর্শনও দার্শনিকদের (বিশেষ করে পরম সিদ্ধ য়োগীদের বাদ দিয়ে) কল্পনার স্রোতে বয়ে ভ্রান্ত হতে পারে। আমাদের দুটোই শৈলীর বিবেক সম্মত ব্যবহারের চেষ্টা করা উচিত। এখন আমরা বিজ্ঞান ও দর্শনের সীমা আর সমন্বয়কে দেখার সঙ্গে সৃষ্টির একটা নিয়মের উপর বিচার করবো। যখন আমরা একথার উপর চিন্তন করি যে একটা ধনাবেশিত বস্তু অপর ঋণাবেশিত বস্তুকে কেন আকর্ষিত করে? তখন এই জ্ঞানের প্রক্রিয়াতে সর্বপ্রথম আমাদের এটা অনুভব হয় যে বিপরীত আবেশকারী যেকোনো বস্তু একে-অপরকে আকর্ষিত করে। এখানে আকর্ষণ বল আছে, তাই সেটার কারণও হবে, এটা বিচার করা হল দর্শনের ক্ষেত্র। কোনো দুটো বস্তু পরস্পর নিকটে আসছে, তখন তাদের মাঝে কোনো আকর্ষণ বল কাজ করে থাকবে, এটা জানাও দর্শনের ক্ষেত্র। এখন সেই আকর্ষিত হতে থাকা বস্তুর উপর বিপরীত বৈদ্যুত্ আবেশ আছে, এটা বলা বিজ্ঞানের কাজ। এই আবেশ কিভাবে কাজ করে? এটা বলাও বিজ্ঞানের কাজ। বর্তমান বিজ্ঞান জেনেছে যে যখন দুটো বিপরীত আবেশকারী কণা নিকটে আসে, তখন তাদের মাঝে Virtual Photons উৎপন্ন আর সঞ্চারিত হতে থাকে। এই Particles (Photons) -ই আকর্ষণ বলের কারণ হয়। এই Particles বর্তমান বিজ্ঞানের মতে সেই দুটো কণার মাঝে বিদ্যমান Space -কে সংকুচিত করে সেই কণাগুলোকে পরস্পর নিকটে নিয়ে আসার কাজ করে। এই প্রক্রিয়াকে জানা বিজ্ঞানের কাজ। সম্ভবত বিজ্ঞানের সীমা এখানে সমাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এরপর দর্শন বা বৈদিক বিজ্ঞানের সীমা প্রারম্ভ হয়।

যখন আমি জিজ্ঞেস করি যে, ধন ও ঋণ বৈদ্যুত আবেশযুক্ত কণাগুলো পরস্পর নিকটে আসতেই Virtual Particles কোথা থেকে ও কেন প্রকট হয়ে যায়? তখন বৈজ্ঞানিক উত্তর দেয় যে এটার উত্তর আমরা জানি না। বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে যেখানে উত্তর পাওয়া যায় না, সেখানে বৈদিক বিজ্ঞান বা দর্শন উত্তর দিয়ে দেয়। এই উত্তর বৈদিক ঋষিদের বা বেদের মহান বিজ্ঞান দ্বারা পাওয়া যাবে, যাকে আমি কোনো পৃথক্ পুস্তকে স্পষ্ট করবো। এখানে আমি বলতে চাই যে, বর্তমান বিজ্ঞান কোনো বল -এর কাজ করার প্রক্রিয়াকে বলে, অপরদিকে বৈদিক বিজ্ঞান কিংবা দর্শন তারও আগে গিয়ে বলে দেয় যে সেই বলের প্রক্রিয়া কেন হচ্ছে আর মূল প্রেরক বল কি? সেখানে আমরা এটা সিদ্ধ করবো যে সব জড় বলের মূল প্রেরক বল হল চেতন পরমাত্মা তত্ত্বের বল। এখানে বর্তমান বিজ্ঞান না তো আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেয় আর না ঈশ্বর তত্ত্বের মূল প্রেরক বলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে। এরকম দুরাগ্রহ কোনো বৈজ্ঞানিকের জন্যই উচিত নয়। তাকে হয় সমস্যার সমাধান করা উচিত অথবা বৈদিক বৈজ্ঞানিকদের নিকট সমাধান জিজ্ঞেস করা উচিত।

এখানে আমরা চর্চা করছিলাম যে, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা পরিচিত মূলকণা অনাদি হতে পারে না আর তাই তাতে হওয়া যেকোনো প্রকারের ক্রিয়া বা গতিও অনাদি হতে পারে না। যদি কেউ এটা জিদ করে বলে যে, ধরে নিন যে মূলকণা প্রাণাদি সূক্ষ্ম পদার্থ বা প্রকৃতি রূপ সূক্ষ্মতম পদার্থ দ্বারা নির্মাণ হয়েছে, তাহলেও সেই সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মতম কারণ পদার্থের মধ্যে গতি অনাদি কেন হতে পারবে না? কেন এর জন্য চেতন ঈশ্বর তত্ত্বের আবশ্যকতা হবে?

এই বিষয়ের উপর আমি এইভাবে বিচার করি যে -
এই সৃষ্টিতে যেসব গতি এবং বলের অস্তিত্ব আছে, সেটা পদার্থের সূক্ষ্মতম অবস্থা পর্যন্ত প্রভাবী হয়। পদার্থের অণুগুলোতে হওয়া যেকোনো ক্রিয়া, বল আদির প্রভাব তারমধ্যে বিদ্যমান আয়ন্স পর্যন্ত হয়। আয়ন্সের মধ্যে হওয়া প্রত্যেক গতি ও বল আদির প্রভাব বা সম্বন্ধ ইলেকট্রন্স, প্রোটন্স, নিউট্রন্স বা ক্বার্স ও গ্লুআন্স পর্যন্ত হয়। আমার বিশ্বাস যে, বর্তমান বিজ্ঞানও এটাকে মিথ্যা বলবে না। এই সূক্ষ্ম কণার গঠন ও স্বরূপের বিষয়ে বর্তমান বিজ্ঞান অনভিজ্ঞ, এই কারণে এগুলোর মধ্যে হওয়া গতি, ক্রিয়া, বল আদির প্রভাবের ব্যাপকতার বিষয়ে তারা অনভিজ্ঞ। এই প্রভাব প্রাণ, মন ও বাক্ তত্ত্ব পর্যন্ত ব্যাপ্ত থাকে, যা মূল প্রকৃতি ও ঈশ্বরের মধ্যে সমাপ্ত হয়। আসলে ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্যে কোনো ক্রিয়া হয় না আর প্রকৃতির মধ্যে ক্রিয়া ঈশ্বরীয় প্রেরণা দ্বারা হয়, আর তারফলে প্রকৃতির মূল স্বরূপ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এইসব জ্ঞান বর্তমান বিজ্ঞান বা টেকনিক দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। গতি ও বলের ব্যাপ্তির পশ্চাৎ আমরা এটাও বিচার করবো যে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে হতে চলা প্রত্যেক ক্রিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পদ্ধতির দ্বারা হচ্ছে। সমস্ত সৃষ্টি যেমন-তেমন কোনো ক্রিয়ার পরিণাম নয়, বরং প্রত্যেক ক্রিয়া অত্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে ও বিশেষ প্রয়োজনানুসারে হচ্ছে। মূলকণা, কোয়ান্টা আদি সূক্ষ্ম পদার্থ কিংবা বিভিন্ন বিশাল লোক-লোকান্তর আদি পদার্থ জড় হওয়ার কারণে না তো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ক্রিয়াগুলো করতে পারে আর না তারা নিজের ক্রিয়ার প্রয়োজনও বুঝতে পারে।

Stephen Hawking, যিনি তার নিজের পুস্তক "The Grand Design" এরমধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তার অবৈজ্ঞানিক কুতর্ক দিয়ে অস্বীকারের অসফল চেষ্টা করেছেন, সেখানে শরীরের মধ্যে জীবাত্মার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করার অসফল চেষ্টা করেন। তিনি তারমধ্যে রোবট এবং পরগ্রহী জীবের মধ্যে পার্থক্যও করেন, তারপরও পরগ্রহী জীবের মধ্যে স্বতন্ত্র ইচ্ছা ও বুদ্ধিযুক্ত আত্মাকে মানেন না। এই জিদটাই বর্তমান বিজ্ঞানকে বিনাশকারী ভোগবাদীর মার্গে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন -
"How can one tell if a being has free will? If One encounters an alien, how can one tell if it is just a robot or it has a Mind of its own? The behavior of a robot would be completely determined, unlike that of a being with free will. Thus one could in principle detect a robot as a being whose actions can be predicted. As we said in Chapter 2, this may be impossibly difficult if the beings large and complex. We can not even solve exactly the equations for three or more particles interacting with eachother. Since an alien the size of a human would contain about a thousand trillion trillion particles even if the alien were a robot, it would be impossible to sole the equations and predict what it would do. We would therefore have to say that any complex being has free will-not as a fundamental feature, but as an effective theory, admission of our inability to do the calculations that would enable us to predict its actions." (The Grand Design - P. 178)

এখানে পাঠক ভাবুন যে, যদি Thousand trillion trillion particles -ই বুদ্ধি, ইচ্ছার উৎপত্তির কারণ হতে পারে, তাহলে কি রোবটের মধ্যে এত কণা হয় না? সেটাও তো সেই মূলকণা দিয়ে নির্মিত হয়েছে, যেগুলো দিয়ে আমাদের শরীর নির্মিত হয়েছে। অণুর স্তরের উপরেই ভেদ আছে, নয়তো প্রায় পরমাণুর স্তরে কোনো ভেদ নেই, মূলকণা স্তরে তো নিতান্ত সমতা আছে। তাহলে কিভাবে কণার সংখ্যা মাত্রের কারণ ভেদকে মেনে নেন আর জীবের ব্যবহারকে কেবল এই আধারের উপর অজ্ঞেয়বাদী বলে দেন। আজ একটি মানুষ অনেক স্বচালিত রোবটের নির্মাণ করতে পারে কিন্তু অনেক রোবটস্ মিলেও বিনা মানুষের প্রেরণা ও নিয়ন্ত্রণে একটা মানুষ কেন, স্বয়ং একটা রোবটের নির্মাণও কি করতে পারবে? এই অবৈজ্ঞানিকতা ও দম্ভপূর্ণ পুস্তকের মধ্যে জন্ম, মরণ, ইচ্ছা আদিকে যে ভাবে বোঝানো হয়েছে, তা বাস্তবে হকিং সাহেবকে বৈজ্ঞানিকের স্থানে এক প্রতিক্রিয়াবাদী দুরাগ্রহী (একগুঁয়ে) নাস্তিক দার্শনিকের রূপে প্রস্তুত করেছে। এটাকে পড়ে আমার মনে তার যা সম্মান ছিল, তা প্রায় সমাপ্ত হয়ে গেছে। তার প্রত্যেক তর্কের উত্তর সহজভাবে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এই গ্রন্থে জীবের সত্তার (অস্তিত্বের) সিদ্ধি আবশ্যক নয়, তবুও এখানে আমি সংক্ষেপে কিছু বিচার রাখবো।

রোবটে ইচ্ছা, জ্ঞান, প্রয়ত্ন, দ্বেষ, সুখ ও দুঃখ এইসব কোনো গুণ থাকে না। সেটা কোনো মনুষ্য দ্বারা নির্মিত ও সঞ্চালিত হয়। অন্যদিকে যেকোনো জীবিত প্রাণী অন্য কারও দ্বারা সঞ্চালিত হয় না, বরং প্রত্যেক কর্ম করতে স্বতন্ত্র হয়। আজ হকিং সাহেবের মতো যেকোনো বৈজ্ঞানিক ইচ্ছা, জ্ঞান আদি গুণ দ্বারা যুক্ত ব্যবহারের কথিত ব্যাখ্যা করে জীবাত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা করছে, তারা আসলে এইধরনের যে, যেমন কোনো ব্যক্তি কোনো রাঁধুনির দ্বারা রান্না করা ব্যঞ্জনের ব্যাখ্যাতে আগুন, জল, আটা, চিনি, দুধ, ঘী, করাই, চামুচ আদি সব কিছুর কাজের কথা বলছে, এই খাদ্য পদার্থে নানা পরিবর্তনের রাসায়নিক প্রক্রিয়াকেও বলছে কিন্তু রাঁধুনির চর্চাই করছে না, বরং তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। এরকম কথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বাস্তবে অবৈজ্ঞানিক ও দুরাগ্রহপূর্ণই হয়।

এই বৈজ্ঞানিক এইভাবে এই সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করার সময় তার নির্মাতা, নিয়ন্ত্রক বা সঞ্চালক অসীম বুদ্ধি ও বল দ্বারা সম্পন্ন চেতন পরমাত্মা তত্ত্বের শুধু উপেক্ষাই করে না, বরং তার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জোর লাগিয়ে দেয়। আমি নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিকদের সেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রশংসা করবো, যারা মূল ভৌতিকীর ক্ষেত্রে নিরন্তর গম্ভীর অনুসন্ধান করছে আর করাও উচিত কিন্তু তারা এই সম্পূর্ণ উপক্রমে চেতন নিয়ন্ত্রক, নিয়ামক তত্ত্বকে সরাসরি উপেক্ষিত করে দেয়, এটাই হচ্ছে কারণ যে, বিজ্ঞান বর্তমান মূল ভৌতিকীর অনেক সমস্যার আজ পর্যন্ত সমাধান করতে পারেনি। আর এই কারণে বিজ্ঞানের History of the time এরমধ্যে ভারী মাত্রায় ত্রুটি আছে, ঊর্জা - দ্রব্য সংরক্ষণের ভঙ্গ হওয়ার সমস্যা আছে, "কেন" ও "কি" -এর মতো প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে পাওয়ার সমস্যা আছে, বস্তুতঃ সর্বত্র সমস্যাই সমস্যা আছে।

এসব লেখার অভিপ্রায় হচ্ছে এটাই যে, সম্পূর্ণ জড় জগতে যেসব বল ও গতি বিদ্যমান আছে, সেই সবের পিছনে চেতন ঈশ্বর তত্ত্বেরই মূল ভূমিকা থাকে। আবার প্রাণীদের শরীরে আত্মার ভূমিকা থাকে। প্রত্যেক গতির পিছনে কোনো না কোনো বলের ভূমিকা থাকে। কেবল বলের ভূমিকা দিয়ে গতি যদৃচ্ছয়া, নিষ্প্রয়োজন এবং অব্যবস্থিত হবে কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে একটা ব্যবস্থিত, বুদ্ধিগম্য ও সপ্রয়োজনীয় রচনা, এই কারণে এরমধ্যে বলের সঙ্গে মহতী প্রজ্ঞারও ভূমিকা অবশ্যই আছে। বল ও বুদ্ধি কিংবা ইচ্ছা, জ্ঞান আদির হওয়া কেবল চেতনের মধ্যেই সম্ভব। সেই চেতন তত্ত্বকেই ঈশ্বর বলা হয়। এই তত্ত্বের উপর বিচার করাটা বর্তমান বিজ্ঞানের সামর্থ্য নেই, এই জন্য বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের ভৌতিক বিজ্ঞানের সঙ্গে-সঙ্গে দর্শন শাস্ত্র, যেখানে ঈশ্বর, জীব রূপী সূক্ষ্মতম চেতন তত্ত্ব এবং প্রকৃতি, মন, প্রাণ, আদি সূক্ষ্মতম জড় পদার্থের বিচার করা হয়, এর উপরেও চিন্তন করা উচিত, এরদ্বারা বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞানের অনেক সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা পাওয়া যাবে।

•••পঞ্চাবয়ব দ্বারা ঈশ্বরের সিদ্ধি•••

মহর্ষি গৌতম কোনো সিদ্ধান্তের (Theory) নিরূপণের উপায়ে পাঁচটা অবয়ব বলেছেন -

"প্রতিজ্ঞাহেতূদাহরণোপনয়নিগমনান্যাবয়বাঃ"
(ন্যায়দর্শন 1.1.32)
অর্থাৎ - এই পাঁচটা অবয়ব হল এইরকম -

(১) প্রতিজ্ঞা= গতি হল অনিত্য।
(২) হেতু= কারণ আমরা এটাকে উৎপন্ন ও নষ্ট হতে দেখি।
(৩) উদাহরণ= যেরকম সংসারের মধ্যে জড় পদার্থ বা চেতন প্রাণীদের দ্বারা নানা প্রকারের গতি উৎপন্ন হতে দেখা যায়, তার সঙ্গে সেই গতির বিরামও চেতন দ্বারা হতে দেখা যায়।
(৪) উপনয়= সেই ভাবে অন্য গতিও হল অনিত্য।
(৫) নিগমন= সব দৃষ্ট বা অদৃষ্ট গতি হল অনিত্য।

গতির অনিত্যতার সিদ্ধির সঙ্গে এই প্রকার গতির পিছনে চেতন কর্তার অস্তিত্বের সিদ্ধি করে -

(১) প্রতিজ্ঞা= গতি মূলত চেতনের বল দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
(২) হেতু= আমরা জগতের মধ্যে বিভিন্ন গতিকে বিভিন্ন প্রাণীর দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখি।
(৩) উদাহরণ= যেরকম আমরা স্বয়ং নানা গতিকে উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকি।
(৪) উপনয়= সেইভাবে অন্য গতি, যাদের কোনো প্রেরক ও নিয়ন্ত্রক সাক্ষাৎ দেখা যায় না, সেগুলোও কোনো অদৃষ্ট চেতন তত্ত্ব (ঈশ্বর আদি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রেরিত হয়।
(৫) নিগমন= সব প্রকারের গতিকে উৎপন্ন, প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রণকারী কোনো না কোনো চেতন তত্ত্ব (ঈশ্বর অথবা জীব) অবশ্যই হয় অর্থাৎ বিনা চেতন গতি উৎপন্ন, নিয়ন্ত্রিত ও সঞ্চালিত হতে পারবে না।

এই ভাবে বলের বিষয়ে বিচার করা যাক -

(১) প্রতিজ্ঞা= প্রত্যেক বলের পিছনে চেতন তত্ত্বের ভূমিকা আছে।
(২) হেতু= কারণ আমরা চেতন প্রাণীর মধ্যে বলের উপস্থিতি দেখি।
(৩) উদাহরণ= যেরকম সংসারের মধ্যে আমরা নানা ক্রিয়ার মধ্যে নিজের বলের ব্যবহার করে থাকি।
(৪) উপনয়= সেইভাবে সৃষ্টির মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকারের বল দেখা যায়, সেইসবের মধ্যে কোনো অদৃষ্ট চেতনের ভূমিকা থাকে।
(৫) নিগমন= প্রত্যেক বলের পিছনে কোনো না কোনো চেতনের (ঈশ্বর অথবা জীব) মূল ভূমিকা অবশ্যই থাকে কিংবা সেই বল ওই চেতনেরই হয়। জড় পদার্থের মধ্যে নিজের কোনো বল থাকে না।

এখন বুদ্ধিগম্য কাজের মধ্যে চেতন তত্ত্বের ভূমিকার উপর বিচার করা যাক -

(১) প্রতিজ্ঞা= প্রত্যেক বুদ্ধিগম্য, ব্যবস্থিত রচনার পিছনে চেতন তত্ত্বের ভূমিকা থাকে।
(২) হেতু= কারণ আমরা চেতন প্রাণীদের দ্বারা বুদ্ধিগম্য কাজ করতে দেখি।
(৩) উদাহরণ= যেরকম আমরা আমাদের বুদ্ধির দ্বারা নানা প্রকারের কাজকে সিদ্ধ করি।
(৪) উপনয়= সেইভাবে সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন বুদ্ধিগম্য রচনার পিছনে ঈশ্বর রূপী অদৃষ্ট চেতনের ভূমিকা থাকে।
(৫) নিগমন= সবপ্রকারের বুদ্ধিগম্য রচনার কিংবা সম্পূর্ণ সৃষ্টির প্রত্যেক ক্রিয়ার পিছনে চেতন তত্ত্বের অনিবার্য ভূমিকা থাকে।

এইভাবে সংযোগজন্য পদার্থের অনাদি ও অনন্ত না হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন গতি, বল ও বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ রচনার পিছনে চেতন তত্ত্বের অনিবার্য ভূমিকা থাকে। কিছু কাজের মধ্যে জীব রূপী চেতনের ভূমিকা থাকে। এই কারণে মহর্ষি বেদব্যাস জী লিখেছেন "সা চ প্রশাসনাত্" (ব্র০সূ০ 1.3.11) অর্থাৎ এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির নানা ক্রিয়াগুলো সেই ব্রহ্মের প্রশাসন দ্বারাই সম্পন্ন হয়।

এইভাবে যেকোনো পদার্থ সূক্ষ্ম কারণ পদার্থের সংযোগ দ্বারাই নির্মিত হয়, তথা যেটা অন্য কিছুর দ্বারা প্রেরিত গতি, বল, ক্রিয়া আদি গুণ যুক্ত হয়, সেই পদার্থ অনাদি হতে পারে না, আবার যে পদার্থ এরকম সূক্ষ্মতম রূপে বিদ্যামান হয়, যার অন্য কোনো কারণ বিদ্যামান হয় না, সেটা অনাদি হতে পারে। এরদ্বারা স্পষ্ট হল যে, মূল প্রকৃতি রূপ পদার্থের মধ্যে যেখানে কোনো গতি আদি গুণ বিদ্যামান থাকে না, সেটা হচ্ছে অনাদি। এই অনাদি পদার্থের দ্বারা সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক, নিয়ামক, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর তত্ত্ব এই সৃষ্টির রচনা সময়ে - সময়ে করতে থাকে। কখনও সৃষ্টি, তো কখনও প্রলয় হতে থাকে। এই সৃষ্টি-প্রলয় চক্রের না তো কোনো আদি আছে আর না কোনো অন্ত। না তো কোনো সৃষ্টি অনাদি ও অনন্ত হতে পারবে আর না প্রলয় কিন্তু এটার চক্র অবশ্যই অনাদি ও অনন্ত হবে।

এইভাবে আমরা Big Bang Theory এবং Eternal Universe এই দুটো মান্যতাকেই নিয়ে সৃষ্টির রচয়িতা চেতন ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের অনিবার্যতাকে সিদ্ধ করলাম। String Theory এবং M-Theory দুটোই Big Bang -এরমধ্যেই বিশ্বাস করে, এই কারণে এটাকে নিয়ে পৃথক্ ভাবে ঈশ্বর তত্ত্বের সিদ্ধির আবশ্যকতা নেই। প্রবুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাবান্ পাঠকদের উচিত যে, তারা তাদের নিজের জিদ, দুরাগ্রহ ও অহংকারকে ত্যাগ করে সত্য বৈজ্ঞানিকতার পরিচয় দিবেন।


সাধারণতঃ ঈশ্বরের অনুভব কেন হয় না ? 

এখানে আপনি এই প্রশ্ন করতে পারেন যে, সৃষ্টির বিভিন্ন ক্রিয়ার কর্তার রূপে আমাদের ঈশ্বরের অনুভব কেন হয় না? চলুন এই প্রশ্নের উপরে বিস্তারভাবে বিচার করি -

এখানে আমরা সর্বপ্রথম বিচার করবো যে, কোনো ক্রিয়ার সঞ্চালক বা কর্তার অনুভব কোন-কোন
পরিস্থিতিতে হয়?
(১) কর্তা সাকার হলে পরে যে কেউ তার প্রত্যক্ষ করতে পারে।
(২) ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্তির লক্ষণগুলোর অনুভব হলে পরেও কর্তার বোধ সহজ হয়।
(৩) কর্তা নিজের মধ্যে ক্রিয়া বিশেষ দ্বারাও তার কর্তাপনের অনুভব হয়।
(৪) কর্তার অনুভবের জন্য ক্রিয়ার বিবিধ গতিবিধি বা লক্ষণগুলোকে শনাক্ত করার জ্ঞান অনিবার্য।
(৫) কর্তা নিরাকার হলে সিদ্ধান্ত নিরূপণের উপরে পাঁচটা অবয়বের সম্যগ্ জ্ঞান অনিবার্য।

এখন উপর্যুক্ত বিন্দুগুলোর উপর ক্রমশঃ বিচার করা যাক -

(১) কর্তা সাকার হলে পরে তার প্রত্যক্ষ হওয়া সরল হবে। আমরা সংসারে বিভিন্ন ক্রিয়ার সঞ্চালক, নিয়ন্ত্রক এবং বিভিন্ন বস্তুর নির্মাতাকে প্রত্যক্ষ দেখতে পারি। এরমধ্যে কোনো সংশয় নেই। সৃষ্টির কর্তা ঈশ্বর তত্ত্ব সাকার না হওয়ায় নেত্র দ্বারা প্রত্যক্ষ হয় না। একইভাবে সেটা স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দের বিষয় না হওয়ায় রসনা, প্রাণ, ত্বচা ও শ্রোত দ্বারাও প্রত্যক্ষ হয় না।

(২) সংসারের মধ্যে হতে চলা অনেক ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্ত হতে আমরা প্রত্যক্ষ দেখে থাকি, এই কারণে সেই ক্রিয়াগুলোর প্রারম্ভ ও সমাপন কর্তার বোধ সহজভাবেই হয়ে যায়। সৃষ্টির সেই ক্রিয়া, যাদের প্রারম্ভ হতে অথবা সমাপ্ত হতে, আমরা দেখতে পারি না অর্থাৎ যেসব ক্রিয়াকে আমরা নিজের জন্ম থেকে মরণ পর্যন্ত যথাযথ দেখে ও শুনে থাকি, সেইসব ক্রিয়ার প্রারম্ভ ও সমাপ্ত হওয়ার বিচার আমাদের মাথায় আসেই না। আকাশের মধ্যে বিভিন্ন লোকের ভ্রমণ, প্রকাশন, অণু বা পরমাণুর গতি আদি আমরা জন্ম থেকেই যেমনটা দেখেছি ও শুনেছি, তেমনটাই এখন পর্যন্ত চলছে আর আমাদের জীবনের অন্তেও সেরকমই থাকবে। এই কারণে এদের কর্তা, নিয়ন্ত্রক, সঞ্চালক আদি গুণযুক্ত কোনো চেতন কর্তার সাধারণতঃ কল্পনাও হয় না। যদি কোনো অত্যল্পায়ু জীব কোনো বাহনকে কেবল চলন্তই দেখে, তাকে কখনও বিরাম অবস্থায় না দেখে, তাহলে তার মনের মধ্যে এই বিষয় আসবেই না যে, এটাকে কোনো কর্তা চালায় বা চালাচ্ছে।

(৩) যখন কোনো সাকার কর্তাও যদি কোনো বাহন আদি যন্ত্রের পাশে বসে থাকে কিন্তু নিজের শরীরের মধ্যে কোনো রূপ ক্রিয়াও না করে, তাহলেও কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর এরকম বোধ হবে না যে সেই কর্তা (চালক) ঐ বাহনটাকে চালাচ্ছে, বরং সে এইরকম মনে করবে যে বাহনটা স্বতঃই চলছে।

(৪) যতক্ষণ পর্যন্ত কাউকে ক্রিয়ার আদি, অন্ত ও মাঝের মধ্যে প্রতিত কারক নানা লক্ষণের জ্ঞান হবে না, ততক্ষণ তার কর্তার বোধ হবে না। কোনো পশুর এটা বোধ হয় না যে, কোনো ব্যক্তি বাস, রেল, উড়োজাহাজ আদি চালায়। সে এই বাহনগুলোকে চলতে ও থামতেও দেখে, তারমধ্যে বসে থাকা চালকটাকেও দেখতে পারে, তবুও তার এই বোধ হয় না যে সেই চালকটাই এই বাহনটাকে চালাচ্ছে বা থামাচ্ছে।

(৫) উপর্যুক্ত চারটা বিন্দু হল সাকার কর্মের সঙ্গেই সম্বন্ধিত। যদি কর্তা নিরাকার হয়, তাহলে সেই স্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিরূপণের সব পাঁচটা অবয়বকে বোঝার হেতু প্রতিভা থাকাটাও অনিবার্য, তা না হলে ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের বোধ হবে না। বর্তমান বিজ্ঞান কেবল প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মধ্যেই বিশ্বাসী, গণিতীয় ব্যাখ্যার মধ্যেই বিশ্বাস করে, এই কারণে ঈশ্বর অস্তিত্বের বোধ তাদের হয় না। যেখানে তাদের সীমা সমাপ্ত হয়ে যায়, সেখানে তারা বলে দেয় যে, আমরা জানি না। এই কথা তো সত্য যে, আপনারা জানেন না কিন্তু আপনাদের কি জানবার চেষ্টাও করা উচিত না? এখানে বৈদিক বিজ্ঞান বা দর্শনের আশ্রয় নেওয়াটাও কি আপনাদের উচিত না? আপনারা এটা কেন মনে করেন যে, যা বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা সিদ্ধ হওয়ার যোগ্য, সেটাই সত্য, অন্য সবই মিথ্যা। এই বিষয়ে Richard P. Feynman ঠিকই লিখেছেন -
"Mathematics is not a science from our point of view, in the sense that it is not a natural science. The test of its validity is not experiment. We must incidentally, make it clear from the beginning that if a thing is not science it is not necessarily bad. For example, love is not a science. So, if something is said not to be a science, it does not mean that there is something wrong with it, it just means that it is not a science." (Lectures on Physics - P. 27)
অর্থাৎ যাকে বর্তমান বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে মানা যেতে পারে না, সেটা মিথ্যা, এমনটা মানা উচিত নয়। তাকে কেবল এটা বলা উচিত যে এটা বিজ্ঞান না।

বস্তুতঃ Feynman মডার্ন সায়েন্সের পরিভাষার আধারেই এটা বলেছেন, তবুও তিনি বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়কে মিথ্যা ও অনাবশ্যক মানেন না। আমি বর্তমান বিজ্ঞান এবং দর্শন উভয়ের পরিভাষাকেই স্পষ্ট করেছি। এখন আমরা বৈদিক দৃষ্টি দিয়ে বিজ্ঞানের পরিভাষার উপর বিচার করবো। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী লিখেছেন -

"বিজ্ঞান তাকে বলে যা কর্ম, উপাসনা আর জ্ঞান এই তিনটা দিয়ে যথাযথ ব্যবহারে নেওয়া আর পরমেশ্বর থেকে তৃণ পর্যন্ত পদার্থের সাক্ষাৎ বোধ হওয়া, তার থেকে যথাযত ব্যবহার করা।" (বেদ বিষয় বিচার - ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা)

এটার সংস্কৃত ভাষ্যতে "পৃথিবীতৃণমারম্য প্রকৃতিরপর্য়ন্তানাম্ পদার্থানাম্ জানেন য়থাবদুপকাগ্রহণ..." বলে প্রকৃতি পর্যন্ত অর্থাৎ স্থূলতম থেকে সূক্ষ্মতম পদার্থের যথাযত জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। এরমধ্যে ঈশ্বর ও জীবেরও যথার্থ জ্ঞান সম্মিলিত আছে। এই যথার্থ জ্ঞান কিভাবে প্রাপ্ত করা যাবে, এই বিষয়ে বলেছেন যে, জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনা দিয়ে যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। এর তাৎপর্য হল সত্যশাস্ত্রের গম্ভীর অধ্যয়নের পশ্চাৎ তাকে কর্ম অর্থাৎ প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ দ্বারা পুষ্ট করা, যাকে আজকের বিজ্ঞানও করছে। যে বিষয় প্রয়োগ বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা সিদ্ধ বা সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব নয়, তাদের জন্য উপাসনাকে বিশেষ সাধন রূপ বলা হয়েছে। য়োগ সাধনার দ্বারা প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি হল বৈদিক ঋষিদের সেই বিশিষ্ট দান, যার বলের উপর সেই ঋষিগণ সৃষ্টির সঙ্গে-সঙ্গে জীব ও ঈশ্বরের মতো নিরাকার চেতন পদার্থের সাক্ষাৎ করে যথার্থ বিজ্ঞানকে প্রাপ্ত করেছিলেন। এই জ্ঞান প্রায়শঃ নির্ভুল হয়। এই অন্তর্দৃষ্টির দ্বারাই প্রাপ্ত যথার্থ বিজ্ঞানকে সেই ঋষিগণ কল্প সূত্র, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মনুস্মৃতি, ষঙ্দর্শন, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারত আদি গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই পরময়োগীজন তাদের নিজের উপাসনা=সমাধির দ্বারা সুবিশাল-লোক লোকান্তর থেকে সূক্ষ্ম মূলকণা ও কোয়ান্টাস্ এবং এটার থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণছন্দ ও মরুদ্ আদি পদার্থের মধ্যে নিজের মন বা বুদ্ধিতত্ত্বকে প্রবিষ্ট করিয়ে তাদের অনুভব বিনা কোনো বাহ্য টেকনিকে করতেন। এরও আগে গিয়ে তারা স্বয়ং নিজের আত্ম স্বরূপ এবং সর্বসূক্ষ্ম ও অনন্ত তত্ত্ব ঈশ্বরের সাক্ষাৎ অনুভব করতেন। এইভাবে বৈদিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বর্তমান বিজ্ঞানের অপেক্ষায় অনেক ব্যাপক। আমি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যান করার সময় মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের য়োগদৃষ্টির দ্বারা পরিচিত সৃষ্টির গূঢ় রহস্যগুলোকে স্বয়ং অনুভব করেছি। আশ্চর্য হয় যে, কিভাবে মহর্ষি ভগবন্ত তাঁর নিজের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টি বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ও গম্ভীর রহস্যগুলোকে সাক্ষাৎ করতেন। এই অন্তর্দৃষ্টিও বিনা ঈশ্বরের কৃপায় পাওয়া সম্ভব নয়। এই সম্পূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে ঈশ্বরীয় অস্তিত্বের সংকেত দেওয়ার মতো অনেক প্রসঙ্গ এরপরে তুলে ধরা হবে।
• সৃষ্টিকর্তা - এই সৃষ্টির রচয়িতা, নিয়ন্ত্রক ও সঞ্চালকের রূপে চেতন তত্ত্ব ঈশ্বর সিদ্ধির পরে আমরা এটা বিচার করবো যে, সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে সিদ্ধ করা ঈশ্বর স্বয়ং কিরকম? এর উপর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করা যাক -

• সত্ স্বরূপ - সর্বপ্রথম সেই ঈশ্বর নিত্য হতে হবে। যদি সেই ঈশ্বর অনিত্য হয়ে যায়, তাহলে তার নির্মাতা কেউ তার থেকেও মহতী চেতন সত্তা বিদ্যামান হওয়া উচিত, যেটা কোনো অনিত্য ঈশ্বর নামক পদার্থকে উৎপন্ন করতে পারে। যদি এরকমটাও হয়, তাহলে সেই মহতী চেতন সত্তা অবশ্যই অনাদি, নিত্য হওয়া উচিত। যদি এরকমটা না মানা হয়, তাহলে সেই অনাদি চেতন সত্তাটাকেই ঈশ্বর নাম দেওয়া হবে, নাকি অনিত্য সত্তাটিকে অনাদি মানা হবে। এই কারণে ঈশ্বর সত্ স্বরূপ সিদ্ধ হয়। ধ্যানে রাখার বিষয় হল, যেকোনো চেতন সত্তা কখনও কারও দ্বারাই নির্মাণ হওয়া সম্ভব নয় আর না স্বয়ং নির্মিত হয়, বরং সেটা হচ্ছে নিশ্চিত রূপে অনাদি।

• চিত্ স্বরূপ - সেই ঈশ্বর সত্ স্বরূপ হওয়ার সাথে চেতনও হতে হবে, কারণ কেবল চেতন সত্তাই ইচ্ছা, জ্ঞান ও চেষ্টা এই তিন গুণ যুক্ত হয়ে নানা প্রকারের রচনাকে সম্পাদিত করতে পারে।

• আনন্দ স্বরূপ - এর সঙ্গে সেই সত্তা আনন্দ স্বরূপও হতে হবে। এর কারণ হল যে, সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে রচনার মধ্যে তাঁর কিঞ্চিৎও ক্লেশ, দুঃখ আদি যেন না হয়। যদি সেই সত্তা দুঃখ ও ক্লেশ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা গ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে সেটা সৃষ্টি রচনার মতো মহান্ কর্মকে করতে পারবে না। এইজন্য ঈশ্বর তত্ত্বের পরিভাষাতে মহর্ষি পতঞ্জলিজী বলেছেন -
"ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ"
(য়োগ দর্শন 1.24)
অর্থাৎ - অবিদ্যাদি ক্লেশ, পাপ-পুণ্য আদি কর্ম এবং তার ফল, বাসনা হতে পৃথক্ পুরুষ অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে শয়নরত অর্থাৎ ব্যাপ্ত বিরাজমান চেতন তত্ত্বটাকে ঈশ্বর বলে। এই কারণে সে হচ্ছে সর্বদা আনন্দ স্বরূপ। এইজন্যই মহর্ষি দয়ানন্দ ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ বলেছেন।

• সর্বব্যাপক - আমরা জানি যে আমাদের সৃষ্টিতে বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রায় দুই অরব গ্যালাক্সিকে দেখেছে বা অনুভব করেছে। আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যেই প্রায় দুই অরব তারা আছে। বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত দেখা ব্রহ্মাণ্ডের ত্রিজ্যা 10^26 m -কে মানে। দুই গ্যালাক্সির মাঝে কয়েক অরব-খরব কিলোমিটার ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো লোক হয় না, তবুও সম্পূর্ণ রিক্ত স্থানের মধ্যে সূক্ষ্ম হাইড্রোজেন গ্যাস অত্যন্ত বিরল অবস্থায় ভরা থাকে। তারমধ্যেও Vaccum Energy ভরা থাকে। সারাংশ এই হল যে, এত বড়ো ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নিতান্ত রিক্ত স্থান কোথাও নেই। এরমধ্যে আমাদের সূর্যের থেকে কয়েক কোটি গুণ বড়ো তারাও বিদ্যমান আছে, তাই সূক্ষ্ম লেপ্টন, কোয়ার্ক এবং কোয়ান্টাস্ বিদ্যমান আছে। এছাড়াও এদের থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণ, ছন্দ ও মনতত্ত্বাদি পদার্থ বিদ্যমান আছে। এইসব স্থূল ও সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে গতি ও বলের বিদ্যামানতা আছে। সবার মধ্যে সৃজন ও বিনাশের খেলা হচ্ছে। এই কারণে যেখানে-যেখানে এই খেলা চলছে, সেখানে-সেখানে ঈশ্বর তত্ত্বও বিদ্যমান হওয়া উচিত। এর মানে হল, ঈশ্বর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে তথা স্থূল থেকে স্থূলতম পদার্থের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এই কারণে কঠ উপনিষদের ঋষি বলেছেন -
"অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্"
(কঠ০ উপ০ ২|২০)
অর্থাৎ - সেই পরমাত্মা হলেন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম আর মহান থেকে মহান্। এই কারণে তিনি হচ্ছেন সর্বব্যাপক।

য়জুর্বেদ বলছে -
ইশাবাস্যমিদ্ঁ সর্বম্ য়ত্কিঞ্চ জগত্যাম্ জগত্"
(য়জু০ ৪০|১)
অর্থাৎ - সেই ঈশ্বর এই সম্পূর্ণ জগতের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাকে আচ্ছাদিত করে আছেন। এইভাবে সেই ঈশ্বর সর্বব্যাপক সিদ্ধ হল। সেটা একদেশী কখনও হতে পারবে না।

• সর্বশক্তিমান্ - এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে বানাতে, চালাতে ও নিয়ন্ত্রিতকারী সর্বব্যাপক ঈশ্বর তত্ত্ব সর্বশক্তিমানই হওয়া উচিত। আজকের বিজ্ঞান এই বিষয়ে অবগত যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড কতটা বড়? সূক্ষ্ম কণা থেকে বিশাল লোকগুলোর রচনা করা, তাদের গতি প্রদান করা, সব বল ও ঊর্জাকেও বল ও ঊর্জা প্রদান করা, কোনো সামান্য শক্তিশালী তত্ত্বের সামর্থ্য নয়, এই কারণে সেই ঈশ্বর তত্ত্ব সর্বশক্তিমানই হতে পারে। এখানে ধ্যাতব্য হল যে, "সর্বশক্তিমান" এর অর্থ এটা নয় যে ঈশ্বর বিনা কোনো উপাদান পদার্থে শূন্য দিয়েই সৃষ্টি রচনা করতে পারে অথবা সে বিনা কোনো নিয়মে চমৎকার পূর্বক যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, তার কাছে যেকোনো কাজ করা অসম্ভব নয়, এরকম বলাটা উচিত নয়। ঈশ্বর হলেন স্বয়ং নিয়ামক, যিনি নিজেরই নিয়মের অনুসারে কাজ করতে পারেন, অন্যথা কাজ করতে পারেন না। তাঁর সর্বশক্তিমত্তা তো এই বিষয়ে যে তিনি এত বড়ো সৃষ্টিকে বিনা কারও সহায়তায় রচনা করেন, চালনা করেন এবং সঠিক সময়ে তার প্রলয়ও করেন।

• নিরাকার - এখন এই বিষয়ের উপর বিচার করা যাক, যে পদার্থ সর্বশক্তিমান্ অর্থাৎ অনন্ত ঊর্জা ও বল যুক্ত এবং সর্বব্যাপক হবে, তার আকার কেমন হবে? আমি মনে করি যে, এই বিষয়ের মধ্যে সামান্য বুদ্ধিমান ব্যক্তিও এটাই বলবে যে সর্বব্যাপক ও সর্বশক্তিমান সত্তার কোনো আকারই হবে না। আসলে ঊর্জা ও বলের মতো গুণ কোনো সাকার পদার্থের মধ্যেই হয় না। এই সংসারে সাকার পদার্থের মধ্যে যেসব বল বা ঊর্জা দেখা যায়, তা আসলে সেই সাকার পদার্থের ভিতর বিদ্যমান অন্য নিরাকার পদার্থেরই হয়। বিভিন্ন বিশাল বা লঘু যন্ত্রের মধ্যে বিদ্যুৎ, যা নিরাকারই হয়, আদির বল বিদ্যমান থাকে। প্রাণীদের শরীরের মধ্যে চেতন জীবাত্মারও বল কাজ করে। নিরাকার বিদ্যুৎ আদি পদার্থের মধ্যে চেতন পরম তত্ত্ব ঈশ্বরের বল কাজ করে, এটা আমি পূর্বেই বলেছি। যে ঈশ্বর তত্ত্ব প্রত্যেক সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে তাদের বল ও ঊর্জা প্রদান করছে, সেটা কেবল নিরাকারই হতে পারে, সাকার কখনও নয়।

• সর্বজ্ঞ - ঈশ্বর তত্ত্বের সর্বশক্তিমত্তার পশ্চাৎ তাঁর সর্বজ্ঞতার উপর বিচার করা যাক। এটা সামান্য বুদ্ধির বিষয় যে, আধুনিক জগতে এক-একটা যন্ত্র নির্মাণকারী ইঞ্জিনিয়ার তথা ব্রহ্মাণ্ডের কিছু রহস্যের জ্ঞান থাকা এক বৈজ্ঞানিক অনেক বুদ্ধিমান মানা হয়। এরকম স্থিতিতে যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে রচনা আর চালনা করেন, তিনি কত জ্ঞানী হবে? আসলে সেই ঈশ্বরই সর্বজ্ঞ হয়। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড যাকে জানার চেষ্টা, এই ভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানব কোটি-কোটি ধরে করে আসছে আর যতদিন সৃষ্টি থাকবে, তারা এরকম চেষ্টা করতেই থাকবে কিন্তু তাঁকে কখনও পূর্ণতঃ জানতে পারবে না। যে এরকম ব্রহ্মাণ্ড নির্মাণ করেছে, যে এটাকে চালাচ্ছে, সেটা নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ অর্থাৎ অনন্ত জ্ঞানী হবে।

• পবিত্র - এরকম ঈশ্বর কখনও সৃষ্টির উপাদান কারণ রূপ পদার্থের মধ্যে মিশ্রিত হয় না, এইজন্য তাঁকে পবিত্রও বলা হয় অর্থাৎ সেটা সর্বদা বিশুদ্ধ রূপে বিদ্যমান থাকে, এই কারণে ঈশ্বরকে সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ মানা হয়, অন্যদিকে প্রকৃতি রূপী মূল পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ মানা হয়, এটাই হল বাস্তবতা। একইসঙ্গে তথ্য এটাও যে, ঈশ্বর কখনও কোনো প্রকারের দোষের সঙ্গে কিঞ্চিৎমাত্রও গ্রস্ত হতে পারবে না।

• সর্বাধার - এরকম সেই ঈশ্বরই ব্রহ্মাণ্ডকে নির্মাণ, চালনা করে তাকে ধারণও করে আছেন, এই কারণে তাঁকে সর্বধার বলা হয়। বর্তমান বিজ্ঞান এটার ধারণের মধ্যে গুরুত্বাকর্ষণ বল এবং ডার্ক ম্যাটারের ভূমিকা মানে। এটাও সত্যি কিন্তু এই ধারক পদার্থগুলোর ধারক হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর তত্ত্বই।

• ন্যায়কারী-দয়ালু - এরকম সেই ঈশ্বর তত্ত্ব নিশ্চই সর্বদা সর্বথা পূর্ণ ও তৃপ্ত বা অকাম হওয়া উচিত। তাই তিনি এই সৃষ্টির রচনা স্বয়ংয়ের জন্য নয় বরং অন্য কারও অপূর্ণকাম চেতন তত্ত্বের উপভোগ ও মোক্ষ হেতু করেন। সেই অপূর্ণকাম চেতন তত্ত্বকেই জীবাত্মা বলে। এখানে "অপূর্ণ" অর্থে এটা বোঝা উচিত যে সেটা বল, জ্ঞান ও আয়তন আদির দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অপেক্ষায় অত্যন্ত লঘু। কারণ সেই ঈশ্বর নিজের জন্য কিছুই চান না, বরং জীবের ভালোর জন্যই সৃষ্টির রচনা করেন, এই কারণে তাঁকে দয়ালু বলে। তিনি সর্বদা জীবদের তাদের কর্মের অনুসারে ফল দেন, না তার অধিক আর না ন্যূন, এই কারণে তাঁকে ন্যায়কারীও বলে। কর্মানুসার ফল পাওয়া চেতন পদার্থ জগতে কারণ কার্যের নিয়মের সমান। জড় জগতে আমরা সর্বত্র কারণ কার্যের নিয়ম দেখে থাকি। বর্তমান বিজ্ঞানও জড় জগতে কারণ কার্যের নিয়মকে স্বীকার করে। Arthur Beiser লিখেছেন -
"cause and effects are still related in quantum mechanics, but what they concern needs careful interpretation" (Concepts of Modern Physics - P.161)

যখন জড় জগতে কারণ-কার্যের নিয়ম সর্বত্র কাজ করে, যদিও তাকে আমরা পূর্ণতঃ বুঝতে না পারি, তাহলে সেটা চেতন জগতের মধ্যে কেন কাজ করবে না? আমার মত হল, এখানে কর্মফল ব্যবস্থাই কারণ কার্যের নিয়মের রূপে কাজ করে। আমরা এটাকে পূর্ণতঃ কখনও জানতে পারবো না। ঈশ্বরও এই ব্যবস্থাকে উপেক্ষিত করতে পারবেন না। তাঁর প্রার্থনা, উপাসনা আদি করলেও তিনি কোনো জীবের কর্মের অনিষ্ট ফল থেকে সেই জীবকে বাঁচাতে পারবেন না, এরমধ্যেই তাঁর ন্যায় ও দয়া উভয়ই সমাহিত আছে। যদি প্রার্থনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি জীবদের তাদের পাপের দণ্ড না দেন, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ কর্মন্যায় ব্যবস্থা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। কোনো অপরাধীর অপরাধকে ক্ষমা করে দেওয়াটা ন্যায়াধীশের (বিচারকের) ন্যায় নয় বরং অন্যায়ই হবে। এই ক্ষমার দ্বারা সেই অপরাধী পাপ করার হেতু আরও প্রোত্সাহিত হবে তথা এরফলে সে অনেক জীবের আরও অধিক দুঃখ দিতে পারবে, যারফল স্বয়ং ন্যায়াধীশকেও (বিচারককেও) ভুগতে হবে কিংবা তিনিও সেই পাপের উত্তরদায়ী হবেন। এই কারণে সত্য বিচারক কখনও কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করেন না আর এটা করা উচিতও নয়। যখন কোনো সত্য বিচারক এরকমটা করেন না, তাহলে সেই পরমাত্মা রূপ বিচারক কেন কারও অপরাধকে ক্ষমা করে নিজের ন্যায় ব্যবস্থাকে ভঙ্গ করবেন? ঈশ্বরীয় ব্যবস্থা হল প্রণত ব্যবস্থিত ও স্বাভাবিক, তাতে কখনও কোনো স্খলন হয় না। এই কারণে যেসব ঈশ্বরবাদী প্রার্থনা, য়াগ, তৌবা, confession আদি দ্বারা নিজেদের পাপমোচনের কামনা করে, তারা ঈশ্বর তত্ত্বের বিশুদ্ধ স্বরূপকে জানে না। পাপের ফলের বিষয়ে মহাদেব শিব ভগবতী উমাকে বলেছেন -
"দ্বিধা তু ক্রিয়তে পাপম্ সনিশ্চাসদ্বি চ।
অভিসম্ধায় বা নিত্যমন্যথা বা য়দৃচ্ছয়া।।
অভিসম্ধিকৃতস্পৈব নৈব নাশোকস্তি কর্মণঃ।
অশ্বমেধসহগ্রেশ্চ প্রায়শ্চিত্তশতৈরপি।।
অন্যথা য়ত্ কৃতম্ পাপ প্রমাদা বা য়দৃচ্ছয়া।
প্রায়শ্চিত্তাশ্বমেধাভ্যাম্ শ্রেয়সা তত্ প্রণস্যতি।"
(মহাভারত অনুশাসন দানধর্ম পর্ব |
অধ্যায় ১৪৫ দক্ষিণাত্য সংস্করণ)
এর মানে হল, যেসব পাপ প্রমাদ বা অসাবধানী পূর্বক হয়ে যায়, সেইসব প্রায়শ্চিত্ত আদি কিছু উপায়ের দ্বারা মুছে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু যেসব পাপ জেনেশুনে বা প্রতিজ্ঞাপূর্বক করা হয়েছে, সেইসব কখনও নাশ প্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ তার ফল অবশ্যই ভোগ করতে হয়। এটাই ঈশ্বরের সত্য ন্যায় ও এটাই হল তাঁর সত্য দয়া। দণ্ড দেওয়ার পিছনেও ঈশ্বরের প্রয়োজন থাকে যেন সেই পাপী প্রাণীর পাপের থেকে অন্য প্রাণীদের রক্ষা করা যেতে পারে আর সেই পাপী প্রাণী স্বয়ংও ভবিষ্যতে পাপ কর্মে প্রবৃত্ত না হয়। সেই ঈশ্বর পাপী জীবকে এইভাবে দণ্ড দেন, যেমনটা যোগ্য মাতা-পিতা নিজের সন্তানকে খারাপ থেকে বাঁচানোর হেতু দয়াপূর্বক তাড়ন করেন, নাকি তিনি ক্রোধবশ এরকম করেন। এইভাবে সেই ঈশ্বর হলেন সকল জীবের সবথেকে বড়ো মাতা-পিতার সমান পালক, ন্যায়কারী ও দয়ালু।

আজ সংসারের মধ্যে একটা সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মকে ছেড়ে দিয়ে মানব সমাজ নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন ঈশ্বরের কল্পনা করছে। প্রায়শঃই সকল সম্প্রদায় পাপ থেকে মুক্তির কোনো সরল উপায় বলে দেয়। প্রায়শঃ সবাই এটাই মনে করে যে ঈশ্বর পাপ ক্ষমা করে দেন। এতদর্থ ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার হেতু বিভিন্ন প্রকারের পূজাডম্বর, নদী স্নান, নাম স্মরণ, কথা স্মরণ, ব্রত, উপবাস, রোজা, প্রার্থনা, নামাজ, নানা মূর্তির, বৃক্ষ পত্র বা পশু আদির পূজা আদি অনেক ধরনের সাধন প্রচারিত করে রেখেছে। এতে পাপ তো ক্ষমা হয় না কিন্তু এই আড়ম্বরের প্রচারকদের আজীবিকা অবশ্য চলছে। এই আড়ম্বর যত মাত্রায় বেড়ে চলেছে, পাপও ততমাত্রাতেই বেড়ে চলেছে। এরফলে সামান্য প্রবুদ্ধ ব্যক্তির বিশ্বাস না কেবল ঈশ্বর ও তাঁর কর্ম ফলের ব্যবস্থা থেকে উঠে যাচ্ছে, বরং নৈতিক মূল্যেরও নিরন্তর ক্ষরণ হতে চলেছে। এই কারণে ঈশ্বরের দয়ালু ও ন্যায়কারী উভয়ই বিশেষণের সমন্বিত বৈজ্ঞানিক স্বরূপ জেনে নেওয়াটা নিতান্ত আবশ্যক।

এইভাবে ঈশ্বর তত্ত্বের অনন্ত গুণ, কর্ম, স্বভাব আছে। আমি এখানে কিছু গুণের বিবেচনা করেছি। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজের দ্বিতীয় নিয়মে ঈশ্বর তত্ত্বের স্বরূপের অত্যন্ত সুন্দর বিবেচনা করে গাগরে সাগর ভরে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন -
"ঈশ্বর হলেন সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অনুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর, সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্য়ামী, অজড়, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র আর সৃষ্টিকর্তা। তাঁরই উপাসনা করা উচিত।"

এরথেকে সুন্দর ঈশ্বরের স্বরূপের বিবেচনা সম্ভবতঃ আর কোথাও নেই। আজ সারা সংসারের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন মত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঈশ্বরের মিথ্যা কল্পিত রূপের ও এরকমই ঈশ্বরের অস্তিত্বের ভরমার আছে। Stephen Hawking তার The Grand Design নামক পুস্তকের মধ্যে উপহাসপূর্বক ঈশ্বর তত্ত্বকে খণ্ডন করেছে আর করাও উচিত। যদি Hawking-এর সম্মুখ ঈশ্বর তত্ত্বের এই বৈদিক বিজ্ঞান স্বরূপটা বিদ্যমান হতো, তাহলে তাকে ঈশ্বর তত্ত্বের মান্যতাকে খণ্ডিত করার আবশ্যকতা হতো না। এটা ভারী আশ্চর্য যে, কোনো ঈশ্বরবাদীই Hawking-এর বিচারকে পড়ে ঈশ্বরের সত্য স্বরূপকে জানার হেতু প্রবৃত্ত হতে দেখা যায়নি, বরং ঈশ্বরের সত্তাকেই অস্বীকারের উপর জোড় দেওয়া হয়। আশা করি যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের আমার ঈশ্বর বিষয়ক এই প্রকরণটা থেকে ঈশ্বরীয় সত্তা ও স্বরূপের অবশ্যই বোধ হবে আর তারা Hawking এর মতো ভুল পুনরাবৃত্তি করবেন না।

•••ঈশ্বরের কাজ করার প্রণালী•••

ঈশ্বরীয় সত্তার অস্তিত্ব ও স্বরূপের বৈজ্ঞানিকতার আলোচনার পরে এখন আমরা এই বিষয়ের উপর বিচার করবো যে, ঈশ্বর এই সৃষ্টির রচনা, সঞ্চালন, ধারণ ও প্রলয় আদি প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে নিজের কি ও কিরকম ভুমিকা পালন করেন অর্থাৎ তাঁর কার্যপ্রণালী - ক্রিয়াবিজ্ঞানটা ঠিক কিরকম? সারা সংসারের ঈশ্বরবাদী নানা ভাবে ঈশ্বরের আলোচনার তো করে কিন্তু এই বিষয়ের উপর বিচারও করে না যে সেই ঈশ্বর তাঁর নিজের কাজকে কিভাবে সম্পন্ন করেন? আমরা জানি যে এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব ক্রিয়াই হচ্ছে, তার পিছনে চেতন তত্ত্ব ঈশ্বরের ভূমিকা আছে। তাছাড়া প্রাণীদের শরীরের মধ্যে জীবাত্মা রূপী চেতন তত্ত্বেরও ভূমিকা আছে। আমরা এখানে ঈশ্বর তত্ত্বের ভূমিকার চর্চা করবো। ঈশ্বর কি সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম কণা, কোয়ান্টা আদির থেকে শুরু করে বড়-বড় লোক লোকান্তরের ঘূর্ণন ও পরিক্রমণ, তাদের ধারণ, আকর্ষণ, প্রতিকর্ষণ বলের প্রত্যক্ষ কারণ? না, ঈশ্বর সূর্যাদি লোক ও ইলেকট্রন্স আদি কণাগুলোকে ধরে ঘোড়ায় না বা চালায় না, বরং এইসব পদার্থ সেই বিভিন্ন বল, যাকে বর্তমান বিজ্ঞান জানে বা জানার চেষ্টা করছে, তাদের দ্বারা নিজ-নিজ কাজ করছে। তবে হ্যাঁ, এইসব বলের উৎপত্তি যেসব প্রাণ ও ছন্দাদি পদার্থ দ্বারা হয়েছে, বর্তমান বিজ্ঞান তাদের এতটুকুও জানে না। এই কারণে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা মান্যতা এমন মূলবলের উৎপত্তি এবং ক্রিয়াবিধির সমুচিত ব্যাখ্যা করতে এই বিজ্ঞান অক্ষম। এই মূলবলের উৎপত্তি এবং নিয়ন্ত্রণ এই বিবিধ প্রকারেরই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মির দ্বারা হয়। কথা এখানেই শেষ নয়, এই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলোও মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্ত্বের মিথুন দ্বারা উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কারণে মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্ত্বের স্বরূপ ও ব্যবহারকে না জেনে প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলোর এবং তারথেকে উৎপন্ন বিভিন্ন কথিত মূলবলগুলোর (গুরুত্ব, বিদ্যুৎ চুম্বকীয়, নাভিকীয় বল এবং দুর্বল বল) স্বরূপ ও ক্রিয়াবিজ্ঞানের যথাযত বোধ হওয়া সম্ভব নয়।

ধ্যাতব্য হল যে, মন ও বাক্ তত্ত্বও জড় হওয়ার কারণে স্বয়ং কোনো কাজের মধ্যে প্রবৃত্ত হওয়ার সামর্থ্য রাখে না। এদের প্রবৃত্তকারী সকলের মূল তত্ত্ব হল চেতন ঈশ্বর। তিনিই এই মন এবং সূক্ষ্ম বাক্ তত্ত্বকে প্রেরিত করেন। এদের মাঝে একটা কাল তত্ত্বও থাকে কিন্তু সেটাও জড় হওয়ায় ঈশ্বর তত্ত্বের দ্বারা প্রেরিত হয়ে কাজ করে। এইভাবে কাজ করতে কিংবা প্রেরক এবং প্রেরিত পদার্থ, নিয়ামক ও নিয়ম্য তত্ত্বের শৃঙ্খলা হচ্ছে এই রকম -

চেতন ঈশ্বর তত্ত্ব কাল তত্ত্বকে প্রেরিত করে। কাল তত্ত্ব মন-বাক্ তত্ত্বকে প্রেরিত করে, পুনঃ মন এবং বাক্ তত্ত্ব প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মিগুলোকে প্রেরিত করে। তারপর সেই প্রাণ ও ছন্দাদি রশ্মি আধুনিক কথিত চার প্রকারের মূলবলকে উৎপন্ন ও প্রেরিত করে, তার পশ্চাৎ সেই চারটা বল (বস্তুতঃ বলের সংখ্যা অনেক অধিক আছে, যা সকল প্রাণাদি রশ্মির কারণেই উৎপন্ন হয়) সমস্ত সৃষ্টিকে উৎপন্ন ও সঞ্চালিত করতে সহায়ক হয়।

এইভাবে ঈশ্বর তত্ত্ব প্রত্যেক ক্রিয়ার সময় কেবল কাল বা ওম্ ছন্দ রশ্মিকেই প্রেরিত করে, সেটা অগ্রিম প্রক্রিয়াকে আগে বাড়িয়ে দেয়। এই তত্ত্ব এতই সূক্ষ্ম যে মানুষ কখনও এটাকে কোনোরূপ প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ দ্বারা জানতে পারবে না। কেবলমাত্র উচ্চ কোটির য়োগীই এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে জানতে ও বুঝতে পারবে। এই গ্রন্থে মহায়োগী মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস এরকম সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে নিজের মহান্ য়োগ বল দ্বারা বুঝে নিয়ে এই মহান্ রহস্যপূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে বর্ণিত করেছেন। পরমাত্মার অসীম দয়ায় আমি এই গ্রন্থকে জানতে সফল হয়েছি। এরমধ্যে স্থানে-স্থানে ঈশ্বর তত্ত্বের ভূমিকার বর্ণনা কিংবা তাঁর ক্রিয়াবিজ্ঞানের সাংকেতিক বর্ণনা আছে, যাকে পাঠক গ্রন্থের অধ্যয়ন করেই জানতে পারবেন। সারাংশতঃ ঈশ্বর কাল, ওম্ রশ্মি ও প্রকৃতিকে প্রেরিত করে সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে প্রারম্ভ ও সম্পাদিত করেন। তিনি কোনো ক্রিয়ার মধ্যে জীবাত্মার মতো এরকম অংশীদার হন না যে তাঁকে নিজের কর্মের ফল ভুগতে হবে। তিনি হলেন সর্বদা অকাম। কেবলমাত্র জীবদের জন্যই সবকিছু করেন, এই কারণে তিনিই কর্তা আর তিনিই অকর্তা। তিনি হলেন সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। ঈশ্বর কিভাবে প্রেরিত করেন? সেই প্রেরণা বা জাগরণের ক্রিয়াবিজ্ঞানটা কি? এইসব বিষয় নিয়ে আমি পরবর্তী কাল তত্ত্ব প্রকরণের মধ্যে সংক্ষিপ্ত রূপে বোঝাবো, পাঠক সেখানেই দেখতে পারবেন∆।
____________________________________________
∆এই বিষয়টি আপনি বেদ বিজ্ঞান আলোক গ্রন্থে পড়তে পারেন বা Vaidic Physics youtube channel এ ভিডিও উপলব্ধ রয়েছে, সেটিও দেখতে পারেন

ও৩ম্ দ্যৌঃ শান্তিরন্তরিক্ষম্ শান্তিঃ পৃথিবী শান্তিরাপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তিঃ। বনস্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বেদেবাঃ শান্তির্ব্রহ্ম শান্তিঃ সর্বম্ শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি।।
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ