শিখার মাহাত্ম্য - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

11 May, 2023

শিখার মাহাত্ম্য

 লর্ড মেকালে দ্বারা প্রচলিত বর্তমান ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ও ঋষি সন্তান আজ নিজেদের মস্তকে শিখা রাখিতে লজ্জা অনুভব করে এবং যজ্ঞোপবীত ধারণ করা তাহার নিকট একটা ভার বলিয়া মনে হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার তীব্র আলোকে বিভ্রান্ত নব যুবক তাদের ধার্মিক চিহ্নগুলি একে-একে ত্যাগ করিতে চলিয়াছে এবং 6 বাবুভ্যো ধর্ম হীনেভ্যঃ স্থিতা মূত্র বিসর্জিভ্যঃ। ভীতং সূত্র গতং ভূমৌ, শিখা ভীতং দিবং গতঃ।। অর্থাৎ ধর্মহীনও দাঁড়াইয়া মূত্র বিসর্জনকারী বাবুদের ভয়ে সূত্র (যজ্ঞোপবীত) পাতালে, এবং শিখা আকাশে পৌঁছিয়া গিয়াছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, যে শিখা রক্ষার জন্য মহারাণা প্রতাপ ও বীর শিবাজী সব কিছু উৎসর্গ করিলেন, এবং গুরু গোবিন্দ সিংহের সন্তানগণ আত্মাহুতি দিলেন, সেই শিখা আধুনিক বাবুদিগের দ্বারা কর্তিত হইতেছে, তাহারা নিজ হস্তে স্বীয় সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করিতেছেন, পাশ্চাত্য পদার্থ বিজ্ঞানে প্রভাবিত নবযুবক জিজ্ঞাসা করে, “আমরা শিখা কেন রাখিব?” আমরা এখানে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইহার সমাধান উপস্থাপিত করিবার চেষ্টা করিব। বেদ ভারতীয় সংস্কৃতির মূলাধার। ধর্ম জিজ্ঞাসুদের পক্ষে ‘শ্রুতিই’ পরম প্রমাণ । অতএব, আমাদের প্রথমে দেখা উচিৎ যে, বেদ এই সম্বন্ধে কি বলিতেছে।

শিখার মাহাত্ম্য

বেদে শিখা রাখিবার স্পষ্ট আদেশ আছে। দেখুন— সত্র বানাঃ সম্পতন্তি কুমারা বিশিখার ইব। যজু ১৭/৪৮ এই মন্ত্রে ‘বিশিখা’ পদ আসিয়াছে, যাহার অর্থ হইল 'বিশিষ্টা, দীর্ঘা, গোক্ষুর পরিমাণ শিখা চূড়া তাদৃশাঃ কুমারা ইব,' অর্থাৎ বীর্য এবং গোক্ষুর পরিমাণ শিখা যুক্ত কুমারদের মত। মহর্ষি দয়ানন্দ ইহার অর্থ করিয়াছেন—“শিখাহীন বা বহু শিখাযুক্ত” এইভাবে এই মন্ত্রে শিখার অস্তিত্ব লক্ষিত হয়। এখন আর একটা মন্ত্ৰ দেখুন—আত্মন্নপস্থে ন বৃকস্য লোম মুখে শ্মশ্রুনি ন ব্যাঘ্র লোম, কেশা ন শীয়ন্যশসে শ্রিয় শিখাঁ সিংহস্য লোমাত্বিষিরিন্দ্রিয়ানি।। - যজু- ১৯/৯২ এখানে কীর্তি ও লক্ষ্মী প্রাপ্তিহেতু শিখা ধারণের বিধান দেওয়া হইয়াছে, এবং শিখার কেশের সহিত ব্যাঘ্রের অর্থাৎ সিংহের লোমের সাদৃশ্য দেখানো হইয়াছে। শিখিভ্যঃ স্বাহা। অথর্ব ১৯/২২/১৫ অর্থাৎ শিখাধারীদের কল্যাণ হউক। এখন অন্য শাস্ত্রকারদের মত ও দেখুন - সদোপৰীতিনা ভাব্যংসদা বধ্য শিখেন চ। বিশিখো ব্যুপবীতশ্চ য়ৎ করোতী ন তৎকৃতম্।। কাত্যায়ন স্মৃতি সদা যজ্ঞোপবীতধারী ও শিখা বদ্ধ থাকা উচিৎ, শিখাহীন ও যজ্ঞোপবীত রহিত ব্যক্তি সে কাজ করে, তাহা অকৃত্য জানিবে, অতএব শিখা কেবল আর্য জাতির ধার্মিক চিহ্নই নহে; বরঞ্চ কর্তব্য কর্মের সহায়ক ও । মহর্ষি দয়ানন্দ ইহাকে আবশ্যক বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন— যজ্ঞোপবীত ও শিখা ত্যাগ করিয়া মুসলমান, খৃষ্টান দিগের ন্যায় হওয়া বৃথা। (সত্যার্থ প্রকাশ ১১ সমু.) গত কয়েক বৎসর ধরিয়া পাশ্চাত্য বিদ্বানগণ ও শিখা সম্বন্ধে অন্বেষণ করিয়াছেন, এই বিষয়ে তাহারা সময়ে সময়ে ভীষণ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তাহাদের মত প্রকাশ করিয়া থাকেন। তাহাদের মত প্রকাশ করিয়া থাকেন; তাহাদের সম্মতি এখানে উদ্ধৃত করা হইল— স্যার চার্লস পার্লি ল্যুকস, ফিলাডেলফিয়া (আমেরিকা)— “শিখার সহিত শরীরের সেই প্রয়োজনীয় অংগের অতিঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, যার দ্বারা জ্ঞানবুদ্ধি এবং শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সঞ্চালন হয়। যখন থেকে আমি শিখার বৈজ্ঞানিক মহত্ত্ব উপলব্ধি করিয়াছি, তখন হইতে আমি স্বয়ংশিখা রাখিতে আরম্ভ করিয়াছি। —(সরস্বতী পত্রিকা ইং ১৯১৪ সং ৭) ডা. হ্যমন—“আমি কয়েক বৎসর ভারতে থাকিয়া ভারতীয় সংস্কৃতির অধ্যয়ন করিয়াছি। এখানকার অধিবাসীগণ বহুকাল হইতে মস্তকে শিখা ধারণ করে, যার উল্লেখ বেদেও পাওয়া যায়।

দাক্ষিণাত্যে অর্ধ শিরোপরি গোক্ষুর পরিমাণ শিখা রাখে। আমি তাহাদের বুদ্ধির বৈলক্ষণ্য দেখিয়া অত্যন্ত প্রভাবিত হইয়াছি। বৌদ্ধিক উন্নতিতে শিখা অবশ্যই অত্যন্ত সাহায্য করে। শিরোপরি শিখা ধারণ করা লাভপ্রদ। ইউরোপে এমন কোন দেশ নেই, যেখানে লোকেরা মস্তকে দীর্ঘকেশ ধারণ করে না। হিন্দুধর্মে আমি গভীর বিশ্বাস রাখি। আমি নিজেও শিখা রাখিতে অভ্যস্ত হইয়াছি।” – (গার্ড ম্যাগাজিন সংখ্যা ২৫৮, পৃ. ১২৩ ১৮৯৯ খ্রীঃ) Dr. I. E. Clark MSD (ডা. আই. ই. ক্লার্ক, এম. এস. ডি.) - “আমি - যখন চীন দেশ ভ্রমণ করিতে গেলাম, তখন চীনাবাসীদেরও ভারতীয়দের মত অর্দ্ধ শিরোপরি শিখা ধারণ করিতে দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। তখন হইতে আমি এই বিজ্ঞান সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়াই, আমার প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, আর্যদের প্রত্যেক নিয়ম বা কর্ম বিজ্ঞান সম্মত, এবং শিখা ধারণ করা আর্যদের ধর্মমাত্র নহে, সুষুম্না কেন্দ্র রক্ষা হেতু ঋষিমুনিদের অদ্ভূত আবিষ্কারও বটে”। মি. আর্ল থামসেন—“সুষুম্না রক্ষাহেতু আর্যগণ শিখাধারণ এবং ইউরোপের অধিবাসীগণ দীর্ঘ কেশ ধারণ করেন। বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই উভয়ের মধ্যে শিখা ধারণ করাকে আমি উপযুক্ত মনে করি, কেননা ইহা শরীরের ঠিক সেই স্থানের রক্ষা করে, মানুষের জীবন ধারণের পক্ষে সার প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি।” (অ্যালার্ম ম্যাগাজিন ১৯২১ খ্রীঃ সংখ্যা – ৭১, পৃ. ১৯৬) শাস্ত্রীয় প্রমাণের পরে এখন বিজ্ঞান ও আয়ুর্বেদ অনুসারে শিখা ধারণে উপকারিতা সম্বন্ধে বিবেচনা করা হইল।অন্তরেণ তালুকে য় এব স্তন ইব অবলম্বেত স ইন্দ্ৰয়োনিঃ । অত্র অসৌ কেশান্তো বির্বততে ব্যপোহ্য শীর্ষ কপালে।। (তৈত্তিরীয় উপনি. শিক্ষাবলী ৬/২) মানুষের মুখ গহ্বরে তালুমধ্যে যে স্তনাকার মাংসপিণ্ড নির্গত রহিয়াছে, উহার পরে কেশের মূলস্থল ব্রহ্মরন্ধ্র। সেখানে মস্তিষ্কের দুই কপোল ভেদ করিয়া সুষুম্না নাড়ি বাহির হইয়াছে, যাহা ইন্দ্রযোনি অর্থাৎ পরমাত্মার প্রাপ্তিদ্বার। বৈদ্যগণ ব্রহ্মরন্ধ্রকে মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নার মূল স্থলকে মস্তুলিঙ্গ বলেন।

সমস্ত শরীরে শির অর্থাৎ মস্তকই মুখ্য অঙ্গ। এই শিরো মধ্যে দুই প্রবল শক্তির নিবাস, জ্ঞান-শক্তি ও কর্ম-শক্তি। এই দুই অংশের মূলস্থল মস্তিষ্ক ও মতুলিঙ্গ। মস্তিষ্ক জ্ঞানশক্তির ভাণ্ডার, এবং মস্তুলিঙ্গ কর্মশক্তির আলয়। মস্তিষ্কের সহিত জ্ঞানেন্দ্রিয় সকলের—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক সম্বন্ধ, এবং মলিঙ্গে র সহিত কর্মেন্দ্রিয় সকলের— হস্ত, পদ, গুহা, লিঙ্গ ও বাক্ সম্বন্ধ। মস্তিষ্ক ও মতুলিঙ্গ যত সামর্থবান্ হইবে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় সকল ততই বল ও শক্তি সম্পন্ন হইবে। মস্তিষ্কের জন্য শৈত্য ও মলিঙ্গের জন্য উষ্ণতা প্রয়োজন । মস্তিষ্ককে শীতল রাখিবার জন্য ক্ষৌর কর্ম করা এবং মস্তুলিঙ্গকে ঊষ্ণ রাখিবার জন্য তদুপরি গোক্ষুর পরিমাণ শিখা থাকা আবশ্যক। মঙ্গুলিঙ্গের জন্য উষ্ণতা প্রয়োজন। কিন্তু ইহা ন্যূনাধিক হইলে চলিবে না — মধ্যম প্রকার আবশ্যক । ইহা হ্যাট বা বস্ত্রাদি দ্বারা প্রাপ্ত হইতে পারে না, কিন্তু শিখা দ্বারা সম্ভব। সে পদার্থ যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, তাহাই তাহার যথার্থ সহায়ক। যথা—কুম্ভ মৃত্তিকা দ্বারা নির্মিত হয়, তার প্রত্যেক অংশের পূর্তি ও মৃত্তিকা দ্বারা হইবে। মস্তুলিঙ্গ শরীরের অংশ বিশেষ হওয়াতে তার রক্ষা ও শিরোৎপন্ন পদার্থ কেশ দ্বারাই সম্ভব, কিন্তু হ্যাট বা টুপি দ্বারা নহে। অতএব, শিখা ধারণ করা বিধেয়। পাঠকগণ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, হ্যাট অপেক্ষা শিখার কি এমন বৈশিষ্ট্য? বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে হ্যাট অপেক্ষা শিখার অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়। কয়েকটি উদাহরণে ইহা ভালরূপে বোধগম্য হইবে। পশমের সহিত সকলেই পরিচিত। পশম কি?

ইহা মেষের দেহের লোম, যেমন—আমাদের মাথায় আছে। অতএব ইহাদের উভয়ের মধ্যে গুণের সাদৃশ্য থাকা স্বাভাবিক। পশমের বৈশিষ্ট্য জানিয়া লওয়ার পর শিখার বৈশিষ্ট্য জানিয়া লইতে অসুবিধা হইবে না । ১) পশমের প্রথম বৈশিষ্ট্য হইল শীতাদি হইতে রক্ষা করা। ভয়ংকর শীত হইতে পশুদের রক্ষা তাদের ঘন লোমের দ্বারাই হয়। ২) শীতের মত বাহিরের তাপ হইতে ও পশম শরীরকে রক্ষা করে। তাপ হইতে বরফকে বাঁচাইবার জন্য কম্বল দিয়া ইহাকে আবৃত করিয়া দেওয়া হয়। যাহাতে বাহিরের তাপ ইহার উপর কোন প্রভাব সৃষ্টি করিতে পারে না। এবং উহা যেমন তেমনই থাকে। ৩) পশম বিদ্যুতের প্রবাহকে বাহির হইতে ভিতরে ও ভিতর হইতে বাহিরে যাইতে দেয় না। কোন ব্যক্তি বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হইলে তাহাকে পশমের কম্বলের সাহায্যে ছাড়াইতে হয়। দেহ হইতে ভিন্ন লোমে যখন এতগুলি গুণ বিদ্যমান। তখন দেহস্থিত লোমে এই সব গুণগুলি নিশ্চিতরূপে থাকিবেই। অতএব শিখা দ্বারা মর্মস্থানের যথাযথ রক্ষা হয়, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। মস্তিষ্কের উচ্চ ও উদ্‌গত অংশ মধ্যে শিখা ধারণ করা হয়। যাহাকে শীর্ষ বলে। শারীর বিজ্ঞান মতে শরীরের যে স্থলে শিখা ধারণ করা হয়, তথায় একটি মর্মস্থান আছে। যাহাকে 'পিনিয়ল গ্ল্যান্ড' নামে অভিহিত করা হয়। ইহার নিম্নে একটি বিশেষ ধরণের গ্রন্থি আছে। যাহাকে 'পিটুইটারি' বলে। এই গ্রন্থি হইতে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়। যাহা শিরাগুলির মাধ্যমে সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত হইয়া শরীরকে হৃষ্ট-পুষ্ট ও বলবান্ করে। শিখার দ্বারা এইসব গ্রন্থিগুলি অত্যন্ত সাহায্য প্রাপ্ত হয়, এবং দীর্ঘকাল ধরিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। ইহাকে মনুষ্য কেবল স্বাস্থ্যবান্ থাকিয়া দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয় না, বরঞ্চ তাহার জীবনীশক্তি ও অক্ষুণ্ণ থাকে। সুশ্ৰুত মতে যেথায় শিখা ধারণ করা হয়, উহা অত্যন্ত কোমল স্থান এবং শিখার দীর্ঘকেশ উহাকে রক্ষা করে। শরীরে ১০৭টি মর্মস্থান আছে। ইহার মধ্যে ছয়টি স্থল এমন যে উহাতে আঘাত লাগিলে তৎক্ষণাৎ মনুষ্যের মৃত্যু ঘটে। এই জন্য সুশ্রুতে বলা হইয়াছে—

মস্তকাভ্যান্তরত উপরিঠাৎ শিরসন্ধি সন্নিপাতো।

রোমা বর্তোऽধি পতিঃ তত্রাপি সদ্য এর মরণম্।। সুশ্রুত – ৬/২০

মস্তিষ্কের মধ্যে ঊর্দ্ধদিকে যেখানে কেশাবর্ত সেখানে শিরা ও সন্ধির সংযোগ হইয়াছে। উহা অধিপ নামক মর্মস্থল। তথায় আঘাত প্রাপ্ত হইলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে। আমাদের মহর্ষিগণ উক্ত মর্মস্থলের রক্ষা হেতু শিখা ধারণের বিধান নির্দেশ করিয়াছেন। এই স্থলে গোক্ষুর পরিমাণ শিখা ধারণ করিলে শীতকালে শীত হইতে, গ্রীষ্মকালে ভয়ংকর তাপ হইতে এবং বর্ষাকালে জলধারা প্রযুক্ত আঘাত হইতে রক্ষা হইতে পারে। মানব শরীরের সহিত একটি দূর্গের উপমা দেওয়া যাইতে পারে। ক্ষিতি, -অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, এই শরীররূপী দূর্গের পাঁচটি প্রান্ত। রোম, চর্ম, রুধির, মাংস, অস্থি, মজ্জা ও শুক্রর এই সাতটি গর্ভগৃহ। সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ীগুলি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, সূর্য, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রধার এই অষ্টচক্র যেন আটটি প্রাসাদ। অষ্টম প্রাসাদে সম্রাটরূপী জ্যোতির্ময় পরব্রহ্মের নিবাস, যথা দূর্গের রাজভবনে বিশেষ মহত্ত্ব হেতু তদুপরি পতাকা শোভায়মান হয়, তদ্রুপ শরীর-রূপী দূর্গে ব্রহ্মরন্ধে, যথা ব্রহ্মের বাসস্থান, তথায় শিখা ধারণ করার বিধান দেওয়া হইয়াছে। কোন স্থানের বৈশিষ্ট জ্ঞাপন হেতু তথায় পতাকা প্রোথিত করিয়া দেওয়া হয়, তদ্রুপ উক্ত পবিত্রস্থলের জ্ঞাপন হেতু মাথায় শিখা অত্যন্ত উপযুক্ত পতাকা সন্দেহ নাই। মস্তিষ্ক একটি বিশাল সমুদ্র এবং শিখা দিকনির্ণয় যন্ত্র সদৃশ। কোন জলযানের ক্যাপ্টেনের নিকট দিকনির্ণয় যন্ত্র না থাকে, তবে সে জলযান সমুদ্রে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকিবে, সঠিক পথের নির্দেশ পাইবে না। এই প্রকার যে ব্যক্তি শিখারূপ দিকনির্ণয় যন্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করে না, তাহার তরণী এই সংসার সমুদ্রে বৃথা পরিক্রমা করিতে থাকিবে, তাহার ব্রহ্ম দর্শন হওয়া অসম্ভব। এই শিখা ব্রহ্মরন্ধ্রের নির্দেশ দেয়, এই জন্য আমাদের আচার্যগণ তথায় শিখা ধারণকরাইয়া সন্ধ্যার সময় গায়ত্রী মন্ত্র দ্বারা শিখা বন্ধন করার প্রথা প্রবর্তন করিয়াছিলেন, যাহাতে চিত্তবৃত্তিকে ব্রহ্মধ্যানের দিকে কেন্দ্রিত করা যাইতে পারে।

গীতার মতে—“উর্দ্ধমূলম্ অধঃশাখম্।” (গীতা—১৫/১) অর্থাৎ আমাদের শরীর একটি বৃক্ষ। বৃক্ষমূল আমাদের শির অর্থাৎ মস্তক। শিখার কেশগুলি ইহার শিকড়। স্কন্ধ হইতে কটি প্রদেশ প্রদেশ পর্যন্ত অংশগুলি ইহার শাখা । বিভিন্ন প্রকার বিষয় ইহার পত্র। সুকর্ম ও কুকর্ম ইহার পুষ্প এবং সুখ-দুঃখ ইহার ফল। কোন বৃক্ষের মূল কোন সময় ছিন্ন করা হয় না, কারণ তাহাতে বৃক্ষ শুকাইয়া যায়, অতএব শরীররূপী বৃক্ষের উন্নতি ও বৃদ্ধির জন্য শিখা ধারণ আবশ্যক। মস্তিষ্কের কেন্দ্র অর্থাৎ শিখার স্থান বৃক্ষের “টেপরুট” এর সমান, এবং শিখার কেশগুলি টেপরুটের লোমগুলির সমান। টেপরুটের লোমগুলি যেমন পৃথিবী হইতে রস আকর্ষণ করে। তদ্রুপ শিখার কেশগুলি বায়ু হইতে অক্সিজেন (Oxygen) আকর্ষণ করে। টেপরুপের উপরের লোমগুলির মত মানুষের লোমও ভিতরে ফাঁকা। টেপরুপের উপরের লোমগুলি ছুলিয়া ফেলিলে বৃক্ষ রস আকর্ষণ করিতে পারে না, সেই মত শিখার কেশগুলি কাটিয়া ফেলিলে মস্তিষ্ক প্রাণবায়ু আকর্ষণ করিতে পারে না। অতএব শিখা ধারণ করা প্রত্যেক মনুষ্যের কর্তব্য। তাই তিনি মুসলমান বা খ্রীষ্টানই হোন না কেন। যে ব্যক্তি শিরোপরি শিখারূপ কেশগুচ্ছ ধারণ করিয়াছেন, তিনি স্বীয় শিরোপরি প্রাণবায়ু আকর্ষণকারী “পাম্প” ধারণ করিয়াছেন। তিনি প্রকৃতির (Nature) সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্তি অর্জন করিতে সক্ষম। জটিল সমাধান করতে পারেন এবং যোগাভ্যাস করার উপযুক্ত। বনের পশুগণ কদাপি বস্ত্র ধারণ করে না, তথাপি তারা রুগ্ন হয় না। বরঞ্চ হৃষ্টপুষ্ট থাকে। ইহার কারণ স্পষ্ট, ইহাদের শরীরের লোমগুলি উন্মুক্ত থাকে, এবং উহারা ঠিক মত প্রাণবায়ু শোষণ করিতে পারে। দীর্ঘ জটাগুলি পৃথিবীর শক্তিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, যে ব্যক্তি শিরোপরি এত দীর্ঘ জটা ধারণ করেন যে, উপবেশন অবস্থায় তাহা ভূমি স্পর্শ করে; তাহা হইলে তাহার ওই জটাগুলি বিশেষ আকর্ষণ শক্তি সম্পন্ন হয়। ইহার কারণ এই যে, ইহাতে মস্তিষ্কের সহিত পৃথিবীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক হয়, এবংপৃথিবীর শক্তি লম্বিত কেশ দ্বারা মস্তিষ্কে উপস্থিত হয়। ইহাতে বিশেষ প্রকার আনন্দ অনুভূত হইয়া থাকে। পাঠক বলিবেন যে, ইহার পিছনে কোন যুক্তি বা প্রমাণ নাই। অতএব আমরা ইহা মানিতে বাধ্য নই। ইহার প্রমাণ দেখুন—

আমরা সন্ধ্যা করিবার সময় প্রতিদিন মার্জন মন্ত্র পাঠ করিয়া বলি, “ওম্ ভূঃপুনাতু শিরসি”। অর্থাৎ পৃথিবী আমাদের মস্তিষ্ক পবিত্র করুন। অতএব ইহা স্পষ্ট হইল যে, আমরা শিখা দ্বারা পৃথিবীর সর্বপ্রকার শক্তি স্বীয় শরীরে আকর্ষণ করি। আমেরিকার চিকিৎসকদিগের মতে দীর্ঘ শ্মশ্রু, দীর্ঘ গুম্‌ফ এবং শিরোপরি দীর্ঘ কেশ বীর্য সংরক্ষণ সহায়ক। দীর্ঘ শিখা বীর্যরক্ষার জন্য অত্যন্ত আবশ্যক। প্রাচীন কালের ব্রহ্মচারীগণ ও বাণপ্রস্থীগণ এই জন্য জটাধারী হইতেন। ভারতীয় আচার্যগণ ও মুনিঋষিদিগের মতানুসারে ও শিখা হইতে বুদ্ধি, শক্তি, আয়ু ও তেজঃ বৃদ্ধি হইয়া থাকে। যেমন কথিত হইয়াছে— দীর্ঘায়ুষ্টায় বলায়, বসে শিখায়ে বষ্ট অর্থাৎ দীর্ঘায়ু, শক্তি ও তেজঃ হেতু শিখাকে স্পর্শ করি, প্রশ্ন হইতেছে যে, শক্তি, আয়ু ও তেজঃ বৃদ্ধির সহিত শিখার কি সম্পর্ক? এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য আমাদিগকে মানব শরীর গঠন বুঝিতে হইবে। মানব শরীর গঠনের প্রতি মনোযোগ দিলে জানা যাইবে যে, শারীরিক প্রবৃত্তি সকলের কেন্দ্র আমাদের মস্তিষ্ক মানসিক ও শারীরিক সর্ব প্রকার ক্রিয়াগুলির সঞ্চালন ইহার দ্বারা সম্পন্ন হয়। শিখার স্থানই কাম-স্নায়ুগুলির কেন্দ্র। যদি ওই স্থানে উত্তেজনা উৎপন্ন করা হয়, তাহা হইলে সমস্ত স্নায়ুগুলি উত্তেজিত হইবে। যদি আমাদের মস্তিষ্ক সুস্থ ও সবল থাকে তাহা হইলে মনুষ্য সুস্থ থাকিয়া “জীবেন শরদ ঃ শতম্”, বেদের এই আজ্ঞা মত শতবর্ষ কেন, তদ্‌অপেক্ষা ও অধিককাল বাঁচিয়া থাকিতে পারে। মস্তিষ্ককে সুস্থ, সবল ও শক্তিশালী করিবার জন্য শিখা ধারণ একটি অব্যর্থ উপায়। শিখার সহিত বল, বীর্য, স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিক উন্নতির গভীর সম্পর্ক। এই বিষয়ে “হরি বংশ” পুরাণে একটি উপাখ্যান দৃষ্ট হয়। সগর নামে মহর্ষি বশিষ্ঠের এক বিশ্ব বিজয়ী ক্ষত্রিয় শিষ্য ছিল, পাশ্চাত্য দেশীয় কতিপয় রাজন্যবর্গ মিলিয়াতাহার পিতাকে হত্যা করিয়াছিল। সগর পিতৃদেবের মৃত্যুর প্রতিশোধ লইবার জন্য তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন, তাহারা ভয়ার্ত হইয়া বশিষ্ঠ মুনির শরণাপন্ন হইল, এবং প্রাণ রক্ষার জন্য প্রার্থনা করিল। মহর্ষি তাহাদিগকে অভয় প্রদান করিলেন বটে, কিন্তু যখন জানিতে পারিলেন যে, উহাদের বিজেতা তাহার শিষ্য স্বয়ং, তখন উভয় পক্ষের প্রতিজ্ঞা রক্ষা হেতু ঋষি বশিষ্ঠ আজ্ঞা প্রদান করিলেন যে, উহাদিগকে প্রাণে বধ না করিয়া উহাদের সকলের শিখা কর্তন করিয়া দেওয়া হউক।

যাহাতে উহারা শক্তিহীন ও মৃতবৎ হইয়া পড়িবে। শিষ্য সেই মত করিলে এবং লোকেরা এই দেখিয়া বিস্মিত হইল যে, সেই সব রাজাগণ নির্জীব তুল্য ও প্রভাবশূন্য হইয়া গেল। খ্রীষ্টানদের মধ্যেও অনুরূপ একটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে। সাম্‌সন অ্যাগোনিষ্টিসের (Somson Agonistes) প্রতাপে অন্য রাজাগণ সদা কম্পমান । তাঁহাকে মারিবার জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইল। অবশেষে তাহারা জানিতে পারিল যে, তাহার সমস্ত শক্তি তাহার শিরোপরি শিখায় নিহিত। তাহারা ছলের আশ্রয় লইয়া ঘুমন্ত অবস্থায় 'সামসনের' শিখা কাটিয়া লইল। প্রাতঃকালে নিদ্রাভঙ্গে তিনি দেখিলেন যে, তাহার শিখা কর্তন করা হইয়াছে এবং তাহার সমস্ত শক্তিলুপ্ত হইয়াছে। ফলস্বরূপ তিনি শত্রুদিগের হস্তে পরাজিত হইলেন। শিখা দ্বারা কেবল ব্রহ্মচর্য রক্ষা, বল, আয়ু ও তেজঃ প্রাপ্ত হয় না, বরঞ্চ গোক্ষুর পরিমাণ শিখা ধারণ করিলে ব্রহ্মশক্তির ও আকর্ষণ হয়। পাশ্চাত্যে জগতের সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ঈ. ক্রোমর (Victor E. Cromer) সাহেব লিখিয়াছেন— In meditation on receives the Virillic influse. While con- centrating one however concentrates ones mind upon God, there is an outgoing and inflowing process setup. The concentration of mind upon words sends a rush of his force though the top of the head and the response comes as a fine rain of soft magne- tism. These two force cause a beautiful display of colour to the higher vision. The outpouring from above is beautiful beyond description" (Vril Kalpaka)অর্থাৎ “ধ্যানের সময় ওজঃশক্তির আবির্ভাব ঘটে। কোনবস্তুর প্রতি চিত্তনশক্তি একাগ্র করিলে ওজঃশক্তি তৎপ্রতি ধাবিত হয়, যদি পরমাত্মার প্রতি চিত্ত একাগ্র করা হয়, তাহা হইলে মস্তকোপরি শিখা-পথে ওজঃশক্তি আবির্ভূত হয়। পরমাত্মার শক্তি সেই পথ দিয়া মনুষ্যের মধ্যে আসিতে থাকে। সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন যোগী পুরুষগণ এই উভয়শক্তির চমৎকার বর্ণেরও দর্শন করেন। যে শক্তি পরমাত্মার দিক দিয়া আমাদের মধ্যে আসে তাহার বর্ণন করা সম্ভব নহে। এইভাবে আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে শিখা দ্বারা ঊর্ধ্বদিক দিয়া শক্তি প্রাপ্ত হয়। ইহাই আয়ু, তেজঃ ইত্যাদির বৃদ্ধির কারণ। পরম হংস সন্ন্যাসী সর্বদা ব্রহ্মের সহিত যুক্ত থাকে। অতএব তাহাদিগকে শিখার সাহায্যে শক্তি আকর্ষণ করার প্রয়োজন নেই।

মুখ, বক্ষ ইত্যাদি স্থলে কেশোদ্‌গম হইলে পৌরুষশক্তি বৃদ্ধি পায়, কিন্তু নারী শক্তির বৃদ্ধি কেশোদ্‌গম দ্বারা না হইয়া মাসিক ধজু, ধর্ম, স্তনে দুগ্ধ ও জরায়ু বৃদ্ধি দ্বারা হয়। যৌন বৃদ্ধির সহিত কেশোদ্‌গমের সম্বন্ধ থাকিলে যেমন বৃক্ষের শাখা ছেদন করিয়া নূতন শাখা প্রবল বেগে উদ্ভূত হয়, তদ্রুপ প্রতিদিন কেশ ছেদন করিলে যৌন বেগ ভিতরের কাম শক্তি রূপে স্নায়ু মধ্যে আবির্ভূত হয়। যাহার ফলে বীর্য স্খলিত হইয়া মনুষ্য দুর্বল হইয়া পড়ে। এইজন্য ব্রহ্মচারী ও বানপ্রস্থীদের জন্য বিশেষরূপে কেশ ধারণ করার বিধি বর্ণিত হইয়াছে। কেশাধিক্য হেতু কাম সংশ্লিষ্ট স্নায়ুগুলি শান্ত থাকে এবং বীর্য নিঃসরণ হওয়ার উত্তেজনা প্রাপ্ত হয় না। শিখা ধারণ করার জন্য আর্যগণ শক্তি, আয়ু, তেজ, ব্রহ্মচর্য, মেধা, আত্মচিত্তন ও সংযমে প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, পক্ষান্তরে শিখাহীন ব্যক্তিগম উচ্ছৃঙ্খল, ইন্দ্রিয় পরায়ণ ও বিলাসিতা আদি দুৰ্গুণ গ্রস্ত। শিখার প্রতি আস্থা লোপ হওয়াতে আর্যদিগের মধ্যেও উপরোক্ত গুণগুলি হ্রাস পাইতেছে এবং দুর্গুণগুলি বৃদ্ধি পাইতেছে। সন্ধ্যা করিবার সময় গায়ত্রী মন্ত্র দ্বারা শিখা বন্ধন করা হয়, সেই সময় অনেক সূক্ষ্ম তত্ত্ব আকর্ষিত হইয়া মনুষ্য মধ্যে স্থিতিলাভ করে, তারা মস্তিষ্ক কেন্দ্র হইতে প্রস্থান না করে এবং আমরা স্বীয় সাধনার লাভ হইতে বঞ্চিত না হই, তদর্থে শিখা বন্ধন করা হয়। শিখায় সর্বদা গ্রন্থি লাগাইয়া রাখিলে মানসিক শক্তির অপব্যয়ের বহুলাংশ রক্ষিত হয়। সাইকেলের চাকায় ভর্তি বায়ুরোধহেতু একটি ছোটো ‘ভাস্ব টিউব' নামক রবার নালিকা থাকে, যার দ্বারা ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে। কিন্তু বাইরে আসিতে পারে না। শিখার গ্রন্থি দ্বারা এই প্রয়োজন সাধিত হয়। উহা বাহিরের বিচার ও শক্তি গ্রহণ করে সত্য, কিন্তু ভিতরের তত্ত্বগুলির অপব্যয় হইতে দেয় না, শিখার নিম্নে বুদ্ধির স্থান, শিখা বন্ধন দ্বারা বুদ্ধিকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হয়, যাহাতে উহা পরমাত্মাতে মগ্ন থাকে। ঈশ্বর ভক্তিতে আত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ আবশ্যক, অতএব ধরিয়া লওয়া হউক যে, ইহাতে আত্মা ও বুদ্ধির যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। পৃথিবীতে শীর্ষের মহত্ত্ব অত্যধিক, সবাই শীর্ষে উপনীত হইবার চেষ্টা করে, গুহা মধ্যে নহে।

আমাদের শিরোপরি স্থিত শিখা সর্বদা আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয় যে, আমাদিগকে শিখর পর্যন্ত পৌঁছাইতে হইবে। এই শিখা আমাদিগকে নির্দেশ করিয়া বলিতেছে যে, আমাদিগের জ্ঞান শীর্ষের হউক, বিজ্ঞান শীর্ষের হউক, ধনৈশ্বর্য শীর্ষের হউক, আমাদের শক্তি শীর্ষের হউক, আমাদের বিদ্যাশীর্ষের হউক, বুদ্ধি শীর্ষের হউক, আমাদিগকে মহত্তম উন্নতি করিতে হইবে। আমাদিগকে শ্রেষ্ঠতম স্থিতি প্রাপ্ত করিতে হইবে ইহা স্মরণ রাখিবার জন্যও শিখা ধারণ করা আবশ্যক। পৃথিবীতে যতগুলি জাতি আছে তন্মধ্যে আর্য জাতিই শীতোষ্ণ দ্বন্দ্ব সহ্য করিতে বেশি সক্ষম। আর্যগণ শীতকালে প্রাতঃ সন্ধ্যা এবং সায়ংকালে স্নান করিতে ভীত হয় না। ইহার একমাত্র কারণ—শিখা। শিখা ত্যাগ করিলে মর্মস্থান দুর্বল হইয়া পড়ে। যাহাতে শীতোষ্ণ সহ্য হয় না। গোক্ষুর পরিমাণ শিখা ধারণ করিলে বীর্যের উর্দ্ধগতি হয়। উর্দ্ধরেতাই জিতেন্দ্রিয় হয়, এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদিগের গৃহে যোগীদিগের জন্ম হয়। এই একমাত্র কারণ যে, ভারতবর্ষে পতঞ্জলি সদৃশ যোগাচার্য জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। শিখাচ্ছেদন করিলে বীর্য অধোগামী হয়, পুরুষত্ব নষ্ট হইলে নারীগণ বশীভূত না থাকিয়া ব্যভিচারে নিযুক্ত হয়, এবং তাহাতে নিষ্কর্মা ও অধার্মিক সন্তান জন্মগ্রহণ করে, শিখা ত্যাগ করিলে এতাদৃশ বহুক্ষতি হওয়া সম্ভব। মুসলমান, খৃষ্টানাদি শিখা ধারণ করে না, তাহাদের কেন ক্ষতি হয় না ?

উহার উত্তর এই যে সূক্ষ্মরূপে ক্ষতি অবশ্যই হয়, কিন্তু ইহার উপলব্ধি নাহওয়াতে ঠিক বোধগম্য হয় না। মুসলমানও খৃষ্টানদিগের স্মরণশক্তি দাক্ষিণাত্য বিদ্বান্ দিগের অপেক্ষা অত্যন্ত ন্যূন। খৃষ্টান ও মুসলমানগণ আর্যদিগের মত সংযমীত নয়। শিখা ইহার একমাত্র কারণ, কেন না যাহা বিদ্যমানে কিছু ঘটে এবং উহার অবর্তমানে তাহা ঘটে না, তবে উহাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে জানিতে হইবে। সন্ন্যাসীগণ শিখা ধারণ করেন না; তাহাদিগের কি ক্ষতি হয় না? না, হয় না। কেন না সন্ন্যাস আশ্রমের বিধান পঞ্চ সপ্ততি (৭৫) বৎসর পর দেওয়া হইয়াছে। সেই সময় পর্যন্ত লঘু মস্তিষ্ক, সুষুম্না জ্ঞান কেন্দ্র পরিপক্ক হইয়া যায়, সেই সময় পর্যন্ত শিরোভাগের বিশেষ করিয়া শিখা স্থলের ত্বক শক্ত হইয়া যায়। তাহা ছাড়া শিখা ঘটিত লাভ ও পঞ্চসপ্ততি বৎসর পর্যন্ত প্রাপ্ত হইয়া যায়। সন্ন্যাসী শীতোষ্ণ সহ্য করিতে অভ্যস্ত, সুতরাং শিখা ধারণ না করিলে উহাদের কোন ক্ষতি হয় না।

শিখা ও পৃথিবীর অন্যান্য জাতি করার প্রথা লুপ্ত প্রায় হইয়াছে এবং আর্য জাতি ব্যতিরেকে অন্য কোন মতাবলম্বী শিখা বিজ্ঞানের অনভিজ্ঞতাবশতঃ শিখাহীন হইয়া পড়িয়াছে, তথাপি কোন সময়ে সর্বদেশে ও জাতি মধ্যে শিখা ধারণ করার প্রথা প্রচলিত ছিল। খৃষ্টানদিগের ধর্মশাস্ত্র বাইবেলে সামসনের সম্বন্ধে একটি কাহিনী লক্ষিত হয়। তিনি খুব প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাহার শত্রুগণ তাহাকে পরাজিত করিবার জন্য বিবিধ উপায় অবলম্বন করিয়া ও সফল হইল না, অবশেষে ফিলীস্তীনদিগের সরদার তাহার প্রেমিকাকে বলিল, “তুই ইহার শক্তির রহস্য অবগত হইয়া আমাদিগকে জানাইবি, প্রতিদানে আমরা তোকে প্রচুর সম্পত্তি প্রদান করিব”। সেই রমণী জিজ্ঞাসা করায় সামসন বলিলেন যে, তাহার শিরোপরি কেশ তাহার শক্তির হেতু, যদি তাহার মস্তক মুণ্ডন করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে তিনি নির্বল হইয়া অন্যান্য ব্যক্তিদিগের মত হইয়া পড়িবেন। তখন— And she made him sleep on her knees and she called for a man, and she caused him to shave off the seven locks of his head and she began to afflict him and his strength went fromhim. (Judges-16-19 ) ।

সেই রমণী তাহাকে তাহার কোলে শোয়াইয়া দিল এবং একজন লোককে আহ্বান করিয়া তাহার শিরোপরি মাথাটির কেশগুচ্ছ মুণ্ডন করাইয়া দিল, সে তাহাকে যাতনা দিতে আরম্ভ করিল এবং তাহার শক্তি তাহাকে ত্যাগ করিল। প্রাচীনকালে কয়েক প্রকার শিখা রাখিবার বিধানও ছিল। মহর্ষি দয়ানন্দ “সংস্কার বিধি”-তে লিখিয়াছেন – (চূড়াকর্ম) পাঁচটি এবং অল্প অল্প কেশ রাখিতে হইবে, এই প্রথা বিকৃত হইয়া খৃষ্টানদিগের মধ্যে সাতটি কেশগুচ্ছ হইয়া থাকিবে। ইহাতে খৃষ্টানদিগের মধ্যে শিখা ধারণ করা প্রত্যক্ষ হইল। ডা. আই. ই. ক্লার্কের পূর্বপ্রদত্ত উদ্ধৃতি দ্বারা চীনে ও শিখাধারণ করার প্রথা সম্বন্ধে জানা যায়। হিব্রু জাতির মান্যগ্রন্থ “তমঙ”-এ এ সম্বন্ধিত কয়েকটি বিবরণ পাওয়া যায়, যদ্বারা ওই জাতির মধ্যেও শিখা ধারণ করার প্রথা ও প্রচলিত ছিল— জানা যায়। মুসলমানদিগের তুর্কি টুপির উপরে কালো সূতার গুচ্ছ শিখা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ইউরোপিয়ান সৈন্যগণের শিরোস্ত্রাণের উপর পিতলের শিখা থাকে। রাজা ও সেনাপতিদিগের শিরোপরি পক্ষীর পালক-শিখা ছাড়া আর কিছু না। ময়ূরের শিখি ও কুক্কুটের তাম্রচূড় নাম সর্ববিহিত। রাজসর্পের মস্তকেও শিখার কথা শ্রুত হয়। এইভাবে ধার্মিক, বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক সর্বপ্রকার দিক দিয়া মানব জীবনে শিখার অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ স্থান। অতএব প্রত্যেক আর্যই নয়, বরঞ্চ প্রত্যেক মনুষ্যকে, ধর্ম, মত সম্প্রদায় নির্বিশেষে শক্তি, আয়ু, তেজ ও বুদ্ধি বৃদ্ধি হেতু আজ হইতেই শিখাধারণ করা উচিৎ।

সহায়ক গ্রন্থঃ-শিখা-সূত্র

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ