জগন্নাথের রথ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

11 June, 2023

জগন্নাথের রথ

জগন্নাথের রথ

 আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে হয় শুভ রথযাত্রা ৷ রথে চেপে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ, বলরাম আর শুভদ্রা ৷

রথের দিন মন্দির ছেড়ে গুন্ডিচা মন্দিরে মাসির বাড়িতে যান জগন্নাথ ৷ গুন্ডিচা ছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী ৷ ইন্দ্রদ্যুম্নই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ৷

জগন্নাথের রথের রশির নাম ‘শঙ্খচূড়া নাগুনি’ ৷ জগন্নাথের রথে সওয়ার হন আরও ৯ দেবতা ৷ এঁদের মধ্যে রয়েছেন গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নরসিংহ, রাম, নারায়ণ, হনুমান, রুদ্র ৷ জগন্নাথের রথে একজন রক্ষীও থাকেন ৷ এই রক্ষীর নাম গারুদা ৷

জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ ৷ রথে জগন্নাথের সঙ্গী হন মদনমোহন ৷ উচ্চতা ৪৫ফুট। রথের গায়ে থাকে হলুদ এবং সোনালি রং। এই রথে রয়েছে সাত ফুট ব্যাসের ১৬টি চাকা। জগন্নাথের রথের সারথির নাম মিতালি। ৮৩২ কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় এই রথ ৷ রথের মাথায় থাকা পতাকার নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী ৷ রথে ৪টি ঘোড়া থাকে ৷ 

বলরামের রথের নাম তালধ্বজ ৷ রথে তাঁর সঙ্গী হন রামকৃষ্ণ ৷ তালধ্বজের উচ্চতা ৪৪ ফুট ৷ এই রথে ৬ ফুট ব্যাসের মোট ১৪ চাকা রয়েছে ৷ ৭৬৩ কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় রথ ৷ লাল ও সবুজ কাপড়ে সাজানো হয় তালধ্বজ ৷

তালধ্বজের রক্ষীর নাম বাসুদেব ৷ সারথি সাত্যকি। রথের মাথায় পতাকার নাম উন্যানী ৷ রথের রশির নাম বাসুকি নাগ ৷ বলরামের রথেও ৯ দেবতা থাকেন ৷ এঁদের মধ্যে আছেন কার্তিক, গণেশ, সর্বমঙ্গলা, মৃত্যুঞ্জয়, মুক্তেশ্বর ৷ 

সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন ৷ রথে থাকেন সুভদ্রার সঙ্গিনী সুদর্শনা ৷ দর্পদলনের উচ্চতা ৪৩ ফুট ৷ এই রথে মোট ১২ চাকা রয়েছে ৷ লাল এবং কালো কাপড়ে সাজানো হয় রথ ৷ দর্পদলনের সারথির নাম অর্জুন ৷ দর্পদলনের মাথায় থাকা পতাকার নাম নদম্বিকা ৷ রথের রশির নাম স্বর্ণচূড়া নাগুনি ৷

সুভদ্রার রথে থাকেন ৯ দেবী ৷ এঁদের মধ্যে রয়েছেন চণ্ডী, চামুণ্ডা, বনদুর্গা, শুলিদুর্গা, শ্যামাকালী, মঙ্গলা, বিমলা ৷

প্রতিবছর ২২টি সিঁড়ি বা ধাপ বেয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে নামানো হয়। যাঁকে বলে ‘বৈশি পঁহচা’। পুরীর মন্দিরের সিংহদুয়ার থেকে কুর্মবেড়া পর্যন্ত এই ‘বৈশি পঁহচা’র প্রতিটি ধাপ খোন্ডালাইট পাথর দিয়ে তৈরি। এই স্থানটিকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন পুণ্যার্থীরা। রথ ঘিরে এমন অজস্র রীতিনিয়ম। 

রথ তৈরির নিয়ম


জগন্নাথ দেবের রথ তৈরি করতে দুই মাস সময় লাগে । এই সময়ে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। একটি রথ তৈরি করতে, প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল কাঠ নির্বাচন। রথের জন্য পেরেক বা যে কোনও কাঠ ব্যবহার করা হয় না। রথের কাঠ সোজা ও খাঁটি হতে হবে। রথ প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত কারিগররাও পুরো ২ মাস সেখানে থাকেন এবং তাঁদেরও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়।

রথ তৈরির কারিগররা একই সময়ে খান। এই সময়টা তাঁরা আমিষ খাবার খেতে পারে না। তাঁদের খেতে হয় ছিমছাম খাবার। এই সময়ে, কারিগরদের ব্রহ্মচর্য পালন করা বাধ্যতামূলক। সুতক বা পাটকের মতো কারিগরের পরিবারের কোনও সদস্যের সঙ্গে যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তবে সেই কারিগরকে রথ তৈরির কাজ থেকে সরে আসতে হয়। 


সোনার কুড়াল দিয়ে রথের কাঠ কাটা হয়

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার জন্য রথ তৈরির কাজ শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। রথ তৈরির জন্য জঙ্গল থেকে কাঠ আনা হয়। মন্দির কমিটির তরফে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে খবর পাঠানো হয়। তারপরে মন্দিরের পুরোহিতরা জঙ্গলে গিয়ে সেই গাছের পুজো করেন । নির্দিষ্ট সেই গাছের গুঁড়ি সোনার কুড়াল দিয়ে কাটা হয়। এই কুঠারটি প্রথমে ভগবান জগন্নাথের মূর্তির পায়ে স্পর্শ করানো হয়।

জগন্নাথের রথ

কোন কোন গাছের কাঠ রথে ব্যবহার করা হয়


জগন্নাথের রথ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় নিম ও হাঁসি গাছের কাঠ। রথযাত্রায় ভগবান জগন্নাথ,  বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা প্রত্যেকেরই  রথ তৈরি করা হয়। এভাবে মোট ৩টি রথ তৈরি হয়। তিনটি রথ নির্মাণের জন্য প্রায় ৮৮৪ টি গাছের ১২ ফুটের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। এগুলি থেকে রথের স্তম্ভগুলি তৈরি করা হয়। 

রথ বিষয়ে শাস্ত্রে বেশ কিছু প্রমান রয়েছে, তবে তার সাথে জগন্নাথের রথের কোন সম্পর্ক নেই। যেমন কঠ উপনিষদের বচনানুসারেঃ-


আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ॥৩॥

ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান্।
আত্মেন্দ্রিয়মনোয়ুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ॥৪॥
[কঠ উপনিষদ ১/৩/৩-৪]

পদ০-আত্মানং। রথিনং। বৃদ্ধি। শরীরং। রথং। এব। তু। বুদ্ধিং। তু। সারথিং। বিদ্ধি। মনঃ। প্রগহং। এব। চ।।
পদার্থ-( আত্মানম্) আত্মাকে ( রথিনম্) রথী ( বিদ্ধি) জানিবে ( তু) এবং ( শরীরম্) শরীরকে ( এব) নিশ্চয় করে ( রথম্) রথ জানিবে ( তু) এবং ( বুদ্ধিম্) বুদ্ধিকে ( সারথিম্) সারথি ( বিদ্ধি) জানিবে ( চ) এবং ( এবং) নিশ্চয় করে ( মনঃ) মনকে ( প্রগ্রহম্) লাগাম জানিবে।

ভাষ্য-এই শ্লোকে রথের অলঙ্কার দ্বারা শরীরের বর্ণনা করা হয়েছে অর্থাৎ এই শরীররূপী রথ যার সারথি বুদ্ধি, মন লাগাম এবং আত্মা যার মধ্যে সারথি। ভাব এই যে,রথীর রথ সঠিক চলে যার বুদ্ধিরূপী সারথি এবং মন রূপী লাগাম সঠিক হয়।
সরলার্থ— আমাদের প্রত্যেকের শরীর হলো রথ,আর বামন জগন্নাথ (আত্মা ও পরমাত্মা) হলো সেই রথের স্বামী,আমাদের মন হলো লাগাম,ঘোড়াগুলি হলো ইন্দ্রিয় এবং মনীষীগণ (যোগীপুরুষ-আমরা) বুদ্ধিরুপী সারথির নিয়ন্ত্রনে মন ও ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করে (বিষয়রুপী) জীবন পথে পরিচালনা করে পরমাত্মামুখী যাত্রা (শুদ্ধজ্ঞানের দ্বারা কর্ম) করে উনার আশ্রয় লাভ করে (ঈশ্বরপ্রাপ্তি)।

পদ০-ইন্দ্রিয়াণি। হয়ান্। আহুঃ। বিষয়ান্। তেষু। গেচরান্।
আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং। ভোক্তা। ইতি। আহুঃ। মনীষিণঃ॥৪॥

পদার্থঃ-( ইন্দ্রিয়াণি) ইন্দ্রিয়াদিকে ( হয়ান্) ঘোড়া ( আহুঃ) বলা হয় ( তেষু) তার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ( বিষয়ান্) শব্দ, স্পর্শাদি বিষয়কে ( গোচরান্) মার্গ বলা হয় ( মনীষিণঃ) মননশীল পুরুষ ( আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং) শরীর, ইন্দ্রিয় তথা মন এই তিন দ্বারা যুক্ত আত্মাকে ( ভোক্তা) ভোক্তা ( ইতি,আহুঃ) বলা হয় ॥৪॥

ভাষ্য-এই শ্লোকে বলা হয়েছে যে,ওই আত্মা যার শরীর ব্রহ্মচর্য্যাদি ব্রত দ্বারা আরগ্য,অভেক্ষ্য পদার্থের ত্যাগ দ্বারা বুদ্ধি শুদ্ধ,সত্যাদি ব্রত দ্বারা মন নির্মল এবং ইন্দ্রিয়াদি যার বশীভূত ওই পুরুষ নির্ভয়তা থেকে নিজ লক্ষ্যকে প্রাপ্ত হয়। মায়াবাদি উক্ত শ্লোকে ভোক্তার অর্থ চিদাভাস করে, আবাসবাদের রীতি দ্বারা ব্রহ্মের জীব উৎপত্তিকে "চিদাভাস" বলে,তাদের মতে জীব উক্ত রীতি দ্বারা ব্রহ্ম জীব হয়ে যায়,এই অর্থ এখানে সঙ্গত নয়,কারণ এই প্রকরণে ব্রহ্মকে জীব ভাব থেকে নিরুপণ কিন্তু করা হয়নি অনাদিকাল হতে জীবকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নিরুপণ করা হয়েছে॥৪॥ ( ভাষ্য০-শ্রী আর্যমুনি পরিব্রাজক)

বেদে বলা আছে-
যম্ দেবাসোঽবথ বাজসাতৌ যম্ শূরসাতা মরুতো হিতে ধনে।
প্রাতর্যাবাণমং রথম্ ইন্দ্র সানসিম্ ওরিষ্যন্তম্ আ রুহেমা স্বস্তয়ে॥
[ঋগ্বেদ ১০/৬৩/১৪]
অর্থ— হে উজ্জ্বল দিব্য ধনের অধিকারী বিদ্যান পুরুষ! অন্ন,বল ও হিতকর ধনাদি লাভের জন্য ঈশ্বর লাভের সাধন যে রথকে তোমরা রক্ষা কর,সেই সুগঠিত রথে কল্যাণের জন্য আমরা আরোহন করি।
ভাবার্থ— বিদ্বান পুরুষের নাম মরুত এবং শরীরের নাম রথ।এই রথ শুধু অন্ন,বল, ও ধন লাভেরই সহায়ক নয়;ইহা ঈশ্বর লাভেরও সহায়ক।নীরোগ শরীর রূপী রথকে ব্রাহ্মমুহূর্তে সন্ধ্যোপাসনায় নিযুক্ত করবে।

যস্যাশ্বা॑সঃ প্র॒দিশি॒ যস্য॒ গাবো॒ যস্য॒ গ্রামা॒ যস্য॒ বিশ্বে॒ রথা॑সঃ।
যঃ সূর্যং॒ য উ॒ষসং॑ জ॒জান॒ যো অ॒পাং নে॒তা স জ॑নাস॒ ইন্দ্রঃ॑ ॥ (অথর্ববেদ ২০।৩৪।৭)
পদার্থঃ (য়স্য) যার (প্রদিশি) আজা বা কৃপাতে (অশ্বাসঃ) কর্মেন্দ্রিয় কর্মে নিযুক্ত হয়, (য়স্য) যার আজ্ঞাতে (গাবঃ) জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞান প্রাপ্ত করে, (য়স্য গ্রামা) যার আজ্ঞাতে প্রাণসমূহ আপন আপন কর্মে নিযুক্ত এবং (য়স্য বিশ্বে রথাসঃ) যার আজ্ঞাতে শরীররূপ রথ বিশ্বে কর্মশীল, (য়ঃ সূর্যম) যে ভগবান সূর্যকে (য়ঃ উপসম্) এবং প্রভাত বেলা কে (জজান) উৎপন্ন করে (য়ঃ অপামা নেতা) যে ভগবান সর্বত্র জলের প্রেরণকারী। (জনাসঃ) হে মানুষ! (স ইন্দ্ৰঃ) তিনি মহান ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন ইন্দ্র।
ভাবার্থ: যেই পরমাত্মার কৃপায় আমাদের কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং শরীর নামক রথ গতিশীল বা নিজ নিজ কর্মে নিযুক্ত হয়, যে ভগবান সূর্য এবং প্রভাত বেলাকে সৃষ্টি করেছেন এবং জল কে যে কোন স্থানে প্রেরণ করেছেন, হে মানুষ তিনিই পরমেশ্বর্য্যসম্পন্ন পরমাত্মা ইন্দ্র।।
শরীররূপী প্রকৃত রথকে চিনুন, আর সেই রথের ভেতরে বিদ্যমান রথি (জগতের নাথ জগন্নাথকে) চিনুন, চিনতে পারলে ও তাকে জানতে পারলেই জীবন সার্থক।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ