হিন্দুস্তানে জিহাদ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 June, 2023

হিন্দুস্তানে জিহাদ

643 AD ইসলাম ধর্মের ভিতর এক হওয়া খেলাফতেরা বিজয় অর্জন করতে করতে আধুনিক আফগানিস্তান, মকরন্দ সিন্ধ প্রদেশের সীমা পর্যন্ত পৌছে যায়। ঐ সময় আধুনিক দক্ষিণ আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান সিন্ধ এর মতো জায়গা গুলো হিন্দু রাজাদের অধিনে ছিলো। ইতিহাস বলে ঐ জায়াগা গুলোতে ব্রাহ্মণ,জাট, রাজপুত ও বৌদ্ধ রাজা জমিদার ও গ্রাম প্রধান এর অধিনে ছিলো।
647 AD সম্রাট হ্রস্ববর্ধন এর মৃত্যু হয়ে যায়। সম্রাট হ্রস্ববর্ধন এর কোনো উত্তরাধিকারি না থাকায় উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব ভারত শত শত ছোট রাজ্যে বিভাজিত হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় বর্বর মুসলিম খেলাফতেদের জন্য ভারতে প্রবেশ সহজ হয়ে যায়।
মুসলিম খেলাফত উমায়েদ এর জন্য এটা ছিলো সূবর্ণ সুযোগ।সে বালুচিস্তান ও সিন্ধ এ অনুপ্রবেশ করা শুরু করে দেয়। কিন্তু হিন্দু তুর্কি শাহি রাজা ও রাজা ছাচ কে হারানো সহজ না। মুসলিম খেলাফতেরা বহুবার হিন্দু রাজাদের কাছে পরাজিত হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ প্রান্তেও আরবীয় বর্বর মুসলিম রা রাজা ছাচ এর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়। কিন্তু এটা মাত্র শুরু ছিলো। খেলাফতেরা এত সহজে থামার নয়। ধীরে ধীরে ইসলামিক খেলাফত একটা বিশাল সাম্রাজ্যে পরিনত হয়। সম্পত্তি ও সেনা সংখ্যায় এদের কোনো মোকাবেলা ছিলো না। আশেপাশে কোনো বড় সম্রাজ্য না থাকায় এদের আটকানো অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো।
অন্যদিকে সিন্ধ প্রেদেশে ব্যাবসায়ী রা জলদস্যু দের উতপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো। এই সুজোগ কাজে লাগিয়ে আল হাজাজ ইবনে উমায়েদ খালিফ অনুমতি নিয়ে প্রভাব শালী সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধ প্রেদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মোহাম্মদ কাসিম আরবী ও বাগদাদি সেনার নেতৃত্ব দিয়ে সিন্ধ প্রদেশের সীমানা পর্যন্ত পৌছেযায়। সিন্ধ প্রদেশে পৌছেই মোহাম্মদ বিন কাসিম কিছু স্থানীয় ভীতু লোভী ব্রাহ্মণ,জাট ও রাজপুত জমিদার ও গ্রাম প্রধান দের সাথে একত্রিত হয়ে যায়। এবং খুব সহজেই দেবাল,নিরুন, সাদুসন দখলে নিয়ে নেয়। দেবাল,নিরুন,সাদুসন দখলে নেয়ার পরে কাসিম এর লখ্য ছিলো সিন্ধু নদীর ওপর প্রান্তে থাকা Alor রাজ্যে। স্থানীয় কিছু জেলেদের সাহায্যে ছোট ছোট
নৌকা দিয়ে তারা সিন্ধু নদী পার হলো। কিন্তু alor রাজ্যে কাসিম এর অপেক্ষা করছিলো পরাক্রমশালী রাজ ছাচ এর পরাক্রমশালী ছেলে রাজা দাহির। শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ যুদ্ধের শুরুতেই রাজা দাহির মোহাম্মদ বিন কাসিমের দুই সেনা প্রধান কে ৭২ হুর দের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু হঠাৎ ই রাজা দাহির এর শরীরে একটি জলন্ত তীর প্রবেশ করে এবং রাজা দাহির বীর- গতি- প্রাপ্ত হন।মোহাম্মদ বিন কাসিমের জয় হয় এবং সে পুরো সিন্ধ প্রদেশের দখল পেয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে পশ্চিম ও উত্তর দুই দিক দিয়ে আক্রমণ হওয়ার পরেও হিন্দুরা কাবুলিস্তান কে আরবীয় দের হাত থেকে বাচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়ে ছিলো। এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে জলদস্যু দের জন্য যুদ্ধের শুরু হলো তারা বিনা যুদ্ধে হার মেনে নেয় এবং ইসলাম মাজহাব গ্রহণ করে নেয়। আসলে তারা ছিলো আরবিয় পৃষ্ঠপুসকতায়। আরবীয় রা সিন্ধ দখল করার জন্য এদের কাজে লাগিয়ে ছিলো। আরবীয় দের পরিকল্পনা ছিলো সিন্ধ কে আরব প্রদেশ বানিয়ে গুজরাট, কাশ্মীর,রাজস্থান, মহারাষ্ট্রে আক্রমণ করার।কিন্তু সিন্ধ ও মুলতান এর স্থানীয় জনতা লরাকু এবং বিদ্রোহী ছিল। হিন্দু বীরেরা নিজেদের উপর মুসলিম শাসন পছন্দ করছিলো না। তারা বিদ্রোহ করা শুরু করে দেয়।বিদ্রোহ কমানোর জন্য মোহাম্মদ বিন কাসিম বিভিন্ন বিভাগের চাকরির উচু পদ গুলোতে হিন্দু দের নিয়োগ দিতে থাকে যাতে স্থানীয় হিন্দুরা খুশি হয়ে বিদ্রোহ করা থামিয়ে দেয়। কিন্তু এতে কাজ হয় নি। বিদ্রোহ থামেনি ফলে আরবীয় দের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না এবং তারা মুলতান পর্যন্তই থেমে যায়।
715 AD দামাস্কাসে সুলেমান ইভনে আব-আলমালিক নতুন খেলাফত হয়ে যান। এবং সে মোহাম্মদ বিন কাসিম একটা ঘটনার জন্য মৃত্যু দন্ড দেন।
মেহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধ থেকে চলে যাওয়ার পরে আবার আগের মতো হিন্দু গ্রাম প্রধান জমিদার ও রাজারা সিন্ধ প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
717 AD খালিফ উমা ইভেন আব-আল আজিজ এর হুমকিতে কিছু ভীতু জমিদার ও গ্রাম প্রধান ইসলাম গ্রহণ করে উমায়েদ খলিফত সম্রাজ্যে যোগ দেয়
720 AD ইয়াজিব বিন আল মালিক ইসলাম সম্রাজ্যের ৯ ম খলিফা। এবং সিন্ধের নতুন রাজ্যপাল/গভর্নর আক্রমনাত্মক হয়ে উজ্জেন ও কাশ্মীর দখল করা শুরু করে দেয়।
724 AD অপরদিকে হিন্দুদের সম্রাট ললিতাদিত্য শাসন কাল শুরু হয়েছিল। ললিতাদিত্য এবং জুনায়েদ এর মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়। ললিতাদিত্য জুনায়েদ কে যুদ্ধে পরাজিত করেন। ললিত আদিত্যের এই বিজয়ের ফলে পশ্চিম তটের স্থানীয় রাজারাও বিদ্রোহ শুরু করে দেয় এবং এর ফলে পাঞ্জাব,গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান থেকে আরবীয় দের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। জুনায়েদ এর এই পরজায় এর শাস্তি হিসেবে তাকে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। এইসময় আরও কয়েকবার আরবীয় রা হামলা চালায় তবে তারা বার বার পরাজিত হয়। তারা এইসময় এত বার পরাজিত হওয়ার ফলে আরবীয় সৈন্য রা বাগদাদ এর আগে আসতে মানা করে দিয়েছিল।এই ৬ বছরে আরবীয় দের পশ্চিম ইরান পর্যন্ত তাড়িয়ে দেয়া হয়।
731 AD
উমায়েদ খলিফত সম্রাজ্য পুনরায় এক এক গভর্নর কে এক মহাপরাক্রমশালী সৈন্য দলের সিন্ধ প্রদেশ দখল করতে পাঠায়। নতুন গভর্নর কিছুদিনের জন্য সিন্ধ দখল করতে সক্ষম হয়। সিন্ধ থেকে সে মূল ভারতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু ভারত বর্ষ দখল করা অতো সহজ না। এই সময়ে ভারতে নতুন পরাক্রমশালী রাজার প্রত্যাবর্তন ঘটে।
কাশ্মীর, পূর্ব আফগানিস্তান ও পাঞ্জাব এ সম্রাট ললিতাদিত্য শাসন করছিলেন। রাজস্থানের রাজা ছিলেন মহাপরাক্রমশালী বাপ্পা রাওয়াল। এরা আরবীয় শিবিরে কম্পন এর কারন ছিলেন।গুজরাটেও একই পরিস্থিতির স্বীকার হয় আরবীয়রা। গুজরাট ও রাজস্থানে যুদ্ধে বার বার পরাজিত হয় আরবীয়রা। বার বার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে গুজরাট ও রাজস্থান বাইপাস করে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে কিন্তু তারা ওখানেও রাজা দন্তি দুর্গা ও চালুক্য সাম্রাট বিক্রমাদিত্য সাম্রাজ্যের এক উপরাজা র কাছে পরাজিত হয়। অন্যদিকে আফগানিস্তানে হিন্দু রাজারা আরবীয় দের উপর আক্রমণ করে সিন্ধের অনেকটা অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। অন্যদিকে বাপ্পারাওয়াল সিন্ধুতে ঢুকে যায় আর মু*লমান আরবীয়দের উপর আক্রমণ করে।বাপ্পারাওয়াল সেখানেই থামেন না। তিনি আরো এগিয়ে গিয়ে মু*লিম দের থেকে মুলতান থেকে ইরান পর্যন্ত নিয়ে নেন এবং তাদের তাড়িয়ে দেন আর অই প্রদেশ গুলোতে স্থানীয় হিন্দু রাজাদের শাসন করার জন্য দিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত আব্বাসাইদ খেলাফত (উমায়েদ খেলাফত) আল-হিন্দ বানানোর স্বপ্ন ছেড়ে দেয় এবং পরবর্তী 40 বছর আর কোনো আক্রমণ করেননি তারা। কিন্তু বাপ্পারাওয়াল ও ললিত আদিত্যের পরবর্তীতে 760 Ad এর সময় আরবীয়রা পুনরায় সিন্ধ প্রদেশ দখল করে নেয় কিন্তু তারা মুল ভারতে প্রবেশ করতে অসফল হয়।
776 Ad আরবীয় রা এক বিশাল সৈন্য নিয়ে সমুদ্র পথে রাষ্ট্রকূট সম্রাজ্যে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে কিন্তু রাজা গোপা আরবীয় দের পরিক্লপনা নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। এই সময় রাষ্ট্রকূট এক মহাশক্তিতে পরিনত হয় যেখানে আক্রমণ করে দখল করা অসম্ভব বেপার ছিলো। আরবীয় ও ভারতীয় হিন্দু রাজাদের মধ্যে বার বার যুদ্ধ হতে থাকে। ৯ ম শতক পর্যন্ত এই যুদ্ধ গুলো Gurjara-pratihas vs Arbas এ পরিনত হয়। এই যুদ্ধ গুলো আরবীয় রা বার বার পরাজিত হতে থাকে। Gurjara-pratihas সম্রাজ্যে গুজরাট, রাজস্থান,পাঞ্জাব এক অভেদ্য সীমান্তে পরিনত হয়। এই অভেদ্য সম্রাজ্য দখল করা আরবীয়, ইরানি,এবং বিভিন্ন জায়গা হতে আগত মুসলিম শাসক দের জন্য অসম্ভব ছিলো পরবর্তী ৩০০ বছর।
কাবুল ও জাবুলিস্তান অধিকারে ব্যর্থ হয়ে মুসলমান সিন্ধু জয়ে উদ্যোগী হয়। পারস্য ইতিপূর্বেই মুসলিম সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়েছে। ওমায়েদ (Omayyad) বংশীয়দের সময় সাম্রাজ্যের সীমা পূর্বদিকে বিস্তৃত হলে, খিলাফতের প্রভাব-প্রতিপত্তি, খ্যাতি ও মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই সময় ইরাকের শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ (I'ajjaj), ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও ঘোর সাম্রাজ্যবাদী।* তিনিই ছিলেন পূর্বতন বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের প্রকৃত অধিকর্তা। তিনি বোখারা, সমরখন্দ ও ফারগানা প্রদেশকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সন্ধি করেন কাশগড়ের চৈনিক শাসকের সঙ্গে। অতঃপর সামান্য একটি ঘটনাকে উপলক্ষ করে হাজ্জাজ সিন্ধু রাজ্য আক্রমণ করে। উপলক্ষটি হল— সিংহলরাজ দুটি জাহাজে খলিফা ও হাজ্জাজের নিকট মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন। দেবলের কাছে জাহাজ দুটি জলদস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। অবশ্য এই ঘটনা সম্বন্ধে মতভেদ আছে। অন্যমতে (১) সিংহলে বাণিজ্য ব্যপদেশে যে সকল আরব বণিকের মৃত্যু হয়—তাহাদের নিরাশ্রয় কন্যাদের মহানুভব সিংহল-রাজ জাহাজে করে হাজ্জাজের নিকট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে জাহাজ দুটি দেবলের জলদস্যুগণ কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়। (২) ভারতের ক্রীতদাসী ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করার জন্য খলিফা তার কয়েকজন অনুচরকে ভারতে পাঠান। সিন্ধুর কাছে সমুদ্রপথে জাহাজটি জলদস্যুগণ কর্তৃক লুন্ঠিত হয়। হাজ্জাজ সিন্ধুরাজ দাহিরের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করলে, দাহির তা দিতে অস্বীকৃত হলে হাজ্জাজ সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেন। ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, ‘হাজ্জাজের একান্ত অনুরোধেই খলিফা সিন্ধু আক্রমণে অনুমতি দেন। সিন্ধুর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত হয়। - নিহত হয় সেনাপতি ধূল্যবলুন্ঠিত হয় সাম্রাজ্যবাদী গর্ব। এই শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হাজ্জাজ নবউদ্যমে শুরু করেন সমরসজ্জা। মহম্মদ বিন কাশিমের সেনাপতো সুসজ্জিত এক বিশাল বাহিনী সিন্ধু আক্রমণে অগ্রসর হয়।'
মহম্মদ বিন কাশিম ছিলেন বীর, সাহসী, দূরদর্শী ও রণনিপুণ। সামরিক খ্যাতির শীর্ষে তাঁর উত্থান, আবার তাঁর জীবন নাট্যের আকস্মিক বিয়োগান্ত অবসান ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। বিকাশিমের সেনাবাহিনীতে ছিল ৬০০০ রণদক্ষ সিরিয়ান ও ইরাকি যোদ্ধা ও সমসংখ্যক সশস্ত্র উদ্ভারোহী। বিন্ কাশিম মেকরান পৌঁছোলে, সেখানকার শাসনকর্তা মহম্মদ হারুন সসৈন্যে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। দাহিরের শাসনে ক্ষুব্ধ জাঠ ও মেড়দের এক অংশ বিন কাশিমের সঙ্গে সহযোগিতা করে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য যুদ্ধ জয়ে বিন্ কাশিমের সহায়ক হয়। অন্যদিকে এই জাতীয় অনৈক্য সিন্ধু-রাজের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
৭১২ খ্রিঃ বসন্তকালে বিন্ কাশিম দেবল পৌঁছিলে, হাজ্জাজ প্রেরিত এক বিরাট সৈন্যদল সমরোপকরণ সহ বিন কাশিমের সঙ্গে মিলিত হয়। দেবলে একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির ছিল। মুসলিম বাহিনী মন্দির আক্রমণ করলে- হিন্দুরা বাধা দেয়। কিন্তু হয় পরাজিত। মুসলমান মন্দির ধ্বংস করে নগর অধিকার করে। তিনদিন ধরে চলে নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন। বিন্ কাশিম নগরে স্থাপন করে একটি সেনানিবাস। নির্মাণ করে মসজিদ। চার হাজার সৈন্যের ওপর নগর রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ফরিস্তার বিবরণ অনুযায়ী ধর্মান্তরে অনিচ্ছুক ১৭ বৎসরের অধিক সকল পুরুষকে হত্যা করা হয়। হাজ্জাজকে উপহার স্বরূপ পাঠানো হয় লুণ্ঠিত সামগ্রীর এক-পঞ্চমাংশ ও ৭৫ জন সুন্দরী হিন্দু রমণী।
ঝটিকা আক্রমণে দেবল অধিকার করে বিন কাশিম আক্রমণ করে নিরুন (Nirun। অধিবাসীরা আত্মসমর্পণ করে; সাহায্য করে খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ যুগিয়ে। বিন্ কাশিম সিন্ধু নদ অতিক্রম করলে রাজা দাহির রাওয়ারে (Rawar) বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। সিন্ধু অভিযানে হিন্দুর সামরিক শক্তির সঙ্গে বিন্ কাশিমের এই প্রথম সম্মুখ সমর। উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। অলবিলাদুরির বর্ণনায়—এরকম ভয়ংকর যুদ্ধ ইতিপূর্বে কেউ কখনও দেখেনি। রণদুর্মদ রাজা দাহির হস্তীপৃষ্ঠ/পালকিতে হতে অবতরণ করে অসংখ্য শত্রু সংহার করেন। কিন্তু দিনশেষে তিনি নিহত হলে পৌত্তলিক বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে রণেভঙ্গ দেয়। মহোল্লাসে মুসলমান মত্ত হয় কাফের নিধনে।
তথ্যসূত্র:
1)Ibid পৃষ্ঠা 224,56
2)Iswari prasad---history of mediaeval india, পৃষ্ঠা-54
একটি ন্যাপথা [মাখানো] তীর দাহিরের হাওদায় এসে আঘাত করলে তাতে আগুন ধরে যায়। রণহস্তী তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ছুটে যায় জলাশয়ের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে রণক্ষেত্রে। আরব সৈন্য দাহিরকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। তাঁর বর্ষণ করে অবিরাম। দাহির মাটিতে পড়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ায়। একজন আরব সৈন্যের সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি লড়াই হয়; সে দাহিরকে তরবারি দিয়ে মস্তকে প্রচণ্ড আঘাত করে। দাহিরের মস্তক দ্বি-খণ্ডিত হয়। রাজার মৃত্যুতে হিন্দুরা বেপরোয়া আক্রমণ করে মুসলমানদের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। মুসলমান মত্ত উল্লাসে নির্বিচারে হত্যা করে পরাজিত হিন্দুদের।
রাজা দাহির ও তাঁর সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে যে বীরত্ব ও শৌর্যের পরিচয় দিয়েছে “চাচনামা”র (Chachnama) রচনায় তার নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যায়।
দাহির মহিষী রাণী বাঈ ছিলেন বীরাঙ্গনা। স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে রাওয়ার দুর্গে শেষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। বিন্ কাশিম দুর্গ অবরোধ করে। দুর্গের ওপর থেকে নীচে শত্রু সৈন্যের ওপর বর্ষিত হয় পাথর, তির ও বর্শা। মুসলিম বাহিনী খুবই শক্তিশালী। প্রচুর লোকক্ষয় সত্ত্বেও দুর্জয় সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তারা আক্রমণ প্রতিহত করে। রাণী বাঈ বুঝতে পারেন ব্যর্থ চেষ্টা - পরাজয় অনিবার্য। কিন্তু শঙ্কিত হন পুরললনাদের জন্য। মুসলিম চরিত্র সম্বন্ধে তিনি অবহিত। তাঁর আহ্বানে সকল রমণীগণ দুর্গমধ্যস্থ একটি স্থানে সমবেত হন। তাঁদের সম্বোধন করে রাণী বাঈ বলেন : “ভগবান না করুন, আমরা যেন স্বাধীনতার জন্য গো-মাংস ভক্ষণকারী এই শ্লেচ্ছ যবনদের নিকট বাধিত না থাকি। নারীত্বের মর্যাদা হবে লুণ্ঠিত। সময়-সংক্ষেপ, চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। পলায়নের সকল পথ রুদ্ধ। এস, আমরা সকলে মিলে কাঠ, তৈল ও বস্ত্র সংগ্রহ করি। তারপর একসঙ্গে অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়ে পরলোকে পতির সঙ্গে মিলিত হই। যদি কেহ বাঁচতে চান, তিনি যেতে পারেন। তারা প্রবেশ করে একটি প্রশস্ত কক্ষে। নারীত্বের সম্মান রক্ষায় প্রজ্বলিত হুতাশনে দেয় আত্মবিসর্জন।
সহস্র বৎসরের মুসলিম শাসনে লক্ষ লক্ষ ভারতের নারী সম্ভ্রম রক্ষায় “জহরব্রত” করে আত্মাহুতি দেয়। রাণী বাঈ ও সিন্ধু রমণীগণ তাদের পথিকৃৎ।
বিন্ কাশিম দুর্গ অধিকার করে। বধ করে ৬০০০ হিন্দুকে। লুণ্ঠন করেন রাজ কোষাগার। সিন্ধু জয় করে রাজা দাহিরের ছিন্ন শির হাজ্জাজকে উপঢৌকন স্বরূপ প্রেরণ করেন; সঙ্গে একখানি পত্র। পত্রে বিন্ কাশিম জানান : 'রাজা দাহিরের ভ্রাতুষ্পুত্র, সমর নায়ক ও পদস্থ রাজকর্মচারীদের ইতিপূর্বেই পরলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিধর্মীদের ইসলামে ধর্মান্তর অথবা বধ করা হয়েছে। মন্দির ভেঙে নির্মিত হয়েছে মসজিদ। প্রতি সকাল সন্ধ্যায় আল্লার উদ্দেশে পাঠ করা হয় নামাজ।'
বিন্ কাশিমের পত্র পেয়ে হাজ্জাজ তাঁকে তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে লেখেন। : “আল্লাহ্ বলেছেন, বিধর্মী কাফেরদের প্রতি কোনো দয়া প্রদর্শন নয়, তাদের বধ করবে। তুমি জেনে রাখো, ইহাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর আদেশ। তুমি যদি তাদের সুরক্ষা দাও, তবে তার দ্বারা তোমার আরব্ধ কাজ (মুসলিম-রাজ প্রতিষ্ঠা) বিলম্বিত হবে।”
বিজয়োন্মত্ত মুসলিম বাহিনী এরপর প্রায় বিনা বাধায় ব্রাহ্মণাবাদ ও আলোর দুর্গ জয় করে মুলতানের দিকে অগ্রসর হয়। মুলতান সিন্ধু নদের তীরবর্তী একটি প্রধান নগর। চাচনামার বিবরণ অনুযায়ী : ‘কাফের হিন্দু ও বিশ্বাসী মুসলমানের সঙ্গে সাতদিন ধরে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন মুলতান নরপতির ভ্রাতুষ্পুত্র। প্রবল সাহস ও পরাক্রমের সঙ্গে লড়াই করেও তিনি মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। বিন কাশিম দুর্গ দখল করে ৬০০০ নারী ও শিশুকে বন্দী করেন এবং অবশিষ্ট সকলকে করেন হত্যা।'
সিন্ধু জয় সমাপ্ত করে বিন্ কাশিম শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ইসলামি আইন অনুযায়ী বিধি-ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়; আবার অনেকে ছিল বেতনভুক। তারা অসহায় হিন্দু মেয়েদের সাদি করে এদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যেই সিন্ধু প্রদেশে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব সামরিক উপনিবেশ (Military Colonies)। ক্রমশ তারা ব্যাবসা-বাণিজ্যেও অংশগ্রহণ করে। জমির মালিক আরব মুসলমান, কিন্তু চাষ করতে হত হিন্দুদের। তাদের অবস্থা ছিল। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতো করুণ ও দুর্বিষহ।
রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল জমির খাজনা ও জিজিয়া কর। উৎপন্ন শস্যের ২/৫ ভাগ খাজনা স্বরূপ দিতে হত। এছাড়া অন্য করও ধার্য করা হত। হিন্দুদের কর দেওয়ার পদ্ধতি ছিল খুবই অপমানজনক। মহার্ঘ পোশাক, অশ্বারোহণ ছিল নিষিদ্ধ। যে জাঠ ও মেড় সম্প্রদায়ের লোকেরা দাহিরের বিরুদ্ধে বিন্ কাশিমকে সাহায্য করেছিল, তাদের ওপরও এই সকল বিধিনিষেধ সমভাবে প্রযুক্ত ছিল। নিয়মিত কঠোরভাবে ও অপমানজনক পদ্ধতিতে হিন্দুদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হত। কোনো হিন্দু চুরি করলে শাস্তি স্বরূপ তারও সন্তানদের পুড়িয়ে মারা হত। হিন্দু-মুসলমানে কোনো বিরোধ হলে কাজি ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার বিচার করতেন। ফলে হিন্দুরা সুবিচার থেকে ছিল বঞ্চিত। বিচারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল "হিন্দুদের কাছ থেকে আর্থিক জরিমানা সংগ্রহ অথবা ধর্মান্তরে (জরিমানা দিতে অক্ষম হলে) বাধ্য করা।
ঐতিহাসিক Dr. Titus বলেন, সিন্ধু জয় করে কি কাশিম অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন;অপবিত্র করেছেন দেবতার বিগ্রহ। দেবল, নিরুন ও আলোরে বহু মন্দির ধ্বংস করে সেখানে নির্মিত হয় মসজিদ। হিন্দুরা বাধা দিলে তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় - - স্ত্রী ও সন্তানদের বিক্রি করা হয় ক্রীতদাসরূপে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Andre Wink বলেন, সিন্ধু জয়ের পর ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস করে ইরাক ও অন্যত্র পাঠানো হয়। চাচনামার বিবরণ অনুযায়ী কয়েক লক্ষ হিন্দু নারীকেও পাঠানো হয় আরবে। মন্দির ধ্বংসের উদ্দেশ্য ছিল দ্বি-বিধ। হিন্দুর ধর্মবোধে আঘাত দেওয়া ও আরবের রাজকোষ সমৃদ্ধ করা। চাচনামার রচনায় প্রকাশ, একটি মন্দির থেকেই লুণ্ঠিত হয়েছে ২৩০ মন সোনা ও ৪০টি বৃহৎ কলস ভর্তি স্বর্ণ-চূর্ণ; সর্বমোট ১৩২০০ মন সোনা।
এ পরিসংখ্যানে অতিরঞ্জন থাকলেও মন্দিরের ধনভাণ্ডার থেকে যে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন লুণ্ঠিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মুলতানে একটি বিখ্যাত মন্দির ছিল। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারা বৎসর অসংখ্য ভক্ত সমাগম হত। প্রণামী বাবদ আয় হত লক্ষ লক্ষ টাকা। এই বিপুল অর্থের লোভে বিন্ কাশিম মন্দিরটি ধ্বংস করেননি, কিন্তু অপবিত্র করেছেন। পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের নিদর্শনস্বরূপ তিনি মন্দিরের দেবতার কণ্ঠে বেঁধে দিয়েছিলেন এক টুকরো গো-মাংস।
1) Ibid. P-57
2) Iswari Prasad History of Mediaeval India, P-58
3) Dr. Titas-Indian Islam, P-10 Quoted from Dr. BR Ambedkar-Writings and Speeches, Vol-8, P-55
4) Iswari Prasad History of Mediaeval India, P-60
5) Thid, P-62-63
6) Ibid, P-65 2. Ibid, P-60-61
পূর্ব আফগানিস্তানের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গজনী। সুলতান সুবুক্তিগীনের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আমীর ইসমাইল গজনীর সিংহাসন অধিকার করে। কিন্তু কনিষ্ঠ আমুর মামুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে পরাজিত করে ১৯৭ খ্রিঃ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর রাজত্বে ক্ষুদ্র গজনী এক বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক Will Durant- এর বিবরণ অনুযায়ী প্রতি শীতে তিনি হিন্দুস্থানে হানা দিতেন। হিন্দুস্থানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পূর্ণ করতেন তাঁর কোষাগার। (রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর) চিত্ত বিনোদনের জন্য লুণ্ঠন ও হত্যায় সৈন্যদের দিতেন অবাধ স্বাধীনতা। তারপর পূর্বাপেক্ষা আরও ধনী হয়ে বসন্তে ফিরে যেতেন স্বদেশে। হিন্দুস্থান থেকে লুণ্ঠিত মণিরত্নের প্রদর্শনী করে তিনি বিদেশী রাজদূতদের চমৎকৃত করতেন। এই সকল রত্নরাজির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য পরিস্রুত হিমায়িত মদ অথবা অগ্নিকণার ন্যায় প্রদীপ্ত মুক্তা ও পদ্মরাগ মণি, চিরহরিৎ গুস্মের সবুজ সতেজ পত্ররাজির ন্যায় পান্না এবং আকার ও ওজনে পক্ক দাড়িম্বের ন্যায় বৃহৎ হীরকখণ্ড।
মামুদের ঐতিহাসিক Al Utbi লিখেছেন - তিনি মন্দির ধ্বংস করে ইসলামের প্রতিষ্ঠা করেছেন। নগরের পর নগর তিনি অধিকার করেছেন; মুসলমানদের অভিলাষ পূর্ণ করতে নীচ কাফেরদের হত্যা করেছেন – ভেঙেছেন তাঁদের দেবতার বিগ্রহ। তারপর স্বদেশে ফিরে গিয়ে সগর্বে প্রচার করেছেন ইসলামের বিজয় কাহিনি.......। খোদার নামে শপথ নিয়েছেন প্রতি বছর তিনি হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ পরিচালনা করবেন।ভারত অভিযানে তিনি এরূপ হিংস্র বর্বর পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন যা হিন্দুদের মনে ভীতির সঞ্চার করত। উদ্দেশ্য পরিষ্কার - যাতে মনোবল হারিয়ে হিন্দুরা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে।
১০০১ খ্রিঃ তিনি রাজা জয়পালের রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধে জয়পাল পরাজিত ও বন্দি হন। মামুদ আদেশ দিলেন – শৃঙ্খলিত জয়পালকে রাজপথে ঘোরানো হবে। রাজার এই চরম দুর্গতি ও অপমান রাজপুত্রগণ ও অমাত্যবর্গ স্বচক্ষেই দেখবে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে ইসলামের আতঙ্ক' ১০১১ খ্রিঃ চাঁদ রাই যুদ্ধে মামুদের নিকট পরাজিত হয়। অসংখ্য হিন্দু নিহত অথবা বন্দি হয়। রাজধানী অরক্ষিত। লুণ্ঠনের সুবর্ণ সুযোগ। ‘ইসলামের বীর ধর্মযোদ্ধাদের সেদিকে কিন্তু খেয়াল নেই – যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা সূর্য ও অগ্নির উপাসক কাফেরদের রক্তে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। “কাফের হত্যা” সুলতান মামুদ ও তাঁর সৈনিকদের দিত অপার আনন্দ।
সুলতান জানতে পারেন যে হিন্দুস্থানে থানেশ্বর নামে একটি রাজ্য আছে। সেখানে আছে জাগরসম (Jagarsom) দেবের বিশাল মন্দির। হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি সংগ্রহ করেন এক বিশাল বাহিনী। অতঃপর হিন্দুস্থান অভিমুখে অগ্রসর হন। জয়পালের পুত্র গুপ্তচর মুখে এ সংবাদ শুনে মামুদের নিকট প্রস্তাব করেন যে সুলতান যদি এ অভিযানে বিরত হন তবে তাঁকে ৫০টি হাতি “নজরানা” বাবদ দেওয়া হবে। মামুদ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। থানেশ্বর পৌঁছে তিনি দেখেন শহর জনশূন্য। সৈন্যরা রাজধানী বিধ্বস্ত করে লুণ্ঠনে মত্ত হয়। ভেঙে দেয় অসংখ্য দেবমূর্তি। জাগরসম দেবের মূর্তি নিয়ে যায় গজনী। সুলতানের আদেশে বিগ্রহকে মসজিদের সোপানে বসানো হয়—যাতে বিশ্বাসীগণ ঐ মূর্তি পা দিয়ে মাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে পারে।
মথুরা। ভগবান কৃষ্ণ বাসুদেবের জন্মস্থান। হিন্দুদের পুণ্য তীর্থক্ষেত্র। বৈরাগী, সাধু-সন্ন্যাসীর বাস; পুণ্যার্থী জনতার সমাগম। বিনা বাধায় মামুদ মথুরার প্রবেশ করলেন। কে তাঁকে বাধা দেবে? মথুরাকে বলা যায় প্রাসাদ নগরী; অনুপম অনবদ্য তার স্থাপত্য।সুলতান মুগ্ধ বিস্মিত। তিনি হিসাব কষে বললেন--এরকম একটি সুন্দর নগর তৈরি করতে ২০০ বছরের শ্রম ও ১০ কোটি dinar প্রয়োজন হবে। সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতেই মথুরাকে ভস্মস্তূপে পরিণত করতে সৈন্যদের আদেশ দিলেন।মথুরার অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী যে সুলতান মামুদকে মুগ্ধ করেছিল, পণ্ডিত নেহেরুও তাঁর Glimpses Of World History-তে তা উল্লেখ করেছেন। মামুদ গজনীতে তাঁর প্রতিনিধিকে লিখছেন, 'এখানে আছে এক সহস্র দেবতার মূর্তি। বিশ্বাসীদের ধর্মের ন্যায় যা অটল, মজবুত ও সুদৃঢ়। কোটি কোটি দিনার ব্যয় করেই নগরীর এরূপ বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং ২০০ বছরেও অনুরূপ আর একটি নগর নির্মাণ করা সম্ভব নয়।'কিন্তু মামুদ যে এমন সুন্দর নগরটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছেন—পণ্ডিত নেহেরু সে কাহিনি সযত্নে পরিহার করেছেন। খাজা নিজামুদ্দিনের বিবরণ অনুযায়ী সুলতান তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় মথুরা প্রবেশ করেন। তাঁর আদেশে সকল মন্দির ভস্মীভূত হয় ধ্বংস হয় সারি সারি -- বিশাল অট্টালিকা,লুণ্ঠন থেকে সংগৃহীত হয় অপর্যাপ্ত রত্নভাণ্ডার। মথুরায় নিখাদ সোনার একটি বিরাট বিগ্রহ ছিল যাঁর ওজন ৯৮৩০০ মিসকাল। সুলতানের আদেশে মূর্তিটিকে ভাঙা হয়। একটি বহু মূল্যবান রত্ন** যার ওজন ৪৫০ মিসকাল, সুলতানের বজ্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে।
(• এক মিসকাল এক সেরের - ভাগ 600
•• মহার্ঘ রত্নটি হল পদ্মরাগ /নীলকান্ত মণি)
ঐতিহাসিক Lane Poole বলেন : 'মামুদের প্রতিজ্ঞা ছিল প্রতিবছর তিনি হিন্দুস্থানের কাফেরদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের (Holy war—জেহাদ) উদ্দেশ্যে অভিযান করবেন। ‘যতদিন পর্যন্ত সোমনাথ মন্দির অক্ষত থাকবে ততদিন তিনি মূর্তিভাঙার অভিযান থেকে বিরত হবেন না। মুলতান থেকে মামুদ বিশাল বাহিনী নিয়ে সোমনাথের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। মন্দিরে ছিল এক হাজার ব্রাহ্মণ, শত শত নর্তকী ও গায়িকা। অর্ধ লক্ষাধিক নর-নারীও আশ্রয় নিয়েছে মন্দির চত্বরে। গর্ভগৃহের মাঝখানে ছিল মণি- ম ণিক্য খচিত কষ্টিপাথরে নির্মিত বিশাল লিঙ্গদেব। চারিদিকে ছিল অতি সুন্দর কারুকার্য শোভিত নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল বিচিত্র বিবিধ রত্নখচিত ঝুলন্ত দীপাধার। সেই রত্নদীপের বর্ণময় বিচ্ছুরিত দীপ্তিতেই আলোকিত হত বিগ্রহ।
ক্রমশ এগিয়ে আসছে ইসলামের ধর্মযোদ্ধারা, মত্ত কলেরবে। শোনা যাচ্ছে তাঁদের রণহুঙ্কার, আল্লা হো আকবর। ভীত অসহায় নরনারীর আকুল আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় দিক হতে দিগন্তরে। পৈশাচিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মামুদের সৈন্যদল। বয়ে গেল রক্তের প্লাবন। লুণ্ঠিত হয় সোমনাথের অতুল ঐশ্বর্য। ধূলিসাৎ হয় তাঁর মন্দির। নিহত হয় ৫০০০০ হিন্দু।*
খাজা নিজামুদ্দিনের বর্ণনায়- ……দূর্গ অধিকৃত হল। শুরু হল পরিকল্পনা অনুযায়ী ধ্বংস ও লুণ্ঠন। অসংখ্য মানুষ নিহত ও বন্দি হয়। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় সোমনাথ মন্দির। বিগ্রহকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। একটি টুকরো গজনীতে জামা মসজিদের দরওয়াজায় (সোপান ?) স্থাপন করা হয়।
ঐতিহাসিক খাজা নিজামুদ্দিন আহম্মদের বিবরণ থেকে জানা যায়—মন্দিরে অনেক সুবর্ণ-নির্মিত বিগ্রহ ছিল। তাঁদের মধ্যে বৃহত্তম বিগ্রহের নাম ছিল মানত (Manat)* । কাবার মন্দির থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
(ইসালম ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে মক্কাবাসীরা যে সকল দেবতার পূজা করত- তাঁদের মধ্যে 'মানত' ছিলেন অন্যতম প্রধান।)
ঐতিহাসিক Minhaj as-Siraj লিখেছেন : এক সহস্র মন্দির ভেঙে মামুদ জগদ্বিখ্যাত (ইসলামিক জগৎ) হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল সোমনাথ মন্দির ধ্বংস। সোমনাথ বিগ্রহ নিয়ে যান গজনীতে। তাকে ভেঙে চার টুকরো করা হয়। এক ভাগ শোভা পায় গজনীর জামা মসজিদে আর এক ভাগ রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে। অবশিষ্ট দু'ভাগ পাঠিয়ে দেওয়া হয় মক্কা ও মদিনায়।
মামুদের ভারত অভিযান সম্বন্ধে পণ্ডিত নেহেরুর বিশ্লেষণ তাৎপর্যপূর্ণ : আরব
থেকে মুসলমান এদেশে আসত আবার চলে যেত। তাঁরা মসজিদ নির্মাণ, ধর্মপ্রচার আবার ধর্মান্তরও করত। এসব নিয়ে কোন আপত্তি ওঠেনি; হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে হয়নি কোনো সংঘাত। কিন্তু একাদশ শতকে যখন ইসলাম ভারতে এল মুক্ত কৃপাণ হাতে বিজয়ীর ছদ্মবেশে তখনই সৃষ্টি হল প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। পূর্বের সহিষ্ণুতার পরিবর্তে দেখা দিল ঘৃণা ও সংঘর্ষ। প্রজ্বলিত মশাল ও মুক্ত কৃপাণ হাতে যিনি এলেন তিনি গজনীর সুলতান মামুদ। প্রতিবছর ভারত আক্রমণ করে তিনি হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করতেন। তারপর দেশে ফিরে যেতেন বিপুল ধন-সম্পদ ও লক্ষ বন্দী নরনারী নিয়ে। সুলতান মামুদ মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। শুধু কাশ্মীর অভিযানে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। উত্তর ভারতে তিনি ছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা। .......থানেশ্বর আক্রমণ করে তিনি ২,০০,০০০ বন্দি ও প্রচুর সম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যান। ......মামুদ যখন সোমনাথ আক্রমণ করেন, তখন মন্দিরে হাজার হাজার নরনারী আশ্রয় নিয়েছিল। আশা ছিল দেবতার অলৌকিক শক্তি তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু ভক্তদের কল্পজগত্ ব্যতীত অলৌকিক লীলা কদাচিৎ ঘটে। মামুদ মন্দিরে আশ্রিত ৫০,০০০ নর- নারীকে হত্যা করে মন্দিরের সর্বস্ব লুঠ করে—সর্বশেষ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সোমনাথ মন্দির।
আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের (AMU) অধ্যাপক প্রয়াত মহম্মদ হাবিব (ইরফান হাবিবের পিতা) Sultan Mahmud of Ghazni বইতে হিন্দুস্থানে মামুদের জেহাদের সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে ধর্মীয় প্রেরণা নয়। বিপুল ঐশ্বর্যের লোভেই মামুদ সোমনাথ আক্রমণ করেন। ‘মামুদের বিজয় বার্তা পেয়ে বাগদাদের খলিফা (মুসলিম জগতের ধর্মগুরু) বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন। সেখানে মামুদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। তাঁকে তুলনা করা হয় পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ সহচর বীর মুসলিম যোদ্ধাদের সঙ্গে — যাঁদের শৌর্যে পরাজিত হয়েছে আরবিয়া, সিরিয়া, ইরান ও ইরাক। -- মহম্মদ হাবিবের বর্ণনা থেকে জানা যায় – মামুদ হিন্দুস্থানের “বেথেলহেম” প্রাসাদনগরী মথুরার বিস্ময়কর স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়েও প্রায় ১০০০ মন্দির ধ্বংস করেন।””
মামুদের হিন্দুস্থান অভিযানের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণে মহম্মদ হাবিবের সঙ্গে নেহেরুর বিস্ময়কর ঐক্যমত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নেহেরু লিখেছেন – 'ইসলামের একজন মহান বীর রূপেই মামুদ পরিচিত, যিনি ভারতে এসেছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। অধিকাংশ মুসলমান তাঁকে শ্রদ্ধা করে—তেমনি অধিকাংশ হিন্দু তাঁকে ঘৃণা করে। অবশ্যই ধর্মে তিনি ছিলেন মুসলমান কিন্তু তা নেহাতই নৈমিত্তিক বা দৈব। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সৈনিক শ্রেষ্ঠ সৈনিক। দুর্ভাগ্যক্রমে সৈনিকরা যা করে তিনিও ভারতে এসেছিলেন জয় ও লুঠ করতে। তিনি অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও এই কাজই করতেন।'
ধর্মপ্রচার নয় মামুদ - হিন্দুস্থানে এসেছিলেন ঐশ্বর্যের লোভে—লুঠ করার জন্য; নেহেরু ও মহম্মদ হাবিবের এই মত কতটা যুক্তিগ্রাহ্য? যেমন মন্দির—তেমনি বড় বড় মসজিদেরও ছিল প্রভূত সম্পদ। কিন্তু মামুদ কেন, কোনো মুসলমান আক্রমণকারী কখনও কোনো মসজিদ আক্রমণ করেনি। দ্বিতীয়ত, উদ্দেশ্য শুধুমাত্র লুণ্ঠন হলে মন্দিরে আশ্রিত প্রাণভয়ে ভীত ৫০,০০০ হিন্দুকে সোমনাথ মন্দিরে হত্যা করা হত না। তৃতীয়ত, সোমনাথ ও অন্যান্য মন্দিরের বিগ্রহ ভেঙে গজনী, মক্কা-মদিনার মসজিদের সোপানশ্রেণিতে বসানোর উদ্দেশ্য হিন্দুর ধর্মবোধকে চূড়ান্ত অপমান করা—তাঁর মর্মে আঘাত দেওয়া; লুণ্ঠন নয়।*
পণ্ডিত নেহেরুর বিশ্লেষণে সুচিন্তিত অভিমতের অভাব লক্ষণীয়। স্ব-বিরোধিতা সুস্পষ্ট। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী এদেশে আরব মুসলমানের অবাধ যাতায়াত আগে থেকেই ছিল। তারা মসজিদ নির্মাণ করত – ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তরও করত। কিন্তু হিন্দু মুসলমানে কোনো সংঘাত হয়নি। একাদশ শতাব্দীতে যখন ইসলাম এদেশে এল মুক্ত কৃপাণ হাতে বিজয়ীর ছদ্মবেশে তখনই দেখা দিল প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কে এই অসিধারী ছদ্মবেশী? গজনীর সুলতান মামুদ। পণ্ডিত নেহেরুর ভাষায়—অধিকাংশ মুসলমান তাঁকে শ্রদ্ধা করে; অধিকাংশ হিন্দু তাঁকে করে ঘৃণা। মুসলমান তাঁকে শ্রদ্ধা করে কেন? লুণ্ঠনের জন্য ? লুণ্ঠনের ভাগ পায় সৈন্যরা - সাধারণ মুসলমান নয়। সুতরাং তা শ্রদ্ধার কারণ হতে পারে না। নির্বিচারে ব্যাপক হত্যা, ধ্বংস ও ইসলামে ধর্মান্তর মামুদকে মুসলমানের নিকট গৌরব ও শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। কারণ এই কাজে ইসলামের মহিমা প্রচার হয় – হয় অগ্রগতি। নির্মূল হয় কাফেরের ধর্ম। আর ঠিক এই কারণেই হিন্দু মানসে দেখা দেয় প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিন্দু তাঁকে করে ঘৃণা। **
দ্বিতীয়ত, সুপ্রাচীন কাল থেকে বহির্বিশ্বে এদেশের পরিচিতি—হিন্দুস্থান। সকল মুসলমান ঐতিহাসিক ও বিজেতাগণ এদেশকে হিন্দুস্থান নামেই অভিহিত করেছে। “India” বা “ভারত” নামের প্রচলন ইংরেজ শাসনকালে। “সিন্ধু”— ভাষা ও উচ্চারণগত কারণে পারসিকদের নিকট হয় “হিন্দু”–গ্রিকদের ইন্দু (Indu - Indus valley civilization) সর্বশেষ ইংরেজদের কাছে India. সিন্ধু-হিন্দু-ইন্দু-ইন্ডিয়া। নেহেরু সচেতনভাবেই India বা ভারত এই শব্দ ব্যবহার করেছেন। হিন্দুস্থানের পরিবর্তে India বা “ভারত” শব্দের প্রয়োগ উদ্দেশ্যপূর্ণ।
১০১৭ খ্রিঃ কনৌজ আক্রমণ করে মামুদ এত সম্পদ ও যুদ্ধ বন্দী গজনীতে নিয়ে গিয়েছিলেন যে তা গুণে শেষ করা যায়নি। এই সকল বন্দীদের দাস বাজারে (Slave market) বিক্রি করা হত। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ক্রেতার অভাব দেখা দেয়। তখন তাদের নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হত। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণী উদ্ধৃত করে Dr. Titus বলেছেন : যুদ্ধ বন্দীদের বিক্রি করা হত ২-১০ দিনারে (১) দিনারের মূল্য ৫০/৬০ পয়সা)। এর থেকেই যুদ্ধ বন্দীর সংখ্যা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা সম্ভব। এই বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হত গজনীতে। তাঁদের কেনার জন্য দূরদেশ থেকে আসত বণিকের দল। ..... এবং সুন্দর-কুৎসিত, ধনী-দরিদ্র সকলেরই হল এক পরিণতি – দাসত্ব।সাহিবে কমলের (Sahibe Kamal) লেখক দৌলত রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায় যে মামুদ লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করে। আরও লক্ষ লক্ষকে দাস-দাসী করে গজনীর বাজারে বিক্রি করে মাথা পিছু ২ দিনার মূল্যে
হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে প্রত্যেক মুসলিম আক্রমণকারীর লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মন্দির ধ্বংস করা, হিন্দু হত্যা করে হিন্দুস্থানকে পৌত্তলিকতার পাপ থেকে মুক্ত করা: হিন্দু নর-নারীকে বন্দী করে আরবের "দাস বাজারে” (Slave Market) বিক্রি করা এবং যথেচ্ছ লুণ্ঠন করা। এ ব্যাপারে সুলতান মামুদের ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। ঐতিহাসিক Dr Titus-এর ভাষায় – শুধু মন্দির ধ্বংস ও হত্যা নয়, বিজিতদের জন্য ছিল কঠিনতম শাস্তি — দাসত্ব। হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে জেহাদে আকৃষ্ট করার জন্য সেনাপতি ও সাধারণ সৈন্যদের লুণ্ঠনের ভাগ দেওয়া হত। মামুদের প্রধান লক্ষ্য ছিল কাফেরদের নির্বিচার হত্যা, তাঁদের মন্দির ধ্বংস, লক্ষ লক্ষ হিন্দু নর-নারীকে বন্দী করা এবং লুণ্ঠন। প্রথমবার ভারত আক্রমণেই মামুদ ৫০,০০০ হিন্দুকে বন্দী করে গজনীতে নিয়ে যান।
ঐতিহাসিক Will Durant বলেন : 'সব সময়ই তিনি অধিকৃত রাজ্যের অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করতেন না। ক্রীতদাসরূপে বিক্রির জন্য তাদের বন্দি করে গজনীতে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি হল যে ক্রেতার অভাব দেখা দিল। মুষ্টিমেয় ক্রেতা যারা দাস বাজারে আসত তারা ক্রীতদাসের মাথাপিছু দাম নিত মাত্র কয়েক শিলিং। প্রতিবার অভিমানের পূর্বে মামুদ নতজানু হয়ে আল্লাহর দোয়া প্রার্থনা • করতেন। সুদীর্ঘকাল রাজত্বের পর তাঁর গৌরবোজ্জ্বল বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে ১০০০ খ্রিঃ।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের বিচারে মামুদ ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তবে বর্তমান সময়ে হিন্দুদের কাছেও(মাহমুদের আসল সত্য না জানার কারণে) মামুদ অনেক জনপ্রিয়।
মামুদের মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারের অভাবে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ১১৭৩ খ্রিঃ তুর্কো-আফগান গোষ্ঠীর গিয়াসুদ্দিন ঘোরী গজনীর সিংহাসন অধিকার করেন। মহম্মদ ঘোরী ছিলেন গিয়াসুদ্দিনের ভ্রাতা।তিনি ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। ১১৮৬ খ্রিঃ তিনি গুজরাট আক্রমণ করেন। কিন্তু শক্তিশালী বীর হিন্দু নরপতি ভীমদেব ২য়-এর নিকট চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করে কাবুলে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১৯১ খ্রিঃ মহম্মদ ঘোরী এক বিশাল বাহিনী নিয়ে হিন্দুস্থান অভিযান করেন। মাতৃভূমির বিপদ উপলব্ধি করে উত্তর ভারতের প্রায় সকল হিন্দু নৃপতি অন্তর্কলহ ভুলে দিল্লীর শাসক চৌহান বংশীয় পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হন (মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসে এরকম ঐক্য কদাচিৎ দেখা গেছে)। কুরুক্ষেত্র এবং পানিপথের অদূরে তরাইনের রণক্ষেত্রে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী সমবেত হয়। রণক্ষেত্রে একদিকে জিহাদী মনোবাসনা নিয়ে মুসলিম সেনাবাহিনী তো আরেক দিকে দেশ এবং ধর্মের রক্ষার্থে বীর সৈনিক দাঁড়িয়ে।উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ তৈরি হয়। মহম্মদ ঘোরী পৃথ্বিরাজের ভ্রাতার সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধে গুরুতর আহত ও পরাজিত হন। অবরুদ্ধ ও বিধ্বস্ত হয় তাঁর সেনাবাহিনী। পৃথ্বীরাজের মহানুভবতায় জিহাদী মহম্মদ ঘোরী ক্ষমা পান এবং নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে সক্ষম হন।সকলেই (পৃথ্বীরাজ চৌহান এর মন্ত্রী পরিষদ এবং যুদ্ধে সহায়ক হিন্দু রাজারা)পৃথ্বীরাজের এই সিদ্ধান্ত কে মানতে চান নি এবং সকলে মিলে ঘোরীর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলেন। কিন্তু পৃথ্বীরাজের মহানুভবতায় সে মুক্তি পায়।
মুক্তি পেলেও এই পরাজয়ের গ্লানি তিনি ভুলতে পারেননি।তাই এই বছর প্রায় ১৫ টি খন্ড যুদ্ধ হয়, যেখানে ঘোরী পরাজিত হয়। কিছু পৃথ্বীরাজ চৌহান এই আক্রমণ এর উত্তরে কোনো উত্তর দেন না।ফলে এক বছর পরে, ১১৯২ খ্রিঃ ঘোরী পুনরায় হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করে কিন্তু ঘোরী কে বার বার ক্ষমা করার জন্য এবারে অন্যান্য হিন্দুরা যারা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে সাহায্য করেনি। তরাইনের রণক্ষেত্রে হিন্দুবাহিনী পরাজিত হয়। রাজা পৃথ্বীরাজ বন্দী হন।বন্দী পৃথ্বীরাজ এর সামনে তাঁর অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তা কে ধর্ষন করে এবং গোমাংস ভক্ষন করায়। এরপর মহম্মদ ঘোরীর আদেশে তাকে হত্যা করা হয়।দূর্গে অবস্থিত ২০০০ দাসি কে যৌনদাসী বানায় আর সকল নিরস্ত্র হিন্দু সেনাদের নরসংহার করে। মুহাম্মদ ঘোরী। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক V.A.Smith বলেছেন - তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে হিন্দুদের পরাভব হিন্দুস্থানে পরবর্তী মুসলিম আক্রমণের সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে।
দিল্লিতে সুলতান শাহীর প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে Will Durant বলেন - তুর্কি-আফগান - বংশীয় ঘোরী ভারত আক্রমণ করে দিল্লী অধিকার করেন। ধ্বংস হয় সকল মন্দির। লুণ্ঠিত হয় ধন-সম্পদ। প্রতিষ্ঠিত হল সুলতান শাহী। প্রায় ৩০০ বছর এই বিদেশি স্বৈরাচারী সুলতানি শাসন সমগ্র উত্তর ভারতের উপর জাঁকিয়ে বসেছিল। পরে অভ্যস্তরীণ বিদ্রোহ ও গুপ্তহত্যায় সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে।
হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে মহম্মদ ঘোরীর সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মুসলিম ঐতিহাসিক Hassan Nizami বলেন— তিনি তাঁর শাণিত কৃপাণের দ্বারা হিন্দুস্থান থেকে অবিশ্বাস (ইসলাম ধর্মে) ও ব্যভিচারের পাপ নির্মূল করেন। মুক্ত করেন সমগ্র দেশকে বহু-দেবত্ববাদ ও মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে। তাঁর অমিতবিক্রম, দুর্জয় সাহস ও ক্ষাত্র শৌর্যের রুদ্র তেজে ধ্বংস হয় সকল মন্দির।

তরাইনের যুদ্ধে জয়লাভ করে মহম্মদ ঘোরী স্বদেশে ফিরে যান। ক্রীতদাস কুতুবুদ্দিন-আইবকের উপর অর্পিত হয় ভারত সাম্রাজ্যের দায়িত্ব। কুতুবুদ্দিন তাঁর মনিবের ন্যায় ছিলেন ধর্মান্ধ—ভয়ংকর ও নির্দয়। মুসলিম ঐতিহাসিকের সপ্রশংস মন্তব্য ‘তাঁর ছিল লক্ষ গুণ - তিনি লক্ষ মানুষকে (হিন্দু) হত্যা করেন।'
কুতুবুদ্দিনের সেনাপতি বখতিয়ারের পুত্র মহম্মদ খলজি ১১৯৩ খ্রিঃ বিহার জয় করেন। বিহারে তখন রাজ পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য। যদিচ তার শক্তি ক্ষীয়মাণ। মুসলিম ঐতিহাসিক হিন্দু ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ দের মধ্যে কোনো পার্থক্য বিচার করেননি। তাঁর মতে জনগণের অধিকাংশই ছিল মুণ্ডিতমস্তক (বৌদ্ধ হতে পারেন) ব্রাহ্মণ-----যাঁদের সকলকেই হত্যা করা হয়। এক বিশাল গ্রন্থাগার ধ্বংস করা হয়। • বেনারসের সন্নিকটে সারনাথে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আজও মূর্তি ভঙ্গকারীদের কোষ ও বিদ্বেষের সাক্ষ্য বহন করে।
১২০৩ খ্রিঃ আইবক বুন্দেলখণ্ড জয় করেন। তৃপ্ত, পূর্ণ-অভিলাষ ঐতিহাসিকের বর্ণনায়—সকল মন্দির রূপান্তরিত হল মসজিদে...... পৌত্তলিকতার নাম পর্যন্ত লুপ্ত হয়। ৫০০০০ মানুষ (হিন্দু) দাসত্বের শৃঙ্খলে হল বন্দি।
ঐতিহাসিক Dr. Titus-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় ১০০০ মন্দির ধ্বংস করেন - “কুতুবুদ্দিন আইবক সেখানেই তৈরি করেন মসজিদ। তিনি দিল্লীর বিখ্যাত জামা মসজিদ নির্মাণ করেন। হাতির সাহায্যে যে সকল মন্দির ধ্বংস করেছেন। সেই সকল মন্দিরের বহু মূল্যবান পাথর ও রত্নরাজি নিয়ে সুসজ্জিত করেন জামা মসজিদ; কোরানের দিব্য বাণী খোদিত করেন মসজিদের দেয়ালে। এ কাহিনি খোদিত আছে জামা মসজিদের পূর্ব দিকের দরওয়াজায়। সেখানে উল্লেখ আছে যে ২৭টি মন্দির ধ্বংস করে তার সামগ্রী দিয়ে নির্মিত হয় জামা মসজিদ।"
এখানে বিহারের বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগারের কথা বলা হয়েছে। ভারত ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ১০০০০ আবাসিক ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করত। মহম্মদ খলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০০০ ছাত্রকেই হত্যা করে। গ্রন্থাগারের বিপুল পুস্তকভাণ্ডারকে ছয় মাস সেনা বাহিনীর রান্নার জ্বালানি রূপে ব্যবহার করে।
পর্ব পাঁচে আমরা এক নয় বরং একাধিক মহান জিহাদীর জিহাদ নিয়ে জানবো যাদের নাম isলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তো চলুন দেরি না করে শুরু করা যাক।
১)উলুগ খান বলবন : সুলতান নাসিরুদ্দিন ছিলেন অপুত্রক। মন্ত্রী ও শ্বশুর বলবন উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হন। বলবন ছিলেন ঘোর ধর্মান্ধ অত্যাচারী, নির্মম ও নিষ্ঠুর। তাঁর সময়ে হিন্দু নির্যাতনের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। চারিদিকে হত্যা এবং লুটন। এরকম সময়ে দোয়াব সহ অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দুরা বিদ্রোহ করে।
১২৬০ খ্রিঃ বলবন বিদ্রোহী হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। ২০ দিনের যুদ্ধে বিদ্রোহীদের পর্যুদস্ত করেন। নির্বিচারে চলে হত্যা ও লুণ্ঠন। বিদ্রোহীদের ২০০ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বন্দী করে দিল্লী আনা হয়। সুলতানের আদেশে ১০০ বন্দীকে হাতীর পায়ের তলায় নিক্ষেপ করে অথবা ভীষণ-দর্শন তুর্কী জল্লাদের দ্বারা হত্যা করা হয়। জীবন্ত চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয় প্রায় ১০০ বন্দীর। অতঃপর সেই চামড়ার খোলের মধ্যে খড় ভর্তি করে দিল্লীর প্রতিটি ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এইরূপ ভয়ংকর শাস্তি দিল্লীবাসীরা কোনোদিন শোনেনি।
এইরূপ ভয়ঙ্কর শাস্তি দিয়েও হিন্দুদের সম্পূর্ণ দমন করা যায়নি। বীর হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে নিজেদের বিদ্রোহ চালাতে থাকে। ১২৬০ খ্রিঃ জুলাই মাসে সুলতান বলবন বিদ্রোহী হিন্দুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। ‘এই আক্রমণের সম্ভাবনা হিন্দুরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। ১২,০০০ নরনারী ও শিশু বন্দী ও নিহত হল। আল্লাহ্র অসীম কৃপায় ইসলামের এই বিজয় সম্ভব হয়েছে। তাঁকে জানাই কৃতজ্ঞতা”
২)মহম্মদ বিন্ তুঘলক : পিতাকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী বলে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। ঐতিহাসিক Will Durant-এর ভাষায়, হত্যা ও বর্বরতায় তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের কীর্তিকেও ম্লান করেছেন। জনৈক মুসলিম ঐতিহাসিকের বর্ণনায়—গাজী হবার জন্য তিনি এত হিন্দুহত্যা করেছেন যে তাঁর রাজপ্রাসাদ ও দরবারের সম্মুখে সর্বদাই রাশি রাশি মৃতদেহ স্তূপীকৃত থাকত। সর্বক্ষণ হত্যা ও মৃতদেহ সরানোর কাজে নিযুক্ত জল্লাদ ও সাফাইওয়ালার দল ক্লান্ত হয়ে পড়ত।
৩)ফিরোজ শাহ তুঘলক : মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লীর মসনদে আসীন হন।ফিরোজ শাহ এর কাজের ধরণ ছিল আলাদা। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাউনির মতে ফিরোজ শাহ ছিলেন দয়ালু ও প্রজাবৎসল সুলতান। তাঁর রাজত্বে প্রজারা সুখে-শান্তিতেই বাস করত। ক্রীতদাস সংগ্রহের প্রতি তাঁর একটা বিশেষ ঝোঁক ছিল। সেনাপতিদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল যুদ্ধে যত সম্ভব অধিক সংখ্যায় হিন্দুদের বন্দী করে ক্রীতদাস সংগ্রহ করতে হবে। তাঁদের মধ্যে বাছাই করে সেরা দলটিকে সুলতানকে দিতে হবে উপঢৌকন। যে সব সেনাপতি অধিক সংখ্যক ক্রীতদাস পাঠাতেন, তাঁদের দেওয়া হত বিশেষ পুরস্কার। সুলতানের ছিল ১২,০০০ ক্রীতদাস - যাঁদের বিভিন্ন পেশাগত দক্ষতা ছিল। ৪০,০০০ ক্রীতদাস প্রহরা ও প্রাসাদের বিভিন্ন কাজের তদারকিতে নিযুক্ত ছিল। রাজধানী ও বিভিন্ন প্রদেশে মোট ১,৮০,০০০ ক্রীতদাস ছিল। কালক্রমে এই সকল ক্রীতদাস অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত। এইভাবে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা সহজ বলেই সুলতান দাস ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
Will Durant বলেন ফিরোজ শাহ বঙ্গদেশ আক্রমণ করে প্রতি হিন্দুর ছিন্ন শিরের জন্য নগদ পুরস্কার ঘোষণা করেন। ১,৮০,০০০ হিন্দুর ছিন্ন মুণ্ডের জন্য তাঁকে নগদ মূল্য দিতে হয়েছে। হিন্দু ক্রীতদাস সংগ্রহের জন্য তিনি বিভিন্ন গ্রামে হানা দিতেন।কিন্তু ফিরোজ শাহ ছিলেন ধর্মান্ধ। কাফেরদের ধর্মাচরণ তাকে ভয়ংকর করে তুলত। তাঁর নিজের বর্ণনা অনুযায়ী — (আমার আদেশে) একজন উলেমা জনৈক মাধীকে (Mahdi) স্বহস্তে বধ করেছে। সুলতান লিখেছেন— 'এই মহৎ কাজের জন্য আমি পরকালে নিশ্চয়ই পুরস্কার পাব।'
দিল্লীর উপকণ্ঠে মালুয়া গ্রামে হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব চলেছে। সে উৎসবে
কতিপয় নিচু শ্রেণীর মুসলমানও যোগ দিয়েছে। এই সংবাদ শুনে সুলতান স্বয়ং সেখানে
উপস্থিত হলেন। “আমি এই ঘৃণ্য উৎসবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও পৃষ্ঠপোষকবৃন্দকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম । সাধারণ হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যায় আমার অবশ্য নিষেধ ছিল। কিন্তু আমি তাঁদের দেবতার মন্দির ভেঙ্গে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করি।'ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন—যে ব্রাহ্মণ প্রকাশ্যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
ফিরোজ শাহ ছিলেন খাঁটি মুসলমান। ইসলাম ধর্মের প্রসারে তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মুসলমান হবার জন্য তিনি কাফের হিন্দুদের উৎসাহ দিতেন। তিনি ঘোষণা করেন, যাঁরা মুসলমান হবে তাঁদের জিজিয়া কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। সুলতানের এই ঘোষণা সাম্রাজ্যব্যাপী প্রচারিত হলে বহুসংখ্যক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাঁদের জিজিয়া কর থেকে ছাড় দেওয়া হয় এবং সম্মান জানানো হয় মূল্যবান উপহার দিয়ে।
ঐতিহাসিক V.A.Smith বলেন, বর্তমান মুসলিম জনসংখ্যার এক বিরাট অংশই ইভাবে হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। উৎকোচ দিয়ে ধর্মান্তর করার এই পদ্ধতি পরবর্তী শাসক গণও অনুসরণ করেছেন।
ইতিহাস সাক্ষী যে কোনো মুsলিম রাজ্যে কখনো অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শান্তিতে থাকতে পারে নাই। কারণ এটি কেবল একটি মতবাদ নয় এটা একটি সংক্রামক রোগ,যার যদি কোনো প্রতিকার না করা হয় তবে এটি ধীরে ধীরে ব্যক্তি,পরিবার, সমাজ,গ্রাম,দেশ সকল কিছুর নাশ করে দিবে।

 হিন্দুস্তানে জিহাদ পর্ব-৬

এই পর্বের আকার যতটুকু বড়ো ঠিক ততটুকুই বিশেষ। কেননা এই পর্বে কেবল জিহাদ নিয়েই আলোচনা নয় বরং জিহাদিদের কার্যকলাপের দ্বারা সমতল ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কারের নির্মাণের বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। পর্বটি সকলকে মনোযোগ সহকারে পড়ার অনুরোধ রইলো।
তৈমুরলঙ,ইসলামের গৌরব, শ্রেষ্ঠ বীর; হিন্দুস্থানের ত্রাস। তিনি তাঁর আত্মজীবনী ও বিভিন্ন রচনায় হিন্দুস্থান জয়ের কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সমরখন্দে সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্য জয় করে সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি করেন। এবার তিনি হিন্দুস্থান জয় করতে সংকল্প করেন। তিনি তাঁর পুত্রগণ ও আমীরদের অভিমত জানতে চাইলেন।
যুবরাজ পীর মহম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন : 'স্বর্ণ প্রসবিনী হিন্দুস্থান জয় করে আমরা হব বিশ্বজয়ী।'
যুবরাজ সুলতান হোসেন বলেন : 'আমরা যখন হিন্দুস্থান জয় করব—তখন আমরা হব চার দেশের শাসক ও প্রভু’
(গ্রীসের অনুসরণে আরব ও পারস্যবাসীরা পৃথিবীকে ( যে অংশে জনবসতি আছে।) সাত অংশে ভাগ করত। এখানে তার চার অংশকে বোঝানো হয়েছে।)
আমীরগণ বলেন : ‘যদিও আমরা হিন্দুস্থান জয় করতে পারি, কিন্তু সেদেশে আমরা যদি থেকে যাই, আমাদের সন্তান ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিগণ হিন্দের (হিন্দুস্থান) ভাষায় কথা বলবে; তাঁরা হারাবে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের শৌর্য-বীর্যের ঐতিহ্য। কালক্রমে আমাদের বংশধরগণ কালস্রোতে হবে লুপ্ত।'
আমার হিন্দুস্থান জয়ের সংকল্প অনড় অটল। তার থেকে আমি বিরত হব না। আমি তাঁদের বললাম, আমি খোদা ও কোরানের নির্দেশ প্রার্থনা করব। খোদার যে রূপ ইচ্ছা আমি তাই করব। তাঁরা সকলেই সম্মতি জানালেন।
আমি সঠিক নির্দেশের জন্য পবিত্র কোরানের শরণাপন্ন হলাম—প্রথম যে আয়াতটি আমার দৃষ্টিগোচর হল, তাতে বলা হয়েছে 'হে মহম্মদ। বিধর্মী ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো'। উলেমাগণ যখন এই বাণীটির তাৎপর্য আমীরদের নিকট ব্যাখ্যা করলেন, নীরব লজ্জায় তাঁরা অধোবদন হলেন। তাঁদের নীরবতায় আমারও কষ্ট হল।
তৈমুর লঙ তাঁর আত্মজীবনী Malfuzat-I-Timuri-তে হিন্দুস্থান আক্রমণের উদ্যোগ পর্ব প্রায় অনুরূপ ভাবে বর্ণনা করেছেন ঃ এই সময় কাফেরদের বিরুদ্ধে এক অভিযানের প্রবল বাসনা আমার হৃদয়- মনকে আলোড়িত করে। কারণ, আমি শুনেছি ধর্মযুদ্ধে (জেহাদ) কাফের হত্যা করলে “গাজী” হওয়া যায় এবং নিহত হলে হয় “শহীদ”। কিন্তু আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। জেহাদ কার বিরুদ্ধে ? চিন অথবা হিন্দুস্থান? আমি সঠিক নির্দেশের জন্য পবিত্র কোরান শরীফের শরণাপন্ন হলাম। প্রথম যে আয়াতটি আমার দৃষ্টিগোচর হল তাতে বলা হয়েছে। : ‘হে মহম্মদ! অবিশ্বাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তাদের কঠোর শাস্তি দাও'।
অতঃপর সকলের মতামত জানার জন্য তিনি যুবরাজ ও আমীরগণকে মন্ত্রণা সভায় আহ্বান করলেন।
যুবরাজ মহম্মদ সুলতান বলেন : 'হিন্দুস্থান এক বিশাল রত্নভাণ্ডার। সেদেশে আছে ১৭টি সোনা ও রূপার খনি। আছে পান্না, চুনি ও হিরার খনি। পাওয়া যায় টিন, লোহা, স্টিল, তামা, পারদ ইত্যাদি। শস্যশ্যামলা হিন্দুস্থানের জলবায়ু, খুব মনোরম।.....অধিবাসীরা যেহেতু বহু দেবতায় বিশ্বাসী, পৌত্তলিক, সূর্য-উপাসক ও কাফের-আল্লাহ্ এবং তাঁর পয়গম্বরের নির্দেশ অনুযায়ী এই দেশটিই আমাদের জয় করা উচিত।
চীন নয়, সকলের সম্মতিতে হিন্দুস্থান অভিযানের সিদ্ধান্তই গৃহীত হল। আত্মজীবনীতে তৈমুর তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। -
হিন্দুস্থান আক্রমণে আমার উদ্দেশ্য হল : কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করে মহম্মদের (তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপর আল্লার কৃপা বর্ষিত হোক) নির্দেশ অনুসারে তাদের সত্যধর্ম ইসলামে ধর্মান্তরিত করা, অবিশ্বাস ও পৌত্তলিকতার পাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করা। এর দ্বারা আমরা হব "গাজী" ও "মুজাহিদ"
১৩৯৮ সাল। কাটোর, (Kator) উঃ পঃ সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র হিন্দু রাজা। হিন্দুস্থানে তৈমুরের প্রথম আক্রমণ এই রাজ্যের বিরুদ্ধে। অধিবাসীরা বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জয় অসম্ভব বুঝে দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিল। তৈমুর পরিত্যক্ত নগরী লুণ্ঠন ও ধ্বংসের আদেশ দেন। তার আদেশে মুসলিম বাহিনী আল্লাহো আকবর রণধ্বনি দিয়ে পাহাড়ে উঠে হিন্দুদের আক্রমণ করে। নিহত হল অসংখ্য হিন্দু। বহু আহত হল পালিয়ে গেল অনেকে। তৈমুর আক সুলতানকে (Ak Sultan) পাঠালেন পরাজিত হিন্দু বাহিনীর নিকট। শর্ত—ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত। তাঁরা সকলেই প্রাণ রক্ষার তাগিদে ইসলাম গ্রহণ করল। অতঃপর দুর্বিনীত অবাধ্য অবিশ্বাসীদের ছিন্নমুণ্ড দিয়ে পাহাড়ের ওপর তৈরি হল স্তম্ভ।
এগিয়ে চলে তৈমুর বাহিনী। লক্ষ্য রাজস্থানের ভাটনীর (Bhatnir) রাজ্য। রাজা দুল চাঁদ শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু রণোন্মত্ত মুসলিম বাহিনীর প্রবল আক্রমণে চূর্ণ হয় রাজপুত প্রতিরোধ। মাত্র এক ঘন্টার যুদ্ধে নিহত হয় ১০ হাজার রাজপুত। লুণ্ঠিত হয় ধন সম্পদ ও শস্যাগার। ভস্মীভূত হয় দুর্গ ও সংলগ্ন অট্টালিকা- সমূহ।
সারসুতি (Sarsuti—হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত সিরসা) নগরের অধিবাসীরা ইসলামের নাম পর্যন্ত শোনেনি—একথা শুনে তৈমুর সারসুতি অভিমুখে অগ্রসর হন। হিন্দুরা নগর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তৈমুর তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করতে অশ্বারোহী বাহিনী পাঠান; তুমুল যুদ্ধ হল—নিহত হল সকল হিন্দু। তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানগণ হল বন্দী; সম্পত্তি লুণ্ঠিত হল। সৈন্যবাহিনী ফিরে এল। সঙ্গে কয়েক হাজার বন্দী হিন্দু রমণী। তারা সকলেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।
তৈমুর জানতে পারেন যে হিন্দুস্থানের জাঠ সম্প্রদায় দুর্দান্ত প্রকৃতির—সংখ্যায়ও বিশাল। আক্রমণের আশঙ্কায় তাঁরা দুর্ভেদ্য জঙ্গল ও মরুভূমিতে আত্মগোপন করেছে। তৈমুর তাদের দমন করতে কৃতসংকল্প হলেন। তাঁর নিজের ভাষায়—'আমার হিন্দুস্থান অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য হল –কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ (Holy war— জেহাদ) পরিচালনা করা। আমার মনে হয় এই জাঠদের দমন করা প্রয়োজন'
তৈমুর বাহিনী জঙ্গল ঘিরে ফেলে। অবরুদ্ধ হিন্দুরা মরিয়া হয়ে আক্রমণ করে, ২০০০ জাঠ নিহত হয়। তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানরা হল বন্দী। ‘সেই দিনই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সৈয়দ বংশীয় মুসলিম গোষ্ঠীর এক প্রতিনিধি দল সৌজন্য ও বিনয়ের সঙ্গে আমার দর্শন প্রার্থনা করে।* পয়গম্বরের বংশের বলে আমিও তাঁদের যথাযথ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করি।'
তৈমুর যমুনার তীরে ছাউনি ফেলেছেন। নদীর অপর পারে লোনী (Loni) শহর ও দুর্গ। তৈমুর দুর্গ আক্রমণ করে। রাজপুত দের স্ত্রী ও সন্তান ঘরের মধ্যে জহরব্রত করে। * অতঃপর বেপরোয়া রাজপুত বাহিনী আক্রমণ করে। প্রচণ্ড লড়াই হয়। কিন্তু তারা পরাজিত ও নিহত হয়। অনেকে হয় বন্দী। তাদেরও পরদিন করা হয় হত্যা। তৈমুর আদেশ দিলেন—শেখ, সৈয়দ ও উলেমাদের গৃহ ব্যতীত হিন্দুদের সকল বাড়ি লুঠ ও দুর্গ ধ্বংস করতে হবে।
দিল্লীতে তৈমুরের তাণ্ডব
১৩৯৮ সালে তৈমুর লঙের হিন্দুস্থান অভিযান। দিল্লীতে তখন তুঘলক বংশের শাসন। ১৩৮৮ সালে ফিরোজ শা তুঘলকের মৃত্যু হয়। কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকায় দুর্বল সাম্রাজ্য প্রায় ভাঙনের মুখে। মামুদ তুঘলক দিল্লীর সুলতান। একের পর এক রাজ্য জয় করে তৈমুরলঙ দিল্লীর দ্বারপ্রান্তে এসে শিবির স্থাপন করেছেন । বহু লক্ষ কাফের হিন্দু হত্যা করেও লক্ষাধিক হিন্দু তাঁর শিবিরে বন্দী। পেছনে শত্রু রেখে যুদ্ধ যাত্রা নিরাপদ নয়—প্রধান আমীরদের এই পরামর্শ মেনে তৈমুর সেই অসহায় শৃঙ্খলিত লক্ষ হিন্দু বন্দীকে হত্যার আদেশ দেন। ** তৈমুর আত্মজীবনীতে লিখছেন — ধার্মিক ও মহাজ্ঞানী মৌলানা নাসিরুদ্দিন হিন্দুস্থান অভিযানে আমার সঙ্গী ছিলেন। তিনি এত দয়ালু ছিলেন যে জীবনে একটি চড়ুই পাখিও মারেননি। কিন্তু আমার আদেশ পেয়ে তিনিও ১৫ জন কাফের হিন্দুকে স্ব-হস্তে বধ করেন।বিদ্বান, ধার্মিক ও দয়ালু বলতে মুসলমান কি বোঝে—তার এক সুন্দর দৃষ্টান্ত- মৌলভী নাসিরুদ্দিন।
(মুসলমানের হাতে বন্দী হলে রমণীদের যে অশেষ লাঞ্ছনা হবে তার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। তাই এই মৃত্যু। একে বলা হয় জহরব্রত।)
এবার লক্ষ্য দিল্লী। সুলতান মামুদ শা তুঘলক অবশ্য বাধা দিয়েছিলেন; কিন্তু বৃথাই সে প্রয়াস! দিল্লী তৈমুরের অধিকারে। তিনি তাঁর দুর্ধর্ষ তুর্কী সেনাদের আদেশ দিলেন নির্বিচারে হিন্দু হত্যার। হিন্দুরা তাদের গৃহে আগুন ধরিয়ে দিল। জহরব্রত করে জীবন্ত ভস্মীভূত হল তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানগণ। অতঃপর তারা বাধা দিল তুর্কীবাহিনীকে। অসম যুদ্ধ। কাতারে কাতারে হিন্দু প্রাণ দিল। দিল্লী প্লাবিত হল হিন্দুরক্তে। রাজপথে তৈরি হল শবদেহের পাহাড়। তিনদিন ধরে চলল ১৫০০০ তুর্কী সৈন্যের এই রক্ত হিম করা তাণ্ডব। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। প্রত্যেক সৈন্য নিয়ে এল অন্ততঃ ৫০/১০০ জন বন্দী। তৈমুরের নির্দেশে কোনো মুসলমান নিহত হয়নি। লুণ্ঠিত হয়নি তার গৃহ। সৈয়দ, উলেমা ও অন্যান্য মুসলমানের গৃহ ব্যতীত পুরো শহরটি পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে।
তৈমুর আত্মজীবনীতে লিখেছেন—দিল্লীতে আমি ১৫ দিন ছিলাম। দিনগুলি বেশ সুখে আনন্দেই কাটছিল। দরবার বসিয়েছি—বড় বড় ভোজসভা দিয়েছি। তারপরই মনে পড়ল – কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই আমার হিন্দুস্থানে আসা। খোদার দয়ায় আমি সর্বত্রই আশাতীত সাফল্যও পেয়েছি। লক্ষ লক্ষ কাফের হিন্দু আমি বধ করেছি; তাদের তপ্ত শোণিতে ধৌত হয়েছে ইসলামের পবিত্র তরবারি।... তাই এখন আরাম-আয়েসের সময় নয় বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করা উচিত।
বিলাস-ব্যসন নয়—চাই যুদ্ধ কাফেরদের রক্তেই হোক পরম তৃপ্তি। এগিয়ে চলে হানাদার বাহিনী আল্লা-হো আকবর (God is great) রণহুঙ্কারে চারিদিক প্রকম্পিত করে।
হরিদ্বার। হিন্দুদের পুণ্যতীর্থ। পুণ্য স্নান উপলক্ষ্যে পতিত পাবনী গঙ্গাতীরে সমাগত লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। অধিকাংশই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। নিরস্ত্র পুন্যার্থী জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিম হানাদার বাহিনী। অনেকে পাহাড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু রেহাই পায় না। প্রায় সকলেই হল নিহত। গঙ্গাজল হল রক্তবর্ণ পাহাড় থেকে নেমে এল রক্তের স্রোত।
কালের ব্যবধানেও তৈমুরের অত্যাচারের দানবীয় বীভৎসতার স্মৃতি কিছুমাত্র ম্লান হয়নি। ঐতিহাসিক Will Durant বলেন : ১৩৯৮ সালে তৈমুর সিন্ধুনদ অতিক্রম করে হিন্দুস্থান আক্রমণ করেন। যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের সকলকে হত্যা অথবা বন্দী করেন। দিল্লীর শাসক মামুদ তুঘলককে পরাস্ত করে অধিকার করেন দিল্লী; নির্বিচার "চিত্তে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেন ১,০০,০০০ বন্দীকে। দিল্লী নগরী লুণ্ঠন করে ফিরে যান সমরখন্দে—সঙ্গে লক্ষ বন্দী—নারী ও দাস। হিন্দুস্থানের জন্য রেখে গেল অরাজকতা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী'
পণ্ডিত নেহেরুর বিচারে তৈমুরের যে রূপটি ফুটে ওঠে তা বোধ করি বীভৎসতায় তুলনাহীন। তিনি বলেন ঃ তৈমুর ছিলেন নিঃসন্দেহে সুদক্ষ রণনিপুণ সেনাপতি, কিন্তু পুরাপুরি বর্বর। তিনি যেখানেই গেছেন সে স্থান হয়েছে জনশূন্য শ্মশান, দেখা দিয়েছে মহামারি ও অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা। নরমুণ্ড দিয়ে বিশাল পিরামিড তৈরি করে তিনি পেতেন অপার আনন্দ ––।'
চেঙ্গিস খাঁ ও মঙ্গল বাহিনী ছিল নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসের প্রতীক। কিন্তু তাঁরা তাঁদের সমসাময়িক মানুষের মতো ছিল। তৈমুর ছিলেন শতগুণ জঘন্য। নির্মম ও ভয়ংকর দানবীয় অত্যাচারের জন্যই তিনি সকলের থেকে স্বতন্ত্র। এক জায়গায় ২০০০ জীবিত মানুষকে স্তম্ভের আকারে সাজিয়ে তাঁদের চারিদিকে ইট গেঁথে জীবন্ত কবর দেন।
“সে কয়েক মাস মাত্র ভারতে ছিল', লিখেছেন নেহেরু—। “কেবল দিল্লীতে এসেই ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু এই অল্প দিনেই তাঁর পথের দুই ধারের সমস্ত নাশ করে, যাঁদের হত্যা করেছিল তাদের মুক্ত দিয়ে পিরামিড তৈরি করেছিল।” নেহেরুর দৃষ্টিতে তৈমুরের হৃদয় ছিল বর্বর যাযাবরের। তার নির্মম হৃদয়হীন অত্যাচারের বর্ণনায় নেহেরু----বোধ হয় মানসিক ক্লান্তি বোধ করতেন। তাঁর তীক্ষ্ণ মন্তব্য, 'আমি কেন এই ভয়ংকর লোমহর্ষক কাহিনী বারংবার বর্ণনা করব। সর্বত্রই তো একই চিত্র।
দিল্লীর পর তৈমুর মীরাট, হরিদ্বার ও জন্ম জয় করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৈমুরের আক্রমণের মত নৃশংস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড খুব কমই ঘটেছে। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে তৈমুরলঞ্জের ভারতবর্ষ আক্রমণের ফলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ... দুই জাতির মধ্যে বিষেষ স্থায়ীরূপ লাভ করেছিল। তৈমুরের আক্রমণের ফলে মুসলমানদের ভয়ে হিন্দুরা তাদের মেয়েদের অল্পবয়সে বিবাহ দিতে শুরু করেছিল'
ইসলাম ও তৈমুরের আক্রমণ হিন্দুর ধর্ম ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পণ্ডিত নেহেরুর অভিমত হল— ইসলামের আবির্ভাবে হিন্দু ধর্মে দু'দিক থেকে পরিবর্তন আসে। একদিকে আত্মরক্ষার তাগিদে হিন্দু ধর্ম শক্ত খোলকের (shell) মধ্যে আশ্রয় নেয়, হয়ে ওঠে রক্ষণশীল। জাতিভেদ প্রথা, যা ছিল নমনীয় তা হয় কঠিনতর। .......অন্যদিকে জাতিভেদ প্রথা, পূজা-অর্চনা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ভেতর থেকে সরব হয়।
এ বিশ্লেষণ যথার্থ। মুসলিম শাসনে ভারতের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তা বাহিরের, অন্তরের নয়। তাঁর অন্তস্থলে সঞ্চিত থাকত অফুরন্ত প্রাণশক্তি। সেই শক্তির বলেই সে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বেঁচে আছে। পণ্ডিত নেহেরু বলেন ঃ ‘যা কিছু (পরিবর্তন) ঘটেছে তা উপরিভাগের ব্যাপার, তা হতে ভারতীয় জীবনের মূলগত ধারায় বিশেষ কোন পার্থক্য আসেনি।'
কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? উত্তরে বলতে হয়—এর কারণ হল ভারতের অখণ্ড ঐক্যবোধ। আর এই ঐক্যবোধের ভিত্তি হল সংস্কৃতি। রাজনৈতিক নয়। পণ্ডিত নেহেরুও এই মতের সমর্থনে বলেন : 'ভারত বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কিন্তু সংস্কৃতিগত ভাবে ভারত ছিল ঐক্যবদ্ধ'
সনাতন শাশ্বত হিন্দুধর্ম এই সাংস্কৃতিক ঐক্যের আধার স্বরূপ। কার্যত এই সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মিক ঐক্য। প্রায় ১১০ বছর ভারতের সঙ্গে যুক্ত থেকে ১৯৩৭ সালে ব্রহ্মদেশ স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। এই ঘটনার উল্লেখ করে ডঃ আম্বেদকর বলেন রাজনৈতিক ঐক্য কোন ঐক্যই নয়। যথার্থ যা ঐক্স তা হল আধ্যাত্মিক।
মুসলমানের নিকট পরাজিত হয়ে ভারতের রাজন্যবর্গ রাজ্যহারা হয়েছেন। কিন্তু আসমুদ্র হিমাচল হিন্দুর ধর্মীয় নেতা ও সমাজপতিদের প্রভাব ছিল অক্ষুণ্ণ। তাঁরা দেখলেন মাতৃভূমি পরাধীন। রাষ্ট্রশক্তি বিদেশীর করায়ত্ত। কিন্তু ধর্ম ও সমাজকে তো রক্ষা করতে হবে। তাই তাঁরা প্রবেশ করে আপন খোলে (shell), অর্থাৎ বিধিনিষেধের কঠিন আবরণের মধ্যে। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বোধ করি বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কচ্ছপ। শুঁড় বের করে চলে, বিপদের আঁচ পেলেই মুখ ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। পিঠ তার সুকঠিন বর্মের ন্যায়—শত আঘাতেও কিছু হয় না। হিন্দু-সমাজের অধিকাংশ কু-সংস্কার (সংস্কার ও কু-সংস্কারের মধ্যে গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান) ও কু-প্রথা মুসলিম শাসনের অনিবার্য পরিণতি। বাল্য বিবাহ ও সতীদাহ এ প্রসঙ্গে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিন্দু নারীর প্রতি মুসলমানের লোলুপদৃষ্টি আজ প্রবাদে পরিণত। মুসলমান শাসকদের “সিন্ধুকী” নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী ছিল। তারা গ্রাম-শহরে খোঁজ নিত কোন্ হিন্দুর বাড়ীতে অবিবাহিতা কন্যা, সুন্দরী বধু বা অল্পবয়সী বিধবা আছে। কোন সংবাদ পেলে যথাসময়ে তা তারা মনিবের নিকট পৌঁছে দিত; এবং অনতিবিলম্বেই হতভাগিনীর স্থান হত মুসলমানের হারেমে।
তখন মুসলমানের রাজত্ব। হিন্দু তার দাসানুদাস — সর্ব অধিকার বঞ্চিত। দিন কাটে তার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে। সাধারণ মুসলমানেরও হাবভাব প্রায় নবাব-বাদশার ন্যায়। কোন হিন্দু নারীর প্রতি নজর পড়লে তাঁর আর রক্ষে নেই। পিতা-মাতা সদাই ভয়ে কম্পিত। অল্প বয়সেই তাই গোত্রান্তরের চেষ্টা। বিবাহ একটা বাধা তো বটে। সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও কেটে যেত। মুসলিম শাসনকালে অ-মানবিক সতীদাহ ঘটনার যে বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়, তারও এই একই কারণ।
এ পৃথিবীতে কিছুই অবিমিশ্র নয়। যার ভাল আছে—তার মন্দও আছে। সেই সুদীর্ঘ পরাধীনতা, চরম অরাজকতা ও স্বৈরাচারী মুসলিম শাসনে হিন্দু তাঁর ধর্ম ও সমাজ রক্ষার প্রয়োজনেই রক্ষণশীল হতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ কু-সংস্কার, ভেদাভেদ। পরিণামে জাতি হয়েছে দুর্বল। কিন্তু যদি এরকম না হয়ে হিন্দু ধর্ম তার স্বাভাবিক উদারতা বজায় রাখত, তবে কি হত? হয়তো ধর্ম ও জাতির অস্তিত্বই লোপ পেত। যেমন ঘটেছে পারস্য (ইরান), ইরাক (ব্যাবিলন) ও মিশরে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ওই সকল দেশে খুব উন্নত ধরনের সভ্যতা ছিল। কিন্তু ওই সকল দেশ ইসলামের শাসনাধীন হওয়ার পর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য আর রক্ষা করতে পারেনি। তাই তাঁদের সুপ্রাচীন গৌরবময় সভ্যতার চিহ্ন মাত্রও আজ অবশিষ্ট নেই। কিন্তু হিন্দুস্থান হাজার বছর ধরে মুসলিম তাণ্ডব সত্ত্বেও তার ধর্ম ও সমাজকে সে রক্ষা করতে পেরেছে — তার অন্যতম কারণ হিন্দু ধর্মের কৃত্রিম রক্ষণশীলতা। যা বর্মের মত ধর্ম ও সমাজকে রক্ষা করেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
সুতরাং ভারতের অতুল ঐশ্বর্য লুণ্ঠনের লোভ অতিরিক্ত প্রেরণা মাত্র — মূল প্রেরণা হল ধর্মীয়। আল্লাহ লুণ্ঠনের জন্য ধর্মযুদ্ধে র নির্দেশ দেননি। লুণ্ঠন উপরি পাওনা। পৌত্তলিক কাফেরদের নির্মূল করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিজয় কেতন ওড়াবার জন্যই কোরানে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের অলঙ্্য বিধান। তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র নির্দেশ, 'তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতদিন না (তাদের) ধর্মদ্রোহীতা দূর হয় এবং আল্লাহর দীনধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়' (কোরান)-২-১৯৩। চীন ও হিন্দুস্থান—উভয় দেশই বিধর্মী। তবে চীনের পরিবর্তে হিন্দুস্থান আক্রমণের সিদ্ধান্ত হল কেন? এরকম হতে পারে---চীনে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম — তারা বহু দেবতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু হিন্দুরা বহু দেবতায় বিশ্বাস করে। চীন অনেক দূরে। দুর্গম পর্বত ও গোবী মরুভূমি অতিক্রম করে চীনে যেতে হবে। সেদেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে হয়তে পর্যাপ্ত তথ্য তৈমুরের জানা ছিল না। পক্ষান্তরে হিন্দুস্থান নিকটবর্তী। ইতিপূর্বে সেখানে বহুবার মুসলিম আক্রমণ ঘটেছে- সেদেশের মুসলিম জনসংখ্যাও কম নয়। হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানের সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে—অন্তত তারা সক্রিয় বিরোধিতা করবে না এরকম আশা করা যায়। তাছাড়া হিন্দুস্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, ও অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য তৈমুরের জানা ছিল। সম্ভবত এ সকল কারণেই তিনি হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।
কিছু তথ্য সূত্র
এই সম্পূর্ণ পর্বটি "মুসলিম শাসন ও ভারতবর্ষ" বই থেকে নেওয়া!বইয়ে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র
১)Ibid, P-259
২)INSTITUTES, Political and Military of the Emperor Timur originally written in the Turkish language by the Timur...translated in English by Major Davy. P-71, 73
৩)Quran P-66-9
Timur-Malfuzat-1-Timuri, P-394-395 Ouoted from-The Calcutta Koran Petition, P-57-58
৪)Timur-Malfizat-l-Timuri, P-394-395 Quoted from The Calcutta Koran Petition, P-58
৫)Lane poole-Medieval India, P-155
Quoted from Dr. BR Ambedkar-Writings and Speeches, Vol-8, P-56
৬)Timur-Malfuzat-I-Timuri, P-427 Quoted from The Calcutta Koran Petition, P-61
৭). Ibid, P-61
Ibid, P-421, P-61
Ibid, P-61, 62 A. Ghosh-The Koran And Kafu, P-31
৮)Timur-Malfuzat-l-Timuri, P-433 Quoted from the Calcutta Quran Petition, P-62
১০)Ghosh-The Koran And The Kafir, P-32

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ