কাল ও সৃষ্টি নির্মান - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 July, 2023

কাল ও সৃষ্টি নির্মান

কাল ও সৃষ্টি নির্মান

 সর্বপ্রথম সর্বব্যাপক চেতন তত্ত্বের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তি করার কামনা উৎপন্ন হয়। এটা হল সৃষ্টি উৎপত্তির প্রথম চরণ। এটা ধ্যানে রাখবেন যে, জড় পদার্থের মধ্যে কোনো প্রবৃত্তি স্বতঃ হয় না। যেরকম আমাদের শরীর জড় আর চেতনের কারণে আমাদের শরীরে কাজ করার ইচ্ছা মনের মধ্যে উৎপন্ন হয়। সেইভাবে প্রকৃতি দ্বারা স্বতঃ সৃষ্টি উৎপত্তি হয় না আর না হতে পারবে। এই কামনা উৎপন্ন হওয়ার পরে যে পদার্থ সবার আগে উৎপন্ন হয় সেটা হল কাল।

সবার আগে চেতন তত্ত্ব প্রকৃতির সত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থার মধ্যে "ওম্" রশ্মির কম্পনকে সূক্ষ্মতম পরা রূপে সর্বত্র উৎপন্ন করে, এই "ওম্" রশ্মিই সেই তিনটি গুণকে জাগ্রত বা সক্রিয় করে। এদের মধ্যেও সর্বপ্রথম কাল তত্ত্বকে উৎপন্ন করার হেতু সত্ব ও রজস্ এই দুটি গুণকেই জাগ্রত করে। এই দুটি গুণের উৎপত্তি হতেই কাল তত্ত্ব সক্রিয় হয়ে যায়। এই সতত সক্রিয় কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে জাগাতে অর্থাৎ সক্রিয় করতে থাকে। এই কাল তত্ত্ব দুই গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে অব্যক্ত ভাব দ্বারা প্রেরিত "ওম্" রশ্মির রূপে হয়। এইভাবে সেটা "ওম্" -এর সবথেকে সূক্ষ্মতম রূপ মূল প্রকৃতির দ্বারা মিশ্রিত হয়েই কালের রূপ ধারণ হয়।

এই অবস্থার মধ্যে মূল প্রকৃতির মতো গুণের সাম্যাবস্থা থাকে না, এই কারণে একে সর্বথা অব্যক্ত মানা যেতে পারে না। এইজন্য তার মধ্যে অতি সূক্ষ্মতম বলও উৎপন্ন হয়ে যায়। "ওম্" রশ্মি সম্পূর্ণ মূল পদার্থের মধ্যে আকর্ষণকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। এই সময়েও প্রকৃতির সাম্যাবস্থা সর্বথা ভঙ্গ হতে পারে না। প্রকৃতির এই অবস্থাকেই কাল বলে। "ওম্" রশ্মির সঙ্গে চেতনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকে। এই অবস্থা প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন হয়, এই কারণে এটা জড় পদার্থ, কিন্তু যেহেতু এটা চেতন তত্ত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধিত এই কারণে এটা চেতনবত্ ব্যবহার করে।
প্রকৃতির সেটা প্রায় অব্যক্ত (পূর্ণ অব্যক্ত নয়) অবস্থা, যার মধ্যে "ওম্" রশ্মির সর্বাধিক সূক্ষ্ম রূপের অব্যক্ত সঞ্চার হয়ে গেছে, যার দ্বারা প্রকৃতির সত্ব ও রজোগুণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপে ব্যক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তমোগুণ সর্বদা অব্যক্তই থাকে। অতি সূক্ষ্ম আকর্ষণ বল ও গতির উৎপত্তি দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের এই অবস্থার নামই হচ্ছে কাল, যা সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তার দ্বারা উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে সর্বদা প্রারম্ভিক বল উৎপন্ন করতে থাকে।

কালের স্বরূপ
1. কাল তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির সত্ব ও রজস্ গুণ বিদ্যমান থাকে। এরমধ্যে তমোগুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, এইজন্য তার অভাবই হয়। এই কারণে কাল তত্ত্ব সতত গতি করে, এটা কখনও থামে না।
2. কালের অতিরিক্ত অন্য সব পদার্থের মধ্যে তিনটি গুণই ন্যূন বা অধিক মাত্রা অনিবার্যতঃ বিদ্যমান হয়।
3. কাল হচ্ছে সর্বব্যাপক, সতত গমনকারী একরস তত্ত্ব, যা প্রত্যেক পদার্থকে প্রেরিত করে, কিন্তু স্বয়ং সর্বোচ্চ চেতন তত্ত্বের অতিরিক্ত অন্য কোনো পদার্থের দ্বারা প্রেরিত হয় না।
4. কালের প্রেরণা দ্বারাই মন, প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় আর এইসবের থেকে নানা পদার্থের উৎপত্তি হয়।
5. কাল তত্ত্বই হচ্ছে অনেক প্রকারের পদার্থ ও কর্মের বীজরূপ। সৃষ্টির সব দ্রব্য, কর্ম, গুণ আদির বীজ হচ্ছে এই তত্ত্বই, কিন্তু এটা হল তার সাধারণ নিমিত্ত কারণ, উপাদান হয় নয়। এর মানে হল কাল তত্ত্বের মধ্যে স্বয়ং এই পদার্থের একটা অবয়ব নেই।
6. কাল তত্ত্ব মনস্ তত্ত্ব আদিকে প্রেরিত করে সাত ব্যাহৃতি রশ্মিকে (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম্) উৎপন্ন করে। এই সাত রশ্মির দ্বারা কাল তত্ত্ব অগ্রিম রশ্মিদের উৎপন্ন করে।
7. কাল তত্ত্ব নিত্য অর্থাৎ অজন্মা ও অবিনাশী পদার্থকে জীর্ণ করে না আর না করতে পারবে, অথচ অনিত্য পদার্থের মধ্যে কাল ব্যাপ্ত হয়ে তাদের নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।
কাল তত্ত্বই হচ্ছে প্রকৃতির উপর্যুক্ত অবস্থা, এটাই ত্রিগুণা প্রকৃতির মহত্ তত্ত্ব আদির মধ্যে পরিবর্তন করে আর পুনঃ তাকেই প্রেরিত করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কাল তত্ত্ব প্রকৃতির তমোগুণকেও সক্রিয় করে মহত্ তত্ত্বাদি পদার্থের নির্মাণ করে। এইভাবে সেটা বিভিন্ন পদার্থকে নিজের প্রেরণা দ্বারা উৎপন্ন করে আর তারপর তাদের প্রেরিত এবং ধারণও করে। আধুনিক বিজ্ঞানও দ্রব্যের ঊর্জা দ্বারা নির্মিত, প্রেরিত হওয়াকে মানে, তারসঙ্গে ঊর্জা দ্বারা দ্রব্যকে ধারণ করা এবং তার রূপকেও মানে। পরা "ওম্" রশ্মি যুক্ত প্রকৃতি পদার্থ, যাকে কাল তত্ত্ব বলে, সেটা কখনও জীর্ণ হয় না। প্রলয়াবস্থাতে প্রকৃতিকে প্রেরিত না করে অব্যক্ত রূপে এই তত্ত্ব যথাযথ বিদ্যমান থাকে। এরদ্বারা আমরা এটা বলতে পারি যে কালের (বা ওম্ রশ্মির) সক্রিয় হওয়াটাই হচ্ছে সৃষ্টির সর্বপ্রথম চরণ, বাস্তবে কাল অব্যক্ত অবস্থায় সর্বদা বিদ্যমান থাকে।
"ওম্" -এর সূক্ষ্মতম স্বরূপ তথা বিভিন্ন অক্ষররূপ বাক্ তত্ত্বের কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না, এই কারণে এদের অক্ষর রশ্মিও বলে। তবে হ্যাঁ, মহাপ্রলয় কালে এই সর্বথা অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" -এর প্রকৃতি রূপ পদার্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ সক্রিয় সম্বন্ধ হয় না। কাল তত্ত্ব অবশ্য নিজের অব্যক্ততম রূপে বিদ্যমান থাকে। এটা মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত এই রূপেই বিদ্যমান থাকে তথা অন্য প্রকৃতি রূপ পদার্থের মধ্যে এটা বীজরূপে অনাদি এবং অনন্ত রূপে সর্বদা বিদ্যমান থাকে। এই অজর কাল চক্রের কারণেই সৃষ্টি-প্রলয়ের চক্র নিয়মিত ও নিরন্তর চলতে থাকে। অক্ষর রশ্মির সম্বন্ধে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে পড়বো।
সারাংশতঃ এই সৃষ্টির মধ্যে সূক্ষ্মতম থেকে শুরু করে স্থূলতম পদার্থ পর্যন্ত সমস্ত পদার্থ কাল দ্বারাই উৎপন্ন এবং কাল দ্বারাই প্রেরিত হয়।
কালের ক্রিয়া বিজ্ঞান
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কালতত্ত্বের ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? চলুন, আমরা একে বোঝার চেষ্টা করি -
যখন পরা "ওম্" রশ্মি (কাল) সর্বপ্রথম মূল প্রকৃতি তত্ত্বকে সৃষ্টির সবথেকে সূক্ষ্ম প্রেরণ দ্বারা যুক্ত করে তাকে বিকৃত করা প্রারম্ভ করে। প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান বিভিন্ন অক্ষর রশ্মিগুলো জাগ্রত হয়ে ধীরে-ধীরে মূল প্রকৃতিকে মহত্, অহংকার ও মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন করে, কিন্তু সত্ব ও রজস্ গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি তথা "ওম্" -এর কালরূপ স্বয়ং সর্বদা অবিকৃত থেকে তমোগুণের সঙ্গে অন্য দুই গুণে যুক্ত প্রকৃতিকেই সৃষ্টি রচনা হেতু প্রেরিত ও বিকৃত করে। সেই কাল তত্ত্ব "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপকে উৎপন্ন করে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন ও ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন করে সপ্ত ব্যাহৃতি রূপী সূক্ষ্ম রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এর পশ্চাৎ সেই রশ্মিরদের সাধন বানিয়ে প্রাণ, অপান আদি সাত মুখ্য প্রাণ রশ্মি, পুনঃ অন্য প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে সৃষ্টি চক্রকে আগে বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানেও কাল তত্ত্ব প্রত্যেক পদার্থ - মূলকণা, তরঙ্গ, আকাশ আদির ভিতরে বিদ্যমান থেকে তাদের মধ্যে বিদ্যমান "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ, ব্যাহৃতি সূক্ষ্ম রশ্মি থেকে শুরু করে সমস্ত রশ্মিকে প্রেরিত করে সবগুলোকে সক্রিয় করে, তারসঙ্গে সেগুলোর মধ্যে উচিত জীর্ণতাও নিয়ে আসে।
প্রশ্নঃ এই প্রেরণ ও জাগরণ কর্ম কি?

উত্তরঃ আমরা সংসারের মধ্যে প্রেরণা বা জাগরণের ভিন্ন-ভিন্ন রূপ দেখে থাকি। এক ব্যক্তি কোনো পশুকে লাঠি দিয়ে হাঁক দেয়, তখন সে সেই পশুটাকে লাঠি দিয়ে কোনো কার্য করার প্রেরণাই করে। পিতা তার উদ্দণ্ড পুত্রকে তাড়না দ্বারাই প্রেরণা করে, তাকে ধাক্কা মেরে -মেরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়। সেই প্রেরণার কারণে সেই পুত্র যেতে বা কার্য করতে বিবশ হয়। আবার সেই পিতাই বুদ্ধিমান তথা আজ্ঞাকারী পুত্রকে চোখের সংকেত মাত্র দ্বারা প্রেরণা করে ত্বরিত ক্রিয়াশীল বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে এক ব্যক্তি কোনো কার্যকে তীব্রতার সঙ্গে করার সময় কোনো এক শোকের সংবাদ দ্বারা আহত হয়ে নিজেকে দুর্বল মনে করে বসে পড়ে, সে বাস্তবে দুর্বল হয়েও যায়। সারাংশতঃ চেতন তত্ত্ব কালকে অব্যক্ত ও অজ্ঞেয় ভাব দ্বারা প্রেরিত ও উৎপন্ন করে। পুনঃ কাল প্রকৃতির মধ্যে সূক্ষ্ম প্রেরণ ও স্পন্দন প্রারম্ভ করে। প্রকৃতি স্পন্দিত ও বিকৃত হয়ে মহত্-অহংকার ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার পশ্চাৎ এই প্রেরণ স্পন্দন প্রক্রিয়া আগে চলে। যেকোনো পদার্থের মধ্যে তার পূর্ববর্তী পদার্থের প্রেরণ অবশ্যই বিদ্যমান থাকে। এইভাবে সমস্ত সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পদার্থ পরস্পর চেতন তত্ত্ব ও কালের প্রেরণ দ্বারা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে যুক্ত হয়ে কার্য করে। কাল, চেতন তত্ত্ব বা মনস্তত্ত্ব আদির প্রেরণ কর্ম অতি সূক্ষ্ম হয়, তাকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

কালের বৈদিক ধারণা

পদার্থ বিজ্ঞানের বিশিষ্ট গ্রন্থ বৈশেষিক দর্শনের রচয়িতা মহর্ষি কণাদ না কেবল দ্রব্যকে পদার্থ মানেন, অপিতু তার গুণ, কর্ম আদিকেও পৃথক পদার্থের রূপে মেনেছেন। মহর্ষি নয়টা দ্রব্যের মধ্যে কাল ও আকাশকেও দ্রব্যের রূপে মেনেছেন। তিনি দ্রব্যের লক্ষণ নিয়ে বলেছেন, যেসব পদার্থে ক্রিয়া ও গুণের আশ্রয় হয় অর্থাৎ যার মধ্যে ক্রিয়া ও গুণ বিদ্যমান হয় বা হতে পারে তথা কোনো কার্যরূপ পদার্থের সমবায় কারণ হয়, তাকে দ্রব্য বলে। এখানে সমবায় কারণের অর্থ হচ্ছে, এই দ্রব্য তারসঙ্গে উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে সর্বদা মিশ্রিত থাকে। এখানে আমরা কেবল "কাল" নামক দ্রব্যের উপরে বিচার করবো। মহর্ষি কণাদ কাল, আকাশ ও দিশার বিষয়ে অন্য দ্রব্যের থেকে আলাদা করে লিখেছেন যে কাল, আকাশ ও দিশা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় দ্রব্য। কালের লক্ষণ বলেছেন যে, ছোটো-বড়ো হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শীঘ্র ও বিলম্ব হওয়া আদি ব্যবহার হল কালের লক্ষণ।
মহর্ষি কণাদ প্রথমে তো দ্রব্যকে ক্রিয়া ও গুণকারী বলেছেন, পুনঃ এরমধ্যে তিনটা দ্রব্য কাল, আকাশ ও দিশাকে নিষ্ক্রিয় বলেছেন, এর রহস্যটা কি? এখানে প্রশ্ন এটা উঠছে যে কাল কি সর্বদা নিষ্ক্রিয় এবং কেবল ব্যবহারের প্রয়োগে আসা কাল্পনিক কোনো দ্রব্য? মহর্ষি কণাদের দৃষ্টিতে কাল হল এরকম দ্রব্য যা ক্রিয়াবান্ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিষ্ক্রিয়ও। অন্যদিকে মহর্ষি য়াস্কের অনুসারে কাল হচ্ছে এরকম পদার্থ যারমধ্যে প্রেরণ, ধারণ, গমন, অধিগ্রহণ আদি কর্ম বিদ্যমান থাকে।
বস্তুতঃ কাল হচ্ছে একটা দ্রব্য যার স্বরূপের চর্চা পরে আমরা এই অধ্যায়ের মধ্যেই করবো। যেহেতু সময় হচ্ছে ব্যবহার করার একটা নির্দেশাংক তো চলুন আমরা এটাকে একটা উদাহরণের দ্বারা বোঝার চেষ্টা করি। ধরে নিন আমরা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে আপেলের ওজন করছি আর আপেলের ওজন 5কেজি হল, তখন এখানে ওজন আপেল নামক দ্রব্যের একটা গুণ হবে আর সেই ওজনের মান হবে 5কেজি আর আপেল হচ্ছে সেই দ্রব্য, যাকে ওজন করেছি। এইভাবে যখন আমরা দুই ঘটনার মাঝে সময়ান্তরালকে মাপি, তখন কালের সঙ্গে সময়ান্তরালের সেই সম্বন্ধ হয় যেটা আপেলের সঙ্গে ওজনের ছিল।

প্রকৃতির তিনটি গুণ - সত্ব, রজস্ ও তমস্। এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থাকেই প্রকৃতি বলা হয়। এর দ্বারা স্পষ্ট যে এই গুণের নিষ্ক্রিয় অবস্থাকেই সাম্যাবস্থা বলা হয়। এখন এই তিনটি গুণের উপরে বিচার করা যাক -
1.সত্ব => সত্ব হল সেই গুণ, যার কারণে কালান্তরে প্রকাশ এবং আকর্ষণ বল আদির উৎপত্তি হয় তথা প্রাণীদের ভিতর সুখ আর শান্তির অনুভূতি হয়।
2. রজস্ => রজো গুণের কারণে প্রতিকর্ষণ-প্রক্ষেপক বল এবং গতিশীলতার উৎপত্তি হয় অর্থাৎ এই গুণের মূল কারণ হল রজোগুণ। প্রাণীর মধ্যে এই গুণের কারণে চঞ্চলতা, ক্রিয়াশীলতা, ঈর্ষা-দ্বেষ আদি গুণ উৎপন্ন হয়।
3. তমস্ => তমোগুণের কারণে অন্ধকার, জড়তা, গুরুতা, নিষ্ক্রিয়তা, দ্রব্যমান আদি গুণের উৎপত্তি হয়। এর কারণে প্রাণীদের মধ্যে মূর্খতা, মোহ, অতি কামুকতা, আলস্য ও ক্রোধ আদি গুণের উৎপত্তি হয়।
মহাভারতের মধ্যে মহর্ষি ব্রহ্মার অনুসারে এই তিনটি গুণ পরস্পর একে অপরের সঙ্গে জোড়া সৃজনকারী, একে অপরের আশ্রিত, একে অপরের সহায়তায় থাকার, একে অপরের অনুসরণ করার আর পরস্পর মিশ্রিত বিদ্যমানের হয়। তমোগুণের সংমিশ্রণ সত্বের সঙ্গে, সত্বের রজসের সঙ্গে, রজসের সত্বের সঙ্গে, সত্বের তমসের সঙ্গে হয়ে থাকে। একে বর্তমান ভৌতিকীর ভাষায় এইভাবে বলা যেতে পারে যে যেখানেই দ্রব্যমান আছে, সেখানে অবশ্যই বল আছে, এমনকি সেটা গুরুত্ব বলই হোক না কেন। যেখানে বল আছে, সেখানে কোনো-না-কোনো ক্রিয়া অবশ্যই হবে। যেখানে ক্রিয়া হবে, সেখানে বল অবশ্যই হবে, যেরকম কোনো বল ফিল্ড ছাড়া হয় না আর ফিল্ড ক্রিয়া ছাড়া হতে পারবে না। এইভাবে যেখানে বল হবে, সেখানে অবশ্যই দ্রব্যমান হবে। এরমধ্যে কেবল কালই হচ্ছে অপবাদ, বস্তুতঃ সেই অপবাদের কারণ হল, যেহেতু সেই বলটি চেতনের হয়, সুতরাং সেখানে এই নিয়ম যথাযথ প্রযোজ্য হয় না। তমোগুণের নিয়ন্ত্রণে রজোগুণ বাড়ে তথা রজোগুণের নিয়ন্ত্রণ করলে পরে সত্বগুণের বৃদ্ধি হয়।
আসুন, একে আমরা এইভাবে জানি, কোনো বস্তুর জড়ত্বকে নিয়ন্ত্রিত করলে পরে তার ক্রিয়াশীলতার মধ্যে বৃদ্ধি দেখা যায়, যেরকম নাভিকীয় সংলোয়নের মধ্যে দ্রব্যমান (জড়ত্ব), ঊর্জা (গতি) -র মধ্যে পরিবর্তন হয় তথা কোনো কণার গতিকে অবরুদ্ধ করে তার থেকে প্রকাশ আদি ঊর্জার বৃদ্ধি হয়। উদাহরণ, উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলের মধ্যে প্রবেশ করলে পরে ঝলমল করা তথা কোনো ইলেকট্রনের প্রবাহের মধ্যে প্রতিরোধ উৎপন্ন করলে পরে প্রকাশ ও ঊষ্মার উৎপন্ন হওয়া (bremsstrahlung)।
মহর্ষি ব্রহ্মার অনুসারে যতক্ষণ পর্যন্ত সত্ব গুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চয়ই রজোগুণ বিদ্যমান থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তমোগুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চয়ই সতোগুণ ও রজোগুণ বিদ্যমান থাকে। এখানে স্পষ্ট সংকেত পাওয়া যাচ্ছে যে সত্ব ও রজস্ গুণ তো তমোগুণ ছাড়াই বিদ্যমান থাকতে পারে, কিন্তু তমোগুণের বিদ্যমানতার জন্য সতোগুণ ও রজোগুণ উভয়ের বিদ্যমান থাকাটা অনিবার্য। কাল তত্ত্বের মধ্যে দুটি গুণ সত্ব ও রজস্ বিদ্যমান থাকে তথা তমোগুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
আসুন, আমরা একে এইভাবে বোঝার চেষ্টা করি -
এই সৃষ্টির মধ্যে যে বস্তুর মধ্যে প্রকাশ ও বল আদি গুণ বিদ্যমান থাকে, তারমধ্যে ক্রিয়া বা গতিশীলতা আর অনেক কম মাত্রায় জড়ত্ব বা দ্রব্যমান আদি গুণ বিদ্যমান থাকে। সর্বদা গতিশীল থাকা প্রকাশের মধ্যেও অবশ্যই দ্রব্যমান থাকে। এইভাবে প্রকাশের মধ্যে তিনটি গুণই বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে কোনো মূলকণার উপর বিচার করলে পরে, তারমধ্যে দ্রব্যমানের সঙ্গে-সঙ্গে গতি এবং অনেক কম মাত্রায় প্রকাশও বিদ্যমান থাকে, এই কারণে সেটাও তিনটি গুণের দ্বারা যুক্ত থাকে।
এইভাবে আমরা এই অধ্যায়ের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের মূল পদার্থ প্রকৃতি আর তার গুণের বিবেচনা করলাম, যেটা সেই অবস্থায় পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে।
সময়ের যাত্রা (time travel) করা কি সম্ভব ?
কিছু ব্যক্তি কালের মধ্যে আগে ও পিছনে যাওয়ার (সময় যাত্রার) কথা বলে, কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
চলুন, জানার চেষ্টা করি -
কালের পিছনে যাওয়া অর্থাৎ ভূতের মধ্যে যাওয়ার অর্থ কি? কোনো বৈজ্ঞানিক কি কালের মধ্যে পিছনে গিয়ে নিজের যুবক বা শিশু রূপকে দেখতে পারবে, আর সে কি সেই রূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে? সে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে কি সাক্ষাৎ করতে পারবে, যারা বর্তমানে মরে গেছে? পারবে কি রামায়ণ, মহাভারত কালের মধ্যে গিয়ে সেই যুগের মানুষ ও অন্য সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে দেখতে এবং এই ভূমিতে উৎপন্ন করতে? এরকম সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, আমি এটা তো স্বীকার করি যে কোনোদিন ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক কোনো টেকনিকের আবিষ্কার করে মহাভারত যুদ্ধের ধ্বনিগুলোকে জানতে পারবে (কারণ বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে শব্দ হচ্ছে নিত্য), তবে বাস্তবে তারা সেই সময়ের সেই পরিস্থিতিকে উৎপন্ন করতে পারবে না। কোনো রাসায়নিক প্রয়োগ দ্বারা বৃদ্ধ ব্যক্তিও যুবক হতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তার কাল পুনঃ ফিরে আসবে। বিজ্ঞান বল ও ঊর্জার কোনো বিশেষ টেকনিকের আধারে কোনো পদার্থ বিশেষের মধ্যে হওয়া প্রক্রিয়াগুলোকে মন্দ বা তীব্র তো করতে পারবে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে কালের গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে এরকমটা করা যাবে।
এখন আমরা ভবিষ্যতে যাওয়া নিয়ে বিচার করবো, তো এটার অর্থ কি? আপনি কি ভবিষ্যতে হবে এমন প্রত্যেক পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষ দেখতে পাবেন? এটা হচ্ছে একটা কল্পনা মাত্র। ভূত তো নিশ্চিতই হয়, কিন্তু ভবিষ্যত তো নিশ্চিতও নয়, তাহলে তার সাক্ষাৎ কিভাবে হবে? কোনো উচ্চ কোটির য়োগী ভবিষ্যতের কিছু অনুমান করতেও পারেন, এটা সম্ভব, কিন্তু এরদ্বারা এটা মতেই সিদ্ধ হবে না যে তিনি কালের মধ্যে আগে চলে গেছেন। কোনো বৈজ্ঞানিক কি পারবে সময় যাত্রা করে স্বয়ংকে চিতার মধ্যে জ্বলা দেখতে? কিছুক্ষণের জন্যও কি ভবিষ্যতের ভূগোলকে সাক্ষাৎ করতে পারবে? বস্তুতঃ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গণিতকেই সর্বথা সত্য মনে করে কালকে না জেনেই এরকম কথা বলছে। তারা আইনস্টাইনের সাপেক্ষতার সিদ্ধান্তেরও দুরুপয়োগ করছে। বাস্তবে তারা কাল আর সময় অবধির মধ্যে পার্থক্যকেও বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ব্যক্তি লম্বা, চওড়া, উচ্চতাকে অথবা তার মাপক মিটার, ফিট আদিকেই আকাশ মনে করে বসে, তাহলে কি এটা তার ভ্রম হবে না? এরকমই স্থিতি ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড আদি অবধি মাপি মাপককে কাল মেনে নিলে হবে। বৈদিক বিজ্ঞান থেকে অনভিজ্ঞা বর্তমান বিজ্ঞান এরকম ভুল অনেকদিন ধরে করে আসছে আর করতেই থাকবে, এরকমটা আমার মত।

জ্যোতিষের মধ্যে কালমানের ইউনিট নিম্ন -
1 ত্রুটি= 1 সেকেণ্ডের 33750 তম ভাগ (1/33750সেকেণ্ড)
100 ত্রুটি= 1 তৎপর
30 তৎপর= 1 নিমেষ
18 নিমেষ= 1 কষ্ঠা
30 কষ্ঠা= 1 কলা
30 কলা= 1 ঘটি (নাড়ি, দণ্ড)
2 ঘটি= 1 মুহূর্ত (ক্ষণ)
15 মুহূর্ত= 1 অহর্ (দিন)
30 মুহূর্ত= 1 অহোরাত্র (দিনরাত)
10 গুরু (দীর্ঘ)= 1 অসু (প্রাণ)
6 অসু= 1 পল
60 পল= 1ঘটি
60 ঘটি= 1 অহোরাত্র
30 অহোরাত্র= 1 মাস
12 মাস= 1 বর্ষ
1 সেকেণ্ড= 2.5 গুর্বক্ষর (দীর্ঘাক্ষর) কাল= 1/4 অসু
4 সেকেণ্ড= 10 গুর্বক্ষর (দীর্ঘাক্ষর) কাল= 1 অসু
24 সেকেণ্ড= 1 পল= 6 অসু
1 মিনিট= 2.5 পল= 15 অসু
24 মিনিট= 1 ঘটি (60 পল) = 360 অসু
1 ঘণ্টা= 2.5 ঘটি = 900 অসু
24 ঘণ্টা = 1 অহোরাত্র = 21600 অসু
1 সেকেণ্ড= 11.25 নিমেষ
1 সেকেণ্ড= 337.50 তৎপর
1 সেকেণ্ড= 33750 ত্রুটি
1 নিমেষ= 30 তৎপর
1 অহোরাত্র = 972000 নিমেষ
[সমুল্লাস-12, বেদোক্ত জ্যোতিষ এবং বেদার্থ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী]
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. কাল হচ্ছে একটা নিষ্ক্রিয় দ্রব্য, যা পরা "ওম্" রশ্মির দ্বারা ত্রিগুণা প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয়।
2. কাল তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির দুটি গুণ সত্ব ও রজস্ বিদ্যমান থাকে আর তমস্ গুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
3. কালের মধ্যে তমস্ না হওয়ার কারণে এটা সর্বদা গতিশীল থাকে।
4. কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে মহত্ আদির মধ্যে পরিবর্তিত করে পদার্থের নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করে।
5. কাল তত্ত্ব নিত্য ও অবিনাশী পদার্থকে জীর্ণ করে না, অথচ অনিত্য পদার্থকে নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।
6. কালের পিছনে যাওয়া অর্থাৎ ভূতের মধ্যে যাওয়ার মতো কথা হচ্ছে কল্পনা মাত্র, এরকমটা সম্ভব না।


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ