ছন্দ রশ্মি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

11 July, 2023

ছন্দ রশ্মি

ছন্দ রশ্মি

সৃষ্টি উৎপত্তি প্রক্রিয়াতে ছন্দ রশ্মির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টিটাই হচ্ছে ছন্দ রশ্মির খেলা। এই স্পন্দনকে বাক্ ও প্রাণ বলে। এই বাক্ তত্ত্বকেই "ছন্দ" বলে অর্থাৎ ছন্দ রশ্মি, মনস্তত্ত্বের ভিতরে যে স্পন্দন রূপ হয়, তাকেই বাক্ তত্ত্ব বলে। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি ছন্দ রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণ রূপী রশ্মি সবই হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন সূক্ষ্ম স্পন্দন।

চেতন তত্ত্ব ঈশ্বর "ওম্" ছন্দ রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এই তিন প্রকারের ছন্দ রশ্মির নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ"-এর প্রাধান্য দ্বারা ভূমিকা হয়। এই সমস্ত ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয় যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিদের আচ্ছাদিত করে মিথুন বানাতে থাকে।

১. ঋক্ = এই রশ্মিগুলো সূক্ষ্ম দীপ্তিযুক্ত হয়। যেসব মূলকণা এই সৃষ্টির মধ্যে আছে, সেইসবের উৎপত্তিতে এই ছন্দ রশ্মির মুখ্য ভূমিকা থাকে। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক ঊর্জার মধ্যেও ঋক্ রূপী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন পদার্থ যখন অপ্রকাশিত বা সঘন রূপ ধারণ করে, সেই সময় তারমধ্যে আকর্ষণ বলেরও প্রবলতা হয়ে যায়। এই ছন্দ রশ্মি তথা সাম রশ্মির মধ্যে বাক্ তত্ত্ব অর্থাৎ "ওম্" রশ্মির প্রাধান্য (মনস্তত্ত্বের সাপেক্ষ) থাকে। এই কারণে এই দুই প্রকারের রশ্মি বলের দ্বারা বিশেষভাবে যুক্ত থাকে। এইভাবে এই উপরিউক্ত গুণ যুক্ত ছন্দ রশ্মিদের ঋক্ বলা হয়।
২. য়জুঃ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো বিভিন্ন পদার্থের সংযোগে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আকাশ তত্ত্বের (স্পেস) মধ্যে এর প্রাধান্য এবং ব্যাপকতা থাকে। এই ব্রহ্মাণ্ডতে সব ধরণের গতি এই ছন্দ রশ্মির ভিতরেই নিরন্তর হতে থাকে। একই সঙ্গে এই রশ্মি একটানা গতি করতে থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে বাক্ তত্ত্বের অপেক্ষায় মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য থাকে। এই কারণে এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের আধার প্রদান করে।
৩. সাম = এই সৃষ্টিতে সব প্রকারের তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) এবং কথিত মধ্যস্থ কণার (মিডিয়েটর পার্টিকলস্) মধ্যে এরই প্রাধান্য থাকে। ব্রহ্মাণ্ডস্থ সম্পূর্ণ প্রকাশ নিরন্তর সাম রশ্মি দিয়ে পূর্ণতঃ ভরা থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে ভেদন ক্ষমতা বিশেষ থাকে। বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিভাষিত ঊর্জাও দ্রব্যের পালন ও রক্ষণ করে।
"ঋক্" সংজ্ঞক সব ছন্দ রশ্মিতে "ভূঃ" ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে এবং অন্য দৈবী ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে। এইভাবে "য়জুঃ" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "ভুবঃ" আর "সাম" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "স্বঃ" দৈবী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে, অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে।
সব প্রকারের ছন্দ রশ্মি, যা মন্ত্রের রূপে বেদ সংহিতার মধ্যে উপলব্ধ আছে এবং সেগুলোর মধ্যে কিছু অনুপলদ্ধও আছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান আছে। এর দ্বারাই সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে। এই সব প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি উপরিউক্ত তিন প্রকারভাবে বর্গীকৃত করা হয়।

সৃষ্টির মধ্যে ছন্দ রশ্মি অনন্ত বা অসংখ্য মাত্রায় বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুণ ও কর্মের আধারে তাদের প্রমুখ রূপে সাতটা বিভাগ হয়। এই সাতটা ছন্দ হল - গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী। আবার এই সাতটা রশ্মিরও দৈবী, আসুরী, প্রাজাপত্যা, য়াজুষী, সাম্নী, আর্চী, আর্ষী এবং ব্রাহ্মী, এই আটটা ভেদ মানা হয়েছে।

সাত ছন্দ রশ্মি

১. গায়ত্রী = "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো যখন মনস্তত্ত্বকে প্রেরিত করা প্রারম্ভ করে, সেই সময় সর্বপ্রথম যে রশ্মিগুলো (স্পন্দন) উৎপন্ন হয়, তাদের গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মি তিন প্রকারের গতি যুক্ত হয়। এর গতি অন্য ছন্দের অপেক্ষায় সর্বাধিক হয়। সৃষ্টি রচনার প্রথম চরণের সময়ে সর্বাধিক প্রাধান্য এরই হয়। এই রশ্মি থেকে প্রকাশের উৎপত্তি হয়। পিঙ্গল ছন্দ সূত্রতে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি থেকে উৎপন্ন প্রকাশকে শ্বেত বর্ণের বলা হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মির মুখের সমান হয়। তার মানে হল, যেভাবে মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রেরিত করে, সেইভাবে গায়ত্রী রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মিদের প্রেরিত করে। এই রশ্মি সবাইকে বল প্রদান করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
২. উষ্ণিক্ = এই রশ্মিগুলো গায়ত্রী রশ্মিগুলোকে উপর থেকে আবৃত্ত করে, তাদের মধ্যে তথা অন্য ছন্দ রশ্মির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের ভাব সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির মধ্যে মিশ্রণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলোকে নিজের সঙ্গে ঠিক সেইভাবে জুড়তে সহায়ক হয়, যেভাবে শরীরে গলা, কাঁধ তথা মস্তক জুড়ে থাকে। একইসঙ্গে এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলো থেকে পরিত্যক্ত অতি সূক্ষ্ম রশ্মিদের একটানা গিলে ফেলতে থাকে, এরদ্বারাই য়জন অর্থাৎ যুক্ত হওয়ার ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মিকে আচ্ছাদিত করতে ত্বকের সমান গায়ত্রী রশ্মির উপরে লোমের মতো সংযুক্ত থাকে। এটা অন্য রশ্মিদের প্রকাশশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়। এটা অন্য রশ্মিদের তীক্ষ্ণ বানাতে সহায়ক হয়। এই রশ্মিদের প্রভাবে গায়ত্রী রশ্মিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, যারফলে ঊষ্ণতারও বৃদ্ধি হয়। এরদ্বারা ব্রহ্মাণ্ডতে সারঙ্গ অর্থাৎ রঙিন রূপের উৎপত্তি হতে থাকে।
৩. অনুষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিগুলোকে অনুকূলতার সঙ্গে ধরে রাখে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অথবা তাদের উপস্থিতিতে সব ছন্দ রশ্মি নিজের-নিজের কাজ সরলতা এবং সক্রিয়তার সঙ্গে করতে পারে। উদাহরণের জন্য যদি কোনো রশ্মি প্রকাশকে উৎপন্ন করতে নিজের ভূমিকা পালন করে, তখন সেই রশ্মিটাই অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে সরলতার সঙ্গে আরও অধিক প্রকাশ উৎপন্ন করবে। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মির য়োনি রূপ হয়, এর মানে হল এই ছন্দ রশ্মির মধ্যে সব ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে। একই সঙ্গে অনেক ধরনের ছন্দ রশ্মি অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি থেকেই উৎপন্ন হয়। এদের মধ্যেও "ওম্" রশ্মির মাত্রা অপেক্ষাকৃত অধিক হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মি থেকে নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে। এদের মধ্যে ভেদক ক্ষমতা থাকে। আর এর থেকে লাল মিশ্রিত বাদামী রঙের উৎপত্তি হয়।
৪. বৃহতী = এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি, বিভিন্ন কণা বা লোকের নির্মাণের সময় পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত ও সংকুচিত করে নির্মাণাধীন কণা বা লোকের পরিধি নির্মাণে সহায়ক হয়। এটা সেইসব লোক বা কণাকে সর্বদিকে ব্যাপ্ত করে থাকে। এই রশ্মির প্রাধান্য আকাশ তত্ত্বতে থাকে। বিভিন্ন তারা আদি প্রকাশিত লোকের কেন্দ্রীয় ভাগেও এর প্রাচুর্য থাকে। এটা মিশ্রিত হওয়া কণার থেকে নির্মিত নবীন কণাকেও পরিধি রূপে ব্যাপ্ত করে তাকে সংঘনিত করে থাকে। প্রাণ রশ্মিগুলো এই বৃহতী রশ্মির উপস্থেন্দ্রিয়ের সমান কাজ করে। বৃহতীর কারণেই জ্বালার সঙ্গে যুক্ত অগ্নিও উৎপন্ন হয়। এই রশ্মি সবাইকে সীমাবদ্ধ করার কাজ করে। এটা হল কৃষ্ণ বর্ণের।
৫. পংক্তি = এই রশ্মিগুলোতে পাঁচ প্রকারের গতি বিদ্যমান থাকে। এরা বিভিন্ন রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের দ্বারা সর্বদা অবশোষিত হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিশেষ সৃজনশীল অর্থাৎ জুড়ে যাওয়ার স্বভাব যুক্ত হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির মজ্জার সমান কাজ করে, যেভাবে শরীরের মধ্যে বিদ্যমান অস্তিগত মজ্জা সম্পূর্ণ শরীরের রক্তকে জীবন্ত বানিয়ে শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে, ঠিক সেইভাবে পংক্তি ছন্দ রশ্মির বিদ্যমানতায় প্রাণ রশ্মির সামর্থ্য সমৃদ্ধ হয়। এর থেকে নীল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
৬. ত্রিষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো সমস্ত ছন্দ রশ্মি সমূহের নাভিরূপ হয়ে পরস্পর বেঁধে রাখে। এদের কারণে তীক্ষ্ণ বিদ্যুত্ তরঙ্গের উৎপত্তি ও সমৃদ্ধি হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিদের তীব্র তেজ ও বল প্রদান করে। এরা প্রাণ রশ্মির মাংস রূপ হয় অর্থাৎ এদের দ্বারা বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি পূর্ণ বল প্রাপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে তিন রকমভাবে ধরে রাখে, এইজন্য একে ত্রিষ্টুপ্ বলা হয়। এরা অসুর পদার্থ অর্থাৎ ডার্ক ঊর্জা আদির বাধক প্রভাবকে নষ্ট করতে সক্ষম হয়। আকাশ তত্ত্বের মধ্যে এদের প্রাচুর্য থাকে। এর থেকে লাল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
৭. জগতী = এই রশ্মিগুলো সর্বাধিক দূর পর্যন্ত গমনকারী হয়। সম্পূর্ণ জগৎ এই রশ্মির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, এই কারণে এদের জগতী বলা হয়। এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন সংযোজক কণা বা তরঙ্গাণুকে (কোয়ান্টা) বেঁধে রাখতে তথা বিভিন্ন কণাকে সংযোগাদি প্রক্রিয়া হেতু সক্ষম করে। ঊর্জা ও ইলেকট্রনের নির্গমন ও অবশোষণের প্রক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই সম্পন্ন হয়। এই রশ্মি সম্পূর্ণ ছন্দ রশ্মি সমূহের মেরুদণ্ডের সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলো সম্পূর্ণ প্রাণ রশ্মি সমূহকে কাঠামোগত আধার প্রদান করে, যার উপর সমস্ত ছন্দ রশ্মি নির্ভরশীল থাকে। এর থেকে গৌর বর্ণের উৎপত্তি হয়।

সাতটা ছন্দ রশ্মি প্রধানতঃ আট প্রকারের হয়। এই আট প্রকার হল নিম্নানুসারে -
১. দৈবী = এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বপ্রথম এই ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয়। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি মূল ছন্দ রশ্মিগুলোকেই দৈবী ছন্দ রশ্মি বলে। এদের কারণে অব্যক্ত সূক্ষ্মতম জ্যোতি তথা অতি সূক্ষ্ম বলের উৎপত্তি হয়। এরা সর্বত্র ব্যাপ্তবত্ হয়। পূর্বোক্ত সব সাত ছন্দ রশ্মির দৈবী রূপে অক্ষর সংখ্যা নিম্নানুসারে হয় - দৈবী গায়ত্রী-1, দৈবী উষ্ণিক্-2, দৈবী অনুষ্টুপ্-3, দৈবী বৃহতী-4, দৈবী পংক্তি-5, দৈবী ত্রিষ্টুপ্-6 এবং দৈবী জগতী-7 অক্ষর হয়।
২. য়াজুষী = এদের প্রভাবে সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে সূক্ষ্ম ও নিরন্তর গতি ও য়জন ক্রিয়া উৎপন্ন হতে থাকে। এই সময় আকাশ তত্ত্বের উৎপত্তি হতে থাকে। সম্পূর্ণ পদার্থ নিরন্তর কম্পন করতে থাকে।
৩. প্রাজাপত্যা = এই ছন্দ রশ্মির উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন রশ্মির সংযোগ-বন্ধন আদির প্রক্রিয়া সমৃদ্ধ হয়ে নবীন রশ্মির উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াও তীব্র হয়। এই রশ্মিগুলো লঘু ছন্দ রূপেই হয় আর তাই এদের মরুত্ বলা হয়, যা ধীরে-ধীরে গতিতে গমন করে।
৪. সাম্নী = বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, কথিত মিডিয়েটর পার্টিকলস্ আদির উৎপত্তিতে এদের ভূমিকা থাকে। এর প্রভাবে প্রকাশ, ঊষ্মা এবং বিভিন্ন প্রকারের বলের সমৃদ্ধি হতে থাকে।
৫. আসুরী = এই রশ্মিদের প্রভাবে অসুর তত্ত্বের (ডার্ক পদার্থ বা ডার্ক এনার্জি) উৎপত্তি হয় অথবা রশ্মিগুলো স্বয়ংই ডার্ক স্বরূপে বিদ্যমান হয়। এই রশ্মিদের পারস্পরিক আকর্ষণ অত্যল্প বা নগণ্য থাকে, অথচ প্রতিকর্ষণ বা প্রক্ষেপক বলের প্রাধান্য এদের মধ্যে থাকে। এদের মধ্যে মনস্তত্ত্ব এবং অপান প্রাণের প্রাধান্যও থাকে।
৬. আর্চী= এই রশ্মিদের প্রভাবে বিভিন্ন অপ্রকাশিত পদার্থ অর্থাৎ নানা মূলকণা ও লোকের নির্মাণ হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন রশ্মি তথা তরঙ্গাণু আদির সংঘনন ও ভেদনের প্রক্রিয়াকে তীব্র বানিয়ে দেয়।
৭. আর্ষী = প্রাণাদি রশ্মি দ্বারা উৎপন্ন অধিকাংশতঃ ছন্দ রশ্মিদের আর্ষী বলা হয়। যখন ব্রহ্মাণ্ডে কস্মিক মেঘ এবং তার থেকে নানা লোকের নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, সেই সময় আর্ষী ছন্দ রশ্মির প্রাচুর্য বা প্রাধান্য থাকে।
৮. ব্রাহ্মী = এই ছন্দ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির বল ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে।
এই ভাবে এদের মোট আট প্রকারের বিভাগ প্রত্যেক গায়ত্রী আদি ছন্দের হয়। এইভাবে এই পর্যন্ত মোট 56 প্রকারের ছন্দ রশ্মি বর্ণিত হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে অক্ষরের কত সংখ্যা থাকে।

উপরিউক্ত প্রকারের ছন্দ রশ্মির পুনঃ অক্ষর ভেদের কারণে নিম্ন প্রকারে ভেদ হয় -
1. সামান্য ছন্দ = যেসব ছন্দ রশ্মির মধ্যে অক্ষরের সংখ্যা পূর্বোক্তানুসারে অর্থাৎ তালিকাতে বর্ণিতানুসারে হয়, তাদের আমরা সামান্য ছন্দ বলতে পারি। এই সবের সামান্য প্রভাব ছন্দের প্রভাবই হবে।
2. ভুরিক্ ছন্দ = এই প্রকারের ছন্দ রশ্মির মধ্যে উপরিউক্ত সামান্য ছন্দের তুলনায় একটা অক্ষর অধিক হয়। এই ছন্দ রশ্মির ধারক ও পোষক ক্ষমতা অন্য প্রকারের ছন্দ রশ্মির তুলনায় বিশেষ হয়। এই রশ্মিগুলো বাহুর সমান হওয়ার কারণে ধারণ, আকর্ষণ, প্রতিরোধ আদি গুণকে অপেক্ষাকৃত অধিক সমৃদ্ধকারী হয়।
3. স্বরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে অক্ষরের সংখ্যা সামান্যের তুলনায় 2টা অধিক হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মি স্বরাট্ -এর রূপ ধারণ করে নেয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্যদের অপেক্ষায় প্রকাশ বা বৈদ্যুত প্রভাবকে উৎপন্ন করতে বিশেষ সক্ষম হয়।
4. বিরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে সামান্যের অপেক্ষায় 2টা সংখ্যা কম হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মিকে বিরাট্ বলে। এর সব অক্ষর বিবিধ প্রকারে প্রকাশিত হতে সক্ষম হয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্য ছন্দ রশ্মির প্রতি সংযোগ গুণ দ্বারা বিশেষ রূপে যুক্ত থাকে। এর প্রভাব ক্ষেত্র অতি ব্যাপক হয়।
5. নিচৃত্ ছন্দ = এই রশ্মিগুলো ভেদক ও বন্ধক উভয় প্রকারের বলের সঙ্গে পূর্ণভাবে যুক্ত থাকে। যখন সামান্য ছন্দ রশ্মির থেকে একটা অক্ষর কমে যায়, সেই সময় সেই ছন্দ রশ্মি নিচৃত্ রূপ ধারণ করে নেয় অর্থাৎ সেই সামান্য ছন্দ রশ্মির প্রভাব অধিক তীক্ষ্ণ ভেদক হয়ে যায়।
এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হতে থাকে।
কিভাবে রশ্মির ছন্দ খুঁজে বের করবেন ওপরের চিত্রে দেখুন-
কোনো রশ্মির ছন্দ খোঁজার জন্য সেই মন্ত্রতে স্বরের গণনা করবেন, কারণ তাদের সংখ্যার দ্বারাই ছন্দের নির্ধারণ হয়। উদাহরণের জন্য নিম্নলিখিত মন্ত্রতে 23টা অক্ষর (স্বর) আছে। সামান্য (24) থেকে এক অক্ষর কম হওয়ার কারণে এটা নিচৃত্ ছন্দ হবে। এইজন্য এর ছন্দ হল আর্ষী নিচৃত্ গায়ত্রী।

এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন মৃদু এবং তীব্র বল যুক্ত নানা প্রকারের কণা আর বিকিরণ মিলিত হয়ে আর তাদের থেকেও পূর্বে বিভিন্ন প্রাণ আর ছন্দাদি রশ্মি মিলিত হয়ে শেষে তীব্র জ্বালা যুক্ত বিশাল তারা আদি লোকের উৎপন্ন করে। লোক নির্মাণের এই প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন তীব্র ঊর্জাযুক্ত তরঙ্গ যখন নিজের ঊর্জাকে কিছু মাত্রায় হ্রাস করতে থাকে, তখন সেই তরঙ্গগুলোই নিম্ন ঊর্জার অন্য তরঙ্গতে পরিবর্তন হতে থাকে। সেই তরঙ্গ এবং বিভিন্ন প্রকারের কণা নিজের মতো সমান গুণধর্মকারী পদার্থের উৎপন্ন করে। কারণ বিশেষ উপস্থিত হলে পরে বিভিন্ন কণা অন্য কণাতে আর বিকিরণও অন্য বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এইভাবে সৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মিও একে অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সবথেকে অধিক শক্তিশালী হয়। সেটাই ক্ষীণবল হলে পরে গায়ত্রী, জগতী আদি অন্য ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে গায়ত্রী আদি ছন্দ রশ্মিও ত্রিষ্টুপ্ আদি ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে।
একটা ছন্দ রশ্মি দ্বিতীয় একটা ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একটা নবীন তৃতীয় ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন করে। এখানে উদাহরণের জন্য গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি নির্মাণের প্রক্রিয়াতে তিন অক্ষর যুক্ত "শোম্সাবোম্" ছন্দ রশ্মি পাঁচ অক্ষর যুক্ত "শম্সাऽऽমো দৈবোম্" এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আট অক্ষর যুক্ত "প্রাজাপত্যা গায়ত্রী" ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। প্রাজাপত্যা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি তিন বার সংযুক্ত হয়ে আর্ষী গায়ত্রী ছন্দকে উৎপন্ন করে।
এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন নিরাবেশিত (ডিসচার্জ) কণা সূক্ষ্ম এবং সংকুচিত মরুত্ রশ্মির সঙ্গে সংযোগ করে বিদ্যুদাবেশিত কণাতে পরিবর্তিত হতে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা জানা যায় এমন মূলকণা, যা পরস্পর একে-অপরের মধ্যে পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তিত হতে থাকে, এদের পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ার পিছনে এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিই হল উত্তরদায়িনী। এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক "ইলেকট্রন-কোয়ার্ক" আদি কণার দ্বারা সম্বোধিত করে।
সৃষ্টির সমস্ত জড় পদার্থ একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে আর হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূক্ষ্ম রশ্মি অথবা বিকিরণের একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হওয়া সৃষ্টির সামান্য ক্রিয়া নয়, বরং এটা হচ্ছে একটা অসামান্য প্রক্রিয়া, যা হঠাৎই কখনও-কখনও আর কোথাও-কোথাও হয়ে থাকে। সামান্য প্রক্রিয়া এই হচ্ছে যে বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গ নিজেরই স্বরূপকে ধরে রাখে।
এই পর্যন্ত আমরা চেতন তত্ত্বের দ্বারা প্রকৃতি পদার্থ থেকে কাল ও মহত্ তত্ত্ব থেকে শুরু করে প্রাণ ও ছন্দাদি নানা সূক্ষ্ম রশ্মির উৎপত্তি ও স্বরূপের সম্বন্ধে জেনেছি, এখন অগ্রিম পদার্থের উৎপত্তি ও স্বরূপের বর্ণনা করা হবে। বর্তমান বিজ্ঞান কাল বা আকাশের স্বরূপ বা উৎপত্তি বিজ্ঞানের বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ। এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর উৎপত্তি ও গঠন হচ্ছে অজ্ঞাত। এমনকি আমরা যে সৃষ্টি বিজ্ঞানের মধ্যে যে যে বিষয়ের উপর চর্চা করলাম, সেই সব বিষয়ে বর্তমান ভৌতিকীর কোনো কল্পনাই নেই আর এই জ্ঞান ছাড়া সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীর বিকাশ যাত্রা সম্মুখে এগোতে পাচ্ছে না, তারমধ্যে একটা বিরাম এসে গেছে, এই বিষয়টা বৈজ্ঞানিকরা স্বয়ং অনুভব করছে যে আগে যাওয়ার জন্য তারা মার্গ খুঁজে পাচ্ছে না।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1. "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি ছন্দ রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণ রূপী রশ্মি সবই হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন সূক্ষ্ম স্পন্দন।
2. ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এর নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ", এবং "স্বঃ" প্রাধান্যের সঙ্গে ভূমিকা হয়।
3. সব ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দন রূপে উৎপন্ন হয়, যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বন্ধনকারী হয়।
4. এই সৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মি অনন্ত বা অসংখ্য মাত্রায় বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুণ ও কর্মের আধারে তাদের প্রমুখ রূপে সাতটা বিভাগ (গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী) হয়।
5. সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মিরও দৈবী, আসুরী, প্রাজাপত্যা, য়াজুষী, সাম্নী, আর্চী, আর্ষী এবং ব্রাহ্মী, এই আটটা ভেদ মানা হয়েছে।
6. সর্বপ্রথম যে রশ্মিগুলো (স্পন্দন) মনস্তত্ত্বতে উৎপন্ন হয়, তাদের গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মিগুলো সবাইকে বল প্রদান করার কাজ করে।
7. আট প্রকারের ছন্দ রশ্মির অক্ষর ভেদের কারণে পুনঃ পাঁচটা (সামান্য, ভুরিক্, স্বরাট্ আর নিচৃত্ ছন্দ) ভেদ হয়।
8. ব্রহ্মাণ্ডতে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
9. কোনো রশ্মির ছন্দ জানার জন্য সেই মন্ত্রতে স্বরের গণনা করা হয়, কারণ তাদের সংখ্যা দিয়েই ছন্দের নির্ধারণ হয়।
10. লোক প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রতে 23 অক্ষর (স্বর) [সামান্য (24) থেকে একটা অক্ষর কম] হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে নিচৃত্ ছন্দ। এইজন্য এর ছন্দ হচ্ছে আর্ষী নিচৃত্ গায়ত্রী।
11. বিভিন্ন কণা অন্য কণাতে আর বিকিরণও অন্য বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যেরকম, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সবথেকে অধিক শক্তিশালী হয়, ক্ষীণবল হলে পরে গায়ত্রী, জগতী আদি অন্য ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

অনেক প্রাণ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে। এই ঋষি রশ্মিগুলো অনেক প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন, ধারণ আর সক্রিয় করে। তারদ্বারা উৎপন্ন মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি, সৃষ্টির মধ্যে যারাই কাজ করছে, তাদের মধ্যে এই ঋষি রশ্মিরও সহযোগী ভূমিকা থাকে।

রশ্মি এবং তাদের গুণ


বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা কথিত সব মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন থেকে হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে। যদি কখনও এরকম কোনো টেকনিক বিকশিত হয়, যা দিয়ে পশ্যন্তী ধ্বনিকে শোনা যেতে পারে, তাহলে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেক স্থানে বেদের সস্বর মন্ত্র শুনতে পারবো। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি একাকী না থেকে সমূহতে থাকে। যখন সেই রশ্মির সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়। যখন সেই রশ্মির সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মূলকণার রূপ ধারণ করে নেয়। যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টার) নির্মাণ করে। এই অধ্যায়ে আমরা এই রশ্মির বর্গীকরণ আর তাদের গুণকে বোঝার চেষ্টা করবো। পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে বোঝার জন্য আমাদের এই রশ্মির গুণগুলোকে বুঝে নেওয়া অতি আবশ্যক।

অক্ষর রশ্মি

সব ধরনের রশ্মি সূক্ষ্ম অক্ষর রূপ অবয়ব দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে আমরা সর্বপ্রথম অক্ষর রূপ পদার্থের উপর বিচার করবো।
মহত্ তত্ত্ব এই অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়। কালের উৎপত্তির সময়েই সাম্যাবস্থার মধ্যে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়। এই রশ্মি পূর্ণতভাবে কখনও অবিদ্যামান হয় না, সেটা মহাপ্রলয়াবস্থাই হোক না কেন। এই রশ্মিগুলো ছন্দ রূপ ধারণ তখনই করে, যখন সেগুলো শব্দের রূপ ধারণ করে নেয়। একে এইভাবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, যেরকম কম্পিউটারের স্ক্রিনে অক্ষর অব্যক্ত হয় আর যখন আমরা কিবোর্ডে বটন চাপ দেই, সেটা আমাদের সমক্ষ ব্যক্ত হয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে মহাপ্রলয় অবস্থাতে অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" রশ্মির সঞ্চরণ দ্বারা ব্যক্ত হয়ে যায়। অক্ষর রশ্মি দুই প্রকারের হয় -
1. স্বর = মনস্তত্ত্বের ভিতরে এটা অত্যন্ত লঘু কম্পনের রূপে (যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম হয়) বিদ্যমান থাকে। এই লঘু রশ্মি স্বয়ং প্রকাশিত হয় অর্থাৎ এদের ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য ব্যঞ্জনের আবশ্যকতা হয় না, কিন্তু এটা নিরন্তর লম্বা দূরত্ব পর্যন্ত গতিমান থাকতে পারে না।
2. ব্যঞ্জন = এই অব্যক্ত সূক্ষ্মতম অবয়বও মহত্তত্ত্বেরই রূপ হয়, যা সর্বদা স্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গতিশীল হতে পারে। মহত্ বা অহংকারের মধ্যে অকস্মাৎ সূক্ষ্মতম স্ফোট রূপে উৎপন্ন ব্যঞ্জন, যা এক স্থানে উৎপন্ন হয়ে রয়ে যায়। সেটা কোনো স্বর রূপী সূক্ষ্ম কম্পনের সঙ্গে মিলিত হলে পরে গতি, বল ও প্রকাশের অব্যক্ত রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটা স্বরের সঙ্গে মিলে সূক্ষ্ম ছন্দের রূপ ধারণ করে নেয়। "ওম্", "ভূঃ" আদি ছন্দ রশ্মি হল এর উদাহরণ ।
[যেরকম মোতি দিয়ে মালা তৈরি হয়, ঠিক সেইভাবে অক্ষর ও ব্যঞ্জন রশ্মির সঙ্গে মিলে বড়ো ছন্দ রশ্মি (ঋচা/মন্ত্র) তৈরি হয়।]
ওম্ (অ+উ+ম্)
এরমধ্যে "অ", "উ" দুটি স্বর তথা "ম্" ব্যঞ্জনের যোগ হয়। যদিও "ম্" ব্যঞ্জন "অ" এবং "উ" এই দুটি স্বরের সঙ্গে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে "ম" তথা "অম্" এবং "মু" তথা "উম্" ছন্দের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু "অ+উ"= "ও"-এর সঙ্গে "ম্" সংগত হয়ে যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেটা সর্বাধিক ব্যাপক বল ও গতির দ্বারা সম্পন্ন হয়। "ওম্" ছন্দের মধ্যে মনস্ তত্ত্ব বা মহত্ তত্ত্বের মাত্রা অন্য যেকোনো দৈবী গায়ত্রী ছন্দের তুলনায় অধিক হওয়ায় এর ব্যাপকতা সর্বাধিক হয়।
🔷 এটা হল অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সব প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মি এর দ্বারাই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
🔷 এই রশ্মি মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করে।
🔷 এই রশ্মিই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করে, আবার বেঁধেও রাখে। মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটা পশ্যন্তী অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, অথচ মহত্ বা কালের মধ্যে পরা অবস্থায়।
মহত্ বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন এটা এক এরকম স্পন্দন, যা এতই সূক্ষ্ম হয়, যেন সেটা স্পন্দনই হয় না অথবা একে এরকম তরঙ্গ বলা যেতে পারে, যার তরঙ্গদৈর্ধ্য প্রায় অনন্ত হবে, তখন আবৃত্তি প্রায় শূন্য হবে। বাস্তবিকতা এই হচ্ছে যে একে অভিব্যক্ত করাই অসম্ভব। এইভাবে বিজ্ঞানের ভাষায় একে অত্যন্ত ক্ষীণ শক্তিসম্পন্ন অব্যক্ত সূক্ষ্মতম এবং সর্বপ্রথম উৎপন্ন ঊর্জার রূপ বলা যেতে পারে।
ধ্যাতব্য হল, সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। উদাহরণ, যেভাবে মস্তিষ্ক বল দ্বারা শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তার থেকে স্থূল বল উৎপন্ন করে দেয়।

প্রাণ ও ছন্দ তত্ত্ব


যখন "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা অর্থাৎ ঊর্জা বেড়ে যায়, সেই সময় চেতন তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যা সর্বত্র একরসবত্ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মির দ্বারা এরকম স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরের মধ্যে এক সঙ্গে তীব্রতে অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ঢেউ উৎপন্ন করছে, সেইভাবে চেতন তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী ঢেউ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে©। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই ঢেউ (রশ্মি) মুখ্যতঃ চার প্রকারের হয় -
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
(স) মাস ও ঋতু রশ্মি
(দ) অন্য ছন্দ ও মরুত্ রশ্মি।
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
অক্ষর রশ্মির উৎপত্তির পরে নিম্নলিখিত প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -

ব্যাহৃতি রশ্মি 

যে রশ্মি বিশেষ রূপে নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে।
প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির মধ্যে সর্বপ্রথম সাত ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি মনস্তত্ত্ব থেকে নিম্নলিখিত ক্রমে হয় -
১. ভূঃ = "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের উৎপত্তির পশ্চাৎ অতি শীঘ্রই এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মিরই উৎপত্তি হয়। যখন কখনও ঋক্® সঞ্জক রশ্মি, পৃথিবী তত্ত্ব বা অপ্রকাশিত কণার উৎপত্তি হয়, তারমধ্যে এই রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মি নানা রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে সক্ষম হয় তথা বাধক সূক্ষ্ম রশ্মিদের নিষিদ্ধ করে ক্রিয়াগুলোকে নির্বাধ বানায়।
২. ভুবঃ = মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভূঃ" রূপ স্পন্দনগুলোকে "ওম্" রশ্মি বিকৃত করে "ভুবঃ" রশ্মিদের উৎপন্ন করে। কালান্তরে এই রশ্মি আকাশ তথা "য়জুঃ" নামক সঞ্জক রশ্মিদের উৎপন্ন করতে সর্বোপরি ভুমিকা পালন করা।
৩. স্বঃ = "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বের মধ্যে "স্বঃ" রশ্মি রূপ স্পন্দন উৎপন্ন হয়। কালান্তরে সাম রশ্মি এবং প্রকাশাণুর (ফোটন) নির্মাণের মধ্যে এই রশ্মির ভারী ভূমিকা থাকে।
৪. মহঃ= এই সূক্ষ্ম রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পরস্পর সংযুক্ত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
৫. জনঃ= এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের মধ্যে সর্বতঃ উৎপন্ন হয়ে তাদের সঙ্গত করে অন্য ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এই রশ্মি বাধক রশ্মিকে প্রতিবন্ধিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
৬. তপঃ= এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পৃষ্ঠ ভাগ অথবা কিনারায় অবস্থিত হয়ে তাদের বহির্ভাগে ব্যাপ্ত বা সঙ্গত হয়ে তাদের রক্ষা করে।
৭. সত্যম্ = এই রশ্মি সব রশ্মির সঙ্গে সঙ্গত ও পূর্ণ ব্যাপ্ত হয়ে তাদের আধার প্রদান করে তাদের বহির্ভাগে অবস্থিত থাকে।
মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল ব্যাহৃতি রশ্মি বিভিন্ন বেদ-ঋচা রূপী ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দিতে ও সুরক্ষিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই রশ্মির অবিদ্যমানতায় বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি আর তারথেকে নির্মিত বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা আকাশ আদি সবই নির্বল বা নষ্ট হয়ে যাবে।
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি

উপরিউক্ত সূক্ষ্ম রশ্মির পশ্চাৎ প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এর বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সব প্রাণ রশ্মি অক্ষরের সমুদায় হয়। প্রাণ তত্ত্ব দড়ির সমান নিয়ন্ত্রণকারী হয়, এটা মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির মিলন দ্বারাই উৎপন্ন হয়। প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে একটাই, কিন্তু তার নানা প্রকারের গতির কারণে নানা ভেদ হয়ে যায়। মহর্ষি ব্যাস বলেছেন সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়। এটা হল মুখ্য প্রাণ। বস্তুতঃ এই রশ্মি এগারো প্রকারের হয়। মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন স্পন্দনের তীব্রতা, গতি এবং স্বভাব আদির ভেদ হতে একটা প্রাণ তত্ত্বেরই এগারোটা রূপ হয়। চলুন, এই রশ্মিগুলোর গুণ সংক্ষেপে জেনে নিই -

১. সূত্রাত্মা বায়ু = সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিকে পরস্পর সঙ্গত করার বিশেষ গুণ যুক্ত হয়। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলোই। মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এটা এরকম অব্যক্ত স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়, যা পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জালের সমান বোনা থাকে। এই রশ্মিগুলো এই রকম উৎপন্ন হয় যে প্রত্যেক রশ্মির মধ্যে থেকে আরও সূক্ষ্ম রশ্মি উৎসর্জিত হয়ে একটা জাল বানায়, এই কারণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি নিজের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রূপ সূক্ষ্ম রশ্মির (স্পন্দনের) দ্বারাই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের সঙ্গে তথা পরস্পর বেঁধে রাখে।
সূত্রাত্মা বায়ুকে একটা সুতোর সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে, যা সব কণা বা রশ্মিকে একে-অন্যের সঙ্গে বোনা থাকে। যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির ধনঞ্জয় রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির মধ্যে প্রতিকর্ষণ একদম হয় না।
২. ধনঞ্জয় = এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক তীব্র গতির স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মির গতি প্রকাশের গতির অপেক্ষায় চার গুণ অধিক হয়। যদি প্রকাশের গতি তিন লক্ষ গুণ কিমি প্রতি সেকেণ্ড ধরা হয়, তাহলে ধনঞ্জয় রশ্মির গতি প্রায় বারো লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড হবে। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এরথেকে অধিক গতি কোনো পদার্থের মধ্যে হয় না। এখানে আপনার মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুসারে তো প্রকাশের থেকে বেশি গতি অন্য কারও হতে পারে না, তাহলে ধনঞ্জয় প্রাণের এত গতি কিভাবে হতে পারে? এটা কি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হচ্ছে না? এর উত্তরটা হল এই রকম যে, সেখানে প্রকাশের গতি আকাশের মধ্যে করা হয়েছে অর্থাৎ আকাশের মধ্যে যেকোনো বস্তুর গতি প্রকাশের থেকে অধিক হবে না। অন্যদিকে ধনঞ্জয় রশ্মি হচ্ছে আকাশের থেকে সূক্ষ্ম, এইজন্য তাকে গতি করার জন্য আকাশের আবশ্যকতা হয় না, সেটা তো মনস্তত্ত্বের মধ্যে গতি করে। এইভাবে এই রশ্মি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরোধ করে না।
এই রশ্মির সংযোগ বা আচ্ছাদন দ্বারা যেকোনো রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের গতি তীব্র হয়ে যায়। প্রকাশ বা যেকোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এই ধনঞ্জয় রশ্মির দ্বারাই টেনে নিয়ে আসা হয়, এই কারণে তার গতি ও শক্তি তীব্র হয়। এই রশ্মি যেরকম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং তীব্রগামী সূক্ষ্ম কণার গতির কারণ হয়, সেইরকম সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে মিলে কণার অক্ষের উপর ঘূর্ণনেরও কারণ হয়।
৩. প্রাণ = সব প্রাথমিক প্রাণের মধ্যে এই প্রাণ রশ্মির স্থান সর্বোচ্চ মানা হয়, এর নাম দিয়েই সব প্রকারের প্রাণ রশ্মিদের গ্রহণ করা হয়। যখন মনস্ তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো তীব্র বেগ ও বলের সঙ্গে গমন করে, তখন এরথেকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন রূপে উৎপন্ন রশ্মিদের "প্রাণ" বলা হয়। এরমধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য থাকে। এটা সবার আকর্ষক হয়ে সবাইকে আকর্ষণ বলের সঙ্গে যুক্ত করে সেই কণা বা তরঙ্গের মধ্যে ভিতর থেকে বাইরে নিরন্তর সঞ্চারিত হতে থাকে। এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানেই আকর্ষণ বলের শক্তি আছে, সেখানে এই বলের মূল কারণ রূপ এই তত্ত্বের শক্তি অবশ্যই বিদ্যমান আছে। মহর্ষি ব্যাস -এর প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে কথন হল -
"প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্র০ সূ০ 1.3.39)
এর দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রাণ সূক্ষ্ম স্পন্দনের হয়। ধ্যান রাখবেন যে, এই পরিভাষা কেবল এই প্রাণ রশ্মির জন্য নয় বরং সব প্রাণ রশ্মিগুলো জন্য।
৪. অপান= এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতর "ওম্" রশ্মির দ্বারা এইরকম স্পন্দন, যার গতি প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণের অপেক্ষায় ঠিক বিপরীত তথা যা বিভিন্ন স্পন্দনকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রাণ ও অপান উভয় রশ্মি যৌথভাবে থাকার পরেও পরস্পর বিপরীত দিশাতে স্পন্দিত হতে থাকে, এই কারণে অপান রশ্মি প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করার মূল কারণ হয়। প্রাণ রশ্মির প্রতি এই রশ্মির আকর্ষণ ভাব থাকে।
প্রাণ রশ্মি সত্বপ্রধান এবং অপান রশ্মি রজস্ প্রধান হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান রশ্মি ক্রমশঃ বল ও ক্রিয়া প্রধান হয়। বস্তুতঃ এই উভয় প্রকারের রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত থাকে। কোথাও এর পৃথক্পন দেখা যায় না। এর সংযুক্ত স্বভাবের দ্বারা প্রত্যেক পদার্থের বল এবং ক্রিয়া দুটোই সম্পন্ন হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে প্রাণের প্রাধান্য তথা অপান গৌণ রূপে বিদ্যমান হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য কিন্তু ক্রিয়াশীলতা গৌণ হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে অপানের প্রাধান্য এবং প্রাণ গৌণ হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে ক্রিয়াশীলতা প্রধান তথা বলের ন্যূনতা হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত বল আকর্ষণ এবং প্রতিকর্ষণ দুই রূপেই বিদ্যমান হয়, কিন্তু গুরুত্বাকর্ষণ বল প্রায়শঃ আকর্ষণেরই প্রভাব রাখে। এর কারণ হল এই বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মির প্রাধান্য তথা অপানের অপ্রাধান্য হওয়া। এইদিকে ক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিতে বিচার করলে পরে, তাহলে যে পদার্থের মধ্যে যত অধিক গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা দ্রব্যমান হবে,সেটা ততই কম সক্রিয় হবে। এই দৃষ্টিতে এখানে অপান প্রাণের ন্যূনতা বা অবিদ্যমানতা সিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে গুরুত্ব বল রশ্মির মধ্যে কেবল আকর্ষণ বলই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সেই রশ্মির ক্রিয়াশীলতা খুবই কম হয়, এই কারণে এটা অত্যন্ত কম আবৃত্তির হয় অর্থাৎ নির্বল হয়।
প্রশ্ন - যখন প্রাণ এবং অপান উভয় যুগ্মেরই রূপে থাকে তখন এরমধ্যে কারও প্রাধান্য ও কারও অপ্রাধান্যতা কিভাবে বলা যেতে পারে?
উত্তর - যুগ্মের মধ্যেও একটা অধিক বলবান্ হতে পারে আর যেটা বলবান্ হয়, তারই প্রাধান্য মানা হয়। যেরকম কিছু প্রাণীর মধ্যে নর প্রধান হয়, আবার কিছুর মধ্যে মাদা।
৫. ব্যান = এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এই ভাবে উৎপন্ন হয় যে প্রাণ ও অপানের মাঝে সন্ধির কার্য করতে পারে। ব্যান রশ্মি ছাড়া প্রাণ ও অপান সঙ্গে-সঙ্গে সঙ্গত থাকতে পারবে না। ব্যান রশ্মি না কেবল প্রাণ ও অপানকে বেঁধে রাখে, অপিতু অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে বাঁধতে প্রাণ ও অপান রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে প্রকাশিত কণাকে অপ্রকাশিত কণার অপেক্ষায় অতি ন্যূন সঘনতা প্রদান করে। যখন "ওম্" রূপী অক্ষর রশ্মি দুই বার আবৃত্ত হয়ে পুনঃ পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন ব্যান নামক প্রাথমিক প্রাণকে উৎপন্ন করে।
৬. সমান = যখন "ওম্" রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে সম গতি ও বলের সঙ্গে স্পন্দন উৎপন্ন করে, তখন সেই সময় সমান নামক প্রাণ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির বল ও গতিকে সুষম বানিয়ে রাখে, বিশেষ করে প্রাণ ও অপান নামক প্রাণ রশ্মিদের সুষম বানিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই রশ্মি সমান লয়ের সঙ্গে নিরন্তর গমন করতে থাকে।
৭. উদান = যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির স্পন্দন এই ধরনের হয় যে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণের প্রাদূর্ভাব হতে থাকে, সেই সময় উৎপন্ন স্পন্দন ঊর্ধ্ব গমনকারী হয়। এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণ উৎপন্ন করার সঙ্গে গতি করে, এরদ্বারা উৎপন্ন উদান নামক স্পন্দন ঊর্ধ্বগমন যুক্ত হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মির মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণ ( অর্থাৎ কোনো বলের বিরুদ্ধে বল লাগানো। যেমন, ঘর্ষণ বল লাগানো বলের বিরূদ্ধে কার্য করে) উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়। উদান রশ্মি নিয়মিত, নিয়ন্ত্রিত লয়ের সঙ্গে গতি করে আর ব্যাপক স্তরে এক প্রকারের দীপ্তিকে উৎপন্ন করে।
৮. নাগ = এটা হচ্ছে প্রাণ নামক প্রাণ তত্ত্বের উপপ্রাণ, যা প্রাণ নামক রশ্মির ক্ষুব্ধ ও অব্যবস্থিত হলে পরে তাদের নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। নাগ প্রাণ রশ্মির প্রাধান্যের মধ্যেই ঊষ্মার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয়। এর স্পন্দন অতি সূক্ষ্ম ও ক্ষীণ হয়, যা অন্য প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্থিরের মতো মানা যেতে পারে।
৯. কূর্ম = এই রশ্মি হল অপান প্রাণের উপপ্রাণ, যা অপান রশ্মিদের বল ও প্রেরণ প্রদান করে। আমরা জানি যে, অপান প্রাণ রশ্মিগুলোর প্রতিকর্ষণ বল প্রধান হয়, তবুও ব্যান রশ্মির মাধ্যম দ্বারা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই কূর্ম উপপ্রাণ সংযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে কচ্ছপের মতো অপান রশ্মিদের কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হয়। যেভাবে মস্তক সম্পূর্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেইভাবে কূর্ম রশ্মি প্রাণ ও অপানের মাঝে নিয়ন্ত্রণ বানিয়ে রাখতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
১০. কৃকল = এই প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে উদান প্রাণের উপপ্রাণ। ভেদন ক্ষমতা বা তীব্রতাকে প্রদান বা প্রাপ্তকারী প্রাণ তত্ত্বকেই কৃকল বলা হয়। যখন উদান রশ্মির উৎক্ষেপণ বলের মধ্যে কোনো বাঁধা আসে, তখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা কৃকল প্রাণ রশ্মি রূপ স্পন্দন অকস্মাৎ উৎপন্ন হয়ে উদান রশ্মিদের ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে বল প্রদান করে তার উৎক্ষেপণ বলকে সক্রিয় বা নির্বাধ করে দেয়।
১১. দেবদত্ত = এটা হচ্ছে সমান প্রাণের উপপ্রাণ। এটা বিদিতই যে, সমান প্রাণ রশ্মিগুলো, প্রাণ তথা অপান রশ্মিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। এই রশ্মি সমান প্রাণের সঙ্গে সমলয় দ্বারা স্পন্দিত হয়ে প্রাণ ও অপানের লয় বানিয়ে রাখে।
জ্ঞাতব্য = বিভিন্ন উপপ্রাণ রশ্মির (স্পন্দনের) গতির দিশা নিজের-নিজের প্রাণ রশ্মির গতির দিশা থেকে বিপরীত হয়, আবার এটার স্পন্দন সম্বন্ধিত প্রাণ রশ্মির স্পন্দনের থেকে সূক্ষ্ম হয়, যা এর নিকট নিরন্তর উৎপন্ন হতে থাকে।
____________________________________________
© "ওম্" ছন্দ রশ্মির সঙ্গত না হলে সমস্ত প্রাণ রশ্মি ডার্ক এনার্জির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
® এই রশ্মির সম্বন্ধে পরে বলা হবে।

(স) মাস ও ঋতু রশ্মি

মাস রশ্মি
মাস হল বিশেষ প্রকারের রশ্মির নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিরিশ বার স্পন্দিত হওয়াতে নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে। (মনে রাখবেন যে, এর মানে এই নয় যে একটা মাস রশ্মির ভিতরে তিরিশ প্রাণ ও তিরিশ অপান হয়ে সব মিলিয়ে ষাট রশ্মি যথাযথ বিদ্যমান হয়, বরং বাস্তবিকতা এই হল যে এই ষাট রশ্মির স্পন্দনের ফলস্বরূপ একটা মাস রশ্মি রূপী স্পন্দন হয়, যা সেই স্পন্দনের থেকে সর্বথা ভিন্ন হয় অথবা সেই ষাট স্পন্দনই একটা নবীন স্পন্দনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়, অনেক রশ্মির মিলিত হওয়ায় কোথাও-কোনো রশ্মির উৎপত্তির চর্চা যেখানে হবে, সেখানে এইভাবেই বুঝে নেওয়া উচিত।) এই যুগ্মের বারো প্রকাশ দ্বারা বিশিষ্ঠ সংযোগের কারণেই তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থেকে বারো মাস রশ্মির নির্মাণ হয়। যদি এরকম না হতো, তাহলে কেবল এক প্রকারেরই মাস রশ্মি উৎপন্ন হতে পারতো। এই মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিকে জুড়ে রাখার কাজ করে।
এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিদের যারা য়োষা ও বৃষা রূপে ব্যবহার করে, তাদের নিশ্চিত বিন্দু রূপ ভাগগুলোকে উত্তেজিত করে পরস্পর সংযোগ করাতে সহায়ক হয়। বারো প্রকারের মাস রশ্মি হচ্ছে নিম্নানুসারে -
1. মধু
2. মাধব
3. শুক্র
4. শুচি
5. নভস্
6. নভস্য
7. ঈষ্
8. ঊর্জ্
9. সহস্
10. সহস্য
11. তপস্
12. তপস্য

ঋতু রশ্মি

ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মির যুগ্মকে ঋতু বলা হয়। ঋতু রশ্মি দিশাকে উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণা ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগ পাওয়া যায়। উৎপন্ন সব পদার্থকেও "ঋতু" বলে, কারণ তারা সবাই সর্বদা নিরন্তর গমন করতে থাকে।
ঋতু রশ্মি প্রকাশ নির্মাণ করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা ঊষ্মার তীব্রতা বৃদ্ধি হয়। এই রশ্মি কণা ও তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) পরস্পর সংযোজন-বিয়োজনের মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মতো স্থানগুলোতে ঊর্জার উৎপত্তি হয়, এই রশ্মির প্রাধান্য সেখানেও থাকে। তারার বাইরের বিশাল ভাগের মধ্যেও ঋতু রশ্মির বিশেষ প্রাধান্য থাকে। ঋতু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণাদি রশ্মিকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে, এই কারণে যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা সেই পদার্থ ঊষ্মাকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে। এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে অথবা তাদের আচ্ছাদিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
ছয় ঋতু রশ্মি হচ্ছে এই রকম -
1. বসন্ত (মধু + মাধব)
2. গ্রীষ্ম (শুক্র + শুচি)
3. বর্ষা (নভস্ + নভস্য)
4. শরদ্ (ঈষ্ + ঊর্জ্)
5. হেমন্ত (সহস্ + সহস্য)
6. শিশির (তপস্ + তপস্য)

(দ) অন্য ছন্দ রশ্মি

কাল মাপি রশ্মি

কাল তত্ত্ব হচ্ছে এরকম এক পদার্থ, যারমধ্যে তমোগুণের অভাব থাকে। কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ কাল মাপক প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মিগুলোই হল এরকম রশ্মি যাদের মধ্যে তমোগুণের মাত্রা সর্বথা অভাব তো থাকে না, কিন্তু এর মাত্রা এতই ন্যূন থাকে যে এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়। এই কাল তত্ত্বের সমান তো সতত ও নিরপেক্ষ গমনকারী হয় না, কিন্তু অন্য রশ্মির অপেক্ষায় এর এটাই স্বভাব হয়। এখন আমরা এটা বিচার করবো যে এই কাল মাপক কিভাবে মানা হয়েছে? আসুন, জেনে নিই -
1. প্রাণ = যত অন্তরালের মধ্যে একটা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির স্পন্দন হয়, সেটা অন্তরাল এক প্রাণ বা অহন্ বলে। এই রশ্মি অক্ষর দ্বারা নির্মিত হয়। এরমধ্যে প্রত্যেকটা অক্ষর এক-এক করে স্পন্দিত হয়। সব ছয় স্পন্দনের একটা সংযুক্ত স্পন্দনকে প্রাণ রশ্মি (অহন্) বলা হয়। প্রাণ ঋতু রশ্মির ("ভূঃ", "ভুবঃ", "সুবঃ", তথা "ওম্") ছয় সূক্ষ্ম স্পন্দন দ্বারা মিলিত হয়ে নির্মিত হয়েছে। "ষঙ্ঋতুনা" দৈবী পংক্তি ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে ছয়টা ঋতু রশ্মিকে সঙ্গত করে প্রাণ তত্ত্বকে উৎপন্ন করে।
যেভাবে বর্তমান ভৌতিকবিদ্ সীজিয়ম-133 অ্যাটমের সংক্রমণের (transition) 9,19,26,31,770 আবৃত্তির সময়কে 1 সেকেণ্ড বলে। এরজন্য কেউ এটা বলতে পারবে না যে সেকেণ্ডই হচ্ছে সময়। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে সময়কে মাপার একটা বিধি। আকাশকে মাপার সাধন হল মিটার, কিলোমিটার আদি, ঠিক সেইরকম প্রাণ, অপান আদি যেখানে পদার্থ (রশ্মি) বিশেষ হয়, সেখানে এই পদ কালের মাপকও হয়©।
2. অপান = যত সময়ে একটা অপান রশ্মি একবার স্পন্দিত হয়, সেই সময়কে অপান বলা হয়। এই রশ্মি ষোলো ঋতুর অর্থাৎ চার-চারটা ঋতুর চার আবৃত্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়। এখানে চিত্রানুসারে প্রত্যেক ব্যাহৃতি ঋতু রশ্মিই মানা হয়েছে।
যদি পূর্ববত্ এক অক্ষরকে এক ঋতু রশ্মি ধরা হয়, তাহলে "সুবঃ"-কে ছেড়ে দিয়ে অন্য তিন রশ্মির চার আবৃত্তির থেকে ষোলো অক্ষর মিলে অপান রশ্মিকে উৎপন্ন করে।

ছন্দ রশ্মির 7 প্রকারের প্রভাব
যেকোনো বেদ মন্ত্রের (ছন্দ রশ্মি) নিম্নলিখিত প্রভাব থাকে -
1. দেবতার প্রভাব (দেবতা হল সেই পদার্থের নাম, যা কোনো ছন্দ রশ্মির সঙ্গে সবথেকে বেশি প্রভাবিত হয়। যেমন কোনো ছন্দ রশ্মির দেবতা হল ইন্দ্র, এর অর্থ হল সেই রশ্মির সঙ্গে বিদ্যুতের বৃদ্ধি হবে।)
2. ছন্দের প্রভাব (ছন্দের জন্য পরবর্তী অধ্যায় পঠনীয়।)
3. ঋষির প্রভাব (কোনো ছন্দ রশ্মি যে ঋষি রশ্মির সঙ্গে উৎপন্ন হয়, তারমধ্যে সেই ঋষি রশ্মির কিছু গুণ এসে যায়।)
4. স্বরের প্রভাব
5. পদের প্রভাব (অর্থাৎ শব্দের প্রভাব)
6. অক্ষরের প্রভাব
7. সম্পূর্ণ ঋচা/ছন্দ রশ্মি/মন্ত্রের প্রভাব

রশ্মির সংযোগ প্রক্রিয়া

বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অস্পষ্ট সুতোর টুকরোর সমান আকৃতির হয়, যার দুই মাথা পৃথক-পৃথক গুণের হয়। যেভাবে চুম্বকের দুই মাথা বিপরীত গুণের হয় আর সামনে নিয়ে আসলে একে-অপরকে আকর্ষিত করে। ঠিক সেইভাবে রশ্মির মাথাগুলো পরস্পরের মধ্যে আকর্ষিত হয়ে সংযুক্ত হয়ে যায়।
এই অগ্রভাগগুলো একে-অপরের সঙ্গে রসির মাথার মতো জুড়ে থাকে। এগুলোর সংযুক্ত মাথার মাঝখানে সূক্ষ্ম দৈবী গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি সতত সঞ্চারিত হতে থাকে। বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির এই দুই মাথাই বিভিন্ন বল আর ক্রিয়ার কেন্দ্র ও কারণ হয়। সেই ক্রিয়া আর বলের নিয়মন আর সঞ্চালন সূক্ষ্ম বাক্ রশ্মির সহযোগ দ্বারা এই মাথাগুলোই করে। এই সূক্ষ্ম রশ্মিগুলো অব্যক্ত রূপে এই মাথাগুলোর মাঝে সতত সঞ্চারিত হতে থাকে আর অন্ততঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ এই মূল সিদ্ধান্তের আধারেই হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সুতোর সমান গঠনের তাৎপর্য এই নয় যে সেটা শক্ত মনে করা যাবে। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে সূক্ষ্ম স্পন্দনেরই রূপ, যেরকম জলের মধ্যে ঢেউ। যেভাবে জলের ঢেউ জুড়ে যায় সেইভাবে এদের মাথাগুলো জুড়ে যায় মনে করা উচিত।

রশ্মির সংখ্যা সীমিত নাকি অসীমিত 

যদিও এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ছন্দ রশ্মি স্বরূপের দৃষ্টিতে অনেক সীমিত সংখ্যাতেই বিদ্যমান আছে, কিন্তু বারংবার আবৃত্তি হওয়ার কারণে তাদের সংখ্যা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসীমিত। যেভাবে কোনো গিটার বা বীণার মধ্যে কেবল কয়েকটা তারই থাকে, কিন্তু তাতে উৎপন্ন হওয়া কম্পনের বারংবার আবৃত্তিতে অসংখ্য স্বর উৎপন্ন হতে পারে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মূল কণার সংখ্যাও স্বরূপের দৃষ্টিতে পরিমিতই আছে, কিন্তু সেটা মোট সংখ্যার দৃষ্টিতে অসংখ্যই হয়। এই জন্য এইভাবে বিভিন্ন লোকের রূপে বিদ্যমান মূল কণার মাত্রা মহাকাশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মূল কণার অপেক্ষায় ন্যূনই হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সীমিত প্রকারের মূলকণা আর অ্যাটমস্, অসীমিত প্রকারের অণুগুলোকে উৎপন্ন করে। এরমধ্যেও সেই কণা আর অ্যাটমের মিশ্রণের মাত্রা আর আবৃত্তিরই ভেদ আছে।
প্রাণ নামক প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্বকে উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়, আর সেটা ঊষ্মার উৎপত্তিতেও বিশেষ যোগদান করে। এইসব রশ্মির ব্যবস্থাপনের আধারের উপরেই বিভিন্ন কণার আয়ু নির্ধারিত হয়। যেকোনো ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা এই সূক্ষ্ম প্রাণ রশ্মি কখনও ব্যক্তরূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে না কিন্তু যখন সেটা ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক আদির রূপে উৎপন্ন হয়, তখনই সেটা ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা অভিব্যক্ত হতে পারে। এই ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক পদার্থ হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণ এবং ছন্দাদি রশ্মির ভাণ্ডার। যদিও প্রাণ বা ছন্দাদি রশ্মির সব ক্রিয়া বা বল ভৌতিক টেকনিক দ্বারা অব্যক্তই হয়, তবুও সেটা ব্যক্ত বলের বা ক্রিয়ার মধ্যে নিজের অব্যক্ত এবং অনিবার্য ভূমিকার সঙ্গে বিদ্যমান থাকে। এদের অভাবে কোনো ব্যক্ত বল বা ক্রিয়ার না তো অস্তিত্ব হওয়া সম্ভব আর না এই সৃষ্টির মধ্যে কোনো পদার্থের অভিব্যক্ত হওয়া সম্ভব হবে।
✍️ স্মরণীয় তথ্য
1.সমস্ত মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন দ্বারা হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে।
2. যখন রশ্মিগুলোর সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়।
3. যখন সেই রশ্মিগুলোর সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মুলকণার রূপ ধারণ করে নেয়।
4. যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) নির্মাণ করে।
5. মহত্ তত্ত্ব অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়।
6. কালের উৎপত্তির সময়ে সাম্যাবস্থাতে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়।
7. "ওম্" ছন্দ রশ্মি হচ্ছে অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সমস্ত প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মিগুলো এর থেকেই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
8. সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
9. যেসব রশ্মি নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের বিশেষ রূপে আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে। এটা সাত প্রকারের (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ আর সত্যম্) হয়।
10. সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ প্রধানতঃ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়।
11. মাস হচ্ছে বিশেষ প্রকারের রশ্মির (মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ঈষ্, ঊর্জ্, সহস্, সহস্য, তপস্ আর তপস্য) নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিনবার স্পন্দিত হওয়ায় নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশটা প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে।
12. মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন রশ্মিকে যুক্ত করার কাজ করে।
13. ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির (বসন্তঃ, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত তথা শিশির) রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মিদের যুগ্ম ঋতু বলে।
14. ঋতু রশ্মি দিশা উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণার ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগিতা পাওয়া যায়। এই রশ্মিগুলো প্রকাশ উৎপন্ন করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
15. প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মির মধ্যে তমোগুণের মাত্রা অত্যন্ত নিম্ন থাকে। এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়।
16. যত অন্তরালে একটা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির স্পন্দন হয়, সেই অন্তরালকে একটা প্রাণ বা অহন্ বলে।
17. যত সময়ে একটা অপান রশ্মি একবার স্পন্দিত হয়, সেই সময়কে অপান বলে।
18. অনেক ছন্দ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মি থেকে উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে।
19. বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অস্পষ্ট টুকরো সুতোর সমান আকৃতির হয়, যার দুটি মাথা পৃথক-পৃথক গুণের হয়।
20. স্বরূপের দৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মি অনেক সীমিত সংখ্যাতেই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু আবৃত্ত হওয়ার কারণে তাদের সংখ্যা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসীমিত হয়।
____________________________________________
© এক প্রাণ আর এক অপান বর্তমান কালের মাপকের মধ্যে কত সময়? এটা এখনও অনুসন্ধানের বিষয়।




No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ