বেদের উৎপত্তি - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

27 July, 2023

বেদের উৎপত্তি

 

যিনি অগ্নি, বায়ু আদির নিকট থেকে চার বেদ পড়েছিলেন তিনিই ব্রহ্মা ঋষি ছিলেন, কারণ "চতুর্বেদ বিদ্ ব্রহ্মা ভবতি" চার বেদের জ্ঞানীই হল ব্রহ্মা।

অগ্নিবাযুরবিভ্যস্তু ত্রয়ম্ ব্রহ্ম সনাতনম্।

দুদোহ য়জ্ঞসিদ্ধ্যর্থমৃগ্যজুঃ সামলক্ষণম্।। (মনুঃ ১|২৩)


অর্থাৎ - অগ্নি, বায়ু, অঙ্গিরা নামক ঋষাদির মাধ্যমে ক্রমশঃ ঋক্ আদি বেদকে পরমাত্মা দোহন করে প্রকাশ করেছিলেন।

"অগ্নিঃ ঋগ্বেদঃ বায়োর্য়জুর্বেদঃ সূর্য়াত্সামবেদঃ" (শতপথ ব্রাহ্মণঃ ১১|৫|৮|৩)

অর্থাৎ - অগ্নি থেকে ঋগবেদ বায়ু থেকে য়জুর্বেদ তথা সূর্য থেকে সামবেদ প্রকট হয়।

য়শ্মাদৃচো অপাতক্ষন্যজুর্য়স্মাদপাকষন্।
সামানি য়স্য লোমান্যথর্বাঙ্গিরসো মুখম্।
স্কম্ভম্ তম্ ব্রূহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।। (অথর্বঃ ১০|৭|২০)

অর্থাৎ - সেই সর্বশক্তিমান পরমাত্মা হতে ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ আর অথর্ববেদ, এই বেদ চতুষ্টয় প্রাদুর্ভূত হয়। অঙ্গিরস অর্থাৎ অথর্ববেদ যার মুখের স্বরূপ, সামবেদ যার লোমবৎ, য়জুর্বেদ যার হৃদয় স্বরূপ আর ঋগ্বেদ যার প্রাণ স্বরূপ। এইভাবে পরমাত্মা রূপকালঙ্কার দ্বারা বেদের উৎপত্তির প্রকাশ করেন।

তস্মা॑দ্য॒জ্ঞাৎ স॑র্ব॒হুত॒ऽঋচঃ॒ সামা॑নি জজ্ঞিরে ।
ছন্দা॑ᳬসি জজ্ঞিরে॒ তস্মা॒দ্যজু॒স্তস্মা॑দজায়ত ॥ যজুর্বেদ০ ৩১।৭

ভাষ্যম্ :- (তন্মাদ্যাৎস০) তস্মাত্যজ্ঞাৎ সচ্চিদানন্দাদিলক্ষণাৎ পূর্ণাৎ পুরুষাৎ সৰ্ব্বভূতাৎ সৰ্ব্বপূজ্যাৎ সর্ব্বোপাস্যাৎ সর্ব্বশক্তিমতা পরব্রহ্মণঃ (চঃ) ঋগ্বেদন, (যজুঃ ) য়জুর্ব্বেদঃ, (সামানি) সামবেদঃ, (ছন্দা॑ᳬসি) অথর্ব্ববেদশ্চ (জজ্ঞিরে) চত্বারো বেদান্তেনৈৰ প্ৰকাশিতা ইতি বেদ্যম্। সর্ব্বহুতঃ ইতি বেদানামপি বিশেষণং ভবিতুমর্হতি, বেদাঃ সৰ্ব্বহুতঃ, য়তঃ সৰ্ব্বমনুষ্যেহোতুমাদাতুং গ্রহীতুং যোগ্যাঃ সন্ত্যতঃ। জঞ্জিরে, অজায়ত ইতি ক্রিয়াদ্বয়ং বেদানামনেক বিদ্যাবত্ত্বদ্যোতনার্থম্ । তথা তন্মাদ ইতি পদদ্বয়মীশ্বরাদের বেদা জাতা ইত্যাবধারণার্থম্ ।। 

বেদানাং গায়াদিচ্ছন্দোন্বিতত্ত্বাৎ পুনশ্ছন্দাংসীতি পদং চতুর্থস্যাথাবেদস্যোৎপত্তিং আপয়তীত্যবধেয়ম্। যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ। শo কাং০১ অ০১।। [ব্রা০২। ক ১৩] ইদং বিষ্ণুবিচক্রমে ত্রেধা নিদধে পদম্।' যজুঃ অ০ ৫ ম০ ১৫ । ইতি সৰ্ব্ব জগতকর্তৃত্বং বিষ্ণৌ পরমেশ্বর এব ঘটতে, নান্যত্র। বেবেষ্টি ব্যাপ্নোতি চরাচরং জগৎ স বিষ্ণুঃ পরমেশ্বরঃ।।

পদার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! তোমাদের উচিত যে, (তস্মাৎ) সেই পূর্ণ, (য়জ্ঞাৎ) অত্যন্ত পূজনীয় (সর্বহুতঃ) যাহার জন্য সকলে সমস্ত পদার্থ প্রদান করে বা সমর্পণ করে সেই পরমাত্মা হইতে (ঋচঃ) ঋগ্বেদ, (সামানি) সামবেদ (জজ্ঞিরে) উৎপন্ন হয় (তস্মাৎ) সেই পরমাত্মা হইতে (ছন্দাংসি) অথর্ববেদ (জজ্ঞিরে) উৎপন্ন হয় এবং (তস্মাৎ) সেই পুরুষ হইতে (য়জুঃ) যজুর্বেদ (অজায়ত) উৎপন্ন হয়, তাহাকে জানো ॥ 

ভাবার্থঃ-(তস্মাৎ যজ্ঞাৎ) সৎ যাঁহার কখনো নাশ হয় না চিৎ যিনি সদা জ্ঞান স্বরূপ, যাঁহার কখনো লেশমাত্র অজ্ঞানতা নাই আনন্দ যিনি সদা সুখস্বরূপ এবং সকলের সুখদাতা, এবম্ভূত সচ্চিদানন্দাদি 
লক্ষণযুক্ত সর্ব্বত্র পরিপূর্ণ, সকলের উপাসনার যোগ্য, ইষ্টদেব ও সর্ব্বশক্তিমান্ পরমব্রহ্ম হতে, (ঋচঃ) ঋগ্বেদ (য়জু) যজুর্ব্বেদ (সামানি) সামবেদ (ছন্দাংসি) এবং অথর্ব্ববেদ প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য সকলেরই বেদশাস্ত্র গ্রহণ ও তদনুযায়ী আচরণ করা কর্ত্তব্য। বেদ অনেক বিদ্যার আধার, ইহা প্রকাশ করার জন্য, 'জঞ্জিরে' এবং 'অজায়ত' এই ক্রিয়া দ্বয়ের প্রয়োগ হয়েছে। ঈশ্বর হতে বেদ সকল উৎপন্ন হয়েছে, তা অবধারণের জন্য, ‘তস্মাৎ' এই পদ দুইবার প্রযুক্ত হয়েছে। বেদ মন্ত্ৰ সকল গায়ত্রাদি ছন্দ যুক্ত হেতু, 'ছন্দাংসি' এই পদ দ্বারা অথর্ব্ববেদের উৎপত্তি প্রকাশ করিতেছে। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং বেদ মন্ত্র প্রমাণ দ্বারা তা সিদ্ধ হয়েছে, যে 'যজ্ঞ' শব্দে 'বিষ্ণু', এবং বিষ্ণু শব্দে সৰ্ব্বব্যাপক পরমেশ্বরেরই গ্রহণ হয়ে থাকে, কারণ জগৎ উৎপত্তি করা, এক পরমেশ্বর ভিন্ন অন্যত্র বা অপরে ঘটতে পারে না। 

হে মনুষ্যগণ ! যাহা হইতে সকল বেদ উৎপন্ন হইয়াছে, তোমরা সেই পরমাত্মার উপাসনা কর, বেদ পড় এবং তাহার আজ্ঞা অনুযায়ী আচরণ করিয়া সুখী হও ॥

য়স্মাদৃচো' অপা'তক্ষন্ য়জুর্য়'স্মাদপাক'ষন্।
সামা'নি য়স্য লোমান্যথর্বংঙ্গিরসো মুখম্।
স্কম্ভং তং ব্রূহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।
অথর্ববেদ কাং ১০ প্রপা ২৩ অনু ০৪ মং ২০
ভাষার্থঃ-
( যস্নাদৃচো অপা০ ) যে সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর হইতে , ( ঋচঃ ) ঋগ্বেদ , ( যজুঃ ) যজুর্বেদ ( সামানি ) সামবেদ ( আংগিরসঃ ) অথর্ববেদ , এই বেদ চতুষ্টয় উৎপন্ন বা প্রাদুর্ভূত হইয়াছে এবম্ভূত ঈশ্বর , আংগিরস অর্থাৎ অথৰ্ব্ববেদ যাঁহার মুখ স্বরূপ , সামবেদ যাহার লােমবৎ , যজুর্বেদ যাঁহার হৃদয় স্বরূপ , এবং ঋগ্বেদ যাহার প্রাণ স্বরূপ , ( ব্রহি কতমঃ স্বিদেব সঃ ) যে , যাঁহা হইতে চারি বেদ উৎপন্ন হইয়াছে , তিনি কোন দেব ? তাহা তুমি বল ? এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান বলিতেছেন , ( স্কংভ তং ) যিনি সমগ্র জগতের ধারণ কর্তা পরমেশ্বর , তাঁহাকেই স্কম্ভ বলা যায় , এবং সেই স্কম্ভকেই বেদ সকলের কর্তা প্রকাশক বলিয়া জানিবে সেই সর্বাধার পরমেশ্বর ভিন্ন , অন্য কোন দেব , বেদ কর্তা নহে , এবং তিনি ভিন্ন মনুষ্যের উপাসনা যােগ্য অন্য কোন ইষ্টদেব নাই । কারণ যে বেদকৰ্তা পরমাত্মাকে পরিত্যাগ করিয়া তৎ স্থানে অন্যর উপসনা " করে , সে নিশ্চয়ই হতভাগ্য সন্দেহ নাই । ।
( এবং বা অরেৎস্য) এই মন্ত্রে মহাবিদ্বান যাজ্ঞবল্ক্য নিজ পত্নী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিতেছেন , হে মৈত্রেয়ি ! যে পরমাত্মা আকাশ হইতেও বৃহৎ, তাহা হইতেই ঋক্ , যজুঃ , সাম ও অথর্ব , এই বেদ চতুষ্টয় নিঃশ্বাসের ন্যায় সহজভাবে নিঃসৃত হইয়াছে । যেরূপ শরীর হইতে শ্বাস সহজে নির্গত হইয়া পূনঃ সেই শরীরেই প্রবেশ করে , তদ্রূপ সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর বেদ শাস্ত্রকে উৎপন্ন বা ( প্রাদুর্ভূত ) করিয়া , সংসারে উহাকে প্রকাশ করিয়া থাকেন ও পুনঃ প্রলয়কালে তিনি বেদশাস্ত্রকে সংসার হইতে অপসারিত করিয়া , নিজ ( অনন্ত ) জ্ঞান মধ্যে সদা স্থিত রাখেন । এইরূপে বীজাঙ্কুরবৎ পরমাত্মা কর্তৃক বেদশাস্ত্রের প্রাদুর্ভাব ও তিরোভাব হইয়া থাকে, অর্থাৎ যেরূপ বীজ মধ্যে প্রথম হইতেই অঙ্কুর বর্তমান থাকে , এবং তাহাই বৃক্ষরূপে প্রকাশিত হয় ও পুনঃ সেই বৃক্ষ আবার বীজরূপে পরিণত হয় , তদ্রূপ বেদ শাস্ত্র সদা ঈশ্বরের জ্ঞানে বিরাজমান থাকে , তাহার কদাপি নাশ হয় না , কারণ বেদ সাক্ষাৎ ঈশ্বরের বিদ্যা বা জ্ঞান , এজন্য ইহাকে নিত্য বলিযা জানিবে ।
বেদোৎপত্তি বিষয়ে কেহ কেহ এরূপ প্রশ্ন করেন , যে পরমেশ্বর নিরাকার হওয়ায় কি প্রকারে শব্দ রূপ বেদ তাঁহা কর্তৃক উৎপন্ন হইতে পারে ?
ইহার উত্তর এই যে , পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান , এজন্য তাঁহাতে এরূপ শঙ্কা করা যুক্তিযুক্ত নহে , কেননা মুখ প্রাণাদি সাধন ব্যতিরেকেও তদ্বিষযের কাৰ্য্য করিবার পরমেশ্বরের অনন্ত শক্তি বর্তমান আছে অর্থাৎ পরমাত্মা নিজ অনন্ত সামর্থ্য বলে , মুখ ও প্রাণাদি ব্যতীত , মুখ প্রাণাদির যথাবৎ কাৰ্য্য করণে সদা সমর্থ হয় । মুখ প্রাণাদি ( ইন্দ্রিয় . ) ব্যতীত , তত্তৎ ইন্দ্রিয়াদি জনিত কাৰ্য্য করণে আসক্ত রূপ দোষ , কেবল অল্পসামর্থযুক্ত জীবেরই ঘটিয়া থাকে , পরমাত্মায় ঘটে না । পুনশ্চ মানসিক কোন বিষয় বিচার করিবার সময় , যেরূপ আমরা বাক্যাদি সাধন ব্যতিরেকেও , মনে মনে প্রশ্নোত্তরাদিও শব্দোচ্চারণ করিতে সমর্থ হই , তদ্রূপ পরমেশ্বরের বিষয় জ্ঞাত হওয়া কর্তব্য । যিনি সৰ্ব্ব সামর্থ্যযুক্ত , তিনি কোন কাৰ্য্য করিবার জন্য , কখন কাহারও সহায়তা গ্রহণ করেন না । কারণ তিনি নিজ সামর্থ্য বলেই সকল প্রকার কার্য্য সাধনে সমর্থ হয়। যে প্রকার অন্যের সাহায্য ব্যতীত আমরা কোন কার্য্য করিতে সক্ষম নয়, ঈশ্বর সম্বন্ধে তদ্রূপ নহে। যেমন দেখ, যখন জগৎ উৎপন্ন ছিল না, সেই সময় নিরাকার ঈশ্বর সম্পূর্ণ জগৎ নির্মাণ করেন, তখন বেদ রচনায় শঙ্কা থাকতে পারে কি❓ যেমন বেদে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিদ্যা রচনা করিয়াছেন, সেইরূপ জগতেও নেতাদি পদার্থগুলি অত্যন্ত আশ্চর্যরূপে রচনা করিয়াছেন, তাহা হইলে বেদের রচনা নিরাকার ঈশ্বর কেন করিতে পারেন না❓
প্রশ্নঃ - জগৎ রচনার সামর্থ ঈশ্বর ব্যতীত অন্য জীবে থাকিতে পারে না (ইহা সত্য বটে ) , পরন্তু ব্যাকরণাদি গ্রন্থ রচনায় যেরূপ জীবের সামর্থ আছে তদ্রূপ বেদ রচনায়ও জীবের সামর্থ হইতে পারে❓
উত্তরঃ - বেদ রচনায় জীবের সামর্থ নাই , কারণ ঈশ্বর রচিত বেদাধ্যয়নের পর, মনুষ্যের গ্রন্থ রচনার সামর্থ জন্মিতে পারে , অন্যথা নহে । অর্থাৎ বেদ শাস্ত্রের পঠন ও তদ্বিষয়ক জ্ঞান ভিন্ন , অন্য কোন উপায়ে মনুষ্যের বিদ্বান হওয়া সম্ভব নহে , যেহেতু কোন শাস্ত্র পাঠ করিয়া বা কোন উপদেশ শ্রবণ করিয়া , অথবা লােকের ব্যবহার দেখিয়াই , মনুষ্যের জ্ঞান জন্মে , অন্যথা অন্য কোন প্রকারে জ্ঞানােদয়ের সম্ভব হয় না । কারণ যদি আমরা কাহারও শিশু সন্তানকে ( শৈশব কাল হইতেই ) কোন নির্জন স্থানে রাখিয়া , যাবৎ তাহার মৃত্যু না হয় , তাবৎ তাহার সহিত লেশ মাত্র ভাষণাদি ব্যবহার না করিয়া , যুক্তি দ্বারা অন্নপানাদি প্রদান করি , তবে যেরূপ তাহার মনুষ্যোচিত কিছু মাত্র যথার্থ জ্ঞানােদয় হয় না অথবা যেরূপ মহারণ্যস্থিত মনুষ্যের উপদেশ ব্যতীত পশুবৎ প্রবৃত্তি হইয়া থাকে, তদ্রূপ আদি সষ্টি হইতে আজ পর্যন্ত বেদোপদেশ ব্যতীত, সকল মনুষ্যেরই পশুবৎ প্রবৃত্তি হইয়া থাকে, গ্রন্থ রচনা করা ত দূরের কথা । অতএব বেদ শাস্ত্র যে ঈশ্বরের রচিত, ইহা স্বীকার করাই কল্যাণদায়ক, অন্যথা নহে।
প্রশ্নঃ - ঈশ্বর মনুষ্যকে স্বাভাবিক জ্ঞান প্রদান করিয়াছেন , যাহা সকল গ্রন্থের জ্ঞান হইতে শ্রেষ্ঠ , কারণ ঐ স্বাভাবিক জ্ঞান ব্যতীত , বেদের শব্দার্থ ও সম্বন্ধ বিষয়ের জ্ঞান মনুষ্যের কদাপি ঘটিতে পারে না , এবং ঐ জ্ঞান ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে , তদ্দ্বারা মনুষ্যরা অনায়াসে পুস্তকাদি রচনা করিতে সমর্থ হন , এজন্য বেদ ঈশ্বর প্রসূত এরূপ কীজন্য স্বীকার করিব ❓
উঃ - ইতিপূর্বে বর্ণিত নির্জনস্থিত শিশু অথবা নিবিড় বনবাসী মনুষ্যদিগকে কি পরমেশ্বর স্বাভাবিক জ্ঞান প্রদান করেন নাই ❓ কীজন্যই বা তাহারা ঐ স্বাভাবিক জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়াও নিজ নিজ বলে বিদ্বান হইতে সমর্থ হন না ❓ এজন্য নিশ্চয় জানা উচিত , যে ঈশ্বরের কৃত বেদরূপ উপদেশ বিনা কখন কাহারও যথার্থ জ্ঞানােদয় হইতে পারে না। যেরূপ আমরা বেদাধ্যয়ন , বিদ্বানদিগের নিকট হইতে শিক্ষা , ও তাহাদিগের কৃত গ্রন্থাদি পাঠ বিনা পণ্ডিত হইতে সমর্থ হই না , তদ্রূপ সষ্টির আদিতে যদি পরমাত্মা বেদশাস্ত্রের উপদেশ না করিতেন , তাহা হইলে আজ পর্যন্ত কেহই বিদ্যাদি বিষয়ক যথার্থ প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইতেন না । ইহার দ্বারা আমরা কী বুঝিলাম? বুঝিলাম এই যে বিদ্বানের নিকট শিক্ষা এবং বেদাধ্যয়ন ব্যতীত , কেবল স্বাভাবিক জ্ঞান বলে, মনুষ্যের সকল কার্য নির্বাহ হইতে পারে না । যেরূপ আমরা প্রথমে অন্য বিদ্বান ব্যক্তির নিকট হইতে বেদাদি শাস্ত্রের লিখিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষা করিয়া , পরে গ্রন্থ রচনা করিতে সমর্থ হই, তদ্রূপ সর্ব প্রথমে সকল মনুষ্যেরই ঐশ্বরীয় জ্ঞানের নিত্যান্ত আবশ্যক আছে । সৃষ্টির প্রারম্ভে পঠন পাঠনের কোন ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল না , অথবা মনুষ্য কৃত কোন বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল না , অতএব সে সময় ঈশ্বর কৃত বেদশাস্ত্র প্রকাশ বিনা , কাহারও গ্রন্থ রচনার শক্তি ঘটিতে পারে না , কারণ কোন মনুষ্যেরই সহায়কারী জ্ঞান বিষয়ে স্বতন্ত্রতা নাই , ( অর্থাৎ বিদ্যা বা বস্তু বিষয়ক জ্ঞান অপরের নিকট হইতেই প্রাপ্ত হওয়া যায় অন্যথা নহে ) । লােকে কেবল স্বাভাবিক জ্ঞান বলে , বিদ্যা প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হন না । এজন্য মনুষ্য মাত্রেরই হিতার্থে পরমেশ্বর বেদের উৎপত্তি ( প্রকাশ ) করিয়াছেন । পুনশ্চ আপনি যে বলিয়াছিলেন যে , স্বাভাবিক জ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ , সে কথাও যথার্থ নহে , কারণ স্বাভাবিক জ্ঞানও , সাধন সাপেক্ষ । যেরূপ মনের সংযােগ বিনা , কেবল দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না , অথবা যেরূপ আত্মার সংযােগ বিনা , মন স্বয়ং কোন কাৰ্য্য করিতে পারে না , তদ্রূপ স্বাভাবিক জ্ঞানকেও জানিবে । এই স্বাভাবিক জ্ঞান , বেদশাস্ত্রও বিদ্বানদিগের গ্রন্থ বিষয়ক জ্ঞানােপার্জনের সাধন স্বরূপ হইয়া থাকে , নচেৎ ইহা কেবল পশুদিগের মত ( আহারও নিদ্রাদি ) সাধনােপযােগীমাত্র হইয়া থাকে । অর্থাৎ স্বাভাবিক জ্ঞান , নিজ স্বতন্ত্রতায় ধৰ্ম্ম , অর্থ , কাম ও মােক্ষ বিদ্যা বিষয়ক সাধন স্বরূপ হইতে পারে না ।
প্রশ্নঃ - ঈশ্বরের বেদোৎপাদন করিবার প্রয়ােজন কী ?
উত্তরঃ - আমি আপনাকেই জিজ্ঞাসা করিতেছি , যে পরমেশ্বরের বেদোৎপাদন না করিবারই বা প্রয়ােজন কী ?
আর যদি আপনি বলেন , যে আমি এরূপ প্রশ্নের উত্তর জানি না , তবে সে কথা সত্য বটে , কারণ বেদ ঈশ্বরের নিত্য বিদ্যা , এজন্য ইহার উৎপত্তি বা অনুৎপত্তি , দুইয়ের মধ্যে একটিও হইতে পারে না । পরন্তু আমাদিগের অর্থাৎ জীবের প্রয়োজন সাধনাৰ্থে পরমেশ্বর বেদশাস্ত্র প্রকাশ করিয়াছেন , এজন্য পরমাত্মা আমাদিগের প্রতি বিশেষ কৃপা করিয়াই বেদোৎপত্তি বা বেদশাস্ত্র প্রকাশ করিয়াছেন তাহা আপনারা জ্ঞাত হইবেন । ।
প্রশ্নঃ - ঈশ্বরে অনন্ত বিদ্যা আছে কী না ?
উত্তরঃ - আছে।
প্রশ্নঃ - সেই বিদ্যার আবশ্যকতা কি ?
উত্তরঃ - নিজের জন্যই আছে , যদ্বারা তিনি সমস্ত পদার্থ রচনা করেন , ও তদ্বিষয়ে জ্ঞাত হইয়া থাকেন। ভাল আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি যে ঈশ্বর পরােপকার করেন কি না ?
প্রশ্নঃ - ঈশ্বর পরােপকারী বটে , পরন্তু তাহাতে আপনার কী সিদ্ধ হইল ?
উত্তরঃ - ইহাতে এই সিদ্ধ হইতেছে যে , বিদ্যা , স্বার্থ ও পরার্থ জন্য হইয়া থাকে, কারণ স্বার্থ ও পরাৰ্থ সিদ্ধ করাই বিদ্যার স্বাভাবিক গুণ । যদ্যপি পরমেশ্বর আমাদিগের জন্য বেদবিদ্যা উপদেশপ্রদান না করেন , তাহা হইলে বিদ্যা প্রদানরূপ পরােপকার গুণ তাহাতে বর্তে না , তজ্জন্য পরমেশ্বর স্ববিদ্যাযুক্ত বেদোপদেশ দ্বারা , তাঁহার বিদ্যোপদেশের সপ্রয়ােজনতা সম্পাদন করিয়াছেন , যেহেতু পরমেশ্বর আমাদিগের পিতা মাতার স্বরূপ , আমরা সকলে তাঁহারই প্রজা , তিনি সর্বদাই আমাদিগের প্রতি কৃপা দৃষ্টি রাখিয়া থাকেন এবং যেরূপ পিতা মাতা সন্তানদিগের প্রতি সদৈব করুণা প্রকাশ করেন , যাহাতে তাহারা সর্ব প্রকারে সুখ প্রাপ্ত হয় , তদ্রূপ ঈশ্বরও সকল মনুষ্যাদি সৃষ্টির প্রতি সদৈব কৃপাদৃষ্টিকরিয়া থাকেন , এবং তজ্জন্যই পরমেশ্বর যাবতীয় মনুষ্যের কল্যাণের জন্য , কৃপাপূর্বক বেদশাস্ত্রের উপদেশ দিয়াছেন । যদি পরমেশ্বর মনুষ্যের হিতার্থে বেদোপদেশ না দিতেন , তবে অন্ধ পরম্পরায় কাহারও ধৰ্ম্ম , অর্থ , কাম , মোক্ষের সাক্ষাৎ প্রাপ্তি হইত না, সুতারাং কেহই পরমানন্দ প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইতেন না, যখন পরম দয়ালু পরমেশ্বর প্রজাদিগের সুখার্থে কন্দমূল ফলাদি ও তৃণাদি ক্ষুদ্র পদার্থ সৃজন ও রচনা করিয়াছেন, তখন সেই ঈশ্বর সর্বসুখ প্রকাশিকা সর্ব সত্যবিদ্যাময়ী বেদবিদ্যার উপদেশ প্রজাদিগের সুখার্থে কেন করিবেন না? ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় উৎকৃষ্ট পদার্থ প্রাপ্তি দ্বারা যে সুখ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা সত্য বিদ্যালব্ধক সুখের সহস্রাংশের একাংশের সহিত তুল্য হইতে পারে না। এজন্য এরূপ সর্বোত্তম বিদ্যা পদার্থ যাহাকে বেদ বলে তাহার উপদেশ পরমেশ্বর কেন করিবেন না ? এতএব নিশ্চয় জানিও যে বেদ ঈশ্বর প্রণীত।
প্রশ্নঃ- ঈশ্বর বেদ পুস্তক লিখিবার জন্য লেখনী মসীও পাত্রোদি সাধন কোথায় প্রাপ্ত হইলেন ?যেহেতু সে সময় কাগজাদি পদার্থ রচিত হয় নাই ?
উত্তরঃ- অহো! আপনি ত বড়ই শঙ্কা করিতেছেন, আপনার বুদ্ধির কী বিশেষ প্রশংসা করিব? ভাল আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞসা করি, যে হস্ত পদাদি অবয়ব ওকাষ্ঠ লোষ্ট্রাদি সাধন ব্যতিরেকেও জগদীশ্বর কীরূপে জগৎ রচনা করিতে সামর্থ হইয়াছিলেন ? যেরূপ হস্ত পদাদি ব্যতিরেকেও পরমেশ্বর জগৎ রচনা করিয়াছেন। তদ্রূপ লেখনী মসী ও পাত্রাদি সাধন ব্যতীতও ঈশ্বর বেদ শাস্ত্র রচনা করিয়াছেন। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এজন্য তাঁহার সামর্থ্য বিষয়ে আপনার এরূপ শঙ্কা করা যোগ্য ও যুক্তিযুক্ত নহে। পরন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তর ইহাও জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক যে, বেদশাস্ত্রকে পুস্তকাকারে লিখিয়া, সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর প্রকাশ করেন নাই।
প্রশ্নঃ - তবে ঈশ্বর কী প্রকারে বেদ প্রকাশ করিয়াছিলেন ?
উত্তরঃ – ঈশ্বর জ্ঞান মধ্যে বেদশাস্ত্রকে প্রেরণা দিয়াছিলেন ।
প্রশ্নঃ – কাহাদের জ্ঞান মধ্যে প্রেরণা দিয়াছিলেন?
উত্তরঃ – অগ্নি , বায়ু , আদিত্য ও আঙ্গিরা ঋষিদিগের মধ্যে ।
প্রশ্নঃ - তাঁহারাও ত জ্ঞান রহিত জড় পদার্থ ছিলেন ?
উত্তরঃ - না না এরূপ বাক্য বলিবেন না , ইহারা সৃষ্টির আদি সময়ে শরীরধারী মনুষ্য ছিলেন , যেহেতু জড় পদার্থে জ্ঞানের কাৰ্য্য বা প্রকাশ অসম্ভব , এবং যে যে স্থানে অর্থ অসম্ভব হয় , তথায় লক্ষণা হইয়া থাকে , অর্থাৎ যে লক্ষণ ধরিলে , ঐ কাৰ্য্য বা অর্থ সম্ভব , তথায় তদনুযায়ী অর্থকরিতে হইবে । যেমন কোন সত্যবাদী ধর্মাত্মা বিদ্বান আপ্ত পুরুষ যদি বলেন যে , ক্ষেত্র মধ্যে মঞ্চ শব্দ করিতেছে ' , এস্থলে লক্ষণ দ্বারা এরূপ বুঝিতে হইবে , যে মঞ্চের স্বয়ং শব্দ করা অসম্ভব , অতএব মঞ্চস্থ কোন ব্যক্তি শব্দ করিতেছে । তদ্রপ ইহাও জ্ঞাত হইবেন যে , মনুষ্যেই বিদ্যার প্রকাশ হওয়া সম্ভব , অন্যত্র নহে । এবিষয়ে ( তেভ্যঃ ) ইত্যাদি শতপথ ব্রাহ্মণের প্রমাণ লিখিত আছে যে ( অগ্নি বায়ু , আদিত্য ও অঙ্গিরা ) এই চারি ঋষিগণের জ্ঞান মধ্যে পরমেশ্বর ( বেদ ) প্রেরণা দিয়া ছিলেন , পরে ঐ চারি ঋষি ব্রহ্মাদি ঋষিগণের মধ্যে চারি বেদ প্রকাশ করিয়াছিলেন ।
প্রশ্নঃ - ইহা সত্য বটে , যে ঈশ্বর ঐ ঋষিদিগকে জ্ঞান দান করিয়াছিলেন । পরন্তু তাহারা ( প্রথমে জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া পরে ) নিজ জ্ঞান দ্বারা বেদ রচনা করিয়া লইয়াছেন ?
উত্তরঃ – আপনার এরূপ বলা উচিত নহে । কারণ ঈশ্বর তাহাদিগকে কী প্রকার জ্ঞান প্রদান করিয়াছিলেন , তাহা কি আপনি অবগত আছেন ? পরমেশ্বর ঐ ঋষিগণকে ।বেদরূপ জ্ঞানই প্রদান করিয়াছিলেন ।
প্রশ্নঃ – তবে আমি জিজ্ঞাসা করি ,ঐ জ্ঞান ঈশ্বরের অথবা উক্ত ঋষিদিগের ?
উত্তরঃ - ঐ জ্ঞান ঈশ্বরেরই ।
প্রশ্নঃ – পুনঃ আপনাকে জিজ্ঞাসা করি , বেদ ঈশ্বর রচনা করিয়াছেন অথবা উক্ত ঋষিগণ ?
উত্তরঃ - যাহার জ্ঞান তিনিই তাহার প্রণেতা ।
প্রশ্নঃ - তবে আপনি কী জন্য শঙ্কা করিয়াছিলেন যে , উক্ত ঋষিগণই বেদশাস্ত্রের প্রণেতা ?
উত্তরঃ - এ বিষয় নিশ্চয় করিবার ও করাইবার জন্যই ঐরূপ শঙ্কা করিয়াছিলাম ।
প্রশ্নঃ - ঈশ্বর ন্যায়কারী অথবা পক্ষপাতী ?
উত্তরঃ - তিনি ন্যায়কারী ।
প্রশ্নঃ- তিনি যদি ন্যায়কারী তবে তিনি কীজন্য সকলের হৃদয়ে বেদ প্রকাশ করিলেন না , কেবল চারিজনের হৃদয়ে প্রকাশ করায় কি তাঁহার পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ হইল না ?
উত্তরঃ – ইহাতে ঈশ্বরে লেশমাত্র পক্ষপাতিত্ব আরােপিত হইতে পারে না , বরং ন্যায়কারী পরমাত্মার সম্যক্ ন্যায়েরই প্রকাশ হইয়াছে । কারণ যে ব্যক্তি যেরূপ কৰ্ম করে , তাহাকে তদনুযায়ী ফল প্রদান করাই ন্যায় ব্যবহারের কার্য বলা হয় । অতএব জানিবেন যে , উক্ত চারি ঋষিগণের এরূপ পূৰ্ব জন্মার্জিত পণ্য ছিল যে তাহাদিগের হৃদয়ে বেদ প্রকাশ করা ঈশ্বর উচিত বিবেচনা করিয়াই উহা প্রকাশ করিয়াছিলেন।
প্রশ্নঃ - এই চারি পুরুষই সৃষ্টির প্রথমেই উৎপন্ন হইয়াছিলেন । অতএব ইহাদিগের পূর্ব পূণ্য কোথা হইতে আসিল?
উত্তরঃ - জীব , জীবের কর্ম ও জগতের কারণ ( প্রকৃতি ) এই তিনই অনাদি । জীব ও কারণ জগৎ স্বরূপতঃ অনাদি এবং জীবের কৰ্ম ও প্রকৃতি ইঁহারা প্রবাহরূপে অনাদি , এবিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রমাণসহকারে পরে লিখিত হইতেছে ।
প্রশ্নঃ - গায়ত্র্যাদি কি ঈশ্ববই রচনা করিয়াছেন ?
উত্তরঃ – আপনার এরূপ সংশয় কোথা হইতে আসিল ?
প্রশ্নঃ - আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি যে , গায়ত্র্যাদি ছন্দ রচনা করিবার জ্ঞান কি ঈশ্বরের নাই ?
উত্তরঃ – ঈশ্বর সর্ব বিদ্যাযুক্ত হেতু তাঁহার গায়ত্র্যাদি ছন্দ রচনার জ্ঞান আছে। সুতরাং আপনার এরূপ সংশয় করা নিরর্থক জানিবেন ।
প্রশ্নঃ - চতুর্মুখব্রহ্মা বেদ রচনা করিয়াছেন , এরূপ ইতিহাস আমরা শুনিতে পাই?
উত্তরঃ - আপনার এরূপ কথা সঙ্গত নহে । কারণ ঐতিহাসিক প্রমাণ শব্দ প্রমাণের অন্তর্গত ন্যায়শাস্ত্রে গােতমাচার্য সত্যবাদী সাক্ষাৎকৃতধর্মা , বিদ্বান্ ব্যক্তির উপদেশকেই শব্দ প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন এবং যাহা শব্দপ্রমাণযুক্ত , তাহাকেই ঐতিহ্য বা ঐতিহাসিক প্রমাণ বলা যায় । বাৎসায়ন মুনি ন্যায়ভাষ্যে আপ্তের লক্ষণ লিখিয়াছেন যে , যিনি সাক্ষাৎ সমস্ত পদার্থ বিদ্যার জ্ঞাতা , কপটতাদি রহিত ও ধর্মাত্মা ,যিনি সত্যবাদী , সত্যমানী ও সত্যকারী এবং যিনি পূর্ণ বিদ্যাযুক্ত ও দয়াপরবশ হইয়া স্বেচ্ছায় পরােপকারার্থে ও সকলের সুখ বৃদ্ধির জন্য নিজ নির্ভ্রান্ত জ্ঞান অপরকে প্রদান করেন এবং যিনি পৃথিবী হইতে পরমাত্মা পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের যথাবৎ সাক্ষাৎ করিয়াছেন ও যিনি তদনুযায়ী নিজ আচরণের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন , এরূপ শুভ গুণকেই আপ্তি বলা হয় । এইরূপ আপ্তি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠগুণযুক্ত মনুষ্যকেই ' আপ্ত ' বলা হয় । এইরূপে আপ্তের বচন বা উপদেশই শব্দপ্রমাণ বলা হইয়া থাকে । আপ্তের লক্ষণের বিপরীত লক্ষণযুক্ত মনুষ্যের বাক্য শব্দপ্রমাণ নহে , যেহেতু সত্য বৃতান্তকেই ইতিহাস বলা হয়, অসত্য বৃতান্ত ইতিহাস নহে । এই কারণে যে সকল ইতিহাস সত্যপ্রমাণযুক্ত তাহাই গ্রহনীয় ও যাহা অসত্য তাহা অগ্রাহ্য । প্রমাদযুক্ত পুরুষ লিখিত মিথ্যা বৃত্তান্ত কদাপি গ্রাহ্য হইতে পারে না । এজন্য ব্যাসদেব চারি বেদ সংহিতা ভাগকে সংগ্রহ করিয়াছেন ইত্যাদি ইতিহাস বা বৃত্তান্তকে সদা মিথ্যা বলিয়া জানিবে । এইরূপ আজকালের নবীন ব্রহ্মবৈবর্তাদি পুরাণ ও ব্রহ্ময়ামল আদি তন্ত্র গ্রন্থাদির লিখিত বৃত্তান্তকে কদাপি প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করা মনুষ্যের কর্তব্য নহে , কারণ এই সকল পুস্তকে অসম্ভব , অপ্রমাণ ও কপােল কল্পিত মিথ্যা ইতিহাসরূপ অনেক কথা লিখিত আছে , অতএব শতপথ ব্রাহ্মণাদি সত্যগ্রন্থে ইতিহাস বা লিখিত বৃত্তান্তকে কদাপি মিথ্যা বলিয়া ত্যাগ করা কর্তব্য নহে।
প্রশ্নঃ - বেদমন্ত্র ও সূক্তে যে সকল ঋষির নাম লেখা আছে তাঁহারা কী জন্য বেদ রচনাকারী হইবেন না?
উত্তরঃ- এরূপ বলিবেন না, যেহেতু ব্রহ্মাদি ঋষিগণও বেদাধ্যয়ন করিয়াছিলেন। এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে লিখিত আছে যে
পরমাত্মা ব্রহ্মাকে উৎপন্ন করিয়া সৃষ্টির আদিতে অগ্নি বায়ু আদি ঋষি দ্বারা বেদের উপদেশ করিয়াছেন, সেই পরমেশ্বরের আশ্রয় যেন আমরা প্রাপ্ত হই । এমন কি যখন মরীচ্যাদি ঋষি এবং ব্যাসাদি মুনিগণের জন্ম পযর্ন্ত হয় নাই তখনও ব্রহ্মাদির নিকটে বেদশাস্ত্র বর্তমান ছিল এবিষয়ে ভগবান মনু বলিয়াছেন যে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরার নিকট হইতে ব্রহ্মা ঋষিও বেদপাঠ করিয়াছিলেন, তখন ব্যাসাদি বা আমাদিগের কথাই আসিতে পারে না।
প্রশ্নঃ - ঋগ্বেদাদি সংহিতার বেদ ও শ্রুতি এই দুই নাম কী জন্য হইল ?
উত্তরঃ – অর্থভেদ হেতু । কারণ এক ( বিদ্ ) ধাতুই জ্ঞানার্থ , সত্যার্থ , লাভার্থ ও বিচারার্থ এই চারি প্রকার অর্থ বাচক হইয়া থাকে । তৎপরে ঐ " বিদ " ধাতু করণ এবং অধিকরণ কারকে “ ঘঞ্ প্রত্যয় ’' করিলে “ বেদ ’ ’ শব্দ সিদ্ধ হইয়া থাকে । এইরূপ ( শ্রু ) ধাতু শ্রবণ অর্থ বাচক , ইহাতে করণ কারকে
‘ ‘ ক্তিন্ ' ' প্রত্যয় করিলে “ শ্রুতি " পদ সিদ্ধ হয় । যাহা পাঠ করিলে মনুষ্যগণ সমস্ত সত্য বিদ্যার জ্ঞাতা হন , যাহা পাঠ করিলে লােকে বিদ্বান হইতে সমর্থ হন ও যদ্বারা মনুষ্যেরা সত্যাসত্যের বিচার করিতে সমর্থ হন তাহাকে বেদ বলে । এজন্যই ঋগ্বেদাদি সংহিতার নাম বেদ সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে । পুনশ্চ সৃষ্টির আদি হইতে আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাদি হইতে যাবতীয় মনুষ্য সকলেই যদ্বারা সত্যবিদ্যা শ্রবণ করিয়া আসিতেছেন তাহাকে শ্রুতি বলে এবং এইজন্যই সংহিতা বা বেদকে শ্রুতি বলা হয় । আজ পর্যন্ত কোন ব্যক্তিই কোন দেহধারীকে বেদের প্রণেতা বলিয়া শুনেন নাই , ইহারই বা কারণ কী ? এজন্যই বেশ বুঝা যাইতেছে যে , নিরাকার ঈশ্বর হইতেই বেদের উৎপত্তি বা প্রকাশ হইয়াছে । এবং এই কথাই আমরা লােক পরম্পরায় শুনিয়াও আসিতেছি । পুনশ্চ যেমন কোন ব্যক্তি বাদ্যযন্ত্র বাজাইয়া থাকেন অথবা কাষ্ঠ পুতুলকে নৃত্য করাইয়া থাকেন , সেই প্রকার পরমেশ্বর বেদের প্রকাশার্থে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চারি জন ঋষিকে নিমিত্ত মাত্র করিয়াছিলেন। এই ঋষিদিগের নিজ জ্ঞান দ্বারা বেদের উৎপত্তি বা প্রকাশ হয় নাই। কিন্তু বেদের যাবতীয় শব্দার্থ সম্বন্ধপূর্ণ ও বিদ্যাযুক্ত পরমেশ্বর নিজ জ্ঞান বলেই উপরোক্ত ঋষিদিগের দ্বারা প্রকট করিয়াছেন। এতদ্দ্বারা ইহাই সিদ্ধ হইতেছে যে, পরমেশ্বর মনুষ্যদেহধারী অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চারি ঋষিগণের হৃদয়ে বেদের প্রকাশ করিয়াছেন।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ