বেদের শাখা ও বিন্যাস - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

09 February, 2024

বেদের শাখা ও বিন্যাস

সংহিতার অর্থ করতে গিয়ে মাণিণি মুনি অষ্টাধ্যায়ী ১।৪।১০৮ এ বলেছেন "পরঃ সন্নিকর্ষঃ সংহিতা" অর্থাৎ "পদান্তাস্পদাদিভি যৎসা"_ পদের শেষকে অন্য় পদের শুরুর সাথে সন্ধিনিয়মে বন্ধন করার নাম সংহিতা। পদসমূহের বাস্তবিক অবত্থার নাম সংহিতা। আদিসৃষ্টিতে সংহিতা সমূহই ছিলো, পদ আলাদা ছিলো না। সমস্ত মন্ত্র সন্ধিযুক্তই ছিলো, পরে বেদার্থ করবা প্রয়োজনে সন্ধিচ্ছেদ করা হয়েছে।

যজুর্বেদ সংহিতার আদি ও প্রাচীনতম অংশটিতে ১,৯৭৫টি মন্ত্র রয়েছে। যজর্বেদের দুইটি বিভাগ, কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়-সংহিতা এবং শুক্লযজর্বেদ বা বাজহনেয় সংহিতা। কৃষ্ণযজুর্বেদ শুক্লযজর্বেদের পূর্ববর্ত্তী। যজুর্বেদের অন্তর্গত শুক্ল যজুর্বেদের ১৬টি শাখার কথা জানা যায়। অন্যদিকে কৃষ্ণ যজুর্বেদের সম্ভবত আনুমানিক প্রায় ৮৬টি শাখা ছিল। শুক্ল যজুর্বেদের মাত্র দুটি শাখাই এখন বর্তমান, এদুটি হল: মধ্যণ্ডিন ও কান্ব। উক্ত শাখাদুটি প্রায় একই রকম। শুধুমাত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে এগুলির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের চারটি শাখা অধুনা বর্তমান, এগুলির বিভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যায়। যজুর্বেদের লুপ্ত শাখাগুলি হল: জাবালা, বৌধ্য, সপেয়ী, তাপনীয়, কাপোল, পৌণ্ড্রবৎস, অবতী, পরমাবটিকা, পরাশর, বৈনেয়, বৈধেয়, কাত্যায়ন ও বৈজয়বপ।

শুক্ল যজুর্বেদের শাখাসমূহ 

শাখার নামঅধ্যায়অনুবাকশ্লোকসংখ্যাসংশ্লিষ্ট অঞ্চল

মধ্যণ্ডিন৪০৩০৩১৯৭৫বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, উত্তর ভারত
কান্ব৪০৩২৮২০৮৬মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অধুনা বর্তমান চারটি শাখা হল তৈত্তিরীয় সংহিতা, মৈত্রয়ানী সংহিতা, কঠ সংহিতা ও কপিস্থল সংহিতা।
শাখার নামউপশাখার সংখ্যাকাণ্ডপ্রপাঠকমন্ত্রসংখ্যাসংশ্লিষ্ট অঞ্চল
তৈত্তিরীয়৪২দক্ষিণ ভারত
মৈত্রয়ানী৫৪পশ্চিম ভারত
কঠক (চরক)১২৪০৩০৯৩কাশ্মীম, উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত
কপিস্থল৪৮হরিয়ানা, রাজস্থান
এই শাখাগুলির মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বাধিক সুসংরক্ষিত শাখাটি হল তৈত্তিরীয় সংহিতা। যজুর্বেদের প্রতিটি আঞ্চলিক শাখায় গ্রন্থের অংশ হিসেবে সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ্‌ রয়েছে। মূল গ্রন্থের সঙ্গে একাধিক শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র ও প্রতিশাখ্য রয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদের গ্রন্থবিন্যাস মধ্যণ্ডিন ও কান্ব শাখাদ্বয়ে একই রকম। কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র, পরস্কর গৃহ্যসূত্র ও শুক্ল যজুর্বেদ প্রতিশাখ্য এই অংশের সঙ্গে যুক্ত।

বেদের শাখাবিভাগকর্তা-অপান্তরতমা [মহর্ষি ব্যাসদেবের পূর্ববর্তী]
(ক) আচার্য শংকর তার বেদান্তসূত্র ভাষ্য ৩/৩/৩২ এ লিখেছেন -
তথা হি - অপান্তরতমা নাম বেদাচার্যঃ পুরাণর্ষিঃ বিষ্ণুনিয়োগাৎ কলিদ্বাপরয়োঃ সন্ধৌ কৃষ্ণদ্বৈপায়নঃ সংবভূব ইতি স্মরন্তি। [দ্র০–৩/৩/৩২ পৃ.৩৩৫, ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য, মোতী লাল বনারসী দাস,১৯৬৪]
অর্থাৎ - অপান্তরতমা নামক বেদাচার্য ও প্রাচীন ঋষিই কলি-দ্বাপরের সন্ধিক্ষণে ভগবান বিষ্ণুর আজ্ঞাতে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন রূপে উৎপন্ন হয়॥
(খ) এই সম্বন্ধে অহির্বুধ্ন্যসংহিতা অধ্যায় ১১তে লেখা রয়েছে -
অথ কালবিপর্যাসাদ্ যুগভেদসমুদ্ভবে॥৫০॥
ত্রেতাদৌ সত্বসংকোচাদ্রজসি প্রবিজৃম্ভতে।
অপান্তরতমা নাম মুনির্বাক্ সম্ভবো হরেঃ॥৫৩॥
কপিলশ্চ পুরাণর্ষিরাদিদেবসমুদ্ভবঃ।
হিরণ্যগর্ভো লোকাদিরহং পশুপতিঃ শিবঃ॥৫৪॥
উদ্ভূত্তত্র ধীরুপমৃগ্যজুঃ সামসংকুলম্।
বিষ্ণুসংকল্পসংভূতমেতদ্ বাচ্যায়নেরিতম্॥৫৮॥
[দ্র০–অধ্যায় ১১,পৃ.১০০,১০১, সম্পাদক রামানুজাচার্য, অড্যার ১৯৬৬]
অর্থাৎ - বাক্ এর পুত্র বাচ্যায়ন অপরনাম ছিল অপান্তরতমা। (কালক্রমের বিপর্যয় হওয়াতে ত্রেতাযুগের আরম্ভে) বিষ্ণুর আজ্ঞাতে অপান্তরতমা, কপিল ও হিরণ্যগর্ভ আদি জন ক্রমশঃ ঋগ্যজুঃ, সামবেদ, সাংখ্য শাস্ত্র এবং যোগ আদির বিভাগ করেন।
অহির্বুধ্ন্য সংহিতা শঙ্করাচার্যের থেকেও অধিক প্রাচীন সময়ের।
(গ) এই অহির্বুধ্ন্য সংহিতার থেকেও অনেক পূর্বের মহাভারতে বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়কে বলছেন -
অপান্তরতমা নাম সুতো বাক্ সম্ভবো বিভোঃ।
ভূতভব্যভবিষ্যজ্ঞঃ সত্যবাদী দৃঢ়ব্রতঃ॥৩৮॥
তমুবাচ নতং মূর্ধ্না দেবানামাদিরব্যয়ঃ।
বেদাখ্যানে শ্রুতিঃ কার্যা ত্বয়া মতিমতাং বর॥৪০॥
তস্মাৎকুরু যথাজ্ঞপ্তং ময়ৈতদ্বচনং মুনে।
তেন ভিন্নাস্তদা বেদা মনোঃ স্বায়ম্ভুবেঽন্তরে॥৪১॥
অপান্তরতমাশ্চৈব বেদাচার্যঃ স উচ্যতে ।
প্রাচীনগর্ভ তমৃষিং প্রবদন্তীহ কেচন ॥৬১॥
[দ্র০–অধ্যায় ৩৩৭, মহাভারত, ভ০ ও০ রি০ ই০, পূনা।]
এই শ্লোকগুলোর এবং মহাভারতের এই অধ্যায়ের অন্য শ্লোকগুলোর অভিপ্রায় এই যে অপান্তরতমা ঋষিকে বেদাচার্য অথবা প্রাচীনগর্ভ বলা হয়ে থাকে। তিনিই পূর্বে একবার বেদগুলোর শাখাবিভাগ করেছিলেন।
অপান্তরতমার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রন্থও ছিল। যোগিযাজ্ঞবল্ক্যতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
[দ্র০–যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি অপরার্ক টীকা। তথা ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, পাদ ২, অধ্যায় ৩৫, শ্লোক ২৪-১২৬ বেঙ্কটেশ্বর প্রেস, সংবৎ ১৯৯২বোম্বাই। এখানে ৩২ ব্যাসের নাম উদ্ধৃত করে অন্তে বলেন যে- এই ২৮ ব্যাস হয়ে গেছে] ।
সাতটি মহান সিদ্ধান্ত গ্রন্থের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। সেই অপান্তরতমাই যিনি একদিকে শাখাসমূহের প্রবক্তা ছিলেন, অন্যদিকে লৌকিকভাষাতে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রন্থের উপদেশ করতেন। এই ঐতিহাসিক তথ্যের বিরুদ্ধ পাশ্চাত্য কল্পিত ভাষা-মত মান্য নয়।
এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস হতে অনেক পূর্বেই বেদ বিভাগ বিদ্যমান ছিল এবং সম্ভবত বেদের অনেক চরণ বিদ্যামান ছিল। [দ্র০- বায়ুপুরাণ অধ্যায় ২৩, শ্লোক ১১৪ হতে সামনে ]। এই চরণ সামগ্রী ব্যাসের কাল পর্যন্ত এদিক-সেদিক বিকীর্ণ অবস্থায় ছিল। ব্যাস জী সেসবকে একত্রিত করে দেন এবং প্রত্যেক বেদের শাখা পৃথক-পৃথক করে দেন। এই শাখাগুলোর ব্রাহ্মণ ভাগগুলোতে নতুন প্রবচনও মিলিত করা হয়েছে॥
লেখকঃ পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত (Research Scholar)
গ্রন্থ : বৈদিক বাঙ্ময় কা ইতিহাস

যজুর্বেদ-সংহিতা দুটি স্পষ্ট শাখায় বিভক্ত—শুক্ল ও কৃষ্ণ। অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় যজুর্বেদের পুরোহিত যে সমস্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, শুক্ল যজুর্বেদে শুধু সেইগুলিই পাওয়া যায়। তাই শুক্ল যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণ’সমূহ স্বতন্ত্র রচনারূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও কৃষ্ণ যজুর্বেদের ‘ব্রাহ্মণগুলি প্রকৃতপক্ষে পরবর্তীকালে প্রথিত, গদ্যে রচিত নির্দেশমালা ও ব্যাখ্যাসমূহের ধারাবাহিক সংযোজন। কৃষ্ণ-যজুর্বেদে অনুষ্ঠানের বর্ণনা ও তার বিধিবদ্ধ ব্যাখ্যার সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের সূত্রগুলিও রয়েছে। মন্ত্র-বহির্ভূত অন্যান্য অংশে গদ্যে রচিত এবং ব্রাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহের পূর্বগামী। শুক্ল যজুর্বেদের একমাত্ৰ সাহিত্যকর্ম বাজসনেয়ী-সংহিতাটি দুটি শাখায় ঈষৎ ভিন্ন পাঠে পাওয়া যায়–কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন ; এই বিভাজন ‘ব্রাহ্মণ’-গ্ৰন্থগুলির মধ্যেও রয়েছে। অবশ্য শুক্ল যজুর্বেদ প্রতিশাখ্য এই দুটি ভাগকেই একসঙ্গে উল্লেখ করেছে। আলোচ্য শাখা দুটির মধ্যে কাণ্বই প্রাচীনতর। দুটি শাখার মধ্যে পাঠগত ভিন্নতার মূল কারণ ভৌগোলিক ; যখন এক প্ৰজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম এই শ্রুতি-সাহিত্য মৌখিকভাবে সঞ্চারিত হত, স্থানগত ভিন্নতায় স্বাভাবিকভাবেই পাঠও ভিন্ন হয়ে পড়ছিল। মাধ্যন্দিন শাখায় বাজসনেয়ী সংহিতা মোট ৪০টি অধ্যায়, ৩০৮ অনুবাক্‌ ও ১৯৭৫ কণ্ডিকায় বিভক্ত। প্ৰথম ২৫টি অধ্যায়ে সাধারণভাবে প্ৰচলিত যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠানবিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে—দর্শপুর্ণমাস (১-২), অগ্নিহােত্র অর্থাৎ প্ৰাতঃকালীন ও সায়ংকালীন সংক্ষিপ্ত যজ্ঞানুষ্ঠান (৩), সাধারণ সোমযাগ (৪-৭), সোমযাগের দুটি বিশেষ ধনন (৯-১০), যজ্ঞবেদী নির্মাণ ও যজ্ঞাগ্নিসমূহের আধান (১১-১৮), সৌত্ৰিমণী যাগ, ইন্দ্রের প্রতি নিবেদিত বিশেষ কিছু কিছু অনুষ্ঠান ও প্ৰায়শ্চিত্তের নানা যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানবিধির বিবরণ (১৯-২১) এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি (২২-২৫)। এদের মধ্যে প্রথম আঠাশটি অধ্যায় পরবর্তী সাতটি অধ্যায়ের তুলনায় প্রাচীনতর। সংহিতার দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ২৬–৩৫তম অধ্যায়। পরবর্তীকালে সংযোজিত ; তাই ভাষ্যকার মহীধর এই অংশকে ‘খিল’ বলে অভিহিত করেছেন। শেষ পাঁচটি অধ্যায় অর্থাৎ ৩৬-৪০ অধ্যায়সমূহে পুরুষমেধ, সর্বমেধ, পিতৃমেধ ও পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত প্ৰবর্গ্য যজ্ঞের বিধি সূত্রবদ্ধ হয়েছে। এই সমস্ত অধ্যায়ের কোনো কোনো অংশ স্পষ্টতই দার্শনিক ব্যঞ্জনাগর্ভ ; যেমন শতরুদ্রীয় নামক রুদ্রদেবের প্রতি নিবেদিত বিখ্যাত সূক্তটি (১৬শ অধ্যায়) ঋগ্বেদীয় পুরুষসূক্ত (৩১তম অধ্যায়) এবং ‘তদেব’ সূক্ত (৩২তম অধ্যায়)। এছাড়া ৩৪তম অধ্যায়ে ‘শিবসংকল্প’ নামক সুপরিচিত সূক্তটিতে নতুন এক ধরনের দেববাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। সংহিতার শেষ অধ্যায়টিই (৪০) ঈশোপনিষদ। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে যজ্ঞবিধি সম্পর্কিত রচনারূপে কৃষ্ণ-যজুৰ্বেদ সংকলিত হওয়ার ফলে তাতে বহু শাখার বিকাশ ঘটেছে ; কখনও অঞ্চল এবং কখনও পরিবারভেদে এই সংহিতায় পাঠগত ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি বা ছয়টি শাখার স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে– তৈত্তিরীয়, কাঠক, আত্ৰেয়, হরিদ্রাবিক, মানব এবং মৈত্রায়ণীয়। এদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূৰ্ণ তৈত্তিরীয় শাখা আপস্তম্ব ও বৌধায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ; মধ্যদেশে তার উৎপত্তি হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, বাজসনেয়ী শাখা উত্তর পূর্বকাশ্মীরে এবং কাঠক ও কপিষ্ঠল পাঞ্জাবে, মৈত্রায়ণীয় গুজরাট, বিন্ধ্য পর্বত ও নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এবং মানবশাখা ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কাঠক ও কপিষ্ঠল সংহিতা চারায়ণীয় (সাধারণভাবে চরকের সঙ্গে সম্পর্কিত) শাখার অন্তর্ভুক্ত। এই পাঠ বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এটি কৃষ্ণ ও শুক্ল যজুর্বেদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় করতে চেয়েছে। স্বভাবত স্বতন্ত্র এই পাঠ মোট পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত ; প্রথম তিনটি অধ্যায় আবার চল্লিশটি স্থানক বা উপবিভাগে বিভক্ত। চতুর্থ অধ্যায়টি বিভিন্ন ধরনের যে সমস্ত সম্পদের বিবরণ দিয়েছে, সে সব মূলত তাৎপৰ্যহীন। পঞ্চম বা শেষ অধ্যায়টি অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ দিয়েছে। আত্ৰেয়-সংহিতা মোটামুটিভাবে তৈত্তিরীয় শাখারই ভিন্ন পাঠ ; এতে কয়েকটি কাণ্ড রয়েছে–প্ৰত্যেকটি কাণ্ড কয়েকটি ‘প্রশ্নে’ এবং প্রত্যেকটি ‘প্রশ্ন’ কয়েকটি অনুবাকে বিন্যস্ত। মৈত্রায়ণীয় বা কলাপ শাখার পাঠ হরিদ্রাবিক বলে অভিহিত। যাঙ্কাচাৰ্য যজুর্বেদের ব্রাহ্মণরূপে একমাত্র মৈত্ৰায়ণীয় শাখারই উল্লেখ করেছিলেন, এতে মনে হয় তিনিই যজুর্বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মাণগুলিকে সুবিন্যস্ত করে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন।

আরণ্যক

সাধারণত প্রথাগতভাবে বৈদিক সাহিত্যকে দুটি প্রধানভাগে বিভক্ত করা হয়,–কর্মকাণ্ড (সংহিতা ও ব্রাহ্মণ) এবং জ্ঞানকাণ্ড (আরণ্যক ও উপনিষদ)। এই বর্গীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বেদের অন্য একটি সংজ্ঞাও স্মরণ করতে পারি : ‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম’, যেখানে বেদের দুটি ভাগ কল্পিত হয়েছে, মন্ত্র (বা সংহিতা) ও ব্রাহ্মণ। এই বিভাজনে আপাতদৃষ্টিতে আরণ্যক ও উপনিষদ উল্লেখিত হয় নি। দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই প্রচুর সত্য রয়েছে, তবে, দ্বিতীয় বর্গীকরণে বিষয়বস্তু অপেক্ষা আঙ্গিকের উপরেই যেন অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। কেননা, সংহিতা নিঃসংশয়ে একটি সাহিত্যমাধ্যম; পরবর্তী রচনাগুলির চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্যই তার নেই। ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক কিংবা আরণ্যক ও উপনিষদ কিংবা ব্ৰাহ্মণ ও উপনিষদের মধ্যে আমরা তেমন কোনো স্পষ্ট রচনাভঙ্গিগত ভেদরেখা কল্পনা করতে পারি না; মাঝে মাঝে এই তিন শ্রেণীর রচনা পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশ্রিত হয়ে পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করেছে। ফলে, মাধ্যমগত বিন্যাস অনুযায়ী আমাদের নিকট দুটি প্রধান ও স্পষ্ট শ্রেণী প্রকট হয়েছে-সংহিতা ও সংহিতাপরবর্তী সাহিত্য, যাতে ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ ইচ্ছামতো সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে, শ্রেণীবিন্যাসের দ্বিতীয় রীতি অর্থাৎ সৎহিতা পরবর্তী সাহিত্যিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে দুটি ভিন্ন যুগ, অঞ্চল বা ধর্মীয় দর্শনের মূল প্রতিফলিত হয়েছে। জ্ঞানকাণ্ডের সমগ্ৰ যুগ ধরে যজ্ঞানুষ্ঠানের ক্রমাগত অবমূল্যায়নের ফলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যদিও প্রত্যেক সংহিতার এক বা একাধিক পৃথক ব্ৰাহ্মণ রয়েছে, তবু প্ৰত্যেক সংহিতার কিন্তু নিজস্ব আরণ্যক বা উপনিষদ নেই। কয়েকটি গ্রন্থ। ব্রাহ্মণ অংশেই সমাপ্ত, আবার কয়েকটি গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে আরণ্যকে। তেমনি কয়েকটি সংহিতার অব্যবহিত পরবর্তী অংশ হ’ল উপনিষদ, আবার কয়েকটিতে কোনো আরণ্যকই নেই। শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ-সবই পাওয়া যাচ্ছে: ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকি এবং যজ্ববেদের তৈত্তিরীয়। সুতরাং যে শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী রচনার প্রধান এবং সর্বতোভাবে পরস্পর-নিরপেক্ষ দুটি মাধ্যম অৰ্থাৎ সংহিতা ও ব্ৰাহ্মণকে নির্দেশ করা হয়েছে, তারই যুক্তিযুক্ততা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত। শেষোক্ত সাহিত্যরীতির তরল্যায়িত অবস্থা একটি গ্রন্থের যৌগিক নামকরণে ব্যক্তি হয়েছে : কৌষীতকি ব্ৰাহ্মাণোপণিষদ; লক্ষণীয় এই যে, এতে আরণ্যক উল্লেখিত হয় নি। তেমনি জৈমিনীয় উপনিষদ, ব্ৰাহ্মণেও আরণ্যকের উল্লেখ নেই; তাছাড়া ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি এখানে উপনিষদের পরে ব্যবহৃত হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থটি বিচার করলে দেখা যায় যে, তালবকার শাখার আরণ্যকের বৈশিষ্ট্য এই গ্রন্থে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এসব থেকে সেই স্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যখন লেখকেরা নতুন ধরনের সাহিত্যিক প্রবণতা সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু পৃথক মাধ্যমরূপে নতুন রচনাগুলি তখনও নির্দেশিত বা বগীকৃত হয় নি। আরণ্যক নামটি সম্ভবত শুধু রচনার স্থানগত তাৎপৰ্যই বহন করছে, অর্থাৎ অরণ্যভূমি যা বহু অনুপুঙ্খাযুক্ত সুদীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত ছিল না; সেখানে অবসরপ্রাপ্ত গৃহস্ত্যদের উপযুক্ত ন্যূনতম কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভবত হত, যার মধ্যে সম্ভবত ছিল অগ্নিহোত্র ও কিছু কিছু সরল গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠান। এখানে যজ্ঞ থেকে উত্তীর্ণ ধর্মচারণ অর্থাৎ তত্ত্বান্বেষণের চর্চাই হত।


বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ গোল্ডস্টুকের আমাদের এই তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, শুধু অরণ্যে বসবাসকারী ব্যক্তি অর্থেই পাণিনি ‘আরণ্যক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ‘অরণ্যে রচিত গ্ৰন্থ’ অর্থে ‘আরণ্যক’ শব্দের প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন কাত্যায়ন–আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে; সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ঐ সময়ের কাছাকাছি আরণ্যক পৃথক প্রকাশ মাধ্যমরূপে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল। আঙ্গিক ও মূলভাবের বিচারে আরণ্যক ও উপনিষদকে যুগ পরিবর্তনের সাহিত্য বলে গণ্য করা যায়। আরণ্যকের প্রবণতা অরণ্যভূমির অধিবাসীদের জ্ঞান ও সন্ন্যাসের অন্বেষণের প্রতি, কারণ তখনও স্পষ্টভাবে কোনো মতবাদ এরা প্রচার করে নি; অথচ পরবর্তী যুগের উপনিষদে কখনাে নূতন মতবাদ প্রকাশের তাগিদ পরিস্ফুট হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ