ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্।
অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।।৫।। — গীতা ১২/৫
অভয়চরণারবিন্দ পাদ ভাষ্যঃ যাদের মন ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত, তাদের ক্লেশ অধিকতর। কারণ, অব্যক্তের উপাসনার ফলে দেহধারী জীবদের কেবল দুঃখই লাভ হয়।
উক্ত শ্লোকের পদার্থঃ — (তেষাম্) ওই (অব্যক্তাসক্তচেতসাম্) অব্যক্ত পরমেশ্বরের মধ্যে আসক্ত অর্থাৎ যুক্ত হওয়া পুরুষের (অধিকতরঃ) অধিক (ক্লেশঃ) ক্লেশ-দুঃখ আছে অর্থাৎ অব্যক্ত - অদর্শনীয় পরমেশ্বরের ভক্তদের বা সাধকদের আরও অধিক ক্লেশ সহণ করতে হয়। (হি) কারণ (অব্যক্তা) অপ্রকট/অদর্শনীয় (গতিঃ) গতি (দেহবদ্ভিঃ) দেহধারীদের থেকে (দুঃখম্) দুঃখের দ্বারা (অব+আপ্যতে) প্রাপ্ত করা হয়।
অর্থঃ — ওই অব্যক্ত পরমেশ্বরে আসক্ত অর্থাৎ যুক্ত পুরুষের অধিক ক্লেশ-দুঃখ অর্থাৎ অব্যক্ত অদর্শনীয় পরমেশ্বরের ভক্তদের বা সাধকদের অধিক ক্লেশ সহণ করতে হয় কেননা অপ্রকট / অদর্শনীয় গতি দেহধারীদের দুঃখ দ্বারা প্রাপ্ত হয়।
ভাবার্থঃ — যখন শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ এই গীতার দিয়েছিলেন তখনও কেবলমাত্র বেদোক্ত নিরাকার সনাতন ভক্তিই ছিল। অতঃ এই শ্লোকের মধ্যে সাকার ভক্তির বর্ণনা করাই উচিত নয়, অন্যথা ইহা বেদ, ভগবদ্গীতার উপদেশের বিরুদ্ধে চলে যাবে।
এই অধ্যায়ের অপর শ্লোকে বোঝানো হয়েছে যে, নিরাকার পরমেশ্বরে মনকে যুক্ত করে নিত্য বেদোক্ত অষ্টঙ্গ যোগ সাধনার দ্বারা ঈশ্বরের ভক্তি করতে হয় তবে সেই যোগী "যুক্তম্" অর্থাৎ এই সাধনা করতে করতে পরবর্তীতে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এই সাধনা দ্বারা প্রথমে যোগীর "সম্প্রজ্ঞাত-সমাধি" প্রাপ্ত হয়। সম্প্রজ্ঞাত-সমাধি চার প্রকার হয়, সংক্ষেপে এর বর্ণনা হল —
(০১) বিতর্ক — যার মধ্যে তর্ক সহিত সমস্ত স্থূল বিচার চিত্ততে হয়।
(০২) বিচারানুগত — যখন সূক্ষ্ম ভূতের বিচার চিত্ততে হয়।
(০৩) আনন্দানুগত — যখন স্থূল এবং সূক্ষ্ম উভয় বিচার সমাপ্ত হয়ে যায় এবং শরীরের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি হয়।
(০৪) অস্মিতানুগত — এই অবস্থায় যখন কেবলমাত্র নিজ স্বরূপকে জানতে পারে।
এই চার সমাধির এবং এর উচ্চতর অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনা ঈশ্বরের কৃপায় পাতঞ্জল যোগদর্শন (হিন্দী ব্যাখ্যা সহিত) ভাগ -১ এর সূত্র ১/১৭ তে করে দেওয়া হয়েছে। সমাধির বিস্তারিত জ্ঞানের জন্য পাঠক উক্ত পুস্তক অবশ্যই পড়ুন। হিন্দীতে লেখা হয়েছে পুস্তক এবং প্রত্যেক যোগ-শাস্ত্র সূত্রের হিন্দিতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
সম্প্রজ্ঞাত সমাধির বিষয়ে কথন করা চার অবস্থার উপর মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে জ্ঞাত হয় যে এই সমস্ত সাকার অবস্থা, নিরাকার নয়। এতে নিরাকার পরমেশ্বরের প্রাপ্তি নেই। আর না এই অবস্থায় মোক্ষ প্রাপ্ত হয় কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত করাও তো অতি আবশ্যক, কারণ ইহা ঈশ্বর প্রাপ্তির প্রারম্ভ। এই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির কঠোর অভ্যাসের পশ্চাতেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত হয়। যাঁর মধ্যে নিরাকার পরমেশ্বরের প্রাপ্তি হয়।
বেদের তথা পতঞ্জল যোগ শাস্ত্রের সূত্রের অধ্যায়ন দ্বারা জ্ঞান হয় যে সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে মন যুক্ত হয়ে থাকে কেননা ইহাতে দেহধারীদের অনুমান প্রাপ্ত হয়েই যায়। কিন্তু অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি তো পুন্য বৈরাগ্য এবং সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয় সংযম বা অষ্টঙ্গ যোগের প্রত্যেক অঙ্গের কঠোর হতে কঠোরতম সাধনার পশ্চাতেই ঈশ্বর কৃপায় প্রাপ্ত হয়। এই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ এই শ্লোকে বলছেন যে — হে অর্জুন অব্যক্ত পরমেশ্বর অর্থাৎ যা চক্ষু দ্বারা আমাদের দৃশ্যমান হয় না ওই পরমেশ্বরের সহিত চিত্ত যুক্ত করে যে যোগী অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত করার প্রয়াস করে তাঁর অধিক থেকে অধিকতর ক্লেশ হয়।
কারণ মনুষ্য সাকার শরীর ধারণ করে আছেন এবং এখন সে মনুষ্য অর্থাৎ সেই যোগী ধ্যান স্থির করতে চায় সেই পরমেশ্বরে যাঁর শরীরই নেই এবং না কখনো হতে পারে। যে পরমেশ্বর অনাদি কাল হতে নিরাকার ছিল, নিরাকার আছে এবং নিরাকারই থাকবে এবং বেদের মধ্যে এই নিয়মই আছে যে পরমেশ্বরের গুণ কর্ম স্বভাব কখনোই পরিবর্তন হবে না, তাহলে পরমেশ্বর নিজ নিরাকার রূপ পরিবর্তন করে সাকার রূপে কিভাবে আসতে পারে ?
অতঃ শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ এই শ্লোকে ইহাই বলেছেন যে, হে অর্জুন নিরাকার পরমেশ্বরের বেদ এবং যোগ বিদ্যা দ্বারা সাধনা করার সময় যোগী সাকার রূপ সম্প্রজ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত করেন, যাঁর বর্ণনা উপরে করা হল। কেননা এখন তারমধ্যে সংসারী তর্ক বিতর্ক, সংসারী সূক্ষ্ম বিচার এবং আনন্দ তথা নিজ রূপে স্থিত হতে হলে তো এই সমস্ত সাকার রূপ, এবং এই সাধকের অনুমান হয়ে যায় এবং ইহাকে প্রাপ্ত করায় ক্লেশ বা দুঃখ হয় না, যতো রকম বস্তু ওই নিরাকার পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত করার জন্য অর্থাৎ অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত করতে ক্লেশ বা দুঃখ হয়। শারীরিক, মানসিক তপ, ইন্দ্রিয় সংযম বৈরাগ্য তাঁর মধ্যে সংসার প্রায় বর্জিত হয়ে যায়, যাঁর বর্ণনা যোগ শাস্ত্রের ১/১৫,১৬ সূত্রতে বিস্তারিত ভাবে করা হয়েছে।
অতঃ অব্যক্ত অর্থাৎ অদর্শনীয় নিরাকার পরমেশ্বরের প্রাপ্ত করার জন্য যোগীর জীবনে নিত্য দুঃখই আর দুঃখ আসে যাকে তিঁনি হর্ষ সহিত সহণ করে, কারণ যিনি দেহধারণ করে আছেন এবং চক্ষু আদি ইন্দ্রিয় দ্বারা জন্ম জন্মান্তর হতে সাকার / মূর্তমান সূর্য, চন্দ্র, অন্ন, মাতা-পিতা আদি পদার্থকে দেখে এসেছেন সে দেহরহিত নিরাকার পরমেশ্বরে নিজ চিত্ত / মন / বুদ্ধিতে কি রূপে যুক্ত করবেন ?
অতঃ যখন সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হতে যোগী অগ্রসর হয় তখন প্রাণায়ম, প্রত্যাহার, ধারণাকে সিদ্ধ করে যোগশাস্ত্র ৩/১ সূত্র অনুসারে "দেশবন্ধস্য চিত্তস্য ধারণা" র নিরাকার মর্মকে নিজ যোগী গুরুর হতে বারংবার বুঝে নিয়ে কঠোর সাধনা দ্বারা অগ্রসর হয় এবং এই সাধনা সম্প্রজ্ঞাত সাধনা হতে অধিক হয়।
"অব্যক্ত+আসক্ত" এর ভাব হল — অব্যক্ত পরমেশ্বর - অদর্শনীয় নিরাকার পরমেশ্বর।
"আসক্ত" এর অর্থ হল — আসক্তি অর্থাৎ যুক্ত থাকা। অর্থাৎ যে নিরাকার পরমেশ্বরের সাধনাতে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি প্রাপ্ত করার জন্য যোগে যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় সর্বদা যুক্ত হয়ে আছেন। তাঁকে "দেহবদ্ভিঃ" এরূপ দেহধারী "অব্যক্তা" অর্থাৎ নিরাকার পরমেশ্বরের প্রাপ্তি "দুঃখম্ অবাপ্যতে" দুঃখ পূর্বক প্রাপ্ত হয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ