অনেক বিদ্বানগণের এরূপ বিচার রয়েছে যে, নাসদীয় সূক্ত (১০.১২৯) অদ্বৈতবাদকে সমর্থন করে। এবার এই কথার উপর বিচার-বিশ্লেষণ করা যাক -
নাসদীয় সূক্তের (১০.১২৯) সব মন্ত্রগুলোকে ধ্যানপূর্বক বিচার করলে দেখা যাবে যে এই সূক্ত অদ্বৈতবাদের প্রতিপাদন করছে না অপিতু ব্রহ্ম, অনেক-কর্মফল ভোক্তা জীব এবং স্বধা নামক প্রকৃতি সত্ত্বার স্পষ্ট নির্দেশ করছে বা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ এই সূক্তের ২ নং মন্ত্রে ব্রহ্মের নির্দেশ "আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাস।"
এই মন্ত্র তথা অন্য মন্ত্রসমূহে স্পষ্ট রয়েছে যে, সেই এক ব্রহ্ম প্রলয়াবস্থাতে সৃষ্টির উৎপত্তির পূর্বেও বিদ্যমান ছিল এবং তিনি স্বধার সহিত বিদ্যমান ছিলেন। সেই পরমাত্মার থেকে উৎকৃষ্ট আর কিছুই ছিল না। এখানে স্বধা এবং "তস্মাৎ হ অন্যৎ ন পরঃ কিঞ্চন আস" এই শব্দগুলোর ওপর মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। এই "স্বধা" শব্দটি এই সূক্তের ৫ নং মন্ত্রে এসেছে -
তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষাম্ অধঃ স্বিদাসী৩দুপরি স্বিদাসী৩ৎ। রেতোধা আসন্ মহিমান আসন্ স্বধা অবস্তাৎ প্রয়তিঃ পরস্তাৎ।।
সেই এক ব্রহ্ম স্বধার সাথে বিদ্যমান ছিল - এমনটা মন্ত্র-২ তে বলা হয়েছে। এই স্বধা শব্দের অর্থ সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকার সায়ণাচার্য, যে কিনা কট্টর অদ্বৈতবাদী ছিলো, তার বেদভাষ্যতে নিম্নপ্রকার করেছেন -
স্বস্মিন্ ধীয়তে ধ্রিয়তে - আশ্রিত্য বর্তত ইতি স্বধা মায়া তয়া তদ্ ব্রহ্ম একম্ অবিভাগাপন্নমাসীৎ সহযুক্তে প্রধান ইতি তৃতীয়া সহশব্দয়োগভাবেহপি সহার্থযোগে ভবতি অত্র প্রকৃতিপ্রত্যয়াভ্যাং তস্যাঃ স্বাতন্ত্র্যং নিবার্যতে।।
(সায়ণাচার্য কৃত ১০.১২৯.২ ভাষ্য)
অর্থাৎ স্বধা শব্দের অর্থ এখানে "স্বস্মিন্ ধীয়তে-ধ্রিয়তে - আশ্রিত্য বর্ততে" এই ব্যুৎপত্তির দ্বারা হলো "মায়া"। ব্রহ্ম সেই মায়া হতে অবিভক্ত ছিলেন। মায়া শব্দের অর্থ " মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যাৎ" (শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ ৪.২০) অনুসারে প্রকৃতি-ই হয়। অতএব ব্রহ্মের সহিত প্রকৃতি সত্ত্বার প্রতিপাদনও এখানে স্পষ্ট। প্রকৃতি চেতন ব্রহ্মকে ছাড়া স্বয়ং কার্য করতে অসমর্থ, অতএব তার স্বতন্ত্রতার নিষেধ স্বীকার করে নিতে কোনো ক্ষতি নেই। প্রকৃতি অচেতন হওয়াতে ব্রহ্মের আশ্রিত, কিন্তু এই নাসদীয় সূক্তের দ্বারাও তার সত্ত্বার অস্বীকার করা অসম্ভব। জীবাত্মাসমূহের অস্তিত্বেরও পঞ্চম মন্ত্রে প্রযুক্ত "রেতোধাঃ" এই শব্দ দ্বারা স্পষ্ট নির্দেশ করা হয়েছে। এই শব্দের অর্থ সায়ণাচার্যও নিম্ন প্রকার করেছেন -
রেতোধাঃ - রেতসো বীজভূতস্য কর্মণো বিধাতারঃ কর্তারো ভোক্তারশ্চ জীবাঃ।
অর্থাৎ বীজভূত কর্মের (যাদের সৃষ্টিতে পুনরায় জন্ম নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে) কর্তা এবং কর্মফলের ভোক্তা জীব, এমন অনেক জীব সত্ত্বার "রেতোধা আসন্" অর্থাৎ উক্ত সৃষ্টি রচনার পূর্ব অবস্থাতেও বীজভূত কর্মকারী ও কর্মফল ভোক্তা জীব বিদ্যমান ছিল, যা এই পঞ্চম মন্ত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অতএব তাকে অস্বীকার করাও অসম্ভব। জীবকেই প্রযন্তশীল হওয়ার কারণে "প্রয়তিঃ" এই নামে বলা হয়েছে। স্বধা অর্থাৎ প্রকৃতির (যাকে মায়া নামে অভিহিত করা হয়েছে) অপেক্ষা চেতন হবার কারণে প্রযন্তশীল জীব উৎকৃষ্ট, এই ভাব "স্বধা অবস্তাৎ প্রয়তিঃ পরস্তাৎ" (মন্ত্র ৫) ইত্যাদি শব্দের দ্বারা প্রকট করা হয়েছে, যার অর্থ সায়ণাচার্য "তত্র চ ভোক্তৃভোগ্যয়োর্মধ্যে (স্বধা) অন্ননামৈতৎ ভোগ্যপ্রপঞ্চঃ (অবস্তাৎ) অবরঃ নিকৃষ্টঃ আসীৎ (প্রয়তিঃ) প্রয়তিতা ভোক্তা (পরস্তাৎ) পরঃ উৎকৃষ্টঃ আসীৎ" ইত্যাদি শব্দে করেছেন। স্বধা শব্দের অন্ন অর্থ নিয়ে ভোগ্য-প্রপঞ্চ উহার তাৎপর্য নেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে স্বথা নিম্নে আছে আর প্রযন্তশীল ও কর্মফল ভোক্তা জীবাত্মা তার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।
এই প্রকার সূক্তটির মন্ত্রগুলো থেকে ব্রহ্মের অতিরিক্ত "স্বধা" নামের দ্বারা প্রকৃতি আর "রেতোধাঃ" নামের দ্বারা অসংখ্য জীবাত্মার সত্ত্বা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়। এভাবেই ব্রহ্ম, জীব এবং প্রকৃতি সত্ত্বার স্পষ্ট নির্দেশ এই নাসাদীয় সূক্তে থাকায় একে অদ্বৈতবাদ-প্রতিপাদক মনে করাটা ভ্রান্ত ধারণামাত্র। এই ভ্রান্তির এক মূখ্য কারণ "তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাস" (মন্ত্র ২) এর অর্থকে সঠিকভাবে না বোঝা। এতে যে "পরঃ" শব্দ এসেছে এর অর্থ পর অথবা অন্য - মনে করা হয় আর তখন এই অর্থ করা দেওয়া হয় যে, সেই ব্রহ্মের অতিরিক্ত আর কিছু ছিল না।
এখানে "পর" শব্দ নয়, কিন্তু "পরস্" (সাকারান্ত) শব্দ রয়েছে যা পরস্তাৎ বা উৎকৃষ্টের বাচক হয়; এজন্যে উহার অর্থ হবে যে (তস্মাৎ) সেই ব্রহ্ম অপেক্ষা (পরঃ) উৎকৃষ্ট (অন্যৎ) আর (হ) নিশ্চিতভাবে (কিঞ্চন ন আস) কিছু ছিল না। সায়ণাচার্যও এস্থলে "তস্মাৎ খলু পূর্বোক্তান্মায়াসহিতাদ্ ব্রহ্মণঃ (অন্যৎ কিঞ্চন) কিমপি বস্তু ভূতভৌতিকাত্মকজগৎ (ন আস) ন বভূব (পরঃ) পরস্তাৎ সৃষ্টেঃ ঊর্ধ্ব বর্তমানম্ ইদং জগৎ তদানীং ন বভূবেত্যর্থ" এই প্রকার অর্থ করেছেন অর্থাৎ সৃষ্টি তৈরির পশ্চাতে এই জগৎ তখন ছিল না। যেহেতু নাসাদীয় সূক্তে ব্রহ্ম, প্রকৃতি ও জীবাত্মার সত্ত্বার কথা রয়েছেই তাই এটা বলা উচিত হবে না যে পরমাত্মা অপেক্ষা অতিরিক্ত কিছু ছিল না বরং পরমাত্মার সমান বা উৎকৃষ্ট কিছু ছিল না এমনটাই নাসদীয় সূক্তের তাৎপর্য যেমনঃ-
ন কিরিন্দ্র ত্বদুত্তরো ন জ্যায়াং অস্তি বৃত্রহন্।
ন কিরেবং যথা ত্বম্।। - ঋ০ ৪.৩০.১
ন ত্বাবাং অন্য দিব্যো ন পার্থিবো ন জাতো ন জনিষ্যতে। - ঋ০ ৭.৩২.৩
ন তে বিষ্ণো জায়মানো ন জাতো দেব মহিম্নঃ পরমন্তমাপ। উদস্তভনা নাকমৃষ্বং বৃহন্তং দাধর্থ প্রাচীং ককুভং পৃথিব্যাঃ।। ঋ০ ৭.৯৯.২
ইত্যাদি মন্ত্রে বলা হয়েছে যে (১) হে পরমেশ্বর! তোমার থেকে উৎকৃষ্ট ও মহান কেউ নেই, তোমার সমানও কেউ নেই। (২) হে পরমেশ্বর! (ত্বাবান্) তোমার মতো (অন্য) আর কোনো (ন দিব্যঃ ন পার্থিবঃ) দিব্য এবং পার্থিব প্রাণী না আছে আর না হবে।।
এভাবেই বেদের অনান্য মন্ত্র থেকেও এটা স্পষ্ট হয় যে বেদ মতে পরমেশ্বরের সমান বা তার থেকে উৎকৃষ্ট কেউ নেই। ব্রহ্মের অনুপমতা এর দ্বারা প্রতিপাদন হয়, অদ্বৈতবাদের নয়। ব্রহ্মের অপেক্ষা জ্ঞান, শক্তি, পরিমাণে হীন স্বীকার করে তো আত্মাদের দিক থেকে অনেক প্রার্থনাসমূহ বেদে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ ঋগ্বেদ (৭.১০০.৫) তথা সাম০ মন্ত্র ১৬২৬ তে বলা হয়েছে - তং ত্বা গৃণামি তবসমতব্যান ক্ষয়ন্তমস্য রজসঃ পরাকে। অর্থাৎ আমি (অতব্যান্) অল্প (তবসং ত্বা গৃণামি) মহান তোমার স্তুতি করি, যিনি (অস্য রজসঃ পরাকে ক্ষয়ন্তম্) ইহ লোকের পড়েও সর্বত্র স্থিত রয়েছেন।
অভী ষতস্তদাভরেন্দ্র জ্যায়ঃ কনীয়সঃ। পুরুবসুর্হি মঘবনৎসনাদসি ভরে ভরে চ হব্যঃ।।
ঋ০ ৭.৩২.২৪। সাম০ মন্ত্র০ ৩০৯
অর্থাৎ হে (ইন্দ্র) পরমেশ্বর (জ্যায়ঃ) মহান তুমি (কনীয়সঃ অভীষতঃ আভর) ক্ষুদ্র এবং তোমার শরণে আগত আমাদের সবদিক থেকে জ্ঞান তথা শান্তি প্রাপ্ত করাও। (মঘবন্) জ্ঞান-ধন-সম্পন্ন তুমি (পুরুবসুঃ) অনেক ঐশ্বর্যবান (হি) নিশ্চিতরূপে (সনাত্ অসি) সনাতন-নিত্য (ভরে ভরে চ) প্রত্যেক যজ্ঞ ও সংগ্রামে তুমিই (হব্যঃ) পূজনীয় এবং আহ্বানের যোগ্য।।
এভাবেই এসকল মন্ত্রে পরমেশ্বরকে মহান (তবস ইতি মহন্নাম নিঘ০ ৩.৩) এবং নিজেকে অতব্যান্ - ক্ষুদ্র, পরমেশ্বরকে (জ্যায়ঃ) মহান ও জীবাত্মাদিগকে (কনীয়সঃ) ক্ষুদ্র বলে স্পষ্ট জীবেশ্বর-ভেদ প্রতিপাদন করা হয়েছে, যা থেকে অস্বীকার করা বেদ হতে নিতান্ত অনভিজ্ঞতা সূচিত করে। এমনইভাবে বিবেচনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে নাসদীয় সূক্ত (ঋ০ ১০.১২৯) তথা অন্য বেদমন্ত্রগুলোতে অদ্বৈতবাদ সিদ্ধ হয় না, কিন্তু ব্রহ্ম, জীবাত্মা এবং প্রকৃতি এই তিন অনাদি পদার্থের সত্ত্বারই সিদ্ধ হয়।।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ