পদবীর উৎস - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

24 October, 2023

পদবীর উৎস

১.'আইচ’ পদবিটি যে বীর্যবত্তা বা পারদর্শিতা অনুসারে দেওয়া হয়েছিল তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আইচ' শব্দটি এসে সংস্কৃত ‘আদিত্য' শব্দ থেকে। অর্থ ছিল অদিতিনন্দন। অদিতিনন্দনরা হলেন বিবস্বান, অর্যমা, পুষা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ ধাতা, বিধাতা, বরুণ, মিত্র, শত্রু ও উরুম। মােট বারােজন অদিতিনন্দনকেই বলা হয় আদিত্য। এই আদিত্য শব্দ থেকেই এসেছে আইচ শব্দটি। উগ্রক্ষত্রিয়, কৰ্ম্মকার, কায়স্থ, নমঃশূদ্র,পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, বারুজীবী, মােদক জাতির মধ্যে এই আইচ পদবিটি পরিলক্ষিত হয়।

২.আর্যদের ভারতে আসার পর থেকে তারা গুটি কয়েক পরিবার পিছু একটি করে গ্রাম গড়ে তুলেছিল। কুড়িটি করে গ্রাম নিয়ে তৈরি হয়েছিল এক একটি জন বা বিশ। এই সব জন বা বিশে, ভালাে মন্দ দেখার দায়িত্ব ছিল বিশপতি বা দলপতি, মান্ডলিক প্রমুখের হাতে। কখনাে সমাজে অপরাধমূলক কোনাে ঘটনা ঘটে গেলে বিচার পরিষদে তার বিচার হত। যাঁরা বিচার কাজে সাহায্য করতেন তাদের বলা হত দণ্ডকার বা দণ্ডপতি। এই দণ্ডপতিই ক্রমশ দিণ্ডা পদবিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। উচ্চারণভেদে তা হয়ে গেছে দিন্দা। সাধারণত মাহিষ্য ও নমঃশুদ্র জাতির মধ্যে এই দিন্দা পদবিটি লক্ষণীয় হয়।

৩.অর্থগত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ ‘আদৃত’ শব্দটির প্রতিশব্দ করতে চেয়েছেন ‘অধভাগদার'। শব্দগত উৎস থেকে বিচার করলে ‘আদক’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ আদি থেকে। সেই ব্যুৎপত্তি অনুসারে ‘আদ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় আদি বা সাবেক; কিংবা মূল। আদির অংশ বা মূলের অংশ হিসেবেও আদক শব্দটি এসে থাকতে পারে। কোথাও কোথাও আদক শব্দটি উচ্চারিত হয়ে থাকে আধক। বাংলায় যে সব জাতির মধ্যে আদক পদবিটি দেখা যায় তারা হলেন মাহিষ্য, কর্মকার, তিওর, নমঃশূদ্র, বাইতি, ব্যগ্রক্ষত্রিয়, রাজবংশী ক্ষত্রিয় ইত্যাদি।

৪.বসাক শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত তাঁত শিল্পী কিংবা তাঁতের কাপড় তাঁতরের কাপড় তৈরি ও ব্যবসা ইত্যাদি যাদের পেশা তারা তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। তন্তবায়দের মধ্যে আবার কয়েক শ্রেণী- বসাক, শেঠ, মল্লিক, হালদার ইত্যাদি। তন্তুবায়রা নবশায়ক। বসাক অর্থ আচ্ছাদন বা পরিধান। বসক থেকে বসাক শব্দের উদ্ভব বলে মনে করা হয় । বঙ্গীয় জাতিমালা গ্ৰন্থে গোবিন্দচন্দ্র বসাক বলেছেন, 'এদের উপাধি বারেন্দ্র সমাজে রায়, প্রামানিক রাঢ়ী সমাজে প্রামানিক, সাহা'। তিনি আরো বলেন যে, বারেন্দ্র তন্তুবায়গন সবাই বস্ত্রবয়ন কাজে এবং রাঢ়ী সকলেই কাপড়, সুতা কেনাবেচা, মহাজনি ও তেজারতি কারবারের লিপ্ত। পূর্বে যারা বানিজ্য- কাজে লিপ্ত থাকতেন তারা বসুক নামে পরিচিত ছিলেন ।

বস্তুবয়ন শিল্পের সঙ্গে বিশেষ করে তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বসাক পদবিটি বেশি দেখা যায়। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ কী! বসা শব্দটির একটি অর্থ নাবাল বা নিম্ন হওয়া। ঘরের মেঝে বসে ঘাওয়া অর্থে বসা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তাঁতযন্ত্র যখন কোথাও বসানাে হয় তখন তা মেঝে থেকে বেশ খানিকটা নীচে বসাতে হয়। সেখানে থেকেই বসা কিংবা বসাক কথাটি এসে থাকতে পারে। সাধারণভাবে তন্তুবায়, তন্তুবণিক, কর্মকার, বৈশ্যকপালী, যােগী, সদগােপ, নমঃশূদ্র ইত্যাদি জাতির মধ্যে বসাক পদবিটি দেখতে পাওয়া যায়। ‘বস’ শব্দ থেকেই বসাক পদবি এসেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
বস্ বা বসক শব্দের তাৎপর্য হল বস্ত্র সম্পর্কিত।

৫.সাধারণত গুহ পদবিটি দিয়ে কুলীন কায়স্থদের বােঝানাে হয়ে থাকে। কায়স্থ ছাড়া ভিন্ন কোনাে জাতির মধ্যে গুহ পদবিটি লক্ষ্য করা যায় না। গুহ পদবিটি উৎপত্তির পিছনে পৌরাণিক গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। পুরাণের গল্প অনুসারে দেবলােকে চিত্রগুপ্ত ছিলেন কায়স্থ। চিত্রগুপ্তের পরবর্তী বংশীয় রাজা ধর্মযজ্ঞ নিজের এগারােজন পুত্রকে বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন নৈমিষারণ্যে। সেখানে আটজন ঋষির অধীনে থেকে তারা বিদ্যাচর্চা করতে থাকেন। ধর্মযজ্ঞের যে পুত্র যে ঋষির আশ্রমে গিয়েছিলেন সেই ঋষির নাম অনুসারে তারা গােত্রের অধিকারী হলেন। নিজ নিজ গুণ ও কর্মের নিরিখে এই গােত্র ও তদনুসারে পদবি দেওয়া হত তাদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে শিষ্যের নাম ছিল গুহ্যক তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন কাশ্যপমুনির আশ্রমে। আশ্রমটির অবস্থান ছিল পর্বর্তকন্দরে বা গুহার অভ্যন্তরে। সেকারণে গুহ্যক স্বীয় শিক্ষালাভ সমাপন করবার পর গুহ উপাধি প্রাপ্ত হলেন। আলােচ্য পদবিটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে এই পৌরাণিক গল্পটির কথা শােনা যায়। গুহ পদবিটি কায়স্থ ছাড়া অন্য কোনাে জাতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না বললেই চলে।

৬.বেরা বা বেহারা নামের পদবিটি সম্ভবত বীররায় থেকেএসেছে বলে অনুমান করা হয়। বীররায় পদবি উদ্ভবের পিছনে যে ইতিহাসের কথা জানা যায়, একই ইতিহাস বহমান রয়েছে বেরা বা বেহারা পদবিটি উৎপত্তির ক্ষেত্রেও। সামন্তরাজাদের আমলে যে মল্লযুদ্ধের আয়ােজন করা হত, সেই প্রতিযােগিতামূলক খেলায় যিনি সেরা বিবেচিত হতেন তিনি সামন্তরাজার দেহরক্ষী হিসেবে সরাসরি নিয়ােগপত্র পেতেন। তাকে বীররায় উপাধি দেওয়ার চল ছিল। সেই বীররায় থেকেই বেরা বা বেহারা পদবিটির উদ্ভব বলে অনুমান করা হয়। সাধারণত মাহিষ্য, সদগােপ, করণ, করেঙ্গা, কুম্ভকার, কৈবর্ত, তিলি, নমঃশূদ্র, বাইতি, ব্যগ্রক্ষত্রিয়, মােদক, যাদব, রাজবংশীক্ষত্রিয়, শবর, সবিতৃ, হাড়ি ইত্যাদি জাতির মধ্যে বেড়া বেরা পদবিটি দেখা যায়।

৭.মুখােপাধ্যায়, মুখার্জি বা মুখুয্যে পদবি একমাত্র ব্রাহ্মণ জাতির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বাঁকুড়া জেলার অম্বিকা পরগনার মুকটী গাঞিনাম থেকে মুখ পদবিটির আবির্ভাব বলে মনে করে হয়। মুখ গাঞিনামের সঙ্গে উপাধ্যায় উপাধি যুক্ত হয়ে মখােপাধ্যায় পদবির জন্ম। আচার, বিদ্যা, বিনয়, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, আর তপঃ ও দান—এই নটি গুণে বিভূষিত ব্রাহ্মণদের উপাধ্যায় নামে চিহ্নিত করবার প্রথা ছিল। সেভাবেই গাঞিনাম মুখ এবং অর্জিত গুণ উপাধ্যায় যুক্ত হয়ে মুখােপাধ্যায় পদবির উদ্ভব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করবার মতাে বিষয় হল যজন যাজন অধ্যাপন এর সঙ্গে যুক্ত ব্রাহ্মণদের বলা হত আচার্য। যেমনভাবে ভট্ট + আচার্য থেকে ভট্টাচার্য পদবির উদ্ভব, সেই একই সাযুজ্যে মুখ + আচার্য/আচ্চারি = মুখাচ্চার্যি ও তা থেকে মুখার্জি পদবির উদ্ভব বলে অনুমান করা হয়। চলতি কথায় এই মুখার্জি বা মুখার্জীই পরিণতি পেয়েছে মুখুয্যে বা মুখুজ্যেতে।

এই প্রসঙ্গে আচার্য শব্দটির একটি স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আচার্য বলতে বােঝাত সেই ব্রাহ্মণকে যিনি উপনয়ন দিয়ে শিষ্যকে কল্প (যজ্ঞবিদ্যা) এবং রহস্য উপনিষেধের সঙ্গে বেদশাস্ত্র পড়াতেন। মুনি ঋষিরা এই বিশেষ ব্রতে রত ব্রাহ্মণদের অভিহিত করতেন আচার্য নামে। যিনি আচরণের শিক্ষা দিতেন তিনিই ছিলেন আচার্য। মুখটি নামক গাঞিনামের কোনাে ব্রাহ্মণ যদি এই বিশেষ বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকতেন তবে তার পরিচিতি ঘটত মুখাচার্য বা মুখাচার্যি নামে। সেখান থেকেই হয়তাে এসেছে মুখার্জি, মুখােপাধ্যায় বা মুখুজ্যের মতাে পদবিগুলি। আগেই বলেছি, এগুলি সবই ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া পদবি। ব্যতিক্রম হিসেবে কোথাও কোথাও মল্লক্ষত্রিয়, যােগী, নমঃশূদ্র ইত্যাদি জাতির মধ্যে এই পদবিগুলি লক্ষ্য করা যায়।

৮.কয়াল শব্দের দুটি অর্থ করা যেতে পারে এক. মাপদার বা ওজনদার,দ্বিতীয় অর্থ হিসাবরক্ষক। আখেরে অর্থ একটিই দাড়াচ্ছে। যিনি মাপ বা ওজন ঠিক করেন। কিংবা যিনি হিসাবকিতাব ঠিক রাখেন। কয়াল একটি আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় শব্দটির বানান ক্কাইল। আরবি ভাষায় ক্কাইল শব্দের অর্থ হল কথক। অর্থাৎ যিনি আড়তে মাল ওজন করবার সময় জোরে জোরে সকলকে পরিমাপটি শুনিয়ে দেন। কয়াল পদবিটি যে সব জাতির মধ্যে প্রচলিত রয়েছে সেগুলি হল—পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, রাজবংশী ক্ষত্রিয়, সবিতৃব্রাহ্মণ, মাহিষ্য, সদগােপ, কাশ্যপকাওরা, নমঃশূদ্র ইত্যাদি।

৯.বাঙালি ও মৈথিলী ব্রাহ্মন মধ্যে মিশ্র পদবির প্রচলন আছে। বিহারে এ পদবি মিশির। শ্রেষ্ঠ বা মান্য অর্থে মিশ্র ব্যবহৃত।

বাঙালিদের মধ্যে মিশ্র পদবিটির আবির্ভাব ঘটেছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য উড়িষ্যা থেকে। শােনা যায় একটা সময় নদীয়া জেলার নবদ্বীপ ছিল শিক্ষা সংস্কৃতির নক্ষত্রলােক। বিদ্যাশিক্ষা করবার জন্য ভারতবর্ষের নানাপ্রান্ত থেকে উৎসুক শিক্ষার্থীর্যাবছুটে আসতেন। নবদ্বীপে। যেমন চৈতন্যমহাপ্রভুর পিতা জগন্নাথ মিশ্র সংস্কৃত ন্যায়শাস্ত্র শিখতে উড়িষ্যা থেকে এসেছিলেন নবদ্বীপে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য হওয়ার কারণে মিশ্র পদবিধারী মানুষেরা বঙ্গদেশের সমাজজীবন, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকেন। সেভাবেই বাঙালিদের মধ্যে মিশ্র পদবীর উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করা হয়। মিশ্র প্রধানত ব্রাহ্মণদের পদবি। কিন্তু ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য যেসব জাতি কোথাও কোথাও মিশ্র পদবি ব্যাবহার করেন তারা কায়স্থ ,যোগী,সবিতৃব্রাহ্মণ, বৈদ্য,কর্মকার,নমঃশূদ্র ইত্যাদি। 

১০.অধিকারী শব্দটির যে আভিধানিক অর্থ তাকে দু'ভাগে দেখানাে যেতে পারে। অধিকারী শব্দটির মূলে রয়েছে অধিকার। এই অধিকার বলতে বােঝায় স্বত্ব, স্বামিত্ব, দখল, আধিপত্য বা কর্তৃত্ব। সে দিক থেকে বিচার করলে একমাত্র ক্ষত্রিয়দের মধ্যেই ‘অধিকারী’ পদবিটি প্রযােজ্য হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে অধিকারী শব্দের আরেকটি ভিন্ন অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যাঁরা যাত্রাদল, কীর্তনদল কিংবা থিয়েটার দলের অধ্যক্ষ বা কর্মকর্তা থাকতেন তাদের অধিকারী বলা হত। বৈষ্ণবসমাজের পূজ্য ব্যক্তিকেও অধিকারী সম্বােধন করবার প্রথা আছে।। ড. কামিনী কুমার রায় তাঁর ‘লৌকিক শব্দকোষ' গ্রন্থে অভিজাত সূচক যে সব পদবির তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে অধিকারী। পদবির সেই তালিকায় অধিকারীর পরে। রয়েছে আঢ্য, কীর্তি, কোঙার, ভদ্র, যশ, শীল, সর্দার, সাঁতরা, সেনাপতি, দিকপতি ইত্যাদি। 

স্বাধীন সুলতান আমলে(১৩৩৪-১৫৩৮)কোনো কোনো এলাকার স্বত্বাধিকারি, প্রধান ,শাসক ব্যক্তি পদবীতে ভূষিত হতেন। প্রাচীনকালে প্রত্যেক গ্রামে এরকম একজন করে অধিকারী থাকতেন।যেমন বলা যেতে পারে গৌড় অধিকারী।এভাবে অধিকারী পদবীটা এসেছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবজি বিক্রেতা সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকারী পদবী দেখা যায়। অধিকারী পদবিযুক্ত মানুষের পূর্বপুরুষ হলো শাস্ত্রধর্মে অধিকার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব কিংবা স্থানীয় শাসক অথবা সবজি ও খাদ্যশস্যের উপর অধিকার ও প্রধান্য বিস্তারকারী গোষ্ঠী।

১১.নন্দ ছিলেন পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা। একসময়ে মগধে নন্দ বংশ নামে বিখ্যাত ছিলেন মগধের রাজারা। 'নন্দ’ শব্দের  আভিধানিক অর্থ আনন্দ। নন্দ পদবিটি মগধের নন্দবংশের সঙ্গে কোনােভাবে সম্পৃক্ত কিনা তার কোনাে ইতিহাস নির্ভর প্রমাণ নেই। entertainer বা আনন্দদায়ক কোনাে পেশা থেকে এ পদবির জন্ম কিনা সমাজতত্ত্ববিদেরা তারও ঠিকঠাক কোনাে প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। তবে এইটুকু বলা যায় ব্রাহ্মণ, সবিতৃব্রাহ্মণ এবং কায়স্থের মত তথাকথিত উচ্চবর্ণের জাতির ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র নন্দ পদবিটি পরিলক্ষিত হয়।

১২.কোলে শব্দটি কুইল্যা থেকে সম্ভবত এসছে। ভিন্ন মত অনুসারে কল্যা শব্দের পরিবর্তিত রূপ কোলে হওয়াও আশ্চর্যের কিছু নয় । কোলে পদবির মধ্যে পড়ছে মাহিষ্য, যাদব, সদগােপ, ব্যগ্রক্ষত্রিয় ও নমঃশূদ্র ইত‍্যাদি।

১৩.অনুমান করা হয়ে থাকে যে, নষ্কর শব্দটি হয়তো এসেছে 'নিষ্কর'থেকে । নিষ্করভোগী সামন্তরাজাদের  উপাধি ছিল নষ্কর,   এমন অনুমানের কথা কোথাও কোথাও শােনা যায়। আর একটি মতে, লস্কর থেকেও নস্কর কথাটি এসে থাকতে পারে। লস্কর শব্দের অর্থ ছিল সৈন্য, ফৌজ কিংবা জাহাজের খালাসি। সামরিক বাহিনীতে বর্তমানে হাবিলদার বা সার্জেন্টকেও লস্কর বলা হয়ে থাকে। সাধারণত কাশ্যপকাওরা, নমঃশূদ্র, পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, ব্যগ্রক্ষত্রিয়, মাহিষ্য, সদগােপ, সভাসুন্দর, সাহা ইত্যাদি জাতির মধ্যে নস্কর পদবিটি দেখা যায়।

১৪.মনে করা হয় 'দে’ শব্দটি আদতে ‘দেব’ শব্দের অপভ্রংশ । পৌরাণিক গল্পে আছে স্বয়ং চিত্রগুপ্ত ছিলেন কায়স্থ। তার বংশের একজন রাজা ছিলেন ধর্মযজ্ঞ। ধর্মযজ্ঞ ছিলেন এগারােটি পুত্রের  জনক । পুত্রসন্তানদের বিদ্যাশিক্ষা দেবার জন্য ধর্মযজ্ঞ তাদের পাঠিয়ে দিলেন আটজন ঋষির আশ্রমে। আটজন ঋষির নাম হল—সৌকালীন, গৌতম, বিশ্বামিত্র, কাশ্যপ, মৌদ্গল্য,

ভরদ্বাজ, বাসুকি ও মুসোল। ধর্মযজ্ঞের যে পুত্রের নাম দুর্বাক্য, তিনি বিদ্যাশিক্ষার জন্য ছিলেন মৌদগল্য ঋষির আশ্রমে। দেবভক্তিতে অতুলনীয় পারদর্শিতার কারণে দুর্বাক্য উপাধি পলেন দেব। কায়স্থ জাতির ক্ষেত্রে এইভাবেই প্রথমে দেব গরপর তা থেকে দে পদবি টির আবির্ভাব। কায়স্থ ছাড়াও দে পদবি অন্যান্য যে সব জাতির মধ্যে দেখা যায় তারা হল- উগ্ৰক্ষত্রিয়, কর্মকার, কাশ্যপকাওরা, কৈবৰ্ত্ত, কংসবণিক,  তন্তুবায়, তাম্বুলিবণিক, তিলি, নমঃশূদ্র, বারুজীবী,বৈশ‍্যকপালী, বৈশ্যতেলী, মালী, মাহিষ্য, মালাকার , মোদক, সবিতৃব্রাহ্মন,সুবর্ণবণিক, সূত্রধর ইত্যাদি।

১৫. আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ ও সুবর্নবণিকদের মধ্যে বড়াল পদবি লক্ষ করা যায়।বড়াল বা বড়ালি একটি গ্রামনাম । বড়ালি আবার এক ধরনের গাছ যা বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে পরিচিত। আমরা জানি শাণ্ডিল্য গোত্রের ব্রাহ্মণদের একটি গ্রামনাম বা গাঞি হলো বটব্যাল বা বড়াল। মূল বাসগ্ৰাম পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে। বটব্যাল নামটি অপভ্রংশ বড়াল নামে খ্যাত। এক্ষেত্রে বলা যায় যে বড়াল পলবি নি়ঃসন্দেহে গ্ৰামনাম থেকে উদ্ভূত। বৈড়াল শব্দের অর্থ বড়শিওয়ালা। বৈড়াল একটি পেশাগত পদবি।এরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বছরের অধিকাংশ সময় এরা নৌকায় বাস করে। মন্সিগঞ্জ, কুমিল্লার হোমনা, সিলেটের ভাটি অঞ্চল ইত্যাদি এলাকায় হিন্দু ও মুসলিম বৈড়াল পদবির মানুষের বাস লক্ষনীয়।

১৬. কাজী আরবি শব্দ। সুলতানি ও মোগল আমলে বাংলাদেশে কাজীরা ছিলেন বিচারক ও ব্যবস্থাপক। তারা মহাল তথা পরগনায় কর্মরত থাকতেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার এবং প্রয়োজনে আইনের ব্যাখ্যা প্রদানের কাজ তারা করতেন। মোগল আমলে প্রত্যেক পরগনা একজন করে কাজী থাকতেন বলে আবুল ফজলের( ১৫৫১ - ১৬০২ খ্রিঃ) আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে পাওয়া যায়।

১৭. লোকেশ্বর বসু অনুমান করেন লাহা,রাহা, নাহা, ইত্যাদি পদবি একই শব্দের রূপভেদ। কিন্তু এসব মানুষের বেশিরভাগের বাসস্থল দৃষ্টে সেরূপ মনে হয় না। তবে লাহা শব্দটি এসেছে লাক্ষা থেকে। মনে হয় লাহাদের পূর্বপুরুষ ছিল লাক্ষা ব্যবসার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আবার হিন্দিতে লাক্ষা সংস্কৃতে রাক্ষা নামেও পরিচিত। এই রাক্ষা শব্দের অপভ্রংশ রাহা হতেও পারে। লাহা শব্দ কোনো স্থানে উচ্ছারণে নাহা হতে পারে। ফারসি রাহ্ হলো রাস্তা আর রাহাগর হলো ভ্রমণ বা ভ্রমণকারী। ভ্রমণকারী হিসাবেও রাহা পদবির উৎপত্তি হতে পারে। ভ্রমণ সংক্রান্ত পেশার সাথেও রাহার সম্পর্ক থাকতে পারে অতীতে। ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরায় নাহা পদবির মানুষ আছেন। নাহা শব্দটি সংস্কৃত নাথ থেকে এসেছে যার অর্থ প্রভু বা মালিক। প্রাকৃত শব্দ ণাহ এবং ব্রজবুলি ও বাংলায় নাহ বা নাহা

১৮. মহান্ত, মোহন্ত বা মোহান্ত পদবিধারীরা সাধারণত বৈষ্ণব আদর্শে অনুপ্রাণিত মানুষ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ মনে করেন যে, যার মোহ (সংসার বা বিষয়- সম্পদের মোহ) অন্ত বা শেষ হয়েছে তিনিই মোহান্ত। মন্দির, টোল, বিদ্যাপীঠ, সন্ন্যাসীদের আখড়া তথা মঠের পরিচালক বা অধ্যক্ষকে মহন্ত বলা হয়। নবধাভক্তিযুক্ত বা কৃষ্ণভক্তকেও মহান্ত নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।কৃষ্ণের প্রতি নবধা(নয়টি) ভক্তির লক্ষণ হলো- অর্চন, বন্দন, দাস্য, সেবন, স্মরণ, কীর্তন, শ্রবণ, সখ্য ও আত্মা-নিবেদন। মহন্ত কোথাও মহান্তি( যেমন উড়িষ্যা ও আসামে) আবার কোথাও মাইতি হিসেবে পরিবর্তিত।

১৯. মিত্র হলো মূল নামের শেষ অংশে ব্যবহৃত শব্দ যা পরবর্তীতে পদবীতে রূপান্তরিত । মিত্র শব্দে বন্ধু বোঝায়। আবার মিত্র হলেন আর্যদের উপাস্য সূর্যদেবতা ।প্রাচীন ইরানীদের কাছে তিনি মিথ্র বা মিহির বা মেহের।

২০. সেন হলো বীরত্বব্যঞ্জক উপাধি। সাধারণত সেন একটি অন্ত্যনাম। কারন সেনা শব্দটি সমাসে সেন হিসাবে উওরপদে উচ্চারিত হয়। ফারসি সর শব্দের অর্থ প্রধান। সর -ই- নৌবত বা নৌসেনাপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন সরনোবত বা সেরনিয়াবত। মহারাষ্ট্রে সরনোবত ছিলেন সর্বসেনাধ্যক্ষ বা প্রধান সামরিক সচিব।

২১. পাঠক উপাধিধারী বাঙালি দুর্লভ নয় । সংস্কৃত পাঠক শব্দের অর্থ হলো পাঠকারী, আবৃত্তিকারী, ছাত্র, পড়ুয়া, পুরাণ পাঠকারী, কথক, উপাধ্যায়, শিক্ষক বা অধ্যাপক। তবে পুরাণ বা ধর্মগ্ৰন্থ পাঠকারী ও কথকদের সাধারণ পরিচয় ছিল পাঠক হিসেবে।

২২. প্রাচীনকালে রাজদরবারে রাজা এবং গন্যমান্য সভাসদগনের উপস্থিতিতে বেদ ও শাস্ত্রধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতেন জ্ঞানী ব্রাহ্মণেরা। শাস্ত্র ব্যাখ্যাকালে আয়োজিত সভা বা চক্রে উপস্থিত হয়ে ঐ ব্রাহ্মণ এই মহৎ কাজটি করতেন বলে তাকে চক্রবর্তী বলা হতো । চক্রবর্তী উপাধি বাঙালি ব্রাহ্মণদের মধ্যেই লক্ষ করা যায়।

২৩. সরকার শব্দটি ফার্সি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভু ,মালিক, ভূস্বামী ,শাসনকর্তা ,রাজা । অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারীও সরকার ।মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এ পদবী দেওয়া হত। প্রধান কর্মচারী এবং সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিকে সরকার বলা হতো।

২৪. আরবি শব্দ মজুম আর ফার্সি শব্দ দার থেকে এসেছে মজুমদার।মজুমদার অর্থ সমষ্টি বা যোগফল বাদশাহী আমলে যারা রাজস্ব-সংক্রান্ত হিসাবপত্র করার দায়িত্ব পালন করত ,তারা মজুমদার নামে পরিচিত হতেন। এদের কাজ ছিল হিসাবপত্র রক্ষা করা ,অনেকটা ট্রেজারার কিংবা অডিট সুপারের মতো ।
আমাদের দেশে মুসলমান ছাড়া ও হিন্দুব্রাহ্মণ -অব্রাহ্মণ প্রায় সব সম্প্রদায়ের মধ্যে অতীতকাল থেকে চলে আসা পেশাগত পদবী মুজমদার বংশ পদবী হিসেবে প্রচলিত আজও।

২৫. আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ এর সঙ্গে ফারসী দার যুক্ত হয়ে শিকদার শব্দের উদ্ভব । সুলতান রুকনুদ্দিন, বারবক শাহ ও সুলতান
জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহের লিপিতে আমরা শিকদার শব্দের উল্লেখ দেখতে পাই। কয়েকটি মহল নিয়ে একটি শিক গঠিত হত, সিকদার নামক কর্মচারিরা এই সব বিভাগ দেখাশোনা করত।
সম্রাট শেরশাহ তাঁর আমলে বিভিন্ন মহলে এই রকম শিকদার নিযুক্ত করেন যাদের কাজ ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। শিকদার বা সিকদার পদবী টি এদেশের হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত আছে। এই শিকদার কর্মচারী থেকে পরবর্তীকালে কালক্রমে এঁদের বংশধরের মধ্যে এই পদবীর প্রচলন হয়।

২৬.প্রাচীন ভারতের কতকগুলি ক্ষত্রপ বা মহাক্ষত্রপের নামের শেষে সীহ(সিংহ) উপাধি দেখা যায়। বাংলাদেশেও সিংহ, সিনহা ইত্যাদি পদবির প্রচলন আছে। সিংহ পদবি সব শ্রেণীর বৌদ্ধ ও হিন্দুর মধ্যে এবং সিনহা পদবি হিন্দু ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে। অতীতের বিজয়সিংহ, সমরসিংহ, জয়সিংহ, মানসিংহ , ইত্যাদি নামের শেষাংশ সিংহ পরবর্তীতে পদবীতে পরিনত হয়ে যায়। আমাদের দেশে সিংহ
পদবিধারীদের পূর্ব পুরুষরা হয়তো যুদ্ধবিগ্ৰহে বলবীর্য ও শক্তিমত্তা দেখিয়েছেন অথবা রাজা বা রাজ পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সিনহা মনে হয় সিংহ শব্দের অপভ্রংশ। বিদেশিদের হাতে পড়ে পদবিটি হয়েছে বলে মনে করা হয়।

২৭. গোস্বামী হলো গো- সমূহের বা পৃথিবীর অধিপতি বা রক্ষক। এরা ধর্মের উপদেষ্টা। বৈষ্ণবগুরু ও ভক্তশ্রেষ্ঠদের উপাধি গোস্বামী। এ পদবি ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রচলিত।

২৮.বাঙালিদের মধ্যে রক্ষিত পদবি চালু আছে। রক্ষিত বা রক্ষিতৃ অর্থ রক্ষাকারী, রক্ষাকর্তা, ত্রাণকর্তা। রক্ষিত অর্থে পালিত, ত্রাত ( যাকে ত্রাণ বা রক্ষা করা হয়েছে) বুঝায়। যেমন দেবরক্ষিত, বিষ্ণুরক্ষিত ইত্যাদি। রক্ষিত পদবির মানুষের পূর্বপুরুষের অন্ত্যনাম রক্ষিত আজ পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া এরা অতীতে কোনো রক্ষীবাহিনীর সদস্য ছিল কিনা তাও বিবেচ্য।

২৯.নন্দী পদবি সম্ভবত শিবের ভক্ত হিসেবে ব্যবহৃত। আবার অনন্দী, হৃষ্ট কিংবা আনন্দদানকারী হিসেবেও পদবিটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।কেউ কেউ মনে করেন যে , নেপালের বিখ্যাত নেওয়ার ও নায়ারগন একই জনজাতি ভিন্ন ভিন্ন শাখা থেকে উদ্ভূত। আবার লোকেশ্বর বসু তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন যে , প্রকৃতপক্ষে নন্দী কায়স্থাদি বহু বর্ণ হিন্দু জাতির পদবি।ক্ষত্রিয়দের মধ্যে ও নন্দী পদবি পাওয়া যায়। নন্দী মূলত ব্রাহ্মণদের একটি আদি পদবী। রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ৫৯ টি গাঞি পদবীর মধ্যে নন্দীও একটি। যা লোকেশ্বর বসুর- "আমাদের পদবীর ইতিহাস" বইতে উল্লেখ আছে।

২৯.মোগল আমলের মনসবদারি পদবি হাজারী বা হাজারি বা হাজারিকা। হাজারি থেকে হাজরা। পদবিগুলো এদেশে প্রচলিত আছে। হাজার সৈনোর অধিপতির পদবি হাজরা, হাজারি বা হাজারিকা । এটি ফারসি শব্দ । মোগলযুগে সেনাপতি ছাড়াও রাজপরিবারের সদস্য, স্হানীয় শাসনকর্তা, সম্ভ্রান্ত সামন্ত, যুবরাজ ইত্যাদি মানুষকে মর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যায় অশ্বারোহী সৈনিকের কতৃত্ব দেয়া হতো মনসবদার প্রথা অনুসারে। সহস্র গ্ৰামের মণ্ডল ও হাজারি।

৩০. বাংলার বণিকজাতির বংশ পরিচয়জ্ঞাপক বিশেষ উপাধি হল সাহা । এদের সুপ্রাচীন বংশতালিকায় সাধুকুলোদ্ভব, সাউকুলোদ্ভব ইত্যাদি বংশপরিচয় পাওয়া যায় । অতীত কালে সাহারা সাধু, সাহু এবং তার অপভ্রংশ সাউ নামে পরিচিত ছিল। উড়িষ্যা, মেদিনীপুর ইত্যাদি দক্ষিনাঞ্চলে সাহু নামে এবং বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের পূবপ্রান্তে সাউ নামে সাহাদের অস্তিত্ব আছে। দক্ষিণাত্যে মহাজনগন সাউকর বা সাওকর নামে আখ্যাত।উওর-পশ্চিম ভারতে সাহ্- মহাজন নামে ও পরিচিত ছিল। সাধু থেকে কালের বির্বতনে সউ,সাউ এবং সাহা নাম জাতিগত পদবিতে রূপান্তরিত হয়েছে‌। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত রচয়িতা অচ্যুতরণ তত্ত্বনিধি(১৮৬৬-১৯৫৪খ্রি.) মনে করেনযে, বৈশ্য সার্থবাহ থেকে সাহা শব্দের উৎপত্তি।

৩১. বাঁকুড়া জেলার মুকটি থেকে মুখটি। মুখটি গ্রামের নামের সাথে উপাধ্যায় যুক্ত হয়ে মুখোপাধ্যায় পদবি । মুখোপাধ্যায় রাঢ়ী ব্রাহ্মণের পদবি । এদের আদি বাসভূমি বাঁকুড়া জেলায়।

৩২. সিপাইদের নায়ক হিসাবে হাবিলদার বা হাওলাদার খ্যাত ছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অপভ্রংশ হিসেবে হালদার শব্দ ব্যবহৃত হতো এবং আজও হয়। বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গলে (১৪৯৪-১৫২৫খ্রিঃ)পাই। মাঝি বা জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে হালদার পদবি লক্ষ করা যায়।হালিক বা হালচালক চাষি, নৌকার মাঝি এবং জেলেদের মধ্যে প্রচলিত হালদার পদবি বাংলাদেশে অপ্রতুল নয়।

৩৩.বন্দোপাধ্যায় বা ব্যানার্জি হলো রাঢ়ী ব্রাহ্মণের পদবি।চট্টোপাধ্যায়ও তাই। বন্দ্য ও চট্ট বা চাটুতিগ্ৰামে বাস করে যে পন্ডিত ও উপাধ্যায়গণ ধর্মেকর্মে পথনির্দেশ করতেন তারা বন্দোপাধ্যায় বা চট্টোপাধ্যায় বা চাটুজ্জে নামে পরিচিত হয়েছেন। বন্দোপাধ্যায় বা ব্যানার্জি আবার বাড়ুজ্জে নামেও পরিচিত।

৩৪. তাঁত শিল্পী কিংবা তাঁতের কাপড় তাঁতরের কাপড় তৈরি ও ব্যবসা ইত্যাদি যাদের পেশা তারা তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। তন্তবায়দের মধ্যে আব্বার কয়েক শ্রেণী- বসাক, শেঠ, মল্লিক, হালদার ইত্যাদি। তন্তুবায়রা নবশায়ক। বসাক অর্থ আচ্ছাদন বা পরিধান। বসক থেকে বসাক শব্দের উদ্ভব বলে মনে করা হয় । বঙ্গীয় জাতিমালা গ্ৰন্থে গোবিন্দচন্দ্র বসাক বলেছেন, 'এদের উপাধি বারেন্দ্র সমাজে রায়, প্রামানিক রাঢ়ী সমাজে প্রামানিক, সাহা'। তিনি আরো
বলেন যে, বারেন্দ্র তন্তুবায়গন সবাই বস্ত্রবয়ন কাজে এবং রাঢ়ী সকলেই কাপড়, সুতা কেনাবেচা, মহাজনি ও তেজারতি কারবারের লিপ্ত। আজকাল সকাল উভয় সম্প্রদায় বসাক উপাধি ধারণ করে । পূর্বে যারা বানিজ্য- কাজে লিপ্ত থাকতেন তারা বসুক নামে পরিচিত ছিলেন । বসু অর্থ ধন উপার্জনকারী ।আরবি-ফারসিতে বো সোক শব্দ তুলা অর্থে ব্যবহৃত । ইতালীয় ভাষায় তুলার এক নাম শেঠ । বসাক শব্দ বাণিজ্যজীবী বৈশ্য জাতিজ্ঞাপক বোধে তাঁতিরা আজকাল বসাক উপাধি গ্ৰহন করেছে বলে গোবিন্দচন্দ্র মনে করেন ।

৩৫.আসলে আরবি আমির থেকে‌ সংক্ষেপে মির একটি ফারসি উপাধি। এটি আমির ও মির্জা উভয় শব্দের প্রায় সমার্থবোধক শব্দ। মির্জা শব্দটি অমিরজাদার সংক্ষিপ্ত রূপ ।আমির আরবি এবং জাদা ফার্সি শব্দ ।অতীতে রাজপুত্রগণকে এ উপাধি দেওয়া হতো।ভারতীয় উপমহাদেশে কবি জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি এ উপাধি পেতেন সম্মান সূচক সাহেব অর্থে ।

৩৬.বিশ্বাস নবাবি আমলের পেশা গত পদবী । বিশ্বস্ত প্ৰতিনিধি , মোক্তার বা উকিল হিসেবে তিনি নবাব দরবারে রাজা বা জমিদারের পক্ষে কাজ করতেন।

৩৭.দে:দেবা শব্দ থেকে দে শব্দটি এসেছে ।১২-১৩দশকের দেব রাজ পরিবার রাজত্ব করতো বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সি গঞ্জে ।দেব থেকে এই দে পদবী এসেছিল বলে মনে করা হয়।

৩৮.ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু রাজা, জমিদার ,রাজপুত্র ,রাজপুরুষ ও জমিদারদের সাধারণ উপাধি হিসেবে রায় শব্দ ব্যবহৃত হতো।রাজ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি ।দক্ষিণ-ভারত তথা মহারাষ্ট্রে এটি হলো রাও। এদেশে সম্রাট, সুলতান বা নবাবের দেওয়া রায় উপাধিও অনেক বংশে প্রচলিত। ব্রাহ্মণ থেকে অন্ত্যজ পর্যায় পর্যন্ত এ পদবির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । এদেশে রাজবংশীয় ও নমঃশূদ্র দের মধ্যে রায় পদবী যেমন দেখা যায় তেমনি তথাকথিত কুলীন ব্রাহ্মণ এর মধ্যেও রায় পদবী লক্ষ্য করা যায় । আমার অন্য মতে ব্রিটিশরা অনেক জমিদার ও রাজপুরুষদের রায়বাহাদুর উপাধি দিতেন, পরবর্তীকালে এই রায়বাহাদুর বিভিন্ন অঞ্চলে ভেঙে গিয়ে রায় এ পরিণত হয়।

৩৯.দত্ত:দত্ত শব্দের অর্থ দেওয়া। দত্তাত্রেয় থেকে দত্ত শব্দটি এসেছে ।তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু,মহাদেব কে একত্রে ত্রয়ী বা দত্তাত্রেয় থেকে দত্ত শব্দটি এসেছে।

৪০.ফার্সি শব্দ খান থেকে এসেছে খাঁ পদবী। উল্লেখ্য যে খান পদবী রাজার প্রিয়পাত্রদের জন্য দেওয়া উপাধি। অভিজাত ব্যক্তি বা ভূস্বামীকেই সাধারণত এই পদবী দেওয়া হতো। কতগুলো গ্রামের প্রধান ব্যক্তিকেও খাঁ উপাধি দেওয়া হতো।মধ্য চিনে রাজা ও প্রাচীন ইরানে আমির-উমরাহদের মধ্যে খাঁ পদবী প্রচলিত ছিল। বেলুচ ও আফগান সর্দাররা এই উপাধি গ্রহণ করে থাকেন হিন্দুদের মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় ভাদুড়ি বংশের অনেকেই সুলতানি আমলে খাঁ উপাধি পেয়েছেন, তাদের উত্তর প্রজন্ম এখনো সে পদবী ব্যবহার করেছেন ।অনেক অব্রাহ্মণ হিন্দুও খাঁ পদবী ব্যবহার করে থাকেন।

৪১.মোদক খুব প্রাচীন পদবী নয়, যারা মোয়া বা চিড়া , মুড়ি, খই, বাতাসা ,মিষ্টি তৈরি করত তাদের মোদক বলা হতো। অনেক জায়গায় এদের কুরি নামেও ডাকা হতো।

৪২.বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমাজে সমান ভাবে ব্যবহৃত হয় মণ্ডল পদবী। বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে গ্রাম- প্রধানকে বলা হয় মণ্ডল। বাংলা মণ্ডলরা আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মণ্ডলীয় কাজ করে তারা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীন বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মণ্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন। কোন কোন সময় তাদের অধীনে পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদার ইত্যাদি কর্মচারী কাজ করতেন। সরকার ও রায়তদের মধ্যবর্তী মানুুষ হিসেবে মণ্ডলরা অধিক পরিচিত ছিল।

৪৩.শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ।মনে করা হয়, হযরত মোহাম্মদ সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে যারা শেখ পদবী ধারণ করেন, তারা এ রকম ধারণা পোষণ করেন না যে, তারা বা তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন মধ্য- প্রাচ্য থেকে। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন; নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। দেড়শো- দুশো আগে শেখ দের অতি উচ্চবংশীয় বলে মনে করা হলেও বর্তমানে বেশির ভাগ সাধারণ মুসলিম শেখ পদবী ব্যবহার করে থাকে ।

৪৪.সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে, চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে চৌধরী’ আর তার থেকেই চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী
লোকেশ্বর বসুর মতে , চৌথহারি বা চৌথ আদায়কারী শাসক বা রাজপ্রতিভু বোঝায় এই পদবিতে। হারী শব্দের অর্থ আদায় করা। সুতরাং চৌথহারী শব্দটির উচ্চারণ বিকৃত হয়ে চৌধুরী হয়ে থাকতে পারে।

৪৫.মাহুত সাংস্কৃত শব্দটির উৎস মহামাত্র বলে মনে করা হয়।মহামাত্র শব্দটির একটি অর্থ অমাত্য হলেও আরেকটি অর্থ হলো হস্তীপালক।আবার গজারোহী সৈন্যদের মাহুতি বলা হতো।মাহাতো পদবী ধারী মানুষেরা পূর্বে হস্তী পালক বা গজারোহী ছিল বলে মনে করা হয় ।আবার ছোট নাগপুর পার্বত্য অঞ্চলের গ্রাম প্রধানকে মাহাতো বলা হয়।

৪৬.বসু পদবী মূলত একটি কায়স্থ পদবী।মনে করা হয় বিশ্বাবসু,পৃথ্বী বসু জাতীয় নাম থেকে বসু এসেছে। তবে গ্রামের নাম থেকেও এই পদবিটি এসে থাকতে পারে। মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামের নাম ছিল বসু,বর্তমানে বসুয়া এবং সেই নাম থেকেই ওই গ্রামের ব্রাহ্মণদের পদবী বসুয়ারী।ঋক বেদের আদিত্য ,মরুৎ, ইন্দ্র ঊষা সকলেই বসু। মহাভারতে শিব ও কুবেরও বসু।আবার আটে অষ্ট বসু। তবে এরা কেউ বাঙালি কায়স্থ ছিলেন না।

৪৭.যে ব্যক্তি বাজারে বা আড়তে ধানচাল ইত্যাদি ওজন করে মূলত তাদের পদবী কয়াল। শস্য সংগ্রহকারী ও শস্য রক্ষণ কারী হিসেবেও কয়াল পরিচিত।

৪৮.বাঙালির অসংখ্য পদবীর মধ্যে একটি হলো পাঁজা। মনে হয় এটি পাঞ্জা বা পঞ্জা শব্দের অপভ্রংশ। ফার্সি পাঞ্জার অর্থ হলো থাবা,বিস্তৃত করতল , দস্তখত বা মোহরের পরিবর্তে করতলের ছাপ যা সম্রাট বা নবাবরা ব্যবহার করতেন সরকারি কাজে। পাঁজা পদবিযুক্ত মানুষদের কোনো পূর্বপুরুষ হয়তো মোগল আমলে কোন পাঞ্জা ব্যবহারের জন্য নিয়োজিত সরকারি প্রতিনিধি ছিলেন কিংবা পাঞ্জা বহনকারী ছিলেন অথবা পাঞ্জা ছাপযুক্ত সনদ লাভ করেছিলেন জমিদার হিসেবে।

৪৯.সৈয়দ পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা ও হজরত আলীর বংশ ধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সঙ্গে কোনা যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোনো কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন।

৫০.বল পদবি নামের শেষাংশ থেকেই এসে থাকতে পারে ।মহাবল,ইন্দ্রবল জাতীয় নাম থেকে। আবার দেবল গোত্রপদবীর ছিন্নমস্তা রূপও হতে পারে।

৫১.কাঁঠাল বা কাঁটাল এসেছে কাটাল থেকে । সম্ভবত দিঘী বা পুকুর কাটানোর ভারপ্রাপ্ত ওভারসিয়ারদের কাটাল বলা হত।

৫২.ভূঁইয়া: এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় এর মধ্যে এ পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যারাই ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে তারা ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবী ধারণ করেছেন। মূল সংস্কৃত শব্দ ভৌমিক > (প্রাকৃত) ভূমিকা > (বাংলা) ভূঁইয়া > থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা এসেছে। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃত পক্ষে কুলীন বংশ পদবীই ছিল তা। আবার যে সব মানুষ আগে স্থান বিশেষে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের পত্তন করেছে তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমি জমার স্বত্ব লাভ করেছে।

৫৩.প্রামানিক পদবীর মধ্যেই প্রমাণপত্র উপস্থিত। অর্থাৎ সাক্ষী। বিবাহ থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সামাজিক সাক্ষ্য রাখা হত, কারণ লেখালেখির ব্যাপারটা ছিল সীমিত।

৫৪.ভৌমিক:এটি ভূমি সংশ্লিষ্ট পদবী।ভূঁইয়ার সংস্কৃত রূপ হলো ভৌমিক।এরা অতীতে সামন্তরাজ, জমিদার, জোতদার, ভূস্বামী হিসাবে কাজ করতো।ভূঁইয়া থেকে ভৌমিক এসেছে বলে মনে করা হয়।

৫৫.বিভিন্ন বংশের পরিচয়দাতা ভট্ট নামে অভিহিত হতেন। আদি পদবি ভট্ট, তার সঙ্গে আচার্য যোগ করে ভট্টাচার্য প্রণীত হয়।ভট্টদেরই কোনও একজন আচার্য হয়ে ওঠার পরে তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা ভট্টর সঙ্গে আচার্য যোগ করে ' ভট্টাচার্য ' পদবির প্রচলন করেন |

৫৬.অধিকারী:স্বাধীন সুলতান আমলে(১৩৩৪-১৫৩৮)কোনো কোনো এলাকার স্বত্বাধিকারি, প্রধান ,শাসক ব্যক্তি পদবীতে ভূষিত হতেন। প্রাচীনকালে প্রত্যেক গ্রামে এরকম একজন করে অধিকারী থাকতেন।যেমন বলা যেতে পারে গৌড় অধিকারী।এভাবে অধিকারী পদবীটা এসেছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবজি বিক্রেতা সম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকারী পদবী দেখা যায়। অধিকারী পদবিযুক্ত মানুষের পূর্বপুরুষ হলো শাস্ত্রধর্মে অধিকার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব কিংবা স্থানীয় শাসক অথবা সবজি ও খাদ্যশস্যের উপর অধিকার ও প্রধান্য বিস্তারকারী গোষ্ঠী।

৫৭.ঘোষ কুলীন কায়স্থ আর গোয়ালা দুটি জাতিরই প্রচলিত পদবি। কায়স্থরা অতীতে সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তাই এরা সমাজে উচ্চতর আসন লাভ করে, এরা সম্ভব ঘোষণা প্রচারকারী। আবার অশ্বঘোষ, ঈশ্বরঘোষ বা অনন্ত ঘোষ থেকে এসে থাকতে পারে ঘোষ পদবী ।এখানে বলে রাখা দরকার এই ঘোষ, কিন্তু নামেরই অংশ ছিল পরবর্তীকালে এদের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ দের নামের শেষাংশ নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিল ।

৫৮.নগর ও গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তিকে উপাধী হিসেবে কর পদবী দেওয়া হয়েছে অতীতে ।

৫৯.আরবি মালিক’ বা মলিক’ শব্দ থেকে এসেছে মল্লিক’ বংশ পদবী। ফারসি মালিক শব্দজাত মল্লিক ভূম্যাধিকারী বা জোতদারের উপাধি। গ্রাম প্রধান বা সমাজের প্রধান ব্যক্তি মালিক। আবার লিপিকুশল রাজকর্মচারিকে মোগল আমলে মল্লিক বা সুলেখক আখ্যা দেয়া হত বলেও আমরা জানতে পারি। হয়তোবা সেই থেকে মল্লিক বংশ পদবী এসেছে।

৬০.নিয়োগী রা কাপ(তথাকথিত আচার ভ্রষ্ট)শ্ৰেণী র ছিলেন।তারা ছিলেন সাঁতৈল রাজ্যের অধীনস্ত তালুকদার।মোগল আমলে নিয়োগী ছিলেন কানুনগো দপ্তদের কর্মচারী।এভাবে নিয়োগী পদবীটা এসেছে বলে মনে করা হয়।

৬১. নিচুতলার লোকদের গ্রাম প্রধানরা এককালে দাস পদবী দান করেন। কিন্তু এই দাস শব্দটি ভৃত্যবাচক হয়ে উঠলো কিভাবে?
‌প্ৰাগার্ধ দাস রা নিজেদের দাস নামে হয়তো পরিচয় দিতো। ঋকবেদে দেবদাস নাম পাওয়া যায় তৎকালে আরেকটি নাম সুদাস অর্থাৎ এই জনগোষ্ঠী হয়তো নিজেদের দেবতার দাস হিসেবে পরিচয় দিত। কিন্তু আর্যভাষীরা তাদের আজ্ঞাবহতে পরিণত করেছিল বলেই দাস শব্দটির অর্থ হয় ভৃত্য বা ক্রীতদাসোপম।গৌড়ীয় বৈষ্ণব যুগের 'দাস' শব্দ অন্য ব্যঞ্জনা লাভ করে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে মালাই ভাষায় এই জাতীয় বিনয় দেখানো হয় 'সায়া' শব্দে যা এসেছে 'সহায়' শব্দ থেকে।অর্থাৎ আমি আপনার সহায়। বাঙালিদের মধ্যে সহায় পদবীও দেখা যায় দাস সংস্কৃতে ভৃত্য। যারা এই লজ্জায় স'র জায়গায় শ লিখে দাশ হন তাঁরা জানেন না সংস্কৃত দাশ মানে জেলে ।আবার মনে করা হয় বাংলা পদবীর 'দাস' এসেছে নামের শেষাংশ থেকে যেমন বিপ্রদাস, কৃষ্ণদাস,শিবদাসেরা অন্তনাম কে পদবী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । প্রাক বৈদিক যুগেও দাসে রা ছিল। সেই সময় দাস অর্থ ছিল মানুষ । সেই দাস থেকে সংস্কৃতের দাস।
পরবর্তী কালে দাস বা দাশ শব্দের আক্ষরিক অর্থের সাথে পদবীধারীদের কর্মের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। অতীতে বাঙালি সমাজে অনেক দাস বংশের জমিদারও লক্ষ্য করা গিয়েছে।

৬২.রক্ষা কর্তা কে পাল বলা হতো।মহারাষ্ট্র এক শিকারি গোষ্ঠী ছিল পাল তা থেকে পাল পদবীটা এসেছে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ধর্মাচার্য গনের উপাধি হিসেবে পাল ব্যবহৃত হত। পাল নগরপালের অপভ্রংশ বলেও মনে করা হয়।

৬৩.কুচবিহার রাজ্যে বেশিরভাগ নিম্ন শ্রেণীর রাজকর্মচারীরা ছিলেন নিরক্ষর।ফলে যে সকল নিম্নশ্রেণির রাজকর্মচারীরা লিখতে পড়তে পারতেন, রাজা কর্তৃক তারা কাইত বা কায়েত উপাধি দেওয়া হতো ।

৬৪.‌জানা জনপতি- র অপভ্রংশ বলে মনে করা হয়। জানা মানে অবগতকারী, বিধানদাতা। জানা শব্দটির সাথে জৈন শব্দের যোগ আছে।
কিন্তু জানা পদবীর উৎস সুস্পষ্ট নয়।ফার্সী জাহান (জগৎ) শব্দের সংক্ষেপিত রূপ- 'জান', তারই আঞ্চলিক প্রতিশব্দ জানা হতে পারে ।

৬৫.পুরকাইত বা পুরকায়স্থ হিন্দু আমলের এক প্রাচীন উপাধি। এর মানে রাজার প্রধান লেখক বা জমির জরিপ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি। পুরকায়স্থ শব্দের অর্থ পুর বা নগরের রাজকর্মচারী বা রেজিস্টার।

৬৬. হাতি হস্তিশূর এর অপভ্রংশ। দীর্ঘদেহী বা বলিষ্ঠ। জন্তু বাচক পদবী। আসলে পদবি টা হাতি নয় হাটি। অনেক আগে বাণিজ্য কেন্দ্রের অধিকর্তা কে বলা হতো এবং রাষ্ট্রীয় উপাধি দেওয়া হতো হট্টারিক। সেই হট্টারিকই মুখে মুখে পরিণত হলো হাটিতে।

৬৭. গ্ৰাম্যমন্ডল।'অভিষেকের বারি' যজমানের মাথায় যাঁরা দিতেন। প্রাচীন 'দৌবারিক' অথবা ইংরেজী 'ব্যারাক' শব্দ থেকে এসেছে কিনা সংশয় আছে। বারি সম্বন্ধীয় অর্থাৎ জলেতে যাহাদের জীবন জীবিকা, বারি শব্দের উত্তর স্বার্থে 'ক'প্রত্যয়যোগে সিন্ধ বারিক।দৌবারিক (সংস্কৃত)।

৬৮.বেরা- বেরা বীররায় এর অপভ্রংশ বলে মনে করা হয়।

৬৯.আইচ- বীর্যবত্তা বা পারদর্শিতা অনুসারে। মনে করা হয় আইচ সংস্কৃত 'আদিত্য' শব্দের অপভ্রংশ ।

৭০.মোল্লা এবং মুন্সী বাঙালির দুটো জনপ্রিয় পদবী। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষ এ মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারনেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার মোল্লা থেকে আগত একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি।

৭১.ধাউর বা ধাউরা অর্থে দ্রুত গামী কিংবা চটপটে সংবাদ বাহকে বোঝানো হয়।ধাউরা থেকে ধারা পদবীটা এসেছে বলে মনে করা হয়।অতীতে ধাড় সম্প্রদায় মানুষেরা পালকি বহন করতো অনেকে মনে করে ধাড় থেকে ধর পদবিটি এসেছে।

৭২.দোলই বা দলুই পদবি এসেছে দলপতি, সর্দার, সেনাপতি, পরিচালক অর্থে। সাধারণত এরা তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ। দুলে পদবি এসেছে পালকি বা ডুলির বাহক হিসেবে নিয়োজিত শ্রেণীর থেকে। দলুই ও দুলে এক কিনা তা চিন্তা করা যায়। অভিভাবক, রক্ষক, পৃষ্ঠপোষক, দীক্ষাদাতা, দীক্ষাগরু, সহায়তাকারী হিসেবে দস্তগির উপাধির প্রয়োগ দেখা যায়। ফারসি দস্ত অর্থ হাত এবং গির অর্থ গ্ৰহণ করা বা দখল করা। অর্থাৎ যার কাছে কাউকে সঁপে দেখা যায় তিনি দস্তগির। অথবা কারো দায়িত্ব গ্ৰহণকারীকে দস্তগির বলা হয় ।অতীতের ধারাবাহিকতায় আমাদের সমাজে পদবি হিসেবে এটি চালু আছে।

৭৩.দস্তিদার এসেছে ফারসি দস্ত(হাত) +ই+দার থেকে। রাজকীয় সিলমোহর যার জিম্মায় থাকতো এবং যার দস্তখতে দলিলপত্র রাজকীয় দপ্তর থেকে প্রেরিত হতো তার উপাধি keeper of Doyel seals বা দস্তিদার।নবাবি আমলে দেওয়ান রামকৃষ্ণ ঘোষ নিজ নাম দস্তখতের সরকারি ক্ষমতা পেয়ে দস্তিদার উপাধি পেয়েছিলেন।তা এখন বংশগত পদবিতে পরিণত। ফরাসি দস্তী অর্থ হাতাহাতি বা মশাল। সে হিসেবে দস্তীদার বা দস্তিদার হলো মশালচী। ঘোষ দস্তিদার পদবিও প্রচলিত আছে বাংলাদেশে।

৭৪.আমাদের দেশে শীল পদবির ব্যবহার রয়েছে। শ্রী অর্থে সৌন্দর্য, লাবণ্য বা শোভা বুঝায়। আবার শীল শব্দের অর্থ শোভাযুক্ত বা লাবণ্যযুক্ত।বেশবিন্যাস অর্থেও শ্রী শব্দ প্রযুক্ত হয়। আমাদের দেশে শীল পদবি সাধারণত নাপিতদের মধ্যে দেখা যায়। শ্রীল থেকে শীল শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা যায়। কারণ নাপিতকে নরসন্দুর বা সভাসুন্দর বলা হয়। অর্থাৎ তিনি মানুষকে সুন্দর বা শোভাযুক্ত করেন ‌। নাপিত বা ক্ষৌরকার অতি বিশুদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত। গুণ ও বিশুদ্ধ স্বভাবের কারণে তারা বৌদ্ধযুগে শীল নামে পরিচিত হয় বলে জানা যায়। আগে এদের হাতে শল্য- চিকিৎসা হত।

৭৫.বাঙালি ও মৈথিলী ব্রাহ্মন মধ্যে মিশ্র পদবির প্রচলন আছে। বিহারে এ পদবি মিশির। শ্রেষ্ঠ বা মান্য অর্থে মিশ্র ব্যবহৃত। ওস্তাগার, মেরামতকর্মী, দারুশিল্পী বা ছুতার, কামার, প্রধান কারিগর বা বাড়ুই সাধারণত মিস্ত্রি নামে পরিচিত। খুলনা বিভাগে মিস্ত্রি পদবির হিন্দুদের বাস লক্ষণীয়।

৭৬. কাঞ্জিলাল একটি পদবি। দাক্ষিণাত্যের কানঝি থেকে কাঞ্জি এবং হিন্দি লালা বা সম্ভ্রান্ত মান্য ব্যক্তি থেকে লাল । দুয়ের সমন্বয়ে পদবিটির উৎপত্তি বলে মনে হয়।

৭৭. বাঙালিদের মধ্যে রায় পদবিটি এমন একটি পদবি যা ব্যাপক সংখ্যক বাঙালি নিজেদের পদবি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রায় শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে রাজন শব্দ থেকে। অর্থাৎ রাজা। রাজন/রাজা > রায়া > রায়—এভাবেই এসেছে রায় শব্দটি। পুরােনাে ইতিহাসপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, নবাবী আমলে রায় শব্দটির খুব প্রচলন ছিল। সহস্ৰ সৈন্যের যিনি অধিপতি হতেন তার পদমর্যাদা অনুযায়ী তাকে রায় উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতেন নবাবেরা। এঁদের মর্যাদা ছিল রাজাদের সমকক্ষ। রাজস্থানে রাণা কিংবা দক্ষিণ ভারতে রাও পদবির উৎস সম্পর্কেও এই একই ব্যাখ্যা খাটে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই, অর্থাৎ, রায়, রাণা, রাও সবক্ষেত্রেই মূল শব্দটি ছিল রাজন। অপভ্রংশ রূপ পরিবর্তিত আকারে রায়, রাণা বা রাও হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আর এক তথ্য উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, বিদেশেও রায় শব্দটির সমােচ্চারিত শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, লাটিন শব্দ REX কিংবা ইওরোপে ROY শব্দটির উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে রাজকীয় পদমর্যাদার মানুষেরাই এই শব্দগুলি উপাধি হিসাবে ব্যবহার করতেন। ইংরেজরা যখন বঙ্গদেশে রায় পদবিধারী মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতেন, তখন পরাধীন বাঙালির রায় পদবি তাদের মুখে হয়ে যেত রয় কিংবা রে। ঔপনিবেশিক সেই ধারাকে আজও পাশ্চাত্যভিমানী বাঙালি মাঝে মধ্যেই আপন নামের পরে ব্যবহার করে থাকেন।

রায় পদবিটি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ইত্যাদি ছাড়াও অন্যান্য যেসব জাতির মধ্যে রয়েছে সেগুলি হল—উগ্রক্ষত্রিয়, কৰ্ম্মকার, কাশ্যপকাওরা, কুর্মিক্ষত্রিয়, কৈবর্ত্ত, গরি, গারাে, গােপ, চাকমা, তন্তবায়, তিলি, তিওর, তুরী, দোসাধ, নমঃশূদ্র, পাটানি, পলিয়া, পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, বাহেলিয়া, বৈশ্য, বৈশকপালী, বৈশ্যতেলী, বৈশ্যসাহা,ব্যাগ্ৰক্ষত্রিয়, মল্লক্ষত্রিয়, মালী, মাহিষ্য, মালাকার, মুন্ডা, মোদক, যাদবযোগী, রাভা, রাজোয়ার, রাজবংশীক্ষত্রিয়, সূত্রধর, হাড়ি, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি।

৭৮. গিরি শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল পর্বত। এক্ষেত্রে বােধহয় পর্বতের সুউচ্চ চূড়ার একটা তুলনা ব্যবহার করা হয়েছে। পর্বতের মতাে উঁচু বা সম্রান্তবংশীয় মানুষদের এই পদবিটি দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে আর একটি ভিন্ন মতও প্রচলিত রয়েছে। দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী যারা রয়েছেন তাদের পদবি গিরি। সেখান থেকেও গিরি পদবিটি এসে থাকতে পারে। সাধারণত ব্রাহ্মণ, কৈবর্ত, ডােম, তিলি, নমঃশূদ্র, পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, মাহিষ্য, যাদব, যােগী, রাজবংশী ক্ষত্রিয়, সবিতৃব্রাহ্মণ ইত্যাদি
জাতির মধ্যে গিরি পদবিটি লক্ষ্য করা যায়।

৭৯.তপশিলি উপজাতিভুক্ত মানুষদের মধ্যে হেমব্রম পদবি লক্ষ্য করা যায়। হেমব্রম হল উদ্ভিদ বাচক একটি পদবি। হেমব্রম শব্দের অর্থ হল বনজ গুল্ম। মুন্ডা, সাঁওতাল, হো ইত্যাদি জাতির মধ্যে হেমব্রম পদবি রয়েছে।

৮০.মান্না শব্দটি এসেছে মান্য থেকে। অর্থাৎ সমাজে যে দল বা গােষ্ঠী বিশেষ মান্যতার সঙ্গে জীবনযাপন করতেন তারা মান্না পদবি লাভ করতেন। অবশ্য এ বিষয়ে নির্দিষ্ট যুক্তিযুক্ত কোনাে তথ্য পাওয়া যায় না। সবটাই অনুমানসাপেক্ষ। সাধারণভাবে মাহিষ্য, তন্তুবায়, করেঙ্গা, কৈবৰ্ত্ত তিলি বাইতি, বারুজীবী মল্লক্ষত্রিয়, মােদক, রাজবংশীক্ষত্রিয় সৎচাষি, সবিতৃব্রাহ্মণ, সূত্রধর ইত্যাদি জাতির মধ্যে মান্না পদবিটি পরিলক্ষিত হয়। মান্য শব্দ থেকে মান্না শব্দটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন।

আমরা কোনোভাবেই জাতপাত বা বর্ণভেদ প্রথাকে সমর্থন করি না। পাঠকের চিন্তাশক্তিকে দৃঢ় করার জন্যই আমাদের এই পোস্টগুলি। আশাকরি আপনি আপনার উদার ও মুক্ত চিন্তা ভাবনা দিয়ে এগুলি গ্রহন করবেন।ধন্যবাদ।

৮১.আরবি আমির থেকে‌ সংক্ষেপে মির একটি ফারসি উপাধি। এটি আমির ও মির্জা উভয় শব্দের প্রায় সমার্থবোধক শব্দ।
মির্জা শব্দটি অমিরজাদার সংক্ষিপ্ত রূপ ।আমির আরবি এবং জাদা ফার্সি শব্দ । অতীতে রাজপুত্রগণকে এ উপাধি দেওয়া হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে কবি জ্ঞানীগুনী ব্যক্তি এ উপাধি পেতেন সম্মান সূচক সাহেব অর্থে ব্যবহৃত হত।

৮২.ভঞ্জ পদবিটির উৎস নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন এটি কায়স্থদের পদবি। আরাধ্য দেবত ভঞ্জদেবের নাম অনুসারে এই পদবিটি এসেছে। কারাে মত হল কায়স্থদের কে গােষ্ঠী নিজেদের বীর্যবত্তা বা পারদর্শিতা অনুসারে ভঞ্জবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন তাঁদের উত্তরপুরুষেরা ভঞ্জপদবি পেয়ে থাকতে পারেন। আর এক দল ঐতিহাসিকের মত, ভঞ্জ শব্দটি এসেছে ভজন কথাটি থেকে। ভজনকারী বা ভজনগায়ক হিসেবেও ভঞ্জ শব্দটি এসে থাকতে পারে। কায়স্থ ছাড়া কর্মকার, কৈবত্ত, রাজবংশীক্ষত্রিয়, শবর, হাড়ি ইত্যাদি জাতির মধ্যেও ভঞ্জ পদবিটি লক্ষ করা যায়। ভঞ্জদেব বা ভঞ্জবাহাদুর থেকেও ভঞ্জ পদবির আবির্ভাব ঘটে থাকতে পারে বলে কেউ কেউ বলেন। ভঞ্জদেব বা ভঞ্জবাহাদুর কথার অর্থ হল শক্ৰহননকারী।

৮৩.বীট একটি প্রচলিত পদবি। যে কোনাে সরকারি দপ্তরে পিওন বা পাহারাওয়ালা কর্মচারী বা দপ্তরের যে জায়গাটুকু পর্যবেক্ষণে রাখেন একে বীট বলে। অনেকের মত হল চৌকিদার বা টলহদারদের টহল দেবার সময় সীমাকে বীট (Beat) বলা হয়। সংস্কৃত ভাষায় বিট শব্দের অর্থ হল ওষুধের জন্য তৈরি একপ্রকার কৃত্রিম লবণ। এই লবণ প্রস্তুতির সঙ্গে যাঁদের যােগ ছিল তাঁদের বিট বলা হয়ে থাকতে পারে। অভিধানে বিট শব্দের একটি অর্থ হল ধূর্ত ব্যক্তি। বিট শব্দটি এতগুলি উৎসের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে কোথা থেকে এসেছে তা বলা শক্ত। সাধারণত তন্তুবায়, তাম্বুলীবণিক, সদগােপ ইত্যাদি জাতির মধ্যে বীট পদবিটি লক্ষ্য করা যায়।

৮৪.মন্ত্রী পদবিটি বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না বললে চলে। এটি একটি প্রতিষ্ঠানিক পদ বা আসনের নাম। মন্ত্রী শব্দটির অভিধানিক অর্থ হল পরামর্শদাতা, আমাত্য বা সচিব। রাজবংশীক্ষত্রিয় এবং ব্যাগ্ৰক্ষত্রিয় ছাড়া মন্ত্রী পদবিটি অন্য কোনো জাতির মধ্যে দেখা যায় না বললেই চলে।

৮৫.সংস্কৃত শব্দ বিদ্যুৎ থেকে প্রাকৃত ভাষায় বিজুলী এসেছে। তা বাংলায় এসেছে বিজলী বা বিজুলী শব্দটি। আভিধানিক বিচারে বিজলী শব্দের অর্থ হল তড়িৎ বা বৈদ্যুতিক বাতি। বৈদ্যুতিক বাতি প্রচলিত হবার পর যে সব দক্ষ প্রযুক্তিবিদেরা এই সব বৈদ্যুতিক বাতি সংযােগের পেশায় বৃত হয়েছিলেন তাদের নামের সঙ্গে বিজলী বা বিজুলী শব্দটি উপাধি হিসেবে এসে থাকতে পারে। সাধারণভাবে পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, ব্যগ্রক্ষত্রিয়, রাজবংশীক্ষত্রিয়, হাড়ি, ডােম ইত্যাদি জাতির মধ্যে বিজুলী বা বিজুলী পদবিটি রয়েছে।

৮৬.গঙ্গোপাধ্যায়/গাঙ্গুলী–গাঙ্গুলি বা গাঙ্গুলী কথাটির অর্থ হল, যারা গঙ্গার তীরে বসবাস করেন। এই শব্দটি এসেছে গঙ্গাকুলিক থেকে। গঙ্গোপাধ্যায় পদবিটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একটু বুঝিয়ে বলার দরকার রয়েছে। ব্রাহ্মণদের মূল উপাধি ‘উপাধ্যায়’ তৈরির পিছনে একটি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যে সব ব্রাহ্মণসন্তান নটি গুণের অধিকারী তাদের ‘উপাধ্যায়’ উপাধিতে বিভূষিত করা হত। এই নটি গুণ হল—আচার, বিদ্যা, বিনয়, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপ ও দান। এই ন’টি গুণে সম্মানিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা যে গ্রামে বসবাস করতেন তাঁদের সেই গ্রামনাম বা গাঞিনামের সঙ্গে যুক্ত হত উপাধ্যায়’ শব্দটি। এভাবেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে পদবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখােপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি পদবিগুলি। গঙ্গোপাধ্যায় ও গাঙ্গুলী একই পদবি বলে ধরাহলেও এ দুটি পদবি একই গাঞি নাম থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয় না। বর্ধমান জেলার বাঁকা নদের কাছে গঙ্গ নামে যে গাঞি নাম রয়েছে, সেই গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে গঙ্গোপাধ্যায় পদবিটি এসেছে। কিন্তু গঙ্গার তীরবর্তী যে কোনাে অঞ্চলের অধিবাসীকেই (ব্রাহ্মণ) গাঙ্গুলি পদবি ব্যবহার করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ একটি গাঞিনাম থেকে পদবিটির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে হয় না। গঙ্গোপাধ্যায় বা গাঙ্গুলি পদবিটি ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনাে জাতির পক্ষে সেভাবে লক্ষ করা যায় না।

৮৭. মিদ্যা /মিদ্দা/মিদদে — এককথায় মিদ্দা বা মিদ্দ্যে কথাটির অর্থ হল নাবিক বা নৌচালক। এক সময় বঙ্গদেশে যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন ছিল জলপথ। প্রধান বাহন ছিল নৌকো। এই নৌকো নিয়ে বঙ্গদেশের বণিকেরা সমুদ্রপথে পাড়ি দিতেন বৈদেশিক বাণিজ্য করবার জন্যও। ফলে দক্ষ নাবিক বা নৌচালকদের কদর ছিল আকাশছোঁয়া। সামাজিক প্রতিপত্তি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদির সুবিধে থাকায় বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হতেন। পেশাগত নাম হিসেবে এদের মিদ্যা বা মিদ্যে বলে অভিহিত করা হত বলে অনুমান করা হয়। সাধারণত ভাবে মাহিষ্য রাজবংশীক্ষত্রিয়, মল্লক্ষত্রিয়, পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, ব্যাগ্ৰক্ষত্রিয়, সদগোপ, কৈবত্ত ডোম, নমঃশূদ্র ইত্যাদি জাতির মধ্য মিদ্যা, মিদ্দা বা মিদদে পদবিটি লক্ষণীয় হয়।

৮৮.ফকির - সাধারণভাবে ফকির বলতে বােঝায় মুসলমান সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুককে। ফকির একটি আরবি শব্দ। ফকিরের জীবনযাপন দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ এই মার্গ বা পথ অবলম্বন করে জীবনধারণে উৎসাহী হন। নিজেদের নামের পরে হিন্দু পদবি ছেড়ে তারা ফকির শব্দটিকে পদবি হিসেবে ব্যবহার করতেই অধিক পছন্দ করেন। সেখান থেকে ফকির পদবিটির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটতে থাকে। হিন্দুদের ফকির পদবিটি একেবারেই প্রচলিত পদবি নয়। কেউ কেউ এটিকে আলঙ্কারিক পদবি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

৮৯.ভট্টাচার্য - ভট্ট শব্দটি এসেছে গাঞিনাম ভট্টশালী থেকে, ভট্টশালী গ্রামের ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা আচার্য অধ্যাপকের পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের ভট্টাচার্য উপাধি দেওয়ার চল ছিল। যজন যাজন অধ্যাপন—এই তিনটি বিষয়কে যাঁরা পাথেয় করতেন জীবনের চলার পথে, তারাই ভট্টচার্য নামে বা পদবিতে ভূষিত হতেন বলে অনুমান করা হয়। ব্রাহ্মণ জাতির মধ্যেও ভট্টাচার্য পদবিধারী ব্রাহ্মণদের সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল সবচাইতে বেশি। বর্তমানে ব্রাহ্মণ কিংবা ছাড়াও যােগী ও নমঃশূদ্রদের মধ্যে কোথাও কোথাও ভট্টাচার্য পদবিটি লক্ষ্য করা গেছে।

তথ্যসূত্র-

১.বাংলার পদবি কথা - দেবাশিস ভৌমিক।

২.আমাদের পদবীর ইতিহাস - লোকেশ্বর বসু

৩. পদবীর উৎস সন্ধান- সমর পাল

৪.বাঙালির ইতিহাস - নিহারঞ্জন রায়।

৫.পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস -শ্রী খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক।

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

कात्‍यायन श्रौतसूत्रम्

  Cont>>

Post Top Ad

ধন্যবাদ