কুলাচারী তান্ত্রিক-সাধকেরা চক্র করে দেব-দেবীর সাধনা করে থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরনের চক্রানুষ্ঠানের নানারকম বিধান রয়েছে। তবে সাধকগণের মধ্যে দুই প্রকার চক্রের অনুষ্ঠানই বহুল প্রচলিত বলে জানা যায়– তত্ত্বচক্র বা দিব্যচক্র এবং ভৈরবীচক্র বা স্ত্রী-চক্র। তবে শাস্ত্রের বিধানাযায়ী কুলাচারী ভৈরবীচক্র এবং দিব্যাচারী তত্ত্বচক্রের অনুষ্ঠান করবে।
তত্ত্বচক্র : তত্ত্বচক্রে ব্রহ্মজ্ঞানীরই অধিকার, অন্যের নাই। তন্ত্রে বলা হয়েছে–
ব্রহ্মভাবেন তত্ত্বজ্ঞা যে পশ্যন্তি চরাচরম্ ।
তেষাং তত্ত্ববিদাং পুংসাং তত্ত্বচক্রেহস্ত্যধিকারিতা।।
সর্বব্রহ্মময়ো ভাবশ্চক্রেহস্মিংস্তত্ত্বসংজ্ঞকে।
যেষামুৎপদ্যতে দেবি ত এব তত্ত্বচক্রিণঃ।।
অর্থাৎ : যিনি এই চরাচরকে ব্রহ্মভাবে অবলোকন করিয়া থাকেন, সেই তত্ত্ববিৎ পুরুষই এই চক্রের অধিকারী। সমস্তই ব্রহ্ম, এবম্বিধ ভাবময় ব্যক্তিরই তত্ত্বচক্রে অধিকার।
অতএব পরব্রহ্মের উপাসক, ব্রহ্মজ্ঞ, ব্রহ্মতৎপর, শুদ্ধন্তঃকরণ, শান্ত, সর্বপ্রাণীর হিতকার্যে নিরত, নির্বিকল্প দয়াশীল, দৃঢ়ব্রত ও সত্যসঙ্কল্প সাধক, এরূপ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তিগণই এই তত্ত্বচক্রের অনুষ্ঠান করবে। এই চক্রের অনুষ্ঠানে কোনো ঘট-স্থাপন নাই, বাহুল্য পূজাদিও নাই। এই তত্ত্বের সাধনা– সর্বত্র ব্রহ্মভাব। ব্রহ্মমন্ত্রোপাসক এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তি চক্রেশ্বর হয়ে ব্রহ্মজ্ঞ সাধকদের সাথে তত্ত্বচক্রের অনুষ্ঠান আরম্ভ করবে। তার ক্রমপ্রণালী স্বামী নিগমানন্দের বর্ণনায় নিম্নরূপ–
‘রম্য, সুনির্মল এবং সাধকগণের সুখজনক স্থানে বিচিত্র আসন আনয়ন করিয়া বিমল আসন কল্পনা করিবে। চক্রেশ্বর এই স্থানে ব্রহ্ম-উপাসকগণের সহিত উপবেশন করিয়া তত্ত্বসমুদয় আহরণকরতঃ আপন সম্মুখভাগে স্থাপন করিবে। চক্রেশ্বর সকল তত্ত্বের আদিতে “ওঁ ” এই মন্ত্র শতবার জপ করিবে। তৎপর “ওঁ হংসঃ” এই মন্ত্র সাতবার কিংবা তিনবার জপ করিয়া সমস্ত শোধন করিবে। তৎপর ব্রহ্মমন্ত্রদ্বারা সেই সকল দ্রব্য পরমাত্মাতে উৎসর্গ করিয়া ব্রহ্মজ্ঞ সাধকগণের সহিত একত্র পান-ভোজন করিবে। এই তত্ত্বচক্রে জাতিভেদ বর্জন করিবে। ইহাতে দেশ, কাল কিংবা পাত্র নিয়ম নাই। যথা–
যে কুর্বন্তি নরা মূঢ়া নিব্যচক্রে প্রমাদতঃ।
কুলভেদং বর্ণভেদং তে গচ্ছন্ত্যধর্মাং গতিম্ ।।
— যে মূঢ় নর দিব্যচক্রে ভ্রমবশতঃ কুলভেদ বর্ণভেদ প্রভৃতি করে, সে নিশ্চয়ই অধোগতি প্রাপ্ত হয়।
অতএব দিব্যাচারী ব্রহ্মজ্ঞ সাধকোত্তম যত্নসহকারে ধর্মার্থ-কাম-মোক্ষ-প্রাপ্তিকামনায় তত্ত্বচক্রের অনুষ্ঠান করিবে।
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্ ।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।
–তত্ত্বচক্রের অনুষ্ঠান করিয়া– যাহা অর্পিত হইতেছে তাহা ব্রহ্ম, যাহা অর্পণ-পদবাচ্য তাহাও ব্রহ্মকর্তৃক হুত হইতেছে, অর্থাৎ অগ্নি ও হোমকর্তাও ব্রহ্ম।– এইরূপ ব্রহ্মকর্মে যাঁহার চিত্তের একাগ্রতা জন্মে, তিনিই ব্রহ্মলাভ করিয়া থাকেন।
দিব্যাচারী ব্রহ্মজ্ঞ সাধকের ন্যায় কুলাচারীরও কুলপূজাপদ্ধতিতে চক্রের প্রয়োজন, বিশেষ-পূজাসময়ে সাধকগণের চক্রানুষ্ঠান করা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করা হয়।
ভৈরবী-চক্র : কুলাচারীর অনুষ্ঠেয় স্ত্রী-চক্র ভৈরবী-চক্র নামে খ্যাত। যিনি এই চক্রে বসে প্রাধান্য করেন, অর্থানুষ্ঠানাদির আয়োজন প্রভৃতি করেন, তাঁকে চক্রেশ্বর বলে।
তন্ত্র-মতে এই ভৈরবীচক্র শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ঠ, সারাৎসার। বলা হয়, একবার মাত্র চক্রের অনুষ্ঠান করলে সর্বপাপ হতে মুক্ত হওয়া যায়। আর নিত্য এর অনুষ্ঠানে নির্বাণমুক্তি লাভ হয়। তবে ভৈরবীচক্র-বিষয়ে সে-ধরনের কোনো নিয়ম নাই; যে-কোন সময়ে এই অতি শুভঙ্কর ভৈরবীচক্রের অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। এরদ্বারা দেবী শীঘ্রই বাঞ্ছিত ফল প্রদান করেন। ভৈরবীচক্রেরও গুরু-প্রণালীভেদে জপ-তপে পার্থক্য আছে হয়তো, কিন্তু সাধন-প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যে খুব একটা ভিন্নতা নেই বলেই মনে হয়। শ্রীমৎস্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী ‘তান্ত্রিকগুরু’তে যেভাবে এই চক্রের বিধান বর্ণনা করেছেন ক্রমান্বয়ে তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলছেন–
‘কূলাচারী সাধক সুরম্য মৃত্তিকার উপরে কম্বল কিংবা মৃগচর্মাদির আসন পাতিয়া “ক্লীং ফট্” এই মন্ত্রে আসন সংশোধনপূর্বক তাহাতে উপবেশন করিবে। অনন্তর সিন্দূর, রক্তচন্দন, অথবা কেবল জলদ্বারা ত্রিকোণ ও তদ্বহির্ভাগে চতুষ্কোণমণ্ডল লিখিবে। পরে সেই মণ্ডলে একটি বিচিত্র ঘট, দধি, আতপ তণ্ডুল, ফল, পল্লব, সিন্দূরতিলকযুক্ত এবং সুবাসিত জলপূর্ণ করিয়া প্রণব (ওঁ) মন্ত্র পাঠ-করতঃ স্থাপন করিবে এবং ধূপ দীপ প্রদর্শন করাইবে। তৎপরে গন্ধপুষ্পদ্বারা অর্চনা করিয়া ইষ্টদেবতার ধ্যান করিবে ও সংক্ষেপে পূজাপদ্ধতি-অনুসারে তাহাতে পূজা করিবে। পশ্চাৎ সাধক আপন ইচ্ছানুসারে তত্ত্বপাত্র সম্মুখে রাখিয়া “ফট্” এই মন্ত্রে প্রোক্ষণ করিয়া দিব্যদৃষ্টি-দ্বারা অবলোকন করিবে। অনন্তর অলি-যন্ত্রে (মদ্যপাত্রে) গন্ধপুষ্প প্রদান করিয়া–
“নবযৌবসম্পন্নাং তরুণারুণবিগ্রহাম্ ।
চারুহাসামৃত উদ্ভাস-উল্লাসৎ-বদনপঙ্কজাম্ ।।
নৃত্যগীতকৃতামোদাং নানাভরণভূষিতাম্ ।
বিচিত্রবসনাং ধ্যায়েৎ-বরাভয়করাম্বুজাম্ ।।”
এই শ্লোকে আনন্দভৈরবীর এবং
“কর্পুরপুরধবলং কমলায়তাক্ষং দিব্যাম্বর-আভরণভূষিদেকান্তিম্ ।
বামেন পাণিকমলেন সুধাঢ্যপাত্রং দক্ষেণ শুদ্ধগুটিকাং দধতং স্মরামি।।”
এই শ্লোকে আনন্দভৈরবের ধ্যান করিবে।
ধ্যানান্তে সেই মদ্যপাত্রে উভয় দেব-দেবীর সমরসতা বিশেষরূপে চিন্তা করিবে। তৎপরে “ওঁ আনন্দভৈরব্যৈ আনন্দভৈরবায় নমঃ” এই মন্ত্রে গন্ধপুষ্পদ্বারা পূজা করতঃ অলি-যন্ত্রে (মদ্যপাত্রে) “আং হ্রীং ক্রোং স্বাহা” এই মন্ত্র একশত আটবার জপ করিয়া মদ্য শোধন করিবে। পরে মাংসাদি যাহা পাওয়া যায়, সেই সমুদয় “ওঁ আং হ্রীং ক্রোং স্বাহা” এই মন্ত্রদ্বারা শতবার অভিমন্ত্রিত করিয়া শোধন করিবে। অনন্তর সমস্ত তত্ত্ব ব্রহ্মময় ভাবনা করিয়া চক্ষুর্দ্বয় মূদ্রিত করতঃ দেবীকে নিবেদন করিয়া দিয়া পান-ভোজন করিবে।’
ভৈরবীচক্রের মূল অনুষ্ঠানের সাথে পরিচয়ের আগে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা আবশ্যক, চক্রে বসার কিছু বিধিবদ্ধ নিয়ম তন্ত্রে বলা আছে। যেমন মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে–
চক্রমধ্যে বৃথালাপং চাঞ্চল্যং বহুভাষণম্ ।
নিষ্ঠীবনমধোবায়ুং বর্ণভেদং বিবর্জেয়েৎ।।
ক্রুরান্ খলান্ পশূন্ পাপান্ নাস্তিকান্ কুলদূষাকান্ ।
নিন্দকান্ কুলশাস্ত্রাণাং চক্রাদ্দূরতরং ত্যজেৎ।।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
অর্থাৎ : চক্রমধ্যে থাকিয়া বৃথালাপ অর্থাৎ ইষ্টমন্ত্রজপাদি ও পদ্ধতি-অনুসারে ব্যতীত অন্য প্রকার আলাপ করিবে না; চঞ্চলতা প্রকাশ করিবে না; থুথু ফেলিবে না; অধোবায়ুনিঃসারণ এবং জাতিবিচার করিবে না। ক্রূর, খল, পশ্বাচারী, পাপী, নাস্তিক, কুলদূষক এবং কুলশাস্ত্রনিন্দুকদিগকে চক্রে বসিতে দিবে না।
এবং–
পূর্ণাভিষেকাৎ কৌলঃ স্যাচ্চক্রাধীশঃ কুলার্চকঃ।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
অর্থাৎ : যাঁহার পূর্ণাভিষেক হইয়াছে তিনিই কৌল, কুলার্চক ও চক্রাধীশ্বর হইবেন।
তাছাড়া এটাও বলা হয়– ‘ভৈরবীচক্র আরম্ভ হইলে সমস্ত জাতিই দ্বিজশ্রেষ্ঠ হয়। আবার ভৈরবীচক্র হইতে নিবৃত্ত হইলে সর্ববর্ণ পৃথক অর্থাৎ যে জাতি ছিল তাহাই হয়। আবার ভৈরবীচক্রমধ্যে জাতিবিচার নাই– উচ্ছিষ্টাদিরও বিচার নাই। চক্রমধ্যগত বীরসাধকগণ শিবের স্বরূপ। এই চক্রে দেশ-কাল নিয়ম বা পাত্র-বিচার নাই। চক্রস্থান মহাতীর্থ, সুতরাং তীর্থসমূহ হইতে শ্রেষ্ঠ। এখান হইতে পিশাচাদি ক্রূরজাতি দূরে পলায়ন করে, কিন্তু দেবতাগণ আগমন করিয়া থাকেন। পাপী ব্যক্তিগণ এই ভৈরবীচক্র ও শিবস্বরূপ সাধকগণকে দর্শন করিলে পাপমুক্ত হইয়া থাকে। যে কোন স্থান হইতে বা যে কোন ব্যক্তিকর্তৃক আহৃত দ্রব্যও চক্রমধ্যস্থ সাধকগণের হস্তে অর্পিত হইলেই শুচি হইয়া থাকে। চক্রান্তর্গত কুলমার্গাবলম্বী সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ সাধকগণের পাপাশঙ্কা কোথায়? ব্রাহ্মণেতর যে কোন সামান্য জাতি কুলধর্ম-আশ্রিত হইলেই দেববৎ পূজ্য।’- (তান্ত্রিকগুরু)
শবাসন, মুণ্ডাসন, অথবা চিতাসনে আসীন হয়ে ভয়ানক সব তন্ত্রচর্চার সাক্ষ্য বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। যেমন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত বলছেন–
‘নানাপ্রকার সাধনের মধ্যে শবসাধন বীরাচারীদের একটি প্রধান সাধন। অষ্টমী বা চতুর্দশী তিথিতে অথবা কৃষ্ণ-পক্ষীয় মঙ্গলবারে শূন্য গৃহে, নদী-তীরে, পর্বতে, নির্জন স্থানে, বিল্ব-বৃক্ষ-মূলে বা শ্মশান-ভূমিতে অথবা তাহার সমীপবর্তী বন-স্থানে সাধনা করিতে হয়। সাধকে দ্বিতীয় প্রহর রাত্তিতে মদ্যাদি উপচার লইয়া সাধনার স্থলে উপস্থিত হয় এবং তথায় গুরু, গণেশ, যোগিনী প্রভৃতির পূজা করিয়া বলিদানাদি সাধন পূর্বক শব আনয়ন করে। কিরূপ শব প্রশস্ত, পশ্চাৎ লিখিত হইতেছে।
যষ্টিবিদ্ধং খড়্গবিদ্ধং পয়োমৃতম্ ।
বজ্রবিদ্ধং সর্পদষ্টং চাণ্ডালঞ্চাভিভূতকম্ ।।
তরুণং সুন্দরং শূরং রণে নষ্টং সমুজ্জ্বলম্ ।
পলায়নবিশূন্যঞ্চ সম্মুখে রনবর্তিনম্ ।। (তন্ত্রসার-ধৃত ভাবচূড়ামণি-বচন)
যে চণ্ডাল যষ্টি, শূল, খড়্গ বা বজ্রের আঘাতে কিম্বা সর্প-দংশনে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে, অথবা অভিভূত, জল-মগ্ন বা সম্মুখ-যুদ্ধে পলায়ন-পরাঙ্মুখ হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে, সে যদি সুন্দর কান্তি-বিশিষ্ট শৌর্যবান ও তরুণ-বয়স্ক হয় তাহা হইলে শব সাধনার্থ, তাহার শব আনয়ন করিবে।
সাধকে শব আনয়ন পূর্বক তাহার পূজা করিবে এবং পরে সেই শবের পৃষ্ঠ-দেশে চন্দন-লেপন পূর্বক হরিণ-চর্ম ও কম্বল স্থাপন করিয়া রাখিবে। অনন্তর ডাকিনী যোগিনী প্রভৃতির পূজা করিয়া ও কিছু দূরে একজন উত্তর সাধক রাখিয়া পূজার সামগ্রী সম্বলিত শবারোহণ করিবে, এবং দেবতার অর্চনাদি করিয়া জপ করিতে থাকিবে।
শবসাধনের সময়ে এরূপ ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ক্রিয়ানুষ্ঠান করিবার ব্যবস্থা আছে যে, তাহা করা দূরে থাকুক, পাঠ করিলেও ভয় পাইতে হয়।
করকাঞ্চীং সমাদায় মুণ্ডমালাবিভূষিতঃ।
তেনৈব তিলকং দত্বা তত্তদ্ভস্মবিভূষিতঃ।
শ্মশানেচাসকৃজ্জপ্ত্বা সর্বসিদ্ধীশ্বরোভবেৎ। (শ্যামারহস্য)
কর-কাঞ্চীগ্রহণ করিয়া মুণ্ড মালায় বিভূষিত হইবে এবং তদীয় রক্তের তিলক ধারণ ও শরীরে তাহার ভস্ম লেপন পূর্বক শ্মশান-ভূমিতে পুনঃ পুনঃ জপ করিয়া সর্ব সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে।
মহাষ্টমীনবম্যোস্তু সংযোগে পুরতঃ স্থিতঃ।
ছাগমহিষমেষাণাং চতুর্দিক্ষু শবান্ ক্ষিপেৎ।।
কবন্ধান্মুণ্ডপুঞ্জাংশ্চ দীপাদিভিরলঙ্কৃতান্ ।
মধ্যে কবন্ধমাস্তীর্য তত্র গন্ধর্বরূপধৃক্ ।।
তাম্বুলপুরিতমুখোমঞ্জনাঞ্চিতলোচনঃ।
কৃত্বা তাবন্মনুং জপ্ত্বা সর্বসিদ্ধীশ্বরোভবেৎ।। (শ্যামারহস্য)
মহা অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধি-কালে গ্রামের বাহিরে ছাগ, মহিষ ও মেষের শব এবং দীপ-সংযুক্ত কবন্ধ ও মুণ্ড সমুদায় চারিদিকে ক্ষেপণ করিবে, মধ্যস্থলে একটি কবন্ধ রাখিয়া তাহার উপর আরোহণ করিবে এবং গন্ধর্ব-রূপ ধারণ পূর্বক মুখেতে তাম্বুল পূর্ণ ও চক্ষুতে অঞ্জন-বিশেষ লিপ্ত করিয়া মন্ত্র জপ পূর্বক সর্ব সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে।
বাহুল্য বিবেচনায় এইসব শবসাধনের প্রসঙ্গ বর্তমান আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। তাছাড়া মহানির্বাণ-তন্ত্রে বলা হয়েছে যে–
পুরশ্চর্যাশতেনাপি শবমুণ্ডচিতাসনাৎ।
চক্রমধ্যে সকৃজ্জপ্ত্বা তৎফলং লভতে সুধীঃ।।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
অর্থাৎ : শবাসন, মুণ্ডাসন, অথবা চিতাসনে আরূঢ় হইয়া শত পুরশ্চরণ করিলে যে ফল পাওয়া যায়, ভৈরবীচক্রে বসিয়া একবারমাত্র মন্ত্রজপ করিলে সেই ফল লাভ হইয়া থাকে।
অতএব কুলাচারী সাধক সযত্নে ভৈরবীচক্রের অনুষ্ঠান করবে। কিন্তু ভৈরবীচক্রের মূল অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে তার গুরুত্ব ও গুহ্যতত্ত্ব অনুধাবনের সুবিধার্থে আমাদেরকে আরও কিছু সহায়ক তথ্য জেনে নেওয়া আবশ্যক। মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে এই স্ত্রী-চক্রের বৃত্তান্ত প্রসঙ্গে বলেছেন–
‘এইরূপ ব্যবস্থা আছে যে, সাধকেরা চক্রাকারে বা শ্রেণী ক্রমে আপন আপন শক্তির সহিত ললাটে চন্দন প্রলেপ করিয়া যুগ যুগ ক্রমে ভৈরব-ভৈরবী-ভাবে উপবেশন করিবে এবং মধ্যস্থিত কোন স্ত্রীকে সাক্ষাৎ কালী বোধ করিয়া মদ্য-মাংসাদি দ্বারা তাঁহার অর্চনা করিতে থাকিবে।’
কিভাবে স্ত্রীলোককে ঐভাবে পূজা করতে হয়, তন্ত্রে তার বিবরণ আছে। ইতঃপূর্বে আমরা গুপ্তসাধনতন্ত্রের প্রথম পটলে বিবরণ উল্লেখ করেছিলাম; পাঠের সুবিধার্থে আবারও উল্লেখ করা হচ্ছে (গুপ্তসাধনতন্ত্র-১/১০-১৪)–
ইহলোকে সুখং ভুক্ত্বা দেবীদেহে প্রলীয়তে।
সাধকেন্দ্রো মহাসিদ্ধিং লব্ধ্বা যাতি হরেঃ পদম্ ।। ১০
পঞ্চাচারেণ দেবেশি কুলশক্তিং প্রপূজয়েৎ।
নটী কাপালিকী বেশ্যা রজকী নাপিতাঙ্গনা।। ১১
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যাঃ প্রকীর্ত্তিতাঃ।। ১২
বিশেষবৈদগ্ধ্যযুতাঃ সর্ব্বা এব কুলাঙ্গনাঃ।
রূপযৌবনসম্পন্না শীলসৌভাগ্যশালিনী।। ১৩
পূজনীয়া প্রযত্নেন ততঃ সিদ্ধির্ভবেদ্ ধ্রুবম্ । ১৪
অর্থাৎ : যে সাধক শক্তির আরাধনা করেন, তিনি ইহলোকে বিবিধ সুখভোগ করিয়া দেবীদেহে প্রলীন হইতে পারেন এবং সেই সাধকেন্দ্র শক্তিসাধনবলে মহাসিদ্ধি লাভ করিয়া অন্তে হরিপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। ১০।। দেবেশি! পঞ্চাচার ক্রমে কুলশক্তির অর্চ্চনা করিবে। নটী, কাপালিককন্যা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতপত্নী, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা ও মালাকারকন্যা ইহারাই নবকন্যা বলিয়া কীর্ত্তিত আছে। ১১-১২।। বিশেষতঃ যাহারা বিশেষ গুণশালিনী এইরূপ সর্ব্বজাতীয় রূপযৌবনসম্পন্না, সুশীলা ও সৌভাগ্যশালিনী কন্যাও কুলাঙ্গনা বলিয়া গ্রহণ করা যায়। ১৩।। উক্ত কুলাঙ্গনা সকলকে যত্নপুরঃসর পূজা করিবে। এইরূপ অর্চ্চনাদ্বারা সাধকের নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হইয়া থাকে। ১৪।
এখানে উল্লেখ্য, মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের বক্তব্যানুযায়ী, রেবতীতন্ত্রে চণ্ডালী, যবনী, বৌদ্ধা, রজকী প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার কুল-স্ত্রীর বিবরণ আছে। নিরুত্তরতন্ত্রকার বলেন, ঐ সকল চণ্ডালী, রজকী প্রভৃতি শব্দ বর্ণ বা বর্ণসঙ্কর-বোধক নয়; কার্য বা গুণের বিজ্ঞাপক। বিশেষ বিশেষ কার্যের অনুষ্ঠান করলে, সকল বর্ণোদ্ভব কন্যাই ঐ সমস্ত বিশেষ বিশেষ নাম প্রাপ্ত হয়ে থাকে; যেমন–
পূজাদ্রব্যং সমালোক্য রজোহবস্থাং প্রকাশয়েৎ।
সববর্ণোদ্ভবা রম্যা রজকী স প্রকীর্তিতা।।
আত্মানং গোপয়েদ যা চ সর্বদা পশুশঙ্খটে।
সর্ববর্ণোদ্ভবা রম্যা গোপিনী সা প্রকীর্তিতা।।
অর্থাৎ : পূজা-দ্রব্য দেখিয়া যে কোন বর্ণোদ্ভবা কন্যা রজো-অবস্থা প্রকাশ করে, তাহাকে রজকী বলে। যে কোন বর্ণোদ্ভবা রমণী পশ্বাচারীর নিকটে আপনাকে গোপন করে, তাহাকে গোপিনী বলা যায়।
শাস্ত্রে কুলস্ত্রীর উপরিউক্ত বর্ণনা দেখে যথার্থ অনুধাবনে অসমর্থ পাঠকের বিবাদ-ভঞ্জনের লক্ষ্যে এটা জেনে রাখা আবশ্যক যে, ঐ চক্র-গত পর পুরুষেরাই ঐ সমস্ত কুলস্ত্রীর প্রকৃত পতি; কেননা কুল-ধর্মে বিবাহিত পতি পতি নয়। কুলস্ত্রীর প্রতি শাস্ত্রের উপদেশ হলো–
পূজাকালং বিনা নান্যং পুরুষং মনসা স্পৃশেৎ।
পূজাকালে চ দেবেশি বেশ্যেব পরিতোষয়েৎ।।- (উত্তর-তন্ত্র)
অর্থাৎ : পূজা-কাল ভিন্ন অন্য সময়ে পর পুরুষকে মনেতেও স্পর্শ করিবে না। দেবেশি! পূজা-কালে বেশ্যার ন্যায় সকলের পরিতোষ করিবে।
এবং তিরুত্তর-তন্ত্রে একেবারে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে–
আগমোক্তপতিঃ শম্ভুরাগমোক্তপতির্গুরূঃ।
স পতিঃ কুলজায়াশ্চ ন পতিশ্চ বিবাহিতঃ।।
বিবাহিতপতিত্যাগে দূষণং ন কুলার্চনে।
বিবাহিতং পতিং নৈব ত্যজেদ্বেদোক্তকর্মণি।।- (তিরুত্তর-তন্ত্র)
অর্থাৎ : আগমোক্ত পতি শিব-স্বরূপ; তিনিই গুরু। সেই পতি কুলস্ত্রীদিগের প্রকৃত পতি; বিবাহিত পতি পতি নয়। কুল-পূজায় বিবাহিত পতি ত্যাগ করিলে দোষ হয় না। কেবল বেদোক্ত কর্মে বিবাহিত পতিকে পরিত্যাগ করিবে না।
প্রাণতোষিণী-ধৃত বচনে বলা হয়েছে, সাক্ষাৎ কালী-স্বরূপা উক্ত কুলনারীর পূজা করে মদ্য শোধনাদি পূর্বক পান করতে হয়–
সিন্দূরতিলকং ভালে পাণৌ চ মদিরাসবম্ ।
কৃত্বা পিবেদ্গুরূং ধ্যায়ংস্তথা দেবীঞ্চ চিন্ময়ীম্ ।।- (প্রাণতোষিণী-ধৃত বচন)
অর্থাৎ : ললাটে সিন্দূর-চিহ্ন এবং হস্তে মদিরাসব ধারণ করিয়া গুরু ও দেবতার ধ্যান পূর্বক পান করিবে।
এবং শ্যামারহস্যের মতে, হস্তে সুরা-পাত্র ধারণ করে তদ্গত ভাবে বন্দনা করতে হয় এভাবে–
শ্রীমদ্ভৈরবশেখরপ্রবিলসচ্চন্দ্রামৃতপ্লাবিতং
ক্ষেত্রাধীশ্বরযোগিনীসুবগণৈঃ সিদ্ধৈঃ সমারাধিতম্ ।
আনন্দার্ণবকং মহাত্মকমিদং সাক্ষাৎ ত্রিখণ্ডামৃতং
বন্দে শ্রীপ্রথমং করাম্বুজগতং পাত্রং বিশুদ্ধিপ্রদম্ ।।- (শ্যামারহস্য)
অর্থাৎ : মহাদেবের শির-স্থিত, চন্দ্রের অমৃত দ্বারা প্লাবিত, এবং ক্ষেত্রপাল, যোগিনীগণ, দেবগণ ও সিদ্ধগণ কর্তৃক আরাধিত এবং মাহাত্ম্য-স্বরূপ, আনন্দ-সাগর, সাক্ষাৎ ত্রিখণ্ডামৃত, শুদ্ধি-প্রদায়ক ও হস্ত-কমল-স্থিত এই প্রথম পাত্রের বন্দনা করি।
এবার আমরা ভৈরবীচক্রের অনুষ্ঠানের পরবর্তী প্রণালী অবগত হতে স্বামী নিগমানন্দের ‘তান্ত্রিকগুরু’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি টানতে পারি। তিনি বলছেন–
‘পূর্বোক্ত প্রকারে ভৈরবীচক্রে পূজাদি করিয়া পান-ভোজনাদি করিবে। প্রথমতঃ আপনার বামভাগে পৃথক্ আসনে স্বীয় শক্তিকে (কুলস্ত্রীকে) সংস্থাপন অথবা একাসনে উপবেশন করিয়া স্বর্ণ, রৌপ্য, কাচ অথবা নারিকেলমালানির্মিত পানপাত্র শুদ্ধিপাত্রের দক্ষিণ আধারোপরি স্থাপন করিতে হইবে। পানপাত্র পাঁচ তোলার কম করিবার নিয়ম নাই, তবে অভাবপক্ষে তিন তোলা করা যাইতে পারে। তদনন্তর মহাপ্রসাদ (?) আনয়ন করিয়া পানপাত্রে সুধা (মদ্য) এবং শুদ্ধিপাত্রে মৎস্যমাংসাদি প্রদান করিবে। তৎপরে সমাগত ব্যক্তিগণের সহিত পানভোজন সমাধা করিবে।
তন্ত্রশাস্ত্রের মদ্যপানের উদ্দেশ্য মত্ততা নহে; দেহস্থ শক্তিকেন্দ্র উদ্বোধন করাই উদ্দেশ্য। প্রথমে আস্তরণের জন্য উত্তম শুদ্ধি গ্রহণ করিবে।
অনন্তর–
স্বস্বপাত্রং সমাদায় পরমামৃতপূরিতম্ ।
মূলাধারাদিজিহ্বান্তাং চিদ্রূপাং কুলকুণ্ডলীম্ ।।
বিভাব্য তন্মুখাম্ভোজে মূলমন্ত্রং সমুচ্চরন্ ।
পরস্পরাজ্ঞামাদায় জুহুয়াৎ কুণ্ডলীমুখে।।
–কুলসাধক হৃষ্টমনে পরমামৃতপূর্ণ স্ব স্ব পাত্র গ্রহণ করিয়া মূলাধার হইতে আরম্ভ করিয়া জিহ্বাগ্র পর্যন্ত কুলকুণ্ডলিনীর চিন্তা করতঃ মুখকমলে মুলমন্ত্র উচ্চারণপূর্বক পরস্পর আজ্ঞা গ্রহণান্তে কুণ্ডলীমুখে পরমামৃত প্রদান করিবে।
বলা বাহুল্য সুষুম্নাপথে ঐ মদ্য ঢালিয়া দিতে হয়। ইহার কৌশল গুরুমুখে শিক্ষা করিয়া ক্রমাভ্যাসে আয়ত্ত করিতে হয়। ঐরূপ কৌশল এবং একতান চিন্তায় কুণ্ডলিনীশক্তি উদ্বোধিতা হয়েন। কিন্তু যদি অতিরিক্ত সুরাপান ঘটে, তাহা হইলে কুলধর্মাবলম্বিগণের সিদ্ধিহানি হইয়া থাকে। যথা–
যাবন্ন চালয়েদ্দৃষ্টির্যাবন্ন চালয়েন্মনঃ।
তাবৎ পানং প্রকুর্বীত পশুপানমতঃপরম্ ।।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
–যে-কাল পর্যন্ত দৃষ্টি ঘূর্ণিত ও মন চঞ্চল না হয়, তাবৎ সুরাপানের নিয়ম, ইহার অতিরিক্ত পান পশুপানসদৃশ।
অতএব সুরাপানে যাহার ভ্রান্তি উপস্থিত হয়, সেই পাপিষ্ঠ কৌল নামের অযোগ্য। তবেই দেখা যাইতেছে, কেবল কুণ্ডলিনী-শক্তিকে উদ্বোধিত ও শক্তিসম্পন্ন রাখিতে তন্ত্রে মদ্যপানের ব্যবস্থা। তবে চক্রস্থিত কুলশক্তিগণ মদ্যপান করিবে না।
সুধাপানং কুলস্ত্রীণাং গন্ধস্বীকারলক্ষণম্ ।।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
–কুলরমণীগণ কেবল মদ্যের আঘ্রাণ মাত্র স্বীকার করিবে, পান করিবে না।
এইরূপ নিয়মে পান-ভোজন সমাধান্তে শেষতত্ত্ব সাধন করিবে। এই ক্রিয়া অতি গুহ্য ও অপ্রকাশ্য বিধায় এবং অশ্লীলতা দোষাশঙ্কায় সাধারণের নিকট প্রকাশ করিতে পারিলাম না। উপযুক্ত গুরুর নিকটে মুখে মুখে শিক্ষা করিতে হয়। শেষতত্ত্বের সাধনায় সাধক উর্ধ্বরেতা হয় এবং প্রকৃতিজয়ী হইয়া ও আত্মসম্পূর্তি লাভ করিয়া জীবন্মুক্ত হইতে পারে।’- (তান্ত্রিকগুরু)
উক্ত বর্ণনায় ‘পান-ভোজন সমাধান্তে শেষতত্ত্ব সাধন’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা বোধ করি তন্ত্রের পঞ্চতত্ত্ব সম্পর্কে অবহিতকারী ব্যক্তি বুঝতে অসমর্থ হবেন না। কেননা ইতঃপূর্বে দেখানো হয়েছে, তন্ত্রে ‘পঞ্চতত্ত্ব’ বলতে বুঝায়– মদ্য মাংস মৎস্য মুদ্রা মৈথুন– এই পাঁচটি তত্ত্ব। এই পর্যায়ে কুলার্ণবতন্ত্রের ভাষ্যেও বলা হয়েছে–
পীত্বা মদ্যং পঠেৎ স্তোত্রাং সাধকঃ কুলভৈরবঃ।
কুলস্ত্রীসঙ্গনিরতঃ কুলকার্য সমাচরেৎ।।
অর্থাৎ : কুলভৈরব-স্বরূপ সাধকে মদ্য পান করিয়া স্তব পাঠ করিবে এবং কুল-স্ত্রী সংসর্গে প্রবৃত্ত হইয়া কুল-কার্যের অনুষ্ঠান করিতে থাকিবে।
তার পরে আনন্দোল্লাসের আরম্ভ হয়। এ ব্যাপারের সবিশেষ বর্ণনা প্রকৃতই অনধিকারীর পক্ষে অত্যন্ত অশ্লীল বলে গণ্য হতে পারে। তন্ত্র-শাস্ত্রে এর বিস্তৃত উন্মুক্ত বর্ণনা থাকলেও আমরা বরং তন্ত্র থেকে কিছু কিছু মূলানুগত বিষয় উদ্ধৃত করে এর একটা বিশিষ্ট ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। যেমন, কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলে (কুমারীতন্ত্র-৬/২১-২৭) ইষ্টদেবতা-স্বরূপ কালিকামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে কুলাচার পালন করতে হবে তার বর্ণনায় বলা হয়েছে–
ব্রাহ্মণস্তাম্রপাত্রে তু মধুমদ্যং প্রকল্পয়েৎ।
নটী কাপালিকা বেশ্যা রজকী-নাপিতাঙ্গনা।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২১)
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২২)
এতাসু কাঞ্চিদানীয় ততস্তু যোনিমণ্ডলে।
পূজয়িত্বা মহাদেবীং ততো মৈথুনমাচরেৎ।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২৩)
ধর্ম্মাধর্ম্ম-হবির্দীপ্তে আত্মাগ্নৌ মনসা স্রুচা।
সুষুম্নাবর্ত্ননা নিত্যমক্ষবৃত্তির্জুহোম্যহম্ ।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২৪)
স্বাহান্তোহয়ং মহামন্ত্র আরম্ভে পরিকীর্ত্তিতঃ।
ততো জপেস্মহাবিদ্যাং দেবীং ত্রিভুবনেশ্বরীম।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২৫)
যোগকালে পঠেদ্দেবি ইমং মন্ত্রং মহেশ্বরি।
প্রকাশাকাশ-হস্তাভ্যামবলোক্যোন্মনীশ্রুচা।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২৬)
ধর্ম্মাধর্ম্মকলাস্নেহপূর্ণমগ্নৌ জুহোম্যহম্ ।
স্বাহান্তোহয়ং ভবন্মেন্ত্রঃ শুক্রত্যাগে প্রীকীর্ত্তিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র-৬/২৭)
অর্থাৎ :
ব্রাহ্মণ তাম্রপাত্রস্থিত মধুকেই মদ্যরূপে কল্পনা করিবে।
নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা এবং মালাকার কন্যা- ইহারা নবকন্যা বা গ্রহণীয়া কুলযুবতী বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ২১-২২।। এই সকল কুলযুুবতী মধ্যে অন্যতমা কুলযুবতী গ্রহণ করিয়া তাহার শক্তিমণ্ডলে কালিকা দেবীর পূজা করিবে। তৎপর কুলযুবতীর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। ২৩।।
মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে “ওঁ ধর্ম্মাধর্ম্ম হবির্দীপ্তে আত্মাগ্নৌ মনসা স্রুচা। সুষুম্নাবর্ত্ননা নিত্যমক্ষবৃত্তি র্জুহোম্যহং স্বাহা” এই মন্ত্র পাঠ করিবে। তৎপর রতি সংযোগকালে ত্রিভুবনেশ্বরী কালিকা দেবীর মন্ত্র জপ করিবে। ২৪-২৫।। হে মনেশ্বরি! তৎপর শুক্রত্যাগ কালে “ ওঁ প্রকাশাকাশ হস্তাভ্যাবমলোক্য নীশ্রুতা। ধর্ম্মাধর্ম্মকলাস্নেহপূর্ণমগ্নৌ জুহোম্যহং স্বাহা।” এই মন্ত্র জপ করিতে করিতে শুক্রত্যাগ করিবে। ২৬-২৭।।
সাধনকালে কুলস্ত্রীই যে দেবীরূপিণী এবং কুলস্ত্রীই যে সাধকের প্রাণ সে সম্পর্কে কুমারীতন্ত্রের অষ্টম পটলে বলা হয়েছে–
স্ত্রিয়ো দেবাঃ স্ত্রিয়ং প্রাণাঃ স্ত্রিয় এব বিভূষণাম্ ।
স্ত্রীমেলনং সদা কার্য্যং সুন্দরীভির্ব্বিশেষতঃ।। (কুমারীতন্ত্র-৮/১২)
অর্থাৎ : সাধনকালে কুলস্ত্রীই দেবীরূপিণী, কুলস্ত্রীই সাধকের প্রাণ এবং কুলস্ত্রীকেই সাধকের ভূষণরূপে গণ্য করিবে। সাধক বিশেষভাবে সর্বদা সুন্দরী কুলস্ত্রীগণের সহিত মিলিত হইবে।
এই সাধনপন্থা যত বিচিত্রগামীই হোক না কেন, এবং সাধকমনে তা যত অভ্রান্তই হোক না কেন, তবুও লোকচক্ষুর সাক্ষাতে এরকম চর্চাকর্ম যে লজ্জার কারণ হতে পারে বা ভিন্নার্থ তৈরি করতে পারে সে বিষয়েও সাধকেরা নিশ্চয়ই সচেতন ছিলেন। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে–
ন নিন্দেন্ন হসেদ্বাপি চক্রমধ্যে মদাকুলান্ ।
এতচ্চক্রগতাং বার্তাং বহির্নৈব প্রকাশয়েত।।
তেভ্যোজনং কুর্বীত নাহিতঞ্চ সমাচরেৎ।
ভক্ত্যা সংরক্ষয়েদেতান্ গোপয়েচ্চ প্রযত্নতঃ।। – (প্রাণতোষিণী)
অর্থাৎ : চক্র-মধ্যে মদিরা-মুগ্ধ ব্যক্তিদিগকে দেখিয়া হাস্য ও নিন্দা করিবে না এবং এই চক্রের বার্তা বাহিরে প্রকাশ করিবে না। তাহাদের নিকটে ভোজন করিবে, অহিত আচরণে বিরত থাকিবে, ভক্তি পূর্বক তাহাদিগকে রক্ষা করিবে এবং যত্ন পূর্বক গোপন করিয়া রাখিবে।
মূলত তন্ত্র-সাধনায় শক্তির দেবী আসলে অন্তর্জাগে মন্ত্রাগম্য এবং বাহ্যপূজায় এই দেবীই কুলস্ত্রী-স্থানে পূজিত হয়ে থাকেন। আর চক্র ও পূজার প্রণালীতে জপ-মন্ত্রের বিশিষ্ট ভিন্নতা ছাড়া কুলাচারের সাথে খুব একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কেননা, তন্ত্রচর্চায় কুলাচারের মাহাত্ম্য যে সর্বোচ্চ অবস্থানে এবং কুলস্ত্রীর মাধ্যমেই যে সর্বোচ্চ পূজার সাধন হয়ে থাকে, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন, কুমারীতন্ত্রের অষ্টম পটলেই (কুমারীতন্ত্র-৮/১৬-২৬) কালিকা বা মহাকালীপূজার বিবরণে বলা হচ্ছে–
শ্রীভৈরব উবাচ–
ন জাপকালনিয়মো নার্চ্চাদিষু বলিষ্বপি।
সেচ্ছানিয়য় উক্তোহত্র মহামন্ত্রস্য সাধনে।। ৮/১৬
পূজয়েৎ বিবিধৈঃ পুষ্পৈ-স্তুলসীবর্জ্জিতৈঃ শুভৈঃ।
এবং সংপূজ্য বিধিবৎ ভোজনে কালিকাং জপেৎ।। ৮/১৭
শক্তিং নিশায়াং সংপূজ্য বিধিবৎ সাধকোত্তমঃ।
সিন্দুরভূষণো নিত্যং তথা চৈব দিগম্বরঃ।। ৮/১৮
নারীং দিগম্বরীং কৃত্বা বিপরীতো ভবেত্তদা।
আলিঙ্গনং চুম্বনঞ্চ কুর্য্যাচ্চৈব নিরন্তরম্ ।। ৮/১৯
নির্লজ্জকামবাণেন সৃষ্টিসম্পাদনোৎসুকা।
তস্মিন্ কালে সাধকেন্দ্রো জপেৎ সংক্ষিপ্তমানসঃ।। ৮/২০
সম্ভোগঞ্চ স্বয়ং কুর্ব্বন্ জপেৎ সারস্বতমনুম্ ।
ইত্যাচারপরঃ শ্রীমান্ কুলাচারপরঃ সদা।। ৮/২১
ইহ সা মানবশ্রেষ্ঠঃ পশ্চান্মুক্তো ভবেদ্ ধ্রুবম্ ।
বাগ্মীয়ং সর্ব্ববিদ্যানাং সর্ব্বসারস্বত-প্রদঃ।। ৮/২২
তস্মাৎ ভাব্যা মহাবিদ্যা কুলাচারঃ সুদুর্ল্লভঃ।
অস্য শাস্ত্রপ্রযুক্ত-শ্চেদাচারং ন করোতি যঃ।। ৮/২৩
সংশয়াৎ স পাপিষ্ঠো ন বিদ্যাফলমশ্নুতে।
রাজরাজেশ্বরী বিদ্যা কথিতা ভুবি দুর্লভা।। ৮/২৪
যস্য জ্ঞানপ্রভাবেন কলয়ামি জগৎ ত্রয়ম্ ।
শিবশক্তিরূপরা দেবী নিত্যানন্দস্বরূপিণী।। ৮/২৫
সারস্বতপ্রদা দেবী নিত্যানিত্যস্বরূপিণী।
যাং জ্ঞাত্বা মুক্তিমাপ্লোতি কিমন্যৎ কথয়ামি তে।। ৮/২৬
অর্থাৎ :
যোগেশ্বর শ্রীভৈরব বলছেন–
এই সাধনায় জপ, অর্চ্চনা বা বলি প্রভৃতি কোন বিষয়েই কালাকাল বিচারের কোন আবশ্যকতা নাই। এই মহামন্ত্রের সাধনে স্বেচ্ছাচারই একমাত্র নিয়ম। ৮/১৬।। পূজাকালে বিবিধপ্রকার শুভ (মঙ্গলসূচক) পুষ্প দ্বারা মহাকালীর পূজা করিবে। পূজার্থে তুলসী সর্ব্বদা বর্জ্জন করিবে। এইরূপে যথাবিধি কালিকার পূজা করিয়া, ভোজনকালেও কালিকা মন্ত্র জপ করিবে। ৮/১৭।।
সাধকশ্রেষ্ঠ নিশাকালে কুলস্ত্রীকে শক্তিরূপে গ্রহণ করিয়া যথাবিধি তাহাকে পূজা করিবে। প্রত্যহ সিন্দুরভূষণে ভূষিত হইয়া সাধক দিগম্বর এবং কুলস্ত্রীকে দিগম্বরীরূপে গ্রহণ করিয়া বিপরীত-রতিতে প্রবৃত্ত হইবে। সাধক নিরবচ্ছিন্নভাবে কুলস্ত্রীকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করিবে। ৮/১৮-১৯।। নির্লজ্জভাবে কামবাণে পীড়িত হইয়া যখন কুলস্ত্রী সৃষ্টি-সম্পাদনে সমুৎসুকা হয়, তখন সাধকশ্রেষ্ঠ সংক্ষিপ্ত মানসিক জপে প্রবৃত্ত হইবে। ৮/২০।। অথবা সাধক নিজে কুলস্ত্রী-সম্ভোগে প্রবৃত্ত হইলেও রতিকালে কালিকা মন্ত্র জপ করিতে থাকিবে। এইরূপে শ্রীমান (ভাগ্যবান) সাধক সর্বদা কুলাচারপরায়ণ হইয়া কালিকা সাধনায় প্রবৃত্ত হইবে। ৮/২১।।
এইরূপে যে ব্যক্তি মহাকালীর সাধনা করে, সে ব্যক্তি ইহকালে মানবশ্রেষ্ঠ এবং দেহান্তে মুক্তি লাভ করে। ইহা ধ্রুব সত্য। এই মন্ত্রপ্রভাবে সাধক বাগ্মী সর্ব্ববিদ্যা এবং জ্ঞানের অধীশ্বর হইয়া থাকে। ৮/২২।। সুতরাং সর্বদা সুদুর্লভ কুলাচারক্রম পদ্ধতিতে এই মহাবিদ্যার সাধনা করিবে। তন্ত্রশাস্ত্রোক্ত শক্তিসাধনায় প্রবৃত্ত হইয়া যে ব্যক্তি কুলাচারে রত হয় না, বা কুলাচার সম্বন্ধে সংশয় পোষণ করে, সে ব্যক্তি মহাপাপিষ্ঠ এবং তাহার সাধনাও ফলবতী হয় না। মহাকালী মন্ত্র, সর্ব্বমন্ত্রশ্রেষ্ঠ এবং পৃথিবীতে এই মন্ত্র অতি দুর্লভ। ৮/২৩-২৪।।
এই মন্ত্রপ্রভাবে আমি ত্রিজগত পালন করিতেছি। দেবী মহাকালী স্বয়ং শিব ও শক্তিস্বরূপা এবং নিত্যানন্দ-স্বরূপিণী। দেবী মহাকালী জ্ঞানদায়িনী এবং নিত্যানিত্য সমস্তই তাঁহার রূপ। কালিকাদেবীর স্বরূপ জ্ঞাত হইলে সাধক মুক্তিলাভ করে। ৮/২৫-২৬।।
তন্ত্রে এরকম আরেকটি সাধনার নাম লতা-সাধনা। এ সম্পর্কে ভিন্নত্র আলোচিত হয়েছে বিধায় এখানে এ আলোচনার বিস্তৃতি ঘটানো বাহুল্য হবে। তবে এটিও কুলাচার-অনুরূপ সাধনাই বলতে হয়। এ প্রসঙ্গে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের বক্তব্য হলো–
‘তন্ত্রের মধ্যে লতাসাধনাদি অধিকতর লজ্জাকর ও ঘৃণাকর যে সমস্ত ব্যাপারের বর্ণনা আছে, পাঠকগণের সমক্ষে তাহা উপস্থিত করা কোন রূপেই শোভা পায় না। যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা হয় কুলার্ণব, গুপ্তসাধন-তন্ত্র, নিরুত্তর-তন্ত্র, শ্যামারহস্য, প্রাণতোষিণী প্রভৃতি দেখিলেই জানিতে পারিবেন। লতাসাধনে একটি স্ত্রীলোককে ভগবতী জ্ঞান করিয়া মদ্য-পানাদি সহকারে তাহার সাধন করিতে হয়। উহাতে তাহার শরীরের গুহ্যাগুহ্য নানাস্থানে মন্ত্র-জপ এবং আপনার ও তাহার অঙ্গ-বিশেষের পূজা বন্দনাদি পুরঃসর স্ত্রী-পুরুষ-ঘটিত ব্যাপারানুষ্ঠানের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হইয়া থাকে।’- (ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়)
আমাদের আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে এ জাতীয় চিন্তাধারা বীভৎস কামবিকারের পরিচায়ক বলে মনে হতে পারে নির্দ্বিধায়। কিন্তু এই সাধনচর্চার উৎসকাল ও তার পরম্পরা বিবেচনায় এটিকে সেই সময়কালের বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতেই দেখা যৌক্তিক বলে মনে করি। দত্ত মহাশয়ের কথিত প্রায় অনুরূপ একটি সাধন-প্রণালীর বর্ণনা আমরা দেখতে পাই গুপ্তসাধনতন্ত্র’র চতুর্থ পটলে (গুপ্তসাধনতন্ত্র-৪/২-৯)। বলা হচ্ছে–
শ্রীশিব উবাচ–
শৃণু পার্ব্বতি বক্ষ্যামি অতিগুপ্ততরং মহৎ।
প্রকাশাৎ সিদ্ধিহানিঃ স্যাত্তস্মাদ্ যত্নেন গোপয়েৎ।। ৪/২
স্বশক্তিং পরশক্তিং বা দীক্ষিতাং যৌবনান্বিতাম্ ।
বিদগ্ধাং শোভনাং শয্যাং ঘৃণালজ্জাবিবর্জ্জিতাম্ ।। ৪/৩
তামানীয় সাধকেন্দ্রো দদ্যাৎ পাদ্যাদিকং শুভম্ ।
পঞ্চাচারেণ তাং শক্তিং পূজায়িত্বা যথাবিধি।। ৪/৪
শতং শীর্ষে শতং ভালে শতং সিন্দূরমণ্ডলে।
শতং মুখে শতং কণ্ঠে শতং হৃদয়মণ্ডলে।। ৪/৫
শতযুগ্মং স্তনদ্বন্দ্বে শতং নাভৌ জপেৎ সুধীঃ।
যোনিপীঠে শতং জপ্ত্বা সাধকঃ স্থিরমানসঃ।। ৪/৬
এবং সহস্রং সংজপ্য দেবীং তত্র বিচিন্তয়েৎ।
স্বয়ং শিবস্বরূপশ্চ চিন্তয়েৎ সাধকোত্তমঃ।। ৪/৭
শিবমন্ত্রেণ দেবেশি স্বলিঙ্গং পূজয়েদথ।
তাম্বুলং তন্মুখে দত্ত্বা সাধকো হৃষ্টমানসঃ।। ৪/৮
তদনুজ্ঞাং সমাদায় যোনৌ লিঙ্গং বিনিক্ষিপেৎ। ৪/৯
…
স্বাহেত্যনেন মন্ত্রেণ পূর্ণাহুতিং সমাচরেৎ।
শুক্রোৎসারণকালে চ দেব্যৈ শুক্রং সমর্পয়েৎ।। ৪/১৩
এবং কৃতে মন্ত্রসিদ্ধির্নাত্র কার্য্যা বিচারণা।
যং যং প্রার্থয়তে কামং তং তং প্রপ্নোতি নিশ্চিতম্ ।। ৪/১৪
ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ :
শিব কহিলেন, পার্বতী! আমি অতি গুপ্ততর সাধনোপায় বলিতেছি, শ্রবণ কর। এই সাধন প্রকাশ করিলে সিদ্ধিকার্যের ব্যাঘাত জন্মে, অতএব সর্বপ্রযত্নে ইহা গোপন রাখিবে। ৪/২।।
স্বীয় শক্তি হউক, কি পরশক্তিই হউক, দীক্ষিতা নবযৌবনান্বিতা নানা গুণশালিনী পরমসুন্দরী ঘৃণালজ্জাবিবর্জ্জিতা রমণীকে আপন শয্যায় আনয়ন করিয়া পাদ্যাদি বিবিধ উপহারদ্বারা ভক্তিপূর্বক অর্চ্চনা করিবে। এইরূপে পঞ্চাচারক্রমে সেই শক্তিকে যথাবিধি অর্চ্চনা করিয়া তাহার মস্তকে শতবার, কপালে শতবার, সিন্দুরমণ্ডলে শতবার, মুখে শতবার, কণ্ঠে শতবার, হৃদয়মণ্ডলে শতবার, স্তনদ্বয়ে দ্বিশতবার এবং নাভিতে শতবার ইষ্টমন্ত্র জপ করিতে………হইবে। অনন্তর সাধক একাগ্রচিত্ত হইয়া সেই শক্তির যোনি পীঠে শতবার ইষ্টমন্ত্র জপ করিবে। ৩-৬।। সাধক এইরূপে সেই শক্তির দেহে সহস্র জপ করিয়া তাহাকে ইষ্ট দেবতাস্বরূপ চিন্তা করিবে এবং আপনিও সাক্ষাৎ শিব এইরূপ জ্ঞান করিবে। ৭।। অনন্তর আপন মুখে এবং সেই শক্তির মুখে তাম্বুল প্রদান করিয়া শক্তির অনুজ্ঞাগ্রহণান্তে মূলগ্রন্থের লিখিত বিধি অবলম্বনপূর্বক ‘সাধন’ করিবে। ৮-৯।।…
তৎপরে মূলের লিখিত প্রকাশাকাশমন্ত্রাভ্যাং ইত্যাদি মন্ত্রের অন্তে স্বাহাশব্দ প্রয়োগ করিয়া পূর্ণাহুতি দিতে হইবে এবং শুক্রোৎসারণকালে মহাদেবীকে সেই শুক্র নিবেদন করিবে। ১৩।। যে সাধক এইরূপ সাধন করেন, তাঁহারই নিশ্চয় মন্ত্রসিদ্ধি হইয়া থাকে, ইহাতে অন্যথা মনে করিবে না। উক্তরূপে সাধনদ্বারা সিদ্ধিলাভ হইলে সাধক যে যে কামনা করে, নিশ্চয়ই সেই সেই কাম্যদ্রব্য পাইতে পারে। ১৪।।
এখানে বোধকরি বলা অসঙ্গত হবে না যে, তান্ত্রিক সাধনদৃষ্টি বস্তুত শাক্ত দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত গুহ্য আচার-সমষ্টি। দীর্ঘ ব্যাপ্তিকাল জুড়ে এই সাধনতন্ত্রে নানাবিধ মত ও পথের সম্মিলন হয়ে পর্যায়ক্রমে তার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে নানান সাধনাঙ্গের বিচিত্র সমাহার। যদিও তার সমন্বিত বিশ্ববীক্ষায় খুব একটা মৌলিক প্রভেদ ঘটেনি বলেই মনে হয়। বস্তুত শাক্ত দৃষ্টিভঙ্গির যে প্রকৃতিগত বিশ্ববীক্ষা, তার সমরূপে দেহকেন্দ্রিক উপাসনা ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের সাধনতান্ত্রিক কল্পিত উপায় হলো তন্ত্রাচার। এক্ষেত্রে আরো মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় দার্শনিক বিশ্ববীক্ষায় বৈদান্তিক দ্বৈত ও অদ্বৈত উভয় মতবাদই শাক্তধর্মে স্থান পেতে দেখা যায়। এ প্রেক্ষিতে বিদ্বান গবেষক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী–
‘তন্ত্রসাধনার দুটি বিশেষ কুল বা সম্প্রদায়ের প্রচলন আছে– শ্রীকুল ও কালীকুল। শ্রীকুল অবলম্বীরা কিছুটা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী।… শিবাদ্বৈতবাদের…প্রণেতা শ্রীকণ্ঠের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য এবং অপ্পয় দীক্ষিতকৃত শিবার্কমণিদীপিকা তাঁরা মেনে থাকেন। তাঁরা শিবের সৎ ও চিৎ প্রকাশত্ব স্বীকার করেন এবং শক্তিকে বিমর্শিনী অর্থাৎ শিবের স্বতঃসিদ্ধা স্পন্দস্বরূপা বলে মনে করেন। কালীকুল অবলম্বীরা সাধারণত অদ্বয়বাদী। তাঁরা বলেন সচ্চিদানন্দরূপে দেবী ব্রহ্মস্বরূপিণী এবং তাঁর মায়া বিবর্ত, পরিণামী নয়। তাঁদের মতে শিবশক্তিতত্ত্ব গুণাতীত, নির্দ্বন্দ্ব ও একমাত্র উপলব্ধিগম্য।’
‘শাক্ত দৃষ্টিভঙ্গীর মূল কথা হল চরম সত্তা, যা দেশ, কাল ও কারণাতীত বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ, প্রকাশ রূপে বর্তমান। বিমর্শ শক্তি এই প্রকাশেরই ক্রিয়াসম্পর্কীয় স্বাতন্ত্র্য, যদিও প্রকৃতপক্ষে এই শক্তি, তাঁর স্বরূপ অর্থাৎ চরম সত্তার সঙ্গে অভিন্ন, তাঁরই মধ্যে নিহিত এবং তাঁরই অবিচ্ছেদ্য গুণরূপে প্রকাশিত। শক্তির দুটি অবস্থা আছে– নিষ্ক্রিয় এবং ক্রিয়াশীল। শক্তি যখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে তখন বলা হয় যে বিমর্শ প্রকাশে লীন হয়ে আছে, কিন্তু শক্তি যখন জাগ্রত তখন চরম সত্তাও স্বয়ং চেতন হন। তখন তাঁর আত্মজ্ঞান অহম রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সমগ্র বিশ্বজগৎ দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিচ্ছবির ন্যায় এই অহমে প্রতিফলিত হয়। চরম সত্তা যাঁর প্রকাশ শিব এবং বিমর্শ শক্তি, একই সঙ্গে বিশ্বময় ও বিশ্বাতীত। দুই-এ মিলে এক অখণ্ড সত্তা। অহমের প্রথম অক্ষর, বর্ণমালার প্রথম অক্ষর অ প্রকাশকে সূচিত করে, দ্বিতীয় অক্ষর, বর্ণমালার শেষ অক্ষর হ, বিমর্শকে সূচিত করে, এবং এই দুই-এর ঐক্য যা অ থেকে হ পর্যন্ত বর্ণমালার সকল অক্ষরের ঐক্যকে বোঝায় তা অনুস্বর বা বিন্দু।’
‘এই চরম সত্তার সঙ্গে শক্তি বা কলা চিরকালীন ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছেন। কলা শব্দটির অর্থ বিশ্বাতিক্রমী সর্বাতীত শক্তি। এই শক্তির প্রথম বিকার ইচ্ছা। তৈলবীজের মধ্য হতে যেমন তৈল নিষ্ক্রান্ত হয় তেমনই সৃষ্টির প্রারম্ভেই শক্তির আবির্ভাব হয়। এই শক্তির আবির্ভাব নিদ্রায় অচেতনতার পর জাগ্রত ব্যক্তির স্মৃতি পুনরাবির্ভাবের মত। সত্তা এবং শক্তি উভয়েই চিৎ বা শুদ্ধ জ্ঞান স্বরূপ, তবে শক্তি সকল বস্তুর উপর ক্রিয়া করেন বলে তাদেরই প্রকৃতি অনুসারে কখনও জ্ঞান এবং কখনও ক্রিয়ারূপে প্রতিভাত হন। দ্বৈতবাদী শাক্তদের মতে বিন্দু হচ্ছে নিত্য জড় বস্তু কিন্তু শক্তির ক্রিয়ার অধীন। অদ্বৈতবাদী শাক্তদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য এখানে যে যদিও তাঁরা শিবকে শক্তির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করেন, এবং তাঁদের এক ঈশ্বরসত্তার দুদিক বলে মনে করেন, বিন্দু বা জড়বস্তুকে তাঁরা শিবশক্তি অন্বয়ের থেকে পৃথক করে দেখেন। তাঁদের মতে বিন্দু শিব ও শক্তির মতই নিত্য, সৃষ্টি বিষয়ে শিব কর্তা, শক্তি তাঁর যন্ত্র এবং বিন্দু জড় উপাদান, শক্তি জড়স্বভাব নয় বলে ক্রিয়ার সময় তার কোন পরিবর্তন হয় না, কিন্তু বিন্দুতে হয়ে থাকে।’- (ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট/ পৃষ্ঠা-১৭০-৭১)
প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রে যেসব আচার-পালন ও আবশ্যিক ক্রিয়াকর্ম ধর্মার্থীদের জন্য মাহাত্ম্যপূর্ণ বলে স্বীকৃত হয়েছে, তান্ত্রিক কৌলাচারীদের জন্য সেসব কর্মকাণ্ডই পরিত্যাজ্য হিসেবে বিবেচিত হতে দেখা যায়। যেমন প্রাণতোষিণীতন্ত্রে বলা হয়েছে–
প্রায়শ্চিত্তং ভৃগোঃ পাতং সন্ন্যাসং ব্রতধারণম্ ।
তীর্থযাত্রাভিগমনং কৌলঃ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ।। (প্রাণতোষিণী-ধৃত বচন)
অর্থাৎ : কৌলদের প্রায়শ্চিত্ত, ভৃগুপাত, সন্ন্যাস, ব্রত-ধারণ, তীর্থযাত্রা এই পাঁচটি বিষয়ের অনুষ্ঠান করিবার প্রয়োজন নাই; তাহা একবারে পরিত্যাগ করাই তাহাদের পক্ষে বিধেয়।
এবং তন্ত্রবিহিত সুরাপান ও পরস্ত্রী বা কুলস্ত্রী গমন ইত্যাদির মতো মারণ, উচ্চাটন প্রভৃতি নর-হত্যা ও পর-পীড়া শাস্ত্রীয় ক্রিয়ার মধ্যে পরিগণিত হতে দেখা যায়। যেমন–
শান্তিবশ্যস্তম্ভনানি বিদ্বেষোচ্চাটনে তথা।
মারণং পরমেশানি ষট্ কর্মেদং প্রকীর্তিতম্ ।। (যোগিনীতন্ত্র, পূর্বখন্ড)
অর্থাৎ : পরমেশানি! শান্তি, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন, মারণ– এই ছয় প্রকার কর্ম পরিকীর্তিত হইয়াছে।
তালিকাটিতে শান্তি ব্যতীত আর পাঁচ প্রকার কর্মই অভিচার সম্বন্ধীয়; অর্থাৎ সাধক এভাবে তাঁর শত্রুদের অনিষ্টসাধন করতে চেষ্টা করতেন। তবে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পঞ্চোপাসনা’ গ্রন্থে বলেন–
‘বীরাচারী উপাসকগণ যেরূপ সিদ্ধিব্যপদেশে ও অপরের অনিষ্ট-কামনায় চক্রাকারে মিলিত হইয়া সর্বতোভদ্রমণ্ডল, স্বল্পসর্বতোভদ্রমণ্ডল, লবণাভমণ্ডল ইত্যাদি মণ্ডলে নানারূপ ক্রিয়ারত থাকিতেন, সেরূপ কুলাকুলচক্র, নক্ষত্রচক্র, অকথহচক্র, অকডমচক্র, ঋণী ধনীচক্র, কূর্মচক্র, মাতৃকাযন্ত্র, বিশালাক্ষীযন্ত্র, দুর্গাযন্ত্র প্রভৃতি অঙ্কিত করিয়া ঐ সকলে মন্ত্রাদি সহকারে দেবীপূজা করিতেন। মন্ত্রাদির সর্বোত্তম বীজমন্ত্রের কথা পূর্বে বলা হইয়াছে। এখন তন্ত্রসার হইতে কয়েকটি দেবী গায়ত্রী উদ্ধৃত করিতেছি। শক্তি গায়ত্রী– সর্বসংমোহিন্যৈ বিদ্মহে বিশ্বজনন্যৈ ধীমহি তন্নঃ শক্তিঃ প্রচোদয়াৎ ; ত্বরিতা গায়ত্রী– ত্বরিতায়ৈ বিদ্মহে মহানিত্যায়ৈ ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ ; ত্রিপুরাসুন্দরী গায়ত্রী– ঐঁ ত্রিপুরাদেব্যৈ বিদ্মহে ক্লীঁ কামেশ্বর্যৈ ধীমহি সৌস্তনঃ কিন্নে প্রচোদয়াৎ ; দুর্গা গায়ত্রী– মহাদেব্যৈ বিদ্মহে দুর্গায়ৈ ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ ; লক্ষ্মী গায়ত্রী– মহালক্ষ্মৈ বিদ্মহে মহাশ্রিয়ৈ ধীমহি তন্নঃ শ্রীঃ প্রচোদয়াৎ, ইত্যাদি। এই সকল গায়ত্রীমন্ত্রের গঠনশৈলী ব্যাহৃতিমুক্ত বৈদিক গায়ত্রীমন্ত্রের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। তান্ত্রিক গ্রন্থসমূহ সাধারণভাবে অথর্ববেদের, বিশেষ করিয়া ইহার পৈপ্পলাদ শাখার অন্তর্ভুক্ত বলিয়া গৃহীত হয়। ব্রহ্মযামলের অন্তর্গত যোগিনীবিজয়স্তবরাজ (ইহার পুঁথি ৮১১ নেওয়ারী সম্বতে প্রথম লিখিত হয়) সম্বন্ধে কথিত আছে যে ইহা প্রথমে শিব তাঁহার পত্নী পার্বতীকে বলেন, এবং পরে পিপ্পলাদ মুনি ইহাকে স্বর্গ হইতে মর্ত্যে আনয়ন করেন। রুদ্রযামলে শক্তি বুদ্ধেশ্বরী নামে অভিহিত হইয়াছেন এবং তাঁহার আর এক নাম এখানে অথর্ববেদ শাখিনী। মনে হয় এই সব ও অনুরূপ উপায়ে বেদবাহ্য তান্ত্রিক আচার ও সাহিত্য ইত্যাদিকে বৈদিক আচার ও সাহিত্যের সমপর্যায়ে আনয়ন করিবার চেষ্টা করা হইয়াছিল।’- (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-২৭৩)
এ প্রসঙ্গে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র বক্তব্য হলো,– ‘তন্ত্রশাস্ত্রের এক অংশে শান্তিক, পৌষ্টিক, মারণ, বশীকরণ, আকর্ষণ, উচ্চাটন প্রভৃতি কতকগুলি ক্রিয়ার পদ্ধতি বিবৃত হইয়াছে। এই ক্রিয়াগুলি একমাত্র ঐহিক ফললাভের উপায়স্বরূপ। ইহাতে চিত্তশুদ্ধি বা অপর কোন প্রকার পারত্রিক ফললাভের আশা নাই। শুধু অলৌকিক নানা কাণ্ড-কারখানা দেখাইয়া সম্মান ও অর্থলাভের উদ্দেশ্যে একদল তথাকথিত তান্ত্রিক তন্ত্রশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন– ইহাও দেখা যায়। এই শ্রেণীর গেরুয়াধারী, জটাধর, সিন্দুরতিলক, গঞ্জিকাসেবী, ত্রিশূলপাণি তান্ত্রিককে দেখিয়া অনেকে তন্ত্রশাস্ত্রকে পুঞ্জীভূত ভোজবাজীর আকর বলিয়া মনে করেন। পরন্তু যথার্থ তান্ত্রিক উপাসক এই জাতীয় সিদ্ধাই বা বুজ্রুকিকে উপাসনার বিঘ্ন বলিয়াই মনে করেন।’
‘তন্ত্রশাস্ত্রের এইসকল সিদ্ধাই-প্রকরণ দেখিলে অনুমান হয়, সমাজের শক্তিহীনতার কোন অশুভ ক্ষণে মানুষের বুদ্ধি এই দিকেই সিদ্ধির পথ খুঁজিয়াছে। তপঃশক্তি ও দৈহিক শক্তি বিশেষভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত না হইলে এই শ্রেণীর অভিচারাদি ক্রিয়ার কথা মনে পড়িবার নহে। এখনও দেখিতে পাই– দেব-দেবীতে যাঁহার বিশ্বাস নাই, যিনি এইসকল শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধী, তিনিও মানসিক অবসাদে, মকদ্দমায় প্রতিপক্ষকে জয় করিবার নিমিত্ত শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করাইতেছেন, বগলামুখীর মন্ত্রজপের নিমিত্ত ব্রাহ্মণকে বরণ করিতেছেন, গ্রহশান্তির উদ্দেশ্যে জ্যোতিষী পন্ডিতকে কোষ্ঠী দেখাইতেছেন। এইসকল ব্যস্ততায় তাঁহার মনের দুর্বলতার অনুমান করা চলে। সমাজেও অবসাদের লক্ষণ দেখা না দিলে বিনা তপস্যায় এবং বিনা শক্তিতে কার্য সিদ্ধ করিবার বাসনা জাগিতে পারে না। সমাজে এই শ্রেণীর প্রতারকের আবির্ভাব সকল সময়েই ঘটিয়া থাকে।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-১৯)
তন্ত্র বিষয়ে এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হয়েছে তার সবই তান্ত্রিক সাধনার কর্ম-কাণ্ড বা সাধন-কাণ্ড বিষয়ক। এবার তন্ত্র-শাস্ত্রের জ্ঞান-কাণ্ড বা দার্শনিক ভাগেরও কিছুটা আলোকপাতের প্রয়োজন রয়েছে।
কর্ম-কাণ্ডের প্রকরণে দেখা যায়, অতি নিম্ন স্তরের উপাসক যেমন দেখতে পান তাঁর উপযোগী উপাসনার পদ্ধতি তন্ত্র-শাস্ত্রে রয়েছে, তেমনি অতি উচ্চ স্তরের সাধকও দেখতে পান যে তাঁর উপযোগী উপদেশও তন্ত্রে কম নেই। হিন্দুশাস্ত্রের অভিনবত্ব এখানেই যে তা কখনও কাউকেও নিরাশ করে না। সব-ধরনের অধিকারীকেই কোলে স্থান দেয়। অধিকারী-ভেদে শাস্ত্রের বিভিন্ন অনুশাসন প্রযুক্ত হয়ে থাকে। অতি সাধারণের ইতু-পুজা, সুবচনীর ব্রত প্রভৃতি কর্ম থেকে কৌল জ্ঞানীর ব্রহ্ম-তত্ত্ব পর্যন্ত সবকিছুই অধিকারী-ভেদে গ্রাহ্য হয়ে থাকে। হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবতার তাৎপর্যও বোধকরি এখানেই। কেননা, হিন্দুর বহু-দেবতাবাদ ও একেশ্বরবাদকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, অসংখ্য দেবতাকে স্বীকার করেও চরম তত্ত্ব অর্থাৎ ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ শ্রুতির সাথে কোন বিরোধ ঘটে না। একইভাবে এই সমন্বয় বুদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে তন্ত্র-শাস্ত্রের উপাসনা-প্রণালীর বিচার করলেও সেই চরম তত্ত্বের অন্যথা হয় না। উপাসনা-প্রণালীর মধ্যে পঞ্চোপাসক তথা শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর ও গাণপত্য সাধকের ভেদ কল্পিত-মাত্র বলেই মনে হয়। পথের বিভিন্নতায় গন্তব্য স্থল ভিন্ন হয়ে যায় না। সবারই চরম উপেয় এক, অর্থাৎ অভিন্ন। ব্যবহারিক ভেদের দ্বারা তাত্ত্বিক অভেদ কখনও ক্ষুন্ন হয় না।
ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র আলোচনার অত্যাবশ্যকীয় তিনটি প্রপঞ্চ হলো– কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান। এই তিনের মধ্যে বাস্তব কোন বিরোধ আছে বলে ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত নয়। সে অনুযায়ী, কর্ম-কাণ্ড জ্ঞান-কাণ্ডের প্রতিকূল বা বিরোধী নয়। প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞান বা চরম তত্ত্বের উপলব্ধি হলে সাধক সর্বত্র পরম শিবের লীলা প্রত্যক্ষ করে থাকেন। সে অবস্থায় ভেদ-জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত উপাসনাদি সম্ভবপর নয়। বলা হয়, কর্মই সাধকের হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বলিত করে। ভক্তি ব্যতীত জ্ঞানলভ্য পরম তত্ত্বের প্রতি আকর্ষণই জন্মে না। তন্ত্র-মতে কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যভূমিতে ভক্তির আসন সুপ্রতিষ্ঠিত। ভক্তির মধ্যস্থতায়ই অনুষ্ঠাতা উপাসক জ্ঞান-ভূমিতে আরোহণ করেন। তাই কর্ম-কাণ্ডের ভিতরে প্রসঙ্গত ভক্তির কথাও আলোচিত হয়। আর দার্শনিক আলোচনাই তন্ত্র-শাস্ত্রে জ্ঞান-কাণ্ডের বিষয়।
(ক) ষটত্রিংশৎ-তত্ত্ব
ছত্রিশটি তত্ত্বকে অবলম্বন করে তন্ত্র-শাস্ত্রে যে বিচার করা হয়েছে, তা-ই তন্ত্রের দার্শনিক আলোচনা। সুতসংহিতায় তত্ত্ব শব্দের অর্থ বিবৃত হয়েছে এভাবে–
আপ্রলয়ং ষত্তিষ্ঠতি সর্বেষাং ভোগদায়ি ভূতানাম্ ।
তৎ তত্ত্বমিতি প্রোক্তং ন শরীর-ঘটাদি তত্ত্বমতঃ।।
অর্থাৎ : সৃষ্টির আদি হইতে প্রলয় পর্যন্ত অবস্থিত থাকিয়া যাহা সর্বভূতের ভোগের হেতু হইয়া থাকে, তাহাই তত্ত্ব। এইকারণে শরীর, ঘট প্রভৃতি তত্ত্ব-সংজ্ঞায় অভিহিত হয় না। অর্থাৎ বক্ষ্যমাণ ষটত্রিংশতত্ত্ব যেরূপ দেশ ও কাল ব্যাপিয়া থাকে, শরীর, ঘট প্রভৃতি সেইরূপ দেশ-কাল ব্যাপিয়া থাকে না।
‘তৎ’ এর ভাব বা ধর্মকেই ‘তত্ত্ব’ বলে। ’তৎ’ বলতে পরম শিবকে বোঝানো হয়। শিব থেকে পৃথিবী পর্যন্ত ষটত্রিংশৎ বা ছত্রিশটি পদার্থ ‘তৎ’ এর অসাধারণ ধর্ম বা ভাব। এ কারণে এগুলিকে তত্ত্ব বলে। ন্যায়াদি-দর্শনের ‘পদার্থ’ এবং আগমসম্মত এই ‘তত্ত্ব’ এক হলেও তন্ত্রের বিচারে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। তান্ত্রিকেরা ‘পদার্থ’ বুঝাতে ‘তত্ত্ব’ শব্দটি প্রয়োগ করে থাকেন, তবে তাঁরা পরম শিবের ধর্ম-রূপেই সব কিছুকে প্রকাশ করতে চান। কারণ, এই সাধন-বিদ্যার সাধারণ দার্শনিক বিচার তাঁদের অভিপ্রেত নয়। পরশুরাম-কল্পসূত্রে বলা হয়েছে–
ষট্-ত্রিংশত্তত্ত্বানি বিশ্বম্ (১/৪)
অর্থাৎ : এই বিশ্বে ছত্রিশটি তত্ত্ব বর্তমান। এই ছত্রিশটি তত্ত্বের বাহিরে জগতে কোন বস্তুই নাই।
এই ছত্রিশ তত্ত্ব কী? তত্ত্বগুলো হচ্ছে– ১. শিব, ২. শক্তি, ৩. সদাশিব, ৪. ঈশ্বর, ৫. বিদ্যা, ৬. মায়া, ৭. অবিদ্যা, ৮. কলা, ৯. রাগ, ১০. কাল, ১১. নিয়তি, ১২. জীব, ১৩. প্রকৃতি, ১৪. মনঃ, ১৫. বুদ্ধি, ১৬. অহঙ্কার, ১৭. শ্রোত্র, ১৮. ত্বক্, ১৯. চক্ষুঃ, ২০. জিহ্বা, ২১. ঘ্রাণ, ২২. বাক্, ২৩. পাণি, ২৪. পাদ, ২৫. পায়ু, ২৬. উপস্থ, ২৭. শব্দ, ২৮. স্পর্শ, ২৯. রূপ, ৩০. রস, ৩১. গন্ধ, ৩২. আকাশ, ৩৩. বায়ু, ৩৪. তেজঃ, ৩৫. জল, ৩৬. পৃথিবী।
১. শিবতত্ত্ব :– পরম শিব যখন এক থেকে বহু রূপ ধারণে ইচ্ছা করেন, তখনই সৃষ্টি আরম্ভ হয়। সেই ইচ্ছাশক্তি-রূপ উপাধি-বিশিষ্ট পরম শিবই শিবতত্ত্ব। উপনিষৎ-প্রতিপাদ্য পর ব্রহ্মের ধারণাই পরম শিব ধারণায় আরোপিত হতে দেখা যায়। তিনি নির্গুণ হলেও সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছার উদয় হলে সগুণ হয়ে থাকেন। তন্ত্র-শাস্ত্রে পরম শিব এবং শিব এই উভয় শব্দই সগুণ ব্রহ্ম এবং নির্গুণ ব্রহ্ম অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, এখানে বেদান্তের প্রভাব দুর্নিরীক্ষ্য নয়, বরং মনে হতে পারে আমরা বুঝিবা কোনো বেদান্ত-ভাষ্যই পড়ছি। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অদ্বৈত-বেদান্তবাদী আচার্য শঙ্কর তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (১/১/১২, উপক্রম) বলেছেন–
দ্বিরূপং হি ব্রহ্মাবগম্যতে, নামরূপবিকারভেদোপাধিবিশিষ্টং তদ্বিপরীতঞ্চ সর্বোপাধিবিবর্জিতম্ ।… এবমেকমপি ব্রহ্মাপেক্ষিতোপাধিসম্বন্ধং নিরস্তোপাধিসম্বন্ধং চোপাস্যত্বেন জ্ঞেয়ত্বেন চ বেদান্তেষুপদিশ্যতে। –(ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-১/১/১২, উপক্রম)
অর্থাৎ :
ব্রহ্মের দুইটি স্বরূপ। একটি স্বরূপ নাম রূপ প্রভৃতি যুক্ত এবং অপর স্বরূপটি তাহার বিপরীত, অর্থাৎ সর্বপ্রকার উপাধিবিবর্জিত।… এইভাবে একই ব্রহ্ম (সগুণ) উপাধিযুক্ত হইয়া উপাস্যরূপে এবং সর্ববিধ উপাধি-সম্পর্কশূন্য (নির্গুণ) হইয়া জ্ঞেয়-রূপে বেদান্তশাস্ত্রে উপদিষ্ট হইতেছেন।
তন্ত্রের ব্যাখ্যায় কোন কোন জায়গায় নির্গুণ ব্রহ্ম অর্থে পরম শিব এবং সগুণ ব্রহ্ম অর্থে শিব শব্দের প্রয়োগও দেখা যায়। ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তন্ত্রের সাধন-প্রণালীতে সাধকের ভেদ কল্পিত-মাত্র এবং অধিকারী-ভেদে পথের বিভিন্নতা থাকলেও চরম উপেয় বা গন্তব্য অভিন্ন, ফলে ব্যবহারিক ভেদের দ্বারা সমন্বয়-বুদ্ধি প্রসূত তাত্ত্বিক অভেদ ক্ষুণ্ন হয় না। আবার উপাসক-ভেদে চরম-তত্ত্ব ও গন্তব্য অভিন্ন হলেও ইষ্ট-দেবতার ধারণা ও কল্পনায় ভিন্নতা থাকায় তত্ত্ব-দৃষ্টির ব্যাখ্যায়ও স্বাভাবিকভাবেই তার চিহ্ন ও প্রভাব দৃষ্টির অগোচর নয়। যেমন তান্ত্রিক উপাসক হয়েও উপনিষদানুসারী তন্ত্রসাধকের তত্ত্ব-দৃষ্টিতে পরমেশ্বর হলেন পরম-ব্রহ্ম, শৈব-তান্ত্রিকের তত্ত্ব-চিন্তায় পরমেশ্বর হয়ে যান পরম শিব কিংবা শাক্ত-তান্ত্রিকের সাধক-চিন্তায় শক্তি বা মাতৃকা-শক্তিই পরম-তত্ত্ব। তবে ব্যাখ্যা যেভাবেই আসুক না কেন, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, তন্ত্রের মৌল-তত্ত্ব আসলে দু’টিই– শক্তি ও শক্তিমান। একটি ছাড়া আরেকটি অর্থহীন বা অস্তিত্বহীন। দুয়ে মিলে এক। দার্শনিক-ভাবনায় অদ্বৈতের দ্বৈত-প্রকাশ। আবার এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তন্ত্রের প্রাচীনতম উৎসের সন্ধান করতে গেলে তন্ত্রের সাধন-তত্ত্বের সাথে প্রাচীন লোকায়তিক সাংখ্য-তত্ত্বদর্শনের সেই পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বৈত-তত্ত্বের সাযুজ্যই লক্ষ্য করি আমরা। যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শাক্ত-দৃষ্টির সুপ্রাচীন মহিমা। কালে কালে তার সাথে অধিকারী-ভেদে তত্ত্ব-চিন্তক সাধক-উপাসকদের সাধন-যোগ ও চিন্তা-দৃষ্টির বৈচিত্র্যের মিশেলে তন্ত্রের তাত্ত্বিকতায় যুক্ত হয়েছে বহু-বৈচিত্র্যের রহস্যময়তা। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই আমরা তন্ত্রের তত্ত্ব-আলোচনায় অভিনিবেশ করবো।
এক্ষেত্রে উপনিষদানুসারী সৃষ্টিতত্ত্বের ধারণা আত্মস্থ করে শিব-তত্ত্বে বলা হচ্ছে,– ‘প্রলয়-কালে সূক্ষ্মতাপন্ন জগৎকে স্বাঙ্গীভূত করিয়া শক্তি শিবে বিলীন হইয়া থাকেন। সেই কালে শক্তি নিষ্ক্রিয় থাকেন বলিয়া তদবস্থাপন্ন নির্গুণ ব্রহ্মই পরম শিব। তন্ত্র-মতে সকল বস্তুই চেতন, কিছুই জড় নহে। সকল বস্তুই প্রকাশ-স্বরূপ। বস্তুর প্রকাশ-রূপতাকে বাদ দিলে তাহার কোন অস্তিত্বই থাকে না। অতএব তত্ত্ব-দৃষ্টিতে সকল বস্তুই প্রকাশময় শিব-স্বরূপ। শুধু যে জ্ঞেয় ভাব-পদার্থই শিব-স্বরূপ, তাহা নহে, অভাব-পদার্থও তৎ-স্বরূপ। বস্তুর প্রকাশ ও প্রকাশক (প্রমাতা) অভিন্ন। তাঁহাকেও শিব ব্যতীত আর কিছু বলা চলে না।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৩)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উল্লিখিত ব্যাখ্যায় ভাব-পদার্থ ও অভাব-পদার্থের ধারণাটি এসেছে কণাদের বৈশেষিক দর্শনতত্ত্ব থেকে। মহর্ষি কণাদ জগতের সকল বিষয় ও বস্তুকে এই দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। জগতের যাবতীয় সকল কিছুই ভাব-পদার্থের অন্তর্ভুক্ত। আর অভাব-পদার্থ হলো ভাব-পদার্থের অভাব-রূপ পদার্থ। বিষয়টা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও বর্তমান নিবন্ধ তার আলোচনার স্থান নয়। আবার ন্যায়-প্রস্থান অনুযায়ী জগতের যাবতীয় পদার্থ জ্ঞান-নির্ভর, তাই সবকিছুই প্রমাণ ও প্রমাণ-নির্ভর প্রমেয়ের অন্তর্ভুক্ত। সে যাক, শিব-তত্ত্বে আরও বলা হচ্ছে–
‘প্রকাশময় পরম শিব স্বতন্ত্র অর্থাৎ স্বাধীন বলিয়া কোনও প্রমাণ তাঁহার স্বরূপকে পরিমিত অর্থাৎ পরিচ্ছিন্ন করিতে পারে না। প্রমেয় বস্তুগুলিও প্রকাশময়কে পরিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত করিতে পারে না। স্বতন্ত্র এবং অন্যানপেক্ষ প্রকাশময় পরম শিব দেশ, কাল প্রভৃতির দ্বারাও সীমাবদ্ধ হইতে পারেন না। যেহেতু তিনি সর্বব্যাপক এবং নিত্য– অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান– এই কল্পিত কালত্রয়ের দ্বারা অনির্দেশ্য।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৩)
এই প্রপঞ্চময় দার্শনিক-বাক্যের জটিল কূহক যদি আমরা বুঝতে সমর্থ হই তাহলে মোটা দাগে তার অর্থ দাঁড়ায়, নিত্য ও সর্বব্যাপক পরম শিব সাধক-চিত্তে উপলব্ধিগম্য, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণের অগম্য। এই পরম শিবকে ছয়টি ভাবে লক্ষ্য করা যায় বলে তান্ত্রিক আচার্য অভিনবগুপ্ত বলেছেন– (তন্ত্রালোক-১/৬৩) ভোগের আধার ভুবন-রূপে, জগতের সকল বস্তুর দেহ-রূপে, জ্যোতি-রূপে, আকাশাদি-রূপে, নাদ-স্বরূপ শব্দ-রূপে এবং মন্ত্রাত্মক শব্দ-রূপে।
সর্বাত্মক প্রকাশময় পরম শিবকে যে সাধক যে-ভাবে ভাবনা করেন, তিনি সেই ভাবেই তাঁকে প্রাপ্ত হন। এটিও আচার্য অভিনবগুপ্তের সিদ্ধান্ত। যিনি তাঁকে ভুবন-রূপে চিন্তা করেন, তিনি ভুবনাধীশত্ব প্রাপ্ত হন। এভাবে উল্লিখিত ছয়টি ভাবনার ধারা এবং তার ফল কীর্তিত হয়েছে। এই ছয়টি পরস্পর ভেদক উপাধি বা বিশেষণের যোগে এটাও বোঝানো হয়েছে যে, সঙ্কোচক এই ভুবনাদির প্রলয় ঘটলেও পরম শিব একইভাবে বিরাজ করবেন। কারণ তিনি বিশ্বময় হলেও বিশ্বোত্তীর্ণ।
‘আচার্য অভিনবগুপ্ত এই বিষয়ে কামিক-তন্ত্রের প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন– পরম শিব সর্বাকৃতি অর্থাৎ বিশ্বরূপ হইয়াও নিরাকৃতি ও বিশ্বোত্তীর্ণ। একই প্রকাশাত্মা পরম শিব সর্বত্র বিদ্যামান। জল বা আয়নার ভিতরে প্রতিবিম্বিত বস্তু জল বা আয়না হইতে পৃথক্ হইলেও প্রতিবিম্বনের সময় সেই বস্তুকে জলাদি হইতে অভিন্ন বলিয়াই প্রতীতি জন্মে। প্রকাশময় পরম শিবও নিখিল বিশ্বকে অর্থাৎ তাঁহার শক্তিকে এইভাবে আপন হইতে অভিন্ন-রূপে (ক্রোড়ীকৃতভাবে) প্রকাশ করিতেছেন। এই কারণেই তিনি বিশ্বময় হইয়াও বিশ্বোত্তীর্ণ, এবং বিশ্বোত্তীর্ণ হইয়াও বিশ্বময়।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৪)
‘জগত ব্রহ্মের বিবর্ত মাত্র’– এই অদ্বৈতবাদী বেদান্ত মতের সাথে উল্লিখিত ব্যাখ্যায় খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না। আচার্য অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোকে এ কথাই প্রকাশ করে বলছেন–
স্বাত্মন্যেব চিদাকাশে বিশ্বমস্ম্যবভাসয়ন্ ।।
স্রষ্টা বিশ্বাত্মক ইতি…।।
অর্থাৎ : স্রষ্টা আপনাকেই বিশ্ব-রূপে প্রকাশিত করেন। তিনিই বিশ্বাত্মক।
শক্তি ও শক্তিমানের দ্বৈত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে দ্বৈতবাদী মনে হলেও শাঙ্কর-বেদান্তের মতো অদ্বয়বাদই আগমসম্মত তত্ত্ব, যার মূলে রয়েছে শিব-তত্ত্ব। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও আশঙ্কা-খণ্ডনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী তন্ত্রপরিচয় গ্রন্থে বলেন–
–‘পরম শিবকে বিভু, নিত্য, বিশ্বাকৃতি, বিশ্বোত্তীর্ণ প্রভৃতি বিশেষণের দ্বারা বিশেষিত করিলেও তাঁহার স্বরূপের কিছুমাত্র হানি হয় না। আপাতদৃষ্টিতে এই ধর্মগুলি বিভিন্ন হইলেও তাঁহার একমাত্র ধর্ম প্রকাশময়ত্বে এইগুলি অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে। তিনি আপনার এবং তাঁহার ধর্মের প্রকাশের নিমিত্ত অপর কাহারও অপেক্ষা করেন না। এই প্রকাশময়ত্বকেই কামিকাদি-তন্ত্রে ‘অহং প্রত্যবমর্শ’ বা স্বাতন্ত্র্য-শক্তি নামে প্রকাশ করা হইয়াছে। এই স্বাভাবিকী শক্তির যোগেই শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারে সমর্থ হইয়া থাকেন।’
–‘এই স্থলে একটি আশঙ্কা হইতে পারে যে, নানা শাস্ত্র-বচনে পরম শিবের ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া প্রভৃতি অনন্ত শক্তিমত্তার কথা শোনা যায়, এখানে শুধু স্বাতন্ত্র্য-শক্তির সহিত তাঁহার যোগের কথা বলা হইল। ইহা তো পূর্বাপর-বিরুদ্ধ হইতেছে। এইপ্রকার আশঙ্কা নিরসনের নিমিত্ত বলা হইতেছে– এই স্বাতন্ত্র্য-শক্তিই ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া প্রভৃতি নানা সংজ্ঞায় কীর্তিত হইয়া থাকে। সুতরাং স্বাতস্ত্র্য-শক্তিমত্তা আর অনন্ত-শক্তিমত্তা একই কথা।’
–‘এইভাবে স্বাতন্ত্র্য-শক্তি নামে একটি পৃথক বস্তুর সত্তা মানিয়া লইলে আগম-সম্মত অদ্বয়-বাদের হানি ঘটে– এই আশঙ্কাও অকিঞ্চিৎকর। কারণ বস্তুর আপন সত্তা বা রূপই তাহার শক্তি। শক্তি ও শক্তিমানে যথার্থ ভেদ নাই। ভেদ কাল্পনিক মাত্র। এই ভেদ-সিদ্ধান্ত শুধু আরোপিত হয়। সুতরাং পরম শিবকে শক্তিবিশিষ্ট বলিলেও কোন হানি ঘটে না।’
–‘সূর্য তেজঃ-পদার্থ, কিন্তু সাধারণতঃ আমরা বলিয়া থাকি, ‘সূর্য তেজস্বী’, ‘সূর্যের তেজ’– ইত্যাদি। সেইরূপ শিব বা ব্রহ্ম স্বয়ং শক্তি-স্বরূপ হইলেও ‘শিব শক্তিমান্’– এইপ্রকার প্রয়োগ করা হয়। এই প্রয়োগ শুধু ব্যবহারিক, প্রকৃত নহে। উভয় তত্ত্বই অভিন্ন, অর্থাৎ একই পদার্থ।’
–‘আচার্য অভিনবগুপ্ত প্রসঙ্গতঃ আরও একটি আপত্তি উত্থাপন করিয়া খণ্ডন করিয়াছেন। শক্তি ও শক্তিমানের মধ্যে যথার্থ ভেদ না থাকিলেও বিভিন্ন শক্তির মধ্যে পরস্পর ভেদ থাকায় অদ্বয়-বাদের হানি ঘটিতেছে– এইপ্রকার আপত্তির উত্তরে তন্ত্রাচার্যগণ বলিয়াছেন– অগ্নির যেমন দাহিকা শক্তি আছে সেইরূপ পাচিকা শক্তিও আছে। কিন্তু এই দুইটিকে অভিন্ন-রূপে দেখা যায়। এইভাবে পরম শিবের অনন্ত শক্তি বাস্তবিক বিভিন্ন নহে। শক্তি ও শক্তিমানের ভেদপ্রতীতি যেরূপ অবাস্তব, শক্তিসমূহের পরস্পর ভেদপ্রতীতিও সেইরূপ অবাস্তব। অতএব আগমসম্মত অদ্বয়-বাদের কোন ক্ষতি হইতেছে না।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৫)
২. শক্তি-তত্ত্ব :– শিবের সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছাকেই শক্তি-তত্ত্ব বলা হয়। শিবের ধর্মই শক্তি। এই শক্তি ‘বিমর্শ-শক্তি’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। শ্রুতি অনুযায়ী, সৃষ্টির প্রারম্ভে পরম ব্রহ্মের সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছার যে স্ফূরণ হয়েছিল, এই স্ফূরণের নামই বিমর্শ। এটিই শক্তির প্রথম প্রকাশ। এক পরম শিবই অনাদি-সিদ্ধ মায়ার যোগে ধর্মী ও ধর্ম– এই উভয়রূপে প্রকাশিত হচ্ছেন। শ্রী সুখময় শাস্ত্রী তাঁর তন্ত্রপরিচয় গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভাস্কর রায় আগম-শাস্ত্র থেকে কতকগুলি শক্তিবাচক শব্দ চয়ন করে গুপ্তবতীতে প্রকাশ করেন, যেমন– বিমর্শ, চিতি, চৈতন্য, আত্মা, স্বরসোদিতা, পরা বাক্, স্বাতন্ত্র্য, ঐশ্বর্য, সত্তত্ত্ব, সত্তা, স্ফুরত্তা, সার, মাতৃকা, মালিনী, হৃদয়মূর্তি, সংবিৎ, কর্তৃত্ব, স্পন্দ ইত্যাদি।
–‘যদিও নিখিল বিশ্বই পরম শিবের শক্তি, তথাপি জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া এই তিন রূপেই শক্তির সমধিক প্রকাশ। মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী পাঠ করিতে পাঠকগণ মহাসরস্বতী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই জ্ঞানশক্তি। মহাকালী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই ইচ্ছাশক্তি এবং মহালক্ষ্মী-রূপে যাঁহাকে স্মরণ করেন, ইনিই ক্রিয়াশক্তি। এই তিনের মধ্যে কোন ভেদ নাই। সকল বিশ্বই শক্তি-স্বরূপ। সুতরাং শক্তি ও শক্তিমানের অভেদই তান্ত্রিক-সম্মত পরম তত্ত্ব।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৭৬)
শাস্ত্রকার বলেন, প্রত্যেক বস্তুতেই আপন আপন প্রয়োজন-সাধিকা শক্তি-রূপে শক্তির এবং বস্তু-রূপে শিবের অধিষ্ঠান স্বীকার করতে হয়। এই শক্তিকেই আদ্যশক্তি এবং মহামায়া বলে। শিব শক্তি হতে অভিন্ন। তবে বেদান্ত-দর্শনের মায়া আর এই শক্তি এক বস্তু নন। মায়া জড় পদার্থ, কিন্তু এই মহামায়া নিত্যচৈতন্য-রূপিণী। সংসার-বন্ধনের বেলায় এই শক্তিই মায়া-রূপে জীবকে বন্ধন করেন। মোচনের বেলায় ইনিই মহামায়া-(শিব) রূপে জীবকে মুক্ত করেন। মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীতে এই তত্ত্বই পরিস্ফুট করে বলা হয়েছে–
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।
অর্থাৎ : ইনিই সেই দেবী, যিনি প্রসন্না এবং বরদা হইলে জীবের মুক্তি দান করেন।
সন্মোহিতং দেবী সমস্তমেতৎ
ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ।
অর্থাৎ : হে দেবী, তুমিই মায়া দ্বারা এই জগৎকে সম্মোহিত করিয়া রাখিয়াছ। তুমি প্রসন্না হইলে সংসার মুক্ত করিয়া থাক।
শিব ও শক্তিতে যে আসলে কোন প্রভেদ নেই, তা লিঙ্গপুরাণ থেকেও জানা যায়–
উমাশঙ্করয়োর্ভেদো নাস্ত্যেব পরমার্থতঃ।
দ্বিধাসৌ রূপমাস্থায় স্থিতো একো ন সংশয়ঃ।।
অর্থাৎ : পারমার্থিকভাবে উমা (শক্তি) ও শঙ্করে (শিব) কোন ভেদ নাই। দুই রূপে অবস্থান করিলেও উভয়ে যে এক, তাহাতে কোন সংশয় নাই।
উভয়ের এই মিলিত মূর্তিই অর্ধনারীশ্বরে প্রকাশিত। আচার্য শঙ্করও তাঁর আনন্দলহরীতে বলেছেন–
ত্বমেব স্বাত্মানং পরিণময়িতুং বিশ্ববপুষা,
চিদানন্দাকারং শিবযুবতি ভাবেন বিভৃষে।
অর্থাৎ : শিব ও শক্তি বস্তুতঃ একই তত্ত্ব। শক্তিই শিবের দেহ। উভয়ের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি-ভাব সম্বন্ধ। উভয়ই সমরস, পরানন্দ।
আনন্দলহরীতে আরও দেখা যায়, বলা হচ্ছে–
শরীরং ত্বং শম্ভোঃ শশিমিহিরবক্ষোরুহযুগম্,
তবাত্মানাং মধ্যে ভগবতি ভবাত্মানমঘম্ ।
অতঃ শেষঃ শেষীত্যয়মুভয়সাধারণতয়া,
স্থিতঃ সম্বন্ধো বাং সমরসপরানন্দপদয়োঃ।।
অর্থাৎ : মাতঃ ভগবতি, তুমিই শিবের শরীর। তোমার স্তনযুগল চন্দ্র ও সূর্য-স্বরূপ। তোমার স্বরূপই ভবের (শিবের) স্বরূপ বলিয়া মনে করি। তোমাদের মধ্যে পরস্পর অঙ্গাঙ্গি-ভাব বিদ্যমান রহিয়াছে। (কিন্তু অঙ্গ ও অঙ্গী নির্ণয় করা যায় না।) উভয়ের এই সমরস (মিলন) পরমানন্দ সম্বন্ধই দেখিতেছি।
শিব ও শক্তির মিলনের পরিণামই বিশ্বপ্রপঞ্চ। তান্ত্রিকের দৃষ্টিতে জগতের সকল পদার্থেই চৈতন্যরূপিণী শক্তির লীলা চলছে। অতএব সকল পদার্থই চেতন। অচেতন বলে কিছুই নেই। সাধক এই চিৎ-শক্তিকেই প্রণতি নিবেদন করেন। শক্তি থেকে শিব স্বতন্ত্র নন। তার মানে, শক্তিবিরহিত কেবল শিব কর্তৃত্বাদি-ধর্মশূন্য। বামকেশ্বর-তন্ত্রের টীকায় ভাস্কর রায় সিদ্ধান্ত করেছেন– ‘সকলকেই এই মহাশক্তির উপাসনা করিতে হয়। মায়াশক্তিকে আশ্রয় করিয়াই ঈশ্বর মূর্তি পরিগ্রহ করেন। এইহেতু তাঁহার পুংমূর্তি ও স্ত্রীমূর্তি সবই শক্তি-স্বরূপ। শিব ও শক্তির সম্বন্ধ নিত্য। কখনও তাঁহাদের বিচ্ছেদ নাই। শক্তির পুংশক্তির স্ফুরণে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার আবির্ভাব, আর স্ত্রীশক্তির স্ফুরণে দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি স্ত্রী-দেবতার আবির্ভাব। এই তত্ত্ব সবিশেষ অবগত হইয়া উপাসনা করিতে হয়।’
শিব ও শক্তি উভয়ের মধ্যে প্রভেদ যে কল্পিত, বাস্তব নয়– তা-ই দেখানো হয়েছে। কিন্তু এই ভেদ-কল্পনারও সার্থকতা আছে। কারণ শিব প্রকাশস্বরূপ মাত্র। তিনি অখণ্ড পূর্ণস্বভাব। তবুও তিনি বিশেষ বিশেষ শক্তির মধ্যস্থতায় ধ্যানের বিষয়ীভূত হয়ে থাকেন। সেই আংশিক রূপ বা লক্ষণকে অভিনবগুপ্ত ‘শৈবীমুখ’ বলেছেন। তার অপর সংজ্ঞা ‘শক্তি’। শক্তি-বিষয়ক জ্ঞানের দ্বারা সাধককে শিব-বিষয়ক জ্ঞান লাভ করতে হয়। অন্য কোন উপায় নেই। সুতরাং শক্তিই হচ্ছেন শক্তিমান্ শিবের জ্ঞানের উপায়-স্বরূপ। শক্তিমান শিব হচ্ছেন– উপেয়। শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্যে–
–‘যদিও শিবতত্ত্ব বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় না, তথাপি ইহা মানস জ্ঞানের বিষয় হইয়া থাকে। আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি চক্ষুরাদি বহিরিন্দ্রিয়ের গোচরীভূত না হইলেও মানস অনুভবের বিষয়ীভূত হইয়া থাকে। শিবও এইভাবে মানস জ্ঞানের গোচর হইতে পারেন। কিন্তু প্রথমতঃ শক্তি-বিষয়ক জ্ঞান আবশ্যক। শক্তিজ্ঞানের দ্বারাই শিবজ্ঞান হইয়া থাকে।’- (তন্ত্রপরিচয়)
তন্ত্রমতে নাদ, বিন্দু প্রভৃতি শক্তিরই স্বরূপ। যদিও সমস্ত ভুবন-রূপ শক্তির জ্ঞান অসম্ভব, তবুও নাদ, বিন্দু প্রভৃতি যে-কোন শক্তির মধ্যস্থতায় শিব-বিষয়ক মানস প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে; এই শক্তিই শিব-জ্ঞানের চরম উপায় এবং ভুবনাদি অনন্ত-রূপে এই শক্তিই বিরাজ করছেন। আপাত বুদ্ধিতে যাকে আমরা জড়-রূপে জানছি, যে বস্তুকে চেতন বলে মনে করছি, সব কিছুই শক্তির স্ফুরণ-মাত্র। জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি প্রভৃতি সকল অবস্থাই শক্তির স্ফুরণ। জগতে কর্মের ও বস্তুর বৈচিত্র্যের মধ্যেই শক্তির অনন্ত প্রকাশ। পরম শিবের স্বাতন্ত্র্য শক্তির প্রকাশ বলেই সমগ্র জগৎ শক্তি-স্বরূপ। অভিনবগুপ্ত বলেছেন, শিবের বিভূতিই তাঁর শক্তি। এভাবে অনন্ত বিভূতি বা বৈচিত্র্যবিশিষ্ট ষড়ত্রিংশৎ তত্ত্ব-রূপ এই জগতের প্রাণস্বরূপ একমাত্র আনন্দঘন শিবই বিরাজ করছেন। শক্তির স্ফুরণ ও উপাসনা সম্বন্ধে অভিনবগুপ্ত আরও বলেছেন যে,– ‘যে-সকল সাধক বোধস্বভাব হইতে পৃথক্-রূপে নিয়মিত নাম-রূপবিশিষ্ট ইন্দ্রাদি দেবতাকেই উপাস্য-রূপে ভাবনা করেন, তাঁহারাও স্ব-স্ব উপাস্য দেবতাকে পরম শিব হইতে অভিন্ন বলিয়াই মনে করেন। শিব হইতে অভিন্ন বলায় শক্তি হইতেও অভিন্নই বুঝিতে হইবে।’
–‘এই বৈচিত্র্যময় বিশ্ব যাহাতে উদিত ও অস্তমিত হয়, তাঁহাকে তান্ত্রিক পরিভাষায় ‘কুল’ বলে। কুলও শক্তিরই স্ফুরণ-বিশেষ। কুল ব্যাতিরেকেও যাঁহার সত্তা উপলব্ধ হয়, তিনিই ‘অকুল’, অর্থাৎ শিব। যে শক্তি অকুল ও কুলের সম্পর্কে অনুকুলতা করে, সেই শক্তিই কৌলিকী পরা শক্তি। প্রভু পরম শিব সেই কৌলিকী পরা শক্তির সহিত নিত্য যুক্ত আছেন।’
–‘শিব কখনও শক্তিবিরহিত হন না এবং শক্তিও শিববিরহিতা হইতে পারেন না। এই উভয়ের পরস্পর মিলিত রূপের নামই ‘যামল’। যামল শব্দের ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থই হইতেছে– ‘যুগল’। অকুল ও কৌলিকী শক্তির যামল-রূপকে তান্ত্রিক পরিভাষায় ‘সংঘট্ট’ বলে। সংঘট্ট শব্দের অর্থ সম্যক্ ঘট্টন, অর্থাৎ চলন। স্পন্দ ও চলন একার্থক শব্দ। ইহাকে আনন্দ-শক্তিও বলা হয়। ইহা হইতেই বিশ্বের উদ্ভব।’- (তন্ত্রপরিচয়)
শক্তি শিব হতে অভিন্না হলেও শিবনিষ্ঠা, শিবের ধর্মরূপা এবং শিবের সাথে মিলিত-রূপে যাবতীয় কর্তৃত্বের সম্পাদিকা। এভাবে ব্যবহারিক প্রয়োজনে শিবের সাথে তাঁর ঈষৎ ভেদ কল্পিত হয়েছে। সগুণ-উপাসনা বিষয়ক আলোচনায়ও জানা যায়, নির্গুণ শিব উপাস্যই হতে পারেন না। উপাস্য দেবতার গুণকীর্তন, নামকীর্তন ইত্যাদি উপাসনার অঙ্গ। উপাসনা-মাত্রই সগুণ-ব্রহ্মবিষয়ক মানস ব্যাপার-বিশেষ। শক্তিরহিত কেবল শিব নির্গুণ বলে তাঁর ধ্যান, স্তুতি, নামকীর্তন প্রভৃতি সম্ভবপর নয়। অতএব শক্তিবিরহিত শিব উপাস্যই নন। যোগিনী-তন্ত্র বলছে–
শক্ত্যা বিনা শিবে সূক্ষ্মে নাম ধাম না বিদ্যতে।
অর্থাৎ : শক্তিবিরহিত সূক্ষ্ম শিবের বাচক শব্দ থাকিতে পারে না এবং শব্দ-ভব তদ্বিষয়ক জ্ঞানও হইতে পারে না।
যদি শ্রুতিশাস্ত্রের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায়, তৈত্তিরীয়-উপনিষদেও বলা হয়েছে–
যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
অর্থাৎ : যাঁহার রূপ ও গুণ আছে, তাঁহার বিষয়েই বাক্য প্রয়োগ করা যাইতে পারে এবং মন দিয়াও তাঁহার বিষয়ে চিন্তা করা চলে।
যেহেতু শক্তিবিরহিত শিব রূপ ও গুণের অতীত, কাজেই তাঁর বিষয়ে বাক্যপ্রয়োগও চলে না, মনও তাঁর বিষয়ে কোন চিন্তা করতে পারে না। শুধু ‘নেতি নেতি’– অর্থাৎ তিনি এই নন, সেই নন– এরকম নিষেধবাচক পরিশেষ-রূপে তিনি জ্ঞেয় হয়ে থাকেন। অতএব শুধু শিবজ্ঞান উপাসনাদিতে কোন কাজে লাগে না। বাক্য এবং মনের বিষয়ীভূত না হলে তাঁর উপাসনা হবে কিভাবে? নাম ও গুণের সাথে পর ব্রহ্মের যে রূপ তাঁরই ইচ্ছায় কল্পিত হয়েছে, সেই রূপেরও অপর নাম শক্তি। বিষ্ণু, শিব, শক্তি, গণেশ ও সূর্য– প্রধান এই পঞ্চদেবতাও সেই শক্তি-শব্দের বাচ্য। কেবল শিব জ্ঞেয় হয়ে থাকেন। সগুণ উপাসনার দ্বারা বিশুদ্ধীভূত চিত্তে নির্গুণ শিব-বিষয়ক জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে।
তন্ত্রের এই ষটত্রিংশৎ-তত্ত্বে শিব ও শক্তি তত্ত্বের পরে বাকি যে চৌত্রিশটি তত্ত্ব রয়েছে, বাস্তব দৃষ্টিতে এগুলিও শক্তি-তত্ত্বেরই অন্তর্গত। রাজানক জয়রথ-কৃত তন্ত্রালোক-টীকায় (৯/৩১২) একটি তন্ত্রবচন রয়েছে–
পঞ্চত্রিংশত্তত্ত্বী শিবনাথস্যৈব শক্তিরুক্তেয়ম্ ।
অর্থাৎ : শিব ব্যতীত অপর পঁয়ত্রিশটি তত্ত্ব শিবেরই শক্তিস্বরূপ।
ঐ টীকাতে অপর একটি তন্ত্রবচনেও (৫/৪০) এরকম বলা হয়েছে–
শক্তিশ্চ শক্তিমাংশ্চৈব পদার্থদ্বয়মুচ্যতে।
শক্তয়শ্চ জগৎ সর্বং শক্তিমাংশ্চ মহেশ্বরঃ।।
অর্থাৎ : পদার্থ (তত্ত্ব) মাত্র দুইটি– শক্তি আর শক্তিমান্ । নিখিল জগতই শক্তি, আর শক্তিমান্ হইতেছেন– মহেশ্বর।
৩. সদাশিব :– এই জগৎকে যিনি আপনা থেকে অভিন্ন বলে মনে করেন, তিনিই সদাশিব।
৪. ঈশ্বর :– এই জগৎকে যিনি নিজ হতে ভিন্ন বলে মনে করেন, তিনিই ঈশ্বর। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র– এই তিন মূর্তি ঈশ্বর-তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। ‘আমি বিশ্ব হইতে ভিন্ন’ এই ভাব প্রকাশ পেলেই সৃষ্টি, পালন ও লয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। ঈশ্বরই ব্রহ্মাদি-রূপে যথাক্রমে এই তিনটি কর্ম করে থাকেন।
৫. বিদ্যা :– অহন্তা ও ইদন্তার অভিন্নত্ব জ্ঞান, অর্থাৎ ‘আমিই এই জগৎ’– সদাশিবের এ প্রকার জ্ঞানের নামই বিদ্যা। এ বিদ্যাকে শুদ্ধ বিদ্যাও বলা হয়। এই বিদ্যাই সদাশিবের মহিষী বা শক্তি। তা-ই ব্রহ্মবিদ্যা।
৬. মায়া :– ‘এই জগৎ আমা হইতে ভিন্ন’– ঈশ্বরের এ প্রকার জ্ঞানের নামই মায়া। তা-ই ঈশ্বরের শক্তি।
৭. অবিদ্যা :– (উল্লিখিত) বিদ্যার আবরণকারিণী তত্ত্বের নাম অবিদ্যা। তার দ্বারা জীবের শিবভাব ও সর্বজ্ঞতা আবৃত হয়ে থাকে।
৮. কলা :– শিবের সর্বময় ব্যাপক শক্তি সঙ্কুচিত হয়ে জীবে অবস্থান করে। এই সঙ্কুচিত শক্তিরই নাম কলা।
৯. রাগ :– অনুরাগ বা আসক্তিকে রাগ বলা হয়। যে বিষয় মনকে আকর্ষণ করে, সে বিষয়ে অনুরাগ হয়। বৈষয়িক তৃপ্তি অপূর্ণ থাকলে সে বিষয়ে আসক্তি জন্মে। পরম শিব নিত্য-তৃপ্ত। অতীতে, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে তাঁর কোনরূপ অনুরাগ থাকতে পারে না। শিবের সেই নিত্য তৃপ্তি সঙ্কুচিত হয়ে অপূর্ণ জীবে আশ্রয় লাভ করে। জীবের তৃপ্তি অসম্পূর্ণ। সর্বদাই ভোগ্য বিষয়ে আসক্তি থাকে। শিবের এই সঙ্কুচিত তৃপ্ততা শক্তিকেই রাগ-তত্ত্ব বলা হয়।
১০. কাল :– সকল অনিত্য বস্তুকে কলন অর্থাৎ ধ্বংস করে বলে এই তত্ত্বকে কাল-তত্ত্ব বলা হয়। শিব নিত্য তত্ত্ব, উৎপত্তিরহিত ও বিনাশরহিত। কাল তাঁকে ধ্বংস করতে পারে না। জাগতি পদার্থের ছযপ্রকার বিকার, অর্থাৎ পরিণাম ঘটে। প্রতিনিয়তই প্রত্যেক অনিত্য বস্তুর পরিণাম ঘটছে। ছয়টি পরিণাম হচ্ছে– অস্তি (অবস্থান), জায়তে (উৎপত্তি), বর্ধতে (বৃদ্ধি), বিপরিণমতে (অবস্থান্তরপ্রাপ্তি), অপক্ষীয়তে (ক্ষয়) এবং বিনশ্যতি (ধ্বংস)। এই ছয়প্রকার বিকারের পারিভাষিক সংজ্ঞা– ষড়্ভাব-বিকার। শিবের নিত্যতা-শক্তি এই ষড়্ভাববিকার-বশে সঙ্কুচিত হয়ে ‘কাল’ আখ্যা প্রাপ্ত হয়। চন্দ্র-সূর্যাদির গতি অনুসারে এই কালকে দণ্ড, পল, ঘটিকা, দিন, পক্ষ, মাস, ঋতু, বৎসর, যুগ, কল্প, মন্বন্তর প্রভৃতি-রূপে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে কাল্পনিক বিভাগ করা হয়েছে।
বস্তু অবস্থান্তরিত না হয়ে স্বরূপে স্থিত হলেও তাকে পরিণামই বলে। এ ধরনের পরিণামের নাম সদৃশ পরিণাম। শৈব ও শাক্ত দর্শন পরিণামবাদী। জাগতিক প্রত্যেক বস্তুরই পরিণাম ঘটছে। কারণ এই ষড়্ভাব-বিকারের হাত থেকে কোন বস্তুই মুক্ত নয়।
১১. নিয়তি :– নিয়তি শব্দের অর্থ নিয়ম। ‘এই কাজ করলে এরকম ফল হবে’– এরূপ নিয়মকেই নিয়তি বলা হয়। শিব নিত্যই স্বাধীন, সর্বপ্রকারে তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর এই স্বাধীনতা অবিদ্যার যোগে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। সঙ্কুচিত বা পরিমিত স্বাধীনতাই নিয়তি। তাকে অদৃষ্ট বা ভাগ্যও বলা হয়।
১২. জীব :– জীবই পুরুষ। জীব শিবের অংশ, অর্থাৎ অসর্বজ্ঞ শিব। এইহেতু জীবকে অণু বলে। শিবের এই জীব-ভাবই শরীর-ধারণ ও মরণের হেতু। এই জীবই অবিদ্যা, কলা, কাল এবং নিয়তির আশ্রয়। সৌভাগ্যভাস্করে স্মৃতিসংহিতা ও পুরাণ থেকে এ বিষয়ে বচন উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন–
বিস্ফুলিঙ্গা যথা তাবদগ্নৌ চ বহুধা স্মৃতাঃ।
জীবাঃ সর্বে তথা শর্বঃ পরমাত্মা চ স স্মৃতঃ।। (লিঙ্গপুরাণ)
অর্থাৎ : অগ্নি থেকে যেভাবে অসংখ্য স্ফূলিঙ্গকণা উদ্ভূত হয়ে থাকে, কিন্তু কণাগুলি অগ্নি থেকে অভিন্ন, সেরূপ শিব থেকে জীবের উৎপত্তি এবং জীব শিব থেকে অভিন্ন।
জীব পরম শিব বা পরব্রহ্মের অংশ-স্বরূপ। ষট্চক্রের রহস্যে জানা যায়, সহস্রারে পরম শিব, হৃদয়ে জীব এবং মূলাধারে কুণ্ডলিনী শক্তি অবস্থিত। জীব পরম শিব থেকে চৈতন্য এবং কুণ্ডলিনী থেকে শক্তি লাভ করেন। পরশুরাম-কল্পসূত্রে (১/৫) বলা হয়েছে–
শরীরকঞ্চুকিতঃ শিবো জীবো নিষ্কঞ্চুকঃ পরশিবঃ।
অর্থাৎ : শরীর অর্থাৎ ত্রিবিধ মলের দ্বারা আবৃত শিবই জীবত্ব প্রাপ্ত হন। এই শরীরাত্মক আবরণ-বিহীন হইলে জীবকেই শিব বলা যায়।
‘পরম শিব সর্বথা স্বতন্ত্র। তাঁহার স্বতন্ত্রত্বে অপর কিছুর অপেক্ষা নাই। শিব স্বেচ্ছায় আপন মায়া-শক্তি দ্বারা পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যকে আচ্ছাদন করিলে তাঁহার স্বাতন্ত্র্য পরিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। এই পরিচ্ছিন্ন বা পরিমিত স্বাতন্ত্র্য-জ্ঞানের নাম ‘আণব মল’। আণব মলেরই অপর সংজ্ঞা হইতেছে– ‘অবিদ্যা’।’
–‘পরিচ্ছিন্ন আণব মলের দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন চিৎ-স্বরূপ শিবের আবৃত হওয়াও অসম্ভব নহে। অঘটন-ঘঁন-পটীয়সী মায়ার সামর্থ্যে সবই সম্ভবপর। এইভাবে আণব মলের দ্বারা আবৃত হইয়া শিব দেহপরিমিত অণু-রূপ ধারণ করিয়া জীবকে আপনা হইতে ভিন্নরূপে মনে করেন। এই ভেদবুদ্ধিও মায়ারই সামর্থ্য। এই ভেদবুদ্ধির সংজ্ঞা হইতেছে– ‘মায়িক মল’।’
–‘মায়িক মলের দ্বারা মলিন হইয়া জীব শুভাশুভ কর্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। কর্মজনিত সংস্কার জীবেই স্থিতি লাভ করে। এই সংস্কারের বশেই জীবের জন্ম-মরণ, সুখ-দুঃখ প্রভৃতি ভোগ উপস্থিত হয়। এই সংস্কারের পারিভাষিক সংজ্ঞা হইতেছে– ‘কার্ম মল’।’
–‘উল্লিখিত সূত্রে শরীর শব্দের অর্থ আণব, মায়িক ও কার্ম মল। বিভু শিব, অণু অর্থাৎ ক্ষুদ্র জীব-রূপে প্রতিভাত হইলে তাঁহাকেই অণু বলে। তাঁহার এই অণুত্ব-সম্পাদক মলের নামই ‘আণব মল’।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৪)
১৩. প্রকৃতি :– প্রকৃতি শব্দ চিত্তকে বুঝিয়ে থাকে। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থার নাম প্রকৃতি। প্রকৃতিই বুদ্ধি প্রভৃতির মূল কারণ। এজন্য তাকে মূলা প্রকৃতিও বলা হয়। সত্ত্বাদি গুণত্রয় এবং বুদ্ধিতত্ত্ব প্রভৃতি পরবর্তী তত্ত্বগুলি প্রকৃতিতে অনভিব্যক্ত হয়ে সূক্ষ্ম-রূপে অবস্থান করে বলে তাকে ‘অব্যক্ত’ও বলা হয়।
১৪. মনঃ — রজোগুণ-প্রধান যে অন্তঃকরণ, তাকেই মন বলা হয়। রজোগুণের প্রাধান্য ঘটলে সত্ত্ব ও তমোগুণ অভিভূত হয়ে থাকে, মন থেইে সব ধরনের সঙ্কল্পের উদয় হয়।
১৫. বুদ্ধি :– সত্ত্বগুণ-প্রধান যে অন্তঃকরণ, তাকেই বুদ্ধি বলে। সত্ত্বগুণের প্রাধান্য ঘটলে রজঃ ও তমোগুণ অভিভূত হয়ে থাকে। বুদ্ধি থেকেই সব ধরনের নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানের উদয় হয়।
১৬. অহঙ্কার :– তমোগুণ-প্রধান যে অন্তঃকরণ, তারই নাম অহঙ্কার। তমোগুণের প্রাধান্যে সত্ত্ব ও রজোগুণ অভিভূত হয়ে থাকে। অহঙ্কার থেকেই বিকল্প, অর্থাৎ ভেদ-জ্ঞানের উৎপত্তি হয়ে থাকে। ‘আমি যাই’, ‘আমি খাই’, ‘ইহা আমার’ এভাবে ‘আমি’ এবং ‘আমার’ ইত্যাদি জ্ঞান অহঙ্কার-তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়।
১৭-২১. শ্রোত্র-ত্বক-চক্ষুঃ-জিহ্বা-ঘ্রাণ :– শ্রোত্র থেকে ঘ্রাণ পর্যন্ত এই পাঁচটি তত্ত্বকে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে। শব্দগ্রাহক ইন্দ্রিয়ের নাম শ্রোত্র। স্পর্শগ্রাহক ইন্দ্রিয়কে ত্বক বলে। রূপগ্রাহক ইন্দ্রিয়ের নাম চক্ষু। রসগ্রাহক ইন্দ্রিয় জিহ্বা। গন্ধগ্রাহক ইন্দ্রিয়ের নাম ঘ্রাণ।
২২-২৬. বাক্-পাণি-পাদ-পায়ু-উপস্থ :– বাক্ থেকে উপস্থ– এই পাঁচটি তত্ত্বকে কর্মেন্দ্রিয় বলা হয়। বাক্য উচ্চারণের প্রধান কারণ তত্ত্বের নামই বাক্-তত্ত্ব। গ্রহণ ও ত্যাগের সাধন কর্মেন্দ্রিয়ের নাম পাণি-তত্ত্ব। চলা ফেরার সাধন যে কর্মেন্দ্রিয়, তা-ই পাদ নামে অভিহিত। মল ত্যাগের সাধন যে কর্মেন্দ্রিয়, তারই নাম পায়ু। উৎপাদনানন্দের সাধন কর্মেন্দ্রিয়কে উপস্থ বলে।
২৭-৩১. শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ :– শব্দ থেকে গন্ধ পর্যন্ত এই পাঁচটি তত্ত্বকে বলা হয় পঞ্চ-তন্মাত্র, সূক্ষ্ম ভূত বা বিষয়। শব্দ-তত্ত্বকে বলা হয় আকাশ-তন্মাত্র, এই তত্ত্ব শ্রবণেন্দ্রিয়ের বিষয়। স্পর্শ-তত্ত্ব বায়ু-তন্মাত্র, ত্বগিন্দ্রিয়ের বিষয়। রূপ-তত্ত্ব তেজঃ-তন্মাত্র, চক্ষুরিন্দ্রিয়ের বিষয়। রস-তত্ত্ব জল-তন্মাত্র, রসনেন্দ্রিয়ের বিষয়। গন্ধ-তত্ত্ব পৃথ্বী-তন্মাত্র, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের বিষয় হয়ে থাকে।
৩২-৩৬. আকাশ-বায়ু-তেজঃ-জল-পৃথিবী :– আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত যে পাঁচটি তত্ত্ব, এগুলিকে পঞ্চ-মহাভূত বলা হয়। আকাশ-তত্ত্ব অবকাশ বা ফাঁক। বায়ু-তত্ত্ব গতি বিশিষ্ট এবং জননী শক্তির উৎস। তেজঃ-তত্ত্ব দাহিকা শক্তিযুক্ত এবং পাচিকা শক্তিবিশিষ্ট। জল-তত্ত্ব দ্রবত্ববিশিষ্ট। পৃথ্বী-তত্ত্ব কাঠিন্যবিশিষ্ট ও আধারশক্তির আশ্রয়।
পরশুরাম-কল্পসূত্র ছাড়াও অন্য কোন কোন শাস্ত্র-গ্রন্থে তত্ত্বে ষটত্রিংশৎ সংখ্যার কথা জানা যায়। প্রসঙ্গত, তন্ত্রশাস্ত্রে এখানে স্পষ্টতই সাংখ্য-দর্শনের কেবল যে বিপুল প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তাই নয়, সৌসাদৃশ্য দেখে সাংখ্য-দর্শনের তত্ত্বগুলিই সর্বাংশে অভিযোজিত হয়েছে বলে মনে হয়। সাংখ্য-দর্শনোক্ত চতুর্বিংশতি তত্ত্বের বাইরে যে বারোটি তত্ত্ব তন্ত্রশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে, ষট্চক্র, ভূতশুদ্ধি প্রভৃতি যৌগিক ব্যাপারের মতোই এগুলি তন্ত্রের নিজস্ব বস্তু বলেই মনে হয়। কোন কোন তন্ত্র-গ্রন্থে উল্লিখিত ছত্রিশটি তত্ত্বকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন– আত্মতত্ত্ব, বিদ্যাতত্ত্ব ও শিবতত্ত্ব।
–‘যে সকল তত্ত্ব বা পদার্থ শিবের জীবভাবের কারণ এবং যে পদার্থগুলি জীবভাবপ্রাপ্ত শিবের ভোগোপযোগী, সেইগুলিকে আত্মতত্ত্ব বলা হইয়াছে। প্রতিলোম-গ্রন্থে পৃথ্বীতত্ত্ব হইতে মায়াতত্ত্ব পর্যন্ত একত্রিশটি তত্ত্বেই ‘সৎ’ অংশটি প্রকটিত, কিন্তু ‘চিৎ’ ও ‘আনন্দ’ অংশ আবৃত। এইহেতু এই একত্রিশটি তত্ত্বই আত্মতত্ত্ব নামে খ্যাত। শুদ্ধ বিদ্যা, ঈশ্বর ও সদাশিব এই তিনটি তত্ত্বে ‘সৎ’ ও ‘চিৎ’ অংশ প্রকটিত কিন্তু ‘আনন্দ’ অংশ আবৃত। এইহেতু এই তিনটি তত্ত্ব বিদ্যা-তত্ত্বের অন্তর্গত। শক্তি ও শিব এই দুই তত্ত্বে সৎ, চিৎ ও আনন্দ প্রকটিত বলিয়া এই দুইটি তত্ত্ব শিব-তত্ত্বের অন্তর্গত। ছত্রিশটি তত্ত্বের সমষ্টিকে এক কথায় বলা হয় ‘তুরীয় তত্ত্ব’। শারদাতিলকাদি প্রামাণিক নিবন্ধে এই তুরীয় তত্ত্বকেই ‘সর্বতত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে।’
–‘ভাস্কর রায়ের সেতুবন্ধ টীকা হইতে জানা যায়, ছত্রিশটি তত্ত্বের মধ্যে প্রতিলোম-ক্রমে পৃথ্বী-তত্ত্ব হইতে শ্রোত্র-তত্ত্ব পর্যন্ত বিশটি তত্ত্ব পৃথ্বী-তত্ত্বেরই অন্তর্গত হইতে পারে। এইরূপে অহঙ্কার-তত্ত্ব হইতে প্রকৃতি-তত্ত্ব পর্যন্ত চারটি তত্ত্ব জলতত্ত্বের অন্তর্গত হইতে পারে। পুরুষ-তত্ত্ব হইতে মায়া-তত্ত্ব পর্যন্ত সাতটি তত্ত্ব তেজস্তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে। শুদ্ধ বিদ্যা, ঈশ্বর ও সদাশিব এই তিনটি তত্ত্ব বায়ু-তত্ত্বের অন্তর্গত। শক্তি ও শিব এই দুইটি তত্ত্ব আকাশ-তত্ত্বের অন্তর্গত। এই কারণেই বিশ্বকে পাঞ্চভৌতিক বলা হয়।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৬)
আত্মতত্ত্ব, বিদ্যাত্ত্ব ও শিবতত্ত্ব সম্বন্ধে পরশুরাম-কল্পসূত্রে অন্যপ্রকারের সিদ্ধান্তও দেখতে পাওয়া যায় বলে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী– ‘পৃথ্বী-তত্ত্ব হইতে প্রতিলোম-ক্রমে প্রকৃতি-তত্ত্ব পর্যন্ত চব্বিশটি তত্ত্বই আত্ম-তত্ত্বের অন্তর্গত। এই স্থলে আত্ম-তত্ত্বের অর্থ স্থূল শরীর। তান্ত্রিক আচমনে ‘আত্মতত্ত্বায় স্বাহা’ এই মন্ত্রে স্থূল দেহকে শোধন করা হয়। পুরুষ বা জীব-তত্ত্ব, পরম ব্রহ্ম শিবেরই অংশ বলিয়া তাহাতে প্রকাশকত্ব ধর্ম আছে। আপাত দৃষ্টিতে বোঝা যায়– নিয়তি, কাল, রাগ, কলা, অবিদ্যা ও মায়া– এই ছয়টি তত্ত্বের ধর্ম জড়ত্ব। নিয়তি প্রভৃতি ছয়টি তত্ত্ব জীবকে আশ্রয় করিয়া যখন জীবের সহিত তাদাত্ম্য-ভাবাপন্ন হয়, তখন নিয়তি প্রভৃতির জড়ত্ব এবং পুরুষের প্রকাশকত্ব মিশ্রভাবে উভয়েই আরোপিত হইয়া থাকে। এই কারণে মিশ্রভাবাপন্ন এই সাতটি তত্ত্ব বিদ্যা-তত্ত্বের অন্তর্গত। তান্ত্রিক আচমনে ‘বিদ্যাতত্ত্বায় স্বাহা’ এই মন্ত্রে সূক্ষ্ম দেহকে শোধন করা হয়। শুদ্ধ বিদ্যা, ঈশ্বর, সদাশিব, শক্তি ও শিব– এই পাঁচটি তত্ত্বের অসাধারণ ধর্ম শুধু প্রকাশকত্ব। এই কারণে এই পাঁচটিকেই শিব-তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তান্ত্রিক আচমনে ‘শিবতত্ত্বায় স্বাহা’ এই মন্ত্রে কারণ দেহের শোধন করা হয়।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৭)
তন্ত্র-শাস্ত্রে এই ছত্রিশটি তত্ত্ব সম্বন্ধে নানাপ্রকার সিদ্ধান্ত দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অধিকারী-ভেদেই উপদেশের বিভিন্নতা ঘটেছে, তা-ই বুঝতে হবে। কেননা সাধক-বুদ্ধিতে তন্ত্রের কোন বচনকে অপ্রমাণ বলা চলে না। সমস্ত তন্ত্র-শাস্ত্রই হর-পার্বতীর মুখনিঃসৃত।
যুক্তিপ্রধান ন্যায়াদি দর্শন-শাস্ত্রে পদার্থ-সঙ্কলন এবং পদার্থ-বিচারই সমধিক প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু আগম-শাস্ত্রে ষটত্রিংশৎ-তত্ত্ব পদার্থের বিচারের সাথে সাথে অনুষ্ঠান-রূপ কার্যকলাপেরই প্রাধান্য, দার্শনিক বিচার প্রসঙ্গতই উপস্থিত হয়েছে। এ কারণেই এই অংশ দর্শন-সংজ্ঞায় অভিহিত হয়নি।
(খ) সংসার বা জগৎ :
দর্শন-শাস্ত্রের মধ্যে ন্যায়, বৈশেষিক, ভাট্ট-মীমাংসা, জৈন-মত প্রভৃতিতে আরম্ভ-বাদ স্বীকার করা হয়। এই আরম্ভ-বাদেরই অপর নাম অসৎকার্য-বাদ। অন্যদিকে সাংখ্য, পাতঞ্জল, ভট্ট ভাস্কর, বল্লভাচার্য, নিম্বার্ক, রামানুজ, মধ্ব, গৌড়ীয়, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায় পরিণাম-বাদী। পরিণাম-বাদেরই অপর নাম সৎকার্য-বাদ। (কার্য ও কারণের মধ্যে সৎ ও অসৎ সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা-সংশ্লিষ্ট সৎকার্যবাদ ও অসৎকার্যবাদ-এর দার্শনিক বিচার বুঝতে বর্তমান লেখকের ‘চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শন-৩, পূর্ব-মীমাংসা’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।) অদ্বৈত-বেদান্তবাদী আচার্য শঙ্কর মায়াবাদ বা বিবর্তবাদকে স্বীকার করেছেন। কাশ্মীরের প্রত্যভিজ্ঞা-মতাবলম্বী আচার্যরা আভাস-বাদী। স্পন্দ-বাদ এবং আভাস-বাদকে পরিণাম-বাদেরই নামান্তর বলা যেতে পারে। সদাশিবাদি তত্ত্ব-রূপে পরম শিবের প্রকাশ বা পরিণামকে ‘স্পন্দ’ বলা হয়। সকল আগমাচার্য দার্শনিকই পরিণাম-বাদ স্বীকার করেছেন। কেননা, তন্ত্রের দার্শনিক অংশের আলোচনায় আমরা জানতে পারি, শক্তি ও শক্তিমানে কোন ভেদ নেই। বরিবসারহস্য-প্রকাশে স্পষ্টরূপেই বলা হয়েছে– ‘ইয়ং সৃষ্টিঃ পরব্রহ্ম পরিণামঃ’– অর্থাৎ, এই বিশ্বসৃষ্টি পরম ব্রহ্মেরই পরিণাম। তন্ত্র-শাস্ত্রেও বলা হয়েছে–
শক্তির্মহেশ্বরো ব্রহ্ম ত্রয়স্তুল্যার্থবাচকাঃ।
স্ত্রী-নপুংসকো ভেদঃ শব্দতো ন পরার্থতাঃ।। (তন্ত্রতত্ত্বধৃত-৩২৮ পৃ)
অর্থাৎ : শক্তি, মহেশ্বর, ব্রহ্ম প্রভৃতি শব্দ প্রকৃতপক্ষে একই অর্থের বাচক। পুং-স্ত্রী-ক্লীব-লিঙ্গের ভেদে শব্দের বাচ্যগত ভেদ সাধিত হয় না।
শক্তি ও শক্তিমানের অভেদের ন্যায় বস্তুর উপাদান কারণ এবং কার্য বস্তুর মধ্যেও আত্যন্তিক অভেদই তন্ত্রাচার্যগণ স্বীকার করে থাকেন। এই যুক্তিতে তান্ত্রিক-আচার্যরা বলেন, শিব-শক্তির লীলা-রূপ ক্রমিক পরিণতিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাব।
–‘তন্তুরূপ কার্যের প্রতি গুটিপোকা নিজেই নিমিত্ত কারণ এবং উপাদান কারণ হইয়া থাকে। অর্থাৎ তাহারই ইচ্ছায় ও চেষ্টায় তাহার তন্তুজাল বিস্তৃত হইতেছে, আবার তাহারই শরীর হইতে তন্তুজালের সৃষ্টি। বিস্তারের বেলা সে নিমিত্ত কারণ এবং সৃষ্টির বেলায় উপাদান কারণ। শিব-শক্তিও সেইরূপ এই জগতের সৃষ্টির নিমিত্ত এবং উপাদান কারণ হইয়া থাকেন। যখনই তিনি বিশ্ব সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, তখনই তিনি নিমিত্ত কারণ, আর যখন সদাশিবাদি তত্ত্ব-রূপে পরিণত হইয়া এই চরাচর সৃষ্টি করিয়াছেন, তখনই তাহাতে উপাদান-কারণতাও বর্তিয়াছে।’– (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৮)
তন্ত্রে শিব ও শক্তি মিলিতরূপে জগতের কারণ। আচার্য শঙ্কর সৌন্দর্যলহরী-স্তোত্রে তা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন–
শিবঃ শক্ত্যা যুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুম,
যো চেদেবৎ দেবো ন খলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি। -(সৌন্দর্যলহরী)
অর্থাৎ : শিব শক্তিযুক্ত হইলেই আপন প্রভুত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হন। শক্তিবিরহিত শিবের প্রভুত্ব তো দূরের কথা, তিনি স্বয়ং নড়িতেই পারেন না।
শিব ও শক্তি পরস্পর অভিন্নভাবে পরস্পরের মধ্যে অনুস্যুত। তান্ত্রিক পরিভাষায় তাকে ‘সমরস’ অবস্থা বলা হয়। সমান অর্থাৎ অন্যূন এবং অনতিরিক্ত রস (আনন্দ) আছে যাঁদের, তাঁরাই ‘সমরস’। এই সমরসের ভাবই ‘সামরস্য’। শিব-শক্তির পরস্পর অত্যন্ত সংশ্লিষ্ট মিলনের নাম সামরস্য। এই সামরস্য-সম্বন্ধে শক্তি-বিশিষ্ট শিবই পর ব্রহ্ম।
–‘শিব শক্তির সামরস্য বিষয়ে চিন্তা করিলে বোঝা যায়, প্রত্যেক জীবে শিব-শক্তি-ভাব বিদ্যমান। বিশেষতঃ পুরুষে শিবভাব এবং নারীতে শক্তিভাবের সমধিক প্রকাশ। পঞ্চম মকারের গূঢ় রহস্যও শিব-শক্তির সামরস্যের আস্বাদন।’ ‘বস্তুতঃ শিব ও শক্তির পৃথক সত্তা না থাকিলেও পরম শিবই শক্তির অধিষ্ঠান। শিবগত সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কার্যে শক্তি হইতেছেন– সঙ্কল্প-নির্বাহিকা। শক্তি সদ্রূপা এবং পরানন্দরূপিণী।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৮৯)। অগস্ত্যসংহিতায়ও বলা হয়েছে–
যয়া দেব্যা বিরহিতঃ শিবোহপি হি নিরর্থকঃ। -(অগস্ত্যসংহিতা)
অর্থাৎ : শক্তিবিরহিত শিবের কোন সার্থকতাই নাই।
অদ্বৈত বেদান্তে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, মায়াই চিৎস্বরূপ পর ব্রহ্মের শক্তি বা ধর্ম। সেই মায়া অবিদ্যারূপিণী এবং জড়স্বভাবা। মায়া থেকে উৎপন্ন জগতের পারমার্থিক সত্তা নেই। কিন্তু তান্ত্রিকগণের সিদ্ধান্ত অন্যরূপ। তাঁরা বলেন, মহামায়া শিবে অধিষ্ঠিতা। ধর্ম ও ধর্মীর অভিন্নহেতু শক্তি বা মহামায়া জড়স্বভাবা নন। ফলতঃ শিব ও শক্তি অভিন্ন হলেও ব্যবহারিক প্রয়োজনে উভয়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য কল্পনা করা হয়। এ জগৎ শিবশক্তিরই পরিণতি। শক্তিনির্বাহ্য এই বিশ্বপ্রপঞ্চ শিবকুক্ষিতে নিয়ত অবস্থান করছে। তাই তান্ত্রিক মতে জগতও আনন্দস্বরূপ, দুঃখের হেতু নয়। জগতকে তিনি বিভীষিকা বলে মনে করেন না। বিশ্বপ্রপঞ্চকে তিনি চৈতন্যের বিলাস-রূপে অনুভব করেন। তান্ত্রিকের দৃষ্টিতে তাই বিশ্ব হেয় বা দুঃখময় নয়।
সৌভাগ্যভাস্করে ভাস্কর রায় বলেছেন, ব্রহ্ম দ্বিবিধ– নির্গুণ ও সগুণ। সগুণ ব্রহ্মের অপর সংজ্ঞা অপর ব্রহ্ম। এই অপর ব্রহ্মকে দু’ভাবে জানতে হবে। প্রথমতঃ তিনি জগতের নিয়ন্তা, দ্বিতীয়তঃ জগদাত্মক।–
জগন্নিয়ন্তা জগদাত্মকশ্চ। -(সৌভাগ্যভাস্কর ধৃত স্মৃতি)
অর্থাৎ : নিমিত্ত-কারণরূপে তিনিই জগতের নিয়ন্তা, আর উপাদান-কারণরূপে তিনিই জগদাত্মক, অর্থাৎ বিশ্বরূপ।
সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় ইত্যাদির ভেদে জগতের নিয়মও নানারকম। তাই জগৎ-নিয়ন্তা ব্রহ্মই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র প্রভৃতির-ভেদে অনেক রূপ ধরে থাকেন। ফলতঃ ঈশ্বরাদি সকল তত্ত্বই তাঁর মধ্যে অর্থাৎ শিব-শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
–‘নিখিল বিশ্বের প্রলয়কালে বিনষ্ট প্রাণিগণের কর্মফল সূক্ষ্মরূপে আপনার মধ্যে সংহত করিয়া একমাত্র অদ্বিতীয় শিবই অবস্থান করেন। শক্তিও তখন অব্যক্তভাবে শিবে বিরাজ করেন। প্রলয়ের নির্দিষ্ট কাল অতীত হইলে প্রাণিগণের কর্মফলের বৈচিত্র্য অনুসারে পুনরায় সৃষ্টির সময়ে অব্যক্তা শক্তি সৃষ্টিবিষয়িণী ইচ্ছা-রূপে প্রকাশিতা হন। অতঃপর এই আবির্ভূতা আদ্যা শক্তি ক্রমশঃ সৃষ্টিরূপে পরিণত হইয়া থাকেন। তন্ত্রশাস্ত্রে সৎকার্য-বাদকে স্বীকার করা হইয়াছে। যে পদার্থের সত্তা নাই, তাহার কখনও উৎপত্তি হইতে পারে না। প্রলয়ের সময় যে জগতের সত্তাই ছিল না, তাহা সৃষ্টিকালে কিরূপে উৎপন্ন হইতে পারে– এইপ্রকার আশঙ্কার উত্তর-রূপে বামকেশ্বর-তন্ত্র বলিতেছেন–
কবলীকৃতনিঃশেষতত্ত্বগ্রামস্বরূপিণী। -(বামকেশ্বর-তন্ত্র)
–সেই মহাশক্তি প্রলয়কালে তত্ত্বাত্মক সমগ্র জগতকে সম্পূর্ণরূপে নিজের কুক্ষিগত করিয়া অব্যক্ত-রূপে শিবে অধিষ্ঠাতা হন। সূক্ষ্মরূপে কুক্ষিস্থিত জগতকে তিনিই সৃষ্টিকালে প্রকটিত করিয়া থাকেন।’- (তন্ত্রপরিচয়)
তান্ত্রিকদের নিকট এই দৃশ্যমান জগৎ শিব-শক্তির বিচিত্র লীলার রঙ্গমঞ্চ। অভিনেতা রামাদির ভূমিকায় অভিনয় করলেও তিনি যেমন বাস্তবিকই নিজেকে রাম বলে মনে করেন না, বরং রাম-স্বরূপে তিনি নির্লিপ্তই থাকেন, শিব-শক্তিও তেমনি লীলার দ্বারা সংসারে লিপ্ত হয়ে যান না। তাঁর নিকট তাঁর লীলা স্বরূপতঃ সত্য না হলেও সাংসারিক জীবের নিকট অবশ্যই সত্য। সাধনার উচ্চ সোপানে আরোহণ করলে সাধক এই সংসারকেও লীলা বলে মনে করতে পারেন। এই সংসার শিব-শক্তির লীলা। শিব-শক্তির তত্ত্ব হৃদয়ে পরিস্ফুরিত হলে সর্বত্রই লীলা চোখে পড়বে। এভাবেই অধিকারী-ভেদে গ্রহণযোগ্য দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ উভয়ই তন্ত্রশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে।
(গ) শিব ও জীব :
ষটত্রিংশৎ-তত্ত্বের আলোচনায় যদিও প্রথম তত্ত্ব শিব এবং দ্বাদশ তত্ত্ব জীব প্রসঙ্গ সাধারণভাবে আলোচিত হয়েছে, তবু শিবের সাথে জীবের সম্বন্ধ বিষয়টিও কিঞ্চিৎ আলোচনার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে পরশুরাম-কল্পসূত্রে বলা হয়েছে–
শরীরকঞ্চুকিতঃ শিবো জীবো নিষ্কঞ্চুকঃ পরশিবঃ। -(পরশুরাম-কল্পসূত্র-১/৫)
অর্থাৎ : শরীর অর্থাৎ ত্রিবিধ মলের দ্বারা আবৃত শিবই জীবত্ব প্রাপ্ত হন। এই শরীরাত্মক আবরণ-বিহীন হইলে জীবকেই শিব বলা যায়।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শিব এবং জীব যদি বস্তুতই দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক পদার্থ হয়, তাহলে তান্ত্রিকদের সম্মত অদ্বয়বাদী-সিদ্ধান্ত বাধিত হয়ে যায়। প্রসঙ্গত এটাও স্মর্তব্য যে, বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদের সাথে তন্ত্রের সিদ্ধান্তের খুব বেশি বিরোধ নেই। উপরে উল্লিখিত সূত্রেও অদ্বৈতবাদের কথাই বলা হয়েছে। শিব সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন। তাঁর এই স্বাতন্ত্র্য অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে না।
–‘শিব স্বয়ং তাঁহার মায়া শক্তির দ্বারা পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যকে আচ্ছাদিত করিলে সেই অপ্রকাশ-স্বাতন্ত্র বা অস্বতন্ত্র শিবই জীবত্ব প্রাপ্ত হন। শিব ও জীবের মধ্যে বাস্তব ভেদ নাই। এই ভেদ ঔপাধিক মাত্র। শরীরাত্মক উপাধির দ্বারা উপহিত শিবই জীব, আর শরীরোপাধি-বিরহিত জীবই শিব। জীবকে যে শিবের অংশ বলা হয়, তাহার তাৎপর্যও এইরূপই বুঝিতে হইবে। বিভু শিবই উপাধির দ্বারা ক্ষুদ্র জীবে পরিণত হইয়া থাকেন। এই কারণে জীবকে ‘অণু’ বলে। জীবের অণুত্ব-সম্পাদক অবিদ্যার পারিভাষিক সংজ্ঞা ‘আণব মল’, এই কথা বলা হইয়াছে। পরিমিত আণব মলের দ্বারা অপরিমিত, অর্থাৎ বিভু শিব কি প্রকারে আবৃত হইতে পারেন– এই আপত্তি অকিঞ্চিৎকর। কারণ অনির্বচনীয় মায়ার অঘটনঘটন-পটীয়সী শক্তি অনেক কিছুই করিতে পারে।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯১)
শিব যখন জীবরূপ ধারণ করেন, তখন তিনি অসংখ্য জীবকে আপনা থেকে পৃথক বলে মনে করেন। এই ভেদজ্ঞানও মায়ারই লীলা। এই ভেদবুদ্ধিই ‘মায়িক মল’। সুভগোদয়ে উক্ত হয়েছে–
মায়াবিভিন্নবুদ্ধি নিজাংশভূতেষু নিখিলভুতেষু।
নিত্যং তস্যা নিরঙ্কুশবিভবং বেলেব বারিধিং রুদ্ধে।। -(সুভগোদয়)
অর্থাৎ : শিব আপনার অংশভূত বিভিন্ন জীবকেও বিভিন্ন বলিয়াই মনে করেন। তাঁহার এইরূপ অসম্পূর্ণ ভাবনা মায়ারই কার্য। তাঁহার নিত্যত্ব ও নিরঙ্কুশত্ব তখন বাধাপ্রাপ্ত হয়। বেলাভূমি যেরূপ সমুদ্রকে রুদ্ধ বা সীমাবদ্ধ ককিরয়া রাখে, এই দুর্ঘটবিধায়িনী মায়াও সেইরূপ শিবের শিবত্বকে সঙ্কুচিত করিয়া জীবে পরিণত করে।
‘মায়িক মলের দ্বারা আবৃত জীব শুভ ও অশুভ কর্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। শুভাশুভ কর্ম হইতে উৎপন্ন সংস্কারও জীবেই প্রতিষ্ঠিত। এই সংস্কারের ফলে জীবের সুখ,দুঃখ, জন্ম, মরণ প্রভৃতি ঘটিতেছে। যে শরীর-রূপ কঞ্চুক অর্থাৎ আচ্ছাদন গ্রহণ করিলে শিব জীবত্ব প্রাপ্ত হন, সেই শরীর শব্দে ত্রিবিধ মলের সমষ্টিকে বুঝিতে হইবে। আণব, মায়িক এবং কার্ম– এই ত্রিবিধ মলই সূত্রস্থ শরীর শব্দের অর্থ। অর্থাৎ বর্ণিত ত্রিবিধ মলাত্মক কঞ্চুক বা আচ্ছাদনের দ্বারা আচ্ছাদিত শিবই জীব-রূপে পরিচিত হন। এই জীবকে পুরুষও বলা হয়।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯২)
এ প্রসঙ্গে পরমার্থসারে উক্ত হয়েছে–
পরমং যৎ স্বাতন্ত্র্যং দুর্ঘটসম্পাদনং মহেশস্য।
দেবী মায়াশক্তিঃ স্বাত্মাবরণং শিবস্যৈতৎ।। -(পরমার্থসার)
অর্থাৎ : মহেশের যে পরম স্বাতন্ত্র্য, দুর্ঘটসম্পাদিকা মায়া-শক্তির দ্বারা তাহা আবৃত হইয়া পড়ে।
সুভোগদয়েও বলা হয়েছে–
স তয়া পরিমিতমূর্তিঃ সঙ্কুচিতসমস্তশক্তিরেষ পুমান্ ।
রবিরিব সন্ধ্যারক্তঃ সংহৃতরশ্মিঃ স্বভাসনেহপ্যপটুঃ।। -(সুভোগদয়)
অর্থাৎ : সন্ধ্যাকালে আরক্ত সূর্য যেরূপ নিজের রশ্মিকে সংহৃত করেন, তখন নিজকে প্রকাশ করিবার শক্তিও তাঁহার থাকে না, সেইরূপ মায়া কর্তৃক শিবের সমস্ত শক্তি সঙ্কুচিত হইলে সেই শিবই পরিমিতমূর্তি জীব-রূপ প্রাপ্ত হন।
তন্ত্র মতে জীব তিন প্রকার– শুদ্ধ, অশুদ্ধ এবং মিশ্র। অজ্ঞানের আশ্রয় হন না বলে শিব, শক্তি এবং সদাসিব শুদ্ধ জীব। অজ্ঞানের আশ্রয় বলে মানুষ থেকে আরম্ভ করে নীচ শ্রেণীর সকল জীবই অশুদ্ধ জীব। বশিষ্ঠাদি মুনি-ঋষিগণ সময়-বিশেষে অজ্ঞানবিরহিত এবং সময়বিশেষে অজ্ঞানাবৃত বলে ‘মিশ্র’ সংজ্ঞায় অভিহিত হয়ে থাকেন।
(ঘ) মুক্তি :
সকল সাধনারই চরম লক্ষ্য মুক্তি। মুক্তি সবার অভিলষিত বলে তাকে পরম পুরুষার্থ বলা হয়। এ প্রেক্ষিতে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী বলেন– ‘বিচারপূর্বক শাস্ত্র অধ্যয়নের দ্বারা শিব সম্বন্ধে পরোক্ষ জ্ঞান লাভ হইতে পারে, পরন্তু অপরোক্ষ জ্ঞান লাভের নিমিত্ত বিচারপূর্বক শক্তি-তত্ত্ব বিষয়েও জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। শিবের প্রত্যক্ষ অনুভবরূপ জ্ঞান হইতে মুক্তি লাভ হয়। শিবই পরমাত্মা। যথার্থ দৃষ্টিতে শিব ও জীব অভিন্ন। বিশ্বপ্রপঞ্চের কোন বস্তুর সহিতই শিবের আসলে কোন ভেদ নাই। শিব ও বিশ্বের ভেদজ্ঞান অজ্ঞানপ্রসূত।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯৩)
তাই তন্ত্রশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হলো–
মোক্ষঃ সর্বাত্মতাসিদ্ধিঃ। (কৌলোপনিষৎ-৪)
অর্থাৎ : সাধন সাধনার দ্বারা এই অজ্ঞানকে বিনাশ করিলেই মুক্ত হইয়া থাকেন।
সর্বৈক্যতাবুদ্ধিমন্তে। (কৌলোপনিষৎ-২৪)
অর্থাৎ : গুরুপদিষ্ট সাধনমার্গে চলিতে চলিতে সাধক চরম অবস্থায় অদ্বৈত বুদ্ধি লাভ করেন।
বলা হয়ে থাকে, বহু জন্মের তপস্যার ফলে এপ্রকার জ্ঞান লাভ করা যায়। শাস্ত্রাধ্যায়ন ও শাস্ত্রবিহিত কর্মের অনুষ্ঠানে চিত্ত বিশুদ্ধ হয়। চিত্ত বিশুদ্ধ হলে সংসারাসক্তি কিঞ্চিৎ শিথিল হয়। এ অবস্থায় সাধক ভক্তি-যোগ অবলম্বনের যোগ্যতা লাভ করেন।
–‘ভাস্কর রায় সেতুবন্ধের উপোদ্ঘাত-প্রকরণে বলিয়াছেন, ভক্তি দুই প্রকার– গৌণী ও মুখ্যা। সগুণ শিবের পূজা, জপ, নামকীর্তন প্রভৃতির নাম গৌণী ভক্তি। গৌণী ভক্তি হইতে যে অনুরাগ-বিশেষের উদ্ভব হয়, তাহারই নাম পরা ভক্তি। এইপ্রকার ভক্তিও সগুণ ব্রহ্মকে অবলম্বন করিয়া জন্মিয়া থাকে। এতদৃশ সগুণ ব্রহ্ম সাধকের অনুরাগ চরিতার্থ করিতে রাম, কৃষ্ণ প্রভৃতি নানা-রূপ ধারণ করিয়া থাকেন। তাঁহার সেইসকল রূপের ভক্তিসাধন উপাসনা-প্রণালী তন্ত্রাদি-শাস্ত্রে বিবৃত হইয়াছে। শাস্ত্রীয় প্রণালীতে উপাসনা আরম্ভ করিলে সংসারের প্রতি অত্যন্ত আসক্তি থাকে না, অথচ সম্পূর্ণরূপে অনাসক্তিও হয় না। এই শ্রেণীর সাধকই ভক্তি-সাধন উপাসনার অধিকারী।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯৪)
এ প্রকার উপাসনার ফলে চিত্ত বিশুদ্ধতর হয় এবং ভগবান্ কৃপা করে থাকেন। তাই, মার্কণ্ডেয়-চণ্ডীতে বলা হয়েছে–
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে। -(মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী)
অর্থাৎ : সেই দেবী প্রসন্না এবং বরদা হইয়া মানবকে মুক্ত করিয়া থাকেন।
বলা হয়, অবিদ্যাবদ্ধ জীব আপনার শিবত্ব ভুলে অণুত্ব বা জীবত্ব লাভ করে। সাধনার দ্বারা ভগবৎপ্রসাদে তার অবিদ্যার বন্ধন ছিন্ন হলে পুরনায় ‘আমিই শিব’ এ ধরনের জ্ঞান লাভ হয়। সে সময় বিভুত্ব, সর্বজ্ঞত্ব প্রভৃতি গুণও তাঁর মধ্যে প্রকটিত হয়। এ প্রকার শিবত্ব-লাভই মুক্তি। পরশুরাম-কল্পসূত্র থেকে জানা যায়–
স্ববিমর্শঃ পুরুষার্থঃ। (পরশুরাম-কল্পসূত্র-১/৬)
অর্থাৎ : নিজের স্বরূপ সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞানই পুরুষার্থ বা মুক্তি।
জীবে সর্বদা শিবত্ব বর্তমান থাকলেও অবিদ্যার মোহে জীব তা ভুলে যায়। ভগবৎপ্রসাদে সেই আবরণ দূর হলে জীব নিজের শিব-স্বরূপত্ব জানতে পারে। এই জানা-ই জীবের মুক্তি।–
আত্মলাভান্ন পরং বিদ্যতে। -(পরশুরাম-কল্পসূত্র-১/২৮)
অর্থাৎ : শিবই জীবের আত্মা বা স্বরূপ। স্বরূপ লাভের অপর নামই মুক্তি।
কিন্তু শিবের অর্থাৎ ভগবানের কৃপা ব্যতীত মুক্তি লাভ হতে পারে না। মহানির্বাণ-তন্ত্রেও (১৪শ উল্লাস) মুক্তি সম্বন্ধে একই ধরনের উপদেশ দেয়া হয়েছে–
জ্ঞানং জ্ঞেয় তথা জ্ঞাতা ত্রিতয়ং ভাতি মায়য়া।
বিচার্যমাণে ত্রিতয়ে আত্মৈবৈকোহবশিষ্যতে।।
জ্ঞানমাত্মৈব চিদ্রূপো জ্ঞেয়মাত্মৈবচিন্ময়ঃ।
বিজ্ঞাতা স্বয়মেবাত্মা যো জানাতি স তত্ত্ববিৎ।।
এতত্তে কথিতং জ্ঞানং সাক্ষান্নির্বাণকারণম্ । -(মহানির্বাণ-তন্ত্র)
অর্থাৎ : কেবল মায়ার বিকারেই জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা এই তিনকে পৃথক বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এই তিনের বিচার করিলে একমাত্র আত্মা অবশিষ্ট থাকেন। চৈতন্যময় আত্মাই জ্ঞান, আত্মাই জ্ঞেয় এবং আত্মাই স্বয়ং বিজ্ঞাতা। যিনি ইহা জানেন, তিনিই তত্ত্ববিৎ। সাক্ষাৎ নির্বাণ-মুক্তির কারণ এই তত্ত্ব তোমাকে কহিলাম।
মহানির্বাণ-তন্ত্রের এই প্রকরণের আলোচনায় বোঝা যায়,– ‘যতদিন জীবের মায়ামোহ তিরোহিত না হইতেছে যতদিন ‘তুমি’, ‘আমি’ ইত্যাদি ভেদবুদ্ধি রহিতেছে, ততদিন দ্বৈত জগতের ভানও অপরিহার্য। জীব এই অবস্থায় কখনও আপন শিবত্ব স্মরণ করিতে পারেন না। মিথ্যাই হউক, স্বপ্নই হউক, আর কল্পনাই হউক– এই দ্বৈতকে বিশ্বাস না করিয়া জীবের সাংসারিক কাজকর্ম চলিতে পারে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্মফল এবং সংস্কারের টানে বাধ্য হইয়া জীবকে এই বিশ্বাস করিতেই হইবে।’
–‘জন্ম-জন্মান্তরের তীব্র তপস্যাজনিত পুণ্যবলে ভগবৎপ্রসাদে জীব মায়ার বন্ধন ছেদন করিয়া শিবত্ব প্রাপ্ত হন। আরাধনা অর্থাৎ আত্ম-সমর্পণ ব্যতীত তাঁহার অনুগ্রহ লাভ করা যায় না। অতএব তাঁহার আরাধনাই পরম্পরা-সম্বন্ধে মুক্তির প্রযোজক।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯৫)
নির্বাণ-মুক্তিই জীবের চরম লক্ষ্য। নির্গুণ ব্রহ্মত্ব বা পরম শিবত্ব লাভই নির্বাণ শব্দের আগম-সম্মত অর্থ। উপাস্য সগুণ ব্রহ্ম বা শিব-রূপতা লাভ করলেও নির্বাণ হয় না। এ উদ্দেশ্যেই পরশুরাম-কল্পসূত্রে ‘স্ববিমর্শ পুরুষার্থঃ’ বলা হয়েছে। এখানে স্ব-শব্দ পরম শিবের বোধক।
মুক্তি সম্বন্ধে অভিনবগুপ্ত (তন্ত্রালোক-১/৮৪-৮৮) যা বলেছেন– সে প্রসঙ্গে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্য হলো– ‘তাহাতে বোঝা যায়– পরম শিবকে জানিলেই জীব মুক্ত হইয়া যান, আর তাঁহাকে শরীর পরিগ্রহ করিতে হয় না। জগতের যাবতীয় ভাব-বস্তু অভাব-বস্তুকে বাদ দিয়া শুধু পরম প্রকাশ-স্বরূপ শিবে জ্ঞানকে নিশ্চল করিলে তাঁহাকে জানা যায়। অর্থাৎ সকল পদার্থকেই শিবময় ভাবনা করিতে পারিলে আত্মজ্ঞান জন্মে। এইপ্রকার জ্ঞান লাভ করিবার নিমিত্ত সাধনার প্রয়োজন। সাধনার বলে তাঁহারই করুণায় জীব তাঁহাকে জানিতে পারেন।’- (তন্ত্রালোক, পৃষ্টা-৯৫)
—লেখকঃ রণদীপম বসু
(চলবে—)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ