ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ॥গীতা ৯।৫॥
অর্থঃ- আর সব ভূত (জড় ও চেতন জগৎ) আমার মধ্যে স্থিত নেই। আর আমি প্রাণীদের ভরণ-পোষণকারীও নই। আমার যোগের ঐশ্বর্য দেখো আমার আত্মা শরীর ধারণ করে ভূত কে উৎপন্ন করে কিন্তু আমার আত্মা মূর্ত্তের (শরীরের), ভূতের মধ্যে স্থিত নয়॥
ভাবার্থঃ- এখানে শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ স্পষ্ট করে বলেছেন যে সমস্ত ভূত অর্থাৎ জড় ও চেতন জগৎ তাঁর মধ্যে স্থিত নয়। অপিতু এই সমগ্র বিশ্ব পরমেশ্বরে স্থিত রয়েছে। পরমেশ্বরই সবকিছুর আধার। শ্রীকৃষ্ণ জী এখানে দ্বিতীয় ভাব ব্যক্ত করে বলেছেন যে তিনি প্রাণীদের ভরণ-পোষণকারীও নন কারণ সংসারের ভরণ পোষণকারী একমাত্র নিরাকার, সর্বশক্তিমান, সর্ব্বব্যাপক পরমশ্বর। তৃতীয়ত, শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ এখানে বলেছেন হে অর্জুন! আমার যোগ ঐশ্বর্যকে দেখো। "ঈশ ঐশ্বর্য" শব্দে ঈশ্বর শব্দ গঠিত। ঈশ্বরে অনন্ত ঐশ্বর্য রয়েছে, সত্য, বিচারশীলতা, অনন্ত জ্ঞান রয়েছে। যখন যোগী সিদ্ধি প্রাপ্ত করেন তখন যোগী ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হন এবং এইভাবে সেই যোগী নিজেকে পরমাত্মার বিভূতি মনে করেন ঈশ্বরে আত্ম-ভাব রেখে নিজেকে ঈশ্বরের সমান অনুভব করেন এবং ঐ প্রেমে নিজেকে পরমাত্মা থেকে আলাদা না মনে করে (বস্তুতঃ তিনি পরমাত্মা থেকে আলাদাই থাকেন) ঐ সোম-পানের অবস্থায় নিজের মধ্যে সমস্ত ঐশ্বর্যের ভাব উৎপন্ন করে নেন। সেই সময় যোগী নিজেকে পরমাত্মাতে স্থিত মনে করেন। যখন চিত্ত একাগ্র এবং নিরূদ্ধ হয় তখন সর্ব্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের স্বরূপে জীবাত্মার স্থিতি হয়ে থাকে
এমন অন্তরঙ্গ অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ জী নিজেকে পরমেশ্বরের সমান বুঝিয়ে অর্থাৎ পরমেশ্বর সমগ্র জগৎ কে সৃষ্টি করেছেন পূর্ববর্তী শ্লোকে বলতে চেয়েছেন। এবং এই শ্লোকে তিনি বলেছেন হে অর্জুন! আমার যোগ ঐশ্বর্যকে দেখো আমি সংসারের রচয়িতা না হয়েও এমন (স্রষ্টা) ভাব রাখায় সক্ষম যোগদর্শনের ৩।৪৯ সূত্রের ভাব হলো যোগী শুধুমাত্র বুদ্ধি ও পুরুষের ভিন্নতার জ্ঞান প্রাপ্তের সাথে সাথে সমস্ত ভাবের ওপর স্বামিত্ব এবং সর্বজ্ঞ ভাব প্রাপ্ত করে নেন এবং সৃষ্টির সমস্ত প্রকার তত্ত্বকে জেন নেন। সৃষ্টি রচয়িতা ঈশ্বরও সমস্ত ভাব ও সৃষ্টির সমস্ত তত্ত্বের জ্ঞাতা। যোগ সূত্র ৪।২৯ অনুসারে যোগী যখন "ধর্মমেঘ-সমাধি" [সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্ব্বোচ্চ অবস্থা] প্রাপ্ত করেন তখন ঈশ্বর অনুভূতি-মোক্ষপদ প্রাপ্ত করেন। এই প্রসঙ্গে প্রথম পাদে দ্বিতীয় সূত্রে বর্ননা রয়েছে।
এই সমস্ত ভাবের অর্থ হলো যোগী নিজেকে ঈশ্বরের মত অবস্থা প্রাপ্ত হন ঐ সমাধি অবস্থায় প্রকৃতি এবং পরমাত্মার তত্ত্ব জ্ঞান (পৃথক পৃথক জ্ঞান) হয়ে যায়। এভাবে যোগী যোগ-দর্শন সূত্র ৩।৪৯ অনুসারে সমস্ত ভাবের ওপর স্বামিত্ব প্রাপ্ত করেন এই প্রাকরে নিজেকে পরমাত্মার সমান অনুভব করে বার্তা অথবা উপদেশ আদি করতে থাকেন। এমন বার্তা করার জন্য যোগীর সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে যায়। এই সিদ্ধির প্রয়োগ করে শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ বিভিন্ন স্থানে নিজেকে ঈশ্বর বলেছেন আবার ঈশ্বর সম্বন্ধেও তিনি বলেছেন। বস্তুতঃ শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ স্বয়ং ঈশ্বর নন অপিতু তিনি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন ও পূর্ন যোগীর ন্যায় ঈশ্বরে স্থিতি অবস্থা প্রাপ্ত ছিলেন। শতপথ ব্রহ্মণের ১৪।৬।৭।৩০ এ ঋষিও একই কথা বলেছেনঃ "য আত্মনি তিষ্টন্........" অর্থাৎ যে আত্মাতে স্থিত হয়ে এবং আত্মা থেকে পৃথক সেই অমৃত-আত্মা অন্তর্যামী পরমেশ্বর। যজুর্বেদে এই ভাবকেই বলা হয়েছে-"ন তং বি॑দাথ॒.... [যজু০ ১৭।৩১]" অর্থাৎ হে জীব! তোমরা সেই পরমাত্মাকে জানো না যিনি তোমা মধ্যে রয়েছেন এবং তোমা হতে আলাদা। যোগ এবং ঐশ্বর্য শব্দের অর্থ গীতার পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে।
আত্মজ্ঞ মহাপুরুষ যখন ভূমি থেকে ভূমার ক্ষেত্রে উঠেন, তখন দ্বৈত-ভ্রান্তি দূরে যায়, জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান, দ্রষ্টা-দৃশ্য-দর্শন, এই ত্রিপুটির লয় হয়; ব্যুত্থানের পরেও যে চিত্তবৃত্তি মানিষকে দেশকালপাত্র দেহাত্মবুদ্ধির মধ্যে পরিচ্ছিন সীমিত করে রাখে, সেই চিত্তবৃত্তির নিরোধের জন্য স্বরূপোলব্ধি হওযায়, সর্বত্রই দেখেন, সেই একই আত্মা জ্ঞাতা জ্ঞেয় জ্ঞান, দ্রষ্টা দৃশ্য দর্শনরূপে Subjectively & Objectively অভিব্যক্ত ! তরঙ্গ যদি বলে আমি জল, স্বর্ণময় অলঙ্কার যদি নামরূপ উপাধির পরিবর্ত্তে বলে আমি সোনা, তাতে যেমন ভুল হয় না তেমনি নামরূপ উপাধি বিনির্ন্মক্ত স্বরূপপলব্ধির পর, সর্ব্বত্র অভেদ-দর্শনের জন্য আত্মজ্ঞ পুরুষেরা "আত্মাদেশ" বাক্য ব্যবহার না করে পারেন না। "ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি"। আত্মতত্ত্ববিদ্ মহাযোগৈশ্বর্য্যশালী মহাপুরুষ যখন শিষ্যকে উপদেশ দেন, তখন আত্মাতে সমাহিত হয়েই উপদেশ দেন। দেহাত্মবোধ থাকে না বলে, পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ববোধের জন্য, তাঁদের সেই সময়কার উপদেশগুলি পরমাত্মারই বাণীরূপে স্ফুরিত হয়।
আত্মজ্ঞ পুরুষরা এই ভূমাবোধে প্রতিষ্ঠিত হয়েই মম, মায়, মাম্ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করেন। কপিলদেব তাঁর পিতাকে উপদেশ দিয়েছেন "গচ্ছাকামঃ ময়া পৃষ্টো মায়সন্ন্যস্ত কর্ম্মনা, জিত্মা সুদুর্জ্জয়ং সৃত্যুম মৃত্যম মৃতত্বায় মাং ভজ" [ভাগঃ৩,২৪,৩৮]----অর্থাৎ মৃত্যুজয় এবং অমৃতত্ত্ব লাভের জন্য আমার ভজনা ক'রো। আবার ভাগবত ৫,৫,১১ তে ঋষভদেব "আমার প্রীতির জন্য কর্ম্ম করা, আমার কথা বলা, আমার ভক্তগণের সঙ্গ, আমার গুনকীর্ত্তন"। এই রকম "আমি আমার" সূচক উপদেশ দিয়েছেন। দশম স্কন্ধের উননব্বই অধ্যায়ে ভূমাপুরুষও উপদেশ কালে "মম,মাম,ময়ি শব্দ ব্যবহার করেছেন। গীতাতে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ "মম ময়ি মাম্" ব্যবহার করেছেন, সেই সমস্তই তিনি কপিল, ঋষভ অথবা শঙ্করাচার্য্যে ইত্যাদির মত আত্মাকে লক্ষ্য করে আত্মাতে সমাহিত হয়েই বলেছেন।
যজুর্বেদ অধ্যায় ৭ এর ৪৬'তম মন্ত্রে উৎসাহী পুরুষের পক্ষে কী অলভ্য বস্তু ? কে এমন পুরুষ যে, প্রচেষ্টা সহ বিদ্বান্দিগের সেবা করে ঋষিগণের প্রকাশিত যোগবিজ্ঞান সিদ্ধ না করিতে পারে ? বলা হয়েছে। মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামী যজুর্বেদের ৭।২৮ মন্ত্রে ভাষ্য ভাবার্থে বলেছেন "যোগবিদ্যা বিনা কোনও মনুষ্য পূর্ণ বিদ্যাবান হতে পারে না এবং পূর্ণবিদ্যা বিনা নিজ স্বরূপ ও পরমাত্মার জ্ঞান কখনও হয় না এবং ইহা ব্যতীত কোন ন্যায়াধীশ সৎপুরুষদিগের ন্যায় প্রজার রক্ষা করিতে পারেন না এইজন্য সব মনুষ্যদিগের উচিত যে, এই যোগবিদ্যার সেবন নিরন্তর করিতে থাকা।" যজুর্বেদ ৭।৩৯ মন্ত্রের ভাব (তাৎপর্য) এই যে রাজাকে ঈশ্বর তুল্য যোগী হতে হবে এবং ন্যায়ের সাথে প্রজাদের পালন করতে হবে॥
যোগী কেমন হয় যজুর্বেদ ৭।৮ মন্ত্রে বলা হয়েছেঃ
ইন্দ্র॑বায়ূऽই॒মে সু॒তাऽউপ॒ প্রয়ো॑ভি॒রাগ॑তম্ । ইন্দ॑বো বামু॒শন্তি॒ হি ।
উ॒প॒য়া॒মগৃ॑হীতোऽসি বা॒য়ব॑ऽইন্দ্রবা॒য়ুভ্যাং॑ ত্বৈ॒ষ তে॒ য়োনিঃ॑ স॒জোষো॑ভ্যাং ত্বা ॥
তাহারাই পূর্ণ যোগী ও সিদ্ধ হইতে পারে যাহারা যোগবিদ্যাভ্যাস করিয়া ঈশ্বর হইতে পৃথিবী পর্য্যন্ত পদার্থসকলকে সাক্ষাৎ করিবার প্রযত্ন করতে থাকে এবং যম-নিয়মাদি সাধনে যুক্ত যোগে রমণ করে এবং যাঁরা এই সমস্ত সিদ্ধের সেবন করে তাঁরাও এই যোগসিদ্ধি প্রাপ্ত হয় অন্যলোকের নয়॥
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিষয়ে মহাভারতের সভাপর্বে পিতামহ ভীষ্ম বলেছেনঃ
বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানং বলং চাভ্যধিকং তথা।
নৃণাং লোকে হি কোঽন্যোঽস্তি বিশিষ্টঃ কেশাবাদৃতে॥
দানং দাক্ষ্যং শ্রুতং শৌর্য় হীঃ কীর্তির্বুদ্ধিরুত্তমা ৷
সন্নতিঃ শ্রীর্ধৃতিস্তুষ্টিঃ পুষ্টিশ্ব নিয়তাচ্যুতে॥
অর্থাৎ- বেদ, বেদাঙ্গের বিজ্ঞান তথা সব প্রকারের বলের দৃষ্টিতে মনুষ্য লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সমান আর দ্বিতীয় কেউ নেই। দান, দক্ষতা, বেদজ্ঞতা, শুরবীরতা, লজ্জা, কীর্তি, উত্তম বুদ্ধি, বিনয়, শ্রী, ধৈর্য, তুষ্টি (সন্তোষ) এবং পুষ্টি এসব সদগুণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে নিত্য বিরাজমান।
যোগ বিষয়ে গীতা ২।৪৮ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জূন কে বলেছেনঃ
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্তা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোং সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে॥
সুখ ও দুঃক্ষে আকুল না হয়ে যোগস্থ হয়ে স্বধর্ম-বিহিত কর্ম আচরণ কর। কর্মের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সম্বন্ধে যে সমবুদ্ধি, তাকেই যোগ বলা হয়। সেই রূপ যোগী হও॥
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জী তাঁর অমর গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশে শ্রীকৃষ্ণ জীকে আপ্তপুরুষ সাদৃশ্য বলেছেন। যিনি সাক্ষাৎ সমস্ত পদার্থ বিদ্যার জ্ঞাতা, ছলাদি রহিত ও ধৰ্ম্মাত্মা, যিনি সত্যবাদী, সত্যমানী ও সত্যকারী, এবং যিনি পূর্ণ বিদ্যাযুক্ত হইয়া, দয়াপরবশ, স্বইচ্ছায় পরোপ কারার্থে ও সকলের সুখ বৃদ্ধির জন্য, নিজ নির্ভ্রান্ত জ্ঞানের অপরকে উপদেশ করেন, এবং যিনি পৃথিবী হইতে পরমাত্মা পর্যন্ত সমস্ত পদার্থের যথাৰৎ সাক্ষাৎকার করিয়াছেন, ও যিনি তদনুযায়ী নিজ আচরণের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, এরূপ গুভ ঋণকেই আপ্তি বলা যায়, ও এইরূপ আপ্তি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠগুণযুক্ত মনুষ্যকেই আপ্ত বলা যায়।
তাই গীতার শেষ শ্লোকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যেখানে যেপক্ষে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ (অর্জুন) আছে, সেই পক্ষেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও ধ্রুবনীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত॥
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ