শাস্ত্রার্থের পূর্বে
সকল সজ্জন মহানুভবদের বিদিত হবে যে দরভাঙ্গা জেলার অন্তর্গত রোসড়াতে আর্য সমাজ তথা ধর্ম সভার মধ্যে ২ থেকে ৪ অক্টোবর সন ১৯১৪ পর্যন্ত শাস্ত্রার্থ হয়েছিল। সেটা সবার লাভের জন্য যেমনটা তেমন প্রকাশিত করা হচ্ছে, পাঠক তার অবলোকন করে সত্যাসত্যের নির্ণয় করে নিবেন। সর্বপ্রথম শ্যাম সুন্দর মন্দিরের মহন্ত "শ্রী জগন্নাথ দাস" জী মিথিলা মিহির প্রেসে ছাপিয়ে একটা নোটিশ বের করেছিলেন। যারমধ্যে "মূর্তি পূজন, অবতার, শ্রাদ্ধ, বর্ণাশ্রম, নিয়োগ, বিধবা বিবাহ, দয়ানন্দের আপ্ততা" এইসব বিষয়ের উপর শাস্ত্রার্থ করার জন্য আর্য সমাজকে চ্যালেঞ্জ দেন, আর সনাতন ধর্মের পক্ষ থেকে শ্রী পণ্ডিত জ্বালা প্রসাদ মিশ্রকে ডাকেন, ওনার এমন কাণ্ড দেখে আর্য সমাজ রোসড়াও কবিরত্ন শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জীকে ডাকার নিশ্চয় করে আর দুই পক্ষের থেকে নিজের-নিজের পণ্ডিতদের জন্য পত্র লেখা হয়। এরই মধ্যে সনাতন ধর্মের মন্ত্রী একটা পত্র পণ্ডিত ভীমসেন জীকেও লিখে পাঠায় যার জবাবে ভীমসেন জী স্বয়ং শাস্ত্রার্থ করতে অস্বীকার করেন আর ধর্ম সভার মন্ত্রীকে লেখেন যে - "যদি আর্য সমাজের পক্ষ থেকে সংস্কৃতের প্রসিদ্ধ বিদ্বান পণ্ডিত অখিলানন্দ জী আসেন তাহলে সনাতন ধর্মের পক্ষ থেকেও কোনো সংস্কৃতের বিদ্বানকে ডাকা উচিত। পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী, পণ্ডিত অখিলানন্দের সম্মুখে সংস্কৃত বলতে পাবেন না, আর এতে সনাতন ধর্মের পক্ষ হেরে যাবে।" ভীমসেন জীর এমন পত্র আসা মাত্রই দরভাঙ্গা প্রান্তের পণ্ডিতদের মধ্যে তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। আর সব পণ্ডিতরা পুরো বল দিয়ে এই শাস্ত্রার্থের মধ্যে ভাগ নিতে স্বীকার করে। অন্যদিকে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী আসা স্বীকার করেন। আর দুই পক্ষ থেকে নিয়ম নির্ধারণ করার প্রস্তাব উপস্থিত হয়। প্রস্তাব উপস্থিত হতেই কালী বাবুর দোকানে দুই পক্ষের সজ্জন একত্রিত হয়। আর আর্য সমাজের পক্ষ থেকে নিম্ন লিখিত নিয়ম নিশ্চিত করা হয় -
শাস্ত্রার্থের নিয়ম -
(১) আর্য সমাজ কেবল বেদকে স্বতঃ প্রমাণ আর উত্তর গ্রন্থকে পরতঃ প্রমাণ মানে, এইজন্য সনাতনী পণ্ডিতকে আর্য সমাজের সামনে কেবল বেদ বা বেদানুকূল গ্রন্থের প্রমাণ দিতে হবে।
(২) দুই পক্ষ থেকে এক-একজন পণ্ডিতই প্রশ্নোত্তর করবেন। এরমধ্যে অন্য কেউ বলতে পারবে না। যদি কারও কিছু বলার থাকে তাহলে সে লিখে বলতে পারবে। যে পণ্ডিত কোনো কারণবশতঃ নিজের স্থানে অন্য কোনো পণ্ডিতকে নিযুক্ত করবেন তাহলে সেই নিযুক্ত পণ্ডিতকেও পূর্ব প্রচলিত বিষয়ের উপরই বলতে হবে। অন্য কোনো বিষয় প্রস্তুত হবে না।
(৩) শাস্ত্রার্থ সংস্কৃত ভাষায় হবে আর সেটা অনুবাদ করে বোঝাতে হবে, দুই পক্ষের পণ্ডিত পনেরো-পনেরো মিনিট সময় বলবেন আর হাততালি বাজানো তথা জয়কার দেওয়ার অধিকার কারও হবে না। যে পক্ষ এমনটা করবে তাকেই পরাজিত ঘোষিত করা হবে।
(৪) শাস্ত্রার্থ প্রতিদিন তিন ঘন্টা পর্যন্ত হবে আর এক-এক দিন দুই পক্ষের পণ্ডিতকে নিজের পক্ষ সিদ্ধ করতে হবে। প্রথম দিন প্রথমে আর্য সমাজ নিজের পক্ষ স্থাপিত করবে। তার উত্তর সনাতনীদের দিতে হবে। দ্বিতীয় দিন সনাতনী প্রথমে বলবে আর আর্য সমাজ তার উত্তর দিবে। এইভাবে ক্রমে-ক্রমে চলবে।
(৫) শাস্ত্রার্থে শান্তি স্থাপনার জন্য দুই পক্ষের পদাধিকারীকে জেলাধীশের নিকট গিয়ে আবেদন করতে হবে। জেলাধীশের আয়োজন না করা পর্যন্ত শাস্ত্রার্থ আরম্ভ হবে না।
এই নিয়মের উপর দুই পক্ষের মন্ত্রী হস্তাক্ষর করেন আর নিয়ম নিশ্চিত হয়ে যায়। এই নিয়মের এক-এক কোপি দুই পক্ষের পণ্ডিতদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর পণ্ডিত অখিলানন্দ জী এটা স্বীকার করে নেন কিন্তু পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী এটা স্বীকার করতে একটু দ্বিধাবোধ করেন। কিন্তু কি করবেন, স্থানীয় সনাতন ধর্ম সভার মন্ত্রী স্বয়ং এটা স্বীকার করেছেন। এইজন্য কোনো হেরফের করা যায়নি। নিয়ম নিশ্চিত হওয়ার পর দুই পক্ষের মন্ত্রী মহোদয় জেলাধীশের নিকট আবেদন করতে যান। আবেদন দেওয়ার সময় জেলাধীশ জিজ্ঞেস করেন যে - শাস্ত্রার্থের চ্যালেঞ্জ কোন পক্ষ থেকে কাকে দেওয়া হয়েছে? এর উত্তরে আর্য সমাজের মন্ত্রী সনাতনীদের সেই নোটিশটা যেটা তারা সর্বপ্রথম বের করেছিল সেটা জেলাধীশের সামনে উপস্থিত করেন। তখন জেলাধীশ শাস্ত্রার্থের অনুমতি দিয়ে দেন আর স্থানীয় পুলিশকে শান্তি স্থাপনের জন্য নিযুক্ত করেন। স্থানের আয়োজনের জন্য কতিপয় সজ্জন অনেক প্রকারের কল্পনা করে কিন্তু অন্তিমে সর্বসম্মতিতে "পুলিশ চত্বর"ই শাস্ত্রার্থের স্থান রূপে নিশ্চিত হয়, আর দুই পক্ষের মঞ্চ সেখানে স্থাপিত হয়। এইদিকে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে নিশ্চিত সময়ে পণ্ডিত অখিলানন্দ জী উপস্থিত হন আর আর্যবর্তের সম্পাদক পণ্ডিত শ্যাম জী শর্মা কাব্যতীর্থ তথা শ্রী স্বামী ওঙ্কার সচ্চিদানন্দ জীও সঠিক সময়ে উপস্থিত হন কিন্তু সনাতন পণ্ডিত এখনও আসেন নি। এর কারণ এই ছিল যে পণ্ডিত জ্বালা প্রসাদ জী সংস্কৃত বলতে একদম অক্ষম ছিলেন আর সংস্কৃত না বললে কাজ চলছিল না। এইজন্য মিশ্র জী মার্গ থেকে পণ্ডিত তারাদত্ত জীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আর তাই এক দিন দেরি হয়ে যায়। জেলাধীশ যে চার দিনের আজ্ঞা দিয়েছিলেন তারমধ্যে এক দিন ব্যর্থ চলে যায়। দ্বিতীয় দিন দুপুরের পর নিশ্চিত সময়ের কিছু পূর্বে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী বেদাদী সত্যশাস্ত্র নিয়ে সভা মণ্ডপে উপস্থিত হন আর ওনার সঙ্গে অন্য আর্য বিদ্বানও নিজের-নিজের স্থানে গিয়ে বসেন। কিন্তু সনাতনী মণ্ডপ এখনও শূন্য ছিল। ঠিক ৪৫ মিনিট দেরি করে শ্রী পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জীও শ্রী পণ্ডিত তারাদত্ত জীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের আসা মাত্র সময় ঠিক করার জন্য ঘড়ি সামনে রেখে দেওয়া হয় আর সৈয়দ এম.এ. য়ুসুফ সাব ইন্সপেক্টর রোসড়াকে শান্তি স্থাপনার্থ উভয় পক্ষ থেকে সভাপতি বানানো হয়। সভাপতির আজ্ঞা পাওয়া মাত্র কবিরত্ন শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী ওঠেন আর নিয়মানুসারে মূর্তি পূজা আর অবতারবাদ এই দুই বিষয়ের উপর দশ মিনিট পর্যন্ত ধারা প্রবাহের সঙ্গে সংস্কৃতে খণ্ডন করা আরম্ভ করে দেন। তারপর অনুবাদ করে জনতাকে শোনান, এইভাবে অন্তিম পর্যন্ত চলতে থাকে। এখন আপনারাও সেই বার্তা পড়ুন আর লাভ নিন।
"সম্পাদক"
শাস্ত্রার্থ আরম্ভ
শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী -
(দশ মিনিট সংস্কৃতে ধারা প্রবাহ বলে তার অনুবাদ করে বললেন) - সজ্জনগণ! (১) "বেদাদ্ধর্মো হি নির্বভৌ" এই মনু বাক্যের অনুসারে যেটা বেদানুকূল তাকেই ধর্ম বলে। মূর্তি পূজা করা বেদের মধ্যে কোথাও লেখা নেই, তাই এটা অধর্ম। (২) "বিরোধেত্বনপেক্ষ্যম্স্যাদসতিহ্যনুমানম্" এই মীমাংসা সূত্র দ্বারা যেটা বেদ বিরুদ্ধ হবে তাকে ত্যাজ্য বলা হয়েছে। বেদের মধ্যে "ন ত্বাবাম্ অন্যো দিব্যো ন পার্থিবো ন জাতো ন জনিষ্যতে" তথা "ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্যশঃ" এবং "স পর্য়গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম্" ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা ঈশ্বর নিরাকার সিদ্ধ হয়েছে, এইজন্য মূর্তিপূজা করা ঠিক নয়। (৩) দর্শনের মধ্যেও "ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ" তথা "জন্মাদ্যস্য য়তঃ" ইত্যাদি সূত্রের দ্বারা ঈশ্বরকে নিরাকারই মানা হয়েছে। এইজন্য - "য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতিয়ন্মনসা ন মনুতে" ইত্যাদি বচন উপনিষদের মধ্যেও পাওয়া যায়। তাহলে কিভাবে ঈশ্বরকে সাকার বলা উচিত হবে? (৪) "মূলম্ নাস্তি কুতঃ শাখা" এই লোকোক্তির অনুসারে বেদের মধ্যে যখন অবতারের শব্দই নেই তাহলে সেটা মানা না মানা এই বিবাদ ব্যর্থ। যদি আপনি দেখাতে পারেন তাহলে চারটা বেদ আছে, এরমধ্যে দেখিয়ে দিন। টন্ টন্ টন্ ...
Note - ঘন্টি বাজতেই কিছু সময় ধরে শ্রী পণ্ডিত জ্বালা প্রসাদ আর পণ্ডিত তারাদত্ত নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে সময় কাটাতে থাকেন। শেষে পণ্ডিত তারাদত্ত জী উত্তর দেওয়ার জন্য দাঁড়া হন।
শাস্ত্রার্থ প্রধান -
শ্রী পণ্ডিত তারাদত্তের নাম নোটিশের মধ্যে নেই, এইজন্য শ্রী পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী মিশ্রই এর উত্তর দিবেন।
Note - এটা শোনামাত্র পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী মিশ্র দাঁড়িয়ে পড়েন আর বলেন যে আজকে আমি বলবো না, কালকে বলবো আর আজ তারাদত্তই উত্তর দিবেন। এটুকু বলে বসে পড়লেন। আর তারাদত্ত জী ৫ মিনিট পর্যন্ত সংস্কৃতে কিছু বলেন। বলতে-বলতে তারাদত্ত জীর গলা বসে যায় আর আওয়াজ ঘরঘোরাতে থাকে, মানুষ কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। যখন এমন দশা হয়েছিল তখন তারাদত্ত জী "দয়ানন্দ তিমির ভাস্কর" নামক গ্রন্থ হাতে নিয়ে বললেন যে বেদের মধ্যে মূর্তিপূজার বিধান আর অবতারের বর্ণনা আছে। "ভদ্রো ভদ্রয়া" এই মন্ত্রের দ্বারা রামাবতার আর "ইদম্ বিষ্ণুর্বিচক্রমে" এরদ্বারা বামনাবতার সিদ্ধ হয়। (এটুকু বলে পণ্ডিত তারাদত্ত জী নিজের বলার সময় সম্পূর্ণ না করেই বসে পড়লেন)।
শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী -
আমি যে প্রমাণগুলো আপনার সামনে রেখেছি আর যেসব যুক্তি দিয়ে সাকারবাদের খণ্ডন করেছি, তারমধ্যে একটারও উত্তর না দিয়ে - "আম্রান্ পৃষ্ঠঃ কোবিদারানাচষ্টে" এই লোকোক্তির অনুসারে আপনি "ভদ্রো ভদ্রয়া" পড়ে রামাবতার সিদ্ধ করতে চলেছেন! আপনার শক্তিই বা কি আছে? যার পুস্তক নিয়ে আপনি দাঁড়িয়েছেন, জ্বালাপ্রসাদ জীও তার উত্তর দিতে পারবেন না। যদি দিতে পারেন তাহলে দাঁড়া হয়ে বলুক যে "ভদ্র" এর অর্থ "রাম" আর "ভদ্রা" এর অর্থ "সীতা" তথা "জার" এর অর্থ "রাবণ" কোন কোষকার করেছে? যদি না করেন তো সায়ণ আর মহিধরের বিরুদ্ধ উল্টোপাল্টা এই অর্থ আপনি কোথা থেকে করলেন? স্বামী দয়ানন্দের উপরে তো আপনি এই আক্ষেপ করেন যে তিনি মন্ত্রের অর্থ বদলে দিয়েছেন কিন্তু আপনি এই অর্থের অনর্থ কোথা থেকে শিখেছেন? "য়া তেনোচ্যতে সা দেবতা" এই নিরুক্ত বাক্যের অনুসারে যে মন্ত্রের মধ্যে যে বিষয়ের প্রতিপাদন হয় সেই বিষয়টাই সেই মন্ত্রের দেবতা হয়। যদি আপনি রাম, কৃষ্ণ, বামন আদি বেদ দ্বারা সিদ্ধ করতে চান তাহলে কোনো মন্ত্রের উপর "রামো দেবতা কৃষ্ণো দেবতা" এই শব্দ দেখিয়ে দিন। যদি না দেখাতে পারেন তাহলে ব্যর্থ বিবাদ করতে আপনি এখানে কেন এসেছেন? টন্ টন্ টন্ ...
Note - এখন শ্রী পণ্ডিত তারাদত্ত জীর বলার সময় ছিল, কিন্তু পণ্ডিত অখিলানন্দ জী চুপ হতেই পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী দেখলেন যে এই সময় তাদের পক্ষ থেকে প্রভাব ভালো পড়ছে না। এইজন্য তিনি স্বয়ং বলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন, তিনি দাঁড়া হতেই শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী বললেন - পণ্ডিত জী! আপনি একটু আগেই যখন বলেছেন যে - আমি আজকে নয় বরং কালকে বলবো। তাহলে আপনি কেন "প্রতিজ্ঞা হানি" করতে এসেছেন? আপনি তারাদত্ত জীকেই বলতে দিন।
শ্রী পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী মিশ্র -
এনার গলা বসে গেছে। সভাতে বলার অভ্যাস এনার নেই এইজন্য আমাকে বলতে হবে।
শাস্ত্রার্থের সভাপতি মহোদয় -
যদি আপনি বলেন তাহলে নিয়মানুসারে সর্বপ্রথম সংস্কৃতে বলে তারপর ভাষাতে এর অনুবাদ করুন। যদি আপনি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংস্কৃতে বলতে না পারেন তাহলে উদাহরণ স্বরূপ অন্ততঃ পাঁচটা মিনিট তো বলুন।
Note - সভাপতির এমন কথা শোনামাত্র সনাতনী দলের মধ্যে নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়। আর পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী হতবাক হয়ে যান। যখন ওনার এমন দশা সভাপতি দেখলেন তো তিনি শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জীকে বললেন যে ঠিক আছে যেতে দিন, অধিক বিরক্ত করা উচিত নয়, এনাকে নিজের ভাষাতেই বলতে দিন। এতে পণ্ডিত তারাদত্ত জী বললেন যে বৃদ্ধাবস্থার কারণে পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জীর দাঁত নেই, এইজন্য তিনি সংস্কৃত বলতে পাবেন না। (শ্রোতার মধ্যে হাসি)
শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী -
শুনুন সজ্জনগণ! শুনুন!! ধ্যান দিয়ে শুনুন!!! এইমাত্র পণ্ডিত তারাদত্ত জী বললেন যে দাঁত না থাকার কারণে মিশ্র জী সংস্কৃত বলতে পাবেন না। ঠিক আছে, যে অক্ষরের মধ্যে দন্ত স্থান আছে আমি তার ভুল ধরবো না, বাকি অক্ষর তো আপনি বলুন। আর যদি বৃদ্ধাবস্থার কথা বলেন, সেটাও ঠিক নয়, কারণ অনেক ইংরেজি জানা বৃদ্ধ বৃদ্ধাবস্থার কারণে ইংরেজি বলা ছাড়ে না। এতকিছু বলার পরেও মিশ্র জী বলার জন্য উদ্যত হলেন না। তখন সর্ব সাধারণের সম্মুখে ওনার বিদ্বতার ঝোলা খুলে যায়। শেষে সভাপতি ওনাকে হিন্দীতেই বলার আজ্ঞা দেন।
শ্রী পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী মিশ্র -
ভ্রাতাগণ! "বেঙ্গটেশ্বর প্রেস" থেকে ছাপা "নীলকণ্ঠী ভাষ্য"তে ভদ্রের অর্থ রাম আর ভদ্রার অর্থ সীতা লেখা আছে। কিন্তু পুস্তক না থাকার কারণে আমি সেটা দেখাতে পারবো না। আর "ন তস্য প্রতিমা অস্তি..." এই মন্ত্রের মধ্যে প্রতিমা পদ আছে যার অর্থ মূর্তি হয় তাহলে বেদের মধ্যে কেন মূর্তি পূজা সিদ্ধ হবে না? (সময় সম্পূর্ণ না করেই বসে পড়লেন)
শ্রী পণ্ডিত অখিলানন্দ জী -
(প্রথমে সংস্কৃতে বলে তারপর অনুবাদ করে বললেন) সজ্জনগণ! নীলকণ্ঠী ভাষ্য কোনো কোষ নয় যে তার প্রমাণ মানা হবে। যদি সেই ভাষ্যতে অন্য কোনো কোষের প্রমাণ দেওয়া থাকে তাহলে আপনি বলে দিন। এই সময় যখন আপনার কাছে পুস্তক নেই তাহলে কেন আপনি আমার সঙ্গে শাস্ত্রার্থ করতে এসেছেন? একেই বলে বাড়িতে অস্ত্র রেখে যুদ্ধভূমিতে যাওয়া (জনতার মধ্যে হাসি)। বেদের মধ্যে অবতার শব্দ না পেয়ে যে প্রতিমা শব্দকে আপনি প্রস্তুত করেছেন তার অর্থ মূর্তি নয় বরং উপমান আর বাট এই দুটো অর্থ হবে। দেখুন - "রূপেণ প্রতিমোভুবি..." এখানে উপমানার্থক প্রতিমা শব্দের প্রয়োগ আছে। আর "সম্বত্সরস্য প্রতিমাম্ য়াম্ত্বা রাত্র্যুপাস্মহে..." এই মন্ত্রের মধ্যে বাটের অর্থে প্রতিমা শব্দ এসেছে। সম্বত্সরের ৩৬০ দিন মাপার জন্য রাত্রি হল বাট।
Note - এটুকু বলার পর আজকের শাস্ত্রার্থ সমাপ্ত হয়ে যায় আর সর্ব সাধারণের নিকট আর্য সমাজের বিজয় আর ধর্ম সভার পরাজয় উত্তম ভাবে বিদিত হয়।
(শাস্ত্রার্থ সমাপ্ত)
বিষয়ঃ ঈশ্বরের কি অবতার হয় ?
স্থানঃ কোহাট(সীমাপ্রান্ত) ফ্রন্টিয়ার (বর্ত্তমান পাকিস্থান)
দিনাঙ্কঃ ২০,২১ ডিসেম্বর ১৯১৯ (দুপুর দুটো)
আর্য সমাজের পক্ষ থেকে শাস্ত্রার্তকর্ত্তাঃ
শ্রী পণ্ডিত ঠাকুর অমর সিংহ জী "আর্য পথিক"
[মহাত্মা অমর স্বামী জী মহারাজ]
পৌরাণিক সনাতন ধর্মের পক্ষে শাস্ত্রার্থকর্ত্তাঃ
শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ্র জী শাস্ত্রী
প্রধানঃ শ্রী মাস্টার বোধরাজ জী (প্রাধান আর্য সমাজ কোহাট)
শাস্ত্রার্থ প্রারম্ভ
Note – দুপুর দুটোয় শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী কোহাটের আর্য মন্দিরে প্রবেশ করেন, তিনি গলায় ফুলের মালা পরে ছিলেন, আর্য মন্দিরের দ্বার পর্যন্ত অনেক সনাতন ধর্মী ওনার সঙ্গে শঙ্খ আর করতাল খুব জোড়ে বাজাতে-বাজাতে আসে।
শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী –
সজ্জন বৃন্দ! আজকের শাস্ত্রার্থের বিষয় অবতারবাদ নিশ্চয় করা হয়েছে। আর্য সমাজ ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বললেও তাঁকে অল্পশক্তি যুক্তই মানে। আর্য সমাজ বলে যে – সেই পরমেশ্বর অবতার নিতে পারে না, তাহলে বলুন! সে একটা শক্তিতে তো হীন হল।
(১) আমি বলছি– যে অবতার নিতে পারে না, জন্ম নিতে পারে না, শরীর ধারণ করতে পারে না তাহলে সে সর্ব শক্তিমান কিভাবে হবে? সর্বশক্তিমানের অর্থ তো এটাই যে যারমধ্যে সবকিছু করার শক্তি থাকবে, অতঃ অবতার না নিতে পারার কারণে সে একটা শক্তিতে হীন হবে, তাহলে সর্ব শক্তিমান থাকলো কোথায়?
(২) সৃষ্টিতে যখন-যখন অধর্ম বেড়ে যায় তথা ধর্ম হ্রাস পায়, তখন-তখন ধর্মের স্থাপনার জন্য পরমেশ্বর অবতার নেয় আর অনেক ধরনের শরীর ধারণ করে অধর্ম আর অধর্মীদের সংহার তথা ধর্মের বিস্তার করে। গোস্বামী তুলসী দাস জীও বলেছেন যে –
জব-জব হোয় ধর্ম কী হানী। বাঢ়হি অসুর-অধম, অভিমানী।। করহি অনীতি জায় নহী বরণী। সীদহি বিপ্র ধেনু সুর ধরণী।। তব-তব প্রভু ধরি বিবিধ শরীরা। হরহি কৃপানিধি সজ্জন পীরা।। দোহা - অসুর মারি থাপহি সুরন রাখহি নিজ শ্রুতি সেতু। জগ বিস্তারহি বিষদ য়শ রাম জন্ম কর হেতু।।
একইভাবে গীতা অধ্যায় ৪ শ্লোক ৭ তে ভগবান স্বয়ং বলছেন যে –
য়দা য়দা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানম্ সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্।
ধর্মসম্স্থাপনার্থায় সম্ভবামি য়ুগে য়ুগে।।
অর্থাৎ – যখন-যখন ধর্মের গ্লানি হয় আর অধর্ম বেড়ে যায় তখন-তখন আমি নিজেকে উৎপন্ন করি অর্থাৎ জন্ম নিই।
কোনো রাজার প্রিয় সন্তান যদি হঠাৎ জল আদির মধ্যে পড়ে যায় তাহলে রাজাও এইরকম ভাবে না যে কোনো চাকর তাকে জল থেকে তুলে নিয়ে আসবে অথবা রাজা তার চাকরকে বলবে যে তুমি আমার সন্তানকে তুলে আনো, বরং সে স্বয়ং সন্তানকে তুলতে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেইরকম পরমেশ্বরও যখন ভূমিতে অত্যাচার দেখে তো তাকে নষ্ট করার জন্য স্বয়ং জন্ম নেয়, অতঃ পরমেশ্বরের অবতার হচ্ছে বেদানুকূল আর সেটা সবদিক দিয়ে সঠিক, পরমেশ্বরের অবতারকে না মানা বেদ তথা পরমেশ্বরের অপমান করা হবে।
শ্রী পণ্ডিত ঠাকুর অমর সিংহ জী –
সজ্জনগণ! আজ অত্যাবশ্যক বিষয়ের উপর শাস্ত্রার্থ আরম্ভ হয়েছে। যদি এটা ঠিক মতো চলে তাহলে শ্রোতাদের অনেক লাভ হবে, ঈশ্বর জন্ম নেয় নাকি নেয় না? আজ এর ঠিক মতো নির্ণয় আপনাদের সম্মুখে হয়ে যাবে। শ্রী পণ্ডিত জী ঈশ্বরের অবতারকে বেদানুকূল তো বললেন কিন্তু ঈশ্বর অবতারের পক্ষে বেদের একটাও প্রমাণ দিলেন না। এই নিন, আমি ঈশ্বরের শরীরধারী হওয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ দিচ্ছি আর আবশ্যকতা হলে আরও অনেক প্রমাণ দিবো। শুনুন, য়জুর্বেদ অধ্যায় ৪০ মন্ত্র ৮ –
স পর্য়গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরꣳশুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
এটা হচ্ছে মন্ত্রের পূর্বাংশ, এখানে বলা হয়েছে যে – পরমেশ্বর হচ্ছে সর্বব্যাপক, সর্বদা শুদ্ধ পবিত্র আর অকায় অর্থাৎ শরীর রহিত। বেদ ছিল, আছে এবং থাকবে, না বেদের শব্দ পরিবর্তন হবে আর না অর্থ পরিবর্তন হবে, এই মন্ত্রের মধ্যে পরমেশ্বরকে ‘অকায়ম্’ অর্থাৎ শরীর রহিত বলা হয়েছে, এটা বলার প্রয়োজন হল তিনি ভূত, ভবিষ্যত আর বর্তমান তিন কালের মধ্যে শরীর রহিতই থাকেন, কখনও শরীরধারী হন না।
পণ্ডিত জী কোনো প্রমাণ না দিয়ে "পরমেশ্বরের সর্ব শক্তিমান বিশেষণের" উপর ব্যর্থ তর্ক করেছেন, তিনি এটাও ভাবেন নি যে শক্তি থাকা সত্বেও শক্তিমানকে সেই কাজ করা উচিত যেটা করা উচিত আর অবশ্যক, অনুচিত আর অনাবশ্যক কাজ করা ব্যক্তিকে মানুষ বুদ্ধিমান বলে না। পরমেশ্বর কেন অনুচিত আর অনাবশ্যক কাজ করবে? শরীর ধারণ করা তাঁর শক্তির মধ্যে আছে, কেবল এইজন্য শরীর ধারণ করবে নাকি তাঁর কোনো আবশ্যকতা হবে তখন করবে ? যদি আবশ্যকতা হলে পরে শরীর ধারণ করে তাহলে বলুন এমন কোন কাজটা আছে, যেটা শরীর ধারণ করা ছাড়া সে সেটা করতে পারবে না? সর্ব শক্তিমানের অনাবশ্যক ঝগড়া করে আপনি ‘উভয় পাশারজ্জু’র মধ্যে ফেঁসে গেছেন।
যদি এমন কোনো কাজ বলেন যেটা শরীর ধারণ করা ছাড়া করতে পারবে না তাহলে আপনার শব্দে পরমেশ্বর ‘সর্ব শক্তিমান’ থাকলো না, কারণ আপনি স্বয়ংই বলবেন যে অমুক কাজটা সে করতে পারবে না, যদি পরমেশ্বরের মধ্যে বিনা শরীর কোনো কাজ বিশেষ করার শক্তি না থাকে আর শরীর ধারণ করলে পরে সেই শক্তি আসে তাহলে পরমেশ্বরের সেই শক্তি স্বাভাবিক হবে না, শরীরের নিমিত্ত দ্বারা আসার কারণে সেই শক্তি নৈমিত্তিকই হবে। ব্যস, আপনার অর্থের সেই সর্বশক্তিমান থাকলো না। এখন আসছি চৌপাইয়ের কথাতে, গোস্বামী তুলসী দাসের বচন আমাদের জন্য প্রমাণ নয়। গীতার দুটো শ্লোক আপনি বলেছেন, সেটা শ্রীকৃষ্ণ জীর বচন, সেটা পরমেশ্বরের বচন নয়, শ্রীকৃষ্ণ জী যে পরমেশ্বর সেটা তো আপনাকে আগে সিদ্ধ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এটা সিদ্ধ করবেন না যে শ্রীকৃষ্ণ জী পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার বলা দুটো শ্লোক প্রমাণ হতে পারবে না। এটাও ‘সাধ্য’যে শ্রীরাম জী আর শ্রীকৃষ্ণ জী ঈশ্বর ছিলেন আর এটাও ‘সাধ্য’ যে ঈশ্বর অবতার নেয়। আপনি সাধ্য দিয়ে সাধ্যের সিদ্ধি করতে চান! তাহলে তো এটা ‘সাধ্যসম হেত্বাভাস’ হবে। অতঃ এই প্রমাণ ব্যর্থ হল, আপনাকে এটাও বলতে হবে যে সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কয়টা আর কি কি অবতার হয়েছে? আমার এই প্রশ্নটা নোট করুন আর অবতারের সংখ্যা তথা অবতারের নাম বলার কৃপা করবেন যাতে শাস্ত্রার্থ ঠিক দিশাতে চলতে পারে আর কোনো নির্ণয়ে পৌঁছাতে সহায়তা পায়। রাজার যে উদাহরণটা আপনি দিয়েছেন সেটা বিষম, রাজা একদেশী আর অল্প শক্তিশালী হয় আর পরমেশ্বর তো সর্বদেশী তথা সদা সর্বদা অপার শক্তিযুক্ত, তাঁকে একদেশী রাজার মতো জল আদির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো আবশ্যকতা হয় না, সে তো জল আদির মধ্যেও বিদ্যমান আছে। বেদের মধ্যে বলা হয়েছে – ‘উতাস্মিন্নল্প উদকে নিলীনঃ’ (অথর্বঃ ৪/১৬/৩) অর্থাৎ সে জলের প্রত্যেক অণুতেও বিদ্যমান আছে।
শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী –
আমি জিজ্ঞেস করছি – আপনি এমন কোনো কাজ বলতে পারেন, যেটা পরমেশ্বর করতে পারে না? আর এমনও কি কোনো কাজ আছে যেটা করা পরমেশ্বরের জন্য অনুচিত? গোস্বামী তুলসী দাস জীর বচন আপনার জন্য প্রমাণ নয়, তাহলে বেদের প্রমাণ তো আপনি মানবেন, বেদেরও প্রমাণ দিচ্ছি শুনুন –
প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভেऽঅন্তরজায়মানো বহুধা বি জায়তে। তস্য য়োনিম্ পরি পশ্যন্তি ধীরাস্তস্মিন্হ তস্থুর্ভুবনানি বিশ্বা।। (য়জুঃ ৩১/১৯)
এরমধ্যে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে প্রজাপতি পরমাত্মা গর্ভের মধ্যে আসে আর জন্ম নিয়ে অনেক প্রকার ভাবে প্রকট হয়। আর্য সমাজী পণ্ডিত জী এই প্রশ্নের উপর অনেক বল দিয়েছেন যে, পরমেশ্বরের অবতার কয়টা আর কি কি, সেটা বলা হোক। এর উত্তরে আমি আপনাকে বলছি শুনুন– পরমেশ্বরের অবতার অনাদি কাল ধরে চলে আসছে। তাঁর গণনা কেউই করতে পারবে না, তবুও মুখ্যরূপে আমাদের এখানে ২৪টা অবতার মানা হয়। তারমধ্যেও মুখ্যরূপে ১০টা বলা হয়েছে, সতযুগে চারটা, ত্রেতা যুগে তিনটা, দ্বাপর যুগে দুইটা, এইভাবে নয়টা অবতার হয়ে গেছে, কলি যুগে একটা হয় সেটা হওয়া বাকি আছে। যেগুলো হয়েছে তাঁদের নাম লিখুন আমি বলে দিচ্ছি – ১. বরাহ (শুয়োর) ২. মৎস্য ৩. কচ্ছপ ৪. নৃসিংহ, এই চারটা অবতার তো সত যুগে হয়েছে। তথা – ১. বামন, ২. শ্রীরাম জী ৩. শ্রী পরশুরাম জী, এই তিনটা অবতার ত্রেতা যুগে এইভাবে সাতটা অবতার হল। আর – ১. শ্রীকৃষ্ণ জী ২. বলরাম জী, এই দুইটা অবতার দ্বাপর যুগে হয়েছে, এইভাবে সব মিলে ‘৯টা অবতার’ হয়েছে, দশম অবতার কলিযুগে কল্কি অবতার হবে। সত যুগে চার চরণ ধর্ম থাকে, ত্রেতাতে তিন চরণ, দ্বাপরে দুই চরণ তথা কলিযুগে এক চরণ ধর্ম শেষ রয়ে যায়। ধর্মের রক্ষা তথা অধর্মের বিনাশ করার জন্য পরমেশ্বরের অবতার হয়। পরমেশ্বর হচ্ছে পরম দয়ালু, নিজের ভক্তের উপর দয়া করে সময়ে-সময়ে শরীর ধারণ করতে থাকে।
শ্রী পণ্ডিত ঠাকুর অমর সিংহ জী –
পণ্ডিত জী! আপনি বড় কৃপা করেছেন যে একটা বেদ মন্ত্র নিজের পক্ষে মনে করে বলে দিয়েছেন। আমি সর্বপ্রথম সেই মন্ত্রের উপরেই বিচার করবো, কারণ –
অর্থকামেষ্বসক্তানাম্ ধর্মজ্ঞানম্ বিধীয়তে।
ধর্মজিজ্ঞাসমানানাম্ প্রমাণম্ পরমম্ শ্রুতিঃ।। (মনুঃ ২/১৩)
সত্যাসত্য জানতে যে ইচ্ছুক, তার জন্য বেদ হচ্ছে পরম প্রমাণ। এটা মনুস্মৃতির বচন বলছে। ‘প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভে’র অর্থ আপনি এমন করেছেন যে – পরমাত্মা গর্ভের মধ্যে আসে। কিন্তু পণ্ডিত জী! পরমাত্মা তো সর্বদেশী তথা সর্বব্যাপক, সে কিভাবে যাবে-আসবে? আসতে তো সেই পারবে যে পূর্বে সেখানে ছিল না। যে আগে থেকেই সর্বত্র বিদ্যমান হয়ে আছে, তো সে কিভাবে আসবে আর কিভাবে যাবে? গর্ভের মধ্যে কি পরমাত্মা আগে থেকে ছিল না, যে সে সেখানে আসবে? পণ্ডিত জী! বেদের মধ্যেই বলা হয়েছে যে – ‘তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।’ (য়জুঃ ৪০/৫) সেই পরমেশ্বর এই সর্ব জগতের ভিতরেও আছে আবার বাইরেও আছে। সে গর্ভের মধ্যেও শিশুকে ভোজন দেয়, তাকে জীবিত রাখে তথা বড় করে, এইজন্য বলা হয়েছে যে – ‘প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভে’ প্রজাপতি পরমাত্মা গর্ভের মধ্যেও কাজ করে। আপনি বলেছেন জন্ম নিয়ে অনেকভাবে প্রকট হয়। আপনি যে শব্দকে ‘জায়মান’ বলেছেন সেটা ‘অজায়মান’ হবে আর তার অর্থ আপনার আচার্য উব্বট আর মহীধর জীও ‘অনুত্পদ্যমান’ উৎপন্ন হয় না, করেছেন। আপনি কিভাবে সেটার অর্থ ‘জন্ম নেওয়া’ করতে পারেন? এই মন্ত্রের মধ্যে পরে বলা হয়েছে – ‘তস্য য়োনিম্ পরি পশ্যন্তি ধীরাঃ’ অর্থাৎ তাঁর স্বরূপকে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই দেখে। শাস্ত্রী জী! যদি পরমেশ্বর শরীর ধারণ করে তাহলে তাঁর সেই রূপকে তো মানুষ, গাধা, ঘোড়া সবাই দেখতে পারবে, কেবল বুদ্ধিমানই নয়, সেটা কেবল বুদ্ধির বিষয় না হয়ে চোখের বিষয় হয়ে যাবে, চোখ দিয়ে তো পশুও দেখে নিবে, পশু কেবল চোখ দিয়ে দেখে বলা হয়েছে। ‘পশ্যতীতি পশুঃ’ অর্থাৎ যে কেবল চোখ দিয়ে দেখে বুদ্ধি দিয়ে দেখে না সে হচ্ছে পশু। ‘তস্য য়োনি পরি পশ্যন্তি ধীরাঃ’ এরদ্বারা শরীরধারী আর সাকার সিদ্ধ হয় না। এই মন্ত্রের দ্বারা অবতারবাদের মণ্ডন হয় না বরং খণ্ডনই হয়, এর অর্থ হচ্ছে – বুদ্ধিমান ব্যক্তিই সেই পরমেশ্বরের স্বরূপকে দেখতে পারে, কারণ – তাঁকে বুদ্ধির দ্বারাই দেখা যায়, চোখ দিয়ে দেখা যায় না, চোখ দিয়ে তাঁর কেবল কারিগরি দেখা যায়। উপনিষদের মধ্যেও বলা হয়েছে যে – ‘দৃশ্যতে ত্বগ্রয়া বুদ্ধয়া, সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্ম দর্শিভিঃ’ যারা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম দেখে তারা বুদ্ধি দিয়েই দেখে, চোখ দিয়ে দেখে না। আপনি অবতারের সংখ্যা আর অবতারের নাম বলে শাস্ত্রার্থের দিশা প্রশস্ত করে দিয়েছেন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক। শাস্ত্রী জী! যখন সতযুগে চার চরণ ধর্ম ছিল তাহলে তো একটাও অবতারের আবশ্যকতা ছিল না, তারপর চারটা অবতার হওয়া বুদ্ধি সঙ্গত নয়, আপনার যুক্তি অনুসারে তো কলিযুগে তিনটা, দ্বাপরে দুইটা আর ত্রেতাতে একটা অবতার আর সতযুগে একটাও অবতার হওয়া উচিত ছিল না, যখন চার চরণ ধর্ম বিদ্যমান আছে তখন ধর্ম থেকে গ্লানি হতেই পারে না, পরমেশ্বরের অবতার সেই সময় ব্যর্থই ঝাঁপাতে থাকে। আর যখন কলি যুগে ধর্মের তিন চরণ ভেঙে যায় তখন একা একটা অবতার এসে কি করবে? বাস্তবিকতা এই হচ্ছে যে, ঈশ্বরাবতারের কল্পনাটাই নিরাধার। আপনি অবতার হওয়ার কারণ এইভাবে বলেছেন – ১. ধর্মের গ্লানি হওয়া, ২. অধর্মের বৃদ্ধি হওয়া, ৩. ধর্মের স্থাপনা, ৪. ধর্মাত্মাদের রক্ষা, ৫. পাপীদের বিনাশ। আপনার পুরাণের মধ্যে তো এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট লেখা আছে যে আপনার বলা সবগুলো অবতার অভিশাপের জন্য হয়েছে। ভৃগু ঋষির পত্নীর মস্তক ইন্দ্রের আজ্ঞাতে বিষ্ণু জী কেটে দেয়। এতে ভৃগু ঋষি বিষ্ণু জীকে অভিশাপ দেন, দেখুন – দেবী ভাগবত স্কন্দ ৪০ অধ্যায় ১২ শ্লোক ৮ –
অবতারাঃ মৃত্যু লোকে, সম্তুমচ্ছাপ সম্ভবাঃ।
প্রায়োগর্ভভবম্ দুঃখম্, ভুম্ক্ষ্ব পাপাজ্জনার্দন।।
ভৃগু বললেন – হে বিষ্ণু! আমার অভিশাপে মৃত্যুলোকে তোমার অবতার হবে, হে বিষ্ণু! তুমি নিজের এই পাপের জন্য গর্ভের মধ্যে হওয়া দুঃখকে ভোগ করবে। দেবী ভাগবত স্কন্দ ৫ অধ্যায় ১৯ শ্লোক ১৮, এরমধ্যেও দেখুন –
শপ্তো হরিস্তু ভৃগুণা কমঠেন কামম্,
মীনো বভূব কমঠঃ খলুশূকরস্তু।
পশ্চান্নৃসিম্হ ইতি য়চ্ছলম্ কৃদ্ধরায়া,
তান সেবতাম্ জননী মৃত্যু ভয়ম্ ন কিম্স্যাত্।।
অর্থাৎ – কুপিত ভৃগুর দ্বারা দেওয়া অভিশাপে বিষ্ণু জী মাছ হয়, অবতার ধারণ করে কচ্ছপ হয়, শুয়োর হয়, পশ্চাৎ নৃসিংহ হয় আর ভূমিতে ছল কারী (বলী রাজার সাথে ঠগ করে) বামন অবতার হয়। ... বলেন যে হে জননী! তাঁর সেবন-পূজনকারীর মৃত্যুর ভয় কেন হবে না? অর্থাৎ অবশ্যই হবে, এইসব প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট ভাবে সিদ্ধ হচ্ছে যে আপনার ভগবানের অবতার ধর্মের উদ্ধার করার জন্য হয়নি প্রত্যুত অভিশাপের ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগার জন্য কচ্ছপ, মাছ আর শুয়োরের মতো নিচ য়োনির মধ্যে তাকে যেতে হয়েছে। আরও শুনুন, দেবী ভাগবত স্কন্দ ৬ অধ্যায় ৭ শ্লোক ৩৪ থেকে ৩৭ পর্যন্ত –
ভৃগু পন্তী শিরচ্ছেদাদ্ভগবান্হরিরচ্যুতঃ।।
ব্রহ্মা শাপাত্পশোর্য়োনো, সম্জাতো মকরাদিষু।
বিষ্ণুশ্চ বামনো ভূত্বা, য়াচনার্থ বর্লেগ্রহে।।
অতঃ কিম্ পরম্ দুঃখম্, প্রাপ্নোতি দুষ্কৃতী নরঃ।
রামোऽপি বনবাসেষু সীতা বিরহজম্ বহুঃ।।
দুঃখম্ চ প্রাপ্তবান্ ঘোরম্ ভৃগুশাপেন ভারত।।
অর্থাৎ – ভৃগু ঋষির পত্নীর মস্তক কেটে ফেলার কারণে ভগবান বিষ্ণু জী ভৃগু ব্রাহ্মণের অভিশাপে পশু য়োনির মধ্যে জন্মায় আর বামন সেজে রাজা বলীর ঘরে ভিক্ষা চাইতে যায়। পাপ কর্ম করা ব্যক্তি এর থেকে অধিক দুঃখ আর কি ভোগ করতে পারে! রাম জীও বনবাসে সীতার বিয়োগের কারণে উৎপন্ন হওয়া ঘোর দুঃখকে অভিশাপের জন্য প্রাপ্ত করে। বিষ্ণু জী জালন্ধরের রূপ নিয়ে বৃন্দার সঙ্গে ব্যভিচার করে, বৃন্দা যখন ব্যভিচারের পশ্চাৎ জানতে পারে যে এটা আমার পতি জালন্ধর নয় বরং এটা তো বিষ্ণু, এতে সে রেগে গিয়ে অভিশাপ দেয় যে – হে বিষ্ণু! পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার কারী তোমার এই স্বভাবকে ধিক্কার জানাই, আমি জেনে গেছি যে তুমি হচ্ছো ছল-কপট যুক্ত তপস্বী। আমার সঙ্গে যেভাবে ছল যুক্ত তপস্বী দ্বারা প্রতারণা করেছো ঠিক সেইভাবে তোমার স্ত্রীকেও কোনো ছলী-কপটী তপস্বী তুলে নিয়ে যাবে। (পদ্ম পুরাণ উত্তর খণ্ড অধ্যায় ১৫০, শ্লোক ১ থেকে ৩০ পর্যন্ত) তথা (পদ্ম পুরাণ উত্তর খণ্ড অধ্যায় ১৬ শ্লোক ৫৪ থেকে ৭২ পর্যন্ত) এবং এইভাবে শিবপুরাণ রুদ্র সংহিতা অধ্যায় ৩ আর ৪ এরমধ্যে নারদের অভিশাপের কারণে বিষ্ণুকে রামাবতার হওয়া বলা হয়েছে। শাস্ত্রী জী! আপনার কথা হল – ‘পরমেশ্বরের অবতার ধর্মের রক্ষা তথা অধর্মের বিনাশ করার জন্য হয়।’ কিন্তু আপনার এই মান্যতা পুরাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় না। পুরাণ দ্বারা তো এটাই সিদ্ধ হয় যে পাপ কর্মের ফল ভোগার জন্য বিষ্ণু জীকে মাছ আদির য়োনিতে জন্ম নিতে হয়েছে। শাস্ত্রী জী! দেখুন আর নোট করুন, গরুড় পুরাণ পূর্ব খণ্ড আচার কাণ্ড অধ্যায় ১১৩ শ্লোক ১৫ তে –
ব্রহ্মা য়েন কুলালবন্নিয়মিতো, ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ডোদরে।
বিষ্ণুর্য়েন দশাবতার গহনে, ক্ষিপ্তো মহাসম্কটে।।
রুদ্রো য়েন কপালপাণি, পুটকে ভিক্ষাটনম্ কারিতঃ।
সূর্য়ো ভ্রাম্যতি নিত্যমেব, গগনে তস্মৈ নমঃ কর্মণে।।
পণ্ডিত জী! আমার কাছে এমন কয়েকশ প্রমাণ পুরাণ আদি গ্রন্থের আছে, যারদ্বারা সিদ্ধ হয় যে আপনি যাকে-যাকে পরমেশ্বরের অবতার মানেন, তারা সবাই কর্মফল ভোগকারী জীবই ছিল, তারা পরমেশ্বরের অবতার ছিল না। বাল্মীকি রামায়ণের মধ্যে শ্রীরাম জীর বচনও এটাই সিদ্ধ করে। শুনুন, বাল্মীকি রামায়ণ অরণ্যকাণ্ড সর্গ ৩৫ শ্লোক ১৭ আর ১৮ –
ন মদ্বিধো দুষ্কৃতকর্মকারী, মন্যে দ্বিতীয়োऽস্তি বসুন্ধরায়াম্। শোকেন শোকো হি পরম্পরায়া মামেতি, ভিন্দন্ হৃদয়ম্ মনশ্চ।।
পূর্বম্ ময়া নূনমভীপ্সিতানি পাপানিকর্মাণ্যসকৃত্কৃতানি।
তত্রায়মদ্যাপতিতো বিপাকো দুঃখেন দুঃখম্ য়দহম্ বিশামি।।
শ্রীরাম জী বলছেন যে – আমার মনে হয় আমার সমান ‘পাপ কর্ম’ করেছে এমন কোনো মানুষ এই ভূমিতে নেই। পূর্বজন্মে আমি নিশ্চই একের পর এক যথেষ্ট পাপ করেছি, সেই পাপের ফল আজ আমি প্রাপ্ত করছি আর তাই আমার উপর একের পর এক দুঃখ আসছে। অর্থাৎ আমি পূর্বজন্মের কোনো ‘পাপ কর্মের ফল’ এই জন্মে ভোগ করছি।
য়োগ দর্শনের মধ্যে পরমেশ্বরের লক্ষণ এইভাবে বলা হয়েছে –
ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ।। (য়োগদর্শন ১/২৪)
অবিদ্যা (বিপরীত জ্ঞান), অস্মিতা (অহংকার) রাগ-দ্বেষ আর অভিনিবেষ, (মৃত্যুর ভয়) এই পাঁচটা ক্লেশ, যার দ্বারা সুখ আর দুঃখ প্রাপ্ত হয় সেই শুভাশুভ কর্ম বিপাক কর্ম ফল আশয় (কর্মের বাসনা) এর থেকে সর্বথা রহিত পুরুষ বিশেষ হল পরমেশ্বর। রাম আদি সকলের ক্লেশ হয়েছে, এদের মধ্যে রাগ-দ্বেষও দেখা যায়, এরা কর্ম ফলও ভোগ করেছে, তাই এরা ঈশ্বর ছিল না। পণ্ডিত জী! সনাতন ধর্ম অনুসারে তো এটাও সিদ্ধ করা কঠিন যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আর দূর্গা এই চারটার মধ্যে পরমেশ্বর কে? পুরাণের মধ্যে কোথাও ব্রহ্মা জীকে সবার থেকে বড় বলা হয়েছে, কোথাও শিব জীকে সবার থেকে বড় বলা হয়েছে, কোথাও বিষ্ণু জীকেই সবার থেকে বড় বলা হয়েছে তো কোথাও বা শক্তি (দূর্গা) -কে এদের সবার শাসনকারী বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোথাও ব্রহ্মার নিন্দা করা হয়েছে, কোথাও শিবের আর কোথাও বিষ্ণুর নিন্দা করা হয়েছে। অতঃ কৃপা করে বলুন আপনার ঈশ্বর কোনটা? তথা আপনি কার অবতার সিদ্ধ করতে চান ?
শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী –
এই নিন আমি এক-দুইটা বেদ মন্ত্র আরও বলছি –
(১) ইদম্ বিষ্ণুর্বিচক্রমে ত্রেধা নিদধে পদম্।
সমূঢমস্য পাᳬসুরে।। (য়জুঃ ৫/১৫)
(২) প্র তদ্বিষ্ণু স্তবতে বীর্য়েণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ।
য়স্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষ্বধিক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।। (য়জুঃ ৫/২০)
এই মন্ত্রের মধ্যে বিষ্ণুর নৃসিংহাবতারের বর্ণনা আছে।
(৩) ভদ্রো ভদ্রয়া সচমান আগাত্স্বসারম্ জারো অভ্যেতি পশ্চাত্।।
(ঋঃ ১০/৩/৩)
এই মন্ত্রের মধ্যে রামাবতার আর সীতার জার (রাবণ) এর বর্ণনা আছে, আর বরাহ ও কৃষ্ণ নামও বেদের মধ্যে আছে, আপনি পুরাণের অনেক প্রমাণ দিয়েছেন, দুর্ভাগ্যবশত আমি শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণই পড়েছি আর গরুড় পুরাণ তো বারংবারই পড়তে হয়। যখন কারও মৃত্যু হয়, তখন সেই বাড়িতে আমরা গরুড় পুরাণই পড়ি। ‘ব্রহ্মায়েন কুলাল বন্নিয়মিতো...’ আদি এই শ্লোক তো সেখানে কোথাও নেই। অন্য পুরাণ আমি পড়িনি। তাই সেই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। বিষ্ণু জীকে নারদ অভিশাপ কেন দিয়েছে এটা স্পষ্ট করে বলুন। ব্রহ্মা আদির প্রশংসা যেখানে-যেখানে আছে, ‘সেটা তো যার বিবাহ তার সঙ্গীত’ কিন্তু পুরাণের মধ্যে ওনার নিন্দাও আছে এটা আমার বিশ্বাস হয় না, যদি বলতে পারেন তো বলুন?
আর্যসমাজী পণ্ডিতের অনেক কথার উত্তর আমার কাছে নেই। ওনার অনেক পাণ্ডিত্যও আছে তথা ওনার সভ্যতা আর শিষ্টাচারকে আমি সম্মান করি। এই শাস্ত্রার্থের মধ্যে অনেক কিছু নতুন কথা সামনে এসেছে, পণ্ডিত জীর অন্তিম ভাষণে আরও আসবে সেইসবের উপর বিচার করবো আর আমি আশা করবো – শ্রী পণ্ডিত অমর সিংহ জী মহারাজের সঙ্গে আমার পুনঃ সম্পর্ক আর সম্বাদ হবে।
শ্রী পণ্ডিত ঠাকুর অমর সিংহ জী –
সজ্জন বৃন্দ! শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী বিদ্বান তথা হঠ দুরাগ্রহ হতে রহিত ব্যক্তি। আমি আশা আর বিশ্বাস করি যে শ্রী পণ্ডিত জী শীঘ্রই আর্য সমাজী হয়ে যাবেন আর এটা মেনে নিবেন যে ঈশ্বর কখনও জন্ম নেয় না। পণ্ডিত জী যে বেদমন্ত্র বলেছেন, তার বিষয়ে আমি স্পষ্টীকরণ করবো, মন দিয়ে শুনুন –
(১) ‘ইদম্ বিষ্ণুর্বিচক্রমে’ এই মন্ত্রের মধ্যে না তো বামন অবতারের নাম আছে আর না রাজা বলীর! কেবল তিন পগের (পদের) বর্ণনা হওয়াতে না বামনাবতার না বলী রাজাকে ঠকানো সিদ্ধ হয়। প্রতারনা করা পরমেশ্বরের কাজ নয়, এই মন্ত্রের মধ্যে বিষ্ণু নামের দ্বারা সূর্যের বর্ণনা করা হয়েছে, সূর্যের তিনটা পগ – পৃথ্বী, অন্তরিক্ষ আর দ্যৌয়ের মধ্যে হয়, বিষ্ণুর দ্বিতীয় অর্থ যজ্ঞ হয়। শতপথ ব্রাহ্মণের মধ্যেও বলা হয়েছে যে – ‘য়জ্ঞৌ বৈ বিষ্ণুঃ’ সেটাও পৃথ্বী, অন্তরিক্ষ আর দ্যৌ পর্যন্ত যায়, মনু জীও মনুস্মৃতির মধ্যে বলেছেন যে – ‘অগ্নৌ প্রাস্তাহুতি সম্যক্ আদিত্যমুপ তিষ্ঠতে’ অগ্নিতে ঠিক মতো দেওয়া আহুতি সূর্য পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। পরমেশ্বরেরও নাম বিষ্ণু, তাঁর তিন পগ কয়েক প্রকারে বলা হয়, সূর্য, অগ্নি আর বায়ু, পৃথ্বী, অন্তরিক্ষ আর দ্যৌ তথা ভূত, ভবিষ্যত আর বর্তমান আদি। ঈশ্বর জন্ম নেয়, বেদের মধ্যে যদি এমন কোনো মন্ত্র থাকে তাহলে বলুন?
(২) ‘প্র তদ্বিষ্ণু স্তবতে বীর্য়েণ...’ আদি মন্ত্রের মধ্যে না তো নৃসিংহ অবতারের নাম আছে, না ভক্ত প্রহ্লাদের তথা না তার অত্যাচারী পিতা হিরণ্যকষ্যপের কোথাও নাম চিহ্ন আছে। মন্ত্রের অর্থটা হচ্ছে এইরকম – এই মন্ত্রের মধ্যে উপমালঙ্কার আছে, যেমন সিংহ নিজের পরাক্রম দ্বারা অন্য পশুদের বধ করে বেড়ায়, জগদীশ্বরও সেইরকম নিজের পরাক্রম দ্বারা সব লোকের নিয়মন করে।
(৩) ‘ভদ্রো ভদ্রয়া সহ...’ এই মন্ত্রের মধ্যে না রাম আছে না সীতা আর না রাবণ আছে, ভদ্রের অর্থ কেবল রামই কেন হবে? যে কোনো ভালো মানুষকে ভদ্র বলা যেতে পারে। আমি বলছি এই মন্ত্রের মধ্যে ভদ্র শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রীকে বলা হয়েছে, তাহলে আপনি কিভাবে আমার কথাকে খণ্ডন করবেন? তাছাড়া এই সম্পূর্ণ মন্ত্রটার মানে আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মন্ত্রটা শুনুন –
ভদ্রো ভদ্রয়া সচমান আগাত্স্বসারম্ জারো অভ্যেতি পশ্চাত্।।
সুপ্রকেতৈর্দ্যুভিরগ্নির্বিতিষ্ঠন্নু শদ্ভির্বর্ণৈরভি রামমস্থাত্।। (ঋঃ ১০/৩/৩)
যেমন (জারঃ) রাত্রির বিনাশ করে সূর্য (স্বসারম্ পশ্চাত্ অভি ইতি) নিজের ভগিনীর তুল্য অন্ধকার দূর কারী ঊষার পিছন-পিছন ছোটে, আর স্বয়ং (ভদ্রঃ) সুখ কারী হয়ে (ভদ্রয়া সচমানঃ আগাত) সুখদায়িনী ঊষার সঙ্গে মিলিত হয়ে আসে, আর সেটা (উশদ্ভিঃ বর্ণৈঃ) উজ্জ্বল রশ্মি দিয়ে (রামম্ অভি আস্থাত্) রাত্রির অন্ধকারকে পরাজিত করে, সেইভাবে (ভদ্রঃ) প্রজাকে সুখ দাতা বিদ্বান (ভদ্রয়া সচমানঃ) প্রজাকে সুখ দাতা বুদ্ধি বা নীতি যুক্ত হয়ে (আগাত্) প্রাপ্ত হোক। সেই (জারঃ) শত্রু বা দুষ্টের নাশকারী হয়ে (স্বসার) সুখ দ্বারা শত্রুকে উচ্ছেদকারী সেনা বা (স্বসারম্) স্বয়ং আসা প্রজার (পশ্চাত্ অভি ইতি) পশ্চাৎ তদনুকূল দ্বারা বশ করবে। সেই (অগ্নিঃ) অগ্নির সমান পুরুষ (সূऽপ্রকেতৈঃ) জ্ঞানবান্ (দ্যুऽভিঃ) রশ্মিতুল্য বিদ্বানের দ্বারা (বিऽতিষ্ঠন্) বিবিধ কার্যকে ক্রমাগত করে (উশদ্ভিঃ) উজ্জ্বল কামনাকারী (বর্ণৈঃ) বিদ্বানের দ্বারা (রামম্ অভি অস্থাত্) অন্ধকার তুল্য শত্রুর উপর আরোহণ করবে।
এই মন্ত্রের মধ্যে যদি জার রাবণকে বলা হয়, তাহলে ‘স্বসারম্ জারো অভ্যেতি’ এর অর্থ কি হবে? ‘স্বসা’র অর্থ তো বোন,বোনকে জার সব দিক থেকে প্রাপ্ত হয়। কিন্তু এটা কি ধরনের অবতার সিদ্ধ হল?
নিরুক্তের মধ্যে ‘বরাহ’র অর্থ য়াস্কাচার্য ‘মেঘ’ করেছেন। যথা – ‘বরাহো মেঘো ভবতি’ (নিরুক্ত ৫/৪), রামের অর্থ কোনো ভাষ্যকারই দশরথী রাম করেন নি আর না কোনো রামাবতার হয়েছে আর না বলা হয়েছে। সায়ণ, মহীধর তথা উব্বট তিনজন আচার্যই রামের অর্থ রাত্রির অন্ধকার আর কৃষ্ণের অর্থ বাসুদেবের পুত্র না করে কালো রঙ বলেছেন।
নারদের অভিশাপের কথা আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, তো মন দিয়ে শুনুন আর নোট করুন! শিব পুরাণ রুদ্র সংহিতা ২, অধ্যায় ৩-৪, শ্রী বেঙ্কটেশ্বর প্রেস বোম্বাই, ভাষা টিকা সহিত সম্বত্ ১৯৮২ বিক্রমিতে প্রকাশিত হয়েছে। একটা রাজকন্যার স্বয়ম্বর ছিল, নারদজী বিষ্ণুজীকে বলেন যে আমার মুখ সুন্দর বানিয়ে দিন, যাতে রাজকন্যা আমাকে নিজের পতি রূপে বরণ করে, বিষ্ণুজী নারদজীর মুখ বাঁদরের মতো বানিয়ে দেন আর স্বয়ং স্বয়ম্বরে গিয়ে উপস্থিত হন, রাজকন্যা বিষ্ণুজীকেই বরণ করে নেয়, নারদজী জলের মধ্যে নিজের মুখ দেখতে পান যে সেটা বাঁদরের মতো ছিল তো নারদ জী রেগে গিয়ে বিষ্ণু জীকে অভিশাপ দেন আর রুষ্ট হয়ে বলেন –
হে হরে ত্বম্ মহা দুষ্টঃ কপটী বিশ্ব মোহনঃ।
পরোত্সাহম্ ন সহসে মায়াবী মলিনাশয়ঃ।।
(শিব পুরাণ রুদ্র সংহিতা ২ অধ্যায় ৪ শ্লোক ৬)
অর্থাৎ – হে বিষ্ণু! তুমি খুব দুষ্ট, কপটী, সংসারকে মোহনকারী, অন্যের উন্নতিকে তুমি সহ্য করতে পারো না, তুমি মায়াবী আর মলিন আশায়কারী, আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যে তুমিও নিজের স্ত্রীর বিয়োগে দুঃখকে প্রাপ্ত করবে। নারদের এই অভিশাপের কারণে বিষ্ণু জী রামের জন্ম নেন আর নিজের স্ত্রীকে যে রাবণ হরণ করে নিয়ে যায়, তখন তার বিয়োগের দুঃখ নারদের অভিশাপের কারণে তিনি ভোগ করেন।
আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন– ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিবের নিন্দা পুরাণের মধ্যে কোথায় আছে? তো খুব সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি, বিস্তার ভাবে বলার জন্য অনেক সময় নয় বরং অনেক দিন হওয়া উচিত। শাস্ত্রী জী! আপনি শ্রীমদ্ভাগবত্ পড়েছেন, সেখানেই পুত্রী গমনের দোষ ব্রহ্মা জীর উপরে লাগানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও অন্য যেসব দোষ লাগানো হয়েছে সেগুলোও বলছি, শুনুন –
(১) ব্রহ্মা জী পুত্রীগামী ছিলেন। (শ্রীমদ্ভাগবত্ স্কন্ধ ৩, অধ্যায় ১২, শ্লোক ২৮, ২৯ ও ৩০)
(২) ব্রহ্মা জীর পাঁচটা মাথা ছিল। (শিব পুরাণ বিদ্যেশ্বরী সংহিতা অধ্যায় ৮, শ্লোক ৪ তথা ৭)
(১) ব্রহ্মা জীর উপর পুত্রীগমনের ঘৃণিত দোষারোপণ –
বাচম্ দুহিতরম্ তন্বীম্ স্বয়ম্ ভূর্হরতীম্মনঃ।
অকামাম্ চকমে ক্ষত্তঃ সকাম ইতি ন শ্রুতম্।।
তমধর্মেকৃতমতিম্ বিলোক্য পিতরম্ সুতাঃ।
মরীচি মুখ্যাঃ মুনয়ো বিশ্রম্ভাত্ প্রত্যবোধয়ন্।।
নেতত্ পূর্বেঃ কৃতম্ ত্বদ্যৈ ন করিষ্যন্তি চাপরে।
য়ত্ত্বম্ দুহিতরম্ গচ্ছেরনিগৃহ্যাম্গজাম্ প্রভুঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত্ পুরাণ স্কন্ধ ৩, অধ্যায় ১২, শ্লোক ২৮, ২৯, ৩০)
অর্থাৎ – হে বিদুর! বাণী হতে শ্রেষ্ঠ শরীরধারী সরস্বতী হয়, যাকে দেখে ব্রহ্মাজী কামে বশীভূত হয়ে তার সঙ্গে কামের ইচ্ছা করে এমনটাই আমি শুনেছি। মরীচি আদি সব পুত্র ঋষিরা তাদের পিতার মন্দবুদ্ধি দেখে বোঝায় যে – তুমি যে নিজের অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হওয়া পুত্রীকে গ্রহণ করছো এইরকম এর আগে কেউ কখনো করেনি আর না কেউ কখনো করবে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
(২) ব্রহ্মা জীর পাঁচটা মাথা ছিল –
শিব জীর আজ্ঞানুসারে ভৈরব সেই পাঁচটা মাথার মধ্যে একটা মাথা কেটে ফেলে, দেখুন – মহাদেব দ্বারা ব্রহ্মা জীর অভিমানকে দূর করা –
সসর্জাথ মহাদেবঃ পুরুষম্ কম্চিদদ্ভুতম্।
ভৈরবাখ্যম্ ভ্রুবোমধ্যাদ্ব্রহ্ম দর্প জিঘাম্সয়া।।
সবৈ তদা তত্রপতিম্ প্রণম্য শিবমম্গণে।
কিম্ কার্য় করবাণ্যত্র শীঘ্রমাজ্ঞাপয় প্রভো।।
বত্সপোऽয়ঁ বিধিঃ সাক্ষাজ্জগতামাদ্যদৈবতম্।
নূনমর্চয় খঙ্গেন তিগ্মেন জবসা পরম্।।
সর্ব গৃহীত্বৈক করেণ কেশম্, তত্পম্চমম্দ্দপ্তমসত্য ভাষিণম্।
ছিত্বা শিরোহ্যস্য নিহন্তুমুদ্যতঃ প্রকম্পয়ন খগমতিস্ফুটম্ করৈঃ।।
পিতা তবোত্সৃষ্ট বিভুষণাম্বর স্রগুত্তরীয়ামলকেশ সম্হতিঃ।
প্রবাতরম্মেব লতেব চম্চলঃ পপাত বৈ ভৈরব পাদ পম্কজে।।
তাবদ্বিধিম্ তাত দিদৃক্ষুরচ্যুতঃ কৃপালুরস্মত্প্রতিপাদ পল্লবম্।
নিষিচ্য বাষ্পৈরবদত্কৃতাজ্জলির্য়থাশিশুঃ স্বপিতরম্ কলাক্ষরম্।।
(শিবপুরাণ বিদ্যেশ্বরী স০ ১ অধ্যায় ৮ ভাষা টিকাকারীর পৃষ্ঠা ১৩, বেঙ্কটেশ্বর প্রেস বোম্বাই দ্বারা প্রকাশিত)
অর্থাৎ – তখন ব্রহ্মা জীর মদ দূর করার জন্য মহাদেব জী ভৃকুটির মধ্য থেকে এক অদ্ভুত ভৈরব পুরুষের রচনা করেন। উৎপন্ন হতেই সমরাঙ্গণে সেই পুরুষ শিব জীকে প্রণাম করে আর বলে – হে ভগবন্! বলুন আমি কি করবো? শীঘ্র আজ্ঞা দিন। শিব জী বললেন – হে বৎস! জগতের এই যে আদি দেবতা ব্রহ্মা আছে, তীক্ষ্ণ ধারালো দ্রুতগামী খঙ্গ দিয়ে এনার অর্চা (পূজা) করো অর্থাৎ এনার উপর প্রহার করো। এটা শোনামাত্র ভৈরব এক হাতে কেশ ধরে সে ব্রহ্মা জীর পঞ্চম অসত্য ভাষী মস্তক কাটে, হাত থেকে স্ফুরায়মান হতেই খঙ্গ দিয়ে ওনার আরও মস্তক কাটার ইচ্ছা করে। তখন আপনার পিতা ব্রহ্মা জী গয়নার-মালা আর উত্তরীয় বস্ত্র ত্যাগ করে, হাওয়াতে কেশ খুলে কলা আর বেলের সমান কম্পিত হয়ে ভৈরব জীর চরণ কমলে গিয়ে পড়েন। ব্রহ্মা জীর এমন দশা দেখে বিষ্ণু জী আমাদের স্বামীর চরণ কমলে অশ্রু মোচন করতে-করতে হাত জোড় করে যেভাবে বালক তার পিতাকে বলে সেইভাবে তিনি বললেন –
ত্বয়া প্রসন্নেন পুরাহিদত্তম্ য়দীশ পম্চাননমীশ চিহ্নম্।
তস্মাত্ক্ষমস্বাদ্যমনুগ্রহার্হ কুরু প্রসাদম্ বিধয়ে হ্যমুষ্যৈ।।
(শিবপুরাণ বিদ্যেশ্বরী স০ ১ অধ্যায় ৮ ভাষা টিকাকারীর পৃষ্ঠা ১৩, বেঙ্কটেশ্বর প্রেস বোম্বাই দ্বারা প্রকাশিত)
অর্থাৎ – বিষ্ণু জী বললেন – হে ভগবান্! আপনি প্রথমে কৃপা করে এনাকে পাঁচটা মস্তক দিয়েছিলেন। এখন একটা চলে যাচ্ছে, এই কারণে ক্ষমা করে ব্রহ্মা জীর উপর প্রসন্নতা করুন।
বিষ্ণুজীর নিন্দা তো আপনি আগেই শুনেছেন। বিষ্ণুজী বৃন্দার সঙ্গে ব্যভিচার করেন, তার পতি জালন্ধরের রূপ বানিয়ে ছল করে তার পতিব্রত ধর্ম নষ্ট করেন। বিষ্ণু জী নৃসিংহ হয়ে শিবের ভক্ত হিরণ্যকশ্যপকে বধ করেন, তো তার দণ্ড স্বরূপ শিব জী নৃসিংহকে প্রচণ্ড মারেন আর তার চামড়া খুলে নেন, শিব জীর ছবিতে সেই বাঘের চামড়া পরা ওনাকে এখনও দেখানো হয় আর শিব জীর গলায় কখনও-কখনও একটা নর মুণ্ডের মালা দেখানো হয়, তার মাঝখানে নৃসিংহের মুখ দেখানো হয়। শাস্ত্রী জী! আপনি নিম্ন স্থানে গিয়ে সম্পূর্ণ বিস্তার ভাবে দেখতে পাবেন, যথা – ‘শিবপুরাণ শত রুদ্র সংহিতা ৩, অধ্যায় ১২, শ্লোক ১ থেকে ৩৬’ পর্যন্ত।
শিবপুরাণের মধ্যে শিবজী উলঙ্গ হয়ে ঋষি পত্নিদের সম্মুখে যাওয়ার কথা লেখা আছে। ঋষিদের অভিশাপে শিবজীর মুত্রেন্দ্রিয় টুকরো-টুকরো হয়ে ভূমিতে পরে যায়, দেখুন – ‘শিবপুরাণ কোটিরুদ্র সংহিতা অধ্যায়
১১ শ্লোক ৬ থেকে ১৯’ পর্যন্ত। বিষ্ণু জীর মোহিনী রূপ দেখে শিব জীর বীর্যপাত হয়ে যায়, দেখুন – ‘শ্রীমদ্ভাগবত স্কন্দ ৮ অধ্যায় ১২, শ্লোক ১৮ থেকে ৩৩’ পর্যন্ত। শিব জী মহানন্দা নামক বেশ্যার সঙ্গে সমাগম করেন, দেখুন – ‘শিবপুরাণ শতরুদ্র সংহিতা অধ্যায় ২৫, শ্লোক ১৩ থেকে ৩০’ পর্যন্ত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিবজী তিনজন মিলে অত্রি ঋষি পত্নী অনুসূইয়ার সঙ্গে অত্যন্ত ঘৃণিত কুচেষ্টা করেছেন, দেখুন – ‘ভবিষ্যপুরাণ প্রতিসর্গ পর্ব খণ্ড ৪, অধ্যায় ১৭, শ্লোক ৬৭ থেকে ৭৫’ পর্যন্ত। আজ আমি আপনাকে এক-দুটো নয়, অনেক প্রমাণ দিবো আর ততক্ষণ পর্যন্ত দিতে থাকবো যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্ত্রী জী ঠিক মতো সন্তুষ্ট না হবেন আর মানা না করবেন।
Note – এরই মাঝে শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী দাঁড়া হয়ে বললেন – ব্যস! ব্যস!! এতগুলো প্রমাণই যথেষ্ট! শ্রী ঠাকুর অমর সিংহ জী শেষে বললেন যে – মাননীয় শাস্ত্রী জী! আপনি বলেছেন যে – ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিব জীর সম্বন্ধে ভিন্ন-ভিন্ন পুরাণের ভিন্ন-ভিন্ন স্থানের মধ্যে যে একে অপরের থেকে বাড়িয়ে প্রশংসা লেখা আছে সেটা তো ‘যার বিবাহ তার সঙ্গীত।’ যদি আপনার এই কথাও মেনে নেওয়া হয় তাহলেও তো তিনটা পৃথক-পৃথক সিদ্ধ হল। আমার তো প্রশ্ন হচ্ছে যে – এই তিনটার মধ্যে কাকে পরমেশ্বর মানা হবে? যখন পরমেশ্বরেরই নিশ্চয়তা নেই তাহলে কার অবতার সিদ্ধ করবেন? আমি তো সিদ্ধ করে দিয়েছি যে ঈশ্বরের অবতার কোনো ভাবেই সিদ্ধ হবে না, শাস্ত্রার্থের সময় তো সমাপ্ত হয়ে গেছে আর নিয়মানুসারে আমাকেই অন্তিমে বলার ছিল। শাস্ত্রী জী! আপনার তো অন্তিম ভাষণ হয়ে গেছে তবুও যদি আপনি কিছু বলতে চান তো আমি আপত্তি করবো না, আপনি কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।
শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী –
আমি শাস্ত্রার্থের অন্তিমে আর্য পণ্ডিত জীকে ধন্যবাদ দিতে চাইবো যে তিনি আমার বলার অধিকার না থাকা সত্ত্বেও আমাকে নিজের উদারতার সঙ্গে বলার অধিকার দিয়েছেন। আমি ওনাকে সহৃদয়ে ধন্যবাদ করছি আর এরপর কিছু না চেয়ে এটাই বলবো যে পুরাণের সব প্রমাণ তথা আমার দেওয়া বেদমন্ত্রের অর্থও আমার জন্য সর্বথা নতুন। আমি এই সবগুলোর উপর পুনঃ বিচার করবো। নিবেদন এইটুকুই যে সনাতন ধর্মের অবতারবাদ বিধায়ক পক্ষকে এখনই সর্বথা খণ্ডিত হওয়া না মানা হোক, আমি অনেক নতুন কিছু পেয়েছি, তার উপর বিচার করবো, শ্রী পণ্ডিত জী আমার জন্য শুভকামনাই করবেন এমনটা আমার আশা আছে।
শ্রী পণ্ডিত ঠাকুর অমর সিংহ জী –
এতে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে পণ্ডিত জী হঠ, দুরাগ্রহ হতে রহিত তথা নিষ্কপট এবং বিদ্বান তথা সজ্জন সাধু স্বভাবের। সনাতন ধর্মী ভাইরা এনাকে অনেক শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আমি তাদের প্রার্থনা করবো যে শ্রী শাস্ত্রী জীকে সেইভাবে শ্রদ্ধা আর প্রেমের সঙ্গে নিয়ে যাবেন, পণ্ডিত জীর মধ্যে কোনো নিম্নতা নেই। বাস্তবিকতা এই যে অবতারবাদকে মানা সর্বথা অনুচিত। একে কেউই সত্য সিদ্ধ করতে পারবে না, আমি শ্রী পণ্ডিত জীর জন্য এই শুভ কামনা করছি যে তিনি যেন পরমাত্মার কৃপায় অবতারবাদের মিথ্যা মতকে ছেড়ে দিয়ে সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মের মান্যতা কারী হয়ে যান। (জনতার মধ্যে চতুর্দিকে হর্ষ ধ্বনি) আপনারা হাসবেন না! আজ অনেক কথা সামনে এসেছে, অনেক প্রমাণ সামনে এসেছে, যার দ্বারা আমি মনে করি শ্রোতাগণের অনেক লাভ হবে। এই ধরনের বাদ-বিবাদ নিরন্তর হওয়া উচিত, এরদ্বারা অনেক বড়-বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী হচ্ছেন বড় বিদ্বান এবং সাধু স্বভাবের ব্যক্তি, এনার পাণ্ডিত্যও কম নয়। আজকের এই শাস্ত্রার্থ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হল। এরজন্য আপনারা সকলে ধন্যবাদের পাত্র।
Note – শ্রী পণ্ডিত গোকুল চন্দ জী শাস্ত্রী মঞ্চ থেকে উঠে চলে যেতে থাকেন তো সনাতন ধর্মীরা বিনা শঙ্খ, করতাল বাজিয়ে শাস্ত্রী জীকে বিনা পুষ্প মালা পরিয়ে চুপচাপ নিয়ে চলে যায়। আর্য সমাজের অনেক ভালো প্রভাব ছিল, পর আর আপন সবাই মিলে আর্য পণ্ডিত শ্রী ঠাকুর অমর সিংহ জী শাস্ত্রার্থ কেশরীর প্রচণ্ড প্রশংসা করে এবং পুষ্পমালা দিয়ে ঠাকুর অমর সিংহ জীকে ভরিয়ে দেয়। চতুর্দিকে জয়-জয়কারে আকাশ কেঁপে ওঠে – বৈদিক ধর্ম কি – জয়, মহর্ষি দয়ানন্দ কি – জয়, আর্য সমাজ কি – জয়, বেদের জ্যোতি – জ্বলতে থাকুক, পরমেশ্বরের অবতার হয় না। ঠাকুর অমর সিংহ জী শাস্ত্রার্থ কেশরী কি – জয়। ইতিসম্।।
(শাস্ত্রার্থ সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ