শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৭ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

10 January, 2024

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৪/৭

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। 
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।।৭।।

পদার্থ-( ভারত) হে ভরত বংশী অর্জুন! ( যদা যদা) যখন যখন ( ধর্মস্য) ধর্মের ( গ্লানিঃ) হানি হয়,( অধর্মস্য) অধর্মের ( অভি-উৎখানম্) চারদিকে বৃদ্ধি ( ভবতি) হয় ( তদা) তখন (:হি) ই ( অহম্) আমি ( আত্মানম্) আত্মাতে ( সৃজামি) রচনা হই।

অর্থ-হে ভরত বংশী অর্জুুন যখন-যখন ধর্মের হানি হয়, অধর্মের চারদিকে বৃদ্ধি হয় তথনই আমি আত্মাতে রচনা হই।

ভাবার্থ-পূর্ববর্তী শ্লোক ৪/৬ এ প্রকৃতির অর্থ স্বভাব, আত্মা শব্দের অর্থ স্বয়ং ( মায়বা) মায়া শব্দের অর্থ জ্ঞান ( বুদ্ধিতে জ্ঞান) করেছি। এই মায়া শব্দ পরমাত্মা দ্বারা চার বেদে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিছু বেদ মন্ত্র উপস্থাপিত করা হয়েছে- ঋগ্বেদ মন্ত্র ১/৩২/৪ এ মন্ত্রে মায়া শব্দের অর্থ সূর্যের সামনে আসা কালো কালো মেঘ বলা হয়েছে। মন্ত্র ১/৩৬/২ এ মায়া শব্দের অর্থ কপট বা অধর্মযুক্ত কর্ম বলা হয়েছে। মন্ত্র ৫/৬৩/৭ এ মায়া শব্দের অর্থ আডম্বর বলা হয়েছে। সামবেদ মন্ত্র ১০৬ এ মায়া শব্দের অর্থ ছল, কপট বলা হয়েছে। ঋগ্বেদ মন্ত্র ৫/৬৩/৩,৪,৬, অথর্ব্বেদ মন্ত্র ১২/১/৮, মন্ত্র ১৩/২/৩,সামবেদ মন্ত্র ১০৪ এবং যজুর্বেদ মন্ত্র ১১/৬৬, এই সকল মন্ত্রে মায়া শব্দের অর্থ বুদ্ধি বলা হয়েছে। এর অতিরিক্ত মায়া শব্দের অর্থ যুক্তি, প্রতারণা, জালিয়াতি, জাদুগরী, অবাস্তবিক,আভাস এবং ছায়া ইত্যাদিও হয়। ঋগ্বেদ মণ্ডল ১০ এবং সাংখ্য সূত্র ১/২৬, সত্ত্বরজস্তমসাম্ সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ প্রকৃতের্মহান্, মহতোऽহংকারো ऽহংকারাত্ পঞ্চতন্মাত্রাণ্যুভয়মিন্দ্রিয়ম্ তস্মাত্রেভ্যঃ স্থূলভূতানি পুরুষ ইতি পঞ্চদিংশতির্গণঃ।। অনুসারে সূর্য, মন বুদ্ধি অথবা কালো মেঘ, কপট, ছল, আডম্বর এই সকল প্রকৃতির রজ,তম,সত্ত্ব এই তিন গুণ থেকে উৎপন্ন তথা জড়। এই আডম্বর ইত্যাদি জীবাত্মার উপর আপন প্রভাব ঢালে। অবিবেকী জীবাত্মা কর্ম বন্ধনে আটকে প্রকৃতির এই বিকারে ফেঁসে যায়,দুঃখী থাকে এবং আপন চেতন অভানাশী স্বরূপ ভূলে যায়।

এই মায়া অথবা যোগ মায়া পরমাত্মার উপর সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারে না। কারণ বৈদিক সাহিত্যে ( যজুর্বেদ মন্ত্র ৪০/৮ ইত্যাদি) তে ঈশ্বর শুদ্ধ এবং পাপ ইত্যাদি থেকে পূর্ণত পৃথক। ঋগ্বেদ মন্ত্র ১০/১২৬/৭ এর অনুসারে ঈশ্বর তাতেও প্রকৃতি এবং জীবাত্মাদের স্বামী। অতএব কোন যোগ মায়া পরমেশ্বরকে কীভাবে পরাভূত করতে পারে, যেকারণে ঈশ্বর অবতার হতে বাধ্য হন বা পরমাত্মা জীব হয়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করতে থাকেন? অতএব পরমাত্মা কখনও জীব হন না। জীবাত্মা চব্বিশ প্রকারের সামর্থ্য দ্বারা যুক্ত যা এই প্রকার-বল,পরাক্রম,আকর্ষণ,প্রেরণা,গতি,ভীষণ, বিবেচন, ক্রিয়া, উৎসাহ, স্বরণ, নিস্চয়, ইচ্ছা, প্রেম, দ্বেষ, সংযোগ, বিভাগ, সংযোজক, বিভাজক, শ্রবণ, স্পর্শন, দর্শন,স্বাদন এবং গন্ধগ্রহণ তথা জ্ঞান। গীতা শ্লোক ১৩/৬ তেও তার সংক্ষেত রয়েছে। সাধারণ মনুষ্যের মৃত্যু হওয়ার পর জীবাত্মা পঞ্চ জ্ঞানোন্দ্রিয়,পঞ্চ কর্মন্দ্রিয়,পঞ্চ সূক্ষ্ম ভূত, মন এবং বুদ্ধি এই সতেরটি তত্ত্ব সহিত শরীর থেকে বেরিয়ে আসে এবং কর্মানুসারে পুনঃ শরীর ধারণ করে যার বর্ণনা শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থ কাণ্ড ১৪ তে দর্শনীয়। পরন্তু মুক্ত জীবাত্মা তার স্বাভাবিক ছব্বিশটি গুণের সাথে হয় এবং মুক্ত জীবাত্মার সংকল্প মাত্র শরীর হয়। অর্থাৎ নিজ ইচ্ছা শক্তি থেকে শরীর ধারণ করে মোক্ষের সুখকে ভোগ করে। যজুর্বেদ অধ্যায় ৩১,অথর্ব্বেদ কাণ্ড ১৬ সূক্ত ৬ সামবেদ মন্ত্র ৬১৭ থেকে ৬২১,ঋগ্বেদ মন্ত্র ১০/৬০/১-১৩ থেকে এই সিদ্ধ হয় যে,রজ,তম এবং সত্ত্ব এই তিন গুণযুক্ত প্রকৃতি জড়,ঈশ্বর এবং জীবাত্মা চেতন তত্ত্ব। পরমাত্মা,জীবাত্মা এবং প্রকৃতি অনাদি এবং অবিনাশী তত্ত্ব। শ্বেতশ্বতরো- পনিষদ শ্লোক ৬/৮ এর অনুসারেও ঈশ্বরের জ্ঞান,ক্রিয়া এবং বল স্বাভাবিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় অতএব নিশ্চিত সময়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঈশ্বরের শক্তি প্রকৃতিতে কার্য করেন। এবং প্রকৃতি থেকে এই জড় জগৎ উৎপন্ন হয়। এতে কর্মানুসারে জীবাত্মারা শরীর ধারণ করে।

অতএব ঈশ্বর কখনও অবতার হন না। এই সকল প্রমাণের সারাংশ এই যে,উপস্থাপিত শ্লোকেও শ্রীকৃষ্ণ মহারাজের অবতারকে সিদ্ধ করে না। শ্লোকে "ধর্মের হানি" এর অর্থ শুভ-সত্য কর্মের হানি। বৈশেষিক শাস্ত্র সূত্র ১/১/২ এ কণাদ ঋষি বলেছেন-"যতোऽভ্যুদয়নি শ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ" অর্থাৎ যে শুভ কর্মের দ্বারা এই লোক এবং মৃত্যু পশ্চাৎ পরলোক ( পরের জন্মেও) সুখ প্রাপ্ত হয় তাকেই ধর্ম বলে। মনুস্মৃতি শ্লোক ২/৬ বলা হয়েছে ( অখিলঃ বেদঃ) সম্পূর্ণ বেদ ( ধর্মমূলম্) ধর্মের মূল। জৈমিনি ঋষি পূর্ব মীমাংসা শাস্ত্র সূত্র ১/১/২ এ বলেছেন যে, ঈশ্বরের দ্বারা বেদে মনুষ্যের জন্য যে কর্ম করার আজ্ঞা দিয়েছেন তাই ধর্ম অন্যথা অধর্ম। গীতা শ্লোক ৩/১৫ তে বলেছেন "কর্ম ব্রহ্মোদ ভবম্ বিদ্ধি,ব্রহ্ম অক্ষরসমুদ ভবম্" অর্থাৎ কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন জানবে তথা বেদ অবিনাশী পরমাত্মা থেকে উতপন্ন হয়েছে। অতএব ধর্ম শব্দের অর্থ বেদোক্ত শুভ কর্ম করা। যার জন্য আমাদের বেদের অধ্যয়ন করা অতি আবশ্যক। অন্যথা অবিদ্যা গ্রস্ত থেকে প্রাণী অন্ধবিশ্বাস,তুচ্ছ কর্ম কাণ্ড,ইত্যাদিতে ফেঁসে জীবন ব্যর্থ করে নেয়। অতএব উপস্থাপিত শ্লোকের অর্থ হল যে, যখন যখন সংসারে "ধর্মস্য গ্লানিঃ ভবতি" অর্থাৎ বেদোক্ত শুভ কর্মের হানি হয় এবং বেদ-বিরুদ্ধ অধর্মযুক্ত কর্মের বৃদ্ধি হয়ে যায় তখন তখনই আমি নিজর আত্মাতে রচনা হই অর্থাৎ আমি শরীর ধারণ করি পূর্ববর্তী শ্লোকের বিস্তৃত বর্ণনা এবং সেই বর্ণনাতেই অথর্ব্বেদ মন্ত্র ৬/১০/১১ এর প্রমাণ দ্বারা এই সিদ্ধ হয় যে,যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ মুক্ত জীবাত্মা ছিলেন যিনি ইচ্ছানুযায়ী কখনও জন্ম নিতে জীবের কল্যাণ করতে পুনঃ মোক্ষ সুখে ফিরে যায়। এই আধারের উপর শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ এখানে বলেছেন যে হে অর্জুন! যখন-যখন ধর্মের হানি হয় এবং অধর্ম বৃদ্ধি হয় তখন আমি নিজের ইচ্ছা থেকে শরীর ধারণ করি। ঋগ্বেদ মন্ত্র ৭/৩৫/১৩ তে ঈশ্বরকে "অজ একপাত্" বলা হয়েছে অর্থাৎ ঈশ্বর কখনও জন্ম নেয় না। অজ এর অর্থ "অ+জ" অ=না এবং জ= জন্ম অর্থাৎ যাঁর কখনও জন্ম হয় না। একপাত্ এর অর্থ যাঁর শক্তির এক অংশ মাত্র দ্বারা সমস্ত সংসার প্রকৃতি দ্বারা মিলিয়ে উৎপন্ন হয়েছে। এই থেকে সিদ্ধ যে পরমেশ্বর অবতার নেয় না। শ্রীকৃষ্ণ মহহারাজ সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন,অবতার ছিলেন না। নিজের ইচ্ছা থেকে ত্রেতাযুগে শরীর ধারণ করেছিলেন।।
( ভাষ্য-যোগাচার্য্য রামস্বরূপজী)

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্যের সাধনা ভোজন

  নবম ভাগ ভোজন ভূমিকা - "ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্" . ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ