নিয়োগ মহর্ষি দয়ানন্দ জীর উদ্ভাবিত কোনো প্রথা বা বিচার নয়। মহর্ষি দয়ানন্দ বেদ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ দ্বারা নির্দেশিত বৈদিক অনুশীলনকে কেবল উপস্থাপন এবং সমর্থন করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি খুব একটা জোরালো ছিলেন না। তিনি উপদেশ মঞ্জরীতে স্পষ্টভাবে লিখেছেন যে "আমি বিধবা বিবাহ প্রত্যাখ্যান করতে চাই না" (উপদেশ ১২)। একই নির্দেশ অনুসারে, আর্য সমাজ বিধবা বিবাহের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করে এবং বিধবা বিবাহ শুরু করলেও পৌরাণিক শ্রেণীর লোকেরা এর তীব্র বিরোধিতা করে ছিলো। এই ধরনের লোকদের সমালোচনা করার আগে সামাজিক মনোবিজ্ঞান এবং ইতিহাস বিবেচনা করা উচিত।
সত্যার্থ প্রকাশের ১৩ সমুল্লাসে মহর্ষি দয়ানন্দ জী উত্পত্তি পর্বের খণ্ডন সময়ে, এবং বাইবেলের ব্যবস্তা বিবরণে নিয়োগ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই প্রমাণগুলি দেখায় যে ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে 'দেবর' দ্বারা নিয়োগ এবং 'দেবর' দ্বারা বিবাহের ঐতিহ্যগুলি বাধ্যতামূলক ছিল এবং সেগুলি বাইবেলে নির্ধারিত রয়েছে। উপরোক্ত বিবরণে বর্ণিত দুটি পরম্পরার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা পাঠককে বুঝতে হবে।
যখন একজন পুরুষ কারো স্ত্রী থেকে একটি সন্তান উৎপাদন করে এবং সেই সন্তানটিকে সেই মহিলা এবং তার স্বামীর বংশের বলে বলা হয়, তখন তাকে 'নিয়োগ' বলা হয়। যখন তাকে একই সঙ্গম পুরুষের বংশের সন্তান বলা হয় তখন তাকে বলা হয় 'পুনর্বিবাহ'। পুনর্বিবাহ এবং নিয়োগের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে; যেমনঃ (প্রথমতঃ) বিবাহ হলে যেমন কন্যা পিতৃগৃহ ছেড়ে পতিগৃহে গমন করে, পিতার সহিত তাঁর বিশেষ সম্বন্ধ থাকে না সেইরূপ বিধবা স্ত্রী বিবাহিত পতির গৃহেই অবস্থান করে। (দ্বিতীয়তঃ) সেই বিবাহিতা স্ত্রীর পুত্র সেই বিবাহিত পতির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে কিন্তু বিধবা স্ত্রীর পুত্র বীর্য্যদাতার পুত্র হয় না, তাঁর গোত্রীয়ও হয়না, পুত্রের উপর তাঁর কোন স্বত্ব থাকেনা। কিন্তু সে বিধবার মৃত পতিরই পুত্ররূপে পরিগণিত হয় এবং তাঁরই গোত্রীয় ও তাঁরই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে তাঁরই গৃহে বাস করে। (তৃতীয়তঃ) বিবাহিত স্ত্রীপুরুষের পক্ষে পরস্পরের সেবা এবং পালন করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের কোন সম্বন্ধই থাকেনা। (চতুর্থতঃ) বিবাহিত স্ত্রীপুরুষের আমরণ সম্বন্ধ থাকে, কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ কার্য্যান্তে ছিন্ন হয়ে যায়। (পঞ্চমতঃ) বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ পরস্পর মিলিত হয়ে গৃহকৰ্ম্ম সম্পাদনে পরস্পর যত্নবান্ হয়ে থাকে কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষ নিজ নিজ গৃহকৰ্ম্ম করতে থাকে।
বিবাহ এবং নিয়োগের নিয়মেও কিঞ্চিত প্রভেদ আছে, তদ্ব্যতীত বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ একপতি এবং এক স্ত্রী মিলিত হয়ে দশটি সন্তান উৎপন্ন করতে পারে। কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষ চারিটির অধিক সন্তান উৎপন্ন করতে পারে না। অর্থাৎ কুমার ও কুমারীর বিবাহের ন্যায় বিপত্নীক পুরুষ এবং বিধবা স্ত্রীর নিয়োগ হয়ে থাকে। কুমার এবং কুমারীর নিয়োগ হয় না। বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ সর্বদা সঙ্গে থাকে কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের ব্যবহার সেইরূপ নয়। তাঁরা ঋতুদানের সময় ব্যতীত (অন্য সময়ে) একত্র হবেনা। যদি স্ত্রী নিজ প্রয়োজনে নিয়োগ করে, তবে দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির দিন হতে তাহার সহিত নিযুক্ত পুরুষের সম্বন্ধ ছিন্ন হয়ে যায়। পুরুষ নিজের জন্য নিয়োগ করলেও দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির পর হতে সম্বন্ধ থাকেনা। কিন্তু সেই নিযুক্ত স্ত্রী দুই তিন বৎসর পর্যন্ত সন্তানগুলিকে লালন পালন করে নিযুক্ত পুরুষকে দিবে। এইরূপে এককালে বিধবা স্ত্রী নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারিজন নিযুক্ত পুরুষের প্রত্যেকের জন্য দুইটি দুইটি করে সন্তান উৎপন্ন করতে পারে। একজন বিপত্নীক পুরুষও নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারি বিধবার জন্য দুইটি করে পুত্র উৎপন্ন করিতে পারে। এইরূপে মোট দশটি সন্তান উৎপত্তির আজ্ঞা বেদে আছে, যথাঃ-
ঋগ্বেদ ১০।৮৫।৪৫📕
ইমাং ত্বমিন্দ্র মীঢ্ব : সুপুত্রাং সুভগাং কৃণু।
দশাস্যাং পু্ত্রতানাধেহি পতিমেকাদশং কৃধি॥
ভাবার্থঃ হে (মীঢ্ব , ইন্দ্র) বীর্য্যসিঞ্চনে সমর্থ ঐশ্বর্য্যশালী পুরুষ! তুমি এই বিবাহিতা স্ত্রী বা বিধবা স্ত্রীকে শ্রেষ্ঠ পুত্রের মাতা এবং সৌভাগ্যবতী কর।বিবাহিতা স্ত্রীতে দশ পুত্র উৎপন্ন কর এবং স্ত্রীকে একাদশ বলিয়া মনে কর (ঋ০১০।৮৫।৪০)। হে স্ত্রী ! তুমিও বিবাহিত বা নিযুক্ত পুরুষ কর্ত্তৃক দশটি সন্তান উৎপন্ন কর এবং পতিকে একাদশ বলিয়া মনে কর॥ [মহর্ষি দয়ানন্দকৃত ভাষ্যের বাংলা অনুবাদ]
(ইমাং ত্বমিন্দ্র) এই মন্ত্র দ্বারা স্ত্রী একাদশ পুরুষ পর্যন্ত নিয়োগ করতে পারে, সেইরূপ পুরুষও একাদশ স্ত্রী পর্য্যন্ত নিয়োগ করতে পারে। কিন্তু একাদশ শব্দদ্বারা দশ পুত্র এবং পতিকে একাদশ গণনা করা হবে না কারন যদি এইরূপ অর্থ করা হয়, তবে "বিধবেব দেবরম্ "দেবরঃ কম্মাদ্ দ্বিতীয়ো বর উচ্যতে," "অদেবৃঘ্নি" এবং "গন্ধর্ব্বো বিবিদ উত্তর" ইত্যাদি বৈদিক প্রমাণ সমূহের বিরুদ্ধ অর্থ হবে। প্রথম পতি বা স্ত্রী + সন্তান প্রয়োজনে অধিকতম দশ জন নিয়োগ পুরুষ বা স্ত্রী।
দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ্বা স্ত্রিয়া সম্যঙ্ নিযুক্তয়া।
প্রজেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্য পরিক্ষয়ে॥ মনু০ ৯।৫৯
জ্যেষ্ঠো যবীয়সো ভার্য্যাং যবীয়াস্বাগ্রজন্দ্রিয়ম্।
পতিতৌ ভবতো গত্বা নিযুক্তাবপ্যনাপদি ॥ মনু০ ৯।৫৮
ঔরসঃ ক্ষেত্রজশ্চৈব॥ মনু০ ৯।১৫৯)
মনু মহারাজ এইসব লিখেছেন যে "সপিণ্ড” অর্থাৎ পতির ছয় পুরুষের মধ্যে, পতির কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অথবা স্বজাতীয় এবং নিজ অপেক্ষা উচ্চ জাতিস্থ পুরুষের সাথে বিধবা স্ত্রীর নিয়োগ হওয়া উচিত। যদি বিপত্নীক পুরুষ এবং বিধবা স্ত্রী সন্তান কামনা করে, তবে তাঁর নিয়োগ হওয়া উচিত। সর্বথা সন্তানের অভাব হলে নিয়োগ হবে। আপৎকাল অর্থাৎ সন্তান কামনা ব্যতীত, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সহিত কনিষ্ঠ ভ্রাতার অথবা কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সহিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিয়োগ হলে এবং সন্তানোৎপত্তির পরেও নিযুক্তগণ সমাগম করিলে পতিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক নিয়োগের সীমা দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভধারণ পর্য্যন্ত। তার পর সমাগম করবে না। যদি উভয়ের প্রয়োজনে নিয়োগ হয়, তবে চতুর্থ গর্ভ পর্য্যন্ত অর্থাৎ পূর্ব্বোক্ত রীতি অনুসারে দশ সন্তান পর্য্যন্ত হতে পারে। তদনন্তর তা বিষয়াসক্তি বলে গণ্য হয়। তাতে তাঁরা পতিত বলে গণ্য হয়। বিবাহিত স্ত্রীপুরুষও দশম গর্ভের পরে সমাগম করলে কামুক বলে নিন্দিত হয়। অর্থাৎ বিবাহ বা নিয়োগ সন্তানের জন্য, পশুবৎ কাম ক্রীড়ার জন্য নয়।
সোমঃ প্রথমো বিবিদে গন্ধর্ব্বো বিবিদ উত্তরঃ।
তৃতীয়ো অগ্নিষ্টে পতিস্তুরীয়স্তে মনুষ্যজাঃ ॥ ঋঃ। ১০।৮৫।৪০॥
হে স্ত্রি! (তে) তোমার যে (প্রথমঃ) প্রথম বিবাহিত (পতিঃ) পতি তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয় তাহার নাম (সোমঃ) সুকুমারতা প্রভৃতি গুণযুক্ত বলিয়া সোম। যে দ্বিতীয়বার নিয়োগ দ্বারা তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয় সে (গন্ধর্ববঃ) এক স্ত্রীর সহিত সম্ভোগ করিয়াছে বলিয়া গন্ধর্ব্ব। যে (তৃতীয় উত্তরঃ) দুই পতির পরবর্তী তৃতীয় পতি সে (অগ্নিঃ) অতি উষ্ণতাযুক্ত হওয়ায় অগ্নিসংজ্ঞক, এবং যাহারা (তে) তোমার (তুরীয়ঃ) চতুর্থ হইতে একাদশ পর্য্যন্ত নিযুক্ত পতি তাহারা (মনুষ্যজাঃ) মনুষ্য নামে অভিহিত হয়।
যে স্ত্রীপুরুষের পাণিগ্রহণ সংস্কার মাত্র হয়েছে, কিন্তু সংযোগ হয়নি, অর্থাৎ স্ত্রী অক্ষতযোনি এবং পুরুষ অক্ষতবীর্য্য তাঁদের অন্য পুরুষ এবং স্ত্রীর সাথে পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত। শূদ্রবর্ণে পূনর্বিবাহ হতে পারে কিন্তু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের মধ্যে ক্ষতযোনি স্ত্রী এবং ক্ষতবীর্য্য পুরুষের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত নয় (মনুস্মৃতি ৯।১৭৬)।
অর্থাৎ দ্বিজদের মধ্যে পুনর্বিবাহ বা বহুবিবাহ কখনও হওয়া উচিত নয় (সত্যার্থ প্রকাশ; চতুর্থ সমুল্লাস)। যদি স্ত্রীপুরুষ ব্রহ্মচর্য্যে স্থির থাকতে ইচ্ছাকরে তবে স্ত্রীপুরুষ ব্যভিচারাদি কর্ম করে গর্ভপাতাদি কুকর্ম বা সন্তানোৎপত্তি বিষয়ে কোন উপদ্রব হবে না। যদি বংশ পরম্পরা রক্ষার জন্য স্বজাতির কোন বালক বালিকাকে পোষ্যগ্রহণ করা হয়, তবে তাতে বংশরক্ষা হবে এবং ব্যভিচার হয় না। আর ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে না পারলে নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপত্তি করার বিধান রয়েছে। মূলতঃ নিয়োগ সন্তাৎনোৎপত্তির জন্য ব্যবস্তা মাত্র। সন্তানের সর্ব্বপ্রকারে অভাব হলে নিয়োগ করার বিধান অন্যথা নয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ