সন্তানিকম্ যক্ষ্যমাণমধ্বহম্ সর্ববেদসম্।
গুর্বর্থম্ পিতৃমাত্রর্থম্ স্বাধ্যায়ার্থ্যুপতাপিনঃ।। মনু-১১/১
এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত অতঃ মূল মনুস্মৃতির অংশ নয়।
টীপ্পণী-
এই সকল ( ১১/১ থেকে ৪৩- পর্যন্ত) নিম্নলিখিত কারণে প্রক্ষিপ্ত-
[১.] প্রসঙ্গ বিরোধ-( ক) পূর্বাপর-প্রসঙ্গের বিরোধ হওয়ার কারণে এই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। ১০/১৩১ এ এই অধ্যায়ের বিষয় "প্রায়শ্চিত-বিধি" বলা হয়েছে এবং এর সঙ্গতি ১১/৪৪এর সম্বন্ধ। তথা এই শ্লোক থেকে "প্রায়শ্চিত-বিধি" প্রারম্ভ হয়েছে। এর মধ্যে আসা ১-৪৩ শ্লোকগুলি সেই প্রসঙ্গকে ভঙ্গ করে দিয়েছে। অতঃ এই সকল শ্লোক অপ্রাসঙ্গিক। ( খ) এবং ১০/১৩১ এর ১১/১ থেকে তথা ১১/৪৪ এবং ১১/৪৩ এর কেন প্রকার সঙ্গতি নেই। এই অসঙ্গতিও এই শ্লোকগুলোকে প্রসঙ্গ-বিরুদ্ধ সিদ্ধ করে।
[২ ] বিষয়-বিরোধ-১০-১০/১৩১ এই অগ্রিম-বিষয়-সংকেতক-সংকেতক শ্লোক দ্বারা স্পষ্ট হয় যে এই অধ্যায়ের বিষয় "প্রায়শ্চিত-বিধি"। এবং এই বিষয় ১১/৪৪ থেকে প্রারম্ভ হয় ১১/২৬৪ পর্যন্ত। এর মধ্যে ১/৪৩ শ্লোকে "প্রায়শ্চিত-বিধি দ্বারা ভিন্ন দানের অধিকারী,যজ্ঞের বিধান,সোম পানের অধিকারী,ইত্যাদি বার্তার বর্ণনা বিষয়-বিরুদ্ধ।
[ ৩] .অন্তর্বিরোধ-( ক) মনু দান গ্রহণ ১/৮৮, ৭/৯,৯২,৮৩,১০/৭৫-৭৬ ইত্যাদি শ্লোকে সকল ব্রাহ্মণদের সমান রূপে কর্ম মান্য হয় । আবার এখানে ১/২ মধ্যে নয় প্রকারের স্নাতকদের পরিগণন করে দানের অধিকারী বলা নিরর্থক। এবং ১১/৩ এ দ্বিজ=ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় তথা বৈশ্য তিনের দান করার বক্তব্য মনু সম্মত নয়। এবং কিছুকে বেদীর উপর ডেকে দান করার তথা কিছুকে বেদী থেকে বাহিরে দান করার বক্তব্যও পক্ষপাতপূর্ণ। (.খ) ১১/৫ এ দ্বিতীয়-বিবাহের বিধান মনুর বিধান থেকে বিরুদ্ধ। মনু ৫/১৬৭-১৬৮ তে এবং ৩/৪-৫ এ এক বিবাহ করারই বিধান করেছেন। এবং দ্বিতীয় বিবাহ থেকে উৎপন্ন সন্তান ধনাধি দানকারী হয়, উৎপাদকের নয়,এই বক্তব্য তাই উপহাস্যাসম্পদই। ( গ) ১০/৭৬ এবং ১১/১৭৫ শ্লোকগুলিতে শ্রেষ্ঠ-পুরুষদের দ্বারা দান করার নির্দেশ করেছেন এবং চণ্ডালাদি হতে দান গ্রহণের পর দান গ্রহণকারী ব্রাহ্মণ পতিত হয়ে যায়। পরন্তু ১১/১৩-১৬ এবং ১৯ এ অশ্রেষ্ঠ পুরুষদের থেকেও ধন গ্রহণের বিধান আছে যা পূর্বোক্ত বক্তব্য থেকে বিরুদ্ধ। ( ঘ) ১১/৩৭ এ নরক এবং ১১/৬ এ স্বর্গের স্থান বিশেষের মান্যতা মনুসম্মত নয়। এই বিষয়ে ১২/৭৫-৮০ শ্লোকগুলোর মীমাংসা দ্রষ্টব্য। ( ঙ) এবং এখানে ১১/৭-৮ এবং ৪০ যাদের অল্প ধনযুক্তের যজ্ঞ না করার বিধান করেছেন,এটিও দক্ষিণা লোভী ব্রাহ্মণদের অন্তর্ভূক্তি, মনুসম্মত নয়। মনু তাই পঞ্চযজ্ঞকে অপরিহার্য ধর্মের কথা বলেছেন এবং এতে অনধ্যায় ( ছুটি)রও নিষেধ করেছেন এবং প্রত্যেক দ্বিজের এই আবশ্যক কর্তব্য। এবং মনু ৬/৫ ও ১১ তম শ্লোকে মনু যজ্ঞীয় দ্রব্যের অভাবে শস্য ( মুন্যন্ন) আদি দ্বারাও যজ্ঞ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং ১১/৮ ও ৩৮-৪০ এ অল্প ধনযুক্ত অথবা অল্প দক্ষিণা যুক্ত যজ্ঞ থেকে ক্ষতির কথাও মনু-বিরুদ্ধ। কারণ মনু ২/১০৫-১০৬ এ যজ্ঞ করাকে সর্বদা অনিবার্য বলেছেন। ( চ) এবং ১১/৩৬-৩৭ শ্লোকগুলোতে কন্যা, যুবতি-স্ত্রী আদির জন্য যজ্ঞ করার নিষেধ পৌরাণিক যুগের উত্তরাধিকার, ঐ সময় স্ত্রীদেরকে পড়া আদির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মনু ৯/২৮,৯৬ তথা ১১ এই শ্লোকগুলোতে সকল প্রকারের ধর্মকার্যে পুরুষের ন্যায় স্ত্রীদের অধিকার মানা হয়েছে। এবং ৯/২৮ এ সমস্ত ধর্মকার্যকে স্ত্রীদের অধীন মানা হয়েছে। অতঃ স্ত্রীদেরকেও যজ্ঞ করার অধিকার মনুসম্মত। ( ছ) ১১/২৭ এ পশুযজ্ঞ কে না করার জন্য প্রায়শ্চিতের বিধান করেছে। এটিও বামমার্গের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করে। মনু যজ্ঞাদি কার্যে পশুহিংসা সর্বথা বিরোধী। মনু অহিংসাকে পরমধর্ম মান্য করেছেন। এই বিষয়ে ৪/২৬-২৮ শ্লোকগুলোর সমীক্ষা দ্রষ্টব্য। ( জ) এই শ্লোকগুলোতে ১১/১৭, ১৯/২১ ব্রাহ্মণদেরকে চুরি দ্বারা ও বলপূর্বক ধন গ্রহণের বিধান করেছে। মনুর এই ৮/৩০২, ৩৩৫-৩৩৮,৩৪৪-৩৫১ শ্লোকগুলোর বিরুদ্ধ। কারণ মনু এই শ্লোকগুলোতে ব্রাহ্মণকে কাউকে পীড়া না দেওয়া তথা চুরি ও দুঃসাহসের জন্য অধিক দণ্ডের বিধান করেছেন। ( ঝ ) ১১/৩১-৩২ শ্লোকগুলোতে বলা হয়েছে যে ব্রাহ্মণ করোও অপরাধের বিষয়ে রাজাকে কিছু না বলে এবং নিজ সামর্থ্য থেকে দণ্ড দিবে। এই বিধান সপ্তম,অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের বিধান থেকে বিরুদ্ধ। কারণ এর মধ্যে রাজাকেই দণ্ড দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে,রাজা থেকে ভিন্ন ব্রাহ্মণাদিকে নয়। ( ঞ) মনু যজ্ঞের বিধানে ২;৬৯,১০৫ ১০৮, ৩/৬৭-১১৮,২২৫-২৮৬, ৪/২১-২৬, ৬/৪-১২ ইত্যাদিতে কোথাও সোমযজ্ঞ,বৈশ্যবানরযজ্ঞাদির বিধান করেননি। কিন্তু ১১/৭-৮ এবং ২৭ শ্লোকে সোমযজ্ঞের কথা প্রসঙ্গ বিরুদ্ধ।
[ ৪] অবন্তর-বিরোধ- এই-এই প্রক্ষিপ্ত শ্লোকে পরস্পর বিরোধও আছে। যা থেকে স্পষ্ট হয় যে এই শ্লোকগুলোকে তৈরীকারী ভিন্ন-ভিন্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১১/১৩,১৬ শ্লোকগুলোতে শূদ্র থেকে তথা নিকৃষ্টকারী থেকে যজ্ঞের জন্য ধন গ্রহণ উচিত মানা হয়েছে। পরন্তু ১১/২৪,৪২-৪৩ শ্লোকগুলোতে তাদের ধন অশুভ হওয়ায় অস্বীকার্য মানা হয়েছে। এবং তাদের থেকে ধন গ্রহণে যজমানকে পরবর্তী জন্মে চন্ডাল হওয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মনু-সমত হতে পারে না।
[ ৫] শৈলী-বিরোধ- ( ক) সমস্ত মনুস্মৃতিতে মনুর প্রবচনের এই শৈলী যে তিনি কোন বিষয়ের প্রারম্ভ তথা সমাপ্তির পর বিষয়ের নির্দেশ অবশ্যই করেছেন। পরন্তু এই ৪৩ শ্লোকে তথা সমাপ্তির পর কোনও প্রকারের বিষয়-সূচক সংকেত নেই অতঃ এই শ্লোক মনুর শৈলীর নয়। ( খ) এবং মনুর শৈলী সমতার ভাব দ্বারা পূর্ণ, ন্যায়চিৎ,যুক্তি-যুক্ত তথা পক্ষপাত রহিত হয়। পরন্তু ৩,৭,১৯,২০ ২৩-২৬,২৮,৩০,৩৭,৪০,৪৩ শ্লোকগুলোর শৈলী ভিত্তিহীন। ১২-১৬,২১-২৩,৩১-৩২,৩৫,৪২-৪৩ শ্লোকগুলোর শৈলী পক্ষপাত পূর্ণ। ১৩,১৯,২৪,৩৭,৪২-৪৩ শ্লোকের শৈলী দ্বেষ পূর্ণ এবং ২৪-২৬,৩৭ শ্লোকগুলোর ভয় প্রদর্শনাত্মক শৈলী। মনুর শৈলীতে এই প্রকারের ত্রুটি নেই। এসব দোষ তথা ত্রুটির কারণে এই সকল শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।।
( ভাষ্যকার-আচার্য রাজবীর শাস্ত্রী)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ