বেদ ছন্দ রূপ ! ছন্দ বিষয়ে মহর্ষি যাস্ক বলেছেন- "ছন্দাংসি ছাদনাত্" (নিরুক্ত ৭।১২) এই বিষয়ে দৈবত ব্রাহ্মণ ৩।১২ তে বলা হয়েছে "ছন্দংসি ছন্দযন্তীতি বা"। এখন এই প্রশ্ন ওঠে ছন্দ কোন পদার্থের নাম যা অন্য পদার্থকে আচ্ছাদিত করে? 'আচ্ছাদন' শব্দের মাধ্যমে আমরা বলতে পারি ছন্দ কোন দ্রব্য যা অন্য দ্রব্য কে আচ্ছাদিত করে। ছন্দ পদের অনেক অর্থ মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামী তাঁর ভাষ্যে করেছেন-
প্রকাশকর্ম (যজু০ ১৫।৪)
উর্জানম্ (যজু০ ১৫।৪)
বলকারী (যজু০ ১৪।১৮)
প্রকাশঃ (যজু০১৪।১৮)
এই সব অর্থে সিদ্ধ হয় ছন্দ কোন দ্রব্য। এর অর্থ হয় বেদ মন্ত্র দ্রব্যরূপ। অন্য এক ঋষির কথন-'প্রাণাঃ বৈ ছন্দাংসি' (কৈ০ব্রা০ ৭।৯।১৭।২) এর অর্থ ছন্দ প্রানরূপ অর্থাৎ বেদ মন্ত্র প্রানরূপ। প্রান নিরন্তর কম্পন করতে থাকা পদার্থ (শ০ব্রা০ ১০।২।৬।১৯)। ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে 'প্রানঃ কম্পনাৎ' (ব্র০সূ০ ১।৩।৩৭)- এর অর্থ বেদ মন্ত্ররূপী পদার্থ, এই সৃষ্টিতে সর্বদা কম্পন করতে থাকে। রুত্বপূর্ণ। বস্তুতঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টিটাই হচ্ছে ছন্দ রশ্মির খেলা। এই স্পন্দনকে বাক্ ও প্রাণ বলে। এই বাক্ তত্ত্বকেই "ছন্দ" বলে অর্থাৎ ছন্দ রশ্মি, মনস্তত্ত্বের ভিতরে যে স্পন্দন রূপ হয়, তাকেই বাক্ তত্ত্ব বলে। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি ছন্দ রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণ রূপী রশ্মি সবই হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন সূক্ষ্ম স্পন্দন।
এই সৃষ্টির মধ্যে ছন্দ রশ্মি অনন্ত বা অসংখ্য মাত্রায় বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুণ ও কর্মের আধারে তাদের প্রমুখ রূপে সাতটা বিভাগ হয়। এই সাতটা ছন্দ হল - গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ্ এবং জগতী। আবার এই সাতটা রশ্মিরও দৈবী, আসুরী, প্রাজাপত্যা, য়াজুষী, সাম্নী, আর্চী, আর্ষী এবং ব্রাহ্মী, এই আটটা ভেদ মানা হয়েছে। চেতন তত্ত্ব "ওম্" ছন্দ রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এই তিন প্রকারের ছন্দ রশ্মির নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ"-এর প্রাধান্য দ্বারা ভূমিকা হয়। এই সমস্ত ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয় যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিদের আচ্ছাদিত করে মিথুন বানাতে থাকে। সাতটা ছন্দ রশ্মি প্রধানতঃ আট প্রকারের হয়। এই আট প্রকার হল - দৈবী, যাজুসী, প্রাজাপত্যা, সাম্নী, আসুরী, আর্চী, আর্ষী, ব্রাহ্মী। এই ভাবে এদের মোট আট প্রকারের বিভাগ প্রত্যেক গায়ত্রী আদি ছন্দের হয়।
ছন্দ রশ্মির অক্ষর ভেদের কারণে নিম্ন প্রকারে ভেদ হয় -
১. সামান্য ছন্দ ২. ভুরিক্ ছন্দ ৩. স্বরাট্ ছন্দ ৪. বিরাট্ ছন্দ ৫. নিচৃত্ ছন্দ। এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হতে থাকে।
চেতন তত্ত্ব "ওম্" ছন্দ রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। ছন্দ রশ্মি তিন প্রকারের হয়, "ঋক্", "য়জুঃ" এবং "সাম"। এই তিন প্রকারের ছন্দ রশ্মির নির্মাণে মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির ভূমিকার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রমশঃ "ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ"-এর প্রাধান্য দ্বারা ভূমিকা হয়। এই সমস্ত ছন্দ রশ্মি এরকম স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয় যে উৎপন্ন হতেই বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিদের আচ্ছাদিত করে মিথুন বানাতে থাকে।
1. ঋক্ = এই রশ্মিগুলো সূক্ষ্ম দীপ্তিযুক্ত হয়। যেসব মূলকণা এই সৃষ্টির মধ্যে আছে, সেইসবের উৎপত্তিতে এই ছন্দ রশ্মির মুখ্য ভূমিকা থাকে। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক ঊর্জার মধ্যেও ঋক্ রূপী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন পদার্থ যখন অপ্রকাশিত বা সঘন রূপ ধারণ করে, সেই সময় তারমধ্যে আকর্ষণ বলেরও প্রবলতা হয়ে যায়। এই ছন্দ রশ্মি তথা সাম রশ্মির মধ্যে বাক্ তত্ত্ব অর্থাৎ "ওম্" রশ্মির প্রাধান্য (মনস্তত্ত্বের সাপেক্ষ) থাকে। এই কারণে এই দুই প্রকারের রশ্মি বলের দ্বারা বিশেষভাবে যুক্ত থাকে। এইভাবে এই উপরিউক্ত গুণ যুক্ত ছন্দ রশ্মিদের ঋক্ বলা হয়।
2. য়জুঃ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো বিভিন্ন পদার্থের সংযোগে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আকাশ তত্ত্বের (স্পেস) মধ্যে এর প্রাধান্য এবং ব্যাপকতা থাকে। এই ব্রহ্মাণ্ডতে সব ধরণের গতি এই ছন্দ রশ্মির ভিতরেই নিরন্তর হতে থাকে। একই সঙ্গে এই রশ্মি একটানা গতি করতে থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে বাক্ তত্ত্বের অপেক্ষায় মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য থাকে। এই কারণে এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের আধার প্রদান করে।
3. সাম = এই সৃষ্টিতে সব প্রকারের তরঙ্গাণু (কোয়ান্টা) এবং কথিত মধ্যস্থ কণার (মিডিয়েটর পার্টিকলস্) মধ্যে এরই প্রাধান্য থাকে। ব্রহ্মাণ্ডস্থ সম্পূর্ণ প্রকাশ নিরন্তর সাম রশ্মি দিয়ে পূর্ণতঃ ভরা থাকে। এই ছন্দ রশ্মিতে ভেদন ক্ষমতা বিশেষ থাকে। বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিভাষিত ঊর্জাও দ্রব্যের পালন ও রক্ষণ করে।
"ঋক্" সংজ্ঞক সব ছন্দ রশ্মিতে "ভূঃ" ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে এবং অন্য দৈবী ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে। এইভাবে "য়জুঃ" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "ভুবঃ" আর "সাম" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মিতে "স্বঃ" দৈবী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে, অন্য ছন্দ রশ্মিগুলো গৌণ থাকে।
সব প্রকারের ছন্দ রশ্মি, যা মন্ত্রের রূপে বেদ সংহিতার মধ্যে উপলব্ধ আছে এবং সেগুলোর মধ্যে কিছু অনুপলদ্ধও আছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান আছে। এর দ্বারাই সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মিত হয়েছে। এই সব প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি উপরিউক্ত তিন প্রকারভাবে বর্গীকৃত করা হয়।
সাত ছন্দ রশ্মি:-
1. গায়ত্রী = "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো যখন মনস্তত্ত্বকে প্রেরিত করা প্রারম্ভ করে, সেই সময় সর্বপ্রথম যে রশ্মিগুলো (স্পন্দন) উৎপন্ন হয়, তাদের গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বলে। এই রশ্মি তিন প্রকারের গতি যুক্ত হয়। এর গতি অন্য ছন্দের অপেক্ষায় সর্বাধিক হয়। সৃষ্টি রচনার প্রথম চরণের সময়ে সর্বাধিক প্রাধান্য এরই হয়। এই রশ্মি থেকে প্রকাশের উৎপত্তি হয়। পিঙ্গল ছন্দ সূত্রতে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি থেকে উৎপন্ন প্রকাশকে শ্বেত বর্ণের বলা হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মির মুখের সমান হয়। তার মানে হল, যেভাবে মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রেরিত করে, সেইভাবে গায়ত্রী রশ্মি অন্য সব ছন্দ রশ্মিদের প্রেরিত করে। এই রশ্মি সবাইকে বল প্রদান করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
2. উষ্ণিক্ = এই রশ্মিগুলো গায়ত্রী রশ্মিগুলোকে উপর থেকে আবৃত্ত করে, তাদের মধ্যে তথা অন্য ছন্দ রশ্মির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের ভাব সমৃদ্ধ করে। বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির মধ্যে মিশ্রণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলোকে নিজের সঙ্গে ঠিক সেইভাবে জুড়তে সহায়ক হয়, যেভাবে শরীরে গলা, কাঁধ তথা মস্তক জুড়ে থাকে। একইসঙ্গে এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মিগুলো থেকে পরিত্যক্ত অতি সূক্ষ্ম রশ্মিদের একটানা গিলে ফেলতে থাকে, এরদ্বারাই য়জন অর্থাৎ যুক্ত হওয়ার ক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মিকে আচ্ছাদিত করতে ত্বকের সমান গায়ত্রী রশ্মির উপরে লোমের মতো সংযুক্ত থাকে। এটা অন্য রশ্মিদের প্রকাশশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়। এটা অন্য রশ্মিদের তীক্ষ্ণ বানাতে সহায়ক হয়। এই রশ্মিদের প্রভাবে গায়ত্রী রশ্মিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, যারফলে ঊষ্ণতারও বৃদ্ধি হয়। এরদ্বারা ব্রহ্মাণ্ডতে সারঙ্গ অর্থাৎ রঙিন রূপের উৎপত্তি হতে থাকে।
3. অনুষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিগুলোকে অনুকূলতার সঙ্গে ধরে রাখে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অথবা তাদের উপস্থিতিতে সব ছন্দ রশ্মি নিজের-নিজের কাজ সরলতা এবং সক্রিয়তার সঙ্গে করতে পারে। উদাহরণের জন্য যদি কোনো রশ্মি প্রকাশকে উৎপন্ন করতে নিজের ভূমিকা পালন করে, তখন সেই রশ্মিটাই অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়ে সরলতার সঙ্গে আরও অধিক প্রকাশ উৎপন্ন করবে। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মির য়োনি রূপ হয়, এর মানে হল এই ছন্দ রশ্মির মধ্যে সব ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে। একই সঙ্গে অনেক ধরনের ছন্দ রশ্মি অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি থেকেই উৎপন্ন হয়। এদের মধ্যেও "ওম্" রশ্মির মাত্রা অপেক্ষাকৃত অধিক হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মি থেকে নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে। এদের মধ্যে ভেদক ক্ষমতা থাকে। আর এর থেকে লাল মিশ্রিত বাদামী রঙের উৎপত্তি হয়।
4. বৃহতী = এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি, বিভিন্ন কণা বা লোকের নির্মাণের সময় পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত ও সংকুচিত করে নির্মাণাধীন কণা বা লোকের পরিধি নির্মাণে সহায়ক হয়। এটা সেইসব লোক বা কণাকে সর্বদিকে ব্যাপ্ত করে থাকে। এই রশ্মির প্রাধান্য আকাশ তত্ত্বতে থাকে। বিভিন্ন তারা আদি প্রকাশিত লোকের কেন্দ্রীয় ভাগেও এর প্রাচুর্য থাকে। এটা মিশ্রিত হওয়া কণার থেকে নির্মিত নবীন কণাকেও পরিধি রূপে ব্যাপ্ত করে তাকে সংঘনিত করে থাকে। প্রাণ রশ্মিগুলো এই বৃহতী রশ্মির উপস্থেন্দ্রিয়ের সমান কাজ করে। বৃহতীর কারণেই জ্বালার সঙ্গে যুক্ত অগ্নিও উৎপন্ন হয়। এই রশ্মি সবাইকে সীমাবদ্ধ করার কাজ করে। এটা হল কৃষ্ণ বর্ণের।
5. পংক্তি = এই রশ্মিগুলোতে পাঁচ প্রকারের গতি বিদ্যমান থাকে। এরা বিভিন্ন রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের দ্বারা সর্বদা অবশোষিত হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিশেষ সৃজনশীল অর্থাৎ জুড়ে যাওয়ার স্বভাব যুক্ত হয়। এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির মজ্জার সমান কাজ করে, যেভাবে শরীরের মধ্যে বিদ্যমান অস্তিগত মজ্জা সম্পূর্ণ শরীরের রক্তকে জীবন্ত বানিয়ে শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে, ঠিক সেইভাবে পংক্তি ছন্দ রশ্মির বিদ্যমানতায় প্রাণ রশ্মির সামর্থ্য সমৃদ্ধ হয়। এর থেকে নীল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
6. ত্রিষ্টুপ্ = এই ছন্দ রশ্মিগুলো সমস্ত ছন্দ রশ্মি সমূহের নাভিরূপ হয়ে পরস্পর বেঁধে রাখে। এদের কারণে তীক্ষ্ণ বিদ্যুত্ তরঙ্গের উৎপত্তি ও সমৃদ্ধি হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য ছন্দ রশ্মিদের তীব্র তেজ ও বল প্রদান করে। এরা প্রাণ রশ্মির মাংস রূপ হয় অর্থাৎ এদের দ্বারা বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি পূর্ণ বল প্রাপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই রশ্মিগুলো অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে তিন রকমভাবে ধরে রাখে, এইজন্য একে ত্রিষ্টুপ্ বলা হয়। এরা অসুর পদার্থ অর্থাৎ ডার্ক ঊর্জা আদির বাধক প্রভাবকে নষ্ট করতে সক্ষম হয়। আকাশ তত্ত্বের মধ্যে এদের প্রাচুর্য থাকে। এর থেকে লাল বর্ণের উৎপত্তি হয়।
7. জগতী = এই রশ্মিগুলো সর্বাধিক দূর পর্যন্ত গমনকারী হয়। সম্পূর্ণ জগৎ এই রশ্মির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, এই কারণে এদের জগতী বলা হয়। এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন সংযোজক কণা বা তরঙ্গাণুকে (কোয়ান্টা) বেঁধে রাখতে তথা বিভিন্ন কণাকে সংযোগাদি প্রক্রিয়া হেতু সক্ষম করে। ঊর্জা ও ইলেকট্রনের নির্গমন ও অবশোষণের প্রক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই সম্পন্ন হয়। এই রশ্মি সম্পূর্ণ ছন্দ রশ্মি সমূহের মেরুদণ্ডের সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মানে হচ্ছে এই রশ্মিগুলো সম্পূর্ণ প্রাণ রশ্মি সমূহকে কাঠামোগত আধার প্রদান করে, যার উপর সমস্ত ছন্দ রশ্মি নির্ভরশীল থাকে। এর থেকে গৌর বর্ণের উৎপত্তি হয়।
ছন্দ রশ্মির আট বিভাগ:-
1. দৈবী = এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বপ্রথম এই ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয়। "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" আদি মূল ছন্দ রশ্মিগুলোকেই দৈবী ছন্দ রশ্মি বলে। এদের কারণে অব্যক্ত সূক্ষ্মতম জ্যোতি তথা অতি সূক্ষ্ম বলের উৎপত্তি হয়। এরা সর্বত্র ব্যাপ্তবত্ হয়। পূর্বোক্ত সব সাত ছন্দ রশ্মির দৈবী রূপে অক্ষর সংখ্যা নিম্নানুসারে হয় - দৈবী গায়ত্রী-1, দৈবী উষ্ণিক্-2, দৈবী অনুষ্টুপ্-3, দৈবী বৃহতী-4, দৈবী পংক্তি-5, দৈবী ত্রিষ্টুপ্-6 এবং দৈবী জগতী-7 অক্ষর হয়।
2. য়াজুষী = এদের প্রভাবে সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে সূক্ষ্ম ও নিরন্তর গতি ও য়জন ক্রিয়া উৎপন্ন হতে থাকে। এই সময় আকাশ তত্ত্বের উৎপত্তি হতে থাকে। সম্পূর্ণ পদার্থ নিরন্তর কম্পন করতে থাকে।
3. প্রাজাপত্যা = এই ছন্দ রশ্মির উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন রশ্মির সংযোগ-বন্ধন আদির প্রক্রিয়া সমৃদ্ধ হয়ে নবীন রশ্মির উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াও তীব্র হয়। এই রশ্মিগুলো লঘু ছন্দ রূপেই হয় আর তাই এদের মরুত্ বলা হয়, যা ধীরে-ধীরে গতিতে গমন করে।
4. সাম্নী = বিভিন্ন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ, কথিত মিডিয়েটর পার্টিকলস্ আদির উৎপত্তিতে এদের ভূমিকা থাকে। এর প্রভাবে প্রকাশ, ঊষ্মা এবং বিভিন্ন প্রকারের বলের সমৃদ্ধি হতে থাকে।
5. আসুরী = এই রশ্মিদের প্রভাবে অসুর তত্ত্বের (ডার্ক পদার্থ বা ডার্ক এনার্জি) উৎপত্তি হয় অথবা রশ্মিগুলো স্বয়ংই ডার্ক স্বরূপে বিদ্যমান হয়। এই রশ্মিদের পারস্পরিক আকর্ষণ অত্যল্প বা নগণ্য থাকে, অথচ প্রতিকর্ষণ বা প্রক্ষেপক বলের প্রাধান্য এদের মধ্যে থাকে। এদের মধ্যে মনস্তত্ত্ব এবং অপান প্রাণের প্রাধান্যও থাকে।
6. আর্চী= এই রশ্মিদের প্রভাবে বিভিন্ন অপ্রকাশিত পদার্থ অর্থাৎ নানা মূলকণা ও লোকের নির্মাণ হতে থাকে। এই কারণে এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন রশ্মি তথা তরঙ্গাণু আদির সংঘনন ও ভেদনের প্রক্রিয়াকে তীব্র বানিয়ে দেয়।
7. আর্ষী = প্রাণাদি রশ্মি দ্বারা উৎপন্ন অধিকাংশতঃ ছন্দ রশ্মিদের আর্ষী বলা হয়। যখন ব্রহ্মাণ্ডে কস্মিক মেঘ এবং তার থেকে নানা লোকের নির্মাণের প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, সেই সময় আর্ষী ছন্দ রশ্মির প্রাচুর্য বা প্রাধান্য থাকে।
8. ব্রাহ্মী = এই ছন্দ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হলে পরে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির বল ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে।
এই ভাবে এদের মোট আট প্রকারের বিভাগ প্রত্যেক গায়ত্রী আদি ছন্দের হয়। এইভাবে এই পর্যন্ত মোট 56 প্রকারের ছন্দ রশ্মি বর্ণিত হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মিগুলোর মধ্যে অক্ষরের কত সংখ্যা থাকে, সেটা আমরা নিম্নলিখিত তালিকার দ্বারা বুঝতে পারবো -
এই তালিকার মধ্যে আপনি যে সমান অক্ষর সংখ্যার ছন্দ দেখতে পাচ্ছেন, তার কারণ হল অক্ষরের বিন্যাসের মধ্যে ভেদ হওয়া। যেমন আপনি সমভারিক (আইসোবার) সমস্থানিক (আইসোটোপ) তত্ত্বের সম্বন্ধে পড়ে থাকবেন। এই বিষয়টাকে ছন্দ শাস্ত্রের সম্পূর্ণ অধ্যয়ন দ্বারাই বোঝা যেতে পারে।
ছন্দের অন্য উপভেদ
এখন আমরা প্রত্যেক প্রকারের ছন্দ রশ্মির অন্য কিছু ভেদগুলোর চর্চা করবো। উপরিউক্ত প্রকারের ছন্দ রশ্মির পুনঃ অক্ষর ভেদের কারণে নিম্ন প্রকারে ভেদ হয় -
1. সামান্য ছন্দ = যেসব ছন্দ রশ্মির মধ্যে অক্ষরের সংখ্যা পূর্বোক্তানুসারে অর্থাৎ তালিকাতে বর্ণিতানুসারে হয়, তাদের আমরা সামান্য ছন্দ বলতে পারি। এই সবের সামান্য প্রভাব ছন্দের প্রভাবই হবে।
2. ভুরিক্ ছন্দ = এই প্রকারের ছন্দ রশ্মির মধ্যে উপরিউক্ত সামান্য ছন্দের তুলনায় একটা অক্ষর অধিক হয়। এই ছন্দ রশ্মির ধারক ও পোষক ক্ষমতা অন্য প্রকারের ছন্দ রশ্মির তুলনায় বিশেষ হয়। এই রশ্মিগুলো বাহুর সমান হওয়ার কারণে ধারণ, আকর্ষণ, প্রতিরোধ আদি গুণকে অপেক্ষাকৃত অধিক সমৃদ্ধকারী হয়।
3. স্বরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে অক্ষরের সংখ্যা সামান্যের তুলনায় 2টা অধিক হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মি স্বরাট্ -এর রূপ ধারণ করে নেয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্যদের অপেক্ষায় প্রকাশ বা বৈদ্যুত প্রভাবকে উৎপন্ন করতে বিশেষ সক্ষম হয়।
4. বিরাট্ ছন্দ = যখন কোনো ছন্দ রশ্মিতে সামান্যের অপেক্ষায় 2টা সংখ্যা কম হয়, তখন সেই ছন্দ রশ্মিকে বিরাট্ বলে। এর সব অক্ষর বিবিধ প্রকারে প্রকাশিত হতে সক্ষম হয়। এই ছন্দ রশ্মি অন্য ছন্দ রশ্মির প্রতি সংযোগ গুণ দ্বারা বিশেষ রূপে যুক্ত থাকে। এর প্রভাব ক্ষেত্র অতি ব্যাপক হয়।
5. নিচৃত্ ছন্দ = এই রশ্মিগুলো ভেদক ও বন্ধক উভয় প্রকারের বলের সঙ্গে পূর্ণভাবে যুক্ত থাকে। যখন সামান্য ছন্দ রশ্মির থেকে একটা অক্ষর কমে যায়, সেই সময় সেই ছন্দ রশ্মি নিচৃত্ রূপ ধারণ করে নেয় অর্থাৎ সেই সামান্য ছন্দ রশ্মির প্রভাব অধিক তীক্ষ্ণ ভেদক হয়ে যায়।
এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সহস্র প্রকারের ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে। অক্ষরের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে অক্ষর-বিন্যাসের ভেদ দ্বারা ছন্দ রশ্মির স্বরূপ পরিবর্তিত হতে থাকে।
রশ্মির পরিবর্তন
এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন মৃদু এবং তীব্র বল যুক্ত নানা প্রকারের কণা আর বিকিরণ মিলিত হয়ে আর তাদের থেকেও পূর্বে বিভিন্ন প্রাণ আর ছন্দাদি রশ্মি মিলিত হয়ে শেষে তীব্র জ্বালা যুক্ত বিশাল তারা আদি লোকের উৎপন্ন করে। লোক নির্মাণের এই প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন তীব্র ঊর্জাযুক্ত তরঙ্গ যখন নিজের ঊর্জাকে কিছু মাত্রায় হ্রাস করতে থাকে, তখন সেই তরঙ্গগুলোই নিম্ন ঊর্জার অন্য তরঙ্গতে পরিবর্তন হতে থাকে। সেই তরঙ্গ এবং বিভিন্ন প্রকারের কণা নিজের মতো সমান গুণধর্মকারী পদার্থের উৎপন্ন করে। কারণ বিশেষ উপস্থিত হলে পরে বিভিন্ন কণা অন্য কণাতে আর বিকিরণও অন্য বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এইভাবে সৃষ্টিতে ছন্দ রশ্মিও একে অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি সবথেকে অধিক শক্তিশালী হয়। সেটাই ক্ষীণবল হলে পরে গায়ত্রী, জগতী আদি অন্য ছন্দ রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে গায়ত্রী আদি ছন্দ রশ্মিও ত্রিষ্টুপ্ আদি ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে।
একটা ছন্দ রশ্মি দ্বিতীয় একটা ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একটা নবীন তৃতীয় ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন করে। এখানে উদাহরণের জন্য গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি নির্মাণের প্রক্রিয়াতে তিন অক্ষর যুক্ত "শোম্সাবোম্" ছন্দ রশ্মি পাঁচ অক্ষর যুক্ত "শম্সাऽऽমো দৈবোম্" এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আট অক্ষর যুক্ত "প্রাজাপত্যা গায়ত্রী" ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। প্রাজাপত্যা গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি তিন বার সংযুক্ত হয়ে আর্ষী গায়ত্রী ছন্দকে উৎপন্ন করে।
এই সৃষ্টিতে বিভিন্ন নিরাবেশিত (ডিসচার্জ) কণা সূক্ষ্ম এবং সংকুচিত মরুত্ রশ্মির সঙ্গে সংযোগ করে বিদ্যুদাবেশিত কণাতে পরিবর্তিত হতে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা জানা যায় এমন মূলকণা, যা পরস্পর একে-অপরের মধ্যে পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তিত হতে থাকে, এদের পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ার পিছনে এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিই হল উত্তরদায়িনী। এই সংকুচিত মরুত্ রশ্মিদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক "ইলেকট্রন-কোয়ার্ক" আদি কণার দ্বারা সম্বোধিত করে।
সৃষ্টির সমস্ত জড় পদার্থ একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে আর হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূক্ষ্ম রশ্মি অথবা বিকিরণের একে-অন্যের মধ্যে পরিবর্তিত হওয়া সৃষ্টির সামান্য ক্রিয়া নয়, বরং এটা হচ্ছে একটা অসামান্য প্রক্রিয়া, যা হঠাৎই কখনও-কখনও আর কোথাও-কোথাও হয়ে থাকে। সামান্য প্রক্রিয়া এই হচ্ছে যে বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গ নিজেরই স্বরূপকে ধরে রাখে।
এই পর্যন্ত আমরা চেতন তত্ত্বের দ্বারা প্রকৃতি পদার্থ থেকে কাল ও মহত্ তত্ত্ব থেকে শুরু করে প্রাণ ও ছন্দাদি নানা সূক্ষ্ম রশ্মির উৎপত্তি ও স্বরূপের সম্বন্ধে জেনেছি, এখন অগ্রিম পদার্থের উৎপত্তি ও স্বরূপের বর্ণনা করা হবে। বর্তমান বিজ্ঞান কাল বা আকাশের স্বরূপ বা উৎপত্তি বিজ্ঞানের বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ। এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞানের কাছে মূলকণা ও তরঙ্গাণুর উৎপত্তি ও গঠন হচ্ছে অজ্ঞাত। এমনকি আমরা যে সৃষ্টি বিজ্ঞানের মধ্যে যে যে বিষয়ের উপর চর্চা করলাম, সেই সব বিষয়ে বর্তমান ভৌতিকীর কোনো কল্পনাই নেই আর এই জ্ঞান ছাড়া সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীর বিকাশ যাত্রা সম্মুখে এগোতে পাচ্ছে না, তারমধ্যে একটা বিরাম এসে গেছে, এই বিষয়টা বৈজ্ঞানিকরা স্বয়ং অনুভব করছে যে আগে যাওয়ার জন্য তারা মার্গ খুঁজে পাচ্ছে না।
রশ্মি এবং তাদের গুণ
বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের অনুসারে বর্তমান ভৌতিকী দ্বারা কথিত সব মূল কণা এবং বিভিন্ন তরঙ্গাণুর উৎপত্তি বৈদিক মন্ত্রের সংঘনন থেকে হয়। এই মন্ত্র এখনও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাণীর পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান আছে। যদি কখনও এরকম কোনো টেকনিক বিকশিত হয়, যা দিয়ে পশ্যন্তী ধ্বনিকে শোনা যেতে পারে, তাহলে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেক স্থানে বেদের সস্বর মন্ত্র শুনতে পারবো। ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি একাকী না থেকে সমূহতে থাকে। যখন সেই রশ্মির সমূহ পৃথক-পৃথক বিচরণ করে স্বতন্ত্র থাকে, তখন সেটা আকাশের রূপ হয়। যখন সেই রশ্মির সমূহ কিছু ছন্দ রশ্মির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে অতি সঘন রূপ প্রাপ্ত করে, তখন সেই সমূহই বিভিন্ন প্রকারের মূলকণার রূপ ধারণ করে নেয়। যখন সেই রশ্মিসমূহ এই দুইয়ের মধ্য অবস্থাকে প্রাপ্ত করে, তখন সেটাই বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টার) নির্মাণ করে। এই অধ্যায়ে আমরা এই রশ্মির বর্গীকরণ আর তাদের গুণকে বোঝার চেষ্টা করবো। পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে বোঝার জন্য আমাদের এই রশ্মির গুণগুলোকে বুঝে নেওয়া অতি আবশ্যক।
অক্ষর রশ্মি
সব ধরনের রশ্মি সূক্ষ্ম অক্ষর রূপ অবয়ব দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে আমরা সর্বপ্রথম অক্ষর রূপ পদার্থের উপর বিচার করবো।
মহত্ তত্ত্ব এই অক্ষরের কম্পনের রূপেই হয়। কালের উৎপত্তির সময়েই সাম্যাবস্থার মধ্যে অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে উৎপন্ন হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়। এই রশ্মি পূর্ণতভাবে কখনও অবিদ্যামান হয় না, সেটা মহাপ্রলয়াবস্থাই হোক না কেন। এই রশ্মিগুলো ছন্দ রূপ ধারণ তখনই করে, যখন সেগুলো শব্দের রূপ ধারণ করে নেয়। একে এইভাবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, যেরকম কম্পিউটারের স্ক্রিনে অক্ষর অব্যক্ত হয় আর যখন আমরা কিবোর্ডে বটন চাপ দেই, সেটা আমাদের সমক্ষ ব্যক্ত হয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে মহাপ্রলয় অবস্থাতে অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" রশ্মির সঞ্চরণ দ্বারা ব্যক্ত হয়ে যায়। অক্ষর রশ্মি দুই প্রকারের হয় -
1. স্বর = মনস্তত্ত্বের ভিতরে এটা অত্যন্ত লঘু কম্পনের রূপে (যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম হয়) বিদ্যমান থাকে। এই লঘু রশ্মি স্বয়ং প্রকাশিত হয় অর্থাৎ এদের ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য ব্যঞ্জনের আবশ্যকতা হয় না, কিন্তু এটা নিরন্তর লম্বা দূরত্ব পর্যন্ত গতিমান থাকতে পারে না।
2. ব্যঞ্জন = এই অব্যক্ত সূক্ষ্মতম অবয়বও মহত্তত্ত্বেরই রূপ হয়, যা সর্বদা স্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গতিশীল হতে পারে। মহত্ বা অহংকারের মধ্যে অকস্মাৎ সূক্ষ্মতম স্ফোট রূপে উৎপন্ন ব্যঞ্জন, যা এক স্থানে উৎপন্ন হয়ে রয়ে যায়। সেটা কোনো স্বর রূপী সূক্ষ্ম কম্পনের সঙ্গে মিলিত হলে পরে গতি, বল ও প্রকাশের অব্যক্ত রূপের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটা স্বরের সঙ্গে মিলে সূক্ষ্ম ছন্দের রূপ ধারণ করে নেয়। "ওম্", "ভূঃ" আদি ছন্দ রশ্মি হল এর উদাহরণ ।
[যেরকম মোতি দিয়ে মালা তৈরি হয়, ঠিক সেইভাবে অক্ষর ও ব্যঞ্জন রশ্মির সঙ্গে মিলে বড়ো ছন্দ রশ্মি (ঋচা/মন্ত্র) তৈরি হয়।]
ওম্ (অ+উ+ম্)
এরমধ্যে "অ", "উ" দুটি স্বর তথা "ম্" ব্যঞ্জনের যোগ হয়। যদিও "ম্" ব্যঞ্জন "অ" এবং "উ" এই দুটি স্বরের সঙ্গে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে "ম" তথা "অম্" এবং "মু" তথা "উম্" ছন্দের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু "অ+উ"= "ও"-এর সঙ্গে "ম্" সংগত হয়ে যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেটা সর্বাধিক ব্যাপক বল ও গতির দ্বারা সম্পন্ন হয়। "ওম্" ছন্দের মধ্যে মনস্ তত্ত্ব বা মহত্ তত্ত্বের মাত্রা অন্য যেকোনো দৈবী গায়ত্রী ছন্দের তুলনায় অধিক হওয়ায় এর ব্যাপকতা সর্বাধিক হয়।
এটা হল অন্য সব রশ্মির বীজ রূপ। সব প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মি এর দ্বারাই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়।
এই রশ্মি মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করে।
এই রশ্মিই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করে, আবার বেঁধেও রাখে। মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটা পশ্যন্তী অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, অথচ মহত্ বা কালের মধ্যে পরা অবস্থায়।
মহত্ বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন এটা এক এরকম স্পন্দন, যা এতই সূক্ষ্ম হয়, যেন সেটা স্পন্দনই হয় না অথবা একে এরকম তরঙ্গ বলা যেতে পারে, যার তরঙ্গদৈর্ধ্য প্রায় অনন্ত হবে, তখন আবৃত্তি প্রায় শূন্য হবে। বাস্তবিকতা এই হচ্ছে যে একে অভিব্যক্ত করাই অসম্ভব। এইভাবে বিজ্ঞানের ভাষায় একে অত্যন্ত ক্ষীণ শক্তিসম্পন্ন অব্যক্ত সূক্ষ্মতম এবং সর্বপ্রথম উৎপন্ন ঊর্জার রূপ বলা যেতে পারে।
ধ্যাতব্য হল, সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। উদাহরণ, যেভাবে মস্তিষ্ক বল দ্বারা শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তার থেকে স্থূল বল উৎপন্ন করে দেয়।
প্রাণ ও ছন্দ তত্ত্ব
যখন "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা অর্থাৎ ঊর্জা বেড়ে যায়, সেই সময় চেতন তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যা সর্বত্র একরসবত্ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মির দ্বারা এরকম স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরের মধ্যে এক সঙ্গে তীব্রতে অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ঢেউ উৎপন্ন করছে, সেইভাবে চেতন তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী ঢেউ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে©। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই ঢেউ (রশ্মি) মুখ্যতঃ চার প্রকারের হয় -
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
(স) মাস ও ঋতু রশ্মি
(দ) অন্য ছন্দ ও মরুত্ রশ্মি।
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
অক্ষর রশ্মির উৎপত্তির পরে নিম্নলিখিত প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -
ব্যাহৃতি রশ্মি
যে রশ্মি বিশেষ রূপে নিজের চারিদিকে অন্য রশ্মিদের আকর্ষিত করে অথবা তাদের বহন করে, তাকে ব্যাহৃতি রশ্মি বলে।
প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির মধ্যে সর্বপ্রথম সাত ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি মনস্তত্ত্ব থেকে নিম্নলিখিত ক্রমে হয় -
1. ভূঃ = "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের উৎপত্তির পশ্চাৎ অতি শীঘ্রই এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মিরই উৎপত্তি হয়। যখন কখনও ঋক্® সঞ্জক রশ্মি, পৃথিবী তত্ত্ব বা অপ্রকাশিত কণার উৎপত্তি হয়, তারমধ্যে এই রশ্মির প্রাধান্য থাকে। এই রশ্মি নানা রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে সক্ষম হয় তথা বাধক সূক্ষ্ম রশ্মিদের নিষিদ্ধ করে ক্রিয়াগুলোকে নির্বাধ বানায়।
2. ভুবঃ = মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভূঃ" রূপ স্পন্দনগুলোকে "ওম্" রশ্মি বিকৃত করে "ভুবঃ" রশ্মিদের উৎপন্ন করে। কালান্তরে এই রশ্মি আকাশ তথা "য়জুঃ" নামক সঞ্জক রশ্মিদের উৎপন্ন করতে সর্বোপরি ভুমিকা পালন করা।
3. স্বঃ = "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বের মধ্যে "স্বঃ" রশ্মি রূপ স্পন্দন উৎপন্ন হয়। কালান্তরে সাম রশ্মি এবং প্রকাশাণুর (ফোটন) নির্মাণের মধ্যে এই রশ্মির ভারী ভূমিকা থাকে।
4. মহঃ= এই সূক্ষ্ম রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পরস্পর সংযুক্ত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
5. জনঃ= এই রশ্মি অন্য রশ্মিদের মধ্যে সর্বতঃ উৎপন্ন হয়ে তাদের সঙ্গত করে অন্য ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এই রশ্মি বাধক রশ্মিকে প্রতিবন্ধিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
6. তপঃ= এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিদের পৃষ্ঠ ভাগ অথবা কিনারায় অবস্থিত হয়ে তাদের বহির্ভাগে ব্যাপ্ত বা সঙ্গত হয়ে তাদের রক্ষা করে।
7. সত্যম্ = এই রশ্মি সব রশ্মির সঙ্গে সঙ্গত ও পূর্ণ ব্যাপ্ত হয়ে তাদের আধার প্রদান করে তাদের বহির্ভাগে অবস্থিত থাকে।
মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল ব্যাহৃতি রশ্মি বিভিন্ন বেদ-ঋচা রূপী ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে দিতে ও সুরক্ষিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই রশ্মির অবিদ্যমানতায় বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি আর তারথেকে নির্মিত বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা আকাশ আদি সবই নির্বল বা নষ্ট হয়ে যাবে।
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
উপরিউক্ত সূক্ষ্ম রশ্মির পশ্চাৎ প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এর বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ সতত গমন করতে থাকে। সব প্রাণ রশ্মি অক্ষরের সমুদায় হয়। প্রাণ তত্ত্ব দড়ির সমান নিয়ন্ত্রণকারী হয়, এটা মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির মিলন দ্বারাই উৎপন্ন হয়। প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে একটাই, কিন্তু তার নানা প্রকারের গতির কারণে নানা ভেদ হয়ে যায়। মহর্ষি ব্যাস বলেছেন সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ সাত প্রকারের (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়) হয়। এটা হল মুখ্য প্রাণ। বস্তুতঃ এই রশ্মি এগারো প্রকারের হয়। মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন স্পন্দনের তীব্রতা, গতি এবং স্বভাব আদির ভেদ হতে একটা প্রাণ তত্ত্বেরই এগারোটা রূপ হয়। চলুন, এই রশ্মিগুলোর গুণ সংক্ষেপে জেনে নিই -
1. সূত্রাত্মা বায়ু = সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মিকে পরস্পর সঙ্গত করার বিশেষ গুণ যুক্ত হয়। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলোই। মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এটা এরকম অব্যক্ত স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়, যা পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জালের সমান বোনা থাকে। এই রশ্মিগুলো এই রকম উৎপন্ন হয় যে প্রত্যেক রশ্মির মধ্যে থেকে আরও সূক্ষ্ম রশ্মি উৎসর্জিত হয়ে একটা জাল বানায়, এই কারণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি নিজের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রূপ সূক্ষ্ম রশ্মির (স্পন্দনের) দ্বারাই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের সঙ্গে তথা পরস্পর বেঁধে রাখে।
সূত্রাত্মা বায়ুকে একটা সুতোর সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে, যা সব কণা বা রশ্মিকে একে-অন্যের সঙ্গে বোনা থাকে। যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির ধনঞ্জয় রশ্মির সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির মধ্যে প্রতিকর্ষণ একদম হয় না।
2. ধনঞ্জয় = এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক তীব্র গতির স্পন্দনের রূপে উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মির গতি প্রকাশের গতির অপেক্ষায় চার গুণ অধিক হয়। যদি প্রকাশের গতি তিন লক্ষ গুণ কিমি প্রতি সেকেণ্ড ধরা হয়, তাহলে ধনঞ্জয় রশ্মির গতি প্রায় বারো লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড হবে। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এরথেকে অধিক গতি কোনো পদার্থের মধ্যে হয় না। এখানে আপনার মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের অনুসারে তো প্রকাশের থেকে বেশি গতি অন্য কারও হতে পারে না, তাহলে ধনঞ্জয় প্রাণের এত গতি কিভাবে হতে পারে? এটা কি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হচ্ছে না? এর উত্তরটা হল এই রকম যে, সেখানে প্রকাশের গতি আকাশের মধ্যে করা হয়েছে অর্থাৎ আকাশের মধ্যে যেকোনো বস্তুর গতি প্রকাশের থেকে অধিক হবে না। অন্যদিকে ধনঞ্জয় রশ্মি হচ্ছে আকাশের থেকে সূক্ষ্ম, এইজন্য তাকে গতি করার জন্য আকাশের আবশ্যকতা হয় না, সেটা তো মনস্তত্ত্বের মধ্যে গতি করে। এইভাবে এই রশ্মি রিলেটিভিটি সিদ্ধান্তের বিরোধ করে না।
এই রশ্মির সংযোগ বা আচ্ছাদন দ্বারা যেকোনো রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের গতি তীব্র হয়ে যায়। প্রকাশ বা যেকোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এই ধনঞ্জয় রশ্মির দ্বারাই টেনে নিয়ে আসা হয়, এই কারণে তার গতি ও শক্তি তীব্র হয়। এই রশ্মি যেরকম বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং তীব্রগামী সূক্ষ্ম কণার গতির কারণ হয়, সেইরকম সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে মিলে কণার অক্ষের উপর ঘূর্ণনেরও কারণ হয়।
3. প্রাণ = সব প্রাথমিক প্রাণের মধ্যে এই প্রাণ রশ্মির স্থান সর্বোচ্চ মানা হয়, এর নাম দিয়েই সব প্রকারের প্রাণ রশ্মিদের গ্রহণ করা হয়। যখন মনস্ তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মিগুলো তীব্র বেগ ও বলের সঙ্গে গমন করে, তখন এরথেকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন রূপে উৎপন্ন রশ্মিদের "প্রাণ" বলা হয়। এরমধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য থাকে। এটা সবার আকর্ষক হয়ে সবাইকে আকর্ষণ বলের সঙ্গে যুক্ত করে সেই কণা বা তরঙ্গের মধ্যে ভিতর থেকে বাইরে নিরন্তর সঞ্চারিত হতে থাকে। এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানেই আকর্ষণ বলের শক্তি আছে, সেখানে এই বলের মূল কারণ রূপ এই তত্ত্বের শক্তি অবশ্যই বিদ্যমান আছে। মহর্ষি ব্যাস -এর প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে কথন হল -
"প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্র০ সূ০ 1.3.39)
এর দ্বারা স্পষ্ট হচ্ছে যে, প্রাণ সূক্ষ্ম স্পন্দনের হয়। ধ্যান রাখবেন যে, এই পরিভাষা কেবল এই প্রাণ রশ্মির জন্য নয় বরং সব প্রাণ রশ্মিগুলো জন্য।
4. অপান= এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতর "ওম্" রশ্মির দ্বারা এইরকম স্পন্দন, যার গতি প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণের অপেক্ষায় ঠিক বিপরীত তথা যা বিভিন্ন স্পন্দনকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রাণ ও অপান উভয় রশ্মি যৌথভাবে থাকার পরেও পরস্পর বিপরীত দিশাতে স্পন্দিত হতে থাকে, এই কারণে অপান রশ্মি প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করার মূল কারণ হয়। প্রাণ রশ্মির প্রতি এই রশ্মির আকর্ষণ ভাব থাকে।
প্রাণ রশ্মি সত্বপ্রধান এবং অপান রশ্মি রজস্ প্রধান হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান রশ্মি ক্রমশঃ বল ও ক্রিয়া প্রধান হয়। বস্তুতঃ এই উভয় প্রকারের রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত থাকে। কোথাও এর পৃথক্পন দেখা যায় না। এর সংযুক্ত স্বভাবের দ্বারা প্রত্যেক পদার্থের বল এবং ক্রিয়া দুটোই সম্পন্ন হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে প্রাণের প্রাধান্য তথা অপান গৌণ রূপে বিদ্যমান হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য কিন্তু ক্রিয়াশীলতা গৌণ হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে অপানের প্রাধান্য এবং প্রাণ গৌণ হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে ক্রিয়াশীলতা প্রধান তথা বলের ন্যূনতা হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত বল আকর্ষণ এবং প্রতিকর্ষণ দুই রূপেই বিদ্যমান হয়, কিন্তু গুরুত্বাকর্ষণ বল প্রায়শঃ আকর্ষণেরই প্রভাব রাখে। এর কারণ হল এই বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মির প্রাধান্য তথা অপানের অপ্রাধান্য হওয়া। এইদিকে ক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিতে বিচার করলে পরে, তাহলে যে পদার্থের মধ্যে যত অধিক গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা দ্রব্যমান হবে,সেটা ততই কম সক্রিয় হবে। এই দৃষ্টিতে এখানে অপান প্রাণের ন্যূনতা বা অবিদ্যমানতা সিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে গুরুত্ব বল রশ্মির মধ্যে কেবল আকর্ষণ বলই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সেই রশ্মির ক্রিয়াশীলতা খুবই কম হয়, এই কারণে এটা অত্যন্ত কম আবৃত্তির হয় অর্থাৎ নির্বল হয়।
প্রশ্ন - যখন প্রাণ এবং অপান উভয় যুগ্মেরই রূপে থাকে তখন এরমধ্যে কারও প্রাধান্য ও কারও অপ্রাধান্যতা কিভাবে বলা যেতে পারে?
উত্তর - যুগ্মের মধ্যেও একটা অধিক বলবান্ হতে পারে আর যেটা বলবান্ হয়, তারই প্রাধান্য মানা হয়। যেরকম কিছু প্রাণীর মধ্যে নর প্রধান হয়, আবার কিছুর মধ্যে মাদা।
5. ব্যান = এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এই ভাবে উৎপন্ন হয় যে প্রাণ ও অপানের মাঝে সন্ধির কার্য করতে পারে। ব্যান রশ্মি ছাড়া প্রাণ ও অপান সঙ্গে-সঙ্গে সঙ্গত থাকতে পারবে না। ব্যান রশ্মি না কেবল প্রাণ ও অপানকে বেঁধে রাখে, অপিতু অন্য রশ্মি ও কণা আদি পদার্থকে বাঁধতে প্রাণ ও অপান রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে প্রকাশিত কণাকে অপ্রকাশিত কণার অপেক্ষায় অতি ন্যূন সঘনতা প্রদান করে। যখন "ওম্" রূপী অক্ষর রশ্মি দুই বার আবৃত্ত হয়ে পুনঃ পরস্পর সংযুক্ত হয়, তখন ব্যান নামক প্রাথমিক প্রাণকে উৎপন্ন করে।
6. সমান = যখন "ওম্" রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে সম গতি ও বলের সঙ্গে স্পন্দন উৎপন্ন করে, তখন সেই সময় সমান নামক প্রাণ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এই প্রাণ রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির বল ও গতিকে সুষম বানিয়ে রাখে, বিশেষ করে প্রাণ ও অপান নামক প্রাণ রশ্মিদের সুষম বানিয়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই রশ্মি সমান লয়ের সঙ্গে নিরন্তর গমন করতে থাকে।
7. উদান = যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির স্পন্দন এই ধরনের হয় যে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণের প্রাদূর্ভাব হতে থাকে, সেই সময় উৎপন্ন স্পন্দন ঊর্ধ্ব গমনকারী হয়। এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের মধ্যে একটা আকর্ষণ উৎপন্ন করার সঙ্গে গতি করে, এরদ্বারা উৎপন্ন উদান নামক স্পন্দন ঊর্ধ্বগমন যুক্ত হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মির মধ্যে উৎক্ষেপণ গুণ ( অর্থাৎ কোনো বলের বিরুদ্ধে বল লাগানো। যেমন, ঘর্ষণ বল লাগানো বলের বিরূদ্ধে কার্য করে) উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়। উদান রশ্মি নিয়মিত, নিয়ন্ত্রিত লয়ের সঙ্গে গতি করে আর ব্যাপক স্তরে এক প্রকারের দীপ্তিকে উৎপন্ন করে।
8. নাগ = এটা হচ্ছে প্রাণ নামক প্রাণ তত্ত্বের উপপ্রাণ, যা প্রাণ নামক রশ্মির ক্ষুব্ধ ও অব্যবস্থিত হলে পরে তাদের নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। নাগ প্রাণ রশ্মির প্রাধান্যের মধ্যেই ঊষ্মার উৎপত্তি ও বৃদ্ধি হয়। এর স্পন্দন অতি সূক্ষ্ম ও ক্ষীণ হয়, যা অন্য প্রাণ রশ্মির সাপেক্ষে স্থিরের মতো মানা যেতে পারে।
9. কূর্ম = এই রশ্মি হল অপান প্রাণের উপপ্রাণ, যা অপান রশ্মিদের বল ও প্রেরণ প্রদান করে। আমরা জানি যে, অপান প্রাণ রশ্মিগুলোর প্রতিকর্ষণ বল প্রধান হয়, তবুও ব্যান রশ্মির মাধ্যম দ্বারা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই কূর্ম উপপ্রাণ সংযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে কচ্ছপের মতো অপান রশ্মিদের কেন্দ্রীভূত করতে সক্ষম হয়। যেভাবে মস্তক সম্পূর্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেইভাবে কূর্ম রশ্মি প্রাণ ও অপানের মাঝে নিয়ন্ত্রণ বানিয়ে রাখতে নিজের ভূমিকা পালন করে।
10. কৃকল = এই প্রাণ তত্ত্ব হচ্ছে উদান প্রাণের উপপ্রাণ। ভেদন ক্ষমতা বা তীব্রতাকে প্রদান বা প্রাপ্তকারী প্রাণ তত্ত্বকেই কৃকল বলা হয়। যখন উদান রশ্মির উৎক্ষেপণ বলের মধ্যে কোনো বাঁধা আসে, তখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা কৃকল প্রাণ রশ্মি রূপ স্পন্দন অকস্মাৎ উৎপন্ন হয়ে উদান রশ্মিদের ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে বল প্রদান করে তার উৎক্ষেপণ বলকে সক্রিয় বা নির্বাধ করে দেয়।
11. দেবদত্ত = এটা হচ্ছে সমান প্রাণের উপপ্রাণ। এটা বিদিতই যে, সমান প্রাণ রশ্মিগুলো, প্রাণ তথা অপান রশ্মিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। এই রশ্মি সমান প্রাণের সঙ্গে সমলয় দ্বারা স্পন্দিত হয়ে প্রাণ ও অপানের লয় বানিয়ে রাখে।
জ্ঞাতব্য = বিভিন্ন উপপ্রাণ রশ্মির (স্পন্দনের) গতির দিশা নিজের-নিজের প্রাণ রশ্মির গতির দিশা থেকে বিপরীত হয়, আবার এটার স্পন্দন সম্বন্ধিত প্রাণ রশ্মির স্পন্দনের থেকে সূক্ষ্ম হয়, যা এর নিকট নিরন্তর উৎপন্ন হতে থাকে।
____________________________________________
© "ওম্" ছন্দ রশ্মির সঙ্গত না হলে সমস্ত প্রাণ রশ্মি ডার্ক এনার্জির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
স) মাস ও ঋতু রশ্মি
মাস রশ্মি
মাস হল বিশেষ প্রকারের রশ্মির নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিরিশ বার স্পন্দিত হওয়াতে নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে। (মনে রাখবেন যে, এর মানে এই নয় যে একটা মাস রশ্মির ভিতরে তিরিশ প্রাণ ও তিরিশ অপান হয়ে সব মিলিয়ে ষাট রশ্মি যথাযথ বিদ্যমান হয়, বরং বাস্তবিকতা এই হল যে এই ষাট রশ্মির স্পন্দনের ফলস্বরূপ একটা মাস রশ্মি রূপী স্পন্দন হয়, যা সেই স্পন্দনের থেকে সর্বথা ভিন্ন হয় অথবা সেই ষাট স্পন্দনই একটা নবীন স্পন্দনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়, অনেক রশ্মির মিলিত হওয়ায় কোথাও-কোনো রশ্মির উৎপত্তির চর্চা যেখানে হবে, সেখানে এইভাবেই বুঝে নেওয়া উচিত।) এই যুগ্মের বারো প্রকাশ দ্বারা বিশিষ্ঠ সংযোগের কারণেই তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থেকে বারো মাস রশ্মির নির্মাণ হয়। যদি এরকম না হতো, তাহলে কেবল এক প্রকারেরই মাস রশ্মি উৎপন্ন হতে পারতো। এই মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিকে জুড়ে রাখার কাজ করে।
এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিদের যারা য়োষা ও বৃষা রূপে ব্যবহার করে, তাদের নিশ্চিত বিন্দু রূপ ভাগগুলোকে উত্তেজিত করে পরস্পর সংযোগ করাতে সহায়ক হয়। বারো প্রকারের মাস রশ্মি হচ্ছে নিম্নানুসারে -
1. মধু
2. মাধব
3. শুক্র
4. শুচি
5. নভস্
6. নভস্য
7. ঈষ্
8. ঊর্জ্
9. সহস্
10. সহস্য
11. তপস্
12. তপস্য
ঋতু রশ্মি
ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মির যুগ্মকে ঋতু বলা হয়। ঋতু রশ্মি দিশাকে উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণা ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগ পাওয়া যায়। উৎপন্ন সব পদার্থকেও "ঋতু" বলে, কারণ তারা সবাই সর্বদা নিরন্তর গমন করতে থাকে।
ঋতু রশ্মি প্রকাশ নির্মাণ করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা ঊষ্মার তীব্রতা বৃদ্ধি হয়। এই রশ্মি কণা ও তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) পরস্পর সংযোজন-বিয়োজনের মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মতো স্থানগুলোতে ঊর্জার উৎপত্তি হয়, এই রশ্মির প্রাধান্য সেখানেও থাকে। তারার বাইরের বিশাল ভাগের মধ্যেও ঋতু রশ্মির বিশেষ প্রাধান্য থাকে। ঋতু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণাদি রশ্মিকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে, এই কারণে যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা সেই পদার্থ ঊষ্মাকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে। এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে অথবা তাদের আচ্ছাদিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।
ছয় ঋতু রশ্মি হচ্ছে এই রকম -
1. বসন্ত (মধু + মাধব)
2. গ্রীষ্ম (শুক্র + শুচি)
3. বর্ষা (নভস্ + নভস্য)
4. শরদ্ (ঈষ্ + ঊর্জ্)
5. হেমন্ত (সহস্ + সহস্য)
6. শিশির (তপস্ + তপস্য)
(দ) অন্য ছন্দ রশ্মি
কাল মাপি রশ্মি
কাল তত্ত্ব হচ্ছে এরকম এক পদার্থ, যারমধ্যে তমোগুণের অভাব থাকে। কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ কাল মাপক প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মিগুলোই হল এরকম রশ্মি যাদের মধ্যে তমোগুণের মাত্রা সর্বথা অভাব তো থাকে না, কিন্তু এর মাত্রা এতই ন্যূন থাকে যে এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়। এই কাল তত্ত্বের সমান তো সতত ও নিরপেক্ষ গমনকারী হয় না, কিন্তু অন্য রশ্মির অপেক্ষায় এর এটাই স্বভাব হয়। এখন আমরা এটা বিচার করবো যে এই কাল মাপক কিভাবে মানা হয়েছে? আসুন, জেনে নিই -
1. প্রাণ = যত অন্তরালের মধ্যে একটা প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির স্পন্দন হয়, সেটা অন্তরাল এক প্রাণ বা অহন্ বলে। এই রশ্মি অক্ষর দ্বারা নির্মিত হয়। এরমধ্যে প্রত্যেকটা অক্ষর এক-এক করে স্পন্দিত হয়। সব ছয় স্পন্দনের একটা সংযুক্ত স্পন্দনকে প্রাণ রশ্মি (অহন্) বলা হয়। প্রাণ ঋতু রশ্মির ("ভূঃ", "ভুবঃ", "সুবঃ", তথা "ওম্") ছয় সূক্ষ্ম স্পন্দন দ্বারা মিলিত হয়ে নির্মিত হয়েছে। "ষঙ্ঋতুনা" দৈবী পংক্তি ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে ছয়টা ঋতু রশ্মিকে সঙ্গত করে প্রাণ তত্ত্বকে উৎপন্ন করে।
যেভাবে বর্তমান ভৌতিকবিদ্ সীজিয়ম-133 অ্যাটমের সংক্রমণের (transition) 9,19,26,31,770 আবৃত্তির সময়কে 1 সেকেণ্ড বলে। এরজন্য কেউ এটা বলতে পারবে না যে সেকেণ্ডই হচ্ছে সময়। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে সময়কে মাপার একটা বিধি। আকাশকে মাপার সাধন হল মিটার, কিলোমিটার আদি, ঠিক সেইরকম প্রাণ, অপান আদি যেখানে পদার্থ (রশ্মি) বিশেষ হয়, সেখানে এই পদ কালের মাপকও হয়©।
2. অপান = যত সময়ে একটা অপান রশ্মি একবার স্পন্দিত হয়, সেই সময়কে অপান বলা হয়। এই রশ্মি ষোলো ঋতুর অর্থাৎ চার-চারটা ঋতুর চার আবৃত্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয়। এখানে চিত্রানুসারে প্রত্যেক ব্যাহৃতি ঋতু রশ্মিই মানা হয়েছে।
যদি পূর্ববত্ এক অক্ষরকে এক ঋতু রশ্মি ধরা হয়, তাহলে "সুবঃ"-কে ছেড়ে দিয়ে অন্য তিন রশ্মির চার আবৃত্তির থেকে ষোলো অক্ষর মিলে অপান রশ্মিকে উৎপন্ন করে।
ঋষি রশ্মি
অনেক প্রাণ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে। এই ঋষি রশ্মিগুলো অনেক প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন, ধারণ আর সক্রিয় করে। তারদ্বারা উৎপন্ন মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি, সৃষ্টির মধ্যে যারাই কাজ করছে, তাদের মধ্যে এই ঋষি রশ্মিরও সহযোগী ভূমিকা থাকে।
রশ্মির সংযোগ প্রক্রিয়া
বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর অস্পষ্ট সুতোর টুকরোর সমান আকৃতির হয়, যার দুই মাথা পৃথক-পৃথক গুণের হয়। যেভাবে চুম্বকের দুই মাথা বিপরীত গুণের হয় আর সামনে নিয়ে আসলে একে-অপরকে আকর্ষিত করে। ঠিক সেইভাবে রশ্মির মাথাগুলো পরস্পরের মধ্যে আকর্ষিত হয়ে সংযুক্ত হয়ে যায়।
এই অগ্রভাগগুলো একে-অপরের সঙ্গে রসির মাথার মতো জুড়ে থাকে। এগুলোর সংযুক্ত মাথার মাঝখানে সূক্ষ্ম দৈবী গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি সতত সঞ্চারিত হতে থাকে। বিভিন্ন প্রাণ রশ্মির এই দুই মাথাই বিভিন্ন বল আর ক্রিয়ার কেন্দ্র ও কারণ হয়। সেই ক্রিয়া আর বলের নিয়মন আর সঞ্চালন সূক্ষ্ম বাক্ রশ্মির সহযোগ দ্বারা এই মাথাগুলোই করে। এই সূক্ষ্ম রশ্মিগুলো অব্যক্ত রূপে এই মাথাগুলোর মাঝে সতত সঞ্চারিত হতে থাকে আর অন্ততঃ সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাণ এই মূল সিদ্ধান্তের আধারেই হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সুতোর সমান গঠনের তাৎপর্য এই নয় যে সেটা শক্ত মনে করা যাবে। বস্তুতঃ এটা হচ্ছে মনস্তত্ত্বের মধ্যে সূক্ষ্ম স্পন্দনেরই রূপ, যেরকম জলের মধ্যে ঢেউ। যেভাবে জলের ঢেউ জুড়ে যায় সেইভাবে এদের মাথাগুলো জুড়ে যায় মনে করা উচিত।
রশ্মির সংখ্যা সীমিত নাকি অসীমিত
যদিও এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ছন্দ রশ্মি স্বরূপের দৃষ্টিতে অনেক সীমিত সংখ্যাতেই বিদ্যমান আছে, কিন্তু বারংবার আবৃত্তি হওয়ার কারণে তাদের সংখ্যা এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসীমিত। যেভাবে কোনো গিটার বা বীণার মধ্যে কেবল কয়েকটা তারই থাকে, কিন্তু তাতে উৎপন্ন হওয়া কম্পনের বারংবার আবৃত্তিতে অসংখ্য স্বর উৎপন্ন হতে পারে। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মূল কণার সংখ্যাও স্বরূপের দৃষ্টিতে পরিমিতই আছে, কিন্তু সেটা মোট সংখ্যার দৃষ্টিতে অসংখ্যই হয়। এই জন্য এইভাবে বিভিন্ন লোকের রূপে বিদ্যমান মূল কণার মাত্রা মহাকাশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মূল কণার অপেক্ষায় ন্যূনই হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সীমিত প্রকারের মূলকণা আর অ্যাটমস্, অসীমিত প্রকারের অণুগুলোকে উৎপন্ন করে। এরমধ্যেও সেই কণা আর অ্যাটমের মিশ্রণের মাত্রা আর আবৃত্তিরই ভেদ আছে।
প্রাণ নামক প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্বকে উৎপন্ন করতে সহায়ক হয়, আর সেটা ঊষ্মার উৎপত্তিতেও বিশেষ যোগদান করে। এইসব রশ্মির ব্যবস্থাপনের আধারের উপরেই বিভিন্ন কণার আয়ু নির্ধারিত হয়। যেকোনো ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা এই সূক্ষ্ম প্রাণ রশ্মি কখনও ব্যক্তরূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে না কিন্তু যখন সেটা ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক আদির রূপে উৎপন্ন হয়, তখনই সেটা ভৌতিক টেকনিকের দ্বারা অভিব্যক্ত হতে পারে। এই ল্যাপ্টন, কোয়ার্ক পদার্থ হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণ এবং ছন্দাদি রশ্মির ভাণ্ডার। যদিও প্রাণ বা ছন্দাদি রশ্মির সব ক্রিয়া বা বল ভৌতিক টেকনিক দ্বারা অব্যক্তই হয়, তবুও সেটা ব্যক্ত বলের বা ক্রিয়ার মধ্যে নিজের অব্যক্ত এবং অনিবার্য ভূমিকার সঙ্গে বিদ্যমান থাকে। এদের অভাবে কোনো ব্যক্ত বল বা ক্রিয়ার না তো অস্তিত্ব হওয়া সম্ভব আর না এই সৃষ্টির মধ্যে কোনো পদার্থের অভিব্যক্ত হওয়া সম্ভব হবে।
ভূমিকা
বেদ হল সংসারের সবথেকে প্রাচীন গ্রন্থ, এটা তো সর্ববিদিত, কিন্তু বেদের পরিচয় কেবল এটুকুই নয়। যে গ্রন্থ সবথেকে পুরোনো হবে, সেটাই যে সবথেকে প্রামাণিক হবে, এটাও অনিবার্য নয়। বেদের বিষয়ে সংসারের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কিছু মহানুভাব বেদকে কেবল হিন্দুদের গ্রন্থ মনে করে। একইসাথে তারা এই গ্রন্থকে হিন্দুদের পূর্বজ ঋষিদের দ্বারা ভিন্ন-ভিন্ন কালে লেখা মানে। এই গ্রন্থের মধ্যে তারা অথর্ববেদকে সবথেকে নবীন বেদ মানে। এই সব মহানুভাব এমনও মানে যে বেদের মধ্যে ইন্দ্র, বরুণ আর অগ্নি আদি কল্পিত দেবতাদের স্তুতির বাহুল্য আছে। বেদের মধ্যে কিছু রাজা, ঋষি-মহর্ষির ইতিহাস আছে আর অথর্ববেদের মধ্যে যাদু-টোনা, ভূত-প্রেত, শকুন-অপশকুনের বর্ণনা আছে। বেদের মধ্যেও ভিন্ন-ভিন্ন দেশ, নদী আর পর্বতের বর্ণনা আছে আর এইসব নদী, পর্বত বা ব্যক্তি প্রাচীন ভারতের সঙ্গে সম্বন্ধিত। এইভাবে তাদের দৃষ্টিতে বেদ হল একটা অতি সাধারণ গ্রন্থ, যেটা হল ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য।
.
অন্যদিকে হিন্দু সমাজ বেদকে ঈশ্বরীয় গ্রন্থ মানে, কিন্তু অনেকত্র কিছু বিদ্বান একে বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা লেখা গ্রন্থ মানে। এদের দৃষ্টিতে বেদের মধ্যে নানা প্রকারের স্তুতি আছে আর এগুলোর ব্যবহার নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডের জন্য করা হয়, এইজন্য এই বিদ্বানদের বেদমন্ত্রে নানা প্রকারের কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে দেখা যায় আর সেই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বর্গ প্রাপ্তির অভিলাষা রাখে। কিছু ব্যক্তি এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে পশুবলি, এমনকি নরবলি এবং মাংস-মদের সেবন করাকেও বেদোক্ত মানে। এই ধরণের মান্যতাই সংসারের মধ্যে বামমার্গকে উৎপন্ন করে, যেখানে পঞ্চ মকারকেই (মাংস, মদ, মৈথুন, মুদ্রা, মৎস) পূজা মানা হতো।
.
যখন কিছু বিজ্ঞ জন বেদের এমন বীভৎস রূপ দেখে আর এমন বেদকে অপৌরুষেয় মানতে দেখে, তখন তারা বলে যে বেদ হল ভাণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচরদের লেখা। এই কারণে তারা না কেবল বৈদিক কর্মকাণ্ডের আলোচনা করে, বরং ঈশ্বর, আত্মা, জন্ম আর কর্মফল আদি মান্যতাকেও পুরোপুরি অস্বীকার করে দেয় আর বলে -
য়াবজ্জীবেত্ সুখম্ জীবেত্ ঋণম্ কৃত্বা ঘৃতম্ পিবেত্।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনম্ কুতঃ।।
(সত্যার্থপ্রকাশ্য দ্বাদশ সমুল্লাস থেকে উদ্ধৃত)
.
এইভাবে বামমার্গীরা বেদকে মানতো, কিন্তু বেদজ্ঞান হতে শূন্য হওয়ার কারণে সংসারের মধ্যে অনেক প্রকার পাপ ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে অনীশ্বরবাদী এবং বেদবিরোধী নাস্তিক মত চার্বাক নাম প্রসিদ্ধ তো ছিলই। এইভাবে এই মানব সমাজ দুটো বর্গে বিভাজিত হয়ে যায়। একটা বর্গ শিখা, সূত্র ও শাস্ত্রধারী হয়ে ভয়ঙ্কর পাপ করছিল, যজ্ঞের মধ্যে মাংস-মদিরা আর চর্বির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে চার্বাক মত মানুষকে স্বেচ্ছাচারী বিষয়ভোগী বানাচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কোনো পবিত্রাত্মা, যিনি বেদের যথার্থ স্বরূপ সম্বন্ধে জানেন না, তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। এই কারণে মহাত্মা বুদ্ধ আর মহাবীর স্বামীর মতো মহাপুরুষ একদিকে তো বেদকে দূরে সরিয়ে দেন অথবা বেদের প্রতি উদাসীন হন, তো অন্যদিকে নাস্তিক চার্বাক মতকেও অস্বীকার করে দেন। তাঁরা দুইজনই অহিংসা আর সত্যকে আধার বানিয়ে নবীন মার্গে গমণ করেন।
.
ঋষি দয়ানন্দের অনুসারে প্রতিমাপূজনের প্রথা এদের অনুয়ায়ীদের থেকে শুরু হয়েছিল। এমন শোনা যায় যে এঁদের দিবঙ্গত হওয়ার পশ্চাৎ এঁদের অনুয়ায়ীরা বেদকে হিংসার পোষক গ্রন্থ বলে আর বৈদিক সাহিত্যকে জ্বালানো শুরু করে দেয়, একথা কতদূর সত্য, তা আমি জানি না। এইভাবে বেদ বিজ্ঞানের অস্ত হওয়ার পশ্চাৎ ছড়িয়ে যাওয়া অজ্ঞানের অন্ধকারে চারটা মত পৃথক-পৃথক ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। বৈদিক বিদ্যা তো প্রায় সমাপ্তই হয়ে গিয়েছিল, তারসঙ্গে বৈদিক সাহিত্যও বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ভারতে আদি শঙ্করাচার্যের মতো মহাপুরুষের জন্ম হয়। শোনা যায় যে তিনি আট বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন আর তিনি বেদ এবং ভারতবর্ষের অধোগতি দেখেন, তো তিনি ধর্ম স্থাপনার বিচার করেন। ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থপ্রকাশের ১১ সমুল্লাসে আদি শঙ্করাচার্যকে অনেক সম্মান সহিত বর্ণিত করেন। ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "এরপর ২২০০ বৎসর পূর্বে দ্রবিড় দেশোৎপন্ন "শঙ্করাচার্য" নামক এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য দ্বারা সব শাস্ত্রের অধ্যয়ন করে ভাবতে লাগলেন, হায়! সত্য আস্তিক বেদমত বিলুপ্ত আর নাস্তিক জৈনমত প্রচলিত হওয়ায় বিশেষ অনিষ্ট হচ্ছে। যেকোনো প্রকার হোক এই মতের অপসারণ আবশ্যক। শঙ্করাচার্য শাস্ত্রধ্যয়ন তো করে ছিলেন, তার পাশাপাশি জৈনগ্রন্থসমূহও অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর যুক্তিও ছিল প্রবল।"
.
এমন মহান বিদ্বান শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক একতার জন্য চার মঠের স্থাপনা করেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ৩২ বছরের অল্পায়ুতেই বিশ্বাসঘাত করে বিষ দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয় আর তিনি তাঁর বিচারকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ পান নি। তাঁর পশ্চাৎ তাঁর অনুয়ায়ীরা ব্রহ্মসূত্রের সহায়তা নিয়ে ব্রহ্মসূত্রেরই বিরুদ্ধ "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা"র মতো মিথ্যা এবং অবৈদিক ঘোষণা প্রারম্ভ করে দেয়। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে নারী আর শূদ্রের প্রতি হেয় ভাবের দুর্ভাগ্যপূর্ণ প্রকরণ আমরা দেখতে পাই আর সম্ভবতঃ এইসব প্রকরণকে দেখেই মনুস্মৃতি, রামায়ণ এবং মহাভারত আদি গ্রন্থের মধ্যে এইরূপ পাপপূর্ণ প্রক্ষেপ করা হয়েছে। হতে পারে এর আগে থেকেই শাস্ত্রের মিথ্যা অর্থ আর প্রক্ষেপের দুর্ভাগ্যপূর্ণ পরম্পরা প্রারম্ভ হয়ে গিয়েছিল।
.
আমার নিজের মত হল, বাল্যাবস্থাতেই যে যুবক বৈরাগ্যবান্ হয়েছে, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে যে নিজের বিদ্বতার ডঙ্কা বাজিয়েছে, যাঁর মনে বৈদিক সনাতন ধর্ম এবং ভারত দেশকে বাঁচানোর প্রবল উৎকণ্ঠা আছে, সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে যে একাই বিজয় যাত্রার জন্য পা বাড়িয়েছে, এমন তেজস্বী, অপ্রতিম আত্মবলসম্পন্ন আর প্রজ্ঞাবান্ পুরুষ পূর্ণ য়োগীই হতে পারে। যেকোনো য়োগীর জন্য এমন সম্ভব বলে মনে হয় না যে তিনি মানব মাত্রের মধ্যে ভেদভাব করবেন। য়োগীর প্রারম্ভই হয় অহিংসা থেকে আর অস্পৃশ্যতা (ছুয়াছুত) তো এক প্রকারের হিংসাই হবে, য়োগ যার সর্বদা বিরোধ করে, এইজন্য এমনই মনে হয় যে কিছু ব্যক্তি নিজের পাপকে প্রমাণিত সিদ্ধ করার জন্য শঙ্করাচার্যের গ্রন্থের মধ্যে প্রক্ষেপ করেছে। যদি দুর্জন-তোষ ন্যায় দ্বারা এটা তাঁর নিজস্ব মত মানা হয়, তাহলেও বেদবিরুদ্ধ হওয়ার কারণে এটা কাউকে স্বীকার করা উচিত নয়।
.
এইভাবে এরপর ভারতবর্ষের মধ্যে পাঁচটা মুখ্য ধারা প্রচলিত হয় - বামমার্গ, চার্বাক, বৌদ্ধমত, জৈনমত আর তথাকথিত অদ্বৈতবাদ। বৌদ্ধমত ভারতীয়কে অহিংসার নামে ভীতু করে দিচ্ছিল, তো অপরদিকে অদ্বৈত মত "অহম্ ব্রহ্মাऽস্মি" এবং "ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা" র মতো ভ্রামক কথন করে-করে ভারতীয়দের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় হিত থেকে বিরক্ত করে দিচ্ছিল। বামমার্গ আর চার্বাক তো ছিলই অধর্মের দুটো নাম। এমন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বেদবিদ্যা থেকে নিরন্তর দূর থেকে দূরতর হয়ে যাচ্ছিল। অনেক আচার্য নিজ-নিজ মতের প্রবর্তন করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনো মতের মধ্যেই বেদবিদ্যার যথার্থ প্রকাশ না হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয়তা এবং সামাজিক অবধারণাই সমাপ্ত হয়ে যায়। কোনো আচার্যই রাষ্ট্র আর সমাজের প্রতি কর্তব্যকে বলার ছিল না। অধিকাংশ জনসংখ্যার জন্য বেদের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় আর যারা পঠন-পাঠন করছিল, তারাও বেদপাঠ আর কর্মকাণ্ড পর্যন্তই সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এটুকু অবশ্যই ছিল যে বেদার্থ হতে সর্বথা শূন্য বেদপাঠিগণ বেদকে সস্বর কণ্ঠস্থ করে প্রত্যেক পরিস্থিতিতে তাকে বাঁচিয়ে রাখে আর এই কারণে তারমধ্যে প্রায় কোনো প্রক্ষেপ হয়নি। বীভৎস কর্মকাণ্ডিগণও ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং শ্রৌত্র সূত্র আদি গ্রন্থকে বাঁচিয়ে রাখে। এই কারণে সংসার এই ব্রাহ্মণদের অবশ্যই ঋণী থাকবে।
.
এমন পরিস্থিতিতে মৃতপ্রায় ভারত বিদেশী আক্রমণকারীদের আক্রমণে আহত হতে থাকে। এইভাবে এই ভারত দেশ ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক সবদিক থেকে ছিন্ন-ভিন্ন আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। অনেক মত-পন্থ জন্ম নিচ্ছিল, দেশ বিদেশিদের কাছে পদাক্রান্ত হচ্ছিল। এমন কোনো রাজা-মহারাজা বা ধর্মাচার্য দেখা যাচ্ছিল না, যিনি এই সম্পূর্ণ পরিস্থিতির মূল্যাঙ্কন করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেশ আর বিশ্বকে উচিত দিশা দিতে পারেন। এই দেশে অনেক মহাপুরুষও জন্মে ছিলেন, যাঁদের মধ্যে আচার্য চাণক্য, সন্ত কবীর, গুরু নানকদেব, সন্ত রবিদাস, গোস্বামী তুলসীদাস, মীরা বাই, সন্ত জ্ঞানেশ্বর আদি প্রমুখ। এখানে আমি বীর ক্ষত্রিয়দের চর্চা করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না, কারণ ধর্মাচার্য আর দার্শনিকগণই দেশকে দিশা দেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এইসব মহাপুরুষদের মধ্যে কেউই বেদবিদ্যার বিশেষ জ্ঞাতা ছিলেন না, তাসত্ত্বেও তাঁরা নিজের সামর্থ্য আর পরিস্থিতি অনুসারে নিষ্কাম পুরুষার্থ করেন।
.
এমন বিষম পরিস্থিতিতে গুজরাটের টাঙ্কারা নামক গ্রামে এক মহাপুরুষ জন্ম নেন আর সেই মহাপুরুষ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নামে বিশ্ববিখ্যাত হন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি মহান প্রজ্ঞাবান্ স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতীর মতো গুরুকে পান। দণ্ডী স্বামী বিরজানন্দ সরস্বতী নেত্রহীন হওয়া সত্ত্বেও নিজের মহতী প্রজ্ঞা এবং য়োগারূঢ় আত্মার বলে ভারতবর্ষের অধোগতিকে সূক্ষ্মতা সহিত দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই সময় সেই দৃশ্য দেখতে ভারতবর্ষের কোনো আচার্য কিংবা রাজা-মহারাজা সক্ষম ছিলেন না। এমন মহান গুরু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকে এক বিরাট ব্যক্তিত্বের বানিয়ে দেন। তিনি নিজের গুরুর ভাবনার অনুরূপ, যেটা প্রাচীন আর্ষ পরম্পরার অনুসারেই ছিল, শাস্ত্রের সঙ্গে-সঙ্গে দেশ আর সমাজ উদ্ধারের সংকল্প নেন। তিনি এক সুদক্ষ বৈদ্যের মতো এটা যথাযথ ভাবে জানতে পারেন যে প্রাচী আর্যাবর্ত (ভারত) দেশেরও উৎকৃষ্ট রূপ ছিল, বেদবিদ্যার প্রকাশই ছিল তার কারণ আর ভারতের যে বিনাশ হয়েছে, সেটা বেদবিদ্যার পতনের কারণেই হয়েছে।
.
যদিও তিনি সত্যার্থপ্রকাশ আদি গ্রন্থের মধ্যে বিবিধ ক্ষেত্রের মধ্যে দেশ আর বিশ্বকে একটা নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেন আর দেশকে স্বতন্ত্র করার আহ্বান তিনিই প্রথম করেন, কিন্তু তাঁর সবথেকে প্রমুখ কাজ ছিল - বিভিন্ন প্রকারের কর্মকাণ্ডের শিকলে জড়িয়ে থাকা বেদের যথার্থ স্বরূপকে সংসারের সম্মুখে প্রস্তুত করার চেষ্টা করা। তিনি বেদকে সনাতন আর্ষ পরম্পরার অনুকূল দেখার চেষ্টা করেন আর তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে যেদিন তাঁর বেদভাষ্য পূর্ণ হবে, সেইদিন ভূমণ্ডলে সূর্যের মতো প্রকাশ হবে, যাকে নষ্ট কিংবা ঢেকে ফেলার সামর্থ্য কারও হবে না। তাঁর দৃষ্টি আর্ষ ছিল, মহান য়োগবল ছিল আর তাঁর হৃদয়ে বৈদিক ধর্ম ধ্বংস হওয়ার প্রবল সন্তাপ ছিল। শরীরে অদ্ভুত বল আর মস্তিষ্ক প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন ছিল। এইজন্য তিনি আর্যাবর্ত দেশ আর সনাতন বৈদিক ধর্মের দুরবস্থার মূল কারণকে জানতে পেরে ছিলেন। এমন ব্যক্তি হাজার-হাজার বছর পশ্চাৎ তিনি প্রথম মহাপুরুষ ছিলেন। তিনি অনুভব করেন যে যখন থেকে ভারতবর্ষ অথবা বিশ্বের মধ্যে বেদের যথার্থ স্বরূপ লুপ্ত হয়েছে, তখন থেকেই এই পতন শুরু হয়েছে।
.
এই কারণে তিনি পরম্পরাগত শৈলী থেকে আলাদা হয়ে বেদভাষ্য করা শুরু করেন। তিনি ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার মধ্যেই বেদের যথার্থ বিজ্ঞানের এক অতি সংক্ষিপ্ত ঝলক প্রস্তুত করেন। ঋগ্বেদের প্রারম্ভিক মন্ত্রের কিছু বিস্তার ভাবে দুই-দুই প্রকারের ভাষ্য করেন আর ক্রমে-ক্রমে তাঁর ভাষ্য সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হতে থাকে আর ঋগ্বেদ ভাষ্যের পশ্চাৎ তিনি য়জুর্বেদ ভাষ্যও সংক্ষিপ্ত রূপেই করেন। আর্য বিদ্বান আচার্য বিশ্বশ্রবা ব্যাসের অনুসারে "ঋষি দয়ানন্দ বলতেন যে চারটা বেদের ভাষ্য করতে তাঁকে চারশ বছরের আয়ু লাগবে", কিন্তু তিনি বেদভাষ্য করার জন্য মাত্র ৭-৮ বছর পেয়েছিলেন, তারমধ্যেও তিনি একটা স্থানে নিশ্চিন্তভাবে বসে ভাষ্য করতে পারেন নি।
.
বর্তমানে ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬১তম সূক্তের দুটো মন্ত্র পর্যন্তই তাঁর করা ভাষ্য আমরা পাই, কিন্তু তাঁর য়জুর্বেদ ভাষ্যের শুরুতে যে লেখা আছে, তাতে স্পষ্ট হয় যে তিনি ঋগ্বেদের ভাষ্য পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু কারও প্রমাদবশ ঋগ্বেদের শেষ ভাষ্যের পাণ্ডুলিপি সম্ভবতঃ কোথাও হারিয়ে গেছে। কেউ তার সন্ধান করার চেষ্টা করেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তাঁর উপলব্ধ ভাষ্যও সাংকেতিক মাত্রই আছে, কারণ কোথাও-কোথাও তো তিনি অনেক পদের ভাষ্য না করেই ছেড়ে দিয়েছেন। ভাষ্যের হিন্দি অনুবাদও তাঁর নয়, বরং তাঁর লেখন কার্য করা পণ্ডিতদের। তারা হিন্দি-অনুবাদে অনেকত্র ঋষি দয়ানন্দের মন্তব্যের বিপরীত অনুবাদ করেছে, যা কোথাও-কোথাও হাস্যাস্পদ হয়ে গেছে। সাধারণ জন হিন্দি অনুবাদই পড়ে, এই কারণে বেদের স্বাধ্যায় করেও আর্যজন বিশেষ কিছু লাভ নিতে পারে নি। ঋষি দয়ানন্দের সংস্কৃত ভাষ্যও বিস্তৃত ব্যাখ্যার আবশ্যকতা রাখে।
.
সম্ভবতঃ ঋষির এমন অনুভব হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর জীবন অধিক দিন যাবে না আর তাঁর কাছে কাজের অধিকতাও ছিল। এইজন্য তিনি সাংকেতিক ভাষ্যই করতে পান। যে সকল আর্যজন হঠপূর্বক এই ভাষ্যকে পূর্ণ মানে, তারা আজ পর্যন্ত সেখানে থেকে কিছু প্রকাশ না স্বয়ং আর না স্বয়ংয়ের পরিবারে করতে পেরেছেন, অথচ তাদের এই প্রকাশ সারা ভূমণ্ডলে করার ছিল। কেউই এই বিচার করার জন্য উদ্যত নন যে আমরা কেন বেদভাষ্য থাকা স্বত্ত্বেও পাশ্চাত্য কুশিক্ষা আর কুসভ্যতার দাস হয়ে গেছি? কেন আমরা নিজের পরিবারের মধ্যে বেদের শ্রেষ্ঠতা স্থাপিত করতে পারিনি? আমাদের আত্মনিরীক্ষণ করা উচিত যে উপলব্ধ বেদভাষ্য পড়ে এমন নিশ্চয় হয় কি যে বেদভাষ্যের মধ্যে যা কিছু আছে, মানুষ তা লিখতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় যে বেদের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের চর্চা করা হয়েছে আর সেই চর্চাও এমন গম্ভীর যে তাকে বর্তমান বিজ্ঞান পূর্ণ রূপে কখনও জানতে পারবে না? আমাদের কি এমন মনে হয় না যে বেদভাষ্য সাংকেতিক আছে আর তাকে আধার করে আমরা সংসারে বেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না?
.
এইসব লেখার মানে এই নয় যে আমি ঋষি দয়ানন্দের অবমাননা করছি, বরং আমার উদ্দেশ্য হল ঋষি দয়ানন্দের সময়ের পরিস্থিতি আর তাঁর বিবশতাকেও অনুভব করার চেষ্টা করা হোক। কেউ যতই প্রতিভাশালী ব্যক্তি হোক না কেন, সে ঋষি দয়ানন্দের সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এত বড় কাজ করতে পারবে না, এটাই তাঁর গৌরব। ঋষি দয়ানন্দের পশ্চাৎ তাঁর থেকে প্রেরিত পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী বেদাদি শাস্ত্রকে কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁর লেখা ইউরোপীয় বৈদিক বিদ্বানদের মধ্যে ধূম মেছে যায়, কিন্তু ইউরোপের পদার্থ বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ দিতে অথবা নতুন দিশা দেওয়ার কাজ তিনি করতে পারেন নি। আর্য সমাজ আর ডি.এ.বি. কলেজের প্রচার করতে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে আর অল্প বয়সে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে তিনি বিশেষ প্রতিভার ধনী হওয়া সত্ত্বেও বেদের উপর কাজ করতে পারেন নি।
.
ঋষি হতে প্রেরিত অন্য মহানুভাব মহাত্মা মুন্সীরাম (স্বামী শ্রদ্ধানন্দ), লেখরাম, পণ্ডিত কৃপারাম (স্বামী দর্শনানন্দ), প্রফেসর শ্যামকৃষ্ণ বর্মা, লালা লাজপতরায় এবং মহাত্মা হংসরাজ প্রমুখ হন, যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজকে জাগাতে আর স্বাধীনতা আন্দোলনকে দাঁড় করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের পশ্চাৎও অনেক বিদ্বান আর দেশভক্ত আর্যসমাজের মধ্যে হয়, যারা নিজের সারা জীবন দেশ আর সমাজের জন্য আহুতি করে দেন, কিন্তু বেদের যথার্থ স্বরূপকে জানতে ইচ্ছুক এমন কোনো বিদ্বান হননি, যিনি বেদের অপৌরুষেয়তা এবং সর্ববিজ্ঞানময়তাকে সিদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। এই কারণে আমাদের গুরুকুল বিদেশী শিক্ষার ঝড়কে থামাতে সক্ষম তো হয়নি, বরং গুরুকুল স্বয়ং ম্যাকালের শিক্ষার প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। যদি আমরা আধুনিক শিক্ষার কোনো বিকল্প প্রস্তুত করতে পেতাম, বৈদিক বিজ্ঞান আর প্রৌদ্যোগিকীর কিছু বিকাশ করতে পেতাম আর সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজ আর্যসমাজের বিদ্বানদের পাশে দাঁড়াতো, তাহলে আজ দেশের মধ্যে নিজের স্বদেশী শিক্ষা আর চিকিৎসার সাম্রাজ্য হতো।
.
আমি প্রায় ৩০ বছর পূর্বেই এটা অনুভব করা শুরু করে ছিলাম যে আমরা আর্যসমাজের প্রথম আর তৃতীয় নিয়মের উপর যতই ভাষণ-প্রবচন করি না কেন, তবে বৈজ্ঞানিক জগতে একে সিদ্ধ করতে পারা অতি দুষ্কর। এই জন্য আমি বেদের উপর এমন দৃষ্টিতে বিচার করার ব্রত নিয়েছি যাতে বেদ ঈশ্বরীয়ও হয়ে যায় আর তারসঙ্গে সর্ববিজ্ঞানময়ও হয়। আর্য বিদ্বানদের মধ্যে এমন কাউকে দেখিনি, যিনি এই দিশাতে মার্গদর্শন বা পরামর্শ দিতে পারেন। এই কারণে স্বয়ংই আর্ষ গ্রন্থ পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই ক্রমে পড়তে-পড়তে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বারি আসে। সর্বপ্রথম ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সায়ণ ভাষ্য তথা ডাক্তার সুধাকর মালবীয় দ্বারা করা হিন্দি অনুবাদ দেখি। একই সঙ্গে আর্য বিদ্বান আচার্য বীরেন্দ্র শাস্ত্রীর হিন্দি অনুবাদ এবং পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় দ্বারা করা শতপথ ব্রাহ্মণের হিন্দি অনুবাদ দেখি। এইসব দেখে খুব ভয় হয় যে যদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এমন হয়, তাহলে বেদকে অপৌরুষেয় আর সর্ববিজ্ঞানময় বলা নিতান্ত মূর্খতার কথা হবে। এরদ্বারা আর্য সমাজের মূল বিচারধারার ভবনই ভেঙে পড়বে।
.
ঋষি দয়ানন্দের কথনের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল আর সকল প্রাচীন ঋষিদের উপরেও অটুট শ্রদ্ধা ছিল। এর থেকে প্রেরিত হয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কোনো ভাষ্য বা অনুবাদই ঠিক নয়। আর তাই স্বয়ং এর ভাষ্য করা উচিত। এই ক্রমেই আমি "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" নামে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বৈজ্ঞানিক ভাষ্য করি। এরমধ্যে প্রায় ১২৫ টা গ্রন্থকে উদ্ধৃত করেছি। যার দ্বারা সিদ্ধ হয়েছে যে আমার করা ভাষ্য ঋষিদের বিচারের অনুরূপই হয়েছে। কোথাও কোনো কথা কল্পনা করে লেখা হয়নি। এইরূপ স্থিতি এই গ্রন্থের মধ্যেও আছে। বেদ মন্ত্রকে রশ্মির রূপে মানতে তথা বেদের ঋষিদেরও রশ্মিরূপে অন্তরীক্ষে বিদ্যমান হওয়ার সংকেত পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলারের নিরুক্ত-ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত হয়। একইসঙ্গে ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার বেদনিত্যত্ব বিষয় নামক অধ্যায়ে উল্লিখিত এই বচন থেকেও হয় - "কিন্তু আকাশে শব্দের প্রাপ্তির কারণে শব্দ তো অখণ্ড একরস সর্বত্র ভরে আছে। শব্দ হল নিত্য। বেদের শব্দ সবদিক থেকে নিত্য বজায় থাকে।" এছাড়াও অনেক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, উপনিষদ এবং আরণ্যক তথা বেদের কিছু শাখার বচন থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি বৈদিক ছন্দ রশ্মি দিয়ে তৈরি আর সেগুলোর দ্বারাই সঞ্চালিত হচ্ছে। আর এই সবেরও মূল সঞ্চালক হল পরব্রহ্ম পরমাত্মা।
.
এইভাবে আমি সৃষ্টিকে জানার জন্য বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের আবিষ্কার করি, যা বাস্তবে আমার সিদ্ধান্ত নয়, বরং প্রাচীন ঋষি আর বেদের সিদ্ধান্ত, যাকে আমরা হাজার-হাজার বছর ধরে ভুলে গিয়েছিলাম। এই সিদ্ধান্তের আধারেই সম্পূর্ণ সৃষ্টির এমন ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা বর্তমান বিজ্ঞানের যেকোনো সিদ্ধান্তের থেকে অধিক সূক্ষ্ম, গম্ভীর আর ব্যাপক হবে। বৈদিক রশ্মি বিজ্ঞানের দ্বারাই বেদকে অপৌরুষেয় এবং সর্ববিজ্ঞানময় সিদ্ধ করা যেতে পারে, এছাড়া অন্য কোনো মার্গ নেই। এই সিদ্ধান্তের দ্বারাই প্রাচীন ইতিহাসের অন্বেষণ করতে যেকোনো ঘটনার সম্ভব বা অসম্ভব হওয়ার পরিচয়ও করা যেতে পারে। এর আধারে বেদাদি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে সেগুলো পূর্ণ নির্দোষ আর সর্বহিতকারী রূপে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এইভাবে এই বিজ্ঞানের বিকাশ করে সুদূর ভবিষ্যতে এমনও বৈদিক শিক্ষা প্রণালীর বিকাশ করা যেতে পারে, যা আধুনিক শিক্ষা প্রণালীর থেকে অধিক শ্রেষ্ঠ আর হিতকারী হবে, কিন্তু এইসব করতে হলে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত আর্থিক সংশোধনের আবশ্যকতা হবে।
.
এর জন্য সেই সব মহানুভাবকে গম্ভীরতা পূর্বক বিচার করা উচিত, যারা বেদকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান।যাদের মধ্যে ভারতবর্ষকে বৌদ্ধিক দাসত্ব থেকে মুক্তি করার প্রচণ্ড ইচ্ছা আছে আর যাদের মধ্যে ঋষি-মুনি আর দেব তথা অন্য প্রাচীন মহাপুরুষদের প্রতি গভীর সম্মানের ভাব বিদ্যমান আছে। আজ আসুরী কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে প্রচারিত আর প্রসারিত করার জন্য বিশ্বের সব সংস্থান লেগে পরে আছে, অথচ বেদ আর দেবতাদের কথা বলে এমন মহানুভাবের কাছে না কোনো পরিকল্পনা আছে আর না আছে কোনো দিশা। পৌরাণিক তথাকথিত সনাতনী মহানুভাব মন্দিরের উপর ধন ব্যয় করা আর নানা কর্মকাণ্ড করা-করানোর মধ্যেই ব্যস্ত আছে আর আর্যসমাজী মাত্র যজ্ঞ, কথিত য়োগ, প্রবচন আদি করেই স্বয়ংকে বেদভক্ত মেনে বসে আছে। বস্তুতঃ বেদ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আশা করি সকল দেশভক্ত বৈদিক সনাতন ধর্মপ্রেমী সজ্জন এর উপর অবশ্যই বিচার করবেন।
প্রশ্ন - আপনার এই কথন যে সৃষ্টির শুরুতে অগ্নি আদি চারজন ঋষি বেদজ্ঞান প্রাপ্ত করেন, এটা উচিত নয়। কারণ ভারতীয় পরম্পরা মহর্ষি ব্রহ্মাকে সর্বপ্রথম বেদের জ্ঞান প্রাপ্তকারী মানে।
.
উত্তর - এখানে আমি সর্বপ্রথম তো এটা বলতে চাইবো যে এটা আমার মত নয় বরং সংসারের সর্বোচ্চ ও সর্বপ্রথম রাজর্ষি ভগবান্ মনুর মত হল এটা, যাঁর বিষয়ে প্রাচীন ঋষিদের কথন আছে - "য়দ্বৈ কিঞ্চ মনুরবদত্ তদ্ ভেষজম্" (তৈত্তেরীয় সংহিতা ২.২.১০.৩) অর্থাৎ মনু মহারাজের কথন ওষুধের সমান হিতকারী হয়। এই কারণে ভারতীয় কোনো পরম্পরা তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া সম্ভব নয়। এখন আমি অন্য আর্ষ গ্রন্থকেও উদ্ধৃত করবো - "ততো ব্রহ্মৈব প্রথমমসৃজ্যত (প্রজাপতিঃ) ত্রয়্যেব বিদ্যা তস্মাদাহুর্ব্রহ্মাস্য সর্বস্য প্রথমজামিতি" (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬.১.১.১০)।"
.
এই কথন থেকে এই সংকেত পাওয়া যায় যে পরমাত্মা মহর্ষি ব্রহ্মাকে ত্রয়ী বিদ্যা অর্থাৎ চতুর্বেদের (শৈলী অনুসারে তিন) জ্ঞান দেন। এই কথন হল মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের। যদিও মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের তুলনায় ভগবান্ মনুর স্থান অত্যন্ত উচ্চ, তবুও মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যও আপ্ত পুরুষ ছিলেন তাই তাঁর কথনও মিথ্যা হতে পারে না। তাহলে আমাদের কোনো একটা পক্ষকে দেখা উচিত নয়, বরং উভয়ের সামঞ্জস্য নির্ধারিত করা উচিত। এর জন্য ভগবান্ মনু প্রোক্ত শ্লোক "অগ্নিবায়ুরবিভ্যঃ" এরমধ্যে পঞ্চমী বিভক্তি মানতে হবে। এইভাবে শতপথের উপরোক্ত বচনের প্রকাশে মনু প্রোক্ত শ্লোকের অর্থ এই দাঁড়াবে -
.
মহর্ষি ব্রহ্মা যজ্ঞ অর্থাৎ লোককল্যাণার্থ অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিদের থেকে ঋক্, য়জুঃ এবং সাম লক্ষণ যুক্ত বেদ প্রাপ্ত করেন। এর মানে হল পরমাত্মা এই সৃষ্টিতে সব জীবের কল্যাণের জন্য অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিদের মাধ্যমে মহর্ষি ব্রহ্মাকে সম্পূর্ণ বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত করিয়ে দেন। এইভাবে মহর্ষি ব্রহ্মাই এই পৃথিবীর প্রথম পুরুষ ছিলেন, যিনি সম্পূর্ণ ত্রয়ীবিদ্যার জ্ঞান প্রাপ্ত করেন। অগ্নি, বায়ু আদি ঋষিগণ এক-একটা বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত করেছিলেন। এইভাবে এক-একটা বেদ প্রাপ্তকারী অগ্নি, বায়ু আদি চার ঋষি ছিলেন, কিন্তু চার বেদের জ্ঞান প্রাপ্তকারী মহর্ষি ব্রহ্মাই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন। তাই ভগবান্ মনু এবং মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য উভয়ের কথনই সত্য।
.
প্রশ্ন - আপনি বার-বার বেদমন্ত্রকে রশ্মি নাম দিয়েছেন, কখনও কোনো ঋষি তো এমন বলে নি। এটা আপনার মনের মিথ্যা কল্পনা নয় কি? যখন আপনি এই রশ্মিজাল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বেদের চিন্তন করবেন, তখন আপনি বেদের অর্থ বুঝবেন।
.
উত্তর - এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে যে বেদ আসলে কি? বেদ হচ্ছে ছন্দরূপ, এই বিষয়ে কোনো প্রকারের তর্ক-বিতর্ক করার আবশ্যকতা নেই। ছন্দের বিষয়ে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন - ছন্দাম্সি চ্ছাদনাত্ (নিরুক্ত ৭.১২)। এই বিষয়ে দৈবত ব্রাহ্মণে (৩.১৯) বলা হয়েছে - "ছন্দাম্সি ছন্দয়ন্তীতি বা"। এখানে প্রশ্ন দাঁড়াবে যে এই ছন্দ কোন পদার্থের নাম, যা অন্য কোনো পদার্থকে আচ্ছাদিত করে। আচ্ছাদন শব্দ এটাই বলে যে ছন্দ হচ্ছে কোনো দ্রব্য, যা অন্য কোনো দ্রব্যকে আচ্ছাদিত করে। "ছন্দঃ" পদের অনেক অর্থ ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যে করেছেন -
প্রকাশকর্ম (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৫.৪)
ঊর্জনম্ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৫.৪)
বলকারী (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৪.১৮)
প্রকাশ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১৪.১৮)
এইসব অর্থ দ্বারা এটাই সিদ্ধ হয় যে ছন্দ হচ্ছে কোনো দ্রব্য। এর অর্থ এই হল যে বেদ মন্ত্র হল দ্রব্যরূপ। অন্যদিকে আরও এক ঋষির কথন হল - "প্রাণাঃ বৈ ছন্দাম্সি" (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ৭.৯.১৭.২)। এর অর্থ হল ছন্দ হল প্রাণ রূপ অর্থাৎ বেদমন্ত্র হল প্রাণরূপ। প্রাণ হল নিরন্তর কম্পনকারী পদার্থ। এর জন্য মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন - "অধ্রুবম্ বৈ তদ্যত্প্রাণঃ" (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.২.৬.১৯)। অপরদিকে মহর্ষি ব্যাস জীর কথন হল - "প্রাণঃ কম্পনাত্" (ব্রহ্মসূত্র ১.৩.৩৯)। এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে বেদমন্ত্র রূপী পদার্থ এই সৃষ্টিতে সর্বদা কম্পন করতে থাকে। রশ্মিও সর্বদা কম্পন করতে থাকে, এইজন্য মহর্ষি তিত্তির বলেছেন - "প্রাণা রশ্ময়ঃ" (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.২.৫.২)। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন যে রশ্মি শব্দের ব্যবহার কেউ করে নি, এটা আপনার স্বাধ্যায়ের ন্যুনতাকেই দর্শায়।
.
রশ্মি শব্দের ব্যবহার অন্যত্র অনেক স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণার্থ -
মাসা রশ্ময়ঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১৩৭)
রশ্ময়ঃ ঋতবঃ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪.৮.৮, কপিষ্ঠল সংহিতা ৪৩.১)
রশ্ময়ো মরুতঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১৩৭)
.
এর উপর আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে রশ্মি তো হল মরুত্, কিন্তু ছন্দকে কোথায় রশ্মি বলা হয়েছে? যদিও প্রাণকে রশ্মি বলা আর ছন্দকে প্রাণ বললে স্বতঃই ছন্দ রশ্মিরূপ সিদ্ধ হয়ে যায়, তবুও আপনার সন্তোষের জন্য আমি আরও একটা প্রমাণ প্রস্তুত করছি - "এষ য়ানি ক্ষুদ্রাণি ছন্দাম্সি তানি মরুতাম্" (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ১৭.১.৩) অর্থাৎ যেসব ন্যুন অক্ষরকারী ছন্দ আছে, সেগুলোই মরুতের রূপ হয়। অথর্ববেদের (১৯.৫৩.১) মধ্যে কালকে সপ্তরশ্মি বলা হয়েছে। এখানে সপ্তরশ্মির অর্থ সাত প্রকারের প্রাণ হবে। সম্পূর্ণ সৃষ্টি এই সব বৈদিক রশ্মি দিয়েই তৈরি হয়েছে, এইজন্য ঋষিগণ বলেছেন -
.
এতে বৈ বিশ্বেদেবা রশ্ময়ঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ২.৩.১.৭)
অন্নম্ রশ্মিঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৮.৫.৩.৩)
এতে বৈ রশ্ময়ো বিশ্বেদেবাঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২.৪.৪.৬)
.
এই সব প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সম্পূর্ণ সৃষ্টিটাই হল রশ্মিরূপ অর্থাৎ রশ্মি দিয়ে মিশ্রিত হয়েই তৈরী হয়েছে। এই সৃষ্টিতে এক বিশেষ প্রকারের বিভাগের দৃষ্টিতে সব পদার্থ অন্ন এবং প্রাণ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে আর উভয় প্রকারের পদার্থ রশ্মিরূপই হবে। অন্যদিকে য়জুর্বেদে সব পদার্থকে ছন্দরূপ বলা হয়েছে -
.
পৃথিবী ছন্দোऽন্তরিক্ষম্ ছন্দো দ্যৌশ্ছন্দঃ সমাস্ছন্দো নক্ষত্রাণি ছন্দো মনশ্ছন্দঃ কৃষিছন্দো হরিণ্যম্ ছন্দো গৌশ্ছন্দোऽজা চ্ছন্দোऽশ্বছন্দঃ।। (য়জুর্বেদ ১৪.১৯)
.
শৈলীর দৃষ্টিতে বেদ (ছন্দ) তিন প্রকারের হয় -
{১} ঋক্ - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
ঋগ্ভ্যো জাতাম্ সর্বশো মূর্তিমাহুঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.১১)
ঋক্ বা অয়ম্ পৃথিবীলোকঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.৩৮০)
.
অর্থাৎ এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ বিদ্যমান আছে, সেগুলোতে ঋক্ ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য আছে।
.
{২} য়জুঃ - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
সর্বা গতির্য়াজুষী হৈব শশ্বত্ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.১)
অন্তরিক্ষম্ বৈ য়জুষামায়তনম্ (গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ২.২৪)
অন্তরিক্ষলোকো য়জুর্বেদঃ (ষড্বিংশ ব্রাহ্মণ ১.৫)
এইসব প্রমাণের অর্থ হল এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ গতি করছে, সেগুলো য়জুঃ ছন্দ রশ্মি দিয়ে তৈরি আকাশের মধ্যেই গমন করছে। এই ছন্দ রশ্মির বিস্তারকেই আকাশ মহাভূত বলে।
{৩} সাম - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
সর্বম্ তেজঃ সামরূপ্যম্ হ শশ্বত্ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.১২.৯.২)
সাম বা অসৌ দ্যুলোকঃ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ৪.৩.৫)
অর্চিঃ আদিত্যস্য সামানি (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.৫.১.৫)
এইসব প্রমাণ দ্বারা এটা সিদ্ধ হয় যে প্রকাশিত কিরণ এবং প্রকাশিত লোকের মধ্যে সাম নামক ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য আছে।
বিস্তার ভয়ের কারণে আমি আর অধিক প্রমাণ দিচ্ছি না আর এইরূপ করা আবশ্যক। এইসব প্রমাণ থাকতে কোনো ব্যক্তিই এমন বলতে পারবে না যে বেদমন্ত্র দিয়ে সৃষ্টির নির্মাণ হয়নি আর বেদমন্ত্র রশ্মি রূপ নয়, এমনও কেউ বলতে পারবে না।
প্রশ্ন - বেদমন্ত্র ক্রিয়ারূপ নাকি দ্রব্যরূপ? আপনি ছন্দকে মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন ঢেউয়ের সমান মানেন, এই মান্যতা দ্বারা তো বেদ ক্রিয়ারূপই হতে পারে, দ্রব্যরূপ নয় আর ক্রিয়ারূপ পদার্থ নিমিত্ত কারণ তো হতে পারবে, কিন্তু উপাদান কারণ নয়। অথচ আপনি উপরোক্ত প্রমাণের মাধ্যমে বেদকে উপাদান কারণ সিদ্ধ করেছেন, এটা কি আপনার বিচারের পরস্পর বিরোধ দেখাচ্ছে না?
উত্তর - আমার বিচারের মধ্যে এমন কোনো বিরোধ নেই, বরং আপনার মতিবিভ্রম আছে। যেরূপ জলের মধ্যে ঢেউ উৎপন্ন হয়, সেইরূপ মনের মধ্যে উৎপন্ন ঢেউকে ছন্দ রশ্মি বলে। জলের থেকে পৃথক অস্তিত্ব ঢেউয়ের নেই, বরং ক্রিয়াশীল অর্থাৎ কম্পন করতে থাকা জলকেই ঢেউ বলে, সেইরূপ কম্পন করতে থাকা মনস্তত্ত্বকেই ছন্দ রশ্মি অর্থাৎ বেদমন্ত্র বলে। বিনা কম্পন অর্থাৎ ক্রিয়া না করে কোনো পদার্থই বিকার প্রাপ্ত হয়ে অন্য কোনো পদার্থকে উৎপন্ন করতে পারবে না। এইজন্য মনস্তত্ত্ব মন্ত্রের রূপে কম্পিত না হয়ে সৃষ্টির রচনা করতে অর্থাৎ পদার্থান্তরে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হবে না। এইভাবে যেকোনো মন্ত্র অর্থাৎ মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হওয়া কম্পন যেকোনো পদার্থের নিমিত্ত কারণ হবে আর কম্পন করা মনস্তত্ত্ব, যেটা বাক্ রূপ হয়, সেটা হল এই সৃষ্টির উপাদান কারণ। এইজন্য ঋষিগণ বাক্ আর মনের পারস্পরিক সম্বন্ধ নিয়ে লিখেছেন -
বাক্ চ বৈ মনশ্চ দেবানাম্ মিথুনম্ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.২৩), বাগিতি মনঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.৪.২২.১১)
.
এখন রশ্মির বিষয়ে মহর্ষি য়াস্কের কথন হল - রশ্মির্য়মনাত্ (নিরুক্ত ২.১৫) অর্থাৎ রশ্মি হল সেই পদার্থ যা নিজের থেকে স্থূল পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রমাণ থেকে আপনি এমন বলতে পারেন যে এখানে তো রশ্মি দড়ির জন্য বলা হয়েছে, কারণ দড়ি দিয়ে ঘোড়া আদিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়। তাহলে এই বিষয়ে আমি এটাই বলবো যে শাস্ত্রের নির্বাচনের স্বরূপের বোধ আপনার নেই। বস্তুতঃ শাস্ত্রের নির্বাচন গণিতের সূত্রের মতো ব্যাপকতার সঙ্গে কাজ করে, প্রসঙ্গ থেকেই যার অর্থ জানা যেতে পারে। যদি আমরা প্রসঙ্গের ধ্যান না রাখি, তাহলে বেদের সব পদ রূঢ় হয়ে যাবে আর তখন সেগুলোর অনুবাদ হাস্যাস্পদই হবে, যৌগিক ব্যাখ্যা কখনও হবে না।
প্রশ্ন - আপনার "বেদবিজ্ঞান আলোকঃ" আর "বৈদিক রশ্মিবিজ্ঞানম্"কে বুঝতে পারা খুবই দুষ্কর। বেদ আর ঋষিদের বিচারকে এত কঠিন ভাবে প্রস্তুত করা কি উচিত? এর মাধ্যমে কত জন ব্যক্তি জুড়বে? উত্তর - যেকোনো বিদ্যা যত সংক্ষেপে বলা হবে, সেটা ততটাই সাংকেতিক ও জটিল ভাষাতে হবে। যখন কোনো বিদ্যাকে অধিকাধিক সরল রূপ দেওয়া হয়, তখন তার গ্রন্থের আকার ততটাই অধিক বেড়ে যায়। সৃষ্টির জ্ঞান হল অনন্ত, তো সেই অনন্ত জ্ঞানকে সীমিত শব্দের মধ্যে আবদ্ধ করা খুবই দুষ্কর। এর পশ্চাৎ বেদের ব্যাখ্যান গ্রন্থ ব্রাহ্মণগ্রন্থ বা নিরুক্তাদি শাস্ত্র বেদসংহিতার তুলনায় সরল আর বিস্তৃত, কিন্তু সেগুলোও সেখানে বর্ণিত জ্ঞানের তুলনায় সংক্ষিপ্ত আর জটিল আছে। তার কারণ হল ঋষি ভগবন্ত কম শব্দের মধ্যে অধিকাধিক জ্ঞান দান করতেন, যাতে তাদের কণ্ঠস্থ করতে সহজ হয়। এই গ্রন্থ সেই সময়কার মানুষের জন্য তো কঠিন ছিল না, কিন্তু আর্ষ পরম্পরা সমাপ্ত হওয়ার হাজার-হাজার বছর পশ্চাৎ আজ সেই গ্রন্থ সবার জন্য দুরূহ হয়ে গেছে, তবে তার দুরূহতা বেদের ঋচার তুলনায় কম আছে। তখন কে জানতো যে ঋষি আর দেবতাদের এই ভূমি আর্যাবর্তে (ভারতবর্ষ) প্রজ্ঞার এমন পতন হবে যে সংস্কৃত ভাষার বড়-বড় বিদ্বান বেদ ও আর্ষ গ্রন্থের এমন ঘৃণিত ও মূর্খতাপূর্ণ ভাষ্য করবেন আর সেই ভাষ্যের আধারেই সারা বিশ্বের মধ্যে বৈদিক সত্য সনাতন ধর্ম এমন অধোগতি প্রাপ্ত করবে।
.
আমি এই গ্রন্থের ভাষ্য করে এর সেই স্থান দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যা বাস্তবে হওয়া উচিত। আমি সেই মূল গ্রন্থকে যথাপরিস্থিতি আর যথাশক্তি সরল করার চেষ্টা করেছি, তাসত্ত্বেও সংসাধন আর সময়ের ন্যুনতার কারণে আমি এর আরও অধিক সরল রূপ দিতে অসফল হয়েছি। এরপরও আমি এটাই বলবো যে বেদ হল সম্পূর্ণ সত্য বিদ্যার গ্রন্থ অর্থাৎ তারমধ্যে সম্পূর্ণ নিত্য জ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত আছে, তা সেটা পদার্থ বিজ্ঞান হোক বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। যখন গুরুকুল অথবা আধুনিক শিক্ষণ সংস্থানের মধ্যে বিজ্ঞান থেকে ইতর বিষয়ের বিদ্যার্থী ঈশ্বরের সৃষ্টির বিষয় সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানটুকু রাখে না, তখন তারা এই বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ কিভাবে বুঝবে? য়ম-নিয়ম পালন যখন দুর্লভ হয়ে গেছে, তখন এই গ্রন্থ তাদের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের প্রকাশ কিভাবে দিতে পারবে? কোনো ইংরেজি ভাষার খুব ভালো বিদ্বান ইংরেজি ভাষাতে লেখা বিজ্ঞানের গ্রন্থকে বুঝতে পারবেন কি? তিনি তার ভাষা আর ব্যাকরণ জ্ঞানের আধারে কখনও বৈজ্ঞানিককে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কি? কক্ষনো পারবেন না কারণ তার বিষয়টা আলাদা, সেইরূপ সংস্কৃত ভাষা, সাহিত্য আর ব্যাকরণের জ্ঞাতা প্রবল পবিত্র তর্ক আর ঊহা ছাড়া আর বৈজ্ঞানিক পৃষ্ঠভূমিকে ছাড়া বৈদিক বিজ্ঞানের মহান গ্রন্থকে কিভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন?
.
এমন পরিস্থিতিতে বেদ কেন সমস্ত আর্ষ গ্রন্থও ভাষা আর ব্যাকরণের পণ্ডিতদের কাছে এতই দুরূহ হয়ে গেছে যে সেগুলোর ব্যাখ্যাতে লেখা গ্রন্থও তাদের কাছে দুরূহ মনে হচ্ছে। যদি নিজের অন্তরে বৈজ্ঞানিক ভাবনার বিকাশ করা যায় আর আধুনিক পদ্ধতি দিয়ে হলেও, যদি বর্তমান বিজ্ঞানেরও কিছু অধ্যয়ন করা যায় আর নিজের আত্মা ও অন্তঃকরণকে পবিত্র বানিয়ে ঈর্ষা আর অহংকারকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সতত অভ্যাসে আমার গ্রন্থও ধীরে-ধীরে বোঝা যাবে। প্রণালীটা নতুন, তাই বুঝতে কঠিন মনে হওয়া স্বাভাবিক। বেদের মধ্যে গূঢ় বিদ্যা আছে, তাকে আমি কথাবাচকদের স্তর পর্যন্ত গিয়ে বোঝাতে পারবো না। আজ দেশের মধ্যে কথা আর প্রবচন খুব হচ্ছে, কোথাও ভাগবত কথা, শ্রীরাম কথা, বেদকথা, উপনিষদ কথা, কোথাও গীতার প্রবচন, কোথাও বেদের প্রবচন। এই সবের স্তরকে দেখলে তো কোনো ভাবেই এমন মনে হয় না যে আমাদের বেদাদি শাস্ত্র অপার বিজ্ঞানের ভাণ্ডার।
.
যদি আপনাকে এই কথাই সরল লাগে, কেবল দক্ষিণার উদ্দেশ্যে করা নানা প্রকারের কর্মকাণ্ড তথা কেবল স্বাস্থ্য আর ধনের লোভে য়োগের চাদর জড়িয়ে ব্যায়াম আর প্রাণায়ামই যদি সরল লাগে, এইভাবে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেই সমাধি প্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার মতো মিথ্যা কথাই মোক্ষ প্রাপ্তকারী মনে হয়, তাহলে তো আমার গ্রন্থ জানা কখনও সম্ভব হবে না আর না তাকে জানার জন্য বেদাদি শাস্ত্র আছে। যদি এইসব কাজ করেই দেশ আর ধর্মের উদ্ধার হতে পারে, তাহলে এই দেশ ও ধর্মের পতন কখনও হতো না, কারণ এইসব কাজে কখনও বিশেষ অবরোধ আসে নি। যদি অবরোধ এসে থাকে তো কেবল শাস্ত্রের বিজ্ঞানকে জানার প্রণালীতে আর যখন থেকে এতে অবরোধ এসেছে, তখন থেকে দেশ আর ধর্ম দুটোরই পতন হয়েছে। আমাদের সবাইকে মিলিত হয়ে এই পতনকে থামাতে হবে।
.
এখানে আমি এটাও বলবো যে এমন নয় যে আমার গ্রন্থকে কেউই বুঝতে পাচ্ছে না। অনেক পাঠক আর শ্রোতা বেদবিজ্ঞান-আলোক গ্রন্থের কিছু অংশ জেনেছে আর ভরপুর আনন্দও নিচ্ছে। এটা জেনেই আমার মানস সন্তান (প্রিয় বিশাল আর্য এবং ডাক্তার মধুলিকা আর্যা) উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত করা সত্ত্বেও এখানে বিজ্ঞানের গভীরত্বকে জানার জন্য নিজের জীবন সমর্পণ করে বসেছে আর উজ্জ্বল ভৌতিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে ত্যাগ করে দিয়েছে। ভৌতিক বিজ্ঞানের অনেক বিদ্বান আছেন যারা আমার সঙ্গে মিলে কাজ করতে ইচ্ছুক, আবার কিছু বিদেশ থেকে এসে আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত যুবক তাদের জীবনকে পূর্ণ রূপে বদলে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কত ব্যক্তি সংস্কৃত অধ্যয়ন শিখছে আর সংস্কৃতের কত ব্যক্তি বিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে চাইছে, তাহলে কিভাবে বলবো যে আমার বিজ্ঞানকে কেউ বুঝতে পাচ্ছে না?
.
যেরূপ কোনো মুমুক্ষু ব্যক্তি মুক্তির কামনায় য়োগের তপ করেন কিন্তু কামনার সঙ্গে যোগ্যতা না থাকলে তাতে অসফল হন, তবে সেই ব্যক্তি কিছুটা হলেও আনন্দ প্রাপ্ত করেন অবশ্যই। সেইরূপ যারা বাস্তবে শাস্ত্রের বিজ্ঞানের আনন্দ নিতে ইচ্ছুক, তারা অবশ্যই "বৈদিক রশ্মিবিজ্ঞানম্"কে পড়বেন। এদের মধ্যে যারা বিশেষ মেধাবী হবেন, তারা বিশেষ আনন্দ প্রাপ্ত করতে পারবেন আর যাদের মধ্যে পর্যাপ্ত মেধা নেই, তারাও বিশ্বাস তো করতেই পারবেন যে আমাদের বেদাদি শাস্ত্র কত মহান বিজ্ঞানের অসাধারণ গ্রন্থ। আজ যদি জনসাধারণের মধ্যে এতটুকুও বিশ্বাস হয়ে যায়, তাহলেও রাষ্ট্র আর ধর্মের অনেক কল্যাণ হতে পারে।
.
প্রশ্ন - যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ, পরীক্ষণ, প্রেক্ষণ, পরীক্ষণ ও গণিতের মধ্যে কোনো একটাতে পুষ্টি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের উপর কিভাবে বিশ্বাস করবো?
উত্তর - আপনাকে কোনো সিদ্ধান্তের পুষ্টির জন্য প্রয়োগ, প্রেক্ষণ বা গণিতের আবশ্যকতা মনে হচ্ছে আর আপনি আপনার এইসব আদর্শ পাশ্চাত্য শিক্ষা পরম্পরা থেকে শিখেছেন। আমি এর গুরুত্বকে অস্বীকার করছি না, তবে পশ্চিমী বৈজ্ঞানিক স্বয়ং তাদের আবশ্যকতার বিষয়ে কি বলেছেন, সেটা আপনার জানার জন্য আমি এখানে উদ্ধৃত করছি -
প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ ভৌতিকশাস্ত্রী স্টিফেন হকিংয়ের কথন হল - "Any physical theory is always provisional in the sense that it is only a hypothesis, you can never prove it. No matter how many times the result of experiments agree with some theory. You can never be sure that the next time a result will not contradict the theory, on the other hand you can disprove a theory by finding even a single observation that disagree with the predictions."
(A Briefer History of Time, Pg.14)
এর মানে হল যেকোনো ভৌতিক সিদ্ধান্ত অস্থায়ী হয়। বস্তুতঃ একটা পরিকল্পনাই হয়। আপনি সেটা সিদ্ধ করতে পারবেন না, যদিও আপনি সেটা কয়েকবার প্রয়োগ করে পরীক্ষণ করেছেন। আপনি এটা সুনিশ্চিত করতে পারবেন না যে পরবর্তী কোনো প্রয়োগে বিপরীত নিষ্কর্ষ প্রাপ্ত হবে না। আপনার যেকোনো একটা বিপরীত নিষ্কর্ষ আপনার অনেক ভবিষ্যবাণীকে অসিদ্ধ করতে পারে।
.
এই ধরণের বিচার বিশ্বপ্রসিদ্ধ ভৌতিকশাস্ত্রী স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন ব্যক্ত করেছেন - "No amount of experimentation can ever prove me right, a single experiment can prove me wrong."
(Meeting the standards in primary science, Lymn D. Newton, Pg.21)
এই পুস্তকের লেখক পৃষ্ঠ সংখ্যা ২১ অস্ট্রিয়ার দার্শনিক কার্ল পোপারকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন - "...you can never prove or verify a theory, you can only ever disprove it. So investigations and experiments serve the purpose of testing the idea but not to prove it to be true."
এখানেও বর্তমান বিজ্ঞানের অসন্দিগ্ধতার উপর প্রশ্ন চিহ্ন লাগানো হয়েছে। স্টিফেন হকিংয়েরই মিত্র রোজোর পেনরোজেরও মত এটাই, তিনি লিখেছেন - "One might have thought that there is no real danger here because if the direction is wrong the experiment would disprove it, so that some new direction would be forced upon us. This is the traditional picture of how science progresses. But I fear that this is too stringent a criterion and definitely too idealistic a view of science in this modern world of 'Big Science'."
(The Road To Reality, Pg.1020)
এর মানে হল কোনো বৈজ্ঞানিক এমন ভাবতে পারেন যে বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো ধরণের কোনো সংকট নেই অর্থাৎ তার সমস্ত নিষ্কর্ষ সত্যই হয়। তিনি মনে করতে পারেন যে যদি নিষ্কর্ষ ভুল হয়, তাহলে সেটা প্রয়োগ ও পরীক্ষণই অসিদ্ধ করে দিবে আর আরেকটা পৃথক নিষ্কর্ষযুক্ত দিশা প্রাপ্ত হয়ে যাবে। এর উপর লেখক লিখেছেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের এমন বিচার খুবই কট্টর আর আদর্শবাদী হয়।
.
বিজ্ঞানের আবশ্যকতার বিষয়ে এই দুই বৈজ্ঞানিকের কথনের পশ্চাৎ এর গণিতীয় আধারের উপরেও প্রখ্যাত আমেরিকান বৈজ্ঞানিক রিচার্ড পি. ফাইনমেনের বিচারকে আমি উদ্ধৃত করছি - "But mathematical definitions can never work in the real world. A mathematical definition will be good for mathematics, in which all the logic can be followed out completely, but the physical world is complex." (Lectures on Physics, Pg.148)
অর্থাৎ গণিতীয় ব্যাখ্যা কখনও বাস্তবিক সংসারে কাজ করে না। এই ব্যাখ্যা গণিতের জন্য তো ঠিক আছে, সেখানে এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে তর্কের অনুসরণ করে, কিন্তু ভৌতিক সংসার হল খুবই জটিল। এই তিন বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে একমত হয়ে আরও একজন বৈজ্ঞানিক জেমস্ ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বলেছেন - "The true logic of the world is in the calcululs of probabilities." (Lectures on Physics, Pg.64)
এর মানে হল সংসার হচ্ছে বাস্তবে সম্ভাবনার গণিত। ফাইনমেন খুবই স্পষ্ট শব্দে স্বীকার করেছেন যে - "We do not yet known all basic laws. There is an expanding frontier of ignorance."
(Lectures on Physics, Pg.1)
অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞানের মূল সিদ্ধান্তকে জানতে পারে নি। এখন বর্তমান বিজ্ঞানের একটা বিচিত্র লক্ষণ দেখুন। স্টিফেন হকিং তাঁর ওয়েবসাইটের একটা স্থানে লিখেছেন - "One can not ask whether the model represents reality, only whether it works. A model is a good model if first it interprets a wide range of observation, in terms of a simple and elegant model. And second, if the model makes definite predictions that can be tested and possibly falsified by observation."
এখানে হকিংয় স্বয়ং বর্তমান বিজ্ঞানের অপূর্ণতা কিংবা অনেকত্র মিথ্যাকে না কেবল স্বীকার করছেন, অপিতু প্রেক্ষণ দ্বারা মিথ্যা সিদ্ধ হওয়াকে বিজ্ঞানের একটা লক্ষণ বা বিশেষত্বও ঘোষণা করছেন। এমন মিথ্যা সিদ্ধ হওয়া বিজ্ঞান কিভাবে কোনো সত্যপিপাসু বা সত্যব্রতীর জন্য প্রমাণ হতে পারে? আমার মতো বৈদিক বৈজ্ঞানিককে এমন বিজ্ঞানের কাছ থেকে সত্যতার প্রমাণপত্র নেওয়ার আবশ্যকতা হবে কি?
.
এতকিছুর পরেও আমি বলবো যে আমাদের বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত সেই সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা বলে, যাকে বর্তমানের কোনো টেকনোলজি দিয়ে গ্রহণ করতে পারা একদমই সম্ভব নয়। বর্তমান টেকনোলজি ফোটোন ও ইলেক্ট্রনের দ্বারাই কোনো কণার অনুভব করতে পারে, এই কারণে স্বয়ং এই দুই কণাকে জানার কোনো বিধিও বর্তমান ভৌতিকীর কাছে নেই। অথচ আমি এই কণার থেকেও সাত চরণ পূর্বের যে প্রকৃতির (যা সর্বদা অব্যাক্ত) কথা বলেছি তার কথা তো ছেড়ে দিন, এমনকি মনস্তত্ত্ব, প্রাণ, আকাশতত্ত্ব এবং ছন্দ রশ্মিকেও এরদ্বারা গ্রহণ করা সর্বথা অসম্ভব। এর সাথে কিছু প্রয়োগ হতে পারে, তবে তারজন্য অত্যুচ্চস্তরীয় প্রয়োগশালার দরকার হবে। কণার স্তরের অনুসন্ধানের জন্য যখন সর্নের (সি.ই.আই.এন.) মতো বিশ্বের সবথেকে বড় পরীক্ষাগারের আবশ্যকতা হতে পারে, তাহলে এরথেকে সূক্ষ্ম স্তরের জন্য পরীক্ষা কোথায় আর কিভাবে সম্ভব হবে? তবুও উচ্চস্তরীয় প্রয়োগশালার মধ্যে কিছু স্থূল প্রয়োগ হতে পারে, কিন্তু সংসাধন ছাড়া এটা এখন সম্ভব নয়। সংসাধনের উপলব্ধতার আধারে পরবর্তী কালে পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।
.
এখন আসছি একথার উপর যে কিভাবে বিশ্বাস করবেন? এই বিষয়ে আমি বলবো যে যদি এমন কোনো ব্যক্তি যিনি গণিতের খুব কম জ্ঞান রাখেন আর তাকে ত্রিকোণমিতির সূত্র পড়ানো হয়, তাহলে তিনি এটাই ভাববেন যে এইসব সূত্র দিয়ে কি হবে? এই সূত্রের সত্যতা কি আছে? কিন্তু যখন সেই সূত্রের মাধ্যমে আমরা কোনো উড়ন্ত বিমান, বৃক্ষ বা পর্বত শিখরের উচ্চতা বলবো, তখন সেই ব্যক্তি ত্রিকোণমিতি সূত্রের সত্যতার উপর বিশ্বাস করবেন। ঠিক সেইরূপ বীজগণিত, নির্দেশাংক জ্যামিতি আদির বিষয়েও ধরে নিবেন।
এইভাবেই বর্তমান ভৌতিকীর এমন কিছু জটিল সমস্যা, যেগুলোর সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না আর সমাধান করার প্রচেষ্টাতে কয়েক আরব ডলার ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, তবুও সংসারের বৈজ্ঞানিক অসফল হচ্ছেন। যদি আমি আমার বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্ত দিয়ে এমন অসফল হওয়া সমস্যার সমাধান রূপে কোনো মডেল প্রস্তুত করি আর সেই মডেল ওই সমস্যাকে চরণবদ্ধ এবং তার্কিক পদ্ধতিতে সমাধান করে, তখন তো বিশ্বাস হবে। এইভাবে বর্তমান ভৌতিকীর কিছু স্থাপিত সিদ্ধান্ত, যেগুলো সত্য হওয়া সত্ত্বেও তর্কসঙ্গত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করতে পাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা যদি আমি তর্কসঙ্গত পদ্ধতিতে করি, তবেই বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের বিশ্বাস হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, হঠধর্মী আর অজ্ঞানীর অবশ্যই বিশ্বাস হবে না আর এমন ব্যক্তির বিশ্বাসের কোনো গুরুত্বও হয় না।
.
প্রশ্ন - যদি বৈদিক বিজ্ঞানের উপর আপনার এতই বিশ্বাস থাকে, তাহলে আপনি বিজ্ঞানের রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশনার্থ শোধ লিখন কেন লেখেন না? যদি কিছু শোধ পত্র উচ্চস্তরীয় পত্রিকার মধ্যে প্রকাশিত হয়ে যায়, তাহলে আপনার বিজ্ঞান শিক্ষিত জগতে মান্য হয়ে যাবে।
উত্তর - শোধপত্র লেখার হঠ করা হল পশ্চিমী দেশের দাসত্বের পরিচায়ক। আমাদের ভারতীয় বা বৈদিক পরম্পরা কখনও এমন ছিল না। শোধপত্রও লিখতে হবে আর সেটা তাদের মানদণ্ডের অনুসারেই লিখতে হবে, আমার এমন দাসত্ব করার কোনো আবশ্যকতা নেই। আমাদের পরম্পরা শাস্ত্রার্থ-সংবাদ করার ছিল, তার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি, কিন্তু সেই ব্যক্তির সঙ্গে যার বিষয় বৈদিক বিজ্ঞান অথবা বর্তমান বিজ্ঞান হবে। আমাদের আরেকটা পরম্পরা হল - গ্রন্থ লেখার, সেগুলো আমি লিখে দিয়েছি। "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ", "বেদার্থবিজ্ঞানম্" আর এই গ্রন্থটা আপনাদের সকলের সম্মুখে আছে। আমি ৫-১০ পৃষ্ঠার শোধপত্র লেখিনি, বরং কয়েকশ ও হাজার-হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ লিখে দিয়েছি। যাদের মাথায় আসবে তারা পড়ার চেষ্টা করবেন। এই গ্রন্থের এক-একটা পৃষ্ঠাই তো শোধপত্র, এটা আপনি পড়তে পারেন।
.
আমি শোধপত্রের প্রকাশিত হওয়ার কথাকে ভালো করে জানি। পশ্চিমী শৈলী অনুসারে লিখতে হবে, তারাই সেগুলোর পরীক্ষা করবে আর কোনো কারণ না জানিয়ে সেগুলোকে নিরস্ত করারও অধিকারী হবে সেই পশ্চিমী শৈলীর মহানুভাবই। এটা তো সরাসরি আত্মসমর্পণ হল। সেই আধুনিক বৈজ্ঞানিকদেরও এমন লেখা, যেটা কোনো প্রচলিত মান্যতার বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে, এমন প্রকাশনেও অনেক বাধা আসে, তাহলে সেই ব্যক্তির শোধপত্র, যা বর্তমান বিজ্ঞানের ভিত্তিকেই কাঁপাবে তথা প্রাচীন ভারতীয় বা বৈদিক পরম্পরার আধারে লেখা হয়েছে, তাকে কে প্রকাশিত করবে? আছে এমন কোনো বর্তমান বৈজ্ঞানিক যিনি আমাদের সম্পূর্ণ বৈদিক বিজ্ঞান- পরম্পরার মূল্যাঙ্কন করার অধিকারী হবেন, যিনি বিজ্ঞানের বর্ণমালা পর্যন্ত তারা জানেন না? একথাকে কোনো বৌদ্ধিক দাস বা মূর্খই স্বীকার করতে পারবে। বর্তমান পাশ্চাত্য পরম্পরাতে নিষ্ঠাবান শোধকর্তাদেরও কত কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ আমি এখানে প্রস্তুত করছি, সেটা নিচে চিত্রের মধ্যে দেওয়া হলো

সংসারের সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষ হল সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী। অন্য সব প্রাণী যদিও একদমই বুদ্ধিহীন হয় না, তবে তাদের মধ্যে বৌদ্ধিক ক্ষমতার বিকাশ অনেক চেষ্টা করার পরেও অনেক কমই হতে পারে। এটাও এক সত্য যে মানুষ বাদে সকল প্রাণী স্বয়মেব নিজের বৌদ্ধিক বিকাশ করতে প্রায়শঃ সক্ষম হয় না। অন্য কারও দ্বারা তাদের বৌদ্ধিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তারা খুব অধিক বিকশিত হতে পারে না। হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বাঁদর আদি বিভিন্ন প্রজাতির কিছু প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিলে কিছু বৌদ্ধিক বিকাশ হবে অবশ্য, তবে এদের মধ্যে কোনো প্রাণী মানুষের সমান বুদ্ধির বিকাশ করতে পারে না। এই কারণে সারা সংসারের বিভিন্ন বিদ্যার বিস্তার আর সেগুলোর ব্যবহার মানব জাতির দ্বারাই হয় এবং হচ্ছে।
.
বিদ্যার পরিভাষা
বিদ্যাই হল এক এমন গুণ, যা এই মানব জাতিকে অন্য সকল জীবধারিদের থেকে আলাদা এক বিশিষ্ট পরিচয় প্রদান করে। বিদ্যাই হল সেই গুণ, যা সংসারের সমস্ত জড় আর চেতন পদার্থের যথার্থ স্বরূপ বিদিত করায়। একথাও বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে যে কোনো মানুষই সৃষ্টির বিভিন্ন পদার্থের যথার্থ স্বরূপ আর সেগুলোর পরস্পর বাস্তবিক সম্বন্ধকে ঠিক-ঠিক না জেনে সেগুলো থেকে যথাযোগ্য উপকার নিতে পারবে না। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী লিখেছেন - "যার দ্বারা পদার্থের স্বরূপ যথাযথ জেনে তার থেকে উপকার নিয়ে নিজের আর অন্যের জন্য সব সুখকে সিদ্ধ করা যেতে পারে, তাকে বিদ্যা বলে।" (ব্যবহারভানু)
.
বিদ্যা ছাড়া মানবের পরস্পর ন্যায়যুক্ত ব্যবহার হওয়াও সম্ভব নয়, এই কারণে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "যার দ্বারা পদার্থ যথাযথ জেনে ন্যায়যুক্ত কর্ম করা হবে, তাকে বিদ্যা বলে।" (ব্যবহারভানু)
.
ঋষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে বিদ্যার ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক, যারমধ্যে বর্তমান জগতে পড়ানো হয় এমন অনেক বিদ্যা যথা - ভৌতিক বিজ্ঞান এবং এর শাখা, যেমন - খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, পরমাণু ভৌতিকী, নাভিকীয় ভৌতিকী, কণা ভৌতিকী, ভূ-ভৌতিকী, সূর্য বিজ্ঞান, জৈব ভৌতিকী আদি। রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, যেমন - কার্বনিক রসায়ন, অকার্বনিক রসায়ন, ভৌতিক রসায়ন, জৈব রসায়ন আদি, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান, টেকনোলজির বিভিন্ন ক্ষেত্র, অত্যন্ত বিকশিত চিকিৎসা বিজ্ঞান, শরীর রচনা এবং ক্রিয়া বিজ্ঞান, পশু-পক্ষী বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং আবহাওয়া বিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি এবং সমাজশাস্ত্র, ভাষা-বিজ্ঞান, সূচনা টেকনিক, উদ্যোগ-ব্যাপার প্রবন্ধ, যুদ্ধ বিজ্ঞান, সমুদ্র বিজ্ঞান, সঙ্গীত আদি বিভিন্ন উপযোগী কলা মহর্ষির বিদ্যার অন্তর্গত হয়। একথাও মনে রাখতে হবে, এই সব বিদ্যা কেবল জড় পদার্থের সঙ্গেই বিশেষ সম্বন্ধ রাখে, অথচ আমরা জানি যে এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড কেবল জড় পদার্থেরই সংঘাত অর্থাৎ জড়মাত্র নয় আর না এই সমস্ত জড় পদার্থ স্বয়ংয়ের জন্য হয়। না তো এই ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাতা জড় হতে পারে আর না এর উপভোক্তা জড় হতে পারে। তাছাড়া এই বিষয় নিয়ে বিস্তার ভাবে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে জানবো।
.
ঋষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে উপরোক্ত যত বিদ্যা বর্তমানে প্রচলিত আছে, সেগুলো হল বিদ্যার কেবল অর্ধেক ভাগ, অথচ বিদ্যার আরেকটা ভাগ, যার সম্বন্ধ চেতন পদার্থের সঙ্গে সম্বন্ধিত, তারসঙ্গে যেটা ভৌতিক জগতের সূক্ষ্মতম বিজ্ঞান (কণা ভৌতিকী, তরঙ্গ ভৌতিকী, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি এবং স্ট্রিং থিয়োরি) থেকেও সূক্ষ্ম এবং বিশালতম সৃষ্টি বিজ্ঞান থেকেও ব্যাপক হয়, এই দুটো মিলিত হয়ে বিদ্যার স্বরূপ পূর্ণ হয়। এইজন্য ঋষি বিদ্যার পরিভাষা সম্বন্ধে লিখেছেন - "যার দ্বারা ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থের সত্য বিজ্ঞান হয়ে সেগুলো থেকে যথাযোগ্য উপকার নেওয়া যায়, তার নাম হল বিদ্যা।" (আর্য়োদ্দেশ্যরত্নমালা)
বিদ্যা বনাম অবিদ্যা
এই সব বিদ্যার কেবল শব্দ অর্থাৎ সৈদ্ধান্তিক জ্ঞানমাত্রকে মহর্ষি বিদ্যা মানতেন না, বরং এগুলোর উচিত ব্যবহার দ্বারা প্রাণীমাত্রের হিত সিদ্ধ হওয়ার পরেই তাকে বিদ্যার শ্রেণীতে রাখতেন। এরদ্বারা সিদ্ধ হল যে সর্বপ্রথম সমস্ত জগতের শাব্দিক এবং সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান হবে, তারপর সেই জ্ঞানের সত্যতা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রয়োগ, পরীক্ষা এবং প্রেক্ষণ হবে। তারপর সত্য সিদ্ধ হওয়া সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্বহিতের জন্য অনুকূল কিনা, এর সঠিকভাবে পরীক্ষা হবে, তখন সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সংসারের বিদ্যার শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তবেই সেই বিদ্যা সকল জগতের জন্য সুখ আর শান্তিদায়ক হতে পারবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমান সংসার এই যথার্থ বিদ্যা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আজকের প্রচলিত বিদ্যা স্বয়ং পরস্পর বিরোধী হয়ে সংসারে দুঃখ আর অশান্তি উৎপন্ন করছে। একে আমরা এই ভাবে বলতে পারি -
.
সরকারের বিভিন্ন দেশ আর সমাজের মধ্যে আহার-বিহারের বিভিন্ন শ্রেণী এবং সেগুলোকে উৎপন্ন করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান আর টেকনিকের বিকাশ হচ্ছে। সেই খাদ্য পদার্থের গুণবত্তা এবং সরসতার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ করা হচ্ছে। সেগুলোর প্রসংস্করণ এবং সংরক্ষণের জন্য নানা প্রকারের টেকনিকের অনুসন্ধান হচ্ছে। এতকিছু হওয়ার পরেও খাদ্য পদার্থ মানব আদির শরীর, মস্তিষ্ক এবং মনের মধ্যে প্রতিকূল প্রভাব উৎপন্ন করছে। যে খাদ্যকে কোনো এক রোগ বিশেষের দৃষ্টিতে উপযোগী ঘোষণা করা হয়, তো সেই খাদ্য পদার্থই কিছু দিনের অনুসন্ধানের পশ্চাৎ অন্য কোনো রোগকে উৎপন্নকারী সিদ্ধ হয়ে যায়। এইভাবে আগে কোনো পদার্থকে কোনো বিশেষ রোগ বা অঙ্গের দৃষ্টিতে উপযোগী সিদ্ধ করতে যেমন সময়, ধন এবং টেকনিকের ব্যয় করা হচ্ছে, তারপর কিছু বছর পর তেমনই ব্যয় তার দুষ্পরিণামকে খোঁজার জন্য করা হচ্ছে আর পরিণাম শূন্য প্রাপ্ত হচ্ছে।
.
আমরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্ল্যেখযোগ্য প্রগতি করেছি, মানুষের গড় আয়ুতে বৃদ্ধিও হয়েছে, অনেক মহামারীর উপর বিজয় প্রাপ্ত করেছি, কিন্তু এটাও দুর্ভাগ্যপূর্ণ সত্য যে পুঁজিপতিদের ক্রীতদাস হওয়া বৈজ্ঞানিক ও অদূরদর্শী শোধগুলো বিভিন্ন মহামারীকে জন্মও দিয়েছে আর এমন আশঙ্কা প্রবল যে ভবিষ্যতে অধিকাধিক রোগকে জন্ম দেওয়া হবে। জেনেশুনে নপুংসকতা ও বন্ধ্যাত্বের রোগ উৎপন্ন করা হচ্ছে। এছাড়া মানব শারীরিক আর মানসিক বল, প্রসন্নতা, স্মৃতি, মেধা, শান্তি এবং পূর্ণ আরোগ্যতা প্রাপ্ত করেছে কি? সারা সংসারে হতে চলা মাছ-মাংস-ডিমের আহার, মদিরা আদি অভক্ষ্য পানীয়ের ব্যবহার এবং বিষয়-লম্পটতা আদি দোষের কারণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক, সামাজিক স্তর তথা পরিবেশ তন্ত্র ক্ষত-বিক্ষত হয়নি কি? বিভিন্ন কৃষি টেকনিক খাদ্যান্নতে বৃদ্ধি তো করা হয়েছে, কিন্তু এতে সেই খাদ্যের গুণবত্তার ক্ষরণ হয়নি কি?
.
এই গুণবত্তার বৃদ্ধি আদির জন্য উচ্চ জৈব টেকনিকের বিভিন্ন আবিষ্কার কি অনেক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে সমস্যা উৎপন্ন করছে না? বিলাসিতা আদির সংসাধনের উপর হওয়া আবিষ্কার এবং তথাকথিত বিকাশের নামে হওয়া শিল্পায়ন থেকে কুপিত হওয়া পরিবেশ কি বন্যা, খড়া, জল সংকট, ভূমিকম্প, সুনামী, অতি হিমপাত, ওলাবৃষ্টি, অতি উষ্ণতা এবং ভীষণ দাবানলের সমস্যা উৎপন্ন করছে না? মনোরঞ্জনের নামে হওয়া বিবিধ আবিষ্কার এই মানব সমাজের মধ্যে হিংসা, কামুকতা, অশান্তি, অকর্মণ্যতা আদি দোষ উৎপন্ন করে নৈতিকতা, সদাচার, অহিংসা এবং শান্তির মতো সৎ গুণকে কি নষ্ট-ভ্রষ্ট করছে না? বাড়তে থাকা সূচনা টেকনিক অনেক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি অনেক মনোরোগ, অপরাধ, আতংবাদ এবং বিকিরণ প্রদূষণের মতো গম্ভীর সমস্যাকে কি উৎপন্ন করেনি? সূচনা টেকনিকের নেশায় পাগল হাইটেক মানব বিকিরণ প্রদূষণকে গম্ভীরভাবে নিচ্ছে না। আমি মনে করি এই প্রদূষণ সমস্ত ভৌতিক প্রদূষণের থেকে ভয়ানক তথা দীর্ঘকাল পর্যন্ত হানি করে প্রাণীমাত্রের একদিন ভারী সন্ত্রাস করবে। এর থেকেও ভয়ংকর বৈচারিক প্রদূষণ সর্বত্র গভীর দুঃখের সামগ্রী একত্রিত করছে। হিংসা, ক্রূরতা, কামুকতা, ঈর্ষা, শোক, দ্বেষ আদি থেকে উৎপন্ন সূক্ষ্ম তরঙ্গ সম্পূর্ণ প্রাণী জগতের জন্য একদিন অত্যন্ত ঘাতক সিদ্ধ হবে।
.
আজকের পদার্থ বিজ্ঞান যতই প্রগতি করছে, ততই তার টেকনিকের দুষ্প্রভাব অনুভবে আসছে। সেটা সুবিধার মৃগতৃষ্ণাতে অনেক দুবিধাকে আমন্ত্রিত করছে। দুবিধার বোধ তার তখন হয়, যখন সেটা বিলাসী মানুষকে সুবিধার আসক্ত ও অভ্যস্ত বানিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়ভোগী মানব দুবিধা ভোগার জন্য বাধ্য হয়, কারণ সে সুবিধার আসক্তি বা মোহ থেকে স্বয়ংকে মুক্ত করতে পারে না। বর্তমান বিজ্ঞান আসলে সেই চঞ্চল বালকের সমান, যে বালক নিজের কোনো কাজ অল্পজ্ঞানের আধারে কৌতূহলবশতঃ কিংবা কোনো লোভ বা আসক্তিবশতঃ শুরু তো করে দেয়, কিন্তু যখন তার কিছু জ্ঞান হয় যে তার কাজের পরিণাম তো তার জন্য হানিকারক হবে, তখন সেই বালক চাইলেও সেই কাজকে ছাড়তে পারে না। এইরূপ বর্তমান বিজ্ঞানও নিজের অপূর্ণ জ্ঞান এবং সুখ-সুবিধার অসীমিত আসক্তিবশতঃ নিরন্তর নিজেরই বিনাশের জাল বুনে চলেছে।
.
আমি সংসারের সকল আধুনিক বিজ্ঞানবাদীকে সাবধান করে দিচ্ছি যে তারা তাদের দিশা পরিবর্তন করুক, অন্যথা পশ্চাতাপ ছাড়া হাতে কিছুই আসবে না। আজ আমার একথা বিজ্ঞান বুঝবে না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে অবশ্যই আমার এই সাবধান বাণী এই বিজ্ঞানও বুঝবে। সম্পূর্ণ সংসারকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করতে ইচ্ছুক মানব নিজের পরিবার এবং স্বয়ং নিজের আত্মা থেকেও দূর হয়ে যায়নি কি? সংসার কি কখনও এটা বিচার করবে যে এমন কেন হচ্ছে? এত কিছু হওয়ার পরেও আমার এইসব লেখার প্রয়োজন এই নয় যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপরোক্ত বিভিন্ন আবিষ্কার বন্ধ করে দেওয়া হোক। এইভাবে সংসারের আর্থিক আর রাজ ব্যবস্থার কারণে যে অশান্তি, দরিদ্রতা, শোষণ, বর্গ-সংঘর্ষ আদি সমস্যা উৎপন্ন হচ্ছে, তার কারণ হলেও আমি এইসব ব্যবস্থাকেই উপড়ে ছুঁড়ে ফেলার আহ্বান করবো না।
.
আমি জার্মান বিদ্বান এডোল্ফ জাস্টের শব্দে বিজ্ঞানকে বেদম এবং হানিকারক বলে পশু-পাখিকে নিজের গুরু বানিয়ে ঘাস-পাতা বা ভূমিতে শোয়ার কথা বলবো না আর না ফ্রান্সিসি সুধারক রুসোর মতো রাজ-ব্যবস্থাকে সব দুঃখের মূল বলবো, কিন্তু আমি এটুকু অবশ্যই বলবো যে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম্পরাতে একটা খুব বড় ভুল হচ্ছে। বর্তমান জগৎ চেতন তত্ত্বের নিতান্ত উপেক্ষা করে অথবা তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে উপভোক্তাবাদী, অপূর্ণ এবং বিকৃত সভ্যতার বিস্তার করছে। বিদ্যার বিভিন্ন শাখাতে কোনো সমন্বয় আর নিয়মন দেখা যাচ্ছে না। জগতে বেঁচে থাকার প্রয়োজন কেন তা নিয়ে কারও মাথায় কিছুই আসছে না। এর মুখ্য কারণ হল একটাই আর সেটা হল আমাদের সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চেতন তত্ত্বের বিজ্ঞানকে ছাড়া নিতান্ত অপূর্ণ। একই সঙ্গে আমার এটাও দৃঢ় বিশ্বাস যে বর্তমান বিকশিত বিজ্ঞানেরও সৃষ্টির সব জড় পদার্থের পূর্ণ আর নির্ভ্রান্ত জ্ঞান নেই।
.
এখনও সৈদ্ধান্তিক ভৌতিকীকে (থিওরেটিকাল ফিজিক্স) গম্ভীর ও সূক্ষ্মভাবে জানার হেতু যথার্থ প্রচেষ্টা করা হচ্ছে না। মূলকণার উপর অনুসন্ধানের যাত্রা সমাপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। য়োগসাধনাজন্য অন্তর্দৃষ্টির না কেবল সর্বথা অভাব আছে, বরং তার উপর কিঞ্চিৎমাত্র বিশ্বাসও নেই। আহার-বিহার, আচার-বিচারের সাত্ত্বিকতার অভাবে সূক্ষ্মগ্রাহী বুদ্ধির উজ্জ্বল প্রকাশ বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটুকুও নেই। তারা প্রত্যেক কথায় প্রয়োগ ও প্রেক্ষণ কিংবা গণিতীয় ব্যাখ্যার আধারেই জানতে চায়। বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ ও প্রেক্ষণ টেকনিকের সীমার বাইরে অসহায় হয়ে যায়। বিশ্বের মধ্যে একটা বড় সংখ্যার বৈজ্ঞানিক মাছ, মাংস, ডিম, মদ, ধূমপান আদি অভক্ষ্য ও ভ্রষ্ট পদার্থের সেবন করে, এতে তাদের বুদ্ধি কিভাবে সাত্ত্বিক হতে পারে? বুদ্ধিই যদি সাত্ত্বিক না হয়, তাহলে তারা জড় ও চেতনের মতো সূক্ষ্ম পদার্থের গম্ভীর ও বিস্তৃত বিবেচনা কিভাবে করতে পারবে? এই কারণে তাদের বিজ্ঞান শুধু চেতন তত্ত্ব কেন, জড় পদার্থ যেমন - মন, প্রাণ, ছন্দ আদি সূক্ষ্ম তত্ত্ব, যেগুলো মূল কণা, ঊর্জা আদিরও মূল কারণ, তার বিষয়ে এতটুকুও বিচার করতে পাচ্ছে না, পরিণামস্বরূপ তাদের সৃষ্টি বিজ্ঞান অপূর্ণ আছে। ঈশ্বর ও জীবাত্মার অস্তিত্বের তো তাদের বিশ্বাসই নেই।
.
এটা স্বাভাবিক কথা যে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কোনো পদার্থের যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই পদার্থের উচিত ব্যবহার কিভাবে করতে পারবো? এইভাবে এটাও সত্য যে যতক্ষণ পর্যন্ত উপভোক্তা মানব স্বয়ং নিজের চেতন স্বরূপের যথার্থ বোধ করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত উপভোগ্য বস্তুর ভোগ তথা জীবন যাপনের প্রয়োজন কিভাবে বুঝবে? সেইরূপ সৃষ্টি বিজ্ঞানকে জানার সময় যতক্ষণ পর্যন্ত মূল নিমিত্ত তত্ত্ব, যা হল সৃষ্টির স্রষ্টা ও নিয়ামক, সেই চেতন পরমাত্মাতত্ত্বের অস্তিত্বের আবশ্যকতা এবং তাঁর যথার্থ স্বরূপের উপর বিচার করা হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত জগৎ রচনার প্রয়োজন এবং বিভিন্ন জীবধারীর পরস্পর সম্বন্ধ এবং উচিত ব্যবহারের যথার্থ বোধ কিভাবে হতে পারে?
.
প্রশ্ন - ঈশ্বর আর জীবাত্মার মতো রূঢ়িবাদী নষ্টপ্রায় মান্যতার সাথে কোনো যথার্থ জ্ঞান-বিজ্ঞান পরম্পরার কি এমন সম্বন্ধ হতে পারে? আপনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলছেন অথচ এই একুশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক যুগে রূঢ়িবাদী অন্ধ পরম্পরাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মিথ্যা চাদর জড়িয়ে এই দেশ আর সংসারকে সেই আদিম আর পাষাণ যুগে নিয়ে যেতে চাইছেন। আপনি কি জানেন না যে এই ভারত আর বিশ্বের মধ্যে ঈশ্বর, জীব এবং ধর্ম আদি অন্ধ পরম্পরার নামে কত রক্ত বয়েছে, মানুষ-মানুষের মধ্যে প্রাচীর দাঁড় করানো হয়েছে, বিকাশের পথে অবরোধ করা হয়েছে? বিদ্যার বাস্তবিক আর সমগ্র দৃষ্টি কি এটাই?
.
উত্তর - আপনার এই প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক আর সাময়িক। এই ধরণের প্রশ্নের জন্য আমি আপনার মতো মহানুভাবকে দোষী মনে করি না, বরং আমি সেই মহানুভাবদের দোষী মনে করি, যারা ঈশ্বর, ধর্ম, পুনর্জন্ম আর জীবাত্মার মতো বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা-লেখন তো খুব করেন, উপাসনা, ভক্তি, পূজা আদি ভিন্ন-ভিন্ন বিধি প্রচলিত করেন, কিন্তু সেই মহানুভাব না কেবল সৃষ্টি বিদ্যার বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান আদি শাখাকে পূর্ণতঃ ভুলে গেছেন, অপিতু যে ধর্ম, ঈশ্বর, জীব আদির কথা বলেন এবং এতদ্ বিষয়ক অনেক গ্রন্থ লিখেছেন ও পড়েছেন, সেগুলোর যথার্থ স্বরূপ থেকেও অতি দূরে চলে গেছেন। এটা স্মরণীয় তথ্য যে বিদ্যা মানুষ মাত্রের প্রত্যেক সমস্যার সমাধান হয়, যেকোনো রোগের ওষুধ আছে, কিন্তু যেরূপ অপূর্ণ অথবা বিপরীত ওষুধ রোগীর প্রাণ নিতে পারে, সেইরূপ অপূর্ণ বিদ্যা অথবা বিপরীত জ্ঞান সংসারের মধ্যে সমস্যাই উৎপন্ন করে। সুতরাং যেরূপ একাকী বর্তমান বিজ্ঞান বিশ্বের মধ্যে উপরোক্ত বর্ণিত সমস্যাকে উৎপন্ন করেছে, সেইরূপ কিছু হাজার বছর পূর্ব থেকে ভারত এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে ধর্ম, ঈশ্বর, জীবাত্মা এবং পুনর্জন্মের মতো গম্ভীর বিষয় নিয়ে যথার্থ সঠিক জ্ঞানের স্থানে কল্পনা আর অন্ধবিশ্বাস এই মানব জাতিকে অনেকবিধ দুঃখসাগরে ডুবানোর কাজ করেছে।
.
বর্তমানে প্রচলিত ভাষাতে জড় পদার্থের জ্ঞানকে বিজ্ঞান (সাইন্স) এবং চেতন তত্ত্বের বিজ্ঞানকে ধর্ম বলা হয়। বস্তুতঃ এই দুটো একে-অপরের পূরক। এই জন্য দয়ানন্দের বিদ্যার পরিভাষাতে এই দুটোরই সুন্দর সমাবেশ আছে। মহান আধুনিক বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনও বলেছেন -
"Science without religion is lame, religion without Science is blind."
অর্থাৎ ধর্ম হীন বিজ্ঞান পঙ্গু হয় আর বিজ্ঞান হীন ধর্ম অন্ধ হয়।
"I am of the opinion that all the finer speculations in the realm of science spring from a deep religious feeling."
(মদ্রচিত "সৃষ্টির মূল উপাদান কারণ" পুস্তকের প্রস্তাবনাতে প্রফেসর আভাস কুমার মিত্রা দ্বারা উদ্ধৃত বচন।)
.
অর্থাৎ আমার মতে বিজ্ঞানের সমাজ্যের সুন্দর বিচার গম্ভীর আধ্যাত্মিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থাকে অথবা সেগুলো থেকেই উৎপন্ন হয়।
.
এখানে একথা মনে রাখতে হবে যে ইংরেজি ভাষার "রিলিজিয়ন" শব্দ "ধর্ম" শব্দের সমান নয়। এই শব্দ সম্প্রদায়কেই ব্যক্ত করে। "ধর্ম" শব্দের সমানার্থক ইংরাজি ভাষাতে কোনো শব্দ নেই। এই জন্য একে ধর্মই বলা উচিত, সেটা যে ভাষাতেই হোক বা কেন।
.
ঋষি দয়ানন্দ বিদ্যা (বিজ্ঞান) এবং ধর্মের আবশ্যক সম্বন্ধকে দর্শানোর জন্য লিখেছেন - "অবিদ্বান ব্যক্তি অপরকে ধর্মের মধ্যে নিশ্চিত করাতে পারে না আর বিদ্বান ব্যক্তি ধার্মিক হয়ে অনেক মানুষকেও ধার্মিক করতে পারে আর কোনো ধূর্ত মানুষ অবিদ্বানকে ফুসলিয়ে অধর্মে প্রবৃত্ত করতে পারে, কিন্তু বিদ্বানকে অধর্ম পথে কখনও চালাতে পারে না, কারণ যে ব্যক্তি চোখে দেখে সে কখনও কুয়োতে পরে না, কিন্তু অন্ধ ব্যক্তির তো পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাছাড়া বিদ্বান ব্যক্তি সত্যাসত্যকে জেনে তাতে নিশ্চিত থাকতে পারে আর অবিদ্বান ব্যক্তি ঠিক-ঠিকভাবে স্থির থাকতে পারে না।" (ব্যবহারভানু)
.
"ধর্মের রক্ষক বিদ্যাই হয়, কারণ বিদ্যার দ্বারাই ধর্ম আর অধর্মের বোধ হয়। সেখান থেকে হিতাহিতের বোধ হয়, অন্যথা নয়।" (ঋষি দয়ানন্দের পত্র আর বিজ্ঞাপন - দয়ানন্দ-বিচার-কোষ, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ৩ থেকে উদ্ধৃত)
প্রাচীন আর্যাবর্তে (ভারত) বিদ্যা-বিজ্ঞানের ব্যাপকতা
প্রাচীন বৈদিক ভারতে বিদ্যার সমগ্র স্বরূপের প্রচলন ছিল। এইজন্য একবার দেবর্ষি নারদ মহর্ষি সনৎকুমারের নিকট গিয়ে বললেন -
"ঋগ্বেদম্ ভগবোऽধ্যেমি য়জুর্বেদম্ সামবেদমাথর্বণম্ চতুর্থমিতিহাসপুরাণম্ পঞ্চমম্ বেদানাম্ বেদম্ পিত্র্যঁ রাশিম্ দৈবম্ নিধিম্ বাকোবাক্যমেকায়নম্ দেববিদ্যাম্ ব্রহ্মবিদ্যাম্ ভূতবিদ্যাম্ ক্ষত্রবিদ্যাম্ নক্ষত্রবিদ্যাঁ সর্পদেবজনবিদ্যামেতদ্ভগবোऽধ্যেমি।।"
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭.১.২, ডাক্তার সত্যব্রত সিদ্ধান্তলঙ্কার ভাষ্য)
.
অর্থাৎ [নারদ] বললেন (ঋগ্বেদম্) ঋগ্বেদ (ভগবঃ) হে ভগবন্ (অধ্যেমি) অধ্যয়ন করি বা করেছি (য়জুর্বেদম্) য়জুর্বেদ (সামবেদম্) সামবেদ (আথর্বণম্) অথর্ববেদ (চতুর্থম্) চতুর্থ (ইতিহাসপুরাণম্) ইতিহাস-পুরাণ (পঞ্চমম্) পঞ্চম (বেদানাম্) বেদের (বেদম্) বেদ [জ্ঞান কারক জ্ঞাপক অর্থাৎ ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, শিক্ষা, কল্প আদি] (পিত্র্যম্) পিতৃ কর্ম [পিতৃ-শুশ্রূষা শাস্ত্র অর্থাৎ গৃহ বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, কৃষি বিজ্ঞান আদি] (রাশিম্) গণিত শাস্ত্র (দৈবম্) আবহাওয়া বিজ্ঞান, বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রকোপ আদি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান এবং কর্মফল ব্যবস্থা (নিধিম্) অর্থশাস্ত্র (বাকোবাক্যম্) তর্কশাস্ত্র এবং বিধিশাস্ত্র (একায়নম্) নীতিশাস্ত্র (দেববিদ্যাম্) সমস্ত প্রকাশিত সূক্ষ্ম পদার্থের বিজ্ঞান এবং বেদমন্ত্রের বিভিন্ন দেবতার বিজ্ঞান (ব্রহ্মবিদ্যাম্) বিদ্যুৎ বিদ্যা, মন-বাক্ তত্ত্ব আদির বিজ্ঞান এবং পরমাত্মতত্ত্ব বিজ্ঞান (ভূতবিদ্যাম্) ভৌতিকী, রসায়ন বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান, ভূগর্ভশাস্ত্র আদি (ক্ষত্রবিদ্যাম্) যুদ্ধ এবং অস্ত্র-শস্ত্র বিদ্যা (নক্ষত্রবিদ্যাম্) খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, সূর্য এবং নক্ষত্রের বিজ্ঞান (সর্পদেবজনবিদ্যাম্) পৃথিবীর সরীসৃপ সব প্রাণী এবং বন্য প্রাণীর বিজ্ঞান, শিল্পশাস্ত্র অর্থাৎ টেকনোলজি এবং গণিত আদি ললিত বিদ্যা আদি (এতদ্) এই সবের (ভগবঃ) হে ভগবন্ (অধ্যেমি) অধ্যয়ন করছি (অধ্যয়ন করেছি)।
.
কিন্তু -
.
সোऽহম্ ভগবো মন্ত্রবিদেবাস্মি নাত্মবিচ্ছ্রুতঁ হ্যেব মে ভগবদ্দৃশেভ্যস্তরতি শোকমাত্মবিদিতি। সোऽহম্ ভগবঃ শোচামি তম্ মা ভগবাচ্ছোকস্য পারম্ তারয়ত্বিতি। তঁ হোবাচ য়দ্বৈ কিম্চৈতদধ্যগীষ্ঠা নামৈবৈতৎ।।৩।।
(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭.১.৩)
.
অর্থাৎ (সঃ অহম্) সেই আমি অর্থাৎ বেদাদি শাস্ত্রের জ্ঞাতা হয়েও (ভগবঃ) হে ভগবন্! (মন্ত্রবিত্+এব) কেবল মন্ত্রবেত্তাই (অস্মি) আছি অর্থাৎ পাঠকমাত্র আছি (আত্মবিত্ ন) ব্রহ্মবিত্ নই (হি) কারণ (ভগবদ্দৃশ্যেভ্যঃ) আপনার সমান তত্ত্ববেত্তাদের থেকে (মে) আমি (শ্রুতমেব) শুনেছি যে (আত্মবিত্) ব্রহ্মবিত্ (শোকম্ তরতি) শোককে পার করে যান অর্থাৎ শোক করেন না, (ইতি) কিন্তু (ভগবঃ) হে ভগবন্! (সোऽহম্) আমি তো (শোচামি) শোক করছি, সুতরাং আমি আত্মবিত্ নই (তম্) শোকগ্রস্থ (মা) আমাকে (ভগবান্) আপনি (শোকস্য পারম্) শোককে পার (তারয়তু) করে দিন (ইতি) এটাই আমার প্রার্থনা। (তম্ হ উবাচ) তখন প্রসিদ্ধ সনৎকুমার সেই নারদকে বললেন যে (য়ৎকিঞ্চ) যাকিছু (এতত্) পূর্বোক্ত বিজ্ঞানের (বৈ) নিশ্চয় (অধ্যগীষ্ঠাঃ) আপনি অধ্যয়ন করেছেন (এতত্ নামৈব) সেগুলো কেবল নামমাত্র।
(ভাষ্য - পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্মা "কাব্যতীর্থ")
.
পাঠকগণ এখানে ভাবুন যে দেবর্ষি নারদের অধ্যয়ন কত বিশাল ছিল। একা কোনো ব্যক্তি এতগুলো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হতে পারে, এইরূপ কল্পনা করাও অতি কঠিন হবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আর্যাবর্ত (ভারতবর্ষ) অথবা বিশ্ব ভগবান্ নারদ আদি মহাপুরুষদের যথার্থ চরিত্রকে বিস্মৃত করে ফেলেছে। এখন একটু এই পক্ষের উপর বিচার করে দেখুন যে সম্পূর্ণ জড় আর চেতন জগতের বিস্তৃত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও দেবর্ষি নারদ কেন শোকমগ্ন ছিলেন? তিনি কোন জ্ঞান-পিপাসার জন্য মহর্ষি সনৎকুমারের শ্রী চরণে উপস্থিত হয়েছিলেন?
.
একথার উত্তর তিনি স্বয়ং দিয়েছেন যে আমি হলাম মন্ত্রবিত্, আত্মবিত্ নই অর্থাৎ উপরোক্ত সব বিদ্যার বিস্তৃত সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান তো তাঁর ছিল। শিল্প শাস্ত্র অর্থাৎ টেকনিকের বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে তিনি সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যার প্রয়োগাত্মক জ্ঞানীও ছিলেন। জ্ঞাতব্য হল, তিনি অনেক বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন, যিনি বিভিন্ন লোকের যাত্রা করতেন। তিনি অনেক তারার যাত্রাও করতেন। ঈশ্বর আর জীব উভয় চেতন তত্ত্বের গভীর মনন-চিন্তনও করেছিলেন, কিন্তু এই চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার করে তিনি সেই সময় পর্যন্ত জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করতে পারেন নি আর এটাই একমাত্র তাঁর শোকের কারণ ছিল।এই বিষয়ে দুটো কথা গম্ভীর রূপে বিচারণীয় -
১. সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ঈশ্বর জীবের পূর্ণ সৈদ্ধান্তিক জ্ঞান ছাড়া চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার সম্ভব নয়। এই কারণে ভগবান্ নারদ সংসারের বিবিধ বিদ্যার অধ্যয়ন আগে করে ছিলেন আর তাঁর গুরুজনও এইটুকু বিদ্যার অধ্যয়ন তাঁকে করিয়েছিলেন। যদি ঈশ্বর এবং আত্মা সাক্ষাৎকারের জন্য এইসব বিদ্যা অনাবশ্যক হতো, তাহলে সেই মহান বৈদিক কালে এবং সেই মহান দেব সমাজের মহান ঋষি মহানুভাব নারদের মতো মহান ব্যক্তিকে এতগুলো বিদ্যা পড়ানোর পুরুষার্থ করতেন না। এই বিষয়ে সেইসব মহানুভাবকে গম্ভীরতাপূর্বক বিচার করা উচিত, যারা পদার্থ বিজ্ঞান এবং লোকব্যবহারের বিদ্যাকে নিতান্ত উপেক্ষা করে কেবল ঈশ্বর আর মুক্তির কথা বলে। তো কোনো-কোনো মহানুভাব মুহূর্তের মধ্যে সমাধি প্রাপ্ত করানোর দাবি করে। বস্তুতঃ এমন মহানুভাব হল বৈদিক আর্ষ পরম্পরা এবং এর এক অঙ্গ পাতঞ্জল য়োগশাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্ত অনভিজ্ঞ।
.
প্রশ্ন - আপনার অনুসারে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য যদি এত জ্ঞান-বিজ্ঞান আবশ্যক হয় তথা এর পশ্চাৎই ঈশ্বর সাক্ষাৎকারের উপায় করা হয়, তাহলে তো কোনো মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করতেই পারবে না, কারণ না তো মহর্ষি নারদের মতো জ্ঞান হবে আর না কেউ আত্ম সাক্ষাৎকারের চেষ্টা করবে।
.
উত্তর - আমার উপরোক্ত কথনের তাৎপর্য এই নয় যে উপরোক্ত পদার্থ বিদ্যা অথবা চেতন বিদ্যার অধ্যয়ন করার সময় ঈশ্বরের উপাসনা না করা হোক। আমাদের বৈদিক সংস্কৃতির মধ্যে তো বাচ্চা জন্ম হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শিশুর পিতা স্বর্ণ শলাকা দিয়ে মধুর সঙ্গে শিশুর জিহ্বাতে "ওম্" লিখে দেয়। তার প্রয়োজন হল এটাই যে শিশু জীবনে মধুরত্ত্বের জন্য সংসারে তার মধুর ব্যবহার দ্বারা মধুরত্ত্ব ভরে দিবে তথা মধু উত্তম স্বাস্থ্যবর্ধক হওয়ার কারণে সেই শিশু আয়ুর্বিজ্ঞান, আহার শাস্ত্র এবং শরীরোপয়োগী বিভিন্ন বিদ্যার জ্ঞাতা হয়ে উত্তম বল, বুদ্ধি, পরাক্রম, প্রজ্ঞা আর দীর্ঘায়ু যুক্ত হয়ে সারা সংসারকে নিজের সমানই গুণ দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করবে এবং সুবর্ণ আদি রত্ন দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে বিভিন্ন লোকোপয়োগী বিদ্যার দ্বারা সংসারকে সুখী-সমৃদ্ধ করার চেষ্টা সর্বদা করবে।
.
একথা বিশেষ বিচারণীয় যে এমন ব্যাপক উদার ভাবনা কোনো ব্যক্তির মধ্যে তখনই আসবে, যখন সে সম্পূর্ণ সংসারকে নিজেরই পরিবার মনে করবে আর নিজের পরিবার তখনই হবে, যখন তাকে উৎপন্ন কারী পিতা একটাই হবে। এইজন্য সেই শিশুর জিহ্বাতে "ওম্" শব্দ লেখা হয়। এটা একথার সংকেত করে যে হে বালক! এই পরমাত্মাই হল এই সম্পূর্ণ জগতের মাতা এবং পিতা অথবা চেতন পরমাত্মাই হল সবার পিতা আর জড় প্রকৃতি হল সবার মাতা। এই কারণে সংসারের সব প্রাণী হল এক পরিবারের সদস্য। এখানে একথা উল্লেখনীয় যে প্রকৃতিকে মাতা তো বলা হয়েছে, কিন্তু পিতা কোথাও বলা হয়নি। অথচ পরমাত্মাকে মাতা এবং পিতা উভয় নামে সম্বোধন করা হয়েছে, যেমন -
ত্বম্ হি নঃ পিতা বসো ত্বম্ মাতা শতক্রতো বভূবিথ।
অথা তে সুম্নমীমহে।। ১১।। (ঋগ্বেদ ৮.৯৮.১১, সামবেদ ১১৭০, অথর্ববেদ ২০.১০৮.২)
.
এইজন্য তিনিই হলেন সর্বোপরী উপাস্য দেব এবং তাঁরই মুখ্য ও নিজ নাম হল "ওম্"। এই কারণে শিশুকে না কেবল এমন শিক্ষা দেওয়া হয় যে সংসার হল পরমাত্মার পরিবার, অপিতু সেই পরমাত্মাই হল আমাদের পরমধাম, এই সংকেতও করা হয়।
.
এইজন্য পাতঞ্জল য়োগের বিভিন্ন অঙ্গের সাধনা করার পাশাপাশি বাল্যাবস্থা থেকেই ঈশ্বর উপাসনা প্রত্যেকটা শিশুর সর্বোপরি ধর্ম হওয়া উচিত। ঈশ্বর উপাসনা এবং ব্রহ্মচর্য-প্রাণায়াম আদি তপের দ্বারা বিদ্যার্থী মহতী প্রজ্ঞাকে প্রাপ্ত করে বিভিন্ন পদার্থ বিদ্যার গম্ভীর রহস্য এবং আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানকেও জানতে অপেক্ষাকৃত সক্ষম হবে আর এমনি করেই দেবর্ষি নারদ উপরিবর্ণিত বিদ্যার মহান বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছিলেন। এইজন্য যেকোনো অধ্যাত্মবেত্তার জন্য পদার্থ বিদ্যার উপেক্ষা ও নিন্দা মোটেও উচিত মানা সম্ভব নয়, বরং পদার্থ বিদ্যা হল প্রত্যেক অধ্যাত্মবেত্তার জন্য অনিবার্য বিষয়। এটা খুবই সাধারণ কথা যে কার্যকে না দেখে কোনো কর্তার অনুমান কিভাবে সম্ভব হবে আর যদি তাঁর অস্তিত্বের অনুমানও না হয়, তাহলে তাঁর স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান আর তাঁর প্রাপ্তির তো কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
.
২. সমস্ত সৃষ্টিকে জানার পশ্চাৎ তথা ঈশ্বর-জীবাত্মা বিষয়ক বিভিন্ন বেদাদি শাস্ত্রকে গম্ভীরভাবে পড়ার পরও ঈশ্বর-আত্মার সাক্ষাৎকার না করে কিংবা জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত না করে পূর্ণ বিশোক অবস্থাকে প্রাপ্ত করা সম্ভব নয়, এই অবস্থাকে মুক্তিও বলে। আমার দৃষ্টিতে দেবর্ষি নারদ মহর্ষি সনৎকুমারের কাছে আসার পূর্বে আত্মা অথবা ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার করেন নি, এমন মোটেও সম্ভব বলে মনে হয় না। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি না হয়ে এত বিশাল আর গভীর অধ্যয়ন করা যেকোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় আর মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি তিনিই হবেন, যিনি ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার করেছেন। বর্তমানে কোনো আধ্যাত্মিক আর প্রতিভাশালী বিদ্বান দ্বারা বেদার্থ করা আলাদা বিষয় হবে আর সেই মহান যুগে দেবর্ষি নারদ দ্বারা স্বয়ংকে মন্ত্রবিত্ বলাটা অনেক উচ্চ বিষয় হবে। আমার দৃষ্টিতে "মন্ত্রবিত্" এর অর্থ কেবল পাঠকমাত্র নয়, বরং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির স্তর প্রাপ্ত করে নেওয়া হবে। আমি বিভিন্ন বিদ্বান দ্বারা মন্ত্রবিত্ শব্দের অর্থ "পাঠক মাত্র" বলার পক্ষে সহমত নই।
.
যদি মন্ত্রবিতের অর্থ ঋষি হয়, তবে কি ঋষিও শোকাকুল এবং অপূর্ণবিদ্য হন, তাহলে তো তাদের আর সামান্য মানুষের মধ্যে ভেদ কি রইলো?
.
উত্তর - সংসারে সর্বথা পূর্ণপুরুষ তো কেবল পরমাত্মাই হতে পারবে আর জীবাত্মার স্তরে পূর্ণ শোকরহিত এবং সমস্ত জ্ঞেয়ের জ্ঞাতা কেবল মুক্তাত্মা এবং জীবনমুক্ত পুরুষই হতে পারবে। অন্য স্তরে একটু-আধটু অল্পমাত্রায় হলেও শোক-দুঃখ আসবেই আর এমন অবস্থাই সেই সময় দেবর্ষি নারদের ছিল। এটাও মনে রাখতে হবে যে এই স্তরের মহাপুরুষ এবং অন্য স্তরের মানুষের সুখ-দুঃখ ও শোক-আনন্দের মধ্যে অনেক ভেদ আছে।
.
দেবর্ষি নারদ সেই সময় যে আত্মবিত্ না হওয়ার কথা বলেছেন, তার মানে এই যে তিনি মুক্তির কামনা হেতু জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করার জন্য ঈশ্বরের সাক্ষাৎকারকে সুদৃঢ় করতে তথা নিজের সব সংস্কারকে দগ্ধবীজ করার অভ্যাসের জন্য জীবনমুক্ত অবস্থাকে প্রাপ্ত করা সদ্গুরু মহর্ষি সনৎকুমারের শরণে এসেছিলেন। এইভাবে এতে এই নিষ্কর্ষ বের হয় যে সম্পূর্ণ পদার্থ বিদ্যার জ্ঞাতা বৈজ্ঞানিক ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ সুখ প্রাপ্ত করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা চেতন তত্ত্বের সাক্ষাৎকার করে তার যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত না করছেন। সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান হল একটা সুন্দর মালার সমান। সংসারের সব পদার্থ বিদ্যা সেই মালার সুন্দর মোতির সমান আর সেই মোতিকে পরস্পর জুড়ে রাখার সুতো হল চেতনতত্ত্ব বিজ্ঞান। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সুতো হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মোতি পরস্পর জুড়ে সৌন্দর্য প্রাপ্ত করতে পারবে না। এইভাবে আধ্যাত্ম বিজ্ঞান ছাড়া পদার্থ বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখা মানব সমাজ অথবা প্রাণীমাত্রকে কক্ষনো সুখ-শান্তি দিতে পারবে না। তারমধ্যে সংঘর্ষ এবং বিরোধ ভাব হবেই, যার ফলে সুখ-সুবিধার বিভিন্ন বিস্তার থাকা সত্ত্বেও মানব সমাজ সুখী আর আনন্দিত হতে পারবে না, আর তখন প্রাণীমাত্রের কথা তো কি বলবো? দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সংসারে এই সবকিছু হচ্ছে। সুখ-সুবিধার সংসাধনের ভীড়ে সুখ, শান্তি, প্রেম, মৈত্রী, করুণার মতো মানবীয় গুণ কোথাও হারিয়ে গেছে। কোনো মালার সুতো না কেবল সেই মোতির আধার প্রদান করে, বরং তাকে ব্যবস্থিত ক্রম প্রদান করে সুন্দর আর উপযোগীও করে তোলে।
.
এইভাবে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান বিভিন্ন বিদ্যাকে পরস্পর একে-অপরের সঙ্গে জুড়ে আর সেগুলোকে পরস্পর পূরক বানিয়ে প্রাণীমাত্রের জন্য উপযোগীও করে দেয়। তখন যেমন নিরাপদ এবং আবশ্যক টেকনিকের বিকাশ হয়ে পরিকেশও সুন্দর আর সুরক্ষিত হয়, তেমনি মানুষের মধ্যে গলাকাট প্রতিস্পর্ধা না হয়ে পরস্পর প্রীতি আর শান্তিও বজায় থাকে। তিন প্রকারের দুঃখ অর্থাৎ শারীরিক আর মানসিক দুঃখ, প্রাকৃতিক প্রকোপ আদি থেকে উৎপন্ন দুঃখ এবং প্রাণীদের পারস্পরিক সংঘর্ষজন্য দুঃখ কাউকেই পীড়িত করে না। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন পদার্থ বিদ্যা এবং ব্যবহারিক জ্ঞানকে পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কেবল আধ্যাত্মিক কথা বলে এমন মহানুভাব কোনো সুন্দর মালা রূপ সামাজিক ব্যবস্থার কল্পনার থেকেও অতি দূর এক সুতোর সমান এমনি নীরস ব্যবস্থাকে উৎপন্নকারী হয়, সেখানে তাদের পরমাত্মা অথবা মুক্তির প্রাপ্তি তো কি আর হতে পারে, বরং তারা নিজেদের উদরপোষণেও সক্ষম না হয়ে নিতান্ত দুঃখী আর অভিশপ্ত জীবন যাপন করে। এইজন্য য়জুর্বেদের মধ্যে বলা হয়েছে -
অন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তি য়েऽবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয়ऽইব তে তমো য়ऽউ বিদ্যায়াঁ রতাঃ।। (য়জুর্বেদ ৪০.১২)
অর্থাৎ যে সকল মানুষ কেবল পদার্থ বিজ্ঞানের মধ্যে রত থাকেন, তারা দুঃখসাগর রূপ অন্ধকারে ডুবে যান আর যে সকল মানুষ পদার্থ বিদ্যার নিতান্ত উপেক্ষা করে কেবল অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের মধ্যেই রত থাকতে চান, তারা আরও অধিক গভীর অন্ধকারে ডুবে যান। এর কারণ পাঠক উপরে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন। তাহলে মানুষ পূর্ণ সুখী কিভাবে হতে পারবে? এর উত্তরে বেদ পুনরায় বলেছে -
.
বিদ্যাম্ চাবিদ্যাম্ চ য়স্তদ্বেদোভয়ঁ সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুম্ তীর্ত্বা বিদ্যয়াऽমৃতমশ্নুতে।।
(য়জুর্বেদ ৪০.১৪)
অর্থাৎ যে সকল মানুষ পদার্থ এবং আধ্যাত্মিক উভয় বিদ্যাকে জানেন, তারা পদার্থ বিদ্যার সমুচিত আর সর্বহিতকারী উপয়োগ দ্বারা তথা শরীর আর জগতের নশ্বর হওয়ার জ্ঞান দ্বারা মৃত্যু-ভয় এবং অন্য সমস্ত দুঃখকে অতিক্রম করে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের দ্বারা জীবনমুক্ত কিংবা মুক্তিরূপ পরমানন্দকে প্রাপ্ত করবেন।
.
এইভাবে সংসারে বিদ্যার বিভিন্নতা, ব্যাপকতা আর সেগুলোর সমন্বিত, সুষম আর উপযুক্ত ব্যবহার দ্বারা মানব স্বয়ং সর্ববিধ দুঃখকে সাঁতরে পার করে অন্য সকল প্রাণীদের সুখ দিতে সক্ষম হয়। বিদ্যার উপযোগিতা হল এটাই।
.
পূর্ব অধ্যায়ে আমরা যে বিভিন্ন বিদ্যার চর্চা করেছি, সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে -
১.যে পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ হয় অর্থাৎ যার মিশ্রণের কারণে এই সকল সৃষ্টি তৈরি হয়েছে।
২. যে পদার্থ এই সৃষ্টির উপাদান কারণ না হয়ে নিমিত্ত কারণ মাত্র হয়।
.
এগুলোর মধ্যে প্রথম প্রকারের পদার্থ জড় হয় তথা দ্বিতীয় প্রকারের পদার্থ কিছুটা জড় তথা কিছুটা চেতন হয়। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী "আর্য়োদ্দেশ্যরত্নমালা" পুস্তকে সৃষ্টির পরিভাষা নিয়ে লিখেছেন - "যা কর্তার রচনা করে কারণ দ্রব্য কোনো সংযোগ বিশেষ দ্বারা অনেক প্রকার কার্যরূপ হয়ে বর্তমানে ব্যবহার করার যোগ্য হয়, তাকে সৃষ্টি বলে।"
.
"স্বমন্তব্যামন্তব্যপ্রকাশ" এরমধ্যে পুনরায় ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "সৃষ্টি তাকে বলে যা পৃথক দ্রব্যের জ্ঞান যুক্তিপূর্বক মিলিত হয়ে বিভিন্নরূপ হয়।"
.
এই দুই পরিভাষার উপর বিচার করলে নিম্ন লিখিত নিষ্কর্ষ প্রাপ্ত হয় -
১. সৃষ্টির পদার্থকে মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। তার যথার্থ জ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারবে। যথার্থ বিজ্ঞান ছাড়া কোনো পদার্থকে উচিত ব্যবহারে নিয়ে আসা সম্ভব নয়, এইজন্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের যথার্থতা মানব জাতির জন্য অনিবার্য। সৃষ্টি নিকৃষ্ট নয়, বরং ব্যবহারে নিয়ে এসে সকলের উপকারের জন্যই হয়। সৃষ্টির সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম ও স্থূল থেকে স্থূল পদার্থ অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা আর তার থেকেও সূক্ষ্ম প্রাণাদি পদার্থ থেকে শুরু করে বিশাল লোক-লোকান্ত পর্যন্ত সবকিছুর যথার্থ বিজ্ঞানের সাক্ষাৎ করে তাকে সর্বহিতার্থ ব্যবহার করা উচিত। সৃষ্টির প্রয়োজন হল এটাই।
২. সৃষ্টি কোনো কারণ পদার্থ থেকে তৈরি হয়েছে। সেই কারণ পদার্থ হল অনাদি ও অনন্ত। সেই কারণ পদার্থ না কখনও তৈরি হয় আর না কখনও নষ্ট হয়। সেই পদার্থের ভাব সর্বদা থাকে, সেটা শূন্য অর্থাৎ অবস্তু নয়, যেমনটা মহান তত্ত্ববেত্তা মহর্ষি কপিল বলেছেন -
"নাবস্তুনো বস্তুসিদ্ধিঃ" (সাংখ্য দর্শন ১.৭৮)
অর্থাৎ অভাব থেকে ভাবের উৎপত্তি হওয়া সম্ভব নয়।
এটাই য়োগেশ্বর মহান বেদবিজ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। (গীতা ২.১৬)
অর্থাৎ অসৎ বস্তুর কখনও ভাব হয় না, সৎ বস্তুর কখনও বিনাশ হয় না। এর মানে হল শূন্য (নথিং) থেকে কখনও কোনো বস্তুর উৎপত্তি হতে পারে না তথা যে বস্তু বিদ্যমান আছে, তার কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না। সংসারে সত্তাবান কোনো কিছুর বিনাশ তথা কোনো কারণ দ্রব্যের কোনো বস্তুর উৎপত্তি দেখা বা শোনা যায়, তার যথার্থ হল -
নাশঃ কারণলয়ঃ (সাংখ্য দর্শন ১.১২১)
অর্থাৎ স্থূল পদার্থ তার কারণভূত সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকেই বিনাশ বলে। এইভাবে বস্তুর বিনাশ আসলে হয় না, বরং তার রূপ এত সূক্ষ্ম হয়ে যায় যে আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না, একেই বিনাশ বা প্রলয় বলে। এর বিপরীত যখন সেই অদৃশ্য, অস্পৃশ্য ও অবিজ্ঞেয় কারণ পদার্থ স্থূল রূপে পরিবর্তিত হয়ে কোনো বস্তুর নির্মাণ হতে দেখা যায়, তখন তাকেই কোনো বস্তুর উৎপন্ন হওয়া মানা হয়। বস্তুতঃ সৃষ্টি ও প্রলয় হল পদার্থের দুই প্রকারের অবস্থার নাম। এটাও মনে রাখতে হবে যে এই সৃষ্টি-প্রলয় বা কার্য-কারণ অবস্থাও সাপেক্ষ হয়ে থাকে। এক পদার্থ অন্য কোনো পদার্থের উপাদান কারণ হতে পারে, আবার সেই পদার্থ অন্য কোনো সূক্ষ্ম পদার্থের কার্যরূপও হতে পারে।
.
এই সৃষ্টি পৃথক-পৃথক সূক্ষ্ম পদার্থের সংযোগ বিশেষ দ্বারা তৈরী হয়েছে। এখানে "বিশেষ" শব্দ এই বলছে যে সৃষ্টির বিভিন্ন পদার্থের (সূক্ষ্ম বা স্থূল) নির্মাণ এলোমেলো কিংবা যেমন-তেমন (randomly combination) ভাবে নয়, বরং জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক সম্যক্ সংযোগ দ্বারাই হয়। সংসারে যে অব্যবস্থা আমরা এলোমেলো দেখতে পাই, সেটা আমাদের অল্প জ্ঞানের কারণেই এমন মনে হয়, অথচ সেই অব্যবস্থার ভিতরেও এক সুন্দর সোদ্দেশ্য ব্যবস্থা থাকে, যাকে আমরা আমাদের অল্প জ্ঞানের কারণে জানতে পারি না। সমস্ত সৃষ্টি পূর্ণ ব্যবস্থিত, জ্ঞানপূর্বক তৈরী করা হয়েছে, জ্ঞানপূর্বক ও সোদ্দেশ্য সঞ্চালিত হচ্ছে।
.
এখন যেহেতু সমস্ত সৃষ্টি সোদ্দেশ্য ও জ্ঞানপূর্বক তৈরী করা হয়েছে, এইজন্য এটা অনিবার্য যে তার নির্মাতা কোনো মহান সামর্থ্যশালী, মহান জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, অনাদি ও অনন্ত কর্ত্তা অদৃষ্টরূপেণ সর্বত্র বিদ্যমান আছে। এই পূর্ণ জ্ঞানী কর্ত্তা তত্ত্বের সঙ্গে-সঙ্গে চেতন ভোক্তা তত্ত্বের অস্তিত্বের আবশ্যকতা এবং যথার্থ স্বরূপের চর্চা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়। বিজ্ঞ পাঠক সৃষ্টিতে ঈশ্বর তত্ত্বের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিকতার উপর বিচার করে স্বয়ংই ভোক্তারূপ চেতন জীবতত্ত্বের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিকতার অনুভব করতে পারবেন।
.
এইভাবে আমরা "সৃষ্টি" শব্দের পরিভাষার চর্চা করলাম। এখন এই সৃষ্টির সমার্থক দুটো শব্দ "জগৎ" ও "সংসার" এর উপরও চর্চা করবো। এই দুটো শব্দের অর্থ হল যা নিরন্তর গতিশীল অর্থাৎ পরিবর্তনশীল, তাকে জগৎ বা সংসার বলে। এই সৃষ্টির মধ্যে কোনো কিছুই স্থির বা স্থায়ী হয় না, আর যেটা স্থির, নির্বিকার বা স্থায়ী হয়, সেটা এই সৃষ্টির উপাদান তত্ত্ব অথবা এর অঙ্গভূত তত্ত্ব নয়। সমস্ত জগতের সূক্ষ্মতম থেকে স্থূলতম পদার্থ নিরন্তর গতি করছে, এই নিরন্তর গতির কারণে সেগুলো নিজের স্বরূপকেও ক্রমাগত পরিবর্তিত করছে। এই পরিবর্তন সর্বত্র ও সর্বদা হতে চলা সংযোগ ও বিয়োগের কারণেই হয় আর এই সংযোগ-বিয়োগের কারণ হল গতি। এই সংযোগ-বিয়োগও জ্ঞানপূর্বকই হয়। এই সমস্ত সংযোগ-বিয়োগ রূপী সৃষ্টির সমস্ত ব্যবহার ও গুণের ব্যবস্থিত ও বিশিষ্ট জ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলে।
.
আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি সংসারের অন্য সব বিজ্ঞান হল সৃষ্টি-বিজ্ঞানেরই বিভিন্ন শাখা। একে এইভাবেও বলা যেতে পারে যে সম্পূর্ণ পদার্থ বিজ্ঞান সৃষ্টি বিজ্ঞানের অন্তর্গত, কিন্তু সংসারে বিভিন্ন লোক-লোকান্তরের রচনার বিজ্ঞানকেই সৃষ্টি বিজ্ঞান বলে। একে ইংরাজি ভাষায় কসমোলজি বলে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক এটুকু অবশ্য মানে ও জানে যে এই কসমোলজির সঙ্গে সৌর ভৌতিকী (সোলার ফিজিক্স), প্লাজমা, ফিজিক্স, খগোল ভৌতিকী, খগোল বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি এবং স্ট্রিং থিয়োরি আদির না কেবল অতি নিকট সম্বন্ধ আছে, অপিতু সেগুলো সবই হল সৃষ্টি বিজ্ঞানের শাখা। এছাড়া কণা-পরমাণু- নাভিকীয় ভৌতিকী ছাড়া কসমোলজির কল্পনাও সম্ভব নয়। ঊষ্মা, প্রকাশ, বিদ্যুৎ, চুম্বক আদির বিজ্ঞানও কসমোলজিকে বোঝাতে আবশ্যক হয়। এইভাবে এই সব বিজ্ঞানের শাখা হল সৃষ্টি বিজ্ঞানেরই ভাগ। যদিও এইসবের জন্য ভৌতিক বিজ্ঞান শব্দই অনেক সার্থক। বিজ্ঞানের অন্য শাখা রসায়ন, ভূগর্ভ বিজ্ঞান, প্রাণী বিজ্ঞান, বনস্পতি বিজ্ঞান আদি সব ভৌতিক বিজ্ঞান ছাড়া অপূর্ণ হয় কিংবা ভৌতিক বিজ্ঞান রসায়ন আদি অনেক শাখা বা বিধির মূল হয়। এইভাবে বর্তমান বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাই হল সৃষ্টি বিজ্ঞানের অঙ্গ। বাস্তবিকতা তো এই হল যে আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান ছাড়া সম্পূর্ণ সৃষ্টি বিজ্ঞান অপূর্ণই হবে।
সৃষ্টি বিজ্ঞানের উপযোগিতা
আজ
অনেক অধ্যাত্মবাদী বিজ্ঞান ও টেকনিকের নিন্দা করেন, অথচ তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা স্বয়ং উচ্চ টেকনিকের প্রচুর ব্যবহার করেন। আমি এমন মহানুভাবদের বলতে চাইবো যে পদার্থ বিজ্ঞান অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টি বিজ্ঞান না কেবল সংসারে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক, অপিতু মুমুক্ষু ও বিরক্তজনদের মোক্ষের জন্যও সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান আবশ্যক, কারণ সৃষ্টি জ্ঞান ছাড়া এর স্রষ্টা পরমাত্মার জ্ঞান হবে না। যখন তাঁর জ্ঞান বা অনুমানই হবে না, তখন তাঁকে প্রাপ্তির জন্য উৎকট ইচ্ছা ও ধ্যানাদি সাধনের প্রাপ্তি হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। এইজন্য ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যতে সৃষ্টি বিদ্যার উপর খুব বল দিয়েছেন। বিদ্যার পরিভাষাতে তিনি দুই প্রকারের বিদ্যার (আধ্যাত্মিক এবং পদার্থ বিদ্যা) সম্মিলিত রূপকেই বিদ্যা বলেছেন। এখানে আমি ঋষির বেদভাষ্যের কিছু বিচার উদ্ধৃত করবো -
.
১. ন হি কশ্চিদপি সৃষ্টিপদার্থানাম্ গুণবিজ্ঞানেন বিনোপকারান্ গ্রহীতুম্ শক্নোতি তস্মাদ্বিদুষাম্ সম্গেন পৃথিবীমারভ্য পরমেশ্বরপর্য়্যন্তান্ পদার্থান্ জ্ঞাত্বা মনুষ্যৈঃ ক্রিয়াসিদ্ধিঃ সদৈব কার্য়া।। (ভাবার্থ ঋগ্বেদ ১.৯১.১৯)
.
অর্থাৎ সৃষ্টির পদার্থের গুণকে না জেনে কেউই সেগুলো থেকে উপকার নিতে পারবে না, এইজন্য মানুষের উচিত বিদ্বানদের সঙ্গ নিয়ে পৃথিবী থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত যথাযোগ্য সব পদার্থকে জেনে ক্রিয়াসিদ্ধি সর্বদা করা।
.
২. অস্মিন্ জগতি য়স্য সৃষ্টিপদার্থবিজ্ঞান য়াদৃশম্ স্যাত্তাদৃশম্ সদ্যোऽন্যান্ গ্রায়েত্।
য়দি ন গ্রাহয়েত্ তর্হি তন্নষ্টম্ সদন্যৈঃ প্রাপ্তুমশক্যম্ স্যাত্।। (ভাবার্থ য়জুর্বেদ ১২.৪৮)
.
অর্থাৎ এই জগতে সৃষ্টির পদার্থের বিজ্ঞান যার যেমন হবে, তৎক্ষণাৎ সেটা অন্যকে জানাবে। যদি অন্যকে বলা না হয়, তাহলে সেই নষ্ট হওয়া জ্ঞান কেউই প্রাপ্ত করতে পারবে না।
.
এই বিষয়ে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতীর য়োগবিদ্যার শিষ্য শ্রী লক্ষ্মণানন্দ তাঁর ধ্যান-য়োগ-প্রকাশ নামক গ্রন্থে লিখেছেন - "যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের রুচি আর পরীক্ষা বিদ্বানদের সঙ্গতে তথা ঈশ্বর ও তাঁর রচনার উপর হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিজ্ঞান কখনও বাড়বে না, বরং সদা ভ্রমজালে পড়ে থাকবে।"
.
প্রশ্ন - এই সৃষ্টি বিজ্ঞান আদি বিষয় কেবল প্রেয়মার্গী সাংসারিক জনের জন্য তো ঠিক আছে, কিন্তু শ্রেয়মার্গী মুমুক্ষু জনকে পদার্থ বিজ্ঞান নিজের মুখ্য লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। এইজন্য তাদের এর উপেক্ষা করাই উচিত।
.
উত্তর - এই বিষয়ে কিছু সংকেত আমি পূর্বেই করেছি। এখন আমরা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী, যিনি এই যুগের একজন প্রসিদ্ধ য়োগী ছিলেন, তাঁর বিচার জানার চেষ্টা করবো। তিনি সত্যার্থ প্রকাশের মুক্তি বিষয়ক নবম সমুল্লাসে মুক্তির সাধনের মধ্যে সর্বপ্রথম বিবেকের বিষয়ে বর্ণনা করে শরীরের পঞ্চকোষ তথা চার প্রকারের শরীরের বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা কি সৃষ্টি বিজ্ঞানের অন্তর্গত নয়? প্রাণ, সূক্ষ্মভূত, ইন্দ্রিয়, মন আদির জ্ঞান সৃষ্টি বিজ্ঞানের একটা ভাগ নয় কি? এমন বিজ্ঞান, যাকে ঋষি বিবেক বলেছেন, তাকে ছাড়া বৈরাগ্য হওয়া কি সম্ভব? তারপর তিনি বৈরাগ্যের অর্থ নিয়ে সত্যার্থ প্রকাশে সেই সমুল্লাসের মধ্যে বলেছেন - "বিবেক দ্বারা যে সত্যাসত্য জানা গেছে, তাতে সত্যাচরণের গ্রহণ আর অসত্যাচরণের ত্যাগ করাই হল বৈরাগ্য।"
.
এখন বিবেকের বিষয়ে বলেছেন - "পৃথিবী থেকে শুরু করে পরমেশ্বর পর্যন্ত পদার্থের গুণ, কর্ম, স্বভাব সম্বন্ধে জেনে তাঁর আজ্ঞাপালন আর উপাসনাতে তৎপর হওয়া, তাঁর বিরুদ্ধে না চলা, সৃষ্টি থেকে উপকার নেওয়াকে বিবেক বলে।"
.
এই বৈরাগ্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত নয় কি? ঋষির য়োগবিদ্যার শিষ্য স্বামী লক্ষ্মণানন্দ ধ্যান-য়োগ-প্রকাশ নামক গ্রন্থের ১৩২ পৃষ্ঠাতে লিখেছেন - "নিজের স্বরূপের জ্ঞান প্রাপ্ত করার যোগ্যতা হওয়ার জন্য জীবের উচিত প্রকৃতিজন্য স্থূল আর সূক্ষ্ম পদার্থকে ক্রমশঃ ধ্যানপূর্বক জানা।"
.
ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যতে য়োগী হওয়ার জন্য সৃষ্টি বিজ্ঞানের আবশ্যকতা নিয়ে বলেছেন -
.
"ত এব জনা য়োগিনস্সিদ্ধাশ্চ ভবিতুম্ শক্নুবন্তি য়ে য়োগবিদ্যাভ্যাসম্ কৃত্বেশ্বরমারভ্য ভূমিপর্য়্যন্তান্ পদার্থান্ সাক্ষাৎকর্তুম্ প্রয়তন্তে য়মাদিসাধনান্বিতাশ্চ য়োগে রমন্তে য়ে চৈতান্সেবন্তে তেऽপ্যেতৎসর্বম্ প্রাপ্নুবন্তি নেতরে।" (য়জুর্বেদ ভাবার্থ ৭.৮)
.
অর্থাৎ তারাই পূর্ণ য়োগী আর সিদ্ধ হতে পারবেন, যারা য়োগবিদ্যাভ্যাস করে ঈশ্বর থেকে শুরু করে পৃথিবী পর্যন্ত পদার্থকে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন আর য়ম-নিয়ম সাধন যুক্ত য়োগের মধ্যে রত থাকেন আর যারা এই সিদ্ধের সেবন করেন, তারাই এই য়োগসিদ্ধিকে প্রাপ্ত করেন, অন্য কেউ নয়।
.
তিনি অন্যত্র লিখেছেন - "য়ে য়থাবৎসৃষ্টিক্রমম্ জানন্তি তে বিদ্বাম্সঃ সর্বতঃ পূজ্যন্তে য়ে চৈতম্ ন জানন্তি তে সর্বতস্তিরস্কৃতা ভবন্তি। (ভাবার্থ ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৩৬) অর্থাৎ যারা সঠিকভাবে সৃষ্টিক্রমকে জানেন, সেই বিদ্বানদের সর্বত্র পূজো করা হয় আর যারা একে জানেন না, তারা সবদিকে তিরস্কৃত হন। ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার "বেদবিষয়বিচার" নামক অধ্যায়ে ঋষি দয়ানন্দ বলেছেন অপরা বিদ্যা অর্থাৎ সৃষ্টি বিদ্যা অর্থাৎ সম্পূর্ণ পদার্থ বিজ্ঞান, পরাবিদ্যা অর্থাৎ অধ্যাত্ম বিদ্যার মূল হয় আর পরাবিদ্যা সেই অপরার ফল হয়। একথা এটাই স্পষ্ট করে যে পদার্থ বিজ্ঞান ছাড়া অধ্যাত্ম জ্ঞান, য়োগ আর মুক্তি হওয়া একদমই সম্ভব নয়।
.
এইভাবে আমরা এখানে দেখতে পেলাম যে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী সমস্ত পদার্থ বিজ্ঞানকে মানবমাত্রের জন্য উপযোগী ও আবশ্যক মানতেন। বস্তুতঃ যে মানব এই সংসারে বাঁচতে চাইবে, তাকে বিজ্ঞান জানতেই হবে। বিজ্ঞান ছাড়া তার জন্য লোকব্যবহার, আহার, বিহার, আরোগ্যতা প্রাপ্ত করা, যেখানে-সেখানে গমনাগমন ব্যবহার করা আদি কোনো কিছুই সম্ভব হবে না। যদি মানুষ এইসব করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে কিভাবে সুখী হবে? ভগবৎপাদ পতঞ্জলি তাঁর য়োগশাস্ত্রে (২.১৮) এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির প্রয়োজন সমস্ত সুখের উপভোগ এবং মোক্ষ প্রাপ্তিকেই বলেছেন। যদি কোনো মানুষ এই সৃষ্টির যথার্থ বিজ্ঞানকে না জানেন, তাহলে তিনি তার যথার্থ ব্যবহার কিভাবে করবেন? আর যদি ব্যবহার করতে না পারেন, তাহলে এই সৃষ্টি যে প্রয়োজনের জন্য তৈরী হয়েছে, সেই প্রয়োজন (সমস্ত সুখ এবং অন্তিম পরম প্রয়োজন মুক্তি) কিভাবে সিদ্ধ হবে?
.
এইজন্য সংসারের মধ্যে প্রত্যেক মানুষের উচিত যে তার নিজের জীবন সার্থক করার জন্য সংসারের সব পদার্থের যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করে সেগুলো থেকে নিজের ও অন্যের যথাযোগ্য উপকার করার চেষ্টা করতে থাকা। এইরূপ করেই মানুষ অন্তিমে যথার্থ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান অর্থাৎ আত্মা ও পরমাত্মার যথার্থ বিজ্ঞান প্রাপ্ত করে মুক্তিকেও প্রাপ্ত করতে সক্ষম হবে।
মানব জিজ্ঞাসা এবং সৃষ্টি বিজ্ঞান
সৃষ্টির এমন প্রয়োজনকে জেনে এই মানব প্রাণী যখন থেকে এই পৃথিবীতে এসেছে, তখন থেকেই সৃষ্টির রহস্যকে জানার চেষ্টা করছে। বেদ, মনুস্মৃতি, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, মহাভারত, সূত্র-গ্রন্থ, দর্শন, উপনিষদ আদি সম্পূর্ণ প্রাচীন বৈদিক বাঙ্গময়ের মধ্যে সৃষ্টির যথার্থ বিজ্ঞানের উপর বিস্তার ভাবে গম্ভীর বিচার করা হয়েছে। যখন এইসব গ্রন্থের রচনা হয়, সেই সময় এই ভূ-তলে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের আবির্ভাবও হয়নি। মহাভারত যুদ্ধের পশ্চাৎ এই সংসারে বিভিন্ন মত-মতান্তর প্রচলিত হয় আর সেগুলোতে নিজ-নিজ শৈলী রূপে সৃষ্টি-উৎপত্তি বিষয়ের উপর বিচার করা হয়। আমি মনে করি যত বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম সৃষ্টিবিজ্ঞান বৈদিক বাঙ্গময়ের মধ্যে আছে, ততটা সারা সংসারের কোনো সম্প্রদায় বা দর্শনের মধ্যে হবে না। সংসারের বিভিন্ন সম্প্রদায় বৈদিক বাঙ্গময় থেকেই কিছু-কিছু বিচারকে গ্রহণ করে নিজের-নিজের পৃথক দর্শন তৈরী করেছে। পারসি, বৌদ্ধমত, জৈনমত, ইহুদী, ঈসাই, ইসলাম আদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দর্শনের মধ্যে বৈদিক মান্যতা থেকেই কিছু-কিছু প্রেরণা নেওয়া হয়েছে। কুরআন এবং বাইবেলের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তির বিষয়ে অনেক বিচার বৈদিক ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে রূঢ়ার্থে নেওয়া হয়েছে।
.
এইসব সম্প্রদায়ের প্রবর্তক এইসব গ্রন্থের বিচারের যৌগিক অর্থ (যথার্থ) জানতে পারেনি, বরং সেই সময় সংসারে প্রচলিত বৈদিক কথনের রূঢ়ার্থে প্রচলিত ধারণার সংকেতকে গ্রহণ করে তার উপরই নিজের-নিজের সৃষ্টি বিজ্ঞানের ভবন দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। ভারতীয় অর্বাচীন ভাগবতাদি পুরাণও এইভাবে বৈদিক কথনকে রূঢ়ার্থেই গ্রহণ করে নিজ-নিজ মতের প্রবর্তন করে দেয়। বৌদ্ধ ও জৈন মত বৈদিক দর্শনের রূঢ়ার্থকে নিয়ে প্রচলিত হওয়া বীভৎস কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়াতে উদিত হয়, এই কারণে তারা অনীশ্বরবাদের দিকে প্রবৃত্ত হয়, যদিও অন্য দেশী ও বিদেশী মত ঈশ্বরবাদীই থাকে, তাতে তাদের ঈশ্বর যেমনই হোক না কেন। বস্তুতঃ বৈদিক সনাতন মতের যথার্থকে না জেনে সৃষ্টি বিজ্ঞানের বিষয়ে যেসব মান্যতা প্রচলিত হয়, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ কল্পনাপ্রসূত ভাগ আছে আর বাস্তবিকতা কম। তবে বৌদ্ধ ও জৈন মতের মধ্যে সৃষ্টিবিদ্যার উপর কিছু গম্ভীর বিচারও করা হয়েছে, তবুও তারা বাস্তবিকতার থেকে অনেক দূরে চলে যায়।
.
আধুনিক পুরাণ গ্রন্থের মধ্যে বায়ু, মৎস্য, ব্রহ্মাণ্ড, বিষ্ণু আদি পুরাণে যেসব সৃষ্টি বিদ্যা আছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথা প্রাচীন বৈদিক বাঙ্গময়ই হল এর মূল স্রোত। অন্য শিবপুরাণাদির মধ্যে কিছু গম্ভীর তো কিছু কাল্পনিক বিচারের সমাবেশ আছে। তবে বাইবেল ও কুরআনের মধ্যে এমন বিস্তৃত বিচার নেই আর না সেখানে কোনো ক্রমবদ্ধতা ও যুক্তিসঙ্গতা প্রতীত হয়। বর্তমানে হিন্দি ভাষাতে এগুলোর যেসব অনুবাদ উপলব্ধ আছে, সেগুলোর মধ্যে চমৎকারী ঈশ্বর কথনমাত্র সৃষ্টির রচনা করে দিয়েছে, এমন বলা হয়েছে। বস্তুতঃ এই দুই গ্রন্থের মধ্যে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কিছু প্রচলিত কথনের রূঢ় পরম্পরার কিছু প্রভাব তো আছে, কিন্তু তারা সেইসব কথনের যথার্থ বুঝতে পারে নি আর রূঢ়ার্থকেই গ্রহণ করে বসে। একথা বর্তমানে প্রচলিত পুরাণের বিষয়েও উচিত মানা যেতে পারে। আধুনিক পুরাণের মধ্যেও না কেবল সৃষ্টি বিজ্ঞানকে কোথাও-কোথাও চমৎকারী ঈশ্বরের জাদুগিরি রূপে বিচিত্র করেছে, অপিতু সেই চমৎকারী ঈশ্বরকেও বিভিন্ন য়োনিতে জন্ম নিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন চমৎকার করে বিভিন্ন চিত্র-বিচিত্র রূপে বর্ণনা করে একটা জাদুকরের মতো প্রচারিত করে দেয়।
.
এইসব মান্যতার মাঝে বিগত কিছু শতাব্দীর মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয় আর এটা সৃষ্টিকে জানতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের উদয় হওয়ার পূর্বে পশ্চিমী দেশের মধ্যে ঈশাই, ইসলাম আদি সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি বিদ্যা বিষয়ক বিচার ছাড়াও অরস্তু, প্লেটো আদি বিচারকদের সৃষ্টিবিদ্যা সম্বন্ধীয় বিভিন্ন বিচারের প্রাদুর্ভাব হয়ে গিয়েছিল। যাকে আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের উদয় বলতে পারি, সেটা কোপারনিকাস এবং গ্যালিলিও থেকে শুরু হয়েছে। এরপর সেই সময়ের মহান ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক আইজেক নিউটন থেকে আধুনিক সৃষ্টি বিজ্ঞানের মহান যুগ শুরু হয়। তারপর মহান বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞান অনেক ক্রান্তিকারী অনুসন্ধান করে। সৃষ্টির অনেক গভীর রহস্যকে জানতে ও বুঝতে পারে।
.
এই কালে আধুনিক বিজ্ঞান অত্যুচ্চ টেকনিকের এমন বিকাশ করে যে তার সহায়তায় এই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্য থেকে পর্দা উঠতে থাকে। আইনস্টাইনের পশ্চাৎ আজ পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে অনেক টেকনিক বিকশিত হয়েছে। অনেক বিচার যা কখনও নতুন ও ক্রান্তিকারী মানা হতো, তাকে পুরোনো ও অবিকশিত ভেবে ত্যাগ বা সংশোধিত করা হচ্ছে। সারা সংসারের বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ার এই ব্রহ্মাণ্ডকে জানতে একসাথে যৌথ প্রচেষ্টা করছে। এইদিকে বিভিন্ন সম্প্রদায় যেন এই বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। তো কোথাও-কোথাও তারাও আধুনিক বিজ্ঞানের বিবেকহীন বা কোথাও-কোথাও বিচারপূর্বক অনুকরণের চেষ্টা করতে দেখা যায়। একদা যে বেদবিদ্যাকে এই ব্রহ্মাণ্ডের বিজ্ঞান বিষয়ের এক অনুপম ও পূর্ণ বিদ্যার রূপে মানা হতো, মধ্যকালীন অবিদ্যার দুষ্প্রভাবে সেটাও নিজেকে বাঁচাতে পারেনি, আমি এমন মনে করি।
.
যদিও ফাল্গুন কৃষ্ণ দশমী বিক্রম সম্বত ১৮৮১ তদনুসারে ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৫ সালে ভারতবর্ষে জন্মা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী সনাতন বৈদিক বিদ্যাকে পুনর্জীবিত করার মহান প্রচেষ্টা করেন, কিন্তু কুটিল কালের গতি তাঁকে না তো পূর্ণ আয়ুপর্যন্ত বাঁচতে দেয় আর না তাঁকে তাঁর অল্পায়ু কালেও পূর্ণ মনোযোগ সহকারে বেদোদ্ধারের কাজ করতে দেয়। এইজন্য বৈদিক সৃষ্টি বিদ্যার অপেক্ষিত ও যথার্থ স্বরূপ প্রকাশিত হতে পারেনি আর যা কিছু হয়েছে, সেটাও সাংকেতিকই রয়ে গেছে, যাকে পূর্ণরূপে বুঝতে পারা প্রত্যেক বিদ্বানের সামর্থ্য নয়।
.
আমি মনে করি সৃষ্টি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দুটোই পক্ষ আছে, যার উপর এখানে বিচার করা আবশ্যক আর সেগুলো হল - ১. আধুনিক বিজ্ঞানের মান্যতা এবং ২. বৈদিক মান্যতার যথার্থ স্বরূপ। এরমধ্যে এখানে আমরা বৈদিক মান্যতার উপরই এরপর বিচার করার চেষ্টা করবো।
.
সংসারের সব প্রাণীর মধ্যে মানুষ হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং বিশিষ্ট প্রাণী। অন্য সব প্রাণী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজের ভাষা, আহার-বিহার আদির জ্ঞান কখনও বাইরে থেকে শেখে না, বরং তাদের ভিতরে এটা স্বভাবতঃ উৎপন্ন হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, তাদের বাচ্চাকে তাদের মা কিছু-কিছু শিখিয়ে দেয়। তাছাড়া যদি না শিখায়, তাহলেও বিভিন্ন পশু-পক্ষীর বাচ্চা একাকী থেকেও কথা বলা, হাঁটাচলা, ভোজন করা, শিকার করা, সন্তানোৎপত্তি করা, নিজের ঘর-ঘোসলা-বাসা বানানো, বলবানের সামনে ভয় পাওয়া ও নির্বলকে ভয় দেখানো আদি স্বয়ং শিখে নেয়। জীবনযাপন শেখার জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যকতা হয় না। তাদের জ্ঞান ও ভাষার মধ্যে শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো বিশেষ বিকাশ দেখা যায় না। তবে কিছু-কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন বয়স্ক হাতি, শিম্পাঞ্জি, বাঁদর, বাঘ আদি তাদের বাচ্চাদের থেকে একটু অধিক জ্ঞানী ও অনুভবী হয়, তবুও তারা যতই জ্ঞানী হোক না কেন, অতিমূঢ় মানুষের সমানও কখনও হতে পারবে না। তাহলে এখন প্রশ্ন হল, মানব জাতির ভাষা ও জ্ঞানের উৎপত্তি বা বিকাশ কি ক্রমশঃ হয়েছে?
.
সংসারে হাজার-হাজার ভাষায় কথা বলা হয় তথা সারা সংসারে প্রায় আট আরব মানুষ নিজের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আশ্চর্যজনক বিকাশ করেছে। আশ্চর্যের কথা হল সারা সংসারের বিভিন্ন জাতির পশু-পক্ষী নিজ-নিজ জাতির অনুসারে প্রায় একইরকম জ্ঞান ও ভাষাকে জানে। তাদের মধ্যে পৃথক-পৃথক স্তর হয় না। একই জাতির বাঁদর বা যেকোনো পশু-পক্ষী স্থান বা কাল ভেদের কারণে পৃথক-পৃথক ভাষায় কথা বলে বা তাদের জ্ঞান ও ব্যবহারের মধ্যে ভিন্নতা হয়, এমন আমরা দেখতে পাই না, অথচ মানব জাতির মধ্যে এমন হয়। ভাই-ভাইয়ের মধ্যেও জ্ঞানের অনেক ভেদ দেখা যায়। যদি মানব শিশুকে কোথাও একাকী রেখে দেওয়া হয়, তাহলে সে কোনো মানবীয় ব্যবহারই জানতে পারবে না। এইসব কেন আর কিভাবে হয়েছে? এই বিষয়ে বর্তমান বিদ্বান প্রায়শঃ বর্তমান বিজ্ঞানের বিকাশবাদী সিদ্ধান্তেরই আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
বিবর্তনবাদের পর্যালোচনা
স্থান ও কালের ভেদানুসারে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের গঠনের মধ্যে হওয়া ভেদকে বর্তমান বৈজ্ঞানিক বা প্রবুদ্ধ বর্গ বিবর্তনবাদেরই দান এমন স্বীকার করে এইরূপ বলে যে - "অমুক প্রাণী তার শরীরে পরিবেশ ও পরিস্থিতির অনুকূল অমুক-অমুক পরিবর্তন করেছে, ডানা করেছে, পায়ের বিকাশ করেছে, ত্বককে শক্ত করেছে, ত্বকের উপর লোম ও উলের বিকাশ করেছে, লেজ লুপ্ত করেছে, হাত ও পায়ের বিকাশ করেছে, আহার-বিহারের শৈলীতে পরিবর্তন করেছে। শুঁড়ের বিকাশ হয়েছে, পরিস্থিতির অনুকূল গলা লম্বা করে নিয়েছে। সব প্রাণীর একটাই মূল স্রোত এককোষিকীয় জীব ছিল, সেখান থেকে বিকাশের যাত্রা করতে-করতে এই প্রাণী প্রবুদ্ধ ও সবচেয়ে উন্নত মানুষ হয়ে যায়...আদি আদি।" বর্তমান প্রবুদ্ধ জন, যারা স্বয়ংকে বৈজ্ঞানিক মেধাসম্পন্ন মানেন, জানি না কেন তাদের এমন ভ্রম হয়ে গেছে যে সমস্ত প্রাণী একই জাতি থেকে বিকশিত হয়েছে। জানি না কেন, তারা এই সংসারের নিয়ামক ও নির্মাতা পরমাত্মা তত্ত্বের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে ভয় বা সঙ্কোচ করেন।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও স্বরূপকে অধিক জানার জন্য পাঠক "সৃষ্টি সঞ্চালক" পুস্তকটা পড়তে পারেন। আমার বিশ্বাস যে সুধী পাঠক সেই বিষয়কে জেনে বিবর্তনবাদের অযৌক্তিকতা সম্পর্কে স্বয়ংই কিছু জেনে যাবেন। এখানে এই বিষয় আমার গ্রন্থের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে না, সুতরাং এই বিষয়ে বিস্তার ভাবে লেখাটা আমি অপ্রাসঙ্গিক এবং অনাবশ্যক মনে করি। তা সত্ত্বেও আমি বিবর্তনবাদীদের থেকে এটুকু অবশ্যই জানতে চাইবো যে আপনারা শরীরের মধ্যে ক্রমিক পরিবর্তনের কথা বলেন, তাহলে সেই পরিবর্তন মানুষের মধ্যে এসে কেন থেমে গেছে? উড়ার আবশ্যকতা হওয়ার জন্য পাখিদের ডানা গজায়, অথচ তাদের পূর্বোজদের ডানা ছিল না এটা আপনারা মানেন, তাহলে লক্ষ-লক্ষ বছর ধরে মানুষও উড়ার চেষ্টা করছে, তবে এমন মানুষের কেন ডানা গজায় নি? মহাভারত, রামায়ণ ও এরথেকেও পূর্বে মানব বায়ুযান বানানো শিখে গিয়েছিল আর শুধু যে শিখেছিল তাই নয় বরং এইসব বিমান অতি অত্যাধুনিক ছিল। যখন আপনার বিবর্তনবাদ পাখিদের ডানা গজিয়ে দেয়, তখন মানুষের মধ্যে ডানা লাগাতে কিসের বাধা আসে? যদি এমন হতো, তাহলে মানুষকে যাতায়াতের সাধনের টেকনিকের আবিষ্কার করতে হতো না। আপনারা বলেন যে ঠাণ্ডা প্রদেশে উল বা বড়-বড় লোম স্বয়ং গজিয়ে ওঠে, তাহলে মানুষের মধ্যে সেইরূপ কেন গজায় নি? যদি এমন হতো, তাহলে উলের বস্ত্র আবিষ্কারের আবশ্যকতাই হতো না।
.
আজ মানব ছোট-ছোট পশু-পক্ষীদের দেখে বিভিন্ন রকমের টেকনিকের আবিষ্কার করছে। পশু-পক্ষীর মধ্যে সবকিছু স্বয়ং হয়ে গেছে আর মানুষের বেলা আসতেই বিকাশে যেন পূর্ণ বিরাম লেগে গেছে, এইসব অত্যন্ত হাস্যাস্পদ তথা অবৈজ্ঞানিক কল্পনা। দুর্ভাগ্যবশতঃ এইসব কল্পনা বিজ্ঞানের নামে গড়া, পড়া ও প্রচারিত করা হচ্ছে। বস্তুতঃ চেতন তত্ত্বের অস্তিত্ব ও স্বরূপের বৈজ্ঞানিকতাকে না জানা পর্যন্ত বর্তমান বিজ্ঞান এই ধরণের মিথ্যা ও অবৈজ্ঞানিক ধারণার মধ্যে জড়িয়ে থাকবে। এটা বর্তমান বিজ্ঞানের নিতান্ত রূঢ়িবাদ বা অন্ধ বিশ্বাসমাত্র, যে ঈশ্বর, আত্মার মতো অনিবার্য চেতন তত্ত্বকে একদমই ভুলে বসে আছে। আমি এই পর্যন্ত শরীর ও কথা বলার বিকাশের কথা বললাম। এখন আমি জ্ঞানের বিকাশের সংক্ষিপ্ত চর্চা করবো -
.
তথাকথিত বিবর্তনবাদী মহানুভাব মানব বাদে সব প্রাণীর শরীরের ক্রমিক পরিবর্তনরূপী বিকাশের কথা বলে, যেগুলো মানব জাতির মধ্যে দেখা যায় না, অথচ মানবের মধ্যে যে ভাষা ও জ্ঞানের বিকাশের কথা বলা হয়, সেটা মানব ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে প্রায় দেখা যায় না। একটা পতঙ্গ যখন থেকে পৃথিবীতে এসেছে, তখন থেকে অর্থাৎ কোটি-কোটি বছর ধরে প্রদীপের নিকট এসে নিজের প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কেবল এতটুকুও জ্ঞানের বিকাশ হয়নি যে পুড়ে যাওয়ার থেকে বাঁচবে, অথচ মানব মূলতঃ অ্যামিবা থেকে বিকশিত হয়ে বৌদ্ধিক দৃষ্টি দিয়ে অত্যন্ত উঁচু উঠে অন্তরীক্ষের অতি দূরে উড়তে আর বিভিন্ন উপায়ে উচ্চ টেকনিক বিকশিত করতে সক্ষম হয়ে গেল? বিবর্তনবাদের মধ্যে এমন বিরোধ কেন? এই বিরোধ কখনও মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তো কোথাও অমানব প্রাণীদের মধ্যে। বস্তুতঃ বিবর্তনবাদীদের কাছে এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মানুষ ছাড়া যেকোনো প্রাণী, সেটা বাঁদরদের সর্বাধিক বুদ্ধিমান প্রজাতি শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং আদি হোক না কেন, লক্ষ-লক্ষ বার চেষ্টা করেও তাকে মানুষের মতো কথা বলা ও অন্য প্রকারের বৌদ্ধিক কাজের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব নয়।
.
এইদিকে মানুষের বিষয়ে বলা হয় যে এরা নাকি এমনি-এমনি করে ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ করেছে। যদি প্রাকৃতিক ধ্বনি, প্রাণীদের শব্দ ও ব্যবহারের অনুকরণ করে পরস্পর মিলেমিশে সমৃদ্ধ ভাষা ও জ্ঞানের বিকাশ ধীরে-ধীরে হয়, তাহলে সংসারের অনেক বনবাসী সমূহগুলো ভাষা-বিজ্ঞান, ভৌতিকী আদি পদার্থ বিজ্ঞান, উচ্চ টেকনিক এবং সুসংস্কৃত সমাজের নির্মাণ করে নিতো, কিন্তু এমনটা হয়নি। কোনো সুসংস্কৃত তথা অতি সমৃদ্ধ প্রবুদ্ধ মাতা-পিতার থেকে উৎপন্ন শিশুকেও যদি জন্মানোর সাথে-সাথে একাকী বন্য পশুদের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। কেবল লুকিয়ে-লুকিয়ে তার সুরক্ষা ও পালন করা হয়, তাহলে সেই শিশুটি যদি জীবিত বেঁচে যায়, তাহলে সে পশুদের মতোই সব ব্যবহার করবে, তার মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক বা শিক্ষাবিদের জিন্স থাকলেও সে এইরূপ হবে। তাকে যেমন পশু বা বন্য মানব জাতি বা বোবা ধাইয়ের মাঝে রাখা হবে, সে তেমনই ব্যবহার তাদের থেকে শিখে নিবে। নিজের মাতা-পিতার কোনো ব্যবহার তার মধ্যে আসবে না। অন্যদিকে পালিত পশু লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি বছর ধরে মানব জাতির সঙ্গে আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা একটাও ব্যবহার মানবের থেকে শিখে নি। মানুষ ও অন্য প্রাণীদের মধ্যে এই মৌলিক ভেদ সকলেই জানে, তবুও বিবর্তনবাদের পট্টি বেঁধে এটা চিন্তা-ভাবনার প্রচেষ্টাই করা হয় না যে এমন কেন হয়েছে?
.
আমার মত হল মানুষ বাদে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে কেবল স্বাভাবিক জ্ঞানই প্রধান হয়, অন্যদিকে নৈমিত্তিক জ্ঞান যেটা মাতা-পিতার থেকে শিখে প্রাপ্ত হয়, সেটা অত্যল্পই হয়, সেটাও খুব অনেক কম জাতির মধ্যে। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক জ্ঞান অনেক কম, অন্যদিকে নৈমিত্তিক জ্ঞানই প্রাধান্য রূপে নিজের ভূমিকা পালন করে। মানুষ নৈমিত্তিক জ্ঞান ছাড়া পশুদের থেকেও অধিক মূর্খ হয়। কোনো পশুর বাচ্চা জলবিহীন মরুভূমিতে জন্মালেও তাকে যদি অকস্মাৎ জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সে সাঁতার কাটবে, অথচ কোনো দক্ষ ডুবুরি, সাঁতারুর বাচ্চাকেও বিনা সাঁতার শিখে ও শিখালে, তাকে হঠাৎ করে জলে ছেড়ে দিলে সে অবশ্যই ডুবে মরবে। মানুষ বাদে অন্য সব প্রাণীর বাচ্চা জন্মানোর সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ভাষা বলতে থাকে আর সেই ভাষাই মৃত্যুকাল পর্যন্ত বলতে থাকে, অথচ মানুষের বাচ্চা জন্মানোর সময় কান্না, হাসি আদি করতে পারে আর সমাজে বাস করে বিভিন্ন ভাষার মহান জ্ঞাতা, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যকার আদি হতে পারে।
.
এমন স্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে যে যখন সর্বপ্রথম মানবের উৎপত্তি হয়েছিল, তখন তারা কেবল পশু-পক্ষী ও জলজ প্রাণীদেরই দেখেছিল, তাদেরই ভাষা শুনেছিল, তাদেরই ব্যবহার দেখেছিল, তাহলে এই মানব জাতির প্রথম প্রজন্ম যাদের কোনো মাতা-পিতাও ছিল না, এইজন্য তাদের জিন্সও মানব ব্যবহারের কোনো প্রকারে সংবহনকারী ছিল না, তাহলে তাদের মধ্যে ভাষা ও জ্ঞানের বিকাশ কিভাবে হয়েছে? তাদের মধ্যে এর উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে? ধীরে-ধীরে নিজেদের মধ্যে পরস্পর মিলেমিশে তো সম্ভব নয়, কারণ যদি এমন হতো, তাহলে পৃথিবীর কোথাও কোনো স্থানে অসভ্য ও জংলী মানব আজ বিদ্যমানই হতো না। মানব কেবল বাইরের পরিবেশ থেকেই সবকিছু শিখে নেয় আর কেউ তাকে শিখাবে, তবেই সে শিখবে। তাহলে শিখাবে এমন কে ছিল, যে এই মানব জাতির থেকেও অতি যোগ্য ছিল? যদি সেও কোনো প্রাণী ছিল, তাহলে তার মধ্যে জ্ঞান ও ভাষার বিকাশ কিভাবে হয়েছে, এই প্রশ্ন উঠবেই।
.
যে সকল পাঠক ডারবিনের বিবর্তনবাদকে সবিস্তার ভাবে পরীক্ষা করে এর অযৌক্তিকতাকে জানতে চান, তারা আর্য বিদ্বান শ্রী পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মা কৃত "বৈদিক সম্পত্তি", স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী কৃত "বেদ মীমাংসা", ডাক্তার ভূপসিংহ কৃত "বৈদিক সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিকতা" আদি পুস্তকের গম্ভীর স্বাধ্যায় করতে পারেন। আমি এই বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিষয়ান্তর হতে চাই না। এই কারণে ভাষা ও জ্ঞানের উৎপত্তির বৈদিক সনাতন মতের চর্চা শুরু করবো।
ভাষা ও জ্ঞানের উৎপত্তি
আমরা বৈদিক সৃষ্টি-উৎপত্তি বিজ্ঞান নামক অধ্যায়ে বিচার করবো যে সৃষ্টি নির্মাণের বিভিন্ন চরণে বিভিন্ন বৈদিক ছন্দের (মন্ত্রের) উৎপত্তি কিভাবে হতে থাকে। সেইসব ছন্দ, যেগুলো বিভিন্ন প্রাণ ও বাক্ (ধ্বনি) রূপই ছিল। সেগুলো এই সৃষ্টির উপাদান কারণ ছিল, তবে সেগুলো মূল প্রকৃতির কার্যরূপই ছিল। কেবল মানবেরই নয়, বরং এই ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির পূর্বেই সম্পূর্ণ আকাশ পূর্ণতঃ বৈদিক ছন্দ (তরঙ্গ, ধ্বনি বা প্রাণ) দিয়ে একসমান ভাবে ভরা ছিল, এই কারণে আর্যসমাজের সংস্থাপক ঋষি দয়ানন্দ তাঁর ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকাতে বেদনিত্যত্ব বিষয়ে লিখেছেন - "কিন্তু আকাশে শব্দের প্রাপ্তির কারণে শব্দ তো অখণ্ড একরস সর্বত্র ভরে আছে। শব্দ হল নিত্য। বেদের শব্দ সবদিক থেকে নিত্য বজায় থাকে।"
.
🌿 শব্দের নিত্যতা 🌿
আমার মতে বৈদিক শব্দের নিত্যতা সৃষ্টিকাল পর্যন্তই মানা উচিত। প্রলয়কালে শব্দের এইরূপ থাকা সম্ভব নয়। তবে সেগুলোর পৃথক-পৃথক অক্ষর রূপ বীজবত্ পরাবস্থায় সর্বদা বজায় থাকে। সৃষ্টি উৎপত্তি শুরু হতেই অক্ষরগুলো প্রকট হলে ধীরে-ধীরে বৈদিক পদ, তারপর ছন্দ প্রকট বা উৎপন্ন হতে থাকে। তবে হ্যাঁ, ঋষি দয়ানন্দ যে বলেছেন বৈদিক শব্দ পরমেশ্বরের জ্ঞানে নিত্যই থাকে অর্থাৎ প্রলয়কালেও যথাযথ ভাবে বজায় থাকে, একথা সত্য।
.
সৃষ্টি যখন থেকে তৈরী হওয়া শুরু হয়, সেই সময়ই প্রারম্ভিক বৈদিক দৈবী ছন্দ "ওম্" এর উৎপত্তি সর্বপ্রথম এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র হয়। এরপর অন্য গায়ত্র্যাদি ছন্দের বিভিন্ন রূপের উৎপত্তি এই ব্রহ্মাণ্ডে হতে থাকে। এইসব ছন্দ বিভিন্ন প্রকারের প্রাণ রশ্মিরই রূপ ছিল। তার মানে হল বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম বায়ুরূপ এইসব ছন্দ রশ্মি সারা ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে ভরে যায়, কিংবা এরই স্থূল রূপ দিয়ে স্থূল বায়ু, অগ্নি আদির উৎপত্তি হয়। প্রতিটি পদার্থ এই পদার্থেরই ঘনীভূত রূপ হয়। যখন মানুষের উৎপত্তি এই পৃথিবীতে হয়, তখন মানব প্রজন্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কার যুক্ত চারজন ঋষি, যাঁদের নাম অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা ছিল, তাঁরা আকাশে বিদ্যমান সেইসব ছান্দস তরঙ্গকে সমাধি, বিশেষ করে সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে অনুভূত করেন। এই সময় যেমন বিভিন্ন রেডিও তরঙ্গ সম্পূর্ণ আকাশে বিদ্যমান আছে, কিন্তু সবাই সেগুলোর অনুভব করতে পারেন না। যার কাছে মোবাইল আদি ইলেকট্রনিক উপকরণ আছে, দূরদর্শন, রেডিও, ইন্টারনেট আদি ব্যবস্থা আছে, তারাই এইসব রেডিও তরঙ্গ থেকে একটা ব্যবস্থার অনুসারে ইচ্ছিত তরঙ্গের গ্রহণ করতে পারবেন।
.
আমি যে ছান্দস রশ্মির চর্চা করছি, সেগুলো হল এই রেডিও তরঙ্গের থেকেও সূক্ষ্ম। সেগুলোকে এইসব যন্ত্রের দ্বারা গ্রহণ করা যাবে না। এই রশ্মির মাধ্যম (আধার) আকাশ না হয়ে মনস্তত্ত্ব হয়, এইজন্য এগুলোর গ্রহণ কেবল সমাধিস্থ মনের দ্বারাই হওয়া সম্ভব। এই কারণে কেবল সেই চার ঋষি যাঁরা প্রথম মানব প্রজন্মের মধ্যে কিছু বিশিষ্ট যোগ্যতাধারী ব্যক্তি ছিলেন, তাঁরা সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে অন্তঃকরণের রশ্মির দ্বারা পরমাত্মার সানিধ্য ও সহায়তায় সেইসব সর্বতোব্যাপ্ত ছান্দস তরঙ্গের মধ্যে তরঙ্গকে আকর্ষিত না গ্রহণ করা শুরু করেন। সেই সময় জন্মা অন্য মানুষদের এমন সামর্থ্য ছিল না যে তাঁরা সেগুলোকে গ্রহণ করবেন। আজও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে লক্ষ-লক্ষ বছর পূর্বের বিভিন্ন ধ্বনি তরঙ্গ অতি সূক্ষ্ম অবস্থায় বিদ্যমান আছে। যদি মানব এমন টেকনিক বিকশিত করতে পারে যা দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত আদি কালে বলা হয়েছে এমন বিভিন্ন ধ্বনির সূক্ষ্ম রূপকে শুনতে পারবে, তো সেই ধ্বনিকে শোনা হয়তো সম্ভব হবে। বৈদিক ছন্দ এইসব ধ্বনির থেকেও সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান হয়। ঋগ্বেদের মধ্যে বৈদিকী বাক্ গ্রহণ করার সুন্দর বিজ্ঞানকে এইভাবে দেখানো হয়েছে -
বেদের প্রাদুর্ভাব
আমি এখানে প্রসঙ্গানুসারে এইসব মন্ত্রের কেবল আধিভৌতিক ভাষ্য করবো, সেগুলোর মধ্যে প্রথম মন্ত্রের ভাষ্য হল এইরূপ -
.
বৃহস্পতে প্রথমম্ বাচো অগ্রম্ য়ৎপ্রৈরত নামধেয়ম্ দধানাঃ। য়দেষাম্ শ্রেষ্ঠম্ য়দরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাম্ নিহিতম্ গুহাবিঃ।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১)
.
(বৃহস্পতে) [এখানে "বৃহস্পতেঃ" এই স্থানে সম্বোধনান্ত পদ ব্যবহৃত হয়েছে। তারসঙ্গে এই পদ সম্বোধনার্থও ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।] হে বেদবাণীর পালক বিদ্বন্! (নামধেয়ম্) সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ এবং সেগুলোর নামকে (দধানাঃ) ধারণকারী অত্যন্ত পবিত্র অন্তঃকরণ যুক্ত সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন ঋষি (য়ৎ, প্র, ঐরৎ) যে প্রেরণা পরমাত্মার থেকে প্রাপ্ত করেন অর্থাৎ সেই আদি ঋষি যেসব ঋচাকে পরব্রহ্ম পরমাত্মার প্রেরণায় ব্রহ্মাণ্ড থেকে গ্রহণ করেন, (প্রথমম্, বাচঃ, অগ্রম্) সেই বাণী হল মানব ব্যবহারে নিয়ে আসা বাণীর মধ্যে সবথেকে অগ্রিম বাণী। (য়দেষাম্, য়ৎ, শ্রেষ্ঠম্) যে বেদবাণী হল এই সমস্ত মানবী ভাষার মধ্যে সবথেকে উত্তম বাণী, (য়ৎ, অরিপ্রম্, আসীৎ) [অরিপ্রম্ = রীঙ্ শ্রবণে দিবা. ধাতো "লীরীঙ্গোহ্রস্ব. উ.কো. ৫.৫৫ সূত্রেণ রঃ প্রত্যয়ঃ পুগাগমো হ্রস্বশ্চ। নঞ্ সমাসঃ (বৈদিক কোষঃ )] সেটা পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে থাকে। ঋষিদের দ্বারা আকাশ থেকে গ্রহণ করার সময় সেই বাণী কোনোরূপ ক্ষয় প্রাপ্ত হয় না আর না তাতে কিছু মিশ্রণ থাকে। (তৎ, এষাম্, প্রেণা) সেই বেদবাণী এই সমস্ত বাণীর মধ্যে সর্বাধিক বেগপূর্বক গমন কারী হয় অথবা সেটা প্রকৃষ্টরূপেণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। (গুহা, নিহিতম্, আবিঃ) [আবিঃ = আবিষ্কুরুতে (নিরুক্ত ৫.৯)] সেই বাণী অন্তরীক্ষরূপী গুহার মধ্যে নিহিত থাকে, যা ঋষিদের অন্তঃকরণ রূপী গুহার মধ্যে প্রকট হয়।
.
এখানে এই ঋচার প্রথম পদ "বৃহস্পতে" কে "বৃহস্পতেঃ" মানলে এই সংকেতও পাওয়া যায় যে সেটা অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত বেদবাণী সম্পূর্ণ বাণী এবং সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পালক ও স্বামী পরমাত্মারই বাণী হয় অর্থাৎ তাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়।
.
ভাবার্থ - সৃষ্টি উৎপন্ন হলে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে বেদের ঋচা প্রাপ্ত হয়। এই ঋচা পরা ও পশ্যান্তী রূপে সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষে ভরে থাকে। প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন সর্বাধিক পবিত্রাত্মা চার ঋষি সমাধিস্থ হয়ে ঈশ্বরের প্রেরণায় এইসব ঋচাকে গ্রহণ করেন। এর পূর্বে কোনো মানুষের কোনো ভাষাই ছিল না, বরং ভাষার উৎপত্তি এইসব ঋচার উৎপত্তির পশ্চাৎ এগুলোরই অপভ্রষ্ট হওয়াতে হয়েছে। এই বাণী থেকে শ্রেষ্ঠ বা এর সমতুল্য ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো ভাষা হওয়া সম্ভব নয়। যখন সেই ঋষি জন বাণীকে সমাহিত চিত্ত হয়ে অন্তরীক্ষ থেকে গ্রহণ করেন, সেই সময় সেই বাণীগুলো শুদ্ধ ও পূর্ণ রূপে তাঁদের অন্তঃকরণে প্রবিষ্ট হয়। কোনো ঋচা ও ঋচার অংশ একটা পদও এই প্রক্রিয়াতে স্রাবিত হয় না অর্থাৎ অন্তরীক্ষে যেরূপ সেই ঋচাগুলো ব্যাপ্ত হয়, সেগুলো সেইরূপে গ্রহণ করা হয়। সেই বাণী অর্থাৎ বেদ মন্ত্র সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে অত্যন্ত শীঘ্রতাপূর্বক হঠাৎ প্রবিষ্ট হয়ে যায়, যেভাবে কেউ মন্ত্রকে কণ্ঠস্থ করে সেইরূপ নয়।সেই মন্ত্রগুলো অন্তরীক্ষ থেকে সেই ঋষিদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে। এর অর্থ হল সেই মন্ত্রগুলো ঋষিদের স্মৃতিস্তরে সদ্যঃ অঙ্কিত হয়ে যায়।
.
দ্বিতীয় মন্ত্রের আধিভৌতিক ভাষ্য হল এইরূপ -
সক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো য়ত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।
অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাম্ লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.২)
.
(সক্তুম্, এব) [সুক্তুঃ = সুক্তুঃ সচতের্দুধাবো ভবতি (নিরুক্ত ৪.১০)] অশুদ্ধ মিশ্রিত ছাতু যাকে হাত দিয়ে শুদ্ধ করা কষ্টসাধ্য হয়, তাকে যেভাবে সহজে শুদ্ধ করা হয়, (তিতউনা) [তিতউ = তিতউ পরিপবনম্ ভবতি। ততবদ্বা তুন্নবদ্বা তিলমাত্রম্ তুন্নমিতি বা (নিরুক্ত ৮.৯)] সূক্ষ্ম ছিদ্র যুক্ত বিস্তৃত শোধন কর্মকারী চালনি দিয়ে (য়ত্র, ধীরাঃ) সেইরূপ যখন অথবা যেখানে অত্যন্ত সত্ত্বগুণ ধারণকারী সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপন্ন ঋষি ধ্যানাবস্থিত অবস্থায় [ধীরাঃ = প্রজ্ঞানবন্তো ধ্যানবন্তঃ (নিরুক্ত ৪.১০)] (মনসা) সমাহিত অন্তঃকরণ দ্বারা (পুনন্তঃ) অন্তরীক্ষস্থ বেদ বাণীকে শুদ্ধ করে (বাচম্, অক্রত) সেই বেদ বাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করেন। (অত্র, সখায়ঃ) এই বেদবিদ্যার বিষয়ে সব প্রাণীদের সখারূপ হিতচিন্তক সেই ঋষিজন (সখ্যানি, জানতে) [সখা = সমানম্ খ্যাতীতি সখা (উ.কো.৪.১২৮)] যেখানে এমন মানুষ আছেন যারা সকল প্রাণীর প্রতি মিত্রধর্মকে জানেন, সেখানে ঈশ্বরের সহায়তায় বেদমন্ত্র, সেগুলোর পদের অর্থ অর্থাৎ শব্দ এবং অর্থের সম্বন্ধকে পূর্ণ রূপে জেনে যান। (এষাম্, বাচি, অধি) সেই বেদবাণীর মধ্যে (ভদ্রা, লক্ষ্মীঃ) [লক্ষ্মীঃ = লক্ষ্মীর্লাভাদ্বা লক্ষণাদ্বা লক্ষ্যতে চিন্ত্যতে সর্বেণ - স্কন্দস্বামী (নিরুক্ত ৪.১০), ভদ্রম্ = ভদ্রম্ ভগেন ব্যাখ্যাতম্ ভজনীয়ম্ ভূতানামভিদ্রবণীয়ম্ ভবদ্রময়তীতি বা (নিরুক্ত ৪.১০)] সকল প্রাণীর জন্য প্রাপ্ত করার যোগ্য পদার্থ আর চিন্তন অর্থাৎ সেই পদার্থের বিজ্ঞান (নিহিতা) নিহিত থাকে।
.
ভাবার্থ - মানব সৃষ্টি উৎপত্তির সময় এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে বেদমন্ত্র ব্যাপ্ত থাকে। সেগুলো সম্পূর্ণ অন্তরীক্ষের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে উৎপন্ন চার সর্বশ্রেষ্ঠ ঋষি সমাধিস্থ মনের দ্বারা অন্তরীক্ষ থেকে ঋচাগুলোকে সেইভাবে ছাঁনিয়ে গ্রহণ করে যেভাবে ছাতু বা আটা ছাঁকনি দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। যেরূপ ছাঁকনি ছাড়া হাত দিয়ে ছাতু বা আটাকে শুদ্ধ করা কঠিন হয়, সেইরূপ সমাধিস্থ মন ছাড়া অন্তরীক্ষস্থ ঋচাকে গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। এখানে এই উপমা এটাও দর্শায় যে চারজন ঋষির দ্বারা বেদমন্ত্র গ্রহণ করার জন্য এটা সিদ্ধ হয়ে যায় না যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে এই সমস্ত মন্ত্রের অতিরিক্ত আর কোনো মন্ত্র ছিল না। যদি এমন হতো, তাহলে ছাঁকনি দিয়ে ছাতু ছাঁনিয়ে নেওয়ার সমান মন্ত্রকে গ্রহণ করার চর্চা হতো না। সেই চারজন ঋষি প্রাণীমাত্রের হিতচিন্তক আর মুক্তি থেকে পুনরাবৃত্ত হয়ে মানুষের মধ্যেও সর্বোচ্চ স্তরের হন। এইজন্য তাঁরাই মন্ত্রকে গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তাঁরা ঈশ্বরের কৃপায় সেই গৃহীত মন্ত্র, সেগুলোর পদ আর সেই পদের অর্থের নিত্য সম্বন্ধকে সম্পূর্ণ রূপে জেনে নেন। সেইসব মন্ত্রের মধ্যে সৃষ্টির সম্পূর্ণ পদার্থকে যথাযথ ভাবে জানার জন্য সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নিহিত থাকে আর সেই বিজ্ঞান প্রত্যেক মানুষের জন্য সকল প্রকারের লাভ প্রাপ্তকারীও হয়।
.
এখন আমি তৃতীয় মন্ত্রের আধিভৌতিক ভাষ্য করবো -
য়জ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্।
তামাভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাম্ সপ্তরেভা অভি সম্ নবন্তে।। (ঋগ্বেদ ১০.৭১.৩)
.
(য়জ্ঞেন) [য়জ্ঞঃ = ব্রহ্ম হি য়জ্ঞঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৫.৩.২.৪), য়জ্ঞঃ প্রজাপতিঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১১.৬.৩.৯)] সেই ধীর বিদ্বানজন, যাঁদের চর্চা পূর্ব মন্ত্রের মধ্যে করা হয়েছে, সবার পালক পরব্রহ্ম পরমাত্মার সাক্ষাৎকার দ্বারা অর্থাৎ তাঁর সহায়তায় (বাচঃ, পদবীয়ম্) সেই বেদবাণীর বিভিন্ন পদের মার্গ আর অনুক্রমকে (আয়ন্) জানেন বা প্রাপ্ত করেন ( ঋষিষু, প্রবিষ্টাম্) আকাশস্থ সূক্ষ্ম রশ্মির মধ্যে প্রবেশ হওয়া (তাম্, অনু, অবিন্দন্) সেই বেদবাণীকে অনুক্রমপূর্বক প্রাপ্ত করেন। (তাম্, আভৃত্য) সেই প্রাপ্ত হওয়া বেদবাণীকে নিজের অন্তঃকরণে ধারণ করে (পুরুত্রা, ব্যদধুঃ) সর্বত্র প্রচারিত করেন। (তাম্, সপ্তরেভাঃ) [রেভঃ = স্তোতৃনাম (নিঘন্টু ৩.১৬)] সেই বেদবাণীর মধ্যে সাত প্রকারের ছন্দ (অভি, সম্নবন্তে) [সম্নবন্তে = নবতে, গতিকর্মা (নিঘন্টু ২.১৪)] সবদিক দিয়ে ব্যাপ্ত থাকে।
.
ভাবার্থ - পূর্বোক্ত চার আদি ঋষি যখন ধ্যানাবস্থিত হন আর পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার করেন, তখন তাঁরা অন্তরীক্ষ থেকে আসা ঋচা আর সেগুলোর পদকে ক্রমপূর্বক আসতে অনুভব করেন। তাঁরা ক্রমপূর্বক সেইসব ঋচা আর পদের বিজ্ঞানকেও পূর্ণরূপে জানতে থাকেন। সেই ঋচাগুলো অন্তরীক্ষে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ঋষিরশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে, সেখান থেকে সেই ঋষিগণ সেগুলোকে নিজের অন্তঃকরণে গ্রহণ করেন। এইভাবে নিজের সামর্থ্যের অনুসারে সমস্ত ঋচাকে মহর্ষি ব্রহ্মার মাধ্যমে সর্বত্র প্রচারিত করেন। সেই বেদবাণী প্রধানত সাত ছন্দ যুক্ত হয়। [ সপ্ত = সৃপ্তা সংখ্যা (নিরুক্ত ৪.২৬)] সেইসব ছন্দ সম্পূর্ন আন্তরীক্ষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে আর সর্বত্র এগুলো একে-অপরের দিকে গতিশীল থাকে। সেগুলোর মধ্যে চার ঋষি বেদের এই ঋচাগুলোকে গ্রহণ করেন।
.
এই তিন মন্ত্রের দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আকাশে অনেক ঋচা ছন্দরূপী প্রাণরশ্মির রূপে উৎপন্ন হয়ে বিদ্যমান থাকে, তখন অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা ঋষি সমাধি অবস্থায় পরমাত্মার কৃপায় অন্তরীক্ষস্থ সেই ঋচাগুলো থেকে মানব জীবন হেতু আবশ্যক ঋচাগুলোকে সমাহিত চিত্ত দ্বারা ছেঁকে-ছেঁকে নিজের চিত্তের মধ্যে সংগৃহীত করেন। সেই ঋচাগুলোই ক্রমশঃ ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ আর অথর্ববেদের রূপ হয়। এই চারজন ঋষি না কেবল সেইসব ঋচাকে সংগ্রহ করেন, অপিতু পরমাত্মার কৃপায় সেই ঋষিগণ সেইসব ঋচা অর্থাৎ বাণীর অর্থকেও জেনে যান। সেই চারজন ঋষি এই জ্ঞানকে মহর্ষি আদ্য ব্রহ্মাকে প্রদান করেন। এইভাবে সংসারের মধ্যে পরবর্তীতে জ্ঞানের প্রবাহ চলতে থাকে।
প্রশ্ন - অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গিরা নামক ঋষি কি কেবল এই সৃষ্টিতে উৎপন্ন হয়েছেন নাকি প্রত্যেক সৃষ্টিতে এই নামের ঋষিই বেদকে গ্রহণ করেন?
.
উত্তর - আমার মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রারম্ভে যে চারজন ঋষির দ্বারা আকাশ থেকে বৈদিক ছন্দকে গ্রহণ করা হয়, তাঁদের এই নামই হয়। এই নামগুলো রূঢ় নয়, বরং য়োগরূঢ় হয়।
প্রশ্ন - পরমাত্মা সৃষ্টির আদিতে চারজন পুরুষকেই কেন বেদজ্ঞান দিয়েছেন, স্ত্রীদের কেন দেন নি? এটা কি বৈষম্যের কারণ নয়?
.
উত্তর - আপনি এটা কিভাবে জানলেন যে এই চারজন ঋষি পুরুষই ছিলেন, এরমধ্যে কোনো স্ত্রী ছিলেন না। আপনি কি পাণিনীয় ব্যাকরণের আধারে এদের নাম থেকে লিঙ্গের নির্ধারণ করছেন? তাই যদি হয়, তাহলে আপনার জেনে রাখা উচিত যে ব্যাকরণের নিয়ম আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে সর্বত্র সমান রূপে কাজ করে না। সর্বত্র সর্বদা বেদাদি শাস্ত্রের প্রতি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ভালো নয়।
.
বাণী
বিদ্বানরা বাণীর চারটা রূপ বলেছেন -
চত্বারি বাক্পরিমিতা পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মনীষিণঃ। গুহা ত্রীণি নিহিতা নেঙ্গয়ন্তি তুরীয়ম্ বাচো মনুষ্যা বদন্তি।। (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫)
.
উপরোক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে ঋষি দয়ানন্দ বৈয়াকরণের দৃষ্টিতে চার প্রকারের বাণী যথা - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত রূপে বর্গীকৃত করেছেন। আচার্য সায়ণ এই ভাষ্যে বাণীর বর্গীকরণ বৈয়াকরণের দৃষ্টির অতিরিক্ত নৈরুক্ত আদির দৃষ্টিকে নিয়েও করেছেন। এরমধ্যে একটা বর্গীকরণ হল - পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী। এরমধ্যে কেবল বৈখরী বাণী মানুষের ব্যবহারে আসে, বাকি তিন প্রকারের বাণীকে কেবল য়োগী পুরুষই দেখতে বা জানতে পারেন।
.
মহর্ষি প্রবর য়াস্ক নিরুক্ত ১৩.৯ এরমধ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে বাণীর বর্গীকরণ নিম্ন প্রকারে করেছেন -
"চত্বারি বাচঃ পরিমিতানি পদানি তানি বিদুর্ব্রাহ্মণা য়ে মেধাবিনঃ গুহায়াম্ ত্রীণি নিহিতানি নার্থম্ বেদয়ন্তে গুহা গূহতেঃ তুরীয়ম্ ত্বরতেঃ কতমানি তানি চত্বারি পদানি ওঙ্কারো মহাব্যাহৃতয়শ্চেত্যার্ষম্ নামাখ্যাতে চোপসর্গনিপাতাশ্চেতি বৈয়াকরণাঃ মন্ত্রঃ কল্পো ব্রাহ্মণম্ চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি য়াজ্ঞিকাঃ ঋচো য়জূম্ষি সামানি চতুর্থী ব্যাবহারিকীতি নৈরুক্তাঃ সর্পাণাম্ বাগ্বয়সাম্ ক্ষুদ্রস্য সরীসৃপস্য চতুর্থী ব্যাবহারিকীত্যেকে পশুষু তূণবেষু মৃগেষ্বাত্মনি চেত্যাত্মপ্রবাদাঃ অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি।"
.
এখানে বর্গীকরণ নিম্নানুসারে -
১. আর্ষমত - ওঙ্কার আর ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ মহাব্যাহৃতি।
ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন -
অকারম্ চাপ্যুকারম্ চ মকারম্ চ প্রজাপতিঃ।
বেদত্রয়ান্নিরদুহদ্ ভূর্ভুবঃ স্বরিতীতি চ।। (মনুস্মৃতি ২.৭৬)
অর্থাৎ বেদ থেকে এই চার পদকে প্রজাপতি দোহন করেন - ওম্, ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ। বেদের সার হল এটাই।
২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ এবং নিপাত।
৩. য়াজ্ঞিক মত - মন্ত্র, কল্প, ব্রাহ্মণ এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৪. নৈরুক্ত মত - ঋক্, য়জুঃ, সাম এবং ব্যাবহারিকী অর্থাৎ লোকভাষা।
৫. অন্য মত - সর্পের বাক্, পক্ষীর বাক্, ক্ষুদ্র সরীসৃপের বাক্ তথা ব্যাবহারিকী (মানব - লোকভাষা)।
৬. আত্মবাদী মত - পশু, বাদ্যযন্ত্র, সিংহ আদির মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকী বাণী।
.
এর অতিরিক্ত নিরুক্তকার (১৩.৯) বাণীর অন্য শ্রেণী সম্বন্ধে মৈত্রায়াণী সংহিতাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন -
"অথাপি ব্রাহ্মণম্ ভবতি - সা বৈ বাক্ সৃষ্টা চতুর্থা ব্যভবৎ এষু লোকেষু ত্রীণি তুরীয়াণি পশুষু তুরীয়ম্য়া পৃথিব্যাম্ সাগ্নৌ সা রথন্তরে য়ান্তরিক্ষে সা বাতে সা বামদেব্যে য়া দিবি সা বৃহতী সা স্তনয়িত্নৌ অথ পশুষু ততো য়া বাগত্যরিচ্যত তাম্ ব্রাহ্মণে ন্বদধু, স্তস্মাদ্ ব্রাহ্মণ উভয়ীম্ বাচম্ বদতি য়শ্চ দেব য়শ্চ ন..."
.
অর্থাৎ সেই উৎপন্ন হওয়া বাণী চার প্রকারের হয়। ভূঃ, ভুবঃ এবং স্বঃ এই তিন লোক বা সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মিরূপে তিন প্রকারে তথা পশু অর্থাৎ বিভিন্ন মরুত্ ও ছন্দ রশ্মি রূপে [পশবো বৈ মরুতঃ] চতুর্থ প্রকারে। যে বাণী পৃথিবীর মধ্যে আছে, সেটাই অগ্নি তথা রথন্তর সামের মধ্যে আছে। এর তাৎপর্য হল যে বাণী অপ্রকাশিত পরমাণুর মধ্যে আছে, সেটা ঊষ্মা ও বিদ্যুৎ যুক্ত কণার মধ্যেও আছে তথা সেই বাণী রথন্তর সাম অর্থাৎ এমন তীব্র বিকিরণ, যা রমণীয় হয়েও তীক্ষ্ণ ভেদক তথা বিভিন্ন কণাকে অতিক্রমকারী হয়, তাতেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী অন্তরীক্ষে আছে, সেই বাণী বায়ুর (সূক্ষ্ম ও স্থূল) মধ্যেও বিদ্যমান আছে। এখানে সূক্ষ্ম বায়ুর তাৎপর্য বিভিন্ন প্রকারের প্রাণের সঙ্গে হবে। সেই বাণী বামদেব্য অর্থাৎ বিভিন্ন সৃজন-প্রজনন কর্মে অংশগ্রহণ কারী প্রশস্য ও প্রকাশমান প্রাণ তত্ত্বের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। যে বাণী দ্যুলোক অর্থাৎ সূর্যাদি তারার মধ্যে আছে, সেটাই সেগুলোর কিরণের মধ্যে তথা সেইরূপ বাণী স্তনয়িন্তু অর্থাৎ শব্দ করতে থাকা বিদ্যুতের মধ্যেও আছে। এছাড়া অন্য বাণী পশু অর্থাৎ মানুষের ব্যাবহারিকীর (লোক ভাষা) হয়। এর অতিরিক্ত যেসব বাণী আছে, পরমাত্মা সেগুলো ব্রাহ্মণের মধ্যে ধারণ করেন। এখানে ব্রাহ্মণের অর্থ হল - অত্যুচ্চ স্তরের য়োগী পুরুষ, যিনি পরমব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে সর্বদা রমণ করেন। এমন ব্রহ্মবেত্তা মহাপুরুষ দুই প্রকারের (মোট চার প্রকারের) বাণী, সেগুলো বিভিন্ন দেবের (লোক আদি) মধ্যে বিদ্যমান হলেও অথবা মানুষের কথা বলার বাণী হলেও, তাঁরা জানেন। এমন ব্রাহ্মণের অক্ষর স্তুতি হয়।
.
এখানে নিরুক্তকার স্বমত তথা মৈত্রায়ণী সংহিতার মত থেকে বাক্-তত্ত্বের গম্ভীর ও ব্যাপক স্বরূপের উপর প্রকাশ ফেলেছেন।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিকও অনেক প্রকারের ধ্বনিকে জানে। সুপারনোবার বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন অতি শক্তিশালী তরঙ্গকে বৈজ্ঞানিক শক-ওয়েবস বলে। ইউ.এস.এ. খগোল ভৌতিকশাস্ত্রী জন গ্রিবিন ডার্ক ম্যাটার তথা কোস্মিক কিরণের মধ্যেও সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের উপস্থিতি মানেন। একথা তিনি তাঁর পুস্তক "দ্য অরিজিন্স অফ দ্য ফিউচার - টেন কোশ্চেনস ফর দ্য নেক্সট টেন ইয়ার" পৃষ্ঠা ১৩০ ও ১৩৪ এরমধ্যে লিখেছেন। সৃষ্টি উৎপত্তির মহা বিস্ফোরণে (বিগ ব্যাং) যে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ২.৭ কেলভিন মানা হয়, সেই অত্যন্ত শীতল রেডিয়েশনের মধ্যেও অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্পন্দন (ফ্লাকচুয়েশন) হওয়াকে বৈজ্ঞানিক মানে আর এই উত্থান-পতন ধ্বনি তরঙ্গের রূপে হয়। "দ্য ট্রবল উইথ ফিজিক্স" নামক পুস্তকের ২০৫ পৃষ্ঠাতে লি স্মোলিন লিখেছেন -
"Over the last decades, the temperature fluctuations of the microwave background have been mapped by satellites, balloon borne detectors, and ground based detectors, one way to understand what these experiments measure is to think of the fluctuations as if they were sound waves in the early universe."
এখানে স্পষ্টভাবে সূক্ষ্ম ধ্বনি তরঙ্গের চর্চা করা হয়েছে। সূর্যতে হওয়া বিস্ফোরণ তথা সামান্য অবস্থাতেও পৃথিবীর ভিতরে বিভিন্ন গতিবিধি এবং অন্তরীক্ষে কোস্মিক রেজের সংঘর্ষ থেকেও ধ্বনি তরঙ্গের উৎপত্তিকে বৈজ্ঞানিক মানে ও জানে। যে কথা বৈজ্ঞানিক আজ জানেছে, তার থেকেও সূক্ষ্ম বিজ্ঞানকে মহর্ষি য়াস্ক ও মৈত্রায়ণী সংহিতাকার সহস্র বছর পূর্বে জানতেন। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে বাক্ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান হল খুবই বিস্তৃত ও গম্ভীর। এই ধ্বনি আসলে কি, একে বৈজ্ঞানিক এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ভাবে জানতে পারেনি।
.
ধ্বনির বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের কথন হল -
"Sound is an alteration in pressure, stress, particle displacement or particle velocity, which is propogated in an elastic material, or the superposition of such propogated vibrations." (Definition recommended by American Standard Association) - "Acoustics" By Joseph L. Hunter
.
এখানে নিশ্চিত ভাবে ধ্বনির স্পষ্ট ও উত্তম স্বরূপ বলা হয়নি, বরং কোনো পদার্থে উৎপন্ন চাপের রূপেই ধ্বনি তরঙ্গকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ কথা। সেই চাপ কেন ও কিভাবে উৎপন্ন হয়, একথা বর্তমান বিজ্ঞান কিছুই স্পষ্ট করে বলতে পারে না।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশাদি বিকিরণের মতো ধ্বনির কণাকেও কল্পনা করে। "কিউ ইজ ফর কোয়ান্টাম পার্টিকল ফিজিক্স ফ্রম এ টু জেড" নামক পুস্তকের ২৮১ পৃষ্ঠাতে জোন গ্রীবিন ধ্বনি কণা ফোননের বিষয়ে লিখেছেন -
"Phonon - A particle of sound travelling through a crystal lattice. The idea of a sound wave can be replaced by the idea of phonons in an analogous way to the description of light in terms of photons."
.
এখানে ধ্বনির কণার ধারণা স্পষ্ট আছে। বৈদিক বিচার ধারার মধ্যেও শব্দ তন্মাত্রার মান্যতা সনাতন থেকে চলে আসছে।
.
এই পর্যন্ত বাণীর বিভিন্ন রূপের চর্চা করার পর এখন আমরা পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা তথা বৈখরী এই চার রূপের উপর বিশেষ চর্চা করবো। বাণীর এই বিভাগ যেটা আচার্য সায়ণ করেছেন, তার প্রামাণিকতার উপর কিছু আর্য বিদ্বান প্রশ্ন তুলতে পারেন। যদিও বৈদিক গ্রন্থকে বুঝতে হলে আচার্য সায়ণের শৈলী খুবই দোষপূর্ণ কিংবা মূর্খতাপূর্ণ। যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের আমি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছি, তাতে সায়ণ ভাষ্যের প্রায় উপেক্ষাই করেছি, কারণ তাঁর ভাষ্য সর্বথা দোষপূর্ণ, কোথাও-কোথাও বীভৎস, অশ্লীল, মূর্খতাপূর্ণ তথা বৈদিক দৃষ্টির একদম বিপরীত আছে। এতকিছুর পরও সায়ণাচার্যের কোনো উচিত কথাকেও অস্বীকার করা হোক, সেটা আমি স্বীকার করি না। এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ আর্য বিদ্বান পণ্ডিত ভগবৎদত্ত রিসার্চ স্কলার তাঁর নিরুক্ত ১৩.৯ ভাষ্যের মধ্যে লিখেছেন -
.
"পরাবাক্ সিদ্ধান্ত নতুন নয়। দেবকী পুত্র ভগবান্ কৃষ্ণ এর বর্ণনা সাম্ব পঞ্চাশিকার তৃতীয় শ্লোকে করেছেন।"
.
এইভাবে মহৎ বেদবিজ্ঞানী য়োগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মত আমি সর্বথা স্বীকার করি। যে বিদ্বান এর উপরও শঙ্কা করেন, তাদের কোনো উপায় নেই।
.
পরা, পশ্যন্তী আদি বাণীর চার রূপের চর্চা ব্যাকরণ মহাভাষ্যের ভাষ্য প্রদীপে আচার্য কৈয়ট তথা নাগেশ ভোট্টও করেছেন। ইনি "বাক্যপদীয়মে"র অনেক শ্লোককেও উদ্ধৃত করেছেন।
আমরা বাণীর এই চার স্বরূপ নিয়ে একটু বিচার করবো -
১. পরা - পরা বাণী হল সবথেকে সূক্ষ্ম কিন্তু সর্বাধিক প্রকৃষ্ট তথা সকল বাণীর উচ্চতম মূল স্বরূপ। "পরা" হল একটি অব্যয় পদ, যার প্রয়োগ আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোষে অনেক অর্থে দর্শানো হয়েছে, যারমধ্যে যাওয়া, সম্মুখীন হওয়া, পরাক্রম, উদ্বৃত্ত, পরাধীনতা, মুক্তি, একপাশে রেখে দেওয়া আদি হল মুখ্য। ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী এই অব্যয়ের প্রয়োগ উপরিভাবে, দূরার্থে, পৃথক্, প্রকৃষ্টার্থে, দূরীকরণে, পরাজয়ার্থে আদিতে করেছেন (দেখুন - বৈদিক কোষ, আচার্য রাজবীর শাস্ত্রী)।
.
যদিও আমি এখানে "পরা" উপসর্গ অব্যয় পদের চর্চা করছি না, তবুও এই অর্থ থেকে "পরা" পদের অর্থ বিদিত হওয়াতে "পরাবাক্" স্বরূপেরও বোধ হয়। সংস্কৃতি ব্যাকরণের ব্যবহার করে যেকোনো শব্দের অর্থের সম্বন্ধ ও তদ্-বাচ্য পদার্থের স্বরূপ বোধ করানোই হল ব্যাকরণ শাস্ত্রের বৈজ্ঞানিকতা। এইভাবে পরাবাক্ হল এক এমন সূক্ষ্ম বাণী, যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম, সর্বতোব্যাপ্ত, অত্যধিক মাত্রায় বিদ্যমান, সবাইকে নিজের সঙ্গে বাঁধনকারী কিন্তু স্বয়ং সবার থেকে মুক্ত এবং সবথেকে উত্তম অবস্থায় থাকে। এটা সূক্ষ্মতম হওয়াতে কখনও কর্ণগোচর হওয়া সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সূক্ষ্মতম রূপে ব্যাপ্ত হয়ে প্রত্যেক কণাকে তার সঙ্গে সমন্বয় রাখে। একে অত্যুৎকৃষ্ট কেবল য়োগী পুরুষই অনুভব করতে পারবেন। একে কোনো বৈজ্ঞানিক টেকনিক দিয়ে জানা সম্ভব নয়। আমার মতে মানুষ যে বৈখরী বাণীকে শোনে, সেই বাণী আত্ম তত্ত্ব দ্বারা পরা অবস্থাতেই গ্রহণ করা হয়।
২. পশ্যন্তী - এই শব্দের রূপই বলে দিচ্ছে যে এই বাণী পরার তুলনায় স্থূল তথা এটি বিভিন্ন বর্ণকে দেখে অর্থাৎ তাদেরকে তাদের স্বরূপ প্রদান করে বীজবত্ হয়। এটি পরা বাণী থেকে স্থূল এবং মধ্যমা থেকে সূক্ষ্ম হয়। সাম্ব পঞ্চাশিকার চতুর্থ শ্লোক হল -
য়া সা মিত্রাবরুণসদনাদুচ্চরন্তী ত্রিষষ্টিম্
বর্ণান্তঃ প্রকটকরণৈঃ প্রাণ সঙ্গাৎ প্রসূতে।।
এই শ্লোকের ব্যাখ্যাতে ক্ষেমরাজ বলেছেন -
"তত্র চিজ্জ্যোতিষি গুণীভূত সূক্ষ্মপ্রাণসঙ্গাৎ পশ্যন্ত্যাম্।"
অর্থাৎ পশ্যন্তীতে চিজ্জ্যোতির প্রাধান্য আর সূক্ষ্ম প্রাণ গৌণ থাকে, সেই অবস্থাতেও বর্ণ উৎপন্ন হয়।© [মিত্রাবরুণৌ = মনো মৈত্রাবরুণঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২.৮.২.২৩), প্রাণোদানৌ বৈ মিত্রাবরুণৌ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৮.৩.১২), য়জ্ঞো বৈ মৈত্রাবরুণঃ (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ১৩.২), প্রাণোদানৌ মিত্রাবরুণৌ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ৬.১০.৫)। সদনম্ = গর্ভস্থানম্ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১২.৩৯)] আমার মতে এই শ্লোকের ভাব এমন হবে যে পশ্যন্তী বাক্ প্রাণাপানাদির আধার মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন হয়। প্রাণ, অপান ও উদানাদি রশ্মির গর্ভরূপ এই পশ্যন্তী বাক্ তত্ত্বই হয় অর্থাৎ সমস্ত প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি এই বাক্ তত্ত্ব থেকে এবং এরমধ্যেই উৎপন্ন হয়। এখানে "প্রাণ সঙ্গাৎ প্রসূতে" এরমধ্যে প্রাণের অর্থ মনস্তত্ত্ব মানা উচিত। পরার অতিরিক্ত তিন প্রকারের বাণীর উৎপত্তি এখানে সাম্বপঞ্চাশিকার এই শ্লোক থেকে হয় বলে প্রতীত হচ্ছে। পরা বাণীতে তেষট্টি বর্ণের পৃথকীকরণ অব্যক্তই থাকে।
.
ক্ষেমরাজের কথন থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে চেতনা যখন মনরূপ সূক্ষ্মপ্রাণের সঙ্গে সংযোগ করে অর্থাৎ যখন চেতনার প্রাধান্য তথা সেই সূক্ষ্ম প্রাণ গৌণ হয়, তখন এই পশ্যন্তী বাক্ উৎপন্ন হয়। এই পশ্যন্তী বাক্ সমস্ত বর্ণের মূল রূপকে ধরে রাখে। সম্ভবতঃ এই বাণীকে ভবিষ্যতে কোনো সূক্ষ্ম টেকনিক দিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে, আমি এমন মনে করি। এখানে এমন মনে হচ্ছে যে বাণীর বর্ণরূপ এই পশ্যন্তী অবস্থার মধ্যেই মূল রূপে প্রকট হতে পারে। পরাবাক্ সর্বদাই অব্যক্ত রূপে থাকে। আমার মতে পরা বাণীর মধ্যেও অক্ষরের সংস্কার সূক্ষ্মতম রূপে অবশ্যই বিদ্যমান থাকে আর সেখান থেকেই মূল রূপে পশ্যন্তী বাক্ উৎপন্ন হয় কিংবা পরাবাক্ -ই পশ্যন্তী বাক্ রূপে পরিবর্তিত হয়। এটা উল্লেখযোগ্য যে পশ্যন্তী অবস্থাতেও বর্ণের স্পষ্ট রূপ বিদ্যমান হয় না।
.
পণ্ডিত শিবশঙ্কর অবস্থী বাক্যপদীয়ম্ টীকার ৭৪ পৃষ্ঠাতে একটা অজ্ঞাতরচিত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন -
বৈখরী শব্দনিষ্পত্তির্মধ্যমা শ্রুতিগোচরা।
দ্যোতিতার্থা চ পশ্যন্তী সূক্ষ্মা বাগনপায়িনী।।
.
এই শ্লোকের কিছু পাঠ্যগত পার্থক্য করে ব্যাকরণের ভাষ্যপ্রদীপকার নাগেশ ভট্ট "চত্বারি বাক্পরিমিতা" (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫) মন্ত্রের বক্তৃতাতে দিয়েছেন।
.
এতে পশ্যন্তীর স্বরূপের বিবেচনাতে অবস্থীর কথন ঠিকই আছে যে এরমধ্যে শ্রোতার বুদ্ধিতে অর্থের দ্যোতন হয়। যখন কোনো ব্যক্তি কান দিয়ে কিছু শোনে, তখন কানের তন্ত্রিকা দ্বারা সংবেদনা মস্তিষ্ক পুনঃ মনস্তত্ত্বের মধ্যে গিয়ে পৌঁছায়। সেই সংবেদনাতে বর্ণের বিদ্যমানতার মধ্যেই মনের সহায়তায় মস্তিষ্ক বর্ণের শনাক্তকরণ করে। যদি সেই সংবেদনার মধ্যে বর্ণের একদম অভাব থাকে, তাহলে মস্তিষ্ক বা মনস্তত্ত্ব বাণীকে কিছুতেই শনাক্তকরণ করতে পারবে না। পশ্যন্তী বাণী হল সেটাই যেটা কান দিয়ে তো শোনা যায় না কিন্তু মস্তিষ্কের মাধ্যমে মনস্তত্ত্ব যাকে অনুভব করে।
.
৩. মধ্যমা - সাম্বপঞ্চাশিকার উপরোক্ত উদ্ধৃত শ্লোকের ব্যাখ্যাতে ক্ষেমরাজ লিখেছেন -
"গুণীভূত চিৎসূক্ষ্মপ্রাণসঙ্গান্মধ্যমায়াম্।"
.
এর উপর ডাক্তার অবস্থী ৪২৪ পৃষ্ঠাতে লিখেছেন যে মধ্যমা বাণীতে চিজ্জ্যোতি গৌণ তথা সূক্ষ্ম প্রাণ প্রধান হয়। এই বাক্ পশ্যন্তীর থেকে স্থূল ও বৈখরীর থেকে সূক্ষ্ম মানা হয়। উপরোক্ত অজ্ঞাতরচিত শ্লোকের ব্যাখ্যাতে ডাক্তার অবস্থীর কথা হল - যে বাণী শ্রোতার কান দ্বারা শোনা যায়, সেটা হল মধ্যমা। এরদ্বারা আমার এটাই মনে হয় যে কর্ণপটললে যে ধ্বনি শোনা যায়, সেটা যে স্বরূপকে প্রাপ্ত করে, তাকে মধ্যমা বলে। মস্তিষ্ক আর কানের মাঝে যে বাণীর সংচরণ হয়, এটাই হল সেটা। এতে বর্ণের রূপ পশ্যন্তীর তুলনায় স্থূল এবং বৈখরীর তুলনায় সূক্ষ্ম হয়। পশ্যন্তীর মতো এখানেও চেতনের সাহচর্য অনিবার্য আছে, কিন্তু তার থেকে কিছুটা ন্যুন হবে।
.
৪. বৈখরী - এই বাণী হল স্থূল, যাকে আমরা কথাবলি। "বৈখরী" শব্দের ব্যাখ্যা আপ্টে তাঁর কোষে করেছেন - "বিশেষেণ খম্ রাতি" অর্থাৎ যা বিশেষ ভাবে আকাশের মধ্যে মিশে যায়। বক্তা ও শ্রোতার মাঝে এই বাণীই গমন করে, যা শেষে শ্রোতার মস্তিষ্কে গিয়ে পশ্যন্তীর রূপ নেয়। এই বিষয়ে উপরোক্ত উদ্ধৃত সাম্বপঞ্চাশিকার শ্লোকের ব্যাখ্যাতে ক্ষেমরাজ লিখেছেন -
"স্থূলপ্রাণসঙ্গাদ্বৈখর্য়াম্ বর্ণা জায়ন্তে।"
অর্থাৎ স্থূল প্রাণের সঙ্গ থেকে বৈখরীতে বর্ণের উৎপত্তি হয়। এখানে বক্তার স্বরযন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন অভ্যন্তর ও বাহ্য প্রচেষ্টায় যে ধ্বনি রূপ বর্ণের উৎপত্তি হয়, সেই সংকেত আছে। এটাই হল লোক ভাষা।
.
এখন বাণীর চার রূপের উপর সায়ণাচার্যের মত উদ্ধৃত করবো -
"পরাপশ্যন্তী মধ্যমা বৈখরীতি চত্বারীতি। একৈব নাদাত্মিকা বাগ্মূলাধারাদুদিতা সতী পরেত্যুচ্যতে। নাদস্য চ সূক্ষ্মত্বেন দুর্নিরূপত্বাৎ সৈব হৃদয়গামিনী পশ্যন্তীত্যুচ্যতে য়োগিভির্দ্রষ্টুম্ শক্যত্বাৎ। সৈব বুদ্ধিম্ গতা বিবক্ষাম্ প্রাপ্তা মধ্যমেত্যুচ্যতে মধ্যে হৃদয়াখ্য উদীয়মানত্বান্মধ্যমায়াঃ। অথ য়দা সৈব বক্ত্রে স্থিতা তাল্বোষ্ঠাদিব্যাপারেণ বহির্নির্গচ্ছিতি তদা বৈখরীত্যুচ্যতে।" (ঋগ্বেদ ভাষ্য ১.১৬৪.৪৫)
অর্থাৎ যখন কোনো মানুষ বাণীর উচ্চারণ করেন, তখন সর্বপ্রথম নাদরূপ বাক্ মূলাধার চক্রতে উৎপন্ন হয়ে উপর ওঠা শুরু করে। এটাই হল বাণীর সূক্ষ্মতম পরারূপ। এর নিরূপণ সম্ভব নয় অর্থাৎ অতি দুষ্কর। যখন এই পরা বাণী হৃদয় চক্রতে আসে, তখন সেখানে এটাই পশ্যন্তী বাক্ রূপ নিয়ে নেয়। এই বাণী যখন বুদ্ধি তত্ত্বের সম্পর্কে আসে, তখন মধ্যমা রূপে প্রকট হয়ে কণ্ঠতে উপস্থিত তালু-ওষ্ঠাদির প্রচেষ্টায় বৈখরীর রূপ ধারণ করে বাইরে বেরিয়ে আসে।
.
শব্দের এই বিষয়ে মহর্ষি পাণিনি বর্ণোচ্চারণশিক্ষাতে লিখেছেন -
আকাশবায়ুপ্রভবঃ শরীরাৎসমুচ্চরন্ বক্ত্রমুপৈতি নাদঃ।
স্থানান্তরেষু প্রতিভজ্যমানো বর্ণত্বমাগচ্ছতি য়ঃ স শব্দঃ।।
আত্মা বুদ্ধ্যা সমেত্যার্থান্মনো য়ুঙ্ক্তে বিবক্ষয়া।
মনঃ কায়াগ্নিমাহন্তি স প্রেরয়তি মারুতম্।
মারুতস্তূরসি চরন্মন্দম্ জনয়তি স্বরম্।।
.
এর ব্যাখ্যা ঋষি দয়ানন্দ এই ভাবে করেছেন -
"আকাশ আর বায়ুর সংযোগে উৎপন্ন হওয়া, নাভীর নিচ থেকে উপরে উঠে যে মুখকে প্রাপ্ত করে, তাকে "নাদ" বলে। সেটা কণ্ঠ আদি স্থানে বিভাগ প্রাপ্ত হয়ে বর্ণাভাবকে প্রাপ্ত করে, তাকে "শব্দ" বলে। জীবাত্মা বুদ্ধি দিয়ে অর্থের সঙ্গতি করে কথাবলার ইচ্ছাতে মনকে যুক্ত করে, বিদ্যুত-রূপ মন জঠরাগ্নিকে প্ররোচিত তথা বায়ুকে প্রেরণা করে আর বায়ু বক্ষস্থলে বিচরণ করে মৃদু স্বরকে উৎপন্ন করে।"
.
এখানে পাঠক আচার্য সায়ণ, মহর্ষি পাণিনি এবং ঋষি দয়ানন্দের মতের একটু সমতা দেখতে পাবেন। মনের দ্বারা বায়ু নিচে থেকে উপরে উঠে আসা আর মূলাধার থেকে হৃদয় পুনঃ কণ্ঠের দিকে আসা, এই মতগুলোতে সমতা দেখাচ্ছে। এখানে বিবেচনা করা উচিত যে বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের মধ্যে বাণীর চারটা রূপ পৃথক্-পৃথক্ স্থানে প্রকট হয়। সাধারণ ব্যক্তির শোনা ও কথাবলার যোগ্য বাণী বৈখরী-ই হবে, এটা সুনিশ্চিত।
.
এখন প্রশ্ন হল যখন সর্বপ্রথম চারজন ঋষি অন্তরীক্ষ থেকে ঈশ্বরীয় সহায়তায় সম্প্রজ্ঞাত সমাধির মধ্যে বৈদিক ছন্দকে গ্রহণ করেন, তখন সেই ছন্দগুলো ব্রহ্মাণ্ডে বাণীর এই চারটা রূপের মধ্যে কোন রূপে ব্যাপ্ত ছিল? যেমন আজ বেদপাঠী বৈখরী বাণীতে বেদপাঠ করে, আকাশের মধ্যে কি শব্দ সেইভাবে ব্যাপ্ত ছিল? আমার মতে এমন হওয়া সম্ভব নয়। তাল্বাদির প্রচেষ্টা ছাড়া এমন শব্দ অর্থাৎ বৈখরী বাণী উৎপন্ন হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমার মতে এই সমস্ত ছন্দ পরা এবং পশ্যন্তী বাণী রূপে সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল। বর্ণত্বের বীজ তো বিদ্যমান ছিল, তবে শ্রব্য অবস্থায় ছিল না। এখন এই পশ্যন্তী বাক্ -কে ঋষিরা কিভাবে গ্রহণ করলেন? এর চর্চা আমি এই অধ্যায়ের শুরুতে লিখে দিয়েছি। এই বিষয়কে মহাত্মা ভর্তৃহরির বাক্যপদীয়মের ব্রহ্ম কাণ্ডের ১৩৬ শ্লোক পর্যাপ্ত সংকেত দেয় -
আবিভাগাদ্ বিবৃত্তানামভিখ্যা স্বপ্নবচ্ছ্রুতৌ।
ভাবতত্ত্বম্ তু বিজ্ঞায় লিঙ্গেভ্যো বিহিতা স্মৃতিঃ।।
এর অর্থ হল অখণ্ড পরমেশ্বর অথবা পরাবাক্ রূপ একাক্ষর "ওম্" পদ বাচক থেকে বিস্তারিত ও প্রকট হওয়া বিভিন্ন ছন্দ, যা পশ্যন্তী রূপে বিদ্যমান থাকে, স্বপ্নের সমান জ্ঞান হয়। এর তাৎপর্য হল যেরূপ স্বপ্নের মধ্যে শ্রোত্রেন্দ্রিয়ের সহায়তা ছাড়া কোনো ব্যক্তি সূক্ষ্ম শরীর দ্বারা বিভিন্ন বাণী শুনতে পারেন, সেইরূপ সবিচার সমাধি, যেখানে য়োগী ব্যক্তি সূক্ষ্ম বিষয়ের বিচার করেন, সেইভাবে এই ছন্দকে নিজের সূক্ষ্ম শরীর কিংবা অন্তঃকরণ দ্বারা গ্রহণ করে নিজের চিত্তের মধ্যে অগ্নি, বায়ু আদি চারজন ঋষি সঞ্চিত করেছিলেন।
___________________
© দেখুন - মহাত্মা ভর্তৃহরি রচিত বাক্যপদীয়ম্ এর ব্রহ্ম কাণ্ডতে পণ্ডিত শিবশঙ্কর অবস্থীর টীকা, পৃষ্ঠা ৪২৩-২৪

প্রশ্ন - আপনি ভগবদ্ য়াস্ক দ্বারা নিরুক্ত শাস্ত্রে দর্শানো বাণী সম্বন্ধীয় ছয় প্রকারের বর্গীকরণের উপেক্ষা করে আচার্য সায়ণ কিংবা সাম্বপঞ্চাশিকাতে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ অথবা ব্যাকরণ মহাভাষ্যের ভাষ্য প্রদীপকার আচার্য কৈয়ট ও আচার্য নাগেশভট্টকে প্রমাণ মেনে পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা এবং বৈখরী এই বর্গীকরণকে কেন স্বীকার করেছেন? এই যুগের মহান বেদবেত্তা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী ব্যাকরণের মতানুসারেই প্রাক্ বর্ণিত ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৫ ভাষ্য করেছেন, তাসত্ত্বেও আপনি ঋষি দয়ানন্দের উপেক্ষা এইজন্য করেছেন কী, কারণ এতে আপনার ছন্দ বিজ্ঞান এবং তাকে অগ্ন্যাদি চার ঋষির দ্বারা গ্রহণ করার কল্পিত প্রক্রিয়ার পুষ্টি হতো না। ঋষি দয়ানন্দ তাঁর ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকা এবং সত্যার্থপ্রকাশাদি গ্রন্থের মধ্যে স্পষ্ট লিখেছেন যে পরমাত্মা সেই অগ্ন্যাদি চার ঋষির আত্মাতে বেদের প্রকাশ করেন। আপনার বেদজ্ঞান আবির্ভাবের প্রক্রিয়া এর বিপরীত মনগড়া নয় কি? .
উত্তর - যেসব ব্যক্তি সাম্বপঞ্চাশিকার রচয়িতা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের আপ্ততার উপর বিশ্বাস করেন না, সর্বপ্রথম আমি তাদের মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিবো, তারপর তাদের মহাভারতের ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞতে পিতামহ ভীষ্ম দ্বারা বর্ণিত ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের গুণগুলোকে মন দিয়ে পড়তে বলবো। বাক্ বর্গীকরণের উপর বিচার করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে নিরুক্ত বর্গীকরণের যেসব মতের বর্ণনা করা হয়েছে, সেই ধরণের বর্গীকরণ পরা, পশ্যন্তী আদির নয়। আপনার শঙ্কার সমাধানার্থ আমি সমস্ত বর্গীকরণের উপর ক্রমশঃ আলোচনা করবো -
.
১. আর্ষমত - ওঙ্কার, ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ।
.
যেরূপ আমি পূর্বে বলেছি যে এই মত ভগবান্ মনু মহারাজও বলেছেন। একে আর্ষমত বলার পিছনে আমি দুটো প্রমুখ হেতু দেখতে পাচ্ছি -
(ক) ভগবান্ মনু থেকে শুরু করে সকল মহর্ষি ভগবন্তের মতে বাণীর এই বর্গীকরণ মান্য হয়ে আসছে। এইজন্য একে আর্ষমত বলা হয়েছে।
(খ) বিভিন্ন ঋষি-প্রাণের মধ্যে চারটা ছন্দ "ওম্", "ভূ", "ভুব" এবং "স্বঃ" বিদ্যমান থাকে কিংবা এগুলো থেকেই সব ঋষি অর্থাৎ প্রাণের উৎপত্তি হয়। আমি মনে করি, এই কারণেও একে আর্ষমত বলা হয়। ঋষি-প্রাণ আসলে কি, এই বিষয়ে আমি "বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান" নামক অধ্যায়ে লিখবো।
.
বাণীর এই বর্গীকরণ ধ্বনি উৎপত্তির, বিশেষ করে তার পদের বর্ণনা নয়, বরং বাক্ -এর প্রকারের বর্ণনা করে। তবে, মূল বাক্ অবশ্যই "ওম্" হবে। এই বর্গীকরণ দ্বারা বাক্ - এর গ্রাহ্যত্বের চরণ বা সামর্থ্যের কোনো স্পষ্টিকরণ হয় না। এগুলো সবই হল ছন্দ, যা সৃষ্টির শুরুতে উৎপন্ন হয়েছিল আর আজও সর্বতোব্যাপ্ত আছে। পরা, পশ্যন্তী আদি চার রূপে এই চার ছন্দ "ওম্" "ভূঃ" আদি হয় বা হতে পারে। একে এইভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যখন কোনো গায়ক ক্রমশঃ নিশ্চিত চারটা ভজনগীত করেন আর সেই ভজনগীত এমন হয় যেন সেগুলো তার পরবর্তী গীতের ভূমিকার রূপ অথবা তিনি সর্বপ্রথম চার ছন্দ "দোহা", "সোরঠা", "চৌপাই", ও "কবিত্ত" গান করেছেন, কিন্তু সেগুলোকে চার প্রকারের স্তরে বা ধ্বনি তরঙ্গের আবৃত্তিতে গান করেছেন। তখন চার স্তর এবং চার ছন্দ দুই প্রকারের বর্গীকরণ পৃথক্-পৃথক স্তরে হবে। এই ভাবে প্রত্যেক ছন্দ বা বাক্ তত্ত্ব পরা, পশ্যন্তী আদি চার রূপে হয়।
.
২. বৈয়াকরণ মত - নাম, আখ্যাত, উপসর্গ ও নিপাত। এই চারটা বাক্ রূপ হয় তবে চারটাই পরা, পশ্যন্তী আদি স্তরে হয়। এদের মধ্যে পরস্পর কোনো বিরোধ নেই।
.
এইভাবে পূর্বোক্ত য়াজ্ঞিক, নৈরুক্ত আদি সকল মতের বিষয়ে জেনে নেওয়া উচিত। পরা, পশ্যন্তী আদি বর্গীকরণ বস্তুতঃ বক্তা ও শ্রোতার কথাবলা ও শোনার প্রক্রিয়াকে চরণবদ্ধ বিধির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে আর অন্য বর্গীকরণ এই আধারে হয় যে বক্তা ও শ্রোতা কি বলছে বা শুনছে? এইভাবে বিভিন্ন বর্গীকরণের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে।
.
এখন যেহেতু আমরা পূর্ব মহর্ষিগণ দ্বারা বৈদিক ছন্দকে গ্রহণ করার বর্ণনা করছি অর্থাৎ সেই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিকতাকে জানার চেষ্টা করছি, তাই বাণীর অন্য কোনো বর্ণনা এখানে গুরুত্ব রাখে না, বরং পরা, পশ্যন্তী রূপের বর্ণনাই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হবে। এইজন্য আমি প্রসঙ্গানুকূল এরই চর্চা করেছি। যতদূর ঋষি দয়ানন্দের সেই মতের প্রশ্ন, যেখানে তিনি অগ্ন্যাদি চার ঋষির আত্মাতে বেদের প্রকাশের চর্চা করেছেন, সেটা আমার মত পূর্ণরূপে বর্ণিত হওয়ার পর তবেই বোঝা যাবে। এই কারণে আমি আমার পূর্ব প্রসঙ্গে পুনরায় আসবো - যখন চারজন ঋষির চিত্তে বৈদিক ছন্দ পশ্যন্তী বাক্ অবস্থায় সঞ্চিত হয়, তখন তারপরের প্রক্রিয়ার বিষয়ে আমরা ঋষি দয়ানন্দের বেদবিষয়ক মতের উপর বিচার করবো। ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকাতে বেদোৎপত্তিবিষয় নামক অধ্যায়ে "বেদ" শব্দের অর্থ নিয়ে ঋষি লিখেছেন -
.
"বেদঃ = বিদন্তি = জানন্তি, বিদ্যন্তে = ভবন্তি, বিন্দন্তি বিন্দতে = লভন্তে, বিন্দতে = বিচারয়ন্তি সর্বে মনুষ্যাঃ সর্বাঃ সত্যবিদ্যা য়ৈর্য়েষু বা তথা বিদ্বাম্সশ্চ ভবন্তি তে বেদাঃ"
.
অর্থাৎ যা পাঠ করলে মানুষ সমস্ত সত্য বিদ্যার জ্ঞাতা হন, যা পাঠ করলে লোকে বিদ্বান হতে সক্ষম হন ও যারদ্বারা মানুষ সত্যাসত্যের বিচার করতে সক্ষম হন, তাকে বেদ বলে। এইজন্যই ঋগ্বেদাদি সংহিতার নাম বেদ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখানে বিদ্ জ্ঞানে, বিদ্লৃ লাভে, বিদ্ সত্তায়াম্ এবং বিদ্ বিচারণে চার ধাতু দ্বারা "বেদ" শব্দের ব্যুৎপত্তি দর্শানো হয়েছে। আমরা এই চার ধাতু দ্বারা কিছু অন্য প্রকারের অর্থ গ্রহণ করবো। "বিদ্ জ্ঞানে" দ্বারা যে জ্ঞান রূপ হয় তথা যা দিয়ে সব মানুষের সত্যাসত্যের পূর্ণ জ্ঞান হয়। "বিদ্ সত্তায়াম্ দ্বারা সেই জ্ঞান এমন হয়, যার সর্বদা অস্তিত্ব থাকে অর্থাৎ এর দ্বারা সব সত্য বিদ্যারই জ্ঞান হয়, কোনো অনিত্য ইতিহাস আদি বিষয়ের জ্ঞান এর দ্বারা হয় না। "বিদ্লৃ লাভে" দ্বারা অর্থাৎ সেই বেদের জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেক মানুষকে কিংবা মানুষ মাত্রের তাকে ব্যবহারের ফলে প্রত্যেক প্রাণীর সব যথাযথ সুখের লাভ হয়। "বিদ্ বিচারণে" দ্বারা অর্থাৎ যে জ্ঞান অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চার ঋষির সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অন্তর্গত হয়, সেই জ্ঞান বিচার রূপ অর্থাৎ পূর্ণতঃ সংশয়রহিত হয়।
.
ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকার "বেদোৎপত্তিবিষয়" নামক অধ্যায়ে ঋষি দয়ানন্দ উদ্ধৃত করে লিখেছেন -
.
তস্মাদ্ য়জ্ঞাৎ সর্বহুত ऽঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাম্সি জজ্ঞিরে তস্মাদ্ য়জুস্তস্মাদজায়ত।। (য়জুর্বেদ ৩১.৭)
এবম্ বা অরেऽস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্যদৃগ্বেদো
য়জুর্বেদঃ সামবেদোऽথর্বাঙ্গিরসঃ।। (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৫.৪.১০)
.
অর্থাৎ তস্মাদ্ য়জ্ঞাৎ সচ্চিদানন্দাদিলক্ষণাৎ পূর্ণাৎ পুরুষাৎ সর্বহুতাৎ সর্বপূজ্যাৎ সর্বোপাস্যাৎ সর্বশক্তিমতঃ পরব্রহ্মণঃ ঋগ্বেদঃ, য়জুর্বেদঃ, সামবেদঃ, অথর্ববেদশ্চ চত্বারো বেদাস্তেনৈব প্রকাশিতা ইতি বেদ্যম্। মহত আকাশাদপি বৃহতঃ পরমেশ্বরস্যৈব সকাশাদ্ ঋগ্বেদাদিবেদচতুষ্টয়ম্ নিঃশ্বাসবৎ সহজতয়া নিঃসৃতমস্তীতি বেদ্যম্। য়থা শরীরাচ্ছ্বাসো নিঃসৃত্য পুনঃ তদেব প্রবিশতি, তথৈবেশ্ব-রাদ্ বেদানাম্ প্রাদুর্ভাবতিরোভাবৌ ভবত ইতি নিশ্চয়ঃ।।
.
অর্থাৎ সেই সচ্চিদানন্দস্বরূপ পূর্ণ পুরুষ পরমাত্মার থেকেই ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ সেই চার ঋষির হৃদয়ে প্রকাশিত হয়। এখন সেটা কিভাবে প্রকাশিত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে বোঝানোর জন্য ঋষি দয়ানন্দ শতপথ ব্রাহ্মণে বলা মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্যের বচনকে উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে পরমেশ্বর যিনি আকাশাদির থেকেও অনেক বড়, তাঁর থেকে চার বেদ সেই চারজন ঋষির মধ্যে প্রকাশিত হয় কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এমন ভাবে উৎপন্ন হয় যেভাবে কোনো প্রাণী সহজ ভাবে শ্বাস নেয় ও ছাড়ে। যেভাবে প্রাণীকে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াতে কোনো বিশেষ প্রচেষ্টা করতে হয় না, সেইভাবে পরব্রহ্ম পরমাত্মা দ্বারা ছন্দ রূপ বেদ এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সর্গোৎপত্তির সময় প্রসারিত হয়।
.
এখানে ভগবান্ য়াজ্ঞবল্ক্য যে উপমা দিয়েছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে চেতন প্রাণী জড় প্রাণকে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াতে গ্রহণ করে ও ত্যাগ করে, সেইভাবে চেতন পরমাত্মা জড় প্রকৃতি দিয়ে ছন্দের উৎপত্তি ও প্রলয় করেন। আমার মতে এর দ্বারা সেই ঋষিদের আত্মা বা চিত্তে বেদ প্রকাশিত হওয়ার আরও একটা বিজ্ঞান উদ্বোধন হল। সেটা এই রকম - যখন সেই ঋষিগণ সম্প্রজ্ঞাত সবিচার সমাধিতে ছিলেন, তখন পরমাত্মার সহায়তায় ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সেই সময় ব্যাপ্ত বিভিন্ন বৈদিক ছন্দ সেই ঋষিদের ভিতরে শ্বাসের সমান প্রবেশ করে যায় আর সেই ছন্দের মধ্যে সেই ঋষিদের যেগুলো এমন মনে হয়েছে যে তার অর্থের প্রকাশ মানব বা প্রাণী জাতির জন্য আবশ্যক হবে, সেগুলোকে গ্রহণ করে নিয়েছেন তথা বাকিগুলোকে প্রশ্বাসবৎ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নিঃসারিত করে দিয়েছেন। যেরূপ কোনো প্রাণী বায়ুমন্ডল থেকে বায়ুকে গ্রহণ করে সেখান থেকে অক্সিজেনকে ফুসফুসের মাধ্যমে গ্রহণ করে তথা বাকি বায়ুকে বাইরে বের করে দেয়, সেইরূপ বৈদিক ছন্দের গ্রহণ ও বিসর্জন হয়েছে।
(🌿 বেদ সংহিতা ব্যতীত অন্যান্য ছন্দ 🌿
প্রশ্ন - পরমাত্মা কি অনাবশ্যক কিছু বৈদিক ছন্দ বানিয়েছেন, যেগুলোকে সেই ঋষিগণ গ্রহণ করতে পারেন নি? যদি তাই হয়, তাহলে পরমাত্মা নিরর্থক মন্ত্রের (ছন্দ) রচনা কেন করেছেন?
উত্তর - আপনার প্রশ্ন উত্তম ও স্বাভাবিক। আমি আগামী "বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান" নামক অধ্যায়ে বলবো যে বৈদিক ছন্দ প্রাণ তত্ত্বের রূপে অসংখ্য মাত্রায় উৎপন্ন হয়। পরমাত্মার সামর্থ্য ও জ্ঞান অনন্ত। চার বেদ সংহিতার জ্ঞান অনন্ত নয়। সেগুলোতে ততটুকুই জ্ঞান আছে, যা মানব জাতির জন্য অনিবার্য। মানবের জ্ঞান গ্রহণ সামর্থ্যের সীমা পর্যন্ত সমগ্র বিজ্ঞান বেদের মধ্যে সাংকেতিক বা মূল রূপে বিদ্যমান আছে। এর থেকে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয় যে পরমব্রহ্ম পরমাত্মার মধ্যে এরথেকে অধিক জ্ঞান হতে পারবে না।
.
একইভাবে এটাও সিদ্ধ হল যে চার সংহিতার মধ্যে যত ছন্দ বা মন্ত্র আছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রাণ-তত্ত্বের রূপে কেবল ততটুকুই বিদ্যমান নেই, বরং তার থেকেও অধিক আছে। এই অধিক ছন্দ আমাদের আবশ্যকতার থেকে অধিক হওয়ার কারণে তথা সেই মানব ঋষিদের সামর্থ্য-সীমার কারণেও সেগুলোকে ঋষি প্রশ্বাসবৎ বাইরে বের করে দেন। যেরূপ প্রাণীর প্রশ্বাস দ্বারা বের হওয়া বায়ু (কার্বন-ডাই-অক্সাইড আদি) সেই প্রাণীর জন্য অনাবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও সৃষ্টিতে বনস্পতি আদির জন্য আবশ্যক হয়, সেইরূপ মানব ঋষিদের দ্বারা অগৃহীত ছন্দ সর্গ প্রক্রিয়াতে আবশ্যক হয়, সেগুলো জ্ঞান রূপে পরমেশ্বরের মধ্যে সর্বদাই বিদ্যমান থাকে অর্থাৎ সেই ছন্দগুলিও নিরর্থক হয় না।
🌿 প্রশ্ন - আপনি চার বেদ সংহিতা ব্যতীত কিছু অন্য মন্ত্র, যেগুলো ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, শ্রৌত সূত্র বা বেদের শাখার মধ্যে বিদ্যমান আছে, সেগুলোকেও বেদ অর্থাৎ অপৌরুষেয় মানছেন, তাহলে কি এটাও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না যে ঈশ্বর প্রথমে চারজন ঋষিকে জ্ঞান দিতে ভুলে গেছেন আর তাঁকে কিছু জ্ঞান পরে দিতে হয়েছে। তাহলে তো কুরআন ও বাইবেলকেও আমরা কিভাবে অস্বীকার করতে পারি আর তাদেরকে কিভাবে বলতে পারি যে খুদা আগেই কেন জ্ঞান দেয়নি? এর থেকে এই অর্থ কেন বের হবে না যে ঈশ্বরের জ্ঞান পরিবর্তিত হয় আর ঈশ্বরের স্মৃতিবিভ্রম আছে?
উত্তর - আপনার এমন শঙ্কা করা উচিত নয়। এমন শঙ্কা করা এটাই দর্শায় যে বেদের স্বরূপ আর তার উৎপত্তি প্রক্রিয়ার বোধ আপনার নেই। সৃষ্টির আদি প্রজন্মকে পরমেশ্বর কিভাবে জ্ঞান দিয়েছেন, এটা জানার জন্য এই সম্পূর্ণ অধ্যায়কে মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে। এর পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে যে ঈশ্বর সেই চারজন ঋষিকে পদ্যাত্মক ভাষা অর্থাৎ ছন্দ রূপে কেন জ্ঞান দিয়েছেন?® এই পদ্যাত্মক ভাষা কি কখনও কথোপকথনের ভাষা ছিল? আমার মনে হয় না এমন ছিল। তাহলে ঈশ্বর কেন সেই পদ্যাত্মক ভাষায় জ্ঞান দিলেন, যেটা কখনও কথোপকথনের ভাষা ছিল না। এমন মনে হয় যে এই বিষয়টা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেই বিচার করেনি। বেদের উৎপত্তি প্রক্রিয়ার রহস্য এই প্রশ্ন থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে। আসুন! আমরা এর উপর বিচার করি -
.
সাম্যাবস্থা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থ থেকে সৃষ্টি উৎপত্তি প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম সূক্ষ্মতম কম্পন প্রারম্ভ হয়। এই কম্পনই ধ্বনি রূপ হয়। প্রথম কম্পন সম্পূর্ণ প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে এক সাথে আর সমান তীব্রতার সঙ্গে উৎপন্ন হয়। ধীরে-ধীরে সেই কম্পন অগ্রিম চরণের লয়বদ্ধ কম্পনগুলোকে উৎপন্ন করতে থাকে। এই কম্পন লয়বদ্ধ হওয়াতে পদ্যাত্মক ধ্বনি রূপে হয় আর এই ধ্বনি পরা রূপে হয়। এই ধ্বনিগুলোই হল বেদমন্ত্র আর সবথেকে প্রথম কম্পন পরা "ওম্" ধ্বনিরূপই হয়। এটাই হল সৃষ্টি উৎপত্তির বৈদিক রশ্মি সিদ্ধান্তের আধার। অগ্নি, বায়ু, আদিত্য আর অঙ্গিরা এই চারজন ঋষি সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে এই পরা ধ্বনি তরঙ্গ অর্থাৎ বেদমন্ত্র গুলোকে অন্তরীক্ষ থেকে গ্রহণ করেন। এই বৈদিক ধ্বনি তরঙ্গগুলো আকাশের মধ্যে সর্বত্র ভরে ছিল। এই চারজন তাঁদের সামর্থ্যানুসারে এই ছন্দ রশ্মিগুলোকে গ্রহণ করেন। গ্রহণ করার পশ্চাৎ সেই মন্ত্রের অর্থের জ্ঞান সমাধি অবস্থাতেই পরমেশ্বর করিয়ে দেন, যা গদ্যাত্মক ভাষা রূপে ছিল।
.
পদ্যাত্মক রূপে ধ্বনি হল সৃষ্টির একটা অনিবার্য ভাগ। সেগুলো থেকেই ঘনীভূত হয়ে সমগ্র পদার্থের নির্মাণ হয়। এই নির্মাণে ঈশ্বরের প্রমুখ নিমিত্ত ভূমিকা থাকে। সেই চারজন ঋষি তাঁদের পুরুষার্থ আর যোগ্যতানুসারে সেই ধ্বনি তরঙ্গগুলোকে স্বতঃ সহজ ভাবে গ্রহণ করে নেন, কিন্তু তাতে ঈশ্বরের পরোক্ষ ভূমিকা অবশ্যই থাকে, তবে এই মন্ত্রের অর্থ জানতে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। ঋষিদের হৃদয়ে জ্ঞানের উৎপত্তি হল বেদ উৎপত্তি প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় চরণ। এর প্রথম চরণ সাম্যাবস্থা ভঙ্গ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রারম্ভ হয়ে যায়। ঋষি দয়ানন্দ তাঁর গ্রন্থের মধ্যে বেদোৎপত্তির দ্বিতীয় চরণেরই চর্চা করেছেন, কিন্তু বেদনিত্যত্ব বিষয়ে বৈদিক পদকে নিত্য বলে বৈদিক পদকে আকাশের মধ্যে একরসে ভরাও মেনেছেন। এই বিন্দুর উপর পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলার ব্যতীত অন্য কারও ধ্যান যায়নি। এইজন্য আজ বিদ্বানদের একথা বুঝতে অনেক কঠিন মনে হচ্ছে যে সেই বেদমন্ত্র রশ্মি (কম্পন) রূপে সৃষ্টিতে বিদ্যমান আছে আর সেগুলো দিয়ে সৃষ্টি তৈরি হয়েছে।
.
প্রারম্ভিক চারজন ঋষি যেসব মন্ত্রকে গ্রহণ করেন, সেগুলোর মধ্যে মানব জাতির জন্য উপযোগী সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিদ্যমান আছে। এই জ্ঞানের বিস্তার করে মানুষ তার সম্পূর্ণ লৌকিক এবং পারলৌকিক উন্নতি করতে পারবে, অনেক ধরণের সাহিত্য তৈরি করতে পারবে। এইভাবে এই জ্ঞান মানুষের দৃষ্টিতে পূর্ণ আছে, তাকে পুনরায় ঈশ্বর দ্বারা জ্ঞান দেওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই, কিন্তু এর দ্বারা এমন মোটেও সিদ্ধ হয় না যে এই সৃষ্টির মধ্যে চার বেদ সংহিতা ব্যতীত আর অন্য কোনো মন্ত্র (কম্পন) বিদ্যমান নেই। ঈশ্বর হলেন অনন্ত জ্ঞানী। সৃষ্টিকে বানাতে, চালাতে ও প্রলয় করতে যত জ্ঞান ব্যবহৃত হয়, সেটা ঈশ্বরের মধ্যে বিদ্যমান জ্ঞানের এক অংশ মাত্রই হবে। তবে সৃষ্টির মধ্যে ঈশ্বরের যে জ্ঞান ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা মানুষের জন্য অনন্ত। এইজন্য সৃষ্টির মধ্যে এমন অনেক মন্ত্র বিদ্যমান আছে, যা বেদ সংহিতার মধ্যে নেই, যাকে চারজন ঋষি গ্রহণ করতে পারেননি।
.
কালান্তরে সৃষ্টির উপর চিন্তনকারী বেদের ব্যাখ্যাতা ব্রাহ্মণ গ্রন্থকার, বেদের শাখার প্রবর্তক ঋষি, শ্রৌত সূত্রকার আদি উচ্চ কোটির মহর্ষি মহানুভাবগণ সমাধি অবস্থায় অন্তরীক্ষে কিছু এমন ধ্বনি তরঙ্গ পরা বা পশ্যন্তী রূপে শুনতে পান, যেগুলো চার সংহিতার মধ্যে ছিল না। সেই মন্ত্রগুলোকে তাঁরা তাঁদের গ্রন্থের মধ্যে স্থান দেন আর সেগুলোর অর্থ পরমাত্মাই জানিয়ে দেন। যদি তাঁরা সেই ঋচাগুলোকে গ্রহণ না করতেন, তাহলেও মানব জাতির লৌকিক আর পারলৌকিক উত্থানের পথে কোনো বাঁধা আসতো না, কারণ এর জন্য চার বেদ সংহিতার মধ্যে পূর্ণ এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান তাঁদের কাছে ছিল। মানুষের জ্ঞান আর তার ব্যবহার করার সামর্থ্যের একটা সীমা আছে, সেই সীমার অন্তর্গতই নিজ-নিজ ক্ষমতানুসারে ঋষিগণ মন্ত্রকে গ্রহণ করেছেন। তবে এতে নিশ্চিত যে, এই সৃষ্টিতে অন্তরীক্ষ থেকে মন্ত্রকে গ্রহণ করে এমন ঋষির সংখ্যা অনেক কম আছে। মন্ত্রের অর্থের দর্শন করে এমন তো সহস্র হয়েছেন।©
.
এখানে ঈশ্বরের জ্ঞান দেওয়ার প্রক্রিয়াতে কোনো ভুল বা অপূর্ণতার অবকাশ কোথায়? পরমাত্মা তো সম্পূর্ণ সৃষ্টি বেদমন্ত্র দিয়ে ভরে দিয়েছেন, এখন যার যত সামর্থ্য হবে, ততটা গ্রহণ করে নিবে আর এইভাবেই অগ্নি আদি ঋষিগণ করেছেন। প্রারম্ভিক প্রজন্মের সব মানুষ পূর্ব সৃষ্টিতে করা কর্মের অনুসারে অথবা মুক্তির অবধি পূর্ণ হলে পুনরায় জন্ম নেওয়ার কারণে ঋষি কোটিরই হয়ে থাকেন। এখানে এটাও মনে রাখতে হবে যে তাঁদের মধ্যেও আমাদের পৃথিবীতে চারজন ঋষিই এই স্তরের ছিলেন, যাঁরা অন্তরীক্ষ থেকে মন্ত্রকে গ্রহণ করতে পারেন। সেই চারজন মিলে মহর্ষি ব্রহ্মাকে সেই জ্ঞান দেন।
.
অন্তরীক্ষ থেকে মন্ত্র গ্রহণকারী যে ঋষি কালান্তরে হন, তাঁরা বস্তুতঃ অগ্নি আদি ঋষিদের মতো অন্তরীক্ষ থেকে মন্ত্র গ্রহণ করার সাধনা করছিলেন না, বরং সৃষ্টিকে জানার প্রক্রিয়াতে কিছু মন্ত্রের সাক্ষাৎকার হয়তো তাঁরা করেছেন, যেগুলোকে তাঁরা তাঁদের গ্রন্থের মধ্যে উদ্ধৃত করেছেন। এই কারণে তাঁদের দ্বারা মন্ত্রের গ্রহণ করা এই কথার দ্যোতক নয় যে ঈশ্বর তাঁর জ্ঞানকে সংশোধিত বা পরিবর্তন করেছেন, বরং এটা তো এই সংকেত দেয় যে সেই ঋষিরা এর জন্য অত্যন্ত পুরুষার্থ করেছেন, এমন নয় যে অগ্নি আদি ঋষিদের মতো তাঁরা সহজ-সরলভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো মন্ত্র প্রাপ্ত করেছেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং তার শাখাগুলোর সঙ্গে বাইবেল আর কুরআনের তুলনা করা নিতান্ত অজ্ঞানতা হবে, যারা এই গ্রন্থগুলো পড়েনি, তারাই এমন প্রশ্ন করতে পারে।
.
এখন পর্যন্ত আমি বিভিন্ন বৈদিক ছন্দকে সৃষ্টির আদিতে চারজন মানব ঋষির দ্বারা গ্রহণ করার প্রক্রিয়ার বর্ণনা করেছি, এখন এরপর সেইসব ছন্দ থেকে "বেদ" শব্দের সার্থকতা প্রমাণিত করে এমন জ্ঞান ও ভাষার উৎপত্তির প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করবো। আমি যেমন লিখেছিলাম যে সেইসব ছন্দ পরা বা পশ্যন্তী বাক্ রূপে অর্থাৎ সূক্ষ্ম প্রাণ রূপে পরমেশ্বরের চেতনার বিদ্যমানতায় ঋষিদের আত্মিক চেতনা চিত্ততত্ত্বের মধ্যে সংগৃহীত করেছিল।
.
আমরা একে নিম্ন প্রকারে জানার চেষ্টা করবো। যখন আমরা কোনো বস্তুকে শুনি অথবা তার রেডিও তরঙ্গকে কোনো উপকরণ দ্বারা গ্রহণ করি, তখন সেই শব্দের তিন প্রকারের প্রভাব হয় -
১. রেডিও তরঙ্গের জড় ও চেতন জগতের উপর প্রভাব। এতে প্রাণীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিও হতে পারে। আজ মোবাইল আদি সঞ্চার সাধন থেকে উৎপন্ন রেডিও তরঙ্গ থেকে অনেক রোগে আক্রান্ত হয়ে পক্ষী ও কীটপতঙ্গের প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যেও মানসিক অবসাদ, ব্রেন টিউমার, চর্ম বিকার আদি অনেক রোগের উৎপত্তি হচ্ছে, তাহলে জড় জগতের উপরে জড় তরঙ্গের প্রভাব ফেলবেই। বর্তমানে হতে চলা জলবায়ু পরিবর্তন এবং তজ্জন্য প্রাকৃতিক প্রকোপে এই তরঙ্গের অনিবার্য ভূমিকা আছে, এর উপর কারও ধ্যান নেই।
.
২. সেই রেডিও তরঙ্গকে যখন ধ্বনি তরঙ্গে পরিবর্তিত করে দেওয়া হয় অথবা যা সরাসরি ধ্বনি তরঙ্গ রূপেই শব্দ শোনা যায়, তাতে সম্পূর্ণ শরীরের উপর ধ্বনির তীব্রতা, আবৃত্তি আদির ভেদের কারণে পৃথক-পৃথক প্রভাব পড়ে। কর্কশ তীক্ষ্ণ ধ্বনি অনেক রোগ উৎপন্ন করে, উত্তেজক সঙ্গীতও মন-মস্তিষ্ক ও শরীরে বিপরীত প্রভাব ফেলে, অপরদিকে মধুর ও শান্ত ভক্তি সঙ্গীত শরীরের রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
.
৩. ধ্বনি তরঙ্গ, যা ছন্দ ও ব্যক্ত বাক্ রূপে হয়, মস্তিষ্ক সেগুলোকে বুঝে সেগুলোর অর্থকে জেনে নেয়। তখন সেই ধ্বনি বা রেডিও তরঙ্গের অন্তিম পরিণাম জ্ঞানের লাভ রূপে হয়। তদনন্তর সেই জ্ঞানকে ব্যবহারে নিয়ে এসে সব সুখের লাভ হয়। যদি সেই ধ্বনি বা শব্দ বিপরীত জ্ঞানোৎপত্তির সংবাহক বা উৎপাদক হয়, তাহলে তাকে ব্যবহার করে দুঃখের প্রাপ্তি রূপী অন্তিম ফল হয়।
.
এইভাবে এই তিন প্রভাবকে দৃষ্টিগত রেখে বৈদিক ছন্দের প্রভাবের চর্চাকে সম্মুখে নিয়ে যাবো -
.
যখন সেই মানব ঋষিগণ বৈদিক ছন্দকে পরা বা পশ্যন্তী অবস্থায় সংগৃহীত করেন, তখন সেই ছন্দের অর্থ বলে দিবে এমন না তো কোনো পরম্পরা ছিল আর না কোনো ব্যক্তি বিশেষ গুরু রূপে বিদ্যমান ছিল। সেই মানব সৃষ্টির প্রথম প্রজন্ম ছিল। তাহলে সেই শব্দের অর্থের বোধ কে করিয়েছে? এর সমাধানে ঋষি দয়ানন্দ ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকাতে বলেছেন যে অর্থের বোধ পরমাত্মা, যিনি সেই ছন্দকে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত করে ছিলেন আর যাঁর সহায়তায় সেই ছন্দগুলোকে ঋষিগণ নিজের চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন, সেই পরব্রহ্ম পরমাত্মাই তাঁদের আত্মার মধ্যে সেই ছন্দের অর্থের বোধ করিয়েছেন। ঋষির কথনের ভাব হল এটাই।
.
এই কারণে বৈদিক পরম্পরা জ্ঞান ও ভাষার মূল স্রোত পরব্রহ্ম পরমাত্মাকেই মানে আর এটাই হচ্ছে একমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এখান থেকে যেরূপ সেই চারজন ঋষি বেদ জ্ঞান প্রাপ্ত করেন, সেইরূপ তাঁরা ভাষাকে মুখে বলা অর্থাৎ সেই ছন্দের পশ্যন্তী অবস্থাকে বৈখরী রূপ প্রদান করে মুখ দিয়ে কথা বলা প্রারম্ভ করেন, যেভাবে আজ আমরা আমাদের বিচারের রূপে মস্তিষ্কগত জ্ঞানকে পরা-পশ্যন্তী, মধ্যমা স্তর দিয়ে নিয়ে গিয়ে বৈখরী রূপে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করি।
.
এই বিষয়ে আর্য বিদ্বান পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলার "বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস" প্রথম ভাগের প্রথম অধ্যায়ে লিখেছেন -
"বেদ-বাক্ হল দৈবী বাক্। এই বাক্ মানব উৎপত্তির বহু পূর্বে অন্তরীক্ষস্থ তথা দ্যুলোকস্থ দেব আর ঋষির অর্থাৎ ঈশ্বরের ভৌতিক বিভূতি দ্বারা প্রকট হয়েছিল। ওম্, অথ, ব্যাহৃতি আর মন্ত্র হিরণ্যগর্ভ আদি থেকে তন্মাত্রারূপ বাগিন্দ্রিয় দ্বারা উচ্চারিত হয়েছিল। সেই বাক্ ক্ষীণ হয়নি, পরম ব্যোম আকাশের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। মানব সৃষ্টির শুরুতে যখন ঋষিগণ আদি-শরীর ধারণ করেন, তখন সেই দৈবী বাক্ ঈশ্বর-প্রেরণায় তাঁদের মধ্যে প্রবেশ করে, তাঁরা সেটা শোনে। এই কারণে বেদবাক্ -এর একটা নাম শ্রুতি হয়। সেই কালেই বৈদিক শব্দের আধারে ঋষিগণ ব্যবহারের ভাষার জন্ম দেন। সেই ভাষা আদিতে মানব মাত্রের ভাষা ছিল আর সেটা অত্যন্ত বিস্তৃত আর সমৃদ্ধ ছিল। তখন ভূমিতে কেবল ব্রাহ্মণই ছিল অর্থাৎ সবাই বৈদিক বিদ্বান ছিলেন। ভাষার উৎপত্তি আর ভাষার উত্তরোত্তর ইতিহাসের এটাই একমাত্র বৈজ্ঞানিক পক্ষ ঔপমন্যব, ঔদুম্বরায়ণ, য়াস্ক, দ্বৈপায়ন ব্যাস, ব্যাডি, উপবর্ষ, পাণিনি, পতঞ্জলি আর ভর্তৃহরির সর্বথা জ্ঞাত ছিল। ভর্তৃহরির পশ্চাৎ গত দুই সহস্র বর্ষের মধ্যে এটা লুপ্তপ্রায় ছিল... মিশ্র আর য়ুনান আদির অতিপ্রাচীন মানুষরা দেব আর তাঁদের বিভূতিকে কিছুটা হলেও জানতো।
.
(ক) মিশ্রের প্রাচীন বিশ্বাসের বিষয়ে মর্সার লিখেছেন -
Egyptians had their "sacred writing" - "writings of the words of the gods" often kept in a "house of sacred writings".
(Page 12, The religion of Ancient Egypt, Mercer)
অর্থাৎ মিশ্রের মানুষ তাদের পবিত্র লিখন রাখতেন। "দেবতাদের শব্দের লিখন" যাকে তারা প্রায়শঃ "পবিত্র লিখনের ঘরে" রাখতেন।
.
(খ) য়ুনানের প্রসিদ্ধ প্রাচীন লেখক হোমর (ঈশা থেকে ৮০০ বছর পূর্বে) দেব ভাষা আর মানব ভাষার বর্ণনা তাঁর লিখনে করেছেন -
"অরস্তু দেব আদির বিষয়ে সম্পূর্ণ বুঝতে পারেনি, তৎপশ্চাৎ দেববিদ্যা ইউরোপ থেকে সর্বথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।"
- The language of gods and of men, Pg.299-303, Asianic elements in Greek Civilization, Ramsay
.
এই বিষয়ে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী সত্যার্থ প্রকাশের একাদশ সমুল্লাসের মধ্যে লিখেছেন - "ভূগোলে যত বিদ্যা ছড়িয়েছে, সেই সব আর্যাবর্ত (ভারত) দেশ থেকে মিশ্র, সেখান থেকে য়ুনান, সেখান থেকে রোম আর সেখান থেকে ইউরোপ দেশে, সেখান থেকে আমেরিকা আদি দেশের মধ্যে ছড়িয়েছে।"
.
এই কারণে ফ্রান্স বিদ্বান জৈকালয়ট বলেছেন - "সব বিদ্যা আর মঙ্গলের ভাণ্ডার হল আর্যাবর্ত দেশ আর সব বিদ্যা তথা মত এই দেশ থেকেই ছড়িয়েছে।" (বাইবেল ইন ইন্ডিয়া) - সত্যার্থ প্রকাশ থেকে উদ্ধৃত।
__________________
® বেদও কিছু এমনই সংকেত করে - দেবস্য পশ্য কাব্যম্ ন মমার ন জীর্য়তি (অথর্ববেদ ১০.৮.৩২) অর্থাৎ ঈশ্বরের কাব্যকে (ছন্দোময় জগৎ) দেখো, যা না নষ্ট হয় আর না পুরোনো হয়।
© ভিন্ন-ভিন্ন লোকের মধ্যে সৃষ্টির আদিতে জ্ঞান গ্রহণকারী ঋষিদের স্তরকে দেখে মন্ত্র আর তার সংখ্যাতে কিছু ভিন্নতা হতে পারে। সেইরূপ ভিন্ন-ভিন্ন লোকে বসবাসকারী মননশীল প্রাণীদের জন্য জ্ঞানের আবশ্যকতা ও পূর্ণতাও ভিন্ন-ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে বেদমন্ত্র তো সবার জন্য একটাই হবে, ভিন্নতা কেবল গ্রহণীয় ও গৃহীত মন্ত্রের সংখ্যার হবে। - সম্পাদক
বেদ জ্ঞান কেবল সংস্কৃত ভাষাতেই কেন?
প্রশ্ন - পরমাত্মা সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মের অনেক মানুষের মধ্যে কেবল চারজন ঋষিকেই কেন জ্ঞান দিয়েছেন? ঈশ্বর কি পক্ষপাতী? তারপর এটাও একটা প্রশ্ন যে পরমাত্মা তাঁর জ্ঞান বৈদিক ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষাতেই কেন দিয়েছেন? এর দ্বারা অন্য ভাষী মানুষের সঙ্গে বৈষম্য বা দোষ পরমাত্মার উপর লাগবে না?
.
উত্তর - এটা সত্য যে সৃষ্টির প্রথম প্রজন্মে স্ত্রী-পুরুষের অনেক জোড়া উৎপন্ন হয়েছে। তাঁরা পূর্ণ যুবকাবস্থায় পৃথিবী রূপী গর্ভ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। যে মহানুভাব পূর্ণ যুবকাবস্থায় ও ভূমি থেকে উৎপত্তির উপর শঙ্কা করছেন, তাকে ঋষি দয়ানন্দ কৃত "সত্যার্থ-প্রকাশ" তথা মদ্রচিত "সত্যার্থ প্রকাশ উভর্তে প্রশ্ন-গরজতে উত্তর" নামক গ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করা উচিত। বিস্তারভয়ে আমি এই বিষয়কে এখানেই ছেড়ে দিচ্ছি। তাছাড়া প্রত্যেক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সম্পন্ন পাঠক এটাই মানবে যে প্রথম প্রজন্মের উৎপত্তি কেবল এই ভাবেই হওয়া সম্ভব।
.
সেই প্রথম প্রজন্মের মধ্যে সেই চারজন ঋষিই সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও সামর্থ্যবান ছিলেন। তাঁরা নিজের মহান তপ দ্বারা আকাশ থেকে বেদের ঋচাকে গ্রহণ করেছেন, এই কারণে তাঁদেরকেই জ্ঞান দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা সবাইকে জ্ঞান প্রদান করতে পারেন। বাকি রইলো সংস্কৃত-ভাষাতে জ্ঞান দেওয়ার, তো তদ্বিষয়ে জ্ঞাতব্য হল সেই সময় সম্পূর্ণ মানব জাতির মধ্যে কোনো ভাষার উৎপত্তিই হয়নি। যেটা উৎপন্ন হয়েছিল, সেটা কেবল বৈদিক ভাষা সংস্কৃতই ছিল, তাও আবার বৈদিক ছন্দের রূপে। পরে ঋষিগণ এই ভাষাকে কথোপকথনের ভাষাতে ব্যবহৃত করেন। কালান্তরে সংস্কৃত ভাষা থেকে অপভ্রষ্ট হয়ে ধীরে-ধীরে বিশ্বের মধ্যে অনেক ভাষার উৎপত্তি হয়। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভূমণ্ডলে সংস্কৃত ভাষাই সর্বাধিক শাসন করেছে। আজ সারা বিশ্বের মধ্যে এটা তো সর্বমান্য তথ্য যে সংস্কৃত ভাষাই হল সমস্ত মানব ভাষার জননী। এই কারণে সংস্কৃত ভাষাতেই জ্ঞান দেওয়া অনিবার্য আর নিষ্পক্ষ ছিল।
.
প্রশ্ন - যদি ছন্দ অন্য কোনো ভাষা হিন্দি, ইংরাজি, চিনি, আরবী আদির মধ্যে কোনো এক ভাষাতে হতো আর সেই ভাষা থেকে অন্য ভাষার উৎপত্তি হতো, তাহলে তাতে কি অসুবিধা হতো? সংস্কৃত ভাষার সঙ্গেই কেন ঈশ্বরের প্রেম ছিল? এটা সংস্কৃত ভাষাবিদদের নিজস্ব কল্পনা ও পূর্বাগ্রহ নয় কি?
.
উত্তর - আপনার প্রশ্ন একটা ভাষার প্রথম উৎপত্তি নিয়ে, এটা উচিত ও স্বাভাবিক। আমি "বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান" নামক অধ্যায়ে স্পষ্ট করবো যে বৈদিক সংস্কৃত ভাষার শব্দের সঙ্গে তার অর্থের নিত্য সম্বন্ধ আছে। যে শব্দের যে অর্থ হয়, সেই অর্থ কোনো মানুষ স্বকল্পনায় মেনে নেয় নি, বরং সেই অর্থ ওই শব্দের সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধে থাকে। সেই বস্তু বিশেষ যখন সর্গপ্রক্রিয়াতে নির্মিত হচ্ছিল, তখন সেই শব্দ বিশেষের উৎপত্তিও হচ্ছিল। এইভাবে বৈদিক সংস্কৃত ভাষাতে বাচক ও বাচ্যের সম্বন্ধ নিত্য, প্রকৃতিক আর ঈশ্বরীয় হয়, মানবীয় মোটেও নয়। এই বিশেষত্ব অন্য কোনো ভাষার মধ্যে নেই। এইভাবে বৈদিক শব্দই নিত্য হয়, অন্য কোনো ভাষার শব্দ হয় না। বৈদিক শব্দই প্রাণ রূপ হয়ে সৃষ্টির সকল পদার্থের উপাদান কারণও হয়, অথচ এমন বিশেষত্ব নামমাত্রেও কোনো মানবীয় ভাষার মধ্যে নেই।
.
এই কারণে বৈদিক সংস্কৃত ভাষা কোনো বর্গ, দেশ বা সম্প্রদায়, এমনকি কেবল পৃথিবীস্থ মানব জাতির ভাষা নয়, বরং এটা হল ব্রহ্মাণ্ডীয় ভাষা। বৈদিক ছন্দ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রাণতত্ত্বের (স্পন্দন বা কম্পন বা ভাইব্রেশন) রূপে ব্যাপ্ত হয়ে আছে। বিভিন্ন সূক্ষ্ম কণার উৎপত্তি এগুলো থেকেই হয়। এইভাবে বৈদিক সংস্কৃত ভাষা পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, শাশ্বত ও সার্বদেশিক হওয়াতে অত্যন্ত ব্যবস্থিত। এর ব্যাকরণ অন্য যেকোনো ভাষার ব্যাকরণের তুলনায় সুব্যবস্থিত আছে। আধুনিক কালে উপলব্ধ একমাত্র প্রামাণিক ব্যাকরণের আধার গ্রন্থ পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ী আজও সারা বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানীদের জন্য আশ্চর্যজনক আদর্শ হয়ে আছে। এই অষ্টাধ্যায়ীর গুরুত্বকে বর্ণনা করে এমন কিছু কথন আমি "অষ্টাধ্যায়ী ভাষ্য প্রথমাবৃত্তি" - পণ্ডিত ব্রহ্মদত্ত জিজ্ঞাসুর (সংস্করণ ২০৪২ বিক্রম সম্বত্ সাল ১৯৮৫) প্রাককথন থেকে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি -
১. তত্রাশক্যম্ বর্ণেনাপ্যনর্থকেন ভবিতুম্ কিম্ পুনরিয়তা সূত্রেণ (মহাভাষ্য ১.১.১ চৌখম্বা সংস্করণ) অর্থাৎ তাঁর অর্থাৎ ভগবৎ পাণিনির একটা বর্ণও অনর্থক নেই, তাহলে এত বড় সূত্রের কথা কি বলবো? মহর্ষি পতঞ্জলি পুনরায় বলেছেন -
সামর্থ্যয়োগান্নহি কিঞ্চিদস্মিন্ পশ্যামি শাস্ত্রে য়দনর্থকম্ স্যাত্
অর্থাৎ শাস্ত্রের সামর্থ্য দ্বারা আমি এই গ্রন্থের মধ্যে একটাও এমন কোনো বর্ণ বা পদ দেখছি না, যেটা অনর্থ হবে।
২. চীন যাত্রী হিওয়েন সাং - শব্দ এবং অক্ষর বিষয়ক কোনো জ্ঞান এরথেকে অবশিষ্ট নেই।
৩. মোনিয়ার উলিয়ামস্ - অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থ হল মানব মস্তিষ্কের প্রতিভার আশ্চর্যতম ভাগ, যা মানব মস্তিষ্কের সামনে এসেছে।
৪. হন্টার - মানব মস্তিষ্কের চরম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল এই অষ্টাধ্যায়ী।
৫. লেনিনগ্রাডের প্রফেসর টি. বাৎসকি - মানব মস্তিষ্কের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হল এই অষ্টাধ্যায়ী।
এইভাবে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের এই গ্রন্থ সারা বিশ্বের মধ্যে আজও সবার সম্মানের পাত্র হয়ে আছে। এই গ্রন্থের পূর্বেও অনেক বৈয়াকরণ হয়েছে। কয়েকটা বৈয়াকরণের নাম ভগবৎ পাণিনি স্বয়ং তাঁর অষ্টাধ্যায়ীর মধ্যে উল্লেখ করেছেন। যে ভাষার ব্যাকরণ সংসারে সর্বাধিক সুব্যবস্থিত ও আশ্চর্যজনক হবে, সেই ভাষাই তো পরমাত্মার দ্বারা প্রথমে উৎপন্ন প্রাকৃতিক ব্রহ্মাণ্ডীয় ভাষা হতে পারে। এইজন্য সংসারের সুবিজ্ঞ জনদের উচিত যে তাঁরা যেন বেদের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য অবশ্যই খুব চেষ্টা করেন। এর উপর প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার আছে। এর জন্য সংসারের উচিত আর্যাবর্তিদের (ভারতবাসী) ধন্যবাদ করা, কারণ তারা এগুলোকে অন্তত কিছুটা তো সুরক্ষিত রেখেছে। এর পাশাপাশি সংসারের উচিত বেদপাঠী ব্রাহ্মণদেরও ঋণী হওয়া, যাঁরা এই ভারী সম্পদাকে নিজের কণ্ঠের মধ্যে সুরক্ষিত রেখে বিনাশ হওয়ার থেকে বাঁচিয়েছেন।
.
এইভাবে আমি এটা সিদ্ধ করেছি যে অগ্নি, বায়ু আদি চারজন ঋষির মধ্যে সর্বস্রষ্টা পরমাত্মা বৈদিক ছন্দের মাধ্যমে জ্ঞান ও ভাষার উৎপত্তি করেন। এই কথাই ভগবান্ মনু মহারাজ বলেছেন -
অগ্নিবায়ুরবিভ্যস্তু ত্রয়ম্ ব্রহ্ম সনাতনম্।
দুদোহ য়জ্ঞ সিদ্ধ্যর্থমৃগ্যজুঃ সামলক্ষণম্।। (মনুস্মৃতি ১.২৩)
.
এর অর্থ করে ঋষি দয়ানন্দ ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা এবং সত্যার্থ প্রকাশে লিখেছেন - পরমেশ্বর অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং অঙ্গিরা এই চার ঋষিকে জ্ঞান দেন। এখানে প্রায়শঃ প্রশ্ন করা হয় যে বেদ তিনটা নাকি চারটা? আমি এর উপর চর্চা করে কলেবর বাড়াতে চাইবো না। এর উপর ঋষি দয়ানন্দকৃত গ্রন্থের পাশাপাশি অনেক আর্য বিদ্বানের পর্যাপ্ত এবং নিশ্চয়াত্মক লেখা আছে। পাঠক সেখানে দেখতে পাবেন। তবে, বৈদিক বিদ্যা অবশ্যই ঋক্, য়জুঃ ও সাম এই তিন লক্ষণযুক্ত হয়। এর বৈজ্ঞানিক অর্থাৎ আধিদৈবিকরূপ আমার গ্রন্থের মধ্যে স্থানে-স্থানে পাওয়া যাবে। এখানে একটা শঙ্কা বিদ্বানদের মধ্যে অবশ্যই উপস্থিত হতে পারে, যার সমাধান সম্ভবতঃ আমার জানা কোনো আর্য বিদ্বানরা ও করেন নি।
.
সেই শঙ্কাটা হল যে ঋষি দয়ানন্দ এখানে "অগ্নি", "বায়ু" ও "রবি" এই তিনটা নাম থেকে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চারটা নাম কেন গ্রহণ করেছেন? এই ভাবে সত্যার্থ প্রকাশ গ্রন্থের মধ্যেও শতপথ ব্রাহ্মণের প্রমাণ দিয়ে অগ্নি, বায়ু ও সূর্য থেকে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চারটা নাম কেন গ্রহণ করেছেন? এটা মনগড়া ও পূর্বাগ্রহ গ্রস্ততার প্রমাণ নয় কি? বেদ হল চার আর ঋষিও হল চার, এর অনেক প্রমাণ অন্যত্র অবশ্যই উপলব্ধ আছে, কিন্তু এখানে দুটো স্থানে কেবল তিনটা নামই আছে। বেদ তো শৈলীভেদ অনুসারে চারের স্থানে তিনটা মানা যেতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিবাচক নামের মধ্যে তিনটা থেকে চারটার গ্রহণ কিভাবে হবে? অন্য আরেকটা প্রশ্ন করা হয় যে কোনো ব্যক্তির নামের স্থানে তার সমার্থক শব্দেরও ব্যবহার করা যায় কি? এমনতো কখনও সম্ভব নয়। তাহলে এই সূর্য অথবা রবির ব্যবহার আদিত্যের স্থানে কিভাবে হয়েছে?
.
বাস্তবে শঙ্কা দুটোই গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে এর সমাধান নিম্নানুসারে হবে -
আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে যদিও প্রায়শঃ সর্বত্র এবং স্বয়ং বেদ সংহিতার মধ্যেও চার প্রকারের বেদের বর্ণনা হওয়াতে বেদের তিনটা হওয়া তো সম্ভব নয়। অনেকত্র চার বেদের জ্ঞানকে চারজন ঋষির দ্বারা গ্রহণ করারও বর্ণনা আছে, কিন্তু এখানে মনুস্মৃতি তথা সত্যার্থপ্রকাশ্যের মধ্যে উদ্ধৃত প্রমাণে তিনটাই নাম আছে। এখানে বেদ বিদ্যার শৈলীগত বিভাগ তিন প্রকারে করা হয়েছে, তাহলে তাকে চারটা নামের সঙ্গে কিভাবে সংগত করা যাবে, এটাও একটা সমস্যা। এই কারণে "রবি" ও "সূর্য" দুটোর মধ্যে প্রত্যেক শব্দ থেকে আদিত্য ও অঙ্গিরার গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হয়। এখানে দুটো স্থানেই "আদিত্য" শব্দের ব্যবহার হয়নি। যৌগিক অর্থের দৃষ্টিতে আদিত্যের সমার্থক শব্দ রবি ও সূর্য দুটোই তথা অঙ্গিরা প্রাণকে বলে - প্রাণো বা অঙ্গিরা (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬.১.২.২৮)। ঋষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ১১.১৫ মন্ত্রে অঙ্গিরার অর্থ সূর্য করেছেন। সূর্য হল প্রাণতত্ত্বের সবথেকে বড় ভাণ্ডার, এই কারণেই সূর্য থেকে অঙ্গিরাকে গ্রহণ করেছেন। সূর্যের মধ্যে অনেক ধরণের তীব্র বিস্ফোরণের জন্য ধ্বনি হতে থাকার কারণে তাকে রবি বলে। এইভাবে "রবি" ও "সূর্য" পদ থেকে আদিত্য ও অঙ্গিরা দুই ঋষিকে গ্রহণ ত্রয়ী বিদ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য হেতু করা হয়েছে। বস্তুতঃ অথর্ববেদের মধ্যে তিন প্রকারের বিদ্যা আছে। তাহলে তাকে কেবল কোনো একটা বিদ্যার সঙ্গে নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়, সুতরাং বিদ্যার শৈলীর দৃষ্টিতে বেদ তিনটাই দর্শানো হয়েছে।
.
এখন প্রশ্ন হল ব্যক্তির নামের মধ্যে সমার্থক শব্দের ব্যবহার করা কি সাধু? আমার দৃষ্টিতে অগ্নি, বায়ু ও অঙ্গিরা ব্যক্তি বিশেষ নয়, বরং যে ঋষিগণ ক্রমশঃ ঋগ্বেদ, য়জুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদের জ্ঞান প্রাপ্ত করেন, তাঁদের নাম অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরাই হয়। এমনটা প্রত্যেক সৃষ্টির আদিতে হয়। এইভাবে এই নাম যৌগিক না হলেও, তবে য়োগরূঢ় তো হবেই, এই নাম যেন তাদের উপাধি। এই পরিস্থিতিতে ত্রয়ী বিদ্যার সামঞ্জস্যে তিন পদ থেকে চার পদের গ্রহণ সমার্থক শব্দের রূপেও গ্রহণ করা অনুচিত নয়। তাহলে আর্ষ প্রয়োগ সাধুই ধরা উচিত, এটা হল বৈদিক পরম্পরা। আমরা মানবীয় ইতিহাসের মধ্যেও এমন কিছু ব্যবহার দেখতে পারি, যেখানে "রাম" শব্দ থেকে তিন মহাপুরুষের গ্রহণ হতে দেখা যায়। সেই তিন ব্যক্তি হল - মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম, মহর্ষি পরশুরাম এবং বাসুদেব পুত্র বলরাম। এইভাবে এখানেও "রবি" বা "সূর্য" থেকে আদিত্য ও অঙ্গিরা দুই মহর্ষিকে গ্রহণ করা উচিত। অস্তু।
বেদবিদ্যার বিষয়ে ভগবৎ ব্যাস মহাভারত শান্তিপর্ব ২৩২ অধ্যায়ে শুকদেবকে বলেছেন -
অনাদিনিধনা বিদ্যা বাগুৎসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা।।২৪।।
ঋষীণাম্ নামধেয়ানি য়াশ্চ বেদেষু সৃষ্টয়ঃ।
নানারূপম্ চ ভূতানাম্ কর্মণাম্ চ প্রবর্ত্তনম্।।২৫।।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ নির্মিমীতে স ঈশ্বরঃ।।২৬।।
অর্থাৎ পরমব্রহ্ম পরমাত্মা অনাদি বেদবাণীকে উৎপন্ন করেছেন। এখানে "উৎসৃষ্ট" শব্দ সেটাই সংকেত করছে, যাকে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য শতপথ ব্রাহ্মণে ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন শ্বাস-প্রশ্বাসবৎ বাণীকে বলেছেন। এখানে "বিদ্যা-বাক্" মানে হল সেই বাণী যেখানে যথাযথ জ্ঞান আছে অর্থাৎ বেদবাণী।।২৪।।
.
বিভিন্ন ঋষিদের নাম অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডস্থ ঋষি প্রাণের নাম, যেখান থেকে মানব ঋষিগণ নিজেদের নাম রেখেছেন। সৃষ্টির যে যে পদার্থ বৈদিক ছন্দরূপ প্রাণের মধ্যে রচিত হয়, বিভিন্ন পদার্থ ও প্রাণীদের নানা রূপ এবং তাদের কর্মকে আদি সৃষ্টিতে ঈশ্বর বৈদিক শব্দ বা ছন্দ দিয়েই রচনা করেন এবং সেগুলোর মাধ্যমেই সেগুলোর বর্ণনা করেন।।২৫-২৬।।
.
এখানে না কেবল ভাষা ও জ্ঞানের স্রোত বেদের চর্চা আছে, বরং সেই বেদ অর্থাৎ প্রাণ (ছন্দ) সমূহরূপ বেদেরও সংকেত আছে, যা দিয়ে সম্পূর্ণ পদার্থের উৎপত্তি হয়। বস্তুতঃ এই দুটো একই হয়। আমি এর চর্চা "বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান" নামক অধ্যায়ে করবো। যদি এমন না হতো, তাহলে "ভূতানাম্ নানারূপম্" এই পদ হতো না। কর্মের প্রবর্তন তো ভাষা ও জ্ঞান থেকে হয়েছে, কিন্তু প্রাণী ও পদার্থের রূপ তো জড় উপাদান থেকেই হওয়া সম্ভব। সম্ভবত ভগবান্ ব্যাসের এইসব বিচার থেকে প্রেরিত হয়েই মহানবিদ্বান ভর্ত্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয়ম্ গ্রন্থের ব্রহ্ম কাণ্ডের প্রথম শ্লোকে লিখেছেন -
অনাদিনিধনম্ ব্রহ্ম শব্দতত্ত্বম্ য়দক্ষরম্।
বিবর্ত্ততেऽর্থভাবেন প্রক্রিয়া জগতো য়তঃ।।
অর্থাৎ অনাদি ও অমর, অবিনাশী শব্দতত্ত্ব রূপ যে ব্রহ্ম আছে, সেটা অর্থের ভাব দ্বারা বিবর্তকে প্রাপ্ত করে। এর মানে হল শব্দ ব্রহ্ম অর্থাৎ মূল শব্দ ওঙ্কার সৃষ্টি রচনার প্রয়োজনে বিভিন্ন বাণী-ছন্দের মধ্যে পরব্রহ্ম পরমাত্মা দ্বারা বিস্তারিত করা হয়, প্রথমে সর্বত্র ওঙ্কার রূপী বাক্ ব্যাপ্ত হয়, তারপর সমস্ত বৈদিক ছন্দ ব্যাপ্ত হয়। এরদ্বারা জগন্নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে সেই বেদ-বাক্ দিয়ে সমস্ত মানব জগতের ব্যবহারের প্রক্রিয়াও চলে। আমি আর্ষগ্রন্থের অধিক প্রমাণ এই কারণে দিচ্ছি না, কারণ দুর্ভাগ্যবশতঃ এইসব গ্রন্থের আজ সংসারে তো কি, ভারতের মধ্যেও সম্মান বাকি নেই। আমি আমার গ্রন্থ, বিশেষ করে সেই বিদ্বানদের জন্য লিখেছি, যারা বিজ্ঞান ও তর্কেরই সহায়তায় সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার দাবি করে আর নিজের বৈজ্ঞানিক বা বৌদ্ধিক দম্ভে পরিপূর্ণ হয়ে বেদ বা আর্ষ গ্রন্থের উপহাস বা নিন্দা করতে নিজেকে গর্বিত মনে করে, অস্তু।
.
এই চারজন ঋষি সর্বপ্রথম মহর্ষি ব্রহ্মাকে জ্ঞান দেন। এরদ্বারা এটা স্পষ্ট হল যে মহর্ষি ব্রহ্মা সেই আদি সৃষ্টিতে ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। মহর্ষি ব্রহ্মা এই চারজন ঋষির কাছ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত করে বিশ্বের মধ্যে সর্বপ্রথম চতুর্বেদবিৎ ঋষি হন। তারপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম্পরা মহর্ষি ব্রহ্মা থেকে অদ্যপর্যন্ত ক্রমাগত চলে আসছে। কারণ মহর্ষি ব্রহ্মাই প্রথম চতুর্বেদবিৎ ছিলেন, এই কারণে তাঁকেই ভারতীয় পরম্পরাতে সভ্যতার আদ্য পুরুষ ধরে নেওয়া হয়েছে। এই পরম্পরাতে ভগবান্ মনু, ভগবান্ শিব, ভগবান্ বিষ্ণু, দেবরাজ ইন্দ্র, দেবগুরু মহর্ষি বৃহস্পতি, সনৎকুমার, নারদ, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য, ভরদ্বাজ, বাল্মীকি, বিশ্বামিত্র, ব্যাস, গোতম, পতঞ্জলি, কণাদ, য়াস্ক, পাণিনি, জৈমিনী আদি অনেক ঋষি-মুনির দ্বারা বিস্তৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ সাহিত্যের সৃজন হয়েছে।
.
এইভাবে সাহিত্য শৃঙ্খলাতে অপৌরুষেয় চার বেদ সংহিতার পশ্চাৎ অনেক শাখা গ্রন্থ, মনুস্মৃতি, বাল্মীকি রামায়ণ, মহাভারত, ঐতরেয়-শতপথ-গোপথ আদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, শিক্ষা, কল্প, ছয় দর্শনশাস্ত্র (ন্যায়, সাংখ্য, বৈশেষিক, য়োগ, বেদান্ত ও মীমাংসা), উপনিষদ, অনেক নীতিগ্রন্থ আদির অতি সমৃদ্ধ পরম্পরা চলতে থাকে। সারা বিশ্বের মধ্যে বেদ থেকে জ্ঞান ও ভাষার বিকাশ হয়েছে। এর ইতিহাসের জন্য পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত রিসার্চ স্কোলার কৃত " বৈদিক বাঙ্ময়ের ইতিহাস" তথা পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মা কৃত "বৈদিক সম্পত্তি" গ্রন্থ বিশেষ পঠনীয় ও মননীয়। আমার এই অধ্যায়কে লেখার প্রয়োজন মাত্র এটাই ছিল যে জ্ঞান ও ভাষার প্রথম উৎপত্তি কোথা থেকে ও কিভাবে হয়েছে।
.
এই তথ্য সর্ববিদিত যে সংসারের যেকোনো দেশ তার বিদ্যা ও সভ্যতার পরম্পরাকে মানব সৃষ্টিকালের সঙ্গে যুক্ত করার সাহস কখনও করবে না। বর্তমানে বিবর্তনবাদের মিথ্যা প্রচার, যেটা বিজ্ঞানের নামে প্রচলিত, সেটা থাকাতে সকল মানব স্বয়ংকে পশুদের বংশজ মেনে নিজেকে মূর্খ প্রজন্মের সন্তান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আমি একথা বুঝি না, বর্তমান বিজ্ঞানের অতি আবেশে মানব স্বয়ংকে পশু তথা জংলী মানুষের বংশজ বলার জিদ কেন করছে? এমন নয় তো যে পশ্চিমী দেশের বৈজ্ঞানিক নিজের শোধকার্যকেও নিজের সাম্প্রদায়িক বিচারের দুরাগ্রহ থেকে মুক্ত রেখে নিষ্পক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করার সাহস পাচ্ছে না। তারা এতে ভয় পাচ্ছে না তো যে এরদ্বারা স্বয়ংকে মহান ঋষিদের সন্তান সিদ্ধ করলে তাদের সম্প্রদায়ের মান্যতা ধ্বংস তথা বৈদিক ও ভারতীয় মান্যতা সত্য সিদ্ধ হয়ে যাবে।
.
বস্তুতঃ বেদের যথাযথ বোধ না হওয়ার কারণে বৈদিক পরম্পরাকে কেবল হিন্দুদের অথবা ভারতীয়দের পরম্পরা মেনে সাম্প্রদায়িক বা ক্ষেত্রীয় দৃষ্টিতেই দেখা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই দেশের তথাকথিত বেদানুরাগী বৈদিক বিদ্বানের সঙ্গে-সঙ্গে তথাকথিত প্রবুদ্ধ বর্গ এবং রাজনীতি এইসবের জন্য অধিক উত্তরদায়ী। এর বর্ণনা করা এই গ্রন্থের প্রয়োজন নয়। বিবেকশীল নিষ্পক্ষ মানুষ জ্ঞান ও ভাষার পরম্পরার প্রারম্ভ সম্বন্ধীয় বর্তমান জগতে প্রচলিত বিভিন্ন মতের সঙ্গে আমাদের বৈদিক মতের তুলনা করে স্বয়ংই সত্যের অনুভব করবেন।
.
আমরা আমাদের চারিদিকে যা কিছু দেখতে পাই, অথবা যেকোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব হয় অথবা হতে পারে বা নাও হতে পারে এবং যেটা কখনও না কখনও নির্মিত হয়েছে, তাকে সৃষ্টি বলে। এই সৃষ্টির উপর আমরা যদি বিচার করি তাহলে আমাদের বুদ্ধি হতভম্ব হয়ে যায়। আসুন, আমরা এর সূক্ষ্মতার উপর কিছু বিচার করি -
.
সকল লোক-লোকান্তর আর তাতে বিদ্যমান প্রাণীদের শরীর এবং বনস্পতি সূক্ষ্ম কণা বা মলিকিউল দিয়ে তৈরি হয়েছে। এই কথা বিজ্ঞান জানা যেকোনো সাধারণ ব্যক্তিও জানে আর এই মলিকিউল দুই বা দুইয়ের বেশি অ্যাটম মিলে তৈরি হয়। যদি আমরা একটা অ্যাটমের আকার সম্বন্ধে বিচার করি, তাহলে একটা অ্যাটমের ত্রিজ্যা প্রায় ১০^ -১০ মিটার হয়, আর এর বক্রপৃষ্ঠ প্রায় ১০^ -২০ বর্গ মিটার হয়। এইদিকে ধরে নিন কোনো আলপিন বা সুইয়ের ত্রিজ্যা প্রায় ০.১ মিমি হয়, আর এর বক্রপৃষ্ঠ প্রায় ১০^ -৮ বর্গমিটার হয়। যদি মানুষের আকার একটা অ্যাটমের সমান ধরে নেওয়া হয়, তাহলে একটা আলপিনের মাথায় ১০^১২ জন মানুষ আরামে বসতে পারবে অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর মতো জনসংখ্যার একশোটা পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ একটা আলপিনের মাথায় বসতে পারবে। এত সূক্ষ্ম অ্যাটমও স্বয়ং কোনো দৃঢ় কণার হয় না, বরং তার ১০^-১৫ ভাগই নাভিক রূপে হয়, যার চারিদিকে ইলেকট্রনস চক্কর কাটতে থাকে। অন্যদিকে সেই নাভিকও পূর্ণ রূপে দৃঢ় হয় না, বরং সেখানেও সূক্ষ্ম কণা, কোয়ার্ক আদি ভরা থাকে। তাদের মধ্যেও অবকাশ আছে আর কোয়ার্ক আদি কণাও দৃঢ় হয় না। এইভাবে সূক্ষ্ম জগতের কল্পনা করাও অতি কঠিন হয়।
.
যদি এই ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতার উপর বিচার করা হয়, তাহলে আমাদের বিশাল দেখতে এই পৃথিবী যার বৃত্ত ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তার ততটুকুই স্থান মানা যেতে পারে, যতটা পৃথিবীতে স্থিত সব মহাসাগরের জলের একটা বিন্দু হবে, সম্ভবতঃ এরথেকেও ছোটো স্থান হবে। আমাদের পৃথিবী হল সৌরমণ্ডলের একটা মধ্যম বা ছোটো আকারের গ্রহ। এমন কয়েক আরব সৌরমণ্ডল আমাদের একটা গ্যালাক্সির মধ্যেই আছে আর এমন কয়েক আরব গ্যালাক্সি এই ব্রহ্মাণ্ডে বৈজ্ঞানিকরা এখন পর্যন্ত দেখেছেন। আমাদের সূর্য আমাদের পৃথিবী থেকে তেরো লক্ষ গুণ বড় আর এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এই সূর্যের থেকে কোটি-কোটি গুণ বড় সূর্য আছে। তাহলে তার বিস্তারের কল্পনা করাও কত কঠিন হবে। বৈজ্ঞানিক যতটুকু দেখেছে, ব্রহ্মাণ্ড কেবল ততটুকুই নয়। এইভাবে এই ব্রহ্মাণ্ড মানুষের জন্য সর্বদা কৌতূহলজনক বিষয় হয়ে আছে।
.
এইজন্য এই পৃথিবীতে যখন থেকে মানুষ জন্ম নিয়েছে, তখন থেকে সৃষ্টি উৎপত্তি এবং সঞ্চালন প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানার চেষ্টা নিরন্তর করেছে। এই সময়ও পৃথিবীতে যেখানে-যেখানে মানুষ বাস করছে, তারা শিক্ষিত হোক অথবা অশিক্ষিত, সবাই কোনো না কোনো স্তরে এই ব্রহ্মাণ্ডের বিষয়ে বিচার অবশ্যই করে। এই বিচার তাদের বিভিন্ন বৌদ্ধিক স্তরের দৃষ্টিতে ভিন্ন-ভিন্ন হয়। সকল সম্প্রদায় তার পৃথক-পৃথক দর্শনের দ্বারা এই সৃষ্টির উপর নানা প্রকারের কল্পনা নিয়ে আছে। অন্যদিকে বর্তমান বিজ্ঞান গত প্রায় ২০০—৩০০ বছর ধরে এই সৃষ্টির উপর পর্যাপ্ত বিচার করেছে। এখন আমরা বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞানের উপর চর্চা আরম্ভ করবো। এই বিষয়ে পাঠকদের সর্বপ্রথম আমার এক লঘু পুস্তক "সৃষ্টি সঞ্চালক" অবশ্যই পড়া উচিত। সেই পুস্তকের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক ও সর্বশক্তিমতী চেতন সত্তা ছাড়া সৃষ্টির উৎপত্তি হওয়া সম্ভব না।
.
এখানে একটা প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে ঈশ্বর স্বয়ং নিজের মধ্যে পূর্ণ ও অকাম হন, তাহলে তিনি কেন সৃষ্টির রচনা করেছেন? সৃষ্টি জড় পদার্থ মিশ্রিত হয়ে তৈরি হওয়াতে সেটা স্বয়ং জড় পদার্থ, এই কারণে তার অস্তিত্ব নিজের জন্য তো হবে না। সৃষ্টির যেকোনো পদার্থই নিজের জন্য হয় না। সূর্য স্বয়ং নিজের জন্য হয় না, পৃথিবী, জল, বায়ু ও অগ্নি আদিও নিজের জন্য হয় না, বরং কোনো চেতন সত্তার জন্য হয়। সেই জগৎস্রষ্টা ও সঞ্চালকের না তো ভোজন, জল এবং বায়ুর আবশ্যকতা আছে আর না তাঁর প্রকাশ, বিদ্যুৎ ও থাকার জন্য কোনো লোকে- লোকান্তরের আবশ্যকতা আছে। এমন স্থিতিতে সৃষ্টির রচনা তিনি নিজের জন্য তো করবেন না। যদি কেউ বলে যে তিনি লীলাবশত এই প্রপঞ্চ রচনা করেছেন, তাহলে সেটাও উচিত নয়, কারণ লীলা তো নির্বোধ শিশু করে, যে শিশু উচিত প্রয়োজন ছাড়া মাটি দিয়ে ঘর বানায় ও ভেঙে ফেলে। সেই সময় তার মধ্যে প্রয়োজনীয়তা নিষ্প্রয়োজনীয়তার কোনো বোধ থাকে না। যখন সে বড় হয়, তখন সে খেলা করা বন্ধ করে দেয়। আরেকটা লীলা কোনো মিথ্যাচারী বা নাটককার করে, যে ক্রমশঃ কাউকে ঠকাতে বা অন্যের মনোরঞ্জন এবং নিজের উদরপূর্তি বা যথেষ্ট ধনার্জন হেতু করে। এরমধ্যে কোনো কারণেই ঈশ্বরের লীলা করা উচিত সিদ্ধ হয় না।
.
এই কারণে ঈশ্বর দ্বারা এই বিশাল সৃষ্টি রচনার পিছনে কোনো বিশেষ প্রয়োজন অবশ্যই আছে। যে যত মহান হয়, তার প্রয়োজন ততই মহান হয়। যেহেতু সেই ঈশ্বর সবথেকে মহান হন, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর প্রয়োজনও সবথেকে মহান হবে। ঈশ্বর হলেন পরম দয়ালু, তাহলে তাঁর দয়ার পাত্র তো কোনো চেতন পদার্থই হবে, জড় পদার্থের জন্য দয়ার কোনো অর্থই হয় না। তিনি ন্যায়কারী হন, তাহলে তাঁর ন্যায়ের পাত্রও তো কোনো চেতন পদার্থই হবে, কারণ জড় পদার্থের জন্য ন্যায়-অন্যায়ের কোনো অর্থই হয় না। সেই ঈশ্বর পরোপকারী হন, তাহলে তিনি কার উপকার করেন, সেই পদার্থ চেতনই হবে, জড় হবে না। এই সৃষ্টি তার উপকারের জন্যই বানিয়েছেন। মহর্ষি কপিল একেই দৃষ্টিগত রেখে বলেছেন -
"সম্হৎপরার্থত্বাৎ পুরুষস্য" (সাংখ্য দর্শন)
অর্থাৎ এই প্রকৃতির সংঘাত থেকে তৈরি সৃষ্টি কারও উপকারের জন্য হয়েছে অর্থাৎ তার ব্যবহারের জন্য হয়েছে, এরদ্বারা কোনো ভোক্তা চেতন পুরুষ পদার্থের অনুমান হয়। কারণ সেই চেতন পদার্থের জন্য ঈশ্বর রচনা করেছেন, এই কারণে সেই চেতন পদার্থ ঈশ্বরের মতো সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপক ও সর্বশক্তিমান তো হতে পারে না। এর অর্থ হল সেই চেতন তত্ত্ব একদেশী, অল্পজ্ঞ ও অল্পশক্তিশালী হবে। এরই নাম জীবাত্মা রাখা হয়েছে, যেটা আমাদের মতো সব প্রাণীর শরীরের মাধ্যমে এই সৃষ্টির ভোগ করে আর এর ভোগ করতে-করতে মোক্ষকেও প্রাপ্ত করে, যেটা হল তার পরম লক্ষ্য। সেই চেতন পদার্থ অর্থাৎ জীবাত্মাও ঈশ্বরের মতো অজন্মা, অবিনাশী, নিরাকার ও নির্বিকার হয়। এইভাবে তিনটা সত্তা অনাদি, অজন্মী ও অবিনাশী হয় - ঈশ্বর, জীব এবং প্রকৃতি। এরমধ্যে ঈশ্বর হলেন এই সৃষ্টির স্রষ্টা ও সঞ্চালক।
.
সেই ঈশ্বর জীবাত্মার ভোগ ও মোক্ষের জন্যই এই সৃষ্টির নির্মাণ করেছেন। ঈশ্বর জড় পদার্থ ছাড়া সৃষ্টির নির্মাণ করতে পারবেন না। কিছু ব্যক্তি তাঁর সর্বশক্তিমান বিশেষণের কারণে এমন মনে করেন যে ঈশ্বর জড় পদার্থ ছাড়াই সৃষ্টির রচনা করতে পারেন, এমন বিচার বৌদ্ধিক অপরিপক্বতার পরিচায়ক হয়। এই বিষয়ে "সৃষ্টি সঞ্চালক" পুস্তকটা পড়া উচিৎ। তার সঙ্গে ডাক্তার ভূপসিংহ কৃত "বৈদিক সংস্কৃতি কী বৈজ্ঞানিকতা" পুস্তকটাও পড়া উচিৎ।
বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান
এখন
আমরা এই ক্রমে সর্বপ্রথম এই বিষয় নিয়ে গম্ভীর বিচার করবো যে ঈশ্বর যে মূল পদার্থ দিয়ে সৃষ্টির রচনা করেছেন, সেই মূল পদার্থটা কি? তার স্বরূপ কি? মনে রাখতে হবে যে বৈদিক বিজ্ঞান শূন্য থেকে সৃষ্টির উৎপত্তিকে স্বীকার করে না আর না সৃষ্টিকে অনাদি মানে, বরং বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই সৃষ্টি একটা জড় পদার্থ, যাকে মূলত প্রকৃতি নাম দেওয়া হয়েছে, তার দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে। এখানে "প্রকৃতি" শব্দ এই সংকেত করে যে এই পদার্থ হল যেকোনো জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম, প্রারম্ভিক এবং স্বাভাবিক অবস্থা। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান অসংখ্য বিশালতম নক্ষত্র থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম কণা বা রশ্মি আদি পদার্থ পর্যন্ত সবকিছু এই প্রকৃতি রূপী স্বাভাবিক অবস্থাযুক্ত পদার্থ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে, তারমধ্যেই উপস্থিত আছে আর একটা নিশ্চিত সময়ান্তরালের পশ্চাৎ সেই স্বাভাবিক অবস্থাযুক্ত পদার্থের মধ্যেই লীন হয়ে যাবে।
.

প্রকৃতি

এখন আমরা এই বিষয় নিয়ে বিচার করবো যে প্রকৃতি কাকে বলে? এর স্বরূপ কি? এই বিষয়ে মহাদেব শিব তাঁর ধর্মপত্নী ভগবতী উমাকে বলেছেন -
নিত্যমেকমণু ব্যাপি ক্রিয়াহীনমহেতুকম্।
অগ্রাহ্যমিন্দ্রিয়ৈঃ সর্বৈরেতদব্যক্তলক্ষণম্।।
অব্যক্তম্ প্রকৃতির্মূলম্ প্রধানম্ য়োনিরব্যয়ম্।
অব্যক্তস্যৈব নামানি শব্দ্যৈঃ পর্য়ায়বাচকৈঃ।।
(মহাভারত অনুশাসন পর্ব-দানধর্মপর্ব ১৪৫ অধ্যায়, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬০১৪)
অন্যদিকে মহর্ষি ব্রহ্মা বলেছেন -
তমো ব্যক্তম্ শিবম্ ধাম রজো য়োনিঃ সনাতনঃ।
প্রকৃতির্বিকারঃ প্রলয়ঃ প্রধানম্ প্রভবাপ্যয়ৌ।।২৩।।
অনুদ্রিক্তমনূনম্ বাপ্যকম্পমচলম্ ধ্রুবম্।
সদসচ্চৈব তৎ সর্বমব্যক্তম্ ত্রিগুণম্ স্মৃতম্।
জ্ঞেয়ানি নামধেয়ানি নরৈরধ্যাত্মচিন্তকৈঃ।।২৪।।
(মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব অনুগীতা পর্ব অধ্যায় ৩৯)
এই শ্লোকগুলো থেকে প্রকৃতি রূপ পদার্থের নিম্ন লিখিত গুণগুলো প্রকাশিত হয় -
১. নিত্য - এই পদার্থ সর্বদা বিদ্যমান থাকে অর্থাৎ এর কখনও অভাব হয় না। এটা অজন্মা এবং অবিনাশী রূপের হয়।
২. এক - মহাপ্রলয় কালে অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তির পূর্বে এই পদার্থ সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে সর্বত্র একরসে ভরে থাকে। এরমধ্যে কোনো রকম হ্রাস-বৃদ্ধি (ফ্লেকচুয়েশন) অর্থাৎ ঘনত্ব এবং বিরলতার ভেদ প্রলয়াবস্থাতে হয় না।
৩. অণু - এটা জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। এর থেকে সূক্ষ্ম জড় পদার্থের অবস্থার কল্পনারও করা সম্ভব নয়।
৪. ব্যাপী - এই পদার্থ সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। কোথাও অবকাশ থাকে না।
৫. ক্রিয়াহীন - মহাপ্রলয়াবস্থাতে এই পদার্থ পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে।
৬. অহেতুক - এই পদার্থের কোনো কারণ হয় না। তার মানে হল এই পদার্থ ঈশ্বরাদি দ্বারা নির্মিত হয় না, বরং স্বয়ম্ভূ রূপ হয়। সৃষ্টির হেতু ঈশ্বর এটিকে প্রেরিত ও বিকৃত করে অবশ্য, কিন্তু তাকে তৈরি করে না।
৭. অগ্রাহ্য - এটা হল পদার্থের সেই স্থিতি, যাকে কোনো ইন্দ্রিয়াদি সাধন দিয়ে কখনও জানা বা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
৮. অব্যক্ত - একে কোনো ভাবেই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ব্যক্তের লক্ষণ সম্বন্ধে মহর্ষি ব্যাস লিখেছেন -
প্রোক্তম্ তদ্ব্যক্তমিত্যেব জায়তে বর্ধতে চ য়ৎ।
জীর্য়তে ম্রিয়তে চৈব চতুর্ভির্লক্ষণৈর্য়ুতম্।।
(মহাভারত শান্তিপর্ব, মোক্ষধর্মপর্ব, অধ্যায়২৩৬, শ্লোক ৩০)
যেটা এর বিপরীত হবে, তাকে অব্যক্ত বলা হবে। এর দ্বারা সিদ্ধ হল যে প্রকৃতি রূপী পদার্থ না জন্ম নেয়, না বৃদ্ধি প্রাপ্ত করে, না পুরোনো হয় আর না নষ্ট হয়।
৯. মূল - এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ বিদ্যমান ছিল, আছে বা থাকবে, সেই সবের উৎপত্তির মূল উপাদান কারণ হল এই জড় পদার্থ। এই পদার্থের মধ্যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি নির্মাণের সমস্ত সম্ভাবনা এবং মূল গুণ লুকিয়ে থাকে।
১০. প্রধান - এই সূক্ষ্মতম পদার্থ সম্পূর্ণ জড় পদার্থকে সঠিকভাবে ধারণ ও পোষণকারী হয়। একথা পৃথক যে ঈশ্বর তত্ত্ব এই পদার্থকেও ধারণ করে।
১১. য়োনি - এই পদার্থ যেমন সবার উৎপত্তির কারণ হয়, তেমনই এই পদার্থ সবার নিবাস ও উৎপত্তি-স্থানও হয়। সম্পূর্ণ সৃষ্টি এই পদার্থ দিয়েই তৈরি এবং এর মধ্যেই উৎপন্ন হয়।
১২. অব্যয় - এই পদার্থ কখনও ক্ষীণ বা ন্যুন হয় না অর্থাৎ এই পদার্থ সৃষ্টি এবং প্রলয় সব অবস্থাতে সর্বদা সংরক্ষিত থাকে।
১৩. তম - এই পদার্থ এমন অন্ধকার রূপে বিদ্যমান থাকে, সেইরূপ অন্ধকার অন্য যেকোনো অবস্থাতে হওয়া সম্ভব নয়।
১৪. ব্যক্ত - এখানে অব্যক্ত প্রকৃতির ব্যক্ত বিশেষণ আমার মতে এই সংকেত দেয় যে সত্ত্ব, রজস্ এবং তমস্ এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্ব ও রজসের তো কোনো লক্ষণ মহাপ্রলয়ে বিদ্যমান হয় না, কিন্তু তমস্ গুণের একটা লক্ষণ অন্ধকার অবশ্য ব্যক্ত থাকে। সর্বত্র অব্যক্ত যে প্রকৃতিকে বলা হয় তাকে এখানে ব্যক্ত বিশেষণ এই কারণেই বলা হয়েছে বলে মনে হয়। তারসঙ্গে এর মানে এটাও হয় যে সেই অব্যক্ত প্রকৃতিই ব্যক্ত জগৎ রূপে প্রকট হয়। তাছাড়া এই পদার্থ ঈশ্বর ও জীবাত্মার তুলনায় ব্যক্তই হয়।
১৫. শিবধাম - "শেতেऽসৌ শিবঃ" (উণাদি কোষ ১.১৫৩) থেকে সংকেত পাওয়া যায় যে এই সূক্ষ্মতম পদার্থ নিদ্রাবস্থার মতো হয়। এই পদার্থ প্রত্যেক জড় পদার্থের ধাম হয় অর্থাৎ সব পদার্থ এর মধ্যেই থাকে। এটা দিয়েই জীবের কল্যাণ অর্থাৎ ভোগ ও মোক্ষের শরীররূপী সাধন নির্মিত হয়।
১৬. রজোয়োনি - সৃষ্টি উৎপত্তির প্রারম্ভ থেকে শুরু করে প্রলয়ের প্রারম্ভ হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক রজোগুণী প্রবৃত্তি এই কারণ রূপ পদার্থের মধ্যেই উৎপন্ন হয়। এর বাইরে কোনো রূপ কোনো উৎপত্তি আদি ক্রিয়া কখনও হওয়া সম্ভব নয়।
১৭. সনাতন - এই পদার্থ হল সনাতন অর্থাৎ এর কখনও অভাব হয় না। না এটা কখনও উৎপন্ন হয় আর না কখনও নষ্ট হয়।
১৮. বিকার - এই পদার্থই বিকার প্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টিতে বিভিন্ন পদার্থ রূপে প্রকট হয়। এই পদার্থ ছাড়া অন্য কোনো পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর ও জীবাত্মা নামক দুই চেতন পদার্থের মধ্যে কখনও বিকৃতি আসে না। এই কারণে সেই দুই পদার্থ কোনোরূপ কোনো পদার্থের উপাদান কারণ হয় না।
১৯. প্রলয় - এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ নষ্ট হওয়ার যোগ্য হয়, সেটা নষ্ট হয়ে তার কারণরূপ প্রকৃতি পদার্থের মধ্যেই লীন হয়ে যায়। মহর্ষি কপিল মুনি একেই নাশ বলেছেন - "নাশঃ কারণলয়ঃ" (সাংখ্য দর্শন ১.১২১)
২০. প্রভব - এর মানে হল এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব পদার্থ উৎপন্ন হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, সেগুলো এই পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয়। জীবাত্মা চেতন হওয়া সত্ত্বেও একে ছাড়া ভোগ ও মোক্ষ দুটোর মধ্যে একটাও প্রাপ্ত করতে পারবে না।
২১. অপ্যয় - এই পদার্থের মধ্যেই সৃষ্টির সব উৎপন্ন পদার্থ বিনাশের সময় মিলে যায়। আর সৃষ্টি কালেও এরমধ্যেই সমাহিত হয়ে পরস্পর মিলেমিশে থাকে।
২২. অনুদ্রিক্ত - এই অবস্থায় স্পষ্টতাদি কোনো লক্ষণ বিদ্যমান হয় না।
২৩. অনূন - এই পদার্থ কখনও অভাব প্রাপ্ত করে না।
২৪. অকম্প - এই অবস্থায় কোনো কম্পন বিদ্যমান হয় না আর না হওয়া সম্ভব।
২৫. অচল - এই অবস্থায় কোথাও কোনো গতি হয় না।
২৬. ধ্রুব - এই পদার্থ পূর্ণ রূপে স্থির থাকে।
২৭. সৎ+অসৎ - এই পদার্থ সর্বদা সত্তাবান হওয়া সত্ত্বেও প্রলয় কালে অর্থাৎ প্রকৃতি রূপে সর্বদা অবিদ্যমানের সমান হয়।
২৮. সর্ব - এই পদার্থ সৃষ্টিনির্মাণার্থ পূর্ণই হয় অর্থাৎ এর অতিরিক্ত অন্য কোনো উপাদান পদার্থের আবশ্যকতা হয় না।
২৯. ত্রিগুণ - এই পদার্থ সত্ত্ব-রজস্-তমস্ গুণের সাম্যাবস্থা রূপ হয়।
৩০. প্রকৃতি - এটাই হল প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থা, যার সম্বন্ধে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
.
এছাড়া মহাভারত শান্তি পর্ব, মোক্ষধর্ম পর্বের ৩০৭ অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোকে মহর্ষি বশিষ্ঠ অব্যক্ত প্রকৃতিকে "অবিদ্যা" বলেছেন। এর দ্বারা এই সংকেত পাওয়া যায় যে সেই অবিদ্যা রূপ প্রকৃতি না জানার, না উপয়োগে নেওয়ার আর না বিচারের যোগ্য হয়। সেটা বিদ্যমান হয়েও অবিদ্যমানবৎ হয়।
আজকের বিজ্ঞান সৃষ্টি উৎপত্তির অনেক পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তকে প্রস্তুত করে। সেগুলোর মধ্যে সবথেকে বড় সমস্যা হল বর্তমান বিজ্ঞান সৃষ্টি উৎপত্তির মূল কারণ এবং তার স্থিতির বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ আছে। সেটা কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপরই আশ্রিত, সামান্য তার্কিকতা ও ঊহাশক্তির ব্যবহারও করতে চায় না, তাই মূল স্থিতির সম্বন্ধে তার অনভিজ্ঞতা কখনও দূর হবে না। বৈদিক বিজ্ঞানে শব্দ প্রমাণের অনেক গুরুত্ব আছে। বর্তমান বিজ্ঞান শব্দ প্রমাণকে প্রমাণ মানুক আমি সেটা বলছি না, কিন্তু তর্ক এবং ঊহার উপেক্ষা করা তো তার উচিত নয়। আমাদের একথা ভুলা উচিত নয় যে পরীক্ষা, নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের একটা সীমা আছে আর সেই সীমা পরীক্ষকের কাছে উপলব্ধ পরীক্ষা, নিরীক্ষা আদির সাধন অর্থাৎ টেকনোলজির উপর নির্ভর করে।
.
যদি আমাদের কাছে ভোজনে বিষের পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত টেকনোলজি না থাকে আর কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আমাদের ভোজন প্রদান করে তথা সেই ভোজন দেওয়া ব্যক্তির মুখাকৃতি সন্দেহজনক বলে মনে হয়, তখন কি আমাদের সেই ভোজন গ্রহণ করা উচিত? আমরা কি বলবো যে ভোজনে যখন বিষ সিদ্ধই হয়নি, তাহলে ভোজনকে কেন ছেড়ে দিবো? আমরা কি এই বিষয়ে নিজের বিচারশক্তি আর ঊহার ব্যবহার করবো না? একইভাবে যদি আমরা কোথাও কোনো জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলি আর কোনো বনবাসী আমাদের পথ বলে দেয়, তাহলে কি আমরা তার বলা পথে যেতে চাইবো না? আমরা কি তার সঙ্গে এমন তর্ক করবো যে আপনি কোন টেকনোলজির সাহায্য নিজে পথটা জেনেছেন? যদি আমরা এমন করি তাহলে সেই গভীর জঙ্গলে সেই ভাবেই পথভ্রষ্ট হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরতে থাকবো, যেভাবে আজকের বৈজ্ঞানিক তার টেকনোলজির কুপমুণ্ডুক (কুয়োর ব্যাঙ) হয়ে সৃষ্টি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের অন্ধকার আর কাটাযুক্ত পথে দিশাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
.
বৈজ্ঞানিকও অবশ্য একথা জানেন যে তর্ক আর ঊহা ছাড়া তাদের টেকনোলজিও উচিত পরিণাম দিতে পারবে না। সেই কারণে তারা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে-সঙ্গে চিন্তন অবশ্যই করেন। ভিন্ন-ভিন্ন প্রতিভার বৈজ্ঞানিক একই উপকরণ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে ভিন্ন-ভিন্ন পরিণাম প্রাপ্ত করতে পারেন অর্থাৎ তারা ভিন্ন-ভিন্ন নিষ্কর্ষ বের করতে পারেন। সেইসব নিষ্কর্ষের শুদ্ধতা পৃথক-পৃথক হয়। যেখানে তাদের উপকরণ কাজ করে না, সেখানে তারাও বৈচারিক ব্যায়াম অর্থাৎ তর্ক আর ঊহা দিয়ে মানসিক পরীক্ষা করেন, যাকে তারা থট এক্সপেরিমেন্ট বলেন। স্ট্রিং থিওরীতে কোনো পরীক্ষা নেই, তাসত্ত্বেও সেটা ৫০-৬০ বছর ধরে কেবল গণিতীয় সংকল্পনার আধারেই চলছে। কোস্মোলজি আদির ক্ষেত্রেও স্থাপিত সিদ্ধান্তের সদৃশ অনেক কল্পনা সারা সংসারে প্রচলিত আছে। আমি এদের সবাইকে বলতে চাইবো যে থট এক্সপেরিমেন্টও সৃষ্টিকে জানার একটা খুব ভালো সাধন? কিন্তু যখন এই সাধনকে কোনো মজহবী পূর্বাগ্রহী অথবা অহম্মন্যতার জালে জড়িয়ে দেওয়া হয় আর নিষ্পক্ষ এবং সাত্ত্বিকী তর্ক আর ঊহার ব্যবহার হয় না, তখন এইসব বিজ্ঞানের জন্য অভিশাপ হয়ে যায়, যেমন আজ হয়ে আছে।
.
আজ সংসারে যে সূক্ষ্ম টেকনোলজি আছে, সেটা বিদ্যুত চুম্বকীয় তরঙ্গ অথবা ইলেক্ট্রনের উপর আধারিত, এইজন্য এই টেকনোলজি দিয়ে ফোটন আর ইলেকট্রনের থেকে স্থূল পদার্থ অথবা সেগুলোর সমকক্ষ সূক্ষ্ম পদার্থকে অনুভূত করা যেতে পারে, কিন্তু এরথেকে সূক্ষ্ম পদার্থের বিষয়ে কোনো কিছুই জানা যাবে না। আজ এই কারণে এইসব কণা এবং কোয়ার্ক আদির বিষয়ে একথার কল্পনাও করা সম্ভব নয় যে এগুলোরও কোনো গঠন আছে আর এগুলোরও অবয়ব আছে তথা সেই অবয়বও মূল পদার্থ নয়। এই কল্পনা, যেটা কল্পনা নয় বরং পূর্ণ বাস্তবতা, তাকে ভুলে গিয়ে বর্তমান বিজ্ঞান এইসব কণাকে মূল কণা বা মূল উপাসনা পদার্থ মেনে নিতে বাধ্য হয়ে আছে। যদি আমার ওজন মাপক যন্ত্রে ওজন মাপার ক্ষমতা ১০ কিলোগ্রাম হয় আর এর থেকে বড় ওজন মাপক যন্ত্র আমি না দেখি আর না শুনে থাকি, তখন যদি আমি এমন বলি যে সংসারে ১০ কিলোগ্রামের থেকে ভারী কোনো পদার্থ নেই, তাহলে এমন কথা বলা কি আমার বুদ্ধিমত্তা হবে?
.
মূল পদার্থের স্বরূপ কি হওয়া উচিত, এইটুকু বিচারের ক্ষমতা তো বৈজ্ঞানিকের মধ্যে অবশ্যই হওয়া উচিত। যেকোনো দুই মূলকণার গুণ পরস্পর ভিন্ন কেন হয়, এর বিবেচনা তো হওয়াই উচিত। লবণ আর মিশ্রির ক্রিস্টাল দেখতে সমান সদৃশের হয়, কিন্তু স্বাদ নিলে দুটোর মধ্যে ভেদ স্পষ্ট হয়ে যায়। এখন এখানে যেকোনো সাধারণ বুদ্ধির ব্যক্তি বিচার করে নিবে যে এদের স্বাদে যেহেতু ভিন্নতা আছে, সুতরাং নিশ্চয়ই এদের গঠনেও ভেদ আছে। এগুলোর অবয়বও অবশ্যই ভিন্ন-ভিন্ন হবে, তাহলে আমরা কেন এটা বিচার করবো না যে তথাকথিত মূলকণা ইলেকট্রন, ফোটন, কোয়ার্ক এবং নিউট্রিনোর মতো কণার গুণের মধ্যে ভেদ হওয়ার কারণে এগুলোর আন্তরিক গঠন এবং এগুলোর অবয়বের মধ্যে ভেদ আছে? এই ভেদ অবশ্যই আছে, অন্যথা এই কণাগুলোর গুণের মধ্যে ভেদ হওয়াই সম্ভব নয়। এগুলোকে কণা রূপে মূল বলা যেতে পারে অবশ্য, তবে এগুলোকে মূল পদার্থ বলা যাবে না, কারণ পদার্থ কণার স্থিতির থেকেও সূক্ষ্মতর আর সূক্ষ্মতম হতে পারে। যেমন গম, যব ছোলা, বাজরা আদি ফসল রূপে মূল হয়, কিন্তু পদার্থ রূপে এগুলোরও কোনো মূল পদার্থ আছে আর যে মূল পদার্থ আছে, সেটা ফসল রূপে নয় বরং সূক্ষ্ম রাসায়নিক তত্ত্ব রূপে আছে আর সেই পদার্থেরও মূল কোনো অন্য পদার্থ আছে।
.
সবার মূলকে জানার প্রক্রিয়া সেখানে সমাপ্ত হয়, যেখানে সম্পূর্ণ পদার্থ একই রকম গুণযুক্ত হয়। যেখানে কোনো বিষমতা নেই, বরং পূর্ণতঃ একত্ব আছে। এইভাবে বর্তমান ভৌতিক বিজ্ঞান মূল পদার্থের জ্ঞান থেকে অনেক দূরে আছে। সেটা যতই সময় আর ধন নষ্ট করুক না কেন, টেকনোলজি আর গণিতের সীমায় বাঁধা থাকার প্রতিবদ্ধতা তাকে কখনও মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে দিবে না। এখানে বিজ্ঞ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আমি যে প্রকৃতি পদার্থের চর্চা করেছি, সেই পদার্থই হল সম্পূর্ণ সৃষ্টির মূল।
.
বৈদিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সৃষ্টি উৎপত্তির পূর্বে অর্থাৎ প্রলয় কালে মূল পদার্থ কোন অবস্থায় বিদ্যমান থাকে, একথা পূর্বোক্ত প্রকৃতির বিভিন্ন নাম থেকে জানা যেতে পারে। এইভাবে সৃষ্টির মূল পদার্থ সর্বত্র অর্থাৎ অনন্ত আয়তনে এমন বিরল অবস্থায় একরস হয়ে ছড়িয়ে বা ব্যাপ্ত থাকে, সেইরূপ এই সৃষ্টি কালে কখনও ও কোথাও থাকে না। সেই সময় অনন্ত অন্ধকার বিদ্যমান থাকে। অনন্ত শীতল যুক্ত সেই পদার্থ নিতান্ত শূন্য দ্রব্যমান, শূন্য ঘনত্ব এবং একদম ঊর্জারহিত হয় অর্থাৎ সেই সময় ঊর্জা, প্রকাশ, তাপ, দ্রব্যমান, গতি, বল, আকাশ, ধ্বনি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কম্পনাদি কোনো কিছুই বিদ্যমান থাকে না। এই কথার সংকেত ভগবান্ মনুও দিয়েছেন -
আসীদিদম্ তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ম্ প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।। (মনুস্মৃতি ১.৫)
.
বেদ বলেছে -
গীর্ণম্ ভুবনম্ তমসাপগূळম্ (ঋগ্বেদ ১০.৮৮.২)
তম আসীত্তমসাগূळহমগ্রেऽপ্রকেতম্ সলিলম্ (ঋগ্বেদ ১০.১২৯.৩)
এইসব প্রমাণ দ্বারাও সেই মূল পদার্থের এমন স্বরূপ সিদ্ধ হয়, যাকে কোনো প্রকারে ভালো ভাবে জানা ও ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তারমধ্যে কোনো লক্ষণ বিদ্যমান থাকে না আর না তার স্বরূপের উপর বিশেষ তর্ক-বিতর্ক হওয়া সম্ভব। সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড যেন সেই অব্যক্ত প্রকৃতির মধ্যে লীন হয়ে গভীর অনুপমেয় অন্ধকারে ডুবে ছিল। পদার্থ বিদ্যমান অবশ্যই থাকে, কিন্তু তার বিদ্যমানতার কোনো লক্ষণ, ক্রিয়া, বল আদির একটুও বিদ্যমানতা থাকে না। এরদ্বারা নিষ্কর্ষ বের হয় যে প্রলয়াবস্থাতে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা জানা ও মানা হয় এমন দ্রব্যমান, ঊর্জা, বল, আকাশ তত্ত্ব আদির সর্বথা অভাব থাকে। এখন আপনারা ভাবুন যে তখন পদার্থের কিরকম রূপ বিদ্যমান থাকে? বস্তুতঃ সেই সময় বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিভাষিত বিভিন্ন মূলকণা, তরঙ্গাণু, ভ্যাকিউম এনার্জি, ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার আদি কোনো কিছুই বিদ্যমান থাকে না, তখন সেগুলোর মধ্যে কোনো প্রকারের মূল বলও বিদ্যমান থাকে না। এই কারণে সেই পদার্থ পূর্ণ নিস্ক্রিয় থাকে। সেই পদার্থ না কণা রূপে হয় আর না তরঙ্গ রূপে হয়।
.
আকাশ নামক পদার্থ, যাকে স্পেস বলা হয়, যেটা গুরুত্ব বা অন্য বলের দ্বারা বক্র (কর্ব) হয়, সেটাও সেই সময় থাকে না, বরং সেই সময় বিদ্যমান পদার্থ এইসব থেকে অনেক সূক্ষ্ম হয়, তার থেকে সূক্ষ্ম অবস্থা কখনও হওয়া সম্ভব নয়। এমন অবস্থাযুক্ত পদার্থের মুখ্য নাম হল প্রকৃতি। একে ত্রিগুণও বলা হয়। বেদের মধ্যেও একে "ত্রিতস্য ধারয়া" (ঋগ্বেদ ৯.১০২.৩), "ত্রিধাতু" (ঋগ্বেদ ১.১৫৪.৪) বলে ত্রিগুণাকেই সিদ্ধ করেছে। এই তিন গুণ কি অবস্থায় থাকে, এই বিষয়ে মহর্ষি কপিল বলেছেন - "সত্ত্বরজস্তমসাম্ সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ" [সাংখ্য দর্শন ১.২৬ (৬১)] অর্থাৎ সত্ত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিনের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়। আমরা সর্বপ্রথম "সাম্য" শব্দের উপর বিচার করবো। সাম্যম্ = সম+ষ্যঞ্ (আপ্টেকোশ) (সম = সম্ অবৈক্লব্যে+অচ্ - আপ্টেকোশ)। এরদ্বারা স্পষ্ট হয় যে গুণের অবিক্ষুব্ধ বা নিষ্ক্রিয় অবস্থাকেই সাম্যাবস্থা বলা হয়। এখন এই তিন গুণের উপর বিচার করবো -
.
এই বিষয়ে আমি সর্বপ্রথমে ভগবান্ ব্রহ্মার মতকে উদ্ধৃত করবো -
তমো রজস্তথা সত্ত্বম্ গুণানেতান্ প্রচক্ষতে।
অন্যোऽন্যমিথুনাঃ সর্বে তথান্যোন্যানুজীবিনঃ।।৪।।
অন্যোন্যাপাশ্রয়াশ্চাপি তথান্যোন্যানুবর্তিনঃ।
অন্যোন্যব্যতিষক্তাশ্চ ত্রিগুণাঃ পঞ্চ ধাতবঃ।।৫।।
তমসো মিথুনম্ সত্ত্বম্ সত্ত্বস্য মিথুনম্ রজঃ।
রজসশ্চাপি সত্ত্বম্ স্যাৎ সত্ত্বস্য মিথুনম্ তমঃ।।৬।।
নিয়ম্যতে তমো য়ত্র রজস্তত্র প্রবর্ততে।
নিয়ম্যতে রজো য়ত্র সত্ত্বম্ তত্র প্রবর্ততে।।৭।।
নৈশাত্মকম্ তমো বিদ্যাৎ ত্রিগুণম্ মোহসম্জ্ঞিতম্।
অধর্মলক্ষণম্ চৈব নিয়তম্ পাপকর্মসু।
তামসম্ রূপমেতৎ তু দৃশ্যতে চাপি সঙ্গতম্।।৮।।
প্রকৃত্যাত্মকমেবাহু রজঃ পর্য়ায়কারকম্।
প্রবৃত্তম্ সর্বভূতেষু দৃশ্যমুৎপত্তিলক্ষণম্।।৯।।
প্রকাশম্ সর্বভূতেষু লাঘবম্ শ্রদ্দধানতা।
সাত্ত্বিকম্ রূপমেবম্ তু লাঘবম্ সাধুসম্মিতম্।।১০।।
(মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, অনুগীতা পর্ব, অধ্যায় ৩৬)
.
এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে তিন গুণ পরস্পর একে-অপরের সাথে জোড়া উৎপন্নকারী, একে-অপরের আশ্রিত, একে-অপরের সহায়তায় থাকে, একে-অপরের অনুসরণ করে তথা পরস্পর মিশ্রিত থাকে।।৪-৫।।
.
তমোগুণের মিথুন সত্ত্বের সঙ্গে, সত্ত্বের রজসের সঙ্গে, রজসের সত্ত্বের সঙ্গে, সত্ত্বের তমসের সঙ্গে মিথুন থাকে।।৬।।
.
তমোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করলে রজোগুণের বৃদ্ধি হয় তথা রজোগুণকে নিয়ন্ত্রণ করলে সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি হয়।।৭।।
.
এখানে তিন গুণের পারস্পরিক সম্বন্ধ বলা হয়েছে, তারপর পরের শ্লোকে বলা হয়েছে যে তমস্ অন্ধকারযুক্ত এবং অধর্মযুক্ত হয়, আর অন্য দুই গুণের কিছু অংশের সঙ্গে সর্বদা যুক্ত থাকে। একেই "মোহ" বলা হয় অর্থাৎ এটা জড়তা রূপ হয়। রজোগুণ প্রকৃতি অর্থাৎ বিশেষ ক্রিয়াশীল যুক্ত হয় তথা সম্পূর্ণ দৃশ্য জগৎ তার কারণেই উৎপন্ন হয়। সত্ত্বের কারণে প্রকাশ, লঘুতা এবং ধারণ গুণ যুক্ত হয়।
.
পাতঞ্জল য়োগদর্শনের সূত্র -
প্রকাশক্রিয়াস্থিতিশীলম্ ভূতেন্দ্রিয়াত্মকম্ ভোগাপবর্গার্থম্ দৃশ্যম্। (২.১৮)
.
এই সূত্রের ব্যাখ্যাতে মহর্ষি ব্যাস লিখেছেন -
প্রকাশশীলম্ সত্ত্বম্। ক্রিয়াশীলম্ রজঃ। স্থিতিশীলম্ তম ইতি। এতে গুণাঃ পরস্পরোপরক্তপ্রবিভাগাঃ পরিণামিন সম্য়োগবিয়োগধর্মাণ ইতরেতরোপাশ্রয়েণোপার্জিতমূর্তয়ঃ পরস্পরাঙ্গাঙ্গিত্বেऽপ্যসম্ভিন্নশক্তিপ্রবিভাগাস্তুল্যজাতীয়া স্তুল্যজাতীয়শক্তিভেদানুপাতিনঃ...।।
.
অন্যদিকে মহর্ষি কপিল সাংখ্যদর্শনে বলেছেন -
প্রীত্যপ্রীতিবিষাদাদ্দৈর্গুণানামন্যোऽন্যম্ বৈধর্ম্যম্।। [১.৯২ (১২৭)]
.
এইসব আর্ষ বচনকে দৃষ্টিগত রেখে আমরা এই তিন গুণের উপর বিস্তার ভাবে চর্চা করবো -
.
সত্ত্ব হল সেই গুণ, যার কারণে প্রকাশ এবং প্রীতি অর্থাৎ আকর্ষণ ও ধারণ বল আদির উৎপত্তি হয়। কোনো পদার্থের লঘুতা এই সত্ত্ব গুণের কারণেই হয়। এই কারণে এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানে-যেখানে প্রকাশ, লঘুত্ব এবং আকর্ষণ-ধারণ আদি বল বিদ্যমান আছে, সেখানে প্রকৃতির সত্ত্ব গুণের মহিমা জানা উচিত।
.
রজোগুণের কারণে অপ্রীতি অর্থাৎ প্রতিকর্ষণ- প্রক্ষেপক বল এবং গতিশীলতার উৎপত্তি হয় অর্থাৎ এইসব গুণের মূল কারণ রজোগুণ হয়।
.
তমোগুণের কারণে অন্ধকার, জড়তা, মাধ্যাকর্ষণ, নিষ্ক্রিয়তা, দ্রব্যমান আদি গুণের উৎপত্তি হয়।
.
ধ্যাতব্য হল, এখানে এই গুণের কারণে চেতন প্রাণীর মধ্যে উৎপন্ন হর্ষ, শোক, দ্রোহ আদি গুণের চর্চা আমি করছি না, কারণ এই সম্পূর্ণ গ্রন্থের মধ্যে চেতন জীব জগতের ব্যবহারের চর্চা নেই। সৃষ্টির প্রত্যেক উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে তিনটা গুণ ন্যুনাধিক মাত্রায় অবশ্যই বিদ্যমান থাকে। আমি উপরে ভগবান্ ব্রহ্মার বচন দ্বারা দেখিয়েছি যে এই তিন গুণের সর্বদা সম্মিশ্রণ বিদ্যমান থাকে।

প্রশ্ন - উৎপন্ন সব পদার্থের মধ্যে এই তিন গুণের বিদ্যমানতা কি অনিবার্য, যেমনটা উপরে ভগবান্ ব্রহ্মার বচন উদ্ধৃত করা হয়েছে?
.
উত্তর - কাল তত্ত্বের অতিরিক্ত সব পদার্থের মধ্যে তিন গুণের বিদ্যমানতা অনিবার্য হয়। এখানে এমন প্রশ্নও উপস্থিত হতে পারে যে যখন এই তিনের পরস্পর মিথুনই থাকে, তাহলে কাল তত্ত্বের মধ্যে এমন কেন মানা হয় না? এর উত্তরে ভগবান্ ব্রহ্মার আরও একটা বচন উদ্ধৃত করছি -
য়াবৎসত্ত্বম্ রজস্তাবৎ বর্ততে নাত্র সম্শয়ঃ।
য়াবত্তমশ্চ সত্ত্বম্ চ রজস্তাবদিহোচ্যতে।।৩।।
(মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, অনুগীতা পর্ব, অধ্যায় ৩৯)
.
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত সত্ত্ব গুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্যই রজোগুণ বিদ্যমান থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তমোগুণ বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্যই সতোগুণ ও রজোগুণ দুটোই বিদ্যমান থাকে। এখানে স্পষ্ট সংকেত পাওয়া যাচ্ছে যে সত্ত্ব ও রজস্ তো তমোগুণকে ছাড়াই বিদ্যমান থাকতে পারে অর্থাৎ সতোগুণ তো তমোগুণকে ছাড়া বিদ্যমান থাকতে পারে, কিন্তু তমোগুণের বিদ্যমানতার জন্য সতোগুণ ও রজোগুণ দুটোর বিদ্যমান থাকা অনিবার্য আছে। আমার মতে কেবল কাল তত্ত্বের মধ্যেই দুটো গুণ সত্ত্ব ও রজস্ বিদ্যমান থাকে। এর চর্চা পরবর্তীতে করা হবে।
.
এখানে আমরা অন্য প্রকারে এই তিন গুণের উপর চর্চা করবো -
এই সৃষ্টিতে যেসব বস্তুর মধ্যে প্রকাশ ও বল আদি গুণের বিদ্যমানতা আছে, সেগুলোতে ক্রিয়া বা গতিশীলতা এবং সামান্য মাত্রায় জড়ত্ব বা দ্রব্যমান আদি গুণ বিদ্যমান থাকে। বর্তমান বিজ্ঞান বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গাণুর মধ্যে দ্রব্যমান (রেস্ট মাস) মানে না। আশ্চর্যের বিষয় হল, যে পদার্থ কখনও বিরাম বা স্থির (রেস্ট) অবস্থায় থাকেই না, তার রেস্ট মাস কিভাবে শূন্য সিদ্ধ করে দিয়েছে? তাহলে এর থেকে অর্থাপত্তি করে এটাও তো সিদ্ধ হতে পারে যে সর্বদা গতিশীল থাকা কোয়ান্টার মধ্যে দ্রব্যমান অবশ্যই আছে। এইভাবে কোয়ান্টার মধ্যে তিন গুণের বিদ্যমানতা অনিবার্যতঃ সিদ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে কোনো মূল কণার উপর বিচার করুন, তো তারমধ্যে দ্রব্যমানের সঙ্গে-সঙ্গে গতি এবং সামান্য মাত্রায় দীপ্তিও বিদ্যমান থাকে। এই কারণে সেগুলোও ত্রিগুণযুক্ত সিদ্ধ হয়।
.
এখন বর্তমান বিজ্ঞানের স্পেসের উপর বিচার করুন। বিজ্ঞান স্পেসে কোনো দ্রব্যমান বা বিদ্যুৎ আবেশ দ্বারা সংকুচন হওয়াকে মানে, এই কারণে স্পেসের মধ্যেও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রায় হলেও বল, ক্রিয়া ও জড়ত্বের উপস্থিতি সিদ্ধ হয়। যদি স্পেসের মধ্যে বল, ক্রিয়া ও জড়ত্বের সর্বথা অভাব হতো, তাহলে স্পেস এই গুণযুক্ত পদার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতো না। বাস্তবে স্পেসের মধ্যে প্রত্যক্ষ জড়ত্ব তো নেই, কিন্তু তার কারণরূপ তমোগুণ বিদ্যমান থাকে, যার কারণে সেটা দ্রব্যমান দ্বারা প্রভাবিত হয়। অন্য দুই গুণেরও বিদ্যমানতা তারমধ্যে অবশ্যই থাকে।
.
এখন এই গুণের উপর নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া, যেটা ভগবান্ ব্রহ্মার দ্বারা বলা হয়েছে, সেটাকে বর্তমান স্থূল বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখুন। তমোগুণের উপর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা রজোগুণের মধ্যে বৃদ্ধি বলা হয়েছে। এইদিকে সংসারের মধ্যে দেখুন, তো দেখবেন কোনো বস্তুর জড়ত্বকে নিয়ন্ত্রিত করলে পরে তার ক্রিয়াশীলতার মধ্যে বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যায় অর্থাৎ যখন কোনো ব্যক্তি জড় বস্তুকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয় অথবা সেই বস্তুর উপর রজোগুণ ও সতোগুণ প্রধান পদার্থের নিয়ন্ত্রণ হয়, তখন তারমধ্যে ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন হয়ে যায়। কোনো কণার গতিকে অবরুদ্ধ করে তারদ্বারা প্রকাশ আদি ঊর্জার বৃদ্ধি হওয়া এটাও সর্ববিদিত। উদাহরণস্বরূপ, উল্কা পিণ্ড বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে চকমক করে তথা কোনো ইলেকট্রন প্রবাহের মধ্যে প্রতিরোধ উৎপন্ন করলে প্রকাশ ও উষ্মা উৎপন্ন হয়। এই কথারই সংকেত করে ভগবান্ ব্রহ্মা বলেছেন যে রজোগুণের নিয়ন্ত্রণ করলে সতোগুণের মধ্যে বৃদ্ধি হয়।
.
এই ভাবে এই তিন গুণের পারস্পরিক সম্বন্ধ স্পষ্ট হয়ে যায়।
.

প্রশ্ন - সত্ত্ব, রজস্ ও তমস্ এগুলোকে কিছু বিদ্বান গুণ না মেনে গুণী অর্থাৎ দ্রব্য মানেন, যার সমান পরিমাণকে প্রকৃতি বলা হয়।
উত্তর - এটা শিশুদের মতো কথা। সত্ত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিন পদার্থকে সব শাস্ত্রের মধ্যে গুণ বলা হয়েছে। কোথাও কোনো স্থানে এগুলোকে কণা বলা হয়নি। এগুলোকে দ্রব্য বলা হয়নি, তাসত্ত্বেও এগুলোকে কণা বলে জিদ করা এটা কেবল দুরাগ্রহ নয়তো কি? এই বিষয়ে ভগবান্ শিবের কথন হল -
সত্ত্বম্ রজস্তমশ্চেতি প্রকৃতিগুণ সম্ভবাঃ।
তৈঃ সৃজত্যখিলম্ লোকম্ প্রকৃতিরাত্মজৈর্গুণৈঃ।।
(মহাভারত অনু. পর্ব অধ্যায় ১৪৫ পৃষ্ঠা ৬০১৪)
.
একেই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এইভাবে বলেছেন -
সত্ত্বম্ রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্।।
(শ্রীমদ্ভগবৎগীতা ১৪.৫)
এখানে ভগবান্ শিব এই গুণগুলোকে প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন বলেছেন। দুটো প্রমাণের মধ্যে "সম্ভবাঃ" পদের ব্যবহার হয়েছে। এরদ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই গুণ প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন হয় বা প্রকট হয়। এরপূর্বেও আমি মহাভারত আর য়োগদর্শনের মহর্ষি ব্যাস ভাষ্য থেকে এর গুণ হওয়াকে প্রমাণিত করেছি।
.
ঋগ্বেদ ৯.১০২.৩ মন্ত্রে প্রকৃতিকে "ত্রিতস্য ধারা" বলা হয়েছে অর্থাৎ ত্রিতকে ধারণকারী। ঋগ্বেদ ১.১৫৪.৪ মন্ত্রে বিশ্বকে "ত্রিধাতু" বলা হয়েছে, এর ভাষ্য করে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "ত্রয়ঃ সত্ত্বরজস্তম - আদি ধাতবো য়েষু তানি"। এইভাবে সত্ত্ব, রজস্ এবং তমস্ হল তিনটা পদার্থের নাম, যা সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করে আর ধারণ করে।
.
সত্যার্থ প্রকাশের অষ্টম সমুল্লাসে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "(সত্ত্ব) শুদ্ধ (রজঃ) মধ্য (তমঃ) জাড্য অর্থাৎ জড়তা তিন বস্তু মিলিত হয়ে যে একটা সংঘাত হয়, তার নাম হল প্রকৃতি।" এখানে "বস্তু" আর "ধাতু" নামক পদ দেখে এমন ভ্রম হয় যে সত্ত্ব, রজস্ আর তমস্ এই তিনটা হল দ্রব্য, গুণ নয়। আমি এগুলোকে পদার্থ বলেছি, এতেও কেউ এগুলোকে দ্রব্য অর্থাৎ কণা বলতে পারে, কিন্তু এর জন্য আমাদের মহর্ষি কণাদ কৃত বৈশেষিক দর্শনের ১.১.৪ সূত্রকে পড়া উচিৎ, যেখানে না কেবল দ্রব্যকে, অপিতু গুণ এবং কর্মকেও পদার্থ বলা হয়েছে। বস্তু আর ধাতুরও এই অর্থ জেনে রাখা উচিত। গুণ কোনো দ্রব্য দ্বারা ধারণ করা হয় আর এই গুণ কিছু অন্য গুণকেও ধারণ করে। এই কারণে এগুলোকে ধাতু বলে। বল সব পদার্থকে ধারণ করে আছে, এর মানে এই নয় যে বল কোনো দ্রব্য, বল হল দ্রব্যের একটা গুণ। সেই গুণ যদি না থাকে, তাহলে কোনো দ্রব্য অন্য কোনো দ্রব্যকে ধারণ করতে পারবে না।
.
"বলম্" পদের ব্যাখ্যাতে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন - "বলম্ কস্মাৎ। বলম্ ভরম্ ভবতি বিভর্তেঃ" (নিরুক্ত ৩.৯)। এখানে বলকে ধারক আর পোষক বলা হয়েছে। এখানে ধারণ করা আর পোষণ করাও কোনো পদার্থের গুণ হয় আর মহর্ষি য়াস্ক এটাকে বলের গুণ বলছেন, তাহলে কি এখানে বলকে দ্রব্য মানা যাবে? এমন তো কোনো মূঢ় ব্যক্তিও স্বীকার করবে না। এই জন্য "ধাতু" আর "বস্তু" পদের দ্বারা সত্ত্ব আদির দ্রব্য হওয়ার ভ্রম হওয়া উচিত নয়। এগুলোকে সূক্ষ্ম পরমাণু বলা মোটেও সিদ্ধ হবে না। সেই সূক্ষ্ম পরমাণু পদার্থ, যারমধ্যে সংযোগ আর বিয়োগের প্রক্রিয়া সর্বপ্রথম প্রারম্ভ হয়, তার সংকেত করে ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশের অষ্টম সমুল্লাসে কোনো আর্ষ বচনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন -
"নিত্যায়াঃ সত্ত্বরজস্তমসাম্ সাম্যাবস্থায়াঃ প্রকৃতেরূৎপন্নানাম্ পরমসূক্ষ্মাণাম্ পৃথক্ পৃথগ্বর্ত্তমানানাম্ তত্ত্বপরমাণূনাম্ প্রথমঃ সম্য়োগারম্ভঃ সম্য়োগবিশেষাদবস্থান্তরস্য স্থূলাকার প্রাপ্তিঃ সৃষ্টিরুচ্যতে।
.
অনাদি নিত্যস্বরূপ সত্ত্ব, রজস্, তমো গুণের সাম্যাবস্থারূপ প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন যে পরম সূক্ষ্ম পৃথক-পৃথক তত্ত্বাবয়ব বিদ্যমান আছে, সেগুলোর প্রথম যে সংযোগারম্ভ হয়, সেই সংযোগ বিশেষ থেকে অবস্থান্তর অন্যান্য অবস্থায় সূক্ষ্ম থেকে স্থূল - স্থূলাকার হতে-হতে বিচিত্ররূপ নির্মিত হয়েছে।"
.
এখানে স্পষ্ট ভাবে ঋষি দয়ানন্দ সত্ত্বাদিকে গুণ বলেছেন আর এই গুণ যুক্ত দ্রব্যকে প্রকৃতি বলেছেন, যেখান থেকে সূক্ষ্ম অবয়বরূপ পরমাণু উৎপন্ন হয়। এই উৎপন্ন পরমাণু থেকে সংযোগ ক্রিয়া প্রারম্ভ হয়। শুদ্ধ, মধ্য এবং জাড্যের মতো পদ কোনো দ্রব্যকে বলা হয়নি, বরং গুণকেই বলা হয়েছে। মহর্ষি কপিল তাঁর সাংখ্যদর্শনে সত্ত্বাদি পদার্থের ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি স্বয়ং এগুলোকে গুণ বলেছেন -
প্রীত্যপ্রীতিবিষাদাদ্যৈর্গুণানামন্যোऽন্যম্ বৈধর্ম্যম্ (১.৯২)
.
এখানে তিন গুণের মধ্যে পরস্পর ভেদ বলেছেন, সেই ভেদকে বৈধর্ম্য বলেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই ধর্ম পদ গুণের সমার্থক শব্দ নয়, বরং সেটা হল এই গুণের একটা লক্ষণ। কিছু মহানুভাব সাংখ্যদর্শনে ব্যবহৃত গুণ এবং ধর্ম উভয় পদের প্রসঙ্গানুসারে বিবেচনা না করে হঠপূর্বক সত্ত্ব আদিকে কণা সিদ্ধ করার জন্য সাংখ্যদর্শনেরই একটা সূত্রকে প্রস্তুত করেন, সেটা হল - "সত্ত্বাদীনামতদ্ধর্মত্বম্ তদ্রূপত্বাৎ" (৬.৩৯)। এই সূত্র প্রস্তুত করে তারা বলতে চান যে সত্ত্বাদি প্রকৃতির ধর্ম নয়, বরং তার রূপই হয়। এর অর্থ হল এই তিনটা দ্রব্যই হবে, গুণ হবে না। এই মহানুভাব এখানে ধর্মের অর্থ গুণ গ্রহণ করছেন, অথচ পূর্ব সূত্রের মধ্যে এগুলোকে স্বয়ং প্রকৃতির গুণই বলেছেন। এখানে ধর্মের অর্থ লক্ষণ হবে, গুণ নয়। এর অর্থ হল প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে এই লক্ষণ বিদ্যমান হয় না, কারণ সেই সময় এই তিনটা গুণই অবিদ্যমানবৎ থাকে। যেরূপ প্রকৃতিকে অব্যক্ত বলা হয়, সেইরূপ তার এই তিন গুণও অব্যক্ত হয়। এই কারণে এগুলোকে তদ্রূপ অর্থের প্রকৃতি রূপী বলা হয়েছে। যদি এই তিনটা প্রকৃতির ধর্ম (লক্ষণ) হতো, তাহলে প্রকৃতির মধ্যে প্রীতি, অপ্রীতি আদি ধর্মও বিদ্যমান হতো। যদি এমন হতো, তাহলে প্রকৃতি প্রকৃতি থাকতো না, বরং সেটা মহত্তত্ত্বের রূপ ধারণ করে নিতো।
.
"সত্ত্বরজস্তমসাম্ সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ" (সাংখ্যদর্শন ১.২৬)।
এখানে এগুলোর সাম্যাবস্থার অর্থ এটাই যে এই গুণের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়াবস্থা হয়ে গেছে। "সাম্যম্" পদ সম+ষ্যঞ্ থেকে ব্যুৎপন্ন হয় আর "সম" পদ সম্ অবৈক্লব্যে+অচ্ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়। এর অর্থ হল যখন এই গুণের পূর্ণ শান্ত অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়াবস্থা হয়, সেই অবস্থাকে সাম্যাবস্থা বলা হয় অর্থাৎ এগুলোও পূর্ণ অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে যে "তিনটা বস্তুর সংঘাত", এমন শব্দের ব্যবহার করেছেন, সেখানেও সংঘাত হল সেই অবস্থা যেখানে এই তিনটা গুণেরই সম্যক্ রূপে হনন হয় অর্থাৎ সেই তিনটা গুণ মৃতপ্রায় অর্থাৎ পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। এখানে "সংঘাত" পদের অর্থ সংযোগ মানা উচিত নয়, কারণ এমন মেনে নিলে প্রকৃতি কখনও অনাদি হতে পারবে না। এই কথনের বৈজ্ঞানিকতা আপনি বুঝবেন না, এইজন্য আমি ঋষি দয়ানন্দের শব্দকেই এখানে উদ্ধৃত করছি, যেটা তিনি দ্বাদশ সমুল্লাসে লিখেছেন - "সংযোগ দ্বারা যেটা উৎপন্ন হয়, সেটা কখনও অনাদি আর অনন্ত হবে না"। এই কারণে সংঘাতের অর্থ সেটাই হবে যেটা আমি করেছি। এখানে আমার মনে হয়, বুদ্ধিমানদের জন্য এইটুকু উত্তরই যথেষ্ট।
.
এই পর্যন্ত প্রকরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে সৃষ্টি উৎপত্তি প্রক্রিয়ার প্রারম্ভে প্রকৃতি রূপী মূল উপাদান পদার্থের মধ্যে প্রকাশ, ক্রিয়াদি সব গুণের মধ্যে কোনো গুণই বিদ্যমান থাকে না কিংবা সেগুলোর বীজরূপও বিদ্যমান থাকে না। সেই কারণে সেই সময় বিদ্যমান মূল পদার্থকে না দ্রব্য, না ঊর্জা আর না স্পেস বলা যেতে পারে। ভ্যাকিউম এনার্জি, ডার্ক এনার্জি বা ডার্ক মেটার আদিও সেই সময় বিদ্যমান থাকে না। এই ভাবে সেই পদার্থ নিম্নলিখিত স্বরূপ যুক্ত হয় -
১. পদার্থের আয়তন অনন্ত হয়।
২. পদার্থের দ্রব্যমান শূন্য হয়।
৩. শীতলতা অনন্ত পরিমাণে হয়।
৪. ঘনত্ব শূন্য হয়।
৫. কোনো ধরণের বল অথবা ক্রিয়া পূর্ণতঃ অবিদ্যমান থাকে। এর ফলে সেই পদার্থ পূর্ণতঃ শান্ত এবং অনন্ত আয়তনে পূর্ণতঃ একরস হয়ে ভরে থাকে।
৬. সেটা না কণা রূপ, না তরঙ্গ রূপ, না স্পেস রূপ আর না স্ট্রিং রূপ হয়।
.
এইভাবে সেটা সর্বথা অনির্বচনীয়, অলক্ষণ, অজ্ঞেয় ও অপ্রতর্ক্য অবস্থার হয়। বৈদিক বিজ্ঞানের মূল পদার্থ বর্তমান বিগ বেং সিদ্ধান্তের প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে প্রায় বিপরীত হয়। সমতা এটা অবশ্যই আছে যে বর্তমান বিজ্ঞানও শূন্য সময় থেকে ১০^-৪৩ সেকেণ্ড পর্যন্ত (সময়ান্তরালে) পদার্থের অবস্থাকে অনির্বচনীয় ও অজ্ঞেয় মানে। তার দৃষ্টিতে জ্ঞেয় অবস্থার প্রাদুর্ভাব প্লাঙ্ক সময়েই হয়, তাহলেও অজ্ঞেয় অবস্থার মধ্যে কল্পিত শূন্য বা অনন্ত আয়তন, অনন্ত তাপ, অনন্ত ঊর্জা, অনন্ত দ্রব্যমান ও অনন্ত ঘনত্বের ধারণা বৈদিক বিজ্ঞানের ধারণার সঙ্গে-সঙ্গে সামান্য যুক্তিরও সর্বথা বিপরীত আছে।
🌿 কাল তত্ত্ব 🌿
কাম - পূর্বোক্ত অবস্থা মহাপ্রলয়ের হয়। যখন সৃষ্টির সময় আসে, সেই সময় সর্বপ্রথম যে ক্রিয়া উৎপন্ন হয়, তার বিষয়ে বেদ বলেছে - "কামস্তদগ্রে সমবর্ত্তত..." (অথর্ববেদ ১৯.৫২.১) অর্থাৎ সর্বপ্রথম ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্যে সৃষ্টি উৎপন্ন করার কামনা উৎপন্ন হয়। এই কথা আমি পূর্বেই জানিয়েছি যে জড় পদার্থের মধ্যে কোনোরূপ কোনো প্রবৃত্তি স্বতঃ হয় না। এই কারণে প্রকৃতিরূপ মহাপ্রলয়াবস্থায় সৃষ্টি উৎপত্তির স্বতঃ প্রবৃত্তি হয় না আর হওয়া সম্ভবও না। এই প্রবৃত্তিকে প্রারম্ভ করার জন্য ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্যে ইচ্ছা উৎপন্ন হয়। এটা হল সর্বপ্রথম চরণ। অথর্ববেদের মধ্যে ১৯.৫২ সূক্তকে কামসূক্ত বলে তথা এর পরের সূক্তকে কালসূক্ত বলে।
.
🌿 কালের স্বরূপ -
ঈশ্বর সর্বপ্রথম কাল তত্ত্বকে প্রেরিত করেন। এখানে একটা বড় বিকট প্রশ্ন আছে যে কাল কি কোনো পদার্থকে বলে? কোনো বিদ্বান কালের বিষয়ে কিছু স্পষ্ট লিখেছে, এখন পর্যন্ত এমন আমি কোথাও দেখিনি। এ পর্যন্ত আমি অনেক মহান বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে সঙ্গতি করেছি, কিন্তু কাল কি, এটা কেউই স্পষ্ট করেনি। আমি কালের বিষয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক পুস্তক কৌতূহলপূর্বক পড়েছি এটা দেখার জন্য যে বর্তমান ভৌতিক বৈজ্ঞানিক কালের স্বরূপ সম্বন্ধে কি বলে? দুঃখের বিষয় যে এইসব থেকে নিরাশ হই। হিস্ট্রি অফ টাইমের চর্চা করে বিগ বেঙের ইতিহাস শোনাতে শুরু করে দেয়। কালের উপর বড়-বড় পুস্তক লেখা হয়েছে, কিন্তু কোথাও এটা বলা হয়নি যে কাল আসলে কি? কিছু পৌরাণিক ব্যক্তি (বিশেষ করে মাতা গণ) সত্যনারায়ণের কথা করে। সম্পূর্ণ কথাতে সত্যনারায়ণ কথার মহিমা বলা হয়, কিন্তু সেই কথার মধ্যে এটা কোথাও বলা হয় না যে সেই কথাটা কি? এমনই কথা বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের কালের বিষয়ে আছে আর কিছু অংশ পর্যন্ত আকাশ তত্ত্বের বিষয়েও এই একই স্থিতি আছে। তারা কালকে (টাইম) আকাশের (স্পেস) সঙ্গে জুড়ে দেখে। তারা স্পেসের তিনটা আয়ামের (ডাইমেনশন ) সাথে টাইমের একটা চতুর্থ ডাইমেনশন মানে। বর্তমান বিজ্ঞান না তো স্পেসের সম্বন্ধে কিছু স্পষ্ট করে আর না টাইমের বিষয়ে। এই দুটো শব্দ কি কেবল ব্যবহার করার জন্যই আছে অথবা এই দুটো কোনো পদার্থের নাম, যার ভূমিকা আছে এই সর্গ রচনাতে। মহর্ষি কণাদ বৈশেষিক দর্শনে (১.১.৪) ছয় প্রকারের পদার্থের সত্তা বলেছেন -
ধর্মবিশেষপ্রসূতাদ্ দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়ানাম্ পদার্থানাম্ সাধর্ম্যবৈধর্ম্যাভ্যাম্ তত্ত্বজ্ঞানান্নিঃ শ্রেয়সম্।
.
এখানে আমি এই সম্পূর্ণ সূত্রের উপর বিচার করবো না। আমি কেবল এটাই বলবো যে মহর্ষি কণাদ না কেবল দ্রব্যকে পদার্থ বলেছেন, অপিতু সেগুলোর গুণ, কর্ম আদিকেও পৃথক্ পদার্থের রূপে বলেছেন। তারপর দ্রব্যের বিষয়ে বলেছেন -
.
পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশম্ কালো দিগাত্মা মন ইতি দ্রব্যাণি (বৈশেষিক দর্শন ১.১.৫)
.
এখানে নয়টি দ্রব্যের মধ্যে কাল ও আকাশকেও দ্রব্যের রূপে মেনেছেন। এরপর তিনি দ্রব্যের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন -
.
ক্রিয়াগুণবৎ সমবায়িকারণমিতি দ্রব্যলক্ষণম্ (বৈশেষিক দর্শন ১.১.১৫)
.
অর্থাৎ যে পদার্থ ক্রিয়া ও গুণের আশ্রয় হয় অর্থাৎ যার মধ্যে ক্রিয়া ও গুণ বিদ্যমান হয় বা হতে পারে তথা কোনো কার্যরূপ পদার্থের সমবায় কারণ হয়, তাকে দ্রব্য বলে। এখানে সমবায় কারণে অর্থ হল যে এই দ্রব্য তার থেকে উৎপন্ন কার্যরূপ পদার্থের মধ্যে সর্বদা মিশ্রিত থাকে। এখানে সব দ্রব্যের উপর বিচার না করে প্রসঙ্গানুসারে কেবল "কাল" নামক দ্রব্যের উপর বিচার করবো। মহর্ষি কণাদ কাল, আকাশ ও দিশার বিষয়ে অন্য দ্রব্যের থেকে ভেদ করে লিখেছেন -
.
দিক্কালাবাকাশম্ চ ক্রিয়াবদ্বৈধর্ম্যান্নিষ্ক্রিয়াণি (বৈশেষিক দর্শন ৫.২.২১)
অর্থাৎ কাল, আকাশ ও দিশা হল নিষ্ক্রিয় দ্রব্য। কালের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন -
অপরস্মিন্নপরম্ য়ুগপচ্চিরম্ ক্ষিপ্রমিতি কাললিঙ্গানি (বৈশেষিক দর্শন ২.২.৬)
.
অর্থাৎ ছোট, বড়, সাথে-সাথে, শীঘ্র ও দেরিতে আদি ব্যবহার হল কালের লক্ষণ।
.
এখানে প্রশ্ন হল কাল কি সর্বথা নিষ্ক্রিয় এবং কেবল ব্যবহারে কাজে লাগা কাল্পনিক দ্রব্য? সবার আগে মহর্ষি কণাদ দ্রব্যকে ক্রিয়া ও গুণকারী বলেছেন, পুনরায় এগুলোর মধ্যে তিনটা দ্রব্য কাল, আকাশ ও দিশাকে নিষ্ক্রিয় বলেছেন, এর রহস্য কি? এই বিষয়টা গভীর অনুসন্ধানের। এই বিষয়ে বিচার করার হেতু পরম প্রমাণ বেদের কিছু বচনকে আমি এখানে উদ্ধৃত করবো -
.
কালো অশ্বো বহতি সপ্তরশ্মিঃ সহস্রাক্ষো অজরো ভূরিরেতাঃ।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.১)
সপ্ত চক্রান্ বহতি কাল এষ সপ্তাস্য নাভীরমৃতম্ ন্বক্ষঃ।
স ইমা বিশ্বা ভুবনান্যঞ্জৎ কালঃ স ঈয়তে প্রথমো নু দেবঃ।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.২)
স এব সম্ ভুবনান্যাভরৎ স এব সম্ ভুবনানি পর্য়ৈৎ।
পিতা সন্নভবৎ পুত্র এষাম্ তস্মাদ্বৈ নান্যত্ পরমস্তি তেজঃ।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.৪)
কালঃ প্রজা অসৃজত। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.১০)
কালো য়জ্ঞম্ সমৈরয়দ্দেবেভ্যো ভাগমক্ষিতম্। (অথর্ববেদ ১৯.৫৪.৪)
বেদের এই বচনগুলোতে কালকে কর্ত্তা তথা "বহতি", "অঞ্জত্", "ঈয়তে", "আভরত্", "পর্য়ৈত্", "অভবত্", "অসৃজত", "সমৈরয়ত্"কে ক্রিয়াপদ রূপে দর্শানো হয়েছে। এই ক্রিয়াপদ মাত্র ব্যবহারার্থক নয়। কাল সূক্তের মধ্যে এমন অন্য উদাহরণও বিদ্যমান আছে। এমন পরিস্থিতিতে কালকে সর্বথা ক্রিয়ারহিত মানা সম্ভব নয়। তাই এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে কাল কি ধরণের দ্রব্য, যাকে মহর্ষি কণাদের দৃষ্টিতে ক্রিয়াবান্ হওয়ার সাথে-সাথে নিষ্ক্রিয়ও বলা হয়েছে। কোনো আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে যদিও এর স্বরূপের বর্ণনা আমি পাইনি। কালের অবয়বরূপ পল, নিমেষ, মুহূর্ত, দিন-রাত, মাস, ঋতু ও সম্বৎসর আদির সম্বন্ধে পড়তে তো পাওয়া যায়, কিন্তু এইসব পদার্থ কি? এগুলোর স্বরূপ কি? এটা রহস্যই হয়ে আছে।
.
আমি এই রহস্যকে উন্মোচন করার হেতু পর্যাপ্ত চিন্তন করেছি আর নিজের মনন ও ধ্যান দ্বারা ঈশকৃপায় আমি যে বিচার প্রাপ্ত করেছি, তাকে আমি প্রতিভাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক বিচারকদের সম্মুখে রাখছি -
.
"কালঃ" পদকে আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোশের মধ্যে "কল্+ণিচ্+অচ্" দ্বারা ব্যুৎপন্ন মানা হয়েছে অর্থাৎ চুরাদি "কল্" ধাতুর অর্থ "ধারণ করা, প্রেরণা করা, অধিকারে রাখা, যাওয়া, আসক্ত হওয়া" আদি দিয়েছে। মহর্ষি য়াস্ক লিখেছেন - কালঃ কালয়তের্গতিকর্মণঃ (নিরুক্ত ২.২৫)। এরদ্বারা স্পষ্ট হয় যে কাল হল সেই পদার্থ, যারমধ্যে প্রেরণ, ধারণ, গমন, অধিগ্রহণ আদির সামর্থ্য বিদ্যমান আছে।
.
এখন গম্ভীর প্রশ্ন এই হল যে এমন পদার্থ কাল আসলে কি? তার স্বরূপ কি? এই বিষয়ে আমার মত হল মূল প্রকৃতি তত্ত্বের মধ্যে ঈশ্বর তত্ত্ব যখন সূক্ষ্মতম পরা "ওম্" রশ্মিকে উৎপন্ন বা জাগ্রত করে, তখন সেই "ওম্" -এর সবথেকে সূক্ষ্মতম রূপ প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই কালের রূপ ধারণ করে। কাল তত্ত্ব চেতন নয়। চেতন তত্ত্ব হল কেবল ঈশ্বর ও জীবাত্মা। জড় তত্ত্ব একটাই হয়, সেটা পূর্বোক্ত প্রমাণের অনুসারে আমি সিদ্ধ করেছি। অন্যদিকে বৈদিক ত্রৈতবাদ হল সর্ববিখ্যাত। এই কারণে কাল তত্ত্বকে প্রকৃতির থেকে ভিন্ন মানা সম্ভব নয়, কিন্তু এটা যে কেবল প্রকৃতির ভাগ, এটাও পূর্ণ সত্য নয়। ঈশ্বরের মধ্যে সৃষ্টির ইচ্ছা হলে অর্থাৎ কাম বা সংকল্প উৎপন্ন হলে সেই ঈশ্বর মূল প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে "ওম্" রশ্মির সূক্ষ্মতম পরা অবস্থা উৎপন্ন বা জাগ্রত করে অতি সূক্ষ্মতম বলকে উৎপন্ন করে দেন। সেই সময়েও প্রকৃতির সাম্যাবস্থা সর্বথা ভঙ্গ হয় না। এই অবস্থাকেই কাল বলে।
.
"ওম্" রশ্মি সম্পূর্ণ মূল পদার্থের মধ্যে কামকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। এই "ওম্" রশ্মি ঈশ্বর দ্বারা উৎপন্ন হয়, ঈশ্বরতত্ত্বের সঙ্গে এর সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকে, এই কারণে এটা প্রকৃতির মধ্যে কাম বা ইচ্ছাকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। প্রকৃতির "ওম্" রশ্মিময়ী অবস্থাকেই কাল বলে। এই অবস্থা প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন হয়, এই কারণে এটা হল জড় পদার্থ। যেহেতু এটা ঈশ্বর তত্ত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ রাখে, এই কারণে এটা চেতনবত্ ব্যবহার করে। এই কথারই সংকেত বেদ থেকে পাওয়া যায় -
.
স ঈয়তে প্রথমো নু দেবঃ (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.২)
.
অর্থাৎ সেই কাল তত্ত্ব প্রথম দেব অর্থাৎ পরমাত্মার সমান ব্যবহার করে। এখানে "ঈয়তে" ক্রিয়াপদের ব্যবহার আছে, যেটা হল "ঈ গতৌ" ধাতুর রূপ। এই ধাতুর আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোশের মধ্যে অনেক অর্থ দেওয়া হয়েছে - যাওয়া, চকমক করা, ব্যাপ্ত হওয়া, কামনা করা, ফেলে দেওয়া, খাওয়া আদি। এইসব অর্থ কাল ও ঈশ্বরের ব্যবহারকে দর্শায়। এখানে "চকমক করা" প্রকৃতিরও ব্যবহার আছে। কাল তত্ত্ব সতত গতি করতে থাকে, এটা কখনও থামে না। এই কারণে এমন মনে হয় যে এই তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির কেবল সত্ত্ব ও রজস্ গুণ বিদ্যমান আছে। এরমধ্যে তমোগুণের সর্বথা অভাব আছে।
.
বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথাকথিত ব্ল্যাক-হোলের উপর কালের থেমে যাওয়ার যে কল্পনা করছে, সেটা হল কেবল তাদের নিতান্ত ভ্রম। যদি ব্ল্যাক-হোলের উপর প্রকাশের থেমে যাওয়া তাদের কল্পনাকে মেনে নেওয়া হয়, তাহলেও এরদ্বারা কালের থেমে যাওয়া সিদ্ধ হবে না। প্রকাশাদি যেকোনো পদার্থের গতি থেমে যাওয়ার কারণে কালের গতিকেও থেমে যাওয়া কিভাবে মানা যেতে পারে? বস্তুতঃ কারও গতি থেমে যাওয়া কোনো প্রতিরোধী বলের কারণে সম্ভব হয়। যদি কোনো লোকের প্রবল গুরুত্বকর্ষণের প্রভাবে প্রকাশাদির নির্গত হওয়া সর্বথা থেমে যাওয়া মেনে নেওয়া হয়, তাহলেও কাল তার কাজ করতে থাকবে। প্রবল গুরুত্ব বলের রশ্মিগুলো অর্থাৎ গুরুত্ব ক্ষেত্র তো আরও প্রবলতা সহিত কাজ করতে থাকে, এখানেও তো কাল তত্ত্বেরই প্রেরণা আছে। একটা গতি বন্ধ ধরে নিলেও, তো গ্রেবিটনের তীব্রতা তো বেড়েছে। এই কারণে কালের থেমে যাওয়া অথবা সামনে-পিছনে হওয়া মিথ্যা কল্পনাই হবে। বস্তুতঃ কাল তো সর্বব্যাপক, সতত গমনকারী একরস তত্ত্ব, যেটা প্রত্যেক পদার্থকে প্রেরিত করে, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর ব্যতীত কোনো পদার্থের দ্বারা প্রেরিত হয় না। এই কাল পরমাত্মার মধ্যেই সর্বদা আশ্রিত থাকে। বেদ একেই বলেছে -
.
কালম্ তমাহুঃ পরমে ব্যোমন্ (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.৩)
.
এখানে "পরম ব্যোমন্" পরমাত্মাকে বলা হয়েছে, যেমনটা ঋষি দয়ানন্দ "ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্।" (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৩৯) মন্ত্রের ভাষ্যতে বলেছেন। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যে এই ভাবকে প্রকট করে বলা হয়েছে -
.
য়েনাবৃতম্ নিত্যমিদম্ হি সর্বম্ জ্ঞঃ কালকারো গুণী সর্ববিধঃ। (৬.২)
.
এখানে সবার নিত্য আচ্ছাদক এবং ব্যাপক সর্বজ্ঞ পরমেশ্বরকে কালতত্ত্বের প্রকট ও ধারণকারী বলা হয়েছে। যে "ওম্" রশ্মিকে আমি কালতত্ত্বের মুখ্য ভাগ বলেছি, তার বিষয়ে ঋষিগণ বলেছেন -
.
ত ওঙ্কারম্ ব্রাহ্মণঃ পুত্রম্ জ্যেষ্ঠম্ দদৃশুঃ (গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্ব ভাগ ১.২৩), রস ওঙ্কারঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.৭৮), ওমিতি ব্রহ্ম। ওমিতীদঁ সর্বম্। (তৈত্তিরীয় অরণ্যক ৭.৮.১; তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১.৮.১)
.
এইভাবে এখানে "ওম্" -কে ব্রহ্ম অর্থাৎ পরমাত্মার রস বা পুত্র মানা হয়েছে তথা সর্বব্যাপক বলা হয়েছে, সেইরূপ কালকেও পরমাত্মার দ্বারা উৎপন্ন তথা সর্বব্যাপক মানা হয়েছে। এর দ্বারা এই দুইয়ের সম্বন্ধ স্পষ্ট হয়।
এখন পুনরায় আমি কাল তত্ত্বের বিষয়ে বেদ মতকে উদ্ধৃত করবো -
কালে মনঃ কালে প্রাণঃ কালে নাম সমাহিতম্।
কালেন সর্বানন্দন্ত্যাগতেন প্রজা ইমাঃ।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩.৭)
.
এখন "ওম্" -এর বিষয়ে উপনিষদে দেখুন -
বাগেবর্ক প্রাণঃ সামোমিত্যেতদক্ষর মুদ্গীথঃ।
তদ্বা এতন্মিথুনম্ য়দ্ বাক্ চ প্রাণশ্চর্ক চ সাম চ।।৫।।
তদেতন্মিথুনমোমিত্যেতস্মিন্নক্ষরে সꣳসৃজ্যতে য়দা বৈ মিথুনৌ সমাগচ্ছত আপয়তো বৈ তাবন্যোন্যস্য কামম্।।৬।। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ১.১)
.
এই দুটো প্রমাণ থেকে "কাল" ও "ওম্" -এর সম্বন্ধ প্রকট হয়। বেদে লেখা আছে কালের মধ্যে মন, প্রাণ ও নাম অর্থাৎ ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান আছে কিংবা কাল তত্ত্বের মধ্যেই সেগুলো আশ্রিত আর এইসব থেকে নানা প্রজা অর্থাৎ পদার্থের প্রসন্ন, তৃপ্ত বা উৎপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে উপনিষদও ছন্দ আর প্রাণ রশ্মির মিথুনকে উদ্গীথ=ওম্ এরমধ্যেই আশ্রিত এবং সেখান থেকেই নানা মিথুন বানিয়ে পরস্পর তৃপ্ত হতে কিংবা নানা পদার্থকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হওয়ার কথা লেখা আছে।
.
দুটো প্রমাণ থেকেই কাল তত্ত্ব এবং "ওম্" তত্ত্বের সম্বন্ধ প্রকট হয়ে আমার কাল সম্বন্ধীয় ধারণাকে পুষ্ট করছে। এইভাবে কাল তত্ত্ব হল সেই পদার্থ, যার মধ্যে মহত্, অহংকার থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত, আশ্রিত এবং তার দ্বারাই সঞ্চালিত হয়। এরই সংকেত বেদ করেছে -
.
কালো ভূতিমসৃজত কালে তপতি সূর্য়ঃ।
কালে হ বিশ্বা ভূতানি কালে চক্ষুর্বি পশ্যতি।।৬।।
তেনেষিতম্ তেন জাতম্ তদু তস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতম্।
কালো হ ব্রহ্ম ভূত্বা বিভর্তি পরমেষ্ঠিনম্।।৯।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৩)
কালেন বাতঃ পবতে কালেন পৃথিবী মহী।
দ্যৌর্মহী কাল আহিতা।।২।।
কালো হ ভূতম্ ভব্যম্ চ পুত্রো অজনয়ত্ পুরা।
কালাদৃচঃ সমভবন্ য়জুঃ কালাদ জায়ত।।৩।। (অথর্ববেদ ১৯.৫৪)
.
অর্থাৎ কালই সব প্রকার পদার্থের সত্তা, সেগুলোর সমৃদ্ধি আর ঐশ্বর্যের কারণ হয়। যেকোনো পদার্থের উৎপত্তি "ওম্" রশ্মি ছাড়া সম্ভব নয়। উৎপত্তি হয়ে যাওয়ার পশ্চাৎ সেগুলোর স্থিতিও "ওম্" রশ্মিকে ছাড়া সম্ভব নয়। এইসব বস্তুর নানা প্রকারের ক্রিয়া ও বলে বৃদ্ধি আর পরস্পর একে-অপরের প্রতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাতে বৃদ্ধিও এই কাল রশ্মি ছাড়া সম্ভব নয়। কালের কারণেই সূর্য তপ্ত হচ্ছে আর কালের কারণেই তার উৎপত্তি হয়েছে। সব প্রকারের উৎপন্ন পদার্থ, সেটা প্রাণী হোক, বনস্পতি হোক অথবা জড় পদার্থ হোক, সর্বদা "ওম্" রশ্মির মধ্যেই নিবাস করে। যতদূর এই ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব আছে, সেখানে সর্বত্র কালেরও অস্তিত্ব আছে আর যেখানে ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব নেই, সেখানেও কালের অস্তিত্ব আছে। কালের মধ্যেই আমাদের নেত্র দেখে অর্থাৎ নেত্রের দ্বারা হওয়া দর্শন ক্রিয়াও কালের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রকাশের গমন এবং প্রতিফলন আদি ক্রিয়ার মধ্যে "ওম্" রশ্মির অন্তিম এবং অনিবার্য ভূমিকা আছে।
.
সমস্ত উৎপন্ন পদার্থ, সেটা যেমনই গতি করুক না কেন, তার পিছনে কালতত্ত্বেরই প্রেরণা আছে। এমনকি যখন সেগুলো গতি করে, তখনও সেগুলো কালের সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই কাল অর্থাৎ "ওম্" রশ্মিই পরমেষ্টী অর্থাৎ দ্যুলোকের ধারণ আর পোষণ করে। এইভাবে এই কাল পরব্রহ্ম পরমাত্মার সমান মহান্ আর ব্যাপক হয়। কালের দ্বারাই বায়ু নিরন্তর গতি করে আর এই "ওম্" রশ্মির দ্বারাই বায়ুর শোধন হয়। কালের দ্বারাই পৃথিবীর উৎপত্তি আর বিস্তার হয়। কালই বিশাল দ্যুলোককে সবদিক থেকে ধারণ করে রেখেছে। ঈশ্বরের পুত্র কাল অর্থাৎ ঈশ্বর থেকে উৎপন্ন "ওম্" রশ্মিই ভূত, ভবিষ্যত আর বর্তমানকে উৎপন্ন করে। কালতত্ত্ব থেকেই ঋক্ এবং য়জুঃ রশ্মি উৎপন্ন হয় অর্থাৎ সমস্ত বেদমন্ত্র কালের দ্বারাই উৎপন্ন হয়।
.
সারসংক্ষেপ হল, এই সৃষ্টির মধ্যে সূক্ষ্মতম থেকে শুরু করে স্থূলতম পদার্থ পর্যন্ত সব পদার্থ কাল দ্বারাই উৎপন্ন এবং কাল দ্বারাই প্রেরিত হয়। এই কাল হল পরমেশ্বরের পুত্র রূপ। এরদ্বারা "ওম্" রশ্মির সঙ্গে কালের সম্বন্ধও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহর্ষি কণাদ "কারণেন কালঃ" (বৈশেষিক দর্শন ৫.২.২৬) এবং "কারণে কালঃ (বৈশেষিক দর্শন ৭.১.২৫) দ্বারা সংকেত করেছেন যে কারণ রূপ প্রকৃতি ও "ওম্" রশ্মির দ্বারাই কাল প্রকট হয় তথা এই কারণ রূপ প্রকৃতি ও ঈশ্বরের মধ্যেই উপস্থিত থাকে। আচার্য প্রশস্তপাদ লিখেছেন -
.
"কারণে কাল ইতি বচনাৎ পরম মহত্পরিমাণম্"
.
অর্থাৎ সেই কাল ঈশ্বর ও প্রকৃতির সমান পরম মহত্ পরিমাণ যুক্ত হয়। বৈশেষিক দর্শনের এই দুই সূত্রের অর্থ বর্তমান ভাষ্যকারগণ কিঞ্চিৎমাত্র বোঝেনি।
.
প্রশ্ন - যদি ঈশ্বরতত্ত্ব দ্বারা "ওম্" রশ্মির মাধ্যমে প্রেরিত ও সক্রিয় প্রকৃতিই কাল তত্ত্বের রূপ হয়, তাহলে সেই কাল কাকে প্রেরিত করে সৃষ্টিকে উৎপন্ন ও সঞ্চালিত করে? প্রকৃতির অতিরিক্ত কি অন্য কোনো জড় পদার্থও আছে, যাকে কাল রূপী প্রকৃতি প্রেরিত ও সঞ্চালিত করে আর এমন করে কি সেটা এই সৃষ্টিকে প্রকট বা উৎপন্ন করে?
.
উত্তর - বস্তুতঃ প্রকৃতির অতিরিক্ত অন্য কোনো জড় পদার্থের অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতির যে উপরোক্ত কালতত্ত্ব অবস্থা আছে, সেটাই ত্রিগুণা প্রকৃতিকে মহত্ তত্ত্বাদিতে পরিবর্তিত করে পুনরায় তাকেই প্রেরিত করে। এই প্রক্রিয়াতে কালতত্ত্ব প্রকৃতির তমোগুণকেও জাগ্রত বা সক্রিয় করে মহত্ তত্ত্বাদি পদার্থের নির্মাণ করে। কালের অতিরিক্ত অন্য সমস্ত পদার্থের মধ্যে তিন গুণ ন্যুনাধিক অনিবার্যরূপে বিদ্যমান থাকে। এইভাবে সেটা বিভিন্ন পদার্থকে নিজের প্রেরণা দ্বারা উৎপন্ন করে আর তারপর সেগুলোকে প্রেরিত ও ধারণও করে। কোনো পদার্থ দ্বারা অন্য কোনো পদার্থকে উৎপন্ন ও ধারণ করার কিছু উদাহরণ আমি প্রস্তুত করছি -
.
মনসো হি বাক্ প্রজায়তে (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.৩২০), মনসা হি বাগ্ধৃতা (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬.১.৭.২, কাঠক সংহিতা ২৪.৩), বাগিতি মনঃ (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ৪.১১.১.১১)।
.
এই তিনটা বচন থেকে সিদ্ধ হয় যে বাক্ তত্ত্ব মনস্তত্ত্ব দ্বারা উৎপন্ন হয়। মনস্তত্ত্বই বাক্ তত্ত্বকে ধারণ করে তথা বাক্ তত্ত্ব মনস্তত্ত্বেরই রূপ হয়। একইভাবে কাল তত্ত্ব রূপী প্রকৃতির অবস্থা থেকেই সব পদার্থ উৎপন্ন হয়, তার দ্বারাই প্রেরিত ও ধারণ হয় এবং তারই রূপ সেগুলো হয়।
.
আধুনিক বিজ্ঞানও দ্রব্যকে ঊর্জা দ্বারা নির্মিত ও প্রেরিত বলে, তারসঙ্গে ঊর্জা দ্বারা দ্রব্যকে ধারণ করা ও দ্রব্যকে ঊর্জার রূপও বলে, কিন্তু কালের ব্যবহার এরথেকে একটু ভিন্ন জেনে রাখা উচিত।
.
প্রশ্ন - কালতত্ত্ব হল প্রকৃতির একটা বিশেষ রূপ, কিন্তু তার স্বরূপ কি? এর পাশাপাশি অহোরাত্র, মাস, অর্ধমাস, ঋতু আদি কিরকম পদার্থ হয়?
.
উত্তর - আমি যেরূপ পূর্বে লিখেছি যে কালতত্ত্ব প্রকৃতির প্রায় অব্যক্ত (পূর্ণ ব্যক্ত নয়) অবস্থার নাম হয়, যারমধ্যে ঈশ্বর তত্ত্ব দ্বারা "ওম্" রশ্মির সর্বাধিক সূক্ষ্ম রূপের অব্যক্ত সঞ্চরণ করা হয়েছে, যার ফলে প্রকৃতির সত্ত্ব ও রজোগুণ তো অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপ থেকে ব্যক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তমোগুণ সর্বথা অব্যক্তই থাকে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রকৃতির মধ্যে হওয়া বিক্ষোভের বিষয়ে বেদ সংকেত করেছে -
.
"য়ানি ত্রীণি বৃহন্তি য়েষা চতুর্থম্ বিয়ুনক্তি বাচম্" (অথর্ববেদ ৮.৯.৩)
.
এর তাৎপর্য হল প্রকৃতির সত্ত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিনটা গুণের মধ্যে পরমাত্মা বাক্ তত্ত্বকে বিশেষ রূপে সংযুক্ত অর্থাৎ সঞ্চারিত করেন। এখানে "ওম্" রশ্মির সর্বাধিক সূক্ষ্ম রূপই হল বাক্ তত্ত্ব। এই বাক্ তত্ত্বই সেই তিন গুণকে জাগ্রত বা সক্রিয় করে। এরমধ্যেও সর্বপ্রথম কাল তত্ত্বকে প্রকট করার জন্য সত্ত্ব ও রজস্ এই দুই গুণকেই জাগ্রত করেন। এই দুটো গুণ প্রকট হতেই কাল তত্ত্ব চক্রবৎ ক্রমাগত ঘুরতে থাকে। এই ক্রমাগত প্রবৃত্তমান কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে জাগাতে অর্থাৎ সক্রিয় করতে শুরু করে। এই কাল তত্ত্ব দুই গুণ যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে অব্যক্ত ভাবে সঞ্চারিত "ওম্" রশ্মি রূপে হয়। এরমধ্যে মূল প্রকৃতির মতো গুণের সাম্যাবস্থা থাকে না, এই কারণে একে সর্বথা অব্যক্ত মানা যাবে না।
.
কালের স্বরূপের বিষয়ে অথর্ববেদের পূর্বোক্ত মন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান নিম্নলিখিত পদের উপর বিচার করবো -
১. সহস্রাক্ষ - অনেক অক্ষর রূপ অবয়ব যার আধার হয়, কিংবা এগুলোর উপর "ওম্" রশ্মির পরারূপ গমন করে। মূল প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে সব অক্ষর রশ্মিরূপে প্রকট হতে পারে না কিংবা অব্যক্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। পরারূপ "ওম্" রশ্মি এই সব অক্ষরের উপর ব্যাপ্ত হয়ে গমন করতে-করতে সেগুলোকে নানা পদরূপ রশ্মির রূপে প্রকট করে। এই "ওম্" রশ্মিই হল কালরূপ, যেটা মূল প্রকৃতির সাথে মিশ্রিত থাকে।
.
২. সপ্তরশ্মি - "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ", "মহঃ", "জনঃ", "তপঃ", "সত্যম্", এই সাত প্রকারের সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মি সর্বপ্রথম এই কালরূপ "ওম্" রশ্মি থেকেই উৎপন্ন বা প্রকট হয়। এই পরারূপ "ওম্" রশ্মি কোনো ছন্দ রশ্মির উপাদান কারণ হয় না, বরং নিমিত্ত কারণ হয়, সেটা ত্রিগুণা প্রকৃতি তথা মনস্ তত্ত্বাদিকে প্রেরিত করে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। আমার মতে পরারূপ "ওম্" রশ্মি কালরূপ হয়ে সত্ত্ব রজস্ এই দুই গুণের মধ্যে রমণ করে প্রকৃতির তিন গুণকে প্রকট করে মহত্ এবং মনস্ তত্ত্বাদিকে উৎপন্ন করে। এর অর্থ হল কাল তত্ত্বই মহত্ আদিকে উৎপন্ন করে। এর পশ্চাৎ কাল তত্ত্ব মনস্তত্ত্ব আদিকে প্রেরিত করে ভূরাদি সাত ব্যাহৃতি রূপ রশ্মিকে উৎপন্ন করে। এই সাত রশ্মির দ্বারাই কাল তত্ত্ব অগ্রিম রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে। এই কারণে কালকে "সপ্তরশ্মি" বলা হয়েছে অর্থাৎ যারদ্বারা ভূরাদি সাত রশ্মি উৎপন্ন হয় কিংবা যেটা ভূরাদি সাত রশ্মিকে সাধন রূপে ব্যবহার করে, সেই কাল তত্ত্বকে সপ্তরশ্মি বলে। এই পদের মধ্যে "সপ্ত" সংখ্যাবাচী পদের একটা বিশিষ্ট গুরুত্ব আছে। মহর্ষি য়াস্কের কথন হল - "সপ্ত সৃপ্তা সংখ্যা" (নিরুক্ত ৪.২৬)। এর দ্বারা সংকেত পাওয়া যায় যে কাল থেকে উৎপন্ন সাত রশ্মি কিংবা কালের সাধন রূপ ভূরাদি রশ্মি পরাবস্থা রূপ হয়ে ছড়িয়ে থাকার মতো হয়। এখানে এমন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে যে এই রশ্মিগুলো অগ্রিম উৎপন্ন পশ্যন্তী রূপ ভূরাদি অন্য রশ্মির তুলনায় অধিক ছড়িয়ে একরসবৎ থাকে। এমন সেই রশ্মির সঙ্গে কাল রশ্মির সাক্ষাৎ সম্বন্ধ আছে।
.
৩. অশ্ব - এই পদ স্পষ্ট করে যে কালরূপ পরা "ওম্" রশ্মি তীব্রগামিনী তথা একরসবৎ সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। এখানে এই প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে যে যখন কাল রশ্মি অর্থাৎ পরারূপ "ওম্" রশ্মি একরসবৎ ব্যাপ্ত থাকে, তাহলে সেগুলো কিভাবে গতিশীল হতে পারে? গতি তো একদেশী পদার্থের মধ্যেই হতে পারে, ব্যাপক পদার্থের মধ্যে হতে পারে না, তাহলে কালকে আশুগামী কেন বলা হয়েছে? এই বিষয়ে আমার মত হল - ঈশ্বর তত্ত্ব থেকে প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে পরারূপ "ওম্" রশ্মি, যেটা কালরূপ হয়, সেটা অতিতীব্র বেগে ক্রমাগত সর্বত্র প্রকট হতে থাকে, এই কারণেই কালকে অশ্ব বলা হয়েছে। এই পদার্থও মূল প্রকৃতিবৎ প্রায় অব্যক্তই থাকে।
.
৪. অজর - পরারূপ "ওম্" রশ্মি সহিত প্রকৃতি পদার্থ, যাকে কাল তত্ত্ব বলে, সেটা কখনও জীর্ণ হয় না। প্রলয়াবস্থাতেও প্রকৃতিকে প্রেরিত না করে অব্যক্ত রূপে এই তত্ত্ব যথাযথ ভাবে বিদ্যমান থাকে।
.
৫. ভূরিরেতা - এই কাল তত্ত্বই অনেক প্রকারের পদার্থ ও কর্মের বীজরূপ হয়। সৃষ্টির সব দ্রব্য, বল, কর্ম, গুণ আদির বীজ এই তত্ত্বই হয়, যেটা সবার মূল ঈশ্বর তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
.
৬. সপ্তচক্র ও সপ্তনাভি - প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান, ধনঞ্জয় ও সূত্রাত্মা বায়ুর সপ্তক কিংবা সাত প্রকারের ছন্দ রশ্মির চক্রকে এই কাল তত্ত্বই উৎপন্ন এবং বহন করে। এই সাত চক্রকে চালানোর জন্য ঈশ্বর তত্ত্ব ভূরাদি সাত ছন্দ রশ্মিকে নাভি অর্থাৎ কেন্দ্ররূপে প্রযুক্ত করেন। এই কারণে কালের সাতটা নাভি বলা হয়েছে। এই নাভিরূপ রশ্মিই সেই প্রাণাদি সাত রশ্মিকে এক রশ্মি রূপে বেঁধে রেখে গতি প্রদান করে কিংবা সেগুলোকে পরমাত্ম তত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে রাখে।
.
"কাল" পদের ব্যুৎপত্তি করে আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোষের মধ্যে বলেছেন - "কু ঈষত্ কৃষ্ণত্বম্ লাতি লা+ক, কোঃ কাদেশঃ"। যদিও আপ্টে এখানে "কালঃ" শব্দের অর্থ "কালা" গ্রহণ করেছেন তথা এতদর্থ কৃষ্ণের অর্থ কালাই মেনেছেন, কিন্তু আমরা এখানে "কৃষ্ণত্বম্" থেকে আকর্ষণ বলশীততা গ্রহণ করে অতি সূক্ষ্ম আকর্ষণ বল কিংবা বল ও গতির প্রারম্ভ যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের পূর্বোক্ত অবস্থার নামই কাল গ্রহণ করবো। এই কাল তত্ত্বই সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তার দ্বারা উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে প্রারম্ভিক বল সর্বদা উৎপন্ন করতে থাকে। বাকি মাস বা প্রাণাপানাদি রশ্মি কালের মাপক হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ত্রিগুণা প্রকৃতির বিকার মহত্ বা মনস্তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয়। এই পদার্থই এই রশ্মিগুলোর উপাদান কারণ তথা কাল ও ঈশ্বর তত্ত্ব নিমিত্ত কারণ হয়। এই রশ্মিগুলোর মধ্যে তমোগুণের মাত্রা অন্য রশ্মির তুলনায় নিম্ন হয়। এই বিষয়ে পরে বিস্তার ভাবে লেখা হবে। এখন আমি প্রাণতত্ত্বের সম্বন্ধে প্রাণ সূক্তের কিছু মন্ত্রকে উদ্ধৃত করবো -
.
প্রাণায় নমো য়স্য সর্বমিদম্ বশে।
য়ো ভূতঃ সর্বস্যেশ্বরো য়স্মিন্ত্সর্বম্ প্রতিষ্ঠিতম্।।১।।
প্রাণঃ প্রজা অনু বস্তে পিতা পুত্রমিব প্রিয়ম্।
প্রাণো হ সর্বস্যেশ্বরো য়চ্চ প্রাণতি য়চ্চ ন।।১০।।
প্রাণো বিরাট্ প্রাণো দেষ্ট্রী প্রাণম্ সর্ব উপাসতে।
প্রাণো হ সূর্যশ্চন্দ্রমাঃ প্রাণমাহুঃ প্রজাপতিম্।।১২।।
প্রাণমাহুর্মাতরিশ্বানম্ বাতো হ প্রাণ উচ্যতে।
প্রাণে হ ভূতম্ ভব্যম্ চ প্রাণে সর্বম্ প্রতিষ্ঠিতম্।।১৫।।
(অথর্ববেদ ১১.৪)
.
এখানে প্রাণ তত্ত্বকে সব উৎপন্ন পদার্থকে নিয়ন্ত্রিত ও ধারণকারী, সেগুলোকে ক্রমাগত আচ্ছাদনকারী, সূর্য, চন্দ্র আদি লোক এবং প্রজাপতি অর্থাৎ বাক্ এবং মনস্তত্ত্ব কিংবা নানা সংযোগাদি ক্রিয়ার, অন্তরীক্ষে শয়নকারী বায়ু তত্ত্ব এবং ভূত, ভবিষ্যৎ আদি কালে উৎপন্ন বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বলা হয়েছে।
.
এখানে প্রাণতত্ত্বের স্বরূপ পূর্বোক্ত কালতত্ত্বের স্বরূপের সঙ্গে প্রায় সাধারণত মিলে যায়। এই কারণে অহোরাত্র রূপ প্রাণাপানোদান রশ্মিও কাল তত্ত্বেরই রূপ হয় কিংবা তার একটা মাপক পরিমাণ বিশেষ হয়। একইভাবে মাস, ঋতু আদিকেও জানা যেতে পারে, কারণ এইসব প্রাণ রশ্মিরই রূপ হয়। প্রাণ রশ্মির বিষয়ে আমি পরে চর্চা করবো।
প
্রশ্ন - আপনার কথা অনুসারে প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে "ওম্" রশ্মির সবথেকে সূক্ষ্ম স্বরূপের উৎপন্ন হলে সেই পদার্থ কালের রূপে প্রকট হয় অর্থাৎ সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক সূক্ষ্ম বল ও ক্রিয়ার উৎপত্তি হয়। তখন মহাপ্রলয় কালে কালের অস্তিত্ব সর্বথা অসিদ্ধ হয়ে যায়, এমন পরিস্থিতিতে প্রলয় কালে মুক্তাত্মাদের গমনাগমন তথা সৃষ্টি প্রারম্ভ হওয়ার জ্ঞান কালের কিভাবে হয় অর্থাৎ ঈশ্বর তত্ত্ব কিভাবে উচিত ও নিশ্চিত সময়ে সর্গ রচনা প্রারম্ভ করতে পারে?
.
উত্তর - আপনার এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক। বস্তুতঃ "ওম্" -এর সূক্ষ্মতম স্বরূপ তথা বিভিন্ন অক্ষররূপ বাক্ তত্ত্বের কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না, এই কারণে এগুলোকে অক্ষর রশ্মিও বলা হয়। তবে হ্যাঁ, মহাপ্রলয় কালে এই সর্বথা অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" -এর সঙ্গে প্রকৃতি রূপ পদার্থের সাক্ষাৎ সক্রিয় সম্বন্ধ থাকে না। ঈশ্বর তত্ত্বের দৃষ্টিতে "ওম্" রশ্মির সেই রূপ সর্বদা বজায় থাকে, কারণ ঈশ্বর অর্থাৎ "ওম্" বাচ্য পরমাত্ম তত্ত্ব সর্বদা জাগ্রত থাকে। বদ্ধ ও মুক্তাত্মাদের সম্পর্কে এই "ওম্" রশ্মিময় পদার্থ অর্থাৎ কাল তত্ত্ব অবশ্য তার অব্যক্ততম রূপে বিদ্যমান থাকে। এটা প্রলয়কাল পর্যন্ত এই রূপে বিদ্যমান থাকে তথা অন্য প্রকৃতি রূপ পদার্থের মধ্যে এটা পরমেশ্বরের মধ্যে বীজরূপে অনাদি এবং অনন্ত রূপে সর্বদা বিদ্যমান থাকে। এই অজর কাল চক্রের কারণেই সৃষ্টি-প্রলয়ের চক্র নিয়মিত ও নিরন্তর চলতে থাকে।
.
প্রশ্ন - ঋষি দয়ানন্দ সত্যার্থপ্রকাশের তৃতীয় সমুল্লাসে বৈশেষিক দর্শনের সূত্র "নিত্যেষ্বভাবাদনিত্যেষু ভাবাৎকারণে কালাখ্যেতি" (২.২.৯) ভাষ্যতে লিখেছেন -
"যেটা নিত্য পদার্থের মধ্যে নেই আর অনিত্যের মধ্যে আছে, এইজন্য কারণের মধ্যেই কাল সংজ্ঞা আছে।"
.
এখানে নিত্য পদার্থের (ঈশ্বর, জীব তথা প্রকৃতি) মধ্যে কালের বিদ্যমান না থাকার কথা লেখা আছে, তাহলে আপনি কালকে প্রলয়কালে জীবাত্মার সম্পর্কে থাকে কেন লিখেছেন?
.
উত্তর - আমার কথনের সঙ্গে ঋষি দয়ানন্দের কথনের কোনো বিরোধ নেই। আমি কোথাও লেখিনি যে জীবাত্মার ভিতরে কাল তত্ত্ব বিদ্যমান থাকে, বরং এটা লিখেছি যে কালতত্ত্ব তাদের সম্পর্কে থাকে। "ওম্" রশ্মির পরারূপ মূল প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রূপকে কাল বলেছি। এখানে নিত্য পদার্থের মধ্যে কালের নিষেধ তথা অনিত্য পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান হওয়ার তাৎপর্য এটাই যে কাল তত্ত্ব নিত্য পদার্থকে জীর্ণ করে না আর না করতে পারবে, বরং এই কাল তত্ত্ব অনিত্য পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে সেগুলোকে নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।
.
প্রশ্ন - কাল অনিত্য পদার্থকে জীর্ণ কিভাবে করে? যে কাল সব পদার্থকে প্রেরিত ও সক্রিয় করে, সেই কালের কারণে সব অনিত্য পদার্থ কিভাবে জীর্ণ হয়ে যায়?
.
উত্তর - আপনার এই প্রশ্ন স্বাভাবিক তথা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যে সব অনিত্য পদার্থ মূল প্রকৃতির বিকারই হয় আর বিকার সর্বদা সংযোগজন্য হয়। কেন কোনো সংযোগজন্য পদার্থ অনাদি হতে পারে না? চলুন, আমরা এর উপর বিচার করি। সংযুক্ত পদার্থের মধ্যে একটা বল কাজ করে, যাকে বর্তমান বিজ্ঞান গুরুত্ব বল, বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল অথবা প্রবল নাভিকীয় বল আদি নামে সম্বোধন করে। এই বলের জন্য কিছু মধ্যস্থ কণা (মিডিয়েটর পার্টিকল) উত্তরদায়ী হয়। সংযুক্ত হওয়া বা হয়ে যাওয়া কণার মাঝে এই কণাগুলোর বিনিময় হতে থাকে। এই বিনিময়ের পিছনে যে বল উত্তরদায়ী হয়, তাকে বর্তমান বিজ্ঞান জানে না। এইসব বলের শৃঙ্খলাতে "ওম্" রশ্মি অর্থাৎ কালের বল মূলে থাকে। পরমাত্মা সবার মূল তো হয়ই। এইভাবে সব জড় বলের মধ্যে গতির বিদ্যমান হওয়া অনিবার্য হয়, কিন্তু গতি কখনও অনাদি হতে পারবে না, এই কারণেই কোনো সংযোগ কখনও অনাদি হতে পারবে না। আর তাই সৃষ্টির কোনো পদার্থ অনাদি ও অজর হতে পারবে না। এখানে প্রত্যেক পদার্থের উৎপন্ন হওয়া, জীর্ণ হওয়া তথা নষ্ট হওয়ার একটা সুনিশ্চিত ব্যবস্থা আছে। এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থা ঈশ্বর তত্ত্বের প্রেরণা ও নির্দেশানুসারেই হয়, অন্যথা কাল এমন করতে পারবে না।
প্রশ্ন - কাল তত্ত্বের দ্বারা যখন মহত্ থেকে শুরু করে বিশাল লোক-লোকান্তর পর্যন্ত উৎপত্তি হয় আর সেটা প্রকৃতির একটা অবস্থা বিশেষের নাম হয়, তাহলে সেই কাল কি সৃষ্টির উপাদান কারণ নাকি নিমিত্ত কারণ? কালের ক্রিয়াবিজ্ঞান কি?
উত্তর - আমি যেমন লিখেছিলাম যে কাল তত্ত্ব ত্রিগুণাযুক্ত প্রকৃতি পদার্থকে প্রেরিত ও সক্রিয় করে, কিন্তু স্বয়ং কখনও কোনো উৎপন্ন পদার্থের উপাদান হয় না। ধ্যাতব্য হল, কাল তত্ত্ব স্বয়ংও মূল চেতন প্রেরক ঈশ্বর তত্ত্ব দ্বারা ক্রমাগত প্রেরিত হতে থাকে। সেই কাল তত্ত্ব কখনও ঈশ্বর তত্ত্বের প্রেরণা থেকে পৃথক হতে পারবে না। কাল দ্বারা প্রেরিত ত্রিগুণা প্রকৃতি মহত্তত্ত্বকে জন্ম দেয়। এই মহত্তত্ত্বও কাল দ্বারা প্রেরিত ও ধারণ করা হয়। এর ধারণ স্থান ত্রিগুণা প্রকৃতিই হয়। তারপর মহত্তত্ত্ব থেকে আগামী পদার্থের উৎপত্তি প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়ে যায়। এই সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাতে ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত কাল তত্ত্বের প্রেরণা সদা বজায় থাকে আর সৃষ্টির পদার্থের মধ্যে সর্বত্র কাল তত্ত্বের বিদ্যমানতা থাকে, তাই ঈশ্বর তত্ত্বের অবিদ্যমানতার প্রশ্নই আসে না। এই দুটো তত্ত্ব অর্থাৎ ঈশ্বর ও কাল দুটোই নিমিত্ত কারণ রূপে কাজ করে, উপাদান রূপে কখনও করে না।
.
কালের ক্রিয়াবিজ্ঞান -
এখন এই প্রশ্নে আসবো যে কালতত্ত্বের ক্রিয়াবিজ্ঞান কি? এর উত্তরে আমার মত হল "ওম্" রশ্মি রূপ কাল রশ্মি সর্বপ্রথম মূল প্রকৃতি তত্ত্বকে সৃষ্টির সবথেকে সূক্ষ্ম প্রেরণা দিয়ে যুক্ত করে তাকে বিকৃত করা প্রারম্ভ করে। প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান বিভিন্ন অক্ষর রূপ বাক্ তত্ত্ব জাগ্রত হয়ে মূল প্রকৃতিকে ক্রমশঃ মহত্, অহংকার ও মনস্তত্ত্বের রূপে প্রকট করে, কিন্তু সত্ত্ব ও রজস্ গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি অর্থাৎ "ওম্" -এর কালরূপ স্বয়ং সর্বদা বিকৃত থেকে তমোগুণের সঙ্গে অন্য দুই গুণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৃতিকেই সৃষ্টি রচনা হেতু প্রেরিত ও বিকৃত করে। সেই কাল তত্ত্ব "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপকে প্রকট করে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন ও ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন করে ভূরাদি সপ্ত সূক্ষ্ম রশ্মিকে প্রকট করে। এর পশ্চাৎ এই ভূরাদি রশ্মিকে সাধন বানিয়ে প্রাণাপানাদি সাত মুখ্য প্রাণ রশ্মিকে, পুনঃ অন্য প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মিকে প্রকট করে সৃষ্টি চক্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানেও কাল তত্ত্ব প্রত্যেক পদার্থ - মূলকণা, তরঙ্গ, স্পেস আদির ভিতরে বিদ্যমান থেকে সেগুলোর মধ্যে "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ, ভূরাদি থেকে শুরু করে সব রশ্মিকে প্রেরিত করে সবাইকে সক্রিয় করে, তার পাশাপাশি সেগুলোতে উচিত জীর্ণতাও নিয়ে আসে।
.
প্রশ্ন - আপনি প্রেরণ, জাগরণ আদি শব্দের ব্যবহার করেছেন। ঈশ্বর কালকে প্রেরিত করে, কাল প্রকৃতিকে, পুনঃ প্রেরণ ও জাগরণ ক্রিয়া পরে চলতে থাকে। প্রেরণ ও জাগরণ কর্মের স্বরূপ কি? ঈশ্বর ও কাল আদি পদার্থ কি অগ্রিম পদার্থের মধ্যে ঊর্জার সঞ্চরণ করে? এগুলো কি স্বয়ং ঊর্জাযুক্ত পদার্থ হয় নাকি স্বয়ংই ঊর্জাস্বরূপ হয়?
উত্তর - এই প্রশ্ন বর্তমান পরম্পরার বৈজ্ঞানিকদের মস্তিষ্কে অবশ্যই উৎপন্ন হয়। আমাদের এক ন্যাসী প্রফেসর বসন্ত মদনসুরে, যিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর ছিলেন তথা এই গ্রন্থের সম্পাদক আমার মানস পুত্র প্রিয় বিশাল আর্য (অগ্নিয়শ বেদার্থী), এই সংস্থানে যে প্রাচার্য পদে কাজ করছেন, তারা চর্চার মধ্যে এমন প্রশ্ন করেছিলেন। আমার মনে হয় যে অন্য অনেক ব্যক্তির মনের মধ্যে ওঠা এই প্রশ্ন তাদের বিভ্রান্তিতে ফাঁসাবে, এই কারণে আমি এর সমাধান আবশ্যক মনে করেছি। বর্তমান বিজ্ঞান পদার্থের তিনটা স্বরূপের উপরই চর্চা করে। সেই স্বরূপ হল - দ্রব্য (মেটার), ঊর্জা (এনার্জি) এবং আকাশ (স্পেস)। এগুলোর মধ্যে আকাশের বিষয়ে তাদের নগণ্য জ্ঞান আছে। বাকি দুই পদার্থের মধ্যে ঊর্জার স্বরূপ দ্রব্যের তুলনায় সূক্ষ্ম হয়।
.
বর্তমান বিজ্ঞান ঊর্জার স্বরূপের বিষয়েও তেমন বিশেষ জ্ঞান রাখে না, তাসত্ত্বেও সংসারের মধ্যে এর অপার দোহন ও ব্যবহার করছে। ভ্যাকিউম এনার্জি ও ডার্ক এনার্জির বিষয়ে এখনও নিতান্ত অন্ধকারে বা ভ্রমই দেখছে। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ ও ধ্বনি ঊর্জার সঙ্গে পরিচিত হয়েও এগুলোরও পূর্ণ স্বরূপ নিয়ে বর্তমান বিজ্ঞান এখন অজ্ঞাত আছে। এই কারণে এইসব ঊর্জা ছাড়াও যে আরও পদার্থ আছে, তার কল্পনাও সেটা করতে পারে না। বর্তমান বিজ্ঞান মনে করে যে যেরূপ বিদ্যুৎ প্রেরণা, চুম্বকীয় প্রেরণা অথবা যান্ত্রিক প্রেরণা আছে, সেইরূপ ঈশ্বর ও কালের মতো সূক্ষ্ম পদার্থের দ্বারা প্রেরণা হওয়া উচিত। সেইভাবে শরীরের মধ্যেও জীবাত্মা দ্বারা সূক্ষ্ম শরীর ও স্থূল শরীরের মধ্যে প্রেরণা হওয়া উচিত। আমরা এই বিষয়ের উপর বিচার করবো -
.
আমরা সংসারের মধ্যে প্রেরণা বা জাগরণের ভিন্ন-ভিন্ন রূপ দেখতে পাই। এক ব্যক্তি কোনো পশুকে লাঠি দিয়ে চালিত করে, তখন সে সেই পশুকে লাঠি দিয়ে কোনো কাজ করার প্রেরণাই করে। পিতা তার উদ্দণ্ড পুত্রকে তাড়না দ্বারাই প্রেরণা করে, তাকে ধাক্কা মেরে-মেরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়। ওই প্রেরণার কারণে সেই পুত্র যেতে বা কাজ করতে বাধ্য হয়। সেই পিতাই তার বুদ্ধিমান তথা আজ্ঞাকারী পুত্রকে চোখের সংকেত মাত্র দ্বারা প্রেরণা করে ত্বরিত ক্রিয়াশীল বানিয়ে দেয়। এই উভয় প্রক্রিয়ার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কি এমন বলবে যে সেই ব্যক্তি পশুর মধ্যে অথবা পিতা তার পুত্রের মধ্যে কোনো ঊর্জা সঞ্চারিত করেছে? জড় বস্তুর মধ্যে প্রেরণার তাৎপর্য ঊর্জা সঞ্চারণ হতে পারে, কিন্তু চেতনের স্তরে এমন বিচার অপরিপক্ব হবে।
.
এক চেতন যখন অন্য চেতন প্রাণীকে প্রেরণা দেয়, তখন কোনো ঊর্জা সঞ্চারণ তো হয় না, বরং মনের রশ্মির দ্বারা প্রেরণা অবশ্যই হয়। মনের রশ্মিকে কোনো ভৌতিক-বিজ্ঞানী না তো দেখতে পারবে আর না অনুভব করতে পারবে। মনের এই সূক্ষ্ম রশ্মির প্রেরণাই অন্য প্রাণীদের সক্রিয়তা প্রদান করে। তার ক্রিয়াশীলতার জন্য আবশ্যক ঊর্জা তার শরীরের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে, যাকে অন্য প্রাণীর মনের তরঙ্গ প্রেরিত করে মাত্র। এই প্রেরণা আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের বিষয় নয়। এমনইভাবে ঈশ্বর দ্বারা কালকে প্রেরিত করা বর্তমান বিজ্ঞানের সীমার বাইরের বিষয় হবে। কাল দ্বারা প্রকৃতি, মন ও প্রাণ তত্ত্বকে প্রেরিত করাও বর্তমান বিজ্ঞানের দৃষ্টির বাইরের বিষয় হবে। বর্তমান বিজ্ঞানের দৃষ্টি বিদ্যুৎ আবেশ উৎপন্ন হওয়ার পশ্চাৎ প্রারম্ভ হয়, এর পূর্বের কাজকে বর্তমান বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে না তো বিচার করা সম্ভব আর না পরিভাষিৎ বা ব্যক্ত করা সম্ভব। ধরে নিন, একজন ব্যক্তি কোনো কাজকে দ্রুত করছিল, এমন সময় কোনো এক দুঃখের সংবাদ পেয়ে আহত হয়ে নিজেকে দুর্বল মনে করে বসে পরে, সে আসলে দুর্বলই হয়ে যায়। যদি কেউ বলে যে তার ঊর্জা কোথায় সঞ্চারিত হয়ে গেছে? সে কেন কাজ করতে পাচ্ছে না, তখন বর্তমান ভৌতিকীর আধারে কোনো ঊর্জা বিজ্ঞানী এর কি উত্তর দিবে? সে যেটাই উত্তর দিবে, সেটা বর্তমান ভৌতিকীর থেকে কিছু ভিন্নই হবে।
.
আশা করি বিজ্ঞ পাঠক এইটুকুতে প্রেরণা ও জাগরণের ভাব বুঝে গেছেন। পুনরায় সারাংশতঃ ঈশ্বর কালকে অব্যক্ত ও অজ্ঞেয় ভাব দ্বারা প্রেরিত ও উৎপন্ন করে। পুনঃ কাল প্রকৃতির মধ্যে সূক্ষ্ম প্রেরণা ও স্পন্দন প্রারম্ভ করে। এই কাজের মধ্যে ঈশ্বরীয় প্রেরণা ও বল অবশ্যই বিদ্যমান থাকে। পুনঃ প্রকৃতি স্পন্দিত ও বিকৃত হয়ে মহত্-অহংকার ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর পশ্চাৎ এই প্রেরণা ও স্পন্দন প্রক্রিয়া পরে চলতে থাকে। যেকোনো পদার্থের মধ্যে তার পূর্ববর্তী পদার্থের প্রেরণা অবশ্যই বিদ্যমান থাকে। এইভাবে সব সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পদার্থ পরস্পর ঈশ্বর ও কালের প্রেরণা দ্বারা একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে কাজ করে। বিদ্যুৎ প্রেরণা আদিকেও কি কোনো ভৌতিকবিদ্ পারবে আমাকে পূর্ণরূপে বোঝাতে? সম্ভবত পারবে না, তাহলে কাল ও ঈশ্বর বা মনস্তত্ত্বাদির প্রেরণা কর্ম তো অতি সূক্ষ্ম, সেগুলোকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন - বর্তমান বৈজ্ঞানিক কালকে আকাশের সাথে জুড়ে অনেক গণিতীয় সংকল্পনাকে প্রস্তুত করে তথা এগুলোকে প্রকাশের তরঙ্গের সাথে সম্বন্ধ করে কাল ও আকাশের সিঙ্গুলারিটির চ
র্চা করে। কালের থেমে যাওয়া, ধীর ও তীব্র গতিতে চলার কথা বলে, সেই বিষয়ে আপনার কি মত?
উত্তর - বর্তমান বিজ্ঞান শুধু কাল ও আকাশই নয়, বরং বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের আন্তরিক সংরচনা ও স্বরূপের বিষয়েও প্রায় অনভিজ্ঞ আছে। এই অনভিজ্ঞতার দ্বারা সেই তিনটার অসংগত ও অস্বাভাবিক মিলন করার অসফল চেষ্টা করে, এই কারণে অনেক মিথ্যা ধারণাকে প্রস্তুত করে। কালতত্ত্ব হল আকাশ তত্ত্বের থেকেও অতি সূক্ষ্ম তত্ত্ব। আকাশ হল প্রাণ ও সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মি দিয়ে নির্মিত পদার্থ, যার বিষয়ে পরে যথাস্থানে লেখা হবে। প্রবল গুরুত্বকর্ষণ ক্ষেত্রে কোনো পদার্থের গতি কম হওয়া বা বন্ধ হওয়ার অর্থ এই নয় যে সেখানে কাল থেমে গেছে, বরং তার তাৎপর্য এই হল যে সেখানে বর্তমান সেই প্রবল বল, সেটা গুরুত্বাকর্ষণ বলই হোক বা অন্য কোনো বল, সেই পদার্থের গতিকে থামাচ্ছে অথবা প্রভাবিত করছে। যদি কোনো ব্যক্তি চলন্ত সাইকেলের চাকাকে থামিয়ে দেয়, তো এর মানে এই নয় যে সেখানে কাল থেমে গেছে। এটা হল বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের ভারী ভ্রম। আকাশ তত্ত্ব হল বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের গমন করার একটা আধার, যেমন কোনো গাড়ি চলার জন্য রাস্তা একটা আধার হয়। এই কারণে এই রশ্মিগুলোর সম্বন্ধ আকাশ তত্ত্বের সঙ্গে অবশ্যই আছে। কাল তো সবার সঙ্গে নিরপেক্ষ ও সমান সম্বন্ধ রাখেই, অন্যথা কোনো বস্তুর মধ্যে কোনো ক্রিয়াই হবে না, অস্তু।
.
প্রশ্ন - বর্তমান বৈজ্ঞানিক কালকে সামনে ও পিছনে যাওয়ার চর্চা করে, এর দ্বারা তারা কোনো ঘটনার ভবিষ্যত ও অতীতে যাওয়ার উপর অনুসন্ধান করছে। এই বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
উত্তর - এই প্রশ্নের উপর আমার প্রতিপ্রশ্ন আছে, সেটা হল কালের পিছনে যাওয়া অর্থাৎ ভূতে বা অতীতে যাওয়ার অর্থ কি? কোনো বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক কালকে পিছনে নিয়ে গিয়ে নিজের পূর্ব যুব বা শিশু রূপকে প্রাপ্ত করতে পারবে কি? তারা কি মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবে? রামায়ণ, মহাভারত কালে গিয়ে এই ভূমিতে সেই যুগ ও তাতে বিদ্যমান মানুষ, দেব ও অন্য সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে? আমার নিশ্চিত মত হল এমন হওয়া সম্ভব নয়। যদি এটা সম্ভব না হয়, তাহলে কালের পিছনে যাওয়ার অর্থ কি থাকলো? তবে হ্যাঁ, আমি এটা তো স্বীকার করি যে, কোনো য়োগী ভূতকালীন ঘটনাকে নিজের য়োগবল দ্বারা জানতে পারবে। ভবিষ্যতে কোনোদিন বৈজ্ঞানিক কোনো টেকনিকের আবিষ্কার করে মহাভারত যুদ্ধের ধ্বনি ও রূপকে শুনতে ও দেখতেও পারবে, কিন্তু বাস্তবে তারা সেই যোদ্ধাদের পুনর্জীবিত করতে পারবে না আর এই পৃথিবীতে সেই পরিস্থিতিকে বাস্তবে উৎপন্ন করতে পারবে।
.
কোনো রাসায়নিক প্রয়োগ দ্বারা বৃদ্ধ ব্যক্তি যুবকও হতে পারবে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কাল পূনরায় ফিরে এসেছে। কাল ফিরে এলে নদী, পর্বত, বৃক্ষ, সম্পূর্ণ ভৌগোলিক ও পরিবেশগত তন্ত্র সবকিছু ভূতকালের মতো হয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু কেউ কি এমন করতে পারবে? কক্ষনো না। বিজ্ঞান বল ও ঊর্জার কোনো বিশেষ টেকনিকের আধারে কোনো পদার্থ বিশেষের মধ্যে হতে চলা প্রক্রিয়াকে মন্দ বা তীব্র তো করতে পারবে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কালের গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে এমন করা হয়েছে। আপনি যখন এটাই জানেন না যে কাল কোন বস্তুর নাম, তখন তার তীব্র বা মন্দ হওয়ার চর্চা করে কি দেখাতে চাইছেন?
.
এখন ভবিষ্যতে যাওয়া নিয়ে একটু বিচার করুন। আমি এটা জানতে চাই যে এর অর্থ কি? আপনি কি এর দ্বারা এটা বলতে চাইছেন যে আপনি ভবিষ্যতে গিয়ে কোনো শিশুর নাতির বিবাহ করতে পারবেন? ভবিষ্যতে হতে চলা প্রত্যেক পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন? তাহলে এটা হল পুরোটাই কল্পনা। ভূত তো নিশ্চিতও হয়, কিন্তু ভবিষ্যত তো নিশ্চিতও হয় না, তাহলে তার সাক্ষাৎ কিভাবে হবে? কোনো উচ্চকোটির য়োগী ভবিষ্যতের কিছু জ্ঞান প্রাপ্ত করবে এটা সম্ভব, কিন্তু এরদ্বারা এটা সিদ্ধ হবে না যে সে কালকে সামনে সরিয়ে দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি কালকে সামনে সরিয়ে স্বয়ংকে চিতাতে জ্বলতে দেখতে পারবে কি? পারবে কি কিছু ক্ষণের মধ্যে ভবিষ্যতের ভূগোলের সাক্ষাৎকার করতে?
.
বস্তুতঃ গণিতের মিথ্যা মাকড়সার জালে ফেঁসে গিয়ে কালকে না বুঝে বর্তমান বিজ্ঞান স্বয়ং উপহাসের পাত্র হয়ে বসে আছে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সিদ্ধান্তের ভারী অপব্যবহার করছে বলে মনে হচ্ছে। কালকে আকাশের সাথে জুড়ে দিয়ে বৈজ্ঞানিক ভারী ভ্রান্তিতে আছে। তারা এই দুটোর স্বরূপকে জানে না, তবুও এই দুটোকে মিশিয়ে টানা হেচড়া করছে, ফলে এর পরিণাম তো বিপরীতই হবে। তারা কাল আর অবধির অন্তরকেও বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ব্যক্তি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতাকে অথবা সেগুলোর মাপক মিটার, ফিট আদিকেই আকাশ মেনে নেয়, তাহলে এটা তার ভারী ভ্রম বা মূর্খতা হবে না? এমনই স্থিতি হবে যদি ঘণ্টা, মিটার, সেকেণ্ড আদি অবধি মাপি মাপককে কাল মানা হয়। এর উপর আবার এগুলোকে পরস্পর জুড়ে দিলে চাল-না-চুলো-ঢেঁকি-না-কুলোর মতো অবস্থা হয়ে যাবে। বৈদিক বিজ্ঞান হতে অনভিজ্ঞ বর্তমান বিজ্ঞান এমন ভুল শতাব্দী ধীরে করে আসছে আর পরবর্তীতেও করতে থাকবে।
.
প্রশ্ন - কাল এবং সময় বা সময়াবধির মধ্যে পার্থক্য কি? যাকে আমরা ক্ষণ, মুহূর্ত, দিন, মাস, বর্ষে মাপি, আপনার দ্বারা পরিভাষিত কালের সাথে তার কি সম্বন্ধ?
.
উত্তর - কালের বিষয়ে আমি সবিস্তারে লিখে দিয়েছি। মহর্ষি কণাদ একে দ্রব্যের অন্তর্গত মেনেছেন, অন্যদিকে সময় বা সময়াবধির প্রয়োগ মাত্র ব্যবহারিক হয়। কোনো ক্রিয়া বিশেষকে পূর্ণ করতে অথবা কোনো ঘটনা বিশেষে কাল রশ্মির স্পন্দনের মাত্রাকেই সময়ের মাপ বলা হয়। "ওম্" রশ্মির একটা স্পন্দন সময়ের সবথেকে সূক্ষ্ম মাপ হয়। এরথেকে সূক্ষ্ম এই সৃষ্টিতে কখনও কোথাও কোনো ঘটনা হওয়া সম্ভব নয়। প্রাণ, অপান, মাস, ঋতু আদিও কালমাপী রশ্মি হয়। একটা প্রাণের স্পন্দনের ঘটনাতে কতবার "ওম্" রশ্মি স্পন্দিত হয়, এটা হল প্রাণ রশ্মির মাপ। একইভাবে অন্য বিষয়েও জেনে নেওয়া উচিত। এক সেকেণ্ডে কতবার প্রাণ রশ্মি বা "ওম্" রশ্মি স্পন্দিত হয়, এটা কেউই জানে না।
.
আমাদের জানা না থাকলেও আমরা ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ড, দিন, মাস, বর্ষ আদির দ্বারা "ওম্" রশ্মির স্পন্দনকেই মাপি। এই কারণে বর্তমান ভৌতিকবিদ্ সীজিয়ম ১৩৩ এটমের দুই অতি সূক্ষ্ম স্তরের মধ্য বিকিরণের ৯,১৯,২৬,৩১,৭৭০ সংক্রমণের অবধিকে এক সেকেণ্ড মানে। বর্তমান সময়ের সবথেকে সূক্ষ্ম মাপ প্লাঙ্ক সময়কে ধরা হয়, সেটা ৫.৩৯১×১০^-৪৪ সেকেণ্ডের সমান হয়। না কেবল "ওম্" রশ্মির স্পন্দন, অপিতু প্রাণাপানাদির স্পন্দনের অবধিও প্ল্যাঙ্ক সময় থেকে ন্যুন হয়। এই কারণে এই স্পন্দনকে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা কখনও মাপা যাবে না।
.
এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব ঘটনা হচ্ছে, সেইসব বিভিন্ন প্রকারের গতির কারণে হচ্ছে। সেইসব গতির মূল কারণই হল কাল অর্থাৎ "ওম্" রশ্মির স্পন্দন। এই স্পন্দন থেকে অগ্রিম চরণের স্পন্দন, পুনঃ নানা প্রকারের কণা ও সংসারের গতি সব কালের কারণেই হচ্ছে। এই গতির কারণেই আমরা সময়ান্তরালকে মাপতে পারি। দুই ঘটনার অন্তরালই সময়ের কোনো মাপ হয়, কারণ ঘটনার মূল উত্তরদায়ী কাল হয়, এই কারণে সংসারের মধ্যে সময়ান্তরাল বা সময়কে কাল নাম দেওয়া হয়। কালের মধ্যে তমোগুণের অভাব হওয়ার কারণে এর রশ্মি ক্রমাগত সমান লয়ে গমন করতে থাকে। এরমধ্যে কখনও উত্থান-পতন হয় না। কাল সব পদার্থকে ক্ষীণ করতে থাকে আর ক্ষীণতার মাত্রাকেও কালের মধ্যে মাপা হয়। ক্ষীণতা-নবীনতা, শীঘ্রতা-চিরকারিতা, পূর্ব-পশ্চাৎ, এই লক্ষণ সমস্ত গতিমান পদার্থের মধ্যে ঘটে অর্থাৎ সব কালের কারণেই সম্ভব হয়। এই কারণে এই লক্ষণ গুলোকে কালের লক্ষণ বলা হয়।
মহত্, অহংকার ও মন
এই কাল তত্ত্ব সর্বপ্রথম যে তত্ত্বকে উৎপন্ন করে, তাকে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে "প্রজাপতি" বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি মহত্ বা মনস্তত্ত্বকেও প্রজাপতি বলা হয়েছে। এই বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
প্রজাপতয়ে মনবে স্বাহা (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৪.১.৯.১, মৈত্রায়ণী সংহিতা ২.৭.৭), প্রজাপতির্বাব মহান্ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ৪.১০.২), প্রজাপতির্বৈ মনঃ (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ১০.১, ২৬.৩; শতপথ ব্রাহ্মণ ৪.১.১.২২), মন ইব বৈ প্রজাপতিঃ (কাঠক সংহিতা ৩১.১৫, ৩৫.১৭), মহদ্রূপো বৈ প্রজাপতিঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.১২)
.
এই সব প্রমাণ দ্বারা মহত্তত্ত্ব এবং মনস্তত্ত্বের প্রজাপতি রূপ হওয়া সিদ্ধ হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে এটাই হল সেই প্রাথমিক পদার্থ, যেটা বল, ক্রিয়া আদির বীজরূপ তথা প্রকৃতির প্রায় অব্যক্ত ভাবযুক্ত হয় তথা সেটা বিকারকে প্রাপ্ত করে নানা পদার্থের রূপে প্রকট হয়। সুশ্রুত সংহিতার মধ্যে বলা হয়েছে -
তস্মাদব্যক্তান্মহানুৎপদ্যতে তল্লিঙ্গ এব (শারীরস্থানম্ ১.৪)
.
অর্থাৎ মহত্তত্ত্ব অব্যক্ত প্রকৃতির লক্ষণযুক্ত হয় অর্থাৎ অব্যক্তবৎই হয়। আমার মতে এটা সর্বথা অব্যক্ত হয় না। আমার মতের পুষ্টি পরে উদ্ধৃত মহাভারতের প্রমাণ থেকে হয়ে যাবে। সাংখ্যদর্শনে মহর্ষি কপিল মহত্, অহংকার এবং মন এই তিন পদার্থকে পৃথক-পৃথক বলেছেন। যদিও সাংখ্যদর্শনের [১.৩৬ (৭১)] সূত্র -
"মহদাখ্যমাদ্যম্ কার্য়ম্ তন্মনঃ"
.
থেকে এমনও সংকেত পাওয়া যায় যে এখানে মহত্ -কে মন বলা হয়েছে। আর আন্তরিক ইন্দ্রিয় রূপে যে মন আছে, সেটা হল এরথেকে পৃথক এর কার্যরূপ আগামী পদার্থ। মহত্ অর্থাৎ মনস্তত্ত্বকে বুদ্ধি নামও দেওয়া হয়েছে তথা এর লক্ষণ করে বলা হয়েছে -
"অধ্যবসায়ো বুদ্ধি" (সাংখ্যদর্শন ২.১৩)
এর অর্থ হল এটা ক্রমাগত প্রচেষ্টা করার ধর্মযুক্ত হয়। মহত্তত্ত্বের বিষয়ে ভগবান্ ব্রহ্মা বলেছেন -
অব্যক্তাৎপূর্বমুৎপন্নো মহানাত্মা মহামতিঃ।
আদির্গুণানাম্ সর্বেষাম্ প্রথমঃ সর্গ উচ্যতে।।১।।
মহানাত্মা মতির্বিষ্ণুর্জিষ্ণুঃ শম্ভুশ্চ বীর্য়বান্।
বুদ্ধিঃ প্রজ্ঞোপলব্ধিশ্চ তথা খ্যাতির্ধৃতিঃ স্মৃতিঃ।।২।।
(মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, অনুগীতাপর্ব অধ্যায় ৪০)
.
এখানে মহত্তত্ত্বের অনেক সমার্থক শব্দের উল্লেখ আছে, যার ব্যাখ্যা আমি নিম্নানুসারে করবো -
১. মহান্ - অত্যন্ত ব্যাপক তাই একে মহান্ বলা হয়।
২. আত্মা - এটা সৃষ্টির সব জড় পদার্থের ভিতরে আত্মার সমান বিচরণ করে তাই একে আত্মা বলে।
৩. মতিঃ - [মন্যতে ইতি কান্তিকর্মা (নিঘণ্টু ২.৬), মন্যতে ইতি অর্চতিকর্মা (নির্ঘণ্টু ৩.১৪)] এই পদার্থ সূক্ষ্ম, কিন্তু ব্যাপক বল তথা অতি মন্দ অব্যক্ত দীপ্তিযুক্ত হয়। এই পদার্থের মধ্যে বাক্ তত্ত্ব অর্থাৎ সূক্ষ্মতম "ওম্" রশ্মি একরস হয়ে ব্যাপ্ত বা বিচরণ করে, এই কারণে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বাক্ তত্ত্বকেও মতি বলেছেন আর লিখেছেন -
"বাগ্বৈ মতির্বাচা হীদম্ সর্বম্ মনুতে" (শতপথ ব্রাহ্মণ ৮.১.২.৭)
৪. বিষ্ণুঃ - [বিষ্ণুঃ = ব্যাপ্তুশীলম্ বিদ্যুদ্রূপাগ্নিঃ (তুলনা মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ১২.৫), যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৯.৩.৯)] এই মহত্তত্ত্বই সর্বপ্রথম সংযোগ-বিয়োগাদি গুণযুক্ত হয়ে বিভিন্ন পদার্থের নির্মাণ প্রারম্ভ করে। ঋষি দয়ানন্দের দৃষ্টিতে সম্ভবত কারণ বিদ্যুৎও এটাই হয়, যেটা একরস প্রকৃতি অবস্থার কিঞ্চিৎ বিক্ষুব্ধ রূপে বিদ্যমান হয়।
৫. বিষ্ণুঃ - এই পদার্থ সব পদার্থকে নিয়ন্ত্রিত করার স্বভাবের হয় অর্থাৎ কিঞ্চিৎ ব্যক্ত বলের উৎপত্তি সর্বপ্রথম এখানেই হয়।
৬. শম্ভুঃ - এই পদার্থ সৃষ্টির বিভিন্ন অবস্থাতে উৎপন্ন ক্ষোভকারী অনিষ্ট রশ্মি আদি পদার্থকে শান্ত করতে অন্তিম ভূমিকা পালন করে।
৭. বীর্যবান্ - এই পদার্থ বিভিন্ন পদার্থের উৎপত্তি প্রক্রিয়ার বীজারোপণ করে।
৮. বুদ্ধি - এই তত্ত্বের কারণেই প্রাণীদের মধ্যে নিশ্চয় করার সামর্থ্য প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ যে প্রাণীর ভিতরে এই তত্ত্বের যত অধিক ভাগ বিদ্যমান হবে, সেই প্রাণী ততই অধিক বিচার শক্তি সম্পন্ন হবে।
৯. প্রজ্ঞা - এর কারণে প্রাণী প্রকৃষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন হয়।
১০. উপলব্ধিঃ - এই পদার্থ নিজের নিকটস্থ পদার্থকে গ্রহণ করার স্বভাবের হয়।
১১. খ্যাতিঃ - জড় পদার্থ যেন এখান থেকেই প্রকটাবস্থাতে আসা প্রারম্ভ করে অর্থাৎ প্রকৃতির অব্যক্তাবস্থা ভঙ্গ হয়ে যায়।
১২. ধৃতিঃ - এই পদার্থ সব পদার্থকে ধারণ করতে সক্ষম হয়।
১৩. স্মৃতিঃ - [স্মৃতিঃ = স্মৃ প্রীতিসেবনয়োঃ, প্রীতিচলনয়োর্বা] এর কারণেই প্রত্যেক পদার্থ সংরক্ষিত ও গতিশীল থাকতে পারে। সেটা নিজের প্রতিরক্ষামূলক স্বভাবেরও হয়। এই কারণে প্রাণী স্মরণ শক্তিযুক্ত হয়।
.
অহংকার তত্ত্বের বিষয়ে ভগবান্ ব্রহ্মা বলেছেন -
য় উৎপন্নো মহান্ পূর্বমহঙ্কারঃ স উচ্যতে।
অহমিত্যেব সম্ভূতো দ্বিতীয়ঃ সর্গ উচ্যতে।।১।।
অহঙ্কারশ্চ ভূতাদির্বৈকারিক ইতি স্মৃতঃ।
তেজসশ্চেনা ধাতুঃ প্রজাসর্গঃ প্রজাপতিঃ।।২।।
দেবানাম্ প্রভবো দেবো মনসশ্চ ত্রিলোককৃৎ।
অহমিত্যেব তৎসর্বমভিমন্তা স উচ্যতে।।৩।।
(মহাভারত আশ্বমেধিক পর্ব, অনুগীতাপর্ব, অধ্যায় ৪১)
.
অর্থাৎ পূর্বোৎপন্ন মহত্তত্ত্বকেই সেই সময় অহংকার বলে, যখন এটা নিজের প্রকটাবস্থা রূপে দ্বিতীয় সৃষ্টির রূপ ধারণ করে। এই তত্ত্বই পঞ্চমহাভূতের কারণ হয় তাই একে বৈকারিক বলে। এটা তেজের ধারণকর্তা ও আত্মা বা পরমাত্মার দ্বারা ধারণ করা হয়। এর থেকে নানা পদার্থ উৎপন্ন হয় তাই একে প্রজাপতিও বলা হয়। এর থেকে নানা দেব পদার্থ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণ, ইন্দ্রিয় ও মন (আন্তরিক ইন্দ্রিয়) এবং [লোকঃ = ছন্দাম্সি বৈ সর্বে লোকাঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.৩৩২), এবা বৈ ব্যাহৃতয় ইমে লোকাঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২.২.৪.৩)] ভূরাদি তিন ব্যাহৃতি ছন্দ রশ্মি রূপী লোক উৎপন্ন হয়, তার পাশাপাশি সব ছন্দ রশ্মি এর থেকেই উৎপন্ন হয়। এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি অহংকার রূপই হয় তথা তার দ্বারাই বিভিন্ন কামনা অর্থাৎ আকর্ষণাদি বলযুক্ত হয়। এইজন্য মহর্ষি কপিল বলেছেন -
"অভিমানোऽহঙ্কারঃ (সাংখ্যদর্শন ২.১৬)
অহংকারের ভেদ
[অভিমানঃ = অভি+মন্ = কামনা করা, লালায়িত হওয়া, আঘাত করা বা আঘাত করার চেষ্টা করা - আপ্টেকোশ] এর তাৎপর্য হল এই পদার্থের মধ্যে সর্বত্র আকর্ষণ এবং ভেদক বল উৎপন্ন হয়ে ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন হতে থাকে। মহত্তত্ত্বের চরম রূপকেই অহংকার বলে, এর পুষ্টি মহর্ষি কপিলও করেছেন -
.
চরমোऽহঙ্কারঃ [সাংখ্যদর্শন ১.৩৭ (৬২)]
.
এই তত্ত্বের তিনটা প্রকার বলে মহর্ষি সুশ্রুত লিখেছেন -
তল্লিঙ্গাচ্চ মহতস্তল্লক্ষণ এবাহঙ্কার উৎপদ্যতে,
স ত্রিবিধো বৈকারিকস্তৈজসো ভূতাদিরিতি।।
(সুশ্রুত সংহিতা, শারীরস্থানম্ ১.৪)
.
অন্যদিকে মহর্ষি কপিলের কথন হল -
.
একাদশপঞ্চতন্মাত্রম্ তৎকার্য়ম্।
সাত্ত্বিকমেকাদশম্ প্রবর্ত্ততে বৈ কৃতাদহঙ্কারাত্।। (সাংখ্যদর্শন ২.১৭-১৮)
.
একে আরও স্পষ্ট করে মহর্ষি সুশ্রুত বলেছেন -
"তত্র বৈকারিকাদহঙ্কারাত্তৈজসসহায়াত্তল্লক্ষণান্যেবৈকাদশেন্দ্রিয়াণ্যুৎপদ্যন্তে ।। ভূতাদেরপি তৈজসসহায়াত্তল্লক্ষণান্যেব পঞ্চতন্মাত্রাণ্যুৎপদ্যন্তে। তদ্যথা-শব্দতন্মাত্রম্, স্পর্শতন্মাত্রম্, রূপ-তন্মাত্রম্, রসতন্মাত্রম্, গন্ধতন্মাত্রমিতি। তেষাম্ বিশেষাঃ শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধাঃ, তেভ্যো ভূতানি ব্যোমানিলানলজলোর্ব্যঃ, এবমেষা তত্ত্বচতুর্বিম্শতির্ব্যাখ্যাতা।।" (সুশ্রুত সংহিতা, শারীরস্থানম্ ১.৫,৭)
.
এরদ্বারা স্পষ্ট হয় যে অহংকার তত্ত্ব সত্ত্ব, রজস্ ও তমস্ -এর প্রাধান্যে ক্রমশঃ বৈকারিক, তৈজস এবং ভূতাদি নামক হয়। বৈকারিক অহংকার থেকে আন্তরিক ইন্দ্রিয় সঞ্জক মন এবং দশ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়, কিন্তু এই ক্রিয়াতে তৈজস অহংকারেরও যোগ থাকে। এর মানে হল ইন্দ্রিয় সত্ত্ব ও রজস্ প্রধান হয়। যদিও এখানে তমোগুণের কোনো উল্লেখ নেই, তবুও আমার মত হল কাল তত্ত্বের অতিরিক্ত সর্বত্রই তমোগুণের মাত্রা ন্যূনাধিক অবশ্যই থাকে, এই কারণে এখানেও তমোগুণের স্বল্প মাত্রার বিদ্যমানতা মানা উচিত। ধ্যাতব্য হল, তমোগুণের সর্বথা অবিদ্যমানতার কারণে যেকোনো পদার্থ সর্বদা গতিশীলই থাকবে। এই সৃষ্টির মধ্যে কাল তত্ত্বের অতিরিক্ত অন্য কোনো এমন জড় পদার্থ নেই, যেটা সর্বদা গতিশীল থাকে, এই কারণে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে তমোগুণের অতিন্যূন মাত্রায় বিদ্যমানতা আবশ্যক। অন্যদিকে তমোগুণ প্রধান ভূতাদি অহংকার থেকে তৈজস অহংকারের সহায়-সংযোগ দ্বারা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের চরণবদ্ধ শৈলী থেকে উৎপত্তি হয়। আমি এখানে সেই ক্রমের বর্ণনা এখন করছি না।
.
এখানে আমরা যদি অহংকার বা মহত্তত্ত্বের স্বরূপের উপর বিচার করি, তাহলে স্পষ্ট হয় যে বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিকল্পিত কোনো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদার্থই এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ আবেশ, দ্রব্যমান এবং স্পষ্ট ও প্রত্যাশিত গতিশীলতা আদির প্রাদুর্ভাব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষাতে এটাও না দ্রব্য, না ঊর্জা আর না স্পেস নামক আকাশ হবে। বৈদিক ভাষাতে একে দ্রব্য ও ঊর্জা দুটোই বলা যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানের ভাষাতে এই পদার্থ এখনও কল্পনাতীতই মানা যেতে পারে।
প্রশ্ন - প্রকৃতি পদার্থ থেকে মহত্, অহংকার বা মনের অবস্থা উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া কি? মন তথা মহত্ - অহংকারের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর - কাল তত্ত্ব সক্রিয় হতেই সম্পূর্ণ ত্রিগুণা প্রকৃতির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন করার জন্য ঈশ্বর তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির পরা অবস্থাকে অব্যক্ত ভাবে সর্বত্র সঞ্চারিত করতে থাকে অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রকৃতির মধ্যে কাল তত্ত্বের সঞ্চারণ হতে থাকে। এই সঞ্চারণ এমন হয় যে সত্ত্বাদি তিন গুণ সক্রিয় হয়ে ওঠে, এই অবস্থাকেই মহত্ বলে। "ওম্" -এর পরাস্বরূপ যখন সত্ত্ব ও রজস্ এই দুই গুণকেই সক্রিয় করে, তখন মূল প্রকৃতি কাল তত্ত্বের রূপ ধারণ করে আর যখন "ওম্"-এর পরারূপ, যেটা কাল তত্ত্ব রূপে বিদ্যমান থাকে, সেই সময় মূল প্রকৃতির তিন গুণকে সক্রিয় করে, তখন প্রকৃতি মহত্তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে একরস হয়ে ভরা থাকে অর্থাৎ এরমধ্যেও প্রায় কোনো উত্থান-পতন (ফ্লাকচুয়েশন) হয় না।
.
"ওম্" রশ্মির পরা অবস্থা সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে এক সাথে ব্যাপ্ত থাকে, যারফলে তিন গুণ সবথেকে সূক্ষ্ম রূপে সক্রিয় বা জাগ্রত হতে থাকে। এর ফলে সেই পদার্থের মধ্যে এমন ধীরতম দীপ্তি হয়, যেটা সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে অন্যত্র কোথাও হয় না। এই সৃষ্টির মধ্যে যেসব গভীর অন্ধকার আছে, তার থেকেও গভীর অন্ধকার মহত্তত্ত্বের মধ্যে হয়। মহত্ -এর চরমাবস্থা রূপ অহংকারও এমন অন্ধকার যুক্ত হয়। এরমধ্যে মহত্তত্ত্বের পূর্ণতা হয়। এই সময় পরারূপ "ওম্" রশ্মির অতিরিক্ত সব অক্ষর ব্যক্তাবস্থাকে প্রাপ্ত করে নেয়। যখন ঈশ্বরীয় প্রেরণায় সর্বতোব্যাপ্ত মহত্তত্ত্বের মধ্যে কাল তত্ত্ব অর্থাৎ পরা "ওম্" রশ্মির সঞ্চারণ হয়, তখন অক্ষর রশ্মি মিলিত হয়ে পদরূপ রশ্মির নির্মাণ করতে শুরু করে, মহত্ -এর এই অবস্থাকেই অহংকার বলে। অহংকারের মধ্যে সব পদরূপ রশ্মি পরা অবস্থাতেই বিদ্যমান থাকে। অহংকারকে অগ্রিম অবস্থা মনস্তত্ত্বে পরিবর্তিত করার জন্য ঈশ্বর দ্বারা "ওম্" রশ্মির পুনরায় সঞ্চারণ করানো হয়। এর ফলে সব পদরূপ রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত হয়ে ছন্দ রশ্মির নির্মাণ করতে থাকে। এই ছন্দগুলোও পরা অবস্থাতেই হয়।
.
এইভাবে সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্ব এমন অনন্ত সমুদ্র হয়, যার মধ্যে সব প্রকারের অক্ষর, পদ ও ছন্দ রশ্মি ব্যাপ্ত থাকে। ধ্যাতব্য হল, না তো সম্পূর্ণ প্রকৃতি মহতের (অক্ষর) মধ্যে, না সম্পূর্ণ মহত্ অহংকারের (পদ) মধ্যে আর না সম্পূর্ণ অহংকার মনস্তত্ত্বের (ছন্দ) মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এর পশ্চাৎ ঈশ্বরের প্রেরণায় কিছু পরা "ওম্" রশ্মি পশ্যন্তী "ওম্" রশ্মিতে পরিবর্তিত হওয়া শুরু করে। এই পশ্যন্তী "ওম্" রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সঞ্চারণের কারণে অন্য পরা রশ্মিগুলো পশ্যন্তী রশ্মিতে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। মনস্তত্ত্বের এই অবস্থাই প্রজাপতি নামে পরিচিত, কারণ এখানে মনস্তত্ত্ব সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে উৎপন্ন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
অনিরুক্তম্ হি মনঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৪.৪.৫), অনন্তম্ বৈ মনঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৬.১.১১), মনসা বাऽ ইদꣳ সর্বমাপ্তম্ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৭.৪.২২), বাক্ চ বৈ মনশ্চ দেবানাম্ মিথুনম্ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.২৩), মনসা হি বাগ্ধৃতা (কপিষ্ঠল সংহিতা ৩৭.৪), মনসো রেতো বাগ্বাচো রেতঃ কর্ম (ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.৩), অথো দ্বে এব ধুরৌ মনশ্চৈব বাক্ চ। মনসো হি বাক্ প্রজায়তে (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.৩২০)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে মনও মহত্তত্ত্ব বা অহংকারের মতো সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়। এটা নিজের থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক পদার্থকেও বাইরে ভিতর থেকে ব্যাপ্ত করে। এই পদার্থ "ওম্" রশ্মিকে পশ্যন্তী রূপের সঙ্গে মিথুন বানিয়ে তাকে নিজের সঙ্গে ধারণ করে থাকে। মনস্তত্ত্বের সার বাক্ অর্থাৎ "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ হয় তথা এই বাক্ তত্ত্ব থেকেই সব কর্ম উৎপন্ন হয় কিংবা ক্রিয়াশীলতা এই বাক্ তত্ত্বের সার হয়। বস্তুতঃ এই "ওম্" রশ্মির কারণেই মনস্তত্ত্ব সক্রিয় হয়। যদি মহত্তত্ত্ব বা মনস্তত্ত্বকে একটা সূক্ষ্ম ঊর্জার মতো ভেবে বিচার করা হয়, তাহলে এমন মনে হবে যে এই অদৃশ্য ও অগ্রাহ্য ঊর্জা নগণ্য শক্তির হয়, যেটা একরসবৎ সর্বত্র ভরে থাকে। এর রশ্মি প্রায় শূন্য কিংবা অত্যল্প আবৃত্তি এবং অনন্তের সমকক্ষ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যুক্ত হয়। এর ফলে এই তত্ত্বও প্রায় অচল রূপে সর্বত্র ব্যাপ্তবৎ থাকে। অন্যদিকে শরীরধারিদের মধ্যে যে মহত্, অহংকার ও মন আছে, সেটা ব্যষ্টি রূপ তীব্র গতিতে বিচরণকারী হয়। মনস্তত্ত্বের ভিতরে সব সংযোগ-বিয়োগ আদি ক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই প্রারম্ভ হয়। এই কারণে বলা হয়েছে -
.
ওমিতি বৈ স্বর্গো লোকঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.৩২)
.
অন্যদিকে ঋষিগণ স্বর্গলোকের ব্যাখ্যাতে বলেছেন -
.
এষ হ বৈ স্বর্গো লোকো য়দ্ য়জ্ঞায়জ্ঞীয়ম্ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.৪২৫), স্বর্গো বৈ লোকো য়জ্ঞঃ (কৌষীতকী ব্রাহ্মণ (১৪.১)
.
এর থেকে সংকেত পাওয়া যায় যে এই "ওম্" রশ্মি রূপ বাক্ তত্ত্বই মনস্তত্ত্বকে সর্গ প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করার যোগ্য করে তোলে অর্থাৎ তাকে সক্রিয় করে। এইজন্য মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন -
মনশ্চ হ বৈ বাক্ চ য়ুজৌ দেবেভ্যো য়জ্ঞম্ বহতঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৪.৪.১)
.
মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল -
বৃষা বা ঋষভো য়োষা সুব্রহ্মণ্যা, তন্মিথুনম্, তস্ম মিথুনস্য প্রজাত্যা ইতি।। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬.৩)
.
এখানে "বৃষা হি মনঃ" (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৪.৪.৩) এবং "বাগ্বৈ সুব্রহ্মণ্যা" (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬.৩) থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে বাক্ ও মনের যোগ দ্বারাই সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি হয়।
.
এইভাবে সেই সময় সম্পূর্ণ অবকাশরূপ আকাশ মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপের মিশ্রণ দিয়ে ভরে যায়। সেই সময় সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে পূর্বাপেক্ষা কিছু ব্যক্ত, কিন্তু মানব দৃষ্টিতে অব্যক্ত দীপ্তি ও সূক্ষ্মতম কম্পন বিদ্যমান হয়। এই অবস্থাও বর্তমান বিজ্ঞান দ্বারা পরিভাষিত দ্রব্য, ঊর্জা ও স্পেস থেকে ভিন্ন তথা তার পূর্বের হবে। এখানে মনস্তত্ত্ব আগামী পদার্থের উৎপত্তি হেতু সক্ষম হয়ে ওঠে। এই পদার্থের মধ্যে এখনও একরসতা ভঙ্গ হয়নি, কিন্তু হওয়ার জন্য অনুকূল স্থিতি হয়ে গেছে। ধ্যাতব্য হল, এই অবস্থা সমষ্টি বুদ্ধি, অহংকার ও মনেরই মানা উচিত। বিভিন্ন প্রাণীর অন্তঃকরণের রূপে যে বুদ্ধি, অহংকার ও মন আছে, সেগুলো এই সমষ্টি বুদ্ধি আদিরই অবয়ব রূপে বিদ্যমান হয়। যেভাবে সমষ্টি পদার্থের সম্বন্ধ ঈশ্বরের সঙ্গে হয়, সেইভাবে ব্যষ্টি পদার্থের সম্বন্ধও জীবাত্মার সঙ্গে হয়। ঋষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ১৭.৩২ মন্ত্রে সূত্রাত্মা বায়ুর পূর্বে যে দিব্য বায়ু উৎপন্ন হওয়ার চর্চা করেছেন, আমার মতে সেটাই হল মন বা অহংকার তত্ত্ব।
যখন
"ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা বাড়ে, সেই সময় প্রায় একরসবৎ মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন হতে থাকে। এই স্পন্দনই ভূরাদি ব্যাহৃতি রশ্মি এবং প্রাথমিক প্রাণের রূপ হয়। এই বিষয়ে মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস লিখেছেন -
"প্রজাপতিরকাময়ত প্রজায়েয় ভূয়ান্ স্যামিতি, স তপোऽতপ্যত, স তপস্তপ্ত্বেমম্ দ্বাদশাহমপশ্যদাত্মন এবাঙ্গেষু চ প্রাণেষু চ, তমাত্মান এবাঙ্গেভ্যশ্চ প্রাণেভ্যশ্চ দ্বাদশধা নিরমিমীত...।।" (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৪.২৩)
.
এই কণ্ডিকার বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যান পাঠক "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" গ্রন্থের মধ্যে দেখতে পাবেন। এখানে সংক্ষেপে চর্চা এই হল যে পরমাত্মা তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এক সাথে স্পন্দন উৎপন্ন করতে থাকে। এই ক্রিয়া অকস্মাৎ অতি তীব্র গতিতে হয়। এই স্পন্দনই ভূরাদি ব্যাহৃতি রূপ এবং প্রাণাদি প্রাণরূপ হয়। মহর্ষি ব্যাস প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে বলেছেন -
.
প্রাণঃ কম্পনাত্ (ব্রহ্মসূত্র ১.৩.৩৯), অণবশ্চ (ব্রহ্মসূত্র ২.৪.৭)
.
এই সূত্র থেকে স্পষ্ট হয় যে প্রাণ সূক্ষ্ম স্পন্দনকারী হয়। ঈশ্বর তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যেটা সর্বত্র একরসবৎ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মি দিয়ে এমন স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরে একসাথে তীব্র গতিতে একের-পর-এক সূক্ষ্ম-স্থূল তরঙ্গ উৎপন্ন করছে। সেইরূপ ঈশ্বর তাঁর শক্তি রূপ কালবাচী "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ বা অহংকার তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী তরঙ্গ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে। ধ্যাতব্য হল, যেকোনো পদার্থ থেকে অগ্রিম পদার্থ তৈরির সময় বড় মাত্রায় পদার্থ মূল রূপেই সুরক্ষিত থাকে, যেটা অগ্রিম প্রজন্মের পদার্থকে সংকুচিত করে তার থেকে অগ্রিম প্রজন্মের পদার্থের নির্মাণ ঈশ্বর, কাল তত্ত্ব এবং ওম্ রশ্মির দ্বারা প্রেরিত হয়ে করে। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই তরঙ্গ (রশ্মি) গুলো মূলতঃ চার প্রকারের হয় -
(অ) মূল ছন্দ রশ্মি
(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি
(স) মাস ও ঋতু রশ্মি
(দ) অন্য ছন্দ ও মরুদ্ রশ্মি
.
সব প্রকারের রশ্মি অক্ষর রূপ সূক্ষ্ম অবয়ব দ্বারা নির্মিত হয়। এই কারণে আমরা সর্বপ্রথম অক্ষর রূপ পদার্থের উপর বিচার করবো। এই বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
অক্ষরম্ বাঙ্নাম (নিঘন্টু ১.১১), তদ্ য়দক্ষরত্তস্মাদক্ষরম্ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৬.১.৩.৬), অক্ষরম্ ন ক্ষরতি, ন ক্ষীয়তে বা বাক্ ক্ষয়ো ভবতি, বাচোऽক্ষ ইতি বা (নিরুক্ত ১৩.১২), য়দ্বেবাক্ষরম্ নাক্ষীয়ত তস্মাদক্ষরয়ম্ অক্ষয়ম্ হ বৈ নামৈতৎ তদক্ষরমিতি পরোক্ষমাচক্ষতে (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ১.৭.২.২), মহত্তত্বাখ্যম্ (মহর্ষি দয়ানন্দ ঋগ্বেদ ভাষ্য ৩.৫৫.১)
.
এই প্রমাণগুলো থেকে সিদ্ধ হয় যে মহত্তত্ত্বই অক্ষর রূপ হয়। আমি পূর্বে লিখেছি যে প্রকৃতির মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি পরা রূপে উৎপন্ন হয়। তার পশ্চাৎ মহত্তত্ত্ব অক্ষর রূপে প্রকট হয় তথা মূল প্রকৃতির মধ্যে অক্ষর রূপ রশ্মিগুলো নিতান্ত অব্যক্তাবস্থায় বিদ্যমান থাকে। এমন মনে হয় যে কালের উৎপত্তির সময়ে সাম্যাবস্থাতেই অক্ষর রশ্মির বীজ রূপ অব্যক্ত রূপে প্রকট হয়, যা "ওম্" রশ্মির পরা রূপে সঞ্চারিত হতেই ব্যক্ত হয়ে যায়। এই রশ্মিগুলো পূর্ণরূপে কখনও অবিদ্যমান হয় না, তা সেটা মহাপ্রলয়াবস্থাই হোক না কেন। এই রশ্মিগুলো ছন্দ রূপ তখনই ধারণ করে, যখন এগুলো শব্দ রূপ ধারণ করে নেয়। এই অক্ষর রশ্মি দুই প্রকারের হয় -
১. স্বর - এই বিষয়ে বলা হয়েছে -
স্বয়ম্ রাজন্ত ইতি স্বরাঃ
(মহাভাষ্য ১.২.২৯.১ - বর্ণোচ্চারণ শিক্ষা থেকে উদ্ধৃত)
.
এই লঘু রশ্মিগুলো স্বয়ং প্রকাশিত হয়, কিন্তু এগুলো নিরন্তর লম্বা দূরত্ব পর্যন্ত গতিমান থাকতে পারে না। প্রশান্ত মনস্তত্ত্ব বা মহত্তত্ত্বের ভিতরে এগুলো অত্যন্ত লঘু (মৃদু) কম্পন, যা সর্বাধিক সূক্ষ্ম হয়, বিদ্যমান থাকে। এই অক্ষরগুলো ছন্দরশ্মির মতো বল, গতি বা প্রকাশের স্রোত হয় না, কিন্তু অন্য অক্ষর, বিশেষ করে ব্যঞ্জন রশ্মির সাথে মিলিত হয়েই ছন্দ রূপ ধারণ করতে পারে। এগুলো ব্যঞ্জনকে বহন করতে সক্ষম হয়। বস্তুতঃ মহত্তত্ত্বের মধ্যে স্বর রশ্মিকে কোনো ভাবেই পৃথক-পৃথক জানা সম্ভব নয়। স্বরের বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
স্বর বাঙ্নাম (নিঘন্টু ১.১১), প্রজাপতিঃ স্বরঃ (ষড্বিংশ ব্রাহ্মণ ৩.৭), অনন্তো বৈ স্বরঃ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ (১৭.১২.৩)
.
অর্থাৎ স্বর হল বাক্ তত্ত্বেরই অতি সূক্ষ্ম অংশরূপ, যা পরিণামে অনন্ত হয় আর এটাই সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থের জনক ও রক্ষক হয়। বস্তুতঃ এই রশ্মি স্বরূপ ব্যবহারকে প্রকট করে না। রশ্মি রূপ ব্যবহার সর্বপ্রথম "ওম্" ছন্দ রশ্মি থেকে প্রকট হতে পারে। স্বর রশ্মি হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত তিন প্রকারের হয়। এগুলো ক্রমশঃ উত্তরোত্তর দীর্ঘাকার হয়ে যায়। এই তিনটা পুনরায় উদাত্ত, অনুদাত্ত এবং স্বরিত তিন প্রকারের হয় অর্থাৎ এগুলো ক্রমশঃ তীব্র, মন্দ এবং মধ্যম শক্তিযুক্ত হয়। এইভাবে একটা স্বর নয় প্রকারের রূপে পাওয়া যেতে পারে। এই নয়টা স্বরও সানুনাসিক এবং নিরনুনাসিক ভেদ দ্বারা ক্রমশঃ বন্ধক হওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তি ও অধিক শক্তিযুক্ত হয়। এইভাবে একটা স্বর রশ্মি সর্বমোট আঠারো ভেদযুক্ত হতে পারে।
২. ব্যঞ্জন - এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
(মহাভাষ্য ১.২.২৯.১ - বর্ণোচ্চারণ শিক্ষা মহর্ষি দয়ানন্দ ভাষ্য থেকে উদ্ধৃত)
.
অর্থাৎ সেই অব্যক্ত সূক্ষ্মতম অবয়বও প্রকৃতি রূপ, পুনঃ প্রায় মহত্তত্ত্বেরই রূপ হয়, যা সর্বদা স্বরের উপর আশ্রিত অর্থাৎ সেগুলোর সাথেই সংযুক্ত হয়ে গতিশীল হতে পারে। মহতের মধ্যে অকস্মাৎ সূক্ষ্মতম স্ফোট রূপে প্রকট ব্যঞ্জন, যা এক স্থানে উৎপন্ন হয়ে থেকে যায়, সেটা কোনো স্বররূপী সূক্ষ্ম কম্পনের সাথে মিলিত হয়ে গতি, বল ও প্রকাশের অব্যক্ত রূপ যুক্ত হয়ে ওঠে। এটা স্বরের সাথে মিলিত হয়ে সূক্ষ্ম ছন্দের রূপ ধারণ করে নেয়। "ভূ" আদি ছন্দ রশ্মি হল এর উদাহরণ।
.
এখন আমি বিভিন্ন অক্ষরের বিষয়ে আরও কিছু তথ্যকে প্রকাশিত করতে চাইবো। সব বৈদিক পদ সার্থক হয় তথা প্রত্যেক পদের তার অর্থরূপ পদার্থের সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ থাকে। যখন প্রত্যেক পদ বা শব্দের তার বাচ্য কোনো পদার্থের সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ থাকে, তখন সেই পদের অবয়বরূপ অক্ষরও নিরর্থক হবে না। এই কারণে প্রত্যেক অক্ষরেরও নিজের অর্থরূপ পদার্থের সাথে নিত্য সম্বন্ধ সিদ্ধ হয়। এই অক্ষর বিজ্ঞানকে বিস্তার ভাবে জানার জন্য পাঠক আর্য বিদ্বান পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মা কৃত "বৈদিক সম্পত্তি" নামক গ্রন্থের স্বাধ্যায় করবেন, বিস্তারভয়ের কারণে আমি এখানে সেই বিষয়ের উপর বিস্তৃত লিখতে পারবো না। এই গ্রন্থের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা এবং দেবনাগরী লিপির গম্ভীর বিজ্ঞান প্রকাশিত হতে পারে। আমি পাঠকদের জানার জন্য সেই গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন অক্ষরের অর্থ সার রূপে উদ্ধৃত করছি -
.
অ - সব, পূর্ণ, ব্যাপক, অব্যয়, এক, অখণ্ড, অভাব, শূন্য।
ই - কারী (যেমন গৃহকারী) গতি, নিকট।
এ - গতি নয়, গতিহীন, নিশ্চল, পূর্ণ, অব্যয়।
উ - উপরে, দূরে, সেটা, তথা, আরও, আদি।
ও - অন্য নয়, সেটাই, অন্য কোনো না।
ঋ - সত্য, গতি, বাইরে।
লৃ - সত্য, গতি, ভিতরে।
ণ, ঞ, ন, ঙ - না, অভাব, শূন্য।
:, হ - নিশ্চয়, অন্ত, অভাব, সঙ্কোচ, নিষেধ।
ক - বাঁধা, বলবান, বড়, প্রভাবশালী, সুখ।
খ - আকাশ, ফাঁকা, খোলা, ছিদ্র।
গ - গমন, সরে যাওয়া, স্থান ত্যাগ করা, পৃথক হওয়া।
ঘ - বাধা, বিরতি, একাগ্রতা।
চ - আবার, পুনঃ, পরে, অন্য, অপর, ভিন্ন, অপূর্ণ, অঙ্গহীন, খণ্ড।
ছ - ছায়া, আচ্ছাদন, ছত্র, পরিচ্ছদ, অখণ্ড আদি।
জ - জন্ম হওয়া, উৎপন্ন হওয়া, নূতনত্ব, গতি।
ঝ - নাশ হওয়া।
ট - মধ্যম, সাধারণ, নির্বল, সঙ্কোচ, ইচ্ছা বিরুদ্ধ।
ঠ - নিশ্চয়, প্রগল্ভতা, পূর্ণতা।
ড - ক্রিয়া, প্রকৃতি, অচেতন, জড়।
ঢ - নিশ্চিত, নিশ্চল, ধারিত, চেতন।
ত - তলভাগ, নিচে, এইদিকে, আধার, এই পারে, কিনারা, অন্তিম স্থান।
থ - থেমে যাওয়া, আধেয়, উপরে, ওই পারে।
দ - গতি, দেওয়া, কম করা।
ধ - না দেওয়া, ধারণ করা, রেখে দেওয়া।
প - রক্ষা।
ফ - খুলে ফেলা, খোলা।
ৰ - প্রবেশ করা, ঢুকে যাওয়া, লুকোনো।
ভ - প্রকট, বাইরে, প্রকাশ।
য় - পূর্ণ গতি, ভিন্ন বস্তু।
র - দেওয়া, রমণ করা।
ল - নেওয়া, রমণ করা।
ব - অন্য, পূর্ণ ভিন্ন, অথবা, গতি, গন্ধ।
ষ - জ্ঞান, শ - প্রকাশ, স - সঙ্গে, শব্দ, সেটা।
ক্ষ - বন্ধ, জ্ঞান, অজ্ঞান, নির্জীব, নাশ, মৃত্যু।
ত্র - নিচে পর্যন্ত যাওয়া, সব দেওয়া, সব, সর্ব, সমগ্র।
জ্ঞ - অজন্মা, নিত্য, কর্ম, জ্ঞান।
ळ - বাণী।
.
৩. ওম্ - এরমধ্যে "অ", "উ" দুটো স্বর তথা "ম্" ব্যঞ্জনের যোগ আছে। যদিও "ম্" ব্যঞ্জন "অ" এবং "উ" এই দুটো স্বরের সাথে পৃথক-পৃথক সংযুক্ত হয়ে "ম" তথা "অম্" এবং "মু" তথা "উম্" ছন্দের নির্মাণ করতে পারে, কিন্তু "অ+উ" = "ও" -এর সাথে "ম্" সংগত হয়ে যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়, সেটা সর্বাধিক ব্যাপক বল ও গতি সম্পন্ন হয়। এর প্রভাব "ম্+অ+উ" = "মো" থেকে ভিন্ন হয়। এমন মনে হয় যে মহত্=অহংকার বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে যখন কোনো স্বররূপ কম্পন উৎপন্ন হয়, তার দ্রুত পশ্চাৎ ব্যঞ্জনরূপী কম্পন উৎপন্ন হয়ে সেই স্বরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ছন্দ তৈরি করে, সেই ছন্দ ওই ছন্দের থেকে অধিক শক্তিশালী এবং ব্যাপক হয়, যে ছন্দ প্রথমে ব্যঞ্জন এবং তার দ্রুত পশ্চাৎ উৎপন্ন স্বর ও ব্যঞ্জনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর তৈরি হয়। এই কারণে "অম্", "উম্", ছন্দ এবং "ওম্" ক্রমশঃ "ম", "মু" তথা "মো" -এর তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়।
.
আমার এমন মনে হয় যে পশ্যন্তী "ওম্" ছন্দ রশ্মির মধ্যে পরা "ওম্" রশ্মির মাত্রা অন্য যেকোনো দৈবী গায়ত্রী ছন্দের তুলনায় অধিক হওয়াতে এর ব্যাপকতা সর্বাধিক হয়। যদিও দীর্ঘ ছন্দের মধ্যে মনস্তত্ত্বের মাত্রা আরও অধিক হয়, কিন্তু সেগুলো অনেক সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মির যোগ হয়, অথচ "ওম্" তিন অক্ষরের যুগ্ম হয়েও আর একটা দৈবী গায়ত্রী ছন্দ রশ্মির রূপ হয়েও অক্ষর রূপ হয়। এই ছন্দ রশ্মির সঙ্গে "ওম্" বাচী ঈশ্বর তত্ত্বের সর্বপ্রথম এবং সাক্ষাৎ সম্বন্ধ হওয়াতেও এটা সর্বদা ঈশ্বর তত্ত্ব দ্বারা প্রেরিত হয়ে অন্য রশ্মিগুলোকে প্রেরিত করতে থাকে।
.
এই ছন্দের বিষয়ে জৈমিনী ঋষির কথন হল -
এতদ্ (ওমিতি) এবাক্ষরম্ ত্রয়ী বিদ্যা (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ১.৪.৪.১০) এতদ্ধ (ওমিতি) বা ইদম্ সর্বমক্ষরম্ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.১০), ওমিতি মনঃ (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ১.২.২.২), রস ওঙ্কারঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.৭৮)
.
এই বচনগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে এই ছন্দ রশ্মি সর্বাধিক সূক্ষ্ম, কিন্তু ব্যাপক হওয়াতে সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্বের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এটা অন্য সব রশ্মির রস অর্থাৎ বীজ রূপ হয়। সমস্ত প্রাণ এবং ছন্দ রশ্মি এর থেকেই উৎপন্ন ও প্রেরিত হয়। এই রশ্মি মনস্তত্ত্বকে স্পন্দিত করে সব প্রকারের রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করে। এই রশ্মিই সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে যেমন উৎপন্ন করে, তেমনি বেঁধেও রাখে। এটা দৈবী ছন্দ রশ্মি হয়েও অক্ষর রূপ হয়, এটা হল এর বৈশিষ্ট্য।
.
এর বিষয়ে অন্য এক ঋষি খুব সুন্দর লিখেছেন -
ওমিত্যেতদক্ষরমিদঁ সর্বম্ তস্যোপব্যাখ্যানম্ ভূতম্ ভবদ্ ভবিষ্যদিতি। সর্বমোঙ্কার এব। য়চ্চান্যৎত্রিকালাতীতম্ তদপ্যোঙ্কার এব।। (মাণ্ডূক্য উপনিষদ্ ১)
.
এর মানে হল এই রশ্মি বিশেষ সক্রিয় অবস্থারূপ কালের উৎপত্তির পূর্বে থেকেই ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্যে নিতান্ত অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান থাকে। সম্পূর্ণ সৃষ্টি তারই বিস্তার বা রূপ হয়। মনস্তত্ত্বের মধ্যে এর পশ্যন্তী অবস্থা বিদ্যমান থাকে, অথচ মহত্ বা কালের মধ্যে পরা অবস্থা থাকে, এই ভেদ অবশ্য আছে। যদিও বাক্ তত্ত্ব য়োষা রূপ হয় তথা মন বৃষা রূপ হয়, কিন্তু আমার মতে "ওম্" রশ্মি রূপ বাক্ তত্ত্বের পরারূপ মনস্তত্ত্বের সাপেক্ষ বৃষা রূপ হয়, যা মনস্তত্ত্বকে বল প্রদান করে তাকে সক্রিয় রূপ প্রদান করে। এর পশ্চাৎ "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ মনস্তত্ত্বের সাপেক্ষ য়োষা রূপ হয়ে যায়।
.
এখন আমরা অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটা জানার চেষ্টা করবো যে "ওম্" রশ্মি সর্বাধিক ব্যাপক ও মূল রূপে বলবতী কেন হয়? এই রশ্মির মধ্যে "অ", "উ" এবং "ম্" এই তিনটা অক্ষর আছে। "অ" অক্ষরের উপরোক্তানুসারে "সব, পূর্ণ, ব্যাপক, অব্যয়, এক, অখণ্ড, অভাব এবং শূন্য অর্থ হয়। "উ" অক্ষরের অর্থ হল - দূর, উপরে আদি। আপ্টে সংস্কৃত-হিন্দি কোষের মধ্যে "উ" -এর অর্থ ব্রহ্মা দেওয়া হয়েছে তথা একে অব্যয় বলা হয়েছে। "মা" -কে পরিমাপ অর্থে ব্যাকরণবিদ্ জানেন। "ম" -এর উচ্চারণে মুখ বন্ধ হয়ে যায়, যেন "ম্" দিয়ে সম্পূর্ণ পদকে বেঁধে দেওয়া হয়। এইভাবে সারাংশতঃ "অ+উ+ম্=ওম্" -এর নিম্ন অর্থ প্রকট হয় -
.
মহত্ বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে উৎপন্ন এটা এক এমন স্পন্দন হয়, যেটা এতই সূক্ষ্ম হয়, যেন সেটা স্পন্দনই নয় কিংবা একে এইরূপ তরঙ্গ বলা যেতে পারে, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় অনন্ত হয়, তাহলে আবৃত্তি প্রায় শূন্য হয়। আমি একথা বর্তমান বিজ্ঞানের শৈলীতে বলেছি, বাস্তবিকতা হল একে অভিব্যক্ত করাই অসম্ভব, তবুও স্থূলরূপেণ আমাদের এমনই ধরে নেওয়া উচিত। এইভাবে বিজ্ঞানের ভাষাতে একে অত্যন্ত ক্ষীণ শক্তি সম্পন্ন, অব্যক্ত, সূক্ষ্মতম এবং সর্বপ্রথম প্রকট ঊর্জার রূপ বলা যেতে পারে। এতোটা প্রভাব কেবল "অ" অক্ষরের হয়। "উ"-এর প্রভাবে এই রশ্মি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত অকস্মাৎ প্রকট হয় তথা সমস্ত বল ও ঊর্জার উপর সূক্ষ্মতম রূপে অধিষ্ঠিত হয়। এর থেকে সূক্ষ্ম কোনো শক্তি হয় না, কারণ এর প্রাকট্য স্বয়ং সর্বোচ্চ চেতন সত্তা ঈশ্বর তত্ত্ব, যাঁকে আমরা ঊর্জা আদি শব্দের রূপে ব্যক্ত করতে পারি না, দ্বারা হয় তথা এটা নিরন্তর তাঁর সঙ্গে সর্বত্র প্রকট হতে থাকে, এই কারণে এটাও ঈশ্বরের মতো সর্বব্যাপক, সর্বশক্তিমান্, অব্যক্ত এবং সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক হয়।
.
ধ্যাতব্য হল, সূক্ষ্মতম ঊর্জাই স্থূল ঊর্জাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। বস্তুতঃ এই সূক্ষ্মতম ঊর্জা নিজের অনন্ত শক্তিসম্পন্ন ঈশ্বর তত্ত্ব রূপী চেতন ঊর্জা দ্বারা সর্বত্র নিরন্তর প্রেরিত হতে থাকে। "ম" -এর প্রভাবে এই রশ্মি অন্য সব রশ্মিকে নিজের সাথে বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়ে সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে বা মাপে রাখে। এর অভাবে সব রশ্মি বা কণা আদি পদার্থ তৎকালই ধ্বংস হয়ে মহাপ্রলয়ে পরিণত হয়ে যাবে। পণ্ডিত রঘুনাথ শর্মা "ও" -এর অর্থ "অন্য নয়, সেটাই, অন্য কোনো না" করেছেন, সেটা এখানেও পূর্ণরূপে সংগত হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে "ওম্" হল এমন রশ্মি, যেটা সর্বদা অনুপমেয় বা অদ্বিতীয়ই বজায় থাকে। এটাই ব্রহ্মের অদ্বৈতপন বলে যে তাঁর সমকক্ষ এই সৃষ্টি বা প্রলয়ে কোনো পদার্থ বিদ্যমান থাকে না। "ওম্" এই বাচক রশ্মি যে পদার্থকে বলে, সেই অর্থ রূপ অর্থাৎ বাচ্য রূপ ঈশ্বর পদার্থ প্রধানতঃ "ওম্"-কেই বলে, এই কারণে ঈশ্বরের এই নামটাই মুখ্য তথা বাকি নামগুলো গৌণ হয়। এর চর্চা ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী কৃত সত্যার্থ প্রকাশের প্রথম সমুল্লাসে সবিস্তারে করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, সেখানে "ওম্" রশ্মির চর্চা নেই।
.
অবগত থাকবেন, "ওম্" রশ্মিকে ঊর্জারূপ বলা তথা সেগুলোর আবৃত্তি প্রায় শূন্য বলাতে কোনো পাঠক এমন যেন কল্পনা না করে বসেন যে "ওম্" রশ্মি বিজ্ঞান দ্বারা সংজ্ঞায়িত ঊর্জার সমানই হবে। বস্তুতঃ সেই সময় প্রচলিত ঊর্জার জ্ঞাত গুণের সর্বথা অভাব থাকে। আমি ঊর্জার সঙ্গে তুলনা করে কেবল এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে এই রশ্মিগুলো সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ও সবার উৎপাদিকার রূপে বিদ্যমান থাকে। ধ্যাতব্য হল, "ওম্" রশ্মির তীব্রতা ও আবৃত্তি সর্বদা সমান থাকে না। সর্বোচ্চ সত্তা ঈশ্বর তত্ত্ব সৃষ্টির বিভিন্ন চরণে প্রয়োজনানুসারে এই রশ্মির তীব্রতার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। একে প্রায় শূন্য আবৃত্তি বলার তাৎপর্য হল এই রশ্মিগুলো সর্বোপরি ব্যাপ্তিসম্পন্ন হয়, তবুও তীব্রতাতে স্পন্দন প্রায়শঃই হতে থাকে।
এই
অক্ষর রশ্মিগুলোর উৎপত্তির পশ্চাৎ নিম্নলিখিত প্রাথমিক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় -
.
(অ) ব্যাহৃতি রশ্মি
১. ভূঃ - "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের উৎপত্তির দ্রুত পশ্চাৎ এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। এর বিষয়ে ঋষিরা বলেছেন -
ভূরিতি বা ঋচঃ (তৈত্তিরীয় অরণ্যক ৭.৫.২; তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ১.৫.৩) ভূরিতি বৈ প্রজাপতিঃ আত্মানমজনয়ৎ (শতপথ ব্রাহ্মণ ২.১.৪.১৩), প্রজাপতির্য়দগ্রে ব্যাহরত্ স ভূরিত্যেব ব্যাহরত্ স ইমাম্ (পৃথিবীম্) অসৃজত (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১০১)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বপ্রথম এই ব্যাহৃতি রশ্মির উৎপত্তি হয়। সক্রিয় মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা স্পন্দন হলে এই "ভূঃ" রূপ স্পন্দনের (রশ্মি) প্রাকট্য হয়। এই রশ্মি প্রজাপতি রূপই হয়, কারণ এর পশ্চাৎই অন্য রশ্মিগুলো প্রকট হতে থাকে। ব্যাহৃতি সংজ্ঞক হওয়াতে এই রশ্মি সম্পূর্ণ মনস্তত্ত্বের মধ্যে ব্যাপক রূপে সবদিকে প্রকট হয়। যখন পৃথিবী তত্ত্ব বা অপ্রকাশিত কণার উৎপত্তি হয়, তখন সেগুলোতে এই রশ্মির প্রাধান্য থাকে। "ঋক্" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মি, যার চর্চা "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" গ্রন্থের মধ্যে অনেকত্র করা হয়েছে তথা আমি পরে এই অধ্যায়ের মধ্যেও করবো, তার ভিতরেও এর প্রাধান্য আছে কিংবা "ঋক্" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তিতে এই ব্যাহৃতি রশ্মির বিশেষ ভূমিকা থাকে। এই রশ্মি পদার্থের ঘনীভবনের প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করার গুণের কারণেই সূক্ষ্ম কণাকে উৎপন্ন করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
.
এখন আমরা অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই রশ্মির উপর আরও বিচার করবো -
.
এই রশ্মি "ভূস্" = ভ্+ঊ+স্, "ভূর্" = ভ্+ঊ+র্ তথা "ভূঃ" = ভ্+ঊ+:, এই তিন রূপে পৃথক-পৃথক পরিস্থিতিতে পাওয়া যেতে পারে। পূর্বোক্ত অক্ষর বিজ্ঞানের প্রকাশে এগুলোর প্রভাব ক্রমশঃ নিম্নানুসারে হয় -
.
(ক) ভূস্ - এটা দূর পর্যন্ত প্রকট ও প্রকাশিত হয়ে নানা রশ্মিকে নিজের সাথে সংগত করতে সক্ষম হয়। এটা সেই রশ্মিগুলোর বাইরে থেকে সেগুলোকে নিজের সাথে সংগত ও প্রকাশিত বা সক্রিয় করার হেতু শক্তি প্রদান করে। এটা এতদর্থ সেগুলোকে স্পন্দিত করতে থাকে।
.
(খ) ভূর্ - এটা দূর পর্যন্ত প্রকট ও প্রকাশিত হয়ে নানা রশ্মির সাথে বাইরে থেকে সংগত হয়ে ও সেগুলোকে প্রকাশিত করে সর্বত্র রমণ করাতে সহায়ক হয়। এই হেতু এটা নানা রশ্মিকে স্পন্দিত করে।
.
(গ) ভূঃ - এটা পূর্বোক্ত প্রভাব দর্শিয়ে সূক্ষ্ম বাধক রশ্মিকে নিষিদ্ধ করে ক্রিয়াকে নির্বাধ করে।
.
এই তিন রূপের স্পন্দনই ন্যূনাধিক সমান প্রভাব প্রদর্শিত করে। বৈদিক ছন্দের মধ্যে বিভিন্ন সন্ধিরও নিজের বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রভাব এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার উপর হয়, যাকে আমি এখানে দেখিয়েছি।
.
২. ভুবঃ - "ভূঃ" -এর পশ্চাৎ "ওম্" রশ্মির প্রেরণায় মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভুবঃ" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হওয়া প্রারম্ভ করে। এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
ভুবর্ ইতি য়জূম্ষি (কাঠক সংকলন ৪৭.৫ - ব্রা.উ.কো. থেকে উদ্ধৃত), ভুব ইত্যন্তরিক্ষম্ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৭.৫.১; তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১.৫.১) ভুব ইতি প্রজাম্ (প্রজাপতিরজনয়ত) (শতপথ ব্রাহ্মণ ২.১.৪.১৩)
.
এই বচনগুলো থেকে সিদ্ধ হয় যে এই রশ্মিগুলো "ভূঃ" রশ্মির প্রজারূপ হয় অর্থাৎ "ওম্" রশ্মি মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ভূঃ" রূপ স্পন্দনকে বিকৃত করে "ভুবঃ" রশ্মিকে প্রকট করে। কালান্তরে এই রশ্মিগুলো আকাশ (স্পেস) তথা য়জুঃ সংজ্ঞক রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করতে সর্বোপরি ভূমিকা পালন করে। আমরা স্পেস এবং য়জুঃ সংজ্ঞক রশ্মির চর্চা পরে করবো। আকাশ তত্ত্ব (স্পেস) নামক পদার্থ বিশেষের নির্মাণের সাথে-সাথে এই রশ্মিগুলো পদার্থকে প্রসারিত করতে সহায়ক হয়, যার ফলে অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে মহাভূত আকাশ তত্ত্ব প্রকট হতে থাকে।
.
এখন এই রশ্মির উপর পূর্বোক্ত অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করবো -
.
এই "ভুবঃ" রশ্মি ভ্+উ+ব্+অ+স্, ভ্+উ+ব্+অ+র্ এবং ভ্+উ+ব্+অ+:, এই তিন রূপে বিদ্যমান হতে পারে। এর স্বরূপ ক্রমশঃ নিম্মানুসারে হয় -
.
(ক) ভুবস্ = ভ্+উ+ব্+অ+স্। এটাও দূর-দূরান্ত পর্যন্ত প্রকট ও প্রকাশিত হয়ে অন্য রশ্মির সাথে বাইরে থেকে সংগত হয়ে সেগুলোকে সক্রিয় করে। এটা পূর্ব রশ্মি "ভূস্" থেকে ভিন্ন কিংবা বিপরীত গতিযুক্ত হয়। সম্ভবত এর গতি "ভূস্" -এর তুলনায় কিছু অধিক হয়। এটাও সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে।
.
(খ) ভুবর্ = ভ্+উ+ব্+অ+র্। এর প্রভাব প্রায় "ভুবস্" -এর সমান হয়, কিন্তু একটু অধিক রমণশীল হয়।
.
(গ) ভুবঃ = ভ্+উ+ব্+অ+: । এর প্রভাব প্রায় উপরোক্তবৎ হয়, কিন্তু বাধক সূক্ষ্ম রশ্মিকে নিষিদ্ধ করা হল এর অতিরিক্ত গুণ।
.
সারাংশতঃ এই তিনটা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রকট হয়, কিন্তু এগুলোর মূল প্রভাব সমানই হয়।
.
৩. স্বঃ - অন্তিমে তৃতীয় ব্যাহৃতি "স্বঃ" ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়। এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
স্বরিতি সামানি (কাঠক সংকলন ৪৭.৬ - ব্রা.উ.কো. থেকে উদ্ধৃত), স্বঃ স্বর্গোলোকোऽভবৎ (ষড্বিংশ ব্রাহ্মণ ১.৫) অন্তো বৈ স্বঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.২০), সুবরিত্যসৌ (দ্যু) লোকঃ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৭.৫.১; তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ১.৫.১)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে এই তিনটা ব্যাহৃতি রশ্মির মধ্যে অন্তিমে উৎপন্ন হয়। "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্তত্ত্বের মধ্যে "স্বঃ" রশ্মি রূপ স্পন্দন উৎপন্ন হয়। কালান্তরে তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) নির্মাণে এই রশ্মিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এর পাশাপাশি "সাম" সংজ্ঞক ছন্দ রশ্মির উৎপত্তিতেও এর বিশেষ ভূমিকা থাকে। "সাম" রশ্মি এবং তরঙ্গাণুর বিষয়ে পরে চর্চা করা হবে।
.
এখন পূর্বোক্ত অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর উপর বিচার করবো। এই "স্বঃ" রশ্মি স্+ব্+অ+স্, স্+ব্+অ+র্, স্+ব্+অ+:, এই তিন রূপে বিদ্যমান হতে পারে। এগুলোর স্বরূপ ক্রমশঃ নিম্বানুসারে হয় -
.
(ক) স্বস্ = স্+ব্+অ+স্। এটা পূর্বোক্ত দুই "ভূঃ" এবং "ভুবঃ" রশ্মিকে নিজের সাথে একসঙ্গে সংগত করে সেগুলোর মধ্যে গতিশীল থাকে আর এমন করে তিনটা রশ্মি "ভূঃ", "ভুবঃ" এবং "স্বঃ" বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির সাথে সংগত হয়ে সেগুলোকে সংগত ও শক্তিশালী করে তোলে।
.
(খ) স্বর্ = স্+ব্+অ+র্। এর প্রভাবও উপরোক্তানুসার হয়, কিন্তু গতিতে একটু বৃদ্ধি হয়।
.
(গ) স্বঃ = স্+ব্+অ+:। এর প্রভাবও পূর্ববৎ হয়, তবে এরমধ্যে বাধক সূক্ষ্ম রশ্মির নিষেধের সামর্থ্য বিশিষ্ট আছে।
.
সারাংশতঃ এই তিনটার প্রভাব একই হয় নানা পরিস্থিতি বা সন্ধিতে এগুলোর এই রূপ একে-অপরের মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। এই হল বৈদিক ভাষার এক আশ্চর্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞান। এই তিন ব্যাহৃতি রশ্মিকে দেবপত্নীও বলা হয়। "বেদবিজ্ঞান-আলোকঃ" গ্রন্থের মধ্যে অনেকত্র দেব পদার্থ এবং বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মির রক্ষিকা শক্তির রূপে এগুলোর ব্যবহার সম্বন্ধে পাঠক জানতে পারবেন। মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল -
"ইতানি হ বৈ বেদানামন্তঃশ্লেষণানি য়দেতা ব্যাহৃতয়ঃ..." (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৫.৩২)
.
অর্থাৎ এই রশ্মিগুলো বিভিন্ন বেদ-ঋচা রূপী ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর সংযুক্ত ও সুরক্ষিত রূপ প্রদান করতে সহায়ক হয়। এই তিন ব্যাহৃতি রশ্মি সক্রিয় মনস্তত্ত্ব দ্বারা প্রেরিত হয়ে সব ছন্দ রশ্মির বল, গতি আর তেজ আদি গুণকে সম্যক্ রূপে নিয়ন্ত্রিত করতে থাকে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি আর তারদ্বারা নির্মিত বিভিন্ন কণা, তরঙ্গ বা স্পেস আদি সব নির্বল বা নষ্ট হয়ে যাবে।
যদিও এই তিন রশ্মিকেই মুখ্য ব্যাহৃতির রূপে জানা যায়, তবুও প্রসঙ্গতঃ আমরা অন্য চার ব্যাহৃতিরও চর্চা করবো। আমি পূর্বে কাল তত্ত্বের বিবেচনায় এগুলোর চর্চা কালের সপ্তরশ্মি
বিশেষণের ব্যাখ্যাতে করেছি, এই কারণে বাকি চার ব্যাহৃতির বিবেচনা আবশ্যক প্রতিত হয়। সেই রশ্মিগুলো হল নিম্ন প্রকার -
৪. মহঃ - এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
মহ ইতি। তদ্ ব্রহ্ম। স আত্মা... মহ ইত্যন্নম্ (তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ১.৫.১-৩), য়জ্ঞো বৈ দেবানাম্ মহঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৯.১.১১)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে এই সূক্ষ্ম রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে বিচরণ করতে থাকে। এর পাশাপাশি এটা অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিকে পরস্পর সংযুক্ত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে। এখন অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর উপর বিচার করবো -
.
এই "মহঃ" রশ্মি ম্+অ+হ্+অ+স্, ম্+অ+হ্+অ+র্, ম্+অ+হ্+অ+:, এই তিন রূপে বিদ্যমান হতে পারে। এগুলোর স্বরূপ বা প্রভাব নিম্নানুসারে হয় -
.
(ক) মহস্ = ম্+অ+হ্+অ+স্। এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিকে সর্বতঃ পূর্ণ রূপে মাপার সাথে-সাথে সেগুলোকে সংগত ও সংকুচিত করে সেগুলোর মধ্যে বিচরণ করে।
.
(খ) মহর্ = ম্+অ+হ্+অ+র্। এটা অন্য ব্যাহৃতি রশ্মিকে ব্যাপকভাবে পরিমাপ করে এবং সংকুচিত করতে-করতে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত রমণ করে।
.
(গ) মহঃ = ম্+অ+হ্+অ+:। এটা উপরোক্ত প্রভাবের সাথে-সাথে বাধক রশ্মিগুলোকে প্রতিবন্ধিত করতে সহায়তা করে।
.
এই ভাবে এই ব্যাহৃতির তিন রূপ প্রায় সমান প্রভাব দেখিয়ে অন্য রশ্মিকে সমৃদ্ধ বা ব্যাপক করে তোলে।
.
(৫) জনঃ - এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
অন্তো বা এষা ঋদ্ধীনাম্ য়জ্জনঃ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ২.২.৯), জনꣳ বা এতদ্যজ্ঞস্য গচ্ছিত য়ৎ স্কন্দতি (মৈত্রায়ণী সংহিতা ১.৪.৯)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে এই রশ্মিগুলো অন্য ব্যাহৃতি রশ্মির সমৃদ্ধিকে পূর্ণতা প্রদান করে সম্পূর্ণ সংগমনীয় পদার্থ কিংবা ব্যাহৃতি তথা অন্য রশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে গমন করে সেগুলোর অবশোষণ করতে থাকে। এখন অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর উপর বিচার করবো -
.
এই "জনঃ" রশ্মি জ্+অ+ন্+অ+স্, জ্+অ+ন্+অ+র্ এবং জ্+অ+ন্+অ+:, এই তিন রূপে প্রকট হয়। এগুলোর প্রভাব নিম্নানুসারে হয় -
.
(ক) জনস্ = জ্+অ+ন্+অ+স্। এই রশ্মি অন্য রশ্মির মধ্যে সর্বতঃ প্রকট হয়ে সেগুলোকে সংগত করে অন্য ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন করে।
.
(খ) জনর্ = জ্+অ+ন্+অ+র্। এই রশ্মি প্রায় পূর্বোক্তবৎ প্রভাব দর্শায়, কিন্তু বিশেষ রমণশীল হয়। এর পাশাপাশি এটা অন্য রশ্মির মধ্যে বিশেষ উৎপাদকতার গুণ প্রদান করে।
.
(গ) জনঃ = জ্+অ+ন্+অ+:। এই রশ্মি প্রায় পূর্বোক্তবৎ প্রভাব দর্শিয়ে বাধক রশ্মিগুলোকে প্রতিবন্ধিত করতে বিশেষ ভাবে সক্ষম হয়।
.
এইভাবে এই তিন রশ্মির প্রভাব প্রায় সমান হয়। এগুলোর মাধ্যমে ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি প্রক্রিয়া বিশেষ সমৃদ্ধ হয়।
.
৬. তপঃ - এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
তপঃ স্বিষ্টকৃত্ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১১.২.৭.১৮), মনো বাব তপঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.৩৩৪), ব্রহ্ম তপসি (প্রতিষ্ঠিতম্) (গোপথ ব্রাহ্মণ উত্তরভাগ ৩.২)
.
এই বচনগুলো থেকে প্রকট হয় যে এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্ব দ্বারা বিশেষ সমৃদ্ধ হয় তথা বিভিন্ন সংগমন কর্মকে ভালো করে সম্পাদিত করতে সক্ষম হয়। এই রশ্মিগুলোর ভিতরে "মহঃ" রশ্মি প্রতিষ্ঠিত হয়ে অধিক ক্রিয়াশীল হয়।
.
এখন আমরা অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর তিন রূপের উপর নিম্নানুসারে বিচার করবো -
.
(ক) তপস্ = ত্+অ+প্+অ+স্। এই রশ্মি অন্য ব্যাহৃতি রশ্মির পৃষ্ঠ ভাগে কিংবা কিনারে উপস্থিত হয়ে সেগুলোর বহির্ভাগে ব্যাপ্ত বা সংগত হয়ে সেগুলোর রক্ষা করে।
.
(খ) তপর্ = ত্+অ+প্+অ+র্। এটা পূর্বোক্ত প্রভাব যুক্ত হয়ে বিশেষ সক্রিয় হয়।
.
(গ) তপঃ = ত্+অ+প্+অ+:। এটাও পূর্বোক্ত প্রভাবের সাথে-সাথে বাধক রশ্মিকে বিশেষ রূপে প্রতিবন্ধিত করে।
.
এইভাবে এই তিন রশ্মি প্রায় সমান প্রভাব দর্শিয়ে অন্য রশ্মিকে অধিক সক্রিয় এবং সক্ষম করে তোলে।
.
৭. সত্যম্ - এটা হল সপ্তম তথা অন্তিম ব্যাহৃতি রশ্মি। এর বিষয়ে ঋষিদের মত হল -
.
আপঃ সত্যে (প্রতিষ্ঠিতাঃ) (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩.৬; গোপথ ব্রাহ্মণ উত্তরভাগ ৩.২), সত্যেনৈব জয়তি (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪.৩.৮), সত্যম্ বৈ সুকৃতস্য লোকঃ (তৈত্তেরীয় ব্রাহ্মণ ৩.৩.৬.১১)
.
এই বচনগুলো থেকে সিদ্ধ হয় যে এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে সহজতা ও সুসজ্জিততা ধারণ করতে এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করতে সহায়ক হয়। এই রশ্মির দ্বারাই প্রাণাপানাদি রশ্মিকে ধারণ করা হয়।
.
এর অক্ষর বিজ্ঞান এই রকম প্রকট হয় -
সত্যম্ = স্+অ+ত্+য়্+অ+ম্। এই রশ্মি সব রশ্মির সাথে সংগত ও পূর্ণ ব্যাপ্ত হয়ে সেগুলোকে আধার প্রদান করে সেগুলোর বাহ্যিক ভাগে স্থির থাকে। এর পাশাপাশি পূর্ণ গতি প্রদান করে পরিমাপ করে।

অন্য দুটো সূক্ষ্ম রশ্মি

এই ব্যাহৃতি রশ্মির পশ্চাৎ প্রায় সেই স্তরের দুটো অন্য রশ্মি আরও উৎপন্ন হয় -
১. হিম্ - এই সূক্ষ্ম রশ্মি দৈবী গায়ত্রী রূপই হয়, এই কারণে এগুলোর প্রভাব ব্যাহৃতি রশ্মির মতো সূক্ষ্ম তেজ ও বল যুক্ত হয়। এই রশ্মিগুলো প্রায়শঃ বিভিন্ন ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর জুড়ে রাখতে সহায়ক হয়। এগুলোর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
বৃষা হিঙ্কারঃ (গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ৩.২৩), বজ্রো বৈ হিঙ্কারঃ (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ৩.২), এষ বৈ স্তোমস্য য়োগো য়দ্ধিঙ্কারঃ (তাণ্ড্য মহাব্রাহ্মণ ৬.৮.৬), রশ্ময় এব হিঙ্কারঃ (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ১.১১.১.৯), স (প্রজাপতিঃ) মন এব হিঙ্কারমকরোত্ (জৈমিনীয়োপনিষদ্ ব্রাহ্মণ ১.৩.৩.৫)
.
এই বচনগুলো থেকে সিদ্ধ হয় যে "হিম্" রশ্মি বৃষা রূপ হয়ে বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির মাঝে উপস্থিত হয়ে সেগুলোকে বল প্রদান করে সংগত রাখতে সহায়ক হয়। এই রশ্মিগুলো প্রজাপতি রূপ মনস্তত্ত্ব থেকে "ওম্" রশ্মির প্রেরণা দ্বারা উৎপন্ন হয়। এই রশ্মিগুলো বজ্র রূপ হয়ে দুটো ছন্দ রশ্মির মাঝে কোনো অনিষ্ট রশ্মির প্রবেশ করতে থামিয়ে দেয়, যারফলে সেই সংযোগযোগ্য ছন্দ রশ্মির বন্ধন দৃঢ় হয় বা বজায় থাকে।
.
এখন এর অক্ষরের বৈজ্ঞানিক স্বরূপের উপর বিচার করবো -
এই হিম্ রশ্মি "হ্+ই+ম্" -এর রূপ হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির মাঝে অতি নিকটতম থেকে উপস্থিত হয়ে কম্পন করে যেকোনো বাধক রশ্মিকে সেখানে আসতে প্রতিবন্ধিত করে। এই কারণে সেই ছন্দ রশ্মিগুলো পরস্পর নিরবচ্ছিন্ন রূপে সংগত ও সুদৃঢ় হয়ে বজায় থাকে।
.
২. ঘৃম্ - এই রশ্মিগুলোও উপরোক্তবৎ দৈবী গায়ত্রী ছন্দেরই রূপ হয়। এই রশ্মিগুলো এই সৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন পদার্থকে সেচন করে ঘৃত রূপকে উৎপন্ন করে। "ঘৃতম্" -এর বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
তেজো বা এতত্ পশূনাম্ য়দ্ ঘৃতম্ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৮.২০), ঘৃতমন্তরিক্ষস্য (রূপম্) (শতপথ ব্রাহ্মণ ৭.৫.১.৩), তেজো বৈ ঘৃতম্ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২.২.৯.৪; মৈত্রায়ণী সংহিতা ১.৬.৮), বজ্রো ঘৃতম্ (কাঠক সংহিতা ২০.৫), য়দধ্রিয়ত (ঘ্রিয়ত্- মৈত্রায়ণী সংহিতা) তদ্ ঘৃতম্ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২.৩.১০.১; মৈত্রায়ণী সংহিতা ২.৩.৪), ঘৃঙ্ঙ্করোত্ তদ্ ঘৃতস্য ঘৃতত্বম্ (কাঠক সংহিতা ২৪.৭)
.
ধ্যাতব্য হল, এখানে "পশুঃ" -র অর্থ ছন্দ ও মরুদ্ রশ্মি গ্রহণ করা উচিত। এই "ঘৃম্" রশ্মিগুলো "হিম্" রশ্মির মতো বজ্ররূপ তেজস্বিনী হয়ে বিভিন্ন রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের তেজস্বিতা দিয়ে তেজযুক্ত করে বাধক রশ্মি আদি পদার্থকে নষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত করে। কালান্তরে উৎপন্ন আকাশ (স্পেস) তত্ত্বের মধ্যে এই রশ্মিগুলোর প্রাচুর্য থাকে, যার কারণে স্পেসে বিদ্যমান বিভিন্ন ছন্দাদি রশ্মি অধিক তেজযুক্ত হয়ে স্পেসকেও অব্যক্ত তেজ যুক্ত করে। নানা প্রকারের পদার্থ এই রশ্মিগুলোকে ধারণ করে অপেক্ষাকৃত অধিক তেজ ও বল যুক্ত হতে থাকে অর্থাৎ এই রশ্মিগুলো সেগুলোর তেজ ও বলের সমৃদ্ধি করে। এই রশ্মিগুলো সব রশ্মি আদি পদার্থকে সেচন করতে থাকে।
.
এখন এর উপর পূর্বোক্ত অক্ষর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করবো -
.
এই "ঘৃম্" রশ্মি "ঘ্+ঋ+ম্" -এর রূপ হয়। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের উপর বাহ্যিক ভাগে একাগ্রতা পূর্বক নিজের বৃষ্টি করে সেগুলোতে সত্যের [সত্যম্ = সত্যম্ ব্রহ্ম (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৮.৫.১), প্রাণা বৈ সত্যম্ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৫.১.২৩), সত্যম্ বৈ হিরণ্যম্ (গোপথ ব্রাহ্মণ উত্তরভাগ ৩.১৭)] নিরন্তর সঞ্চারণ হতে সহায়ক হয় অর্থাৎ সেই রশ্মি ও কণা আদি পদার্থ নানা প্রাণ রশ্মির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাপক রূপে তেজস্বী হতে থাকে। এই রশ্মি হতে চলা ক্রিয়াগুলোকে বিশেষ রূপে উৎপ্রেরিত করার কাজ করে। এগুলোর স্বরূপও বজ্রতুল্য হওয়াতে এই সংকেত পাওয়া যায় যে এই রশ্মিগুলোও সূক্ষ্ম স্তরে বাধক পদার্থকে নষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত করার কাজ করে। এগুলোর সঘনতার কারণে আকাশ তত্ত্বেও সঘন হতে থাকে আর আকাশের সঘনতায় বাধক অসুর পদার্থ নিঃশক্ত হয়ে যায় অথবা পালিয়ে যায়। আকাশ তত্ত্ব যেসব পদার্থকে ধারণ করে, সেই ধারণ কর্মে এই রশ্মিরও ভূমিকা থাকে।

(ব) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি

উপরোক্ত সূক্ষ্ম রশ্মির পশ্চাৎ প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এগুলোর বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন -
অধ্রুবম্ বৈ তদ্যৎপ্রাণঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১০.২.৬.১৯)
.
অর্থাৎ সব প্রাণ রশ্মি কখনও স্থির থাকে না অর্থাৎ ক্রমাগত গমন করতে থাকে। সব প্রাণ রশ্মি ছন্দ রশ্মির তুলনায় বৃষা রূপ হয়ে সেগুলোর সাথে সংগত হয়ে সেগুলোকে প্রেরিত করে। সব প্রাণ রশ্মি অক্ষরেরই সম্প্রদায় হয়। প্রাণ তত্ত্ব, যার মধ্যে সব প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি সমাহিত হয়, তার বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
মনসা হি প্রাণো ধৃতঃ (কাঠক সংহিতা ২৭.১; কপিষ্ঠল সংহিতা ৪২.১), মনো বা অনু প্রাণাঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১৬), মনো বৈ প্রাণানামধিপতির্মনসি হি সর্বে প্রাণাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪.৩.২.৩), এষা হীদম্ দেবতা সর্বম্ প্রাণয়ত। তদ্ য়ৎ প্রাণয়ত তস্মাৎপ্রাণঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ৩.৩৭৭), তস্মাৎ সর্বে প্রাণা বাচি প্রতিষ্ঠিতাঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১২.৮.২.২৫), প্রাণ এব রজ্জুঃ প্রাণেন হি মনশ্চ বাক্ চাভিহিতে (কাণ্বীয় শতপথ ব্রাহ্মণ ৩.১.৪.২), প্রাণা রশ্ময়ঃ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩.২.৫.২), বাক্ প্রাণেন সম্হিতা (ঐতরেয় আরণ্যক ৩.১.৬), বাক্ চ বৈ প্রাণশ্চ মিথুনম্ (শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৪.১.২)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে প্রাণ তত্ত্ব, যেটা রশ্মি রূপ হয়, মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্" রশ্মির মিলন থেকেই প্রকট হয়। এটা মনস্তত্ত্বেরই বিকার হয় আর তারই দ্বারা ধারণ করা হয় তথা তারই অনুগমন করে। "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপ সর্বদা বিচরণ করে এই প্রাণ তত্ত্বকে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। এই প্রাণ রশ্মিগুলো রশ্মি রূপ হয় তথা বাক্ এবং মনস্তত্ত্ব উভয়কে ধারণ করে থাকে তথা বাক্ তত্ত্বের ("ওম্" রশ্মি এবং অন্য মরুদ্ বা ছন্দ রশ্মি) সাথে সর্বদা মিথুন বানিয়ে রাখে। "ওম্" রশ্মি ব্যতীত অন্য ছন্দাদি রশ্মি য়োষা তথা প্রাণ রশ্মি বৃষার কাজ করে। প্রাণ তত্ত্বের বিষয়ে মহর্ষি ব্যাস বলেছেন -
.
সপ্ত গতের্বিশেষিতত্ত্বাচ্চ (ব্রহ্মসূত্র ২.৪.৫), জ্যোতিরাদ্যধিষ্ঠানম্ (ব্রহ্মসূত্র ২.৪.১৪)
.
অর্থাৎ সাত প্রকারের গতির কারণে প্রাণ সাত প্রকারের হয়। আমার মতে এখানে প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয়েরই চর্চা করা হয়েছে। এগুলো হল মুখ্য প্রাণ। এরদ্বারা আমি এটা সিদ্ধ করতে চাইবো যে প্রাণ তত্ত্ব একটাই হয়, কিন্তু তার বিভিন্ন প্রকারের গতির কারণে বিভিন্ন ভেদ হয়ে যায়। এইসব প্রাণ রশ্মি প্রকাশ, বল আদি গুণের অধিষ্ঠান হয়। শাস্ত্রের মধ্যে অনেকত্র প্রাণ, অপান এবং ব্যানকে তিন মুখ্য প্রাণ মানা হয়েছে। বস্তুতঃ এই রশ্মিগুলো এগারো প্রকারের হয়। মনস্তত্ত্ব বা অহংকারের মধ্যে "ওম্" রশ্মি দ্বারা উৎপন্ন স্পন্দনের তীব্রতা, গতি এবং স্বভাব আদির ভেদ থেকে একটা প্রাণ তত্ত্বেরই এই এগারোটা রূপ হয়। এখানে আমি এই তিন প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে কিছু চর্চা করবো -
ঋতু সংজ্ঞক প্রাণ এমন সূক্ষ্ম প্রাণ হয়, যেটা সৃষ্টি উৎপত্তির প্রথম চরণে অহংকার বা মনস্তত্ত্ব রূপ অতি সূক্ষ্ম পদার্থের মধ্যে সর্বপ্রথম স্পন্দন রূপে উৎপন্ন হয়। শতপথ ব্রাহ্মণের⁷ অনুসারে "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ"-এর এক-একটা অক্ষর ঋতু সংজ্ঞা হয়। এগুলোর ঋতু সংজ্ঞা হওয়ার কারণ হল এগুলো এই সৃষ্টির মধ্যে বারংবার উৎপন্ন হয়ে সবাইকে ব্যাপ্ত করতে থাকে। এই এমন সূক্ষ্ম ঋতু সংজ্ঞক প্রাণ রশ্মি, যা একাক্ষরা বাক্ রূপে হয়, তার যজ্ঞ থেকে প্রাণ, অপান এবং ব্যান আদি প্রাথমিক প্রাণের উৎপত্তি হয়। যখন এমন সূক্ষ্ম ঋতু রশ্মির সংগতি হয়ে সেগুলো প্রবাহ রূপে মনস্ বা অহংকার তত্ত্বের মধ্যে বিচরণ করে, তখন সেগুলো প্রাণাপান আদি রূপে ব্যবহার করে।
.
প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণ ৬ সূক্ষ্ম ঋতু রশ্মির মিশ্রণ থেকে তৈরি হয়। এই ৬ সূক্ষ্ম ঋতু রশ্মির পৃথক-পৃথক এক-এক করে আবৃত্তি হয়। পুনঃ সেইসব ৬ ঋতু রশ্মি পরস্পর সংগত হয়ে যেকোনো সংযোগযোগ্য পদার্থের মধ্যে প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণকে ধারণ করায় অর্থাৎ এই ৬ রশ্মি ক্রমশঃ সংগত হওয়াতে যেকোনো পদার্থ প্রাণকে ধারণ করে। এরদ্বারা এটাও সিদ্ধ হয় যে প্রাণ রূপী প্রাথমিক প্রাণ এইসব ঋতু রশ্মির তুলনায় স্থূল হয়। প্রাণ তত্ত্বকে ৬ ঋতু রশ্মির সমান মানা উচিত। "ষড্ঋতুনা" এই দৈবী পংক্তি ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে ঋতু রশ্মিকে সংগত করে প্রাণ তত্ত্বকে উৎপন্ন করে।
.
"চত্বার ঋতুভিঃ" এই দৈবী ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি উৎপন্ন হয়ে চার-চার সূক্ষ্ম ঋতু রশ্মির চার সংযুক্ত রূপকে সংগত করে অপান তত্ত্বের উৎপত্তি করে কিংবা এই চার-চার ঋতু রশ্মির চার সংযুক্ত রূপই পরস্পর সংগত হয়ে যেকোনো পদার্থের মধ্যে অপান তত্ত্বকে উৎপন্ন করে ধারণ করায়। এক সাথে চার-চারটা ঋতু রশ্মির উৎপত্তি হয়ে চার আবৃত্তি হয়, যারদ্বারা সর্বমোট ১৬ টা ঋতু রশ্মির যোগ দ্বারা অপান তত্ত্বের উৎপত্তি হয়। এখানে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এখানে কোন-কোন চার ঋতু রশ্মি উৎপন্ন হয়? এই বিষয়ে আমার মত হল "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ" আর "সুবঃ" এরমধ্যে থেকে একটা "ওম্" অক্ষরকে সাথে নিয়ে অন্যের থেকে এক-একটা অক্ষর নিয়ে চতুরক্ষরা বাগ্ রশ্মি চার ঋতু সংজ্ঞক রশ্মির সংযুক্ত রূপ নিতে পারে। দ্বিতীয় বিকল্প এটাও সম্ভব যে ব্যাহৃতিগুলোকে এক-একটা ঋতু রশ্মি মানা হোক, তাহলে ওঙ্কার সহিত এগুলোর সংযুক্ত রূপ চার ঋতু রশ্মির রূপ নিতে পারবে।
.
একটা ঋতু সংজ্ঞক রশ্মি দুইবার আবৃত্তি আর তারপর পরস্পর সংযুক্ত হয়ে ব্যান প্রাণকে উৎপন্ন করে। দুইবার আবৃত্তি এই ঋতু রশ্মি "দ্বির্ঋতুনা" এই দৈবী বৃহতী ছন্দ রশ্মির উৎপন্ন হয়ে প্রেরণা করাতে পরস্পর সংগত হয়ে ব্যান প্রাণকে উৎপন্ন করে। এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে এই ঋতু রশ্মি কোনটা হবে? আমার মতে এর উত্তর হবে "ওম্" রূপী ঋতু রশ্মিই দুইবার সংগত হয়ে ব্যান প্রাণের রূপ ধারণ করে প্রাণ আর অপান আদির মধ্যে বিচরণ করতে-করতে সেগুলোকে পরস্পর সংগত রাখে।
.
"ঋতুনা", "ঋতুভিঃ" এবং পুনঃ "ঋতুনা" পদ দিয়ে প্রাণ, অপান আর ব্যানের পরস্পর সংগতি বজায় থাকে। এই বিষয়ে আমার মত হল সর্বপ্রথম "ওম্" অক্ষর দিয়ে ঋতু রশ্মির উৎপত্তি এক-এক করে প্রারম্ভ হওয়া, পুনঃ চার ঋতু রশ্মির সংযোগও "ওম্" দিয়েই প্রত্যেক বার প্রারম্ভ হওয়া আর শেষে "ওম্" -এরই দুইবার আবৃত্তি হওয়াতে এই "ওম্" অক্ষর রশ্মিই সবাইকে পরস্পর বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়। এই "ওম্" অক্ষরই সর্বত্র ব্যাপ্ত আছে। এইজন্য বলা হয়েছে - এতদ্ধ (ওমিতি) বা ইদম্ সর্বমক্ষরম্ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ২.১০), ওমিতি ব্রহ্ম, ওমিতীদꣳ সর্বম্ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৭.৮.১)। সম্পূর্ণ সৃষ্টি হল "ওম্" -এরই বিস্তার আর প্রকাশ। এইজন্য মাণ্ডূক্যোপনিষৎকার মহর্ষি খুব সুন্দর লিখেছেন -
ওমিত্যেতদক্ষরমিদꣳ সর্বম্ তস্যোপব্যাখ্যানম্ ভূতম্ ভবদ্ ভবিষ্যদিতি সর্বোমোঙ্কার এব। য়চ্চান্যৎত্রিকালাতীতম্ তদপ্যোঙ্কার এব।। (মাণ্ডূক্য উপনিষদ্ ১)
.
১. সূত্রাত্মা বায়ু - ঋষি দয়ানন্দ তাঁর য়জুর্বেদ ১৭.৩২ মন্ত্রের ভাষ্যতে "গন্ধর্ব" শব্দ থেকে সূত্রাত্মা বায়ুর গ্রহণ করেছেন তথা তার উৎপত্তি অন্য সব দশ প্রাণ রশ্মির থেকে পূর্বে হয়, এমন লিখেছেন। একে তিনি তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্য ৬.২১.৯ তথা য়জুর্বেদ ভাষ্য ২৭.২৫ মন্ত্রের ভাবার্থে "সর্বধরম্" তথা ঋগ্বেদ ভাষ্য ৫.৪৬.৩ মন্ত্রে "পালকম্" বিশেষণ যুক্ত বলেছেন। আমার মতে অনেক আর্ষ গ্রন্থের মধ্যে "আত্মা" পদ থেকে সূত্রাত্মা বায়ুও গ্রহণ করা যোগ্য আছে, কারণ এই বায়ু অন্য সব প্রাণ বা ছন্দাদি রশ্মির মধ্যে নিরন্তর গমন করতে থাকে। এর বিষয়ে বলা হয়েছে -
আত্মা বৈ দেবয়জনম্ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩.৮.৪; কপিষ্ঠল সংহিতা ৩৮.৬), আত্মা য়জমানঃ (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ১৭.৭; তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০.৬৪.১)
.
এই বচনগুলো থেকে সংকেত পাওয়া যায় যে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণ রশ্মি রূপী দেবগুলোকে পরস্পর সংগত করার বিশেষ গুণ যুক্ত হয়। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিরই হয়। তবে হ্যাঁ, "হিম্" রশ্মি অবশ্য দুটো ছন্দ রশ্মিকে পরস্পর সংগত করতে ভূমিকা পালন করে। "ওম্" রশ্মি সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে বাঁধে ও নিয়ন্ত্রণ করে। "ওম্" রশ্মির পশ্চাৎ সর্বাধিক ব্যাপকতা ও যোজনী বা যোজ্যতা এরই হয়।
.
এর নাম থেকেই স্পষ্ট হয় যে এই রশ্মি সূত্রবৎ সব পদার্থের মধ্যে বিচরণ করে তাদের বাঁধে ও সংগত করে। মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা এটা এমন অব্যক্ত স্পন্দন রূপে প্রকট হয়, যা পরস্পর একে-অপরের সাথে জালের সমান বোনা থাকে। এইজন্যই গ্রন্থকার বলেছেন -
.
"আত্মা বৈ সমস্তঃ" (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২.৪০)
.
অর্থাৎ সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিগুলো পরস্পর মিশ্রণের সমান প্রকট হয়ে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে সেগুলোকে পরস্পর মিশ্রিত করে। বিভিন্ন কণা আর লোকের পরিধির নির্মাণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির অনিবার্য ভূমিকা থাকে। এই রশ্মি না কেবল লোক বা কণার পরিধি নির্মাণে সহায়ক হয়, অপিতু বড় ছন্দ রশ্মিকেও বাঁধতে সহায়ক হয়। যখন দুই বা দুইয়ের অধিক কণার পরস্পর সংযোগ হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি সেই সংযুক্ত কণাকে একসাথে বেঁধে নেয়। সংযোগ-বিয়োগের প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার জন্য আকাশতত্ত্বকে সক্রিয় করতেও এর অনিবার্য ভূমিকা আছে।
.
যখন এই সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সঙ্গে ধনঞ্জয় রশ্মির মিলন হয়, তখন ধনঞ্জয় রশ্মির গতি কিছু কমে যায়। "বাক্" এই পদরূপী ছন্দ রশ্মির নামই হল সূত্রাত্মা বায়ু। এটাও "ওম্" রশ্মির মতো দৈবী গায়ত্রী ছন্দ হয়। বিভিন্ন রশ্মির সঙ্কোচনেও এর ভূমিকা থাকে। "তন্তু তন্বন্" (ঋগ্বেদ ১০.৫৩.৬) এখানে সূত্রাত্মা বায়ুর উপমা একটা সুতোর সঙ্গে করা হয়েছে, যেটা সব কণা বা রশ্মিকে একে-অপরের সাথে বোনা থাকে। সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি যখন ধনঞ্জয় রশ্মির সাথে মিশ্রিত হয়ে যায়, তখন সেগুলোর তীব্রতা বেড়ে যায়, অথচ ধনঞ্জয় রশ্মির গতি কিছু কম হয়ে যায়। পদার্থের তরলাবস্থাতে সূত্রাত্মা বায়ুর কারণে ঘুরতে থাকা ছন্দ রশ্মিগুলো প্রেরকের কাজ করে অর্থাৎ যেকোনো পদার্থের তরলাবস্থা এমনই ঘুরতে থাকা ছন্দ রশ্মির কারণে হয়। সূত্রাত্মা এবং ধনঞ্জয় রশ্মির সংযুক্ত রূপ বিভিন্ন পদার্থের পরিধি বা মর্যাদা বানাতে বৃহতী ছন্দ রশ্মির সাথে কাজ করে, এই কারণে যেকোনো পদার্থের পরিধিতে এগুলোর ঘনত্ব আছে। আকাশতত্ত্ব যেটা নিজের থেকে স্থূল সব পদার্থের মধ্যে সদা ব্যাপ্ত থাকে, সেই ব্যাপ্তির কারণও সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিই হয়। বিভিন্ন কণার সংযোগ আর তরঙ্গের সুপার-পজিশনের জন্য সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিও বিশিষ্টভাবে উত্তরদায়িনী হয়। এই সূক্ষ্ম রশ্মিগুলো বিভিন্ন ছন্দ রশ্মি থেকে শুরু করে আকাশতত্ত্ব পর্যন্ত সমস্ত সূক্ষ্ম কণা আর বিশালতম লোকের মধ্যে গুপ্ত রূপে ব্যাপ্ত থাকে।
.
এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির উৎকর্ষ কাল হয়, তখন সব রশ্মি আদি পদার্থের ঊর্জাতে ভারী বৃদ্ধি হতে থাকে আর সংযোগ-বিয়োগের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে হতে থাকে। এই সময় বিভিন্ন ছন্দ রশ্মির সাথে অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সংযোগ বিশেষ রূপে হওয়া শুরু করে , যার ফলে ছন্দ রশ্মিগুলো বিশেষ সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
.
এই রশ্মিগুলো এমন ভাবে উৎপন্ন হয় যে প্রত্যেক রশ্মির মধ্যে থেকে আরও সূক্ষ্ম রশ্মি উৎসর্জিত হয়ে একটা জাল তৈরি করে, এই কারণে সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি নিজের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখা রূপ সূক্ষ্ম রশ্মি=স্পন্দনের দ্বারাই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে নিজের সাথে তথা পরস্পর বেঁধে রাখে। এগুলোর সম্বন্ধ স্পেসের সাথে অনিবার্য এবং অতি নিকট হয়। এগুলো কোনো পদার্থের আকার প্রদান করতেও অনিবার্য ভূমিকা পালন করে।
___________________
⁷ দ্বৌ হি মাসা বৃতুঃ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৭.৪.২.২৯)
২. ধনঞ্জয় - মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মির দ্বারা সূক্ষ্ম স্পন্দন রূপে উৎপন্ন এই রশ্মি সূত্রাত্মা বায়ুর পশ্চাৎ প্রথম স্থান রাখে অর্থাৎ এর উৎপত্তি সূত্রাত্মা বায়ুর
দ্রুত পশ্চাৎ হয়। এই রশ্মিগুলো মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক তীব্র গতি যুক্ত স্পন্দন রূপে উৎপন্ন হয় তথা এগুলো সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিকেও স্পন্দিত করে প্রায় সেগুলোতে মিশ্রিত হয়ে যায়, কিন্তু কোথাও-কোথাও এগুলো কিছু ভিন্নতা সহিত অতি তীব্রতার সাথে গমন করে।
.
এই প্রাণ রশ্মির গতি প্রকাশের গতির তুলনায় চার গুণ অর্থাৎ প্রায় বারো লক্ষ কিমি প্রতি সেকেণ্ড হয়। এই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এর থেকে অধিক গতি কোনো পদার্থের হয় না। এই রশ্মির সংযোগ বা আচ্ছাদন দ্বারা যেকোনো রশ্মি বা কণা আদি পদার্থের গতি তীব্র হয়ে যায়। প্রকাশ বা যেকোনো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এই ধনঞ্জয় রশ্মির দ্বারাই টেনে নিয়ে আসা হয়, এই কারণেই সেগুলোর গতি ও শক্তি তীব্র হয়। নক্ষত্রের নির্মাণের প্রক্রিয়াতে কোস্মিক মেঘের মধ্যে কেন্দ্রের নির্মাণ প্রক্রিয়া ধনঞ্জয়, ব্যান এবং সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সংযোগ দ্বারা আকাশের সঙ্কুচন থেকে প্রারম্ভ হয়। সূত্রাত্মা এবং ধনঞ্জয় রশ্মির সাথে কিছু মরুদ্ রশ্মির মিলন দ্বারা মধ্যস্থ কণা (মিডিয়েটার পার্টিকল) উৎপন্ন হয়।
.
ধনঞ্জয় রশ্মি যখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সাথে মিশ্রিত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি অধিক বলবতী হয়ে ওঠে। সূত্রাত্মা এবং ধনঞ্জয়ের সংযুক্ত রূপ বৃহতী ছন্দ রশ্মির সাথে মিলিত হয়ে পদার্থকে আকার প্রদান করে। বিদ্যুতের বিভিন্ন ক্রিয়াকে তীব্রতা প্রদান করতে এগুলোর বিশেষ যোগদান থাকে। এই রশ্মিগুলো সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির সাথে মিশ্রিত হয়ে বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গের মাঝে কার্যরত বলের তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু সূত্রাত্মা বায়ুর সংযোগে ধনঞ্জয় রশ্মির গতিতে কিছু ন্যূনতা এসে যায়। এই রশ্মিগুলো যেমন বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ এবং তীব্রগামী সূক্ষ্ম কণার গতির কারণ হয়, তেমনই সূত্রাত্মা বায়ুর সাথে মিলিত হয়ে কণার অক্ষের উপর ঘূর্ণনেরও কারণ হয়।
.
এই রশ্মিগুলোর "ধনঞ্জয়" নাম একথার সূচক হয় যে এই রশ্মিগুলো নানা প্রকারের ধন রূপী কণাকে নিয়ন্ত্রিত করতে নিজের ভূমিকা পালন করে। "ধনম্" -এর বিষয়ে মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাসের কথন হল -
রাষ্ট্রাণি বৈ ধনানি (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৮.২৬)
অর্থাৎ এই প্রকরণে নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় ভাগে সংলয়নীয় কণাগুলোকেই "ধন" বলে। এই কণাগুলোর নিয়ন্ত্রণে ধনঞ্জয় রশ্মিরও ভূমিকা আছে। "ধন" -এর বিষয়ে অন্য ঋষিদের কথন হল -
ধনম্ ধিনোতীতি সতঃ (নিরুক্ত ৩.৯), বস্তুমাত্রম্ (মহর্ষি দয়ানন্দ য়জুর্বেদ ভাষ্য ৪০.১)
.
এখানে ঋষি দয়ানন্দ বস্তুমাত্রকে ধন বলেছেন। মহর্ষি য়াস্কের নির্বচনে "ধিনোতি" পদ "ধিবি প্রীণনার্থ" ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন আছে। এর অর্থ হল - সন্তুষ্ট হওয়া বা করা, নিকট যাওয়া বা আসা (সংস্কৃত ধাতু কোশ - পণ্ডিত য়ুধিষ্ঠির মীমাংশক)। এর তাৎপর্য হল "ধন" সেই কণা বা রশ্মিকে বলা যেতে পারে, যেগুলো সব প্রকারের কণা বা তরঙ্গের নিকটে গিয়ে কিংবা সেগুলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে সেগুলোকে তৃপ্ত করতে সহায়ক হয় অর্থাৎ সেই কণা বা তরঙ্গকে তাদের অভীষ্ট কর্মে সমুচিত বল প্রদান করে সহায়তা করে। আমার মতে প্রাণ রশ্মির স্তরে ব্যান রশ্মিগুলোই ধনবাচী মানা যেতে পারে। ধনঞ্জয় রশ্মিকে এই ব্যান রশ্মির উপপ্রাণ মানা হয়, এর কারণ হল এগুলো ব্যান রশ্মির নিকটে থেকে সেগুলোকে প্রত্যেক ক্রিয়াতে সহযোগিতা-বল প্রদান করে। এখানে "ধন" শব্দ দ্বারা "ওম্" রশ্মিরও গ্রহণ করা যেতে পারে, যার দ্বারা সংকেত পাওয়া যায় যে "ওম্" রশ্মিগুলো নিকটে থেকে মনকে স্পন্দিত করে, তখন ধনঞ্জয় রশ্মি উৎপন্ন হয়। এর দ্বারা স্পষ্ট হয় যে এই সৃষ্টির মধ্যে সর্বত্র এই রশ্মির ভূমিকা আছে।
.
৩. প্রাণ - সব প্রাথমিক প্রাণের মধ্যে এই প্রাণ রশ্মির স্থান সর্বোচ্চ মানা হয়। একথা এর নাম থেকেও সিদ্ধ হয় যে এর নাম দিয়েই সব প্রকারের প্রাণ রশ্মিকে গ্রহণ করা হয়। যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মি প্রকৃষ্ট বেগ ও বলে গমন করে, তখন এরফলে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন রূপে উৎপন্ন রশ্মিকে "প্রাণ" বলে। এরমধ্যে "প্র" উপসর্গ বিদ্যমান আছে, এই উপসর্গের বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
আ ইত্যর্বাগর্থে, প্র পরেত্যেতস্য প্রাতিলোম্যম্ (নিরুক্ত ১.৩), অন্তরিক্ষম্ বৈ প্র (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২.৪১), প্রাণো বৈ প্র (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২.৪০)
.
এই বচনগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে "আ" উপসর্গের নিকট অর্থের বিপরীত, যখন মনস্তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" রশ্মিগুলো দূর-দূরান্ত স্পন্দন উৎপন্ন করে, তখন প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণ রশ্মির উৎপত্তি হয়। এই প্রাণ রশ্মির দ্বারা আকাশ তত্ত্ব সামর্থ্যবান হয় অর্থাৎ এই রশ্মিগুলো কোনো কণা বা রশ্মিকে প্রাণ তত্ত্ব কিংবা বল প্রদান করে আকাশ তত্ত্বের মধ্যে যাতায়াতের প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করে। এর জন্য ঋষি দয়ানন্দ তাঁর বেদভাষ্যে নিম্নলিখিত বিশেষণের প্রয়োগ করেছেন -
প্রিয়ম্ (ঋগ্বেদ ৬.৫০.১), বহুভ্যঃ কারণেভ্য উৎপন্নঃ (ঋগ্বেদ ১.২.৯), সর্বমিত্রোবাহ্যগতিঃ (ঋগ্বেদ ১.১৫.৬)
.
এই বিশেষণগুলো থেকে প্রাণ রশ্মির নিম্নলিখিত গুণের সংকেত পাওয়া যায় -
.
এর মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য আছে। এটা অনেক কারণভূত পদার্থ সম্ভবত মন, "ওম্" রশ্মি, সূত্রাত্মা বায়ু এবং ধনঞ্জয় রশ্মির সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়। এটা সবার আকর্ষক হয়ে সবাইকে আকর্ষণ বল যুক্ত করে সেইসব কণা বা তরঙ্গের মধ্যে ভিতর থেকে বাইরে নিরন্তর সঞ্চারিত হতে থাকে।
.
অন্য ঋষিগণও প্রাণ রশ্মির বিষয়ে লিখেছেন -
ন বৈ প্রাণাত্ প্রেয়ঃ কিম্চনাস্তি (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.২৭২), প্রাণ এব সবিতা (গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ১.৩৩; শতপথ ব্রাহ্মণ ১২.৯.১.১৬), প্রাণো বৈ সবিতা (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১.১৯), ভূরিতি বৈ প্রাণঃ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৭.৫.৩; তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১.৫.৩)
.
এই বচনগুলোর তাৎপর্য হল প্রাণ নামক প্রাণ রশ্মির থেকে অধিক আকর্ষক বল যুক্ত অন্য কোনো রশ্মি এই স্তরের হয় না। এগুলোই বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গের প্রেরক এবং উৎপাদিকা হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে যেখানেই আকর্ষণ বলের অস্তিত্ব আছে, সেখানে এই বলের মূল কারণ রূপ এই তত্ত্বের অস্তিত্ব অবশ্যই বিদ্যমান আছে। এই রশ্মিগুলো "ভূঃ" ব্যাহৃতি রশ্মির সাথেও সাম্যতা রাখে, এই কারণে এগুলোর গুণের তুল্য গুণযুক্ত হয়। বিভিন্ন রাসায়নিক সংযোগ এবং নাভিকীয় সংযোজনের প্রক্রিয়াতে প্রাণ রশ্মির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এর উৎপত্তি ওম্ এবং সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মি থেকে হয়। বিভিন্ন কণা বা বিকিরণের মার্গকে নিরাপদ করতে অপান রশ্মির সাথে এরও সংযুক্ত ভূমিকা আছে। গুরুত্বাকর্ষণ বলের মধ্যে অন্য প্রাণ রশ্মির তুলনায় এর প্রাধান্য আছে।
.
৪. অপান - এই রশ্মি মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন এমন স্পন্দন হয়, যার গতি প্রাণ নামক প্রাথমিক প্রাণের তুলনায় ঠিক বিপরীত হয়। প্রাণ ও অপান দুটো রশ্মি একসাথে থেকেও পরস্পর বিপরীত দিশাতে স্পন্দিত হতে থাকে। এগুলোর স্বভাব সর্বত্র এমনই হয়। অপান শব্দ "অপ" উপসর্গপূর্বক "অন্" ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। এই উপসর্গের বিষয়ে মহর্ষি য়াস্কের কথন হল -
"সমিত্যেকীভাবম্ অপেত্যেতস্য প্রাতিলোম্যম্" (নিরুক্ত ১.৩)
এরদ্বারা প্রতিত হয় যে মনস্তত্ত্বের ভিতরে "ওম্" রশ্মি এমন স্পন্দন উৎপন্ন করে, যা বিভিন্ন স্পন্দনকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবযুক্ত হয়। এই কারণে অপান রশ্মি প্রতিকর্ষণ বলকে উৎপন্ন করার মূল কারণ হয়। এই রশ্মির বিষয়েও ঋষি দয়ানন্দ তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্য ১.২.৯ মন্ত্রের মধ্যে প্রাণ রশ্মির মতো "বহুভ্যঃ কারণেভ্যঃ উৎপন্নঃ" বলেছেন, এরদ্বারা এই দুই রশ্মির মধ্যে কিছুটা সমতা প্রতিত হয়। এই কারণে এই দুটো একসাথে থাকে ও গমন করে। এই রশ্মির বিষয়ে ঋষিদের কথন হল -
.
অপানেন বৈ প্রাণো ধৃতঃ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪.৫.৬),
অপানো বৈ য়ন্তোऽপানেন হ্যয়ম্ য়তঃ প্রাণো ন পরাঙ্ ভবতি (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২.৪০), প্রাণো বৈ দক্ষোऽপানঃ ক্রতুঃ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২.৫.২.৪), বহির্বৈ সন্তম্ প্রাণমুপজীবন্ত্যন্তঃ সন্তমপানম্ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.৩৭ - ব্রা.উ.কো. থেকে উদ্ধৃত)
.
এই বচনগুলো থেকে নিম্ন পরিণাম প্রাপ্ত হয় -
.
এই রশ্মি প্রাণ রশ্মির সাথে সর্বদাই জুড়ে থাকে, যেন এটা প্রাণ রশ্মিকে ধারণ করে থাকে। এখানে এই বিশেষত্ব আছে যে এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিকে পৃথক-পৃথক করার স্বভাবযুক্ত হয় আর এই কারণে এটা প্রতিকর্ষণ বলের জননী হয়, কিন্তু এই রশ্মি প্রাণ রশ্মিকে নিজের সাথে সংগত করে থাকে অর্থাৎ সেগুলোর প্রতি অপান রশ্মির মধ্যে আকর্ষণের ভাব থাকে। প্রাণ রশ্মি একে ত্যাগ করে কোথাও যেতে পারে না। প্রাণ রশ্মি বলপ্রধান তথা অপান রশ্মি ক্রিয়াপ্রধান হয়। প্রাণ রশ্মি কোনো কণা বা তরঙ্গকে ভিতর থেকে বাইরের দিকে তথা অপান রশ্মি বাইরে থেকে ভিতরের দিকে সঞ্চারিত হয়।
.
প্রশ্ন - আপনি প্রাণ রশ্মিকে বলপ্রধান তথা অপান রশ্মি ক্রিয়াপ্রধান বলেছেন, এর কারণ বা তাৎপর্য কি? অন্যদিকে আপনি প্রাণকে আকর্ষণ তথা অপানকে প্রতিকর্ষণ বলের কারণ বলেছেন, এই কারণে এই দুটো পরস্পর অসঙ্গত বিচার বলে মনে হচ্ছে।
.
উত্তর - প্রাণ রশ্মি সত্ত্ব প্রধান এবং অপান রশ্মি রজস্ প্রধান হয়। এই কারণে প্রাণ ও অপান রশ্মি ক্রমশঃ বল ও ক্রিয়া প্রধান হয়। বস্তুতঃ এই উভয় প্রকারের রশ্মি পরস্পর সংযুক্ত থাকে। কোথাও এগুলোর পৃথকতা দেখা যায় না। এগুলোর সংযুক্ত প্রভাবের কারণে প্রত্যেক পদার্থ বল এবং ক্রিয়া উভয় সম্পন্ন হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে প্রাণের প্রাধান্য তথা অপান গৌণ রূপে বিদ্যমান থাকে, তখন সেই পদার্থের মধ্যে আকর্ষণ বলের প্রাধান্য, কিন্তু ক্রিয়াশীলতা গৌণ হয়। যখন কোনো পদার্থের মধ্যে অপানের প্রাধান্য এবং প্রাণ গৌণ হয়, তখন সেই পদার্থের মধ্যে ক্রিয়াশীলতা প্রধান তথা বল ন্যূনতম হয়। এই সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত বল আকর্ষণ এবং প্রতিকর্ষণ উভয় রূপে বিদ্যমান আছে, কিন্তু গুরত্বাকর্ষণ বল কেবল আকর্ষণেরই প্রভাব রাখে। এই পরিস্থিতিতে এই বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মির প্রাধান্য তথা অপানের অপ্রাধান্য মানতে হবে। গুরুত্ব বলের মধ্যে বৃহতী এবং পংক্তি ছন্দ রশ্মি বিদ্যমান থাকে তথা প্রাণ রশ্মির বিষয়ে ঋষিগণ বলেছেন -
অথ বৈ হবিষ্পঙ্কতিঃ প্রাণ এব (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ১৩.২), প্রাণা বৈ বৃহত্যঃ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩.১৪), অথ বৃহতী য়োऽয়ম্ প্রাঙ্প্রাণঃ (জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.২৫৪), ভুব ইত্যপানঃ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৭.৫.৩; তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১.৫.৩)
.
এই বচনগুলো থেকে সিদ্ধ হয় যে বৃহতি ও পংক্তি ছন্দ রশ্মি প্রাণ প্রধান বা প্রাণ রশ্মির সমানই ব্যবহার করে। এরদ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে গুরুত্ব বলের মধ্যে প্রাণ রশ্মিই প্রধান হয়। সেখানে অপান রশ্মি অত্যন্ত ন্যূনতম মাত্রায় থাকে, যার প্রায় কোনো প্রভাব হয় না, এই কারণে গুরুত্ব বলে কেবল আকর্ষণের ব্যবহারই দেখায়। এইদিকে ক্রিয়াশীলতার দৃষ্টিতে বিচার করে দেখুন, তো দেখবেন যে পদার্থের মধ্যে যত অধিক গুরত্বাকর্ষণ বল কিংবা দ্রব্যমান হবে, সেটা ততই কম সক্রিয় হবে। এই দৃষ্টিতে এখানে অপান প্রাণের ন্যূনতা বা অবিদ্যমানতা সিদ্ধ হয়। অন্যদিকে গুরুত্ব বল রশ্মির মধ্যে কেবল আকর্ষণ বলের বিদ্যমানতা হয়, কিন্তু সেই রশ্মিগুলোতে ক্রিয়াশীলতা খুবই কম হয়, এই কারণে এগুলো অত্যন্ত কম আবৃত্তির হয় অর্থাৎ নির্বল হয়। ধ্যাতব্য হল, বলের মধ্যে প্রাণ তথা ক্রিয়ার মধ্যে অপানের প্রাধান্য আছে। এখানে অপ্রাধান্যের তাৎপর্য অত্যন্তাভাব নয়। বস্তুতঃ কিঞ্চিৎ মাত্রায় হলেও অপ্রধান পদার্থ বিদ্যমান থাকেই। এই রশ্মিগুলো "ভুবঃ" ব্যাহৃতি রশ্মির সাথেও সাম্যতা রাখার জন্য সেগুলোর গুণের তুল্য গুণযুক্ত হয়। বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মধ্যে এই রশ্মিগুলো প্রাণ রশ্মির তুলনায় অধিক হওয়ার কারণে এই তরঙ্গ নিরন্তর প্রবল বেগে গমন করতে থাকে।
চলবে
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ