জাতিবাদ ও ভগবান মনু - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

25 November, 2024

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

 

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

সম্পাদকীয়

বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হয়েছে আর নিরন্তর হয়ে চলেছে। একদা যে দেশকে তার চরিত্র, শিক্ষা, শাসন আদির দৃষ্টিতে আদর্শ মানা হতো, যার বিষয়ে স্বয়ং ভগবান্ মনু বলেছেন -
এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ ।
স্বম্ স্বম্ চরিত্রম্ শিক্ষেরন্পৃথিব্যাম্ সর্বমানবাঃ ।। (মনু.২.২০)
অর্থাৎ পৃথিবীতে থাকা সব মনুষ্য এই দেশের বিদ্বানদের থেকে আচরণ অর্থাৎ কর্তব্যের শিক্ষা গ্রহণ করবে।
.
আজ ভগবান্ মনুর সেই বিশ্ববিখ্যাত দেশ জাতি-ব্যবস্থার মতো অভিশাপের কারণে বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। দেশের নীতি নির্ধারকদের কাছে এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না। কিছু দেশদ্রোহী ও বিধর্মী লোক একে বাড়ানোর জন্য নিরন্তর নতুন-নতুন পরিকল্পনা করছে। "ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্...পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রোऽজায়ত" এই মন্ত্রের বাস্তবিক অর্থকে না জেনে আর মিথ্যা অর্থকে প্রচারিত করে বিধর্মীরা আগুনে ঘী দেওয়ার কাজ করছে।
অন্যদিকে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা ভগবান্ মনু প্রোক্ত বৈদিক বর্ণ-ব্যবস্থা, যা কিনা যোগ্যতা আর কর্মের উপর আধারিত ছিল, যার অনুসারে এখানকার সম্পূর্ণ শাসন ব্যবস্থা চলতো আর যার কারণে আর্যাবর্ত্তে (ভারত) সুখ ও শান্তির পরিবেশ ছিল। অজ্ঞানতার কারণে সেই আদর্শ বর্ণ-ব্যবস্থাকে না জেনে অথবা তার বিকৃতরূপের অধিক প্রচার হওয়ার কারণে অনেক সংগঠন ভগবান্ মনুর বিরোধী হয়ে গেছে।
.
এইসবের মূল কারণ হল - বেদমন্ত্রের যথার্থ স্বরূপকে না জানা। এই সবের উপর বিচার করার পর পূজ্য আচার্যশ্রী "ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্..." মন্ত্রের বৈজ্ঞানিক এবং আধ্যাত্মিক অর্থ সংসারের সম্মুখে নিয়ে আসার নির্ণয় করেন। এই লঘু পুস্তিকা মূলরূপে উপরোক্ত বেদ-মন্ত্রের উপর আধারিত। এতে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা কৃত ভাষ্যের আধিভৌতিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। তারসঙ্গে বর্ণ-ব্যবস্থার উপর ওঠা অনেক শঙ্কার সমাধানও এই পুস্তকের মধ্যে করা হয়েছে।
.
পুস্তকের অন্তিমে আরক্ষণ, জাতিবাদ ও নির্ধনতার স্থায়ী এবং সর্বোত্তম সমাধান দেওয়া হয়েছে। আমার সহধর্মিণী শ্রীমতি মধুলিকা আর্যা এই পুস্তকের সম্পাদন আর ঈক্ষ্যবাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এতদর্থ আমি তাকে ধন্যবাদই দিতে পারবো। পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, তারা যেন এই পুস্তকের আদ্যোপান্ত গম্ভীরতাপূর্বক পড়ে আর বর্ণ-ব্যবস্থার যথার্থ স্বরূপ হতে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেন, যাতে এই দেশ এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় সেই মহান আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়। এই আশার সঙ্গে...
- বিশাল আর্য

ভূমিকা


মনুষ্যকে সৃষ্টির সর্বোত্তম প্রাণী মানা হয় আর ঈশ্বর তাকে সর্বোত্তমই বানিয়েছে। যদিও এই সৃষ্টির মধ্যে লক্ষ-লক্ষ প্রকারের প্রাণী আছে, কিন্তু মনুষ্যের মতো মননশীল প্রাণী আর কেউ নেই এবং যদি কোনো পরগ্রহী প্রাণী অথবা অন্য গ্যালাক্সিতে থাকা প্রাণী মননশীল হয়, তাহলে বৈদিক দৃষ্টিতে তাকে মনুষ্যই বলা হবে। মহর্ষি য়াস্ক মনুষ্য পদের নির্বাচন করে লিখেছেন -
মত্বা কর্মাণি সীব্যন্তি (নিরুক্ত)
অর্থাৎ যে বিচার করে কাজ করে, তাকে মনুষ্য বলে।
.
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে অনেক চোর, ডাকু আদিও তো চিন্তা ভাবনা করেই চুরি আদি দুষ্কর্ম করে, কারণ বিনা ভেবে আর বিনা পরিকল্পনা করে তারা তাদের সেই দুষ্কর্মে সফল হবে না, তাহলে কি বৈদিক দৃষ্টিতে তাদেরও মনুষ্য বলা হবে? এই প্রশ্নের সমাধান করার জন্য ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "সব কাজ ধর্মানুসারে অর্থাৎ সত্য আর অসত্যের বিচার করে করা উচিত।" (আর্যসমাজের পঞ্চম নিয়ম)
.
এইভাবে এটা সিদ্ধ হল যে সত্য আর অসত্যকে বিচার করে যে প্রাণী তার সব কাজের সম্পাদন করে আর সেইরূপ তার জীবনশৈলী সম্পূর্ণরূপে সত্যের উপর আধারিত হয়, সেই প্রাণীকেই মনুষ্য বলে। এখন এখানে আরেকটা প্রশ্ন হল, সত্য কি? কিছু ব্যক্তির মত হল সত্য নিরপেক্ষ হয় না, বস্তুতঃ এটা হচ্ছে ভ্রম, কিন্তু সত্যকে জানা এতটা সহজও নয়। এই বিষয়ে দেবর্ষি নারদ বলেছেন -

সত্যস্য বচনম্ শ্রেয়ঃ সত্যজ্ঞানম্ তু দুষ্করম্ ।

য়দ্ ভূতহিতমত্যন্তমেতত্ সত্যম্ ব্রবীম্যহম্ ।।

(মহাভারত শান্তিপর্ব | মো.ধ.প. | অধ্যায় ২৬৯)

.
য়োগদর্শন ভাষ্যে মহর্ষি ব্যাস বলেছেন -
সত্যম্ য়থার্থে বাঙ্মনসে। য়থা দৃষ্টম্ য়থাऽনুমিতম্ য়থা শ্রুতম্ তথা বাঙ্মনশ্চেতি। পরত্র স্ববোধসম্ক্রান্তয়ে বাগুক্তা, সা য়দি ন বঞ্চিতা ভ্রান্তা বা প্রতিপত্তিবন্ধ্যা বা ভবেদিতি। এষা সর্বভূতোপকারার্থম্ প্রবৃত্তা ন ভূতোপঘাতায়। (য়োগদর্শন ২.৩০)
.
এই দুটো প্রমাণ থেকে তাৎপর্য এটাই বেরিয়ে আসছে যে যখন কোনো প্রাণী আত্মা, মন আর বাণীকে সংযত করে কথা বলে অর্থাৎ এদের মধ্যে পরস্পর কখনও অসংযতি বা বিরোধ হয় না, তাকেই সত্য বলে। এখানে কেবল সত্য কথা বলাই পর্যাপ্ত নয়, বরং তদনুকূল আচরণ হওয়াটাও অনিবার্য। একেই বেদ বলেছে -

স্বেন ক্রতুনা সম্বদেত।

তবে মনে রাখা উচিত যে মন, বাণী আর কর্মের সমতা তো সৃষ্টির সব প্রাণী আর পাগল ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়, কারণ তারা কখনও মিথ্যা বলে না, কিন্তু তাদের বলা বা করা যে সবার অথবা কারও হিতে হবে, তার সম্ভাবনা খুব কম। এইজন্য এদের সত্য বক্তা আর সত্যের উপর আচরণকারী বলাটা উচিত হবে না। মনুষ্যের গুণ এইভাবে নিশ্চিত হয় -
১. কথা বলার সময় আত্মা, মন, বুদ্ধি আর বাণী সব পূর্ণ সংযত হওয়া উচিত অর্থাৎ আত্মা, বুদ্ধি বা মনের প্রতিকূল কথা বললে সেটা অসত্য হবে।
২. এই সবের সংযতির পাশাপাশি তাদের সব কর্মও সেইরূপ হতে হবে।
৩. তাদের বিচার, তাদের বচন আর তাদের কর্ম সকল প্রাণীর জন্য হিতকারী হবে আর যেসব কর্ম তাদের ব্যক্তিগত হিতের জন্য হবে, সেটাও অন্য কোনো প্রাণীর জন্য কখনও অহিতকারী হবে না।
.
এই তিন মানদণ্ডের উপর যে প্রাণী দাঁড়াবে, তাকেই মনুষ্য বলবে। কেবল মনুষ্য-শরীরধারী হওয়া মাত্রই মনুষ্যতার লক্ষণ নয়। আজ সংসারে যদি সবথেকে বড় কিছুর অভাব থাকে তাহলে সেটা হল মনুষ্যতার প্রচণ্ড অভাব। পরমাত্মা তো সৃষ্টি রচনা করে মনুষ্যকে বলে দিয়েছেন -
তুভ্যেমা ভুবনা কবে মহিম্নে সোম তস্থিরে ।
তুভ্যমর্ষন্তি সিন্ধবঃ ।। (ঋগ্বেদ ৯.৬২.২৭)
অর্থাৎ - হে মনুষ্য! এইসব লোক-লোকান্তর তোমার জন্যই বিদ্যমান আর এই নদী ও সাগর তোমার জন্যই প্রবাহিত হচ্ছে। এমন প্রাণীকে "আর্য" বলা হয়েছে আর আর্যের পরিভাষাতে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন -
আর্য় ঈশ্বরপুত্রঃ
অর্থাৎ - যে ব্যক্তি ঈশ্বরের সব আজ্ঞা পূর্ণ রূপে পালন করে, তাকেই আর্য বলে আর সেই ঈশ্বরের আজ্ঞা কি? সেটাও বেদ স্পষ্ট করে দিয়েছে -
মনুর্ভব
অর্থাৎ - মনুষ্য হও। অন্যত্র বলেছে -
অহম্ ভূমিম্ অদদাম আর্য়ায়
অর্থাৎ - আমি এই ভূমি আর্যদের জন্য দিয়েছি। এইভাবে আর্য এবং মনুষ্য দুটো পদ সমানার্থক সিদ্ধ হল।
.
এইভাবে এটা স্পষ্ট হল যে বেদের দৃষ্টিতে সর্বহিতৈষী, সত্যপালক মনুষ্যকেই আর্য বলা হয়েছে আর আর্যকেই সৃষ্টির সম্পদ উপভোগ করার অধিকারী বলা হয়েছে। হিংসক, চোর, মিথ্যাবাদী, প্রতারক আর লম্পট আদি দোষ যুক্ত মনুষ্য-শরীরধারিদের পরমাত্মা প্রদত্ত সম্পদ উপভোগের অধিকার নেই। এইভাবে পৃথিবীর সব মনুষ্য শরীরধারী প্রাণী যদি সত্যিকারের মনুষ্য হয়, তাহলে এই পৃথিবীতে বিনা কারণে কোনো প্রাণীর দুঃখই হবে না।
.
বস্তুতঃ পরমেশ্বর এই সৃষ্টিকে সবার হিত সম্পাদন (সৃষ্টির ধর্মাধারিত ভোগ আর মোক্ষ) করার জন্য বানিয়েছেন। প্রারম্ভে ঈশ্বর অত্যন্ত শুদ্ধ আর স্বচ্ছ বায়ু, পবিত্র জল, পোষক তত্ত্বে ভরপুর শুদ্ধ ভূমি, অনিষ্ট বিকিরণ হতে রহিত আকাশ, শুদ্ধতম মনস্তত্ত্ব আর এইসব দ্বারা নির্মিত সুন্দর, পূর্ণ সুস্থ আর পবিত্র বনস্পতি আর আমাদের শরীর প্রদান করেছিলেন। কারও কোনো রকম কোনো দুঃখ হবে এমন কোনো কারণ তখন এই পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল না, কারণ সেই সময় সব মনুষ্যধারী প্রাণী পৃথিবীতে জন্মে ছিলমাত্র আর সত্যি কথা হল তারা মনুষ্যই ছিল, কিন্তু কোটি-কোটি বর্ষ পশ্চাৎ আজ এই পৃথিবীর কি দুর্দশা হয়েছে, সেটা কে না জানে? তিন প্রকারের দুঃখ - আধিদৈবিক, আধিভৌতিক আর আধ্যাত্মিক তথা সব প্রকারের দুঃখের তাণ্ডব এই পৃথিবীর উপর দেখা যাচ্ছে।
.
যদিও বিশ্বের সব দেশের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে কিন্তু সেই সবের কারণ একটাই প্রতীত হয় যে আমরা ঈশ্বরীয় ব্যবস্থার পালন করিনি। অন্য সব প্রাণী ঈশ্বর প্রদত্ত নিজের ধর্ম (স্বভাব) - কে ছাড়ে নি। তারা যখন থেকে এই পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছে তখন থেকেই নিজ-নিজ ধর্মের মর্যাদার একশ শতাংশ পালন করছে, কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী এই মনুষ্য তার সব মর্যাদাকে পুরোপুরি ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে। মনুষ্য সেই মর্যাদা থেকেও নিচে নেমেছে, যা কিনা ঈশ্বর পশু-পাখিদের জন্য নির্ধারিত করে ছিলেন, এই কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবীর প্রতিপালক এই মনুষ্য সম্পূর্ণ পৃথিবী আর তাতে থাকা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের দুঃখ আর বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদা দেবরাজ ইন্দ্র মহান সম্রাট মান্ধাতা-কে বলেছিলেন -
নির্মর্য়াদান্ নিত্যমর্থে নিবিষ্টানাহুস্তাম্স্তান্ বৈ পশুভূতান্ মনুষ্যান্।
(মহাভারত শান্তিপর্ব | রা.ধ.অ.প. | অধ্যায় ৬৫)
অর্থাৎ - মর্যাদাবিহীন মনুষ্য পশুর সমান হয়, কিন্তু পশুদের মর্যাদা থেকেও নিচে যাওয়ার কারণে মিথ্যাবাদী, হিংসক, প্রতারক, চোর আদিকে পশুর সমান বলা, বস্তুতঃ পশুদেরও অপমান করা হবে।
.
বিশ্বের মধ্যে যদিও সাংকেতিক রূপে সাম্প্রদায়িকতা তথা মুখ্য রূপে অনেক সমস্যা আছে, তবে এই পুস্তকে আমি কেবল ভারতের প্রেক্ষাপটে জাতিবাদের সমস্যা পর্যন্তই নিজের বিচার সীমিত রাখবো। আজ মানবতারূপী মায়ের প্রত্যেকটা অঙ্গ আহত। এতে অসংখ্য আঘাতের ক্ষত আছে, কিন্তু আমি জাতিবাদের একটা ক্ষত নিয়ে আলোচনা করবো। আজ এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ঈসাই, জৈন, বৌদ্ধ, বামপন্থী আদি বিভিন্ন প্রকারের ব্যক্তি বাস করে। তাদের নিজ-নিজ পরিচয়কে বজায় রাখার জন্য আকুল দেখা যায়। তবে হ্যাঁ, হিন্দুদের মধ্যে এমন কোনো আকুলতা দেখা যায় না। তারা মাঝি বিহীন নৌকোর সমান যেকোনো স্বার্থ অথবা ভয়ের কারণে যেখানে মন চায় সেখানে গিয়ে মাথা ঠুকে বেড়ায়। এদের মধ্যে কেউই নিজেকে ভারতীয় বলে না আর না তাদের মধ্যে ভারতীয়তার সঙ্গে কোনো প্রেম আছে, তাহলে কেউ নিজেকে আর্য অথবা মনুষ্য বলবে, এর তো দূর-দূর পর্যন্ত কোনো সম্ভাবনা নেই। একদা এই ভূমির উপর আর্য অর্থাৎ মনুষ্য ছিল, কিন্তু এখন কোনো আর্য (মনুষ্য) দেখা যায় না। ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির নিয়মের অনুকূল চলে এমন কাউকে দেখা যায় না।
.
কল্পনা করুন আমরা যদি কোনো বাহনের প্রয়োগ, তার তথা যাতায়াতের নিয়মের ঠিক-ঠিক তথ্য না জেনে করি, তাহলে কি কখনও সুখোদ আর সুরক্ষিত যাত্রা করতে পারবো? কেউ কি বিদ্যুতের অনেক উপকরণের সঠিক তথ্য না জেনে, ইচ্ছেমত সেগুলোর প্রয়োগ করে স্বয়ং জীবিত থাকার কল্পনা করতে পারবে? কক্ষনো না। এইভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজের শরীর আর ব্রহ্মাণ্ডের পাশাপাশি নিজের তথা পরমাত্মার সঠিক জ্ঞান প্রাপ্ত করে আর্য অর্থাৎ মনুষ্য হবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্টিকে ভোগার অসীম স্বচ্ছন্দতা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে এই সৃষ্টির বিনাশেরও কারণ হবে আর হয়েও চলেছে। এইজন্য আজকের বৈজ্ঞানিক আর শীর্ষ পুঁজিবাদীও চাঁদে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আবার কেউ মঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং তো মরতে-মরতে এই মনুষ্যকে অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে শরণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গেছেন।
.
এই সংসারে যেসব উপরোক্ত সম্প্রদায় আছে সেগুলো সবই বেদের কিছু শিক্ষাকে নিয়ে আর তারসঙ্গে নিজের কিছু মনগড়া কল্পনাকে মিশ্রিত করে প্রচলিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে হিন্দু কোনো সম্প্রদায় নয়, বরং এটা হচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিশ্রিত রূপ, যারা এই আর্যবর্ত্ত (ভারত) -কে নিজের ভূমি মানে আর স্বয়ংকে সর্বদা এখানকারই নিবাসী মানে। তাই এই ভারতীয় মহাপুরুষ, দেব এবং ঋষিদের আর তাঁদের দ্বারা লিখিত গ্রন্থ তথা ঈশ্বরীয় জ্ঞান বেদের উপর কিছু শ্রদ্ধা তো রাখেই। শিখ মতের আধার গ্রন্থ "গুরুগ্রন্থ সাহিব" এরমধ্যেও বেদকে ঈশ্বরীয় জ্ঞান বলে তার প্রশংসা করা হয়েছে। বৌদ্ধদের "ধম্মপদ" এরমধ্যেও বেদ, সত্য ব্রাহ্মণ আর আর্যদের অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। মূলরূপে অহিংসার উপর আধারিত জৈন মতও অনেক অর্থে বেদের নিকটই আছে। অন্যদিকে ঈসাই, ইসলাম, ইহুদী আদি মত নিজ-নিজ গ্রন্থ দ্বারা পূর্ববিশ্বের স্থিতি, ভাষা আর জ্ঞানের মূল স্রোত আর সৃষ্টির উপর পূর্ণ বিচার না করেই অজ্ঞতাবশত স্বয়ংকে বেদবিরোধী মেনে বসে আছে।
.
আজ সংসারের স্থিতি এমন হয়েছে যে যারা বেদের প্রসংশক আর যারা বেদের বিরোধী, যাদের মধ্যে বামপন্থীও সম্মিলিত আছে, এদের মধ্যে কেউই বেদের যথার্থ স্বরূপকে জানে না। আমার মতে কোনো গ্রন্থ অথবা ব্যক্তির স্বরূপকে পূর্ণরূপে না জেনে তার প্রশংসা অথবা নিন্দা দুটোই করা উচিত নয় আর এই অনৌচিত্যের আধারেই বর্গ-সংঘর্ষ, রক্তপাত আর সন্ত্রাসবাদ অনেক শতাব্দী ধরে চলে আসছে আর নিরন্তর নতুন-নতুন রূপে বেড়ে চলেছে। এদের মধ্যে কেউই এটা জানার চেষ্টা করে না যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি সূক্ষ্ম কণা, তরঙ্গ আর রশ্মি দ্বারা নির্মিত। সবার গ্রন্থ এটাও বলে যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাতা হল এক চেতন সর্বশক্তিমান কর্তা। এইরূপ আমাদের সবার শরীরও একই প্রকারের সামগ্রী দিয়ে সেই চেতন সত্তা বানিয়েছে।
আমাদের সবার আত্মা যা কিনা আমাদের নিজস্বরূপ, সেটাও পৃথক-পৃথক হওয়া সত্ত্বেও স্বরূপের দিক দিয়ে এক সমান, তাহলে পৃথক-পৃথক মজহব আর সম্প্রদায় কিভাবে হয়ে গেল? ঈশ্বর তো সবাইকে মনুষ্য শরীরই দিয়েছিল, কিন্তু আমরা হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ঈসাই, জৈন, বৌদ্ধ, পারসী, ইহুদী আর বামপন্থী এই সবের মধ্যে কিভাবে বিভক্ত হয়ে গেছি? ঈশ্বর মনুষ্যের সৃষ্টি রচনার পাশাপাশি তাকে সত্যিকারের মনুষ্য হতে অর্থাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে জেনে সকল প্রাণীর প্রতি উচিত ব্যবহার আর এই সৃষ্টিরও উপয়োগ করার জ্ঞান বেদের মাধ্যমে উপদেশ দিয়েছেন, এই জ্ঞান মনুষ্যের জন্য পূর্ণ আর পর্যাপ্ত ছিল, কারণ ঈশ্বর হল পূর্ণ আর সর্বজ্ঞ, ঈশ্বর কখনও অল্পজ্ঞ আর অপূর্ণ হয় না।
আসলে ঈশ্বরীয় জ্ঞানের আবশ্যকতা মনুষ্যের প্রথম প্রজন্মেই হয়, তার পশ্চাৎ তো পরম্পরা ধরে এই জ্ঞান চলতে থাকে। আরও একটা কথা সুনিশ্চিত করা উচিত যে পূর্ণপুরুষ পরমাত্মার পূর্ণজ্ঞানের মধ্যে কখনও সংশোধন অথবা পরিবর্তনের কোনো আবশ্যকতা হয় না। এই আবশ্যকতা তো অল্পজ্ঞ মনুষ্যের বিচার এবং গ্রন্থের মধ্যেই হয় আর আমার মনে হয় না এমন কোনো সম্প্রদায়কারী নিজের ইষ্ট দেব, তাঁর যে নামই হোক না কেন, তাঁকে কখনও অপূর্ণ বা অজ্ঞানী বলবে।এমতাবস্থায় এক ধর্মের স্থানে বিভিন্ন মত-মতান্তর দ্বারা মানবতার টুকরো-টুকরো হওয়া কেমন বিড়ম্বনা? এই বিড়ম্বনা এখানেই থেমে থাকে নি, বরং এটা বিভিন্ন মজহবের ভিতরেও অনেক তথাকথিত জাতি পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে আর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে সবথেকে বেশি দুর্ভাগ্যপূর্ণ স্থিতি হল হিন্দুদের, যেখানে বিভিন্ন তথাকথিত জাতি আর তাদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে একে-অপরকে পরস্পর প্রচণ্ড শত্রু বানাচ্ছে। বলার বেলায় তো যে কেউ নিজেকে হিন্দু বলে কিন্তু তার ভিতরে কোনো তথাকথিত জাতির অহংকার বা বন্ধন বসে থাকে, যা কিনা অন্যদের থেকে স্বয়ংকে সর্বদা পৃথকই মানে।
কেউ-কেউ নিজের পূর্বজের নামেই অহংকার করে স্বয়ংকে অকারণেই জ্যেষ্ঠ আর শ্রেষ্ঠ মানে আর অন্যদের নিম্ন মানা শুরু করে, যদি অন্য কেউ বর্তমানে তার থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তা সত্ত্বেও। এর পরিণাম এমন হয় যে অন্য ব্যক্তিরা দেশের মহাপুরুষদেরও কোনো বর্গবিশেষের পূর্বজ ধরে নিয়ে তাদের ঘৃণা করতে থাকে আবার কোথাও মহাপুরুষের উপরই নিজের-নিজের পূর্বজ হওয়ার দাবি করে বর্গ-সংঘর্ষের জন্ম দেয়। কেউই দেশের মহাপুরুষদের সম্পূর্ণ দেশের মহাপুরুষ মানতে রাজি নয়, আবার স্বয়ংকেও ভারতীয় অথবা হিন্দু মানতে রাজি নয়। কত দুঃখের বিষয় যে যাদের পূর্বোজ একদা আর্য ছিল, আজ তাদের "হিন্দু" বলা হয় আর এখন হিন্দুও নয়, বরং নানা তথাকথিত জাতির মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয় দেয়।
.
যোগ্যতা আর কর্মের উপর আধারিত যে বর্ণ-ব্যবস্থা ভগবান্ মনু সংসারের কল্যাণের জন্য স্থাপিত করেছিলেন, সেই বর্ণ-ব্যবস্থা জন্মের উপর আধারিত হয়ে সংসারের জন্য বিশেষ করে ভারতের জন্য অভিশাপ হয়ে যায়। এইসব কিভাবে হয়েছে? এখন আমরা তার চর্চা করবো।
(ক্রমশঃ)


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

জাতিবাদ ও ভগবান মনু

  সম্পাদকীয় বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ