সম্পাদকীয়
বর্তমান সময়ে দেশ অনেক গম্ভীর সমস্যায় গ্রস্ত আছে, তারমধ্যে একটা হল - জাতিবাদ। এই জাতিবাদের কারণে আমাদের দেশের অনেক বড় হানি হয়েছে আর নিরন্তর হয়ে চলেছে। একদা যে দেশকে তার চরিত্র, শিক্ষা, শাসন আদির দৃষ্টিতে আদর্শ মানা হতো, যার বিষয়ে স্বয়ং ভগবান্ মনু বলেছেন -
এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ ।
স্বম্ স্বম্ চরিত্রম্ শিক্ষেরন্পৃথিব্যাম্ সর্বমানবাঃ ।। (মনু.২.২০)
.
আজ ভগবান্ মনুর সেই বিশ্ববিখ্যাত দেশ জাতি-ব্যবস্থার মতো অভিশাপের কারণে বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। দেশের নীতি নির্ধারকদের কাছে এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না। কিছু দেশদ্রোহী ও বিধর্মী লোক একে বাড়ানোর জন্য নিরন্তর নতুন-নতুন পরিকল্পনা করছে। "ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্...পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রোऽজায়ত" এই মন্ত্রের বাস্তবিক অর্থকে না জেনে আর মিথ্যা অর্থকে প্রচারিত করে বিধর্মীরা আগুনে ঘী দেওয়ার কাজ করছে।
অন্যদিকে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা ভগবান্ মনু প্রোক্ত বৈদিক বর্ণ-ব্যবস্থা, যা কিনা যোগ্যতা আর কর্মের উপর আধারিত ছিল, যার অনুসারে এখানকার সম্পূর্ণ শাসন ব্যবস্থা চলতো আর যার কারণে আর্যাবর্ত্তে (ভারত) সুখ ও শান্তির পরিবেশ ছিল। অজ্ঞানতার কারণে সেই আদর্শ বর্ণ-ব্যবস্থাকে না জেনে অথবা তার বিকৃতরূপের অধিক প্রচার হওয়ার কারণে অনেক সংগঠন ভগবান্ মনুর বিরোধী হয়ে গেছে।
.
এইসবের মূল কারণ হল - বেদমন্ত্রের যথার্থ স্বরূপকে না জানা। এই সবের উপর বিচার করার পর পূজ্য আচার্যশ্রী "ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্..." মন্ত্রের বৈজ্ঞানিক এবং আধ্যাত্মিক অর্থ সংসারের সম্মুখে নিয়ে আসার নির্ণয় করেন। এই লঘু পুস্তিকা মূলরূপে উপরোক্ত বেদ-মন্ত্রের উপর আধারিত। এতে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা কৃত ভাষ্যের আধিভৌতিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। তারসঙ্গে বর্ণ-ব্যবস্থার উপর ওঠা অনেক শঙ্কার সমাধানও এই পুস্তকের মধ্যে করা হয়েছে।
.
পুস্তকের অন্তিমে আরক্ষণ, জাতিবাদ ও নির্ধনতার স্থায়ী এবং সর্বোত্তম সমাধান দেওয়া হয়েছে। আমার সহধর্মিণী শ্রীমতি মধুলিকা আর্যা এই পুস্তকের সম্পাদন আর ঈক্ষ্যবাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এতদর্থ আমি তাকে ধন্যবাদই দিতে পারবো। পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, তারা যেন এই পুস্তকের আদ্যোপান্ত গম্ভীরতাপূর্বক পড়ে আর বর্ণ-ব্যবস্থার যথার্থ স্বরূপ হতে সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেন, যাতে এই দেশ এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় সেই মহান আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়। এই আশার সঙ্গে...
- বিশাল আর্য
ভূমিকা
মনুষ্যকে সৃষ্টির সর্বোত্তম প্রাণী মানা হয় আর ঈশ্বর তাকে সর্বোত্তমই বানিয়েছে। যদিও এই সৃষ্টির মধ্যে লক্ষ-লক্ষ প্রকারের প্রাণী আছে, কিন্তু মনুষ্যের মতো মননশীল প্রাণী আর কেউ নেই এবং যদি কোনো পরগ্রহী প্রাণী অথবা অন্য গ্যালাক্সিতে থাকা প্রাণী মননশীল হয়, তাহলে বৈদিক দৃষ্টিতে তাকে মনুষ্যই বলা হবে। মহর্ষি য়াস্ক মনুষ্য পদের নির্বাচন করে লিখেছেন -
মত্বা কর্মাণি সীব্যন্তি (নিরুক্ত)
অর্থাৎ যে বিচার করে কাজ করে, তাকে মনুষ্য বলে।
.
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে অনেক চোর, ডাকু আদিও তো চিন্তা ভাবনা করেই চুরি আদি দুষ্কর্ম করে, কারণ বিনা ভেবে আর বিনা পরিকল্পনা করে তারা তাদের সেই দুষ্কর্মে সফল হবে না, তাহলে কি বৈদিক দৃষ্টিতে তাদেরও মনুষ্য বলা হবে? এই প্রশ্নের সমাধান করার জন্য ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "সব কাজ ধর্মানুসারে অর্থাৎ সত্য আর অসত্যের বিচার করে করা উচিত।" (আর্যসমাজের পঞ্চম নিয়ম)
.
এইভাবে এটা সিদ্ধ হল যে সত্য আর অসত্যকে বিচার করে যে প্রাণী তার সব কাজের সম্পাদন করে আর সেইরূপ তার জীবনশৈলী সম্পূর্ণরূপে সত্যের উপর আধারিত হয়, সেই প্রাণীকেই মনুষ্য বলে। এখন এখানে আরেকটা প্রশ্ন হল, সত্য কি? কিছু ব্যক্তির মত হল সত্য নিরপেক্ষ হয় না, বস্তুতঃ এটা হচ্ছে ভ্রম, কিন্তু সত্যকে জানা এতটা সহজও নয়। এই বিষয়ে দেবর্ষি নারদ বলেছেন -
সত্যস্য বচনম্ শ্রেয়ঃ সত্যজ্ঞানম্ তু দুষ্করম্ ।
য়দ্ ভূতহিতমত্যন্তমেতত্ সত্যম্ ব্রবীম্যহম্ ।।
(মহাভারত শান্তিপর্ব | মো.ধ.প. | অধ্যায় ২৬৯)
.
য়োগদর্শন ভাষ্যে মহর্ষি ব্যাস বলেছেন -
সত্যম্ য়থার্থে বাঙ্মনসে। য়থা দৃষ্টম্ য়থাऽনুমিতম্ য়থা শ্রুতম্ তথা বাঙ্মনশ্চেতি। পরত্র স্ববোধসম্ক্রান্তয়ে বাগুক্তা, সা য়দি ন বঞ্চিতা ভ্রান্তা বা প্রতিপত্তিবন্ধ্যা বা ভবেদিতি। এষা সর্বভূতোপকারার্থম্ প্রবৃত্তা ন ভূতোপঘাতায়। (য়োগদর্শন ২.৩০)
.
এই দুটো প্রমাণ থেকে তাৎপর্য এটাই বেরিয়ে আসছে যে যখন কোনো প্রাণী আত্মা, মন আর বাণীকে সংযত করে কথা বলে অর্থাৎ এদের মধ্যে পরস্পর কখনও অসংযতি বা বিরোধ হয় না, তাকেই সত্য বলে। এখানে কেবল সত্য কথা বলাই পর্যাপ্ত নয়, বরং তদনুকূল আচরণ হওয়াটাও অনিবার্য। একেই বেদ বলেছে -
স্বেন ক্রতুনা সম্বদেত।
তবে মনে রাখা উচিত যে মন, বাণী আর কর্মের সমতা তো সৃষ্টির সব প্রাণী আর পাগল ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যায়, কারণ তারা কখনও মিথ্যা বলে না, কিন্তু তাদের বলা বা করা যে সবার অথবা কারও হিতে হবে, তার সম্ভাবনা খুব কম। এইজন্য এদের সত্য বক্তা আর সত্যের উপর আচরণকারী বলাটা উচিত হবে না। মনুষ্যের গুণ এইভাবে নিশ্চিত হয় -
১. কথা বলার সময় আত্মা, মন, বুদ্ধি আর বাণী সব পূর্ণ সংযত হওয়া উচিত অর্থাৎ আত্মা, বুদ্ধি বা মনের প্রতিকূল কথা বললে সেটা অসত্য হবে।
২. এই সবের সংযতির পাশাপাশি তাদের সব কর্মও সেইরূপ হতে হবে।
৩. তাদের বিচার, তাদের বচন আর তাদের কর্ম সকল প্রাণীর জন্য হিতকারী হবে আর যেসব কর্ম তাদের ব্যক্তিগত হিতের জন্য হবে, সেটাও অন্য কোনো প্রাণীর জন্য কখনও অহিতকারী হবে না।
.
এই তিন মানদণ্ডের উপর যে প্রাণী দাঁড়াবে, তাকেই মনুষ্য বলবে। কেবল মনুষ্য-শরীরধারী হওয়া মাত্রই মনুষ্যতার লক্ষণ নয়। আজ সংসারে যদি সবথেকে বড় কিছুর অভাব থাকে তাহলে সেটা হল মনুষ্যতার প্রচণ্ড অভাব। পরমাত্মা তো সৃষ্টি রচনা করে মনুষ্যকে বলে দিয়েছেন -
তুভ্যেমা ভুবনা কবে মহিম্নে সোম তস্থিরে ।
তুভ্যমর্ষন্তি সিন্ধবঃ ।। (ঋগ্বেদ ৯.৬২.২৭)
অর্থাৎ - হে মনুষ্য! এইসব লোক-লোকান্তর তোমার জন্যই বিদ্যমান আর এই নদী ও সাগর তোমার জন্যই প্রবাহিত হচ্ছে। এমন প্রাণীকে "আর্য" বলা হয়েছে আর আর্যের পরিভাষাতে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন -
আর্য় ঈশ্বরপুত্রঃ
অর্থাৎ - যে ব্যক্তি ঈশ্বরের সব আজ্ঞা পূর্ণ রূপে পালন করে, তাকেই আর্য বলে আর সেই ঈশ্বরের আজ্ঞা কি? সেটাও বেদ স্পষ্ট করে দিয়েছে -
মনুর্ভব
অর্থাৎ - মনুষ্য হও। অন্যত্র বলেছে -
অহম্ ভূমিম্ অদদাম আর্য়ায়
অর্থাৎ - আমি এই ভূমি আর্যদের জন্য দিয়েছি। এইভাবে আর্য এবং মনুষ্য দুটো পদ সমানার্থক সিদ্ধ হল।
.
এইভাবে এটা স্পষ্ট হল যে বেদের দৃষ্টিতে সর্বহিতৈষী, সত্যপালক মনুষ্যকেই আর্য বলা হয়েছে আর আর্যকেই সৃষ্টির সম্পদ উপভোগ করার অধিকারী বলা হয়েছে। হিংসক, চোর, মিথ্যাবাদী, প্রতারক আর লম্পট আদি দোষ যুক্ত মনুষ্য-শরীরধারিদের পরমাত্মা প্রদত্ত সম্পদ উপভোগের অধিকার নেই। এইভাবে পৃথিবীর সব মনুষ্য শরীরধারী প্রাণী যদি সত্যিকারের মনুষ্য হয়, তাহলে এই পৃথিবীতে বিনা কারণে কোনো প্রাণীর দুঃখই হবে না।
.
বস্তুতঃ পরমেশ্বর এই সৃষ্টিকে সবার হিত সম্পাদন (সৃষ্টির ধর্মাধারিত ভোগ আর মোক্ষ) করার জন্য বানিয়েছেন। প্রারম্ভে ঈশ্বর অত্যন্ত শুদ্ধ আর স্বচ্ছ বায়ু, পবিত্র জল, পোষক তত্ত্বে ভরপুর শুদ্ধ ভূমি, অনিষ্ট বিকিরণ হতে রহিত আকাশ, শুদ্ধতম মনস্তত্ত্ব আর এইসব দ্বারা নির্মিত সুন্দর, পূর্ণ সুস্থ আর পবিত্র বনস্পতি আর আমাদের শরীর প্রদান করেছিলেন। কারও কোনো রকম কোনো দুঃখ হবে এমন কোনো কারণ তখন এই পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল না, কারণ সেই সময় সব মনুষ্যধারী প্রাণী পৃথিবীতে জন্মে ছিলমাত্র আর সত্যি কথা হল তারা মনুষ্যই ছিল, কিন্তু কোটি-কোটি বর্ষ পশ্চাৎ আজ এই পৃথিবীর কি দুর্দশা হয়েছে, সেটা কে না জানে? তিন প্রকারের দুঃখ - আধিদৈবিক, আধিভৌতিক আর আধ্যাত্মিক তথা সব প্রকারের দুঃখের তাণ্ডব এই পৃথিবীর উপর দেখা যাচ্ছে।
.
যদিও বিশ্বের সব দেশের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে কিন্তু সেই সবের কারণ একটাই প্রতীত হয় যে আমরা ঈশ্বরীয় ব্যবস্থার পালন করিনি। অন্য সব প্রাণী ঈশ্বর প্রদত্ত নিজের ধর্ম (স্বভাব) - কে ছাড়ে নি। তারা যখন থেকে এই পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছে তখন থেকেই নিজ-নিজ ধর্মের মর্যাদার একশ শতাংশ পালন করছে, কিন্তু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী এই মনুষ্য তার সব মর্যাদাকে পুরোপুরি ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে। মনুষ্য সেই মর্যাদা থেকেও নিচে নেমেছে, যা কিনা ঈশ্বর পশু-পাখিদের জন্য নির্ধারিত করে ছিলেন, এই কারণে সম্পূর্ণ পৃথিবীর প্রতিপালক এই মনুষ্য সম্পূর্ণ পৃথিবী আর তাতে থাকা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের দুঃখ আর বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদা দেবরাজ ইন্দ্র মহান সম্রাট মান্ধাতা-কে বলেছিলেন -
নির্মর্য়াদান্ নিত্যমর্থে নিবিষ্টানাহুস্তাম্স্তান্ বৈ পশুভূতান্ মনুষ্যান্।
(মহাভারত শান্তিপর্ব | রা.ধ.অ.প. | অধ্যায় ৬৫)
অর্থাৎ - মর্যাদাবিহীন মনুষ্য পশুর সমান হয়, কিন্তু পশুদের মর্যাদা থেকেও নিচে যাওয়ার কারণে মিথ্যাবাদী, হিংসক, প্রতারক, চোর আদিকে পশুর সমান বলা, বস্তুতঃ পশুদেরও অপমান করা হবে।
.
বিশ্বের মধ্যে যদিও সাংকেতিক রূপে সাম্প্রদায়িকতা তথা মুখ্য রূপে অনেক সমস্যা আছে, তবে এই পুস্তকে আমি কেবল ভারতের প্রেক্ষাপটে জাতিবাদের সমস্যা পর্যন্তই নিজের বিচার সীমিত রাখবো। আজ মানবতারূপী মায়ের প্রত্যেকটা অঙ্গ আহত। এতে অসংখ্য আঘাতের ক্ষত আছে, কিন্তু আমি জাতিবাদের একটা ক্ষত নিয়ে আলোচনা করবো। আজ এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ঈসাই, জৈন, বৌদ্ধ, বামপন্থী আদি বিভিন্ন প্রকারের ব্যক্তি বাস করে। তাদের নিজ-নিজ পরিচয়কে বজায় রাখার জন্য আকুল দেখা যায়। তবে হ্যাঁ, হিন্দুদের মধ্যে এমন কোনো আকুলতা দেখা যায় না। তারা মাঝি বিহীন নৌকোর সমান যেকোনো স্বার্থ অথবা ভয়ের কারণে যেখানে মন চায় সেখানে গিয়ে মাথা ঠুকে বেড়ায়। এদের মধ্যে কেউই নিজেকে ভারতীয় বলে না আর না তাদের মধ্যে ভারতীয়তার সঙ্গে কোনো প্রেম আছে, তাহলে কেউ নিজেকে আর্য অথবা মনুষ্য বলবে, এর তো দূর-দূর পর্যন্ত কোনো সম্ভাবনা নেই। একদা এই ভূমির উপর আর্য অর্থাৎ মনুষ্য ছিল, কিন্তু এখন কোনো আর্য (মনুষ্য) দেখা যায় না। ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির নিয়মের অনুকূল চলে এমন কাউকে দেখা যায় না।
.
কল্পনা করুন আমরা যদি কোনো বাহনের প্রয়োগ, তার তথা যাতায়াতের নিয়মের ঠিক-ঠিক তথ্য না জেনে করি, তাহলে কি কখনও সুখোদ আর সুরক্ষিত যাত্রা করতে পারবো? কেউ কি বিদ্যুতের অনেক উপকরণের সঠিক তথ্য না জেনে, ইচ্ছেমত সেগুলোর প্রয়োগ করে স্বয়ং জীবিত থাকার কল্পনা করতে পারবে? কক্ষনো না। এইভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজের শরীর আর ব্রহ্মাণ্ডের পাশাপাশি নিজের তথা পরমাত্মার সঠিক জ্ঞান প্রাপ্ত করে আর্য অর্থাৎ মনুষ্য হবো না, ততক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্টিকে ভোগার অসীম স্বচ্ছন্দতা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে এই সৃষ্টির বিনাশেরও কারণ হবে আর হয়েও চলেছে। এইজন্য আজকের বৈজ্ঞানিক আর শীর্ষ পুঁজিবাদীও চাঁদে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আবার কেউ মঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং তো মরতে-মরতে এই মনুষ্যকে অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে শরণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে গেছেন।
.
এই সংসারে যেসব উপরোক্ত সম্প্রদায় আছে সেগুলো সবই বেদের কিছু শিক্ষাকে নিয়ে আর তারসঙ্গে নিজের কিছু মনগড়া কল্পনাকে মিশ্রিত করে প্রচলিত হয়েছে, এগুলোর মধ্যে হিন্দু কোনো সম্প্রদায় নয়, বরং এটা হচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিশ্রিত রূপ, যারা এই আর্যবর্ত্ত (ভারত) -কে নিজের ভূমি মানে আর স্বয়ংকে সর্বদা এখানকারই নিবাসী মানে। তাই এই ভারতীয় মহাপুরুষ, দেব এবং ঋষিদের আর তাঁদের দ্বারা লিখিত গ্রন্থ তথা ঈশ্বরীয় জ্ঞান বেদের উপর কিছু শ্রদ্ধা তো রাখেই। শিখ মতের আধার গ্রন্থ "গুরুগ্রন্থ সাহিব" এরমধ্যেও বেদকে ঈশ্বরীয় জ্ঞান বলে তার প্রশংসা করা হয়েছে। বৌদ্ধদের "ধম্মপদ" এরমধ্যেও বেদ, সত্য ব্রাহ্মণ আর আর্যদের অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। মূলরূপে অহিংসার উপর আধারিত জৈন মতও অনেক অর্থে বেদের নিকটই আছে। অন্যদিকে ঈসাই, ইসলাম, ইহুদী আদি মত নিজ-নিজ গ্রন্থ দ্বারা পূর্ববিশ্বের স্থিতি, ভাষা আর জ্ঞানের মূল স্রোত আর সৃষ্টির উপর পূর্ণ বিচার না করেই অজ্ঞতাবশত স্বয়ংকে বেদবিরোধী মেনে বসে আছে।
.
আজ সংসারের স্থিতি এমন হয়েছে যে যারা বেদের প্রসংশক আর যারা বেদের বিরোধী, যাদের মধ্যে বামপন্থীও সম্মিলিত আছে, এদের মধ্যে কেউই বেদের যথার্থ স্বরূপকে জানে না। আমার মতে কোনো গ্রন্থ অথবা ব্যক্তির স্বরূপকে পূর্ণরূপে না জেনে তার প্রশংসা অথবা নিন্দা দুটোই করা উচিত নয় আর এই অনৌচিত্যের আধারেই বর্গ-সংঘর্ষ, রক্তপাত আর সন্ত্রাসবাদ অনেক শতাব্দী ধরে চলে আসছে আর নিরন্তর নতুন-নতুন রূপে বেড়ে চলেছে। এদের মধ্যে কেউই এটা জানার চেষ্টা করে না যে সম্পূর্ণ সৃষ্টি সূক্ষ্ম কণা, তরঙ্গ আর রশ্মি দ্বারা নির্মিত। সবার গ্রন্থ এটাও বলে যে সম্পূর্ণ সৃষ্টির নির্মাতা হল এক চেতন সর্বশক্তিমান কর্তা। এইরূপ আমাদের সবার শরীরও একই প্রকারের সামগ্রী দিয়ে সেই চেতন সত্তা বানিয়েছে।
আমাদের সবার আত্মা যা কিনা আমাদের নিজস্বরূপ, সেটাও পৃথক-পৃথক হওয়া সত্ত্বেও স্বরূপের দিক দিয়ে এক সমান, তাহলে পৃথক-পৃথক মজহব আর সম্প্রদায় কিভাবে হয়ে গেল? ঈশ্বর তো সবাইকে মনুষ্য শরীরই দিয়েছিল, কিন্তু আমরা হিন্দু, মুসলিম, শিখ, ঈসাই, জৈন, বৌদ্ধ, পারসী, ইহুদী আর বামপন্থী এই সবের মধ্যে কিভাবে বিভক্ত হয়ে গেছি? ঈশ্বর মনুষ্যের সৃষ্টি রচনার পাশাপাশি তাকে সত্যিকারের মনুষ্য হতে অর্থাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে জেনে সকল প্রাণীর প্রতি উচিত ব্যবহার আর এই সৃষ্টিরও উপয়োগ করার জ্ঞান বেদের মাধ্যমে উপদেশ দিয়েছেন, এই জ্ঞান মনুষ্যের জন্য পূর্ণ আর পর্যাপ্ত ছিল, কারণ ঈশ্বর হল পূর্ণ আর সর্বজ্ঞ, ঈশ্বর কখনও অল্পজ্ঞ আর অপূর্ণ হয় না।
আসলে ঈশ্বরীয় জ্ঞানের আবশ্যকতা মনুষ্যের প্রথম প্রজন্মেই হয়, তার পশ্চাৎ তো পরম্পরা ধরে এই জ্ঞান চলতে থাকে। আরও একটা কথা সুনিশ্চিত করা উচিত যে পূর্ণপুরুষ পরমাত্মার পূর্ণজ্ঞানের মধ্যে কখনও সংশোধন অথবা পরিবর্তনের কোনো আবশ্যকতা হয় না। এই আবশ্যকতা তো অল্পজ্ঞ মনুষ্যের বিচার এবং গ্রন্থের মধ্যেই হয় আর আমার মনে হয় না এমন কোনো সম্প্রদায়কারী নিজের ইষ্ট দেব, তাঁর যে নামই হোক না কেন, তাঁকে কখনও অপূর্ণ বা অজ্ঞানী বলবে।এমতাবস্থায় এক ধর্মের স্থানে বিভিন্ন মত-মতান্তর দ্বারা মানবতার টুকরো-টুকরো হওয়া কেমন বিড়ম্বনা? এই বিড়ম্বনা এখানেই থেমে থাকে নি, বরং এটা বিভিন্ন মজহবের ভিতরেও অনেক তথাকথিত জাতি পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে আর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে সবথেকে বেশি দুর্ভাগ্যপূর্ণ স্থিতি হল হিন্দুদের, যেখানে বিভিন্ন তথাকথিত জাতি আর তাদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে একে-অপরকে পরস্পর প্রচণ্ড শত্রু বানাচ্ছে। বলার বেলায় তো যে কেউ নিজেকে হিন্দু বলে কিন্তু তার ভিতরে কোনো তথাকথিত জাতির অহংকার বা বন্ধন বসে থাকে, যা কিনা অন্যদের থেকে স্বয়ংকে সর্বদা পৃথকই মানে।
কেউ-কেউ নিজের পূর্বজের নামেই অহংকার করে স্বয়ংকে অকারণেই জ্যেষ্ঠ আর শ্রেষ্ঠ মানে আর অন্যদের নিম্ন মানা শুরু করে, যদি অন্য কেউ বর্তমানে তার থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তা সত্ত্বেও। এর পরিণাম এমন হয় যে অন্য ব্যক্তিরা দেশের মহাপুরুষদেরও কোনো বর্গবিশেষের পূর্বজ ধরে নিয়ে তাদের ঘৃণা করতে থাকে আবার কোথাও মহাপুরুষের উপরই নিজের-নিজের পূর্বজ হওয়ার দাবি করে বর্গ-সংঘর্ষের জন্ম দেয়। কেউই দেশের মহাপুরুষদের সম্পূর্ণ দেশের মহাপুরুষ মানতে রাজি নয়, আবার স্বয়ংকেও ভারতীয় অথবা হিন্দু মানতে রাজি নয়। কত দুঃখের বিষয় যে যাদের পূর্বোজ একদা আর্য ছিল, আজ তাদের "হিন্দু" বলা হয় আর এখন হিন্দুও নয়, বরং নানা তথাকথিত জাতির মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয় দেয়।
.
যোগ্যতা আর কর্মের উপর আধারিত যে বর্ণ-ব্যবস্থা ভগবান্ মনু সংসারের কল্যাণের জন্য স্থাপিত করেছিলেন, সেই বর্ণ-ব্যবস্থা জন্মের উপর আধারিত হয়ে সংসারের জন্য বিশেষ করে ভারতের জন্য অভিশাপ হয়ে যায়। এইসব কিভাবে হয়েছে? এখন আমরা তার চর্চা করবো।
🍁 ...পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রোऽজায়ত 🍁
আজ ভারতে বিশেষ করে হিন্দু সমাজের মধ্যে জাতি-ব্যবস্থা শিরায়-শিরায় বিষের মতো ব্যাপ্ত হয়ে গেছে। অথচ জাতি জন্ম থেকেই হয়, যেমন - মনুষ্য, গরু, মোষ, ছাগল আদি। অন্যদিকে বর্ণ হল কর্ম আর যোগ্যতার উপর আধারিত, যা আজ আর নেই। বর্ণ-ব্যবস্থার প্রচণ্ড বিরোধী তথাকথিত দলিত বিচারক বেদোক্ত বর্ণ-ব্যবস্থার সত্যতাকে না জেনে বিনা তার ও তার প্রবর্তক ভগবান্ মনু এবং বেদের খুব নিন্দা করতে দেখা যায়। বস্তুতঃ তারা এর জন্য পূর্ণতঃ দোষীও নয়, কারণ বর্ণ-ব্যবস্থার পোষকও শতাব্দী ধরে এই ব্যবস্থার সত্যতা আর বৈজ্ঞানিকতাকে ভুলে গিয়ে একটা বর্গ বিশেষের উপর অত্যাচার করছিল। বর্ণ-ব্যবস্থার বিরোধী আর সমর্থক উভয়ই এই ব্যবস্থার মূল স্রোত একটা বেদ মন্ত্রকে মানে। দুঃখের বিষয় হল উভয় পক্ষই সেই মন্ত্রের বাস্তবিক অর্থ জানে না। সেই বিতর্কিত মন্ত্রটা হল -
ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ ।
ঊরু তদস্য য়দ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রোऽজায়ত ।।
(য়জুর্বেদ ৩১.১১ | অথর্ববেদ ১৯.৬.৬ | ঋগ্বেদ ১০.৯০.১২)
এই মন্ত্রের অর্থ না বুঝতে পারার কারণে হিন্দু সমাজের যেভাবে বিনাশ হয়েছে, তা বড়ই দুঃখজনক। এরই আধার নিয়ে দুষ্ট ব্যক্তি দ্বারা মনুস্মৃতির মধ্যে অনেক শ্লোক মিশ্রিত করে অস্পৃশ্যতা আর জাতিবাদের বিষ বমন করা হয়েছে। মনুস্মৃতি হল মানব জাতির সর্বপ্রথম ধর্মশাস্ত্র, যেটা সংসারের প্রথম রাজা ভগবান্ মনু দ্বারা রচিত। এই কারণে বেদের পশ্চাৎ এই পৃথিবীতে মানবমাত্রের জন্য এটাই সর্বাধিক প্রামাণিক গ্রন্থ মানা হতো। এরই সুযোগ নিয়ে কিছু সমাজ কণ্টক এই গ্রন্থের মধ্যে স্বেচ্ছাকৃত প্রক্ষেপ করা শুরু করে দেয়। শূদ্রকে বেদমন্ত্র পড়া, বলা আর শোনার অধিকার থেকে একদম বঞ্চিত করে দেওয়া হয়। এর লঙ্ঘন করলে শূদ্রের গলা কেটে ফেলা আর কানের মধ্যে সীসা গলিয়ে ঢেলে দেওয়ার মতো ক্রুর দণ্ডের বিধান করা হয়।
.
মনুস্মৃতির মধ্যে মিশ্রিত করা এই শ্লোকগুলোকে ভগবান্ মনুর বচন মেনে অন্য কিছু শাস্ত্র অথবা তার ভাষ্যকর্তারাও এইরূপ বীভৎস ব্যবস্থাকে নিজের গ্রন্থের মধ্যে স্থান দেয়। এরফলে ভারতের চার-ভাগের এক-ভাগ জনসংখ্যা বেদ আর ঋষিদের নাম শোনামাত্র ভয় পেতে শুরু করে আর এইসবের প্রতি ঘৃণা করতে শুরু করে। এই ব্যক্তিরা কেবল শূদ্রকেই নয়, বরং সম্পূর্ণ নারী জাতিকেও বেদ পড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয়। এই বিষয়ে কিছু ব্যক্তির মত হল শাস্ত্রের মধ্যে এমন লেখা থাকলেও ভারতীয় সমাজের মধ্যে এমনটা কখনও হয়নি। তাদের এমন কথা বড় হাস্যকর। অস্পৃশ্যতা রোগের উপেক্ষা ঘাতক হয়। আসলে এইরূপ শিশুসুলভ বিবৃতি দাতাদের শাস্ত্রের কোনো বোধ নেই, এই কারণে তারা "শাস্ত্রের মধ্যে প্রক্ষেপও হয়েছে" এমনটা বলার সাহস করতে পারে না। বস্তুতঃ তারা শাস্ত্রকে গুরুত্ব দেয় না, বরং নিজের মিথ্যা মান্যতাকেই প্রভাবী মানে, যা কিনা রাষ্ট্রের জন্য খুবই ঘাতক। এখন আমরা জানার চেষ্টা করবো যে এই মন্ত্রের কারণ এমন কেন হয়েছে?
এর কারণ হল, অনেক বেদ ভাষ্যকারও এই মন্ত্রের অর্থকে বুঝতে অনেক বড় ভুল করেছে। আমি মনে করি ঋষি দয়ানন্দের অতিরিক্ত সম্ভবতঃ কোনো বেদ ভাষ্যকারই বেদের নিকট যেতে পারেনি। সর্বপ্রথম আমি সবথেকে প্রসিদ্ধ বেদ ভাষ্যকার আচার্য সায়ণের ভাষ্য এখানে প্রস্তুত করছি -
"অস্য প্রজাপতের্ব্রাহ্মণো ব্রাহ্মণত্বজাতিবিশিষ্টঃ পুরুষো মুখমাসীত্ । মুখাদুৎপন্ন ইত্যর্থঃ । য়োऽয়ম্ রাজন্যঃ ক্ষত্রিয়ত্বজাতিমান্পুরুষঃ স বাহূ কৃতঃ । বাহুত্বেন নিষ্পাদিতঃ । বাহুভ্যামুৎপাদিত ইত্যর্থঃ । তথাস্য পদ্ভ্যাম্ পাদাভ্যাম্ শূদ্রঃ শূদ্রত্বজাতিমান্ পুরুষোऽজায়ত ।"
অর্থাৎ - প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ উৎপন্ন হয়, বাহু থেকে ক্ষত্রিয় উৎপন্ন হয়, উরু থেকে বৈশ্য উৎপন্ন হয় আর পা থেকে শূদ্র উৎপন্ন হয়।
পদ্মভূষণ ডাক্তার শ্রীপাদ সাতবলেকর অথর্ববেদ ভাষ্যতে এর অর্থ এইভাবে করেছেন -
(অস্য মুখম্ ব্রাহ্মণঃ) এই পুরুষের মুখ ব্রাহ্মণ - হল জ্ঞানী, (রাজন্যঃ বাহূ অভবৎ) ক্ষত্রিয় এর বাহু হয়েছে, (মধ্যম্ তৎ অস্য য়ৎ বৈশ্যঃ) এর মধ্যভাগ হল বৈশ্য, (পদ্ভ্যাম্ শূদ্রঃ অজায়ত) পায়ের জন্য শূদ্র হয়েছে।
.
প্রথমে আমরা আচার্য সায়ণের ভাষ্যের উপর আলোচনা করবো যে কিভাবে তিনি নিরাকার ব্রহ্মকে সাকার বানিয়ে, তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ থেকে কিভাবে মনুষ্য উৎপন্ন করে দিয়েছেন। পণ্ডিত সাতবলেকরের ভাষ্য অপেক্ষাকৃত অধিক উচিত আছে। এখানে অথর্ববেদের মধ্যে কিছু পাঠভেদ আছে, সেখানে "উরু" র স্থানে "মধ্যম" পদের প্রয়োগ আছে। ইতি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র বর্ণের তুলনা ক্রমশঃ পরমাত্মার মুখ, বাহু, উদর/উরু আর পায়ের সঙ্গে করেছেন। এর উপর আপত্তি এমন করা হয় যে শূদ্রের তুলনা পায়ের সঙ্গে আর ব্রাহ্মণের তুলনা মুখের সঙ্গে কেন করা হয়েছে?
.
এই বিষয়ে আমি আমার তথা ঋষি দয়ানন্দের ভাষ্য প্রস্তুত করার পূর্বে এটা বলে রাখতে চাইবো যে ব্রাহ্মণ আদি বর্ণ কি? বস্তুতঃ বর্ণ হল যাকে ব্যক্তি নিজের কর্ম আর যোগ্যতার অনুসারে বরণ করে। তার মাতা-পিতা আদির সঙ্গে বর্ণের কোনো সম্পর্ক হয় না। বর্ণ-ব্যবস্থার প্রথম প্রস্তোতা ভগবান্ মনুর অনুসারে মনুষ্যের জীবনে বর্ণের পরিবর্তনও হতে পারে। এই বিষয়ে ভগবান্ মনুর কথন হল -
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্ ।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবম্ তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাত্তথৈব চ ।। (মনু.১০.৬৫)
অর্থাৎ - যদি শূদ্র বর্ণস্থ ব্যক্তি ব্রাহ্মণের যোগ্যতা অর্জন করে নেয়, তাহলে সে ব্রাহ্মণ হয়ে যায় আর যদি ব্রাহ্মণ বর্ণের ব্যক্তি নিজের কর্ম আর যোগ্যতা থেকে নেমে শূদ্রের সমান যোগ্যতার হয়ে যায়, তাহলে সে শূদ্র হয়ে যায়। এইভাবে ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়াদি বর্ণেরও অন্য বর্ণের মধ্যে পরিবর্তন হতে পারে। অন্যদিকে গীতার মধ্যে ভগবান্ শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন -
চাতুর্বর্ণ্যম্ ময়া সৃষ্টম্ গুণকর্মবিভাগশঃ ।
এখানেও ব্রাহ্মণ আদি বর্ণের বিভাজন গুণ, কর্ম আর স্বভাবের আধারেই মানা হয়েছে, জন্মের আধারে মোটেও নয়। গুণ, কর্ম আর স্বভাবের আলোচনাও ভগবান্ মনু এইভাবে করেছেন -
১. ব্রাহ্মণের কর্ম -
অধ্যাপনমধ্যয়নম্ য়জনম্ য়াজনম্ তথা ।
দানম্ প্রতিগ্রহম্ চৈব ব্রাহ্মণানামকল্প য়ৎ ।। (মনু. ১.৮৮)
অর্থাৎ - বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপন, যজ্ঞ করা এবং করানো, দান দেওয়া এবং নেওয়া, এই ছয়টা হল ব্রাহ্মণের কর্ম।
.
এখানে ব্রাহ্মণের মুখ্য যোগ্যতা আর কর্ম হল বেদ পড়া আর পড়ার পর পূর্ণ-বিদ্বান হয়ে অন্যদের বেদ পড়ানো। যারা এই যোগ্যতা প্রাপ্ত করে আর সেই যোগ্যতার অনুসারে নিজের জীবন বানিয়ে নেয়, তারাই ব্রাহ্মণ হয়। এইভাবে আধ্যাত্মিক আর পদার্থ বিদ্যার বৈজ্ঞানিক য়োগীকে ব্রাহ্মণ বলে। এখানে ব্রাহ্মণের য়জন-য়াজন কর্মকেও অনিবার্য বলে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল ব্রাহ্মণকে শিল্প বিজ্ঞানে বিদ্বান, ত্যাগী-তপস্বী, সমাজকে সংগঠিত করতে কুশল হওয়া উচিত আর সমাজের জনগণকে এইরূপ আদেশকারী ব্যক্তি হওয়া উচিত। এখানে এমন কথার কোনো গুরুত্ব নেই যে সেই ব্যক্তির মাতা-পিতা, দাদা-দাদী বা বাপ-ঠাকুরদা কোন বর্ণের। যে ব্যক্তি সমাজে সংগঠন, সহায়ক আর সম্প্রীতির সঞ্চার করতে সক্ষম নয় অথবা এমন করার চেষ্টা করে না অথবা অর্থ আদিতে আসক্ত থাকে, সে ব্যক্তি উচ্চ কোটির বিদ্বান হলেও ব্রাহ্মণ বলার অধিকারী হবে না। এইজন্য মনুস্মৃতি আদি গ্রন্থের মধ্যে বীভৎস প্রক্ষেপকারী সংস্কৃত ভাষা বা ব্যাকরণের মহান পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ বলা যেতে পারে না, বরং তারা প্রচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ-বিরোধী সিদ্ধ হচ্ছে।এইসব ব্যক্তি কারা ছিল, এটা পৃথক অনুসন্ধানের বিষয়।
.
২. ক্ষত্রিয়ের কর্ম -
প্রজানাম্ রক্ষণম্ দানমিজ্যাऽধ্যয়নমেব চ ।
বিষয়েষ্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ ।। (মনু. ১.৮৯)
অর্থাৎ - প্রজার রক্ষা করা, দান দেওয়া, যজ্ঞ করা, বেদাধ্যয়ন করা আর বিষয়ে অনাসক্তি থাকা, এই হল ক্ষত্রিয়ের কর্ম।
.
এর তাৎপর্য হল ক্ষত্রিয়েরও অনিবার্য কর্তব্য হল তারা সব বিদ্যায় বিদ্বান হবে, কারণ অধ্যাত্ম আর পদার্থ বিদ্যায় বিদ্বান না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজাই তার প্রজার পালন আর রক্ষণ করতে পারবে না। এর পাশাপাশি যে রাজা জিতেন্দ্র হবে না, সেও কখনও প্রজার পালন আর রক্ষণ করতে পারবে না। ব্রাহ্মণের মতো ক্ষত্রিয়কেও য়াজ্ঞিক হওয়া উচিত। তার মানে ক্ষত্রিয়ও শিল্প-বিজ্ঞানী, ত্যাগী-তপস্বী, রাষ্ট্রহিতে বিদ্বানদের উচিত উপয়োগকারী তথা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রকে এক সূত্রের মধ্যে বেঁধে রাখতে সক্ষম হওয়া উচিত। এখানেও ক্ষত্রিয়ের জন্মের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই, বরং যোগ্যতা আর আচরণ দ্বারাই ক্ষত্রিয়ত্ব সিদ্ধ হয়, কারণ ক্ষত্রিয় হল প্রজার রক্ষক, এইজন্য অন্যায়ের প্রতি সংঘর্ষ করা, পক্ষপাত রহিত ন্যায়াদি করা, যুদ্ধ-কৌশল আর যুদ্ধনীতিতে নিপুণ হওয়া, বলবান আর বীরযোদ্ধা হওয়া আদি তার স্বাভাবিক গুণ হওয়া উচিত।
.
৩. বৈশ্যের কর্ম -
পশূনাম্ রক্ষণম্ দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ ।
বণিক্পথম্ কুসীদম্ চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ ।। (মনু. ২.৯০)
অর্থাৎ - পশুদের রক্ষা করা, দান দেওয়া, যজ্ঞ করা, বেদাধ্যয়ন করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, সুদ নেওয়া আর কৃষি করা হল বৈশ্যের কর্ম।
.
এখানেও সিদ্ধ হল যে, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের মতো বৈশ্যও বেদ-বিদ্যা অর্থাৎ সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিদ্বান হওয়া উচিত। এরমধ্যেও পশু বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, বিত্তীয় এবং বাণিজ্য প্রবন্ধন আদি বিষয়ে বিশেষ বিদ্বান হওয়া উচিত। এটাও উপরোক্ত দুই বর্ণের মতো য়াজ্ঞিক অর্থাৎ শিল্পবিজ্ঞানী, দানী আর সমাজ ও রাষ্ট্রের সংগঠনের ভাবনা রাখবে এমনটা হওয়া উচিত। এইসব ছাড়া পশুপালন, রক্ষণ, কৃষি এবং ব্যবসা উচিত রীতিতে কখনও করতে পারবে না। এটা হচ্ছে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের আর্থিক মেরুদণ্ড। এখানেও জন্মের কোনো গুরুত্ব নেই, বরং সবকিছু যোগ্যতা আর আচরণের উপর নির্ভর করছে।
.
🌿 জ্ঞাতব্য - এই তিনটা বর্ণ বিশেষতঃ বিদ্বান এবং বুদ্ধিমানদের জন্য হয়েছে, কারণ উচ্চ কোটির বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই এই উপরোক্ত সব কর্ম করতে সক্ষম হবে। এই কারণে বেদ-বিদ্যা পড়া এদের সর্বোপরি কর্তব্য বলে দেওয়া হয়েছে। এদের সবার জন্য যজ্ঞ করাটাও একটা অনিবার্য কর্তব্য বলা হয়েছে, যার উপরোক্ত অর্থের অতিরিক্ত ব্রহ্মযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ আদি পঞ্চ মহাযজ্ঞ করাটাও এরই অন্তর্গত ধরে নেওয়া উচিত। ক্ষত্রিয়, বিশেষভাবে রাজাদের জন্য এই পঞ্চ মহাযজ্ঞের অতিরিক্ত বড়-বড় যজ্ঞ করারও বিধান করা হয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলোর মধ্যে যেকোনো কর্মকে যোগ্যতাপূর্বক করতে সক্ষম হবে না, তাকেই শূদ্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
.
৪. শূদ্রের কর্ম -
একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশত ।
এতেষামেব বর্ণানাম্ শুশ্রূষামনসূয়য়া ।। (মনু. ২.৯১)
অর্থাৎ - ঈশ্বর শূদ্রের জন্য একটাই কর্মের বিধান করেছেন যে তারা ঈর্ষা-দ্বেষ রহিত হয়ে উপরোক্ত তিন বর্ণের সেবা করবে।
.
লোকব্যবহারের মধ্যেও দেখা যায় যে একটা পরিবারের মধ্যে যদি চার ভাই থাকে, তাদের মধ্যে একজন বিদ্বান শিক্ষাবিদ্ হয়, দ্বিতীয়জন কোনো প্রশাসনিক - সেনা অথবা পুলিশের অধিকারী হয়, তৃতীয়জন কোনো উদ্যোগপতি, ব্যবসায়ী, অর্থশাস্ত্রী বা উন্নত কৃষক হয় আর চতুর্থজন এদের অপেক্ষা মন্দবুদ্ধি হওয়ার কারণে এই তিন ভাইয়ের ছোট-খাটো কর্মের মধ্যে সহায়ক মাত্র হয়, তো এরমধ্যে পক্ষপাত বা বৈষম্য কোথা থেকে আসবে? এগিয়ে যাওয়ার সমান সুযোগ সবারই প্রাপ্য, কিন্তু যোগ্যতা অসমান হওয়ার কারণে তারা সমান পদের অধিকারী হতে পারবে না। যদি এমনটা করে দেওয়া হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। এতকিছুর পরও, অসমান পদ হওয়া সত্ত্বেও, তারা ভাই-ভাই থাকবে। এদের মধ্যে পরস্পর নিজেদের মধ্যে প্রেম আর সমতার ব্যবহারই থাকবে। ভগবান্ মনুর দৃষ্টিতে চার বর্ণের মধ্যে এইরূপ সম্বন্ধ হওয়া উচিত। একে আমরা মনু জীর দণ্ড-ব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিকভাবে জানতে পারবো যে তিনি সবথেকে দুর্বল বর্ণ অর্থাৎ শূদ্রদের প্রতি কতটা দয়া ভাব রাখতেন। এই বিষয়ে তিনি লিখেছেন -
অষ্টাপাদ্যম্ তু শূদ্রস্য স্তেয়ে ভবতি কিল্বিষম্ ।
ষোডশৈব তু বৈশ্যস্য দ্বাত্রিম্শৎক্ষত্রিয়স্য চ ।।
ব্রাহ্মণস্য চতুঃষষ্টিঃ পূর্ণম্ বাऽপি শতম্ ভবেৎ ।
দ্বিগুণা বা চতুঃষষ্টিস্তদ্দোষগুণবিদ্ধি সঃ ।। (মনু.৮.৩৩৭-৩৩৮)
.
এখানে ভগবান্ মনুর অনুসারে শূদ্র যদি এক টাকা চুরি করে, তাহলে তাকে আট টাকা দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে, কারণ যদি এক টাকাই দণ্ড হতো, তাহলে সে পুনরায় চুরি করতে পারে। অন্যদিকে বৈশ্যকে এক টাকা চুরির উপর শূদ্রের থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ষোলো টাকা দণ্ড তথা ক্ষত্রিয়কে শূদ্রের থেকে চারগুণ অর্থাৎ বত্রিশ টাকা দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। ক্ষত্রিয় হল সবার রক্ষক আর তার অপরাধ করা অধিক দণ্ডনীয়। ব্রাহ্মণের বিষয়ে ভগবান্ মনুর বিধান হল এই অপরাধে ব্রাহ্মণকে শূদ্রের তুলনায় আরও অধিক দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। সেই দণ্ড চৌষট্টি টাকা, একশ টাকা আর একশ আঠাশ টাকা পর্যন্ত হতে পারে অর্থাৎ শূদ্রের তুলনায় আট থেকে ষোলো গুণ পর্যন্ত দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ভগবান্ মনুকে শূদ্র বিরোধী বলে এমন সংসারের বিচারক আর দণ্ড বিশেষজ্ঞের অতিরিক্ত মনুবিরোধীরা এখন বিচার করুক যে ভগবান্ মনু কি শূদ্র বিরোধী, নাকি শূদ্রদের সবথেকে বড় হিতৈষী? ভগবান্ মনুর দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি যত অধিক বুদ্ধিমান বা সমৃদ্ধ হবে, অপরাধের জন্য সে ততটাই অধিক দণ্ডনীয় হবে। রাজার বিষয়ে ভগবান্ মনুর কথন হল -
কার্ষাপণম্ ভবেদ্দণ্ড্যো য়ত্রান্যঃ প্রাকৃতো জনঃ ।
তত্র রাজা ভবেদ্দণ্ড্যঃ সহস্রমিতি ধারণা ।। (মনু. ৩.৩৩৬)
.
এখানে রাজাকে সাধারণ ব্যক্তির তুলনায় এক হাজার গুণ অধিক দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। এই বিষয়ে সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন -
"মন্ত্রী অর্থাৎ রাজার "দেওয়ানের" আটশ গুণ, তদপেক্ষা নিম্নপদস্থের সাতশ গুণ, তদপেক্ষা নিম্নপদস্থের ছয়শ গুণ, এইভাবে ক্রমশঃ নিম্নপদস্থের অল্পদণ্ড হবে। ভৃত্য অর্থাৎ চাপরাসী প্রভৃতির আট গুণ অপেক্ষা কম দণ্ড হওয়া উচিত নয়। কারণ, প্রজা অপেক্ষায় রাজকর্মচারীদের দণ্ড অধিক না হলে তারা প্রজাদের বিনাশ করবে। যেমন, সিংহ অধিক দণ্ড দ্বারা কিন্তু ছাগী অল্প দণ্ড দ্বারা বশীভূত হয়, সেইরূপ রাজা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ভৃত্য পর্যন্ত রাজকর্মচারীর অপরাধের জন্য প্রজা অপেক্ষা অধিক দণ্ড হওয়া উচিত। (সত্যার্থপ্রকাশ, ষষ্ঠ সমুল্লাস)
.
বর্তমান লোকতান্ত্রিক প্রণালীর প্রশংসকদের উচিত যে তারা বিশ্বের যেকোনো দেশের দণ্ড-ব্যবস্থাতে শূদ্রের প্রতি এত দয়া-করুণা আমাকে দেখাক। আমাদের ভারতের মধ্যে তো আমরা দেখতেই পাই যে, রাজা অর্থাৎ মন্ত্রীদের হয় দণ্ডই নেই আর যদিও বা কারও দণ্ড হয়, তাহলেও সে পূর্ণ সুবিধাজনক দণ্ড প্রাপ্ত করে, কারাগারে বসে-বসে সে নির্বাচনের লড়াইও করতে পারে আর জামিনে বেরিয়ে এসে শাসনও করতে পারে। অন্যদিকে শূদ্র অর্থাৎ অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত ব্যক্তি সামান্য অপরাধের কারণে কত যন্ত্রণা সহ্য করে, সেইসব লেখার আবশ্যকতা নেই। আজ এভাবেই সর্ব-সুবিধাভোগীরা জাতির রাজনীতি করতে-করতে ভগবান্ মনুর নিন্দা করে বেড়ায়। আজ যদি ভগবান্ মনুর ব্যবস্থা থাকতো তাহলে বিধায়িকা, ন্যায়পালিকা অথবা কার্যপালিকাতে কোনোরূপ কোনো অপরাধীর স্থান হতো না আর অপরাধীদের দেওয়া দণ্ড দিয়ে রাজকোষ ভরে যেতো আর কোনো কৃষক, শ্রমিক, নির্ধন আর অশিক্ষিত ব্যক্তি কখনও দুঃখী আর শোষিত হতো না।
.
যদি মনুপ্রোক্ত ব্যবস্থা আজ হতো তাহলে দেশের মধ্যে কোনো অশিক্ষিতই থাকতো না, কারণ সেই ব্যবস্থার মধ্যে প্রত্যেক বালক আর বালিকাকে অনিবার্য রূপে শিক্ষা দেওয়ার বিধান ছিল। সমস্ত গুরুকুল বা বিদ্যালয় আবাসীয় হতো, যেখানে সকল বিদ্যার্থীর জন্য সমান ভোজন, বস্ত্র, শিক্ষা, শয্যা, চিকিৎসা আদির ব্যবস্থা রাজ্যের পক্ষ থেকে হতো। তা সে বিদ্যার্থী রাজকুমার হোক অথবা শূদ্র অথবা ভিক্ষুকের সন্তান হোক, সবার জীবনের-স্তর পূর্ণতঃ সমান রাখা হতো। কোনো বিদ্যার্থীর অভিভাবক, সে রাজাই হোক না কেন, নিজের পুত্রকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারতো না। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের কোনো বালক অথবা বালিকা অশিক্ষিত থাকবে না আর নির্ধন মাতা-পিতাকে নিজের সন্তানের শিক্ষা পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ তাদের যুবকাবস্থা হওয়া পর্যন্ত তাদের আহার-বিহার, বস্ত্র, শিক্ষা আর চিকিৎসা আদি কোনো ধরণের অর্থ ব্যয়ের কোনো চিন্তা করতে হতো না। এইভাবে নিজের সন্তানের সব চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে শ্রমিকও নিজের জীবন সানন্দে ব্যতীত করতে পারতো।
.
হায় রে! যদি আজ ভগবান্ মনুর অনুসারে শাসন হতো, তাহলে দেশের প্রত্যেকটা শিশু পড়াশুনা করতো, কেউ ভিক্ষা করে বেড়াতো না, কেউ শিশুশ্রমের অভিশাপ ভোগ করতো না, কেউ গলিতে-গতিতে আবর্জনা তুলতো না, কেউ বস্তি-কুঁড়েঘরে দুঃখী জীবন ব্যতীত করতো না, কেউ ফুটপাতের উপর শুতো না, যাকে ধনের অহংকারে অন্ধ কেউ তার গাড়ি দিয়ে পিষে দেয়। ভগবান্ মনুর শূদ্র অর্থাৎ শ্রমিক না তো নির্ধন হতো আর না নিতান্ত অশিক্ষিত। তার মধ্যে বেদ পড়ার ক্ষমতা নেই তো তাতে কি হয়েছে, সে অন্য বিদ্যা তো পড়তে পারতো আর তারা পড়তো। এই কারণে পিতামহ ভীষ্ম শূদ্রকেও মন্ত্রী হওয়ার অধিকার দিয়েছেন। মহাভারতকার লিখেছেন -
চতুরো ব্রাহ্মণান্ বৈদ্যান্ প্রগল্ভান্ স্নাতকাঞ্শুচীন্ ।
ক্ষত্রিয়াম্শ্চ তথা চাষ্টৌ বলিনঃ শস্ত্রপাণিনঃ ।।
বৈশ্যান্ বিত্তেন সম্পন্নানেকবিম্শতিসম্খ্যয়া ।
ত্রীম্শ্চ শূদ্রান্ বিনীতাম্শ্চ শুচীন্ কর্মণি পূর্বকে ।।
অষ্টাভিশ্চ গুণৈর্য়ুক্তম্ সূতম্ পৌরাণিকম্ তথা ।
পঞ্চাশদ্বর্ষবয়সম্ প্রগল্ভমনসূয়কম্ ।।
(মহাভারত-শান্তিপর্ব-রাজধর্মানু-শাসনপর্ব ৮৫.৭-৯)
অর্থাৎ - রাজার উচিত যারা বেদবিদ্যার বিদ্বান, নির্ভীক, বাহ্য-অন্তর শুদ্ধ এবং স্নাতক হবে, এমন চার ব্রাহ্মণ, শারীরিক ভাবে বলবান তথা শস্ত্রধারী আট ক্ষত্রিয়, ধন-ধান্যে সম্পন্ন একুশ বৈশ্য, পবিত্র আচার-বিচারশীল তিন বিনয়শীল শূদ্র তথা আটগুণ যুক্ত এবং পুরাণবিদ্যার জ্ঞাতা একজন সূত মনুষ্য, এইসব ব্যক্তিদের নিয়ে একটা মন্ত্রিমণ্ডল বানানো। সেই সূতের অবস্থা অন্তত পঞ্চাশ বর্ষ হবে আর সে নির্ভীক তথা দোষদৃষ্টি হতে রহিত হবে।
.
এখন আপনারাই ভাবুন, মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য শূদ্র কি শিক্ষিত হবে না? অবশ্যই হবে। এখনও কি কেউ মনু জীর উপর অস্পৃশ্যতা আর বৈষম্য আদির দোষ দিতে পারবে? ঋষি দয়ানন্দ তো সত্যার্থ প্রকাশের মধ্যে এটাও লিখে দিয়েছেন -
প্রশ্ন - যদি কারও একটি মাত্র পুত্র বা কন্যা থাকে এবং সেই পুত্র বা কন্যা অন্য বর্ণে প্রবিষ্ট হয়, তবে তার মাতা বা পিতার সেবা কে করবে? তাতে বংশচ্ছেদও ঘটবে। এর কী ব্যবস্থা হওয়া উচিত?
উত্তর - কারও সেবাভঙ্গ অথবা বংশচ্ছেদ হবে না। কারণ তারা নিজ-নিজ পুত্র কন্যার পরিবর্তে বিদ্যাসভা ও রাজসভার ব্যবস্থা অনুসারে স্ববর্ণযোগ্য অন্য সন্তান প্রাপ্ত করবে। সুতরাং কোনো অব্যবস্থা হবে না।
.
এখন পাঠক বিচার করুন, যে বৈদিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রহিতে গুণ-কর্ম-স্বভাব এবং যোগ্যতার সম্মান করার জন্য নিজের সন্তানকেও অন্যকে সমর্পণ করার আদেশ বা প্রেরণা দেয়, সেই ব্যবস্থা থেকে আদর্শ আর কি হতে পারে? আজ সংসারে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে শান্তি, আনন্দ আর সন্তোষ আছে। এইসব মনুপ্রোক্ত বৈদিক ব্যবস্থাকে ভুলে যাওয়ার কারণেই হয়েছে।
ব্রা॒হ্ম॒ণো᳖ऽস্য॒ মুখ॑মাসীদ্ বা॒হূ রা॑জ॒ন্যঃ᳖ কৃ॒তঃ ।
ঊ॒রূ তদ॑স্য॒ য়দ্বৈশ্যঃ॑ প॒দ্ভ্যাᳬ শূ॒দ্রোऽঅ॑জায়ত ॥ যজু০ ৩১।১১
ঊ॒রূ তদ॑স্য॒ য়দ্বৈশ্যঃ॑ প॒দ্ভ্যাᳬ শূ॒দ্রোऽঅ॑জায়ত ॥ যজু০ ৩১।১১
এখন আমি এখানে এই মন্ত্রের উপর ঋষি দয়ানন্দের ভাষ্য ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা থেকে উদ্ধৃত করবো -
ভাষ্যম্ - (ব্রাহ্মণোऽস্য..) অস্য পুরুষস্য মুখম্ য়ে বিদ্যাদয়ো মুখ্যগুণাঃ সত্যভাষণোপদেশাদীনি কর্মাণি চ সন্তি, তে য়ো ব্রাহ্মণ আসীদ্ উৎপন্নো ভবতীতি । (বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ) বলবীর্য়্যাদিলক্ষণান্বিতো রাজন্যঃ ক্ষত্রিয়স্তেন কৃত আজ্ঞপ্ত আসীদুৎপন্নো ভবতি । (ঊরু তদস্য..) কৃষিব্যাপারাদয়ো গুণা মধ্যমাস্তেভ্যো বৈশ্যো বণিগ্জনোऽস্য পুরুষস্যোপদেশাদ্ উৎপন্নো ভবতীতি বেদ্যম্ । (পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রো..) পদ্ভ্যাম্ পাদেন্দ্রিয়নীচত্বমর্থাজ্জডবুদ্ধিত্বাদিগুণেভ্যঃ শূদ্রঃ সেবাগুণবিশিষ্টঃ পরাধীনতয়া প্রবর্ত্তমানোऽজায়ত জায়ত ইতি বেদ্যম্ ।
ভাবার্থ - (ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্) এই পুরুষের আজ্ঞানুসারে বিদ্যা ও সত্যভাষণাদিরূপ উত্তম গুণ আর শ্রেষ্ঠ কর্মের দ্বারা ব্রাহ্মণ বর্ণ উৎপন্ন হয়, এই ব্রাহ্মণ বর্ণস্থ মুখ্যকর্ম আর শুভ গুণযুক্ত হওয়ার কারণে মনুষ্যের মধ্যে একে উত্তম বা শ্রেষ্ঠ বলা হয়। (বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ) সেই পরম পুরুষ পরমেশ্বর বল আর পরাক্রম আদি গুণযুক্ত করে ক্ষত্রিয় বর্ণের উৎপত্তি করেছেন। (ঊরু তদস্য..) কৃষির ব্যাপারে পারদর্শী এবং দেশ-বিদেশের ভাষাভিজ্ঞ তথা পশু পালনাদি মধ্যমগুণযুক্ত হওয়ার জন্য বৈশ্য বর্ণ সিদ্ধ হয়েছে। (পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রো..) যেরূপ পাদ সর্বাপেক্ষা নিম্ন অঙ্গ হয়, সেইরূপ মূর্খতাদি নিম্নগুণ হতে মনুষ্যের মধ্যে শূদ্রবর্ণ হয়েছে।
.
য়জুর্বেদ ভাষ্য ৩১.১১ এই মন্ত্রের ভাষ্য ঋষি দয়ানন্দ এইভাবে করেছেন -
পদার্থ - (ব্রাহ্মণঃ) বেদেশ্বরবিদনয়োঃ সেবক উপাসকো বা (অস্য) ঈশ্বরস্য (মুখম্) মুখমিবোত্তমঃ (আসীত্) অস্তি (বাহূ) ভুজাবিব বলবীর্য়্যয়ুক্তঃ (রাজন্যঃ) রাজপুত্রঃ (কৃতঃ) নিষ্পন্নঃ (ঊরু) ঊরু ইব বেগাদিকর্মকারী (তৎ) (অস্য) (য়ৎ) (বৈশ্যঃ) য়ো য়ত্র তত্র বিশতি প্রবিশতি তদপত্যম্ (পদ্ভ্যাম্) সেবানিরভিমানাভ্যাম্ (শূদ্রঃ) মূর্খত্বাদিগুণবিশিষ্টো মনুষ্যঃ (অজায়ত) জায়তে।
.
ভাবার্থ - য়ে বিদ্যাশমদমাদিষু গুণেষু মুখমিবোত্তমাস্তে ব্রাহ্মণাঃ । য়েऽধিকবীর্য়্যা বাহুবক্তার্য়্যসাধকাস্তে ক্ষত্রিয়াঃ । য়ে ব্যবহারবিদ্যাকুশলাস্তে বৈশ্যা য়ে চ সেবায়াম্ সাধবো বিদ্যাহীনাঃ পাদাবিব মূর্খত্বাদিনীচগুণয়ুক্তাস্তে শূদ্রাঃ কার্য়্যা মন্তব্যাশ্চ ।
.
পদার্থ - হে জিজ্ঞাসু গণ! তোমরা (অস্য) এই ঈশ্বরের সৃষ্টিতে ( ব্রাহ্মণঃ) বেদ ঈশ্বরের জ্ঞাতা তাঁর সেবক বা উপাসক (মুখম্) মুখের তুল্য উত্তম ব্রাহ্মণ (আসীত্) হয়েছে (বাহূ) বাহুর তুল্য বল পরাক্রমযুক্ত (রাজন্যঃ) রাজপুত (কৃতঃ) করেছেন (য়ৎ) যা (ঊরু) উরুর তুল্য বেগাদি কর্মকারী (তৎ) তা (অস্য) এর (বৈশ্যঃ) সর্বত্র প্রবেশ কারী বৈশ্য হয়েছে (পদ্ভ্যাম্) সেবাযুক্ত আর অভিমান রহিত হওয়ায় (শূদ্রঃ) মূর্খতাদি গুণ যুক্ত শূদ্র (অজায়ত) উৎপন্ন হয়েছে, এগুলো উত্তম ক্রমানুসারে জানবে।
ভাবার্থ - যারা বিদ্যা আর শমদমাদি উত্তম গুণে মুখের তুল্য উত্তম হবে তারা ব্রাহ্মণ, যারা অধিক পরাক্রমশালী ভুজার তুল্য কর্মকে সিদ্ধ করতে সক্ষম হবে তারা ক্ষত্রিয়, যারা ব্যবহার বিদ্যাতে প্রবীণ হবে তারা বৈশ্য আর যারা সেবাতে প্রবীণ, বিদ্যাহীন, মূর্খতাদি নিম্নগুণযুক্ত হবে তাদের শূদ্র করা আর মানা উচিত।
.
ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকাতে ঋষি "ঊরু" পদের অর্থ "মধ্যম" করেছেন, তো য়জুর্বেদ-ভাষ্যতে "ঊরু"-র অর্থ "জঙ্ঘা" করেছেন। উণাদিকোষে এর ব্যুৎপত্তি করে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন -
ঊর্ণোত্যাচ্ছাদয়তি য়া সা ঊরুঃ জঙ্ঘা ।
এই ব্যুৎপত্তি দ্বারা সম্পূর্ণ কোমর-ক্ষেত্র, এরমধ্যে জঙ্ঘা আর নাভিক্ষেত্র সম্মিলিত আছে, তাকে ঊরু বলা যেতে পারে। এখন এই উপমার উপর আমরা ক্রমশঃ আলোচনা করবো -
১. ব্রাহ্মণ -
এই বর্ণের তুলনা পুরুষের মুখ অর্থাৎ মাথার সঙ্গে করা হয়েছে। এই মন্ত্রের দেবতা হল পুরুষ, যা পরমাত্মার অর্থে প্রযুক্ত, কিন্তু পরমাত্মার মুখাদি অঙ্গ হয় না। এইজন্য এখানে আধিভৌতিক অর্থে পুরুষ শব্দ দ্বারা পুরুষকৃত সৃষ্টি অর্থাৎ ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি, বিশেষতঃ মানব-সমাজের গ্রহণ করবো। শরীরের মধ্যে যেমন মাথা সম্পূর্ণ শরীরের মার্গদর্শক, প্রেরক ও সঞ্চালক হয়, সেটাই দেখে, শোনে, শোঁকে, চাতে আর কথা বলে, সেটাই উপদেষ্টা আর প্রত্যেক কর্মের নির্দেশক রূপ হয়। এইজন্য তাকে সম্পূর্ণ শরীরের মধ্যে সবথেকে শ্রেষ্ঠ ভাগ মানা হয় আর সেটা শ্রেষ্ঠই হয়। যদি আমরা মানব সমাজের প্রেক্ষাপটে বিচার করি, তাহলে ব্রাহ্মণ অর্থাৎ বিদ্বান, য়োগী, শিক্ষকই সমাজের নির্দেশক, মার্গদর্শক আর প্রেরক হবে। সব বর্ণকে এরাই মার্গ দেখায়, অথচ এদের মার্গ দর্শক কেউ হয় না। এইজন্য ব্রাহ্মণকে পুরুষের মুখের সঙ্গে তুলনা তর্কের সর্বথা অনুকূল হবে। যে রাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ বর্গ অর্থাৎ শিক্ষক, উপদেশক, বৈজ্ঞানিক আদি অল্পবুদ্ধিযুক্ত হয়, সেই রাষ্ট্র মাঝি হীন নৌকোর সমান দিশাহীন আর সংকটাপন্ন হয়।
২. ক্ষত্রিয় -
এই বর্ণের তুলনা পুরুষ অর্থাৎ সমাজের বাহুর সঙ্গে করা হয়েছে। যেমন শরীরের সম্পূর্ণ বল বাহুর মধ্যেই হয়। বাহুই নিজের বল দ্বারা সম্পূর্ণ শরীরের রক্ষা করে, সেইরূপ সমাজের মধ্যে ক্ষত্রিয়ই সবথেকে অধিক বলশালী হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ সমাজের রক্ষার জন্য উত্তরদায়ী হয়। এই কর্মে অন্য কোনো অঙ্গ সক্ষম হয় না। এইজন্য ক্ষত্রিয়কে পুরুষ অর্থাৎ সমাজের বাহু বলা হয়েছে। শরীরের মধ্যে যেমন দুটো বাহু আছে, ক্ষত্রিয়ের মধ্যেও দুটো বল আছে, যথা - বুদ্ধিবল আর বাহুবল। সে এই বলের প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ রাষ্ট্র আর সমাজের রক্ষক তথা পালক হয়। যে রাষ্ট্রের ক্ষত্রিয় অর্থাৎ রাজা, সেনা আর ন্যায়াধীশ আদি ভীতু, বলহীন তথা মন্দবুদ্ধির হয়, সেই রাষ্ট্রের স্বতন্ত্রতা আর সম্মানকে বাঁচানোর কেউ থাকে না।
.
৩. বৈশ্য -
এই বর্ণের তুলনা পুরুষের ঊরু আর কোমরের সঙ্গে করা হয়েছে। কোমরের ক্ষেত্র শরীরের তিন গুরুত্বপূর্ণ তন্ত্রকে আচ্ছাদনকারী হয় যথা - পাচন তন্ত্র, উৎসর্জন তন্ত্র এবং উৎপাদক তন্ত্র। পাচন দ্বারা শরীরের বিস্তার ও পোষণ আর উৎপাদক দ্বারা সন্ততি-বিস্তার আদি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকে আচ্ছাদন ও সম্পাদন করার কারণেই এই ক্ষেত্রকে "ঊরু" বলে। সমাজের মধ্যে বৈশ্য অর্থাৎ ব্যবসায়ী, কৃষক আর পশুপালকও এই কাজ করে। তারা সম্পূর্ণ সমাজের ভরণ-পোষণ করে তথা পশুদেরও ভরণ-পোষণ করে। শরীরের মধ্যে যেমন ঊরু সম্পূর্ণ শরীরের ভার তুলে ধরে, সেইরূপ সমাজের মধ্যে বৈশ্য বিত্ত, অন্ন, বস্ত্র, দুগ্ধ আদির দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমাজের ভার বহন করে। যার ঊরু দুর্বল হবে সে ব্যক্তি দাঁড়িয়েও থাকতে পারবে না। সেইরূপ যে রাষ্ট্রের মধ্যে বৈশ্য দুর্বল বা নির্ধন হবে, সেই রাষ্ট্র নষ্ট হয়ে যাবে।
.
৪. শূদ্র -
এই বর্ণের তুলনা পায়ের সঙ্গে করা হয়েছে। যদি আমরা আমাদের শরীর রচনার উপর বিচার করে, তাহলে একথায় কেউ বিরোধ করবে না যে পা হচ্ছে সম্পূর্ণ শরীরের আধার। সমস্ত অঙ্গের ভার এই বহন করে, এইরূপ সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রমিকই সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের আধার হয়। শিক্ষার বড়-বড় সংস্থান হোক, রাজসভা বা সেনা হোক, ন্যায়ালয় অথবা কৃষি-ব্যাপারের বড়-বড় উদ্যোগপতি হোক, চিকিৎসালয় হোক অথবা পরীক্ষাগার, এইসবের মধ্যে ভূমি পৃষ্ঠের উপর শ্রমিকই কাজ করে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য সবাইকে শূদ্রের আবশ্যকতা হয়। কেউ কি বলবে যে আমাদের পা হচ্ছে শরীরের ঘৃণিত অঙ্গ, পা যদি ঘৃণিত অঙ্গ না হয় তাহলে শূদ্র কিভাবে ঘৃণিত হতে পারে?
.
বর্ণের পারস্পরিক সমন্বয় -
আমরা শরীরের মধ্যে এমন ভারসাম্য দেখি যে যখন পায়ে কোনো কাঁটা হানে, তখন ব্যথার অনুভব মাথায় হয় আর তখন মাথা হাতকে সেই পায়ের ব্যথা দূর করার আদেশ দেয়। যেকোনো অঙ্গে কষ্ট হোক না কেন, তার ব্যথা আমাদের মাথাই অনুভব করে আর হাত সেইসব রক্ষা করে। যখন কাদা, মাটি, কাঁটা আদিকে পেরিয়ে যেতে হয়, তখন আমাদের এই পা সবাইকে পার করিয়ে দেয়, অন্য কোনো অঙ্গ এই কাজ করতে পারে না আর যখন কাঁটা, কাদা, পাথর অত্যধিক মাত্রায় থাকে, তখন মাথার প্রেরণা নিয়ে হাত মার্গকে পরিষ্কার করে দেয় আর সে পায়ের চলার যোগ্য বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে উদরকে দেখুন, ভোজন থেকে সব রস অবশোষিত করে নিজের কাছে সে কিছুই সঞ্চিত রাখে না, তার কাছে রসের ভাণ্ডারের কোনো ব্যবস্থা নেই, বরং সে সম্পূর্ণ রসকে সব অঙ্গের ব্যবস্থিত অনুপাতে বিতরণ করতে থাকে। বেদ বিভিন্ন বর্ণকে শরীরের অঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে মনুষ্যকে উৎকৃষ্ট সমাজ নির্মাণের প্রেরণা দিয়েছে।
.
এখন ভাবুন, আজ সমাজে শ্রমিক সবথেকে অধিক দুঃখী কেন? এর কারণ হল আজ অশিক্ষিত শ্রমিকের দুঃখের অনুভব বড়-বড় প্রবুদ্ধজনদের হচ্ছে না। যদি শ্রমিকরূপী পায়ে ছোট্ট একটা কাঁটা হানার ব্যথা আজকের মস্তক-রূপ ঐশ্বর্যসম্পন্ন বুদ্ধিজীবিদের হতো, ন্যায়াধীশ আর ধর্মাচার্যদের হতো আর তারা বাহুর সমান কর্ম করে এমন বিধায়িকা আর কার্যপালিকাকে শ্রমিক আর নির্ধনদের ব্যথা দূর করার প্রেরণা বা আদেশ দিতো, তাহলে সংসারের মধ্যে কোনো শ্রমিক, নির্বল বা নির্ধন এইভাবে পীড়িত আর শোষিত হতো না। যদি সংসারের উদ্যোগপতি আর অন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজের উদর থেকে প্রেরণা নিয়ে অন্ন আর ধন সম্পদের অপরিমিত ভাণ্ডার না করে সম্পূর্ণ সমাজে বিতরণ করতো, তাহলে সমাজের মধ্যে কেউই নির্ধন হতো না, না কেউ ক্ষুধার্ত আর নগ্ন থাকতো, না কেউ কুপোষক আর রোগগ্রস্ত হতো। যদি সমাজের ক্ষত্রিয় অর্থাৎ নেতা, অধিকারী, নিরাপত্তা বাহিনী আর রাজকর্মচারী নিজের বাহু থেকে প্রেরণা নিয়ে সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ, এমনকি সমস্ত পশু-পক্ষীর রক্ষার উত্তরদায়িত্ব পালন করতো, তাহলে আজ কোনো সবল ব্যক্তি নির্বলের সঙ্গে অন্যায় করতে পারতো না আর না কেউ নির্বল থাকতো, বরং সবাই আত্মসম্মানের সঙ্গে সবল হয়ে জীবনযাপন করতো।
.
আজ দুর্ভাগ্যবশতঃ এই মন্ত্র থেকে প্রেরণা নেওয়ার পরিবর্তে বেদ এবং ভগবান্ মনু আদি ঋষিদেরই নিন্দা করা হচ্ছে। এই নিন্দাকারী মহানুভব শূদ্র অর্থাৎ শ্রমিক নয়, বরং এরা হচ্ছে বড়-বড় নেতা, অভিনেতা, উচ্চ অধিকারী, লেখক, সাহিত্যকার, শিক্ষাবিদ এবং তথাকথিত সামাজিক নেতা। বড়-বড় পদের উপভোগ করা সত্ত্বেও এরা নিজেকে শূদ্র বলে, এটা ভারী আশ্চর্যের বিষয়। ভগবান্ মনু যাদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যের পদ দিয়েছেন, এরই সঙ্গে সেই মহানুভব, যারা স্বয়ংকে রাজা বা ঋষিদের বংশধর বলে, তারাও সরকার থেকে কিছু লাভ প্রাপ্ত করার লোভে নিজেদের আত্মসম্মান বেচে দিয়ে স্বয়ংকে পিছিয়ে পরাই বানিয়ে রাখতে চায়, এটা বিড়ম্বনা নয়তো কি?
.
যদি আজ মনু জীর ব্যবস্থা লাগিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতিক দলের জাতি-আধারিত বিভাজনকারী রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে আর ভারতের মধ্যে কেবল একটা জাতি থাকবে আর সেই জাতিটা হল - মনুষ্য আর তাদের যোগ্যতা আর গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুসারে দেশকে সুব্যবস্থিত রূপে চালানোর জন্য চার বর্ণ হয়ে যাবে - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র, যাদের বিষয়ে আমি পূর্বেই লিখে দিয়েছি। এতে কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব আর বৈষম্য হবে না, বরং সবার মধ্যে প্রেম, ভ্রাতৃত্ব আর সহযোগিতার ভাব হবে।
.
এখন আমি প্রাক্বর্ণিত মন্ত্রের উপর আমার অন্য মৌলিক বিচার প্রস্তুত করবো। এই মন্ত্রের বিষয়ে পূর্বোক্ত আচার্যদের যে ভাষ্য আছে, সেগুলো আধিভৌতিক দৃষ্টিতে করা হয়েছে, যা সরাসরি সমাজ বা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে। এই সব ভাষ্যের মধ্যে ঋষি দয়ানন্দকৃত ভাষ্য অধিক স্পষ্ট আর ব্যবস্থিত, যার ব্যাখ্যা আমি আধিভৌতিক দৃষ্টিতে করে দিয়েছি। এইজন্য পৃথকভাবে এর আধিভৌতিক ভাষ্য করার কোনো আবশ্যকতা আছে বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু অন্য দু্ই প্রকারের ভাষ্য যারমধ্যে যেকোনো মন্ত্রের স্বাভাবিক ভাষ্য আছে, তাতে আধিদৈবিক ভাষ্য সম্মিলিত, সেই ভাষ্য প্রস্তুত করবো।
.
আধিদৈবিক ভাষ্য
এর জন্য আমি এই মন্ত্রটা পুনরায় উদ্ধৃত করছি -
ব্রাহ্মণোऽস্য মুখমাসীদ্ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ ।
ঊরু তদস্য য়দ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাᳬ শূদ্রোऽজায়ত ।।
(য়জুর্বেদ ৩১.১১)
এই মন্ত্রের ঋষি হল নারায়ণ। [নরঃ = অশ্বনাম (নিঘণ্টু ১.১৪), নয়নকর্ত্তারো মনুষ্যা বায়বো বা (ম.দ.ঋ.ভা. ১.১৬৪.১০)] আশুগামী মরুদ্ রশ্মি অথবা কিরণকেই নর বলে আর এদের জন্য যে পথ তৈরি করে অথবা এদের যে নিয়ে যায়, তাকে নারায়ণ বলে। এইজন্য এই ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি প্রাণ আর অপানের মিশ্রিত রূপ থেকে হয়। এখানে "নরঃ" পদের অর্থ হল ধনঞ্জয় রশ্মি আর তার থেকে উৎপন্ন "নারঃ" হল প্রাণাপানের মিশ্রিত রূপ। এর দেবতা হল পুরুষ। [পুরুষঃ = পুরুষো বৈ য়জ্ঞঃ (জৈ.উ. ৪.২.১), পুরুষো বাব সম্বতৎসরঃ (শ.১২.২.৪.১), পুরুষ এব সবিতা (জৈ.উ. ৪.২৭.১৭)]
.
এর ছন্দ নিচৃদনুষ্টুপ্ হওয়াতে এর দৈবত আর ছান্দস প্রভাব দ্বারা সূর্যলোকে হতে চলা বিভিন্ন সংযোগাদি ক্রিয়াতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রশ্মি অধিক অনুকূলতার সঙ্গে কর্ম করতে সক্ষম হয় আর সেই রশ্মির ক্ষেত্রে তাতে উৎপন্ন রঙের সঙ্গে-সঙ্গে লালিমাযুক্ত বাদামী রঙের প্রকাশেরও উৎপত্তি হতে থাকে। এর আধিদৈবিক ভাষ্য এইরূপ হবে -
.
(ব্রাহ্মণঃ, অস্য, মুখম্, আসীত্) [ব্রাহ্মণঃ = গায়ত্রছন্দা বৈ ব্রাহ্মণঃ (তৈ.১.১.৯.৬), গায়ত্রো বৈ ব্রাহ্মণঃ (ঐ.১.২৮, জৈ.২.১০২)] কেবল সূর্যই নয়, বরং সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে হতে চলা য়জন ক্রিয়াতে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি মুখের কাজ করে। যেমন শরীরের মধ্যে মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী সম্পূর্ণ শরীরের জন্য প্রেরণা দেওয়ার কাজ করে অথবা সম্পূর্ণ শরীরের পোষণের জন্য মুখ অন্নাদির ভক্ষণ করে, সেই রকম গায়ত্রী ছন্দ রশ্মি বিভিন্ন পদার্থের সংযোগের সময় অনিবার্য এবং প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। এই রশ্মিগুলোই অন্য সব রশ্মি আদি পদার্থকে বিভিন্ন য়জন প্রক্রিয়ার জন্য প্রেরিত করে। প্রসিদ্ধ "ওম্" রশ্মি হল দৈবী গায়ত্রী ছন্দ, এটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ সৃষ্টির আদ্যপ্রেরক এবং আধার।
.
(বাহূ, রাজন্যঃ, কৃতঃ) [বাহূ = বাহূ কস্মাৎ? প্রবাধত আভ্যাম্ কর্মাণি (নিরুক্ত ৩.৮)। ত্রিষ্টুব্ছন্দা বৈ রাজন্যঃ (তৈ.ব্রা.১.১.৯.৬), রাজন্যঃ = আনুষ্টুভো রাজন্যঃ (মৈ.৪.৪.১০); (তাণ্ড.১৮.৮.১৪), ত্রৈষ্টুভো রাজন্যঃ (জৈ.২.১০২)] এই সৃষ্টি যজ্ঞতে, যারমধ্যে সূর্যাদি লোকের মধ্যে হতে চলা য়জন ক্রিয়াও সম্মিলিত আছে, ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি বাহুর সমান উৎপন্ন হয় অর্থাৎ সেগুলো বাহুর সমান কাজ করে। মানুষ যেমন বাহুর দ্বারা সব কাজ সম্পাদিত করে, কারণ সে নিজের বলের প্রয়োগ বাহু দ্বারাই করতে পারে, সেইরকম সৃষ্টির মধ্যে তীব্র বল দ্বারা হতে চলা কাজ ত্রিষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিগুলোই করে, এইজন্য মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য এর তুলনা ইন্দ্রের সঙ্গে করে লিখেছেন - "ইন্দ্রস্ত্রিষ্টুপ্" (শ.৬.৬.২.৭) এই রশ্মিগুলোই বিভিন্ন বাধক রশ্মিকে নষ্ট করার জন্য বজ্রের কাজ করে। যখন এই রশ্মি অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সাথে মিলিত হয়, তখন এরা আরও অধিক শক্তিশালী হয়ে অন্য অনেক রশ্মি আদি পদার্থকে উৎপন্ন করতে থাকে। এইজন্য মহর্ষি ঐতরেয় মহীদাস বলেছেন -
"বৃষা বৈ ত্রিষ্টুব্ য়োষানুষ্টুপ্" (ঐ.আ.১.৩.৫, তু.কৌ.২০.৩)
.
এছাড়া অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মি অন্য যেকোনো ছন্দ রশ্মিকে অধিক অনুকূলতা এবং সক্রিয়তা প্রদান করে। এই কারণে এই দুই ছন্দ রশ্মির মিশ্রিত রূপ সূর্যাদি লোক বা সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বাহুর কাজ করে।
.
(ঊরু, তৎ, অস্য, য়ৎ, বৈশ্যঃ) [বিশ্ = বিড্ জগতী (জৈ.১.২৮৬), বৈশ্যো জগতীছন্দাঃ (জৈ.১.৬৯)] এই সৃষ্টিযজ্ঞতে জগতী ছন্দ রশ্মিগুলো উরুর সমান ব্যবহার করে অর্থাৎ এই ছন্দ রশ্মি সব পদার্থকে আচ্ছাদিত করে দূর-দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়, এইজন্য এই রশ্মির বিষয়ে ঋষিগণ বলেছেন - "গততমম্ ছন্দঃ" (নিরুক্ত ৭.১৩), "জগতী গততমম্ ছন্দঃ" (দে. ৩.১৭) অর্থাৎ এই ছন্দ দূর-দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়, এইজন্য একে জগতী বলে আর এইজন্য এর তুলনা উরু (জঙ্ঘা এবং কোমর) ক্ষেত্রের সঙ্গে করা হয়েছে। এই ছন্দ রশ্মির সঙ্গে অন্য ছন্দ রশ্মির বিস্তার হয়, এইজন্য মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন - "জগতী সর্বাণি ছন্দাম্সি" (শ.৬.২.১.৩০)। যেরূপ কোমরের মধ্যে অন্য তন্ত্রের পাশাপাশি উৎপাদক তন্ত্রও বিদ্যমান থাকে, সেইরূপ এই রশ্মির সঙ্গে পদার্থ উৎপাদনের বিশেষ সম্বন্ধ আছে। এইজন্য বলা হয়েছে - "প্রজননম্ জগতী" (জৈ.১.৯৩; ষ.২.৩)।
.
(পদ্ভ্যাম্, শূদ্রঃ, অজায়ত) [শূদ্রঃ = আনুষ্টুভঃ শূদ্রঃ (জৈ. ১.১০২), শূদ্রোऽনুষ্টুপ্ছন্দাঃ (জৈ.১.৬৯)] এই সৃষ্টিতে অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিকেই শূদ্র বলে। অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির বিষয়ে মহর্ষি য়াস্ক বলেছেন -
.
"অনুষ্টুবনুষ্টোভনাত্" (নিরুক্ত ৭.১২)
.
এই বিষয়ে অন্য ঋষিদের কথন হল -
"বাগনুষ্টুপ্ সর্বাণি ছন্দাম্সি" (তৈ.১.৭.৫.৫),
"অনুষ্টুবনুষ্টোভনাত্" (দে.৩.৭)।
.
এর অর্থ হল এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে অনুকূলতা-পূর্বক ধরে রেখে তাদের প্রভাবকে অধিক সমৃদ্ধ করে। এদের তুলনা পায়ের সঙ্গে করা হয়েছে, কারণ পা-ও সম্পূর্ণ শরীরকে ধরে রেখে সেই অঙ্গগুলোকে অনুকূলতা প্রদান করে।
.
জ্ঞাতব্য - আমার (অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক) এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ সৃষ্টিতে হতে থাকা য়জন ক্রিয়ার সম্বন্ধে করা হয়েছে। এই য়জন ক্রিয়া তারার মধ্যেও হচ্ছে, অন্য লোক বা অন্তরীক্ষেও হতে পারে। চার পদার্থের ভূমিকা সর্বত্র এটাই থাকবে। মনে রাখবেন, যেকোনো অন্য মন্ত্রের সমান এই মন্ত্রের স্বাভাবিক ভাষ্য আধিদৈনিকই হবে, সেটা আমি এখানে করে দিয়েছি। আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক ভাষ্য আধিদৈনিকের পরেই সম্ভব হয়, কারণ মনুষ্য ভাষা বেদ থেকেই শিখেছে আর পদার্থের নামও বেদ থেকেই রেখেছে। এইজন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সংজ্ঞক উপরোক্ত রশ্মিগুলোর গুণ দেখেই মনুষ্য ব্রাহ্মণাদি নামগুলো শিখেছে আর তারপর সেগুলোর ব্যবহার করতে শুরু করে। যেমন রশ্মির নাম তাদের গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুসারে হয়েছে, তেমনই বর্ণের নামও গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুসারেই হয়েছে।
.
আজ এগুলোর নামে যেসব হিংসা ছড়ানো হচ্ছে, তার পিছনে কিছু লোকের অজ্ঞানতা আর কিছু লোকের দুষ্টতাই কারণ।
.
আধ্যাত্মিক ভাষ্য
জ্ঞাতব্য হল "আত্মা" পদের অর্থ যেমন জীবাত্মা আর পরমাত্মা হয়, তেমনই এর একটা অর্থ শরীরও হয়। এই বিষয়ে ঋষিদের কথন হল - "পাঙ্ক্ত ইতর আত্মা লোমত্বঙ্মাম্সমস্থি মজ্জা" (তাণ্ড্য.৫.১.৪), "আত্মা বৈ তনূঃ" (শ.৭.৩.১.২৩; ৭.৫.২.৩২) এই কারণে আমরা আধ্যাত্মিক ভাষ্যতে (আত্মা, পরমাত্মা আর শরীর) এই তিনটাকে গ্রহণ করতে পারবো। পরমাত্মার বিষয়ে আধিদৈবিক ভাষ্যই আধ্যাত্মিক ভাষ্যের রূপে জানা যেতে পারে, যখন আমরা "পুরুষঃ" পদের অর্থ ঈশ্বর দ্বারা রচিত সৃষ্টিকে না নিয়ে ঈশ্বরই গ্রহণ করবো। সেই সময় যে গায়ত্রী আদি ছন্দ রশ্মি ব্রাহ্মণ আদি রূপে কাজ করে তা ঈশ্বরের প্রেরণাতেই কাজ করে। এইজন্য সেই রশ্মিগুলোকে সেইরূপ ঈশ্বরের অঙ্গের রূপে দর্শানো হয়েছে, যেরূপ নিম্ন লিখিত মন্ত্রের মধ্যে অন্তরীক্ষ আদির তুলনা ঈশ্বরের নাভি আদি অঙ্গের সঙ্গে করা হয়েছে -
নাভ্যাऽআসীদন্তরিক্ষঁ শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্ত্তত ।
পদ্ভ্যাম্ ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাত্তথা লোকাঁ অকল্পয়ন্ ।। (য়জুর্বেদ ৩১.১৩)
এই মন্ত্রের বিশেষ ব্যাখ্যা আমি আধিদৈবিক ভাষ্যের মধ্যেই করে দিয়েছি। যখন আমরা আত্মা বা পুরুষের অর্থ জীবাত্মা বা শরীর গ্রহণ করবো, তখন এই মন্ত্রের ভাষ্য এইরকম হবে -
(ব্রাহ্মণঃ, অস্য, মুখম্, আসীত্) এই শরীরে সবথেকে উত্তম ভাগ মুখ অর্থাৎ মাথা ব্রাহ্মণের সমান কাজ করে। "মুখম্" পদের বিষয়ে মহর্ষি য়াজ্ঞবল্ক্য বলেছেন - "মুখম্ প্রতীকম্" (শ.১৪.৪.৩.৭) অর্থাৎ মুখ দ্বারাই শরীরকে চেনা যায় আর আমরা জানি যে শনাক্তকরণ কেবল জিহ্বা আর ঠোঁট আদি দিয়ে হয় না, বরং সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল দ্বারাই হয়। এইজন্য আমি মুখের অর্থ মাথা গ্রহণ করেছি। আমাদের শরীরে শিরস্থ অঙ্গ চোখ, কান, নাক, রসনা, বাণী আর মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ শরীরের সমবেদনাকে গ্রহণ করে, তাদের প্রেরিত আর সঞ্চালিত করে, এইজন্য এই মাথাই হচ্ছে আমাদের শরীরের ব্রাহ্মণ রূপ। শরীরের যেকোনো অঙ্গের যন্ত্রণা অথবা কোনো অঙ্গের স্বাস্থ্য আর সুখ আদি মাথাই অনুভব করে আর প্রত্যেক যন্ত্রণাকে দূর করার জন্য বিভিন্ন ভাবে বিচারও করে, এইজন্য মাথা আমাদের ব্রাহ্মণ হবে। এই স্বভাব থেকে প্রেরণা নিয়ে সমাজে ব্রাহ্মণ বর্গ সেইরূপ ব্যবহার করে নিজের আধ্যাত্মিক স্তরকে উচ্চ বানাতে পারে। এর অর্থ হল যেকোনো সাধককে সমাজ আর পরিবারের বাস্তবিক সমস্যা, বিশেষ করে অজ্ঞানতা আর মানসিক প্রদূষণকে দূর করার চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত। এইরূপ না করলে তার সাধনা একটা আড়ম্বর মাত্র হয়ে থাকবে।
.
(বাহূ, রাজন্যঃ, কৃতঃ) আমাদের শরীরে বাহু ক্ষত্রিয়ের কাজ করে। এই বাহুই শরীরের যেকোনো অঙ্গের উপর আসা প্রহারকে নিজের উপরে নিতে উদ্যত হয়। প্রহার মাথায় হোক অথবা হাতে, বুকে হোক অথবা পিঠে বা পায়ে, আমাদের হাত দ্রুত সেই প্রহারকে নিজের উপর নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে আর না কেবল সেই প্রহারকে সহ্য করে, বরং প্রহারকর্তার উপর দ্রুত প্রত্যাক্রমণও করে। এইভাবে অধ্যাত্ম পথের ক্ষত্রিয় সাধককে অন্যের দুঃখ থেকে দুঃখী হয়ে সবার দুঃখ ভাগ করে এবং সেই দুঃখকে দূর করার চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত। নিজের নিকট আর্তনাদ করতে থাকা ক্ষুধার্ত, নগ্ন, আহত, পীড়িতদের উপেক্ষা করে নেত্র বন্ধ করে ধ্যানে বসে থাকা কখনও আধ্যাত্মিকতা হতে পারে না।
.
(ঊরু, তৎ, অস্য, য়ৎ, বৈশ্যঃ) আমাদের শরীরে উরু এবং কোমর ক্ষেত্র বৈশ্যের কাজ করে। সমাজের মধ্যে যেমন বৈশ্য অধিকাধিক ধন অর্জন করে সমাজ বা রাষ্ট্র হিতে সম্পূর্ণ ধনকে সমর্পণ করে দেয় আর সেই ধনের বৃদ্ধিও করতে থাকে, সেই রকম শরীরস্থ মধ্যভাগ রসাদি ধাতুর অধিকাধিক সঞ্চয় করে সম্পূর্ণ শরীরকে আবশ্যকতানুসারে প্রদান করতে থাকে আর সন্ততি-বিস্তারের কাজও করে। এইজন্য এটা হচ্ছে বৈশ্যরূপ। এরদ্বারা প্রেরিত হয়ে প্রত্যেক বৈশ্য সাধকের উচিত যে সে ধর্মপূর্বক অধিক ধন অর্জন করার চেষ্টা করবে আর সে "ইদম্ রাষ্ট্রায় স্বাহা, ইদম্ রাষ্ট্রায় ইদন্ন মম" ভাবনার অনুসারে ব্যক্তিগত রূপে আবশ্যকতার অধিক ধনের সঞ্চয় কখনও যেন না করে। ধনাদির সঞ্চয়কারী কখনও সত্য সাধক হয় না, বরং সেটা হচ্ছে অধ্যাত্ম মার্গের অনেক বড় বাঁধক।
.
(পদ্ভ্যাম্, শূদ্রঃ, অজায়ত) শরীরের মধ্যে পা শূদ্রের রূপে কাজ করার জন্য উৎপন্ন হয়েছে। যেমন সমাজের শ্রমিক বর্গ শরীর দিয়ে পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের আধার হয়। তারা তিন বর্ণের সেবাতে প্রতিমুহূর্ত নিযুক্ত থাকে, সেই রকম আমাদের শরীরের পা শরীরের অন্য সব অঙ্গের উদ্যেশ্য পূর্তির জন্য তাদের যেখানে ইচ্ছে সেখানে নিয়ে যায়, তার নিজের কোনো স্বার্থ নেই। এইভাবে শ্রমিক সাধকদের উচিত যে তারা বিনা কোনো স্বার্থে নিজের থেকে অধিক শ্রেষ্ঠদের সৎকার সর্বদা বিনম্রতাপূর্বক করবে।
.
এখানে পাঠক ভাবুন, যে মন্ত্র আমাদের জীবন, সমাজ আর রাষ্ট্রের পুনরুদ্ধার করতে পারে, তাকেই আমরা আমাদের অজ্ঞানতার কারণে সমাজে বিষ মেশানো সাধন বানিয়েছি। এই মন্ত্র সম্পূর্ণ বিশ্বকে বন্ধুত্ব আর যেকোনো রাষ্ট্রকে সত্য রাষ্ট্রভক্তি শেখানোর জন্য অনেক বড় আধার হতে পারে। বর্তমান বিশ্বের সব সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধানের দিশাতে এই মন্ত্রের ভূমিকা সবথেকে মুখ্য হতে পারে। আমরা যদি আমাদের পক্ষপাত আর স্বার্থকে ছেড়ে দিয়ে আত্মা আর অন্তঃকরণ দিয়ে এই মন্ত্রের ভাব বুঝতে সক্ষম হই, তাহলে বৈদিক বর্ণব্যবস্থার প্রতি বিশ্বের জনগণ, বিশেষ করে নির্ধন, শোষিত, পীড়িত আর অশিক্ষিতদের এমন আকর্ষণ বাড়বে যে বিভাজনকারী রাজনীতিও তাকে থামাতে পারবে না। ঈশ্বর সবাইকে সুমতি প্রদান করুক।
এখানে পাঠকের মনে এমন প্রশ্ন আসতে পারে যে যখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র চার বর্ণ কর্মানুসারে ছিল আর শূদ্রের কাজ তিন বর্ণের সেবা ছিল, তাহলে কি শূদ্রদের বেদ পড়ার অধিকার ছিল না?
উত্তর - যদি শূদ্রকে বেদ পড়ার কোনো অধিকার না থাকতো, তাহলে ভগবান্ মনু "শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি" কেন বলেছেন? যখন কোনো শূদ্র বর্ণস্থ ব্যক্তি নিজের পুরুষার্থ আর বুদ্ধিবল দ্বারা নিজের বর্ণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হতো, তখন তার বর্ণ পরিবর্তন মেনে নেওয়া হতো। বেদ পড়ার অধিকার সবাইকে দেওয়ার পাশাপাশি বেদ স্বয়ং বলেছে -
য়থেমাম্ বাচম্ কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাম্ শূদ্রায় চার্য়ায় চ স্বায় চারণায় ।। (য়জুর্বেদ ২৬.২)
স্বয়ং বেদ যখন সবাইকে এই সুযোগ প্রদান করছে যে সবাই বেদ পড়তে পারবে, তখন অন্য কোনো ব্যক্তি বা গ্রন্থ তার বিরুদ্ধ আদেশ কিভাবে দিতে পারে? যদি কেউ এমন করে, তাহলে তাকে বেদবিরোধী, মনুবিরোধী, অনার্য বা দস্যু মানা উচিত। এমতাবস্থায় বেদ পড়লে বা শুনলে দণ্ড দেওয়ার কথা বেদবিরোধী তথা ভারতবিরোধী লোকেরা ঋষিদের গ্রন্থের মধ্যে সময়ে-সময়ে মিশ্রণ করেছে। যে সকল লেখক বা নেতা এইসব কথার আধার বানিয়ে বেদ এবং ঋষিদের নিন্দা করে অথবা কাউকে নীচু দেখায় বা দ্বেষ ছড়ায়, তারা অবশ্যই অমানবীয় কাজ করছে।
.
চার বর্ণের মধ্যে যখন এত প্রেম আর সহায়তার ভাব ছিল, তাহলে তাদের মধ্যে কি পরস্পর বৈবাহিক সম্বন্ধও হতো?
উত্তর - হ্যাঁ, বৈদিক কালে এমনও হতো। এর কয়েকটা উদাহরণ আমি এখানে প্রস্তুত করছি -
১. শ্রবণ কুমার ব্রাহ্মণ ছিল, অথচ তার পিতা বৈশ্য তথা মাতা শূদ্রা ছিল।
শূদ্রায়ামস্মি বৈশ্যেন জাতো নরবরাধিপ ।
অজ্ঞানাত্তু হতো য়স্মাৎক্ষত্রিয়েণ ত্বয়া মুনিঃ ।
তস্মাত্ত্বা নাবিশত্যাশু ব্রহ্মহত্যা নরাধিপ ।।
(বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড সর্গ ৬৩.৫১, সর্গ ৬৪.৫৫ | গীতা প্রেস)
অর্থাৎ - রাজা দশরথকে শ্রবণ বললেন - হে রাজন! আমি বৈশ্যের সাথে শূদ্রাতে জন্মেছি।।৫১।।
.
শ্রবণের পিতা বললেন - হে রাজন! যেহেতু আপনি অজ্ঞতাবস্থায় শ্রবণ মুনিকে মেরেছেন, এইজন্য ব্রহ্মহত্যার পাপ আপনার হয় নি।
.
২. মহাত্মা বিদুরের পত্নীর পিতা ব্রাহ্মণ ছিল আর মাতা শূদ্রা।
(মহাভারত, আদিপর্বের সম্ভবপর্ব অধ্যায় ১১৩, শ্লোক ১২ | গীতা প্রেস)
.
৩. রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এক পত্নী বৈশ্য বর্ণের ছিল। (দেখুন - উপরোক্ত অধ্যায় ১১৪)
.
এখানে কেউ এমন দোষ দেখাতে পারে যে উচ্চ বর্ণস্থ ব্যক্তি তো নিম্ন বর্ণস্থ কন্যার সঙ্গে বিবাহ করতো, কিন্তু উচ্চ বর্ণস্থ ব্যক্তি নিজের কন্যাকে নিম্নবর্ণে কেন দিতো না? এর উত্তর হল, আজও কোনো পিতা তার কন্যাকে নিজের থেকে অধিক সম্পন্ন আর শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেই দিতে চায়, যাতে তার কন্যা সুখী থাকে। এই ভাবনা সেই সময়ও ছিল। তাহলে এতে দোষের কি আছে!
.
যদি বর্ণের মধ্যে পরস্পর এতই প্রেম ছিল, তাহলে গুরু দ্রোণাচার্য কেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একলব্যকে শিক্ষা দেন নি? আর যখন সে স্বয়ং নিজের প্রচেষ্টায় মহান ধনুর্ধর হয়, তখন এসে স্বয়ং গুরু হয়ে দক্ষিণার নামে তার কাছে তার হাতের আঙ্গুল চান। এটা কি একলব্যের সঙ্গে অত্যাচার হয়নি?
উত্তর - গুরু দ্রোণাচার্য কেবল রাজপরিবারের শিক্ষক ছিলেন, এইজন্য তিনি একলব্য আর কর্ণের মতো যোগ্যতম বাচ্চাদের ধনুর্বেদের শিক্ষা দেন নি। তাছাড়া এতে অস্পৃশ্যতার মতো ভেদভাবের কোনো কারণ ছিল না। যখন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছিল, সেই সময় মহান ধনুর্ধারী একলব্য বিশ্বের বড়-বড় রাজা আর যোদ্ধাদের সভাতে সম্মানিত আসনে বসে ছিল। যে সময় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের অগ্রপূজার বিরোধ করে চেদিনরেশ শিশুপাল অনেক রাজা যোদ্ধাদের সামনে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণকে অসভ্যতাপূর্ণ ভাষায় হীন সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল, সেই সময় সে এটাও বলেছিল যে -
নৃপে চ রুক্মিণি শ্রেষ্ঠে একলব্যে তথৈব চ ।
শল্যে মদ্রাধিপে চৈব কথম্ কৃষ্ণস্ত্বয়ার্চিতঃ ।।
(মহাভারত, সভাপর্ব, অর্ধাভিহরণ পর্ব, অধ্যায় ৩৭, শ্লোক ১৪)
এখন কেউ বলুক, এখানে একজন ক্ষত্রিয় নরেশ কেন একলব্যকে বিশিষ্ট পুরুষের রূপে সেই বিশ্বপ্রসিদ্ধ রাজসভাতে গণনা করছে? যদি সেই কালে শূদ্রকে ঘৃণা করা হতো তাহলে কিভাবে এমন সম্ভব ছিল?
.
এরদ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে সেই সময় জন্ম নয় বরং যোগ্যতা আর কর্মের সম্মান ছিল। একথা সেই সময়ের যখন বৈদিক মর্যাদার পতন প্রারম্ভ হয় আর এই পতনই মহাভারত যুদ্ধের বীজ হয়ে ভারতের বিনাশের কারণ হয়।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামকে তো বৈদিক ধর্মের প্রতিপালক মানা হয়, তা সত্ত্বেও তিনি দেবর্ষি নারদের প্ররোচনায় তপস্যারত নির্দোষ শূদ্রের কেন নির্মম ভাবে হত্যা করেন?
উত্তর - পরম পবিত্র পুরুষ ভগবান্ শ্রীরামের উপর এমন দোষ লাগানো কোনো দুষ্টের বানানো ঘৃণিত ষড়যন্ত্রই হতে পারে। এই কারণে কেউ বাল্মীকি রামায়ণের মধ্যে এই রকম প্রক্ষেপ করেছে। আপনি একটু ভাবুন, যে শ্রীরামকে মহর্ষি বাল্মীকি "রক্ষিতা জীবলোকস্য", "আর্য়ঃ সর্বসমঃ", "সর্বলোকপ্রিয়ঃ" এইরূপ বিশেষণ দ্বারা বিভূষিত করেছেন, সেই শ্রীরাম কোনো তপস্যারত শূদ্রকে কিভাবে ঘৃণা করতে পারেন?
.
একটু ভাবুন! মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম, যাঁর দর্শনের জন্য বড়-বড় ঋষি-মুনি আকাঙ্ক্ষা করতো আর যাঁর দর্শন করে মহর্ষি শরভঙ্গের মতো সিদ্ধ পুরুষ নিজের জীবনকাল পূর্ণ হয়েছে মনে করে য়োগবল দ্বারা প্রাণত্যাগ করে সংসার থেকে চলে যান, এইরকম মহাপুরুষ তপস্বিনী শবরীর আশ্রমে গিয়ে তাকে "তপোধনা" -র মতো সম্মানিত বিশেষণ দ্বারা বিভূষিত করেন আর তার আতিথ্যকে খুব প্রেমসহিত স্বীকার করেন, সেই শ্রীরাম কিভাবে তপস্বী শম্বুককে হত্যা করতে পারেন? শ্রীরাম বেদ-বেদাঙ্গ তত্ত্ববেত্তা ছিলেন আর বৈদিক মর্যাদার পূর্ণ প্রতিপালক ছিলেন, তাহলে শম্বুকের হত্যার মতো বেদবিরুদ্ধ পাপ তিনি কিভাবে করবেন? আসলে বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভাবে সংশয়যুক্ত আর প্রক্ষিপ্ত, আবার এই কাণ্ডের মধ্যেই সীতার নির্বাসনের দুঃখজনক কল্পিত কাহিনীও আছে।
.
সত্যর্থ প্রকাশের অষ্টম সমুল্লাসে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "এক মানব জাতি ছিল, পরে "বিজানীহ্যার্য়ন্ য়ে চ দস্যবঃ" এটা ঋগ্বেদের বচন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের আর্য, বিদ্বান এবং দেব, আর দুষ্টদের দস্যু অর্থাৎ ডাকাত, মূর্খ নাম, এইভাবে আর্য আর দস্যু এই দুই নাম হয়। "উত শূদ্র উতার্য়্য" ঋগ্বেদের বচন। আর্যদের মধ্যে পূর্বোক্তরূপে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র - এই চারটা বিভাগ করা হয়। দ্বিজ বিদ্বানদের নাম আর্য আর মূর্খদের নাম শূদ্র ও অনার্য অর্থাৎ অনাড়ী হয়।" (সত্যার্থপ্রকাশ, অষ্টম সমুল্লাস)
.
প্রায় এইরকম প্রকরণই এই সমুল্লাসের পরের পৃষ্ঠাতে আছে। পূর্বোক্ত বেদ প্রমাণকে উদ্ধৃত করে ঋষি লিখেছেন - "এটাও বেদের প্রমাণ আছে - এটা লিখে দিয়েছি যে আর্য নাম ধার্মিক, বিদ্বান, আপ্ত পুরুষদের আর এর বিপরীত ব্যক্তিদের নাম দস্যু অর্থাৎ ডাকাত, দুর্বৃত্ত, অধার্মিক আর অবিদ্বান তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য দ্বিজদের নাম আর্য আর শূদ্রের নাম অনার্য অর্থাৎ অনাড়ী।"
.
এখানে স্পষ্ট দেখাচ্ছে যে শূদ্রকে"অনার্য" বলা হয়েছে, অথচ চার বর্ণকে আর্যদেরই ভেদ বলা হয়েছে, এমন বিরোধাভাস কেন?
উত্তর - এর সারমর্ম হল পরমাত্মার সৃষ্টিতে এক জাতি মনুষ্য ছিল বা মনুষ্য রূপে জন্ম থেকে উৎপন্ন হয়। তারপর পরবর্তীতে এই মনুষ্যই গুণের পার্থক্যের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
.
এখানে ধ্যাতব্য হল, আর্যদের মুখ্য পরিচয়ই হল ধার্মিকতা, বিদ্বান নয়। এইরূপ না হলে দস্যুদের থেকে আলাদা হতে পারবে না। আর্যদের মধ্যে শূদ্ররাও ধার্মিক কিন্তু অশিক্ষিত হওয়ার কারণে অনাড়ী হয়েছে, সেটা অনার্যের অপভ্রষ্ট রূপ। মনে রাখবেন, অনার্যের অর্থ দুর্বৃত্ত, ডাকাত এবং নিন্দনীয় নয়। এই শূদ্র হচ্ছে দস্যুর তুলনায় আর্য আর দ্বিজদের তুলনায় অনার্য। এইজন্য ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে অর্জুনকে জীর্ণ হওয়ার কারণে অনার্য বলে সম্বোধন করেন। এরমধ্যে আপত্তির কি আছে? কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারে যে আর্যদের একটা ভেদ আর্য আর আরেকটা অনার্য কিভাবে হবে? তবে হ্যাঁ, মনুষ্যের মধ্যে দুটো ভেদ "আর্য" আর "দস্যু" হতে পারে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করছি রামায়ণ আর মহাভারত কালে মনুষ্যের মধ্যে রাক্ষস, কিন্নর, দেব, গন্ধর্ব, গৃধ, বানর, নাগ, ঋক্ষ, মনুষ্য কিভাবে অনেক হয়েছে? এখানেও মনুষ্য ভেদের মধ্যে একটা নতুন ভেদ "মনুষ্য"ও আছে, বাকি সব অন্য। তাহলে কি তাদের অন্য কোনো প্রাণী ধরে নেওয়া হবে? না। রাম, লক্ষণ, কৌরব, পাণ্ডব আদিকে মনুষ্য, অথচ ইন্দ্র, ব্রহ্মা, শিব আদিকে দেব; রাবণ, খর, বক আদিকে রাক্ষস; হনুমান, সুগ্রীবকে বানর আদি বলা হয়েছে। এইভাবে আর্যদের থেকে শূদ্রের আলাদা বিভাগ বোঝা উচিত।
.
এখানে যদি কেউ এমন বলে যে দেব, রাক্ষস, গন্ধর্ব, বানর আদি হল পৃথক য়োনি, এগুলো মনুষ্য য়োনির ভাগ নয়। তাহলে আমি এমন মহানুভবকে বাল্মীকি রামায়ণ পড়ার পরামর্শ দিবো, যেখানে রাবণের অন্তঃপুরে এইসব বর্গের স্ত্রী থাকার বর্ণনা আছে। যদি পৃথক-পৃথক য়োনি হতো, তাহলে তাদের মধ্যে পরস্পর বৈবাহিক সম্বন্ধ হতো না। এমনটা হলে তাদের দ্বারা বংশ পরম্পরা চলতো না। এই কারণে এদের সবার মধ্যে সমতা অনিবার্য।
.
সত্যার্থ প্রকাশের দ্বিতীয় সমুল্লাসে লেখা আছে -
"দ্বিজ নিজের সন্তানের উপনয়ন করে আচার্য কুলে অর্থাৎ যেখানে পূর্ণ বিদ্বান পুরুষ এবং পূর্ণ বিদুষী স্ত্রী শিক্ষা আর বিদ্যাদান করেন, সেখানে বালক আর বালিকাকে পাঠিয়ে দিবে। আর শূদ্রাদি বর্ণের সন্তানকে উপনয়ন না করিয়ে বিদ্যাভ্যাসের জন্য গুরুকূলে পাঠিয়ে দিবে।" (সত্যার্থপ্রকাশ, দ্বিতীয় সমুল্লাস)
.
তার মানে শূদ্রকে নিজের উপনয়ন সংস্কার করার অধিকার নেই। অন্যদিকে তৃতীয় সমুল্লাসে লেখা আছে -
"শূদ্র কূলীন ও শুভ লক্ষণযুক্ত হলে তাকে মন্ত্রসংহিতা ব্যতীত সকল শাস্ত্র পড়াবে। অনেক আচার্যের মত হল, শূদ্র বিদ্যা শিক্ষা করবে কিন্তু তার উপনয়ন হবে না।"
উত্তর - প্রথমে আমি যজ্ঞোপবীত প্রকরণের উপর আলোচনা করবো আর সত্যার্থপ্রকাশের আরও একটা কথন উদ্ধৃত করবো - "বালকের প্রথম যজ্ঞোপবীত গৃহে হবে, দ্বিতীয় পাঠশালা অথবা আচার্যকুলে হবে।" (সত্যার্থপ্রকাশ, তৃতীয় সমুল্লাস)
.
এই দুটোর উপর বিচার করলে নিম্নলিখিত পরিণাম প্রাপ্ত হয় -
১. দ্বিজ অর্থাৎ যারা বেদবিদ্যার জ্ঞাতা, তারা সন্তানের সংস্কার বাড়িতেই করে আচার্য কুলে পাঠিয়ে দিবে।
২. শূদ্র অর্থাৎ অশিক্ষিত কিন্তু ঈর্ষারহিত, সেবাভাবী, ধার্মিক সেবক নিজের সন্তানের যজ্ঞোপবীত সংস্কার করবে না। এমন লেখার কারণ হল, তাদের সংস্কার করানোর যোগ্যতা নেই আর যোগ্যতা বিনা অধিকার হয় না। আবার সেই শিশু, যার যোগ্যতার জন্য এখনও পরীক্ষা করা হয়নি, অবশ্যই আচার্যকুলে পাঠানো হবে আর পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার অধিকার তারও আছে।
৩. উপনয়ন সংস্কার স্বগৃহের অতিরিক্ত আচার্য দ্বারা গুরুকুলের মধ্যেও করানো হয়, তখন সেখানে আচার্য সব সন্তানের যোগ্যতা দেখে সংস্কার করিয়ে দিবেন। যদি কারও শূদ্রত্বের গুণই থাকে তাহলে করাবেন না। আর এটা একেবারে উপযুক্ত যে, যারা যজ্ঞোপবীতের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না, তাদের কেন দেওয়া হবে? আজ যেভাবে মাংসভক্ষী রাক্ষস, লম্পট, কামী, মদ্য আদি নেশাখোর, দুর্বৃত্তদের প্রসাদের মতো যজ্ঞোপবীত কোনো পরীক্ষা ছাড়াই বিতরণ করা হচ্ছে, এমনটা উচিত নয়। এইজন্য ঋষিদের এমন বিধান নেই। এইভাবে শূদ্রকুলোৎপন্ন, কিন্তু যোগ্য সন্তানের যজ্ঞোপবীত একবার অর্থাৎ আচার্য কুলেই হবে, আর দ্বিজ কুলোৎপন্ন যোগ্য সন্তানের যজ্ঞোপবীত দুইবার (স্বগৃহ আর গুরুকুলে) তথা দ্বিজ কুলোৎপন্ন কিন্তু অযোগ্য আর শূদ্রকুলোৎপন্ন অযোগ্যের যজ্ঞোপবীত ক্রমশঃ একবার (স্বগৃহ) এবং একবারও হবে না।
.
এর সঙ্গে এটাও জেনে রাখা উচিত যে দ্বিজের সন্তানের বিদ্যাগ্রহণের যোগ্যতার সম্ভাবনা শূদ্রের সন্তানের তুলনায় অধিক হবে, কারণ প্রথমতো, তার মাতা-পিতা দু"জনই বিদ্বান, গৃহে বিদ্যার সংস্কার ও পরিবেশ হওয়া তথা জেনেটিক অর্থাৎ বংশানুগতি সম্বন্ধীয় গুণ (বৈজ্ঞানিকদের নবীন মতানুসারে ৭৫ শতাংশ সংস্কার জিন্স দ্বারা সন্ততির মধ্যে আসে) এই জন্য। যেমন উচ্চ শিক্ষিতদের শিশু অশিক্ষিতদের শিশুর তুলনায় প্রায়শঃ উচ্চ শিক্ষাতে আগে থাকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এর বিপরীত সম্ভব নয়। সম্ভাবনা অবশ্যই আছে তবে তুলনামূলক ভাবে কম।
.
এইভাবে বর্ণ চয়ন করার সুযোগ প্রাপ্ত করার অধিকার সবার সমান আছে, তবে বর্ণ প্রাপ্ত করার অধিকার যোগ্যতানুসারেই হয়। আজও কলেক্টর হওয়ার অধিকারী সবাই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাকে ইচ্ছে কালেক্টর বানিয়ে দাও। এর পরীক্ষা আই.এ.এস. এরমধ্যে বসার জন্য অন্তত স্নাতক হতে হবে, কিন্তু শুধু স্নাতক হলেই হবে না, আই.এ.এস. এর সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, তারপর ইন্টারভিউতেও উত্তীর্ণ হতে হবে, তাহলে কোনো কালেক্টর বা অন্য কোনো উচ্চাধিকারী হতে পারবেন। আজও যখন সমান অধিকার নেই, বরং যথা-যোগ্যতাবাদ চলছে তাহলে ঋষি দয়ানন্দকে কেন দোষী বলবেন?
.
এখন দ্বিতীয় প্রকরণে আসছি। এই বিষয়ে ঋষি দয়ানন্দ
.
য়থেমাম্ বাচম্ কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাম্ শূদ্রায় চার্য়ায় চ স্বায় চারণায় ।। (য়জুর্বেদ ২৬.২)
.
এই মন্ত্রের উপর ব্যাখ্যা করে সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে লিখেছেন - "পরমেশ্বর কি শূদ্রদের মঙ্গল চান না? তিনি কি পক্ষপাতী যে, বেদের অধ্যয়ন আর শ্রবণ শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ আর দ্বিজদের জন্য বৈধ করবেন? যদি শূদ্রদের বেদ পড়া আর শোনার অভিপ্রায় তাঁর না থাকতো তাহলে তিনি শূদ্রদের শরীরে বাক্, শ্রোত্রেন্দ্রিয়
বানিয়েছেন কেন? পরমাত্মা যেমন সবার জন্য পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য এবং অন্নাদি যাবতীয় পদার্থের সৃষ্টি করেছেন, সেইরূপ বেদকেও সবার জন্য প্রকাশিত করেছেন। আর যেখানে নিষেধ আছে সেখানে নিষেধের অভিপ্রায় এই যে, যাকে পড়ালেও কিছু শিখতে পারে না, সে নির্বুদ্ধি আর মূর্খ হওয়ার কারণে তাকে শূদ্র বলা হয়। তার পড়া আর তাকে পড়ানো ব্যর্থ।"
.
একজন এই প্রশ্ন করেন যে "যদি শূদ্ররা বেদ পড়ে, তাহলে আমরা কি করবো?" এর কঠোরভাবে উত্তর দিয়ে ঋষি দয়ানন্দ লিখেছেন - "তুমি কুয়োতে পড়ো।" এরপরও কি কেউ সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে শূদ্রের প্রতি অস্পৃশ্যতা আর বৈষম্যের দোষ দিতে পারবে?
সত্যার্থপ্রকাশের দ্বিতীয় সমুল্লাসের মধ্যে ভঙ্গী, চামার, নীচ আদি শব্দের প্রয়োগ হয়েছে, এগুলো কি ঘৃণাসূচক শব্দ নয়?
উত্তর - প্রথমেই ধ্যাতব্য হল, কোনো শব্দ কি প্রসঙ্গ তথা পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়েছে, এটা বিচার করা আবশ্যক। আজ যে বর্গ পরিষ্কারের কাজ করে, তাকে সেই সময় সারা ভারতে "ভঙ্গী" (মেথর) বলতো। কাজটাও নোংরা পরিষ্কারের, এই কারণে শব্দটাও খারাপ হয়ে গেছে। যদিও এই শব্দের অর্থ বিদ্যা আদি হতে পতিত, হতাশ, পরাজিত আদি। সেই সময় কর্ম বা বিদ্যার দৃষ্টিতে এমনটাই ছিল - বেচারা হতাশ, নিরাশ আর নিতান্ত অশিক্ষিত ছিল। ধীরে-ধীরে এই শব্দটা গালাগালির রূপ নিয়ে নেয়। গান্ধীকে শব্দটা খারাপ লাগে, তাই সম্মানজনক নতুন শব্দ "হরিজন" আবিষ্কার করেন, কিন্তু ডক্টর আম্বেদকর এটাও ভালো মনে করেননি, বরং উপহাসজনক বলে "দলিত" শব্দ স্বীকার করেন। তখন "হরিজন" শব্দটা খারাপ হয়ে যায়। আজ এইসব শব্দকে খারাপ মনে করা হয় আর "বাল্মীকি" এই নতুন শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মানে হল, শব্দ বিশেষ প্রয়োগ করার শৈলী, তৎকালীন পরিস্থিতি তথা ব্যবহারকারীর অনুভূতির উপর নির্ভর করে ভাল অথবা খারাপ হতে পারে। এইজন্য সেইসময় ঋষিদের প্রয়োগ খারাপ ছিল না। এইভাবে "চামার" শব্দ হল "চর্মকার"-এর অপভ্রষ্ট রূপ। "চামার"ও সেই সময় অশিক্ষিত তথা চামড়ারই ব্যবসায়ী হতো। লোহার যে সম্বন্ধ লুহার, সোনার সুনার, কুম্ভের কুম্ভকারের সঙ্গে হয়, তেমনই চামড়ার সঙ্গে চামারের সম্বন্ধ আছে।
.
আসলে ভাষা দেশ, কাল আর পরিস্থিতির অনুসারে পরিবর্তন হতে থাকে, এটা যেকোনো ভাষার ইতিহাস বলে দেয়। আগে শৌচালয়কে টাট্টিঘর এবং পায়খানা বলা হতো, তখন এই শব্দ খারাপ ছিল না, কিন্তু এখন কেউ এটা বলুক, তাহলে লোকে তাকে অশিক্ষিত বলে হাসবে। ভাষা ইংরেজি রূপ নেয় আর শৌচালয়কে টয়লেট, তারপর বাথরুম বলা হয়। ভাষা পুনরায় বদলায়, এখন বাথরুমকে ওয়াশরুম বলা হয়, আরও চমৎকার দেখুন, এখন একে রেস্টরুম বলা হচ্ছে। এইজন্য পুরোনো শব্দ নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়। হ্যাঁ, এখন এই শব্দ ভালো মানা হয় না, তাই এদের প্রয়োগ করা উচিত নয়। তবে হ্যাঁ, যদি প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে বর্তমান ভাষার অনুকূল পরিবর্তন করা হয়, তাহলে সব গ্রন্থের স্বরূপ না কেবল বদলে যাবে, বরং ভাষার ইতিহাসই সমাপ্ত হয়ে যাবে। যদি এমনটা করা হয় তাহলে মানুষকে নিজের পূর্বজের নামটাও বদলাতে হতে পারে।
.
ভূতপ্রেতের বিষয়ে সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে লেখা আছে - "ওই সব রোগের ওষুধ সেবন পথ্যাদির উচিত ব্যবহার না করে ধূর্ত, মহামূর্খ, অনাচারী, স্বার্থপর, মেথর, চামার, শূদ্র এবং ম্লেচ্ছ প্রভৃতিকে বিশ্বাস করে আর নানা প্রকার ঢং, ছলনা, কপটতা করে আর উচ্ছিষ্ট ভোজন, মাদুলি-তাবিজ আদি মিথ্যা মন্ত্র-যন্ত্র ব্যবহার করে সুতো আর ধাগা বাঁধে আর বাঁধায়।"
.
এরমধ্যে পাখণ্ডী আর প্রতারককে এমন লেখা কেন অনুচিত মনে হচ্ছে? ভঙ্গী, চামার শব্দের উপর লিখে দিয়েছি। "চামার" শব্দ সেই সময় খারাপ ছিল না আর না এর অর্থটা খারাপ, কিন্তু একে ঘৃণ্য বলে বিবেচিত করা হয় আর আজ জাটব, মেঘবল, রাইগর আর জটিয়া আদি অনেক নাম প্রচলিত হয়ে যায়। এই শব্দের প্রয়োগ ডক্টর আম্বেদকরও করেছেন, তাহলে তাকে কেন কেউ খারাপ বলছে না? এখানে ঋষি বলতে চেয়েছেন যে, কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি ভূতপ্রেত, যা হচ্ছে রোগ বিশেষ বা পাখণ্ড, এই বিষয়ে নিতান্ত অজ্ঞানী, তারা ধূর্ত আর প্রতারককে বিশ্বাস করে আর চিকিৎসা করায় না। তাই ঋষি এমনটা লিখেছেন, তো এতে অনুচিতের কি আছে? আপনি যদি কোনো বৌদ্ধিক কর্মে বিদ্বান ব্যক্তির পরামর্শ না মেনে শূদ্র অর্থাৎ নিজের শ্রমিক বা অন্য কোনো ধূর্তের উপর বিশ্বাস করেন, তাহলে কি এটা আপনার জন্য উচিত হবে? তাহলে আপনার কাছে মহর্ষির সমালোচনা করার কী ভিত্তি আছে?
.
মনে রাখবেন, ঋষি দয়ানন্দ কোনো বর্গকে নীচ, ধূর্ত আদি শব্দ দিয়ে সম্বোধিত করেন নি, বরং যেসব ব্যক্তিরা প্রতারণা করে আর মনুষ্যকে ভ্রমিত করে, তাদের জন্যই এমন কঠোর শব্দের প্রয়োগ করেছেন। পাঠক! দেখুন, তিনি তৎকালীন ব্রাহ্মণ, যারা বাস্তবে কর্মানুসারে ব্রাহ্মণ ছিল না, তাদের জন্য সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে লালভুজক্কড়, কানা, গর্ভের মধ্যেই কেন মরে যায় নি, অন্ধপোপ, গাপোড়ার মতো কঠোর শব্দের প্রয়োগ করেছেন। ব্রাহ্মণকূলে জন্মা ঋষি নকল অর্থাৎ জন্মনা ব্রাহ্মণকে কিভাবে তিরস্কার করেছেন, এটা কেউ ভেবে তো দেখুন। আসলে ঋষি দয়ানন্দের থেকে বড় গত কয়েক হাজার বছরে ভারতের মধ্যে কোনো সত্য মানবতাবাদী জন্মই নেয় নি।
উপসংহার
পাঠকরা নিশ্চয়ই এই বই পড়ে এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে বেদ এবং ঋষিদের গ্রন্থ না কেবল সমস্ত মানব জাতি, অপিতু প্রাণীমাত্রের হিতের জন্যই উপদেশ করে। এইসব না জানার কারণে সংসারে বিশেষ করে ভারতের মধ্যে অনেক দুঃখজনক সমস্যার জন্ম হয়েছে। বস্তুতঃ এই সমস্যাগুলোর জন্ম নিতান্ত অজ্ঞানতাবশই নয়, বরং কিছু ধর্মদ্বেষী আর ভারতবিরোধী ব্যক্তিরাও ঋষিদের গ্রন্থের মধ্যে প্রক্ষেপ করেছে এবং ঋষিদের নাম করে কল্পিত গ্রন্থ রচনা করে এক বর্গ বিশেষকে অনেক বেশি প্রতারিত করে আর তাদের এই বীভৎস খেলা কয়েকশ নয় বরং কয়েক হাজার বছর ধরে চলেছে। এইসব দেখেই ভারতের অনেক সুপঠিত ব্যক্তি আর এক অনেক বড় বর্গ নিজের-নিজের নেতাদের আদর্শ মেনে বেদ আর ঋষিদের প্রচণ্ড বিরোধী হয়ে যায়।
.
আজকের তথাকথিত দলিত বর্গ ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকরকে প্রমাণ মানে, অথচ ডক্টর আম্বেদকর স্বয়ংকে ঋষিদের গ্রন্থের জ্ঞাতা মানেন না। তিনি অনেকবার বর্ণব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন আর যেখানেই তিনি এর সমালোচনা করেছেন, সেখানে তিনি মনুস্মৃতির বিদেশী বিদ্বান দ্বারা করা ইংরেজি অনুবাদের আধারের উপরই করেছেন। আসলে বর্ণব্যবস্থার যথাযথ স্বরূপকে বিগত লম্বা কালখণ্ডে ঋষি দয়ানন্দের অতিরিক্ত অন্য কেউই সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি।
.
আমি মনুস্মৃতির সকল সমালোচকদের কাছে আবেদন করবো যে, তারা যেন সবাই পূর্বাগ্রহ আর স্বার্থপরতা ত্যাগ করে এই পুস্তককে শান্ত মনে কয়েকবার পড়েন। যদি তাদের আত্মা এই বইয়ে ন্যায্যতা খুঁজে পায়, তাহলে ডক্টর সুরেন্দ্র কুমার দ্বারা লিখিত নিম্ন সাহিত্যকে অবশ্যই পড়বেন -
১. মনুস্মৃতি (मनुस्मृति)
২. বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি (विशुद्ध मनुस्मृति)
৩. মনুর বিরোধ কেন? (मनु का विरोध क्यूं)
৪. মহর্ষি মনু বনাম ডক্টর আম্বেদকর। (महर्षि मनु बनाम डॉ. अम्बेडकर)
.
আমি আশা করি ভারতের সমস্ত সুধীগণ সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা, বিশেষ করে ভারতের রাষ্ট্রীয় একতাকে স্থাপিত করার জন্য সত্যের মার্গেই চলবেন আর সবাই মিলে এই রাষ্ট্রকে পুনরায় মহান্ বানানোর ব্রত নিবেন।
.
আরক্ষণ (রিজার্ভেশন), জাতিবাদ আর নির্ধনতার স্থায়ী সর্বোত্তম সমাধান -
সকল জীব দুঃখ ত্যাগ করে সুখ লাভ করতে চায়। মাংসাহারী প্রাণীরা তাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য দুর্বল প্রাণীদের মেরে খায়, কিন্তু এমনটা ঈশ্বরীয় ব্যবস্থার অনুসারেই হয়। সংসারের সর্বোত্তম প্রাণী মনুষ্য ঈশ্বরীয় ব্যবস্থাকে ভুলে গিয়ে কেবল নিজের মনোরঞ্জন আর ইন্দ্রিয় লোলুপতাবশতঃ অন্যকে কষ্ট দেওয়ার পাপ করতে থাকে। কাম, ক্রোধ, লোভ, দ্বেষ, অহংকারে বশীভূত হয়ে মানব এই সংসারের মধ্যে কত ভয়ংকর নিষ্ঠুর কাজ করেছে? আজ এই তথাকথিত সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ, অন্যের জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর জ্বালিয়ে দিয়ে স্বয়ং বড় ভবনে বাস করতে চায়, এমনকি নিজের দুঃখী দরিদ্র ভাইয়ের হাত থেকে শুকনো রুটিও ছিনিয়ে নিয়ে স্বয়ং সোনার পাত্রে সুন্দর, সরস আর সুস্বাদু ভোজন করতে চায়, অন্য ভাইদের শরীর থেকে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাওয়া বস্ত্রও ছিনিয়ে নিয়ে বহুমূল্য বস্ত্রের দ্বারা ফ্যাশনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়, অন্যের গলা কেটে স্বয়ং অমর একাকী জীবনযাপন করতে চায়।
.
প্রাচীন বৈদিক কালে "অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাসঃ, ঈশাবাস্যমিদম্ সর্বম্...তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ, সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ" এর ভাবনানুসারে সকল মানব পরস্পর ভাই-ভাইয়ের ব্যবহার করে কর্মের আধারে বর্ণ ব্যবস্থার সুন্দর তথা সর্বহিতকারী মর্যাদার মধ্যে বসবাস করতো। পরস্পর সহযোগ, সদ্ভাব, করুণা, প্রেমের সুন্দর শান্তিময় বাতাবরণ ছিল। কালক্রমে মহাভারতের পর সেই সুন্দর বর্ণ ব্যবস্থা জন্মের উপর আধারিত হিংস্র জাতি-ব্যবস্থায় বদলে যায়, সেটা এই বিশ্ব বিখ্যাত দেশকে অন্ধকার, দুঃখ, দরিদ্রতা, অবিদ্যা, শত্রুতা, চরিত্রহীনতা আর পরাধীনতার গভীর গর্তে ফেলে দেয়। এইসব পাপ বেদ, মনুস্মৃতি এবং প্রাচীন ঋষিদের নামে হয়। তাঁদের গ্রন্থের মধ্যে পাপপূর্ণ প্রক্ষেপ, বেদের বানোয়াট দূষিত ব্যাখ্যা এইসব পাপের পোষক হয়। এরফলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র জন্মের আধারে মানা প্রারম্ভ হয় তথা এই ব্যবস্থাতে জন্মনা শূদ্র বর্গ আর মহিলাদের উপর বীভৎস অত্যাচার হয়। এরফলে তারা অতি নির্ধন, অস্পৃশ্য ও দাসবত্ জীবনযাপনে বাধ্য হয়।
.
উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক সমাজ সুধারক এই পাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায়, কিন্তু প্রাচীন বৈদিক বর্ণ-ব্যবস্থার শুদ্ধ স্বরূপ পুনরায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়নি। আর্য সমাজের সংস্থাপক মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বেদ এবং মনুপ্রোক্ত বৈদিক বর্ণ-ব্যবস্থার শুদ্ধ এবং সর্বহিতকারী স্বরূপ ভারতের সম্মুখে নিয়ে আসার অনেক পুরুষার্থ করেন আর সেই অনুসারে তিনি গুরুকুলের মধ্যে সবাইকে সমান শিক্ষা, সমান ভোজনাদি ব্যবস্থা দ্বারা জাতিভেদ আর অস্পৃশ্যতা মুছে ফেলে হাজার-হাজার ভাই যাদেরকে দলিত বলা হয়, বেদপাঠী ব্রাহ্মণ আর সর্বপূজ্য সন্ন্যাসী বানান। দুর্ভাগ্যবশত দেশের নেতা আর সমাজশাস্ত্রী এই ব্যবস্থাকে বুঝতে পারেনি। কেউ-কেউ তো অস্পৃশ্যতা আর জাতিভেদের দোষ বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থার মাথাতেই চড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে তথাকথিত বিদ্বান আর নেতার দ্বারা বৈদিক সংস্কৃতির বাস্তবিক জ্ঞানের আশা কিভাবে করা যেতে পারে? দেশ অন্ততঃ ইংরেজদের থেকে স্বতন্ত্র হয়েছে, কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা, সভ্যতা আর বিচারের আরও ভয়ংকর রূপে দাস হয়ে গেছে।
.
সেই সময় দলিত বর্গের নেতা ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর যিনি স্বয়ং জাতিগত বৈষম্য আর অস্পৃশ্যতার কামড়ের প্রচণ্ড দুঃখ ভুগেছেন, তিনি দেশের সেই কোটি-কোটি জন্মগত শূদ্র (দলিত) -দের করুণ অবস্থা দেখে তাদের একটু সান্তনা প্রদান করার জন্য দয়া আর সদ্ভাবনাবশত দশ বছরের জন্য আরক্ষণ (রিজার্ভেশন) ব্যবস্থাকে চালু করেন। যদিও তিনি সিদ্ধান্ততঃ একে দলিতোদ্ধারের স্থায়ী সমাধান মানতেন না তথা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহেরু এই নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন, তা সত্ত্বেও দশ বছরের জন্য এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করে হয়। যদিও ডক্টর আম্বেদকরের শিক্ষা আর জীবনের বিকাশে আর্য সমাজ দ্বারা প্রভাবিত বরৌদা আর কোল্হাপুরের নরেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তারপরও ডক্টর আম্বেদকর দলিতোদ্ধারের কাজে আর্য সমাজের বিচার এবং কর্মের কোনো ব্যবহার করতে পারেন নি। আমি মনে করি যে ডক্টর আম্বেদকর সেই আরক্ষণ ব্যবস্থাকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে বাস্তবায়িত করেন নি, বরং তিনি আসলে দলিতদের প্রতি সদ্ভাবনা রেখে তাদের সম্মানিত জীবন প্রদার করতে চেয়ে ছিলেন। দুঃখের বিষয় হল, প্রথম পীড়ির রাজনেতাদের পশ্চাৎ দেশের নেতারা আরক্ষণকে দলিতের হিতের বাহানা করে নিজেদের ভোটের অস্ত্র বানিয়ে নেয় আর ইংরেজদের "ফুট ডালো - রাজ করো" (ভাগ করো আর শাসন করো ) নীতিকেই গ্রহণ করে। যদি সেই রাজনেতাদের মধ্যে দলিতদের হিতের জন্য সামান্য আগ্রহও থাকতো, তাহলে তারা দশ বছরের পরে আরক্ষণ ব্যবস্থার সমীক্ষা করে এটা দেখতো যে এতে কতজন দলিতের লাভ হয়েছে আর কতজন এরথেকে বঞ্চিত আছে? তারা এটাও দেখতো যে এরফলে দেশের প্রতিভার সঙ্গে কোনো অন্যায় হচ্ছে না তো?
.
যে সকল দলিতের জীবন স্তর সামান্য হয়ে গিয়েছিল, তাদের আরক্ষণের লাভ থেকে মুক্ত করে অন্য নারকীয় জীবনযাপন করা দলিতদের এর লাভ দেওয়ার পাশাপাশি যদি তারা প্রতি পাঁচ বছর পর সমীক্ষা করতো, তাহলে এতদিনে কোনো দলিত গরীব থাকতোই না আর প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে কোনো দলিত (নিপীড়িত, শোষিত) থাকতোই না, কিন্তু এমনটা করলে চালাক নেতাদের ভোটের তেমন লাভ হতো না আর না আরক্ষণের সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি নিজের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চিরতরে অধিকতর সম্পত্তি সম্পন্ন করতে সক্ষম হতো।
.
দুর্বল গরীব কখনও আন্দোলন করে না, বরং সে নিজের নেতার বিশেষ করে নিজেরই বর্গের বড়লোকের মহড়া হয়ে নিজেরই হানি করে। এইভাবে দলিতের সঙ্গে কেউ প্রকৃত ন্যায়বিচার করেনি। বিশ্বনাথ প্রতাপসিংহের শাসনে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত করে দেশের নেতারা নিজের স্বার্থের জন্য অনেক যুবকদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের চোখে এক ফোঁটা চোখের জল আসেনি। তার পশ্চাৎ সারা দেশে জাতীয় শত্রুতার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আর নেতারা তামাশা দেখতে থাকে। জাতির নামে সংগঠন, সেনা, বিদ্যালয়, ধর্মশালা, ছাত্রাবাস, মন্দির তৈরি হচ্ছে। ঈশ্বরকেও জাতির মধ্যে বিভক্ত করে দিয়েছে। ভোটের মধ্যে জাতিবাদ সবথেকে বড় ইস্যু হয়। লাভ কিছু নেতা আর চালাক ব্যক্তিদের হয় কিন্তু নিচের সব ব্যক্তি পরস্পর অনাবশ্যক শত্রুতার আগুনে জ্বলতে থাকে। যারা আরক্ষণের জন্য লড়াই করছে তারা কোথাও রেলের লাইন উপড়ে ফেলে, কোথাও বাস আর ট্রেনে আগুন লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিকে স্বাহা করে দেয়। তারা এটা তাদের অধিকার মনে করে। তারা এটাও ভাবে না যে এই দেশ কোনো বিশেষ বর্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর উপর সবার সমান অধিকার আছে, এর সম্পত্তি সবার ব্যবহারের জন্য, তাহলে একে জ্বালাতে, উপড়ে ফেলার অধিকার কার আছে? যদি সব বর্গ এইভাবে করা শুরু তাহলে দেশের কি হবে?
.
এটা সত্য যে লোকতন্ত্রে সবার দাবি করার অধিকার আছে, কিন্তু জাতীয় নেতা এর জন্য ভাঙচুর করায়, দেশ আর রাজ্যকে বন্ধক বানিয়ে নেয়, দেশ আর রাজ্যের আন্দোলনকারীদের তুলনায় কয়েকগুন অধিক জনসমূহকে বিরক্ত করে, পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয় আর যুবক মরতে থাকে, বিপক্ষী রাজনৈতিক দল তামাশা দেখতে থাকে, আবার কেউ আরক্ষণের পক্ষে বা বিপক্ষে আপত্তিজনক ভাষণ দিয়ে আগুনে ঘী দেওয়ার কাজ করে, এইসব কতদিন দেশকে জীবিত রাখতে পারবে? এই দেশের মধ্যে একটা মারাত্বক বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী সংগঠনও আছে, যারা তথাকথিত সবর্ণদের বিদেশী বানিয়ে বাকি ভারতীয়কে অ-হিন্দু আর দেশের মূল নিবাসী পরিচয় দিয়ে ভবিষ্যতে গৃহ যুদ্ধ করার প্রস্তুতিতে লেগে আছে। যাদের পরিকল্পনা গুপ্ত, যার সম্বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থাও অবগত নয়।
.
দুঃখের বিষয় হল এই দেশের মধ্যে বর্গবিহীন সামাজিক সম্প্রীতির স্থাপনা হেতু আরক্ষণ আদির অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই কুব্যবস্থাই দেশের মধ্যে সামাজিক বর্গ-সংঘর্ষের আগুন লাগিয়েছে। জন্মের আধারে বিঘটনকারী আর অন্যায়পূর্ণ, যে জাতি ব্যবস্থা মধ্যকালে ছিল, সেটা আজও আছে, কেবল ক্রম পাল্টে গেছে মাত্র। জন্ম, মৃত্যু, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, ছাত্রাবাস, ব্যাঙ্ক সর্বত্র জাতি জিজ্ঞেস করা হয়। কোনো সরকারি কাজ বিনা জাতি জিজ্ঞেস করে আর লিখে হয় না। দুঃখের বিষয় হলেই অভাগা দেশের মধ্যে কয়লার কালি মুছে ফেলার জন্য সাবানের স্থানে কয়লাকেই ঘষা হচ্ছে। আজ এই দেশের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, ঈসাই, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পুনঃ ব্রাহ্মণ, রাজপুত, বানিয়ে, জাট, য়াদব, গুর্জর, লোধে, কুর্মী, রেবাহী, প্রজাপত, ঘাঁচি, চারণ, বিষ্ণোই, মেঘবাল, জাটব, বাল্মীকি, ভীল, মীণা আদি নিজেকে বলে এমন লক্ষ-লক্ষ লোক আছে, কিন্তু সারা ভারতের মধ্যে এমন একটাও লোক দেখি না যে নিজেকে ভারতীয় বলে, তাহলে মানুষের বিষয় কথা থেকে আসবে! পরমাত্মা তো সবাইকে মানব বানিয়ে ছিল, কিন্তু এরা মানুষ না হয়ে জানি না কি-কি হয়ে গেছে? এরা তো পরমাত্মাকেও জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছে, এটা তোর এটা আমার।
.
হায়! যদি এদেশের নাগরিক মানুষ না হলেও অন্তত ভারতীয় হতো, তাহলে আমাদের দেশ জাতি আর মজহবের আগুনে এইভাবে জ্বলতো না, কিন্তু দেশের রাজনীতি ভারতীয়দের হিতের জন্য হয়নি, বরং কিছু রাজনেতাদের জন্য হয়েছে। আপনি ভাববেন যে, শুধু সমস্যা বলে দিলেই হবে না, বরং তার সমাধানও করতে হবে।
.
সুধী পাঠকবৃন্দ! আমি এর পূর্ণ আর সর্ব মান্য সমাধান তো বলবো কিন্তু তার পূর্বে আপনার কাছে জানতে চাইবো যে এতদিন যাবত আরক্ষণ (রিজার্ভেশন) ব্যবস্থার ফল কী হয়েছে? আজ যখন আমি মহানগরের বস্তি, ফুটপাথ আদির মধ্যে লক্ষ-লক্ষ দীন দুঃখী, যাদের অন্ত্র ক্ষিদাতে শুকিয়ে গেছে, তাদের নারকীয় জীবনযাপন করতে দেখি। দেহাতি ক্ষেত্রের মধ্যে আজও অনেক মেঘবাল, পাউয়া, জোগি, নট, সাপুড়ে, ঝাড়ুদার, ভীল, গারাসিয়া আদির করুণ দশাকে দেখি, (এদের মধ্যে জাটব বা মেঘবালের থেকে তো কিছু উন্নীতও করেছে) তো ভাবছি যে দলিত নামে পরিচিত এদের জন্য কি কোনো আরক্ষণ নেই? তথাকথিত অনগ্রসর (পিছিয়ে পড়া) বর্গের মধ্যে কিছু সম্প্রদায় একতার লাঠির বলে আরক্ষণ পেয়ে এসেছে।
.
আশ্চর্যের বিষয় হল, যে আরক্ষণ দয়া ভাবনাবশত সুবিধা মাত্র ছিল, সেটা আজ গোঁফ আর পাগড়ির পরিচয় হয়ে উঠেছে। আগে বীরত্বের পরিচয় স্বয়ংকে উচ্চ বলার মধ্যে ছিল, তারমধ্যেই গোঁফ আর পাগড়ির গর্ব ছিল, কিন্তু আজ স্বয়ংকে অনগ্রসর তথা দলিত বলার হেতু দেশের ব্যবস্থাকে অবরোধ করার মধ্যে গর্ব করা হয়। কিছু চাওয়া অথবা দাবি করা আগে খারাপ মনে করা হতো, কিন্তু আজ এটা অধিকার মনে করা হচ্ছে। আজ আই.এ.এস. অধিকারী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হওয়ার পরেও দলিত আর অনগ্রসরদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। এমন ব্যক্তিরাই জাতীয় আরক্ষণের আগুনকে বাড়িয়ে দেয়। যদি কেউ আর্থিক আধারে আরক্ষণের দাবি করে, তাহলে এরা গরীব, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের জাতির নামে উস্কানি দিয়ে উপদ্রপ দাঁড় করিয়ে দেয়। গরীব, দলিত আর অনগ্রসর বেচারা জানেই না যে তাদের নেতা তাদের হিতের জন্য নয় বরং নিজের সন্তান আর প্রজন্মের স্বার্থবশ আর্থিক আধারে আরক্ষণের বিরোধ করে।
.
ক্রিমীলেয়ারকে আরক্ষণ দেওয়ার দাবি কি দেশের মধ্যে কোটি-কোটি গরীব দলিত, অনগ্রসর, কৃষক, শ্রমিক, অল্পবেতন ভোগী কর্মচারীর হিতের জন্য, নাকি তাদের নামে আরক্ষণের ওকালতি করে এর থেকে হওয়া ধনী, নেতা আর উচ্চ অধিকারীদের স্বার্থের জন্য? আরক্ষণের লাভ থেকে উচ্চ পদের উপর বিরাজমান এই জাতীয় নেতা জানে যে যদি আর্থিক আধারে আরক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়, তাহলে আরক্ষণের লাভ দীন-হীন বস্তি-কুঁড়েঘরে বাস করা ব্যক্তি, শ্রমিক, কৃষক, গরীব নিয়ে যাবে আর তাদের সন্তানরা এর লাভ পাবে না আর সেই গরীবও শীঘ্র সম্মানজনক জীবনযাপন করবে, তাহলে তাদের নেতাগিরী কিভাবে চলবে?
.
একটু ভাবুন, কোনো দলিত বা অনগ্রসর নেতা কি গরীব আছে? কোনো অধিকারী কি গরীব আছে, তাহলে কেন আর্থিক আধারে আরক্ষণকে স্বীকার করবে? আজ যাকে ফাইভ-স্টার হোটেল সন্তুষ্ট করতে পারে না, যে নিজের জন্মদিনে কয়েক অরব টাকা আদায় করে তথা যে নিজের জীবদ্দশায় নিজেরই মূর্তি উন্মোচন করে কোটি-কোটি টাকা খরচ করে, সেও নিজেকে দলিত বলে পরিচয় দিয়ে দলিতের হিতের কথা বলে, এইসব এই অভাগা দেশের মধ্যেই সম্ভব। এটা হচ্ছে কোটি-কোটি দলিত বা গরীবদের সঙ্গে জঘন্য উপহাস। ক্ষমতা তাদের হাতে আছে, গরিবের হাতে তো ভোট আছে, সেটা কোথায় দিবে সেই বেচারা এটাও জানে না। জাতির নামে ভাবুক হয়ে ভোট দিতে থাকে আর নরকে পড়ে থাকাই তার ভাগ্যে আছে। আজ এই জাতীয় আরক্ষণ ব্যবস্থা দেশের মধ্যে দলিতের মধ্যে দলিত আর অনগ্রসরের মধ্যে অনগ্রসর তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমান বিবেকহীন আরক্ষণ ব্যবস্থাতে পরীক্ষার মধ্যে অনুত্তীর্ণ হওয়া ব্যক্তিও নির্বাচিত হয়ে যায় আর অতি উচ্চ যোগ্যতার ব্যক্তি নির্বাচিত সবর্ণ থেকে যায়। না কেবল অনুত্তীর্ণ, বরং এমনকি যারা শূন্য নম্বর পেয়েছে তারাও বিজ্ঞান, গণিতের মতো বিষয়ের অধ্যাপক হয়ে যায়। একটু ভাবুন! এমন শিক্ষক কি পড়াবে? তার কাছে পড়ে দেশের কতগুলো শিশুর ভবিষ্যত নষ্ট হবে? সেই নষ্ট হওয়া ভবিষ্যত শিশুদের মধ্যে কয়টা শিশু আরক্ষিত বর্গের হবে, তাই এই চালাক, স্বার্থপর নেতারা এক ব্যক্তিকে লাভ দেওয়ার জন্য হাজার-হাজার জীবন বলিদান করে দিয়েছে। এইভাবে অযোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অন্য অধিকারী আদি হওয়াতে দেশকে ধ্বংসের আগুনে ফেলে দিয়ে রাজনৈতিক রুটি সেঁকে চলেছে।
.
পাঠকবৃন্দ! এখন আমি সংক্ষেপে সব সমস্যার সমাধান হেতু দুটো উপায় বলে দিচ্ছি। প্রথমটা হল, সব ধরণের আরক্ষণ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে তৎকাল প্রভাব থেকে সমাপ্ত করে দেশের সব ক্ষেত্র আর সব বর্গের সততার সঙ্গে অর্থনৈতিক সমীক্ষা করতে হবে। যারা গরীব রেখা থেকে নিম্ন জীবনযাপন করছে, তারাই আরক্ষণের লাভ করবে। এই দেশের মধ্যে গরীব আর ধনী দুটো বর্গই মানা হবে, কিন্তু বিশেষ যোগ্যতার পদে আরক্ষণ না দিয়ে দরিদ্রদের শিক্ষা ও প্রবৃদ্ধির সুবিধা দিতে হবে, কারণ গরীবরা কখনই ধনী কেন, সামান্য স্তরের সুযোগ-সুবিধা ভোগীর সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না।
.
এটাও মনে রাখতে হবে যে, দেশের নির্ধন বর্গ বা ব্যক্তিদের অবলোকন করার সময় এই বিষয়েরও পরীক্ষা করা হবে যে তারা নির্ধন কেন হয়েছে? কয়েকবার দেখা যায় যে দুর্বলতা, আলস্য, প্রমাদ, নেশাখোর, জুয়া, অহেতুকব্যয়, অধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজের পেট বাড়িয়ে তথা তারপর সংখ্যার বলে অধিকারের জন্য সংঘর্ষ করার ভাবনা রাখা আদি দোষও নির্ধনতার কারণ হয়। অল্পসংখ্যক, বিশেষ করে মুসলিম বর্গের মধ্যে সন্তান আর স্ত্রীদের বহুত্ব একটা সাধারণ রোগ, যাকে তারা মজহবী কারণে উচিত বলে মনে করে। এমন সব কারণকে দূর করার উপায় সাম, দান, দণ্ড, ভেদ আদি সব বিধির দ্বারা করার প্রচেষ্টা করা উচিত। যেসব ব্যক্তি সংস্কারের বিরোধিতা করবে, তাদের কোনো ধরণের রাজকীয় সহায়তা দেওয়া উচিত নয়। যদি তারা এই দোষের পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রীয় একতা আর অখণ্ডতাকে স্পর্ধা করার ভাবনা করে, তাহলে তাদের তৎকাল কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত। আমাদেরকে আমাদের ইতিহাসের ভুল আর গৌরব দুটো থেকেই শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রকে সশক্ত, অখণ্ড এবং সমৃদ্ধ বানানোর প্রচেষ্টা করা উচিত।
.
এরথেকেও উত্তম, বরং সর্বোত্তম স্থায়ী উপায় হল দেশের মধ্যে অনিবার্য শিক্ষা বাস্তবায়িত করা। যেসব মাতা-পিতা সন্তানকে পড়াবে না, তাদের দণ্ড দেওয়া হবে। অতি দরিদ্র মাতা-পিতা, যারা বালকের ভিক্ষা আর শ্রমিকের উপরই আশ্রিত, তাদের বৃদ্ধাবস্থা পেনশন বা বৃদ্ধাশ্রমের সুবিধা পাবে। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে গরীব, ভিখারী, দলিত, অনগ্রসর, সবর্ণ, উদ্যোগপতি সবার সন্তানের জন্য সর্বত্র এক সমান সুবিধাযুক্ত বিদ্যালয় হবে। সব ছাত্রের আহার-বিহার সমান হবে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো ছাত্রকে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি হোস্টেল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনো সরকারি চাকরিতে জন্মগত জাতির কোনো স্থান থাকবে না। বর্তমানে সর্বশিক্ষা তথা পোষাহারের নামে শিক্ষা-ব্যবস্থার সর্বনাশ করে দিয়েছে। কেবল সাক্ষর করতে বা এরও ভুয়া তথ্য পূরণ করতে আর পোষাহার চুরি করার হেতু বিদেশ থেকে ভিক্ষা চেয়ে-চেয়ে দেশের কর্মচারী আর নেতা পুঁজিবাদী হয়ে যাচ্ছে, তারা গরীব শিশুদের মুখের আহারকে কেড়ে নিয়ে নৃশংস অপরাধ করছে।
.
কিন্তু মনু প্রণীত ব্যবস্থার মধ্যে এমন হবে না। তারপর বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যোগ্যতানুসারে কাজ পাবে। তখন দরিদ্র-ধনী, অনগ্রসর-দলিত-সবর্ণের বৈষম্যতা সমাপ্ত হয়ে যাবে। কেউই আরক্ষণের দাবি করতে পারবে না। নেতারা উপদ্রব করার সুযোগ পাবে না। কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে এত ব্যয় শাসন কিভাবে করবে, তার উত্তর হল যখন সন্তানদের লালন-পালন, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে অভিভাবকরা মুক্তি পাবে, তখন তারা প্রসন্নতাপূর্বক শাসনকে কর দিবে। কর ব্যবস্থা চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আজ শীর্ষ উদ্যোগপতিদের লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকার ঋণ মাফ করে দেওয়া হয়, এই রাষ্ট্রবিরোধী পাপ তৎকাল বন্ধ করে তাদের উপর করকে আরও অধিক বাড়িয়ে এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে সহজে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। সারা দেশে কেবল ভারতীয় আর তারথেকে এগিয়ে শুধু মানবই দেখা যাবে। জাতীয় এর সম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যাবে। দরিদ্র আর ধনীর ভেদ সমাপ্ত হয়ে অনেক প্রকারের সন্ত্রাসবাদ থেকেও মুক্ত হয়ে এই রাষ্ট্র একতা, অখণ্ডতা, সম্প্রীতি, সুখ, সমৃদ্ধি এবং বিদ্যা বল দ্বারা বিশ্বের মধ্যে এক মহাশক্তি হতে পারবে। সবার পাগড়ি আর গোঁফের সম্মান বাঁচবে। দেশের গৌরব বেড়ে উঠুক, এটা পুনরায় জগৎগুরু আর চক্রবর্তী দেশ হোক, এর জন্য প্রত্যেক দেশবাসীকে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা আছে। যদি দেশ বাঁচবে তো সবাই বাঁচবে আর যদি দেশ মরে যায় তাহলে সব মুছে যাবে।
.
আসুন, আমরা নিজের ধর্ম আর কর্তব্যকে জেনে এই দেশকে পুনরায় মহান করে তুলি।
(সমাপ্ত)
আচার্য অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিক জীর হিন্দি পুস্তক হতে বাংলা অনুবাদ।
অনুবাদক (আশীষ আর্য)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ