অন্বয়: জন্তূনাং (জীবগণের) নরজন্ম (মনুষ্যজন্ম) দুর্লভম্ (দুর্লভ) অতঃ (এর থেকে) পুংস্তং (পুরুষদেহ লাভ) [দুর্লভ] ততঃ (তার থেকে) বিপ্রতা (ব্রাহ্মণশরীর লাভ) [দুর্লভ]। তস্মাৎ (ব্রাহ্মণশরীর হলেও) বৈদিকধর্মমার্গপরতা (বেদবিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা) [দুর্লভ]। অস্মাৎ (এর থেকেও) বিদ্বত্ত্বং (শাস্ত্রের তাৎপর্যজ্ঞান) পরম্ (শ্রেষ্ঠ)। আত্মানাত্ম বিবেচনং (আত্মা ও অনাত্মবিষয়ে বিচার) স্বনুভবঃ (সম্যক্ অনুভব) ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতিঃ (আত্মাই ব্রহ্ম এই বোধে একান্ত স্থিতি এর ফলস্বরূপ] মুক্তিঃ (মুক্তি) শতজন্মকোটিসুকৃতৈঃ (শতকোটি জন্মের সুকৃত কর্মের জন্যে) পুণ্যৈঃ বিনা (পুণ্যফল ব্যতীত) নো লভ্যতে (লাভ করা যায় না)।
সরলার্থ: জীবগণের মনুষ্যজন্ম দুর্লভ, এর থেকেও দুর্লভ পুরুষদেহ প্রাপ্তি আবার তার থেকেও দুর্লভ ব্রাহ্মণশরীর লাভ। ব্রাহ্মণশরীর লাভ হলেও চাই বেদবিহিত ধর্মমার্গে নিষ্ঠা। আবার এর থেকেও শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি শাস্ত্রের তাৎপর্যজ্ঞান। আত্মা ও অনাত্ম বিষয়ের বিচার, এসবের সম্যক্ অনুভব, ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অবস্থায় স্থিতি ও এর ফলস্বরূপ মুক্তি-শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পুণ্যফল ব্যতীত লাভ করা যায় না।
ব্যাখ্যা: বলছেন, 'জন্ত্বনাং নরজন্ম দুর্লভম্'; যার জন্ম হয় সে জন্ত বা জীব। আবার জীবজগতে মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। কারণ মানুষের বুদ্ধি আছে, সেই বুদ্ধি ভালোমন্দের বিচার করতে পারে, মন্দটাকে বর্জন করে যা ভালো, শ্রেয়স্কর তাই গ্রহণ করতে পারে। অন্য যেসব জীবজন্তু আছে তাদের যে বুদ্ধি নেই তা নয় কিন্তু তাদের বুদ্ধির তেমন কোনও প্রয়োগ নেই। সেটাকে বুদ্ধি না বলে instinct বা একটা সহজ প্রবৃত্তি বলাই ঠিক। কিন্তু মানুষের বুদ্ধির সৃজনী প্রতিভা আছে। এই যে বিজ্ঞানের এত উন্নতি, সাহিত্য চিত্রকলা সঙ্গীত, সবকিছুর এত উৎকর্ষ, এ তো মানুষের বুদ্ধিরই কাজ। মানুষের কৌতূহল অদম্য, সবকিছু জানার আগ্রহ তাকে সবসময় সম্মুখে ঠেলছে, একটা অতৃপ্তি তাকে থামতে দিচ্ছে না। বলছেন, 'নরজন্ম দুর্লভম্'। দুর্লভ কেন বলছেন? এই জন্ম কি আমি লাভ করেছি নিজেরই চেষ্টায়? হ্যাঁ তাই। আমরা হিন্দুরা কর্মবাদে বিশ্বাস করি। আমার এই জন্ম আমার জন্মজন্মান্তরের কর্মের ফলে হয়েছে। হিন্দু বলছে, মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরছে। একটা জন্মের কর্ম তার পরবর্তী জন্মে প্রতিফলিত হচ্ছে। সৎকর্মের ভাগ যদি বেশী থাকে তাহলে অনুকূল পরিবেশে জন্ম হয়, স্বচ্ছন্দ জীবন হয়। সৎ-অসৎ দুরকম কর্মের মিশ্রণে মানুষ-জন্ম হয়। যদি একটা জন্মে প্রায় সব কর্মই হীনকর্ম হয় তাহলে পরের জন্মে সেই মানুষ ইতরযোনি প্রাপ্ত হয়। ইতর প্রাণীর জীবন শেষ হলে আবার সে মানুষ হয়ে জন্মায়। আর যদি তার মানুষ- জীবনে সে বেদবিহিত যাগ-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করে, অনেক পুণ্য সঞ্চয় করে, তাহলে দেহ গেলে তার স্বর্গলাভ হয়। সে সেখানে দেবতা হয়ে পুণ্যকর্মের ফল ভোগ করে। সেই ভোগ শেষ হলে আবার মানুষ-জন্ম লাভ করে।
দেবতা বা পশুর জীবনে নতুন কর্মের কোন স্থান থাকে না। যেসব কর্মের ফলে দেবজীবন বা পশুজীবন হয়েছে, তা শেষ হয়ে গেলে আবার মানুষ হয়ে জন্মাতে হয়। মানুষ-জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে আমার নতুন কর্ম করার স্বাধীনতা থাকে। আমি হয়তো মন্দ কর্ম করে কষ্ট পাচ্ছি, কিন্তু আমিই আবার বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে শুভকর্ম করে আমার ভবিষ্যৎটাকে সুন্দর করে ফেলতে পারি। এই কারণেই মনুষ্য-জন্মকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। স্বাধীনভাবে কর্ম করতে পারি বলে মনুষ্য-জন্মকে বলে কর্মভূমি। আর সেটা করা যায় না বলে, শুধু পুরোনো কর্মের ফল ভোগ করতে হয় বলে, পশুজন্ম আর দেবজন্মকে বলে ভোগভূমি। তাই আমি যদি মোক্ষ-অভিলাষী হই, তাহলে আমাকে মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে। মানুষ হয়ে জন্মে নতুন কর্মের দ্বারা পুরোনো কর্মের বন্ধন কেটে জন্ম-মৃত্যুর চক্রের বাইরে যেতে হবে। তাই বলছেন 'নরজন্ম দুর্লভম্'। আবার বলছেন 'অতঃ পুংস্তুং', এর থেকেও দুর্লভ পুরুষদেহ লাভ। আগেকার দিনে শাস্ত্রচর্চার অধিকার প্রধানতঃ পুরুষদেরই থাকত, তাই একথা বলছেন। তাছাড়া মোক্ষের সাধন তো নির্জনে করতে হয়, পুরুষদেহ হলে তাতেও সুবিধে হয়। 'ততঃ বিপ্রতা'-তার থেকেও ব্রাহ্মণত্ব লাভ আরও দুর্লভ ভাগ্য। বর্ণাশ্রমের রীতি অনুযায়ী যিনি ব্রাহ্মণ তিনি বেদ অধ্যয়নে রত থাকবেন। এখানে সেইরকম ব্রাহ্মণের কথা বলছেন। যিনি বেদান্তচর্চায় নিবিষ্ট হয়েছেন তাঁর পক্ষে মোক্ষের পথ তো সুগম হবেই। তারপর বলছেন
"তস্মাবৈদিকধর্মমার্গপরতা বিস্বত্ত্বম্-অস্মাৎ পরম্'।
পুরুষ-দেহ, ব্রাহ্মণত্ব এসব হলেও সব হলো না। মুক্তির জন্যে চাই 'বৈদিকধর্মমার্গপরতা'। তার মানে কি? বেদে অনেক যাগযজ্ঞের কথা বলা আছে সেগুলোর অনুষ্ঠান করতে হবে। কিন্তু আমি তো মোক্ষ লাভ করতে চাই। তাই যেসব বৈদিক আচরণ আমায় মোক্ষের পথে এগিয়ে দেবে সেগুলোই আমি করব, সেগুলোই আমার পক্ষে ধর্মাচরণ। যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদি বিহিত কর্ম নিশ্চয় আমি করব কিন্তু নিষ্কাম ভাবে। ব্রহ্মসূত্রে আছে যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসার জন্যে একটা প্রস্তুতি লাগে। আমি যদি ব্রহ্মকে জানতে পারি তাহলেই আমার মুক্তি, কিন্তু সেই ব্রহ্মকে জানার ইচ্ছে জাগারও একটা প্রস্তুতি আছে। কি সেই প্রস্তুতি? ইহ-অমুত্র-ফলভোগ-বিরাগঃ, আর ষট্সম্পত্তি লাভ। 'ইহ-অমুত্র-ফলভোগ- বিরাগঃ', 'ইহ' মানে এখানকার অর্থাৎ এই জগতের, আর 'অমুত্র' হচ্ছে অন্য জগতের, এই দুই জগতেই আমার কোনও ফলের আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি নিষ্কাম, আমার জাগতিক কিছু চাইবার নেই, পাবারও নেই। আর ষসম্পত্তি হচ্ছে মনের ছটি সম্পদ-শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, শ্রদ্ধা ও সমাধান। 'শম' হচ্ছে অন্তরিন্দ্রিয় অর্থাৎ মনের দমন, 'দম' হচ্ছে বহিরিন্দ্রিয়ের দমন, 'উপরতি' হচ্ছে সমস্ত বিষয় থেকে মনকে সরিয়ে নেওয়া। 'তিতিক্ষা' হচ্ছে শীত গ্রীষ্ম সুখ দুঃখ সবকিছুতে নির্বিকার থেকে সহ্য করার ক্ষমতা। 'শ্রদ্ধা'-গুরুবাক্যে শাস্ত্রবাক্যে বিশ্বাস, সংশয়ের একান্ত অভাব, ভক্তিপূর্ণ নির্ভরতা।
সমাধান'-গভীর একাগ্রতা, আত্মস্থ হয়ে যাওয়া। এগুলোকে ষট্সম্পত্তি বলা হয় কারণ এগুলোই মানুষের সত্যিকারের ঐশ্বর্য, ধনদৌলত তো চিরকাল থাকবে না। 'বিম্বত্ত্বম্-অস্মাৎ পরম্', এসবের থেকে যা পরম লাভ, শ্রেষ্ঠ লাভ তা হলো শাস্ত্রের তাৎপর্য বোঝা, শাস্ত্রবাক্যের মর্মগ্রহণ করতে পারা। তারপর আসছে 'আত্মানাত্মবিবেচনম্', আত্মা ও অনাত্মার বিচার করে অনাত্মবস্তুকে বর্জন। নেতি নেতি করে যা অনাত্মবিষয়, অনিত্য, মিথ্যা সেসব বাদ দিতে দিতে আত্মায় এসে থেমে যাওয়া। 'সু-অনুভবঃ' সবকিছুর সম্যক্ অনুভব। যা অবস্তু সেসব বর্জন করে আত্মাই যে আমার স্বরূপ, একমাত্র নিত্যবস্তু এই জ্ঞানের সম্যক্ উপলব্ধি। 'ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতিঃ-মুক্তিঃ নো শতজন্মকোটি সুকৃতৈঃ পুণ্যৈঃ-বিনা লভ্যতে'। 'ব্রহ্মাত্মনা সংস্থিতিঃ' অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতায় স্থিতি অর্থাৎ ব্রহ্মকে জেনে ব্রহ্মই হয়ে যাওয়া। আর তার মানেই হলো ভববন্ধন থেকে মুক্তি, জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে নিষ্কৃতি। বলছেন, শতকোটি জন্মের সুকৃতি ও পুণ্যফল ব্যতীত এই অত্যন্ত দুর্লভবস্তু লাভ হয় না।
ওম্ শম্।।
শঙ্করাচার্যকৃত "বিবেকচূড়ামণি"
অনুবাদ ও ব্যাখ্যা - স্বামী লোকেশ্বরানন্দ
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ