নবম ভাগ
ভোজন
ভূমিকা -
"ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্"
.
ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উদ্দেশ্য। এই পুরুষার্থচতুষ্টয় সিদ্ধির মূলকারণ হল আরোগ্য। শরীর যদি সুস্থ না থাকে, রোগী হয় তাহলে পুরুষার্থচতুষ্টয় কেন, শৌচ স্নানাদি নিত্য কর্মের অনুষ্ঠানও সঠিকভাবে হবে না। রোগী স্বয়ং অন্যের উপর বোঝা হয়ে যাবে, সে কিভাবে অন্যের সেবা বা উপকার করবে তথা কিভাবে ধর্মানুসারে চলবে? এইজন্য শরীরের সুস্থতাকে পুরুষার্থচতুষ্টয়ের সিদ্ধির জন্য আমাদের শাস্ত্রকারগণ সর্বপ্রথম আর মুখ্য স্থান দিয়েছেন।
.
জীবনের চরম লক্ষ্য, অন্তিম ধ্যেয় হল মোক্ষপ্রাপ্তি আর তার প্রাপ্তি আত্মা এই শরীররূপী রথের সহায়তায় করে। যদি শরীররূপী রথ সুস্থ আর দৃঢ় না হয় তাহলে মাঝ পথেই জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাবে তথা আত্মা তার লক্ষ্যের প্রাপ্তি করতে পারবে না। আবাগমনের চক্র থেকে না বেরিয়ে বরং দুঃখসাগরেই পাক খেতে থাকবে। সুতরাং আমাদের শরীররূপী রথ, জীবন যাত্রার সাধন, সুস্থ দৃঢ় আর সুগঠিত হোক সেটা অবশ্যক।
আহারবৈষম্যাদস্বাস্হ্যম্" (সুশ্রুত অধ্যায় ৪৬)
.
ভোজন বিষমতার কারণে স্বাস্থ্য খারাপ হয়। শরীরকে সুস্থ আর নীরোগ রাখার জন্য ভোজনের স্থান হল সর্বপ্রথম, কারণ এই পঞ্চভৌতিক শরীর ভোজনের মাধ্যমেই হৃষ্ট-পুষ্ট আর দৃঢ়াঙ্গ হয়। শরীরের উপচয়-অপচয় বা বৃদ্ধি আর হ্রাস ভোজনের উপর নির্ভর করে। যদি শরীরকে যথা সময়ে উচিত ভোজন দেওয়া হয় তাহলে শরীরও হৃষ্ট-পুষ্ট আর সুডৌল হয় অন্যথা স্বাস্থ্য খারাপ হয়।
.
ভোজনের মতো আবশ্যক আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপেক্ষা করা মানে নিজের জীবনের উপেক্ষা করা, ভোজনের বিষয়ে অজ্ঞানী থাকা মানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে রাখা। আমাদের পূর্বজ ঋষি-মহর্ষিগণ এই বিষয়ে অনেক গম্ভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেছেন। কোন পদার্থের কি গুণ আছে আর সেটা কি অবস্থায় লাভদায়ক তথা হানিপ্রদ, দেশ-কাল আর প্রকৃতি ভেদে আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভক্ষ্যাভক্ষ্য পদার্থের পূর্ণ মীমাংসা করে দিয়েছেন, এইজন্য আমাদের দেশ যখন শাস্ত্রবিহিত ভোজন করতো তখন সংসারের মধ্যে আমাদের দেশে সবাই বীর শক্তিশালীর শিরোমণি ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজ আমরা শাস্ত্রকে ভুলে গেছি, তাই ভোজনের নামে অনেক কুপ্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে। মদ্য, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ আদি অভক্ষ্য পদার্থও নিঃসঙ্কোচ হয়ে লোকে সেবন করছে।
.
এর মুখ্য কারণ হল আমরা ভোজনের মুখ্য উদ্দেশ্যটাই ভুলে গেছি, আমাদের ভোজন জীবনের জন্য নয় বরং জীবনটাই ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। ভোজন পরীক্ষার সাধন কেবল জিহ্বাই রয়ে গেছে আর এই পিশাচিনী এত লোলুপ হয়ে গেছে যে সব সর্বনাশ করে দিয়েছে।
.
ভোজন বিগড়ে যাওয়াতে আর অসংযত হওয়াতে ব্রহ্মচর্য পালন আর সংযত জীবনের অভাব হয়ে গেছে। বিষয়বাসনা, শৃঙ্গার আর ব্যভিচারের আগুন এত প্রচণ্ড ভাবে জ্বলছে যে ঋষিদের এই পবিত্র ভূমি শুধু ভারতই নয় বরং সমস্ত বিশ্বকেই ভস্মসাৎ করে দিচ্ছে।
.
এমন বিকট সময়ে এই ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায় "ভোজন" যদি কারও কোনো পথ প্রদর্শন করতে পারে তাহলে আমার পরিশ্রম সফল তথা দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করবো।
.
এরমধ্যে ভোজন সম্বন্ধীয় অনেক ভ্রান্তধারণা আর কুপ্রথার খণ্ডন করা হয়েছে। এমন অনেক বিষয় পাঠক মহানুভবগণ দেখবেন যা সর্বথা নবীন বলে মনে হবে, সেগুলোর উপর গম্ভীর ভাবে বিচার করলে তত্ত্বজ্ঞান হবে। আমি সেটা যথাশক্তি উপযোগী আর সহজভাবে করার চেষ্টা করেছি, আমি আমার কাজে কতটা সফল হয়েছি তা পাঠক মহানুভবই বলতে পারবেন।
ওমানন্দ সরস্বতী
গুরুকুল ঝজ্জর
বৈশাখ ২০৩৪ (বিক্রম)
মে ১৯৭৭ ইংরাজি
____________________________________________
.
আমাদের ভোজন
.
প্রত্যেক মানুষ সুস্থ থাকতে চায়, কেউই রোগী হয়ে থাকতে চায় না। স্বাস্থ্য আর ভোজনের মধ্যে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। বিচারশীল পুরুষ তথা সমাজ এর গুরুত্বকে সঠিক ভাবে জানে। আমাদের প্রাচীন পুরুষ ভোজনের গুরুত্বকে ঠিকভাবে জানতেন তাই তাঁরা এই বিষয়ে খুব সাবধান ছিলেন। আজ আমরা তাঁদের সন্তান ভোজনের বিষয়ে কিঞ্চিৎমাত্র ধ্যান রাখি না।
.
দৈনিক আহার আমাদের স্বাস্থ্য, ব্রহ্মচর্য, মন, বুদ্ধি আর আত্মার উপর কি প্রভাব ফেলে সেটা নিয়েও আমরা কখনও ভাবার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। শুদ্ধাহার দ্বারাই মানুষের সবকিছু শুদ্ধ হয় আর মিথ্যাহার দ্বারা হয় সর্বনাশ। এর উপর আমাদের প্রাচীন ঋষি-মহর্ষিগণ গম্ভীর ভাবে কেবল বিচারই করেছেন তা নয় বরং পূর্ণ রূপে অনুভব করেছেন। এইজন্য তাঁরা নিজের অনুসন্ধানের আধারে শুদ্ধাহারের অনেক প্রশংসা করেছেন। ছান্দোগ্যোপনিষদের মধ্যে লেখা আছে -
.
আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাম্ বিপ্রমোক্ষঃ।।
.
আহার শুদ্ধ হওয়াতে অন্তঃকরণ অর্থাৎ বুদ্ধি আদির শুদ্ধি হয়, বুদ্ধি শুদ্ধি হওয়াতে স্মৃতি দৃঢ় বা স্থির হয়, স্মৃতি দৃঢ় হওয়াতে হৃদয়ের আবরণ অর্থাৎ জন্ম-মরণের বন্ধন ঢিলে হয়, অবিদ্যা-অন্ধকার মুছে গিয়ে মানুষ সকল প্রকার দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয় আর পরম পদ মোক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। সুতরাং শুদ্ধাহারের ফলে মানুষের এই লোক তথা পরলোক দুটোতেই মঙ্গল হয়। য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার মধ্যে একে এইভাবে লিখেছেন -
.
য়ুক্তাহারবিহারস্য য়ুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
য়ুক্তস্বপ্নাববোধস্য য়োগো ভবতি দুঃখহা।। (৬/১৭)
.
যথাযত আহার-বিহার, যথাযত কর্মকারী, উচিত মাত্রায় নিদ্রা আর জাগরণকারীর এই য়োগ দুঃখনাশক হয় অর্থাৎ সঠিকভাবে আহার-বিহার আদির সেবন করলে মানুষের সব দুঃখ দূর হয়।
.
ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণীর আছে, কীট পতঙ্গ থেকে শুরু করে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ পর্যন্ত এই ভোজনের জন্য ব্যাকুল হতে দেখা যায়। এই যুগের মানুষের সম্পূর্ণ শক্তি এই ভোজনের জোগাড় করতেই চলে যায়। প্রাতঃকাল থেকে শুরু করে সায়ংকাল পর্যন্ত "হায় ভোজন হায় ভোজন" করে দৌড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, আজ মানুষের জীবন-মরণও ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ভোজন কেন করি, এর উচিত উত্তর সহস্র ব্যক্তির মধ্যে কোনো বিচারশীল ব্যক্তিই দিতে পারবে। আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে এর উত্তর এই ভাবে দেওয়া আছে -
.
আহারঃ প্রীণনঃ সদ্যোবলকৃদ্দেহধারণঃ।
স্মৃত্যায়ুঃ শক্তিবর্ণোজঃ মত্ত্বশোভাবিবর্ধনঃ।। (ভাব০ ৪/১)
.
ভোজন দ্বারা তৎকাল শরীরের পোষণ আর ধারণ হয়, বলের বৃদ্ধি হয় তথা স্মরণ শক্তি, আয়ু, সামর্থ্য, শরীরের বর্ণ, কান্তি, উৎসাহ, ধৈর্য্য আর শোভা বৃদ্ধি পায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হল যে - আহার হচ্ছে আমাদের জীবন। কারণ ভোজন দ্বারা শুধু মানুষ কেন সকল প্রাণীর জীবন রক্ষা হয়, সুতরাং ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণধারীদের আছে অথবা বলা উচিত প্রাণীমাত্রের জীবনের আধার হল ভোজন। যদি আমরা ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে আমাদের জীবিত থাকা অসম্ভব। সুতরাং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাণী জীবনধারণার্থ ভোজন গ্রহণ করতে থাকে আর তার দ্বারাই জীবিত থাকে। সুতরাং সর্বপ্রথম তথা সর্বোত্তম ভোজনের গুরুত্ব আমাদের জীবনে এটাই, যাকে ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে আমরা যদি অন্ধকারে থাকি তাহলে সেটা বড়ই আশ্চর্য তথা মুর্খতা হবে। অপঠিত বা অশিক্ষিত জীবনের বিষয়ে যাদের কোনো জ্ঞান নেই, এমন ব্যক্তি যদি এই বিষয়ে কিছু না জানে তাহলে কোনো বড় বিষয় হবে না, কিন্তু আজকের শিক্ষিত সমুদায় এই বিষয়ে একদম পঙ্গু যা বড়ই দুঃখের বিষয়। অশিক্ষিত ভাই তো কিছু প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে এই বিষয়ে একটু হলেও কম-বেশি কিছু জ্ঞান রাখে কিন্তু বড়-বড় বি.এ., এম.এ., প্রভাকর আর শাস্ত্রী আদি ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদের মধ্যে জীবনের আধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জ্ঞানের অভাব থাকলে, তাহলে তো এইরকম দুঃখজনক অবস্থাকে দেখে অত্যন্ত দুঃখই হবে আর দেশের নিকট ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল প্রতীত হয় না।
.
তাছাড়া এটুকু জ্ঞান তো প্রত্যেক প্রাণীর আছে যে ভোজনের পশ্চাৎ বল উৎসাহ প্রতীত হয়, ক্ষুধার্ত প্রাণীর মধ্যে এর অভাব দেখা যায়। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে মৃত্যু নিশ্চিৎ রূপে দর্শন দিবে, এটা শরীরের রচয়িতা বা প্রকৃতির অটল নিয়ম। উচিত এবং আবশ্যক ভোজন প্রাপ্তি বিনা স্বাস্থ্যরক্ষা অথবা জীবনরক্ষা হবে না। এইজন্য স্বাস্থ্য প্রাপ্তি তথা জীবন রক্ষার জন্য ভোজনেরও একটা বিশেষ স্থান আছে। এই বিষয়ে চরকসংহিতার মধ্যে বলা হয়েছে -
.
বলমারোগ্যমায়ুশ্চ প্রাণাশ্চাগ্নৌ প্রতিষ্ঠিতাঃ।
অন্নপানেন্ধনৈশ্চাগ্নির্দীপ্যতে শাম্যতেऽন্যথা।।
.
শরীরের ভিতরে যে অগ্নি আছে তারই আশ্রয়ে শরীরে প্রাণ স্থির থাকে। এই অগ্নি বল, আরোগ্য আর আয়ুর প্রতিষ্ঠাকারী হয় অথবা বলা উচিত অন্তরগ্নিতে শরীর স্থিত আছে। অন্ন-পান রূপী জ্বালানি দ্বারাই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, এই অগ্নির দীপন আর শমন ভোজনের দ্বারাই হয়। এটা আমরা প্রত্যক্ষ দেখি যে অন্ন-পানের সেবন দ্বারা আয়ুপর্যন্ত প্রাণ থাকে। এই বিষয়ে চরক সংহিতাতে লেখা আছে -
.
ইষ্টবর্ণগন্ধরসস্পর্শবিধিবিহিতমন্নপানম্ প্রাণিনাম্ প্রাণি সঞ্জ্ঞকানাম্ প্রাণমাচক্ষতে কুশলাঃ, প্রত্যক্ষফলদর্শনাৎ, তদিন্ধনা হ্যন্তরাগ্নেঃ স্থিতিঃ, তৎসত্ত্বমূর্জয়তি, তচ্ছরীরধাতুব্যূহবলবর্ণেন্দ্রিয়প্রসাদকরম্ য়থোক্তমুপসেব্যমানম্ বিপরীতমহিতায় সম্পদ্যতে।
.
কুশল বিচারশীল পুরুষ যে অন্ন-পান (ভোজন) বিধিপূর্বক বানানো হয়েছে, যা সুন্দর বর্ণ (রঙ) গন্ধ রস তথা স্পর্শসংযুক্ত তাকে মনুষ্য আদি দেহধারীদের জন্য প্রাণতুল্য মানেন। কারণ এটা প্রত্যক্ষ অনুভবের বিষয় যে অন্ন-পান দ্বারা প্রাণীদের প্রাণ কাজ করে। ভোজন না করলে আয়ু ক্ষীণ হয়ে মৃত্যু হয়। অন্ন-পানের কারণেই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, অন্নের কারণে মনের মধ্যেও বল আসে। যখন ভোজন যথাযত ভাবে করা হয় তখন এটা শরীরের বাতাদি দোষের রস রক্ত বীর্যাদি ধাতুর সংঘাতকে তৈরী করে। যেখানে যে ধাতুর ন্যূনতা থাকে সেখানে তার ভোজন পূর্তি করে দেয়। বিধিপূর্বক ভোজন শরীরকে বল দেয়, বর্ণকে উজ্জ্বল করে, কান্তি দায়ক আর ইন্দ্রিয়কে প্রসন্ন তথা তৃপ্ত করে। বিধির বিপরীত সেবন করলে হানিকারক সিদ্ধ হয়।
.
আহার দ্বারা শরীরের বিকাশ আর বৃদ্ধি
.
সব প্রাণী যখনই জন্ম নেয় ততকাল খিদে তাদের যন্ত্রণা দেয়। মাতার গর্ভ থেকে বাইরে আসা মাত্র মানব-শিশু সঙ্গে-সঙ্গে কান্না আর ঝটপট করতে থাকে আর যখন মাতার স্তন যেখানে, সেখানে তার মুখ আসে তথা সে দুগ্ধামৃতের পান করে, সে ততকাল শান্তচিত্ত হয়ে খেলা শুরু করে বা ঘুমিয়ে পড়ে। খিদের নিবৃত্তির সঙ্গে-সঙ্গে তার ব্যাকুলতাও পালিয়ে যায়। সব প্রাণীর অবস্থাই এইরূপ সমান হয়।
.
এই দুগ্ধপান তথা ভোজনের সেবন দ্বারা সব প্রাণী খিদে শান্ত হতেই যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনি এদের শরীরের মধ্যে কিছু দিনের মধ্যেই বৃদ্ধি-বিকাশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হয় যে জন্মের সময় থেকে যুবকাবস্থা পর্যন্ত শুধু মানুষই নয় বরং প্রত্যেক প্রাণীর শরীরের বৃদ্ধি তথা বিকাশ প্রতিদিনের করা ভোজনের মাধ্যমে হয়।
.
সুতরাং আমাদের শরীরের সম্যক্তয়া বৃদ্ধি বা সম্পূর্ণ বিকাশ আমাদের ভোজনের উপর নির্ভর করে, যদি আমরা যথাযত ভাবে ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে শরীরের বিকাশও থেমে যাবে। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে বিকাশের স্থানে হ্রাস তথা শেষে শরীরের নাশ হবে। তাই আহার যেমন জীবনের আধার তেমনই বিকাশ বা বৃদ্ধিরও মুখ্য কারণ কিন্তু সেই ভোজন হিতকর হওয়া উচিত। হিতকর ভোজন বিনা বৃদ্ধি অসম্ভব। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে -
.
"হিতাহারোপয়োগ এব পুরুষস্যাভিবৃদ্ধিকরো ভবতি"
.
অর্থাৎ একমাত্র হিতকর আহারের ব্যবহারই পুরুষের শরীরের বৃদ্ধি করে। তাছাড়া যেটাই খাওয়া হয় তাকেই আহার (ভোজন) বলে। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে "আহারত্বমাহারস্যৈকবিধমর্থাভেদাৎ" নিগরণ অর্থাৎ গ্রাসের ক্রিয়া সব আহারের মধ্যে এক সমান হয়। ভিন্ন-ভিন্ন ভোজনের বস্তুতে নিগরণ সমান হওয়ার কারণে সবগুলোকে আহার বলে। "আহার্য়তে গলাদধো নীয়তে ইত্যাহারঃ" গলা থেকে নীচে যা নিয়ে যাওয়া হয় তাকে আহার বলে। সব আহারের দ্রব্যতে আহারতা থাকে, কিন্তু আমাদের জন্য হিতকর আহার কোনটা সেটা জেনে রাখা উচিত। যে আহার শরীরের বৃদ্ধি করে আর হিতকর হয়, এই একটা লক্ষণ তো করে দেওয়া হয়েছে। এরপর এই বিষয়ে লেখা আছে -
.
সমাঁশ্চৈব শরীরধাতূন্ প্রকৃতৌ স্থাপয়তি বিষমাঁশ্চ সমীকরোতীত্যেতদ্ধিতম্ বিদ্ধি, বিপরীতমহিতমিতি, এতদ্ হিতাহিতলক্ষণমনপবাদম্ ভবতি। (চরক সূত্র০ অ০ ২৫)
.
অগ্নিবেশ জিগ্যেস করাতে ভগবান্ আত্রেয় উত্তর দেন - যে আহার অসমাবস্থায় স্থিত শরীরের বাত, পিত্ত, কফ, রক্ত, মাংস, বীর্যাদি ধাতুকে প্রকৃতি অর্থাৎ সাম্যাবস্থাতে রাখে, দূষিত হতে দেয় না আর সুরক্ষিত রাখে। বিষম (খারাপ হওয়া) ধাতুকে সমাবস্থায় নিয়ে আসে অর্থাৎ সুধরে দেয়, সেই ভোজনকে হিতকর বলে। এর বিপরীত যেটা সম ধাতুকে বিষম (নষ্ট) করে দেয় আর বিষম অবস্থায় রাখে অর্থাৎ খারাপকে খারাপই করে রাখে তাকে অহিতকর বলে। এই বিষয়ে বিস্তার ভাবে পরে লেখা হবে। বিষম আর অহিতকর ভোজন করলে অরুচি, শারীরিক দুর্বলতা, কণ্ডু, পামা, কুষ্ঠ আদি রোগের উৎপত্তি হয়। অঙ্গাবসাদ তথা দোষ প্রকুপির হওয়াতে সেই-সেই স্থানের অনুসারে গ্রহণী অর্শ আদি রোগ উৎপন্ন করে।
🍁 অধিক ভোজন 🍁
এটা প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনের অনুভব তথা অধিকাংশ ডাক্তারের মত হল এটাই যে ৯৯ শতাংশ মানুষ আবশ্যকতার অধিক আহার গ্রহণ করে। আর এর মুখ্য কারণ হল আমরা সবাই জিহ্বার দাস হয়ে গেছি। আমাদের রসনা (জিহ্বা) সর্বদা সুস্বাদু ভোজনের জন্য ছটপট করে, তাই আমরা স্বাদের চক্করে পড়ে অধিক আহার করে ফেলি। কিন্তু স্বভাবে স্বাদপ্রিয় মানুষ সুস্বাদু ভোজনের মধ্যে যে ক্ষণিক সুখ অনুভব করে এই সুখকেই নিজের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় আর নিজের সব বহুমূল্য জীবন এই সুখের ইচ্ছাপূর্তিতেই হারিয়ে দেয় আর ভুলে যায় যে আমাদের হিত ও কল্যাণ এই সুস্বাদু ভোজন দিয়ে সম্ভব নয়। এর ফলে মানুষ পেটুক হয়ে যায়। স্বাস্থ্য, বল, বীর্য, শক্তি, ব্রহ্মচর্য চুলোয় যাক কিন্তু এই পেটুক মানুষকে চটপটা আর মিষ্টি সুস্বাদু ভোজনই চাই। জিহ্বার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে এমন ব্যক্তি খুব কম দেখা যায়। সুস্বাদু ভোজন করা কোনো পাপ নয় তবে স্বাদের কারণে অধিক আহার তথা ভোজনকে সুস্বাদু বানানোর জন্য লবণ, লংকা, মসলা, টক আদি হানিকারক পদার্থ দিয়ে ভোজনকে খারাপ করে খাওয়া তো মহামুর্খতাই হবে। কবিরাজ হরনামদাস জী এই বিষয়ে লিখেছেন "চূর্ণ আর চটপটে বস্তুর চল বেড়ে গেছে। বাবুরা ফুচকা, ইমলীর চাট, ভল্লে পকড়িয়া এক স্থানে বসে খেয়ে নেয়। হে মানব! জাগো, কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারছো, এইসব বস্তু পরিপাকতন্ত্রকে খারাপ করে আর জীবনের সার (বীর্য) -কে দুর্বল করে আর সন্তান উৎপন্ন করার যোগ্যতা রাখে না। ছোটো বাচ্চারা যারা টক খায় তাদের মধ্যে যুবকাবস্থার পূর্বেই কামবাসনার প্রতি টান আসতে থাকে, যাদের চোখ খোলা আছে তারা এইসব বিষয় স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে, অধিক কি লিখবো! এইরূপ দৃশ্যকে দেখে আমি এই পরিণামে এসেছি যে আমাদের দুর্বলতা, আমাদের রোগ, আমাদের বৃদ্ধাবস্থা, একটা সীমা পর্যন্ত অন্ন-পানের কারণেই হয়। সুতরাং ভোজনে অনেক সাবধান আর সংযত থাকা আবশ্যক।
.
🍁 ভোজনে নিয়ন্ত্রণ 🍁
স্বাস্থ্যপ্রিয় ব্যক্তি বা ব্রহ্মচারী না অধিক আহার করে আর না ন্যুন; কিন্তু শরীরের জন্য যতটা আবশ্যক ঠিক ততটুকুই আহার করে। অধিক আহার করাটা সহজ আর সর্বথা উপবাস করাও সহজ কিন্তু যথাযথ (না ন্যুন না অধিক) ভোজন করা অধিক কঠিন ব্যাপার। ভোজনে সমতা বজায় রাখাই তো ব্রহ্মচারীর আসল তপস্যা আর ভোজনের নিয়ন্ত্রণ বলতে এটাই, "মিতভোজন স্বাস্থ্যম্" একটা সূত্র আছে যার অর্থ হল মিতভোজন অর্থাৎ অল্পাহার স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর। অতিভোজন তো সবাই নিষেধ করেছেন তবে মিতাহারের প্রশংসা প্রায় সব লেখক আর প্রভাষক করেছেন। কিন্তু মানুষের জন্য বিশেষ তো তখন হবে যখন শরীরের জন্য যতটা ভোজনের আবশ্যকতা ঠিক ততটাই সে গ্রহণ করবে, না অধিক না ন্যুন। যথাযথ ভোজন করা অনেক বড় সংযম আর ভোজনের এই সংযম হল ব্রহ্মচর্য, স্বাস্থ্য আদি সব শুভ কর্মের আধারশিলা। ভোজনে সংযম করে এমন মানুষ কয়েক হাজারের মধ্যে এক-দুই জন হয় আর এমন সংযমী পুরুষই স্বাস্থ্যের আসল স্বাদ ভোগ করে তথা এইরূপ সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিই ব্রহ্মচর্য পালনে সফলতা প্রাপ্ত করে। ৭৫ শতাংশ স্বপ্নদোষের রোগী ভোজনে সংযম না হওয়ার কারণেই হয়। যেখানে ভোজন একটু অধিক সুস্বাদু লাগে, সংযম না হওয়ার কারণে মানুষ পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভরে দেয়, রাতে পেট ভারী থাকার কারণে স্বপ্নদোষ হয়। যার ফলে স্বাদ বেরিয়ে যায়, কান্না আর আফসোস করে। অনেকেই নিজের এই ভুলকে জানতে পারে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এইভাবে হানি বহন করে বেড়ায়। কিছু রোগী অজ্ঞানবশতঃ ভোজনে অধিক আহার করার ভুল করে, যখন তারা জানতে পারে তখন অধিক আহার করা ছেড়ে দেয় আর আহার-ব্যবহারের সংযমকে ধারণ করে নেয়। নিত্য উচিত আহার-বিহার ছাড়া কল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যার্থী তথা সবার জন্য উচিত আহার-বিহারের আদেশ বা উপদেশ ঋষিরা করেছেন - "নিত্যম্ য়ুক্তাহারবিহারবান্ বিদ্যোপার্জনে চ য়ত্নবান্ ভব" বিদ্যার্থী অর্থাৎ ব্রহ্মচারীকে নিত্য উচিত পরিমাণ আহার-বিহার করার পাশাপাশি বিদ্যা গ্রহণে যত্নশীল হওয়া উচিত। কিন্তু অধিক অল্প মাত্রায় আহার করলে বল, বর্ণ, কান্তি, শক্তি, পুষ্টির নাশ বা ক্ষীণতা হয়, উদাবর্ত (যৌনরোগ) আদি রোগ উৎপন্ন হয়; মানুষ অতৃপ্ত আর অশান্ত থাকে, বীর্য আদি ধাতুর বৃদ্ধি হয় না, আয়ু কমে যায়। শরীরের আবশ্যকতানুসারে ভোজন না করলে শরীরের সারভাগ বীর্য, বল, ওজ নষ্ট হয়ে যায়। মন-বুদ্ধি আর ইন্দ্রিয়ের শক্তির হ্রাস আর নাশ হয় আর ৮০ প্রকারের বাত রোগের উৎপত্তি হয়। সুতরাং অল্পাহার, সুস্থশরীরে উপবাস করা আদি স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক কিন্তু এটা স্মরণে রাখা উচিত যে আবশ্যকতার তুলনায় অল্প আহার যেমন শরীরকে রোগী তথা ক্ষীণ করে, তেমনই আবশ্যকতার অধিক আহার বল, বীর্য, ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যের জন্য আরও অধিক ঘাতক হয়। অল্পাহার করা যতটা অপরাধ নয়, তারথেকেও বড় আর প্রচণ্ড অপরাধ হল অধিক আহার করা। অল্প আহার করার ফলে শরীরের ক্ষতি কিছু অধিক দিনে হয় কিন্তু অধিক আহার করা ব্যক্তি নিজের অপরাধের দণ্ড শীঘ্রই প্রাপ্ত করে। সুতরাং এখানে সংক্ষেপে অধিক আহার করার হানিগুলো দর্শানো হল।
.
🍁 অধিক আহারের ফলে হানি 🍁
মাত্রাতিরিক্ত খাবার খেলে আলস্য, প্রমাদ, পেট ফোলা, পেটের মধ্যে গুড়গুড় আদি উপদ্রপ উৎপন্ন হয়। বায়ুবিকার উৎপন্ন হয়, তেঁতো ঢেক আসে, এটা ভোজন না হজম হওয়ার পরিচয়। ডাক্তার আর বৈদ্য সবার মত হল, পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভর্তি করলে বিশূচিকা (হৈজা) রোগ খুব শীঘ্র হয় আর ইনফ্লুএঞ্জা হওয়ারও আশঙ্কা থাকে; বদহজম, অজীর্ণ, মলবন্ধ, আনাহ (Anaphylaxis), সংগ্রহণী (IBS), অর্শ তথা স্বপ্নদোষ, প্রমেহাদি ধাতু সম্বন্ধীয় রোগ অধিক আহারকারী পেটুক ব্যক্তিদেরই হয়। মানুষ প্রায়শঃ যতটা খাবার খায় তার তিন ভাগও হজম করতে পারে না, যেসব খাবার হজম হয় না সেটা পেটের মধ্যে পড়ে থেকে রক্তকে বিষাক্ত আর দূষিত করে আর স্বপ্নদোষ তথা অর্শাদি অসংখ্য বিকারের জন্ম দেয়। প্রাণশক্তিকে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়, একটা তো অধিক ভোজনকে হজম করতে আর আরেকটা মলকে বাইরে বের করতে। অধিক আহারের ফলে রাষ্ট্রের অন্ন আর ধন, উভয়ের অপব্যয় হয় তথা প্রকৃতি দেবীও দণ্ডরূপ রোগ প্রদান করেন। ধনী ব্যক্তিরা এই দোষের অধিক দোষী, অনেক নির্ধন মানুষের পালন যার দ্বারা হওয়া সম্ভব এমন অধিক অন্ন তারা প্রতিদিন নষ্ট করে। খুবই গুরুতর অপরাধ এটা, সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত অধিক ভোজন করা উচিত নয়। এই বিষয়ে ভগবান্ মনু বলেছেন -
.
অনারোগ্যমনায়ুষ্যমস্বর্গ্যম্ চাতিভোজনম্ ।
অপুণ্যম্ লোকবিদ্বিষ্ট তস্মাত্তৎপরিবর্জয়েৎ ।। (মনু.২.৫৭)
.
অতি আহার করলে স্বাস্থ্য হানি তথা রোগের বৃদ্ধি হয়, আয়ু হ্রাস পায়, ব্যাধি আদির কারণে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়, পুণ্যের নাশ আর পাপের বৃদ্ধি হয় আর সমাজে অধিক আহার কারী ব্যক্তির নিন্দা হয়। ব্রহ্মচারীকে তো ভুলেও অধিক ভোজন করা উচিত নয়। পেট ঠুসে-ঠুসে অধিক আহারকারী ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী থাকতে পারবে না। ব্রহ্মচারীদের সায়ংকালের ভোজন মধ্যাহ্নের থেকে অর্ধেক হওয়া উচিত তথা শুতে যাওয়ার ২ থেকে ৩ ঘন্টা পূর্বেই ভোজন করা উচিত। দুগ্ধ তথা জলপানও শুতে যাওয়ার দুই বা তিন ঘন্টা পূর্বেই করা উচিত। সুতরাং ভোজন অধিক করা উচিত নয়।
.
এই বিষয়ে "ব্রহ্মচর্যই হল জীবন" পুস্তকের প্রসিদ্ধ লেখক স্বামী শিবানন্দ জী লিখেছেন - " অধিক ভোজন করা ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী হবে না, কারণ ঝড়ের দমকা হওয়া যেমন গাছকে উপড়ে ফেলে দেয় ঠিক তেমনই কামদেব পেটুক মানুষকে আছড়ে-আছড়ে মেরে ফেলে। অধিক আহার কারী ব্যক্তি কোনোভাবেই বীর্যকে থামিয়ে রাখতে পারবে না, তার চিত্ত সর্বদা বিষয়ের উপর লেগে থাকবে। মন আর শরীর দুটোই রোগী হয়ে যাবে, আয়ু কমে যাবে আর স্বার্থ ও পরমার্থ দুটোই বর্বাদ হবে। যদি আপনি বীর্যবান বা আরোগ্যবান হতে চান, স্বপ্নদোষ তথা অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই সাদা মিতাহারী হতে হবে।"
.
🍁 উত্তম ভোজন থেকে উত্তম সন্তান 🍁
মহর্ষি দয়ানন্দ জী তাঁর গ্রন্থ সংস্কারবিধিতে গর্ভাধান সংস্কার বিষয়ে লিখেছেন - "উত্তম সন্তান মুখ্যতঃ বধূ আর বরের যথাশাস্ত্রোক্ত আহারের উপর নির্ভর করে। অতএব পতি ও পত্নী স্ব-স্ব শরীর ও আত্মার পুষ্টির জন্য বল আর বুদ্ধি আদির বর্দ্ধক সর্বোষধি সেবন করবে।
.
সেই সর্বোষধি এইরূপ, যথা - দুই খণ্ড আম-আদা, হরিদ্রা, চন্দন, একাঙ্গী, কুড়, জটামাসী, মূর্বা, শিলাজীত, কর্পূর, মুথা আর নাগরমুথা।
.
এইসব ঔষধি চূর্ণ করে প্রত্যেকটা সমভাগে (পরিমাণে) নিয়ে যজ্ঞডুমুরের কাষ্ঠপাত্রে গোদুগ্ধ সহিত মিশ্রিত করে তার দই প্রস্তুত করবে আর সেই ডুমুরের কাষ্ঠেরই মন্থনদণ্ড দিয়ে মন্থন করে সেখান থেকে মাখন বের করে তার ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতে সুগন্ধি দ্রব্য যথা - কেশর, কস্তুরী, জায়ফল, এলাইচ, জয়ত্রী মিশ্রণ করবে।
.
অর্থাৎ একসের পরিমাণ দুধে এক ছটাক পরিমাণে সর্বোষধি মিশ্রিত করে জ্বাল দিয়ে উক্ত বিধিতে ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতের প্রত্যেক সেরে কস্তুরী এক রতি, কেশর এক মাসা, জায়ফল এক মাসা, জয়ত্রী এক মাসা আর এলাচ এক মাসা মিশ্রিত করে প্রতিদিন প্রাতঃকালে সেই সুগন্ধি দ্রব্য মিশ্রিত সর্বোষধি ঘৃত দ্বারা ২৪ থেকে ২৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখিত বিধিতে আঘারাবাজ্যভাগাহুতি ৪ আর ৪০ পৃষ্ঠায় লিখিত "বিষ্ণুর্য়োনিম্.." ইত্যাদি ৭ টা মন্ত্রের শেষে "স্বাহা" শব্দ উচ্চারণ করে যে রাতে গর্ভস্থাপন ক্রিয়া করতে হবে এক প্রহর রাত্রির পরে সেইদিন দিবাভাগে হোম করে হুতশেষ ঘৃত, ক্ষীর বা অন্নের সঙ্গে মিশ্রিত করে উভয়ে যথারীতি ভোজন করবে। এইভাবে গর্ভস্থাপন করলে সুশীল, বিদ্বান, দীর্ঘায়ু, তেজস্বী, সুদৃঢ় ও নীরোগ পুত্র উৎপন্ন হবে। যদি কন্যা লাভের ইচ্ছা হয়, তাহলে অন্নের সহিত পূর্বোক্ত প্রকারে প্রস্তুত ঘৃত মিশ্রিত করে ডুমুরকাষ্ঠের পাত্রে জমানো দধির সহিত সেই অন্ন সেবন করবে। এতে উত্তম গুণযুক্ত কন্যা জন্মাবে। কারণ "আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধি সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।।" এটা ছান্দোগ্যের বচন অর্থাৎ মদ্যমাংসাদিরহিত ঘৃত, দুগ্ধাদি আর তণ্ডুল, গোধূম ইত্যাদি শুদ্ধাহার করলে অন্তঃকরণের শুদ্ধি বুদ্ধি, বল, পুরুষকার আর আরোগ্য লাভ হয়। যেমন সব পদার্থকে উৎকৃষ্ট করার বিদ্যা আছে, তেমনই সন্তানকেও উৎকৃষ্ট করার এইরূপ বিদ্যা আছে। এই বিষয়ে মানুষকে বিশেষরূপে মনোযোগী হওয়া উচিত, কারণ এতে মনোযোগী না হলে বংশের হানি আর অধঃপতন হয় তথা মনোযোগী হলে বংশের বৃদ্ধি আর উন্নতি অবশ্যই হতে থাকে।"
.
গর্ভাধানের সময় স্ত্রীকে সাবধান থাকার জন্য লিখেছেন -
"তৎপশ্চাত স্ত্রীর গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সুনিয়ম করে দিবে। স্ত্রীরা কখনও মদ্যাদি মাদক দ্রব্য, হরিত্যকাদি রেচক দ্রব্য, অতি লবণাদি ক্ষার দ্রব্য, অত্যম্ল, চণকাদি রুক্ষ পদার্থ এবং লঙ্কাদি তীক্ষ্ণ দ্রব্য ভক্ষণ করবে না। তবে ঘৃত, গোদুগ্ধ, মিষ্টি, সোমলতা অর্থাৎ গুড়ুচ্যাদি ঔষধি, অন্ন, মিষ্ঠ, দধি, গোধূম, মুগ, মাষকলাই, অড়হরাদি খাদ্য এবং পুষ্টিকর তরকারী ভোজন করবে। তাতে ঋতুভেদে ভিন্ন-ভিন্ন মশলা যেমন গ্রীষ্মকালে স্নিগ্ধ শ্বেত এলাইচ প্রভৃতি এবং শীতকালে কস্তুরী ও কেশরাদি মিশ্রিত করে সেবন করবে। সর্বদা উচিত আহার-বিহার করবে। এতে সন্তান অতি বুদ্ধিমান, নিরোগ আর শুভ গুণ-কর্ম-স্বভাবযুক্ত হবে।"
.
উত্তম সন্তান নির্মাণার্থ পুংসবন সংস্কারের মধ্যে মহর্ষি লিখেছেন - "স্ত্রী সুনিয়ম ও উচিত আহার-বিহারের পাশাপাশি বিশেষভাবে গুলঞ্চ, ব্রাহ্মী ঔষধি ও শুন্ডী দুধের সহিত মিশ্রিত করে অল্প-অল্প সেবন করবে। অধিক নিদ্রা, অধিক বাক্যালাপ পরিত্যাগ করবে, অধিক ক্ষার, অম্ল, তীক্ষ্ণ, কটু আর হরিতকী আদি রেচক বস্তু খাবে না। লঘুপাক দ্রব্য আহার করবে। ক্রোধ, দ্বেষ ও লোভাদি দোষে আবদ্ধ থাকবে না। চিত্তকে সদা প্রসন্ন রাখবে - ইত্যাদি শুভ আচরণ করবে।"
.
🍁 ভোজনের স্থান 🍁
ভোজনালয় - যে স্থানে বসে মানুষ ভোজন করবে সেটা শুদ্ধ, ধোয়া-মোছা-পরিষ্কার, ধুলোবালি রহিত, বায়বীয়, খোলামেলা হওয়া উচিত, যাতে আহার গ্রহণ করার সময় মনের মধ্যে কোনোরূপ বিকার না আসে। সেই সময় ভোজন কারী ব্যক্তির চিত্ত ভোজনালয়ের স্বচ্ছতা আদি হতে প্রভাবিত হয়ে সর্বথা শান্ত আর প্রসন্ন হওয়া উচিত। আহার গ্রহণ করার সময় যদি চিত্তের মধ্যে কোনো ধরণের গণ্ডগোল বা অশান্তি থাকে তাহলে ভোজনের পাচন কর্ম সঠিকভাবে হবে না। ভোজন করার সময় মানসিক বিচারের অত্যধিক প্রভাব শরীরযন্ত্রের উপর পড়ে।
.
যারা শুদ্ধি করে না তাদের ভোজনালয়ে কোথাও কয়লা, কোথাও ছাই, কোথাও খড়ি, কোথাও ভগ্ন ফুটো হাঁড়ি, কোথাও এঁটো বাসন তথা মাংসাহারীদের স্থানে হাড়-হাড্ডি আদি অন্যান্য পদার্থ পড়ে থাকে আর মাছির কথা তো কি বলবো! স্থানটা এমন জঘন্য মনে হয় যে, যদি কোনো ভদ্রলোক গিয়ে সেখানে বসে তাহলে তার বমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন দুর্গন্ধযুক্ত স্থানে ভোজন করলে শরীর আর মনের উপর ভালো প্রভাব কিভাবে পড়বে? পূর্বোক্ত দোষের নিবৃত্তির জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "যদি পাকা ঘর হয় তাহলে জল দিয়ে ধুয়ে শুদ্ধ করা উচিত।"
.
আর কাঁচা ঘরে গরুর গোবর দিয়ে চৌকো লাগানোর গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন - "গোময় (গরুর গোবর) মসৃণ হওয়াতে শীঘ্র উঠে যায় না। তাতে বস্ত্র বিকৃত বা মলিন হয় না। মাটি দ্বারা যেরূপ ময়লা জন্মে, শুষ্ক গোময় থেকে সেইরূপ হয় না। তাছাড়া মাটি আর গোময় দিয়ে যে স্থান লেপন করা হয়, সেটা দেখতে অতি সুন্দর হয়। রন্ধনশালায় ভোজন করলে ঘৃত, মিষ্ট আর উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে, তাতে মাছি, কীট এবং অন্যান্য জীব অপরিষ্কৃত স্থান থেকে সেখানে এসে বসে। তাই প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে সেইস্থান পরিষ্কার করে লেপন করা না হলে সেটা পায়খানার ন্যায় হয়ে উঠবে। অতএব প্রত্যহ গোময়, মৃত্তিকা এবং সম্মার্জনী দ্বারা উক্তস্থান পরিষ্কার রাখবে।" এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় - "রান্নাঘরে বসে ভোজন করা উচিত নাকি রান্নাঘরের বাইরে ভোজন করা উচিত?" উত্তর দিয়েছেন - "উত্তম ও রমণীয় স্থানে ভোজন করা উচিত।" এই বিষয়ে মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
.
ভোক্তারম্ বিজনে রম্যে নিঃসম্য়াতে শুভে শুচৌ ।
সুগন্ধপুষ্পরচিতে সমে দেশে চ ভোজয়েৎ ।।৪৫৮।।
(সূত্র স্থান অধ্যায় ৪৬)
.
একান্ত স্থানে, যেখানে মানুষের যাতায়াত = আসা-যাওয়া হয় না, রময়ীয়, শুদ্ধ পবিত্র তথা পুষ্পাদি দ্বারা সুগন্ধিত, সম (সেটা উঁচু নীচু হবে না), এইরূপ স্থানে ভোজন করা উচিত। আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভোজন, ভোজনের স্থান আর ভোজ্য পদার্থের শুদ্ধতা তথা পবিত্রতার উপর অধিক বল দিয়েছেন, সুতরাং ভোজনের স্থানাদিকে ধুয়ে-মুছে-লেপে সদা শুদ্ধ রাখা উচিত। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যের রহস্য নিহিত আছে।
.
🍁 ভোজনের পূর্বে তথা পশ্চাৎ আবশ্যক ক্রিয়া 🍁
ভোজনের পূর্বে স্নান করার গুরুত্বকে আমাদের প্রাচীন পুরুষগণ বিশেষভাবে মানতেন। গ্রামীণ ব্যক্তিদের মধ্যে এর ছাপ এখনও দেখা যায়। এমন অনেক অশিক্ষিত ভারতীয় মানুষ আছে যারা বিনা স্নান করে ভোজন করাকে পাপ মনে করে। সুতরাং মকরসংক্রান্তি আদি পর্বে তো স্নান করে না এমন ব্যক্তিও ভোজনের পূর্বে স্নান করে নেয়। এই প্রসিদ্ধ প্রবাদ "শত কাজ ছেড়ে স্নান করো" মানুষের মধ্যে একটু ব্যবহারিক রূপে প্রচলিত আছে। সংস্কৃত শ্লোকের এই ভাগ - "শতম্ বিহায় ভোক্তব্যম্ সহস্রম্ স্নানমাচরেৎ" এটাই সিদ্ধ করে যে ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত।
.
মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে লিখেছেন - "প্রথমে স্নান এইজন্য যে এতে শরীরের বাহ্য অবয়বের শুদ্ধি আর আরোগ্য আদি হয়, এইজন্য ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত।" এখনকার শিক্ষিত ব্যক্তি ভোজন তো চার-পাঁচ বার করে কিন্তু স্নানের মতো আবশ্যক কৃত্যকে দিনে একটাবারও করতে চায় না। এমন অনেক বাবু ব্যক্তি এই ভারতের মধ্যে পাওয়া যাবে যারা সারা শীতকাল ধরে একটাবারও স্নান করেনি আর বিস্কুট আদি তো বিনা শৌচ হতে নিবৃত্তি হয়ে বিছানাতে ঘুম থেকে জেগেই চেয়ে বসে। কিন্তু ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যপ্রেমী ব্যক্তিকে প্রতিদিন সব ঋতুতে বিনা স্নান করে ভোজন করা মোটেও উচিত নয়। যদি স্নান প্রাতঃ সায়ং দুই সময় করা হয় তাহলে তো আরও ভালো।
.
আসলে ভোজনের অধিকারী তো তারাই যারা প্রাতঃ কাল ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে শৌচ, স্নান, প্রাণায়াম, ঈশ্বরোপাসনা, যজ্ঞ, ব্যায়াম আদি নিত্যপ্রতি প্রাতঃকালেই করে নেয় আর এইভাবে সায়ংকালেও সব নিত্যকর্ম করে। ভোজনের সময় হাত, পা আর মুখকে ভালোভাবে শুদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে স্বচ্ছ করে নেওয়া উচিত। তারপর শুদ্ধ বস্ত্র ধারণ করে ভোজনশালাতে গিয়ে কুশ আসনে বসবেন, যদি গৃহস্থ হন তাহলে বলিবৈশ্বদেবযজ্ঞ করে নিবেন তথা নিজের আশ্রিত গরু, কুকুর আদি প্রাণীদেরও ভোজন দিবেন।
.
আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে অতিথি সৎকারের গুরুত্ব অত্যধিক পাওয়া যায়। অথর্ববেদের মধ্যে লেখা আছে - "শ্রেয়াম্সমেনমাত্মনো মানয়েৎ" (১৫/১০/২) যদি কোনো অতিথি আপনার গৃহে আসে তাহলে নিজের সৌভাগ্য ভেবে তার সৎকার করা উচিত আর "অশিতবত্যতিথো অশ্নীয়াৎ" (৯/৮/৮) এই বেদাজ্ঞার অনুসারে গৃহস্থকে অতিথির পূর্বে কখনও ভোজন করা উচিত নয়। সুতরাং নিজের পূজ্যজন সাধু মহাত্মা অতিথিদের শ্রেষ্ঠ ভোজন দিয়ে তৃপ্ত করার উপরান্তই স্বয়ং প্রসন্নচিত্ত হয়ে ভোজন গ্রহণ করা উচিত।
.
ভোজন করার সময় কথা বলা বা কোলাহল করা, আমাদের সভ্যতার বিরুদ্ধ। "বাগ্যতস্তু ভুঞ্জীত" অনুসারে মৌন হয়ে শান্তিপূর্বক ভোজন করা উচিত। নিজের ভাগ্য আর পরিশ্রম করার পশ্চাৎ যা প্রাপ্ত হয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত আর অন্নের নিন্দা কখনও করা উচিত নয়।
.
ভোজনোপরান্ত তৎকালই কঠিন শারীরিক বা মানসিক কোনো কাজ করা বা দৌড়ানো আদি হানিকারক। শান্তিপূর্বক শারীরিক বা মানসিক সাধারণ কোনো কাজ করা যেতে পারে। ভোজনের পূর্বে বা পশ্চাৎ ক্রোধাদি করলে ভোজন বিষ হয়ে যায়। অনেক দেরিতে হজম হয়, সুতরাং সাবধান তথা শান্ত থাকা উচিত।
.
ভোজন করার সময় সব ধরণের চিন্তা শোক ঈর্ষাদি পরিত্যাগ করে সর্বথা প্রসন্নচিত্ত থাকলে ভোজন ভালোভাবে হজম তথা শুদ্ধ রক্তাদি ধাতুর নির্মাণ করে আর বলিষ্ঠ করে তোলে। এর পাশাপাশি ভক্ষ্যাভক্ষ্যের আলোচনা অবশ্যই করা উচিত।
🍁 সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক ভোজন 🍁
সত্ত্ব, রজ আর তমের সাম্যাবস্থাই হল প্রকৃতি আর সব প্রাকৃতিক পদার্থকে এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। ভোজনও সাত্ত্বিক, রাজসিক আর তামসিক ভেদানুসারে তিন প্রকারের হয়। মানুষের প্রবৃত্তি স্ব-স্ব রুচি তথা স্বভাবের কারণে বিভিন্ন হয়। যার যেরূপ প্রবৃত্তি হয় সে সেইরূপ প্রকারের ভোজন পছন্দ করে। শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার মধ্যে লিখেছেন - "আহারস্ত্বপি সর্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ" অর্থাৎ সব মানুষ নিজ-নিজ প্রবৃত্তির অনুসারে তিন প্রকারের ভোজনকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সাত্ত্বিক প্রবৃত্তির ব্যক্তি সাত্ত্বিক ভোজনকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, রাজসিক প্রবৃত্তির ব্যক্তি রাজসিক ভোজনকে উত্তম মনে করে আর এইভাবে তমঃপ্রধান ব্যক্তি তামস ভোজনের প্রতি রুচি রাখে।
.
🍁 সাত্ত্বিক ভোজন 🍁
আয়ুঃ সত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবির্বধনাঃ ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ ।।
(গীতা ১৭/৮)
আয়ু, বল, উৎসাহ, আরোগ্য, চিত্ত প্রসন্নতা আর প্রীতির বৃদ্ধিকারী তথা রসালো, স্নেহযুক্ত, হৃদয়ের জন্য হিতকারী ভোজন - এইরূপ আহার সাত্ত্বিক ব্যক্তিদের প্রিয়। অর্থাৎ যে ভোজন সেবন করলে আয়ু, বল, বীর্য, আরোগ্য আদির বৃদ্ধি হয়, যা সরস স্নেহযুক্ত (ঘৃতাদিযুক্ত), প্রীতিকর তথা হৃদয়ের জন্য হিতকারী, তাকে সাত্ত্বিক ভোজন বলে।
.
🍁 সাত্ত্বিক পদার্থ 🍁
গোদুগ্ধ, ঘী, গম, চাল, যব, মুগ ডাল, মথ ডাল, উত্তম ফল, শাকপাতা, ঝিঙ্গে, কুমড়ো আদি মধুর, শীতল, স্নিগ্ধ, সরস, শুদ্ধ, পবিত্র আর শীঘ্র হজম তথা ওজ এবং কান্তিপ্রদ পদার্থ।
.
🍁 রাজসিক ভোজন 🍁
কট্বম্ললবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্ণরুক্ষবিদাহিনঃ ।
আহারা রাজসস্যেষ্টা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ ।।
(গীতা ১৭/৯)
অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, বিদাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগ উৎপাদক আহার রজোগুণী ব্যক্তিদের প্রিয় হয়।
.
কটু, অম্ল, লবণাক্ত, অতি উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, রুক্ষ আর দাহকারক - লবণ, মরিচ, তেঁতুল, মশলা আদি যুক্ত ভোজন হল রাজসিক আর এইসব সেবন করলে মানুষের বৃত্তি চঞ্চল হয়, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্যক্তি বিবিধ দুঃখ উপভোগ করে আর শোকের সাগরে ডুবে যায়।
.
🍁 রাজসিক পদার্থ 🍁
লবণ, মরিচ, মশলা, হিং, গাজর, ছোলা, মাষকলাই, করলা, সর্ষা, তেল দিয়ে ভাজা পদার্থ, মাংস, মাছ, ডিম, মদ, চরস, তামাক, কফি, কোকিন আদি মাদক দ্রব্য তথা উষ্ণ, রুক্ষ, গৃষ্ঠ, ভারী, দেরিতে হজম হয়, এমন সব পদার্থ হল রাজসিক।
.
🍁 তামসিক ভোজন 🍁
য়াতয়ামম্ গতরসম্ পূতি পর্য়ুষিতঞ্চ য়ৎ ।
উচ্ছিষ্টমপি চামেধ্যম্ ভোজনম্ তামসপ্রিয়ম্ ।।
(গীতা ১৭/১০)
যে খাদ্য বহু পূর্বে রন্ধন করা হয়েছে, যার রস শুকিয়ে গেছে, যা দুর্গন্ধ, বাসী, উচ্ছিষ্ট, এঁটো ও অপবিত্র, বুদ্ধিকে নষ্ট করে এইরূপ ভোজন তমঃপ্রধান ব্যক্তিদের প্রিয়।
.
যে অন্ন পঁচা-গলা, অনেক পূর্বে রান্না করা, দুর্গন্ধযুক্ত, উচ্ছিষ্ট আর কৃমি কীট দ্বারা অপবিত্র হওয়া তথা রসহীন হয়, সেগুলোকে তামসিক বলে। এমন ভোজন সেবন করলে সব ধরণের রোগ হয়, স্বাস্থ্য আর আয়ু ক্ষীণ হয়, বুদ্ধি-মন তথা আত্মা এতটাই মলিন হয়ে যায় যে সে নিজের হিতাহিত আর ধর্মাধর্মের ধ্যানও রাখে না। অতএব তমোগুণী ব্যক্তি মলিন, আলসী, প্রমাদী আর অকর্মণ্য হয়ে পড়ে থাকে। তামসিক ভোজন কোনো ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত নয়, এগুলো সর্বদাই ত্যাগ করে দেওয়া উচিত।
.
🍁 তামসিক পদার্থ 🍁
পঁচা, গলা, দূষিত, বাসী অন্ন-ফল আদি, মোষের দুধ আর ঘী, ভেন্ডি, রসুন, পিঁয়াজ, শালগম আদি কফবর্দ্ধক, বুদ্ধিকে ভ্রষ্ট করে এমন দুর্গন্ধযুক্ত আর ভারী পদার্থ, এগুলো সব তামসিক।
🍁 ভোজন সম্বন্ধীয় আবশ্যক নিয়ম 🍁
১. ভৌতিক অগ্নি যেমন জ্বালানি না থাকার কারণে নিভে যায় ঠিক সেই রকম খিদে পেলে ভোজন না করলে জঠরাগ্নি মন্দ হয়ে যায়, রক্তাদি ধাতুর শোষণ তথা শরীর কৃশ (দুর্বল) হয়ে পড়ে।
২. ভোজন নিশ্চিত সময়ে করা উচিত, অসময়ে ভোজন করলে বিভিন্ন ব্যাধি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
৩. ভোজনের সময় পেরিয়ে গেলে খালি পেটে বায়ু জঠরাগ্নিকে মন্দ করে দেয়, তৎপশ্চাৎ করা ভোজন অনেক কষ্টে হজম হয়।
৪. ভোজনের গুণ আর দোষকে মাথায় রেখে দিনে কেবল দুইবার ভোজন করা উচিত।
৫. অধিক উষ্ণ অথবা অনেক পূর্বে রান্না করা বাসী ভোজন খাওয়া উচিত নয়।
৬. সায়ংকালের ভোজন শুতে যাওয়ার দুই-তিন ঘন্টা পূর্বে করা উচিত। সায়ংকালের ভোজনের মাত্রা দুপুরের ভোজনের অর্ধেক হওয়া উচিত।
৭. অল্পাহারে যেমন সন্তুষ্টি হয় না, বল আর শরীর ক্ষীণ হয়ে যায়, তেমনই অধিক আহারের ফলে আলস্য, প্রমাদ, মোটা, ভারীতা আদি হয়, সুতরাং দুটোই ত্যাজ্য।
৮. মিত ভোজনই (সীমিত খাদ্য) হল স্বাস্থ্যের মূলমন্ত্র।
৯. অজীর্ণ হলে পথ্য হোক অথবা অপথ্য কোনো কিছুই খাওয়া উচিত নয়, কারণ অজীর্ণ অবস্থায় ভোজন করা দুঃখদায়ক হয়।
১০. একা স্বাদু ভোজন সেবন করা উচিত নয়, সঙ্গে থাকা সেবক সম্বন্ধীয়দের তাতে সম্মলিত করা উচিত।
১১. পরস্পর বিরুদ্ধ ভোজন একসঙ্গে খেলে লাভের স্থানে হানি অধিক হয়।
১২. ভোজনের অন্তত এক ঘন্টা পূর্বে অথবা এক ঘন্টা পশ্চাৎ জল পান করা উচিত।
১৩. ভোজনের মাঝে জল পান করা উচিত নয়, যদি ভোজন রুক্ষ হয় তাহলে অল্প পরিমাণ পান করা উচিত।
১৪. ব্যায়ামের তৎকাল পশ্চাৎ ভোজন করা অথবা ভোজনের তৎকাল পশ্চাৎ ব্যায়াম করা খুবই হানিকারক।
১৫. ভোজনে শুদ্ধতা অত্যধিক আবশ্যকতা আছে।
১৬. ভোজনোপরান্ত মুখকে কুল্লাদি করে শুদ্ধ করে নেওয়া উচিত আর দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা অন্নকণাকে কাঠি আদি দিয়ে যুক্তিপূর্বক পৃথক করা উচিত।
১৭. ব্রহ্মচারীর সায়ংকালের ভোজন অত্যন্ত হালকা হওয়া উচিত, যদি সম্ভব হয় তাহলে কেবল দুগ্ধাহারই করা উচিত।
১৮. ভোজন খুব খিদে পেলে করা উচিত, স্বাদ ভোজনে নয়, খিদাতে আছে।
১৯. যেসব পদার্থ থেকে স্নেহভাগ বের করে ফেলা হয়েছে, তার সেবন করা উচিত নয়।
২০. এক বস্ত্র ধারণ করে ভোজন করা উচিত নয়।
২১. বিছানায় বসে, শুয়ে, আসনের উপর রেখে বা হাতের উপর নিয়ে ভোজন করা শিষ্টাচার বিরুদ্ধ।
২২. কারও সঙ্গে একপাত্রে ভোজন করা উচিত নয়।
২৩. এঁটো মুখ ও হাত না ধুয়ে এদিক-সেদিক যাওয়া উচিত নয়।
২৪. ভিজে পায়ে ভোজন করা উচিত, এইরূপ করলে আয়ু বাড়ে।
২৫. সুশ্রুতের মতানুসারে ভোজনের পশ্চাৎ শতপদ ঘোরাঘুরি করে বাঁপাশ হয়ে শোয়া উচিত। ভাবমিশ্রের মতানুসারে ৮ শ্বাস সোজা, ১৬ শ্বাস ডানপাশে আর ৩২ শ্বাস বাঁপাশে শুয়ে নেওয়া উচিত।
২৬. সর্বদা এক ধরণের পদার্থ খাওয়া উচিত নয়, কিছু পরিবর্তন করে ভোজন করা উচিত।
২৭. ক্ষুধার্ত পেটে জল পান করলে জলোধর রোগ হয় আর তৃষ্ণাতে ভোজন করলে গুল্মরোগ হয়, সুতরাং ক্ষুধার্ত অবস্থায় ভোজন আর তৃষ্ণাবস্থায় জল পান করা উচিত।
২৮. ভোজনের পূর্বে জল পান করলে জঠরাগ্নি মন্দ বা ধীর হয়, ভোজনের পশ্চাৎ জল পান করলে কফ বেড়ে যায় আর ভোজনের মাঝে জল পান করলে ভোজন সঠিকভাবে হজম হয় না।
২৯. ভোজন খুব চিবিয়ে-চিবিয়ে খাওয়া উচিত, এরফলে ভোজন দ্রুত হজম হয় তথা শরীরের অঙ্গ হয়ে যায়। বিনা চিবিয়ে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া ভোজন রোগ বৃদ্ধি করে। মনে রাখবেন, দাঁতের কাজ অন্ত্র দিয়ে করা মোটেও উচিত নয়।
৩০. পেটের দুইভাগ অন্ন দিয়ে, তৃতীয় ভাগ জল আর চতুর্থ ভাগ বায়ু দিয়ে ভরা উচিত অর্থাৎ পেটকে ঠুসে-ঠুসে অন্ন দিয়ে ভরা উচিত নয়।
৩১. ফল তথা সকল শুষ্ক (যা তরল নয়) পদার্থকে ভোজনকারীর ডানদিকে তথা দুধ জল আদি তরল পদার্থকে বাঁদিকে রাখা উচিত।
৩২. ভোজন করার সময় প্রথমে মধুর রসের সেবন করা উচিত, মাঝে টক আর লবণ রসের তথা অন্তিমে তীক্ষ্ণ তিক্ত রসের সেবন করা উচিত।
৩৩. যদি ভোজনে ফল থাকে তাহলে প্রথমে বেদানা, আনার বা ডালিম খাওয়া উচিত, তারপর রুটি, ভাত, শাকাদি আর অন্তিমে দুধ বা ছাছ (ঘোল) আদি তরল পদার্থের সেবন করা উচিত, কারণ শাস্ত্রের মধ্যে প্রথমে ঘন (কঠিন), মাঝে মৃদু (নরম) আর অন্তিমে তরল পদার্থের সেবন করার বিধান আছে।
ভোজনে লবণ এবং ক্ষার
ক্ষারের বিষয়ে চরকশাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে - "দৃষ্টিশুক্রঘ্নঃ ক্ষারঃ" ক্ষার দৃষ্টি অর্থাৎ চোখের দেখার শক্তি আর বীর্য অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যকে নষ্ট করে।
.
চরকশাস্ত্রের মধ্যে আরও লেখা আছে যে - "ক্ষারঃ পুম্স্ত্বোপধাতিনাম্" অর্থাৎ পুরুষের পুংস্ত্বশক্তির নাশক এমন পদার্থের মধ্যে সবথেকে অধিক পুংস্ত্বনাশক হল ক্ষার। মানুষের ব্রহ্মচর্যশক্তি বা বীর্যের সবথেকে অধিক নাশ ক্ষার করে।
.
ক্ষার বস্তুটা কি? এই বিষয়ে "ক্ষরণাৎক্ষারঃ" ক্ষরণ করার কারণে ক্ষার বলা হয়, এটি ত্বক, মাংস আদিকে ছাড়িয়ে দেয়, তাই একে ক্ষার বলে। চক্রপাণির মতে নিচে যাওয়ার ক্রিয়াকে ক্ষার বলে। দোষকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া, এটাও ক্ষরণের অভিপ্রায়। তাছাড়া ক্ষার অনেক রসযুক্ত দ্রব্য যব, স্বরজিকা, অপামার্গ (অপাঙ্গ), মুলো, সোহাগা (বোরাক্স) আদি দিয়ে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে তিক্ত লবণ আদি অনেক রস থাকে।
.
সব ক্ষার প্রায়শঃ রুক্ষ, উষ্ণ আর তীক্ষ্ণ হয়, সুতরাং বীর্যকে পাতলা করে তার নাশ করে। ব্রহ্মচর্যপ্রেমী ব্যক্তিকে এর সেবন করা উচিত নয়। ওষুধে ক্ষারের সেবন করতে হলে তাহলে কোনো বিদ্বান বৈদ্যের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ক্ষার যেমন কিছু রোগকে দূর করে তেমনি এতে বীর্যনাশক ভয়ংকর দোষও আছে, সুতরাং ব্রহ্মচারীকে সর্বদা এর থেকে দূরে থাকা উচিত। মানবগৃহ্যসূত্রের মধ্যে "উপনয়নপ্রভৃতিব্রতচারী (ব্রহ্মচারী) স্যাৎ" ইত্যাদি নিয়ম বলার পাশাপাশি তাতে লেখা আছে "ন মধুমাম্সে প্রাস্নীয়াৎ ক্ষারলবণে চ" (পুরুষ ১ খ.১ সূত্র ১২) ব্রহ্মচারী মদ্য, মাংস আর ক্ষার তথা লবণের সেবন করবে না।
.
গোভিল গৃহ্যসূত্রের মধ্যে লেখা আছে - "ক্ষাররেচনদ্রব্যাণি মা সেবস্ব।" স্বামী দয়ানন্দ জী সংস্কারবিধিতে এর অর্থ এইভাবে করেছেন - "ক্ষার অধিক লবণ আদি আর রেচক জমালঘোটাদি দ্রব্যের সেবন করবেন না।" বেদারম্ভ সংস্কারে ব্রহ্মচারীর জন্য লেখা আছে যে, ব্রহ্মচারী তিন দিন পর্যন্ত ক্ষার-লবণ রহিত পদার্থের ভোজন করবে।" সুতরাং ব্রহ্মচারীর জন্য লবণ ক্ষারের পরিত্যাগ তার ব্রহ্মচর্য সাধনাতে সহায়ক হবে।
.
লবণ থেকে হানি
চরক শাস্ত্রের মধ্যে লবণের দোষ এইভাবে লেখা আছে - "লবণো রসো গুরুঃ স্নিগ্ধ উষ্ণশ্চ...পিত্তম্ কোপয়তি, রক্তম্ তর্ষয়তি, মোহয়তি, মূর্চ্ছয়তি, তাপয়তি, দারয়তি, কুষ্ণাতি, মাম্সানি, প্রগালয়তি কুষ্ঠানি, 'বিষম্ বর্ধয়তি', শোফান্ স্ফোটয়তি, পুম্স্ত্বমুপহন্তি, ইন্দ্রিয়াণ্যুপরুণদ্ধি, বলীপলিতখালিত্যমাপাদয়তি, অপি চ লোহিতপিত্তাম্লাপিত্তবিসর্পবাতরক্তবিচর্চিকেন্দ্রলুপ্ত- প্রভৃতিন্ বিকারানুপজনয়তি।
.
লবণ রস ভারী স্নিগ্ধ আর উষ্ণ হয়, লবণ-রস বা লবণের উপয়োগ পিত্তকে কুপিত করে, রক্তের মধ্যে অত্যধিক গতিকে উৎপন্ন করে, তৃষ্ণার্ত করে তোলে, মোহ উৎপন্ন করে, অচেতনতা, যন্ত্রণা উৎপন্ন করে, মাংসকে ছিঁড়ে, ছুলে দেয়, কুষ্ঠকে গলিয়ে দেয়, বিষকে বাড়িয়ে তোলে, প্রদাহ ভেঙ্গে দেয়, পুংস্ত্বকে নষ্ট করে, ইন্দ্রিয়কে ক্ষীণ করে, মানুষকে শীঘ্র বুড়ো করে, শরীরের চামড়া ক্ষুদ্র কুক্ষিত রেখা বা ভাঁজ পড়ে, চুল সাদা আর নেড়া করে দেয়। রক্তপিত্ত, অম্লপিত্ত, বিসর্প, বাতরক্ত, বিচর্চিকা, ইন্দ্রলুপ্ত আদি রোগকে উৎপন্ন করে। সুশ্রুতের মধ্যেও লবণকে চুলকানি, প্রদাহাদি রোগের উৎপাদক তথা পুংস্ত্ব আর ইন্দ্রিয়ের শক্তির নাশক লেখা আছে।
.
আজকাল যেভাবে মানুষ লবণ সেবন করছে সেটা তো একদম অনুচিত। সব্জিতে লবণ মিশ্রণ, ফলের সঙ্গে লবণ, এমনকি আপেল তরমুজ আদি মিষ্টি ফলের সঙ্গেও লবণ খাচ্ছে, লবণ মিশ্রিত ছাতু আদিতে দুধ মিশিয়ে খাচ্ছে, এদের দেখলে মনে দয়া আসে। এরা ব্রহ্মচর্যের কি রক্ষা করবে? লবণের সেবন করার ফলে মানুষ কুষ্ঠাদি ভয়ংকর রোগে ফেঁসে পড়ে। লবণের কারণে অধিক আহার করে, অধিক আহারের ফলে অপচন (কোষ্ঠকাঠিন্য) হয় আর কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বীর্য নাশ হয়। কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য = মলবন্ধ হল ব্রহ্মচর্যের পরম শত্রু। ভোজনের যে নিজস্ব একটা স্বাদ আছে সেটা কেমন? যারা লবণ খায় তারা তো সেটা জানেই না, কারণ লবণের স্বাদের কারণে অন্য স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। অধিক লবণ সেবনকারী প্রায়শঃ জিহ্বালোলুপ হয়, সুতরাং সে পেটুক হয়ে যায়। পেটুক মানুষের ব্রহ্মচর্যনাশ তথা সর্বনাশ হয়। ভোজন খাওয়ার যে উদ্দেশ্য - স্বাস্থ্য, বল বা শক্তি বাড়িয়ে তোলা তথা জীবনরক্ষাদি সেই সব লবণ খাওয়ার কারণে পুরোপুরি সমাপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং বাহ্য অপ্রাকৃতিক লবণের পরিত্যাগ ব্রহ্মচারী তথা স্বাস্থ্যপ্রেমীর জন্য হিতকর।
.
শরীরনির্মাণ স্বাস্থ্য-রক্ষণাদির জন্য লবণরসের যতটা আবশ্যকতা আছে ততটা লবণ শাক, সব্জি, ফল আদি ভোজ্য পদার্থের মধ্যে স্বাভাবিক রূপে আগে থেকে বিদ্যমান আছে। সুতরাং শাক-সব্জি-ফলাদি সেবন নিজের প্রকৃতির অনুসারে যথাযথ মাত্রায় প্রতিদিন করা উচিত, যার দ্বারা শরীরের আবশ্যকতানুসারে লবণ রসের পূর্তি হতে পারে, আর বাইরের লবণ খেয়ে ব্রহ্মচর্য তথা স্বাস্থ্যের নাশ করা উচিত নয়। কারণ লবণের মধ্যে যে পাচনাদি কিছু গুণ লেখা আছে, সেখানে একে ব্রহ্মচর্যের শত্রুও বলা হয়েছে - "পুঁস্ত্বমুপহন্তি" অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যের নাশ করে মানুষের পুঁস্ত্ব শক্তিকে নষ্ট করে অর্থাৎ লবণের সেবন মানুষকে নপুংসক (পুরুষত্বহীন) করে দেয়।
.
লবণ-রস থেকে লাভ তথা বাহ্য লবণ থেকে হানি
লবণরসের সেবন আমরা সবাই প্রতিদিন ভোজনে করি। ডাক্তার একে শরীরের জন্য হিতকারী বলে, সুতরাং একে অত্যন্ত আবশ্যক মানে তথা নিম্নলিখিত লাভ বলে -
১. লবণ থেকে হাড় তথা শরীরের নির্মাণ হয়।
২. পাচনশক্তিতে লবণ সহায়তা করে তথা রক্তকে শুদ্ধ করে।
৩. লবণের সেবনের ফলে মুখের লালাগ্রন্থি অধিক কাজ করে, লার অধিক মাত্রায় উৎপন্ন করে।
৪. লবণের সহায়তায় যকৃৎ পিত্ত তৈরির কাজ করে।
৫. ভোজনকে হজম করার জন্য আমাদের আমাশয়ে যে পাচকরস তৈরি হয় সেটা লবণের সাহায্যে হয়।
.
চরক শাস্ত্রের মধ্যে লবণ রসের গুণ এইভাবে লেখা আছে -
"লবণো রসঃ পাচনঃ ক্লেদনো দীপনশ্চ্যাবনশ্ছেদনো ভেদনঃ তীক্ষ্ণঃ সরো বিকাস্যধঃ স্রম্স্যবকাশকরো বাতহরঃ স্তম্ভসম্ঘাতবিধমনঃ সর্বরসপ্রত্যনীকভূত আস্যমাসাবয়তি কফম্ বিষ্যন্দয়তি...।" অর্থাৎ লবণরস হল পাচন, সিক্তকারী, দীপন, স্রাবকারী, ছেদন, ভেদন, রেচক, সন্ধিজোড়ের বন্ধনকে মুক্তকারী, কোষ্টের মধ্যে থেমে থাকা মলকে না পরিপাক করে নিচের দিকে নিয়ে যায়, বাত আর কফের হরণকারী, স্তম্ভ, বন্ধ (কোষ্ঠকাঠিন্য) দোষের সংঘাতের নাশক আর সম্পূর্ণ রসের শত্রু অর্থাৎ যদি লবণ রস কোনো ভোজ্য পদার্থে অধিক হয় তাহলে অন্য রসের স্বাদ আসে না। মুখের লালা আর কফকে প্রবাহিত করে। (মার্গান্ বিশোধয়তি) মার্গকে শুদ্ধ করে তথা শরীরের অবয়বকে মৃদু নরম করে, (রোচয়ত্যাহারম্) আহারে রুচি করে। প্রায়শঃ মানুষ এর স্বাদের কারণেই অধিক ভোজন করে। লবণ রসের এইসব লাভ বলা হয়েছে, তবে যে লবণ প্রতিদিন ভোজনে মিশ্রণ করে সেবন করা হয় তাতে এইসব গুণ আর লাভ নেই।
.
লবণ এই শরীরের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, তাই পরমাত্মা লবণরস সবথেকে অধিক উৎপন্ন করেছেন। লবণরস প্রায় সব খাদ্য পদার্থের মধ্যে পাওয়া যায়। ফল তথা শাক সব্জির মধ্যে স্বাভাবিক রূপে লবণরস বা প্রাকৃত লবণ অধিক পাওয়া যায়। সুতরাং কন্দ মূল, ফল, শাক, সব্জি ভোজনে স্বাস্থ্য রক্ষার্থ অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা শাক সব্জি ভোজন করে না তাদের প্রায়শঃ রোগী দেখা যায়। ফলের মধ্যে যে মিশ্রিত লবণ পাওয়া যায় সেটা শরীরের জন্য খুবই লাভদায়ক। এই স্বাভাবিক লবণেরই প্রশংসা প্রাচীন শাস্ত্র তথা আধুনিক বৈদ্য আর ডাক্তাররা করেন। ভোজনের সঙ্গে যে সমুদ্র আদির তৈরি করা লবণ খাওয়া হয় সেটা হানিকারক আর তার কোনো আবশ্যকতাও নেই। আসলে আমাদের আবশ্যকতার অনুসারে লবণরস ভোজ্য পদার্থ থেকে স্বয়ংই প্রাপ্ত হয়। সুতরাং এমন কোনো আবশ্যকতা নেই যে ভোজন রান্না করার সময় লবণ মেশাতে হবে বা খাওয়ার সময় তাতে লবণ দিয়ে তারপর খেতে হবে। লবণরসের প্রশংসার কারণে মানুষের মধ্যে লবণ মেশানোর প্রবল প্রথা চালু হয়েছে, এটা অনাবশ্যক আর হানিকারক। স্বাদের কারণে মানুষ লবণের সেবন আবশ্যকতার অধিক মাত্রায় করে হানি বহন করছে। সুতরাং লবণ মিশিয়ে অথবা রান্নার সময় ভোজনে লবণ মিশিয়ে খাওয়ার প্রথা বন্ধ করা উচিত।
.
ভোজ্য পদার্থের মধ্যে আগে থেকে বিদ্যমান স্বাভাবিক লবণরসই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট। তথা এটাও খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, যেখানে লবণের লাভ অথবা ব্যবহার লেখা আছে, সেখানে এই সাম্ভর, বিড, সৌঁচর আর সমুদ্রের লবণ তো ভুলেও নেওয়া উচিত নয়, বরং সেখানে সন্ধক লবণের ব্যবহার করা উচিত, এর জন্য আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে লেখা আছে। এটা বৈদ্যের জন্য সংকেত - "লবণম্ সৈন্ধবম্ প্রোক্তম্" ব্যবহারের জন্য যেখানেই লবণ লেখা আছে তো সেটা সন্ধক লবণই ধরা উচিত। চরক শাস্ত্রের মধ্যেও "সৈন্ধবম্ লবণানাম্ শ্রেষ্ঠতমম্ পথ্যম্" অর্থাৎ লবণের মধ্যে সবথেকে শ্রেষ্ঠ সন্ধক লবণ পথ্য মানা হয়েছে। সন্ধক লবণ হল খনিজ অর্থাৎ খনি থেকে বের হয়। সাম্বার লবণ খাওয়া তো অত্যন্ত হানিকারক। ব্রহ্মচর্য রক্ষার দৃষ্টিতে তো সব লবণই অনেক হানিকারক।
.
লবণের উপর ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ জীর অনুভব -
ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ বিস্মিল যিনি দেশ স্বতন্ত্রতার জন্য হাসতে-হাসতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে গেছেন, তিনি লবণের বিষয়ে লিখেছেন - "হঠাৎ করে খারাপ অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিয়েছিলাম এই জন্য কখনও-কখনও স্বপ্নদোষ হতো। তখন কোনো এক সজ্জন ব্যক্তির বলাতে আমি লবণ খাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিই, কেবল সেদ্ধ শাক বা ডাল দিয়ে এক সময় ভোজন করতাম। আমি রাতে ভোজন করা ছেড়ে দিই, রাতে কেবল একটু দুধ পান করতাম। লঙ্কা টক তো স্পর্শ পর্যন্ত করতাম না। এইভাবে পাঁচ বছর পর্যন্ত পুরোপুরি লবণ খাইনি। লবণ না খাওয়ার কারণে শরীরের সব দোষ দূর হয়ে যায় আর আমার শরীর দর্শনীয় হয়ে ওঠে, সবাই আমার স্বাস্থ্যকে আশ্চর্য্যের দৃষ্টিতে দেখতো।"
.
এইসব কথা শুনে অনেকেই হতবাক হবেন কিন্তু এটা এক অনুভব সিদ্ধ বিষয়, ইংল্যান্ডে একটা স্কুল আছে যার মত হল লবণ মশলার থেকে অধিক হানিকারক, আমরা যে শাক সব্জি খাই তাতে আবশ্যকতা অনুসারে আগে থেকেই লবণের ভাগ বিদ্যমান আছে। সুতরাং তার উপর লবণ মেশানোর কোনো আবশ্যকতা নেই। আবশ্যকতার অধিক লবণ আমাদের শরীরের ঘাম দিয়ে বা অন্য কোনো প্রকারে বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রকৃতি আবশ্যকতানুসারে সকল খাদ্য পদার্থের মধ্যে লবণের ভাগ দিয়ে রেখেছে। একজন লেখক লিখেছেন যে - লবণ রক্তকে বিষাক্ত করে দেয়। তিনি এটাও বলেছেন যে - যারা কখনও লবণ সেবন করে না তাদের রক্ত এতটাই স্বচ্ছ হয় যে সাপের বিষের প্রভাবও তার উপর হয় না।
.
আমি নিজের অনুভবে বলতে পারি যে হাঁপানির মতো অনেক রোগ লবণ ত্যাগ করলে খুব শীঘ্র ঠিক হয়ে যায়। আরেকটা কথা হল, এর সেবন বন্ধ করার কারণে কারও হানি হতে দেখা যায়নি। আমি স্বয়ং কয়েক বছর ধরে লবণ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি আর তারফলে আমার মোটেও কোনো অসুবিধা হয় না, বরং কিছুটা আমার লাভই হয়েছে, যেমন এখন আমাকে আগের মতো বার-বার জল পান করতে হয় না। যদি কেউ লবণ খাওয়া ছেড়ে দেয় তাহলে কিছু দিন সে অস্বস্তি অনুভব করবে, কিন্তু সে যদি নিজের ধৈর্যকে স্থির রাখে তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই তার অনেক লাভ হবে।
.
লবণের উপর মহাত্মা নারায়ণ স্বামী জীর মত -
মহাত্মা নারায়ণ স্বামী জী তাঁর "য়োগরহস্য" পুস্তকে লিখেছেন "যদি লবণ না খাওয়া হয় তাহলে খুব ভালো, অন্যথা অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে", সুতরাং যদি অভ্যাসী পুরোপুরি লবণ পরিত্যাগ করে দেয় তাহলে তার জন্য অধিক হিতকর হবে।
.
লবণের উপর টণ্ডন জীর অনুভব -
রাজর্ষি শ্রী পুরুষোত্তমদাস টণ্ডন জী হরিদ্বারে একটা ভাষণে বলেছিলেন - "মানুষ ভোজনের মধ্যে লবণ মিশিয়ে ভোজন করছে এটা শুধু ব্যর্থই নয় বরং বিপদজনকও। মানুষের যত লবণের আবশ্যকতা আছে সেটা সে শাকাদি থেকে পেয়ে যায়, তার উপর আরও লবণ মেশানো, এটা হানিকারক।" টণ্ডন জী তর্কবল দিয়ে বিষয়টা পুষ্ট করেন আর উদাহরণে স্বয়ংকে উপস্থিত (পেশ) করেন। তিনি দীর্ঘকাল যাবত লবণ সেবন করেন নি, এরফলে তাঁর উপর অনেক ভালো প্রভাব পড়েছে। টণ্ডন জী ভোজনের মধ্যে লবণ মিশ্রণকে একটা হালকা বিষ মনে করেন। তিনি বৈদ্য তথা ডাক্তারদের অনুরোধ করেন যে তারা যেন এই বিষয়ে বিচার করেন।
.
লবণের উপর আমার অনুভব -
৪০ বছরের অধিক সময় ব্যতীত হয়ে গেছে, অনেক বছর পূর্বে আমি লবণ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তার কিছু কাল পশ্চাৎ আমার অন্য কয়েকজন মিত্রও লবণ পরিত্যাগ করে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন তো কিছু বছর পশ্চাৎ খেতে শুরু করে আর কয়েকজন এমনও আছে যারা পরিত্যাগ করার পর লবণকে খাওয়ার জন্য স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। আমাদের গুরুকুলে (ঝজ্জর) ২২ বছর থেকে কোনো ব্রহ্মচারী লবণ মিশিয়ে বা শাক সব্জি রান্নার সময় তাতে লবণ মিশিয়ে ভোজন করে না। শাক সব্জির মধ্যে যে স্বাভাবিক লবণ আছে সেটাই আমরা ভোজন করি। সন্ধকাদি কোনো লবণই আমরা ভোজ্য পদার্থ রূপে সেবন করি না। এর মুখ্য কারণ হল এটাই যে আমি মনে করি - ব্রহ্মচারীকে তার সাধনা কালে লবণ খাওয়া উচিত নয়, সুতরাং আমি স্বয়ং লবণ সেবন করি না তথা আমাদের ব্রহ্মচারীও লবণ সেবন করে না।
.
লবণ ছাড়ার প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর কেমন পড়ে এটা আমাদের বিদ্যার্থীদের স্বাস্থ্য দেখলেই বোঝা যায়। বিদ্যার্থীদের স্বাস্থ্য ভারতের সমস্ত শিক্ষণালয়ের তুলনায় সাধারণত ভালোই হবে, খারাপ তো কোনো ভাবেই হবে না। চুলকানি তো আজ পর্যন্ত কারও হয়নি। ফার্মী আখ চুষার কারণে কখনও-কখনও এক-দুই বিদ্যার্থীর দাদ হয়েছে অবশ্য, সেটা সাধারণ ওষুধের সেবন করে চলে গেছে। কারও চোখ ব্যথা করে না। ফোড়া ব্রণ আদি রক্ত সম্বন্ধীয় বিকারও হয় না। পিপাসা সাধারণ মানুষের মতো আমাদের লাগে না। আমাদের এখানে যখন নতুন বালক প্রবেশ করে তখন কিছুদিন তো আমাদের লবণ ছাড়া শাক-ডাল তার ভালো লাগে না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার অভ্যাস হয়ে যায় আর ভোজনকে রুচি করে খায় তখন তার শরীর তথা স্বাস্থ্য উন্নতি করতে থাকে, রক্ত অত্যন্ত শুদ্ধ হয়ে যায়, মুখের লালী শরীরের লাল রং তথা চর্মরোগের সর্বথা অভাব এর অকাট্য প্রমাণ। শুধু তাই নয়, চরক শাস্ত্র তথা অন্য বিদ্বানদের মত হল, লবণ সেবন করলে সাপ আদি বিষাক্ত জন্তুর বিষ শীঘ্র আর অধিক হানি করে, কিন্তু যারা লবণ সেবন করে না তাদের উপর সাপ আদির বিষ অনেক কম হানি করে অথবা করেই না।
.
এটা আমার অনেক বছরের প্রত্যক্ষ অনুভব। আমাকে তথা আমার অনেক ব্রহ্মচারীকে সাপ কামড়েছে কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়ে যে প্রত্যক্ষ রূপে তো অনেক ব্রহ্মচারীর উপর নাম-মাত্রও সাপে কামড়ের প্রভাব দেখা যায়নি। কারও-কারও উপর নামমাত্র প্রভাব পড়েছে, তা ওষুধ-উপচার করে এক-দুই দিনের মধ্যেই ঠিক হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি লবণ সেবন করে এমনও আমার কয়েকজন সাথীকে সাপ কামড়ে ছিল। সাপের কামড়ে তাদের যথেষ্ট হানি তথা কষ্ট ভুগতে হয়।
.
প্রায় ২০ বছর ধরে আমি সাপ-বিষের চিকিৎসা করছি। আশেপাশের গ্রাম থেকে প্রতিবছর সাপে কামড়ের রোগী এসেই থাকে। এই শুষ্ক প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় এমন ফনা-হীন পিত্তপ্রকৃতির (Vapur) সাপ বেশিরভাগ চিত্তকড়িয়াদি সেগুলো যথেষ্ট বিষাক্ত হয়। যথা সময়ে তথা যথাযথ চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এমন ধরণের সাপ আমাদের ব্রহ্মচারীদের কামড়ে ছিল। তাদের উপর তো নামমাত্র প্রভাব পড়েছিল অথবা সর্বথা প্রভাবও হয়নি।
.
যখন কোনো সাপে কাটা রোগী চিকিৎসার্থ গুরুকুলে আসে তখন ঔষধোপচারের পাশাপাশি তার লবণ মশলা আদি সব ছাড়িয়ে দেওয়া হয় তথা গোঘৃতাদি সাত্ত্বিক পদার্থের সেবন বিশেষভাবে করানো হয়। লবণাদি ছাড়ার কারণে চিকিৎসা শীঘ্র তথা সহজভাবে হয়। ঠিক এইভাবে তৃষা, দাহ, রক্তপিত্ত, অম্লপিত্ত, বিসর্প, কুষ্ঠ, শোথ, গঞ্জ, দাদ, চুলকানি আদি সব চর্মরোগ, নেত্ররোগ, দন্তরোগ, চুল সাদা হওয়া, নপুংসকতা অর্থাৎ ব্রহ্মচর্যের নাশ, স্বপ্নদোষ আর ধাতু-প্রমেহ আদি রোগকে লবণের সেবন জন্ম দেয় আর বাড়িয়ে তোলে। লবণ খাওয়া পরিত্যাগ করলে উপরোক্ত রোগ কমে যায়, কয়েকটা তো একদম সেরেই যায়। আমি অনেক বছর ধরে এই অনুভব করে আসছি। ব্রহ্মচর্যের জন্য লবণ কতটা হানিকারক এটা কাকোরীর অমর বলিদানী ব্রহ্মচারী রামপ্রসাদ জীর লেখা পড়ে পাঠক অবশ্যই বুঝে গেছেন।
.
নপুংসকতাকে উৎপন্ন করার মধ্যে লবণ হল সবথেকে বড় কারণ, এটা চরক শাস্ত্রের অনেক প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ। কারণ রুক্ষ আর তীক্ষ্ণ প্রকৃতির লবণাদি যত পদার্থ আছে, সেগুলো বীর্যাদি ধাতুকে পাতলা করে দেয়, এর ফলে স্বপ্নদোষ, মূত্রতে বীর্য বেরিয়ে আসা আদি প্রমেহ রোগ হয়। সুতরাং স্বাস্থ্যপ্রেমী তথা ব্রহ্মচারীকে কখনও ভুলেও লবণ সেবন করা উচিত নয়। যদি দুর্ভাগ্যবশতঃ কাউকে ঔষধাদির রূপে বা অন্য কোনো কারণে লবণের প্রয়োগ করতে হয় তাহলে সন্ধক লবণের সেবন আর সেটাও অল্প মাত্রায় করা উচিত। চরক শাস্ত্র অনুসারে "সৈন্ধবম্ লবণানাম্" সব লবণের মধ্যে সন্ধক লবণই পথ্য অর্থাৎ কম হানিকারক। কিন্তু ব্রহ্মচারীকে সর্বদা লবণ থেকে দূরে থাকা উচিত। যেখানে সন্ধক লবণ খাওয়ার আজ্ঞা আছে সেটা কেবল এইজন্য যে যদি কোনো রোগী আদি লবণ খেতে চায় অথবা কোনো গৃহস্থ লবণ ছাড়া থাকতে না পারে তাহলে সে খুব কম মাত্রায় সন্ধক লবণের সেবন করতে পারে। এতে একটু কম হানি হবে কারণ "লবণম্ সৈন্ধবম্ নোষ্ণম্" চরকে লেখা আছে, সব লবণ উষ্ণবীর্য হয়, কেবল সন্ধক লবণ উষ্ণবীর্য হয় না। কিন্তু তীক্ষ্ণতা আর রুক্ষতার দোষ এরমধ্যেও আছে। সুতরাং সবপ্রকার লবণ সেবন থেকে দূরে থাকাই ব্রহ্মচারীর জন্য কল্যাণকর হবে।
🍁 দুধ 🍁
গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া আদি অনেক পশুর দুধ ব্যবহার করা হয়, গোদুগ্ধই হল সর্বশ্রেষ্ঠ ও অমৃত। মহাভারতে লেখা আছে - "অমৃতম্ বৈ গবাম্ ক্ষীরম্" (অনু. অ. ৬৬/৪৬) অর্থাৎ গোদুগ্ধই হল আসল অমৃত।
.
আমাদের শরীরের জন্য দুধের অত্যধিক আবশ্যকতা আছে। যদি কোনো শিশু যথাযথ পরিমাণ দুধ প্রাপ্ত না করে তাহলে তার শরীরের পূর্ণ বিকাশ হয় না। দুধ সব অবস্থায় শ্রেষ্ঠ আর পথ্য কিন্তু বৃদ্ধি অবস্থায় ১৬ বছর থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত নবযুবকদের জন্য অত্যাবশ্যক। "ক্ষীরমোজস্করম্ পুম্সাম্" তথা "পয়সা বর্ধতে তনুঃ" অনুসারে দুধ থেকে বল, বীর্য, ওজ, কান্তি আর শরীরের বৃদ্ধি হয়। সুতরাং প্রতিদিনের ভোজনে দুধের একটা বিশেষ স্থান আছে।
.
দুধ হল সর্বশ্রেষ্ঠ আর পূর্ণ ভোজন। ডাক্তারের মতানুসারে এতে ভিটামিন এ. বি. ডি. জি. আছে। দুধের মধ্যে সব পোষক এবং জীবনীয়তত্ত্ব বিদ্যমান আছে, সুতরাং কেবল দুগ্ধাহার দ্বারাই শরীরের পূর্ণ বিকাশ হতে পারবে। সংসারে এর তুল্য অন্য কোনো পদার্থ নেই যার দ্বারা জীবন নির্বাহ অথবা শরীরের বিকাশ করা যেতে পারে। গোমাতার এটা এক অনন্য উপহার। ধন্বন্তরীয় নিঘন্টুতে গোদুগ্ধের গুণ এইভাবে লেখা আছে -
.
পথ্যম্ রসায়নম্ বল্যম্ হৃদ্যম্ মেধ্যম্ গবাম্ পয়ঃ ।
আয়ুষ্যম্ পুঁস্ত্বকৃদ্বাতরক্ত বিকারনুত্ ।।১৬৪।।
(সুবর্ণাদি ষষ্ঠো বর্গঃ)
গোদুগ্ধ পথ্য = সব রোগ বা অবস্থাতে সেবন করার যোগ্য রসায়ন, বলকারক, হৃদয়ের জন্য হিতকারী, মেধা (বুদ্ধি) -কে আর আয়ুকে বাড়িয়ে তোলে, পুংস্ত্বশক্তি অর্থাৎ বীর্যবর্দ্ধক, বাতনাশক আর রক্তপিত্তের বিকারকে নির্মূলকারী।
.
দুধকে আমাদের শাস্ত্রকারগণ বলেছেন "সদ্যঃ শুক্রকরম্ পয়ঃ" অর্থাৎ তৎকাল বীর্যবর্দ্ধক, এইভাবে চরক, সুশ্রুত আদি সব আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থের মধ্যে গোদুগ্ধের মহিমা ও গুণ বলা হয়েছে। আজকাল গোবংশের রক্ষা করা হয় না, তার স্থানে মোষ পালা হয় আর তারই ঘী দুধ আদির সেবন করা হয়, কিন্তু মোষের দুধ হানিকারক হয়।
.
🍁 গরু আর মোষের দুধের তুলনা 🍁
১. গরুর দুধ মধুর, স্নিগ্ধ, শীতল, বাত-পিত্ত-কফ নাশক, ফুসফুসের জন্য লাভদায়ক, ক্ষয়রোগ নির্মূলকারী তথা স্নায়ুকে স্নিগ্ধকারী। অস্থিমার্দব (Reckets) দ্বারা ক্ষীণ হওয়া বালকের জন্য গরুর দুধ অমৃতের সমান প্রাণবর্দ্ধক হয়। যেসব বালকের নেত্রজ্যোতি ক্ষীণ হয়ে গেছে বা যারা রক্তক্ষয় বা পাণ্ডু রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্যও এটা অত্যন্ত উপকারী ওষুধ। ক্রমাগত সেবন করলে সব ধরণের রোগ দূর হয় এবং বৃদ্ধাবস্থা শীঘ্র আসে না। ধারোষ্ণ অর্থাৎ অনেক উষ্ণপান করলে অমৃততুল্য হয়, এটা দুই ঘন্টার মধ্যে হজম হয়।
.
২. মোষের দুধ উপরোক্ত কিছু রোগের জন্য তো একদম অকেজো কিন্তু কয়েকটা রোগের জন্য লাভদায়কও হয়, তবে সেটা খুব অল্প মাত্রায়। এটা মধুর, ভারী, গরম, বীর্যবর্দ্ধক, কফ আর বায়ুকারক, আলস্য উৎপন্নকারী, মন্দাগ্নি তথা সংক্রামক রোগকে আহ্বানকারী। ধারোষ্ণ বিষাক্ত, নয় ঘন্টায় হজম হয় আর পান করলে অধিক ঘুম আসে। যাদের অনিদ্রারোগ আছে তাদের ওষুধ রূপে এটা দেওয়া হয়। এতে অনেক গরম থাকে, এইজন্য মোষের দুধ আদি পদার্থের গুণ শীঘ্রই শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় আর অনেক্ষণ পর্যন্ত শরীরের মধ্যে শক্তি রাখতে পারে না।
.
৩. গরুর দুধে ভিটামিন এ. ডি. অনেক বেশি থাকে। গরু উষ্ণ রোদে গোচর ভূমিতে ঘোরাঘুরি করে তার দুধকে সূর্য কিরণ দ্বারা উপযুক্ত করে তোলে আর মোষ রোদ্দুরে চরে বেড়ায় না।
.
৪. গোদুগ্ধে আয়োডিন আর ক্যারোটিন থাকে যা মোষের দুধে থাকে না। ক্যারোটিনই ভিটামিনের গুণকে সুরক্ষিত রাখে।
.
গরুর দুধে স্নেহ পদার্থ যেখানে ২০ ইউনিট আছে সেখানে মোষের দুধে স্নেহ পদার্থ ২ ইউনিটেরও কম আছে। গরুর দুধ গরম করলে তার মালাইয়ে যে হলদে রং আসে সেটা এই ক্যারোটিন পদার্থের কারণেই আসে। মোষের দুধের মধ্যে এই পদার্থ নেই, এইজন্য তার মাখন ঘী আদি একদম সাদা হয়।
.
৫. গোদুগ্ধের প্রোটিন খুব সহজে হজম হয়, বীর্যবর্দ্ধক হয় আর ক্ষয়রোগের নির্মূলকারী হয়। এক থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে হজম হয়। এটা সাত্ত্বিক আহার এবং শরীরে পুরুষার্থ, শান্তি, উৎসাহ, তৎপরতা নিয়ে আসে।
.
৬. গোদুগ্ধ হল দৈবী কিন্তু মোষের দুধ হল আসুরী তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, রাগ, দ্বেষ, আলস্য, মন্দাগ্নিকারক, গরম, ভারী, মন্দবুদ্ধি, তামসী আহার।
.
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে - "Cow milk and honey are the root of beauty" অর্থাৎ গোদুগ্ধ আর মধু হল সৌন্দর্যের মূল কারণ। ডাক্তারদের এটা অনুভব যে ধারণা-শক্তিকে তীব্র করতে তথা তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা অনেক সহায়ক হয়, কিন্তু এই গুণ মোষের দুধে নেই।
.
🍁 আসুন বিভিন্ন প্রাণীর দুধ সম্বন্ধে জেনে নিই -
🌿 গোদুগ্ধ -
গরুর দুধ বলদায়ক, আয়ুবর্দ্ধক , শীতল, কফ আর পিত্তের বিকারকে শান্ত করে, হৃদয়ের জন্য হিতকারী, রুচিকারক, বুদ্ধি তথা অত্যধিক বীর্যবর্দ্ধক, স্বাদু, রসায়ন আর জীবনীয় হয়, চোখের জন্য হিতকারী তথা রস ও রন্ধনে মধুর হয়।
.
🌿 মহিষী দুগ্ধ -
মোষের দুধ গরুর দুধের থেকে ভারী, শীতল আর স্নিগ্ধ হয়। মহাভিষ্যন্দী, নিদ্রা, আলস্য আর প্রমাদজনক, জঠরাগ্নিকে মন্দকারী আর বলদায়ক হয় কিন্তু মোষের দুধ কামোদ্দীপকও হয়, সুতরাং এটা ব্রহ্মচারীর জন্য বিশেষ হানিকারক।
.
🌿 অজাপয়ঃ (ছাগলের দুগ্ধ) -
ছাগীর দুধের গুণও প্রায় গরুর দুধের সমান হয়, এটা বিশেষ করে কৃশ শরীরওয়ালা হ্যাংলা-পাতলা ব্যক্তিদের জন্য হিতকারী আর এটা কাশি, রক্তপিত্ত তথা ত্রিদোষনাশক হয়।
.
🌿 অবিকপয়ঃ (ভেড়ার দুধ) -
ভেড়ার দুধ মধুর, স্নিগ্ধ, গুরু, পিত্ত আর কফকারক হয়, এটা কেবল বাত ব্যাধির মধ্যে পথ্য; তাছাড়া স্থূলতা আর প্রমেহনাশক হয়।
.
🌿 উষ্ট্রীপয়ঃ (উটের দুধ) -
উটের দুধ রুক্ষ, উষ্ণ, একটু লবণ, লঘু আর স্বাদু হয়। এটা বাত আর কফের রোগ, গুল্মোদর, ফুলা (edema), পেট-ফাঁপা (flatulence), কৃমি, কুষ্ঠ, অর্শরোগ আর বিষনাশক হয়।
.
🌿 হস্তিনীপয়ঃ (হাতির দুধ) -
হাতির দুধ ভারী, বলদায়ক, স্নিগ্ধ, অতিশীতল, মধুর, নেত্রজ্যোতিবর্দ্ধক তথা শরীরকে অত্যন্ত দৃঢ় করে তোলে।
.
🌿 অশ্বাপয়ঃ (ঘোড়ার দুধ) -
এই দুধ টক, নোনতা, লঘু, বল-কান্তিদায়ক আর শ্বাসরোগ তথা বাতনাশক হয়।
.
🌿 গর্দভীপয়ঃ (গাধার দুধ) -
এটা মধুর, অম্ল, রুক্ষ আর দীপন হয়, তাছাড়া এটা শ্বাসরোগ, কাশি নাশক তথা শিশুদের সব রোগ দূর করে।
.
🌿 মানুষীপয়ঃ (মানব স্ত্রীর দুগ্ধ) -
মধুর, শীতল, লঘু, স্নিগ্ধ, তৃপ্তিকারক, দীপন, বলবর্দ্ধক, জীবন, নেত্রের জন্য হিতকারী, রক্তপিত্ত তথা নেত্র-পীড়াকে নষ্ট করে। নাক ও চোখে দেওয়ার জন্য পথ্য।
.
🍁 ঘৃত (ঘী) 🍁
দুধের মতো ঘীয়েরও নিজের একটা বিশিষ্ট স্থান ভোজনে আছে। ঘীয়ের অভাবে ভোজনে সুস্বাদুতা আর স্নিগ্ধতা আসে না। ঘীয়ের সংযোগে সব ভোজ্য পদার্থ উত্তম, সুস্বাদু আর বলদায়ক হয়। "আয়ুর্বৈ ঘৃতম্" অনুসারে ঘী দ্বারা আয়ু বাড়ে আর বেদের মধ্যে বলা হয়েছে "ঘৃতেন ত্বম্ তন্বম্ বর্ধয়স্ব" (য়জু.১২/৪৪) অর্থাৎ ঘী দ্বারা শরীরের বৃদ্ধি হয়।
.
মহর্ষি ধন্বন্তরি জী গোঘৃতের গুণের বিষয়ে লিখেছেন -
শস্তম্ ধীস্মৃতিমেধাগ্নিবলায়ুঃ শুক্রচক্ষুষাম্ ।
বালবৃদ্ধপ্রজাকান্তিসৌকুমার্য়স্থিরানাম্ ।।১৪৫।।
ক্ষতক্ষীণপরীসর্পশস্ত্রাগ্নিগ্লপিতাত্মনাম্ ।
বিপাকে মধুরম্ শীতম্ বাতপিত্তবিষাপহম্ ।
চক্ষুষ্যম্ বল্যমগ্রয়ম্ চ গব্যম্ সর্পির্গুণোত্তরম্ ।।১৪৬।।
(ধন্বন্তরীয় নিঘন্টৌ ষষ্ঠো বর্গঃ)
অর্থাৎ গরুর ঘী বুদ্ধি, স্মরণশক্তি, মেধা (ধারণাবতী বুদ্ধি), অগ্নি (জঠরাগ্নি), বল, আয়ু, বীর্য, নেত্রজ্যোতি, বালক-বৃদ্ধ, প্রজা (সন্তান), কান্তি (তেজ) তথা সৌকুমার্য (যুবকাবস্থা) আদি বজায় রাখতে হিতকারী এবং লাভদায়ক হয়। গোঘৃত রন্ধনে মধুর আর শীতল হয়। বাতরোগ, পিত্তরোগ তথা সব ধরণের বিষ নাশক হয়। ক্ষতক্ষীণ (নির্বল), পরীসর্প রোগ তথা শস্ত্র আর অগ্নি দ্বারা পীড়িতের জন্য লাভদায়ক হয়। চোখের জন্য হিতকারী অর্থাৎ নেত্রজ্যোতিবর্দ্ধক আর সবথেকে অধিক গুণযুক্ত হয়। সুশ্রুত শাস্ত্রের মধ্যেও গোঘৃতের গুণ এইভাবে লেখা আছে।
.
শ্রী নরহরি জী রাজনিঘন্টুর মধ্যে লিখেছেন - গোঘৃত বাতশ্লেষ্মহারক, শ্রমনিবারক, হৃদয়ের হিতকারী আর শরীরকে স্থিরতা দেয় অর্থাৎ বৃদ্ধাবস্থা আসতে দেয় না। আরও লিখেছেন -
গব্যম্ হব্যতমম্ ঘৃতম্ বহুগুণম্ ভোগ্যম্ ভবেদ্ভাগ্যতঃ ।।২০৪।। (রাজনিঘন্টৌ পঞ্চদশো বর্গঃ)
অর্থাৎ গোঘৃত হব্যতম অর্থাৎ হবনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আর অনেক গুণযুক্ত হয়, এটা খুব সৌভাগ্যশালী মানুষই ভোজনে প্রাপ্ত করে। আসলে গোপালকরাই শুদ্ধ গোঘৃতের সেবন করে।
.
শালিগ্রাম নিঘন্টুতে গোঘৃতের গুণ সম্বন্ধে লেখা আছে -
"গোঘৃত অমৃতের সমান গুণকারী আর রসায়ন হয় তথা সব ঘৃতের মধ্যে এটি উত্তম আর প্রশংসনীয়। ভাবপ্রকাশ নিঘন্টুতেও গোঘৃতকে এর থেকে ভিন্ন, কুরুপতাপায় তথা রাক্ষস-নাশক, মঙ্গলরূপ রসায়ন, সুন্দর, সকল ঘৃতের মধ্যে উত্তম বলা হয়েছে।
.
এইভাবে দই, তক্র (ছাছ) আদিও স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম। দই আর তক্রের সেবন করলে পাচন প্রণালী তার ক্রিয়া সঠিকভাবে করে, পেটের সব বিকার নষ্ট হয়ে উদর নিরোগ থাকে। নিঘন্টুকার লিখেছেন - "ন তক্রসেবী ব্যথতে কদাচিৎ" অর্থাৎ তক্রের সেবনকারী কখনও রোগী হয় না।
ফলাহার
দুগ্ধাহারের পশ্চাৎ দ্বিতীয় স্থানটা হল ফলাহার। কিছু মানুষ ফলাহারকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানে কিন্তু এতে মলভাগ অধিক হওয়ার কারণে দুগ্ধাহারকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলা উচিত। ফলাহার হল দুগ্ধাহারের থেকে হীন তথা অন্নের থেকে উত্তম আহার। ফলের মধ্যে বল, বীর্য, কান্তি আর ওজকে বাড়ানোর শক্তি প্রচুর মাত্রায় আছে। ফলাহারের ফলে সত্ত্বশক্তির বৃদ্ধি হয়, মনের চঞ্চলতা নষ্ট হয় আর স্বাস্থ্য অত্যুত্তম হয়। যেসব ফল তাজা, পাকা এবং দূষিত নয়, সেগুলোই উপযোগী। তবে যে ফল গুণের দৃষ্টিতে উত্তম সেগুলো প্রকৃতির অনুসারে চিন্তা-ভাবনা করে গ্রহণ করা উচিত।
নিম্নে কিছু ফল এবং সেগুলোর গুণ তুলে ধরা হল -
ডুমুর -
ডুমুরের ফল অত্যন্ত শীতল হয় আর রক্তপিত্তকে তৎকাল দূর করে। পিত্ত ও মাথার বিকারে প্রথম পথ্য তথা নাক দিয়ে রক্তপাতে (নকসীর) বিশেষ লাভদায়ক। এর সেবন ব্রহ্মচারী তথা স্বাস্থ্যপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত হিতকর, প্রচুর মাত্রায় সেবন করা উচিত।
মালবেরী -
পাকা মালবেরী - গুরু, স্বাদু, শীতল, বাত-পিত্তনাশক আর কাঁচা মালবেরী - ভারী, সারক, টক, উষ্ণ আর রক্ত-পিত্তকারক হয়। এর সেবন অল্প মাত্রায় করা উচিত। সর্দি, কাশি, গলার ব্যাধির জন্য হিতকর।
আমলা -
আমলা একটু তিক্ত, টক, মধুর, শীতল, হালকা হয়। এটা দাহ, পিত্ত, বমন, প্রমেহ, শোষ, অরুচি, রক্তপিত্ত, পেট ফাঁপা (fatulence), মলবদ্ধতাকে নষ্ট করে। চুলের জন্য হিতকারী, রসায়ন, বৃদ্ধাবস্থা আর ত্রিদোষনাশক; টক দ্বারা বাতের, মধুরতা আর শীতলতার দ্বারা পিত্তের তথা তিক্ত আর রুক্ষতার দ্বারা কফের নাশ করে।
শুকনো আমলা টক, অম্ল, কষায়, মিষ্টি হয়, এটি চুল ও চোখের জন্য হিতকারী আর বীর্যবর্দ্ধক হয়। তৃষ্ণা, মেদ, বিষ আর ত্রিদোষ নাশক হয়। আমলার যে টক আছে, সেটাই একমাত্র হানি করে না।
আঙ্গুর -
আঙ্গুর হল সর্বশ্রেষ্ঠ ফল আর এটা রুচিকারক, বীর্যবর্দ্ধক, শীতল, মধুর, স্নিগ্ধ হয়। স্বর আর চোখের জন্য হিতকারী, বাত, রক্তপিত্ত, জ্বর, শ্বাসরোগ, বমন, পাণ্ডু (জন্ডিস), দাহ, তৃষ্ণা আদির নাশ করে। এর শুকনো কিশমিশও এইরূপ লাভদায়ক হয়। আঙ্গুর যদি টক হয় তাহলে রক্তপিত্তকে করে। একে ইচ্ছেমতো সেবন করা উচিত।
আম -
পাকা আম সুগন্ধিত, মধুর, স্নিগ্ধ, অত্যন্ত পুষ্টিকারক, রুচিকারী, বাতনাশক, হৃদয়ের জন্য হিতকারী, শীতল, ভারী, মলরোধক, প্রেমেহনাশক, বর্ণকে উজ্জ্বলকারী, তৃষ্ণা, বাত তথা শ্রমনাশক, বল-বীর্য, মাংস আর কফকে বাড়িয়ে তোলে। আমের সঙ্গে দুধের সেবন অত্যন্ত লাভপ্রদ। দুধের সঙ্গে পাকা আম চুষলে বল-বীর্যের অত্যন্ত বৃদ্ধি হয় আর এটা লঘু, বাত-পিত্ত নাশক আর শীঘ্র হজম হয়।
কাঁচা ছোটো আম কষায়, টক হয় এবং বাত আর রক্তপিত্তকারক হয়। কাঁচা বড়ো আমও এইরূপ অত্যন্ত টক, রুক্ষ, ত্রিদোষকারক তথা রুচিত রোগকে বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং এর সেবন করা উচিত নয়। ব্রহ্মচারীর জন্য কাঁচা আমের টক অত্যন্ত হানিকারক।
পেয়ারা -
পেয়ারা স্বাদু, কষায়, অত্যন্ত শীতল, বাতপিত্তনাশক, কফকারক, বীর্যবর্দ্ধক আর রুচিকারক হয়। এর যথাযথ সেবন স্বাস্থ্যের জন্য লাভদায়ক। এর সেবন করলে কারও কারও কোষ্ঠকাঠিন্য তথা ডায়রিয়া হয়।
কলা -
কলা সুস্বাদু, শীতল, রন্ধনে মধুর, বীর্যবর্দ্ধক, পুষ্টিকারক, রুচিপ্রদ, শরীরের মাংসকে বাড়িয়ে তোলে তথা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নেত্ররোগ আর প্রমেহনাশক হয়। কলাগাছের মূল কৃমিনাশক হয়। শুকনো কাঁচা কলার চূর্ণ হল উত্তম পৌষ্টিক পদার্থ। পুরোনো কাশি থাকলে কলার শরবত সেবন করা উচিত। কলার সেবন কারও-কারও কোষ্ঠকাঠিন্য করে।
আপেল -
আপেল বাত-পিত্তনাশক, পুষ্টিকারক, কফবর্দ্ধক, ভারী, শীতল, রুচিকারক, আর বীর্যবর্দ্ধক হয়। রস আর রন্ধনে মধুর হল। খুব রক্ত বাড়িয়ে তোলে। এর সেবন হিতকারী।
কমলা -
এটা মিষ্টি, টক, ভারী, অনেক কষ্টে হজম হয় তথা বীর্যবর্দ্ধক ও বাতনাশক হয়। টক কমলা অত্যন্ত উষ্ণ হয়। কমলা কোষ্ঠকাঠিন্য কারক হয় তথা টক ও উষ্ণ হওয়ার কারণে ব্রহ্মচারীর জন্য এটা হানিকারক, সুতরাং এর সেবন উচিত নয় তবে মিষ্টি কমলা অল্প মাত্রায় সেবন করা যেতে পারে।
নাশপাতি -
নাশপাতি ভারী, বীর্যবর্দ্ধক, মধুর আর ত্রিদোষনাশক হয়। সংস্কৃতে এর আরও একটা নাম আছে - অমৃতফল। এটা খুবই ভালো ফল।
লেবু -
লেবু উষ্ণ, পাচক, দীপন, টক, ত্রিদোষনাশক, চোখের জন্য হিতকারী, অতিশয় রুচিকারী, তিক্ত, কষায়, হালকা হয়। কফ, বাত, বমন, কাশি, কণ্ঠরোগ, ক্ষয়, কলেরা, বাতের ব্যথা, টিউমার আর কৃমিকে নষ্ট করে। গুণের দিক দিয়ে পাকা লেবু শ্রেষ্ঠ আর এগুলো কাগজি লেবুর গুণ। ব্রহ্মচারীর জন্য তো কাগজি লেবু হোক অথবা অন্য কোনো লেবু, সবগুলোই হানিকারক।
মিষ্টি লেবু বা শরবতী লেবু মধুর, ভারী, বাত, পিত্ত, সর্পবিষ, রক্তবিকার, শোধ, বমন, অরুচি তথা তৃষ্ণাকে নষ্ট করে। কফ সম্বন্ধীয় রোগকে দূর করে এবং বলদায়ক ও পুষ্টিকারক হয়। কাগজি লেবু আর শরবতী লেবুর মধ্যে কেবল পাতার ভেদ আছে। কাগজি লেবুর পাতা ছোটো আর শরবতী লেবুর পাতা বড় হয়।
জামির লেবু সুস্বাদু, টক, দীপন, হালকা, রক্তপিত্ত, কন্ঠ আর জিহ্বাকে শুদ্ধ করে। হৃদয়ের জন্য হিতকারী, শ্বাসরোগ, কাশি, অরুচি তথা তৃষ্ণাকে নষ্ট করে।
লেবুর অনেক ভেদ আছে, যথা - কাগজি, শরবতী, মিষ্টি লেবু, জম্বীর, জামির, চকোতরা, কমলা, সন্তরা, বিহারী আদি।
তেঁতুল -
কাঁচা তেঁতুল অত্যন্ত টক, উষ্ণ, মলরোধক, বাতনাশক, অগ্নিদীপন, রক্তপিত্ত, কফ আর রক্তকে দূষিত করে। সুতরাং স্বাস্থ্য এবং ব্রহ্মচর্য প্রেমীকে এর সেবন একদম করা উচিত নয়। সংস্কারবিধি বেদারম্ভ সংস্কারে মহর্ষি দয়ানন্দ জী ব্রহ্মচারীর জন্য "না অতি টক তেঁতুল আদি" লিখে তেঁতুল খেতে নিষেধ করেছেন। দক্ষিণ ভারতে এটা খাওয়ার প্রচার খুব বেশি, এটা হানিপ্রদ হওয়াতে একদম ত্যাজ্য।
সিঙ্ঘাড়া বা পানিফল -
পানিফল হল এক জলীয় ফল। এটা শীতল, সুস্বাদু, ভারী, গ্রাহী আর বীর্যবর্দ্ধক হয় আর বাত তথা কফের কারক হয়, তাছাড়া রক্তবিকার আর দাহকে নষ্ট করে।
তরমুজ -
তরমুজ শীতল, গ্রাহী, পিত্ত, দৃষ্টি আর বীর্যকে নষ্ট করে। পাকা তরমুজ উষ্ণ, ভারী, পিত্তকারক, বাত আর কফকে নষ্ট করে। এর সেবন ব্রহ্মচারীর জন্য হানিকারক।
পেঁপে -
পাকা পেঁপে মধুর, রুচিকারক, ভারী, মলরোধক, কফকারী, বীর্যবর্দ্ধক, বাত আর উন্মাদ রোগকে নষ্ট করে। পাচন প্রণালীকে ঠিক রাখতে সহায়ক হয়। এরমধ্যে রোগের কীটাণুকে ছিন্ন-ভিন্ন করার শক্তি আছে।
খেজুর -
খেজুর গুরু, শীতল, হৃদয়ের জন্য হিতকারী আর তৃপ্তিকারক হয়। রস আর রন্ধনে মধুর, কফকারক তথা রক্তপিত্ত জয়ী। বল-বীর্যবর্দ্ধক, অল্পায়ু, জ্বর, ডায়রিয়া, কাশি, শ্বাসরোগ আদিকে দূর করে। এটা বেশির ভাগ পশ্চিমী দেশে হয়।
খরবুজ বা খরমুজ -
খরবুজ বলদায়ক, মূত্রকারক, ভারী, স্নিগ্ধ, শীতল, বীর্যবর্দ্ধক, অতি সুস্বাদু, বাত তথা পিত্তনাশক হয়।
বেদানা বা ডালিম -
বেদানা তিন প্রকারের হয় - মিষ্টি, মিষ্টি ও টক তথা কেবল টক। মিষ্টি বেদানা ত্রিদোষ নাশক, তৃষ্ণা, দাহ, জ্বর, হৃদয়রোগ, কণ্ঠ আর মুখের রোগকে দূর করে। এটা তৃপ্তিকারক, বল-বীর্যবর্দ্ধক, হালকা, একটু তিক্ত, মলরোধক, স্নিগ্ধ আর মেধাজনক হয়। শ্রম, অরুচি আর নির্বলতাকে দূর করে।
মিষ্টি আর টক বেদানা দীপনকারী, রুচিকারী, একটু পিত্তকারক আর হালকা হয়।
টক বেদানা বাত কফ নাশক, পিত্তকারক, অগ্নিদীপন আর হালকা হয়।
আনার দানা - রুচিকারক, হৃদয়ের প্রিয়, দাহ আর তৃষ্ণাকে প্রশমন করে। বেদানার ফুল নাক দিয়ে আসা রক্তকে থামায় আর এর বল্কল কৃমিনাশক, মলরোধক আর আমাশয়কে দূর করে।
নারকেল -
নারকেলের জল স্নিগ্ধ, সুস্বাদু, বলদায়ক, বীর্যবর্দ্ধক, রুচিকারক হয় আর পিত্ত ও তৃষ্ণাকে দূর করে।
সাধারণ নারকেল স্বাদু, রন্ধনে মধুর, ভারী, দুর্জর (দেরিতে হজম হয়), মলকারক, পিত্তনাশক, কৃমিবর্দ্ধক, জঠরাগ্নিকে মন্দ করে আর কামদেবের বলকে বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং ব্রহ্মচারীকে এর সেবন করা উচিত নয়।
বাদাম -
বাদাম মসৃণ, গরম, বীর্যবর্দ্ধক, ভারী আর বাতনাশক। বাদামের গিরী বীর্যবর্দ্ধক, বলদায়ক, কফকারক আর বাত পিত্ত নাশক হয়। রক্তপিত্তের রোগীর জন্য ঠিক নয়। বাদামের গিরীকে সায়ংকালে জলে ভিজিয়ে প্রাতঃকালে দুধ বা জলের সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে শরীর আর মস্তিষ্কের খুশকি তথা উষ্ণতা দূর হয়, বল-বীর্যের বৃদ্ধি হয়। ব্রহ্মচারীকে বাদামের সেবন এইভাবেই করা উচিত, অন্যথা উষ্ণ হওয়াতে হানিকারক হবে।
দুগ্ধাহারের পশ্চাৎ দ্বিতীয় স্থানটা হল ফলাহার। কিছু মানুষ ফলাহারকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানে কিন্তু এতে মলভাগ অধিক হওয়ার কারণে দুগ্ধাহারকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলা উচিত। ফলাহার হল দুগ্ধাহারের থেকে হীন তথা অন্নের থেকে উত্তম আহার। ফলের মধ্যে বল, বীর্য, কান্তি আর ওজকে বাড়ানোর শক্তি প্রচুর মাত্রায় আছে। ফলাহারের ফলে সত্ত্বশক্তির বৃদ্ধি হয়, মনের চঞ্চলতা নষ্ট হয় আর স্বাস্থ্য অত্যুত্তম হয়। যেসব ফল তাজা, পাকা এবং দূষিত নয়, সেগুলোই উপযোগী। তবে যে ফল গুণের দৃষ্টিতে উত্তম সেগুলো প্রকৃতির অনুসারে চিন্তা-ভাবনা করে গ্রহণ করা উচিত।
নিম্নে কিছু ফল এবং সেগুলোর গুণ তুলে ধরা হল -
ডুমুর -
ডুমুরের ফল অত্যন্ত শীতল হয় আর রক্তপিত্তকে তৎকাল দূর করে। পিত্ত ও মাথার বিকারে প্রথম পথ্য তথা নাক দিয়ে রক্তপাতে (নকসীর) বিশেষ লাভদায়ক। এর সেবন ব্রহ্মচারী তথা স্বাস্থ্যপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত হিতকর, প্রচুর মাত্রায় সেবন করা উচিত।
মালবেরী -
পাকা মালবেরী - গুরু, স্বাদু, শীতল, বাত-পিত্তনাশক আর কাঁচা মালবেরী - ভারী, সারক, টক, উষ্ণ আর রক্ত-পিত্তকারক হয়। এর সেবন অল্প মাত্রায় করা উচিত। সর্দি, কাশি, গলার ব্যাধির জন্য হিতকর।
আমলা -
আমলা একটু তিক্ত, টক, মধুর, শীতল, হালকা হয়। এটা দাহ, পিত্ত, বমন, প্রমেহ, শোষ, অরুচি, রক্তপিত্ত, পেট ফাঁপা (fatulence), মলবদ্ধতাকে নষ্ট করে। চুলের জন্য হিতকারী, রসায়ন, বৃদ্ধাবস্থা আর ত্রিদোষনাশক; টক দ্বারা বাতের, মধুরতা আর শীতলতার দ্বারা পিত্তের তথা তিক্ত আর রুক্ষতার দ্বারা কফের নাশ করে।
শুকনো আমলা টক, অম্ল, কষায়, মিষ্টি হয়, এটি চুল ও চোখের জন্য হিতকারী আর বীর্যবর্দ্ধক হয়। তৃষ্ণা, মেদ, বিষ আর ত্রিদোষ নাশক হয়। আমলার যে টক আছে, সেটাই একমাত্র হানি করে না।
আঙ্গুর -
আঙ্গুর হল সর্বশ্রেষ্ঠ ফল আর এটা রুচিকারক, বীর্যবর্দ্ধক, শীতল, মধুর, স্নিগ্ধ হয়। স্বর আর চোখের জন্য হিতকারী, বাত, রক্তপিত্ত, জ্বর, শ্বাসরোগ, বমন, পাণ্ডু (জন্ডিস), দাহ, তৃষ্ণা আদির নাশ করে। এর শুকনো কিশমিশও এইরূপ লাভদায়ক হয়। আঙ্গুর যদি টক হয় তাহলে রক্তপিত্তকে করে। একে ইচ্ছেমতো সেবন করা উচিত।
আম -
পাকা আম সুগন্ধিত, মধুর, স্নিগ্ধ, অত্যন্ত পুষ্টিকারক, রুচিকারী, বাতনাশক, হৃদয়ের জন্য হিতকারী, শীতল, ভারী, মলরোধক, প্রেমেহনাশক, বর্ণকে উজ্জ্বলকারী, তৃষ্ণা, বাত তথা শ্রমনাশক, বল-বীর্য, মাংস আর কফকে বাড়িয়ে তোলে। আমের সঙ্গে দুধের সেবন অত্যন্ত লাভপ্রদ। দুধের সঙ্গে পাকা আম চুষলে বল-বীর্যের অত্যন্ত বৃদ্ধি হয় আর এটা লঘু, বাত-পিত্ত নাশক আর শীঘ্র হজম হয়।
কাঁচা ছোটো আম কষায়, টক হয় এবং বাত আর রক্তপিত্তকারক হয়। কাঁচা বড়ো আমও এইরূপ অত্যন্ত টক, রুক্ষ, ত্রিদোষকারক তথা রুচিত রোগকে বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং এর সেবন করা উচিত নয়। ব্রহ্মচারীর জন্য কাঁচা আমের টক অত্যন্ত হানিকারক।
পেয়ারা -
পেয়ারা স্বাদু, কষায়, অত্যন্ত শীতল, বাতপিত্তনাশক, কফকারক, বীর্যবর্দ্ধক আর রুচিকারক হয়। এর যথাযথ সেবন স্বাস্থ্যের জন্য লাভদায়ক। এর সেবন করলে কারও কারও কোষ্ঠকাঠিন্য তথা ডায়রিয়া হয়।
কলা -
কলা সুস্বাদু, শীতল, রন্ধনে মধুর, বীর্যবর্দ্ধক, পুষ্টিকারক, রুচিপ্রদ, শরীরের মাংসকে বাড়িয়ে তোলে তথা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নেত্ররোগ আর প্রমেহনাশক হয়। কলাগাছের মূল কৃমিনাশক হয়। শুকনো কাঁচা কলার চূর্ণ হল উত্তম পৌষ্টিক পদার্থ। পুরোনো কাশি থাকলে কলার শরবত সেবন করা উচিত। কলার সেবন কারও-কারও কোষ্ঠকাঠিন্য করে।
আপেল -
আপেল বাত-পিত্তনাশক, পুষ্টিকারক, কফবর্দ্ধক, ভারী, শীতল, রুচিকারক, আর বীর্যবর্দ্ধক হয়। রস আর রন্ধনে মধুর হল। খুব রক্ত বাড়িয়ে তোলে। এর সেবন হিতকারী।
কমলা -
এটা মিষ্টি, টক, ভারী, অনেক কষ্টে হজম হয় তথা বীর্যবর্দ্ধক ও বাতনাশক হয়। টক কমলা অত্যন্ত উষ্ণ হয়। কমলা কোষ্ঠকাঠিন্য কারক হয় তথা টক ও উষ্ণ হওয়ার কারণে ব্রহ্মচারীর জন্য এটা হানিকারক, সুতরাং এর সেবন উচিত নয় তবে মিষ্টি কমলা অল্প মাত্রায় সেবন করা যেতে পারে।
নাশপাতি -
নাশপাতি ভারী, বীর্যবর্দ্ধক, মধুর আর ত্রিদোষনাশক হয়। সংস্কৃতে এর আরও একটা নাম আছে - অমৃতফল। এটা খুবই ভালো ফল।
লেবু -
লেবু উষ্ণ, পাচক, দীপন, টক, ত্রিদোষনাশক, চোখের জন্য হিতকারী, অতিশয় রুচিকারী, তিক্ত, কষায়, হালকা হয়। কফ, বাত, বমন, কাশি, কণ্ঠরোগ, ক্ষয়, কলেরা, বাতের ব্যথা, টিউমার আর কৃমিকে নষ্ট করে। গুণের দিক দিয়ে পাকা লেবু শ্রেষ্ঠ আর এগুলো কাগজি লেবুর গুণ। ব্রহ্মচারীর জন্য তো কাগজি লেবু হোক অথবা অন্য কোনো লেবু, সবগুলোই হানিকারক।
মিষ্টি লেবু বা শরবতী লেবু মধুর, ভারী, বাত, পিত্ত, সর্পবিষ, রক্তবিকার, শোধ, বমন, অরুচি তথা তৃষ্ণাকে নষ্ট করে। কফ সম্বন্ধীয় রোগকে দূর করে এবং বলদায়ক ও পুষ্টিকারক হয়। কাগজি লেবু আর শরবতী লেবুর মধ্যে কেবল পাতার ভেদ আছে। কাগজি লেবুর পাতা ছোটো আর শরবতী লেবুর পাতা বড় হয়।
জামির লেবু সুস্বাদু, টক, দীপন, হালকা, রক্তপিত্ত, কন্ঠ আর জিহ্বাকে শুদ্ধ করে। হৃদয়ের জন্য হিতকারী, শ্বাসরোগ, কাশি, অরুচি তথা তৃষ্ণাকে নষ্ট করে।
লেবুর অনেক ভেদ আছে, যথা - কাগজি, শরবতী, মিষ্টি লেবু, জম্বীর, জামির, চকোতরা, কমলা, সন্তরা, বিহারী আদি।
তেঁতুল -
কাঁচা তেঁতুল অত্যন্ত টক, উষ্ণ, মলরোধক, বাতনাশক, অগ্নিদীপন, রক্তপিত্ত, কফ আর রক্তকে দূষিত করে। সুতরাং স্বাস্থ্য এবং ব্রহ্মচর্য প্রেমীকে এর সেবন একদম করা উচিত নয়। সংস্কারবিধি বেদারম্ভ সংস্কারে মহর্ষি দয়ানন্দ জী ব্রহ্মচারীর জন্য "না অতি টক তেঁতুল আদি" লিখে তেঁতুল খেতে নিষেধ করেছেন। দক্ষিণ ভারতে এটা খাওয়ার প্রচার খুব বেশি, এটা হানিপ্রদ হওয়াতে একদম ত্যাজ্য।
সিঙ্ঘাড়া বা পানিফল -
পানিফল হল এক জলীয় ফল। এটা শীতল, সুস্বাদু, ভারী, গ্রাহী আর বীর্যবর্দ্ধক হয় আর বাত তথা কফের কারক হয়, তাছাড়া রক্তবিকার আর দাহকে নষ্ট করে।
তরমুজ -
তরমুজ শীতল, গ্রাহী, পিত্ত, দৃষ্টি আর বীর্যকে নষ্ট করে। পাকা তরমুজ উষ্ণ, ভারী, পিত্তকারক, বাত আর কফকে নষ্ট করে। এর সেবন ব্রহ্মচারীর জন্য হানিকারক।
পেঁপে -
পাকা পেঁপে মধুর, রুচিকারক, ভারী, মলরোধক, কফকারী, বীর্যবর্দ্ধক, বাত আর উন্মাদ রোগকে নষ্ট করে। পাচন প্রণালীকে ঠিক রাখতে সহায়ক হয়। এরমধ্যে রোগের কীটাণুকে ছিন্ন-ভিন্ন করার শক্তি আছে।
খেজুর -
খেজুর গুরু, শীতল, হৃদয়ের জন্য হিতকারী আর তৃপ্তিকারক হয়। রস আর রন্ধনে মধুর, কফকারক তথা রক্তপিত্ত জয়ী। বল-বীর্যবর্দ্ধক, অল্পায়ু, জ্বর, ডায়রিয়া, কাশি, শ্বাসরোগ আদিকে দূর করে। এটা বেশির ভাগ পশ্চিমী দেশে হয়।
খরবুজ বা খরমুজ -
খরবুজ বলদায়ক, মূত্রকারক, ভারী, স্নিগ্ধ, শীতল, বীর্যবর্দ্ধক, অতি সুস্বাদু, বাত তথা পিত্তনাশক হয়।
বেদানা বা ডালিম -
বেদানা তিন প্রকারের হয় - মিষ্টি, মিষ্টি ও টক তথা কেবল টক। মিষ্টি বেদানা ত্রিদোষ নাশক, তৃষ্ণা, দাহ, জ্বর, হৃদয়রোগ, কণ্ঠ আর মুখের রোগকে দূর করে। এটা তৃপ্তিকারক, বল-বীর্যবর্দ্ধক, হালকা, একটু তিক্ত, মলরোধক, স্নিগ্ধ আর মেধাজনক হয়। শ্রম, অরুচি আর নির্বলতাকে দূর করে।
মিষ্টি আর টক বেদানা দীপনকারী, রুচিকারী, একটু পিত্তকারক আর হালকা হয়।
টক বেদানা বাত কফ নাশক, পিত্তকারক, অগ্নিদীপন আর হালকা হয়।
আনার দানা - রুচিকারক, হৃদয়ের প্রিয়, দাহ আর তৃষ্ণাকে প্রশমন করে। বেদানার ফুল নাক দিয়ে আসা রক্তকে থামায় আর এর বল্কল কৃমিনাশক, মলরোধক আর আমাশয়কে দূর করে।
নারকেল -
নারকেলের জল স্নিগ্ধ, সুস্বাদু, বলদায়ক, বীর্যবর্দ্ধক, রুচিকারক হয় আর পিত্ত ও তৃষ্ণাকে দূর করে।
সাধারণ নারকেল স্বাদু, রন্ধনে মধুর, ভারী, দুর্জর (দেরিতে হজম হয়), মলকারক, পিত্তনাশক, কৃমিবর্দ্ধক, জঠরাগ্নিকে মন্দ করে আর কামদেবের বলকে বাড়িয়ে তোলে। সুতরাং ব্রহ্মচারীকে এর সেবন করা উচিত নয়।
বাদাম -
বাদাম মসৃণ, গরম, বীর্যবর্দ্ধক, ভারী আর বাতনাশক। বাদামের গিরী বীর্যবর্দ্ধক, বলদায়ক, কফকারক আর বাত পিত্ত নাশক হয়। রক্তপিত্তের রোগীর জন্য ঠিক নয়। বাদামের গিরীকে সায়ংকালে জলে ভিজিয়ে প্রাতঃকালে দুধ বা জলের সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে শরীর আর মস্তিষ্কের খুশকি তথা উষ্ণতা দূর হয়, বল-বীর্যের বৃদ্ধি হয়। ব্রহ্মচারীকে বাদামের সেবন এইভাবেই করা উচিত, অন্যথা উষ্ণ হওয়াতে হানিকারক হবে।
শাক (সব্জি)
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অনুসারে পাতা, ফুল, ফল, ডগা, কন্দ আর সংস্বেদজ হিসেবে ছয় ধরণের সব্জিকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। প্রায়শঃ সব শাক বিষ্টম্ভী কোষ্ঠকাঠিন্যকারী তথা ভারী হয়। শুষ্ক, অনেক মলকারক, অপানবায়ু তথা মল অপসারণকারী হয়। পাতার তুলনায় পুষ্প, পুষ্পের তুলনায় ডগা, ডগার তুলনায় ফল, ফলের তুলনায় কন্দ আর কন্দের তুলনায় সংস্বেদজ শাক উত্তরোত্তর ভারী হয়।
"শাকেষু সর্বেষু বসন্তি রোগাঃ" সবপ্রকারের শাকের মধ্যে রোগ নিবাস করে। এর পুষ্টি আচার্য চাণক্য জীও করেছেন - "শাকেন রোগা বর্ধন্তে" শাক থেকে রোগ বাড়ে। অধিক মাত্রায় শাকের সেবন হাড়ের ভেদন, নেত্র জ্যোতি, বুদ্ধি, স্মরণশক্তি, বর্ণ, রক্ত আর বীর্যের নাশ করে। এছাড়াও আরও অনেক হানিকারক দ্রব্য গুণ বিজ্ঞ-বিদ্বানগণ বলেছেন।
.
শাকের মধ্যে ক্ষার লবণের মাত্রা অধিক পরিমাণ থাকে আর এর অধিক সেবন করলে শরীরে ক্ষার লবণের মাত্রা অধিক হবে, তারফলে স্বপ্নদোষ, প্রমেহ আদি রোগের উৎপত্তি হবে। শাক অধিক মাত্রায় কখনও খাওয়া উচিত নয়। প্রাকৃতিক চিকিৎসকরা শাকের সেবন অধিক মাত্রায় করার কথা বলেন কিন্তু এটা শাস্ত্রবিরুদ্ধ। শাকের যেমন গুণ আছে তেমনই বিশেষ কয়েকটা দোষও আছে। নিজের প্রকৃতি আদির উপর চিন্তা-ভাবনা করে অল্প পরিমাণ শাক-সব্জির সেবন করা উচিত। গুণ-দোষ বিচার করে পদার্থের সেবন করলেই স্বাস্থ্য রক্ষা, বল, বুদ্ধি, আয়ু, তেজ, কান্তি আদির বৃদ্ধি হবে। সুতরাং যেসব শাক অধিক লাভদায়ক আর হানি কম করবে, সেগুলোকেই বেছে নিয়ে একটু বিস্তারভাবে লিখে দিচ্ছি। যেসব শাক নিষিদ্ধ তথা হানিকারক, সেগুলোর সূচী এই প্রকরণের শেষে দেওয়া হয়েছে। পাঠক লাভ নিবেন।
পত্র-শাক
ছোলার শাক -
এটা খুব কব্জকারক, কফ তথা বাতের রোগকে বাড়িয়ে তোলে, টক আর বিষ্টম্ভকারক হয়, সুতরাং গুণকারী নয়। তবে এটা পিত্তনাশক তথা দাঁতের প্রদাহকে দূর করে।
মটরের শাক -
মটরের শাক মলভেদক, হালকা, স্বাদু, শীতল, কষায়, পুষ্টিপ্রদ, বাতকারক, কফ আর পিত্তনাশক। এর সেবন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
কাসুন্দির পাতার শাক -
কাসুন্দির পাতার শাক রুচিকারক, বীর্যবর্দ্ধক, কাশি, বিষ আর রক্তবিকার নাশক হয়। বাত আর কফের রোগকে দূর করে, পাচক তথা কণ্ঠশোধক হয়। উষ্ণ হওয়ার কারণে সেবন করা উচিত নয়।
মেথি শাক -
মেথির পাতার শাক বানিয়ে মানুষ সেবন করে, এটা কষায়, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ আর রুক্ষ হয়। বাত আর কফের রোগীকে ওষুধরূপে এর সেবন করালে লাভ হয়। স্বাস্থ্য আর ব্রহ্মচর্য প্রেমীকে দৈনিক ভোজনে এর সেবন করা উচিত নয়।
সরষে শাক -
সরষে শাক স্বভাবেই অহিতকর - হানিকারক হয়। এরমধ্যে মলভাগ অধিক থাকে, পোষকতত্ত্ব নামমাত্রের থাকে। নিঘন্টুকার "শাকেষু নিন্দিতম্" সব শাককে নিন্দিত বলার পাশাপাশি লিখেছেন সরষের শাক ঝাঁঝালো, মল-মূত্রকে অত্যধিক বাড়িয়ে তোলে, ভারী, রন্ধনে টক, জ্বলনকারী, গরম, শুকনো আর ত্রিদোষকারক হয়। এটা স্বাদু হলেও হানিকারক, সুতরাং এর সেবন একদম করা উচিত নয়।
নটে শাক (লাল শাক) -
এই শাক হালকা, মধুর, শীতল, রুক্ষ, রুচিকারক, অগ্নিদীপন, পিত্ত, কফ তথা রক্তের দোষকে হরণকারী, মলমূত্র অপসারণকারী, সব ধরণের বিষের নাশ আর পেটের সব বিকারকে দূর করে। ডাক্তারের মতানুসারে এতে ভিটামিন C -এর মাত্রা প্রচুর পরিমাণে আছে।
এটা প্রায়শঃ সব প্রান্তে তথা সব ঋতুতে পাওয়া যায়। আর্দ্রভূমিতে তথা বর্ষা আর শীতকালে এই শাক অধিক হয়। এটা সমূহের সঙ্গে পাওয়া যায়, এর কান্ড এক ফুট থেকে দেড় হাত পর্যন্ত লম্বা দেখা যায়। এর কান্ড অনেক শাখা যুক্ত ঝোপের সমান কিন্তু নরম হয়। এর ফল ছোটো-ছোটো গুচ্ছাকার তথা বীজ অত্যন্ত ছোটো আর কালো রঙের হয়।
নটে শাকের আরও একটা ভেদ আছে যাকে পানীধ তণ্ডুলীয় তথা কঞ্চরও বলে। এটা জলীয় প্রদেশে অধিক পাওয়া যায়। এটা হালকা, তিক্ত, রক্তপিত্তনাশক আর বাতের রোগকে নষ্ট করে।
নটে শাকের মূল গরম, কফনাশক, স্ত্রীদের রজকে থামাতে তথা রক্তপিত্ত আর প্রদর (মহিলাদের সাদা স্বাব) রোগকে নষ্ট করে। এইরূপ অন্য অনেক রোগে নটে শাক উপযোগী।
পালক -
পালক শাক বাতবিকার কারী, শীতল, কফকারক, ভেদক, ভারী, বিষ্টম্ভজনক তথা মদ (নেশা), শ্বাসরোগ, রক্তপিত্ত আর বিষনাশক হয়। রক্তের বিকারকে শান্ত করে, উদরের সব রোগ দূর করে। ডাক্তারের মতানুসারে পালকের মধ্যে চুন, লোহা, আয়োডিন, ক্লোরিন, গন্ধকাদি লবণ আবশ্যকতার অধিক পাওয়া যায়। এরমধ্যে জীবনীয়তত্ত্ব (ভিটামিন C) প্রচুর মাত্রায় বিদ্যমান আছে। পালকের সেবন ভোজনে প্রতিদিন করা যেতে পারে। এই শাক সব ঋতু তথা সব স্থানে উৎপন্ন হয়।
পুদিনা -
পুদিনা শাক রোচক, মধুর, গুরু, হৃদয়ের জন্য লাভপ্রদ আর সুখদায়ক হয়। কফ, কাশি, অগ্নিমান্দ্য, বিসূচিকা (কলেরা), সংগ্রহণী (IBS), ডায়রিয়া, জীর্ণজ্বর, আর কৃমিনাশক হয়। এর সেবন করলে বাত আর কফের দোষ দূর হয়, রক্তকে খুব শুদ্ধ করে, জঠরাগ্নিকে তীব্র করে। কলেরার দিনে সেবন করলে কলেরা হয় না। তৃষ্ণার তৃপ্তি করে। চোখের জন্য হিতকারী। ঘরে কোনো শাক রান্না করলে এই শাকের পাতাও তারমধ্যে দেওয়া উচিত। এরমধ্যে ভিটামিন A পর্যাপ্ত মাত্রায় আছে।
বথুয়া -
বথুয়ার গুল্ম লাল তথা সবুজ পাতা দুই প্রকারের হয়। বথুয়ার গুল্ম (গাছ) এক হাত থেকে চার হাত পর্যন্ত উঁচু হয়। ছোটো বথুয়ার পাতা মোটা, পাতলা তথা সবুজ রঙের হয় আর বড় বথুয়ার পাতা বড় আর পুষ্ট হলে লাল রঙের হয়। বথুয়া বেশিরভাগ যব আর গমের ক্ষেতে উৎপন্ন হয়। এটা শীতকাল তথা গরমের শুরুতে ভারতের সব প্রান্তে পাওয়া যায়, এর ফুল ছোটো তথা সবুজ হয় আর তাতে কালো রঙের ছোটো বীজ থাকে। বথুয়ার মধ্যে এক প্রকারের ক্ষার আছে। ডাক্তারের মতানুসারে এরমধ্যে ভিটামিন C প্রচুর মাত্রায় আছে।
বথুয়ার গুণ -
বাস্তুকম্ তু মধুরম্ সুশীতলম্ ক্ষারমীষদম্লম্ ত্রিদোষজিৎ ।
রোচনম্ জ্বরহরম্ মহার্শসাম্ নাশনম্ চ মলমূত্রশুদ্ধিকৃত্।। (রাজনিঘন্টু)
বাস্তূকদ্বিতীয়ম্ স্বাদু ক্ষারম্ পাকে কটূদিতম্ ।
দীপনম্ পাচনম্ রুচ্যম্ লঘু শুক্রবলপ্রমদ ।।
সরম্ প্লীহাস্রপিত্তার্শঃ কৃমিদোষত্রয়াপহম্ ।।
(ভাবপ্রকাশঃ)
উভয় প্রকারের বথুয়া স্বাদে মধুর, নোনতা, রন্ধনে ঝাঁঝালো, একটু অম্ল আর সুশীল হয়। এটা রুচিবর্দ্ধক, হালকা, দীপন, পাচনকারী, বল-বীর্য বৃদ্ধিকারী, প্লীহা, রক্তপিত্ত, জ্বর, সব ধরণের অর্শ আর কৃমিরোগের নাশক হয়। ত্রিদোষ দূর করে আর রেচক অর্থাৎ মল-মূত্রের শুদ্ধি কারক। এর দ্বারা পেটের খুব ভালো শুদ্ধি হয়।
বাস্তূকোऽগ্নিকরো রসে চ মধুরঃ পিত্তাপহশ্চা ক্ষুষঃ,
স্নিগ্ধো বাতবিনাশনঃ কৃমিহরঃ পিত্তাদিদোষাপহঃ ।
বর্চোমূত্রবিশোধনঃ প্রথমতঃ, শ্লেষ্মাময়ানাম্ তথা,
শাকানামপি চোত্তমো লঘুতরঃ পথ্যঃ সদা প্রাণিনাম্ ।।
(শালিগ্রাম নিঘন্টুঃ)
বথুয়া জঠরাগ্নিকে দীপ্ত করে, রসে মিষ্টি, পিত্তনাশক, চোখের জন্য হিতকারী, স্নিগ্ধ, কৃমিনাশক, পিত্তাদি দোষ নষ্ট কারী, মল-মূত্র শোধক, শাকের মধ্যে উত্তম আর হালকা তথা কফ রোগী ব্যক্তির জন্য সর্বদাই হিতকারী।
.
চরক শাস্ত্রের মধ্যে বলা হয়েছে বথুয়াতে "ভিন্নবর্চস্তু বাস্তুকম্" মল ভেদনকারী গুণ অন্য শাকের তুলনায় বিশেষ আছে।
লাল বথুয়া -
সক্ষারঃ কৃমিজিৎ ত্রিদোষশমনঃ সন্দীপনঃ পাচনঃ
চক্ষুষ্যো মধুরঃ সরো রুচিকরো বিষ্টম্ভশূলাপহঃ ।
বর্চোমূত্রবিশোধনঃ স্বরকরঃ স্নিগ্ধো বিপাকে গুরুর্বাস্তূকঃ সকলাময়প্রকাশমনশ্চিল্লী তদেবোত্তমা ।। (সুষেণ)
লাল বথুয়া ক্ষারযুক্ত, কৃমিনাশক, ত্রিদোষ শমনকারী, দীপন, পাচন, চোখের জন্য হিতকারী, সারক, রুচিকারক, বিষ্টম্ভ (কোষ্ঠকাঠিন্য) আর শূলনাশক, মল-মূত্র শোধক, স্বরকে উত্তমকারী, স্নিগ্ধ, রন্ধনে ভারী, সব ধরণের রোগকে শান্তকারী আর সবথেকে উত্তম শাক এটা।
চিল্লী বাস্তুকতুল্যা চ সক্ষারা শ্লেষ্মপিত্তনুৎ ।
প্রমেহমূত্রকৃচ্ছ্রধ্নী পথ্য চ রুচিকারিণী । (রাজনিঘন্টু)
চিল্লী (লাল বথুয়া) হল অন্য বথুয়ার সমান গুণযুক্ত। এটা ক্ষারযুক্ত, কফ, পিত্ত, প্রমেহ নাশক, মূত্রকৃচ্ছ্রনিবারক, পথ্য আর রুচিকারক হয়।
বাস্তুকম্ মধুরম্ হৃদ্যম্ বাতপিত্তার্শসাম্ হিতম্ । (হ. স.)
বথুয়া মধুর, হৃদয়ের জন্য হিতকারী তথা বাতপিত্ত আর অর্শ রোগীর জন্য হিতকারী।
পুষ্পের শাক (সব্জি)
কলার ফুলের শাক -
স্নিগ্ধ, মধুর, কষায়, ভারী, শীতল, বাতপিত্ত, রক্তপিত্ত তথা ক্ষয়কে নষ্ট করে। অল্প মাত্রায় সেবন করা উচিত।
সজনে ফলের শাক (সব্জি) -
তীক্ষ্ণ আর গরম হয়, ব্রহ্মচর্য প্রেমিকে এর সেবন করা উচিত নয়। কিন্তু এর যথাযথ সেবন করলে ফুলে যাওয়া, কৃমি, বাত, কফ, বিদ্রধি, তিল্লী তথা গুল্মরোগ দূর হয়। সুতরাং উপরোক্ত রোগীকে এর সেবন করা উচিত।
শিমুলের ফুল -
রস রন্ধনে মধুর, কষায়, শীতল, ভারী, গ্রাহী, বাতকারক আর কফ তথা পিত্তকে নষ্ট করে। মহিলাদের অসহনীয় লিউকোরিয়াতে (সাদা স্রাব) এই ফুলের শাক ঘী দিয়ে রান্না করে সন্ধক লবণ মিশিয়ে খেলে সেরে যায়।
ফলের শাক (সব্জি)
কুমড়ো -
পুষ্টিকারক, বীর্যবর্দ্ধক, ভারী, পিত্ত তথা রক্তবিকার, রক্তপিত্ত তথা বাত রোগ নষ্ট করে। কাঁচা কুমড়ো শীতল আর পিত্তনাশক হয়, মধ্যম কুমড়ো কফকারক হয়, আর পাকা কুমড়ো একটু শীতল, স্বাদু, ক্ষারযুক্ত, অগ্নিদীপক, হালকা, মূত্রাশয়কে শুদ্ধ করে তথা মানসিক রোগ অপস্মার (মৃগী), উন্মাদাদি (পাগলামো) দূর করে। এটা সব দোষের বিজয়ী, তবে এইসব গুণ মিষ্টি কুমড়োতে আছে। এর থেকে কুষ্মাণ্ডাবলেহ তৈরী হয়, যা অসাধ্য রক্তক্ষরণ আদি রক্তপিত্ত রোগের রামবাণ ওষুধ হয়। কিন্তু বাজারে যে কুমড়ো বিক্রি হয় যার সব্জি প্রায় সবাই খুব খায়, তাতে উপরোক্ত গুণ নেই। কিছু বিদ্বান তো একে তামসিক তথা ব্রহ্মচার্যের জন্য হানিকারক মানেন।
বাজারের কুমড়োতে মল ভাগ অধিক থাকে, শরীরের পোষক তত্ত্ব সার ভাগ নামমাত্রই থাকে। বায়ু রোগকে বাড়ায়, পেটে গ্যাস (Flatulence) আদি রোগ উৎপন্ন করে, জঠরাগ্নিকে মন্দ করে। সুতরাং বাজারের সব্জি ওয়ালা কুমড়ো খাওয়া উচিত নয়। মিষ্টি কুমড়োকে শাকাদি বানিয়ে সেবন করা লাভদায়ক কিন্তু মানুষ একে কেবল মিষ্টি বানানোর জন্য মনে করে, সব্জি বানিয়ে এর সেবন করে না, এটা ভারী ভুল।
ধুঁধুল -
শীতল, মধুর, কফ তথা বাতকারক, পিত্তনাশক, অগ্নিদীপক আর শ্বাসরোগ, জ্বর, কাশি আর কৃমিরোগকে নষ্ট করে। এটা হালকা হওয়ার জন্য সব প্রকারের রোগীর জন্য পথ্য।
পটল -
এটা ফলের সব্জির মধ্যে সর্বোত্তম। এটা গরম, হালকা, পাচক, স্নিগ্ধ, অগ্নিদীপক আর হৃদয়ের জন্য হিতকারী হয়। তাছাড়া কাশি, কৃমি, রক্তবিকার তথা ত্রিদোষ সম্বন্ধীয় রোগের বিনাশক। এটা বীর্যবর্দ্ধক, সুতরাং ব্রহ্মচারী আর স্বাস্থ্য প্রেমীদের জন্য এটা খুবই ভালো একটা সব্জি। বাংলা, বিহার আদি প্রদেশে এটা অধিক পাওয়া যায়।
টিন্ডা -
টিন্ডা রুচিকারক, মলভেদক, খুব শীতল, বাতকারক, রুক্ষ, মূত্রবর্ধক হয়, কফ তথা পাথরী রোগ নষ্ট করে। সাধারণত একে ভালো সব্জি মানা হয়।
লাউ -
হৃদয়ের প্রিয়, পিত্ত তথা কফনাশক, ভারী, বীর্যবর্দ্ধক, রুচিকারক আর ধাতুকে পুষ্টকারী হয়।
শসা -
কাঁচা শসা শীতল, গ্রাহী, মধুর, ভারী, রুচিকারক আর পিত্তকে নষ্ট করে। পাকা শসা তৃষ্ণা অগ্নি আর পিত্তকারক হয়।
সিম -
রস তথা রন্ধনে মিষ্টি, শীতল, ভারী, বলদায়ক, দাহকারক, কফকারক, বাত আর পিত্তকে নষ্ট করে।
বেগুন -
বেগুন খুব গরম হয়, এর সেবন অর্শ, প্রমেহ, স্বপ্নদোষ আদি রোগ উৎপন্ন করে। ব্রহ্মচারী তথা স্বাস্থ্যপ্রেমীকে ভুলেও এর সেবন করা উচিত নয়। কেবল একবার তথা অল্প মাত্রায় খেলেই বীর্যনাশ করে।
কন্দ-শাক (সব্জি)
আলু -
আলুর সব্জি খুব অধিক মাত্রায় তথা সব দেশে পাওয়া যায়। কিন্তু এর গুণ দোষের বিষয়ে বড় ভ্রান্তি আছে। চরক শাস্ত্রের মধ্যে আলুর বিষয়ে লেখা আছে - "আলূকঃ কন্দানাম্ প্রকৃত্যৈব অহিততমানামাহারবিকারাণাম্" সব কন্দের মধ্যে আলু সাধারণত সবথেকে অধিক অহিতকর অর্থাৎ হানিকারক। যে আলুর প্রশংসা করতে-করতে আধুনিক ডাক্তার আর তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায় ক্লান্ত হয় না, আমাদের ঋষিদের দৃষ্টিতে সেটাই কন্দের মধ্যে সবথেকে অধিক হানিকারক সব্জি। প্রাচীন কালে পাহাড় পর্বতে জঙ্গলী রূপে এটা উৎপন্ন হতো, এর ক্ষেতি কেউই করতো না আর সব্জি রূপে এর ব্যবহারও হতো না। প্রায় দুই সহস্র বছর হয়েছে, তখন থেকে এটা ক্ষেতে বপন করা হয় আর আজ তো এটা মানব সমাজের ভোজনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে গেছে। স্কুল, কলেজ, গুরুকুল, পাঠশালা, পুলিশ, সেনা, হোটেল, হোস্টেল (ছাত্রাবাস) সবার পাকশালাতে একমাত্র এর শাসন দেখা যায়। এর স্বাদু আর স্থায়ী হওয়ার কারণে এটা আমাদের প্রিয় ভোজ্য পদার্থ হয়ে গেছে। এর দোষের উপর কারও ধ্যান নেই, চোখে পট্টি বেঁধে এর গুণ দোষ বিচার না করে সারা মানব-সমাজ একে মাথায় তুলে রেখেছে। সংক্ষেপে এর বিষয়ে লিখে দিচ্ছি, বিস্তার-পূর্বক অন্য কোনোদিন স্বতন্ত্র নিবন্ধই লিখে দিবো।
.
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মতানুসারে -
আলুকম্ শীতলম্ সর্ববিষ্টম্ভি মধুরম্ গুরু ।
সৃষ্টমূত্রমলম্ রুক্ষম্ দুর্জরম্ রক্ষপিত্তনুত্ ।।
আলু হচ্ছে শীতল, মধুর, রুক্ষ, শুষ্ক, হজমে ভারী আর দুর্জর আলস্য কারক, বিষ্টম্ভি, মলকে থামিয়ে তথা কঠিন করে কোষ্ঠকাঠিন্য করে, মল-মূত্রকে বাড়ায় তথা কামোদ্দীপক অর্থাৎ কামবাসনাকে বাড়িয়ে তোলে। য়ুনানী মতানুসারেও এটা প্রথম শ্রেণীর শীতল তথা রুক্ষ, পাক্কাশয় (পরিপাকতন্ত্র) -কে মন্দ করে তথা কোষ্ঠকাঠিন্য উৎপন্ন করে। কারও কারও মতে এটা রক্তকে খারাপ করে তথা চুলকানি উৎপন্ন করে। বায়ু আর কফকে কুপিত করে। এটা এতই রুক্ষ হয় যে যদি এর দ্বিগুণ মাত্রায় ঘী এরসঙ্গে খাওয়া যায়, তাহলেও এটা রুক্ষই করে আর রুক্ষতার কারণে মলবন্ধ (কোষ্ঠকাঠিন্য) হয় তথা এরফলে প্রায়শঃ স্বপ্নদোষ হতে থাকে, সুতরাং এর সেবন কারী একে গরম মনে করে, যদিও এটা শীতল আর শুষ্ক। দুই-চার দিন ক্রমাগত খেলে স্বপ্নদোষ, বীর্যনাশ আদি কুপরিণাম প্রত্যক্ষ দেখা যায়। এর সেবন করলে জ্বর, কাশি তথা শ্বাসরোগ পর্যন্ত হয়। এটা রুক্ষ হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের রুক্ষতা বাড়ায়, জ্বরকে স্থায়ী রাখে। চোখের খুব হানি করে। স্বাস্থ্যপ্রেমী ব্যক্তি তথা ব্রহ্মচারীকে ভুলেও এর সেবন করা উচিত নয়। সব প্রকারের আলুর মধ্যে দোষ আছে। নিরন্তর আলুর সেবন করলে বাতের রোগ (Arthritis) হয়। এটা মূত্রনলিকাতে জ্বলন উৎপন্ন করে, তাছাড়া ধাতব ব্যাধি (gonorrhea), ফিরিঙ্গি রোগ বা গর্মি রোগ (syphilis), মুত্রকৃচ্ছ্ররোগবিশেষ (Strangury) এর সেবন করলে উৎপন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে আলুর সেবন করলে অধিক হানি হয়। যার কোষ্ঠবদ্ধতা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ আছে, আলুর সেবন তাদের অধিক হানি করে। পিত্ত, বাত তথা রক্ত সম্বন্ধীয় রোগে আলুর সেবন করাতে উল্টো পরিণাম দেখতে পাওয়া যায়। যদি এর রুক্ষতার দোষকে চেপে রাখার জন্য ঘীয়ের সেবন এর সাথে অধিক করা হয়, তাহলে এর সেবনে চর্বি অধিক বেড়ে যাবে আর পেটও অনেক বড় হবে। এর গুণ কেবল নামমাত্রই আছে, যেমন বিষাক্ত দুধ, দুধ তো আছে কিন্তু সঙ্গে বিষ মেশানো আছে, সুতরাং এর সেবন ভোজনে একদম করা উচিত নয়।
মূলা -
মূলা দুই প্রকারের হয়। একটা ছোট মূলা, যাকে সংস্কৃতে লঘুমূলক বলে। এটা ঝাঁঝালো, গরম, রুচিকারক, হালকা, পাচক, ত্রিদোষনাশক, স্বরকে উত্তম করে, জ্বর, শ্বাসরোগ, নাসিকারোগ, কণ্ঠরোগ তথা নেত্ররোগ নাশক হয়। আরেকটা বড় মূলা যেটা রুক্ষ, গরম, ভারী আর ত্রিদোষকারী হয় আর যদি ঘী আদি দিয়ে রান্না করা হয় তাহলে ত্রিদোষনাশক হবে। মূলা অন্য ভোজনকে হজম করায় কিন্তু স্বয়ং কব্জ করে। অর্শ রোগীর জন্য মূলার সব্জি অমৃতের সমান লাভদায়ক হয়, তাছাড়া যকৃৎ তথা প্লীহার রোগীর জন্যও লাভদায়ক হয়।
.
মূলা পাতার শাক - পাচক, হালকা, রুচিকারক আর গরম হয়। ঘী দিয়ে রান্না করা মূলা শাক ত্রিদোষনাশক আর ঘী ছাড়া মূলাশাক কফ তথা পিত্ত কারক হয়।
.
গাজর -
গাজর - তীক্ষ্ণ, মধুর, তিক্ত, গরম, অগ্নি দীপনকারী, হালকা, গ্রাহী আর রক্তপিত্ত, অর্শ, ডায়রিয়া, কফ তথা বাত সম্বন্ধীয় রোগের নাশ করে। কালো গাজর সবথেকে ভালো। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন আছে, সুতরাং যকৃতে শক্তি দেয় তথা যকৃত সম্বন্ধীয় সব রোগকে দূর করে আর রক্ত বাড়ায়। নির্ধনদের কাছে এটা আপেল। যারা এর সেবন করে তারা শীতকালে লাল হয়ে যায়। এটা যেহেতু রাজসিক তাই অবশ্যই রজোগুণের বৃদ্ধি করে। ডাক্তারের মতানুসারে এতে প্রায় সব ভিটামিন আছে। গাজর কাঁচা খেলেও ভালো লাভ হয়। এটা শরীরের ত্বককে সুন্দর করে তোলে তথা রক্তকে শুদ্ধ করে। স্বাস্থ্যের জন্য এর সব্জি খুবই ভালো।
.
কপি-শাক -
কপির শাক মানুষ খুব খায় কিন্তু এর দোষ সম্বন্ধে মানুষ পরিচিত নয়। এটা তিন প্রকারের হয় যথা - ফুলকপি, বাঁধাকপি আর পত্রকপি। ফুলকপি তথা বাঁধাকপি এই দুটো সুস্বাদু, মধুর, শীতল, খুব দেরিতে হজম হয় তথা বায়ুর রোগ উৎপন্ন করে, তাছাড়া পেটের সব রোগকে উৎপন্ন করে। অজীর্ণ তথা কোষ্ঠকাঠিন্য করা এর সর্বপ্রথম কাজ। সুতরাং ব্রহ্মচারী তথা স্বাস্থ্যপ্রেমী ব্যক্তিদের উচিত এর সেবন একদম না করা।
.
পত্রকপি ভারী তথা শীতল হয় আর বায়ু করে। মলবন্ধ অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্যকে দূর করে। এরমধ্যে এটাই গুণ আছে যে এটা পেটের শুদ্ধি করে। যদি কেউ কপি খেতে ইচ্ছুক তাহলে পত্রকপির সেবন করা উচিত। কিছু ব্যক্তি একে ভালো সব্জি বলেন আর ডাক্তারের মতানুসারে এতে ভিটামিন A.B.C.D.E. বিদ্যমান আছে।
.
গৃঞ্জন (শালগম) -
গৃঞ্জন শব্দ আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে তিনটা অর্থে ব্যবহার হয়েছে - ১ গাজর, ২ শালগম আর ৩ রসুন। কিন্তু মুখ্যরূপে গৃঞ্জনের ব্যবহার শালগম অর্থেই হয়েছে, এর নাম তথা গুণ দেখেই তা সিদ্ধ হয়। যারা গৃঞ্জনের মুখ্যার্থ গাজর মনে করে এটা তাদের ভ্রান্তি। মহর্ষি মনু মনুস্মৃতির পঞ্চম অধ্যায়ে "লশুনম্ গৃঞ্জনম্ চৈব পলাণ্ডুম্ কবকানি চ" বলে রসুন, শালগম, পিয়াঁজ আদি দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থকেই অভক্ষ্য বলেছেন, গাজরকে বলেন নি।
.
রাজনিঘন্টুতে শ্রী নরহরি জী গৃঞ্জনের সমার্থক শব্দে লিখেছেন -
গৃঞ্জনম্ শিখিমূলম্ চ য়বনেষ্টম্ চ বর্তুলম্ ।
গ্রন্থিমূলম্ শিখাকন্দম্ কন্দম্ ডিণ্ডীরমোদকম্ ।।৫৫।।
(রাজনিঘন্টৌ চতুর্থো বর্গঃ)
.
এখানে দেওয়া সব নাম দ্বারা গৃঞ্জন শব্দের অর্থ শালগম সিদ্ধ হচ্ছে। শিখিমূল আর শিখাকন্দ তাকে বলে যার মূলে শিখা আছে আর যেটা শিখাযুক্ত কন্দ। এইভাবে বর্তুল গোল এটাও শালগমেই হয়। য়বনেষ্ট অর্থাৎ য়বনদের প্রিয়, কারণ তারা বেশিরভাগ রসুন, পিয়াঁজ, শালগম আদি দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থই পছন্দ করে। ডিণ্ডীরমোদক নাম দ্বারা লাড্ডুর মতো আকৃতি প্রতীত হয়, সেটা কেবল শালগমই হতে পারে। এর গুণ -
.
গৃঞ্জনম্ কটুকোষ্ণম্ চ কফবাতরুজাপহম্ ।
রুচ্যম্ চ দীপনম্ হৃদ্যম্ দুর্গন্ধগুল্মনাশনম্ ।।৫৬।।
(রাজনিঘন্টৌ চতুর্থো বর্গঃ)
.
গৃঞ্জন - তিক্ত, উষ্ণ, কফ তথা বাতের রোগকে নষ্ট করে, রুচিকারী, দীপন, হৃদয়ের জন্য হিতকারী, দুর্গন্ধযুক্ত আর গুল্মনাশক হয়। এতে দুর্গন্ধযুক্ত বলাতে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে এটা শালগমই হবে কারণ শালগমে দুর্গন্ধ আছে তথা গাজরে নেই। আর যদি রসুন ও পিয়াঁজ অর্থ করা হয় তাহলে সেটাও হবে না, কারণ মনু জী যেখানে গৃঞ্জনের নিষেধ করেছেন সেখানে তারসঙ্গে পিয়াঁজ আর রসুনেরও নিষেধ করেছেন।
.
শব্দকল্পদ্রুপ তো পুরোপুরি ভ্রম দূর করে দিয়েছে -
"গৃঞ্জনম্ ক্লী । মূল বিশেষঃ । শলগম ইতি খ্যাতঃ।" গৃঞ্জন লৌকিক ভাষায় শলগম নামে প্রসিদ্ধ, এমন লেখা আছে।
.
বৈজয়ন্তী কোষকার গৃঞ্জনের পিঁয়াজের দশ জাতির উল্লেখ করেছেন।
.
ফরুণ্ডুশ্চ পলাণ্ডুশ্চ লক্ষার্কশ্চ পরারিকা ।
গৃঞ্জনো য়বনেষ্টশ্চ পলাণ্ডোর্দশজাতয়ঃ ।।২০৭।।
(ভূমিকান্ডে বনাধ্যায়ঃ)
আসলে এটা পলাণ্ডু অর্থাৎ পিঁয়াজেরই এক জাতিবিশেষ, এর আকার অনেকটা পিঁয়াজের সমান আর এরমধ্যে পিঁয়াজের মতোই দুর্গন্ধ আছে। সুতরাং গৃঞ্জন অর্থ সাধারণত শলগমই হবে, আর এর সেবন করা হানিকারক তথা মনুস্মৃতির অনুসারে এটা অভক্ষ্য পদার্থ।
.
মিষ্টি আলু বা রাঙা আলু (শকরকন্দী) -
মিষ্টি আলু হল শীতল, মধুর, ভারী, কফ তথা বাত কুপিতকারী, বীর্যবর্দ্ধক, পিত্তনাশক, তৃপ্তিকারক, দাদ, প্রদাহ, প্রমেহ, ব্রণ, মূত্রকৃচ্ছ্র আদি রোগের নাশকারী, বলকারক, পুষ্টিজনক, স্বাদু কন্দ সব্জি। এর সেবন ব্রহ্মচারীর জন্য লাভদায়ক। তবে নিজের পাচনশক্তির উপর ধ্যান রেখে এর ইচ্ছেমত সেবন করা উচিত।
.
জিমিকন্দ (ওল) -
অগ্নিদীপক, শুষ্ক, কষায়, ঝাঁঝালো, বিষ্টম্ভী, বিশদ, রুচিকারক, হালকা তথা কফ আর অর্শ রোগের নাশক। প্লীহা তথা টিউমারকে এই সব্জি নষ্ট করে। এছাড়াও অনেক রোগকে এই সব্জি নষ্ট করে। সুতরাং "সর্বেষাম্ কন্দশাকানাম্ সূরণঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে" সমস্ত কন্দ শাক-সব্জির মধ্যে ওলকে শ্রেষ্ঠ ধরা হয়। কিন্তু এটা উষ্ণ তথা রুক্ষ হওয়াতে ব্রহ্মচর্যকে নষ্ট করে। সুতরাং ব্রহ্মচারী তথা সামান্য মানুষকে সব্জি রূপে এর সেবন করা উচিত নয়। এছাড়া এটা দাদ, রক্তপিত্ত, কুষ্ঠ তথা চুলকানি আদি রোগ উৎপন্ন করে।
.
কদলীকন্দ (কলার কন্দ) -
কলার কন্দ শীতল, বলদায়ক, চুলকে উত্তম করে, অম্ল-পিত্তকে নষ্ট করে, অগ্নিকারক, মধুর আর অগ্নিবর্দ্ধক হয়।
.
মানকন্দ (মানকচু) -
মানকচু শীতল, হালকা, সুজন তথা রক্তপিত্তনাশক হয়।
.
বিদারী কন্দ -
পিত্তকারক, উষ্ণ, বলদায়ক, ঝাঁঝালো কড়া, রসায়ন, আয়ু-বীর্য তথা অগ্নিবর্দ্ধক হয়। প্রমেহ, কুষ্ঠ, কফ তথা বাত বিনাশক হয়।
.
কাসেরু -
উভয় প্রকারের শীতল, মধুর, ভারী, বীর্যবর্দ্ধক, কফবর্দ্ধক, পিত্ত-রক্তের রোগ তথা প্রদাহ রোগকে নষ্ট করে।
.
রতালু -
মলস্তম্ভক, ভারী, মূল স্নিগ্ধ হয়, সুতরাং কোষ্ঠকাঠিন্য করে আর অনেক দেরিতে হজম হয়। যদি সঠিকভাবে হজম হয় তাহলে বলকারক হয়। ঘীয়ের সঙ্গে রান্না করে সেবন করলে কফনাশক তথা রুচিপ্রদ হয়। তীব্র জঠরাগ্নি ব্যক্তিকে অল্প মাত্রায় সেবন করা উচিত। কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়াতে লাভের স্থানে হানিই করবে।
.
কমল কন্দ -
একে শালুকও বলে। এটা বীর্যবর্দ্ধক, ভারী, দেরিতে হজম হয়, রন্ধনে মধুর, দুগ্ধবর্দ্ধক, বাত তথা কফকারক, গ্রাহী, রুক্ষ, পিত্ত, প্রদাহ তথা রক্তবিকারকে দূর করে। ভারী হওয়ার কারণে অল্প মাত্রায় সেবন করা উচিত।
.
বাদাম -
তেল তথা তেলযুক্ত পদার্থ কেবল বাদামই শ্রেষ্ঠ, বাকী বাদামের কন্দ আদি সব হানিকারক।
সংস্বেদজ শাক -
সংস্বেদজ, ভূমিচ্ছত্র, শিলন্ধি, ছত্রাক, মাশরুম, ছাতৌনা আদি হল এর নাম। এটা বর্ষা ঋতুতে মাটি, গোবর, কাঠ আর বৃক্ষাদির মধ্যে উৎপন্ন হয়। এইসব শাক (সব্জি) শীতল, দোষযুক্ত, পিচ্ছিল, ভারী আর বমন, ডায়রিয়া, জ্বর তথা কফ সম্বন্ধীয় রোগ উৎপন্ন করে। সুতরাং এইসব সেবন মূর্খতা হবে আর রোগকে নিমন্ত্রণ করা হবে। এইসব নিন্দিত শাক বা সব্জি ভুলেও কখনও সেবন করা উচিত নয়। মনু জীও একে অভক্ষ্য বলে নিষেধ করেছেন।
নিষিদ্ধ শাক (সব্জি) -
কন্দ - কাঁচা, বিনা ঋতুতে উৎপন্ন হওয়া, পুরোনো, রোগযুক্ত, কীট-পতঙ্গ বা পোকা আদি খাওয়া, অগ্নি আদি দ্বারা দূষিত, অত্যন্ত জীর্ণ, শুষ্ক আর ঘী আদি দিয়ে যেটা রান্না করা হয়নি, নিকৃষ্ট ভূমিতে উৎপন্ন হওয়া, কঠিন, অত্যন্ত কোমল, অত্যন্ত শীতল, সর্প আদি দ্বারা দূষিত, খুব শুষ্ক হওয়া কন্দ খাওয়া উচিত নয়। কেউ-কেউ বলেন যে মূলা বাদে কোনো কন্দই খাওয়া উচিত নয়। "নাশ্নীয়ান্মূলকম্ বিনা" কিন্তু এই মত সর্বমান্য নয়। মনু জী রসুন, শালগম, পিঁয়াজ আর মাশরুম শাক-সব্জিকে অভক্ষ্য বলেছেন।
.
এইরূপ যেসব অন্ন শাকাদি মল, মূত্র অথবা দুর্গন্ধযুক্ত খাদ দিয়ে উৎপন্ন করা হয় সেগুলো কখনও খাওয়া উচিত নয়। এইসব পদার্থ ব্রহ্মচর্য, স্বাস্থ্য আর বুদ্ধি আদির নাশ করে, সুতরাং নিজের কল্যাণ করতে ইচ্ছুক এমন বিবেকশীল ব্যক্তিকে এইসব ভুলেও সেবন করা উচিত নয়, কারণ এগুলো সব তামসিক পদার্থ।
.
অন্ন
"অন্নম্ বৈ প্রাণিনাম্ প্রাণাঃ" অনুসারে অন্নই হল প্রাণাধার। খিদের শান্তি আর জীবন নির্বাহের জন্য অন্নের স্থান সর্বপ্রথমে। নতুন আর পুরোনো অন্নের গুণও ভিন্ন-ভিন্ন হয়। নতুন অন্ন অভিষ্যন্দী (নেত্ররোগ = চোখ ব্যথা আদি) আর ভারী হয়। এক বছর পর্যন্ত অন্ন নতুন থাকে, দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত পুরোনো আর গুণযুক্ত হয়। এর পশ্চাৎ অন্ন নীরস আর গুণহীন হয়। পুরোনো হলে সব অন্ন ভারীতা ত্যাগ করে হালকা হয়ে যায়। যেসব অন্ন অধিক গুণকারী আর সাত্ত্বিক সেগুলোই স্বাস্থ্য আর ব্রহ্মচর্যের দৃষ্টিতে উত্তম হয়।
.
গম -
মধুর, স্নিগ্ধ, ভারী, অতিশীতল, বাত-পিত্ত নাশক, কফ-কারক, বলদায়ক, বীর্য তথা আয়ুকে বাড়িয়ে তোলে, সন্ধানকারক, শরীরকে স্থির রাখে, বর্ণকে সুন্দর করে, রুচিকারক, কিঞ্চিৎ রেচক আর সর্বোত্তম ভোজন। ডাক্তারের মতানুসারে এতে ভিটামিন A.B.G. আর ৭৫ শতাংশ সুগার তথা ১১ শতাংশ প্রোটিন আছে।
.
যব -
শীতল, মধুর, কষায়, বলদায়ক, মেধা, শরীরে অগ্নি আর বীর্যকে বাড়িয়ে তোলে, স্বর আর বর্ণকারী, অত্যন্ত বায়ু-কারক, পীনস, শ্বাসরোগ, কাশি, প্রমেহ, তৃষ্ণা, মেদ, কণ্ঠ তথা ত্বকের রোগের নাশক হয়। তাছাড়া রক্ত আর পিত্তকে শান্ত করে।
.
চাল -
শীতল, মধুর, বীর্যবর্দ্ধক, বলদায়ক, পিত্তনাশক, কফবর্দ্ধক, মেধার জন্য হিতকারী আর অল্পমল উৎপন্ন করে।
.
লাল চাল - মধুর, শীতল, হালকা, মলরোধক, স্নিগ্ধ, কোমল, ত্রিদোষনাশক আর জ্বরকে নষ্ট করে। চালের মধ্যে এটা সবথেকে উত্তম।
.
ছোলা -
শীতল, মধুর, কষায়, রুক্ষ, বিষ্টম্ভী, কুষ্ঠ, কফ, পিত্ত আর বীর্যনাশক হয় তথা ঘীয়ের সঙ্গে খেলে ত্রিদোষনাশক হয়।
.
নবীন মতানুসারে ছোলাকে বলদায়ক আর বাজীকরণ মানা হয় কিন্তু প্রাচীন আয়ুর্বেদ মতানুসারে ছোলা পুংস্ত্বনাশক অর্থাৎ বীর্যের নাশ করে। মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতে "চণাকাঃ পুঁস্ত্বনাশনাঃ" (সূত্রস্থান অধ্যায় ৪৬, শ্লোক ৩২) লিখে বলেছেন ছোলা পুংস্ত্বনাশক হয় আর একইভাবে মহর্ষি ধন্বন্তরি জী তাঁর নিঘন্টুতেও "কফাস্রপিত্ত পুঁস্ত্বঘ্নাশ্চণকা বাতলা হিমাঃ" লিখে ছোলা পুংস্ত্বশক্তিনাশক বলেছেন। সুতরাং ব্রহ্মচারীর জন্য ছোলার সেবন হানিপ্রদ।
.
জোয়ার -
ভারী, মলরোধক, শীতল, রুক্ষ, রুচিকারক, বীর্যবর্দ্ধক, সুস্বাদু, তৃষ্ণা, পিত্তনাশক আর রুচির বিকারকে শান্ত করে। রাজনিঘন্টুতে "পশুনামবলপ্রদম্" অর্থাৎ পশুদের জন্য বলকারক হয় না, এমন লেখা আছে।
.
বাজরা -
উষ্ণ, রুক্ষ, বল, কান্তিদায়ক, অগ্নিদীপন, বাত-কফ নাশক, পিত্ত প্রকোপক, দূর্জর (অনেক কষ্টে হজম হয়), বীর্যনাশক আর স্ত্রীদের কামশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। দুধ, দই আদির সঙ্গে সেবন করলে এর উষ্ণতা কিছুটা কম হয়।
.
মুগ ডাল -
শীতল, মধুর, হালকা, অগ্নিদীপন, স্বাদু, কফ-পিত্তের বিকারকে শান্ত করে, একটু বাতকারক, চোখের জন্য হিতকারী, কিঞ্চিৎ রেচক আর পথ্যতম।
.
বিভিন্ন প্রকারের ডাল যথা মুগ, মথ, মসুর, অড়হর, মাসকালাই, বুট আদি রান্না করে খাওয়া হয়, কিন্তু সবথেকে মুগ ডালই হল উত্তম। ধন্বন্তরীয়নিঘন্টুতে মুগডালকে "সূপশ্রেষ্ঠঃ" অর্থাৎ ডালের মধ্যে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। সুশ্রুতের মতানুসারে "ঋতেমুদ্গমসূরাভ্যামন্যে ত্বাধ্মানকারকাঃ" অর্থাৎ মুগ আর মসুরকে ছেড়ে বাকি সব আধ্মান = বায়ুবিকার (GDV) কারী হয়।
.
মথ ডাল -
মথ ডালের গুণ মুগ ডালের সমানই হয়, বিশেষ হল জ্বর, প্রদাহ হরণকারী হয়।
.
মাসকলাই -
ভারী, গরম, স্নিগ্ধ, মধুর, বাতনাশক, কফ, চর্বি, মাংস আর বীর্যকে বাড়িয়ে তোলে। তৃপ্তিকারক, পোষক আর বিশেষ করে এর সেবন করলে মাতাদের স্তনে দুধ বাড়ে। এটা উষ্ণ, গরিষ্ঠ (দেরিতে হজম), পিত্তকারক আর রাজসিক হয়, এর সেবন অল্প মাত্রায় করা উচিত, যাদের জঠরাগ্নি তীব্র আছে তারাই এর সেবন করতে পারে, মন্দাগ্নি ব্যক্তিদের এর সেবন থেকে দূরে থাকা উচিত।
.
মসুর ডাল -
মধুর, শীতল, রুক্ষ, সংগ্রাহী, কফ-পিত্তনাশক আর বায়ুর রোগকে বাড়িয়ে তোলে, মুত্রকৃচ্ছ্ররোগবিশেষ দূর করে।
.
অড়হর ডাল -
শীতল, রুক্ষ, বাতকারক, কফ, পিত্তনাশক হয় তথা বাতকেও অধিক প্রকুপিত করে না। চর্বি, কফ, রক্তপিত্ত আদিতে অড়হর ডালের সেবন হিতকর। ঘীয়ের সঙ্গে সেবন করলে ত্রিদোষনাশক হয়।
.
মহাকায় (ভুট্টা) -
ভুট্টা - শীতল, বিষ্টম্ভী, রুক্ষ, বাতকারক, কফ-পিত্তনাশক আর তৃপ্তকারী হয়। কাঁচা ভুট্টা রুচি আর পুষ্টিকারক হয়।
মাংস-ভক্ষণ
আমিষ বলুন অথবা মাংস, উভয়ের অভিপ্রায় হল একই। মাংস হল সেই পদার্থ যার প্রাপ্তি প্রাণীহিংসা ছাড়া হয় না, এইজন্য "অহিম্সা পরমো ধর্মঃ" অনুসারে ধর্মীয় মানব সমাজে মাংস খাওয়া সর্বদা নিষিদ্ধ।
.
"অমন্তি রোগিণো ভবন্তি য়েন ভক্ষিতেন তদামিষম্" যে পদার্থের ভক্ষণ করলে মানুষ রোগী হয় তাকে আমিষ বলে। ক্যান্সার, কুষ্ঠ, গরমের সব রোগ, দাঁত পড়ে যাওয়া ইত্যাদি ভয়ংকর সব রোগ মাংস ভক্ষণের কারণে হয়।
.
প্রাচীন ভারতে "ঘৃতম্ বৈ বলম্" দুগ্ধম্ বৈ বলম্" যে সময় ঘী আর দুধকে সাক্ষাৎ বল মনে করে ব্যবহার করা হতো সেই সময় মানব স্বাস্থ্য উন্নতির শিখরে ছিল, একশ বছর বয়সের পূর্বে মারা যাওয়াকে অকালমৃত্যু আর পাপ মনে করা হতো, তিনশ-চারশ বছর পর্যন্ত আয়ু ভোগ করতো।মানব আয়ুর মাধ্যম একশ বছরের কম ছিল না, কিন্তু আজ ভারতে মানুষের আয়ুর মাধ্যম ২৭ বছর। এমন পরিণাম মাংসাহারের কারণে হয়েছে।
.
এটাও তখন, যখন মাংসের পাশাপাশি অন্ন তথা ঘী দুধ আদিও ব্যবহার করা হয়, আর মানুষ যদি কেবল মাংসের ভক্ষণ করে তাহলে মানব জীবনে বেঁচে থাকা অসম্ভব। কারণ মানুষের স্বাভাবিক ভোজন মাংস নয়।
.
বলা হয় যে ভারত তো উষ্ণপ্রধান দেশ, এখানকার জলবায়ু মাংস ভক্ষণের বিপরীত হলেও ইংল্যান্ড, আমেরিকা আদি শীতপ্রধান দেশে মাংস ভক্ষণ অনুকূল হবে। এইজন্য মানুষ মাংস ভক্ষণকে স্বীকার করে।
.
পরিমাণ সামনে আছে, শীতপ্রধান দেশেও জীবনের হ্রাস হচ্ছে। তাদের চোখ বিড়ালের মতো দেখতে হয়, ক্যান্সার, কুষ্ঠ আদি উপরোক্ত রোগ গ্রাস করছে। যখন রোগ বাড়ে তখন বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা অনুসন্ধান করা শুরু করে।
.
লন্ডন ভেজিটেরিয়ান এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মিস এফ. ই. নিকলসন ১০ সহস্র শিশুকে নিরামিষ ভোজন করান আর অপর দিকে লন্ডন কাউন্সিল দ্বারা একটা অন্য ভোজনালয়ে তত সংখ্যক শিশুকে মাংস সহিত ভোজন করানো হয়। ছয় মাস পর উভয় দলের শিশুদের পরীক্ষা ডাক্তারদের দ্বারা করা হয়। এটা জেনে প্রসন্ন হবেন যে নিরামিষভোজী শিশুদের স্বাস্থ্য বেশি ভালো ছিল। তাদের ভার অধিক আর তাদের মাংসপেশী সুদৃঢ় ছিল তথা ত্বক অধিক স্বচ্ছ ছিল।
.
তাই এখন লন্ডন কাউন্সিলের প্রার্থনায় আর তার পরিচালনায় লন্ডন ভেজিটেরিয়ান এসোসিয়েশন দ্বারা লন্ডনের দরিদ্র নির্ধন সহস্র সংখ্যক নিবাসীকে নিরামিষ ভোজন করানো হয়।
.
এমনও বলা হয় যে মাংসভক্ষণ করলে সৈনিকের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে, লড়াইয়ের শক্তি বাড়ে, এইজন্য সেনাবাহিনীতে মাংসের ব্যবহার করা হয়, কিন্তু অনুসন্ধান করে এর পরিণাম বিপরীত এসেছে। আমেরিকার প্রসিদ্ধ বিদ্বান শ্রী প্রফেসর শিটেএডন পি.এইচ.সি.সি.এল.ডি.ডি. নিম্ন প্রয়োগ করেছেন -
.
আমেরিকান সৈনিকদের সাধারণ দৈনিক ভোজনে ৭৫ ওন্স ভারী ভোজন হয়ে থাকে। এই ৭৫ ওন্সের মধ্যে ২২ ওন্স কসাইয়ের দেওয়া মাংস থাকে। এই সৈনিকদের তথা যারা ব্যায়াম করে তাদেরও ভোজনের পরিমাণ এক প্রকার সম্পূর্ণ মাংস তথা ভারী বস্তুর কিছু অংশ বের করে কেবল ৫১ ওন্স করে দেওয়া হয়। নয় মাস পর্যন্ত তাদের এইরূপ ভোজনে রাখা হয়। যদিও এই ভোজনের পরিবর্তন করার পূর্বে তাদের শরীর পূর্ণ বিকশিত ছিল আর দেখে এমন মনে হতো যেন এখন এর থেকে অধিক শক্তি এদের মধ্যে আর আসবে না কিন্তু তাসত্ত্বেও নয় মাস পর তাদের মধ্যে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি দেখা যায় আর তাদের স্বাস্থ্যও পূর্বের তুলনায় অনেক ভালো হয়। এরপর যন্ত্র দিয়ে ঠিক-ঠিক মাপার পর জানা যায় যে তাদের শক্তি প্রায় ৫০% বৃদ্ধি হয়েছে তথা তারা খুব সহজেই কঠিন-কঠিন কাজগুলো করতে পারে। তাদের মধ্যে অধিক প্রসন্নতা দেখা যায় তথা তাদের স্বাস্থ্যের খুব উন্নতি হয়েছে আর যখন তাদের এই বিষয়ের স্বতন্ত্রতা দেওয়া হয় যে তারা চাইলে তাদের পুরোনো ভোজন পদ্ধতি শুরু করতে পারে, তো তখন তাদের মধ্যে কেউই পূর্বের মাংসাহার ভোজনকে স্বীকার করেনি। যদি উপরোক্ত প্রফেসর সাহেবর কম করা ভোজনের স্থানে দুধ ২৫ ওন্স বাড়িয়ে দিতেন তাহলে পরিণামটা এরথেকেও বেশি ভালো হতো।
.
মানুষের স্বাভাবিক ভোজন হল ফল, শাক-সব্জি, দুধ-ঘী আর অন্নাদি। মাংস নয়, কারণ মানুষের শরীরের গঠনই এইরূপ। যেসব পশু-পক্ষীর ভোজন মাংস, তাদেরকে পরমাত্মা ধারালো দাঁত তথা নখ এমন দিয়েছেন যে তারা খুব সহজে মাংসের মধ্যে ছেদ করতে পারে, এর পাশাপাশি মাংসভক্ষী পশু জিভ জিয়ে চেটে-চেটে জল পান করে। দৌড়ালেও তাদের শরীরে ঘাম আসে না। জন্মের সময় তাদের বাচ্চার চোখ বন্ধ থাকে। না শেখালেও তারা তাদের ভক্ষ্য পশুর উপর আক্রমণ করে। বিড়ালের বাচ্চা ফলকে তুলে মুখে দিলেও, তার মধ্যে আক্রমণ করার সাহস আছে কিন্তু মানুষের বাচ্চার নেই।
.
মানুষের ভোজননলিকা অনেক লম্বা হয়, তাতে মাংসের মতো অত্যন্ত ভারী পদার্থ খুবই কঠিনভাবে হজম হবে। হজমের জন্য মদ্যপান করতে হবে। কথায় বলে যারা মাংস খায় তারা অবশ্যই মদ্যপান করে।
.
মাংসভোজী পশুর ভোজননলিকা ছোটো হয়, তাই তাতে মাংস দ্রুত হজম হয়।
.
মানুষের উদরে কোন পদার্থ কত সময়ে হজম হয় তার তালিকা নিম্নে দেওয়া হল -
নাম_______অবস্থা______হজমের সময়
১. চাল_________রান্না করা________১ ঘন্টা
২. আপেল______পাকা ফল_______৪০ মিনিট
৩. যব_____________,,____________২ ঘন্টা
৪. আলু________সিদ্ধ করা________৯০ মিনিট
৫. রুটি_________________________২ ঘন্টা
৬. দুধ___________গরম___________২ঘন্টা
৭. পাঠার মাংস___________________৩ ঘন্টা
৮. সব্জি_________________________২ ঘন্টা
৯. মুরগির মাংস__________________৪ ঘন্টা
১০. মাছ________________________৪ ঘন্টা
১১. শুয়োরের মাংস_______________৫ ঘন্টা
১২. গরুর মাংস__________________৫ ঘন্টা
.
গম, চাল আদি অন্ন, ফল, দুধ, ঘী আদি পদার্থের উপরই মানুষের জীবন, আর এইগুলো রান্না না করেও সেবন করা যায়। বিজ্ঞান বলে যে রান্না করলে অথবা লবণ মশলা আদি মিশ্রিত করলে পদার্থের শক্তি কমে যায়, এইজন্য প্রাকৃতিকতা এমন হওয়া উচিত - যে পদার্থ যেরূপ হবে তাকে সেইরূপে সেবন করা। কিন্তু মানুষ মাংসকে রান্না না করে সেবন করতে পারবে না। এইজন্য বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, শিয়াল, কুকুর, বিড়াল আদিকে মাংসভক্ষী বলা যেতে পারে কারণ তারা নিজে অন্য প্রাণীকে মেরে তাদের তাজা মাংস খায়, কিন্তু মানুষ সেইরূপ করে না।
.
শক্তির দৃষ্টিতে মাংসের স্থিতি নিম্ন তালিকা দ্বারা জ্ঞাত হয়ে যাবে -
পদার্থপ্রোটিনচর্বিকার্বোজখনিজজল
গম_______১১.৪৭___২.০৪__৭০.৯০___৩.১৪__১১.৮৩
আটা(গম)__ ১০.৭____১.১____৭৫.৪____০.৫______+
ময়দা(গম)___৭.৯____১.৪____৭৬.৪_____০.৫______+
তুষ (গম)___১৬.৪____৩.৫____৪৩.৬_____৬____১২.৫
মসুর ডাল__২৫.৪৭___৩.০___৫৫.৭৩_____+_______+
মুগ ডাল___২৩.৬২___২.৬৯___৫৩.৪৫____+_______+
মাষকলাই__২২.৩৩___১৯.৫___৫৫.০৬_____+______+
মটর ডাল__২১.৭০____২.৫____৪৫.০৬_____+______+
বাদাম_____২৪.০০___৫৪.০০___১০.০____৩০____৯.০
চিনাবাদাম__২৭.৫____৪৪.৫___১৫.৭____২.৫____৭.৫
গোদুগ্ধ_____৩.৫_____৪.০০____৩.৫___০৭.৫__৮৭.২৫
মোষের দুধ__৬.১১___৭.৪৫____৪.১৭__০.৮৭__৮১.৪০
ছাগলের দুধ_১৮.০০___৫.৪______+____১.০____৭৬.৭
গরু মোষের মাংস ২০.০০_১.৫___০.৬___১.২____৭৬.৭
মুরগির মাংস__২২.৭___৪.১____১.৩____১.১____৭৪.৪
ডিমের কুসুম __১৬.১২__৩১.৩৯__+____১.০১___৫১.৩
.
আজকাল এমন যুক্তি দেওয়া হয় যে যেখানে মাংসের ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্ত হয় না তাহলে সেখানে কি করা উচিৎ? রুসের টন্ড্রা প্রান্তে কিছুই উৎপন্ন হয় না। সেখানকার মানুষ হরিণকে মেরে তার মাংস দিয়েই নির্বাহ করে। কিন্তু পরমাত্মা যেখানে মানুষের উৎপন্ন করেছেন সেখানে তার খাওয়ার জন্য খাদ্য আগে থেকেই উৎপন্ন করেছেন। টন্ড্রা প্রান্তেও যখন হরিণ নদ-নদীতে জমে থাকা শৈবাল দিয়ে নিজের নির্বাহ করতে পারে তাহলে মানুষ কেন করতে পারবে না!
.
আর্যজগতের প্রসিদ্ধ বিদ্বান স্বর্গীয় পণ্ডিত গুরুদত্ত M.A. একবার রোগে আক্রান্ত হন। ডাক্তার পরামর্শ দেন যে যদি গুরুদত্ত জী মাংস ভোজন করেন তাহলে বেঁচে যাবেন। পণ্ডিত গুরুদত্ত জী উত্তর দেন যে যদি আমি মাংস খেয়ে অমর হয়ে যাই, আর পুনরায় মৃত্যু না হয় তাহলে বিচার করতে পারি। ডাক্তার চুপ হয়ে যান।
.
ইংরেজি ভাষার খ্যাত সাহিত্যকার বর্নাডাশাহ মাংসের সেবন পরিত্যাগ করেন। তিনি মাংসাহারী কোনো অনুষ্ঠানে সম্মিলিত হতেন না। ডাক্তার বলে যে যদি মাংস না খান তাহলে মরে যাবেন। তিনি বলেন আমাকে পরীক্ষা করতে দিন, যদি আমি না মরি তাহলে আপনি নিরামিষভোজী হবেন। বর্নাডাশাহ প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন আর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন আমার স্থিতি খুব গম্ভীর, আমাকে গোমাংস খেতে বলা হচ্ছে, তাহলে আমি জীবিত থাকবো। আমি আমার উইলে লিখে দিয়েছি যে আমি মারা গেলে আমার অর্থীর সঙ্গে বিলাপ করে গাড়ি নিয়ে যাত্রা করার আবশ্যকতা নেই। আমার সঙ্গে গরু, ভেড়া, মুরগি আর মাছ থাকবে, কারণ আমি আমার সঙ্গী প্রাণীদের খাওয়ার অপেক্ষা নিজের মরণ ভালো বলে মনে করি।
.
মাংস মানুষকে রোগী করে, এইজন্য এটা অভক্ষ্য পদার্থ। সব মানুষেরই উচিত এর থেকে সদা দূরে থাকা।
.
ডিম
ডিমও মাংসের মধ্যে সম্মিলিত কিন্তু কিছু ব্যক্তি ডিমকে মাংস থেকে পৃথক মনে করে আর বলেন যে ডিমের মধ্যে জীব থাকে না, সুতরাং একে খাওয়া তথা ভক্ষ্যপদার্থ বলে মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি থুক-খকার মল-মূত্রাদি খাওয়া থেকে উৎপন্ন হওয়া ডিমও ভক্ষ্য পদার্থ হয় তাহলে সংসারের মধ্যে অভক্ষ্য পদার্থ বলতে কি রইলো?
.
"অভক্ষ্যাণি দ্বিজাতীনামমেধ্যপ্রভবাণি চ" (মনুস্মৃতি) অনুসারে আমাদের শাস্ত্রকারগণ নোংরা থেকে উৎপন্ন হওয়া সব পদার্থকে অভক্ষ্য বলেছেন।
.
ডিমের মধ্যে জীবকে না মানা, এটাও বুদ্ধিসংগত নয়। মুরগি হচ্ছে ডিম্বজ প্রাণী আর ডিম থেকে তার বাচ্চা উৎপন্ন হয় তাহলে কিভাবে তারমধ্যে জীব হবে না? ডিমের ভক্ষক স্বার্থপর ব্যক্তিরা নিজের প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য মিথ্যা যুক্তি দেওয়া প্রারম্ভ করেছে। যদি দুর্জনদোষ ন্যায় দ্বারা ডিমের মধ্যে জীব নাও মানা হয় তাহলে কি সব নির্জীব পদার্থ ভক্ষ্য হবে? তাহলে তো মল-মূত্র আদিও এই শ্রেণীর মধ্যে চলে আসবে। জীবের থাকা না থাকা মোটেও ভক্ষ্য পদার্থের লক্ষণ নয়।
.
আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে মাংসভক্ষণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ আছে। মহর্ষি মনু লিখেছেন - "বর্জয়েন্মধুমাম্সঞ্চ" মদ্য আর মাংস একদম ছেড়ে দেওয়া উচিত। একইভাবে রাজর্ষি চাণক্য লিখেছেন - "মাম্সভক্ষণময়ুক্তম্ সর্বেষাম্" (চাণক্য রাজসূত্র ৫৬২), অর্থাৎ সব মানুষের জন্য মাংস ভক্ষণ অনুচিত বলেছেন। বেদ ভগবান্ ভোজ্য-পদার্থের কত স্পষ্ট নির্দেশ করেছেন -
.
"অজীজন ঔষধীর্ভোজনায়" (ঋ.৫/৮৩/১০) অর্থাৎ ভোজনের জন্য চাল, গম, যব আদি ঔষধি (ঔষধয়ঃ ফল পাকান্তাঃ মনু.) উৎপন্ন করেছেন। সুতরাং সেগুলোর সেবন করা উচিত।
.
ডিম খাওয়ার পক্ষে আরও একটা যুক্তি দেওয়া হয় যে এরমধ্যে প্রোটিন আছে। প্রোটিনের অধিক আবশ্যকতা কেবল বৃদ্ধি অবস্থাতেই হয় অর্থাৎ তিরিশ-চল্লিশ বয়স পর্যন্ত। তাছাড়া বৈজ্ঞানিকদের মত হল মাংসের প্রোটিন মানুষের শরীরের জন্য উপযুক্ত নয়। দুধ, দই, ছাছ, গম, ছোলা, মটর আর ডালের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন আছে আর এগুলোই মানব শরীরের জন্য উপযুক্ত।
.
জীবনীয় তত্ত্ব ভিটামিনের দৃষ্টিতেও ডিমকে কোনো গুরুত্ব দেওয়ার আবশ্যকতা নেই। গোদুগ্ধে A.B.D.G. ভিটামিন বিদ্যমান আছে, আঙ্গুর, গম, ছোলা, বিউলির ডাল, সবুজ মটর আদিতে ভিটামিন A.B.C.D. পর্যাপ্ত মাত্রায় আছে। এইভাবে নিরামিষ ভোজন দিয়েই মানুষের জন্য সব জীবনীয় তথা পোষকতত্ত্ব আর খনিজ পদার্থের যথাযথ প্রাপ্তি হয়ে যায়, তারপরও যদি কেউ মাংস-মাছ-ডিম আদি অভক্ষ্য পদার্থ খেয়ে নিজের শরীর-মন তথা আত্মাকে দূষিত করতে চায়, তাহলে সেটা মহামূর্খতা আর পাপ হবে।
.
অধিক দুঃখের বিষয় হল অহিংসার ঢোল বাজানো সরকারও মাংস-মাছ-ডিম আদির প্রচার করছে। মৎস উৎপাদন বাড়াও, মুরগি পালো, যাতে অধিক ডিম পাওয়া যায় ইত্যাদি প্রচার সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। লক্ষ-লক্ষ টাকা এই কাজের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। মৎসপালন যোজনা বানানো হচ্ছে। মুরগি বিকাশ কেন্দ্রের স্থাপনা আর মুরগি-প্রদর্শনীদের উৎঘাটন হচ্ছে। এই কিছুদিন আগে ৮ জানুয়ারী মুম্বইয়ের মুরগি-প্রদর্শনীর উৎঘাটনে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শ্রী পাঞ্জাবরাও দেশমুখ বলেছেন -
"আগামী দ্বিতীয় পঞ্চবর্ষীয় যোজনাতে ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১৪০ মুরগি বিকাশ কেন্দ্র স্থাপিত করা হবে। সরকার সম্প্রতি ১৫ টা কেন্দ্রকে খোলার স্বীকৃতি প্রদান করেছে।"
.
রাজ্যাধিকারী অথবা জনতার প্রতিনিধিদের উচিত তারা যেন এই জঘন্যপ্রবৃত্তিকে থামিয়ে দেয়। রাষ্ট্রহিতের জন্য রাজ্যের উচিত তারা প্রচারের পরিবর্তে এর উপর যেন নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আশা করি অধিকারী মহানুভব এইদিকে ধ্যান দিবেন আর খাদ্য সমস্যার সমাধানের জন্য প্রাচীন সাধনের ব্যবহার করবেন, যার নির্দেশ উপনিষদ করে দিয়েছে - "অন্নম্ বহু কুর্বীত।"
🍁 মদ্যপান 🍁
ইংরেজী সভ্যতা ভারতকে মাংস ভক্ষণের পাশাপাশি অন্যদিকে ভয়ংকর বস্তু প্রদান করেছে, আর সেটা হল মদ। এর ফলে মানুষের শরীর, মস্তিষ্ক আর আত্মা তিনটাই বিগড়ে যায়। গত মহাযুদ্ধে যেখানে যুদ্ধের কারণে এক কোটি প্রাণী মারা গেছে আর দেড় কোটি মহামারীর কারণে মারা গেছে, সেখানে মদ্যপানের কারণে দুই কোটি মানুষ মারা গেছে।
.
প্রাচীন ভারতে মদ্যপানের প্রথা ছিল না। আদি সৃষ্টি থেকে মহাভারত কাল পর্যন্ত দশ-বিশ-পঞ্চাশ-শত নয়, লক্ষ-লক্ষ শতাব্দী ধরে ধর্মীয় মানব-সমাজের আহার-বিহার ভালোই ছিল, সবাই সাত্ত্বিক আহার ও পান করতো। কিন্তু মহাভারত যুদ্ধের পশ্চাৎ বৈদিক শিক্ষার অভাবে মদ্যাদি প্রথা প্রারম্ভ হয়। মহাত্মা বুদ্ধ মদ্যপানের বিরুদ্ধে লোকমত পেশ করেন, তিনি বলেন - "বেশ্যা আর সুরাপান দুটোই ত্যাজ্য। বেশ্যা ধনের আর মদ পরিবারের হরণ করে মানুষকে এমন বানিয়ে দেয় যে তার মূল্য শূণ্যেরও তুল্য হয় না।" তিনি মানুষকে সম্বোধন করে বলেন যে, হে মানব! তুমি সিংহের সম্মুখে যেতে ভয় করো না, এটা পরাক্রমের পরীক্ষা। তুমি তরোয়ালের নিচে মাথা নামাতে ভয় করো না, এটা বলিদানের শৈলী। তুমি পর্বত শিখর থেকে জলাশয়ে ঝাঁপাতে ভয় করো না, এটা তপ সাধনা। তুমি আগুনের প্রকোপ অগ্নি-জ্বালা দেখে বিচলিত হও না, এটা স্বর্ণ পরীক্ষা। কিন্তু সুরা দেবীকে সদা ভয় করে চলবে, কারণ এটা হচ্ছে পাপ আর অনাচারের জননী।
.
তিনি রাজাদের সাবধান করে দেন - যে রাজার রাজ্যে সুরা দেবী আদর পাবে, সেই রাজ্য কাল বেদিতে নষ্ট হবে, সেখানে না ওষুধ উৎপন্ন হবে, না অন্ন, না বুদ্ধি, কারণ এটা হচ্ছে মহাহিংসা।
.
কৌটিল্য তাঁর সময়ে মদকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন আর মদের দোকানে ঋতুর অনুকূল ভোজন রেখে ছিলেন। ভোজন পাত্রকে সুগন্ধিত ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়ে ছিলেন। যারা যারা সেই ভোজন করতো তারা মদ্যপান ছেড়ে দিতো। সেই সময় সুরাপান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞা কয়েকশ বছর ধরে চলে। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চিনি যাত্রী হিউয়েন স্যাং ভারতে আসেন, তিনি ১৬ বছর পর্যন্ত ভারতে ছিলেন, সেই সময় মদ্যপান ভারতে ছিল না, এমনকি ঔরঙ্গজেবের সময়ও সুরাপান ছিল না। প্রসিদ্ধ ফ্রান্সিসী ডাক্তার বার্নিয়ার যিনি ঔরঙ্গজেবের সময় ভারতে এসেছিলেন আর পর্যাপ্ত সময় ধরে ভারতে ছিলেন, তিনি লেখেন যে দিল্লিতে মদের একটাও দোকান নেই।
.
ইংরেজ ভারতে আসে আর তাদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা মদ্যপান করতো। কোম্পানি মদ্যপানকে প্রোৎসাহিত করে, দিনের পর দিন মদের প্রচার বাড়তে থাকে। তাড়ির বৃক্ষের উপর টেক্স লাগিয়ে দেওয়া হয়। মদ বানাতে আর বিক্রি করার জন্য চুক্তি দেওয়া হয় যাতে ঠিকাদার মদের প্রচার করে। কোম্পানির এমন প্রেরণায় ভারী প্রভাব পড়ে। এমন প্রভাব দেখে স্বর্গীয় কেশবচন্দ্র সেন বলেছিলেন - ১০ জন শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে ৯ জন লুকিয়ে-লুকিয়ে মদ্যপান করে। ১৮৮৮ সালে লন্ডনের হাউস অফ কমন্সে মদের উপর বিতর্ক হয়, তো মিস্টার কেনি ভারতবাসীদের পক্ষ নিয়ে ইংরেজ সরকারের নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি মদ নিয়ে সরকারের দূষিত নীতি সমন্ধে বলেছিলেন যে যদি সরকার নিজের আয়কে প্রতি দশ বছরে দ্বিগুণ করার বর্তমান নীতিকে স্থায়ী রাখে, তাহলে ভারত ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর মধ্যে একটা পাক্কা মাতালের দেশ হয়ে যাবে।
.
মদ্যপান করলে পাচনশক্তি একদম নষ্ট হয়ে যায়। শরীর নিচে থেকে হলদে হতে থাকে কিন্তু চেহারা দেখতে লাল হয়। উন্মাদ-পাগলামী উৎপন্ন করে তথা শ্বাস ও হাঁপানি রোগ উৎপন্ন করে। যকৃত কিডনি তথা আমাশয় আর রক্তস্নায়ুকে ভিতরে-ভিতরে শুকিয়ে দেয়। অস্বাভাবিক রীতিতে রোগজন্তুকে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করায়, যার ফলে শরীরের অবয়ব আর জ্ঞানতন্তু খারাপ হয়, নিমোনিয়া, শ্বাসরোগ, যক্ষ্মা, শোষ আদি সাংঘাতিক রোগ উৎপন্ন হতে থাকে আর সেটা প্রজন্ম ধরে চলে। অক্সিজেনের প্রচারকে থামিয়ে চর্বিকে বাড়িয়ে তোলে। অন্ত্র আর পেশীর ছোটো সেলগুলোকে নষ্ট করে তাদের বৃদ্ধি থামিয়ে দেয়।
.
ইউরোপীয়রাও মদের দুষ্পরিণামের অনুভব করছে। সেখানকার হাসপাতালে মদকে ওষুধ রূপে বেশিরভাগ ব্যবহার করা হতো। অস্ত্রোপচারের পর প্রায়শঃ হাসপাতালের মধ্যে হৃদয়ের উত্তেজনার জন্য ব্রাণ্ডী ব্যবহার করা হতো কিন্তু এখন তার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
.
অস্ট্রেলিয়াতে ১৮৯১ সালে এক হাজার পাউন্ডের অধিক মদ একটা হাসপাতাল ব্যবহার করেছিল। সেই হাসপাতালে ১৯১৪ সালে মাত্র চার পাউন্ড মূল্যের মদ ব্যবহার করা হয়।
আমেরিকার প্রসিদ্ধ চিকিৎসক তথা মেডিসন রিসার্চ শন এসোসিয়েশনের প্রধান শ্রী ডাক্তার ডার্বি বেলী মদ নিয়ে রিসার্চ করেন। তিনি পরিষ্কার ভাবে বলে দেন যে মদ কোনো পৌষ্টিক পদার্থ নয়, এটা পুরোপুরি এক বিষাক্ত পদার্থ। এইজন্য উইস্কি আর ব্রান্ডি দুটোকেই ওষুধের শ্রেণী থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে।
.
প্রসিদ্ধ ডাক্তার লেথেবে বলেছেন "যেসব খাদ্য পদার্থ জীবিত শরীরের অন্ত্রের চেতনা শক্তিকে নষ্ট করে অথবা জীবনের হ্রাস করে, সেটা বিষ।"
.
পর্যাপ্ত সময় ধরে ব্রিটেন আর ভারতের ডাক্তার মিলে নিম্ন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত করেছে -
১. মদ, কোকেন, আফিম, তামাক আদি যেসব মাদক দ্রব্য আছে, সেগুলো যে বিষ সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
২. ভারতের মতো গরম দেশে এর অল্প পরিমাণ সেবনও স্থায়ীরূপে হানিকারক।
৩. শিশুদের জন্য মদ অনেক বেশী হানিকারক।
৪. প্লেগ, মেলেরিয়া আর ক্ষয় (TB) রোগকে থামাতে মদ ব্যর্থ।
৫. এমন কথা অন্য নেশা জাতীয় পদার্থ সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে।
.
"যেমন রাজা তার তেমন প্রজা" সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজার উপর নিজের তথা প্রজার সবপ্রকার রক্ষণের উত্তরদায়িত্ব থাকে। আলাউদ্দিন খিলজী যখন বুঝতে পারে যে তার অবনতি আর পতনের কারণ মদ ছিল, তখন সে সবার সামনে মদ দিয়ে ভরা তার জগকে ভূমিতে ফেলে দেয় আর মহলের সমস্ত মূল্যবান পেয়ালা আর জগ সবার সামনে ভেঙে ফেলে আর মদকে নিষিদ্ধ করে দেয়। যারা মদ্যপান করে তাদের কঠিন দণ্ড দেয়, এমনকি যারা মদ্যপান করা ছাড়তে চাইতো না তাদের জীবিতই ভূমিতে গর্ত করে কবর দিয়ে দিতো। এর ফলে পরিণাম সামনে চলে আসে, মদ্যপান একদম মুছে যায়। আজও আমাদের সরকারি কর্মচারী আর জনতার প্রতিনিধি ধারাসভা তথা লোকসভার সদস্যরা যদি এটা বোঝে যে মদ হচ্ছে খুবই খারাপ একটা বস্তু আর দেশের উন্নতিতে এটা বাধক, তাহলে তৎকাল মদ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। কয়েকটা প্রান্ত বিচার করেছে, তারা অভিনন্দন প্রাপ্য। সুতরাং যত শীঘ্র এর বহিষ্কার হবে ততই শ্রেয়স্কর।
.
🍁 তামাক 🍁
তামাক গাছের বর্ণনা আমাদের প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে কোথাও নেই। বলা হয় যে তামাক সেবনের প্রথা সবার আগে চিনদেশে ছিল কিন্তু অনুসন্ধান করে জানা যায় যে চিনদেশে আগে এই প্রথা ছিল না। এইজন্য ভারত কেন, সারা এশিয়াতেও তামাকের কোনো জ্ঞান ছিল না।
.
তামাকের খেতি সর্বপ্রথম পাতালে অর্থাৎ আমেরিকাতে শুরু হয়। ১৬০৭ সালে জেম্সটাউন ভার্গিনিয়া কলোনিতে তামাক চাষ করা হয়। ৮ বছর পর্যন্ত এর বিস্তার করা হয় আর ১৩ বছর পশ্চাৎ ১৬২০ সালে তামাকের ব্যবসা একটা গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় এটা এক অদ্ভুত বস্তু মনে করা হতো। বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে এর ভারী প্রচার করা হয়। সংবাদ পত্রিকাতে এর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এর প্রচারের জন্য নতুন-নতুন সংবাদপত্র বের করা হয়। বিক্রয় সাহিত্য বিতরণ করা হয়। পরিণাম সবার সামনে, তামাক সংসারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
.
তামাকের সবথেকে বড় প্রচারক জর্জ ওয়াশিংটন হিল নামক এক ব্যক্তি ছিল। তামাক বিজ্ঞাপনের জন্য সে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করে। সুপ্রসিদ্ধ লেখক মাইক গোল্ড জর্জ ওয়াশিংটন হিলের বিষয়ে - "এই বিলক্ষণ বুদ্ধির সিগারেট পক্ষপাতী ব্যক্তি নিজের দেশের কাছে লক্ষ-লক্ষ মিথ্যাকথা বলেছে" নামক নিবন্ধে লিখেছেন - জর্জ ওয়াশিংটন হিল একটা নেশাগ্রস্ত অদ্ভুত ছোকরা ছিল।
.
১৮১৭ সালে সেই ব্যক্তি আমেরিকাকে আশ্বস্ত করে আর বলে যে দেশের স্বাস্থ্য, ধন আর প্রসন্নতা কেবল সিগারেট সেবন আর তার ব্যবসার উপর নির্ভর করছে আর সেই চালাক ছোকরা তার এই যুক্তিপূর্বক কাজে অনেকটা সফল হয়। কারণ আমেরিকাতেই সিগারেটের খরচ প্রতিবছর তিন অরব টাকা থেকে বেড়ে তিনশ অরব টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
.
এইভাবে জর্জ ওয়াশিংটন হিল স্ত্রীদের মধ্যেও তামাকের ভারী প্রচার করে। অবিবাহিত নারী বা সেই বিবাহিত নারীদের জন্য যারা তাদের স্বামী থেকে পৃথক থাকতে চায়, তাদের মধ্যে এই ব্যক্তি স্লোগান দেয় যে - "আপনার প্রিয় স্বামী ছাড়া যেকোনো ধরনের সিগারেট খাওয়া আপনাকে আরও বেশি আনন্দ দিবে তথা স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যকে বজায় রাখবে।" আগে স্ত্রীরা তামাকের নেশা থেকে দূরে থাকতো, কিন্তু হিলের এই চাল সফল হয়। তার ভারী প্রচারের কারণে স্ত্রীরাও তামাক সেবন করা শুরু করে। পরিণাম এই দাঁড়ায় যে স্ত্রীরাও বিভিন্ন প্রকারের রোগে আক্রান্ত হতে থাকে।
.
বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয় {University at Buffalo (North Campus)} দ্বারা দেওয়া ডাক্তারদের এক সহভোজে জন্স হো পার্কন্সের শ্রী ডাক্তার উইলিয়াম রেন হোফ বলেন - স্ত্রীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার বা মর্কট রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আর ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। কারণ এই স্থানে স্ত্রীরাও তামাকের সেবন করা শুরু করেছে।
.
তামাক হচ্ছে এক মারাত্বক নেশাকর বস্তু। মানুষের জন্য এটা মারাত্মক বিষ, কিন্তু মানুষ সেদিকে ধ্যান দেয় না। তামাকের মধ্যে ১৯ টা বিষ আছে -
১. নিকোটাইন ২. প্রসিক এসিড ৩. কার্বন মোনোকসাইড ৪. পিরোডাইন ৫. এমোনিয়া ৬. কার্বলিক এসিড ৭. সাল্ফটন হাইড্রোজেন ৮. মিথিলিমাইন ৯. মার্শসগে ১০. নিকোলাইন ১১. ল্যুরী ডাইন ১২. কোলি ডাইন ১৩. পারেবোডাইন ১৪. কোরি ডাইন ১৫. রুপি ডাইন ১৬. বিরো ডাইন ১৭. পাই রোল ১৮. ফির্মিক বোল্ডি হাইড ১৯. ফরফরোল। এর মধ্যে চার-পাঁচটা বিষ তো খুবই মারাত্মক।
.
ডাক্তার গাথ বলেছেন নিকোটাইন এত ভয়ঙ্কর বিষ যে যদি এর এক ফোঁটাও পেটের মধ্যে পৌঁছায় তাহলে তৎক্ষণাৎ মানুষের প্রাণান্ত হবে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে আধ ফোঁটা নিকোটাইন দিয়ে বিড়াল আর এক ফোঁটা দিয়ে কুকুর মারা যায় আর আট ফোঁটা দিয়ে একটা ঘোড়া কেবল আট ঘন্টার মধ্যে মারা যায়।
.
মেলসেন্সের কথন হল সওয়া তোলা অর্থাৎ ২.৯১ গ্রাম তামাকের ধোঁয়াতে এত নিকোটাইন আছে যে তা দিয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
.
তামাকের ধোঁয়া গলার শিরা হয়ে মস্তিষ্ক আর যকৃতের দিকে ছড়িয়ে যায়। মস্তিষ্কে উষ্ণতা উৎপন্ন করে, স্মরণ শক্তি নষ্ট করে, পড়ায় মন লাগে না। যারা এর সেবন করে তাদের মস্তিষ্ক-জ্বর হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ধোঁয়া মস্তিষ্কে না পৌঁছায় - আরাম লাগে না।
.
ডাক্তার গর্জসের কথন হল তামাক হচ্ছে অধ্যয়নের বন্ধ দ্বার। যেসব বিদ্যার্থী আর অধ্যাপক তামাক সেবন করে, ড্রয়িং করার সময় তাদের হাত কাঁপে। দৃষ্টিতেও ভারী অন্তর আসে, সেই অভাবকে চশমা দিয়েও পূরণ করা যায় না। এখন এর সেবনে রোগের বৃদ্ধি হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। কেবল এক বছরের অবস্থাতেই ২৫ শতাংশ বালক প্রাণ হারিয়েছে, বাকী ৭৫ শতাংশ বালকও যে ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচবে, সেটাও সম্ভব না। এরমধ্যে কেবল ৩৫ শতাংশই এমন বালক আছে যারা ৩০ বছর পর্যন্ত আয়ুতে পৌঁছাতে পারে। কারও ক্ষয়রোগ তো কারও ক্যান্সার হয়ে গেছে, কেউ অন্ধ হয়ে গেছে তো কেউ চোখে চশমা লাগাচ্ছে।
.
বিদ্যার্থীদের স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া, এটা তো একটা কলঙ্ক। বিদ্যার্থীর জীবন তো আনন্দের হয়। প্রথম অবস্থাতেই রোগের শিকার হওয়া মানে মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ দেওয়া। যদি আমাদের বিদ্যার্থী সুখ সমৃদ্ধির জীবন যাপন করতে চায়, যদি সে আগামী ভারতের উজ্জ্বলতার প্রতীক হতে চায় তাহলে তামাক জাতীয় পদার্থ থেকে দূরে থাকা উচিত। একে যেন একটা মারাত্মক বিষ মনে করে। শুধু মারাত্নক বিষই নয়, এর থেকেও অধিক ঘাতক, কারণ বিষ তো তৎক্ষণাৎ প্রাণ নিয়ে নেয় আর এটা ব্যক্তিকে পচিয়ে-পচিয়ে মারে।
.
একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক পরামর্শ দেন যে আমি আজ পর্যন্ত এমন একটাও তামাক সেবনকারী মাতা-পিতা দেখিনি যাদের সন্তানের স্নায়ু-মণ্ডল নির্বল হয়নি, তাদের মস্তিষ্কও দুর্বল হয়ে যায়।
.
মস্তিষ্কতে নির্বলতা তাতে বিভিন্ন প্রকারের রোগ, অনিদ্রা, চোখের সামনে ঝাপসা দেখা, অন্ধত্ব, হৃদস্পন্দন, কাজে নিরুৎসাহ, আলস্য, মুখে ব্যথা, দাঁত পড়ে যাওয়া, বদহজম, কুষ্ঠরোগ, গলার রোগ, কানে ফোড়া আদি রোগের কারণ হল তামাক। এছাড়াও যকৃৎ, মূত্রাশয়ের রোগ আদি বিভিন্ন প্রকারের রোগ হয়। ফ্রান্সের সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার জী. সেন ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সের তামাক সিগারেট বিড়ি আদির ধুমপান করে এমন বালকদের নিরীক্ষণ করেন, এই বাচ্চাদের রক্তপ্রবাহ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল আর হৃদয় রোগে আক্রান্ত ছিল, পাচনশক্তি খারাপ ছিল আর এদের অলকোহল (মদ) পান করার ইচ্ছা হতো, পালাজ্বর আসতো, রক্তের লাল পরমাণু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নাক দিয়ে রক্ত পড়তো। ডাক্তার এই বাচ্চাদের তামাকের নেশা ছড়িয়ে দেন আর তারা কেবল ৬ মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠে।
.
প্রোফেসর রোফ ম্যুনি আয়োর্সের ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে হাজার-হাজার রোগীর পরীক্ষা করে বলেন যে এরমধ্যে বেশির ভাগ ফুসফুস, গলা, মুখ আর শ্বাস নালীর ক্যান্সারের রোগী, এরমধ্যে ৮০ শতাংশ তামাকের সেবন করতো।
.
তামাকের প্রভাব সন্তানের উৎপত্তির উপরও পড়ে। পরিণামস্বরূপ তামাক সেবনকারী ব্যক্তির বীর্যের সন্তান উৎপন্নকারী কীটাণু মৃত হয়। অনেক বিদ্বানের মতে তামাক মদের থেকেও অধিক হানিকর। যে পদার্থকে পশুও খায় না তার সেবন যদি মানুষ করে এটা ভারী লজ্জাস্পদ। মানুষকে বিবেক অনুযায়ী কাজ করা উচিত।
চা (tea)
তামাকের পশ্চাৎ যদি কোনো বস্তুর অধিক প্রচার হয়ে থাকে তো সেটা হল চা। চা শুধু ভারত কেন সারা সংসারের উত্তম পানীয় পদার্থ হয়ে গেছে। স্টেশনের প্রাচীরে, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, হাসপাতাল অফিস দোকানে, বাস মোটর ট্রামে তথা সমাচার পত্রের পৃষ্ঠায় "চা ভারতের সর্বোত্তম পানীয়" শীর্ষক বিজ্ঞাপন লেখা থাকে। "কৃষক, শ্রমিক, ধনী, গরীব, দোকানদার, স্ত্রী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ ইত্যাদি সবার জন্য চা-পান শরীরে স্ফূর্তি নিয়ে আসে। চা গরমে শীতলতা তথা শীতে উষ্ণতা দেয়, জ্বরকে থামিয়ে দেয়, বৃদ্ধবস্থা দূর করে, শরীরে নবজীবনের সঞ্চার করে, ক্লান্তি দূর করে, মস্তিষ্ককে তাজা করে।" ইত্যাদি অনেক প্রকারের অসত্য কথার প্রচার করা হয়।
.
প্রচার তথা বিজ্ঞাপনের উপর কোটি-কোটি টাকা খরচ করা হয়, বিক্রয়সাহিত্য বিতরণ করা হয়। গ্রামে-গ্রামে তথা শহর-নগরে গ্রামোফোনে গান শুনিয়ে-শুনিয়ে চায়ের প্রচার করা হয়। কিভাবে চা বানাতে হয় তাও শেখানো হয়। প্রচার সমিতিগুলো চা বানিয়ে বিনা মূল্যে সবাইকে চা পান করাতো। এইভাবে বাজনা বাজিয়ে চায়ের বিজ্ঞাপন করা হয়। চায়ের প্রচারে নমুনা রূপে বিনা মূল্যের চা পানের জন্য মানুষকে প্রোৎসাহিত করা হতো।
.
চায়ের বর্ণনা আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে কোত্থাও নেই। বলা হয় যে চায়ের জন্ম চীনদেশে হয়েছে। ভারতেও চা আসাম, বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মৈসূর, ত্রাবনকোর, কোচিনে উৎপন্ন হয়। সারা বিশ্বে ভারত আর শ্রীলঙ্কা ৯০ শতাংশ চা উৎপন্ন করে। ভারতে ইংরেজরাই চা উৎপত্তির জন্য প্রোৎসাহিত করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চায়ের সব বাগানকে নিজের হাতে নিয়ে নেয়। আজও চায়ের ব্যবসা বিদেশী পুঁজিপতিদের হাতে আছে। ভারত প্রতিবছর ২৫ কোটি টাকার চা বিদেশে, বিশেষ করে ব্রিটেনে পাঠায়। প্রায় ৬০ কোটির জনসংখ্যার ভারতে চায়ের উপর কত অর্থ ব্যয় করা হয় সেটা অনুমান করেই জানা যেতে পারে।
.
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায় দুই পাউন্ড চা ১৬৬৪ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন চার্লস দ্বিতীয়কে ভেট করে। সেই চা মহারানী ক্রেইপরিনের খুব পছন্দ হয়। পরিণাম স্বরূপ ইংল্যান্ডে খুব শীঘ্র এর প্রচার হয়।
.
চীনে চায়ের প্রচার অনেক আগে থেকে ছিল কিন্তু ইউরোপে এর প্রচার সপ্তদশ আর অষ্টাদশের মাঝে হয়। তদুপরান্ত এর প্রচার ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। বিজ্ঞাপনের যুগে এখন এর প্রচার আরও বাড়বে। ভারতে গ্রামের মধ্যেও এখন দুধের পরিবর্তে অতিথিকে আপ্যায়নে চা দেওয়া হচ্ছে। সহভোজ আর সহপানের পরিবর্তে এখন "টি পার্টি" নাম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
.
"দুগ্ধম্ বৈ বলম্" "দুধ মানেই বল" এইরূপ বিশ্বাসী ভারতবাসী এখন চায়ের পিছনে দৌড়াচ্ছে। আসলে দুধের অভাবেই চা-কে মাথায় তুলে রেখেছে। নগরবাসী এটা জানে যে আমরা তো বিশুদ্ধ দুধ প্রাপ্ত করতে পারবো না, সেই ক্রিম বের করে নেওয়া দুধ জলের সমান, তার উপর আবার জল মেশানো, তবুও যথেষ্ট দাম হবে। অন্যদিকে এক কাপ চায়ের দাম যত হয়, তত পরিমাণ দুধের দাম বেশি আর সেটাও বিশুদ্ধ হয় না। তাছাড়া চা পান করলে কিছু সময়ের জন্য মস্তিষ্কে চেতনতা তো আসে, এইজন্য মানুষ চা-পান করা শুরু করে। গ্রামীণরাও নগরবাসীর অনুকরণ করা শুরু করে। বিবাহ আদি অনুষ্ঠানে দুধের জন্য কেন অর্থ ব্যয় হবে, একটু চা দিয়েই তো কাজ চলে যায় কিন্তু তারা এটা বোঝে না যে চা-পান করে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে অন্যায় করছি।
.
চা হল এক ধরনের গাছের শুকনো পাতা। এই পাতা ঝোপের আগায় হয়। চা গ্রীষ্মমন্ডলীয় পণ্য আর এটা উৎপন্ন করতে ঢালু ভূমি তথা অধিক উষ্ণ ও অধিক বর্ষার আবশ্যকতা হয়। ভারতের পাহাড়ী প্রদেশে যেখানে বর্ষা অধিক মাত্রায় হয় আর ভূমি ঢালু আছে, সেখানে চা অধিক উৎপন্ন হয়। চা গাছের ঝোপ পাঁচ থেকে সাত ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। একবার লাগালে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে চা-পাতা চলে আসে আর পঁচিশ-তিরিশ বছর পর্যন্ত ক্রমাগত চা-পাতা আসতে থাকে। পাতা ছিঁড়ে ছায়াতে শুকাতে তথা গরম পাত্রে রোস্ট করতে শ্রমিকের খুব আবশ্যকতা হয়। যেখানে শ্রমিকের অভাব আছে সেখানে চায়ের উৎপত্তি অধিক করা সম্ভব না।
.
চা-পাতা বিভিন্ন প্রকারের হয়। লুশাই আর কাচ্ছারের পাতা এক ফুট লম্বা হয়। আসামের চা-পাতা ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।
.
চা হচ্ছে মাদক দ্রব্য, এটা পান করলে হালকা নেশা হয়। এরমধ্যে তিনটা বিষ আছে - থিন, টেনিন (Tannin), বোলেটাইল তেল (Volatile oil), এর মধ্যে থিন হল একটা তীব্র ক্ষার। জ্ঞানতন্তুর সংগঠনের উপর এর খুব উত্তেজক আর বিষাক্ত প্রভাব পড়ে। চা পান করলে যে একটা হালকা আনন্দের অনুভূতি হয়, সেটা হল এই ক্ষারের প্রভাব।
.
টেনিন হচ্ছে এক তীব্র কব্জ (অজীর্ণ) কারী পদার্থ, যার দ্বারা পাচনশক্তি একদম নষ্ট হয়ে যায়, উদরে বিভিন্ন প্রকারের বিকার উৎপন্ন হয়। শিরা ফুলে যায়, রক্ত একত্রিত হয় আদি-আদি। পুনঃ অপরেশন করার আবশ্যকতা হয়।
.
বোলেটাইল তেলে নিদ্রা নষ্ট করার শক্তি আছে, যার কারণে চোখের অনেক রোগ হয়। যখন ভারতে দুধ ঘী সেবনের প্রচলন ছিল তখন এমন ব্যক্তি উৎপন্ন হতো যারা ১০০ বছরের অধিক আয়ু উপভোগ করতো আর তাদের চোখের জ্যোতিও ঠিক অবস্থায় ছিল, কারও চোখে কখনও চশমা লাগে নি। কিন্তু আজ চায়ের কৃপায় পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট-ছোট্ট শিশুদের চোখে চশমা লাগাতে হচ্ছে।
.
বলা হয় যে বৃদ্ধাবস্থায় চা শরীরে স্ফূর্তি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা কেবল ভ্রান্তি, এটা চা বিক্রেতাদের মিথ্যা প্রচার। বৃদ্ধাবস্থায় চা সেবনকারী ব্যক্তির নিদ্রানাশ, কম্পন, মস্তিষ্কে বিশৃঙ্খলা আর হৃদয়ের কম্পন আদি রোগ হয়।
.
এমনও বলা হয় যে চায়ের উষ্ণ জল পেটে যাওয়া লাভদায়ক। কিন্তু জলের সঙ্গে বিষও যায়, সেটা নেশা করায় আর বিভিন্ন প্রকারের রোগকে উৎপন্ন করে। এই বিষময় নেশা উৎপন্নকারী পানীয় পদার্থের কারণেই মানুষের আয়ু হ্রাস হয়।
.
চা হল এমন এক পদার্থ যা অভ্যাসে পরিণত হয়। আজ ঘরে-ঘরে চায়ের পাত্র পাওয়া যাবে, লক্ষ-লক্ষ টাকা কাপ প্লেটের উপর ব্যয় হচ্ছে। এর অভ্যাস এমন হয় যে হীন-দরিদ্র শ্রমিকও যতক্ষণ পর্যন্ত এক কাপ চা-পান না করছে, মনে শান্তি পায় না।
.
বুদ্ধি আর স্বাস্থ্যকে নষ্ট করে এমন পদার্থ একদম নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের দিকে সরকারের ধ্যান যাওয়া উচিত, বাস্তবিকতার বিপরীত বিজ্ঞাপন হওয়া উচিত নয়।
.
চায়ের সঙ্গে-সঙ্গে কোকো, কাহওয়াহ (kahwah), কফি আদিরও প্রচার হয়। এইগুলো চায়ের থেকে অধিক নেশা করে আর চায়ের মতোই ব্যবহার করা হয়।
.
কোকোর মধ্যে একটা ক্ষার থিয়োক্রোমাইন থাকে যা হৃদয় কম্পন আর মস্তিষ্কের শক্তির উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।
.
কাহওয়াহের মধ্যে কাফিন নামক একটা বিষ অধিক থাকে যা ৭৫% হয়, এটা হল কড়া বিষ। এটা হৃদস্পন্দনকে ধীর করে দেয়।
.
গান্ধী জী বলেছেন "এই পদার্থ রাষ্ট্রকে ডুবানোর জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ করছে। এটা সহস্র স্ত্রী-পুরুষের ক্ষিদে নষ্ট করেছে। এটা গরীবদের ফালতু খরচা।"
আফিম, গাঁজা, ভাঙ্গ আদি
আফিমও একটা মাদক দ্রব্য। ভারতে এটা পর্যাপ্ত রূপে উৎপন্ন হতো, ভারত প্রায় সাত-আট কোটি টাকার আফিম চীনে পাঠাতো, কিন্তু চীনের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কারণে আফিম পাঠানো বন্ধ হয় আর তাই আফিমের উৎপত্তিতে প্রোৎসাহন নেই, তবুও উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা আর মধ্যভারতের মালবা রাজ্যতে কিছু পরিণাম উৎপন্ন হয়।
.
আফিম সেবন করলে অজীর্ণতা বাড়ে, পাচনশক্তি নষ্ট হয় তথা শ্বাসরোগ, হাঁপানি আদিকে উৎপন্ন করে। বুদ্ধিকে হ্রাস করে, মস্তিষ্কের শক্তিকে নষ্ট করে আর খিটখিটে বা বদমেজাজী করে তোলে আর শরীরকে শুকিয়ে দেয়।
.
তামাকের সেবন ভালো নয়, কিন্তু মানুষ যদি চায় তাহলে তার নেশা ছাড়তে পারবে, কিন্তু যারা আফিম সেবনে নেশাগ্রস্থ তাদের আফিম ত্যাগ করা খুবই কঠিন। এটা সাধারণ আর সরল কাজ নয়, আফিমখোর ব্যক্তির অবস্থা খুব খারাপ হয়। যতক্ষণ আফিম না পাচ্ছে ততক্ষণ সংসারের কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না। আফিমখোরের স্নায়ুমণ্ডল সারাজীবনের জন্য নির্জীব হয়ে যায়। আফিম মস্তিষ্ককে মন্দ (slow) করে জ্ঞান-তন্তুকে মূর্ছিত করে আর মস্তিষ্ক যখন অচৈতন্য হয়, তখন শ্রবণশক্তি স্বরেন্দ্রিয় আর দৃষ্টির উপরও তার খুব খারাপ প্রভাব পড়ে।
.
যদি কোনো ব্যক্তি ৩ গ্রাম আফিম প্রতিদিন সেবন করে আর তাকে ৩ গ্রামের স্থানে ২ গ্রাম আফিম দেওয়া হয় তাহলে সে আরও এক গ্রাম বা এক গ্রামের অধিক নেওয়ার জন্য ছটফট করবে। যদি ৪ গ্রাম আফিম দেওয়া হয় তাহলে সে খুব মজা করে তার সেবন করবে। তবে হ্যাঁ, যদি একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়, এক গ্রামও না দেওয়া হয় তাহলে হতাশ হবে আর অস্থির হয়ে উঠবে।
.
বলা হয় যে আফিম বাচ্চাদের শক্তি প্রদান করে, বৃদ্ধদের সহায়তা করে, কিন্তু এইসব কথা বুদ্ধি বিরুদ্ধ। বেশিরভাগ স্ত্রী যারা খেত বা কারখানাতে কাজ করে, তারা তাদের বাচ্চাকে আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আফিমের নেশাতে বাচ্চা দুই-চার ঘন্টা পর্যন্ত চুপচাপ শুয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু এর পরিণাম খুবই ঘাতক হয়। বেশির ভাগ বাচ্চার যকৃৎ খারাপ হয়, বাচ্চা শুকিয়ে যায় আর সে বিভিন্ন রোগের কারণে অকালেই প্রাণ হারায়। উপরোক্ত প্রথা ভারী ভয়ানক, সুতরাং বুদ্ধিমতি স্ত্রীদের এর থেকে দূরে থাকা উচিত।
.
এটা ঠিক যে কিছু রোগের মধ্যে আফিম ওষুধ রূপে কাজ করে, বাড়তে থাকা সাংঘাতিক লক্ষণকে থামিয়ে দেয়, বিশেষ করে ব্যথার বেদনাকে দূর করতে এটা সহায়ক হয়।
.
পশ্চিমী দেশের ব্যবসায়ীদের কারণেই পূর্বীয় দেশে আফিমের প্রচার বেড়েছে। এরা পূর্বীয় দেশের মধ্যে আফিম আদি মাদক দ্রব্যের ব্যবসা করে এর গুরুত্বকে বাড়িয়েছে, তাহলেও আফিমের অধিক বৃদ্ধির আসল কারণ আফিমখোরদের সংঘই হয়। আফিমখোর ব্যক্তিরা পরস্পর এর খুব প্রচার করে (সঙ্গী বাড়ায়)। আফিম সেবনের নেশা ত্যাগ করা যায় না, তা তো নয়, যদি কেউ ছাড়তে চায় তাহলে ছাড়তে পারবে কিন্তু আফিম ছাড়তে হলে খুব বড় মানসিক শক্তির আবশ্যকতা হয়।
.
আফিমখোর কোনো কথা নিশ্চয়পূর্বক বলতে পারে না, তার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার যদি তার সেনাতে কাউকে আফিম সেবন করতে দেখে তাহলে তাকে ততকাল চাকরি থেকে বহিষ্কার করে দিতো, কারণ তার সেবা সন্দেহজনক বলে বিবেচিত হতো।
.
আফিমের পাশাপাশি গাঁজা, ভাঙ্গ আদিও মারাত্মক নেশা উৎপন্নকারী পদার্থ, এইসব পদার্থ থেকে সকল মানবকে দূরে থাকা উচিত। মানুষের জন্য এইসব অভক্ষ্য আর অপেয় (অপানীয়) বস্তু।
.
উপসংহার
বুদ্ধি আর বিবেক অনুযায়ী কাজ করা মানুষের ধর্ম, যেসব পদার্থ সাত্ত্বিক, লাভদায়ক আর ভক্ষ্য, তারই সেবন করা উচিত, বাকি সব হানিকারক পদার্থকে একদম ত্যাগ করা উচিত, যাতে শরীর সুস্থ দৃঢ় হয়ে মানুষ তার চরম লক্ষ্য মোক্ষ বা ঈশ্বর পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়। মানবদেহ এতেই সফল হবে।
(নবম অধ্যায় সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ