নবম ভাগ
ভোজন
ভূমিকা -
"ধর্মার্থকামমোক্ষাণামারোগ্যম্ মূলমুত্তমম্"
.
ধর্ম-অর্থ-কাম আর মোক্ষ এই পুরুষার্থচতুষ্টয় হল মানব জীবনের উদ্দেশ্য। এই পুরুষার্থচতুষ্টয় সিদ্ধির মূলকারণ হল আরোগ্য। শরীর যদি সুস্থ না থাকে, রোগী হয় তাহলে পুরুষার্থচতুষ্টয় কেন, শৌচ স্নানাদি নিত্য কর্মের অনুষ্ঠানও সঠিকভাবে হবে না। রোগী স্বয়ং অন্যের উপর বোঝা হয়ে যাবে, সে কিভাবে অন্যের সেবা বা উপকার করবে তথা কিভাবে ধর্মানুসারে চলবে? এইজন্য শরীরের সুস্থতাকে পুরুষার্থচতুষ্টয়ের সিদ্ধির জন্য আমাদের শাস্ত্রকারগণ সর্বপ্রথম আর মুখ্য স্থান দিয়েছেন।
.
জীবনের চরম লক্ষ্য, অন্তিম ধ্যেয় হল মোক্ষপ্রাপ্তি আর তার প্রাপ্তি আত্মা এই শরীররূপী রথের সহায়তায় করে। যদি শরীররূপী রথ সুস্থ আর দৃঢ় না হয় তাহলে মাঝ পথেই জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাবে তথা আত্মা তার লক্ষ্যের প্রাপ্তি করতে পারবে না। আবাগমনের চক্র থেকে না বেরিয়ে বরং দুঃখসাগরেই পাক খেতে থাকবে। সুতরাং আমাদের শরীররূপী রথ, জীবন যাত্রার সাধন, সুস্থ দৃঢ় আর সুগঠিত হোক সেটা অবশ্যক।
আহারবৈষম্যাদস্বাস্হ্যম্" (সুশ্রুত অধ্যায় ৪৬)
.
ভোজন বিষমতার কারণে স্বাস্থ্য খারাপ হয়। শরীরকে সুস্থ আর নীরোগ রাখার জন্য ভোজনের স্থান হল সর্বপ্রথম, কারণ এই পঞ্চভৌতিক শরীর ভোজনের মাধ্যমেই হৃষ্ট-পুষ্ট আর দৃঢ়াঙ্গ হয়। শরীরের উপচয়-অপচয় বা বৃদ্ধি আর হ্রাস ভোজনের উপর নির্ভর করে। যদি শরীরকে যথা সময়ে উচিত ভোজন দেওয়া হয় তাহলে শরীরও হৃষ্ট-পুষ্ট আর সুডৌল হয় অন্যথা স্বাস্থ্য খারাপ হয়।
.
ভোজনের মতো আবশ্যক আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপেক্ষা করা মানে নিজের জীবনের উপেক্ষা করা, ভোজনের বিষয়ে অজ্ঞানী থাকা মানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে রাখা। আমাদের পূর্বজ ঋষি-মহর্ষিগণ এই বিষয়ে অনেক গম্ভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেছেন। কোন পদার্থের কি গুণ আছে আর সেটা কি অবস্থায় লাভদায়ক তথা হানিপ্রদ, দেশ-কাল আর প্রকৃতি ভেদে আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভক্ষ্যাভক্ষ্য পদার্থের পূর্ণ মীমাংসা করে দিয়েছেন, এইজন্য আমাদের দেশ যখন শাস্ত্রবিহিত ভোজন করতো তখন সংসারের মধ্যে আমাদের দেশে সবাই বীর শক্তিশালীর শিরোমণি ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজ আমরা শাস্ত্রকে ভুলে গেছি, তাই ভোজনের নামে অনেক কুপ্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে। মদ্য, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ আদি অভক্ষ্য পদার্থও নিঃসঙ্কোচ হয়ে লোকে সেবন করছে।
.
এর মুখ্য কারণ হল আমরা ভোজনের মুখ্য উদ্দেশ্যটাই ভুলে গেছি, আমাদের ভোজন জীবনের জন্য নয় বরং জীবনটাই ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। ভোজন পরীক্ষার সাধন কেবল জিহ্বাই রয়ে গেছে আর এই পিশাচিনী এত লোলুপ হয়ে গেছে যে সব সর্বনাশ করে দিয়েছে।
.
ভোজন বিগড়ে যাওয়াতে আর অসংযত হওয়াতে ব্রহ্মচর্য পালন আর সংযত জীবনের অভাব হয়ে গেছে। বিষয়বাসনা, শৃঙ্গার আর ব্যভিচারের আগুন এত প্রচণ্ড ভাবে জ্বলছে যে ঋষিদের এই পবিত্র ভূমি শুধু ভারতই নয় বরং সমস্ত বিশ্বকেই ভস্মসাৎ করে দিচ্ছে।
.
এমন বিকট সময়ে এই ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায় "ভোজন" যদি কারও কোনো পথ প্রদর্শন করতে পারে তাহলে আমার পরিশ্রম সফল তথা দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করবো।
.
এরমধ্যে ভোজন সম্বন্ধীয় অনেক ভ্রান্তধারণা আর কুপ্রথার খণ্ডন করা হয়েছে। এমন অনেক বিষয় পাঠক মহানুভবগণ দেখবেন যা সর্বথা নবীন বলে মনে হবে, সেগুলোর উপর গম্ভীর ভাবে বিচার করলে তত্ত্বজ্ঞান হবে। আমি সেটা যথাশক্তি উপযোগী আর সহজভাবে করার চেষ্টা করেছি, আমি আমার কাজে কতটা সফল হয়েছি তা পাঠক মহানুভবই বলতে পারবেন।
ওমানন্দ সরস্বতী
গুরুকুল ঝজ্জর
বৈশাখ ২০৩৪ (বিক্রম)
মে ১৯৭৭ ইংরাজি
____________________________________________
.
আমাদের ভোজন
.
প্রত্যেক মানুষ সুস্থ থাকতে চায়, কেউই রোগী হয়ে থাকতে চায় না। স্বাস্থ্য আর ভোজনের মধ্যে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। বিচারশীল পুরুষ তথা সমাজ এর গুরুত্বকে সঠিক ভাবে জানে। আমাদের প্রাচীন পুরুষ ভোজনের গুরুত্বকে ঠিকভাবে জানতেন তাই তাঁরা এই বিষয়ে খুব সাবধান ছিলেন। আজ আমরা তাঁদের সন্তান ভোজনের বিষয়ে কিঞ্চিৎমাত্র ধ্যান রাখি না।
.
দৈনিক আহার আমাদের স্বাস্থ্য, ব্রহ্মচর্য, মন, বুদ্ধি আর আত্মার উপর কি প্রভাব ফেলে সেটা নিয়েও আমরা কখনও ভাবার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। শুদ্ধাহার দ্বারাই মানুষের সবকিছু শুদ্ধ হয় আর মিথ্যাহার দ্বারা হয় সর্বনাশ। এর উপর আমাদের প্রাচীন ঋষি-মহর্ষিগণ গম্ভীর ভাবে কেবল বিচারই করেছেন তা নয় বরং পূর্ণ রূপে অনুভব করেছেন। এইজন্য তাঁরা নিজের অনুসন্ধানের আধারে শুদ্ধাহারের অনেক প্রশংসা করেছেন। ছান্দোগ্যোপনিষদের মধ্যে লেখা আছে -
.
আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাম্ বিপ্রমোক্ষঃ।।
.
আহার শুদ্ধ হওয়াতে অন্তঃকরণ অর্থাৎ বুদ্ধি আদির শুদ্ধি হয়, বুদ্ধি শুদ্ধি হওয়াতে স্মৃতি দৃঢ় বা স্থির হয়, স্মৃতি দৃঢ় হওয়াতে হৃদয়ের আবরণ অর্থাৎ জন্ম-মরণের বন্ধন ঢিলে হয়, অবিদ্যা-অন্ধকার মুছে গিয়ে মানুষ সকল প্রকার দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয় আর পরম পদ মোক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। সুতরাং শুদ্ধাহারের ফলে মানুষের এই লোক তথা পরলোক দুটোতেই মঙ্গল হয়। য়োগীরাজ শ্রীকৃষ্ণ জী গীতার মধ্যে একে এইভাবে লিখেছেন -
.
য়ুক্তাহারবিহারস্য য়ুক্তচেষ্টস্য কর্মসু।
য়ুক্তস্বপ্নাববোধস্য য়োগো ভবতি দুঃখহা।। (৬/১৭)
.
যথাযত আহার-বিহার, যথাযত কর্মকারী, উচিত মাত্রায় নিদ্রা আর জাগরণকারীর এই য়োগ দুঃখনাশক হয় অর্থাৎ সঠিকভাবে আহার-বিহার আদির সেবন করলে মানুষের সব দুঃখ দূর হয়।
.
ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণীর আছে, কীট পতঙ্গ থেকে শুরু করে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ পর্যন্ত এই ভোজনের জন্য ব্যাকুল হতে দেখা যায়। এই যুগের মানুষের সম্পূর্ণ শক্তি এই ভোজনের জোগাড় করতেই চলে যায়। প্রাতঃকাল থেকে শুরু করে সায়ংকাল পর্যন্ত "হায় ভোজন হায় ভোজন" করে দৌড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, আজ মানুষের জীবন-মরণও ভোজনের জন্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ভোজন কেন করি, এর উচিত উত্তর সহস্র ব্যক্তির মধ্যে কোনো বিচারশীল ব্যক্তিই দিতে পারবে। আয়ুর্বেদ গ্রন্থের মধ্যে এর উত্তর এই ভাবে দেওয়া আছে -
.
আহারঃ প্রীণনঃ সদ্যোবলকৃদ্দেহধারণঃ।
স্মৃত্যায়ুঃ শক্তিবর্ণোজঃ মত্ত্বশোভাবিবর্ধনঃ।। (ভাব০ ৪/১)
.
ভোজন দ্বারা তৎকাল শরীরের পোষণ আর ধারণ হয়, বলের বৃদ্ধি হয় তথা স্মরণ শক্তি, আয়ু, সামর্থ্য, শরীরের বর্ণ, কান্তি, উৎসাহ, ধৈর্য্য আর শোভা বৃদ্ধি পায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হল যে - আহার হচ্ছে আমাদের জীবন। কারণ ভোজন দ্বারা শুধু মানুষ কেন সকল প্রাণীর জীবন রক্ষা হয়, সুতরাং ভোজনের আবশ্যকতা সব প্রাণধারীদের আছে অথবা বলা উচিত প্রাণীমাত্রের জীবনের আধার হল ভোজন। যদি আমরা ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে আমাদের জীবিত থাকা অসম্ভব। সুতরাং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক প্রাণী জীবনধারণার্থ ভোজন গ্রহণ করতে থাকে আর তার দ্বারাই জীবিত থাকে। সুতরাং সর্বপ্রথম তথা সর্বোত্তম ভোজনের গুরুত্ব আমাদের জীবনে এটাই, যাকে ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারবো না। এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে আমরা যদি অন্ধকারে থাকি তাহলে সেটা বড়ই আশ্চর্য তথা মুর্খতা হবে। অপঠিত বা অশিক্ষিত জীবনের বিষয়ে যাদের কোনো জ্ঞান নেই, এমন ব্যক্তি যদি এই বিষয়ে কিছু না জানে তাহলে কোনো বড় বিষয় হবে না, কিন্তু আজকের শিক্ষিত সমুদায় এই বিষয়ে একদম পঙ্গু যা বড়ই দুঃখের বিষয়। অশিক্ষিত ভাই তো কিছু প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে এই বিষয়ে একটু হলেও কম-বেশি কিছু জ্ঞান রাখে কিন্তু বড়-বড় বি.এ., এম.এ., প্রভাকর আর শাস্ত্রী আদি ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদের মধ্যে জীবনের আধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জ্ঞানের অভাব থাকলে, তাহলে তো এইরকম দুঃখজনক অবস্থাকে দেখে অত্যন্ত দুঃখই হবে আর দেশের নিকট ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল প্রতীত হয় না।
.
তাছাড়া এটুকু জ্ঞান তো প্রত্যেক প্রাণীর আছে যে ভোজনের পশ্চাৎ বল উৎসাহ প্রতীত হয়, ক্ষুধার্ত প্রাণীর মধ্যে এর অভাব দেখা যায়। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে মৃত্যু নিশ্চিৎ রূপে দর্শন দিবে, এটা শরীরের রচয়িতা বা প্রকৃতির অটল নিয়ম। উচিত এবং আবশ্যক ভোজন প্রাপ্তি বিনা স্বাস্থ্যরক্ষা অথবা জীবনরক্ষা হবে না। এইজন্য স্বাস্থ্য প্রাপ্তি তথা জীবন রক্ষার জন্য ভোজনেরও একটা বিশেষ স্থান আছে। এই বিষয়ে চরকসংহিতার মধ্যে বলা হয়েছে -
.
বলমারোগ্যমায়ুশ্চ প্রাণাশ্চাগ্নৌ প্রতিষ্ঠিতাঃ।
অন্নপানেন্ধনৈশ্চাগ্নির্দীপ্যতে শাম্যতেऽন্যথা।।
.
শরীরের ভিতরে যে অগ্নি আছে তারই আশ্রয়ে শরীরে প্রাণ স্থির থাকে। এই অগ্নি বল, আরোগ্য আর আয়ুর প্রতিষ্ঠাকারী হয় অথবা বলা উচিত অন্তরগ্নিতে শরীর স্থিত আছে। অন্ন-পান রূপী জ্বালানি দ্বারাই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, এই অগ্নির দীপন আর শমন ভোজনের দ্বারাই হয়। এটা আমরা প্রত্যক্ষ দেখি যে অন্ন-পানের সেবন দ্বারা আয়ুপর্যন্ত প্রাণ থাকে। এই বিষয়ে চরক সংহিতাতে লেখা আছে -
.
ইষ্টবর্ণগন্ধরসস্পর্শবিধিবিহিতমন্নপানম্ প্রাণিনাম্ প্রাণি সঞ্জ্ঞকানাম্ প্রাণমাচক্ষতে কুশলাঃ, প্রত্যক্ষফলদর্শনাৎ, তদিন্ধনা হ্যন্তরাগ্নেঃ স্থিতিঃ, তৎসত্ত্বমূর্জয়তি, তচ্ছরীরধাতুব্যূহবলবর্ণেন্দ্রিয়প্রসাদকরম্ য়থোক্তমুপসেব্যমানম্ বিপরীতমহিতায় সম্পদ্যতে।
.
কুশল বিচারশীল পুরুষ যে অন্ন-পান (ভোজন) বিধিপূর্বক বানানো হয়েছে, যা সুন্দর বর্ণ (রঙ) গন্ধ রস তথা স্পর্শসংযুক্ত তাকে মনুষ্য আদি দেহধারীদের জন্য প্রাণতুল্য মানেন। কারণ এটা প্রত্যক্ষ অনুভবের বিষয় যে অন্ন-পান দ্বারা প্রাণীদের প্রাণ কাজ করে। ভোজন না করলে আয়ু ক্ষীণ হয়ে মৃত্যু হয়। অন্ন-পানের কারণেই অন্তরগ্নি স্থির থাকে, অন্নের কারণে মনের মধ্যেও বল আসে। যখন ভোজন যথাযত ভাবে করা হয় তখন এটা শরীরের বাতাদি দোষের রস রক্ত বীর্যাদি ধাতুর সংঘাতকে তৈরী করে। যেখানে যে ধাতুর ন্যূনতা থাকে সেখানে তার ভোজন পূর্তি করে দেয়। বিধিপূর্বক ভোজন শরীরকে বল দেয়, বর্ণকে উজ্জ্বল করে, কান্তি দায়ক আর ইন্দ্রিয়কে প্রসন্ন তথা তৃপ্ত করে। বিধির বিপরীত সেবন করলে হানিকারক সিদ্ধ হয়।
.
আহার দ্বারা শরীরের বিকাশ আর বৃদ্ধি
.
সব প্রাণী যখনই জন্ম নেয় ততকাল খিদে তাদের যন্ত্রণা দেয়। মাতার গর্ভ থেকে বাইরে আসা মাত্র মানব-শিশু সঙ্গে-সঙ্গে কান্না আর ঝটপট করতে থাকে আর যখন মাতার স্তন যেখানে, সেখানে তার মুখ আসে তথা সে দুগ্ধামৃতের পান করে, সে ততকাল শান্তচিত্ত হয়ে খেলা শুরু করে বা ঘুমিয়ে পড়ে। খিদের নিবৃত্তির সঙ্গে-সঙ্গে তার ব্যাকুলতাও পালিয়ে যায়। সব প্রাণীর অবস্থাই এইরূপ সমান হয়।
.
এই দুগ্ধপান তথা ভোজনের সেবন দ্বারা সব প্রাণী খিদে শান্ত হতেই যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনি এদের শরীরের মধ্যে কিছু দিনের মধ্যেই বৃদ্ধি-বিকাশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। এরদ্বারা সিদ্ধ হয় যে জন্মের সময় থেকে যুবকাবস্থা পর্যন্ত শুধু মানুষই নয় বরং প্রত্যেক প্রাণীর শরীরের বৃদ্ধি তথা বিকাশ প্রতিদিনের করা ভোজনের মাধ্যমে হয়।
.
সুতরাং আমাদের শরীরের সম্যক্তয়া বৃদ্ধি বা সম্পূর্ণ বিকাশ আমাদের ভোজনের উপর নির্ভর করে, যদি আমরা যথাযত ভাবে ভোজন প্রাপ্ত না করি তাহলে শরীরের বিকাশও থেমে যাবে। যদি ভোজন সর্বথা না করা হয় তাহলে বিকাশের স্থানে হ্রাস তথা শেষে শরীরের নাশ হবে। তাই আহার যেমন জীবনের আধার তেমনই বিকাশ বা বৃদ্ধিরও মুখ্য কারণ কিন্তু সেই ভোজন হিতকর হওয়া উচিত। হিতকর ভোজন বিনা বৃদ্ধি অসম্ভব। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে -
.
"হিতাহারোপয়োগ এব পুরুষস্যাভিবৃদ্ধিকরো ভবতি"
.
অর্থাৎ একমাত্র হিতকর আহারের ব্যবহারই পুরুষের শরীরের বৃদ্ধি করে। তাছাড়া যেটাই খাওয়া হয় তাকেই আহার (ভোজন) বলে। চরক শাস্ত্রের মধ্যে লেখা আছে "আহারত্বমাহারস্যৈকবিধমর্থাভেদাৎ" নিগরণ অর্থাৎ গ্রাসের ক্রিয়া সব আহারের মধ্যে এক সমান হয়। ভিন্ন-ভিন্ন ভোজনের বস্তুতে নিগরণ সমান হওয়ার কারণে সবগুলোকে আহার বলে। "আহার্য়তে গলাদধো নীয়তে ইত্যাহারঃ" গলা থেকে নীচে যা নিয়ে যাওয়া হয় তাকে আহার বলে। সব আহারের দ্রব্যতে আহারতা থাকে, কিন্তু আমাদের জন্য হিতকর আহার কোনটা সেটা জেনে রাখা উচিত। যে আহার শরীরের বৃদ্ধি করে আর হিতকর হয়, এই একটা লক্ষণ তো করে দেওয়া হয়েছে। এরপর এই বিষয়ে লেখা আছে -
.
সমাঁশ্চৈব শরীরধাতূন্ প্রকৃতৌ স্থাপয়তি বিষমাঁশ্চ সমীকরোতীত্যেতদ্ধিতম্ বিদ্ধি, বিপরীতমহিতমিতি, এতদ্ হিতাহিতলক্ষণমনপবাদম্ ভবতি। (চরক সূত্র০ অ০ ২৫)
.
অগ্নিবেশ জিগ্যেস করাতে ভগবান্ আত্রেয় উত্তর দেন - যে আহার অসমাবস্থায় স্থিত শরীরের বাত, পিত্ত, কফ, রক্ত, মাংস, বীর্যাদি ধাতুকে প্রকৃতি অর্থাৎ সাম্যাবস্থাতে রাখে, দূষিত হতে দেয় না আর সুরক্ষিত রাখে। বিষম (খারাপ হওয়া) ধাতুকে সমাবস্থায় নিয়ে আসে অর্থাৎ সুধরে দেয়, সেই ভোজনকে হিতকর বলে। এর বিপরীত যেটা সম ধাতুকে বিষম (নষ্ট) করে দেয় আর বিষম অবস্থায় রাখে অর্থাৎ খারাপকে খারাপই করে রাখে তাকে অহিতকর বলে। এই বিষয়ে বিস্তার ভাবে পরে লেখা হবে। বিষম আর অহিতকর ভোজন করলে অরুচি, শারীরিক দুর্বলতা, কণ্ডু, পামা, কুষ্ঠ আদি রোগের উৎপত্তি হয়। অঙ্গাবসাদ তথা দোষ প্রকুপির হওয়াতে সেই-সেই স্থানের অনুসারে গ্রহণী অর্শ আদি রোগ উৎপন্ন করে।
🍁 অধিক ভোজন 🍁
এটা প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনের অনুভব তথা অধিকাংশ ডাক্তারের মত হল এটাই যে ৯৯ শতাংশ মানুষ আবশ্যকতার অধিক আহার গ্রহণ করে। আর এর মুখ্য কারণ হল আমরা সবাই জিহ্বার দাস হয়ে গেছি। আমাদের রসনা (জিহ্বা) সর্বদা সুস্বাদু ভোজনের জন্য ছটপট করে, তাই আমরা স্বাদের চক্করে পড়ে অধিক আহার করে ফেলি। কিন্তু স্বভাবে স্বাদপ্রিয় মানুষ সুস্বাদু ভোজনের মধ্যে যে ক্ষণিক সুখ অনুভব করে এই সুখকেই নিজের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় আর নিজের সব বহুমূল্য জীবন এই সুখের ইচ্ছাপূর্তিতেই হারিয়ে দেয় আর ভুলে যায় যে আমাদের হিত ও কল্যাণ এই সুস্বাদু ভোজন দিয়ে সম্ভব নয়। এর ফলে মানুষ পেটুক হয়ে যায়। স্বাস্থ্য, বল, বীর্য, শক্তি, ব্রহ্মচর্য চুলোয় যাক কিন্তু এই পেটুক মানুষকে চটপটা আর মিষ্টি সুস্বাদু ভোজনই চাই। জিহ্বার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে এমন ব্যক্তি খুব কম দেখা যায়। সুস্বাদু ভোজন করা কোনো পাপ নয় তবে স্বাদের কারণে অধিক আহার তথা ভোজনকে সুস্বাদু বানানোর জন্য লবণ, লংকা, মসলা, টক আদি হানিকারক পদার্থ দিয়ে ভোজনকে খারাপ করে খাওয়া তো মহামুর্খতাই হবে। কবিরাজ হরনামদাস জী এই বিষয়ে লিখেছেন "চূর্ণ আর চটপটে বস্তুর চল বেড়ে গেছে। বাবুরা ফুচকা, ইমলীর চাট, ভল্লে পকড়িয়া এক স্থানে বসে খেয়ে নেয়। হে মানব! জাগো, কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারছো, এইসব বস্তু পরিপাকতন্ত্রকে খারাপ করে আর জীবনের সার (বীর্য) -কে দুর্বল করে আর সন্তান উৎপন্ন করার যোগ্যতা রাখে না। ছোটো বাচ্চারা যারা টক খায় তাদের মধ্যে যুবকাবস্থার পূর্বেই কামবাসনার প্রতি টান আসতে থাকে, যাদের চোখ খোলা আছে তারা এইসব বিষয় স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে, অধিক কি লিখবো! এইরূপ দৃশ্যকে দেখে আমি এই পরিণামে এসেছি যে আমাদের দুর্বলতা, আমাদের রোগ, আমাদের বৃদ্ধাবস্থা, একটা সীমা পর্যন্ত অন্ন-পানের কারণেই হয়। সুতরাং ভোজনে অনেক সাবধান আর সংযত থাকা আবশ্যক।
.
🍁 ভোজনে নিয়ন্ত্রণ 🍁
স্বাস্থ্যপ্রিয় ব্যক্তি বা ব্রহ্মচারী না অধিক আহার করে আর না ন্যুন; কিন্তু শরীরের জন্য যতটা আবশ্যক ঠিক ততটুকুই আহার করে। অধিক আহার করাটা সহজ আর সর্বথা উপবাস করাও সহজ কিন্তু যথাযথ (না ন্যুন না অধিক) ভোজন করা অধিক কঠিন ব্যাপার। ভোজনে সমতা বজায় রাখাই তো ব্রহ্মচারীর আসল তপস্যা আর ভোজনের নিয়ন্ত্রণ বলতে এটাই, "মিতভোজন স্বাস্থ্যম্" একটা সূত্র আছে যার অর্থ হল মিতভোজন অর্থাৎ অল্পাহার স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর। অতিভোজন তো সবাই নিষেধ করেছেন তবে মিতাহারের প্রশংসা প্রায় সব লেখক আর প্রভাষক করেছেন। কিন্তু মানুষের জন্য বিশেষ তো তখন হবে যখন শরীরের জন্য যতটা ভোজনের আবশ্যকতা ঠিক ততটাই সে গ্রহণ করবে, না অধিক না ন্যুন। যথাযথ ভোজন করা অনেক বড় সংযম আর ভোজনের এই সংযম হল ব্রহ্মচর্য, স্বাস্থ্য আদি সব শুভ কর্মের আধারশিলা। ভোজনে সংযম করে এমন মানুষ কয়েক হাজারের মধ্যে এক-দুই জন হয় আর এমন সংযমী পুরুষই স্বাস্থ্যের আসল স্বাদ ভোগ করে তথা এইরূপ সৌভাগ্যশালী ব্যক্তিই ব্রহ্মচর্য পালনে সফলতা প্রাপ্ত করে। ৭৫ শতাংশ স্বপ্নদোষের রোগী ভোজনে সংযম না হওয়ার কারণেই হয়। যেখানে ভোজন একটু অধিক সুস্বাদু লাগে, সংযম না হওয়ার কারণে মানুষ পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভরে দেয়, রাতে পেট ভারী থাকার কারণে স্বপ্নদোষ হয়। যার ফলে স্বাদ বেরিয়ে যায়, কান্না আর আফসোস করে। অনেকেই নিজের এই ভুলকে জানতে পারে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এইভাবে হানি বহন করে বেড়ায়। কিছু রোগী অজ্ঞানবশতঃ ভোজনে অধিক আহার করার ভুল করে, যখন তারা জানতে পারে তখন অধিক আহার করা ছেড়ে দেয় আর আহার-ব্যবহারের সংযমকে ধারণ করে নেয়। নিত্য উচিত আহার-বিহার ছাড়া কল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং বিদ্যার্থী তথা সবার জন্য উচিত আহার-বিহারের আদেশ বা উপদেশ ঋষিরা করেছেন - "নিত্যম্ য়ুক্তাহারবিহারবান্ বিদ্যোপার্জনে চ য়ত্নবান্ ভব" বিদ্যার্থী অর্থাৎ ব্রহ্মচারীকে নিত্য উচিত পরিমাণ আহার-বিহার করার পাশাপাশি বিদ্যা গ্রহণে যত্নশীল হওয়া উচিত। কিন্তু অধিক অল্প মাত্রায় আহার করলে বল, বর্ণ, কান্তি, শক্তি, পুষ্টির নাশ বা ক্ষীণতা হয়, উদাবর্ত (যৌনরোগ) আদি রোগ উৎপন্ন হয়; মানুষ অতৃপ্ত আর অশান্ত থাকে, বীর্য আদি ধাতুর বৃদ্ধি হয় না, আয়ু কমে যায়। শরীরের আবশ্যকতানুসারে ভোজন না করলে শরীরের সারভাগ বীর্য, বল, ওজ নষ্ট হয়ে যায়। মন-বুদ্ধি আর ইন্দ্রিয়ের শক্তির হ্রাস আর নাশ হয় আর ৮০ প্রকারের বাত রোগের উৎপত্তি হয়। সুতরাং অল্পাহার, সুস্থশরীরে উপবাস করা আদি স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক কিন্তু এটা স্মরণে রাখা উচিত যে আবশ্যকতার তুলনায় অল্প আহার যেমন শরীরকে রোগী তথা ক্ষীণ করে, তেমনই আবশ্যকতার অধিক আহার বল, বীর্য, ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যের জন্য আরও অধিক ঘাতক হয়। অল্পাহার করা যতটা অপরাধ নয়, তারথেকেও বড় আর প্রচণ্ড অপরাধ হল অধিক আহার করা। অল্প আহার করার ফলে শরীরের ক্ষতি কিছু অধিক দিনে হয় কিন্তু অধিক আহার করা ব্যক্তি নিজের অপরাধের দণ্ড শীঘ্রই প্রাপ্ত করে। সুতরাং এখানে সংক্ষেপে অধিক আহার করার হানিগুলো দর্শানো হল।
.
🍁 অধিক আহারের ফলে হানি 🍁
মাত্রাতিরিক্ত খাবার খেলে আলস্য, প্রমাদ, পেট ফোলা, পেটের মধ্যে গুড়গুড় আদি উপদ্রপ উৎপন্ন হয়। বায়ুবিকার উৎপন্ন হয়, তেঁতো ঢেক আসে, এটা ভোজন না হজম হওয়ার পরিচয়। ডাক্তার আর বৈদ্য সবার মত হল, পেটকে ঠুসে-ঠুসে ভর্তি করলে বিশূচিকা (হৈজা) রোগ খুব শীঘ্র হয় আর ইনফ্লুএঞ্জা হওয়ারও আশঙ্কা থাকে; বদহজম, অজীর্ণ, মলবন্ধ, আনাহ (Anaphylaxis), সংগ্রহণী (IBS), অর্শ তথা স্বপ্নদোষ, প্রমেহাদি ধাতু সম্বন্ধীয় রোগ অধিক আহারকারী পেটুক ব্যক্তিদেরই হয়। মানুষ প্রায়শঃ যতটা খাবার খায় তার তিন ভাগও হজম করতে পারে না, যেসব খাবার হজম হয় না সেটা পেটের মধ্যে পড়ে থেকে রক্তকে বিষাক্ত আর দূষিত করে আর স্বপ্নদোষ তথা অর্শাদি অসংখ্য বিকারের জন্ম দেয়। প্রাণশক্তিকে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়, একটা তো অধিক ভোজনকে হজম করতে আর আরেকটা মলকে বাইরে বের করতে। অধিক আহারের ফলে রাষ্ট্রের অন্ন আর ধন, উভয়ের অপব্যয় হয় তথা প্রকৃতি দেবীও দণ্ডরূপ রোগ প্রদান করেন। ধনী ব্যক্তিরা এই দোষের অধিক দোষী, অনেক নির্ধন মানুষের পালন যার দ্বারা হওয়া সম্ভব এমন অধিক অন্ন তারা প্রতিদিন নষ্ট করে। খুবই গুরুতর অপরাধ এটা, সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত অধিক ভোজন করা উচিত নয়। এই বিষয়ে ভগবান্ মনু বলেছেন -
.
অনারোগ্যমনায়ুষ্যমস্বর্গ্যম্ চাতিভোজনম্ ।
অপুণ্যম্ লোকবিদ্বিষ্ট তস্মাত্তৎপরিবর্জয়েৎ ।। (মনু.২.৫৭)
.
অতি আহার করলে স্বাস্থ্য হানি তথা রোগের বৃদ্ধি হয়, আয়ু হ্রাস পায়, ব্যাধি আদির কারণে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়, পুণ্যের নাশ আর পাপের বৃদ্ধি হয় আর সমাজে অধিক আহার কারী ব্যক্তির নিন্দা হয়। ব্রহ্মচারীকে তো ভুলেও অধিক ভোজন করা উচিত নয়। পেট ঠুসে-ঠুসে অধিক আহারকারী ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী থাকতে পারবে না। ব্রহ্মচারীদের সায়ংকালের ভোজন মধ্যাহ্নের থেকে অর্ধেক হওয়া উচিত তথা শুতে যাওয়ার ২ থেকে ৩ ঘন্টা পূর্বেই ভোজন করা উচিত। দুগ্ধ তথা জলপানও শুতে যাওয়ার দুই বা তিন ঘন্টা পূর্বেই করা উচিত। সুতরাং ভোজন অধিক করা উচিত নয়।
.
এই বিষয়ে "ব্রহ্মচর্যই হল জীবন" পুস্তকের প্রসিদ্ধ লেখক স্বামী শিবানন্দ জী লিখেছেন - " অধিক ভোজন করা ব্যক্তি সাত জন্মেও ব্রহ্মচারী হবে না, কারণ ঝড়ের দমকা হওয়া যেমন গাছকে উপড়ে ফেলে দেয় ঠিক তেমনই কামদেব পেটুক মানুষকে আছড়ে-আছড়ে মেরে ফেলে। অধিক আহার কারী ব্যক্তি কোনোভাবেই বীর্যকে থামিয়ে রাখতে পারবে না, তার চিত্ত সর্বদা বিষয়ের উপর লেগে থাকবে। মন আর শরীর দুটোই রোগী হয়ে যাবে, আয়ু কমে যাবে আর স্বার্থ ও পরমার্থ দুটোই বর্বাদ হবে। যদি আপনি বীর্যবান বা আরোগ্যবান হতে চান, স্বপ্নদোষ তথা অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই সাদা মিতাহারী হতে হবে।"
.
🍁 উত্তম ভোজন থেকে উত্তম সন্তান 🍁
মহর্ষি দয়ানন্দ জী তাঁর গ্রন্থ সংস্কারবিধিতে গর্ভাধান সংস্কার বিষয়ে লিখেছেন - "উত্তম সন্তান মুখ্যতঃ বধূ আর বরের যথাশাস্ত্রোক্ত আহারের উপর নির্ভর করে। অতএব পতি ও পত্নী স্ব-স্ব শরীর ও আত্মার পুষ্টির জন্য বল আর বুদ্ধি আদির বর্দ্ধক সর্বোষধি সেবন করবে।
.
সেই সর্বোষধি এইরূপ, যথা - দুই খণ্ড আম-আদা, হরিদ্রা, চন্দন, একাঙ্গী, কুড়, জটামাসী, মূর্বা, শিলাজীত, কর্পূর, মুথা আর নাগরমুথা।
.
এইসব ঔষধি চূর্ণ করে প্রত্যেকটা সমভাগে (পরিমাণে) নিয়ে যজ্ঞডুমুরের কাষ্ঠপাত্রে গোদুগ্ধ সহিত মিশ্রিত করে তার দই প্রস্তুত করবে আর সেই ডুমুরের কাষ্ঠেরই মন্থনদণ্ড দিয়ে মন্থন করে সেখান থেকে মাখন বের করে তার ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতে সুগন্ধি দ্রব্য যথা - কেশর, কস্তুরী, জায়ফল, এলাইচ, জয়ত্রী মিশ্রণ করবে।
.
অর্থাৎ একসের পরিমাণ দুধে এক ছটাক পরিমাণে সর্বোষধি মিশ্রিত করে জ্বাল দিয়ে উক্ত বিধিতে ঘৃত প্রস্তুত করবে। সেই ঘৃতের প্রত্যেক সেরে কস্তুরী এক রতি, কেশর এক মাসা, জায়ফল এক মাসা, জয়ত্রী এক মাসা আর এলাচ এক মাসা মিশ্রিত করে প্রতিদিন প্রাতঃকালে সেই সুগন্ধি দ্রব্য মিশ্রিত সর্বোষধি ঘৃত দ্বারা ২৪ থেকে ২৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখিত বিধিতে আঘারাবাজ্যভাগাহুতি ৪ আর ৪০ পৃষ্ঠায় লিখিত "বিষ্ণুর্য়োনিম্.." ইত্যাদি ৭ টা মন্ত্রের শেষে "স্বাহা" শব্দ উচ্চারণ করে যে রাতে গর্ভস্থাপন ক্রিয়া করতে হবে এক প্রহর রাত্রির পরে সেইদিন দিবাভাগে হোম করে হুতশেষ ঘৃত, ক্ষীর বা অন্নের সঙ্গে মিশ্রিত করে উভয়ে যথারীতি ভোজন করবে। এইভাবে গর্ভস্থাপন করলে সুশীল, বিদ্বান, দীর্ঘায়ু, তেজস্বী, সুদৃঢ় ও নীরোগ পুত্র উৎপন্ন হবে। যদি কন্যা লাভের ইচ্ছা হয়, তাহলে অন্নের সহিত পূর্বোক্ত প্রকারে প্রস্তুত ঘৃত মিশ্রিত করে ডুমুরকাষ্ঠের পাত্রে জমানো দধির সহিত সেই অন্ন সেবন করবে। এতে উত্তম গুণযুক্ত কন্যা জন্মাবে। কারণ "আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধি সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।।" এটা ছান্দোগ্যের বচন অর্থাৎ মদ্যমাংসাদিরহিত ঘৃত, দুগ্ধাদি আর তণ্ডুল, গোধূম ইত্যাদি শুদ্ধাহার করলে অন্তঃকরণের শুদ্ধি বুদ্ধি, বল, পুরুষকার আর আরোগ্য লাভ হয়। যেমন সব পদার্থকে উৎকৃষ্ট করার বিদ্যা আছে, তেমনই সন্তানকেও উৎকৃষ্ট করার এইরূপ বিদ্যা আছে। এই বিষয়ে মানুষকে বিশেষরূপে মনোযোগী হওয়া উচিত, কারণ এতে মনোযোগী না হলে বংশের হানি আর অধঃপতন হয় তথা মনোযোগী হলে বংশের বৃদ্ধি আর উন্নতি অবশ্যই হতে থাকে।"
.
গর্ভাধানের সময় স্ত্রীকে সাবধান থাকার জন্য লিখেছেন -
"তৎপশ্চাত স্ত্রীর গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সুনিয়ম করে দিবে। স্ত্রীরা কখনও মদ্যাদি মাদক দ্রব্য, হরিত্যকাদি রেচক দ্রব্য, অতি লবণাদি ক্ষার দ্রব্য, অত্যম্ল, চণকাদি রুক্ষ পদার্থ এবং লঙ্কাদি তীক্ষ্ণ দ্রব্য ভক্ষণ করবে না। তবে ঘৃত, গোদুগ্ধ, মিষ্টি, সোমলতা অর্থাৎ গুড়ুচ্যাদি ঔষধি, অন্ন, মিষ্ঠ, দধি, গোধূম, মুগ, মাষকলাই, অড়হরাদি খাদ্য এবং পুষ্টিকর তরকারী ভোজন করবে। তাতে ঋতুভেদে ভিন্ন-ভিন্ন মশলা যেমন গ্রীষ্মকালে স্নিগ্ধ শ্বেত এলাইচ প্রভৃতি এবং শীতকালে কস্তুরী ও কেশরাদি মিশ্রিত করে সেবন করবে। সর্বদা উচিত আহার-বিহার করবে। এতে সন্তান অতি বুদ্ধিমান, নিরোগ আর শুভ গুণ-কর্ম-স্বভাবযুক্ত হবে।"
.
উত্তম সন্তান নির্মাণার্থ পুংসবন সংস্কারের মধ্যে মহর্ষি লিখেছেন - "স্ত্রী সুনিয়ম ও উচিত আহার-বিহারের পাশাপাশি বিশেষভাবে গুলঞ্চ, ব্রাহ্মী ঔষধি ও শুন্ডী দুধের সহিত মিশ্রিত করে অল্প-অল্প সেবন করবে। অধিক নিদ্রা, অধিক বাক্যালাপ পরিত্যাগ করবে, অধিক ক্ষার, অম্ল, তীক্ষ্ণ, কটু আর হরিতকী আদি রেচক বস্তু খাবে না। লঘুপাক দ্রব্য আহার করবে। ক্রোধ, দ্বেষ ও লোভাদি দোষে আবদ্ধ থাকবে না। চিত্তকে সদা প্রসন্ন রাখবে - ইত্যাদি শুভ আচরণ করবে।"
.
🍁 ভোজনের স্থান 🍁
ভোজনালয় - যে স্থানে বসে মানুষ ভোজন করবে সেটা শুদ্ধ, ধোয়া-মোছা-পরিষ্কার, ধুলোবালি রহিত, বায়বীয়, খোলামেলা হওয়া উচিত, যাতে আহার গ্রহণ করার সময় মনের মধ্যে কোনোরূপ বিকার না আসে। সেই সময় ভোজন কারী ব্যক্তির চিত্ত ভোজনালয়ের স্বচ্ছতা আদি হতে প্রভাবিত হয়ে সর্বথা শান্ত আর প্রসন্ন হওয়া উচিত। আহার গ্রহণ করার সময় যদি চিত্তের মধ্যে কোনো ধরণের গণ্ডগোল বা অশান্তি থাকে তাহলে ভোজনের পাচন কর্ম সঠিকভাবে হবে না। ভোজন করার সময় মানসিক বিচারের অত্যধিক প্রভাব শরীরযন্ত্রের উপর পড়ে।
.
যারা শুদ্ধি করে না তাদের ভোজনালয়ে কোথাও কয়লা, কোথাও ছাই, কোথাও খড়ি, কোথাও ভগ্ন ফুটো হাঁড়ি, কোথাও এঁটো বাসন তথা মাংসাহারীদের স্থানে হাড়-হাড্ডি আদি অন্যান্য পদার্থ পড়ে থাকে আর মাছির কথা তো কি বলবো! স্থানটা এমন জঘন্য মনে হয় যে, যদি কোনো ভদ্রলোক গিয়ে সেখানে বসে তাহলে তার বমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এমন দুর্গন্ধযুক্ত স্থানে ভোজন করলে শরীর আর মনের উপর ভালো প্রভাব কিভাবে পড়বে? পূর্বোক্ত দোষের নিবৃত্তির জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ জী লিখেছেন - "যদি পাকা ঘর হয় তাহলে জল দিয়ে ধুয়ে শুদ্ধ করা উচিত।"
.
আর কাঁচা ঘরে গরুর গোবর দিয়ে চৌকো লাগানোর গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন - "গোময় (গরুর গোবর) মসৃণ হওয়াতে শীঘ্র উঠে যায় না। তাতে বস্ত্র বিকৃত বা মলিন হয় না। মাটি দ্বারা যেরূপ ময়লা জন্মে, শুষ্ক গোময় থেকে সেইরূপ হয় না। তাছাড়া মাটি আর গোময় দিয়ে যে স্থান লেপন করা হয়, সেটা দেখতে অতি সুন্দর হয়। রন্ধনশালায় ভোজন করলে ঘৃত, মিষ্ট আর উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে, তাতে মাছি, কীট এবং অন্যান্য জীব অপরিষ্কৃত স্থান থেকে সেখানে এসে বসে। তাই প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে সেইস্থান পরিষ্কার করে লেপন করা না হলে সেটা পায়খানার ন্যায় হয়ে উঠবে। অতএব প্রত্যহ গোময়, মৃত্তিকা এবং সম্মার্জনী দ্বারা উক্তস্থান পরিষ্কার রাখবে।" এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় - "রান্নাঘরে বসে ভোজন করা উচিত নাকি রান্নাঘরের বাইরে ভোজন করা উচিত?" উত্তর দিয়েছেন - "উত্তম ও রমণীয় স্থানে ভোজন করা উচিত।" এই বিষয়ে মহর্ষি ধন্বন্তরি জী সুশ্রুতের মধ্যে লিখেছেন -
.
ভোক্তারম্ বিজনে রম্যে নিঃসম্য়াতে শুভে শুচৌ ।
সুগন্ধপুষ্পরচিতে সমে দেশে চ ভোজয়েৎ ।।৪৫৮।।
(সূত্র স্থান অধ্যায় ৪৬)
.
একান্ত স্থানে, যেখানে মানুষের যাতায়াত = আসা-যাওয়া হয় না, রময়ীয়, শুদ্ধ পবিত্র তথা পুষ্পাদি দ্বারা সুগন্ধিত, সম (সেটা উঁচু নীচু হবে না), এইরূপ স্থানে ভোজন করা উচিত। আমাদের শাস্ত্রকারগণ ভোজন, ভোজনের স্থান আর ভোজ্য পদার্থের শুদ্ধতা তথা পবিত্রতার উপর অধিক বল দিয়েছেন, সুতরাং ভোজনের স্থানাদিকে ধুয়ে-মুছে-লেপে সদা শুদ্ধ রাখা উচিত। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যের রহস্য নিহিত আছে।
.
🍁 ভোজনের পূর্বে তথা পশ্চাৎ আবশ্যক ক্রিয়া 🍁
ভোজনের পূর্বে স্নান করার গুরুত্বকে আমাদের প্রাচীন পুরুষগণ বিশেষভাবে মানতেন। গ্রামীণ ব্যক্তিদের মধ্যে এর ছাপ এখনও দেখা যায়। এমন অনেক অশিক্ষিত ভারতীয় মানুষ আছে যারা বিনা স্নান করে ভোজন করাকে পাপ মনে করে। সুতরাং মকরসংক্রান্তি আদি পর্বে তো স্নান করে না এমন ব্যক্তিও ভোজনের পূর্বে স্নান করে নেয়। এই প্রসিদ্ধ প্রবাদ "শত কাজ ছেড়ে স্নান করো" মানুষের মধ্যে একটু ব্যবহারিক রূপে প্রচলিত আছে। সংস্কৃত শ্লোকের এই ভাগ - "শতম্ বিহায় ভোক্তব্যম্ সহস্রম্ স্নানমাচরেৎ" এটাই সিদ্ধ করে যে ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত।
.
মহর্ষি দয়ানন্দ জী এই বিষয়ে লিখেছেন - "প্রথমে স্নান এইজন্য যে এতে শরীরের বাহ্য অবয়বের শুদ্ধি আর আরোগ্য আদি হয়, এইজন্য ভোজনের পূর্বে অবশ্যই স্নান করা উচিত।" এখনকার শিক্ষিত ব্যক্তি ভোজন তো চার-পাঁচ বার করে কিন্তু স্নানের মতো আবশ্যক কৃত্যকে দিনে একটাবারও করতে চায় না। এমন অনেক বাবু ব্যক্তি এই ভারতের মধ্যে পাওয়া যাবে যারা সারা শীতকাল ধরে একটাবারও স্নান করেনি আর বিস্কুট আদি তো বিনা শৌচ হতে নিবৃত্তি হয়ে বিছানাতে ঘুম থেকে জেগেই চেয়ে বসে। কিন্তু ব্রহ্মচর্য আর স্বাস্থ্যপ্রেমী ব্যক্তিকে প্রতিদিন সব ঋতুতে বিনা স্নান করে ভোজন করা মোটেও উচিত নয়। যদি স্নান প্রাতঃ সায়ং দুই সময় করা হয় তাহলে তো আরও ভালো।
.
আসলে ভোজনের অধিকারী তো তারাই যারা প্রাতঃ কাল ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে শৌচ, স্নান, প্রাণায়াম, ঈশ্বরোপাসনা, যজ্ঞ, ব্যায়াম আদি নিত্যপ্রতি প্রাতঃকালেই করে নেয় আর এইভাবে সায়ংকালেও সব নিত্যকর্ম করে। ভোজনের সময় হাত, পা আর মুখকে ভালোভাবে শুদ্ধ জল দিয়ে ধুয়ে স্বচ্ছ করে নেওয়া উচিত। তারপর শুদ্ধ বস্ত্র ধারণ করে ভোজনশালাতে গিয়ে কুশ আসনে বসবেন, যদি গৃহস্থ হন তাহলে বলিবৈশ্বদেবযজ্ঞ করে নিবেন তথা নিজের আশ্রিত গরু, কুকুর আদি প্রাণীদেরও ভোজন দিবেন।
.
আমাদের শাস্ত্রের মধ্যে অতিথি সৎকারের গুরুত্ব অত্যধিক পাওয়া যায়। অথর্ববেদের মধ্যে লেখা আছে - "শ্রেয়াম্সমেনমাত্মনো মানয়েৎ" (১৫/১০/২) যদি কোনো অতিথি আপনার গৃহে আসে তাহলে নিজের সৌভাগ্য ভেবে তার সৎকার করা উচিত আর "অশিতবত্যতিথো অশ্নীয়াৎ" (৯/৮/৮) এই বেদাজ্ঞার অনুসারে গৃহস্থকে অতিথির পূর্বে কখনও ভোজন করা উচিত নয়। সুতরাং নিজের পূজ্যজন সাধু মহাত্মা অতিথিদের শ্রেষ্ঠ ভোজন দিয়ে তৃপ্ত করার উপরান্তই স্বয়ং প্রসন্নচিত্ত হয়ে ভোজন গ্রহণ করা উচিত।
.
ভোজন করার সময় কথা বলা বা কোলাহল করা, আমাদের সভ্যতার বিরুদ্ধ। "বাগ্যতস্তু ভুঞ্জীত" অনুসারে মৌন হয়ে শান্তিপূর্বক ভোজন করা উচিত। নিজের ভাগ্য আর পরিশ্রম করার পশ্চাৎ যা প্রাপ্ত হয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত আর অন্নের নিন্দা কখনও করা উচিত নয়।
.
ভোজনোপরান্ত তৎকালই কঠিন শারীরিক বা মানসিক কোনো কাজ করা বা দৌড়ানো আদি হানিকারক। শান্তিপূর্বক শারীরিক বা মানসিক সাধারণ কোনো কাজ করা যেতে পারে। ভোজনের পূর্বে বা পশ্চাৎ ক্রোধাদি করলে ভোজন বিষ হয়ে যায়। অনেক দেরিতে হজম হয়, সুতরাং সাবধান তথা শান্ত থাকা উচিত।
.
ভোজন করার সময় সব ধরণের চিন্তা শোক ঈর্ষাদি পরিত্যাগ করে সর্বথা প্রসন্নচিত্ত থাকলে ভোজন ভালোভাবে হজম তথা শুদ্ধ রক্তাদি ধাতুর নির্মাণ করে আর বলিষ্ঠ করে তোলে। এর পাশাপাশি ভক্ষ্যাভক্ষ্যের আলোচনা অবশ্যই করা উচিত।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ