মহাভারতের ভীষ্মপর্ব হতে তৎকালীন ভৌগলি বর্ণনা পাওয়া যায়। পৃথিবীতে ৭টি দ্বীপ আছে (বর্ত্তমানের সপ্ত মহাদেশের মত)। সাত দ্বীপের মধ্যে একটি হলো জম্বু। জম্বুতে ৯টি বর্ষ বা দেশ আছে, যথাঃ--------
১) ঐরাবৎ বর্ষ,
২) হৈরণ্যক বর্ষ বা হিরন্ময় বর্ষ,
৩) শ্বেত বর্ষ,
৪) ভদ্রাশ্ব বর্ষ,
৫) কেতুমাল বর্ষ,
৬) ইলাবৃত বর্ষ,
৭) হরি বর্ষ,
৮) হৈমাবত বর্ষ বা কিম্পুরুষ বর্ষ,
৯) ভারতবর্ষ।
বর্ষ শব্দের তিনটি অর্থের একটি হল দ্বীপের অংশ। তদানীন্তন কালের 'হিমালয়' নামে চিহ্নিত পর্বতশৃঙ্গ হল বর্ত্তমানের Shibalik Range। এর দক্ষিনে শুরু হল ভারতবর্ষ। হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত ও সর্বধাতুসম্পন্ন শৃঙ্গবান এই ছয় পর্বত একাকার। এসকল পর্বত পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। তন্মধ্যে নানা জনপদ প্রতিষ্ঠিত।
হিমালয়ের উত্তরে হৈমবৎবর্ষ এবং হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। নীল পর্বতের দক্ষিণে এবং নিষধ গিরির উত্তরে মাল্যবান পর্বত। সুমেরু গিরি নীল ও নিষধ পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। লোকসমূদয় উহার উর্দ্ধ, অধঃ ও পার্শ্বপ্রদেশে অবস্থান করে। ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্মু ও উত্তরকুরু; এই চারটি দ্বীপ এর পার্শ্বদেশে অবস্থিত।
হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে হৈমবৎবর্ষ। হেমকূট পর্বতের উত্তরে হরিবর্ষ, নিষধ পর্বতের উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ, নীল পর্বতের উত্তরে শ্বেতবর্ষ, শ্বেত পর্বতের উত্তরে হৈরণ্যক বর্ষ। তারপর ঐরাবৎবর্ষ। এই সাতটি বর্ষ ধনুকাকারে অবস্থিত। -
মহাভারত ভীষ্মপর্ব প্রথম খণ্ড ষষ্ঠোSধ্যায়
ষড়েতে বর্ষপর্ব্বতাঃ।
অবগাঢ়া ল্যুভয়তঃ সমুদ্রৌ পূর্বপশ্চিমৌ ॥৩॥
-পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত এই ছয়টা বর্ষপর্বত ঐ উভয়দিকে পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে প্রবেশ করিয়া রহিয়াছে ॥৩॥
হিমবান্ হেমকূটশ্চ নিষধশ্চ নগোত্তমঃ।
নীলশ্চ বৈদুর্য্যময়ঃ শ্বেতশ্চ শশিসন্নিভঃ ॥৪॥
সর্বধাতুবিচিত্রশ্চ শৃঙ্গবান্ নাম পর্বতঃ।
এতে বৈ পর্বতা রাজন! সিদ্ধচারণসেবিতাঃ ॥৫॥
--রাজা! হিমালয়, হেমকূট, পর্বতশ্রেষ্ঠ নিষধ, বৈদুর্য্যমণিময় নীল, চন্দ্র- তুল্য শ্বেত এবং সর্বধাতুবিচিত্র শৃঙ্গবান্, সিদ্ধচারণসেবিত এই ছয়টা বর্ষপর্বত ॥৪-৫৷
এষামন্তরবিষ্কম্ভা যোজনানি সহস্রশঃ।
তত্র পুণ্যা জনপদাস্তানি বর্ষাণি ভারত ! ॥৬॥
-ভরতনন্দন! এই পর্ব্বতগুলির মধ্যবর্তী দেশ সকল সহস্র সহস্র যোজন- বিস্তৃত। তাহাতে যে সকল পবিত্র দেশ আছে, সেই গুলিকেই বর্ষ বলে ॥৬॥
বসন্তি তেষু সত্ত্বানি নানাজাতীনি সর্ব্বশঃ।
ইদস্ত ভারতং বর্ষং ততো হিমবতঃ পরম্ ॥৭॥
-সেই বর্ষগুলিতে নানাজাতীয় প্রাণী সকল বাস করে। সেই হিমালয়ের দক্ষিণদিকে এই ভারতবর্ষ ॥৭॥
ততঃ কিংপুরুষাবাসং বর্ষং হিমবতঃ পরম্।
হেমকূটাৎ পরঞ্চৈব হরিবর্ষং প্রচক্ষতে ॥৮॥
-তাহার পর হিমালয়ের উত্তরে এবং হেমকূটের দক্ষিণে কিন্নরগণের বাসস্থান হরিবর্ষনামক বর্ষ কথিত আছে ॥৮॥
দক্ষিণেন তু নীলস্থ্য নিষধস্যোত্তরেণ তু।
প্রাগায়তো মহাভাগ! মাল্যবান্ নাম পর্বতঃ ॥৯৷৷
-মহাভাগ। নীলগিরির দক্ষিণে ও নিষধগিরির উত্তরে পূর্ব্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত 'মাল্যবান'-নামে একটা পর্ব্বত আছে ॥৯॥
ততঃ পরং মাল্যবতঃ পর্ব্বতো গন্ধমাদনঃ।
পরিমণ্ডলস্তয়োমধ্যে মেরুঃ কনকপর্বতঃ ॥১০৷৷
-সেই মাল্যবান্ পর্ব্বতের পরে গন্ধমাদনপর্ব্বত রহিয়াছে এবং মাল্যবান্ ও গন্ধমাদনপর্বতের মধ্যে গোলাকার ও স্বর্ণময় মেরুপর্বত আছে ॥১০॥
অধস্তাচ্চতুরাশীতিযোজনানাং মহীপতে!।
ঊর্দ্ধমধশ্চ তির্য্যক্ চ মেরুরাবৃত্য তিষ্ঠতি ॥১২॥
-রাজা। আর সেই মেরুপর্বত চৌরাশী যোজন ভূগর্ভে প্রবিষ্ট। এইভাবে সেই মেরুপর্বত উর্দ্ধ, অধ ও তির্য্যক্ দিক্ সকল ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে ॥১২॥
তস্য পার্শ্বেষমী দ্বীপাশ্চত্বারঃ সংস্থিতা বিভো!।
ভদ্রাশ্বঃ কেতুমালশ জম্বুদ্বীপশ্চ ভারত!।
উত্তরাশ্চৈব কুরবঃ কৃতপুণ্যপ্রতিশ্রয়াঃ ॥১৩৷৷
-ভরতনন্দন! রাজা! সেই মেরুর চারি পার্শ্বে এই চারিটা বিশাল বর্ষ রহিয়াছে; ভদ্রাশ, কেতুমাল, ভারত ও পুণ্যবান্দিগের আশ্রয় উত্তরকুরু ॥১৩৷৷
মেরোস্ত্র পশ্চিমে পার্শ্বে কেতুমালো মহীপতে!।
জন্ম খণ্ডে তু তত্রৈব মহাজনপদো নৃপ ! ॥৩১৷৷
-রাজা। সুমেরুপর্বতের পশ্চিম দিকে কেতুমালনামক স্থান আছে এবং জন্ম দ্বীপে সেই স্থানেই বৃহৎ একটা দেশও রহিয়াছে ॥৩১৷
নীলাৎ পরতরং শ্বেতং শ্বেতাদ্ধৈরণ্যকং পরম্।
বর্ষমৈরাবতং রাজন! নানাজনপদাবৃতম্ ॥৩৭॥
-রাজা। নীলপর্ব্বতের উত্তরে শ্বেতবর্ষ, শ্বেতবর্ষের উত্তরে হৈরণ্যকবর্ষ এবং তাহার উত্তরে নানাদেশযুক্ত ঐরাবতবর্ষ ॥৩৭॥
ধনুঃসংস্থে মহারাজ! দ্বে বর্ষে দক্ষিণোত্তরে।
ইলাবৃতং মধ্যমন্ত্র পঞ্চ দীর্ঘাণি চৈব হি ॥৩৮॥৷
-মহারাজ! হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতবর্ষ এবং সর্ব্বোত্তরে ঐরাবতবর্ষ; এই দুইট। বর্ষই ত্রিকোণ; মধ্যে ইলাবৃতবর্ষ, সেই ইলাবৃতবর্ষের সহিত পাঁচটা বর্ষই পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ ॥৩৮॥
অস্ত্র্যত্তরেণ কৈলাসং মৈনাকং পর্বতং প্রতি।
হিরণ্যশৃঙ্গঃ সুমহান্ দিব্যো মণিময়ো গিরিঃ ॥৪৩
-কৈলাসপর্ব্বতের অদূরে উত্তরদিকে মৈনাকপর্ব্বতের নিকটে বিশাল ও দিব্য 'হিরণ্যশৃঙ্গ-' নামে মণিময় একটা পৰ্ব্বত আছে ॥৪৩৷
তস্য পার্শ্বে মহদ্দিব্যং শুভ্রং কাঞ্চনবালুকম্।
রম্যং বিন্দুসরো নাম যত্র রাজা ভগীরণঃ ॥88॥
দৃষ্ট্বা ভাগীরথীং গঙ্গামুবাস বহুলাঃ সমাঃ।
যূপা মণিময়াস্তত্র চৈত্যাশ্চাপি হিরন্ময়াঃ ॥৪৫॥
-তাহার পার্শ্বে 'বিন্দুসর'-নামে বিশাল ও মনোহর একটা জলাশয় আছে; তাহার জল শুভ্রবর্ণ এবং বালুকাগুলি স্বর্ণময়। যেখানে ভগীরথ রাজা গঙ্গাকে দেখিতে পাইয়া বহু বৎসর বাস করিয়াছিলেন, সেই স্থানে বহুতর মণিময় যূপ ও হিরণ্ময় যজ্ঞভবন রহিয়াছে ॥৪৪-৪৫॥
মহাভারত ভীষ্মপর্ব প্রথম খণ্ড সপ্তমোSধ্যায়
দক্ষিণেন তু নীলস্য মেরোঃ পার্শ্বে তথোত্তরে।
উত্তরাঃ কুরবো রাজন! পুণ্যাঃ সিদ্ধনিসেবিতাঃ ॥২॥
-সঞ্জয় বলিলেন-'রাজা। নীলপর্বতের দক্ষিণে এবং সুমেরু পর্বতের উত্তরে পবিত্র ও সিদ্ধসেবিত উত্তর কুরুদেশ রহিয়াছে ॥২॥
মহাভারতের বর্ণিত তথ্য এবং সেখানে উল্লিখিত আরও তথ্য থেকে জানা যায়-
হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান পর্বত একাকার। অর্থাৎ এরা আসলে বৃহত্তর হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্গত। এইবর্ষগুলি ভারত, চীন ও আফগানিস্তানের অন্তর্গত। কখনই মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া বা সাইবেরিয়া নয়। বলা আছে এই সাতটি বর্ষ ধনুকাকারে অবস্থিত। পর্বতগুলির মধ্যে মধ্যে নানা জনপদ অবস্থিত। সুমেরু-র শিখর থেকে ভাগিরথী নিপতিত হচ্ছে। অর্থাৎ গঙ্গোত্রী হিমবাহ হল সুমেরু পর্বতে। এই সুমেরু বর্তমানের সুমেরু (north pole) নয়। সুমেরুর দক্ষিণে অবস্থিত কৈলাস। সুমেরুর চূড়ায় আছে ব্রহ্মাপুরী। অলকানন্দা ব্রহ্মার পুরী থেকে দক্ষিণ দিকে গিয়ে হেমকুট এবং হেমকূট ভেদ করে ভারতবর্ষে পতিত হচ্ছে। শৃঙ্গবানের উত্তরদিকে আছে সাগরপাড়ে ঐরাবতবর্ষ। এখানে দিবাকর উত্তাপ প্রেদান করে না। এই সাগর পারে ঐরাবৎবর্ষ বহুদুরে রাশিয়াতে হতে পারে। তবে ভারতের পৌরাণিক কাহিনীতে কোথাও ঐরাবৎবর্ষ নিয়ে বিশেষ কাহিনী নেই। বিষ্ণুপুরাণ বলছে সুমেরুর উত্তরদিকের পর্বতগুলি (নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান) বরফ পর্বত নামে খ্যাত। বোঝা যাচ্ছে সুমেরুর দক্ষিণের পর্বতগুলিতে সারা বছর বরফ থাকে না। অর্থাৎ এগুলি শিবালিক রেজ- এর অন্তর্গত। সুমেরুর চারিদিকে মানস ইত্যাদি চার সরোবর আছে। বর্তমানে মানস সরোবরের অবস্থান থেকে আমরা সুমেরুর অবস্থান টের পায়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ