'বিবাহ' শব্দটি 'বি' উপসর্গপূর্বক 'বহ প্রাপণে' ধাতুতে 'ঘঅ্' প্রত্যয় যোগ করে গঠিত এবং 'উদ' উপসর্গ হতে পর্যায়বাচী 'উদ্ভাহ' শব্দ তৈরি হয়। বিবাহের অর্থ হলো বিধিপূর্বক একে অপরকে বৈধভাবে গ্রহণ করা এবং পারস্পরিক দায়িত্ব পালন করা। শাস্ত্র অনুসারে এটি একটি সামাজিক আইন তথা সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন। এতে, পুরুষ এবং মহিলা তাদের আরাম এবং সুবিধার জন্য গৃহকর্তার কর্তব্য পালনের জন্য দম্পতি হিসাবে একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সময়ের সাথে সাথে, তারা প্রজননের মাধ্যমে মানব জাতির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
'বিবাহ' শব্দটি সরাসরি বেদে পাওয়া যায় না, তবে বিবাহের জন্য মূলে যে মন্ত্রটি পাঠ করা হয়, তাতে 'হস্তম গৃহ্নামি' পদ স্পষ্টভাবে বিবাহের তাৎপর্যের বোধক। এর অর্থ হল স্বামী সারা জীবন তার স্ত্রীর হাত ধরে থাকবে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। বিয়েতে হাত ধরা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে 'পাণিগ্রহণ' (ঋ০ ১০।৮৫।৩৬ "हस्तं॒ मया॒ पत्या॑ ज॒रद॑ष्टि॒र्यथास॑:") কে বিবাহের পর্যায়বাচী (সমার্থক শব্দ) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও অন্যান্য অনেক জাতি বৈদিক ধর্মকে তার মূল রূপে পরিত্যাগ করেছে, তবুও তাদের কিছু আচার-অনুষ্ঠানে বৈদিক রীতিনীতির প্রভাব এখনও দৃশ্যমান হয়। যেমন পার্সিয়ানদের মধ্যে বিয়ের সময় বর কনের হাত ধরে, তারা এই বিবাহ পদ্ধতিকে 'হাথবরো' বলে। রোমান মহিলারাও বিয়েতে বরের ডান হাতের উপর তার ডান হাত রাখেন, এর বিস্তারিত বিবরণ Encyclopaedia of Religion-এর "বিবাহ" শিরোনামে দেখা যাবে।
বৈদিক বিবাহ সংস্কারে বধূর বেণী খুলে দেওয়ার পর অর্থাৎ কেশ মোচন ক্রিয়া সম্পাদনের পর "সপ্তপদী" বিধি আরম্ভ হয়। এটি বৈদিক বিবাহ অনুষ্ঠানের শেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা সম্পন্ন হওয়ার পরে বৌধানিক দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। এই সময় বরের উপবস্ত্রের (উত্তরীয়) সাথে বধূর উত্তরীয়কে গাঁঠ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় যা 'গ্রন্থি বন্ধন' বা 'গাঁঠছড়া' বলা হয়; এটি কোনও শাস্ত্রীয় বিধান নয়, কিন্তু বেদাবিরুদ্ধ তথা পরম্পরাগত লোকাচার (লোক রীতিনীতি) হওয়ায় এতে কোন আপত্তি নেই; তথা এক সময় হতে চলে আসছে। মহা কবি কালিদাসের রঘুবংশের সময় হতে নিশ্চিত করে যে এই প্রথাটি কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর হতে চলে আসছে বলা যায়।
তেমনই বাংলা তথা বেশকিছু অঞ্চলে সিদুর বর্ত্তমানে বিবাহিতা নারীর প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বিবাহের একটি অংশে লোকাচার হিসেবে চলে আসছে। যদিও এই সিদুর দেওয়া বা সিদুর পরা কোন শাস্ত্রীয় বিধি নয়। এই সিদুর দান বৈদিক বিবাহের মধ্যেও আজ কিছু অঞ্চলে চলে তবে এটা মহর্ষি দয়ানন্দকৃত সংস্কার বিধিতেও উল্লেখ নেই। যা লেখা পাওয়া যায় তা 'সংস্কারবিধি' বাংলা সংস্করণে বাংলার আচার হিসেবেই লেখা রয়েছে।
যাইহোক অবিবাহিত মেয়েরা সিঁথিতে সিদুর পরে না, কপালে টিপ পরে। বিধবাদের সিঁদুর ব্যবহার নেই তথা নিষিদ্ধ। বিবাহিতা বাঙালি হিন্দু মেয়েদের সিঁদুর দেওয়ার প্রচলন মুসলমানদের অত্যাচারের ফলে বৃদ্ধি পেয়ে আজ অনেক স্থানেই দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে মেয়েদের সিঁথিতে রাসায়নিক সিদুর (লেড অক্সাইড) ব্যবহার হলেও, অরগ্যানিক সিদুর বিক্সা ওরেলানা গাছ বা সিদুর গাছ হতেও পাওয়া যায়।
পৌরাণিক মতে যে পুস্তক হতে বিবাহাদি ক্রিয়া সম্পাদন করা হয় সেই পুরোহিত দর্পণেও "আচার বশতঃ জামাতা বধূর সীমন্তে সিন্দুর তিলক দিয়া অবগুণ্ঠন দেওয়া হয়।" বলে বর্ননা পাওয়া যায় (পুরোহিত দর্পন; তৃতীয় খণ্ড ৪৪৮ পৃ০)। বর্ত্তমান সময়ে বেশ কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে সিঁদুর-দান বা বিবাহে সিদুর পরানোর বিরোধীতা করার বিষয় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বস্তুতঃ বৈদিক মন্যতার ছেলে মেয়েরাই বৈদিক বিবাহে সিদুর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মনে হলেও, বাস্তবে বিবাহে সিদুর পরানো নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করছে না! যারা এর বিরূদ্ধে প্রচার করছে তারা বলতে চাইছে বৈদিক রীতিতে সিদুর দানটা বিবাহ সংস্কারের অংশ নয়। এটা বেদে লেখা নেই এমনকি মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামীও বৈদিক সংস্কার বিধির মধ্যে উল্লেখ করেন নি; তাই "বৈদিক বিবাহ সংস্কার অনুষ্ঠান" ক্যাপশন ব্যবহার করে বৈদিক বর-বধূর সিঁদুর দেওয়ার ছবি দেওয়া বৈদিক আচার নয়। আর যারা এর পক্ষে কথা বলছেন তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে তারা সংস্কার বিধি ও বেদ হতে প্রমাণ দেখিয়ে ডিবেট করবেন আর্য সমাজের অন্য পণ্ডিতবর্গের সাথে। সাথে গৃহসূত্রাদি হতে বৃথা প্রমান দেখানোর চেষ্টা করছেন সমাজিক আচার হিসেবে বিধান রয়েছে। কারন সমস্ত সামাজিক রীতিকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যাইহোক, এই ধরনের গোলযোগ শুরু হওয়ায় যারা নতুন বৈদিক মতে আসছেন এবং পৌরাণিক মহলেও সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে ! এতে সমাজের কোথায় ভালো হচ্ছে ? মহর্ষি দেব দয়ানন্দ আর্য সমাজের ৬নং নিয়মে লিখেছেন সংসারের উপকার করা এই সমাজের মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থাৎ শারীরিক, আত্মিক ও সামাজিক উন্নতি করা এবং সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্বক ধর্মানুসারে যথাযোগ্য ব্যবহার করা উচিত। সাথে মহর্ষি ১০নং নিয়মে বলেছেন সব মানুষকে সামাজিক সর্বহিতকারী নিয়ম পালনে পরতন্ত্র থাকতে এবং প্রত্যেক হিতকারী নিয়মে সবাইকে স্বতন্ত্র থাকতে। আর্যসমাজীরাকি আর্যসমাজের মূলনীতি ও বিশ্বাসকে টাটা বাই-বাই করছেন ?!!!
@অমৃতস্য পুত্রাঃ
ReplyDelete