বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

26 January, 2025

বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান

 

বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান

যখন সৃষ্টি নির্মাণের সময় আসে, সেই সময় সর্বপ্রথম সর্বব্যাপক চেতন তত্ত্বের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তি করার কামনা উৎপন্ন হয়। এটা হল সৃষ্টি উৎপত্তির প্রথম চরণ। জড় পদার্থের মধ্যে কোনো প্রবৃত্তি স্বতঃ হয় না। যেরকম আমাদের শরীর জড় আর চেতনের কারণে আমাদের শরীরে কাজ করার ইচ্ছা মনের মধ্যে উৎপন্ন হয়। সেইভাবে প্রকৃতি দ্বারা স্বতঃ সৃষ্টি উৎপত্তি হয় না আর না হতে পারবে। এই কামনা উৎপন্ন হওয়ার পরে যে পদার্থ সবার আগে উৎপন্ন হয় সেটা হল কাল। চেতন তত্ত্ব প্রকৃতির সত্ব, রজস্ ও তমস্ এই তিনটি গুণের সাম্যাবস্থার মধ্যে "ওম্" রশ্মির কম্পনকে সূক্ষ্মতম পরা রূপে সর্বত্র উৎপন্ন করে, এই "ওম্" রশ্মিই সেই তিনটি গুণকে জাগ্রত বা সক্রিয় করে। এদের মধ্যেও সর্বপ্রথম কাল তত্ত্বকে উৎপন্ন করার হেতু সত্ব ও রজস্ এই দুটি গুণকেই জাগ্রত করে। এই দুটি গুণের উৎপত্তি হতেই কাল তত্ত্ব সক্রিয় হয়ে যায়। এই সতত সক্রিয় কাল তত্ত্ব ত্রিগুণা প্রকৃতিকে জাগাতে অর্থাৎ সক্রিয় করতে থাকে। এই কাল তত্ত্ব দুই গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের মধ্যে অব্যক্ত ভাব দ্বারা প্রেরিত "ওম্" রশ্মির রূপে হয়। এইভাবে সেটা "ওম্" -এর সবথেকে সূক্ষ্মতম রূপ মূল প্রকৃতির দ্বারা মিশ্রিত হয়েই কালের রূপ ধারণ হয়।

এই অবস্থার মধ্যে মূল প্রকৃতির মতো গুণের সাম্যাবস্থা থাকে না, এই কারণে একে সর্বথা অব্যক্ত মানা যেতে পারে না। এইজন্য তার মধ্যে অতি সূক্ষ্মতম বলও উৎপন্ন হয়ে যায়। "ওম্" রশ্মি সম্পূর্ণ মূল পদার্থের মধ্যে আকর্ষণকে উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। এই সময়েও প্রকৃতির সাম্যাবস্থা সর্বথা ভঙ্গ হতে পারে না। প্রকৃতির এই অবস্থাকেই কাল বলে। "ওম্" রশ্মির সঙ্গে চেতনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকে। এই অবস্থা প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন হয়, এই কারণে এটা জড় পদার্থ, কিন্তু যেহেতু এটা চেতন তত্ত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধিত এই কারণে এটা চেতনবত্ ব্যবহার করে।


প্রকৃতির সেটা প্রায় অব্যক্ত (পূর্ণ অব্যক্ত নয়) অবস্থা, যার মধ্যে "ওম্" রশ্মির সর্বাধিক সূক্ষ্ম রূপের অব্যক্ত সঞ্চার হয়ে গেছে, যার দ্বারা প্রকৃতির সত্ব ও রজোগুণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপে ব্যক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তমোগুণ সর্বদা অব্যক্তই থাকে। অতি সূক্ষ্ম আকর্ষণ বল ও গতির উৎপত্তি দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি পদার্থের এই অবস্থার নামই হচ্ছে কাল, যা সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং তার দ্বারা উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে সর্বদা প্রারম্ভিক বল উৎপন্ন করতে থাকে।


বৈদিক বিজ্ঞান অর্থাৎ বেদ তথা আমাদের ঋষিদের অনুসারে এই সৃষ্টি এক জড় পদার্থ দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে, পদার্থের সেই অবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়। এই পদার্থ হচ্ছে যেকোনো জড় পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম, প্রারম্ভিক এবং স্বাভাবিক অবস্থা। এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বিদ্যমান অসংখ্য বিশালতম তারা থেকে শুরু করে সূক্ষ্মতম কণা, তরঙ্গ, আকাশ আদি পদার্থ সবই এই প্রকৃতি পদার্থ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, তার মধ্যেই স্থির আছে আর এক নিশ্চিত সময়ের পশ্চাৎ সেই পদার্থের মধ্যে লীনও হয়ে যাবে। এই ভাবে,


[পদার্থের সবথেকে সূক্ষ্ম অবস্থা, যা দিয়ে বর্তমানের আকাশ, তরঙ্গ ও মূলকরণ থেকে শুরু করে তারা আদির নির্মাণ হয়, তাকে প্রকৃতি বলা হয়]


আমাদের চারপাশে, যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি অথবা দেখতেও পাচ্ছি না, সেই সব সূক্ষ্ম স্তরে অণু - পরমাণু দিয়ে তৈরি হয়েছে। এর থেকেও অধিক সূক্ষ্ম স্তরে গেলে পরমাণুও অতি সূক্ষ্ম কণা, যাকে বর্তমানে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন বলে, দ্বারা মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে। তারপর প্রোটন ও নিউট্রনকে কোয়ার্ক নামক সূক্ষ্মতর কণার দ্বারা মিশ্রিত হয়ে তৈরি মানা হয়। এখন প্রশ্ন এটা উঠছে যে ইলেকট্রন ও কোয়ার্ক আদি কণা কি দিয়ে মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে নেই, কারণ তার থেকে অধিক সূক্ষ্ম স্তরে আমরা বর্তমানের কোনো টেকনিক দিয়ে জানতে পারবো না। বর্তমান বিশ্বের মধ্যে অনেক বৈজ্ঞানিক এই সূক্ষ্ম পদার্থকে স্ট্রিং নামক সূক্ষ্ম সংরচনার দ্বারাই তৈরি বলে মনে করে, কিন্তু তারা স্ট্রিংয়ের বিষয়ে খুব বেশি ব্যাখ্যা করতে পারে না। বস্তুতঃ তাদের এই কথিত সিদ্ধান্ত গণিতীয় ব্যাখ্যা পর্যন্তই সীমিত।


বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে, যে পদার্থ নিজের থেকে কোনো সূক্ষ্ম তত্ত্ব দ্বারা মিলিত হয়ে তৈরি হয়নি, যার বিভাগ করতে-করতে শেষে যা অবশিষ্ট থাকে আর সমস্ত মূলকণা, এমনকি সমস্ত তরঙ্গ ও আকাশ আদি পদার্থ যে পদার্থ দ্বারা তৈরি হয়, সেটা হল প্রকৃতি পদার্থ।


কাল তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির সত্ব ও রজস্ গুণ বিদ্যমান থাকে। এরমধ্যে তমোগুণ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, এইজন্য তার অভাবই হয়। এই কারণে কাল তত্ত্ব সতত গতি করে, এটা কখনও থামে না। কালের অতিরিক্ত অন্য সব পদার্থের মধ্যে তিনটি গুণই ন্যূন বা অধিক মাত্রা অনিবার্যতঃ বিদ্যমান হয়। কাল হচ্ছে সর্বব্যাপক, সতত গমনকারী একরস তত্ত্ব, যা প্রত্যেক পদার্থকে প্রেরিত করে, কিন্তু স্বয়ং সর্বোচ্চ চেতন তত্ত্বের অতিরিক্ত অন্য কোনো পদার্থের দ্বারা প্রেরিত হয় না। কালের প্রেরণা দ্বারাই মন, প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির উৎপত্তি হয় আর এইসবের থেকে নানা পদার্থের উৎপত্তি হয়। কাল তত্ত্বই হচ্ছে অনেক প্রকারের পদার্থ ও কর্মের বীজরূপ। সৃষ্টির সব দ্রব্য, কর্ম, গুণ আদির বীজ হচ্ছে এই তত্ত্বই, কিন্তু এটা হল তার সাধারণ নিমিত্ত কারণ, উপাদান হয় নয়। এর মানে হল কাল তত্ত্বের মধ্যে স্বয়ং এই পদার্থের একটা অবয়ব নেই। কাল তত্ত্ব মনস্ তত্ত্ব আদিকে প্রেরিত করে সাত ব্যাহৃতি রশ্মিকে (ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্যম্) উৎপন্ন করে। এই সাত রশ্মির দ্বারা কাল তত্ত্ব অগ্রিম রশ্মিদের উৎপন্ন করে। কাল তত্ত্ব নিত্য অর্থাৎ অজন্মা ও অবিনাশী পদার্থকে জীর্ণ করে না আর না করতে পারবে, অথচ অনিত্য পদার্থের মধ্যে কাল ব্যাপ্ত হয়ে তাদের নিরন্তর জীর্ণ করতে থাকে।


কাল তত্ত্বই হচ্ছে প্রকৃতির উপর্যুক্ত অবস্থা, এটাই ত্রিগুণা প্রকৃতির মহত্ তত্ত্ব আদির মধ্যে পরিবর্তন করে আর পুনঃ তাকেই প্রেরিত করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কাল তত্ত্ব প্রকৃতির তমোগুণকেও সক্রিয় করে মহত্ তত্ত্বাদি পদার্থের নির্মাণ করে। এইভাবে সেটা বিভিন্ন পদার্থকে নিজের প্রেরণা দ্বারা উৎপন্ন করে আর তারপর তাদের প্রেরিত এবং ধারণও করে। আধুনিক বিজ্ঞানও দ্রব্যের ঊর্জা দ্বারা নির্মিত, প্রেরিত হওয়াকে মানে, তারসঙ্গে ঊর্জা দ্বারা দ্রব্যকে ধারণ করা এবং তার রূপকেও মানে। পরা "ওম্" রশ্মি যুক্ত প্রকৃতি পদার্থ, যাকে কাল তত্ত্ব বলে, সেটা কখনও জীর্ণ হয় না। প্রলয়াবস্থাতে প্রকৃতিকে প্রেরিত না করে অব্যক্ত রূপে এই তত্ত্ব যথাযথ বিদ্যমান থাকে। এরদ্বারা আমরা এটা বলতে পারি যে কালের (বা ওম্ রশ্মির) সক্রিয় হওয়াটাই হচ্ছে সৃষ্টির সর্বপ্রথম চরণ, বাস্তবে কাল অব্যক্ত অবস্থায় সর্বদা বিদ্যমান থাকে।


"ওম্" -এর সূক্ষ্মতম স্বরূপ তথা বিভিন্ন অক্ষররূপ বাক্ তত্ত্বের কখনও পূর্ণ বিনাশ হয় না, এই কারণে এদের অক্ষর রশ্মিও বলে। তবে হ্যাঁ, মহাপ্রলয় কালে এই সর্বথা অব্যক্ত অক্ষর "ওম্" -এর প্রকৃতি রূপ পদার্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ সক্রিয় সম্বন্ধ হয় না। কাল তত্ত্ব অবশ্য নিজের অব্যক্ততম রূপে বিদ্যমান থাকে। এটা মহাপ্রলয়কাল পর্যন্ত এই রূপেই বিদ্যমান থাকে তথা অন্য প্রকৃতি রূপ পদার্থের মধ্যে এটা বীজরূপে অনাদি এবং অনন্ত রূপে সর্বদা বিদ্যমান থাকে। এই অজর কাল চক্রের কারণেই সৃষ্টি-প্রলয়ের চক্র নিয়মিত ও নিরন্তর চলতে থাকে।

যখন পরা "ওম্" রশ্মি (কাল) সর্বপ্রথম মূল প্রকৃতি তত্ত্বকে সৃষ্টির সবথেকে সূক্ষ্ম প্রেরণ দ্বারা যুক্ত করে তাকে বিকৃত করা প্রারম্ভ করে। প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত রূপে বিদ্যমান বিভিন্ন অক্ষর রশ্মিগুলো জাগ্রত হয়ে ধীরে-ধীরে মূল প্রকৃতিকে মহত্, অহংকার ও মনস্তত্ত্বের রূপে উৎপন্ন করে, কিন্তু সত্ব ও রজস্ গুণ দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি তথা "ওম্" -এর কালরূপ স্বয়ং সর্বদা অবিকৃত থেকে তমোগুণের সঙ্গে অন্য দুই গুণে যুক্ত প্রকৃতিকেই সৃষ্টি রচনা হেতু প্রেরিত ও বিকৃত করে। সেই কাল তত্ত্ব "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপকে উৎপন্ন করে মনস্তত্ত্বের মধ্যে স্পন্দন ও ক্রিয়াশীলতা উৎপন্ন করে সপ্ত ব্যাহৃতি রূপী সূক্ষ্ম রশ্মিদের উৎপন্ন করে। এর পশ্চাৎ সেই রশ্মিরদের সাধন বানিয়ে প্রাণ, অপান আদি সাত মুখ্য প্রাণ রশ্মি, পুনঃ অন্য প্রাণ, মরুত্ ও ছন্দ রশ্মিগুলোকে উৎপন্ন করে সৃষ্টি চক্রকে আগে বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানেও কাল তত্ত্ব প্রত্যেক পদার্থ - মূলকণা, তরঙ্গ, আকাশ আদির ভিতরে বিদ্যমান থেকে তাদের মধ্যে বিদ্যমান "ওম্" -এর পশ্যন্তী রূপ, ব্যাহৃতি সূক্ষ্ম রশ্মি থেকে শুরু করে সমস্ত রশ্মিকে প্রেরিত করে সবগুলোকে সক্রিয় করে, তারসঙ্গে সেগুলোর মধ্যে উচিত জীর্ণতাও নিয়ে আসে।

কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ যে পদার্থ সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়, তাকে বৈদিক ভৌতিকীর মধ্যে মহত্ বলা হয়েছে। এই সৃষ্টির মধ্যে এটাই হচ্ছে সেই প্রাথমিক উৎপন্ন পদার্থ যা বল, ক্রিয়া আদির বীজরূপ হয় তথা যার মধ্যে বিকারের পরিমাণস্বরূপ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নানা পদার্থ উৎপন্ন হয়। মহত্-এর উত্তেজিত অবস্থাকে অহংকার বলে আর অহংকারের উত্তেজিত অবস্থাকে মন বলে।

মহত্ তত্ত্বও অব্যক্ত প্রকৃতির লক্ষণের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ অব্যক্তের মতোই হয়, কিন্তু এটা সর্বথা অব্যক্ত হয় না। সাংখ্যদর্শনের মধ্যে মহর্ষি কপিল মহত্, অহংকার এবং মন এই তিন পদার্থকে পৃথক-পৃথক মেনেছেন। এই পদার্থ সব পদার্থকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। মহর্ষি কপিলের দৃষ্টিতে মহত্ তত্ত্বের চরম অর্থাৎ অগ্রিম রূপকেই অহংকার বলে। অহংকার তত্ত্ব সত্ব, রজস্ ও তমস্-এর প্রধানতার দ্বারা ক্রমশঃ বৈকারিক, তৈজস এবং ভূতাদি নামের হয়। মহত্ তত্ত্বকে সেই সময় অহংকার বলে যখন এটা সৃষ্টি উৎপত্তির দ্বিতীয় চরণ অর্থাৎ তার প্রকট অবস্থার মধ্যে হয়। এর থেকে নানা দেব পদার্থ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণ, ইন্দ্রিয় ও মন এবং তিন ব্যাহৃতি রূপ সূক্ষ্ম ছন্দ রশ্মি রূপী লোক উৎপন্ন হয়, তার সঙ্গে-সঙ্গে সব ছন্দ রশ্মি এর থেকেই উৎপন্ন হয়। এই সম্পূর্ণ সৃষ্টি অহংকার রূপই হয় তথা তারই দ্বারা নানা কামনার অর্থাৎ আকর্ষণ আদি বলের সঙ্গে যুক্ত হয়।  যখন পরা "ওম্" রশ্মি সত্ব আর রজস্ এই দুই গুণকেই সক্রিয় করে, তখন মূল প্রকৃতি কাল তত্ত্বের রূপ ধারণ করে আর যখন পরা "ওম্" রশ্মি (কাল তত্ত্ব) সেই মূল প্রকৃতির তিন গুণকে সক্রিয় করে, তখন সেটা মহত্ তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবকাশ রূপ আকাশের মধ্যে একরস হয়ে ভরা থাকে অর্থাৎ এরমধ্যে প্রায় কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। "ওম্" রশ্মির পরা অবস্থা সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে এক সঙ্গে ব্যাপ্ত থাকে, যারফলে তিন গুণ সবথেকে সূক্ষ্ম রূপে সক্রিয় বা জাগ্রত হতে থাকে। এতে সেই পদার্থের মধ্যে এরকম মন্দতম দীপ্তি হয় যেটা সম্পূর্ণ সৃষ্টির মধ্যে অন্যত্র কোথাও হয় না। এই সৃষ্টির মধ্যে যে ঘন অন্ধকার আমরা দেখি, তার থেকেও অধিক ঘন অন্ধকার মহত্ তত্ত্বের মধ্যে হয়। মহত্ -এর চরমাবস্থা রূপ অহংকারও এরকম অন্ধকার যুক্ত হয়। এই সময় পরারূপ "ওম্" রশ্মির অতিরিক্ত অন্য যেকোনো সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম রশ্মিও উৎপন্ন হতে পারে না। যখন সর্বত্র ব্যাপ্ত অহংকার তত্ত্বের মধ্যে "ওম্" ছন্দ রশ্মির পশ্যন্তী রূপের সঞ্চরণ হয়, তখন অহংকারের সেই অবস্থাকেই মনস্তত্ত্ব বলা হয়। মনও মহত্ তত্ত্ব বা অহংকারের মতো সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। এটা নিজের থেকে উৎপন্ন প্রত্যেক পদার্থকে বাইরে ও ভিতর থেকে ব্যাপ্ত করে। এই পদার্থ "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের সঙ্গে মিলে তাকে নিজের সঙ্গে ধারণ করে থাকে। মনস্তত্ত্বের সার হল "ওম্"-এর পশ্যন্তী রূপ তথা এই বাক্ তত্ত্ব থেকেই সমস্ত কর্ম উৎপন্ন হয়। বস্তুতঃ এই "ওম্" রশ্মির কারণেই মনস্তত্ত্ব সক্রিয় হয় অথবা অহংকার তত্ত্ব মনস্তত্ত্বের রূপ ধারণ করে। যদি মহত্ তত্ত্ব, মনস্তত্ত্বকে একটা সূক্ষ্ম ঊর্জার মতো মনে করে বিচার করা হয়, তাহলে এরকমটা মনে হবে যে এই অদৃশ্য ও অগ্রাহ্য ঊর্জা নগণ্য শক্তির হয়, যা একরসবত্ সর্বত্র ভরা থাকে। এটার রশ্মি প্রায় শূন্য অথবা অত্যল্প আবৃত্তি এবং অনন্তের সমকক্ষ তরঙ্গদৈর্ধ্যকারী হয়। এইজন্য এই তত্ত্বও প্রায়শঃ অচল রূপে সর্বত্র ব্যাপ্ত থাকে। মনস্তত্ত্বের ভিতরে সমস্ত সংযোগ-বিয়োগ আদি ক্রিয়া এই রশ্মির কারণেই প্রারম্ভ হয়। এই "ওম্" রশ্মি রূপ বাক্ তত্ত্বই মনস্তত্ত্বকে সর্গ প্রক্রিয়া প্রারম্ভ করার যোগ্য বানিয়ে তোলে অর্থাৎ তাকে সক্রিয় করে।


এইভাবে সম্পূর্ণ অবকাশরূপ আকাশ সেই সময় মনস্তত্ত্ব এবং "ওম্"-এর পশ্যন্তী রূপের মিশ্রণে ভরে যায়। সেই সময় সম্পূর্ণ পদার্থের মধ্যে কিছু ব্যক্ত, কিন্তু মানবের টেকনিকের দৃষ্টিতে অব্যক্ত দীপ্তি ও সূক্ষ্মতম কম্পনের বিদ্যমানতা হয়। এখানে মনস্তত্ত্ব আগামী পদার্থের উৎপত্তি হেতু যোগ্য হয়ে উঠে। এই পদার্থের মধ্যে এখনও একরসতা ভঙ্গ হয়নি, কিন্তু হওয়ার জন্য অনুকূল স্থিতি হয়ে গেছে। উদাহরণের জন্য যেভাবে বীজ রোপণের পূর্বে খেতে হাল দিয়ে চাষ করা হয় আর সেই বীজ রোপণের জন্য তৈরি থাকে, ঠিক সেইভাবে মনস্তত্ত্ব অগ্রিম স্তরের পশ্যন্তী রশ্মি বানানোর জন্য তৈরি থাকে, তদুপরান্ত অন্য পদার্থের উৎপত্তি প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে প্রারম্ভ হবে।


যখন "ওম্" রশ্মির পশ্যন্তী রূপের তীব্রতা অর্থাৎ ঊর্জা বেড়ে যায়, সেই সময় চেতন তত্ত্ব কাল তত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ মহত্তত্ব-অহংকার বা মনস্তত্ত্বের বিশাল সাগর, যা সর্বত্র একরসবত্ ভরা থাকে, তাকে সূক্ষ্ম পশ্যন্তী "ওম্" বাক্ রশ্মির দ্বারা এরকম স্পন্দিত করতে থাকে, যেন কোনো শক্তি কোনো মহাসাগরের মধ্যে এক সঙ্গে তীব্রতে অনেক প্রকারের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম ঢেউ উৎপন্ন করছে, সেইভাবে চেতন তত্ত্ব "ওম্" রশ্মির দ্বারা মনস্ তত্ত্বের মধ্যে প্রাণ ও ছন্দ রশ্মি রূপী ঢেউ নিরন্তর উৎপন্ন করতে থাকে [ "ওম্" ছন্দ রশ্মির সঙ্গত না হলে সমস্ত প্রাণ রশ্মি ডার্ক এনার্জির মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়]। যখন এর উৎপত্তির প্রক্রিয়া প্রারম্ভ হয়, তখন সেই প্রক্রিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত তীব্র গতিতে হয়। এই ঢেউ (রশ্মি) মুখ্যতঃ চার প্রকারের হয় -

(১) মূল ছন্দ রশ্মি (২) প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি (৩) মাস ও ঋতু রশ্মি (৪) অন্য ছন্দ ও মরুত্ রশ্মি।

মাস হল বিশেষ প্রকারের রশ্মির নাম, যা প্রাণ ও অপানের সংযুক্ত রূপের তিরিশ বার স্পন্দিত হওয়াতে নির্মিত হয়। একটা মাসের মধ্যে তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থাকে। (মনে রাখবেন যে, এর মানে এই নয় যে একটা মাস রশ্মির ভিতরে তিরিশ প্রাণ ও তিরিশ অপান হয়ে সব মিলিয়ে ষাট রশ্মি যথাযথ বিদ্যমান হয়, বরং বাস্তবিকতা এই হল যে এই ষাট রশ্মির স্পন্দনের ফলস্বরূপ একটা মাস রশ্মি রূপী স্পন্দন হয়, যা সেই স্পন্দনের থেকে সর্বথা ভিন্ন হয় অথবা সেই ষাট স্পন্দনই একটা নবীন স্পন্দনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায়, অনেক রশ্মির মিলিত হওয়ায় কোথাও-কোনো রশ্মির উৎপত্তির চর্চা যেখানে হবে, সেখানে এইভাবেই বুঝে নেওয়া উচিত।) এই যুগ্মের বারো প্রকাশ দ্বারা বিশিষ্ঠ সংযোগের কারণেই তিরিশ প্রাণ-অপান যুগ্ম থেকে বারো মাস রশ্মির নির্মাণ হয়। যদি এরকম না হতো, তাহলে কেবল এক প্রকারেরই মাস রশ্মি উৎপন্ন হতে পারতো। এই মাস রশ্মি ছাড়া সৃষ্টি বা সূর্যাদি লোকের নির্মাণ সম্ভব হবে না। এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিকে জুড়ে রাখার কাজ করে।


এই রশ্মি বিভিন্ন রশ্মিদের যারা য়োষা ও বৃষা রূপে ব্যবহার করে, তাদের নিশ্চিত বিন্দু রূপ ভাগগুলোকে উত্তেজিত করে পরস্পর সংযোগ করাতে সহায়ক হয়। বারো প্রকারের মাস রশ্মি হচ্ছে নিম্নানুসারে -

১) মধু ২) মাধব ৩) শুক্র ৪) শুচি ৫) নভস্ ৬) নভস্য ৭) ঈষ্ ৮) ঊর্জ্ ৯) সহস্ ১০) সহস্য ১১) তপস্ ১২) তপস্য। ঋতু হচ্ছে একটা পদার্থ, যা রশ্মির রূপে হয়। দুই-দুই মাস রশ্মির যুগ্মকে ঋতু বলা হয়। ঋতু রশ্মি দিশাকে উৎপন্ন করে অর্থাৎ এর কারণে বিভিন্ন লোক বা কণা ঘূর্ণনের দিশা নির্ধারিত হতে সহযোগ পাওয়া যায়। উৎপন্ন সব পদার্থকেও "ঋতু" বলে, কারণ তারা সবাই সর্বদা নিরন্তর গমন করতে থাকে।


ঋতু রশ্মি প্রকাশ নির্মাণ করতে নিজের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা ঊষ্মার তীব্রতা বৃদ্ধি হয়। এই রশ্মি কণা ও তরঙ্গাণুর (কোয়ান্টা) পরস্পর সংযোজন-বিয়োজনের মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তারার কেন্দ্রীয় ভাগের মতো স্থানগুলোতে ঊর্জার উৎপত্তি হয়, এই রশ্মির প্রাধান্য সেখানেও থাকে। তারার বাইরের বিশাল ভাগের মধ্যেও ঋতু রশ্মির বিশেষ প্রাধান্য থাকে। ঋতু রশ্মি বিভিন্ন প্রাণাদি রশ্মিকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে, এই কারণে যেকোনো পদার্থের সঙ্গে এর মিলন দ্বারা সেই পদার্থ ঊষ্মাকে তীব্রতার সঙ্গে অবশোষিত করে। এই রশ্মি অন্য রশ্মিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গত করতে অথবা তাদের আচ্ছাদিত করতে বিশেষ সমর্থ হয়।

ছয় ঋতু রশ্মিঃ ১) বসন্ত (মধু + মাধব) ২) গ্রীষ্ম (শুক্র + শুচি) ৩) বর্ষা (নভস্ + নভস্য) ৪) শরদ্ (ঈষ্ + ঊর্জ্) ৫) হেমন্ত (সহস্ + সহস্য) ৬) শিশির (তপস্ + তপস্য)।
 
কাল তত্ত্বের পশ্চাৎ কাল মাপক প্রাণ, অপান, উদান, মাস এবং ঋতু রশ্মিগুলোই হল এরকম রশ্মি যাদের মধ্যে তমোগুণের মাত্রা সর্বথা অভাব তো থাকে না, কিন্তু এর মাত্রা এতই ন্যূন থাকে যে এই রশ্মি অন্য সব রশ্মির অপেক্ষায় সতত ও নির্বাধগামিনী হয়। এই কাল তত্ত্বের সমান তো সতত ও নিরপেক্ষ গমনকারী হয় না, কিন্তু অন্য রশ্মির অপেক্ষায় এর এটাই স্বভাব হয়। অনেক প্রাণ রশ্মি, যা এই সৃষ্টির মধ্যে নানা অতিসূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা উৎপন্ন হয়, তাদের ঋষি রশ্মি বলে। এই ঋষি রশ্মিগুলো অনেক প্রকারের মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মিকে উৎপন্ন, ধারণ আর সক্রিয় করে। তারদ্বারা উৎপন্ন মন্ত্র রূপ ছন্দ রশ্মি, সৃষ্টির মধ্যে যারাই কাজ করছে, তাদের মধ্যে এই ঋষি রশ্মিরও সহযোগী ভূমিকা থাকে।

রশ্মির উৎপত্তি কালেই আকাশের উৎপত্তি হয়। "আকাশ" শব্দটা হচ্ছে দুটি রূপে প্রযুক্ত। প্রথম রূপটা হচ্ছে অবকাশ রূপ আকাশ অভাব বা শূন্য রূপ। অন্যদিকে বেদের মধ্যে অপর ব্যোম নামে দ্বিতীয় আকাশের সংকেত করা হয়েছে, যার সংকেতকে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী "ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা" নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এই আকাশ হচ্ছে একটা পদার্থ বিশেষের নাম।

মনস্তত্ত্ব থেকেই পাঁচ মহাভূত উৎপন্ন হয়। এই সৃষ্টির উৎপত্তি বিভিন্ন প্রাণ ও ছন্দ রশ্মির নানা প্রকারের মিলন দ্বারাই হয়েছে। সব পঞ্চ মহাভূত যথা পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ সবই এর দ্বারাই তৈরি হয়েছে, এদের মধ্যে আকাশ মহাভূতের উৎপত্তি সর্বপ্রথম হয়। বর্তমান ভৌতিক বৈজ্ঞানিক আকাশ তত্ত্বের (স্পেস) বিষয়ে নিতান্ত ভ্রম বা সংশয়ের মধ্যে আছে। তারা আকাশকে ত্রিবিমীয় (3D) মানে, কিন্তু আকাশের স্বরূপ কি? রিক্ত স্থানই কী আকাশ? নাকি আকাশ হচ্ছে কোনো পদার্থ? এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর তাদের কাছে নেই। তারা গুরুত্বাকর্ষণ বল অথবা বিদ্যুত্ চুম্বকীয় বলের দ্বারা আকাশের বক্র বা বিকৃত হওয়াকে মানে, কিন্তু তাকে কোনো ধরনের পদার্থ বিশেষ বলার থেকে এড়িয়ে চলে।

যদি আকাশ কোনো পদার্থই না হয়, তাহলে বলের কারণে বিকৃত অথবা বক্রতা কিভাবে হবে? আশ্চর্যের বিষয় হল, বর্তমানে উন্নত মানা হয় এমন ভৌতিক বিজ্ঞান গুরুত্বাকর্ষণ বলকে আকাশের বক্রতার রূপেই মানে ও জানে, অথচ আকাশ কি? এটা তারা জানে না। এইদিকে বৈদিক বিজ্ঞান আকাশ তত্ত্বের বিষয়ে ব্যাপক তথ্য প্রস্তুত করে। বৈদিক বিজ্ঞানের অনুসারে আকাশ হচ্ছে একটা পদার্থ, সব ধরনের কণা ও তরঙ্গাণু আকাশ তত্ত্বের মধ্যেই উৎপন্ন হয় ও তারমধ্যেই নিবাস করে। আকাশ প্রাণ রশ্মির রূপেই বিদ্যমান থাকে। প্রাণ, অপান এবং উদান রশ্মিগুলোর এক সহস্র বার আবৃত্তি হয়, তখন বিভিন্ন প্রাণের সঙ্গম দ্বারা অন্য রশ্মিগুলো আকাশ তত্ত্ব রূপে উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন ছন্দ ও প্রাণ রশ্মির মিশ্রণ আকাশ তত্ত্বকে বক্র বা বিকৃত করার ক্ষমতা রাখে। আকাশ স্বয়ং হচ্ছে রশ্মি রূপ, এই রশ্মিগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়। আকাশ তত্ত্ব বিভিন্ন কণা বা তরঙ্গাণুদের থামিয়ে রাখতে সহায়ক হয়। এরমধ্যে বৃহতী ছন্দ রশ্মিগুলো প্রচুর মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এটা এতই সূক্ষ্ম হয় যে এর স্বরূপ অভাব বা রিক্ততার মতো মনে হয়। এরমধ্যে রশ্মির প্রাচুর্য থাকে তথা এটা সমস্ত পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। এটা ছিদ্রের সমান অর্থাৎ শূন্যতার সমান ব্যবহার করে। এরমধ্যে "ওম্", ত্রিষ্টুপ্, মরুত্, সূত্রাত্মা বায়ু ও ছন্দ আদি রশ্মির প্রাচুর্য থাকে। এটা বিভিন্ন বড়ো ছন্দ রশ্মি, মূল কণা, বিকিরণ আদিকে গতিশীল করার হেতু অবকাশ ও মার্গ প্রদান করে। মহর্ষি কণাদ-এর শব্দে "যারমধ্য দিয়ে বিভিন্ন পদার্থের প্রবেশ করা বা বেরিয়ে যাওয়া হয়, তাকে আকাশ বলে।"


আকাশের মধ্যে বিদ্যমান প্রাণ রশ্মিগুলো অত্যন্ত শিথিলাবস্থায় চক্রাকার গতিতে ভ্রমণ করতে থাকে। এদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন অতি নিম্ন হয়। এই কারণে আকাশ তত্ত্বতে বিভিন্ন কণা বা বিকিরণ স্বচ্ছন্দ আর নিরাপদ গতিতে গমন করতে থাকে। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অন্তর্গত যখন "ওম্", "ভূঃ", "ভুবঃ", "স্বঃ" -এর অতিরিক্ত অন্য দৈবী ছন্দ রশ্মি এবং সূত্রাত্মা বায়ু সহিত প্রাণ, অপান আদি প্রাণ রশ্মিগুলো উৎপন্ন হয়ে যায়, সেই সময় সেগুলোর মধ্যে কিছু রশ্মির সংঘাত দ্বারা একটা সূক্ষ্ম ও প্রায়শই একরসবত্ পদার্থের উৎপত্তি হয়। এই পদার্থের উৎপত্তির পূর্বে প্রাণ, অপান এবং উদানের এক সহস্রবার আবৃত্তি আগে থেকেই হয়ে থাকে। তখন দৈবী অনুষ্টুপ্ এবং য়াজুষী (বৃহতী, পংক্তি ও ত্রিষ্টুপ্) রশ্মিগুলোও আগে থেকেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই চার ছন্দ রশ্মি পরস্পর এইভাবে মিশ্রিত থাকে যে দৈবী অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মির সমান প্রভাব দেখায়। বিভিন্ন প্রাণ, অপান আদি রশ্মি, বিভিন্ন দৈবী ছন্দ রশ্মির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এরকম দৈবী অনুষ্টুপ্ ছন্দ রশ্মিদের উৎপন্ন করে, যা প্রায়শই নিষ্কম্প হয়। এই রশ্মিগুলো নিজের স্থানেই স্পন্দিত হতে থাকে, না কি মনস্তত্ত্বের মধ্যে সর্বত্র গমন করে।


আকাশ তত্ত্বের অবয়বভূত প্রাণ ও মরুত্ রশ্মিগুলো শিথিলাবস্থায় পারস্পরিক সংঘাতের রূপেই বিদ্যমান থাকে। এই সংঘাতের মধ্যে বিদ্যমান সেই রশ্মিগুলো চক্রাকারে ঘূর্ণন করতে থাকে অর্থাৎ সেগুলোর মধ্যে রেখীয় গতি থাকে না, তবে ঘূর্ণন গতি অতি ধীর গতিতে হতে থাকে। এই রশ্মিগুলো আকাশ রশ্মির রূপে পরিচিত। এই রশ্মিগুলো এই অবস্থায় এরকম শিথিল থাকে যে বিভিন্ন বড়ো ছন্দ রশ্মি, কণা বা তরঙ্গাণু সরলতার সঙ্গে এদের মাঝখানে স্বচ্ছন্দ গতি করতে পারে। গতি করতে গিয়ে কণা, তরঙ্গাণু বা রশ্মিগুলো যখন আকাশ তত্ত্বের মাঝখান দিয়ে গমন করে, তখন এরা ঘূর্ণন করতে-করতে পূর্বোক্ত শিথিল আকাশ রশ্মিগুলোর (প্রাণ ও মরুত্) মাঝখান দিয়ে সরলতার সঙ্গে পিচ্ছলিয়ে গতি করে। এতকিছুর পরেও এই শিথিল রশ্মিগুলো সর্বদা সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকে। এই কারণে যখন আকাশ তত্ত্ব কোনো বলের দ্বারা সংকুচিত বা বিকৃত হয়, তখন সূত্রাত্মা বায়ু রশ্মির দ্বারা আকাশ রশ্মির ঘূর্ণন গতি প্রভাবিত হওয়ার কারণেই হয়। এই তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত প্রকাশযুক্ত, সবথেকে হালকা অর্থাৎ নগণ্য দ্রব্যমান এবং বিদ্যুৎ বলের হয়।


এইভাবে আকাশ বিভিন্ন একক দ্বারা নির্মিত জালের সমান হয়। এই একক পরস্পর সূত্রাত্মা বায়ুর সঙ্গে বাঁধা থাকে। এই এককগুলো নিরন্তর নিজের অক্ষের উপর ঘূর্ণন করতে থাকে। এর পারস্পরিক বন্ধন অতি শিথিল হয়, তাই এর মাঝখান দিয়ে কোনো তরঙ্গ অথবা কণা সরলতার সঙ্গে গমন করতে পারে। আকাশ এই তরঙ্গ অথবা কণাগুলোকে গমন করার জন্য রাস্তার কাজ করে। এর অঙ্গভূত কিছু রশ্মি কোনো কণা ও তরঙ্গকে আধার প্রদান করে, তো অন্য কিছু রশ্মি সেই তরঙ্গ ও কণাগুলোকে এরকম ঘর্ষণ প্রদান করে, যেরকম রাস্তায় চললে পরে রাস্তা ঘর্ষণ বল প্রদান করে। যেভাবে রাস্তার ঘর্ষণ বলের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উৎপন্ন বল গাড়ির চাকাকে আগে চলার হেতু বল প্রদান করে, ঠিক সেইভাবে কিছু রশ্মি কোনো কণা ও তরঙ্গকে আকাশে গমন করার সময় প্রতিক্রিয়া বল প্রদান করে তাকে আগে বাড়িয়ে দেয়। এইভাবে কোনো কণা ও তরঙ্গ মুক্ত রূপে আকাশে গমন করে। কণা ও তরঙ্গের গতি করার সময় আকাশের কিছু রশ্মি, আকাশের এককগুলোকে কিছু বিচলিত করে মার্গ তৈরির কাজ করে। 

আকাশ তত্ত্ব প্রাথমিক প্রাণ রশ্মি এবং সূক্ষ্ম রশ্মির দ্বারা নির্মিত হয়। যেকোনো প্রকারের আকর্ষণ-প্রতিকর্ষণ বলের সময় আকাশের সঙ্কুচিত বা প্রসারিত হওয়া এই কারণেই সম্ভব হয়, কারণ আকাশ এই রশ্মিদের দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে।

আকাশ তত্ত্বও সূক্ষ্ম প্রাণ আর মরুত্ রশ্মির মিশ্ররূপ হয়। এরমধ্যে ত্রিষ্টুপ্ আর বৃহতী ছন্দ রশ্মিরও প্রাধান্য বিদ্যমান থাকে, আবার বিভিন্ন কণার ভিতরে গায়ত্রী ছন্দ রশ্মির প্রাধান্য থাকে। আকাশ তত্ত্বের রশ্মিগুলো বিভিন্ন কণার সংযোগ-বিয়োগের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম স্তরে বিভিন্ন কণাকে স্পর্শ বা সেচন করতে থাকে, কিন্তু তাদের নিজের আকর্ষণাদি বল নগণ্যের মতো হয়। দিক্-তত্ত্ব (দিশা) হচ্ছে আকাশের অন্তর্গতই অন্তর্ভুক্ত। দিক্-তত্ত্ব হচ্ছে আকাশ তত্ত্বের সেই ভাগ, যা কোনো কণা বা লোক আদি পদার্থকে সবদিক থেকে আবৃত্ত করে থাকে তথা সেই পদার্থের ঘূর্ণন, সংযোজন আদি ক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে। দিক্ তত্ত্বও আকাশ মহাভূতের মতো রশ্মি রূপ হয়। কাল তত্ত্ব হচ্ছে তাদের তুলনায় অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। এই তিন পদার্থের পারস্পরিক সম্বন্ধ এই হচ্ছে যে, তিন মহাভূতকে প্রেরিত ও নিয়ন্ত্রিত তো করে, কিন্তু এরা কোনো পদার্থের ভাগ হয় না। আজ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নানা পদার্থের নির্মাণ হচ্ছে আর এই জন্য নানা ক্রিয়াও হচ্ছে। এই ক্রিয়াগুলোর মধ্যে এই তিন পদার্থ প্রত্যক্ষ ভাগ না নিয়ে পরোক্ষ রূপে প্রেরণার কাজ করতে থাকে। বিভিন্ন বাক্ অর্থাৎ ছন্দ রশ্মিগুলোই দিক্ তত্ত্বের রূপ ধারণ করে।











No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

বৈদিক সৃষ্টি উৎপত্তি বিজ্ঞান

  যখন সৃষ্টি নির্মাণের সময় আসে, সেই সময় সর্বপ্রথম সর্বব্যাপক চেতন তত্ত্বের মধ্যে সৃষ্টি উৎপত্তি করার কামনা উৎপন্ন হয়। এটা হল সৃষ্টি উৎপত্...

Post Top Ad

ধন্যবাদ