"ভাসং নাম সত্তা উন্নণহতী'তি বত্ত্বা পনেথ ইদং কথিতং। মাতাপিতরো হি দহরকালে কুমারকে মঞ্চে বা পীঠে বা নিপজ্জাপেত্বা তং তং কথয়মানা তানি তানি কিচ্চানি করোন্তি। দারকা তেসং তং তং ভাসং ববত্থাপেস্তি 'ইমিনা ইদং বুত্তং', ইমিনা ইদং বুত্ত'স্তি। গচ্ছন্তে গচ্ছন্তে কালে সব্বম্পি ভাসং জানন্তি।"-(পটিসম্ভিদাবিভঙ্গো/ বিভঙ্গ-অষ্টকথা)
পালি ভাষার উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে কেউ বলেন মগধ, কেউ কোশল, কেউ বা উড়িষ্যা। তাঁরা শব্দগত পার্থক্য ও সাদৃশ্য যোজনা করে এ সমস্ত মন্তব্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোন ভাষাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক শব্দের প্রবেশ বা প্রয়োগ অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে বিশাল জম্বুদ্বীপের (ভারতবর্ষের) ষোড়শ জনপদের জনগোষ্ঠীর ভাষার আঞ্চলিক শব্দগত প্রভাব পড়বেই। সে যাই হোক্ না কেন, পরিশেষে মগধই পালি ভাষার উৎপত্তির স্থল হিসেবে ধরে নিতে হয়।
সুতরাং বুদ্ধের মুখনিঃসৃত ভাষা আর তৎকালে বহুল প্রচলিত সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার সমন্বয়ে যে ভাষার উৎপত্তি হয় সেটিই মাগধী ভাষা। বুদ্ধ এ ভাষাকেই 'সকায় নিরুত্তি' অর্থাৎ নিজ ভাষা বোঝাতে চেয়েছেন। পরবর্তীকালে এ মাগধী ভাষাই পালি ভাষার রূপ ধারণ করে ত্রিপিটকাকারে বুদ্ধবচন লিপিবদ্ধ হয়।
'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং পালিভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ আছে। পঙক্তি, বীথি, শ্রেণী প্রভৃতি অর্থে 'পালি' শব্দের প্রয়োগ আছে। 'পালি' শব্দ প্রথমতঃ বৌদ্ধশাস্ত্রের মূলশাস্ত্রকে এবং পরে মূলশাস্ত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত যে কোনও গ্রন্থকে বোঝাতে ব্যবহৃত হোত। এমন কথাও অনেকে বলেন যে মূলশাস্ত্র 'পালি' বলে, যে ভাষায় ঐ মূল বা 'পালি' লেখা হয়েছিল তাকেই কালক্রমে পালিভাষা বলা হ'ল। 'পালি' শব্দটির প্রথম প্রয়োগ আমরা বুদ্ধঘোষের অট্ঠকথার মধ্যে পাওয়া যায়। এই শব্দটির বহুপ্রকার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ করার চেষ্টা হয়েছে এবং বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর 'পালিপ্রকাশ' গ্রন্থে এ সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে আলোচনা করেছেনও।
পালি ভাষার উৎপত্তি কী করে হ'ল এবং এটি কোন্ অঞ্চলের ভাষা এ নিয়েও পণ্ডিতমহলে বিশেষ মতভেদ দেখা যায়ও। পালি একটি মিশ্র ভাষা এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ভাষার সাদৃশ্যধর্ম লক্ষ্য করে পণ্ডিতরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। উজ্জয়িনীকেই পালির উৎপত্তিস্থল বলে মনে করেছেন Westergaard, Kuhn প্রমুখ পণ্ডিতগণ; পৈশাচীর সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন Sten Konow; Oldenberg প্রমুখরা পালিকে কলিঙ্গের ভাষা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন; Lüders বলেন অর্ধমাগধীর মূল প্রাচীন রূপ থেকে অনুবাদ করেই পালি সাহিত্যের সৃষ্টি; Geiger, Windisch প্রমুখ সিংহলী ঐতিহ্যকে স্বীকার করে মনে করেন বৌদ্ধমতের পীঠভূমি মগধই হ'ল পালির উৎপত্তিস্থল এবং মাগধীই হ'ল মূলভাষা, আবার সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মনে করেন পালি হ'ল পশ্চিমা ভাষা।
এই মতগুলির মধ্যে কোনটিই পণ্ডিতমহলে সন্তোষজনকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। মাগধীর পক্ষে মতামতের পাল্লা ভারী হ'লেও ব্যাকরণ, প্রতুলেখ বা নাটকের মধ্যে আমরা যে মাগধী প্রাকৃতের পরিচয় পাই তা'র সঙ্গে পালির বিশেষ মিল দেখা যায় না।
'পালি'র মত 'প্রাকৃত' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়েও নানা পণ্ডিতের নানা মত'! 'প্রকৃতিতে যাহা জাত' বা 'প্রকৃতি হইতে যাহা আগত' তার নামই 'প্রাকৃত'। প্রকৃত বলতে বাণীর পরা অবস্থাকে বলা যেতে পারে। অনেকে বলেন এই 'প্রকৃতি' হ'ল সংস্কৃত ভাষা এবং 'প্রাকৃত' ভাষা হ'ল সংস্কৃতের বিকৃতি। কারও মতে আবার 'প্রকৃতি' অর্থাৎ স্বভাব থেকে যে ভাষা এসেছে তারই নাম 'প্রাকৃত'। যে ভাষার 'সংস্কার' বা গুণাধান করা হয়েছে তা' হ'ল 'সংস্কৃত' এবং যে ভাষা নৈসর্গিক বা স্বাভাবিক অবস্থায় আছে এবং যার কোন 'সংস্কার' করা হয়নি তা-ই হ'ল 'প্রাকৃত'। আর এক মতে সাধারণ 'প্রাকৃত' লোকের ব্যবহৃত ভাষাই 'প্রাকৃত' ভাষা। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় পালি প্রকাশ গ্রন্থে এ বিষয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন।
ফরাসী ফণ্ডিত Eugene Burnouf ও তাঁর অনুগামীদের মতে বৌদ্ধশাস্ত্র প্রথম লেখা হয় পালি ভাষায়, বৌদ্ধগ্রন্থ বুদ্ধের নির্বাণের সময় থেকে অশোকের সময় পর্যন্ত প্রায় তিনশ' বছরের মধ্যেই রচিত হয় বৌদ্ধ সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা করলে বোঝা যায় বহু শতাব্দী ধরে এই সাহিত্যের রচনা চলেছিল এবং অশোকের আগে বা খৃঃ পূঃ তৃতীয় শতকের পূর্বে খুব বেশী বৌদ্ধগ্রন্থ বিধিবদ্ধভাবে রচিত হয়নি, সম্ভবতঃ একটি পিটকেরও অস্তিত্ব ছিল না।
কেউ কেউ অবশ্য এমন মত পোষণ করেছেন যে অশোকের মত বৌদ্ধ মতসেবীর নাম শাস্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকায় মনে হয় তাঁর সময় এই শাস্ত্র রচনা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অশোকের একশ' বছর পরেও আমরা 'ত্রিপিটক' শব্দের কোন উল্লেখ পাই না, পাই শুধু 'পিটক' শব্দটি। আরও মনে রাখা দরকার যে স্বকীয় অনুশাসনে সম্রাট অশোক ভিক্ষু সংঘকে মুনিগাথা, অনাগতভয়, রাহুলোবাদ ইত্যাদি সাতটি সূত্র অধ্যয়ন করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন, কিন্তু কোন 'পিটক' বা 'ত্রিপিটকে'র উল্লেখ সেখানে নেই! যে রূপে এই সূত্রগুলির উল্লেখ করা হয়েছে ঠিক সেইভাবেই পালি ত্রিপিটকে এদের আমরা পাইনা। এখন প্রশ্ন, অশোকের পূর্বে প্রচলিত বৌদ্ধশাস্ত্র কোন্ ভাষায়ও কী রূপে ছিল। শিক্ষক রূপে বুদ্ধ তাঁর ধর্মমত কোশল ও মগধের মধ্যেই প্রচার করেন এবং অশোকের সময় পর্যন্ত এই ধর্মমত সাধারণভাবে এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধানতঃ অশোকের চেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্ম (মত) প্রসার লাভ করে। বুদ্ধ স্বয়ং এবং অশোকের সময় পর্যন্ত বুদ্ধশিষ্যরা কোশল-মগধের ভাষাতেই ধর্মের আলোচনা করতেন বলে মনে হয় এবং ঐ সময় প্রচলিত বৌদ্ধশাস্ত্র সম্ভবতঃ ঐ স্থানের ভাষাতেই প্রচলিত ছিল।
অশোক তাঁর অনুশাসনে যে সূত্রগুলির উল্লেখ করেছেন সেগুলি মগধের ভাষাতেই রচিত ছিল বলে মনে হয়। ভাষাতত্বের বিচারে পালিভাযা কোশল-মগধের প্রচলিত প্রাকৃত নয়, সম্ভবতঃ পশ্চিম ভারতের বা অবন্তির কোন কথিত ভাষার সাহিত্যিক রূপ। বর্তমানে প্রচলিত পালি ত্রিপিটক অশোকের পরবর্তী কালেরই বলে মনে হয়, তবে এই গ্রন্থরচনার কাজ হয়ত অনেক আগেই গুরু হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন শাস্ত্র যে ভাষাতেই প্রচলিত থাকুক না কেন, তা আকারে খুব বড় ছিল না এবং ঐ শাস্ত্রকে (গ্রন্থকে) তিনভাগে ভাগ করার কোন প্রয়োজন হয়নি।
বৌদ্ধধর্ম যখন ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করল তখনই সম্ভবতঃ সঙ্ঘনায়করা প্রাচীন শাস্ত্রকে বিভিন্ন স্থানীয় প্রাকৃত ভাষায় এবং সংস্কৃতে রূপান্তরিত বা অনুবাদ করলেন। এইসব অনুবাদের মধ্যে এখনও আমরা প্রাচীন মাগধী ও অর্ধ মাগধী শব্দের সন্ধান পাই। বৌদ্ধাচার্যরা কেবল তাঁদের শাস্ত্র অনুবাদই করলেন না, প্রাচীন শাস্ত্রের কাঠামো বজায় রেখে তাঁদের নিজস্ব সাম্প্রদায়িক মত স্থাপন করতে উদ্যোগী হ'লেন। এর ফলেই এই শাস্ত্র (গ্রন্থ) বিপুল আকার ধারণ করল এবং তখনই ঐ 'শাস্ত্রকে 'পিটক' ভাবে ভাগ করার প্রয়োজন দেখা দিল।
বৌদ্ধসাহিত্য এবং সিংহলী ঐতিহ্য অনুসারে আমরা জানি যে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের অব্যবহিত পরেই রাজগৃহে (বর্তমান রাজগীর) বৈভার পর্বতের সপ্তপর্ণী নামক গুহায় পাঁচশত বৌদ্ধ অর্হতের এক সঙ্গীতি (Council) আহ্বান করা হয়। এই সঙ্গীতি আহ্বানের উদ্দেশ্য ছিল "বুদ্ধবচন” সংকলন ও অবিকৃতভাবে রক্ষা করা। বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় বহু উপদেশ ও শিক্ষা দেন কিন্তু কখনও তা' সংগ্রহ বা লিপিবদ্ধ করা হয়নি। তিনি যতদিন বর্তমান ছিলেন ততদিন তাঁর উপদেশের কোন ভ্রান্ত ব্যাখ্যার বা তাঁর 'বচনে'র পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না; কিন্তু তাঁর দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গেই ঐ রকম আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় প্রধান বুদ্ধ শিষ্যগণ এই রকম একটি সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। থের (স্থবির) মহাকসপের (মহাকাশ্যপ) আহ্বানে এবং তাঁরই সভাপতিত্বে এই সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হ'ল। প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি নামে পরিচিত এই সঙ্গীতিতে আনন্দ আবৃত্তি করে শোনালেন বুদ্ধ, কোথায়, কী প্রসঙ্গে, ধর্মব্যাখ্যান করেছিলেন, আর, উপালি বিবৃত করলেন বুদ্ধের 'বিনয়' সম্বন্ধীয় উপদেশ। 'ধর্ম'-সম্বন্ধীয় আনন্দের আবৃত্তি দিয়েই সূচনা হ'ল সুত্তপিটকের আর উপালি 'বিনয়'-সম্বন্ধে যা বললেন তাই নিয়ে সুত্রপাত হ'ল বিনয়পিটকের।
সূত্ত এবং বিনয়ের ঠিক্ কোন্ কোন্ অংশ ঐ সম্মেলনে বিবৃত হয়েছিল তা' আজ আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না। তবে, এ কথা মনে করা অসঙ্গত হ'বে না যে, পালি ও সংস্কৃত উভয় ভাষায় প্রাপ্ত এই দুই পিটকে যে অংশগুলি সাধারণ (common) সেইগুলিই সম্ভবতঃ এই দুই পিটকের প্রাচীনতম অংশ। অভিধস্মের অস্তিত্বের কোন ইঙ্গিত এই সঙ্গীতির বিবরণে আমরা পাই না।
বুদ্ধ ছিলেন জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের কনিষ্ঠ সমসাময়িক। বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ ছাড়াও বুদ্ধের জীবন ছিল আজীবক, চার্বাক, জৈনধর্ম ও অঞ্জন প্রভৃতি প্রভাবশালী শ্রমণ চিন্তাধারার উদয়কালের সমসাময়িক। প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্য জনগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মূল ভূখণ্ড থেকে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র গণতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র হিসেবে শাসন করত। দীর্ঘ নিকায় গ্রন্থে ব্রহ্মজাল সুত্রে এই ধরনের বাষট্টিটি মতবাদের কথা বিবৃত হয়েছে। সেই যুগেই মহাবীর, পূরণ কস্সপ, মক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত প্রমুখ প্রভাবশালী দার্শনিক তাদের মত প্রচার করেছিলেন। পিটকে সামান্নফল সুত্র এঁদের কথা উল্লিখিত হয়েছে। বুদ্ধ নিশ্চয় এঁদের মতবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুসারে, গৌতম অধুনা নেপালের লুম্বিনী নগরে জন্মগ্রহণ করেন ও কপিলাবস্তুতে বড় হয়ে ওঠেন।গৌতমের বংশীয় নামের অর্থ "গোতমার বংশধর", "গোতম" অর্থ "যার কাছে সবচেয়ে বেশি আলো আছে"। সিদ্ধার্থ তাঁর আসল নাম গৌতম গোত্রীয় হওয়ায় গৌতম ও বৌদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত হন।
"যদি চারবাক প্রভৃতি বেদাদি সত্যশাস্ত্র দর্শন পাঠ এবং শ্রবণ করিতেন তাহা হইলে কখনও বেদের নিন্দা করিতেন না এবং বলিতেন না যে, বেদ ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচরসদৃশ ব্যক্তিদিগের রচিত। অবশ্য মহীধর প্রভৃতি টীকাকারগণই ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচর সদৃশ; ধূর্ততা তাঁহাদের, বেদের নহে।কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, চারবাক, বৌদ্ধ এবং জৈনগণ মূল চারিবেদের সংহিতাগুলি দর্শন, শ্রবণ ও পাঠ করেন নাই এবং কোন বিদ্বানের নিকট অধ্যয়নও করেন নাই। এই নিমিত্ত তাঁহারা নষ্ট ভ্রষ্ট বুদ্ধি লইয়া নিরর্থক বেদের নিন্দা করিয়াছেন এবং দুষ্টবুদ্ধি বামমার্গীদিগের প্রমাণশূন্য কপোল কল্পিত জঘণ্য টীকাসমূহ পাঠ করিয়া বেদবিরোধী হইয়াছেন। ফলে তাঁহারা অবিদ্যারূপী অতল সমুদ্রে নিপতিত হইয়াছেন॥"-
সত্যার্থ প্রকাশ

"বামমার্গিগণ মিথ্যা কপোল কল্পনা করিয়া বেদের নামে নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধ করিয়াছে অর্থাৎ যথেচ্ছ মদ্যপান, মাংসভোজন, পরস্ত্রীগমনাদি দুষ্ট কর্ম্মের প্রবর্তনকল্পে বেদের উপর কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে। ইহাদের দেখাদেখি, চারবাক, বৌদ্ধ ও জৈনগণও বেদের নিন্দা করিতে আরম্ভ করে, নিজেরা পৃথক এক বেদবিরুদ্ধ, অনীশ্বরবাদী অর্থাৎ নাস্তিক মত প্রচলন করিল। চারবাকাদি যদি বেদের মূল অর্থ আলোচনা করিতেন তবে মিথ্যা টীকাসমূহ দেখিয়া সত্য বেদমত পরিত্যাগ করিতেন কি? কি করা যায়! হতভাগ্যদের "বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি"। যখন নষ্ট ভ্রষ্ট হওয়ার সময় আসে তখনই মানুষের বুদ্ধি বিপরীত হয়।"-
সত্যার্থ প্রকাশ

চারবাক হইতে বৌদ্ধ একটি পৃথক শাখা হইয়াছে। যাঁহারা বৌদ্ধদিগের তীর্থঙ্কর, তাঁহাদিগকে জৈনগণও মানেন। তাঁহাদের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই। রাজা শিবপ্রসাদ "ইতহাসতিমিরনাশক" নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন বৌদ্ধ এবং জৈন দুইটি নাম মাত্র, কিন্তু মত একই। এই দুইটি শব্দ পর্য্যায়বাচী। বৌদ্ধদিগের মধ্যে বামমার্গী, মদ্যপায়ী ও মাংসভোজী বৌদ্ধও আছেন। তাঁহাদের সহিত জৈনদিগের বিরোধ আছে। কিন্তু মহাবীর এবং গৌতম গণধরকে বৌদ্ধগণ বুদ্ধ এবং জৈনগণ গণধর এবং জিনবর বলিয়া থাকেন। জিন হইতে পরম্পরা ক্রমে জৈনমত চলিয়া আসিয়াছে। রাজা শিবপ্রসাদ তাঁহার "ইতিহাসতিমিরনাশক” নামক গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখিয়াছেন যে, স্বামী শঙ্করাচার্য্য প্রায় এক সহস্র বৎসর পূর্বে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। তাঁহার পূর্ব্বে সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধ অথবা জৈনধর্ম বিস্তৃত হইয়াছিল। এবিষয়ে তিনি এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন-"যে বেদবিরুদ্ধ মত মহাবীর গণধর গৌতম স্বামীর সময় হইতে স্বামী শঙ্করাচার্য্যের সময় পর্য্যন্ত আরতবর্ষে বিস্তৃত হইয়াছিল এবং যাহা সম্রাট অশোক এবং সম্প্রতি মহারাজ বিশ্বাস করিতেন, বৌদ্ধমত বলিতে আমি সেই মতই বুঝি। জৈনমত কখনও তাহার বহির্ভূত হইতে পারে না। যে জিন শব্দ হইতে জৈনের এবং যে বুদ্ধ শব্দ হইতে বৌদ্ধের উৎপত্তি হইয়াছে, সেই দুইটি শব্দ পর্যায়বাচক। অভিধানে দুইটি শব্দের একই অর্থ লিখিত হইয়াছে। দীপবংশ প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ সমহে শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধকে প্রায়ই মহাবীর নামে উল্লেখ করা হইয়াছে। শাক্যমুনির সময়ে হয়ত বৌদ্ধ এবং জৈন দুইটি একই ছিল। আমরা যে গৌতমের অনুযায়ীদিগকে জৈন না লিখিয়া বৌদ্ধ লিখিয়াছিম তাহার কারণ এই যে, অন্য দেশীয়গণ তাঁদিগকে বৌদ্ধ নামেই অভিহিত করিয়াছেন।"
বুদ্ধদের মধ্যে প্রথম তিনজন — তৃষ্ণঙ্কর, মেধঙ্কর ও শরণঙ্কর — দীপঙ্কর বুদ্ধের আগে বেঁচে ছিলেন। চতুর্থ বুদ্ধ, দীপঙ্কর, বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি ছিলেন সেই বুদ্ধ যিনি ব্রাহ্মণ যুবকদের নিয়থ বিবরণ (ভবিষ্যত বুদ্ধত্বের ভবিষ্যদ্বাণী) দিয়েছিলেন, যারা সুদূর ভবিষ্যতে বোধিসত্ত্ব গৌতম বুদ্ধ হবেন। বৌদ্ধ তন্ত্রে বেশ কিছু নারী বুদ্ধও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন তারা, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী বুদ্ধ, যারা বিভিন্ন রূপ এবং রঙে আসে। বেশ কয়েকটি তান্ত্রিক সূত্রে, প্রধান পাঁচ বুদ্ধের প্রত্যেককে বিদ্যারাজি (জ্ঞান রানী) বা প্রজ্ঞা সহধর্মিণীর সাথে যুক্ত করা হয়েছে। তারা হলো: আকাশধাতবীশবরী, লোচনা, মামকী, পণ্ডারবাসিনী, তারা।
বৌদ্ধ ধম্মগ্রন্থ অনুসারে, মৈত্রেয় গৌতমের উত্তরসূরি হবেন যিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন, সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করবেন ও বিশুদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দেবেন। মৈত্রেয়ের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীটি সমস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের (থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযান) প্রামাণিক সাহিত্যে পাওয়া যায় এবং বেশিরভাগ বৌদ্ধদের দ্বারা ধর্মকে বিস্মৃত হওয়ার সময় ঘটবে এমন ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি হিসাবে গৃহীত হয় জম্বুদ্বীপ (পার্থিবরাজ্য, যেখানে সাধারণ মানুষ বাস করে)।
ঊনত্রিশ (শেষ আটাশ ও ভবিষ্যৎ) বুদ্ধের নাম:
১ তৃষ্ণঙ্কর ২ মেধঙ্কর, ৩ শরণঙ্কর, ৪ দীপঙ্কর, ৫ কৌণ্ডিণ্য, ৬ মঙ্গল, ৭ সুমন, ৮ রায়বত, ৯ শোবিত, ১০ অনবমদর্শিন, ১১ পদ্ম, ১২ নারদ, ১৩ পদ্মোত্তর, ১৪ সুমেধ, ১৫ সুজাত, ১৬ প্রিয়দর্শিন, ১৭ অর্থদর্শিন, ১৮ ধর্মদর্শিন, ১৯ সিদ্ধার্থ (জন্মস্থানঃ বেভার) পিতামাতা- উদেন - সুফশা, ২০ তিষ্য, ২১ পুষ্য, ২২ বিপশ্যিন, ২৩ শিখিন, ২৪ বিশ্বভু, ২৫ ক্রকুচ্ছন্দ, ২৬ কনকমুনি ২৭ কাশ্যপ, ২৮ গৌতম (কপিলাবস্তু) খ্রীষ্টপূর্ব ৬৫৩ ঋষিপতন (সারনাথ) ৫২৮ খ্রীষ্টপূর্ব পিতা-মাতা শুদ্ধোধন- মায়াদেবী, ২৯ মৈত্রেয়॥
ঐতিহাসিক গৌতম বুদ্ধের শৈশবের নাম ছিল সিদ্ধার্থ, গৌতম ছিলেন তাঁর গোত্র পরিচয়। শাক্য ছিল তার বংশ যারা সূর্যবংশী ক্ষত্রিয় শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর পিতার নাম ছিল শুদ্ধোধন, যিনি শাক্য গণরাজ্যের শাসক ছিলেন। এই গণরাজ্য কোশলরাজের শাসনাধীনে ছিল। শাক্যদের রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। তাঁর মাতার নাম ছিল মহামায়া বা মায়াদেবী, তিনি ছিলেন কোলীয় বংশের একজন ক্ষত্রিয় রাজকন্যা। সিদ্ধার্থ ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (মতান্তর ৬৫৩খ্রীষ্টপূর্ব) বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের তরাই অঞ্চলে অবস্থিত কপিলবস্তুর কাছে 'লুম্বিনী' নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে এই গ্রামটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নেপালে অবস্থিত।
মহাযান বৌদ্ধরা অসংখ্য বুদ্ধকে পূজা করে যা আদি বৌদ্ধধর্মে বা থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে পাওয়া যায় না। ভদ্রকল্পিকসূত্রে এক হাজার চারজন বুদ্ধের তালিকা রয়েছে এবং তাদের কাজ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই ভবিষ্যতের বুদ্ধ। থেরবাদ বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পরবর্তী স্তরের (খ্রিস্টপূর্ব ১ম থেকে ২য় শতাব্দীর মধ্যে) বুদ্ধবংশ গ্রন্থ অনুসারে, আদি গ্রন্থে সাতটি নামের তালিকায় আরও একুশ জন বুদ্ধকে যুক্ত করা হয়েছিল।[A textual and Historical Analysis of the Khuddaka Nikaya – Oliver Abeynayake Ph.D., Colombo, First Edition – 1984, p. 113] থেরবাদ ঐতিহ্য বজায় রাখে যে কল্প বা বিশ্বযুগে পাঁচজন পর্যন্ত বুদ্ধ থাকতে পারে এবং বর্তমান কল্প-এ চারজন বুদ্ধ ছিল, বর্তমান বুদ্ধ, গৌতম, চতুর্থ ও ভবিষ্যত বুদ্ধ মৈত্রেয় হলেন কল্পের পঞ্চম ও চূড়ান্ত বুদ্ধ।
ঐতিহাসিক বুদ্ধ, গৌতম, যাকে শাক্যমুনিও (শাক্যদের ঋষি) বলা হয়, রুমিন্দেই (আধুনিক নেপালে লুম্বিনী)-এ অশোকের স্তম্ভে লিপিগ্রাফিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্তম্ভের ব্রাহ্মী লিপির শিলালিপি প্রমাণ দেয় যে মৌর্য সাম্রাজ্যের অশোক খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে এই স্থানটি পরিদর্শন করেন এবং এটিকে বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন (Paranavitana, S. (Apr. – Jun. 1962). Rummindei Pillar Inscription of Asoka, Journal of the American Oriental Society, 82 (2), 163–167)
শাক্য বংশ, প্রাচীনকালের একটি গোত্র। সূর্যবংশীয় রাজা ইক্ষ্বাকুর বংশধরেরা শাক্য বংশের প্রবর্তন করেন [মহামানব বুদ্ধ, অধ্যাপক রনধীর বড়ুয়া। প্রকাশক: Buddhist Reseacrch And Publication Center- Bangladesh; প্রকাশকাল: ২৫০১ বুদ্ধাব্দ/১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ।]
pdf Great Disciples of the Buddha: Their Lives, Their Works, Their Legacy
সূর্যবংশীয় রাজা ইক্ষাকুর বংশধরেরা শাক্য বংশের প্রবর্তন করেন। শাক্য বংশীয় রাজা শুদ্ধোধন ও মায়াদেবীর সিদ্ধার্থ পরবর্তী জীবনে সিদ্ধি লাভ করে বুদ্ধ নামে পরিচিত হন। তার গোত্রীয় নাম ছিলো গৌতম। এই কারণে ইতিহাসে তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত ছিলেন। গৌতম ২৯ বছর বয়সে রোগ, জ্বরা, ব্যাধি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গৃহত্যাগ করেন যা মহাভিনিষ্ক্রমণ নামে পরিচিত। গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধম্মের স্রষ্টা এবং প্রবর্তক।
বৌদ্ধ পুরাণ হিন্দু পুরাণের সাথে সমাপতিত করা। উদাহরণস্বরূপ, অক্ষোভ্য উগ্র তান্ত্রিক রূপ লাভ করে যা হিন্দু দেবতা শিবের উগ্র রূপের স্মরণ করিয়ে দেয়; এই রূপে তিনি বৌদ্ধ নামে পরিচিত হন হেরুকা, হেভজরা বা সম্ভার। তিনি এই ছদ্মবেশে জাপানে ফুদৌ (অভেদযোগ্য) নামে পরিচিত। ভারতীয় দেবতা ভৈরব, একজন উগ্র ষাঁড়ের মাথাওয়ালা দেবতা, তান্ত্রিক বৌদ্ধরা বজ্রভৈরব হিসাবে গ্রহণ করেছিল। যমান্তক (মৃত্যুর হত্যাকারী) নামেও ডাকা হয় এবং মৃদু মঞ্জুশ্রীর উগ্র অভিব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত, তাকে আধা-বুদ্ধ পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
পৌরাণিক বীভস্য কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়াতে উৎপন্ন হওয়া এক বিচারধারা, চার্বাকদর্শন কাল ৩৫০০-৩০০০ বর্ষ পূর্ব। ২৬০০ বর্ষ মতান্তর ৩০০০ বর্ষ অধিক পূর্বে ক্রর কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ার কারনে জৈন মত এবং বৌদ্ধমতের প্রবর্তন হয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ