ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

03 March, 2025

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায়
ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

🍁 মেখলা 🍁

প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময় মেখলা কৌপীনাদি বস্ত্র দণ্ড আর কমণ্ডলু ধারণ করাতেন। মেখলা ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য দীক্ষার একটা চিহ্নরূপে গুরু দ্বারা দেওয়ার পরম্পরা চলে আসছিল। মহাভারত (বিশ্ব) যুদ্ধের পশ্চাৎ যখন গুরুকুল শিক্ষাপ্রণালী লুপ্ত হয়ে যায় তখন মেখলা ধারণ করার রীতি তো চলতে থাকে কিন্তু গুরুর স্থানে গৃহের মায়েরা এই কাজ নিজের মাথায় নিয়ে নেন আর আজ পর্যন্ত মায়েরাই এটা বেঁধে এই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতিকে চালিয়ে আসছেন।
.
এখন এর গুরুত্বকে প্রায় সবাই ভুলে গেছে। গুরুকুলেও এটা বাঁধা অনিবার্য ধরা হয় না। এই কল্যাণকারী ঋষিদের প্রিয় মেখলা, যা কিনা ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মচর্যের প্রাণের সমান রক্ষক, তার উপর ধ্যান দেওয়া হয় না। কোনো-কোনো বেদভক্ত অনুভবী আচার্য তাঁর ব্রহ্মচারীদের মেখলা বেঁধে জনতার ধ্যান সেদিকে নিয়ে যান। বেদের কোনো বিদ্বান মেখলাসূক্তের উপর লিখে তার গুরুত্ব সম্বন্ধে সঠিকভাবে প্রকাশ ফেলেনি।
.
মহর্ষি দয়ানন্দ জী সংস্কারবিধিতে এটা বাঁধার জন্য বল দিয়েছেন আর এটা সর্বদা ধারণ করার জন্য ব্রহ্মচারীর নিত্যধর্ম কর্তব্য বলেছেন। শ্রদ্ধাবশত নিজের বুদ্ধি তথা অনুভবের আধারে জনকল্যাণের ভাবনা মাথায় রেখে মেখলাসূক্তের উপর কিছু লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা পড়ুন আর মেখলা-ধারণ করার লাভ নিন।
✍️ ওমানন্দ সরস্বতী
.
🍁 ব্রহ্মচারীর তিনটা ধার্মিক চিহ্ন 🍁
ব্রহ্মচারী তিনটা ধার্মিক চিহ্ন ধারণ করে, যথা - শিখা, য়জ্ঞোপবীত আর মেখলা।
.
(১) শিখা - যখন শিশু এক থেকে তিন বছরের হয় সেই সময় তার মুণ্ডন বা চূড়াকর্ম সংস্কার করা হয়। এতে শিশুর মস্তকের সব কেশ কেটে ফেলা হয় তবে কেবল শিখা রেখে দেওয়া হয়। সেইরূপ দ্বিতীয় বার কেশ মুণ্ডনের সময় শিখা রেখে দেওয়াকে ভালো ভাবা হয়।
.
(২) সূত্র বা য়জ্ঞোপবীত - এটা হল বিদ্যার চিহ্ন, ব্রহ্মচারী এটা উপনয়ন সংস্কারের সময় ধারণ করে। বাড়িতে মাতা-পিতা তথা গুরুকুলে আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করে সূত্র বা পৈতা ধারণ করিয়ে দেন। বেদের মধ্যে আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে -
আচার্য় উপনয়মানো ব্রহ্মচারিণম্ কৃণুতে গর্ভমন্তঃ ।
তম্ রাত্রিস্তিস্র উদরে বিভর্তি তম্ জাতম্ দ্রষ্টুমভিসম্য়ন্তি দেবাঃ ।। (অথর্বঃ ১১/৭/৩)
.
আচার্য ব্রহ্মচারীকে য়জ্ঞোপবীত (পৈতা) ধারণ করিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন, তিনি এমন নিকটে নিয়ে আসে যেন তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করেন, তার মাতার সমান ধারণ-পোষণ করেন। আচার্যের ছত্র-ছায়াতে থেকে তার বিদ্যার দ্বিতীয় জন্ম হয়, যার দ্বারা সে দ্বিজ বলে পরিচিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তার তিন প্রকারের অজ্ঞান অর্থাৎ আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আধিদৈবিক অজ্ঞান দূর না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আচার্য তাকে নিজের দেখাশোনাতে রাখবেন। একেই আচার্যের গর্ভের তিন রাত্রি বলা হয়। প্রকৃতি, জীবাত্মা আর পরমাত্মা সম্বন্ধীয় অজ্ঞানই হল সেই তিন অন্ধকারময় রাত্রি, এগুলো দূর করে আচার্য ব্রহ্মচারীকে দর্শনীয় বিদ্বান করে তোলেন, তখন সেই ব্রহ্মচারীকে সব দেব বিদ্বান ব্যক্তিরা আদর সম্মান করেন আর ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মসূত্র বা য়জ্ঞোপবীত ধারণ করা, আচার্যের নিকট আসা (উপনয়ন ধারণ করা) সার্থক হয়। সেই ব্রহ্মচারী জ্ঞানী-তেজস্বী-বিদ্বান হয়ে চতুর্থ প্রকাশময় অবস্থা অর্থাৎ দেবতাদের উঁচু স্থানকে প্রাপ্ত করে। য়জ্ঞোপবীত ধারণ করার সময় ৫ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত আয়ু ধরা হয়। ব্রহ্মচারীর এই দ্বিতীয় ধার্মিক চিহ্নকে য়জ্ঞোপবীত, পৈতা বা উপনয়ন বলে। বিদ্যা পড়তে সক্ষম সকল বালক-বালিকারা এটা ধারণ করতে পারে।
.
(৩) মেখলা - এটা হল ব্রহ্মচারীর তৃতীয় ধার্মিক চিহ্ন, একে তাগড়িও বলে। এটা ধারণ করার সময়ও সাধারনত ৫ থেকে ১২ বছরের আয়ু হয় আর বেদারম্ভ সংস্কারের সময়ই বিদ্বান আচার্য ব্রহ্মচারীকে মেখলা ধারণ করিয়ে দেন। আজকাল বাড়িতে মায়েরাই বালকের মেখলা বা তাগড়ি বেঁধে দেন। আগে মেয়েরাও মেখলা তথা য়জ্ঞোপবীত ধারণ করতো। এখন কেবল ছেলেরাই মেখলা এবং য়জ্ঞোপবীত পরে। মেয়েরা পরে না তবে বিবাহ হলে আভূষণ রূপে রুপোর তাগড়ি বা মেখলা পরে। পুরোনো মূর্তিতে দেখলে এটাই প্রমাণিত হয় যে আগেকার দিনে স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই মেখলা তথা য়জ্ঞোপবীত ধারণ করতো। দেবসংজ্ঞক বিদ্বানই ব্রহ্মচারীকে মেখলা প্রদান করতেন। বেদের মধ্যে মেখলাসূক্তের উপর সুন্দরভাবে প্রকাশ ফেলা হয়েছে। এই সূক্তের মধ্যে পাঁচটা মন্ত্র আছে, তার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হল।
.
🌿 মেখলাসূক্ত -
য় ইমাম্ দেবো মেখলামাববন্ধ য়ঃ সন্ননাহ য় উ নো য়ুয়োজ। য়স্য দেবস্য প্রশিষা চরামঃ স পারমিচ্ছাৎ স উ নো বিমুঞ্চাৎ।। (অথর্বঃ ৬/১৩৩/১)
.
অর্থ - (য়ঃ দেবঃ) দেবসংজ্ঞক যে বিদ্বান, আচার্য, গুরু (নঃ) আমাদের (ইমাম্) এই (মেখলাম্) মেখলা (আববন্ধ) সঠিকভাবে বেঁধেছেন (য়ঃ সন্ননাহ) যিনি সাজিয়েছেন (উ) আর (য়ঃ য়ুয়োজ) যিনি সংযুক্ত করেছেন (য়স্য) যে (দেবস্য) বিদ্বান আচার্যের (প্রশিষা) উত্তম শাসন দ্বারা (চরামঃ) আমরা (ব্রহ্মচারী) বিচরণ বা যাপন করি (সঃ) তিনি (নঃ) আমাদের (পারম্) পার (ইচ্ছাৎ) করাবেন (সঃ উ) কষ্ট থেকে, দুঃখ থেকে, সর্বপ্রকারের বন্ধন থেকে তিনিই (বিমুঞ্চাৎ) মুক্ত করবেন, নিবৃত্ত করবেন।
.
মহর্ষি দয়ানন্দ জী হলেন এই যুগের আপ্ত পুরুষ। "আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ" (ন্যায়দর্শন ১১/৩) অর্থাৎ আপ্ত পুরুষের উপদেশ বা কথন সত্য হয়, সুতরাং সেটা শব্দ প্রমাণের শ্রেণীতে আসে, এইজন্য সেটা সবার মান্য হয়। মহর্ষি দয়ানন্দ জী সত্যার্থপ্রকাশের মধ্যে লিখেছেন - "বিদ্বাম্সো হি দেবাঃ" (শতপথব্রাহ্মণ ৩/৭/৩/১০) "যারা বিদ্বান ব্যক্তি তাদেরই দেব বলা হয়। যে ব্যক্তি সাঙ্গোপাঙ্গ চার বেদের জ্ঞানী, তাদের নাম ব্রহ্মা আর যারা তাদের থেকে কিছু ন্যুন হয়, তাদের নাম দেব বা বিদ্বান।"
.
🍁 বেদের মধ্যে দেব শব্দ 🍁
মহর্ষি দয়ানন্দ জী বলেছেন যে "বেদ হল সব সত্য বিদ্যার পুস্তক।" তিনি আরও বলেছেন যে "ব্রহ্মা থেকে জৈমিনি পর্যন্ত সব ঋষি-মহর্ষি এই সিদ্ধান্তই মেনে আসছেন।" অন্যদিকে মহর্ষি মনু মহারাজ বলেছেন - "ধর্মম্ জিজ্ঞাসমানানাম্ প্রমাণম্ পরমম্ শ্রুতিঃ" অর্থাৎ ধর্মকে যথাযথ ভাবে জানতে বেদকেই পরম প্রমাণ মানা হয়েছে।
.
বেদের মধ্যে দেব শব্দের ব্যবহার বহু স্থানে আছে। দেব শব্দ "দিবু" ধাতু দিয়ে তৈরি আর এর বারোটা অর্থ আছে। খেলা জেতার ইচ্ছা, ব্যবহার (আদান-প্রদান), প্রকাশ, প্রশংসা, আনন্দ, অহংকার, নিদ্রা, শোভা, গতি (জ্ঞান, গমন, প্রাপ্তি) আদি। দেবতাদের দেব সবথেকে বড় বিদ্বান হওয়ার কারণে পরমাত্মাকেও দেব বলা হয়।
.
(১) এই সংসার পরমাত্মা আর বিদ্বান উভয়ের জন্য ক্রীড়াক্ষেত্র। পরমাত্মা হলেন সংসারের কর্তা-ধর্তা আর হর্ত্তা, তিনি সৃষ্টির রচনা করেন, সব প্রাণীর পালন-পোষণ করেন আর সব জীবের কর্মের যথাযোগ্য ফল দিয়ে সুখী বা দুঃখী রাখেন, এটাই হল প্রভুর খেলা। বিদ্বান ব্যক্তিও বিদ্যার দ্বারা তার ক্রিয়া করেন, অবিদ্যার নাশ করে প্রাণীদের অনেক ধরণের সুখ প্রদান করেন। দেবকোটির বিদ্বান ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে চলে নিজের খেলা খেলেন। বিদ্বান ব্যক্তি নিজে খুব আনন্দ নেন তথা বিদ্যার দ্বারা অন্য প্রাণীদেরও সুখ প্রদান করেন। কিন্তু মুর্খ বা অবিদ্বান ব্যক্তি তার মূর্খতা দিয়ে এমন খেলা খেলে যে অনেক দুঃখ আর বন্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
.
(২) বিদ্বান ব্যক্তির সব কাজে সফল হয়, বিজয় তার পদ চুম্বন করে। মুর্খ ব্যক্তির পদে-পদে পরাজয় হয়।
.
(৩) দেব পুরুষ ব্যবহারকুশল হয় আর মুর্খ তার বিপরীত ব্যবহারশূন্য হয়।
.
(৪) দেব পুরুষ জ্ঞানী হন তথা অন্যকে জ্ঞান দান করেন। জ্ঞানের প্রকাশ তাকে অনেক দিব্যগুণে পরিপূর্ণ করে তোলে। এইভাবে তিনি সংসারের পথপ্রদর্শক বা গুরু হয়ে যান।
.
(৫) অনেক বিদ্যার্থী দিব্যগুণের কারণে তাদের স্তুতি বা প্রশংসা করে কারণ সেই দেব পুরুষরা পরোপকার কর্মেই লেগে থাকেন।
.
(৬) দেব পুরুষদের স্বপ্ন সদা সংসারকে স্বর্গ করে তোলার হয়। তারা শরীর আর মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখার জন্য উচিত মাত্রায় আহার-নিদ্রার সেবন করেন।
.
(৭) পরমাত্মার আজ্ঞানুসারে আচরণ করার জন্য দেব পুরুষরা সর্বদা মুদিত অর্থাৎ প্রসন্নচিত্ত আনন্দে থাকেন।
.
(৮) দেবতাদের মধ্যে স্বাত্মাভিমান থাকে কিন্তু মিথ্যা অভিমান অহংকার থাকে না।
.
(৯) নিজের দিব্যগুণের কারণে তাদের মধ্যে বিশেষ কান্তি বা কমনীয়তা থাকে।
.
(১০) সব বিদ্যার দ্বারা দেবসংজ্ঞক বিদ্বান সংসারের মধ্যে অবিদ্যার নাশ করে বিদ্যার প্রকাশ ছড়িয়ে দেন।
.
(১১) দেব পুরুষ সর্বদা শুভ কর্ম করার জন্য পুরুষার্থ করেন, তৎপর থাকেন আর মুর্খ প্রমাদি অলস ব্যক্তিরা অধর্ম পাপ কর্ম করতে নিজের কর্তব্যের পূর্তি মনে করে।
.
(১২) দেব পুরুষ তার জীবনে পৃথিবী থেকে পরমেশ্বর পর্যন্ত জ্ঞান প্রাপ্ত করে তথা অন্য ব্যক্তিকে করান। তারা স্বয়ং জীবন মুক্ত হন আর অন্য ব্যক্তিকেও জীবনের চরম লক্ষ্য মোক্ষের দিকে প্রবৃত্ত করান। এই অর্থ বিদ্বান আর পরমাত্মা উভয়ের মধ্যে ঘটে এইজন্য উভয়কে দেব বলা হয়।
.
বেদের ব্যাকরণ নিরুক্তে মহর্ষি য়াস্ক দেব শব্দের অর্থ নিম্ন প্রকারে করেছেন -
দেবো দানাদ্বা দীপনাদ্বা দ্যোতনাদ্বা দ্যুস্থানো ভবতীতি বা।।
(নিরুক্ত ৭/৪/১৫)
দান দেওয়ার জন্য দেব নাম হয়, যে ব্যক্তি নিজের বিদ্যাদি সব পদার্থকে সংসারের হিতার্থে দেয়, সেই বিদ্বান ব্যক্তি দেব নামে সংসারে প্রসিদ্ধ হয়। বিদ্যার প্রকাশ করার জন্য দীপন, সত্যোপদেশ দেওয়ার জন্য দ্যোতন, বিদ্বানকে দেব বলা হয়। সব মূর্তিমান দ্রব্যকে প্রকাশিত করার জন্য সূর্যাদিলোককেও দেব বলা হয়, তবে সেটা জড়। চেতন দেব হল মাতা, পিতা, আচার্য আর অতিথি, বিদ্বান সন্ন্যাসী, তারা পালন, বিদ্যা আর সত্য উপদেশ করার জন্য তাদের দেব বলা হয়। এইসব দেবের দেব আদি গুরু ঈশ্বরকে তাঁর উপরোক্ত গুণের কারণে সবথেকে বড় দেব মহাদেব বলা হয়।
.
🍁 দেবের দ্বারা মেখলা বন্ধন 🍁
এই মন্ত্রের মধ্যে দেব শব্দের ব্যবহার বিদ্বান-আচার্য-গুরুর জন্য হয়েছে, তাঁরাই ব্রহ্মচারীদের মেখলা বাঁধিয়ে দেন। কারণ মেখলার সমান পবিত্র চিহ্নের দ্বারা ব্রতের মধ্যে বাঁধার অধিকার কেবল বেদ ভগবান্ দেবসংজ্ঞক আচার্যকেই দিয়েছেন। কারণ "সদা দেবা অরেপসঃ" অর্থাৎ দেবসংজ্ঞক নিষ্কাম জ্ঞানী বিদ্বান আচার্য সর্বদা নির্দোষ আর নিষ্পাপ হন, কারণ তাঁরা পবিত্র বেদের জ্ঞানের গঙ্গা প্রবাহিত করে সারা সংসারের পাপ তথা দোষকে ধুয়ে ফেলে সবাইকে জ্ঞানামৃত পান করিয়ে নিষ্পাপ করে তাদের ধারণ-পোষণ করেন।
.
এই দেব পুরুষরা স্বয়ং পরিশ্রমী হন আর "ন ঋতে শ্রান্তস্য সখ্যায় দেবাঃ" অর্থাৎ বিনা পরিশ্রমে দেব কারও মিত্র বা সখা হয় না, তাঁরা পুরুষার্থীদেরই সাথী হন। কারণ দেবতাদের মিত্রতার লাভ পরিশ্রম দ্বারা ক্লান্ত হওয়া মানবরাই প্রাপ্ত করে। দেবতাদের দেব ভগবান্ স্বয়ং "ইন্দ্র ইচ্চরতঃ সখা" অর্থাৎ পুরুষার্থীরই সখা সহায়ক হয় আর দেবসংজ্ঞক বিদ্বান "প্রশিষম্ য়স্য দেবাঃ" পরমদেব ভগবানের প্রত্যক্ষ সত্যস্বরূপ শাসন ন্যায় আর তার একমাত্র আজ্ঞাকেই মেনে চলেন। এইজন্য তাঁরাও ঈশ্বরের সমান পুরুষার্থী, বিদ্যার্থীদের প্রতি বিশেষ স্নেহ রাখেন। তাই নীতিকারগণ এই সত্যকে এইভাবে প্রকট করেছেন -
সুখার্থী চেত্ত্যজেদ্ বিদ্যাম্ বিদ্যার্থী চেত্ত্যজেদ্ সুখম্।
সুখার্থিনঃ কুতো বিদ্যা নাস্তি বিদ্যার্থিনঃ সুখম্।।
(চাণক্যনীতিশাস্ত্র ১/৩)
.
প্রাচীনকালে বিদ্যালয়গুলোতে এই ধরণের শ্লোক দ্বারের উপর লাগানো থাকতো। যার অর্থ হল - সুখ যে চায় তার বিদ্যা কোথায় আর বিদ্যা যে চায় তার সুখ কোথায়? এইজন্য যে সুখ চায় সে বিদ্যা ছেড়ে দিবে আর বিদ্যার্থী সুখ ছেড়ে দিবে। এখানে সুখের অর্থ হল সাংসারিক ভোগ-বিলাস, যার পরিণাম বিষের তুল্য হয়।
.
সাংসারিক বিষয়ভোগের মিথ্যা ক্ষণিক সুখ থেকে দেব পুরুষরা সর্বদা নিজেকে দূরে রাখেন তথা শিষ্য ব্রহ্মচারীকেও দূরে রাখেন। কিন্তু দেব-বিদ্বান-আচার্যই আনন্দকন্দ ভগবানের আনন্দময়ী কোলে বসার অধিকার প্রাপ্ত করেন আর মোক্ষরূপী আনন্দামৃত পান করার সৌভাগ্য দেব পুরুষরাই প্রাপ্ত করেন। "য়ত্র দেবা অমৃতমানশানাস্তৃতীয়ে ধামন্নধ্যৈরয়ন্ত" অর্থাৎ যে সাংসারিক সুখ দুঃখ থেকে রহিত নিত্যানন্দযুক্ত মোক্ষরূপ ধারণকারী পরমাত্মার মধ্যে মোক্ষরূপ আনন্দামৃতকে প্রাপ্ত করে দেবসংজ্ঞক বিদ্বান পুরুষ স্বেচ্ছাপূর্বক নিজের অধিকার জেনে জীবনযাপন করেন, কারণ সেটা প্রাপ্তির জন্য সংযম, ব্রহ্মচর্যব্রতের সেবন দেব হওয়ার জন্য করেন। ব্রহ্মচর্যরূপী তপের মাধ্যমেই তারা দেব-বিদ্বান-আচার্যপদ "আচার্য়ো ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচারী প্রজাপতিঃ" -কে প্রাপ্ত করেন। সত্য ব্রহ্মচারীই আসলে আচার্য হয় আর সে নিজের শিষ্য ব্রহ্মচারীকে নিজের সন্তান মেনে নিয়ে তাদের পালন-পোষণ করে, এইজন্য আচার্যকে প্রজাপতিও বলা হয়। ব্রহ্মচারীই "আচার্য়ো ব্রহ্মচর্য়েণ ব্রহ্মচারিণমিচ্ছতে" নিজের শিষ্যকে ব্রহ্মচারী করতে পারে, কেবল শব্দের উপদেশের কিছু প্রভাব পড়ে নয়, প্রভাব তো আচরণের পড়ে, এইজন্য "আচারম্ গ্রাহয়তি ইতি আচার্য়ঃ" স্বভাবের শিক্ষা নিজের উচ্চ আচরণের শিক্ষা দিয়ে বিদ্যার্থীকে আচারবান্ করে তোলার জন্য আচার্য সংজ্ঞাকে প্রাপ্ত করে। আচার্য তো যথানাম তথা গুণের হয়। আর এই দেব পুরুষ ব্রহ্মচর্য থেকে দেব হয়ে মহাদেব প্রভুকে প্রাপ্ত করেন।
.
"য়দিছন্তো ব্রহ্মচর্য়ম্ চরন্তি" সেই পরমাত্মাকে প্রাপ্তির ইচ্ছায় বিদ্বান ব্যক্তিরা ব্রহ্মচর্যের সাধনা বা পালন করেন, কারণ "তেষামেষ ব্রহ্মলোকো য়েষাম্ তপো ব্রহ্মচর্য়ম্" ব্রহ্মলোক হল তাদের যারা ব্রহ্মচর্য পালনার্থ তপস্যা করে, অর্থাৎ তপস্বী ব্রহ্মচারী তপ করে দেব হয়ে প্রভুকে প্রাপ্ত করে। কারণ দেবের দেব পরমাত্মা হচ্ছেন স্বয়ং ব্রহ্মচারী আর সেই ব্রহ্মচারী নিষ্কাম দেব বিদ্বানদেরই "তচ্চক্ষুর্দেবহিতম্" হিতৈষী, হিত সাধক। এইজন্য নিজের হিতৈষী পূর্ণ ব্রহ্মচারী প্রভুর প্রশাসন "প্রশিষম্ য়স্য দেবাঃ" আজ্ঞাতে দেব পুরুষরা চলেন আর তাঁর ছত্র-ছায়া বা আশ্রয়কে "য়স্যচ্ছায়ামৃতম্" অমৃতের তুল্য মানেন আর "ব্রহ্মচর্য়েণ তপসা দেবা মৃত্যুমপাঘ্নত" (অথর্ববেদ) এই নিষ্কাম জ্ঞানী দেব পুরুষই ব্রহ্মচর্যরূপী তপ দ্বারা মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে দেন, মৃত্যুর উপর বিজয় প্রাপ্ত করেন।
.
এমন দেব-বিদ্বান-আচার্য যিনি নিজেকে ব্রহ্মচর্যরূপী তপস্যার আগুনে খুব তপ্ত হয়েছেন, নিজের ব্রহ্মচারীদের তিনি মেখলার ব্রতবন্ধন ঠিকভাবে বেঁধে দেন। তিনি সেটা এমন ভাবে বাঁধেন যে সেটা সেই ব্রহ্মচারীদের জন্য বন্ধন থাকে না কিন্তু সেটা আভূষণের রূপ ধারণ করে নেয়, সেই মেখলা সেই ব্রহ্মচারীদের সাজিয়ে তোলে আর তারা সেটা দিয়ে সেজে ওঠে। এইজন্য ব্রহ্মচারী মজা করে বলে যে এই মেখলা আমাদের আচার্য আমাদের (আববন্ধ) ঠিকভাবে বেঁধেছেন। শুধু তাই নয়, (য়ঃ সম্ননাহ) সেই দেব সুন্দর আভূষণের সমান এই মেখলাকে সাজিয়েছেন আর এই মেখলা আমাদের সঙ্গে (য়ঃ য়ুয়োজ) যিনি সংযুক্ত করেছেন অর্থাৎ এই মেখলার সঙ্গে সর্বদার জন্য আমাদের দৃঢ় সম্বন্ধ জুড়ে দিয়েছেন। আমরা সব ব্রহ্মচারী এর সঙ্গে জুড়ে গেছি, এখন আমরা এই বন্ধনকে বন্ধন নয় কিন্তু আভূষণ মনে করছি কারণ এর দ্বারা আমরা মহান ব্রত, ব্রহ্মচর্যব্রতের সাধনায় সফলতা প্রাপ্ত করবো, যার দ্বারা আমরা আমাদের বিদ্বান গুরু নিষ্কামদেবের আজ্ঞাতে থেকে বা চলে এই ভবসাগর থেকে পার হয়ে যাবো। আমাদের দেব গুরু এই মেখলা আমাদের সংসারের বন্ধন থেকে, দুঃখ থেকে, কষ্ট থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বেঁধেছেন। মেখলার এই বন্ধন অন্য সব বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে আমাদের পার করিয়ে দিবে। এইজন্য আমাদের দেব গুরুর এই বন্ধনকে আমরা সব ব্রহ্মচারী আভূষণ মনে করি কারণ এর দ্বারাই ব্রহ্মচর্যামৃতকে পান করে আমরা দেব হবো, মৃত্যুকে জিতবো আর অমরপদকে প্রাপ্ত করবো। পুনরায় এমন দেবের সুন্দর বন্ধনকে-মেখলাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আভূষণ কেন বলবো না? কারণ এই নৌকা দিয়ে আমাদের সবাইকে সব দুঃখ থেকে আচার্যদেব বাঁচিয়ে ভবসাগর থেকে পার করাবেন।
.
এই মন্ত্রের সার তো এটাই যে ব্রহ্মচারী হর্ষোল্লসিত হয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক গর্ভপূর্ণ ভাষায় বলছে, তাদের বাণীই নয় হৃদয়স্থিত আত্মা বলছে, আমাদের পূজনীয় গুরু দেবতাস্বরূপ আচার্য আমাদের সবাইকে এই মেখলা খুব ভালো করে বেঁধেছেন, বাঁধা নয় যেন আভূষণের রূপে সাজিয়েছেন, এটা আমাদের এত প্রিয় লাগে যে এরদ্বারা সর্বদার জন্য আমরা সংযুক্ত হয়ে গেছি, সম্বন্ধীয় হয়ে গেছি। মেখলার বন্ধন আমাদের জন্য বন্ধন নয়, আভূষণ, কারণ এই সম্বন্ধ আমাদের পরমহিতৈষী বিদ্যা আর আচারের শিক্ষক আচার্য এই মেখলা দিয়ে করিয়েছেন, তাই এই সম্বন্ধ অটুট। আমরা একে কিভাবে ছাড়তে পারি। এটা আমাদের সব প্রকারের বন্ধনকে, দুঃখকে দূর করার জন্য, সফল জীবন করার জন্য আর জীবনের চরমলক্ষ্য মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য তথা এই ভবসাগর থেকে পার হয়ে পরমধামে পৌঁছানোর জন্য বিধিপূর্বক দেওয়া মেখলা হল আমাদের জন্য আচার্যপ্রবরের, দেবতাদের বরদান। আমরা ব্রহ্মচারীরা তো আচার্যের অধীনে থেকে "আচার্য়াধীনো বেদমধীষ্ব" নিত্য সাঙ্গোপাঙ্ক বেদ পড়ার ব্রত নিয়েছি, "আচার্য়াধীনো ভবান্যত্রাধর্মাচরণাৎ" আমরা সর্বথা সর্বদার জন্য আচার্যের অধীনে থেকে তাঁর আজ্ঞানুসারে চলার ব্রত নিয়েছি কারণ তিনি হলেন ধর্মাত্মা, আচারের ধনী, আচারের সাক্ষাৎ আদর্শ মূর্তি, তিনি আমাদের অধর্ম করার উপদেশ তো স্বপ্নেও কখনও দিবেন না। মেখলা ধারণ করাকে তিনি আমাদের নিত্যধর্ম বলেছেন। তাহলে এই পবিত্র কল্যাণকারী মেখলা যেটা আমাদের ব্রহ্মচর্যব্রতের সাধিকা, তাকে আমরা কিভাবে ত্যাগ করতে পারি। আমাদের কটিতে মেখলা বেঁধে, সাজিয়ে তো আমাদের ব্রহ্মচর্যপালনের দীক্ষা দিয়ে সন্নদ্ধ করে দিয়েছেন, সজ্জিত করে দিয়েছেন। "ব্রহ্মচারী অসি অসৌ" আজ থেকে তুমি ব্রহ্মচারী, এই শব্দ আমাদের জন্য আচার্যদেব বলেছেন। আমরা কি একে নিজের আচরণে সত্য সিদ্ধ করে দেখাবো না? অবশ্যমেব।
(ক্রমশঃ)

প্রস্তুতকরণে- আশীষ আর্য

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

ব্রহ্মচর্য ও য়জ্ঞোপবীত

একাদশ অধ্যায় মেখলা প্রাচীনকালে গুরুকুলগুলোতে বেদের বিদ্বান বেদসংজ্ঞক আচার্য য়জ্ঞোপবীত সংস্কার করাতেন আর তারপর তারা বেদারম্ভসংস্কারের সময়...

Post Top Ad

ধন্যবাদ