এক অদ্ভুত ও বিষ্ময়কর মহাবিশ্বে আমাদের বাস। এর বয়স, আকার, উন্মত্ততা এবং সৌন্দর্যের গভীরে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন অসম্ভব রকম কল্পনা শক্তি। এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের মতো মানুষের অবস্থান নগণ্য মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ জন্যেই আমরা এর সবকিছু জানতে চাই, দেখতে চাই এতে আমাদের অবস্থান কোথায়। কয়েক দশক আগে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী (কারো কারো মতে তিনি ছিলেন বারট্রান্ড রাসেল) জ্যোতির্বিদ্যার ওপরে একটি লেকচার দেন। তিনি এতে বলেন, পৃথিবী কীভাবে সূর্যের চারদিকে ঘুরেছে, সূর্য নিজেই কীভাবে আবার অনেক নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ইত্যাদি।
বক্তব্য শেষ হবার পর হলের পেছন থেকে এক বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি আমাদের যা বললেন, তার সব বানানো কথা। আসলে পৃথিবী হল থালার মতো চ্যাপ্টা, আর এটি বসে আছে একটি দৈত্যাকার কাছিমের পিঠে।’
বিজ্ঞানীর জ্ঞানগর্ভ ও হাসিমাখা প্রশ্ন, ‘কাছিমটি তাহলে কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে?’
মহিলা জবাব দিলেন, ‘ইয়াং ম্যান, আপনি খুবই চালাক, তবু নিচে কিন্তু আসলে একেরপর এক কাছিমই আছে!’
কাছিমের উপর স্থাপিত মহাবিশ্বের চিত্রটি এখন অনেকের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু আমরা খুব ভালো জানি- এমনটা মনে করা ঠিক হবে কি? বিশ্ব সম্পর্কে আপনি যা জানেন – অথবা জানেন বলে মনে করেন তা একটিবারের জন্যে একটু ভুলে যান। এবার তাকিয়ে দেখুন রাতের আকাশের দিকে। ঐসব আলোক বিন্দুকে আপনার কী মনে হচ্ছে? এরা কি ছোট ছোট আগুনের স্ফুলিঙ্গ? এদের সম্পর্কে সত্যিকারের ধারণা করা কঠিন, কেননা এদের প্রকৃত পরিচয়ের সাথে আমাদের দৈনন্দিন কাজ- কর্মের কোনোই মিল নেই। নিয়মিত রাতের আকাশের খোঁজখবর রেখে থাকলে আপনি গোধূলির সময় একটি ক্ষণস্থায়ী আলোকে দিগন্তের উপর ভেসে থাকতে দেখে থাকবেন। এটা আসলে বুধ গ্রহ। কিন্তু এর সাথে আমাদের গ্রহের (পৃথিবী) কোনোই মিল নেই। বুধ গ্রহের এক দিন তার এক বছরের তিন ভাগের দুই ভাগের সমান। দিনের বেলায় সূর্যের উপস্থিতিতে এর তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে, যা রাতের বেলায় নেমে আসে হিমাংকের ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। তবে বুধ গ্রহ আমাদের গ্রহের চেয়ে আলাদা- এটা বুঝুতে পারার চেয়ে নক্ষত্র যে আলাদা সেটা বোঝা তুলনামূলক সহজ। এক একটি নক্ষত্র এক একটি বিশাল চুল্লি, যা প্রতি সেকেন্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড পদার্থ পুড়িয়ে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত উন্নীত করে।
গ্রহ এবং নক্ষত্রদের প্রকৃত দূরত্ব কল্পনা করাও বেশ কঠিন কাজ। প্রাচীনকালে চীন দেশের মানুষ ভালো করে তারা দেখার জন্য পাথর দিয়ে টাওয়ার বানাত। গ্রহ এবং নক্ষত্রদেরকে এদের প্রকৃত দূরত্বের চেয়ে কাছে মনে করা খুব স্বাভাবিক। অন্তত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা মহাকাশের বিশাল বড়ো দূরত্বের সাথে পরিচিত নই। এই দূরত্বগুলো এত বেশি বড়ো যে এদেরকে আমাদের বহুল পরিচিত ফুট বা মাইল দিয়ে হিসাব করা অর্থহীন। এর পরিবর্তে আমারা ব্যবহার করি আলোকবর্ষ নামক একটি একক, যা আলোর এক বছরে অতিক্রান্ত দূরত্বের সমান। এক সেকেন্ডে একটি আলোকরশ্মি ১, ৮৬, ০০০ মাইল যেতে পারে। অতএব, আলোকবর্ষ এককটি অনেক বড়ো একটি দূরত্ব। সূর্যের পরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্র হল প্রক্সিমা সেন্টোরি (অপর নাম আলফা সেন্টোরি সি)। এটি প্রায় ৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটি এত বড়ো যে বর্তমান সময়ে আমাদের কল্পনাযোগ্য সবেচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযানে চেপে ওখানে যেতে প্রায় ১০ হাজার বছর সময় লাগবে।
প্রাচীন কালেও মানুষ মহাবিশ্বকে বুঝতে অক্লান্ত চেষ্টা করেছে। কিন্তু তখনো এ সময়ের মতো গণিত ও বিজ্ঞানের এমন অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে আমাদের কাছে আছে উন্নত যন্ত্র- যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে গণিত ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতে রয়েছে কম্পিউটার ও টেলিস্কোপের মতো যন্ত্র। যন্ত্রগুলোর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের অনেকগুলো তথ্যকে জোড়া দিতে পেরেছেন। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা ঠিক কী জানি এবং তা কীভাবে জানি? মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে হল? ভবিষ্যতে এর কী হতে যাচ্ছে? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল? যদি থেকেই থাকে তবে তার আগে কী ছিল? সময় আসলে ঠিক কী? এর কি কোন শেষ আছে? আমরা কি অতীতের দিকে যেতে পারি? পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতির মাধ্যমে দীর্ঘ দিন জমে থাকা এসব প্রশ্নের মধ্যে অনেকগুলোর জবাব হাতে এসেছে। এক সময় হয়ত এই প্রশ্নগুলোর জবাব পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘোরার মতোই পরিষ্কার হয়ে যাবে- অথবা হয়ত কচ্ছপের টাওয়ারের মত হাস্যকর মনে হবে। এর উত্তর কেবল সময়ই বলতে পারে, তা সময়ের পরিচয় যাই হোক।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ