সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব

 সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব

(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)*

সূচিপত্র

1) গীতায় সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব
2) মূলতত্ত্ব

প্রকৃতি
সাধনার উদ্দেশ্য

3) প্রকৃতি-পরিণাম বা সৃষ্টিক্রম

মহত্তত্ত্ব
অহঙ্কার

4) জীবের ক্রমবিকাশ (Evolution Theory)

4.1) পঞ্চ কোষ ও পঞ্চ পুরুষ
4.2) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যমতের তুলনা

5) জড় ও চেতনা

1) গীতায় সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব

বাইবেল-আদি ধর্মগ্রন্থে যেরূপ সৃষ্টি-বিবরণ আছে (something out of nothing), প্রাচ্যদর্শনে তাহা নহে । প্রাচ্যদর্শনের মুখ্য কথা – যাহা নাই তাহা হয় না; যাহা আছে তাহারও বিনাশ হয় না; পরিবর্তন হয় মাত্র(‘নাসৎ উৎপদ্যতে, ন সৎ বিনশ্যতি’ – সাংখ্যসূত্র) । একমাত্র ব্রহ্মই আছেন, তিনিই বহুরূপে আপনাকে বিকশিত করিলেন । আমাদের শাস্ত্রমতে সৃষ্টির অর্থ নূতন কিছুর উৎপত্তি (Creation) নহে, যাহা আছে তাহারই বহুরূপে ক্রমবিকাশ (Evolution) ।

[পরব্রহ্ম / পুরুষোত্তম] → [(চেতন) পুরুষ / পরা প্রকৃতি (১)] + [(জড়া) প্রকৃতি / অপরা প্রকৃতি (১)]

[(জড়া) প্রকৃতি / অপরা প্রকৃতি] → [মহত্তত্ত্ব / বুদ্ধিতত্ত্ব (১)] → [অহঙ্কার (১)]

(প্রকাশাত্মক) সত্ত্বগুণের প্রাবল্যে
[অহঙ্কার] → [জ্ঞানেন্দ্রিয় (৫) + কর্মেন্দ্রিয় (৫) + উভয়েন্দ্রিয় (১)]

(আবরণাত্মক) তমগুণের প্রাবল্যে
[অহঙ্কার] → [পঞ্চতন্মাত্র / পঞ্চ সূক্ষভূত (৫)] → [পঞ্চ স্থূলভূত (৫)]
(প্রকৃতির বিকার মহৎ তত্ত্ব, মহতের বিকার অহঙ্কার, অহঙ্কারের বিকার পঞ্চতন্মাত্র ও একাদশ ইন্দ্রিয়, পঞ্চতন্মাত্রের বিকার পঞ্চ মহাভূত – এই ২৪ তত্ত্ব + পুরুষ = ২৫ তত্ত্ব)

পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় = চক্ষু + কর্ণ + নাসিকা + জিহ্বা + ত্বক
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় = হস্ত + পদ + বাক্ + পায়ু + উপস্থ
উভয়েন্দ্রিয় = মন
(‘ইন্দ্রিয়’ বলিতে এস্থলে সূক্ষ ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়ের শক্তি বুঝিতে হইবে; কেননা হস্ত, পদ বা চক্ষুর্গোলকাদি বাহ্য যন্ত্র দেহের অংশ এবং স্থূলভূতের অন্তর্গত ।)
পঞ্চতন্মাত্র = শব্দ + স্পর্শ + রূপ + রস + গন্ধ
পঞ্চ স্থূলভূত = আকাশ + বায়ু + অগ্নি + অপ্ + পৃথিবী
(তন্মাত্র অর্থ ‘কেবল তাহাই’ অর্থাৎ স্থূলভূতের যাহা সার, যাহা সূক্ষ অবস্থা । যেমন আকাশকে সূক্ষ অবস্থায় পরিণত করিলে থাকে শব্দ ।)

(কাপিল)সাংখ্য দর্শন বলেন – সংসার দুঃখময়, জীব ত্রিবিধ তাপে তাপিত । এই ত্রিবিধ দুঃখ নিবৃত্তিই পরম পুরুষার্থ । এই দুঃখ নিবৃত্তির একমাত্র উপায় – জ্ঞান [‘জ্ঞানান্মুক্তিঃ’, সাংখ্যসূত্র ৩২|৩] । কিসের জ্ঞান ? – পঞ্চবিংশতি-তত্ত্বের জ্ঞান (knowledge of 25 cosmic principles), প্রকৃতি ও পুরুষের পার্থক্য জ্ঞান, অর্থাৎ এই সৃষ্টিপ্রপঞ্চ কি এবং উহার সহিত আত্মার কি সম্বন্ধ – এই জ্ঞান ।

২৫ তত্ত্ব = পুরুষ + প্রকৃতি + ২৩ বিকার = পুরুষ + ৮ প্রকৃতি + ১৬ বিকার

পুরুষ = অপ্রকৃতি-অবিকৃতি (স্বতন্ত্র, উদাসীন)

(মূল)প্রকৃতি = প্রধান = অব্যক্ত = ত্রৈগুণ্য = জগতের মূল উপাদান
৮ প্রকৃতি = মূল প্রকৃতি + ৭ প্রকৃতি-বিকৃতি
৭ প্রকৃতি-বিকৃতি = মহত্তত্ত্ব + অহঙ্কার + ৫ তন্মাত্র
(প্রকৃতি-বিকৃতি প্রত্যেকটি অন্য তত্ত্বের কারণ – অর্থাৎ প্রকৃতি; অথচ নিজে অন্য তত্ত্ব হইতে উদ্ভূত – অর্থাৎ বিকৃতি ।)

১৬ বিকার = ৫ জ্ঞানেন্দ্রিয় + ৫ কর্মেন্দ্রিয় + মন + ৫ স্থূলভূত
(১৬ বিকার/বিকৃতি হইতে অন্য কোন তত্ত্ব উদ্ভূত হয় নাই ।)

“সাংখ্য = গণনাকারী; কপিলশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব ২৫ হওয়াতেই ঐ ‘গণনাকারী’র অর্থে এই বিশিষ্ট ‘সাংখ্য’ নাম দেওয়া হইয়াছে; ব্যাপক অর্থে সমস্ত প্রকার তত্ত্বজ্ঞান ।” –  [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৫৪-১৫৫]

2) মূলতত্ত্ব

নিরীশ্বর সাংখ্যে (1)প্রকৃতি ও (2)পুরুষই মূলতত্ত্ব । তাই সাংখ্যদিগকে দ্বৈতবাদী বলা হইয়া থাকে । এই মতে প্রকৃতির স্বভাবই পরিণাম, এই জন্য উহাকে ‘প্রসবধর্মী’ বলে । উহা স্বয়ংই জগৎ সৃষ্টি করে, সৃষ্টির কারণান্তর নাই ।

কিন্তু সেশ্বর বেদান্তাদি শাস্ত্র মতে ঈশ্বরের অধিষ্ঠানই প্রকৃতির সৃষ্টিরূপে পরিণামের প্রকৃত কারণ । বেদান্তে ইহাকেই ‘ঈক্ষণ‘ বলে । গীতাতে ইহাকেই প্রকৃতিতে গর্ভাধান বলা হইয়াছে [১৪|৩] । গীতায় মূলতত্ত্ব সেই পরম পুরুষ, পুরুষোত্তম বা পরব্রহ্ম – পুরুষ ও প্রকৃতি তাঁহারই বিভাব; তাঁহারই ইচ্ছায় বা অধ্যক্ষতায় প্রকৃতি সৃষ্টি করে, প্রকৃতির স্বাতন্ত্র্য নাই । তাই গীতায় জড়া প্রকৃতিকে শ্রীভগবানের অপরা প্রকৃতি এবং চেতন পুরুষকে পরা প্রকৃতি বলা হইয়াছে [৭|৪,৫] । “ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, গীতা সাংখ্যশাস্ত্রকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন ।” – [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬৪]

প্রকৃতি – ইহা অনাদি, অন্তহীন, নিত্য, অসীম, অতি সূক্ষ্ম, অলিঙ্গ ও নিরবয়ব বা নির্বিশেষ । “বেদান্তশাস্ত্রে এই প্রকৃতিকেই মায়া অর্থাৎ মায়িক অবভাস বলা হইয়াছে । গুণত্রয়ীরূপী পদার্থভেদের বীজ প্রকৃতিতে আছে বলিয়া উহাকে বহুধানক বলে এবং প্রকৃতি হইতেই সমস্ত পদার্থ প্রসূত হয় বা উৎপন্ন হয় বলিয়া উহাকে প্রসবধর্মিনী বলে ।” – [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬২]

প্রলয়কালে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ সাম্যাবস্থায় থাকে – ইহাই অব্যক্ত অবস্থা (মূল প্রকৃতি বা ত্রৈগুণ্য) । এই অব্যক্তের পরিণাম জগতে সকল পদার্থই এই তিন গুণের ন্যূনাধিক্যে সৃষ্ট – ত্রিগুণ ব্যতীত পদার্থ নাই[গীতা ১৮|৪০] ।

সাধনার উদ্দেশ্য – শাস্ত্রে গুণভেদ অনুসারেই কর্ম-ভেদ ও উপাসনা-প্রণালীরও ভেদ নির্দিষ্ট হইয়াছে । প্রকৃতপক্ষে, সকল সাধনারই উদ্দেশ্য হইতেছে তমঃ ও রজোগুণকে অর্থাৎ অজ্ঞান ও কাম-ক্রোধাদিকে দমন করিয়া সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ সাধন করা এবং পরিণামে সত্ত্বগুণকেও অতিক্রম করিয়া ত্রিগুণাতীত হওয়া বা প্রকৃতির হস্ত হইতে মুক্ত হওয়া । সমগ্র হিন্দু দর্শন-শাস্ত্র, হিন্দু সমাজগঠন, বর্ণাশ্রমাদি ধর্ম ও বিবিধ সাধন-প্রণালী এই ত্রিগুণতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ।

3) প্রকৃতি-পরিণাম বা সৃষ্টিক্রম

“পুরুষ সচেতন ও জ্ঞাতা হইলেও, কেবল অর্থাৎ নির্গুণ হওয়া প্রযুক্ত, তাহার নিকট স্বতঃ কর্ম করিবার কোন সাধন নাই; এবং প্রকৃতি কর্মকর্তা হইলেও জড় বা অচেতন হওয়া প্রযুক্ত, সে জানে না যে কোন্‌ কাজ করিতে হইবে । এই কারণে অন্ধের কাঁধের উপর খঞ্জ বসিয়া অন্যোন্যসহায়তায় দুজনেই যেরূপ পথ চলিতে থাকে, সেইরূপই জড় প্রকৃতি ও সচেতন পুরুষের সংযোগ হইলে সৃষ্টির সকল কর্মের আরম্ভ হইয়া থাকে [সাং, কা, ২১]।” –  [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬৫]

সাংখ্যগণ বলিয়া থাকেন যে সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ সমস্ত পদার্থের মূলবস্তুরও অর্থাৎ প্রকৃতিতে প্রারম্ভ হইতেই আছে । অধিক কি এই তিন গুণকেই প্রকৃতি বলিলে অনুচিত হইবে না । এই তিন গুণের মধ্যে প্রত্যেকেরই বল আরম্ভে একইরূপ থাকায় প্রথম প্রথম এই প্রকৃতি সাম্যাবস্থায় থাকে । এই সাম্যাবস্থা জগতের আরম্ভে ছিল; এবং জগতের লয় হইলে পুনর্বার হইবে । সাম্যাবস্থাতে যাহা কিছু সমস্ত স্তব্ধ থাকে । –  [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৫৯]

সৃষ্টিকালে গুণত্রয়ের সাম্যভঙ্গ হয় এবং বিসদৃশ পরিণামাত্মক সৃষ্টি আরম্ভ হয় । কোথাও সত্ত্ব প্রবল হইয়া প্রকাশ, জ্ঞান, সুখ – এই সকল উৎপন্ন করে; কোথাও রজঃ প্রবল হইয়া চঞ্চলতা, প্রবৃত্তি, দুঃখ – এই সকল আনয়ন করে; কোথাও তমঃ প্রবল হইয়া মোহ, অজ্ঞান বা জড়তা উৎপাদন করে ।

মহত্তত্ত্ব – সৃষ্টির আরম্ভে প্রকৃতির সাম্যভঙ্গ হইলে তাহার প্রথম পরিণাম মহত্তত্ত্ব । আধুনিক সাংখ্যকারগণ উহাকেই বুদ্ধিতত্ত্ব বলেন ।

“মনুষ্যের যেরূপ কোন কার্য্য করিবার বুদ্ধি (সঙ্কল্প) প্রথমে হয় সেইরূপ, প্রকৃতিরও স্বকীয় বিস্তার করিবার বুদ্ধি প্রথমে হওয়া চাই । তাই প্রকৃতিতে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরূপ গুণ প্রথমে উৎপন্ন হয়, সাংখ্যেরা এইরূপ স্থির করিয়াছেন । মনুষ্য সচেতন হওয়া প্রযুক্ত, তাহার ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি মনুষ্য বুঝে; প্রকৃতি অচেতন বা জড় হওয়া প্রযুক্ত, নিজের বুদ্ধির তাহার কোন জ্ঞান থাকে না । মানবী ইচ্ছার অনুরূপ কিন্তু অস্বয়ংবেদ্যশক্তি জড় পদার্থেও আছে, … একথা অর্বাচীন (আধুনিক) আধিভৌতিক সৃষ্টিশাস্ত্রজ্ঞও (বৈজ্ঞানিকগণও) এক্ষণে বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন ।” – [বিশ্বের রচনা ও সংহার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৭৫]

“Without the assumption of an atomic soul the commonest and the most general phenomena of chemistry are inexplicable. Pleasure and pain, desire and aversion, attraction and repulsion must be common to all atoms of an aggregate; for the movements of the atoms which must take place in the formation and dissolution of a chemical compound can be explained only by attributing to them Sensation and Will.” -[Perigenesis der PlastiduleHaeckel quoted by Lokmanya Tilak in 9th chapter of Gitarahasya, pp.175]

“I explicitly stated that I conceive the elementary psychic qualities of sensation and will, which may be attributed to atoms, to be unconscious – just as unconscious as the elementary memory which I, in company with that distinguished physiologist, Ewald Hering, consider to be ‘a common function of all organized matter’ – or, more correctly, ‘living substances.’ – [The Riddle of the UniverseHaeckel quoted by Lokmanya Tilak in 9th chapter of Gitarahasya, pp.175]

“…Modern science itself has been driven to the same conclusion. Even in the mechanical action of the atom there is a power which can only be called an inconscient will and in all the works of nature the pervading will does inconsciently the works of intelligence. What we call mental intelligence is precisely the same thing in essence as that which discriminates and coordinates subconsciously in all the activities of the material universe.” – [Sankhya and Yoga, Essays on the GitaSri Aurobindopp.73]

“…বর্তমান বিজ্ঞানও এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে । এমন কি পরমাণুর জড়ক্রিয়াতে যে শক্তি রহিয়াছে তাহাকেও অচেতন ইচ্ছাশক্তি বলা যাইতে পারে এবং প্রাকৃতিক জগতের সমস্ত ঘটনায় ঐ সর্বব্যাপী ইচ্ছা অচেতনভাবেই বুদ্ধির কার্য করিতেছে । জড় জগতের সকল কার্য্যে যে ভেদাভেদ নির্ণয় অচেতন ভাবে চলিতেছে – সেই ক্রিয়া এবং যাহাকে আমরা মানসিক বুদ্ধির ক্রিয়া বলি তাহা মূলতঃ একই জিনিষ ।” – [সাংখ্য ও যোগ,শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ৯৮]

অহঙ্কার – মহত্তত্ত্বের পরিণাম অহঙ্কার – অন্য হইতে পৃথক্‌ থাকিবার ভাব-প্রবণতা বাঅভিমান । উহার প্রভাবেই একবস্তুপরতা ভাঙ্গিয়া বহুবস্তুপরতা উৎপন্ন হয় । সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ দ্বারা অহঙ্কার সেন্দ্রিয় পদার্থের (একাদশ ইন্দ্রিয়) সৃষ্টি করে । তমোগুণের উৎকর্ষ দ্বারা অহঙ্কার নিরিন্দ্রিয় পদার্থের (পঞ্চ তন্মাত্র বা পঞ্চ সূক্ষভূত) সৃষ্টি করে ।

পঞ্চতন্মাত্র হইতে পঞ্চীকরণে পঞ্চ স্থূলভূতের সৃষ্টি হয় ।

স্থূলভূতের পরিণামে স্থাবর-জঙ্গমাত্মক জগৎ সৃষ্টি ।

4) জীবের ক্রমবিকাশ (Evolution Theory)

ব্রহ্মের বিকাশ একবারেই হয় নাই, একবারেই এই বহু-বিচিত্র জীবজগতের উদ্ভব হয় নাই, ইহা ক্রমে-ক্রমে হইয়াছে । সৃষ্টির ক্রমবিকাশ-তত্ত্ব আমাদের সাংখ্য-বেদান্ত-পুরাণাদি-শাস্ত্রে নানাভাবে এবং অনেক স্থলে রূপকের ভাষায় বিবৃত হইয়াছে । বিকাশের ক্রম সম্বন্ধে একটি শ্রুতিবাক্য – ‘ব্রহ্ম তপঃশক্তি দ্বারা আপনাকে স্ফীত করিলেন, জড়ীভূত করিলেন, তাহাতে অন্নের (জড়ের) উদ্ভব হইল; অন্ন হইতে প্রাণের উদ্ভব হইল, প্রাণ হতে মনের উদ্ভব হইল এবং ক্রমে লোকসমূহের উদ্ভব হইল ।’ ‘By energism of consciousness, Brahman is massed; from that Matter is born and from Matter Life and Mind and the Worlds.’ [Translated by Sri Aurobindo]

4.1) পঞ্চ কোষ ও পঞ্চ পুরুষ (5 selves)

(1) নির্জীব পদার্থ – তমোগুণদ্বারা সত্ত্ব সম্পূর্ণ আবৃত থাকে, সুতরাং উহারা অচেতন ও অচঞ্চল, কিন্তু উহাদের ভিতরে রজোগুণের ক্রিয়াও চলিতে থাকে । (জীবাত্মা অর্থাৎ অন্নময় পুরুষ / Physical Self জড়দেহ অর্থাৎ অন্নময় কোষ ধারণ করেন)
(2a) বৃক্ষলতাদি – তমোগুণের প্রাধান্য, রজঃ ও সত্ত্ব স্বল্প পরিস্ফুট, উহাদেরও অনুভূতি ও চেতনা আছে । (জীবাত্মা অর্থাৎ প্রাণময় পুরুষ / Vital Self or Self of Life প্রাণময় কোষ ধারণ করেন)
(2b) ইতর জন্তু – তিন গুণই পরিস্ফুট, কিন্তু তমঃ ও রজোগুণের আধিক্যে সত্ত্বগুণ অভিভূত থাকে । (প্রাণময় পুরুষ প্রাণময় কোষ ধারণ করেন)
(3) মনুষ্য – তিন গুণই স্পষ্টরূপে পরিস্ফুট হইলেও বুদ্ধি, বিবেক, বিচারশক্তি আদি সত্ত্বগুণের লক্ষণ সকলের সমান থাকে না । (মনোময় পুরুষ / Mental Self or Self of Mind মনোময় কোষ ধারণ করেন)
(4) বিজ্ঞানময় পুরুষ (Self of Truth-knowledge) বিজ্ঞানময় কোষ ধারণ করেন
(5) আনন্দময় পুরুষ (Self of Bliss) আনন্দময় কোষ ধারণ করেন । এই অবস্থায় জীব ভগবানের মধ্যেই অবস্থিতি করেন ।

জীব, ক্রমবিকাশে মনুষ্যজন্ম লাভ করিলেই আত্মচেষ্টায় মোক্ষাধিকারী হয়, মনুষ্যত্বের পরবর্তী সোপানই ব্রহ্মত্ব, সুতরাং মনুষ্য-জন্ম দুর্লভ । বৃহৎ বিষ্ণুপুরাণে আছে, জীব কর্মফলে ৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমণের পর সুকৃতি থাকিলে মনুষ্য-জন্ম লাভ করে –

স্থাবরং বিংশতের্লক্ষং জলজং নবলক্ষকম্‌ ।
কূর্মাশ্চ নবলক্ষং চ দশলক্ষং চ পক্ষিণঃ ।।
ত্রিংশলক্ষং পশূনাঞ্চ চতুর্লক্ষং চ বানরাঃ ।

ততো মনুষ্যতাং প্রাপ্য ততঃ কর্মাণি সাধয়েৎ ।। – [বৃহৎ বিষ্ণুপুরাণ]

a) স্থাবর জন্মে ২০ লক্ষ
b) জলচর জন্মে ৯ লক্ষ
c) কূর্ম জন্মে ৯ লক্ষ
d) পক্ষী জন্মে ১০ লক্ষ
e) পশু জন্মে ৩০ লক্ষ
f) বানর জন্মে ৪ লক্ষ
g) মনুষ্য জন্ম
(মনুষ্য জন্মের অতীত ৮২ লক্ষ যোনির হিসাব পাওয়া গেল, বাকি ২ লক্ষ কই ?)

4.2) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যমতের তুলনা

প্রাচ্যমতে ও পাশ্চাত্যমতে উদ্বর্তনের (Evolution) ক্রম প্রায় একই । পাশ্চাত্য মতানুসারে অতি সূক্ষ সূক্ষ Amoeba নামক এককোষবিশিষ্ট জীববিশেষ হইতে ক্রমবিকাশে শ্রেষ্ঠ প্রাণী মনুষ্যের উদ্ভব হইয়াছে । জীবতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতগণের খানিকটা আনুমানিক হিসাবে এই উদ্ভবের পূর্ব পর্যন্ত মধ্যবর্তী বিভিন্ন জাতির বা যোনির সংখ্যা ৫৩ লক্ষ ৭৫ হাজার অথবা আরও বেশী হইতে পারে । সুতরাং আমাদের পুরাণাদিতে উল্লিখিত স্থাবর, জলচর, কৃমি, পক্ষী, পশু ও মনুষ্য জাতি লইয়া মোট ৮৪ লক্ষ যোনির বর্ণনাকে একেবারে কল্পনামূলক বা ভিত্তিহীন বলা চলে না ।

কিন্তু একটি বিষয়ে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রাচ্য প্রজ্ঞানে মর্মান্তিক প্রভেদ আছে । পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আলোচনা আধিভৌতিক বা দেহগত, প্রাচ্য দর্শনের আলোচনা আধ্যাত্মিক বা জীবগত । জড়বিজ্ঞানে দেহের ক্রম-বিকাশেরই আলোচনা করে; ঋষি প্রজ্ঞান দেখেন । এখানে দুইটি তত্ত্ব – দেহ ও দেহী; শরীর ও আত্মা; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ; অপরা ও পরা প্রকৃতি (গীতা); প্রকৃতি ও পুরুষ (সাংখ্য) । স্থাবর-জঙ্গম যত কিছু পদার্থ আছে সকলই এই দুইএর সংযোগ হইতে স্পষ্ট হইয়া থাকে । জীবের মধ্যে নিহিত ব্রহ্মশক্তির বিকাশই ক্রমবিকাশ (Evolution) । এই বিকাশের ক্রমানুসারেই জন্মে-জন্মে জীবের নূতন-নূতন দেহ প্রাপ্তি হয় ।

“সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থের উপর নূতন নূতন ও ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা প্রয়োগ করিয়া দেখা, কিংবা তাহাদিগকে অনেক প্রকারে পৃথকৃত করিয়া তাহাদের গুণধর্ম নির্ধারণ করা, কিংবা সজীব জগতের প্রাচীন ও নূতন অনেক প্রাণীদেগের শারীরিক অবয়বসমূহের একত্র তুলনা করা, ইত্যাদি আধিভৌতিকশাস্ত্রের অবার্চীন যুক্তি কণাদের (পরমাণুবাদ-ন্যায়শাস্ত্রের প্রণেতা) কিংবা কপিলের (সাংখ্য-শাস্ত্রের প্রণেতা) উপলব্ধ ছিল না । তাঁহাদের দৃষ্টির সম্মুখে সেই সময় যে সকল সামগ্রী ছিল তাহা হইতেই তাঁহারা আপন সিদ্ধান্ত বাহির করিয়াছিলেন । তথাপি আশ্চর্যের বিষয় যে, সৃষ্টির অভিবৃদ্ধি ও তাহার সংগঠন কি করিয়া হইয়াছিল এই সম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রকারগণ কর্তৃক প্রদত্ত তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে এবং অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্রের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে অধিক প্রভেদ নাই । কিন্তু ‘একই অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে নানাবিধ ব্যক্ত সৃষ্টি কি করিয়া হইল ?‘ – এই বিষয়ে অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্রকারও কপিল অপেক্ষা বেশী কিছুই বলিতে পারেন নাই ।” – [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৫৩-১৫৪]

5) জড় ও চেতনা
প্রশ্ন – প্রকৃতি জড়া, সুতরাং তাহার পরিণাম বুদ্ধি, অহঙ্কার, মন, ইন্দ্রিয়াদি সমস্তই জড় পদার্থ । কিন্তু ইহাদিগকে চেতনাত্মক বোধ হয় কেন ?

উত্তর – জগৎ কেবল জড়াত্মক নহে, সৃষ্টিতে জড় ও  চেতন উভয়ই সংসৃষ্ট । সাংখ্যমতে পুরুষের সান্নিধ্যবশতঃ প্রকৃতিতে চৈতন্যের আভাস হয় । কিন্তু সাংখ্যের পুরুষ চেতন হইলেও নির্বিকার, অকর্তা; প্রকৃতির গুণেই কর্ম হয়, পুরুষ কেবল সাক্ষী, ভোক্তা ও অনুমন্তা ।

“সাংখ্যমতে সৃষ্টিকালে প্রকৃতি ও পুরুষ পরস্পর সংযুক্ত থাকে । তাহার ফলে পুরুষের গুণ প্রকৃতিতে ও প্রকৃতির গুণ পুরুষে উপচরিত হয় । সেই জন্য বস্তুতঃ অচেতন হইলেও প্রকৃতিকেও চেতন বলিয়া মনে হয় এবং বস্তুতঃ অকর্তা হইলেও পুরুষকে কর্তা বলিয়া মনে হয় ।” – [গীতায় ঈশ্বরবাদ, বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]

“লৌহ চুম্বকের সন্নিধানে আসিলে লৌহে আকর্ষণশক্তি আসে, সেইরূপ প্রকৃতির সঙ্গে নির্গুণ পুরুষের সংযোগ হইলে মূল অব্যক্ত প্রকৃতি স্বকীয় গুণসমূহের (সূক্ষ ও স্থূল) ব্যক্ত বিস্তার পুরুষের সম্মুখে স্থাপন করে [সাং, কা, ৫৭]।” –  [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬৫]

এই স্থলেই পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অপেক্ষা সাংখ্যের শ্রেষ্ঠত্ব ।

“পাশ্চাত্য বিজ্ঞান প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছে যে, সচেতন মন অচেতন জড়ের ক্রিয়ারই পরিণাম ফল, কিন্তু অচেতন কেমন করিয়া চেতনের মত হয় পাশ্চাত্য বিজ্ঞান তাহা ব্যাখ্যা করিতে পারে নাই, সাংখ্য তাহা ব্যাখ্যা করিয়াছে । পুরুষের ভিতর প্রকৃতি প্রতিবিম্বিত হওয়াতেই এইরূপ হইয়া থাকে, আত্মার চৈতন্য জড়প্রকৃতির ক্রিয়ার উপর আরোপিত হয় । এইরূপে সাক্ষি-স্বরূপ পুরুষ নিজকে ভুলিয়া যায়, প্রকৃতির চিন্তা, ইচ্ছা, ক্রিয়া নিজের বলিয়া ভ্রম করে । …এই ভ্রম হইতে পরিত্রাণ লাভই প্রকৃতি এবং তাহার কার্য হইতে পুরুষের মুক্তি লাভের প্রথম সোপান ।” – [সাংখ্য ও যোগ, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ৯৮]

“জলস্থ মাছ যেরূপ জল হইতে পৃথক্‌, সেইরূপ প্রকৃতি ও পুরুষের সম্বন্ধ । এই ভিন্নতা যে জানিতে পারে সে মুক্তই (কৈবল্য-, কেবলত্ব-, একাকীত্ব-প্রাপ্ত) হয় ।” –  [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬৭]


হেকেলের জড়াদ্বৈত বা আধিভৌতিকশাস্ত্রাদ্বৈত (Haeckel’s Monism) – একমাত্র জড় ও অব্যক্ত প্রকৃতিই সমস্ত সৃষ্টির মূল । এই সমস্ত বিশ্ব এক বৃহৎ কারাগার, প্রাণীমাত্রই কয়েদী এবং পদার্থের গুণধর্ম শৃঙ্খল – এই শৃঙ্খল কেহ ভাঙ্গিতে পারে না । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রকারেরা এই জড়াদ্বৈত স্বীকার করেন না । – [কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, পৃঃ১৬৩]


*Hard Copy Source:

“Sri Gita” or “Srimadbhagabadgeeta” by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition – June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006. pp.246-252.

Online References:1a)”Perigenesis der Plastidule” by Ernst Haeckel. pp. 38f. Also cited in Martineau’s “Types of Ethical Theory”, 3rd Ed., Vol.IIpp.399.1b)”The Riddle of the Universe” by Earnest Haeckel, 1905. Chapter IX, pp.63 (R.P.A. Cheap Edition).2)”Essays on the Gita” by Sri Aurobindo. The Complete Works of Sri Aurobindo. © Sri Aurobindo Ashram Trust 1997. Published by Sri Aurobindo Ashram Publication Department. Printed at Sri Aurobindo Ashram Press, Pondicherry, India. Volume-19, pp.73.

3)”Sri Aurobinder Gita” translated by Sri Anil Baran Ray (translator’s biography at the end of the linked web-page), 1924. Published by Sri Bibhutibhushan Ray, Saraswati Library, 9 Romanath Majumdar Street, Kolkata. Printed by Sri Mohendranath Dutta, Sri Saraswati Press, 26/1 Beniyatola Lane, Kolkata.

4)”Shrimadbhagabadgita Rahasya” or “Karmajogsastra” by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata.

5)”Sankhya-Darshan” by Sri Bankim Chandra Chattopadhyay. Bankim Rachanabali, unicode compliant electronic edition provided by “Eduliture“.

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

तैत्तिरीय ब्राह्मणम्

  Conti..... Conti........ Conti..........

Post Top Ad

ধন্যবাদ