নীতি ও ধর্মতত্ত্ব
মীমাংসাশাস্ত্রে কর্মের অনুষ্ঠানকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। মীমাংসকদের মতে যে কর্ম বেদ নির্দেশিত অর্থাৎ বেদ যে কর্মকে ইষ্টের সাধক বলে তাই-ই ধর্ম, এবং বেদ নিষিদ্ধ কর্ম অর্থাৎ বেদ যাকে অনিষ্টের সাধক বলে তা অধর্ম। এই মতে, স্মৃতি (অর্থাৎ ঋষিদের রচিত ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ) ও সদাচারও ধর্মে প্রমাণ বলে গৃহীত হতে পারে যদি বেদে তার বিরুদ্ধতা না পাওয়া যায়। কিন্তু তাকে বেদ থেকে পৃথক মনে করে ধর্ম বলে মানা যায় না, এইভাবেই শুধু মানা যেতে পারে যে এ রকম কোনো উক্তি পূর্বেই ছিলো যা থেকে স্মৃতি ও সদাচার তাকে গ্রহণ করেছে। বেদের বেশ কয়েকটি শব্দ লুপ্ত হওয়ায় এখন সেগুলি অপ্রাপ্য। এখানে ‘অপ্রাপ্য’ শব্দের এই অর্থ করতে হবে যে সেগুলির অভিব্যক্তি নেই, অন্যথায় নিত্য হওয়ার জন্য বেদের শব্দরাজি তো কোথাও না কোথাও সংরক্ষিত থাকবেই।
(ক) কর্তব্য-কর্ম :
মীমাংসা-মতে, কর্তব্যের জন্যেই কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে, অন্য কোন বস্তুর জন্য নয়। যেহেতু বেদে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের নির্দেশ রয়েছে তাই যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান বেদ নির্দেশিত বলে তা করতে হবে, কোনো ফল লাভের আশায় অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা দেবতাকে তুষ্ট করে ফল লাভ করার জন্য নয়। মীমাংসকরা বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানকে অনুমোদন করলেও এই সব যাগযজ্ঞ দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য করতে হবে তা সমর্থন করেন না। তবে ফল লাভের আশা না করেও কোনো কর্তব্য সম্পাদন করলে কর্তব্য সম্পাদনে যে ফল লাভ হয় এ কথা মীমাংসকরা বিশ্বাস করেন। তাই লৌকিক শুভকর্ম এবং বেদ-বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা মানুষ ঐহিক ও পারলৌকিক শুভফল লাভ করতে পারে। এই ফল কোন ঈশ্বর প্রদান করে না, কেননা মীমাংসা-মতে কর্তব্য কোনো বেদ নিহিত ঈশ্বরের আদেশ নয়। মীমাংসকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এবং তাঁরা ‘ঈশ্বর’ নামের কোনো অতি-প্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে কর্তব্য-কর্মের ফললাভ হয় কর্ম নিয়ম অনুসারে।
মীমাংসকরা কর্মকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন- অর্থকর্ম ও গুণকর্ম। যে-কর্ম আত্মবিষয়ক অপূর্বের জনক, তা-ই অর্থকর্ম। যেমন- অগ্নিহোত্রযোগ, সন্ধ্যাহ্নিক, উপাসনা প্রভৃতি। এসব কর্মের দ্বারা জীবাত্মাতে শুভ অদৃষ্ট উৎপন্ন হয়। এই অর্থকর্ম আবার তিন প্রকার- নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য।
যে কর্ম প্রতিদিন করা প্রয়োজন অর্থাৎ, যে-কর্ম অবশ্য করণীয় এবং না করলে প্রত্যবায় (পাপ) ঘটে, তা হলো নিত্যকর্ম; যেমন সন্ধ্যাবন্দনাদি প্রার্থনা করা নিত্যকর্ম। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
মীমাংসকরা কর্মকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন- অর্থকর্ম ও গুণকর্ম। যে-কর্ম আত্মবিষয়ক অপূর্বের জনক, তা-ই অর্থকর্ম। যেমন- অগ্নিহোত্রযোগ, সন্ধ্যাহ্নিক, উপাসনা প্রভৃতি। এসব কর্মের দ্বারা জীবাত্মাতে শুভ অদৃষ্ট উৎপন্ন হয়। এই অর্থকর্ম আবার তিন প্রকার- নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য।
যে কর্ম প্রতিদিন করা প্রয়োজন অর্থাৎ, যে-কর্ম অবশ্য করণীয় এবং না করলে প্রত্যবায় (পাপ) ঘটে, তা হলো নিত্যকর্ম; যেমন সন্ধ্যাবন্দনাদি প্রার্থনা করা নিত্যকর্ম। শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
‘নিত্যকর্ম্মণান্তু অঙ্গেষু যথাশক্তিন্যায়ঃ।’
অর্থাৎ : নিত্যকর্মের অঙ্গসমূহ যথাশক্তি অনুষ্ঠিত হলেই কর্ম সিদ্ধ হবে।
.
যাবজ্জীবন কেউই সমগ্র অঙ্গের সাথে কর্মানুষ্ঠান করতে পারেন না। সমর্থ থেকে কর্মানুষ্ঠানের অঙ্গহানি করা চলবে না। তবে অসমর্থ ব্যক্তির পক্ষে প্রধান কর্ম অনুষ্ঠিত হলেও কর্ম সম্পন্ন হবে। তাই মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন-
যাবজ্জীবন কেউই সমগ্র অঙ্গের সাথে কর্মানুষ্ঠান করতে পারেন না। সমর্থ থেকে কর্মানুষ্ঠানের অঙ্গহানি করা চলবে না। তবে অসমর্থ ব্যক্তির পক্ষে প্রধান কর্ম অনুষ্ঠিত হলেও কর্ম সম্পন্ন হবে। তাই মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন-
‘অপি বাপ্যেকদেশে স্যাৎ প্রধানে হ্যর্থনির্বৃত্তির্গুণমাত্রমিতরত্তদর্থত্বাৎ।’- (মীমাংসাসূত্র-৬/৩/২)
অর্থাৎ : কর্মের একদেশ, অর্থাৎ প্রধান অংশ অনুষ্ঠিত হলেই নিত্যকর্ম সিদ্ধ হয়। তাতেই প্রত্যবায়-পরিহার হয়ে থাকে। অন্যান্য অঙ্গগুলি গুণমাত্র। যেহেতু সেগুলি স্বর্গাদি ফলের নিমিত্ত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
.
কোনো একটি ঘটনার নিমিত্তে কোনো বিশেষ তিথিতে বা বিশেষ কোনো দিনে যে কর্ম করা হয় তা নৈমিত্তিক কর্ম; যেমন সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় আহার না করা বা কাউকে কিছু দান করা এবং সূর্যগ্রহণের পর মুক্তিস্নান করা প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম। স্নানরূপ কর্মটি নৈমিত্তিক কর্ম। গ্রহণই তার নিমিত্ত বা হেতু।
.
কোনো বিশেষ ফললাভের আশায়, অর্থাৎ কামনাপূর্বক যে কর্তব্য-কর্ম করা হয় তা হলো কাম্যকর্ম; যেমন স্বর্গকামীর যাগযজ্ঞ প্রভৃতি কাম্যকর্ম। কাম্যকর্ম তিনপ্রকার- ঐহিকফলক, পারত্রিকফলক এবং ঐহিক-পারত্রিকফলক।
যে কাম্যকর্মের ফল ইহলোকেই ভোগ করা যায়, তা ঐহিকফলক। যেমন- কারীরীযাগ প্রভৃতি। অনাবৃষ্টিতে শস্যাদির ক্ষতি ঘটলে বৃষ্টি কামনা করে কারীরীযাগ করবার বিধান। ‘কালান্তরে বা জন্মান্তরে ফল ভোগ করবো’- এরকম কামনাপূর্বক কেউ কারীরীযাগ করেন না।
শুধু মৃত্যুর পর পরলোকেই যে কর্মের ফল পাওয়া যায়, তা পারত্রিকফলক। যেমন- দর্শপূর্ণমাসযাগ প্রভৃতি। ইহলোকে এসব যাগের স্বর্গাদিফল ভোগ্য নয়, পরলোকেই তা ভোগ্য।
তৃতীয়প্রকারের কাম্যকর্মের ফল উভয় লোকেই ভোগ করা যায়। যেমন- ‘ঐশ্বর্য্যকাম ব্যক্তি শ্বেতবর্ণ ছাগলের দ্বারা বায়ুদেবতার উদ্দেশে যাগ করবেন।’ এই বিধিবিহিত যাগের ফল ঐশ্বর্য্য উভয় লোকেই ভোগ করা যায়। এভাবে পুষ্করিণীপ্রতিষ্ঠা, পথসংস্কার প্রভৃতি কর্মের ফলও ইহলোকে এবং পরলোকে ভোগ করা যায়। কাম্যকর্ম একাধিকবার করলে ফলের আধিক্য হয়ে থাকে।
.
নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম বেদের নির্দেশ বলে এগুলো সম্পাদন করা অবশ্যই করণীয়। নিত্যকর্ম সর্বদা অপরিত্যাজ্য বলেই তা যথাশক্তি অনুষ্ঠেয়। রোগে-শোকে, রাস্তায়-ঘাটে, প্রবাসে-বিদেশে এবং আরও নানা কারণে প্রাত্যহিক আহ্নিকাদি নিত্যকর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান সবসময় সম্ভবপর হয় না। সেসব স্থলে শুধু মানস জপের দ্বারাই কর্ম সিদ্ধ হবে। অপরাপর অঙ্গ-কর্মের অনুষ্ঠান না করলেও নিত্যকর্ম নিষ্ফল হবে না। নৈমিত্তিক কর্ম সম্বন্ধেও এই বিধান খাটবে।
কাম্যকর্ম না করলেও কোন দোষ হয় না। যথাযথভাবে করবার সামর্থ্য না থাকলে কাম্যকর্মে প্রবৃত্ত হওয়াই উচিত নয়। তাই নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্মের সাথে কাম্যকর্মের তুলনা চলে না। নিখুঁতভাবে সকল অঙ্গের সাথে প্রধান কর্ম যিনি সম্পন্ন করতে পারবেন, তাঁর ফলভোগের কামনা থাকলে তিনিই হবে কাম্যকর্মের অধিকারী। নিত্যকর্ম ও কাম্যকর্মের এই প্রভেদকে বলা হয়- ‘নিত্যে যথাশক্তিনিয়ম’ ও ‘কাম্যে সর্ব্বশক্তিনিয়ম’।
.
এই সমস্ত কর্মের ফল সব সময় ইহজন্মে পাওয়া যায় না। মৃত্যুর পর এমনকি পরজন্মেও ঐ সমস্ত কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। মীমাংসকরা বলেন যে, শুভ বা অশুভ, বিহিত বা নিষিদ্ধ, যে কোনো কর্মের অনুষ্ঠানের পর আর ধর্মানুষ্ঠানের পরই শুদ্ধচিত্তে বেদাধ্যয়ন এবং জ্ঞান লাভ সম্ভব।
.
(খ) বেদবাক্যের অর্থনির্ধারণ :
মীমাংসা নীতি ও ধর্মতত্ত্বের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বেদবাক্যের অর্থনির্ধারণ। বেদ কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, বেদ প্রাচ্যসভ্যতার অতি মূল্যবান প্রাচীন নথি। বলাই বাহুল্য, এই নথির মর্মোদ্ধার সহজসাধ্য নয়। বেদে উক্ত পদ ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ অতি দুরূহ ব্যাপার। এই উদ্দেশ্যেই তাই নানা শাস্ত্র রচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিরুক্ত, ব্যাকরণ ও মীমাংসাশাস্ত্র।
কোনো একটি ঘটনার নিমিত্তে কোনো বিশেষ তিথিতে বা বিশেষ কোনো দিনে যে কর্ম করা হয় তা নৈমিত্তিক কর্ম; যেমন সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় আহার না করা বা কাউকে কিছু দান করা এবং সূর্যগ্রহণের পর মুক্তিস্নান করা প্রভৃতি নৈমিত্তিক কর্ম। স্নানরূপ কর্মটি নৈমিত্তিক কর্ম। গ্রহণই তার নিমিত্ত বা হেতু।
.
কোনো বিশেষ ফললাভের আশায়, অর্থাৎ কামনাপূর্বক যে কর্তব্য-কর্ম করা হয় তা হলো কাম্যকর্ম; যেমন স্বর্গকামীর যাগযজ্ঞ প্রভৃতি কাম্যকর্ম। কাম্যকর্ম তিনপ্রকার- ঐহিকফলক, পারত্রিকফলক এবং ঐহিক-পারত্রিকফলক।
যে কাম্যকর্মের ফল ইহলোকেই ভোগ করা যায়, তা ঐহিকফলক। যেমন- কারীরীযাগ প্রভৃতি। অনাবৃষ্টিতে শস্যাদির ক্ষতি ঘটলে বৃষ্টি কামনা করে কারীরীযাগ করবার বিধান। ‘কালান্তরে বা জন্মান্তরে ফল ভোগ করবো’- এরকম কামনাপূর্বক কেউ কারীরীযাগ করেন না।
শুধু মৃত্যুর পর পরলোকেই যে কর্মের ফল পাওয়া যায়, তা পারত্রিকফলক। যেমন- দর্শপূর্ণমাসযাগ প্রভৃতি। ইহলোকে এসব যাগের স্বর্গাদিফল ভোগ্য নয়, পরলোকেই তা ভোগ্য।
তৃতীয়প্রকারের কাম্যকর্মের ফল উভয় লোকেই ভোগ করা যায়। যেমন- ‘ঐশ্বর্য্যকাম ব্যক্তি শ্বেতবর্ণ ছাগলের দ্বারা বায়ুদেবতার উদ্দেশে যাগ করবেন।’ এই বিধিবিহিত যাগের ফল ঐশ্বর্য্য উভয় লোকেই ভোগ করা যায়। এভাবে পুষ্করিণীপ্রতিষ্ঠা, পথসংস্কার প্রভৃতি কর্মের ফলও ইহলোকে এবং পরলোকে ভোগ করা যায়। কাম্যকর্ম একাধিকবার করলে ফলের আধিক্য হয়ে থাকে।
.
নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম বেদের নির্দেশ বলে এগুলো সম্পাদন করা অবশ্যই করণীয়। নিত্যকর্ম সর্বদা অপরিত্যাজ্য বলেই তা যথাশক্তি অনুষ্ঠেয়। রোগে-শোকে, রাস্তায়-ঘাটে, প্রবাসে-বিদেশে এবং আরও নানা কারণে প্রাত্যহিক আহ্নিকাদি নিত্যকর্মের যথাযথ অনুষ্ঠান সবসময় সম্ভবপর হয় না। সেসব স্থলে শুধু মানস জপের দ্বারাই কর্ম সিদ্ধ হবে। অপরাপর অঙ্গ-কর্মের অনুষ্ঠান না করলেও নিত্যকর্ম নিষ্ফল হবে না। নৈমিত্তিক কর্ম সম্বন্ধেও এই বিধান খাটবে।
কাম্যকর্ম না করলেও কোন দোষ হয় না। যথাযথভাবে করবার সামর্থ্য না থাকলে কাম্যকর্মে প্রবৃত্ত হওয়াই উচিত নয়। তাই নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্মের সাথে কাম্যকর্মের তুলনা চলে না। নিখুঁতভাবে সকল অঙ্গের সাথে প্রধান কর্ম যিনি সম্পন্ন করতে পারবেন, তাঁর ফলভোগের কামনা থাকলে তিনিই হবে কাম্যকর্মের অধিকারী। নিত্যকর্ম ও কাম্যকর্মের এই প্রভেদকে বলা হয়- ‘নিত্যে যথাশক্তিনিয়ম’ ও ‘কাম্যে সর্ব্বশক্তিনিয়ম’।
.
এই সমস্ত কর্মের ফল সব সময় ইহজন্মে পাওয়া যায় না। মৃত্যুর পর এমনকি পরজন্মেও ঐ সমস্ত কর্মের ফল ভোগ করতে হয়। মীমাংসকরা বলেন যে, শুভ বা অশুভ, বিহিত বা নিষিদ্ধ, যে কোনো কর্মের অনুষ্ঠানের পর আর ধর্মানুষ্ঠানের পরই শুদ্ধচিত্তে বেদাধ্যয়ন এবং জ্ঞান লাভ সম্ভব।
.
(খ) বেদবাক্যের অর্থনির্ধারণ :
মীমাংসা নীতি ও ধর্মতত্ত্বের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বেদবাক্যের অর্থনির্ধারণ। বেদ কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, বেদ প্রাচ্যসভ্যতার অতি মূল্যবান প্রাচীন নথি। বলাই বাহুল্য, এই নথির মর্মোদ্ধার সহজসাধ্য নয়। বেদে উক্ত পদ ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ অতি দুরূহ ব্যাপার। এই উদ্দেশ্যেই তাই নানা শাস্ত্র রচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিরুক্ত, ব্যাকরণ ও মীমাংসাশাস্ত্র।
নিরুক্ত মূলত বৈদিক অভিধান গ্রন্থ। এটি বেদের (প্রধানত ঋগ্বেদের) যাস্ক প্রণীত প্রাচীনব্যাখ্যা। কেননা- ‘যাস্কের সময়ের (আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ৬০০-৫০০) বহুপূর্বেই বৈদিকসংহিতাগুলি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিলো। এর দ্বারা সংহিতাগুলির প্রাচীনত্বসম্বন্ধে একটা আন্দাজ করা যেতে পারে। যাস্কের সময়ের সঙ্গে সংহিতাগুলির রচনাকালের বিস্তর ব্যবধান না ঘটলে, যাস্কের অনেক পূর্ব থেকেই বেদের দুর্বোধ্যতার ঘটনাটা ব্যাখ্যা করা যায় না। বেদ ব্যাখ্যার প্রাচীনতম প্রচেষ্টা বোধহয় ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলির ‘পদপাঠ’। পদপাঠে মন্ত্রগুলির সন্ধি সমাস ভেঙে পদগুলি আলাদা করে দেখানো হয়েছে। যুক্ত বা সমাসবদ্ধ পদগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। পদ-পাঠের দ্বারা অন্বয় অর্থাৎ পদগুলির পরস্পর সম্বন্ধ বুঝতে অনেকটা সুবিধা হয়। কিন্তু যে শব্দ বা পদগুলি কেবল বেদেই ব্যবহৃত হয়, লৌকিক সংস্কৃতে হয় না, তাদের সঠিক অর্থনির্ণয়ের সমস্যা থেকেই যায়। এই সমস্যাপূরণের জন্য বেদ ব্যাখ্যার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হল একটা নতুন পদ্ধতি যাকে বলা হয় ‘নিরুক্ত’। ‘নিরুক্ত’ শব্দের অর্থ ‘নির্বচন’, অর্থাৎ অনুমিত অর্থ অনুসারে বিশিষ্ট বৈদিক শব্দগুলির একটি তালিকা প্রস্তুত করে, ঐ শব্দগুলি যে মন্ত্রগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছে সেই মন্ত্রগুলির একটা সংগত অর্থ আবিষ্কার করা সম্ভব। এই শব্দতালিকাটির নাম ‘নিঘণ্টু’। তালিকাপ্রস্তুতিরও একটা পদ্ধতি আছে। প্রথমে, একই অর্থে অনেকগুলি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ( যেমন পৃথিবী অর্থে এতগুলি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে) এ জাতীয় শব্দের একটি তালিকা। তারপর একটা শব্দ অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অথবা এমন কতগুলি নিতান্ত অপ্রচলিত শব্দ যার অর্থ নির্ণয় দুরূহ সেসব শব্দগুলির একটি তালিকা। তারপর পৃথিবী, পৃথিবীর উপরিস্থিত বায়ুমন্ডল বা আন্তরিক্ষ এবং তারও পরবর্তী ‘দ্যুস্থান’ বা মহাকাশ- এই তিন স্তরের সহিত সম্বন্ধযুক্ত বিভিন্ন দেবতাদের নামের একটি তালিকা। মোটামুটিভাবে এই তালিকা ধরে উদ্ধৃত প্রাসঙ্গিক মন্ত্রগুলি যাস্ক ব্যাখ্যা করেছেন। তালিকানুযায়ী এই ব্যাখ্যাকে ‘নিরুক্ত’ বলা হয়, তাই নিরুক্তকে নিঘণ্টুর ভাষ্যও বলা হয়।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৯৬)
প্রচলিত নিঘণ্টু ও নিরুক্ত দুটোই যাস্কের রচিত কিনা তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তবে একথা ঠিক যে যাস্কই প্রথম নিরুক্তকার নন। নিরুক্ত পদ্ধতিতে বেদের ব্যাখ্যা যাস্কের পূর্বেও প্রচলিত ছিলো। এই বিশেষ পদ্ধতিতে বেদব্যাখ্যার একটা সম্প্রদায়ই গড়ে উঠেছিলো, যার নাম ‘নৈরুক্ত’। এই নামটি যাস্কের নিরুক্তেই পাওয়া যায়। যেমন, যাস্ক বলেছেন-
প্রচলিত নিঘণ্টু ও নিরুক্ত দুটোই যাস্কের রচিত কিনা তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তবে একথা ঠিক যে যাস্কই প্রথম নিরুক্তকার নন। নিরুক্ত পদ্ধতিতে বেদের ব্যাখ্যা যাস্কের পূর্বেও প্রচলিত ছিলো। এই বিশেষ পদ্ধতিতে বেদব্যাখ্যার একটা সম্প্রদায়ই গড়ে উঠেছিলো, যার নাম ‘নৈরুক্ত’। এই নামটি যাস্কের নিরুক্তেই পাওয়া যায়। যেমন, যাস্ক বলেছেন-
‘তিস্র-এর দেবতা ইতি নৈরুক্তাঃ… ঐকৈকস্যা অপি বহূনি নামধেয়ানি ভবন্তি’- (নিরুক্ত-৭/৫)
অর্থাৎ : নৈরুক্ত বা নিরুক্তপন্থীদের মতে মূল দেবতা মাত্র তিনটি- পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরিক্ষে বায়ু বা ইন্দ্র এবং দুস্থানে বা মহাকাশে সূর্য, বাকি সব দেবতা এদেরই এক একটির বিভিন্ন নামমাত্র।
ব্যাকরণশাস্ত্রেরও লক্ষ্য বৈদিক পদসমূহের অর্থ নির্ধারণ। এই সম্প্রদায়কে বলা হতো বৈয়াকরণ। ‘পাণিনি প্রণীত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামে সুপ্রসিদ্ধ ব্যাকরণ-গ্রন্থকে অবলম্বন করে এই সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। পাণিনিকে কেউ কেউ প্রায় যাস্কের সমসাময়িক বলে মনে করেন। পাণিনির মূল গ্রস্থ অষ্টাধ্যায়ীতে কোন দার্শনিক আলোচনা নেই। প্রায় চার হাজার সূত্রে পাণিনি বৈদিক ও লৌকিক সংস্কৃত শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি প্রক্রিয়া নিরূপণ করেন। পাণিনির সূত্রগুলির ওপর কাত্যায়ন বার্তিক রচনা করেছেন। সূত্র ও বার্তিক অবলম্বন করে পতঞ্জলি সুবিপুল ভাষ্য রচনা করেন যা অনন্যসাধারণ মাহাত্ম্যের জন্য ‘মহাভাষ্য’ নামে পরিচিত। পতঞ্জলি শুঙ্গ-সম্রাট পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক বলে অনুমান করা হয় (আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ২য় শতক)। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে প্রসঙ্গক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু দার্শনিক আলোচনা করেছেন। মূখ্যত মহাভাষ্য দার্শনিক গ্রন্থ নয়, ব্যাকরণ প্রক্রিয়ার গ্রন্থ। ব্যাকরণকে যিনি দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত করেন, ব্যাকরণ-দর্শন বা ভাষার দর্শন নামে একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক প্রস্থান প্রবর্তন করেন তিনি হলেন ভর্তৃহরি, যার ‘বাক্যপদীয়’-গ্রন্থ দার্শনিক জগতের একটি পরম বিস্ময়। এই দুরূহ গ্রন্থে ভর্তৃহরি ব্যাকরণের দার্শনিক আলোচনা প্রসঙ্গে মানুষের ভাষার সঙ্গে জ্ঞান ও বস্তুর সম্বন্ধ নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। ভর্তৃহরির একটি সুপ্রসিদ্ধ সিদ্ধান্ত হল- জ্ঞানমাত্রেই বাক্সময়, অর্থাৎ শব্দের ঐকান্তিক অনুপ্রবেশ ছাড়া কোন জ্ঞানই সম্ভব নয়। শব্দরূপতা প্রাপ্ত না হলে জ্ঞান আত্মপ্রকাশ লাভ করে না।
শব্দহীন জ্ঞান লোক ব্যবহারের অযোগ্য, তাই এহেন জ্ঞানের সম্পর্কে সত্যাসত্য-বিচারের প্রশ্নই উঠে না। মীমাংসক ও নৈয়ায়িকগণ এ জাতীয় ‘জ্ঞানকে’ সাধারণভাবে নির্বিকল্প জ্ঞান বলেছেন। ভর্তৃহরি কিন্তু ব্যবহারিক জগতে শব্দসংস্পর্শ শূন্য তথাকথিত নির্বিকল্প জ্ঞানের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না। জানা মানেই হল কোন বস্তুকে চেনা। ঘটকে ঘট বলে চিনতে হলে চোখের সঙ্গে ঘটের সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘট’ শব্দটি স্মৃতিবাহিত হয়ে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে রূপদান করে। তাই জ্ঞানের আকারটা হয়- ‘এটা ঘট’। এই আকারের তাৎপর্য হল- একে ‘ঘট’ বলে।
চেতনার সঙ্গে অর্থবহ শব্দের অবিচ্ছেদ্য একাত্মতা থেকে ভর্তৃহরি যে পারমার্থিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন… (তা) মূলত অদ্বৈতবাদী (সিদ্ধান্ত)। অদ্বৈতবাদের সিদ্ধান্ত হল- জ্ঞানের বাইরে জ্ঞেয় বস্তুর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। সুতরাং মূল বস্তু হল এক চৈতন্যময় মহাসত্তা যা অবিদ্যাবশত মিথ্যা জাগতিক বহির্বস্তু-রূপে প্রতিভাসিত হয়। ভর্তৃহরি বললেন- জ্ঞানের বাইরে স্বতন্ত্র জ্ঞেয় বস্তু নেই একথা সত্য। তেমনি আবার শব্দাকারতা বাদ দিলে কোন জ্ঞানই প্রকাশিত হয় না। তা হলে দাঁড়াচ্ছে- জ্ঞানের বাইরে জ্ঞেয়বস্তু নেই। আবার শব্দের বাইরে জ্ঞান নেই। যা কিছু জ্ঞেয় তা জ্ঞানময়, যা কিছু জ্ঞান তা শব্দময়। সুতরাং হেতুবিদ্যার নিয়মানুযায়ী বস্তু ও জ্ঞান সবকিছুই শব্দময়। এখন তা হলে মূল পারমার্থিক তত্ত্ব হল এক শব্দচৈতন্যময় মহাসত্তা যার নাম ‘শব্দব্রহ্ম’। এই শব্দব্রহ্মাই অবিদ্যাবশতঃ মিথ্যা জাগতিক বস্তুরূপে প্রকাশিত হয়। একে বলে শব্দাদ্বৈতবাদ।
ভর্তৃহরিকে শব্দাদ্বৈতবাদের স্রষ্টা বলে মনে হয় না। শব্দাদ্বৈতবাদ ভর্তৃহরির অনেক পূর্বেই প্রচলিত ছিল। ভর্তৃহরি এই মতবাদকে একটি সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল দার্শনিক প্রস্থানে উন্নীত করেন যার পরবর্তী নামকরণ হয়েছে পাণিনীয় দর্শন। এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা ভর্তৃহরি, প্রধান অবলম্বন ‘বাক্যপদীয়’।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-২০২)
শব্দহীন জ্ঞান লোক ব্যবহারের অযোগ্য, তাই এহেন জ্ঞানের সম্পর্কে সত্যাসত্য-বিচারের প্রশ্নই উঠে না। মীমাংসক ও নৈয়ায়িকগণ এ জাতীয় ‘জ্ঞানকে’ সাধারণভাবে নির্বিকল্প জ্ঞান বলেছেন। ভর্তৃহরি কিন্তু ব্যবহারিক জগতে শব্দসংস্পর্শ শূন্য তথাকথিত নির্বিকল্প জ্ঞানের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না। জানা মানেই হল কোন বস্তুকে চেনা। ঘটকে ঘট বলে চিনতে হলে চোখের সঙ্গে ঘটের সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘট’ শব্দটি স্মৃতিবাহিত হয়ে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে রূপদান করে। তাই জ্ঞানের আকারটা হয়- ‘এটা ঘট’। এই আকারের তাৎপর্য হল- একে ‘ঘট’ বলে।
চেতনার সঙ্গে অর্থবহ শব্দের অবিচ্ছেদ্য একাত্মতা থেকে ভর্তৃহরি যে পারমার্থিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন… (তা) মূলত অদ্বৈতবাদী (সিদ্ধান্ত)। অদ্বৈতবাদের সিদ্ধান্ত হল- জ্ঞানের বাইরে জ্ঞেয় বস্তুর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। সুতরাং মূল বস্তু হল এক চৈতন্যময় মহাসত্তা যা অবিদ্যাবশত মিথ্যা জাগতিক বহির্বস্তু-রূপে প্রতিভাসিত হয়। ভর্তৃহরি বললেন- জ্ঞানের বাইরে স্বতন্ত্র জ্ঞেয় বস্তু নেই একথা সত্য। তেমনি আবার শব্দাকারতা বাদ দিলে কোন জ্ঞানই প্রকাশিত হয় না। তা হলে দাঁড়াচ্ছে- জ্ঞানের বাইরে জ্ঞেয়বস্তু নেই। আবার শব্দের বাইরে জ্ঞান নেই। যা কিছু জ্ঞেয় তা জ্ঞানময়, যা কিছু জ্ঞান তা শব্দময়। সুতরাং হেতুবিদ্যার নিয়মানুযায়ী বস্তু ও জ্ঞান সবকিছুই শব্দময়। এখন তা হলে মূল পারমার্থিক তত্ত্ব হল এক শব্দচৈতন্যময় মহাসত্তা যার নাম ‘শব্দব্রহ্ম’। এই শব্দব্রহ্মাই অবিদ্যাবশতঃ মিথ্যা জাগতিক বস্তুরূপে প্রকাশিত হয়। একে বলে শব্দাদ্বৈতবাদ।
ভর্তৃহরিকে শব্দাদ্বৈতবাদের স্রষ্টা বলে মনে হয় না। শব্দাদ্বৈতবাদ ভর্তৃহরির অনেক পূর্বেই প্রচলিত ছিল। ভর্তৃহরি এই মতবাদকে একটি সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খল দার্শনিক প্রস্থানে উন্নীত করেন যার পরবর্তী নামকরণ হয়েছে পাণিনীয় দর্শন। এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা ভর্তৃহরি, প্রধান অবলম্বন ‘বাক্যপদীয়’।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়: বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-২০২)
তবে ঋগ্বেদের দশম-মণ্ডলের ‘বাগাম্ভূণী-সূক্ত’কে (ঋ: ১০/৭১,১২৫) ব্যাকরণ দর্শনের বৈদিক মূল বলে মনে করা হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এই সূক্তের কিছু ঋক তর্জমাসহ উদ্ধৃত করা যেতে পারে-
‘বৃহস্পতে প্রথমং বাচো অগ্রং যৎপ্রৈরত নামধেয়ং দধানাঃ।
যদেষাং শ্রেষ্ঠং যদরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাং নিহিতং গুহাবিঃ।। (ঋক-১০/৭১/১)
সক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো যত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।
অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাং লম্মীর্নিহিতাধি বাচি।। (ঋক-১০/৭১/২)
যজ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্ ।
তামাভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাং সপ্ত রেভা অভি সং নবন্তে।। (ঋক-১০/৭১/৩)
উত ত্বঃ পশান্ন দদর্শ বাচমুত ত্বঃ শৃণ¦ন্ন শৃণোত্যেনাম্ ।
উতো ত্বস্মৈ তন্বংবি স¯্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ।। (ঋক-১০/৭১/৪)
উত ত্বং সখ্যে স্থিরপীতমাহুর্নৈনং হিন্বন্ত্যপি বাজিনেষু।
অধেন্বা চরতি মায়য়ৈষ বাচং শুশ্রুবাঁ অফলামপুষ্পাম্ ।। (ঋক-১০/৭১/৫)
হ্রদা তষ্টেষু মনসো জবেষু যদব্রাহ্মণাঃ সংর্যজন্তে সখায়ঃ।
অত্রাহ ত্বং বি জহুর্বেদ্যাভিরোহব্রহ্মাণো বি চরন্তু ত্বে।। (ঋক-১০/৭১/৮)
ইমে যে নার্বাঙ্ ন পরশ্চরন্তি ন ব্রাহ্মণাসো ন সুতেকরাসঃ।
ত এতে বাচমভিপদ্য পাপয়া সিরীস্তন্ত্রং তন্বতে অপ্রজজ্ঞয়ঃ।। (ঋক-১০/৭১/৯)
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।। (ঋক-১০/১২৫/১)
অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ।। (ঋক-১০/১২৫/৩)
অহমেব বাত ইব প্র বাম্যারভমাণা ভূবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতাবতী মহিনা সং বভূব।। (ঋক-১০/১২৫/৮)
অর্থাৎ :
হে বৃহস্পতি ! বালকেরা সর্বপ্রথম বস্তুর নাম মাত্র করতে পারে, তাই তাদের ভাষাশিক্ষার প্রথম সোপান। তাদের যা কিছু উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ জ্ঞান হৃদয়ের নিগূঢ় স্থানে সঞ্চিত ছিলো, তা বাগ্দেবীর করুণাক্রমে প্রকাশ হয়। (ঋক-১০/৭১/১)
যেমন চালনীর দ্বারা শক্তুকে পরিষ্কার করে সেরূপ বুদ্ধিমান বুদ্ধিবলে পরিষ্কৃত ভাষা প্রস্তুত করেছেন। সে ভাষাতে বন্ধুগণ বন্ধুত্ব অর্থাৎ বিস্তর উপকার প্রাপ্ত হন। তাঁদের বচনরচনাতে অতি চমৎকার লক্ষ্মী সংস্থাপিত আছে। (ঋক-১০/৭১/২)
বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞদ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হন। ঋষিদের অন্তকরণ মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিলো তা তাঁরা প্রাপ্ত হলেন। সে ভাষা আহরণপূর্বক তাঁরা নানাস্থানে বিস্তার করলেন। সপ্তছন্দ সে ভাষাতেই স্তব করে। (ঋক-১০/৭১/৩)
কেউ কেউ কথা দেখেও কথার ভাবার্থ গ্রহণ করতে পারে না, কেউ শুনেও শুনে না। যেমন প্রেম পরিপূর্ণা সুন্দর পরিচ্ছদধারিণী ভার্যা আপন স্বামীর নিকটে নিজ দেহ প্রকাশ করেন সেরূপ বাগ্দেবী কোন কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশিত হন। (ঋক-১০/৭১/৪)
পণ্ডিত সমাজে কোন কোন ব্যক্তির এ প্রতিষ্ঠা হয় যে সে উত্তম ভাবগ্রাহী, তাঁকে ছেড়ে কোন কার্য হয় না। কেউ বা পুষ্পফল বিহীন অর্থাৎ অসারবাক্য অভ্যাস করে, তার যে বাক্য তা যেন বাস্তবিক দুগ্ধপ্রদ গাভী নয়, কাল্পনিক মায়াময় গাভী মাত্র। (ঋক-১০/৭১/৫)
যখন অনেক স্তোতা (‘ব্রহ্ম’ বা স্তোত্র উচ্চারণকারী) একত্র হয়ে মনের ভাব সমস্ত হৃদয়ে আলোচনা পূর্বক অবধারিত করতে প্রবৃত্ত হন তখন কোন কোন ব্যক্তির কিছুই জ্ঞান জন্মে না। কেউ কেউ স্তোত্রজ্ঞ (‘ব্রহ্ম’ বা স্তোত্রবিশারদ) বলে পরিচিত হয়ে সর্বত্র বিচরণ করেন। (ঋক-১০/৭১/৮)
এ যে সকল ব্যক্তি যারা ইহকাল বা পরকাল কিছুই পর্যালোচনা করে না, যারা স্তুতি প্রয়োগ বা সোমযাগ কিছুই করে না, তারা পাপযুক্ত অর্থাৎ দোষাশ্রিত ভাষা শিক্ষা করে নির্বোধ ব্যক্তির ন্যায় কেবল লাঙ্গল চালনা করবার উপযুক্ত হয় অথবা তন্তুবায়ের কার্য করবার উপযুক্ত হয়। (ঋক-১০/৭১/৯)
[বাগ্দেবীর উক্তি]
আমি রুদ্ধগণ ও বসুগণের সঙ্গে বিচরণ করি, আমি আদিত্যদের সঙ্গে এবং সকল দেবতাদের সঙ্গে থাকি, আমি মিত্র ও বরুণ এ উভয়কে ধারণ করি, আমিই ইন্দ্র ও অগ্নি এবং দুই অশ্বিদ্বয়কে অবলম্বন করি। (ঋক-১০/১২৫/১)
আমি রাজ্যের অধিশ্বরী, ধন উপস্থিত করেছি, জ্ঞানসম্পন্ন এবং যজ্ঞোপযোগী বস্তু সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরূপে আমাকে দেবতারা নানা স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন, আমার আশ্রয়স্থান বিস্তর, আমি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছি। (ঋক-১০/১২৫/৩)
আমিই সকল ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই। আমার মহিমা এরূপ বৃহৎ হয়েছে যে দ্যুলোককেও অতিক্রম করেছে, পৃথিবীকেও অতিক্রম করেছে। (ঋক-১০/১২৫/৮)
তবে নিরুক্ত-ব্যাকরণাদির লক্ষ্য বৈদিক পদসমূহের অর্থ নির্ধারণ হলেও একমাত্র মীমাংসাশাস্ত্রই বৈদিক বাক্যের অর্থ নির্ধারণে নিয়োজিত বলে মীমাংসকদের ভাষ্য। তাই বৈদিক বাক্যের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য মীমাংসাশাস্ত্রের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পদের অর্থ নির্ধারিত হলেই তো বাক্যের অর্থ তা থেকেই নির্ধারিত হতে পারে; কারণ বাক্য তো পদসমূহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এর উত্তরে বলা হয়, সাধারণ বাক্যের ক্ষেত্রে একথা অনেকাংশে সত্য হলেও বৈদিক বাক্যের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। কারণ অনেক বৈদিক বাক্য আছে যার অর্থ পদের অর্থ থেকে কোনভাবেই নির্ধারিত হয় না। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘চত্বারি শৃঙ্গা’ (ঋগ্বেদ-৪/৫৮/৩) এই মন্ত্রের পদগত শক্যার্থ হলো ‘চারটি শিং’। উল্লিখিত ঋকটির পূর্ণরূপ হলো-
প্রশ্ন উঠতে পারে, পদের অর্থ নির্ধারিত হলেই তো বাক্যের অর্থ তা থেকেই নির্ধারিত হতে পারে; কারণ বাক্য তো পদসমূহ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এর উত্তরে বলা হয়, সাধারণ বাক্যের ক্ষেত্রে একথা অনেকাংশে সত্য হলেও বৈদিক বাক্যের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। কারণ অনেক বৈদিক বাক্য আছে যার অর্থ পদের অর্থ থেকে কোনভাবেই নির্ধারিত হয় না। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘চত্বারি শৃঙ্গা’ (ঋগ্বেদ-৪/৫৮/৩) এই মন্ত্রের পদগত শক্যার্থ হলো ‘চারটি শিং’। উল্লিখিত ঋকটির পূর্ণরূপ হলো-
‘চত্বারি শৃঙ্গা ত্রয়ো অস্য পাদা দ্বে শীর্ষে সপ্ত হস্তাসো অস্য।
ত্রিধা বদ্ধো বৃষভো রোরবীতি মহো দেবো মত্যাঁ আ বিবেশ।।’ (ঋক-৪/৫৮/৩)
অর্থাৎ : এঁর চারটি শৃঙ্গ, এঁর তিনটি পাদ, দুটি মস্তক, সাতটি হস্ত। ইনি অভীষ্টবর্ষী, ইনি তিন প্রকারে বদ্ধ হয়ে অত্যন্ত শব্দ করছেন। মহতী দেবতা মর্ত্যগণের মধ্যে প্রবেশ করছেন।
মীমাংসকরা বলেন, ‘লক্ষণার্থের দ্বারা এর অর্থ হয় চারটি শিং, তিনটি পা, দুটি মাথা ও সাতটি হাতবিশিষ্ট কোন কিছু বা এমন কোন প্রাণী। কিন্তু এই অর্থ উক্ত বৈদিক বাক্যের যথার্থ অর্থ নয়। রূপক অর্থেই এই বৈদিক বাক্যটিকে গ্রহণ করতে হয়। যজ্ঞের অঙ্গ নির্দেশ করতেই এই বাক্যটি বেদে উক্ত হয়েছে। যজ্ঞের চার প্রধান ঋত্বিক হলেন চারটি শিঙ। সোমযজ্ঞের তিন অধিবেশন হলো যজ্ঞের তিনটি পা, যজমান ও তাঁর পত্নী হলেন দুটি মাথা এবং গায়ত্রী ইত্যাদি সাতটি ছন্দ হলো যজ্ঞের সাতটি হাত। এই দৃষ্টান্ত একথাই প্রমাণ করে যে, বৈদিক বাক্যের অর্থ নির্ধারণে মীমাংসাশাস্ত্রের গুরুত্ব অত্যাধিক।’- (প্রদ্যোত কুমার মন্ডল/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৭৬)
মজার বিষয় হলো, বৈয়াকরণ পতঞ্জলি মনে করেন উপরিউক্ত মন্ত্রটি ব্যাকরণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। কেননা, মন্ত্রকে যজ্ঞে প্রয়োগ করবার সময় কোনও কোনও ক্ষেত্রে পদের লিঙ্গ বিভক্তি প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। ব্যাকরণ না জানলে পদের অর্থগ্রহণ করা সহজ হয় না, ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখাও প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে ব্যাকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই মন্ত্রটি যে ব্যাকরণকে উদ্দেশ্য করেই বলা, পতঞ্জলির এই মতের সাথে বিখ্যাত বেদ-ভাষ্যকার সায়ণাচার্যও একই মত প্রকাশ করে তাঁর ‘ঋগ্বেদ ভাষ্যোপক্রমণিকায়’ এই মন্ত্রটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন-
‘চারটি শৃঙ্গ অর্থে এর চারটি পদ আছে। তিনটি পাদ হচ্ছে তিন কাল। দুই শীর্ষ হচ্ছে সুবন্ত এবং তিঙন্ত প্রত্যয়। সাতটি হাত হচ্ছে সাতটি বিভক্তি। রোরবীতির অর্থ শব্দকর্মক ধাতূ।’- (সূত্র: ড. হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়/ঋগ্বেদ-সংহিতা (প্রথম খন্ড), ঋগ্বেদ পরিচয়, পৃষ্ঠা-২৭)
কিন্তু যজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে অবান্তর কোনো কিছুকে মীমাংসকরা স্বীকার করেন না। মীমাংসা দর্শনে বিচারের কেন্দ্রস্থল হলো ধর্ম অর্থাৎ বেদপ্রতিপাদ্য অর্থ বা বিষয়। মীমাংসা দর্শনের সূত্রকার জৈমিনি’ তাঁর ‘মীমাংসাসূত্র’-এর শুরুতেই বলেছেন যে ধর্মজিজ্ঞাসা মীমাংসাশাস্ত্রের প্রয়োজন-
‘অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা’।- (মীমাংসাসূত্র : ১/১/১)
অর্থাৎ : এবার ধর্মজিজ্ঞাসা আরম্ভ হচ্ছে।
তাহলে ধর্ম কী ? এখানে ধর্ম বলতে কোন ধর্মমত বোঝানো হয়নি বা সমাজকে ধারণ করে যে সব আচার-আচরণ, আইন-কানুন তাও নয়। জৈমিনি তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে এই ধর্ম কী তার উত্তর দিয়েছেন-
‘চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্ম’।- (মীমাংসাসূত্র : ১/১/২)
অর্থাৎ : চোদনা লক্ষণ অর্থাৎ চিহ্ন বা জ্ঞাপক যার সেই বিষয়ই ধর্ম।
‘চোদনা’ শব্দের মীমাংসাসম্মত অবিসংবাদিত অর্থ হলো প্রবর্তক বাক্য। তবে যে কোন প্রবর্তক বাক্য নয়, প্রবর্তক বেদবাক্য দ্বারা সূচিত বিষয়ই ধর্ম। অর্থাৎ বেদই হচ্ছে প্রেরণা এবং তার কথাই ধর্ম। জৈমিনি এখানে ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে চেয়ে তার জন্য যুক্তি তর্ককে প্রাধান্য না দিয়ে বেদের সেই বাণীকেই মুখ্য বলেছেন যাতে কর্মের প্রেরণা পাওয়া যায়। বেদের মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ অংশে এরূপ প্রেরণার (চোদনা) সংখ্যা সত্তরটির কাছাকাছি বলে পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। এগুলিকে বিধি বলা হয়।
[পরের পর্ব : বিধি ও অর্থবাদ]
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ