মীমাংসার একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত হলো- ‘আম্লায়স্য ক্রিয়ার্থত্বম্’- অর্থাৎ, বেদের তাৎপর্য হলো ক্রিয়া।
এখানে ক্রিয়া বলতে যাজ্ঞিক ক্রিয়াকলাপ বোঝাচ্ছে। কিন্তু কেন যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? যেহেতু বেদে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের নির্দেশ রয়েছে তাই যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান বেদ নির্দেশিত বলে তা করতে হবে। মীমাংসকরা বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানকে অনুমোদন করলেও এই সব যাগযজ্ঞ দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য করতে হবে তা সমর্থন করেন না। তবে কোনো কর্তব্য সম্পাদন করলে কর্তব্য সম্পাদনে যে ফল লাভ হয় এ কথা মীমাংসকরা বিশ্বাস করেন। তাই লৌকিক শুভকর্ম এবং বেদ-বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা মানুষ ঐহিক ও পারলৌকিক শুভফল লাভ করতে পারে। এই ফল কোন ঈশ্বর প্রদান করে না, কেননা মীমাংসা-মতে কর্তব্য কোনো বেদ নিহিত ঈশ্বরের আদেশ নয়। মীমাংসকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এবং তাঁরা ‘ঈশ্বর’ নামের কোনো অতি-প্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে কর্তব্য-কর্মের ফললাভ হয় কর্ম নিয়ম অনুসারে। কিন্তু এই কর্ম নিয়ম কী ?
এখানে ক্রিয়া বলতে যাজ্ঞিক ক্রিয়াকলাপ বোঝাচ্ছে। কিন্তু কেন যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? যেহেতু বেদে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের নির্দেশ রয়েছে তাই যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান বেদ নির্দেশিত বলে তা করতে হবে। মীমাংসকরা বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানকে অনুমোদন করলেও এই সব যাগযজ্ঞ দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য করতে হবে তা সমর্থন করেন না। তবে কোনো কর্তব্য সম্পাদন করলে কর্তব্য সম্পাদনে যে ফল লাভ হয় এ কথা মীমাংসকরা বিশ্বাস করেন। তাই লৌকিক শুভকর্ম এবং বেদ-বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা মানুষ ঐহিক ও পারলৌকিক শুভফল লাভ করতে পারে। এই ফল কোন ঈশ্বর প্রদান করে না, কেননা মীমাংসা-মতে কর্তব্য কোনো বেদ নিহিত ঈশ্বরের আদেশ নয়। মীমাংসকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এবং তাঁরা ‘ঈশ্বর’ নামের কোনো অতি-প্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে কর্তব্য-কর্মের ফললাভ হয় কর্ম নিয়ম অনুসারে। কিন্তু এই কর্ম নিয়ম কী ?
ভারতীয় দর্শন পরম্পরায় কার্য-কারণ তত্ত্ব অনুযায়ী কর্ম কারণ হলে কার্য হিসেবে ফল থাকবে। মীমাংসা-মতে যজ্ঞকর্মই যজ্ঞফলের অদ্বিতীয় কারণ। যজ্ঞফল হলো বেদ-নির্দেশিত যে কামনায় কোন যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়। যেমন বেদ-বিধিতে বলা আছে- ‘অগ্নিহোত্রম্ জুহুয়াৎ স্বর্গকামঃ’- অর্থাৎ, ‘স্বর্গের কামনায় অগ্নিহোত্র করো’ প্রভৃতি।
তবে যজ্ঞকর্মই যজ্ঞফলের অদ্বিতীয় কারণ- সুপ্রাচীন কালের যাজ্ঞীকদের কাছে শুধুমাত্র এই বিশ্বাসই হয়তো পর্যাপ্ত ছিলো। তাই ব্রহ্মবাদী মহর্ষি বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রের প্রকরণে জৈমিনিমতের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন-
‘ধর্ম্মং জৈমিনিরত এব।’- (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৪০)
অর্থাৎ : আচার্য্য জৈমিনি ধর্ম অর্থাৎ অনুষ্ঠানকেই (কর্মকে) ফলদাতা বলে থাকেন। এইহেতু স্বর্গকামাদি শ্রুতির অর্থও সঙ্গত হয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে মীমাংসকদের কাছে স্বভাবতই তা আর সম্ভব হয়নি। কেননা, তাঁরা দার্শনিক; অতএব, ইতোমধ্যেই অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ-জাতীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যে-সব দার্শনিক আপত্তি উঠেছে সেগুলির উত্তর দিয়ে মীমাংসকদের পক্ষে এই বিশ্বাসটি প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়োজন হয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বর্গাদিফলের কারণরূপে যাগ-যজ্ঞাদিকে গ্রহণ করা কিভাবে সম্ভবপর ? কারণ তো কার্যের অব্যবহিত পূর্বক্ষণে বর্তমান থাকা চাই। অন্যদিকে বেদবিহিত যাগাদিকে স্বর্গাদির কারণরূপে স্বীকার না করলে সেইসব বেদবাক্যের অপ্রামাণ্য ঘটে। অতএব ক্ষণমাত্রস্থায়ী যাগাদি অনুষ্ঠান থেকেই স্বর্গাদি ফল যাতে উৎপন্ন হতে পারে, সেরূপ কিছু কল্পনা করতে হয়। সেরূপ কিছু কল্পনা করতে গেলেই অর্থাপত্তি-প্রমাণের বলে যাগক্রিয়া এবং স্বর্গাদি ফলের মধ্যবর্তী অপর একটি পদার্থ স্বীকার না করলে চলে না। সেই পদার্থকেই অপূর্ব, অদৃষ্ট, অতিশয় প্রভৃতি শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এভাবেই তাঁরা ‘অপূর্ববাদ’ নামের একটি দার্শনিক তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। জৈমিনির মীমাংসাসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম পাদের পঞ্চমসূত্রের ওপর শাবরভাষ্য এবং এই ভাষ্যের ওপর কুমারিল-কৃত তন্ত্রবার্তিক টীকায় বিস্তৃতভাবে অপূর্ববাদের আলোচনা করা হয়েছে।
.
উল্লেখ্য, প্রাচীন মীমাংসকদের ‘অপূর্ব’ নৈয়ায়িক পরিভাষায় দাঁড়িয়েছে ‘অদৃষ্ট’। সুতরাং অপূর্ববাদকে সাধারণভাবে অদৃষ্টবাদও বলা যায়। যদিও ‘অদৃষ্ট’ কথাটির প্রচলিত সাধারণ অর্থ পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়তি বা ভাগ্য এবং অদৃষ্টবাদের সাধারণ প্রচলিত ধারণা হলো নিয়তিবাদ, তবু বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে অপূর্ব বা অদৃষ্টের মূল দার্শনিক অর্থ নিয়তি বা ভাগ্য নয়। অদৃষ্টবাদের সঙ্গে জন্মান্তরবাদ মিলিত হয়ে ‘অদৃষ্ট’ শব্দটির অর্থবিকার ঘটেছে। তাহলে অপূর্ব বা অদৃষ্টের মৌলিক দার্শনিক অর্থ কী ? নৈয়ায়িক আচার্য উদয়নও তাঁর ‘কুসুমাঞ্জলি’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘চিরধ্বস্তং ফলায়ালং য কর্ম্মাতিশয়ং বিনা।’- (কুসুমাঞ্জলি)
অর্থাৎ : অনেক কাল পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত কর্ম মধ্যবর্তী অতিশয় (অদৃষ্ট) ব্যতীত ফলপ্রদানে সমর্থ হয় না।
কোন কর্ম করলে তৎক্ষণাৎ ফল পাওয়া যায় এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মের পর ফলের জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। কর্ম ক্ষণস্থায়ী, অর্থাৎ ভঙ্গুর। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো, ফলটা পাওয়া যাচ্ছে দুমাস বা দুবছর পর। কর্মটা হলো কারণ, ফলটা তার কার্য। কর্ম ও ফলের মধ্যে এই কালিক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দুয়ের মধ্যে যোগসূত্রটা কী করে বজায় থাকে ? যোগসূত্র বা বন্ধনী সেতু না থাকলে কার্যকারণসম্পর্কটাই বা কী করে বজায় থাকে ? এই সেতুবন্ধনটি তো সবসময় আমাদের দৃষ্টিগোচর নয়। যেমন, কৃষিকর্ম আর ফসলফলন, ঘৃতসেবন আর শরীরের পুষ্টিসাধন, অধ্যয়ন আর জ্ঞানসঞ্চয়ন। মীমাংসক কুমারিল ভট্ট এসব কৃষিকর্মাদি লৌকিক উদাহরণ দিয়ে বলেন,-
কৃষকের কৃষিকর্মের প্রভাব আমাদের দৃষ্টির অগোচরে বীজের মধ্যে প্রতিক্ষণে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটাচ্ছে আর পুঞ্জিত ফলশ্রুতি হলো ফসলের আবির্ভাব। অনুরূপভাবেই শরীরের মধ্যে অলক্ষ্য প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ঘৃতসেবন শরীরের পুষ্টিসাধনে পরিণত হয়। অধ্যয়ন জ্ঞানলাভে সার্থকতা প্রাপ্ত হয়। কর্মের এই অলক্ষ্য-সঞ্চারিণী শক্তি বা প্রভাবকেই বলা হয় অপূর্ব, যা আপাতবিচ্ছিন্ন কর্ম ও ফলের মধ্যে অদৃশ্য যোগাযোগ রক্ষা করে।- (তন্ত্রবার্তিক)
অবশ্য কুমারিল একথাও বলেছেন যে ‘অপূর্ব’ শব্দটি সাধারণত কৃষিকর্মাদি লৌকিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় না, যাগযজ্ঞাদি ধর্মীয় কর্মেই ব্যবহৃত হয়।
.
কর্ম ও ফলের মধ্যবর্তী এই অবস্থাকে কর্মসংস্কারও বলে। অপূর্ব, অদৃষ্ট, কর্মশক্তি বা কর্মসংস্কার মূলত একই কথা। নৈয়ায়িকরা অদৃষ্ট বা কর্মসংস্কারকে শক্তি না বলে ব্যাপার বলেন। কিন্তু মীমাংসকরা শক্তি কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। তাদের মতে শক্তি একটি মৌলিক পদার্থ। নৈয়ায়িকরা একথা স্বীকার করেন না। মীমাংসা-মতে অপূর্ব এক ধরনের শক্তি যা কর্ম থেকে উৎপন্ন হয় এবং ফললাভ পর্যন্ত অলক্ষ্যে কাজ করে যায়। একেই আবার বলা হয় কর্মের পরিণাম বা বিপাক। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, কর্মের পরবর্তী এবং ফলপ্রাপ্তির পূর্ববর্তী কর্মজনিত অলক্ষ্য সূক্ষ্ম প্রভাব, শক্তি বা সংস্কারকে বলা হয় অপূর্ব বা অদৃষ্ট, যা কর্ম ও ফলের মধ্যে কার্যকারণসম্বন্ধীয় যোগাযোগ রক্ষা করে। ‘তন্ত্রবার্ত্তিকে’ ভট্টপদ কুমারিল বলেছেন-
‘কর্ম্মভ্যঃ প্রাগযোগ্যস্য কর্ম্মণঃ পুরুষস্য বা।
যোগ্যতা শাস্ত্রগম্য যা পরা সাহপূর্ব্বমিষ্যতে।।’- (তন্ত্রবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : প্রধান কর্ম অনুষ্ঠানের পূর্বে অনুষ্ঠাতা ব্যক্তি স্বর্গাদি ফল লাভের অযোগ্য থাকেন এবং অঙ্গ কর্মের অনুষ্ঠানের পূর্বে অনুষ্ঠেয় যাগাদি কর্মও ফল উৎপাদনের অযোগ্য থাকে। প্রধান কর্ম ও অঙ্গ কর্ম অনুষ্ঠিত হলেই অনুষ্ঠাতা ব্যক্তি ও অনুষ্ঠিত কর্ম উভয়েরই যোগ্যতা জন্মে। অতএব অনুষ্ঠাতা ব্যক্তি ও অনুষ্ঠিত কর্মে যে যোগ্যতা থাকে, তাকেই শাস্ত্রে অপূর্বাদি শব্দে অভিহিত করা হয়।
যেহেতু মীমাংসকরা বৈদিক যাগযজ্ঞের দ্বারা অভীষ্ট ফললাভে বিশ্বাসী, তাই অদৃষ্টের একটি সুন্দর বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্মত লৌকিক দৃষ্টান্তকে একটা অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস যাগযজ্ঞের ক্ষেত্রে টেনে নিয়ে গেছেন অনায়াসে। কেননা যজ্ঞসমাপ্তি ও ফললাভের মধ্যবর্তীকালে যজ্ঞকর্মজনিত একটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া বা প্রভাব বিশ্বাস করতে এরা হয়তো বদ্ধপরিকর। ধর্মকর্মজনিত অলক্ষ্যপ্রভাব বা শক্তির পারিভাষিক নামকরণ করলেন- ‘অপূর্ব’, যা কর্মের পূর্বে থাকে না, কর্মের পরে উৎপন্ন হয় ও ফলপ্রাপ্তিতে শেষ হয়। মীমাংসকরা বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি শুভকর্ম এবং তার কল্যাণকর প্রভাব বা অপূর্ব- এই দুটোরই নাম দিয়েছেন ‘ধর্ম’। এই ধর্মই হলো বেদের ‘অর্থ’ বা তাৎপর্য। ‘অর্থ’ মানে ইষ্ট, যা ‘অনর্থ’ বা অনিষ্টের বিপরীত। একথা বলার উদ্দেশ্য হলো- মারণ উচাটন প্রভৃতি অভিচারকর্ম অর্থাৎ শ্যেনযাগ, ইষুযাগ, বজ্রযাগ প্রভৃতি যা অন্যের অনর্থ বা অনিষ্টসাধনে প্রযুক্ত হয়, বেদে তার বিধান থাকলেও এ-জাতীয় যজ্ঞগুলি ও তজ্জনিত অশুভ প্রভাবকে ‘ধর্ম’ বলা যাবে না। শবরস্বামীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হলো, এসব অধর্ম। নৈয়ায়িকরাও তাই অদৃষ্ট বলতে বোঝেন ধর্মাধর্ম। শুভকর্মের শুভ প্রভাব ধর্ম, অশুভ কর্মের অশুভ প্রভাব অধর্ম। ধর্মাধর্ম হলো কর্মের সংস্কার বা ব্যাপার। এরই আর এক নাম যথাক্রমে পুণ্য ও পাপ।
.
মীমাংসার এই অপূর্ববাদের বিপক্ষে আপত্তিও উত্থাপিত হয়েছে। যেমন অদ্বৈতবেদান্তী শঙ্করাচার্য মীমাংসা-মতের সমালোচনায় বলেন, শুধুমাত্র কর্ম থেকেই কর্মফলের উৎপত্তি হতে পারে না, কেননা কর্ম ক্ষণ-বিনাশী এবং কর্মফল কালান্তরভাবী- অতএব, অভাবগ্রস্ত কর্ম থেকে কর্মফলের উদ্ভব অসম্ভব।
মীমাংসকরা হয়তো এ-জাতীয় আপত্তির আশঙ্কা অনুভব করেছিলেন আগেই। তাই শাবরভাষ্যে (২/১/৫) শবরস্বামী বলছেন,-
মীমাংসকরা হয়তো এ-জাতীয় আপত্তির আশঙ্কা অনুভব করেছিলেন আগেই। তাই শাবরভাষ্যে (২/১/৫) শবরস্বামী বলছেন,-
‘যাগ ক্রিয়া-বিশেষ, ক্রিয়া আবার ক্ষণিক- উৎপত্তির পরক্ষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়; কিন্তু যাগক্রিয়ার ফল ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপন্ন হয় না। অনেক পরে উৎপন্ন হয়। অতএব যাগক্রিয়াকেই কী ভাবে ফল-উৎপাদক বলা যায় ? অথচ বিধি আছে ‘দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত’; তাই স্বীকার করতেই হবে দর্শপূর্ণমাস নামের যাগ স্বর্গফলের সাধন। কীভাবে তা সম্ভব হতে পারে ? ‘অপূর্ব’-র দরুন সম্ভব হয়। যাগক্রিয়া একটি অদৃশ্য শক্তি উৎপাদন করে, তারই নাম অপূর্ব। ক্রিয়া বিনষ্ট হলেও এই শক্তিটি কার্যকরি থাকে এবং এই শক্তিই শেষ পর্যন্ত ফল সৃষ্টি করে।’- (শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-২/১/৫)
অর্থাৎ, মীমাংসকদের কাছে অপূর্বর প্রমাণ বলতে অর্থাপত্তি : যাগ ক্ষণস্থায়ী, তা থাকে না; অথচ বেদ অনুসারে যাগ থেকে স্বর্গাদি ফল উৎপন্ন হয়। বেদ ভ্রান্ত হতে পারে না; অতএব মানতেই হবে যাগ এবং স্বর্গাদি-ফল উভয়ের মধ্যে শক্তিবিশেষ উৎপন্ন হয়।– (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৫৪)।
উল্লেখ্য, মীমাংসাসম্মত অপূর্ব কোনো এক অদৃশ্য শক্তি হলেও সে-শক্তি সম্পূর্ণ অচেতন বা জড়শক্তি বলেই পরিকল্পিত। তাই মীমাংসা-খণ্ডন প্রসঙ্গে বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্য বলেন-
‘অপূর্বস্যাচেতনস্য কাষ্ঠলোষ্ট্রসমস্য চেতনাপ্রবর্তিতস্য প্রবৃত্ত্যনুপপত্তেঃ’-অর্থাৎ, যে-অপূর্ব কাষ্ঠলোষ্ট্রের সমান অচেতন এবং যা চেতন-প্রেরিত নয় তার পক্ষে প্রবৃত্তি (অর্থাৎ ফলদানে উন্মুখ) হওয়া অসম্ভব।
.
চেতন-প্রবর্তিত না হয়েও কোনো নিছক জড়শক্তির কার্যকারিতা একান্তই সম্ভব কিনা- বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ হলেও সম্ভবত অধ্যাত্মবাদের আশঙ্কার নিবৃত্তির উদ্দেশ্যেই মীমাংসকেরা এই ‘অপূর্ব’ তত্ত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপণ করেছিলেন। কেননা, তা না হলে স্বীকার করা যায় না যে কর্ম থেকেই কর্মফলের উদ্ভব হয়, বরং স্বীকার করার আশঙ্কা থাকে কর্ম-জনিত ঈশ্বরের করুণা থেকে কর্মফলের উদ্ভব, অর্থাৎ ঈশ্বরই প্রকৃতপক্ষে কর্মফলদাতা। তাই ভট্টপদ কুমারিল তন্ত্রবার্ত্তিকে বলেন-
‘প্রমাণবন্ত্যদৃষ্টানি কল্প্যানি সুবহূন্যপি।
অদৃষ্টশতভাগোহপি না কল্প্যো নিষ্প্রমাণকঃ।।’- (তন্ত্রবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : নিরর্থক কোন কল্পনা করতে নেই, বরং প্রয়োজনবশত সার্থক কল্পনায় গৌরব (অতি-দোষ) হলেও সেই গৌরব স্বীকারের প্রয়োজন অর্থাৎ বিশেষ ফল আছে বলে তা ফলমুখ গৌরব। অতএব দোষের নয়।
ধারণা করা যায়, কর্মফল তথা যজ্ঞফলের প্রতি মীমাংসকদের এক আদিম জাদুবিশ্বাসময় দার্শনিক সমর্থনযুক্ত এই অপূর্ববাদ উদ্ভাবনের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য হলো কর্মফলের দাতারূপে কোনো দেবতা বা ঈশ্বরের ভূমিকাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা। তাই কুমারিল ভট্ট তন্ত্রবার্তিকে বলেন,- যাগার্জিত শক্তি (অপূর্ব)দ্বারা সাধিত হওয়া আর যাগের দ্বারা সাধিত হওয়া একই কথা। যা কিছু ইষ্টফল আর যা কিছু ইষ্টফলের সাধন, এই দুয়ের অন্তরালে সাধনের (যা দ্বারা কোনোকিছু সাধিত হয়) একটা ব্যাপার বা প্রভাবের উপস্থিতি অপরিহার্য। সাঁচ দিয়ে দই পাতলে অসংখ্য সূক্ষ্ম ক্রমিক পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুধ দই-এ পরিণতি লাভ করে। হঠাৎ হয় না। এটাই বস্তুস্বভাব। বীজ থেকে বৃক্ষ পর্যন্ত অন্তরালবর্তী অনেক সূক্ষ্মাবস্থা পার হয়েই বীজ একসময় বৃক্ষে পরিণত হয়। যাগযজ্ঞ থেকে এভাবেই স্বর্গ প্রভৃতি ফল উৎপন্ন হয়। লৌকিক দৃষ্টান্ত অনুসারে এটাও স্বাভাবিক নিয়মে হবে। অর্থাৎ এজন্য কোনো দেবতার হস্তক্ষেপ বাহুল্য মাত্র।
.
গুরু প্রভাকরও অপূর্ব স্বীকার করেন। তবে তিনি অপূর্ব না বলে বলেছেন- ‘নিয়োগ’। তাঁর মতে বৈদিক লিঙ্ প্রভৃতি আখ্যাত প্রত্যয়-থেকেই নিয়োগরূপ অর্থও জানা যায়। নিয়োগ ধাতুর অর্থ নয়। নিয়োগই কালান্তরভাবী ফলের জনক।
.
অতএব, জৈমিনির সুপ্রসিদ্ধ মত হিসেবে, কর্ম ও ফলের মধ্যে ব্যবধান ঘোচাবার জন্য দৈবানুগ্রহ নিষ্প্রয়োজন, অন্তরালবর্তী অপূর্ব-ই যথেষ্ট- আদিম জাদুবিশ্বাসের এই দার্শনিক সমর্থনটি একদিক থেকে যতো অসম্ভব বা আজগুবি বলেই প্রতীত হোক না কেন, অপরদিক থেকে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের সঙ্গে মীমাংসার ঐকান্তিক বিরোধটিই এখানে পরিলক্ষিত হয়।
[পরের পর্ব : মীমাংসামতে ঈশ্বর]
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ