মীমাংসা-মতে স্বর্গ ও মোক্ষ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

মীমাংসা-মতে স্বর্গ ও মোক্ষ

মীমাংসা-শাস্ত্রে যজ্ঞকর্মকেই যজ্ঞফলের অদ্বিতীয় কারণ বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু যজ্ঞকর্ম যেহেতু ক্ষণিক এবং এর ফল ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপন্ন হয় না, তাই প্রশ্ন আসে, যজ্ঞক্রিয়াকে কীভাবে ফল-উৎপাদক বলা যায় ? যেমন, বেদের বিধিতে বলা হয়- ‘দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত’- অর্থাৎ, স্বর্গকামী ব্যক্তি দর্শপূর্ণমাস নামের যজ্ঞ করবেন। এই স্বর্গফল প্রাপ্তি কীভাবে সম্ভব হতে পারে ? যজ্ঞের এই ফল-উৎপাদক শক্তিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মীমাংসকরা ‘অপূর্ব’ নামের একটি অদৃষ্ট-শক্তির ধারণা আনয়ন করেন। এই ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, যজ্ঞক্রিয়া বিনষ্ট হলেও তার মাধ্যমে সৃষ্ট অপূর্ব-শক্তিটি কার্যকরি থাকে এবং এই শক্তিই শেষ পর্যন্ত ফল সৃষ্টি করে। বেদ যেহেতু ভ্রান্ত হতে পারে না, এবং বেদ অনুসারে যাগ থেকে স্বর্গাদি ফল উৎপন্ন হয় উল্লেখ আছে, অতএব মানতেই হবে যাগ এবং স্বর্গাদি-ফল উভয়ের মধ্যে শক্তিবিশেষ উৎপন্ন হয়।

যেহেতু মীমাংসকরা কোনো লোকোত্তর ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, তাই যজ্ঞকর্ম থেকে উৎপন্ন কাষ্ঠলোষ্ট্রের সমান অচেতন অপূর্ব থেকে ফলপ্রাপ্তি জাতীয় কথা আসলে আদিম জাদুবিশ্বাসের দার্শনিক সমর্থন বলা যায়। এখন প্রশ্ন হলো মীমাংসা-মতে স্বর্গ বলতে কী বোঝায় ? 
.
স্বর্গ :
স্বর্গ এবং নরক সম্বন্ধে বহুবিধ মতবাদ প্রচলিত। স্বর্গের লোভ এবং নরকের ভীতি প্রায় প্রত্যেকের অন্তরেই বিদ্যমান। স্বর্গপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যেই হিন্দুগণ অধিকাংশ কাম্যকর্মের অনুষ্ঠান করে থাকে। মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধাদি কর্মের উদ্দেশ্যও মৃতের আত্মার স্বর্গপ্রাপ্তি। আমাদের কল্পনায় স্বর্গ পরম ঈপ্সিত এবং নরক অত্যন্ত হেয় ও ভীতিপ্রদ। মুক্তিকাম ব্যক্তি ব্যতীত সকলের নিকটই স্বর্গ পরম কাম্য।
.
মীমাংসাদর্শনে বলা হয়- যে-সব যাগের ফল বেদে কীর্তিত হয়নি, সেসব যাগের একটিমাত্র ফল কল্পনা করতে হবে। সেই ফলটি কী ? এই জিজ্ঞাসার উত্তরে মহর্ষি জৈমিনি বলছেন-  
‘স স্বর্গঃ স্যাৎ সর্ব্বান্ প্রত্যবিশিষ্টত্বাৎ।’- (মীমাংসাসূত্র-৪/৩/১৫)
অর্থাৎ : সেই ফলটি হচ্ছে স্বর্গ; যেহেতু তা সকলের নিকট অবিশেষে ঈপ্সিত।
.
মীমাংসামতে স্বর্গ মানে সুখ বা প্রীতি হলেও মীমাংসকদের সিদ্ধান্ত খুব স্পষ্ট নয়। তবু শব্দটির নানবিধ অর্থ পাওয়া যায়। প্রাচীন আচার্য্যরা বলেন (সূত্র: সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা-দর্শন)-  
‘যন্ন দুঃখেন সংভিন্নং ন চ গ্রস্তমনন্তরম্ ।
অভিলাষোপনীতং যৎ তৎসুখং স্বঃপদাস্পদম্ ।।’
অর্থাৎ : যাতে দুঃখের লেশমাত্র নেই, উৎপত্তির পরক্ষণেই যার ধ্বংস হয় না এবং ইচ্ছামাত্রই যা উপস্থিত হয়, সেই সুখকে স্বর্গ বলে।
.
অভিধান থেকে জানা যায়- স্বঃ, অব্যয়, স্বর্গ, নাক, ত্রিদিব, ত্রিদশালয় প্রভৃতি শব্দ একার্থক। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় স্থান বা লোকবিশেষকেই স্বর্গ বলা হয়েছে, যেমন-  
‘তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং
ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্ত্যলোকঃ বিশন্তি।
এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না
গতাগতং কামকামা লভন্তে।। (গীতা-৯/২১)
অর্থাৎ : তাঁরা সেই বিপুল স্বর্গলোক উপভোগ করে পুণ্যক্ষয় (ভোগের দ্বারা পাপের ফল দুঃখ ও পুণ্যের ফল সুখ ক্ষয় হয়।) হলে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এভাবে ত্রিবেদোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ভোগকামী ব্যক্তিগণ সংসারে যাতায়াত করেন।
.
শাস্ত্রে চতুর্দশ লোক বা ভুবনের বর্ণনা থেকেও জানা যায়- ভূর্লোকের উর্ধ্বে ভুবর্লোক এবং ভুবর্লোকের উর্ধ্বে স্বর্গলোকের অবস্থিতি। বেদমন্ত্রে, ছান্দোগ্যাদি উপনিষদে এবং ইতিহাস পুরাণ প্রভৃতিতেও দেবলোক বা স্বর্গলোকের কথা বহুভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবার আচার্য সুরেশ্বর দেবলোকের দিব্যদেহ ব্যতীত নিরতিশয় স্বর্গসুখ ভোগ করা যায় না বলে বৃহদারণ্যকবার্ত্তিকে উল্লেখ করেছেন-  
‘কাম্যেহপি শুদ্ধিরস্ত্যেব ভোগসিদ্ধ্যর্থমেব সা।
বিড়বরাহাদিদেহেন ন হ্যৈন্দ্রং ভুজ্যতে ফলম্ ।।’- (সম্বন্ধবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : নিত্যকর্মের ন্যায় কাম্যকর্মেরও ফলভোগের নিমিত্তই চিত্তশুদ্ধি ও দেহশুদ্ধি আবশ্যক। শূকরাদির দেহে স্বর্গাদি ফল ভোগ করা যায় না। অর্থাৎ দিব্য ভোগের নিমিত্ত দিব্যদেহও আবশ্যক। কাম্যকর্মের ফলে দিব্য ভোগোপযোগী দিব্যদেহও লাভ হয়।
.
একইভাবে এই দেহে নরকভোগও সম্ভবপর হয় না বলে পাপীকে যাতনা সহ্য করবার উপযোগী কদর্য্য দেহও ধারণ করতে হয়। স্বর্গের বিপরীতে নরকের কল্পনা বা উল্লেখও বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে পাওয়া যায়। যেমন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-  
‘অনেকচিত্তবিভ্রান্তা মোহজালসমাবৃতাঃ।
প্রষক্তাঃ কামভোগেষু পতন্তি নরকেহশুচৌ।।- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৬/১৬)
অর্থাৎ : অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ অবিবেকমুগ্ধ হয় এবং বহু সংকল্পে বিক্ষিপ্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত ও বিষয়ভোগে আসক্ত হয়ে বিন্মুত্রাদিময় রৌরবাদি নরকে পতিত হয়।
.
গীতার বচনে ‘পতন্তি’ পদ থেকে বোঝা যায় নরক ভূর্লোকের অধোভাগে অবস্থিত, আর ‘অশুচৌ’ থেকে বোঝা যায় নরক অপবিত্র লোকবিশেষ। মহাভারতে বহুস্থানে নরক শব্দ পাওয়া যায়। আবার শ্রীমদ্ভাগবতে কপিলদেবহূতিসংবাদে পাওয়া যায়-  
‘অত্রৈব নরকঃ স্বর্গ ইতি মাতঃ প্রচক্ষ্যতে।
যা যাতনা বৈ নারক্যস্তা ইহাপ্যুপলক্ষিতাঃ।।’- (ভাগবত-৩/৩০/২৯)
অর্থাৎ : নরকযন্ত্রণা ইহলোকেও ভোগ করতে দেখা যায়। স্বর্গ ও নরক ইহলোকেই।
.
স্বর্গ ও নরক যে ইহলৌকিক, অনুরূপ একটি প্রাচীন উক্তিও পাওয়া যায় (সূত্র: সুখময় ভট্টাচার্য্য/ পূর্ব্বমীমাংসা-দর্শন,পৃষ্ঠা-৯৯)-  
‘ইহৈব স্বর্গনরকাবিতি মাতঃ প্রচক্ষ্যতে।
মনঃপ্রীতিকরঃ স্বর্গো নরকস্তদ্-বিপর্য্যয়ঃ।।’
অর্থাৎ : স্বর্গ ও নরক ইহলোকেই ভোগ্য। মনের প্রীতিকর বিষয়ই স্বর্গ এবং অপ্রীতিকর বিষয়ের নাম নরক।
.
এবং তার্কিক কবি শ্রীহর্ষও তাঁর নৈষধীয়চরিতে বলেছেন-  
‘দ্যৌর্ন কাচিদথবাস্তি নিরূঢ়া,
সৈব সা চলতি যত্র হি চিত্তম্ ।’- (নৈষধীয়চরিত-৫/৫৭)
অর্থাৎ : স্বর্গনামে প্রসিদ্ধ কোন স্থান বা অন্য কিছুই নেই। যে বিষয়ে যাঁর অনুরাগ থাকে, সেই বিষয়ই তাঁর নিকট স্বর্গ।
.
কিন্তু এসব আলোচনা থেকে কোন পরিষ্কার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। বিভিন্ন শাস্ত্র-পুরাণাদির বচনের আপাতলভ্য অর্থকে গ্রহণ না করে শুভ কর্মের প্রশংসা এবং অশুভ কর্মের নিন্দারূপ অর্থবাদ বলেই মীমাংসকগণ সামঞ্জস্য-বিধানের চেষ্টা করে থাকেন। তাই হয়তো মীমাংসক ভাষ্যকার শবরস্বামী বলেন-  
‘যদ্যপি কেবলং সুখশ্রবণার্থাপত্ত্যা তাদৃশো দেশঃ স্যাত্তথাপি অস্মৎপক্ষস্যাবিরোধঃ।’- (শাবরভাষ্য)
অর্থাৎ : শ্রুতিতে যে স্বর্গ শব্দ আছে, সেই শব্দ থেকে শ্রুতার্থাপত্তি-প্রমাণের বলে যদি কোন স্থানবিশেষও কল্পিত হয়, তবুও নিরতিশয় প্রীতিই যে স্বর্গ, আমাদের এ সিদ্ধান্তের সাথে বিরোধ হয় না।
.
তবে ভট্টপদ কুমারিল স্থানবিশেষকেই স্বর্গ বলেছেন। তিনি ভাষ্যকারের উক্তিকে বলেন-  অভ্যুপেত্যবাদ, অর্থাৎ আপাত কথনমাত্র। তিনি বলেছেন-  
‘যা প্রীতির্নিরতিশয়া অনুভবিতব্যা, সা চ উষ্ণশীতাদিদ্বন্দ্বরহিতে দেশে শক্যা অনুভবিতুম্ । অস্মিংশ্চ দেশে মুহূর্তশতভাগোহপি দ্বন্দ্বৈর্ন মুচ্যতে। তস্মান্নিরতিশয়াপ্রীত্যনুভবায় কল্প্যো বিশিষ্টো দেশঃ।’
অর্থাৎ : নিরতিশয়া যে প্রীতি অনুভব করতে হবে তা উষ্ণশীতাদি-দ্বন্দ্বরহিত স্থানেই অনুভব করা যেতে পারে। এই মর্ত্যলোকে মুহূর্তের শতাংশ কালও দ্বন্দ্বরহিত নয়। তাই নিরতিশয় প্রীতি অনুভব করবার নিমিত্ত বিশিষ্ট স্থান কল্পনা করতে হয়।
.
এখানে আবার প্রশ্ন ওঠে, স্বর্গ মানে যদি শুধু সুখই হয় এবং যেহেতু সুখ ইহকালেই সম্ভব তাহলে স্বর্গ বলে লোকোত্তর কিছু কি নেই ? এ বিষয়ে ভূতনাথ সপ্ততীর্থ শাবরভাষ্য (৬/১/২)-এর তর্জমায় মন্তব্য করেন-
মীমাংসকগণের এ বিষয়ে যথাযথ মত কী তাহা নিরূপণ করা দুরূহ। ভাষ্যের আপাতলভ্য অর্থে বুঝা যায়, স্বর্গ বা নরকভোগের জন্য স্বতন্ত্র স্থান বিশেষ অনাবশ্যক।’ (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৫৬)।


এই তথাকথিত আপাতলভ্য অর্থটিই যে প্রকৃত অর্থ হবে তার নজির হলো, মীমাংসা-মত খণ্ডনে বৈদান্তিকদের উত্থাপিত যুক্তির পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মতকে এই অর্থেই উপস্থাপন করা। যেমন, বেদান্তর বিবরণ প্রস্থানের ‘তত্ত্বদীপন’ টীকায় পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মত উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে-
‘কিং লোকবিশেষঃ স্বর্গঃ, উত সুখমাত্রম্ ? নান্যঃ, তত্র মানাভাবাৎ।’-
অর্থাৎ, লোকবিশেষকে স্বর্গ বলা যায় না, তাহাতে কোনো প্রমাণ নাই।
একইভাবে ‘বিররণপ্রমেয়সংগ্রহ’-তেও পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মত উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে-
‘অত্রৈব নরক-স্বর্গাবিতি মাতঃ প্রচক্ষতে। মনঃপ্রীতিকরঃ স্বর্গো নরকস্তাদ্বিপর্যয়ঃ’-
অর্থাৎ, স্বর্গ ও নরক ইহলোকেই ভোগ্য, আর নিরতিশয় যে প্রীতি তাহাই স্বর্গ এবং তদ্বিরুদ্ধ যে-দুঃখ তাহাই নরক।

এক্ষেত্রে, মীমাংসাসূত্র ৬/১/৩ শাবরভাষ্যের মূল প্রতিপাদ-বিষয়, স্বর্গাদি ফলই সাধ্য বা প্রধান, যাগাদি কর্ম তার কারণ বা গুণস্বরূপ। যুক্তি হলো, নিষ্ফল কর্মে পুরুষের প্রবৃত্তি উৎপাদন করতে পারে না। পক্ষান্তরে কর্ম ক্লেশাত্মক হওয়ায় পুরুষের প্রবৃত্তিকে প্রতিহত করে, অতএব, বিধিশক্তিকে কুণ্ঠিত করে। তাই, যজ্ঞকর্মের ফল যে স্বর্গ বা নিরতিশয় সুখ- অর্থাৎ, নিরতিশয় সুখই উদ্দেশ্য, যজ্ঞকর্ম তার উপায়মাত্র- এই বোধ সুদৃঢ় না হলে যজ্ঞকর্মমূলক বিধি শক্তিশালী হতে পারে না। (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩২৮)।
মীমাংসকদের এই অর্থবাদ ব্যাখ্যা অনুসারে মানতেই হয় যে, বেদোক্ত ‘স্বর্গকামো যজেত’ বিধিবাক্যটিকে মীমাংসকেরা ‘সুখকামো যজেত’ অর্থেই গ্রহণ করেছিলেন। শবরস্বামীর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অনুযায়ী মীমাংসা-দর্শনে এই বিধিবাক্যের উপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করায় সহজেই অনুমান হয়, মীমাংসা-মতে বস্তুত  সুখলাভই মানুষের চরম উদ্দেশ্য- যজ্ঞ এই সুখলাভের উপায়মাত্র।
.
মোক্ষ :
স্বর্গ নামের উৎকৃষ্ট সুখ যদি ইহলোকেই ভোগ্য হয়, তাহলে এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন ওঠে, মীমাংসা-মতে ইহলৌকিক সুখই কি পুরুষার্থ বা মোক্ষ বলে বিবেচিত হবে ? এখানে উল্লেখ্য, লোকায়ত চার্বাক-মতেও কিন্তু বলা হয়, সুখই পুরুষার্থ। যদিও লোকায়তিকরা যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদিকে পুরোহিত-শ্রেণীর প্রবঞ্চনামূলক উদ্ভাবন বলে বিদ্রূপ করেছেন। তাহলে আস্তিক-নিন্দিত লোকায়তিকদের সঙ্গে আস্তিক-অগ্রণী মীমাংসকদের পুরুষার্থ বিষয়ে মতপার্থক্য কোথায় ? পূর্ব-মীমাংসার নামান্তর কর্মমীমাংসা। বেদের ব্রাহ্মণভাগ বা কর্মকাণ্ডকে আশ্রয় করেই এই দর্শনের উদ্ভব। অতএব কর্মই মীমাংসার মূল আলোচ্য বিষয়। এবং কর্মের ফল স্বর্গ বা সুখ, মোক্ষ নয়। অতএব মীমাংসা-দর্শনে যুক্তিযুক্তভাবে মোক্ষের আদর্শ থাকা সম্ভব নয়। কিংবা কোনো মীমাংসক যদি মোক্ষকেই পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করতে চান তাহলে তাঁকে মীমাংসা-দর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে। এজন্যেই কি সূত্রকার মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসাসূত্রে মোক্ষের কোনো আলোচনা করেননি? এমনকি ভাষ্যকার শবরস্বামীর শাবরভাষ্যেও মোক্ষ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা বা উল্লেখ নেই। তাই মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ তর্কসাংখ্যবেদান্ততীর্থ তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন সমগ্র’-এ বলেন-
পূর্ব-মীমাংসা দর্শনের সূত্রকার জৈমিনি মোক্ষর কোনো আলোচনা করেন নাই। ধর্মের সাধন, স্বরূপ প্রভৃতির আলোচনাতেই জৈমিনি-সূত্র পর্যবসিত হইয়াছে।’ (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৫৮)।

প্রাচীন মীমাংসার আদিরূপটিতে যুক্তিযুক্তভাবেই মোক্ষের কোনো স্থান না থাকলেও কালক্রমে পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মধ্যে মোক্ষই পুরুষার্থ বলে স্বীকার করার ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। মীমাংসক প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্ট মোক্ষ বিষয়ে আলোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও তাঁদের অনুগামীরা ক্রমশই এ আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তারই ফলে তাঁরা ক্রমশই সুপ্রাচীন মীমাংসা-মতকে বেদান্ত বা প্রচ্ছন্ন-বেদান্তে পরিণত করেছেন। ‘প্রকরণপঞ্চিকায়’ শালিকনাথ মিশ্র বলছেন-  
‘আত্যন্তিকো দেহোচ্ছেদঃ নিঃশেষধর্ম্মাধর্ম্মপরিক্ষীণো মোক্ষঃ।’- (প্রকরণপঞ্চিকা)
অর্থাৎ : কর্মপ্রসূত সমস্ত ধর্মাধর্মের ঐকান্তিক বিলোপই মোক্ষ।

মজার বিষয় হলো, মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলে স্বীকার করা হলে কর্ম এবং ধর্মকর্ম সবকিছুই পরম পুরুষার্থেও অন্তরায় বলে বিবেচিত হতে বাধ্য এবং যদি তাই হয় তাহলে মীমাংসকদের কাছে মীমাংসা-দর্শনের মূল আলোচ্য-বিষয়ই বর্জনীয় হতে বাধ্য। তারপরও এই স্ববিরোধিতাই পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মধ্যে প্রকট হতে দেখা যায়। অর্থাৎ নামে মীমাংসক হলেও পরবর্তীকালের মীমাংসকেরা মীমাংসাকে বেদান্তনুগামী বা বেদান্তনুসারী করবারই প্রয়াস করেছেন। বস্তুত প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে এ-জাতীয় প্রয়াসের প্রকট পরিচয় পাওয়া যায়। সেজন্যেই গৌড় ব্রহ্মানন্দ তাঁর ‘সিদ্ধান্তবিন্দু’ গ্রন্থে বলেন-
‘প্রভাকরভাট্টয়োস্তু বেদান্তদর্শনে বিদ্বেষাভাবঃ।’-(সিদ্ধান্তবিন্দু)
অর্থাৎ : বেদান্ত-দর্শনে প্রভাকরের (ও ভাট্টর) বিদ্বেষ নেই।

পরবর্তী প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের মতে সকল প্রকার দুঃখের আত্যন্তিক লয়ে ভূমানন্দের যে অনুভূতি হয় তাই মুক্তি। শরীরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হওয়াই জন্ম এবং এই সম্বন্ধের বিনাশই মৃত্যু। কর্মফল ভোগের জন্য জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু নিত্য, নৈমিত্তিক ও নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে সুখ-দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ হয়। এইরূপ বিনাশই মুক্তি।

মোক্ষের স্বরূপ সম্পর্কে অবশ্য ভাট্ট-সম্প্রদায় ও প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। প্রাভাকর-মতে সকল দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশই মোক্ষ। মোক্ষলাভে ধর্ম ও অধর্ম দুই-এরই বিনাশ হয়। ধর্ম ও অধর্মের জন্যই জীবের সংসারগতি লাভ হয়। ধর্ম ও অধর্ম সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে দেহের যে আত্যন্তিক বিনাশ হয়, তাই মোক্ষ। ধর্ম ও অধর্মের বশীভূত হয়েই জীব ভিন্ন ভিন্ন যোনিতে আবর্তিত হয়। সংসারে আত্যন্তিক সুখ নেই। সংসার-সুখ অস্থির। কর্মের কর্তা-রূপ আত্মায় শুভ বা অশুভ রূপ অদৃষ্ট বা অপূর্ব সমবেত থাকে এবং এই অদৃষ্ট বা অপূর্বের দ্বারাই শুভ ও অশুভ ফল লাভ হয়। এই অপূর্ব লৌকিক প্রমাণের অগম্য, একমাত্র বৈদিক শব্দ প্রমাণের দ্বারাই তার কথা জানা যায়।

বৈদিক কর্মসমূহও যে মরণোত্তর বা জন্মান্তরীয় ফল উৎপাদন করে, সে ক্ষেত্রেও ঐ অদৃষ্ট বা অপূর্ব অলৌকিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কর্ম ইহজীবনে সাময়িককালে অনুষ্ঠিত হলেও তার ফল ভোগ করতে হয় জন্ম-জন্মান্তরে। নিষিদ্ধ কর্মের ফলে যে অশুভ অদৃষ্ট উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় পাপ। পাপের ফলে আত্মাকে নরক ভোগ করতে হয়। আর বিহিত কাম্য-কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা যে পুণ্য সঞ্চয় হয়, তার দ্বারা স্বর্গাদি লাভ হয়।
প্রাভাকর-মতে এই স্বর্গাদিলাভ শুভকর্মের প্রাসঙ্গিক ফলমাত্র। কর্তব্যবোধেই কর্ম অনুষ্ঠেয় এবং তার ফলে চিত্তশুদ্ধি হয়, আর শুদ্ধচিত্তেই মোক্ষপ্রাপ্তির প্রত্যক্ষ কারণস্বরূপ জ্ঞান লাভ হয়। তাই বলা হয়, ধর্মজিজ্ঞাসা বা ধর্মানুষ্ঠান ব্রহ্মজিজ্ঞাসার পূর্ববর্তী ধাপ। উল্লেখ্য, এই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা হলো মূলত বেদান্ত-সিদ্ধান্ত।

লৌকিক শুভকর্মের অনুষ্ঠান এবং নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম চিত্তশুদ্ধির সহায়ক। ভাট্ট-মতে নিত্যকর্ম প্রত্যক্ষভাবে ফলদায়ক নয়। দূরিতক্ষয়ই তার ফল। প্রাভাকর-মতে ফল-নিরপেক্ষভাবেই নিত্যকর্ম অনুষ্ঠেয়। এই কর্মই পুরুষার্থ। কাম্য, নিত্য ও নৈমিত্তিক এই ত্রিবিধ কর্মের অনুষ্ঠানই ধর্ম। ধর্মমাত্রই দুঃখমিশ্রিত। সেজন্যেই জীবের মোক্ষাভিলাষ জাগে। ইহলোকে বা পরলোকে সুখ বা দুঃখ উৎপাদনকারী সমস্ত প্রকার কর্ম থেকে বিরতিই মোক্ষ। দূরিতক্ষয়কারী প্রয়োজনীয় প্রায়শ্চিত্ত কর্মের দ্বারা সঞ্চিত কর্মের ফলনাশ হয় এবং শম, দম, ব্রহ্মচর্য, সন্তোষ প্রভৃতি দ্বারা শরীরী সত্তা থেকে ক্রমশ মুক্তি হয়। কিন্তু শুধুমাত্র তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা বন্ধন-মুক্তি হয় না। তার জন্য বেদবিহিত নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান প্রয়োজন। তবে কাম্য কর্ম পুনর্জন্মের প্রযোজক, মোক্ষলাভের ঘটক নয়। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা পাপ-পুণ্যের ভবিষ্যৎ-বৃদ্ধি বিরত হয়। নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তাদি কর্ম সাধন করে চিত্ত শুদ্ধ হয়। পরে শমদমাদিসাধন সম্পত্তির দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলেই মোক্ষ লাভ হয়।

প্রাভাকর-মতে জীবের এই মুক্তাবস্থা কিন্তু আনন্দদায়ক অবস্থা নয়। মুক্ত আত্মা নির্গুণ বলে তার আনন্দানুভব সম্ভব নয়। নির্গুণ আত্মার স্বাভাবিক রূপের স্ফুরণই মোক্ষ। মোক্ষ সুখ এবং দুঃখ এই দুই-এরই অতীত। কিন্তু ভাট্ট-মতে মোক্ষ আনন্দস্বরূপ। সকল দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশে উৎপন্ন ভূমানন্দ লাভই মোক্ষ। সংসারে জন্মগ্রহণ করে জীবকে সুখ-দুঃখ ভোগ করতেই হয়, আর সুখ-দুঃখের ভোগের দ্বারাই সঞ্চিত ও প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয়। কিন্তু নিষিদ্ধ ও কাম্য বর্ম বর্জন না করলে নব নব ভোগ্যবস্তুর দিকে চিত্ত আকৃষ্ট হয় এবং মোক্ষলাভে বাধা সৃষ্টি হয়। তাই শ্লোকবার্ত্তিকের সম্বন্ধাক্ষেপপরিচ্ছেদে কুমারিল ভট্ট বলেছেন-  
‘মোক্ষার্থী ন প্রবর্ত্তেত তত্র কাম্যনিষিদ্ধয়োঃ।
নিত্যনৈমিত্তিকে কুর্য্যাৎ প্রত্যবায়জিহাসয়া।।’- (শ্লোকবার্ত্তিক-সম্বন্ধাক্ষেপপরিচ্ছেদ)
অর্থাৎ : মোক্ষকাম ব্যক্তি কাম্যকর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্মে প্রবৃত্ত হবেন না। পাপের উৎপত্তি যেন না হয়, এ উদ্দেশ্যে নিত্যকর্ম ও নৈমিত্তিককর্ম অবশ্যই করবেন।

ভূমানন্দস্বরূপ মোক্ষ দুঃখের আত্যন্তিক অভাবস্বরূপ। তাই এই অবস্থা নিত্য। ভাট্টমতে বলা হয়, সূত্রকার জৈমিনি স্বর্গরূপ যে পুরুষার্থেও কথা বলেছেন, তার দ্বারা আসলে মোক্ষই সূচিত হয়। কারণ স্বর্গ বলে কোন স্থান নেই। দুঃখলেশশূন্য পূর্ণানন্দই মোক্ষস্বরূপ। তাই পরবর্তী গ্রন্থকার নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’-এ ভাট্টমত উল্লেখ করে বলেছেন-  
‘দুঃখাত্যন্তসমুচ্ছেদে সতি প্রাগাত্মবর্ত্তিনঃ।
আনন্দস্যানুভূতিস্তু মুক্তিরুক্তা কুমারিলৈঃ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ হলে তখন আত্মাতে পূর্ব থেকে বিদ্যমান নিত্যানন্দের যে অনুভূতি হয়, তাকেই কুমারিল ভট্ট মুক্তি বলেছেন।
এই মোক্ষরূপ স্বর্গই নিত্য, আর কাম্যকর্মজন্য অপূর্ব থেকে লব্ধ যে স্বর্গের কথা বলা হয়েছে, তা অনিত্য। অর্থাৎ পুণ্যের দ্বারা যে স্বর্গলাভ হয়, পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে সেখান থেকে আবার মর্ত্যে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু ভূমানন্দস্বরূপ মোক্ষ নিত্য, তাকে আর হারাতে হয় না। মোক্ষ তাই নিত্য আনন্দস্বরূপ।
কিন্তু মুক্তজীবের আনন্দানুভূতি যথার্থই কুমারিলসম্মত কি না, তা বিচার সাপেক্ষ। কেননা শঙ্করাচার্য, মাধবাচার্য, উদয়নাচার্য, নারায়ণভট্ট প্রমুখ আচার্যগণ কুমারিলমতে মুক্তিতে নিত্যসুখের অনুভূতির কথা বলে গেছেন। কিন্তু কুমারিলের গ্রন্থ ‘শ্লোকবার্ত্তিক’-এ সেরকম দেখা যায় না, বরং বিপরীত সিদ্ধান্তই পরিলক্ষিত হয়। যেমন, শ্লোকবার্ত্তিকের সম্বন্ধাক্ষেপ-পরিহার-প্রকরণে কুমারিল বলছেন-  
‘সুখোপভোগরূপশ্চ যদি মোক্ষঃ প্রকল্প্যতে।
স্বর্গ এব ভবেদেষ পর্য্যায়েণ ক্ষয়ী চ সঃ।।
ন হি কারণবৎ কিঞ্চিদক্ষয়িত্বেন গম্যতে।
তস্মাৎ কর্ম্মক্ষয়াদেব হেত্বভাবেন মুচ্যতে।।
ই হ্যভাবাত্মকং মুক্তা মোক্ষনিত্যত্বকারণম্ ।…ইত্যাদি।’- (শ্লোকবার্ত্তিক)
অর্থাৎ :
যদি সুখের উপভোগরূপ মোক্ষের কল্পনা করা হয়, তবে তা স্বর্গই হবে এবং কালক্রমে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। কারণবিশিষ্ট কোন কার্যবস্তুই অক্ষয় হয় না। অর্থাৎ সকল কার্যবস্তুই বিনষ্ট হয়ে থাকে। অতএব প্রারব্ধাদি কর্মের ক্ষয় হলেই ভোগ্যহেতুর অভাববশত জীবের মুক্তি হয়। আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি অভাবাত্মক না হলে মুক্তির নিত্যত্ব সিদ্ধ হয় না। (সূত্র: সুখময় ভট্টাচার্য্য/ পূর্ব্বমীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-২০২)
.
উল্লেখ্য, এখানে কুমারিল নিত্যসুখের অভিব্যক্তির কথা বলেননি। একারণে কুমারিলমতের সর্বপ্রধান ব্যাখ্যাতা পার্থসারথিমিশ্র কী বলেন তাও উল্লেখ্য। তিনি তাঁর ‘শাস্ত্রদীপিকা’ গ্রন্থের প্রারম্ভেই বলে রেখেছিলেন-  
‘কুমারিলমতেনাহং করিষ্যে শাস্ত্রদীপিকাম্ ।’
অর্থাৎ : আমি কুমারিলের মতকে অবলম্বন করে ‘শাস্ত্রদীপিকা’ রচনা করছি।
.
এই ‘শাস্ত্রদীপিকা’র তর্কপাদে পার্থসারথি আনন্দমোক্ষবাদিগণের মত প্রদর্শন করে বিচারপূর্বক সেই মত খণ্ডন করেছেন, এবং পরিষ্কার বলেছেন-  
‘সুখদুঃখাদিসমস্তবৈশেষিকাত্মগুণোচ্ছেদো মোক্ষঃ।’ ইত্যাদি- (শাস্ত্রদীপিকা)
অর্থাৎ : সুখ-দুখাদি আত্মগত সর্ববিধ বিশেষ গুণের আত্যন্তিক বিনাশই মোক্ষ।
.
পার্থসারথি বলেন, ধর্ম ও অধর্মের বিনাশে সুখদুঃখের বিনাশ। উপভোগ, নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান এবং আত্মজ্ঞানের দ্বারা উৎপন্ন ধর্মাধর্মের বিনাশ। নিষিদ্ধ ও কাম্য কর্মের অনুষ্ঠান না করায় উৎপাদ্য ধর্মাধর্মের অনুৎপত্তি। এই অবস্থায় দেহবিনাশে পুনর্জন্মের সম্ভাবনা না থাকায় জীব মুক্ত হয়ে থাকেন।
এবং আরো প্রাঞ্জল ভাষায় পার্থসারথি বলেন-  
‘নিরানন্দো মোক্ষঃ; দুঃখপরিলোপাচ্চ পুরুষার্থত্বম।’- (শাস্ত্রদীপিকা)
অর্থাৎ : মোক্ষদশায় জীবের আনন্দ থাকে না, দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ হয় বলেই মোক্ষ পুরুষার্থ, অর্থাৎ জীবের অভিলষিত।
.
কুমারিলমতকে সহজবোধ্য করবার নিমিত্ত পার্থসারথি ‘শাস্ত্রদীপিকা’য় যা বলেছেন, তার তাৎপর্য হলো- সংসারপ্রপঞ্চের বিলয়ই মোক্ষ নয়, প্রপঞ্চের সাথে জীবের সম্বন্ধের বিলয়ই মোক্ষ। শরীর থাকলেই সুখদুঃখ ভোগ করতে হয়। ইন্দ্রিয়সমূহ ভোগের সাধন এবং রূপরসাদি ভোগ্য বস্তু। শরীর, ইন্দ্রিয় ও ভোগ্য- এই তিনের বিলয় মোক্ষেই প্রতিষ্ঠিত। কর্মজনিত পাপপুণ্যের ফল ভোগ করবার নিমিত্ত জীবের শরীরধারণ। ভোগের দ্বারা পাপপুণ্য নিঃশেষে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না। শরীরাদি প্রপঞ্চের সাথে জীবের সম্বন্ধকে ‘বন্ধ’ বলে, আর চিরতরে এই বন্ধের নাশই মোক্ষ।
[শেষ]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ