চার্লস ডারউইন ১৮৫৯ সালে তার বই অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস প্রকাশ করেন।
প্রথম নজরে চার্লস ডারউইনকে কোনোদিক থেকেই এক বিপ্লবীর ভাবমূর্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। তাঁর চাইতে ন’বছরের ছোট কার্ল মার্ক্সের সঙ্গে তুলনা করলে ডারউইনকে নেহাতই ছাপোষা, তদানীন্তন ইউরোপীয় উচ্চবিত্ত পরিবারের এক সাধারণ সদস্য বলে মনে হবার কথা। যৌবনেও তাঁকে আর পাঁচজনের চাইতে অন্যরকম বা প্রতিভাবান বলেও মনে হয়নি। ডারউইনের বাবা ভাবতেন ছেলেটা কুঁড়ের হদ্দ, তার ওপরে জীবনে কোনও লক্ষ্য নেই। প্রথমে ডাক্তারি পড়ার বৃথা চেষ্টা করার পরে পাদ্রী হবার জন্য কিছুদিন পড়াশুনা করেন ডারউইন, তারপর সে পাঠও ছেড়ে দেন। ছোটবেলা থেকে ডারউইনের প্রকৃতি নিয়ে আগ্রহ ছিল বটে, কিন্তু সেটা তখনকার ইংল্যান্ডের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেদের নেশা ছিল।
প্রায় ‘নিষ্কর্মা’ এই মানুষটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা পড়ার সময় ‘এইচএমএস বিগল’ জাহাজে বিনা বেতনের প্রকৃতিবিদ হিসাবে কাজ করার সুযোগ পান। বিশ্ব জুড়ে অনুসন্ধানী ভ্রমণে বেরিয়েছিল ‘এইচএমএস বিগল’। সমুদ্রের বুকে পাঁচ-পাঁচটা বছর। বিগল ঘুরে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে, অস্ট্রেলিয়ায়, মহাসমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নানা দ্বীপে। ডারউইন সর্বত্র উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবন, ভূতত্ত্ব ও ফসিল পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে রাখছেন জাহাজে। মোটা মোটা নোটের খাতা ভরে উঠেছে হাতের খুদে খুদে অক্ষরে। এরই মধ্যে বারংবার আক্রমণ করেছে সমুদ্রপীড়া, পেটের গোলযোগ এবং চর্মরোগ।
১৮৩৬ সালের অক্টোবরে বিগল ইংল্যান্ডে ফিরল। ডারউইন এতদিন ধরে তার জমানো পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ শুরু করলেন। পরের দু’বছর ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনতত্ত্বের মূল কাঠামোটি তাঁর মনের মধ্যে রূপ পায়। চেনাশোনা বিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর ধারণাগুলি নিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু জীবনের উৎস এবং বিকাশের বিষয়ে ডারউইন তাঁর মতামত তখন ছাপার অক্ষরে কোথাও প্রকাশ করেননি। তাঁর বিখ্যাততম বই ‘অন অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মীনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে— ইংল্যান্ডে ফিরে আসার অনেক পরে। আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস পত্রাঘাত না করলে ডারউইন তাঁর গবেষণা তখনও প্রকাশ করতেন কিনা সন্দেহ আছে।
বিবর্তনবাদের তত্ত্ব ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ আর সেই তত্ত্বের অন্য নাম ‘ডারউইনবাদ’। অথচ একা ডারউইন সে তত্ত্ব আবিষ্কার করেননি, ডারউইন এবং ওয়ালেস দুজনে আলাদাভাবে তথ্য জোগাড় করে ও ভেবেচিন্তে একই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। ১৮৫৮ সালে ডারউইনকে একটি চিঠি লেখেন ওয়ালেস। সেই চিঠিতে ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের নিজস্ব তত্ত্বটির রূপরেখার আভাস দিয়ে ডারউইনের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। ডারউইন দেখেন, ওয়ালেস যা লিখেছেন সেটাই বিগত কুড়ি বছর ধরে তিনি ভেবেছেন আর আলোচনা করেছেন। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর নিজের গবেষণা সেই মুহূর্তে প্রকাশ না করলেই নয়।
১ জুলাই, ১৮৫৮। ডারউইনের পূর্ববর্তী নোটগুলির একটি সংকলন এবং ওয়ালেসের একটি রচনা লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটিতে পঠিত হল। যাকে আমরা সাধারণভাবে ‘বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’ বলে জানি, বিজ্ঞানে তার স্বীকৃত নাম হল ‘ডারউইন ও ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’। দুজন একই সময়ে এই তত্ত্ব পেশ করেন বলে দুজনেরই নাম আছে। কিন্তু ১৮৮৯ সালে ওয়ালেস স্বয়ং তাঁর বিবর্তনীয় প্রবন্ধসংগ্রহকে ‘ডারউইনবাদ’ আখ্যা দেন।
পরের বছর ডারউইন ‘অন দি ওরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশ করলেন। এটি পৃথিবীর বিখ্যাততম বইগুলির একটি। ডারউইন সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ তাঁর বিবর্তনীয় তত্ত্ব এই বইটিতে রেখেছিলেন। বইটি প্রকাশ হওয়া মাত্র বেস্টসেলার হয়, আর তা খুব দ্রুত প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত করে।
ডারউইন অবশ্য এই বিতর্কই আশা করছিলেন, বা বলা ভাল, ডারউইন নিজের ওপর আরও বেশি আক্রমণের আশঙ্কা করছিলেন। ব্রিটেনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যে এই বিবর্তন তত্ত্ব শুনে ক্ষেপে যাবে সেটা তিনি জানতেন। এমনকি ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিক্রিয়া যে তাঁর পক্ষে যাবে না, সেটাও তিনি ধরেই নিয়েছিলেন। নিজের পক্ষে নিখুঁতভাবে যুক্তি ও তথ্য সাজাতে সময় চাইছিলেন বলেই কুড়ি বছর ধরে তিনি তত্ত্বটি নিয়ে ছাপার অক্ষরে কিছু বলতে চাননি। অনেকে ভাবেন, প্রজাতির অভিযোজনের ধারণা ও বিবর্তনের ধারণা ডারউইনের অবদান, তাঁর মৌলিক ধারণা। আসলে তা নয়, সেই সময়ে বিবর্তনবাদ অভূতপূর্ব বা একেবারে মৌলিক ধারণা ছিল না। ডারউইন তার তত্ত্ব প্রকাশ করার কয়েক দশক আগে থেকেই জীবজগতে বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক চলছিল। বিবর্তনের ফলে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব হয়, এই ধারণার সমর্থক অবশ্য সংখ্যায় প্রথমে খুবই কম ছিলেন। ডারউইনের ঠাকুরদা চিকিত্সক ইরাসমাস ডারউইন ছিলেন হাতে গোনা আদি বিবর্তনবাদীদের মধ্যে একজন। এক ফরাসী বিজ্ঞানী জাঁ ব্যাপতিস্তে ল্যামার্ক বিবর্তনের কথা প্রচার করেন ও বিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে কিছু ধারণা দেন। তবে ল্যামার্কের ধারণা পরবর্তীকালে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। আবার ফরাসী বিজ্ঞানী জর্জ কুভিয়ার-এর মত বহু বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভবের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিবর্তনবিরোধী বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে (ঈশ্বর দ্বারা) প্রজাতিগুলি সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত একই রকম রয়ে গেছে।
চার্লস ডারউইনের কৃতিত্ব হ’ল প্রজাতিগুলি কীভাবে বিবর্তিত হয় তার একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অকাট্য ব্যাখ্যা দেওয়া, এবং জীবনের বিকাশের কারণ হিসেবে অতিলৌকিক সমস্ত ব্যাখ্যাকে অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করা। তিনি যুক্তি ও তথ্য দিয়ে দেখালেন, সমস্ত বিদ্যমান জীব কিছু সংখ্যক আদি বা পূর্বসূরি প্রজাতি থেকে বিকাশের ফলে পৃথিবীতে এসেছে। তিনি জীবনের বিবর্তনকে একটি বিশাল বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করলেন। জীবনবৃক্ষের গুঁড়ি কয়েকটি সাধারণ পূর্বসূরির প্রতিনিধিত্ব করে, আর সেই গুঁড়ি থেকে জন্ম নেওয়া অজস্র শাখাপ্রশাখা হল এখনকার পৃথিবীতে বাস করা নানা ধরণের জীব।
এই বিবর্তনের দুটি কারণ আছে।
প্রথম কারণটি হ’ল, প্রতিটি জীব তার পিতামাতার চাইতে আলাদা। এই পার্থক্য সাধারণত সূক্ষ্ম। ডারউইন এই পার্থক্যগুলিকে ‘বৈচিত্র্য’ বা ‘ভেরিয়েশন’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
ডারউইনীয় বিবর্তনের দ্বিতীয় কারণ হল এইরকম। প্রতিটি জীব তার পিতামাতার চাইতে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা মাফিক আলাদা, এমন নয়। বৈচিত্র্য বা ভেরিয়েশন হল এলোমেলো বা রান্ডম। কিন্তু এই এলোমেলো বৈচিত্র্য কয়েকটি নতুন প্রজন্মের জীবদের কিছু স্বতন্ত্র সুবিধা দেয়। নতুন প্রজন্মের কারও হয়তো পরিবেশে একটু বেশি লুকিয়ে থাকার মত চেহারা হয় (বিভিন্ন পোকা বা পাখি), হয়তো পরিবেশ থেকে বেশি খাদ্য সংগ্রহ করার ক্ষমতা (জিরাফের লম্বা গলার মত) হয়, হয়তো গতি বাড়ে (আর সে হরিণের মত বাঘের হাত থেকে বাঁচতে পারে)। এক কথায় নতুন বৈশিষ্ট্য হয়তো নতুন প্রজন্মের একটি জীবকে তার পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আরও ভালভাবে সজ্জিত করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এর উল্টোটাও হতে পারে—নতুন বৈশিষ্ট্য হয়তো এমন হল যে জীবটি তার পিতামাতার চাইতে পরিবেশে টিকে থাকতে আরও অসুবিধায় পড়ল। সে ক্ষেত্রে সেই জীবটির অকালে মরে যাবার ও বংশধর না রাখার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, সুবিধাজনক বৈচিত্র্যের অধিকারী নতুন প্রজন্মের জীব গড়ে বেশিদিন বাঁচে আর তাদের বাচ্চাকাচ্চাও বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে। ফলে তার পরের প্রজন্মে আরও বেশি সংখ্যক বংশধর সেই উপকারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। এইভাবে অপকারী বৈশিষ্ট্যগুলি লুপ্ত হয় আর উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলি সময়ের সাথে সাথে একটি প্রজাতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা প্রজাতিটিই এইভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। বহু প্রজন্ম জুড়ে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি জমা হয়ে অবশেষে বড় আকারের পরিবর্তন দেখা দেয় এবং হয়তো একটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়।
ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে কোনও দুর্বলতা ছিল না, এমন নয়। তিনি প্রজন্মের মধ্যেকার বৈচিত্র্যসমূহ ও তার প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে বিবর্তনের প্রক্রিয়া ও কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানতেন, এই বৈচিত্র্যগুলি বংশানুক্রমিক না হলে তাঁর বিবর্তনের তত্ত্ব মিথ্যা হয়ে যায়। কিন্তু কেমন করে বংশানুক্রমিকভাবে এই বৈচিত্র্যসমূহ পরিবাহিত হয় তা তিনি বোঝেননি। বৈচিত্র্যের আসল কারণ জেনেটিক মিউটেশন। কিন্তু ডারউইন মারা যাবার কুড়ি বছর পরে জেনেটিক্সের বৈজ্ঞানিক ধারণা বিজ্ঞানীমহলে প্রথম যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে চর্চিত হয়। ফলে বৈচিত্র্যের বংশানুক্রমিক সঞ্চার কেমন করে হয়, সে বিষয়ে ডারউইন যা বলেছিলেন তা ভুল ছিল। তাই প্রাথমিক প্রবল ইতিবাচক অভিঘাতের পরে বিজ্ঞানীমহলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে খানিকটা সংশয় তৈরি হয়।
বিংশ শতকের শেষার্ধে জিন-এর গঠন আবিষ্কৃত হয়। ধীরে ধীরে জানা যায় কীভাবে জিনের নানা বৈচিত্র্য প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রবাহিত হয়, কেমন করে জিনের পরিবর্তনের ফলে নতুন বৈচিত্র্যের জন্ম হয়। পরিবেশ কীভাবে জিনের পরিবর্তনের ওপর ছাপ ফেলে সেটাও ধীরে ধীরে বোঝা যায়। নতুন সমস্ত আবিষ্কার ডারউইনের মতবাদকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ডারউইনের ধারণাগুলি বহুযুগের ইউরোপীয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। এমনকি বিজ্ঞানপ্রতিষ্ঠানগুলিও গোড়ার দিকে ডারউইনের বক্তব্য নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিল। অবশ্য ইংরেজিভাষী বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে বিরোধিতা ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ প্রকাশের কয়েক দশকের মধ্যে প্রায় ধসে পড়েছিল। তবুও ব্রিটিশ এবং আমেরিকান গীর্জা বিবর্তনকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলে। ধর্মীয় নেতারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, তত্ত্বটি খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের মূল শিক্ষার বিরোধিতা করে।
মানুষ সহ বিদ্যমান প্রজাতিগুলি কয়েকটি আদি জীব থেকে ধীরে ধীরে এবং ‘এলোমেলো পরিবর্তন’ ও ‘সুবিধাজনক পরিবর্তনের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার অর্জন’-এর দ্বারা বিবর্তিত হয়েছে। এটাই ডারউইনের বিবর্তন ধারণার মূলকথা। এর বিপরীতে ছিল বাইবেল বর্ণিত ‘বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্ব’। বাইবেলের ভাষ্য হল, সমস্ত জীবকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, এবং তাদের মূল ‘প্রকার’ কখনও বদলায়নি। জীবনের উদ্ভব এবং বিকাশের কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ডারউইনের পূর্বেও ছিল। কিন্তু মূলধারার বিজ্ঞানীরা মোটের ওপর ধরে নিয়েছিলেন যে প্রজাতিগুলি স্থির, তারা কখনই পরিবর্তিত হয়নি। বাইবেলে উল্লিখিত ঈশ্বর কর্তৃক মাছ, পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী সৃজনের বিষয়টি অবিকৃত রেখে পরবর্তীকালের যেটুকু পরিবর্তন সম্ভব তা নিয়ে সে সময়কার বিজ্ঞানীরা চর্চা করতেন। এর ব্যাতিক্রম অল্পই ছিল।
ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম এই তিন আব্রাহামিক ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা হল যে, বিশ্বে মানুষের একটি বিশেষ ঈশ্বর-প্রদত্ত স্থান আছে। ডারউইনের তত্ত্ব তার বিরোধিতা করে। ডারউইনিয় বিবর্তনের সমর্থকরা মানব অঙ্গসংস্থানবিদ্যায় (অ্যানাটমি) একটি লক্ষণের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, মানুষের সঙ্গে পশুজগতের শারীরিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। মানুষের লেজ নেই, কিন্তু তার দেহে লেজ হাড়ের একটি অবশিষ্টাংশ আছে। এই ককিক্স হাড়টি প্রমাণ করে মানুষ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর সঙ্গে একই সাধারণ পূর্বসূরির সন্তান।
ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণায়, যে সমস্ত জীব পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না তারা বেঁচে থাকতে পারে না। এটা যেন জীবজগতকে এক বর্বর ও নিষ্ঠুর স্থান হিসাবে চিত্রিত করে। একজন ত্রুটিহীন মঙ্গলময় ঈশ্বর জীবজগৎ সৃষ্টি করেছেন ও সযত্নে তাকে পালন করেন। করুণাময় সেই ঈশ্বর প্রার্থনায় সাড়া দেন। তাঁর সৃষ্ট ক্ষমাসুন্দর বিশ্ব থেকে ডারউইনের বিশ্ব মূলগত ভাবে ভিন্ন। অবশ্য ক্ষমাসুন্দর বিশ্বের ধারণাটি এই সময় সাধারণভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছিল। ডারউইনের সমসাময়িক ছিলেন আলফ্রেড লর্ড টেনিসন। ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ বইটি প্রকাশের কয়েক বছর আগেই তিনি প্রকৃতির ভয়াল রূপ বর্ণনা করে লিখেছিলেন, ‘Nature red in tooth and claw’। এই কথাটিকে টেনিসন বিখ্যাত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শব্দবন্ধটি তার আগেই চালু ছিল। ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বের অনৈসর্গিক সম্প্রীতির ধারণাকেও অমূলক বলে দেখিয়ে দেয়।
ডারউইন জানতেন, তাঁর তত্ত্ব সনাতন ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবে। আমেরিকান উদ্ভিদবিজ্ঞানী আসা গ্রে-কে ১৮৬০ সালে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “নাস্তিকের মত লেখার কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু অন্যরা যেমন আমাদের চারপাশে পরিকল্পনা ও উপকারী-হস্তের প্রমাণ পান … আমি তাদের মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না … বিশ্বে খুব বেশি দুর্দশা রয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে।”
ডারউইনের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তাঁর ধারণাগুলি ব্রিটেনের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে তত্ক্ষণাৎ কঠোর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ ক্যাথলিক কর্মকর্তা হেনরি কার্ডিনাল ম্যানিং ডারউইনের মতকে একটি নিষ্ঠুর দর্শন হিসাবে অভিহিত করেন। অক্সফোর্ডের অ্যাংলিকান আর্চবিশপ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ১৮৬০ সালে ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি এডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’-এর সভাতে ডারউইনের তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ঘাটতি দেখানোর প্রচেষ্টায় যে বক্তৃতা দেন তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। খ্যাতির কারণ অবশ্য বক্তৃতা নয়, বরং বক্তৃতার উত্তরে টমাস হেনরি হাক্সলির চোখা প্রত্যুত্তর। বৈঠকের মধ্যে উইলবারফোর্স জীববিজ্ঞানী টমাস হেনরি হাক্সলিকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি উত্তরাধিকারের খাতিরে নিজেকে ‘এপ’ (গরিলা শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি মহাবানর) বংশজাত বলে মনে করেন—তাঁর ঠাকুমার দিক দিয়ে নাকি দিদিমার দিক দিয়ে? হাক্সলি বলেন, সত্যের সাধকদের সম্পর্কে এরকম মিথ্যা অপযশ দেবার কাজে যিনি তার জ্ঞান এবং বাগ্মীতাকে ব্যবহার করছেন, তাঁদের চাইতে বরং একটি বানরকে তিনি নিজের পূর্বপুরুষ হিসেবে পছন্দ করবেন।
অবশ্য অনেক গবেষক বলেন এইরকম কথাবার্তা সেই সভাতে আদৌ হয়নি। তবে এই সময়েই বিবর্তন নিয়ে বিতর্কে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক ধারণা ধর্মীয় ডগমাকে জনসমক্ষে পরাজিত করতে শুরু করে। ১৮৬০ দশকের মধ্যেই ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার মধ্যে প্রকাশ্য মতবিরোধের ফয়সালা হয়নি, এবং অল্প সময়ে এমন অবসান ঘটার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এই সময় থেকেই ধর্মীয় নেতারা বিবর্তনবিজ্ঞান সম্পর্কে আরও সতর্ক হয়ে পড়েছিলেন। অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তনের ফলে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, এমন ধারণা উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে যায়। ফলে ঐশ্বরিক সৃষ্টিতত্ত্ব বা মানুষের আত্মার ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে। তাই সারা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত চার্চের সংগঠিত শক্তি এই ধারণাকে প্রতিরোধ করার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ ও অন্য কিছু চার্চের কর্তারা মেনে নেন যে, জৈবিক বিকাশের একটি ঈশ্বরনির্দেশিত প্রক্রিয়া হিসাবে বিবর্তন মিথ্যা নয়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। জীবনের আদি কারণ হিসেবে বা মানুষের একমাত্র স্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন কোনও আব্রাহামিক ধর্ম প্রতিষ্ঠান এখনও মেনে নেয়নি।
১৮৮২ সালে ডারউইন মারা যান। তখন তাঁকে সেই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে বিবেচনা করা হত। তাঁর সপক্ষে জনমত অত্যন্ত জোরালো ছিল। যে চার্চ তাঁর তত্ত্ব কোনোকালে মেনে নেয়নি, সেই চার্চই ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধির কাছে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করে। চার্চ ঠিকই জানত, ডারউইনের ধারণাটি ছিল ‘ধর্মদ্রোহী উস্কানি’! কিন্তু সে সময় ব্রিটেনে তাঁর মতের গ্রহণযোগ্যতা এতই বেশি ছিল যে, এমনকি অ্যাংলিকান ধর্মযাজকদের মধ্যে অনেকেই এই মতের অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন। চার্চ ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে ডারউইনকে সমাহিত করে ব্রিটেনের বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে একটি যুদ্ধের অবসান ঘোষণা করতে চেয়েছিল।
ডারউইন ব্যক্তিজীবনে বা স্বঘোষণায় একজন বিপ্লবী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বৌদ্ধিক অবদান ছিল বৈপ্লবিক। যেমন আড়াই হাজার বছর আগে ভারতের এক মহামানবের বৈপ্লবিক অবদানকে আত্মসাৎ করে তাঁকে ধর্মীয় অবতার বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, ডারউইনের ক্ষেত্রেও চার্চ ঠিক তেমনভাবেই তাকে একজন ‘সন্ত’ বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে শেষ পর্যন্ত ডারউইনের বৈপ্লবিক ধারণা টিকে থাকবে, আর ‘সন্ত’ ডারউইনের ভাবমূর্তি সৃষ্টিকারী ধর্মরক্ষকদের সমস্ত আজগুবি গল্প টিকে থাকবে না।
কে যেন বলেছিলেন না, সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট!
ডারউইনঃ মানব বিবর্তন ও যৌন নির্বাচন
১৮৫৯ থেকে ১৮৭১। ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ প্রকাশের পরের এক ডজন বছর। ইউরোপ আমেরিকা বিতর্কে সরগরম। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ইংল্যান্ডের টমাস হেনরি হাক্সলি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশা গ্রে এবং জার্মানিতে আর্নস্ট হেকেল নানা বিতর্কে অংশগ্রহণ করছেন। ডারউইন স্বয়ং প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি শানিত করছেন। আবার এরই মধ্যে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের পদ্ধতি মানব প্রজাতির বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করছেন। মানুষের উদ্ভব নিয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আরোপ করলে মানুষকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সন্তান বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু ‘অন দি অরিজিন…’ গ্রন্থে ডারউইন এই প্রশ্নটি সরাসরি মীমাংসা করার চেষ্টা করেননি। ফলে দ্বাদশ বছরের এই দীর্ঘ সময় জুড়ে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো মানবজাতির জন্য বিশেষ সৃষ্টিতত্ত্বকে সমর্থন করেন। কিন্তু ডারউইনের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা তখন অন্য খাতে বইছিল।
১৮৬৭ সালে ডারউইন ‘ভেরিয়েশন অফ প্ল্যান্টস অ্যান্ড এনিম্যালস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’ গ্রন্থের বিশাল খসড়া নিয়ে কাজ করছিলেন। তারই অংশবিশেষ নিয়ে তিনি মানবজাতির উত্স সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ লেখার কথা ভাবেন। কিন্তু ছোট প্রবন্ধ নিয়ে কাজ শুরু করলেও সেটি ছাপতে দেবার সময়ে দেখা গেল যে, একটা বেশ বড় বই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নাম দেওয়া হল ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’, অর্থাৎ ‘মানুষের উদ্ভব ও যৌন নির্বাচন’। সেটি ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হল।
প্রায় একই সঙ্গে ‘ভেরিয়েশন…’-এর ঐ খসড়া থেকে তিনি আরও একটি বই বের করেন। সেটির নাম ‘এক্সপ্রেশন অফ ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড দ্য এনিম্যালস’ অর্থাৎ ‘মানুষ ও পশুর আবেগের প্রকাশ’। এটি ১৮৭২-এ প্রকাশিত হয়। আমরা এখানে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান…’ বইটি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তবে ‘এক্সপ্রেশন অফ ইমোশনস …’ গ্রন্থটির কিছু বিষয় এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে।
এই বই দুটি ডারউইনের মতবাদ সম্পর্কে জনসাধারণের এতাবৎ গড়ে ওঠা ধারণায় বিরাট অভিঘাত ফেলে। ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান…’ বইটিতে ডারউইন এমন কিছু লেখেননি যা তাঁর আগের বই ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ এর চাইতে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দিক থেকে আলাদা। কিন্তু মানুষের উৎস নিয়ে এই বইতে সরাসরি লেখার ফলে যে সব পাঠক এর আগে ‘অরিজিন’-কে দুহাত তুলে সমর্থন করেছিল তাদেরও অনেকে একটু পিছিয়ে গেলেন—কী ব্যাপার, এই ডারউইন ভদ্রলোক এবার যেন সৃষ্টিছাড়া নাস্তিকের মতন কথা কইছেন!
বিজ্ঞানের ধারণা অনুসারে মানব বিবর্তনের প্রশ্নটি ইতিমধ্যে টমাস হাক্সলি, চার্লস লিয়েল ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো ডারউইনের বইয়ের মত পুরো বিষয়টিকে একসাথে ধরতে পারেনি, উপরন্তু ডারউইনের মত তথ্য ও তত্ত্বের সুষম সমাবেশ অন্যদের বই বা প্রবন্ধে ছিল না।
প্রথাগতভাবে এতদিন যে সব বিষয় ছিল কেবলমাত্র দর্শন, ধর্মতত্ত্ব এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে আলোচিত প্রশ্ন, ডারউইনের বই দুটি সে সব বিষয়কে সজোরে বিজ্ঞানের আওতার মধ্যে নিয়ে এল। তাঁর তত্ত্বের এই বিস্তৃতির ফলে অনেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিবর্তনবাদী তত্ত্বের বিরোধিতা বেড়ে গেল। ডারউইন মানবজাতির উত্সের আক্ষরিকভাবে শাস্ত্রীয় অর্থাৎ বাইবেলের বিবরণ অস্বীকার করেছিলেন—সেটা এই বিরোধিতার একটা কারণ ছিল। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল এমন নয়। শুধু ধর্মমত নয়, নানা দার্শনিক মতেরও সঙ্গেও ডারউইনের এই বই দুটির বক্তব্যের চরম বিরোধিতা ছিল। মানব এবং প্রাণীদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এখানে ডারউইন সরাসরি অস্বীকার করেন, আর তাই এই বিরোধিতা।
অবশ্য ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান…” প্রকাশের আগেও ডারউইন ক্রমশ এই অভিমুখে নিজের মতবাদকে গড়ে তুলছিলেন, এবং ধীরে ধীরে একই ধরণের বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ‘অরিজিন’-এর পঞ্চম এবং ষষ্ঠ সংস্করণে মানব বিবর্তন প্রক্রিয়া এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সূত্রগুলি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। তা আগের সব সংস্করণের আলোচনার চাইতে বেশি কড়া ছিল। কেউ কেউ ভাবতেন বিবর্তন হয় ঠিকই, কিন্তু তা নির্দিষ্ট অভিমুখে প্রগতির পথ ধরে এগোয়। ‘অরিজিন’-এর এই সংস্করণ দুটি তার সরাসরি বিরোধিতা করে। ডারউইন বলেন, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে বিবর্তন এগোয় না। ঈশ্বর বিবর্তনের অভিমুখ নির্দেশ করে দেন, এমন চিন্তার সঙ্গে ডারউইনের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ এখানেই ঘোষিত হয়। ‘অরিজিন’-এর পঞ্চম সংস্করণে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে হারবার্ট স্পেন্সারের কাছ থেকে নেওয়া ‘সারভাইভাল অফ দি ফিস্টেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’ কথাটি ডারউইন ব্যবহার করেন।
এসবের ফলে জন হেনরি নিউম্যান-এর মত অনেক প্রভাবশালী ধর্মীয় চিন্তাবিদ ডারউইনের ওপর ক্রুদ্ধ হন। আগে এরাই তাঁর মতের সম্পর্কে কিছুটা সহনশীল ছিলেন। ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান…’এর উপসংহারে ডারউইন লেখেন যে “লেজওয়ালা এবং ছুঁচাল কানবিশিষ্ট এক লোমশ চতুর্ভূজ থেকে মানুষ এসেছে”। তখন মানুষের চোখে ডারউইনের আগেকার ধর্মসহনশীল ভাবমূর্তি অনেকটাই বদলে গেল।
চার্লস ডারউইন, এক জ্ঞানী ওরাংওটাং। কার্টুনটি The Hornet নামক ব্যাঙ্গ-পত্রিকায় ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল
‘অরিজিন’-এর তুলনায় ‘ডিসেন্ট’-এ ডারউইন প্রাণীজগতে যৌন নির্বাচনের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। সংক্ষেপে যৌন নির্বাচন হল বিবর্তনের আরেকটি প্রক্রিয়া। এতে প্রজননের উদ্দেশ্যে স্ত্রী প্রাণী পুরুষদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বেছে নেয়, ও তার ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পুরুষ প্রাণীর মধ্যে বিরাট শিং বা ময়ূরের বাহারি পেখমের মত নানা গুণের উদ্ভব ঘটে। অবশ্য পুরুষ প্রাণীও কখনও কখনও স্ত্রী প্রাণীকে বেছে নিতে পারে, ও এর ফলে স্ত্রী প্রাণীর নানারকম পরিবর্তন হতে পারে। ‘অরিজিন’-এ যৌন নির্বাচনের সামান্য উল্লেখ ছিল মাত্র। কিন্তু ‘ডিসেন্ট’-এ তা পুস্তকের একটা বড় অংশ অধিকার করে।
ডারউইন দেখান যে যৌন নির্বাচন কখনও কখনও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিপরীত অভিমুখে কাজ করতে পারে। কীটপতঙ্গ থেকে পাখি পশু, এমনকি মানুষের নানা গুণের মধ্যে তিনি যৌন নির্বাচনের হাত দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। ডারউইন ‘ডিসেন্ট’-এ বলেন, প্রাকৃতিক এবং যৌন নির্বাচনের মিলিত কাজের ফলে এপ-জাতীয় পূর্বসূরি থেকে মানুষের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। আর যৌন নির্বাচনের ফলে মানবের নানা ‘রেস’-এর অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। আবার মানুষের মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষের আকার প্রভেদের কারণ হল যৌন নির্বাচন।
তবে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’-র সব চাইতে সমস্যাসঙ্কুল অংশ হল মানব সমাজে নীতিবোধ নিয়ে বিবর্তনীয় ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা। ডারউইন ‘ডিসেন্ট’ লেখার সময়ে মানব সমাজের নীতিবোধের উদ্ভব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। ‘ডিসেন্ট’-এর দীর্ঘতম অধ্যায়টিতে নীতিবোধের উদ্ভব সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ডারউইন প্রাকৃতিক ইতিহাসের দিক থেকে নীতিশাস্ত্রের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখনকার সামাজিক পরিমণ্ডলে যে নীতি ইংলন্ডে চালু ছিল তার সঙ্গে এই নীতিবোধ মেলেনি। বরং ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নীতিবোধ’-এর সঙ্গে অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড হিউমের স্কটিশ নৈতিক বোধের ঐতিহ্যের খানিকটা মিল ছিল।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হল, অ্যাডাম স্মিথ কেবল নীতিবোধের দার্শনিক ছিলেন না; তিনি অর্থনীতিজ্ঞ ও ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’-র আদি প্রবক্তাও ছিলেন। অ্যাডাম স্মিথ মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে নৈতিক ও বাস্তব শক্তি হিসেবে (মুক্ত বাজারের) ‘অদৃশ্য হাত’-এর ধারণাটি প্রথম চালু করেন। বাজারের অদৃশ্য হাত হল মুক্ত বাজারে অংশগ্রহণকারীদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত সামাজিক নানা সুফল। মুক্ত বাজারে বিভিন্ন আত্মস্বার্থসর্বস্ব শক্তি নিজ স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু তার ফলে অনেকের জন্য সুবিধাজনক একটি আর্থসামাজিক ব্যবস্থা সুসংগঠিত হয়ে ওঠে। বাজারের এই অদৃশ্য হাতের সঙ্গে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের অন্ধ ও উদ্দেশ্যবিহীন হাতের মিল হয়তো পুরোটাই আপতিক নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনে প্রতিটি জীব নিজের সন্তানসন্ততি বেশি রাখার স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু তাদের আন্তক্রিয়ার ফলে জীবজগতের সামগ্রিক বিবর্তন সম্ভব হয়, ও একটি সুসংগঠিত জীবজগৎ অনেকে জীবকে ধারণ করে।
বিবর্তন তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে নৈতিক বোধের ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা করার তাগিদে ডারউইনকে মানবেতর প্রাণীর পশু প্রবৃত্তি থেকে মানুষের নৈতিক বোধের উন্মেষের সমস্যার সমাধান হাজির করতে হয়েছিল। জন স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটিরিয়ান তত্ত্ব মানুষের অন্তর্জাতবোধের বদলে অর্জিত গুণাবলীর ওপরে ভিত্তি করে সম্পূর্ণ নীতিশাস্ত্র সাজিয়েছিল। ডারউইন তার সমালোচনা করে বলেন, পশুজগতে আত্মত্যাগ ও পরোপকারী ব্যবহার তাদের সহজাত নৈতিক বোধের কারণে সম্ভব হয়। মানুষ তারই ধারাবাহিকতায় একই সহজাত উদ্দেশ্য দ্বারা প্রণোদিত হতে পারে।
ডারউইনের ‘ডিসেন্ট’ বলেছে, সাধারণত প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব থেকে নৈতিক দ্বন্দ্বর জন্ম হয়। প্রাণীজগতে যে প্রবৃত্তি ‘দলগত নির্বাচন’-এর পক্ষে সুবিধাজনক হয় সেটি জয়লাভ করে। মানুষের মধ্যে ‘সামাজিক প্রবৃত্তি’ দীর্ঘস্থায়ী হয় ও তা ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এভাবেই পরোপকার প্রবৃত্তির জন্ম হয়।
বাস্তবের নীতিবোধের ভিত্তি হিসাবে বিবর্তনীয় ‘প্রাকৃতিক’ নৈতিকতার যে কথা ডারউইন ‘ডিসেন্ট’-এ বলেছিলেন, তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের চিন্তাবিদদের কাছে তা অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় ছিল। কিছু দার্শনিকের মতে, ডারউইন মানবিক নীতিবোধকে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের নানা প্রবণতাতে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়।
ডারউইনের এই পদক্ষেপ নীতিশাস্ত্রকে জীববিজ্ঞানের অংশে পরিণত করার প্রচেষ্টা ছিল। সমস্যা হল, এতে নৈতিকতাকে ‘বেঁচে থাকার সুবিধা’ থেকে আলাদা করার কোনও উপায় ছিল না। এমনকি ডারউইনের সমসাময়িক সমর্থকরাও এটা মেনে নিতে পারেননি। ‘ডারউইনের বুলডগ’ টমাস হক্সলে পর্যন্ত এর সমালোচনা করেন। নীতিশাস্ত্রের বড় সমস্যা হল ‘যা হয়’ আর ‘যা হওয়া উচিত’—এ-দুয়ের ফারাক বুঝে ইতিকর্তব্য ঠিক করা। প্রাকৃতিক নির্বাচন ‘যা হয়’ এর বিবরণ হিসেবে যথেষ্ট হলেও তা ‘যা হওয়া উচিত’ সে বিষয়ে কিছু বলতে পারে না।
পরবর্তীকালের দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও মনস্তত্ত্বের গভীর আলোচনা দেখিয়েছে, ‘যা আছে’ তার যথার্থ উপলব্ধি ব্যতীত ‘যা হওয়া উচিৎ’ তা ঠিক করা অনেকটাই আকাশকুসুম স্বপ্ন মাত্র। কিন্তু সে আলোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিসর দাবি করে।
বিবর্তনবাদ শুধুই থিওরী
বিবর্তনের সমালোচনাকারীরা বিবর্তন শুধুমাত্র একটি থিওরী বা তত্ত্ব বলেন দাবী করেন এবং তারা জোর দেন যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনোই বাস্তব নয়। এই তত্ত্ব বিভ্রান্তিকরভাবে নিজেকে প্রকাশ করে এবং এর কোনো প্রমাণস্বাপেক্ষ না। তাই বিবর্তনবাদ ফ্যাক্ট নয়, শুধুই তত্ত্ব।।
প্রচলিত ভাষায় তত্ত্ব আর বিজ্ঞানের ভাষায় তত্ত্বের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। প্রচলিত ভাষায় তত্ত্বের অর্থ অনুমান হলেও বিজ্ঞানের ভাষায় থিওরী বা তত্ত্ব হচ্ছে এমন এক ব্যাখ্যা যার মাধ্যমে ভবিষ্যতবাণী করে প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই করা যায় এবং অবশ্যই পরীক্ষা করে তার সত্যতা নিশ্চিত করতে হয়। বিবর্তনবাদ প্রজাতির বৈচিত্র্যতা এবং তাদের পুর্বপুরুষকে ব্যাখ্যা করে। এটা উচ্চতর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। বিবর্তনবাদের উদাহরণ হচ্ছে আধুনিক বিবর্তনীয় সমন্বয়, যা ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ এবং মেণ্ডেলের বংশগতিবিদ্যার যুগপৎ উদাহরণ। অন্য যে কোনো মতবাদের মতই এই আধুনিক সমন্বয় ঘনঘন তর্ক-বিতর্ক, পরীক্ষা এবং বারবার বিজ্ঞানীদের দ্বারা সংশোধন হতে থাকে। সর্বশেষ গোটা বিজ্ঞান সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এই সিদ্ধান্তে আসে যে এই মডার্ণ সিন্থেসিস বা আধুনিক সমন্বয় ঘটছে বিবর্তনের কারণে।
সমালোচকরা এটাও বলেন যে বিবর্তন ফ্যাক্ট নয়।[৩০] প্রচলিত অর্থে ফ্যাক্ট হচ্ছে, যা পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং পর্যবেক্ষণ করেই সেখান থেকে তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানে প্রমাণ স্বাপেক্ষে ফ্যাক্ট যে কোনো কিছু হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ জানামতে থিওরী যেমন "পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘুরে" এবং "বস্তু উপর থেকে নিচে পরে অভিকর্ষের কারণে" হতে পারে "ফ্যাক্টস" যদিও এরা সম্পূর্ণভাবে তত্ত্বীয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিবর্তনকেও "ফ্যাক্ট" বলা যায় একই কারণে, যেভাবে অভিকর্ষকে তত্ত্ব বলা হয়। বিবর্তনবাদ পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রক্রিয়া, কারণ জীবের পপুলেশন সময়ের দ্বারা জীনগতভাবে পরিবর্তিত হয়। এইভাবেই বিবর্তনবাদকে ফ্যাক্ট বলা যেতে পারে। এই তত্ত্ব সমাজে প্রতিষ্ঠিত সত্য। এভাবেই বিজ্ঞানীদের কাছে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব এবং ফ্যাক্ট উভয়ভাবেই স্বীকৃত হয় ।
নব্য সৃজনবাদীদের বিবর্তন নিয়ে একটা প্রচলিত অভিযোগ হচ্ছে: বিবর্তন বিজ্ঞানের ধারা অনুসরণ করে না,তাই এটা খাটি বিজ্ঞান নয়। একে বিজ্ঞানের শ্রেণিতে পাঠদান করা উচিত নয়। অথবা এর পাশাপাশি বিকল্প মতবাদ(যেমন সৃজনবাদ) পড়ানো উচিত।
তথ্যসূত্র
১) David Masci, ‘Darwin and His Theory of Evolution’, Pew Research Centre, February 4, 2009
২) J Browne, Wallace and Darwin. Current Biology, Vol 23(24), R1071-R1072, 2013
৩) ‘Darwin’s delay the stuff of myth‘, University of Cambridge Research, 27 Mar 2007
৪) Darwin Correspondence Project. Letter To Asa Gray, 22 May 1860
৫) CR Darwin, ‘The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex’, First Published in 1871
২) CR Darwin, ‘The Expression of the Emotions in Man and Animals’, First Published in 1872
৩) JS Schwartz, CR Darwin, Wallace, ‘The Descent of Man‘, Journal of the History of Biology, vol. 17, no. 2; pp. 271-289 1984
৪) Philip Sloan, ‘Darwin: From Origin of Species to Descent of Man’, Stanford Encyclopedia of Philosophy, First published Mon Jun 17, 2019
৫) T.V Carey, ‘The Invisible Hand of Natural Selection, and Vice Versa‘, Biology & Philosophy, 13, 427–442, 1998
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ