‘অনুমান’ শব্দের অর্থ যার দ্বারা পশ্চাৎ জ্ঞান হয়। যেমন, পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে পশ্চাতে বহ্নির অস্তিত্বের অনুমান হয়। ‘অনু’ শব্দের অর্থ পশ্চাৎ, আর ‘মান’ শব্দের অর্থ জ্ঞান বা প্রমা। সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। কোন পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে যদি বলা হয় যে, ঐ পর্বতে অগ্নি আছে, তবে এই অগ্নির জ্ঞান অনুমানলব্ধ জ্ঞান।
অনুমান হলো পরোক্ষ জ্ঞান। তা প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয়। কোন একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষ করে সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অপর একটি অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ হয় তাকেই অনুমান বলে। অর্থাৎ অনুমানলব্ধ জ্ঞানে জ্ঞানের বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকে না। ইন্দ্রিয়সংশ্লিষ্ট অন্য একটি বিষয়ের সাথে অজ্ঞাত জ্ঞানের বিষয়ের ব্যাপ্তি সম্পর্কের মাধ্যমে অনুমান প্রমা হয়। তাই বলা হয়-
‘ব্যাপ্যদর্শনাৎ অসন্নিকৃষ্টার্থজ্ঞানম্ অনুমানম্’।
অর্থাৎ : ব্যাপ্য পদার্থের জ্ঞান থেকে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অসন্নিকৃষ্ট পদার্থের যে জ্ঞান, তাকে অনুমিতি বলে।
যেমন, পর্বত ধূমবান এই জ্ঞান থেকে পর্বত অগ্নিমান এরূপ জ্ঞান। বহ্নির ব্যাপ্য যে ধূম সেই ধূম পর্বতে আছে একথা জেনে পর্বতে বহ্নির যে জ্ঞান, তাকে বলে অনুমিতি। নৈয়ায়িকেরা ব্যাপ্তিবিশিষ্টপক্ষধর্মতাজ্ঞান বা পরামর্শকে অনুমিতির করণ বলেছেন। মীমাংসকেরা যদিও পরামর্শের কারণতা স্বীকার করেন না, তবে ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পক্ষধর্মতাজ্ঞানকে অনুমিতির কারণ বলে স্বীকার করেন। যেমন, ধূম বহ্নিব্যাপ্য এবং পর্বত ধূমবান- এরূপ দুটি জ্ঞানকে পর্বত বহ্নিমান এরূপ অনুমিতির কারণরূপে মীমাংসকেরা স্বীকার করেন।
অনুমিতির ক্ষেত্রে ব্যাপ্তিজ্ঞান বা ব্যাপ্তি-সম্বন্ধ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপ্তি কী ? মীমাংসামতে ব্যাপ্তি হলো স্বাভাবিক সম্বন্ধ। ভূয়োদর্শনের দ্বারা স্বাভাবিক সম্বন্ধ নিশ্চয় করা যায়। মানমেয়োদয় গ্রন্থে নারায়ণ ভট্ট বলেছেন-
‘স্বাভাবিকঃ সম্বন্ধো ব্যাপ্তিঃ স্বাভাবিকত্বং উপাধিরাহিত্যম্’। -(মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : স্বাভাবিক সম্বন্ধ হলো উপাধিরহিত সম্বন্ধ।
‘উপাধি’ অর্থ শর্তযুক্ত। ব্যাপ্তি হবে শর্তহীন। এজন্য ব্যাপ্তিকে অনৌপাধিক সম্বন্ধ বলা হয়। ধূমের সঙ্গে বহ্নির সম্বন্ধ অনৌপাধিক সম্বন্ধ। কারণ, যেখানে ধূম থাকে সেখানে বহ্নি থাকবে। সেজন্য এই সম্বন্ধকে বলা হয় ব্যাপ্তি সম্বন্ধ। কিন্তু বহ্নির সঙ্গে ধূমের সম্বন্ধ অনৌপাধিক নয়, আর্দ্রেন্ধন উপাধিযুক্ত। অর্থাৎ, বহ্নি বা আগুন থাকলেই সেখানে ধূম থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই। যেমন, গলন্ত লোহায় আগুন থাকলেও সেখানে ধূম থাকে না। ভেজা কাঠ বা আর্দ্র ইন্ধনযুক্ত আগুনে ধূম থাকে। এই আর্দ্র ইন্ধনযুক্ত শর্তের কারণে বহ্নির সঙ্গে ধূমের এই সম্বন্ধকে ব্যাপ্তি বলা যায় না। অতএব, ব্যাপ্তিজ্ঞান হলো নিত্যসাহচর্যরূপ সম্বন্ধনিয়মের জ্ঞান। ধোঁয়াকে বারেবারে আগুনের সঙ্গে দেখে এবং আগুন ছাড়া ধোঁয়া কখনো না দেখে ‘যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন’ এই নিত্যসাহচর্যরূপ সম্বন্ধনিয়মের জ্ঞান হওয়ার পরে পাহাড়ে ধোঁয়া দেখে আগুনের অনুমান ঘটে। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, অনুমান প্রমাণও মূলত প্রত্যক্ষপূর্বক বা প্রত্যক্ষাধীন। উল্লেখ্য, কেবল অনুমানই নয়, মীমাংসা স্বীকৃত ছয়প্রকার প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষভিন্ন সকলেই প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষপূর্বক বা প্রত্যক্ষাধীন। এক্ষেত্রে অনুমানের নিয়ত প্রত্যক্ষপূর্বকত্বকে প্রতিপাদন করতে গিয়ে কুমারিলভট্ট তাঁর শ্লোকবার্তিকে বলেন-
‘যত্রাপ্যনুমিতাল্ লিঙ্গাল্ লিঙ্গিনি গ্রহণং ভবেত্ ।
তত্রাপি মৌলিকং লিঙ্গং প্রত্যক্ষাদেব গম্যতে।।’- (শ্লোকবার্ত্তিক: অনুমান-১৭০)
অর্থাৎ : এমনকি যেক্ষেত্রে অনুমিত কোন লিঙ্গ বা জ্ঞাপক ধর্ম থেকে কোন লিঙ্গী বা জ্ঞাপ্য বিষয়ের অনুমান জন্মায় সেক্ষেত্রেও মূলে থাকে প্রত্যক্ষ।
উপাধিরহিত ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার জন্য ভাট্টরা ভূয়োদর্শনের সাহায্য নিয়েছেন। পাকশালা, মহানস প্রভৃতি স্থলে বারবার ধূম ও বহ্নির সম্বন্ধ দর্শন করে এবং ব্যভিচার দর্শন না করে ধূম ও বহ্নির ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা যায়। ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভাট্টরা তর্কের সাহায্য নিয়েছেন। কোন বিষয়ের বৈপরীত্য আশঙ্কার করলে সেই আশঙ্কায় দোষ প্রদর্শন করাই হলো তর্ক। এজন্য একে অনিষ্ট প্রসঙ্গ বলা হয়। ধূম ও বহ্নির স্বাভাবিক সম্বন্ধ বিষয়ে যদি কারো আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেই আশঙ্কা দোষদুষ্ট বলে প্রমাণ করাই হলো তর্কের লক্ষ্য। এর দ্বারা ধূম ও বহ্নির স্বাভাবিক সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। নৈয়ায়িকদের মতো মীমাংসকরাও দু’প্রকার ব্যাপ্তি স্বীকার করেন- সমব্যাপ্তি ও বিষমব্যাপ্তি।
অনুমান বিভাগের ক্ষেত্রে মীমাংসকরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নৈয়ায়িকদের অনুরূপ নানা বিভাগ নির্দেশ করেছেন। প্রথমত, কেবল-অন্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী এবং অন্বয়-ব্যতিরেকী ভেদে অনুমান ত্রিবিধ। দ্বিতীয়ত, বীত ও অবীত ভেদে অনুমান দ্বিবিধ। বীত অনুমান আবার দৃষ্ট ও সামান্যতঃ দৃষ্ট ভেদে দ্বিবিধ। তৃতীয়ত, স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান ভেদে অনুমান দ্বিবিধ। এইসব নানা প্রকারের অনুমান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মীমাংসকরা মূলত ন্যায় সম্প্রদায়ের অনুগামী হয়েছেন। তবে পরার্থানুমানের অবয়ব প্রসঙ্গে অবশ্য ন্যায়মতের সঙ্গে মীমাংসামতের পার্থক্য বর্তমান। ন্যায়দর্শনে প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন, ন্যায়ের এই পাঁচটি অবয়ব স্বীকার করা হয়েছে। যেমন-
পরার্থানুমান :
(১) পর্বত বহ্নিমান (প্রতিজ্ঞা)
(২) কারণ পর্বত ধূমায়মান (হেতু)
(৩) যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি, যেমন- মহানস বা পাকশালা, কামারশালা ইত্যাদি (উদাহরণ)
(৪) পর্বতও ধূমায়মান (উপনয়)
(৫) সুতরাং পর্বত বহ্নিমান (নিগমন বা সিদ্ধান্ত)।
এই পরার্থানুমান সম্পর্কে কুমারিল ভট্টের মত হলো, পাঁচটি অবয়ব অনাবশ্যক। হয় প্রথম তিনটি অথবা শেষ তিনটি অবয়বই যথেষ্ট। ভাট্ট সম্প্রদায় মতে প্রতিজ্ঞা ও নিগমন এবং হেতু ও উপনয় সমার্থক। সুতরাং ন্যায়ের অবয়ব তিনটিই, পাঁচটি নয়।
বিভিন্ন মীমাংসাশাস্ত্রে বিভিন্ন সংখ্যক হেত্বাভাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘শাস্ত্রদীপিকা’ ও ‘ভাট্টচিন্তামণি’ গ্রন্থে অসিদ্ধ, অনৈকান্তিক ও বাধক এই তিন প্রকার হেত্বাভাসের উল্লেখ আছে। আবার ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে চার প্রকার হেত্বাভাসের উল্লেখ পাওয়া যায়- অসিদ্ধ, বিরুদ্ধ, অনৈকান্তিক ও অসাধারণ।
.
অনুমান প্রমাণের প্রমেয়বিষয়ে নানাপ্রকার মতভেদ দেখা যায়। শ্লোকবার্ত্তিকে কুমারিল বলেছেন-
‘তস্মাদ্ধর্ম্মবিশিষ্টস্য ধর্ম্মিণঃ স্যাৎ প্রমেয়তা।
সা দেশস্যাগ্নিযুক্তস্য ধূমস্যান্যৈশ্চ কল্পিতা।।’- (শ্লোকবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : পর্বতে ধূমদর্শন ও ধূমে বহ্নির ব্যাপ্তি-সম্বন্ধের স্মরণ হলে বহ্নিবিশিষ্টত্বরূপে প্রমেয় পর্বতেরই অনুমিতি হয়। অর্থাৎ ধর্মীই অনুমানের প্রমেয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ