মীমাংসা দার্শনিকেরা মূলত বেদের প্রামাণ্য প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেই জ্ঞানের স্বরূপ, যথার্থ ও অযথার্থ জ্ঞানের পার্থক্য নির্ণয়, যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় এবং এতৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন। মীমাংসা দর্শন মতে, সমস্ত বস্তুই হয় প্রমাণ অথবা প্রমেয়ের অন্তর্গত। এই মতে, প্রমাণ হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের করণ বা উপায়, আর প্রমেয় হলো যথার্থ জ্ঞানের বিষয়।
মনীষী নারায়ণভট্ট তাঁর মানমেয়োদয় গ্রন্থে বলেন-
মনীষী নারায়ণভট্ট তাঁর মানমেয়োদয় গ্রন্থে বলেন-
‘মানমেয়বিভাগেন বস্তুনাং দ্বিবিধা স্থিতিঃ’।- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : জগতের সকল বস্তুই (মান) প্রমাণ অথবা (মেয়) প্রমেয়র অন্তর্গত। এই দুই প্রকার বিভাগের অন্তর্গত নয় এমন কোন বস্তু জগতে নেই।
.
এ প্রেক্ষিতে আবারো মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনির প্রথম সূত্রটি স্মরণ করা যেতে পারে-
‘অথাতো ধর্ম্মজিজ্ঞাসা’ বা সন্ধি-ভেঙে বললে- ‘অথ অতঃ ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা’।
.
এখানে- ‘অথ’ শব্দটির অর্থ- আনন্তর্য্য। বেদাধ্যয়নের অনন্তর। ‘অতঃ’ শব্দের দ্বারা ত্রৈবর্ণিকের অধিকার স্থির করা হইয়াছে। বিচার ব্যতীত প্রকৃত অর্থের নির্ণয় হইতে পারে না বলিয়া ধর্ম্মজিজ্ঞাসা তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। ‘জিজ্ঞাসা’ পদে ‘জ্ঞা’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান এবং ‘সন্’ প্রত্যয়ের অর্থ ইচ্ছা। জ্ঞান ইচ্ছানিষ্পাদ্য নহে। কেহ ইচ্ছা করিলেই তাহার জ্ঞান হয় না। ইচ্ছাও কর্ত্তব্য, অর্থাৎ ক্রিয়ানিষ্পাদ্য নহে। কোনও ক্রিয়ার দ্বারা ইচ্ছা জাগ্রত হয় না। অতএব ‘ধর্ম্মজিজ্ঞাসা’ পদস্থিত ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দের লাক্ষণিক অর্থ স্থির করা হইয়াছে- বিচার।’- (সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-২০)।
.
উল্লেখ্য, সকল বিচারই বিচার্য্য বিষয়ের অপেক্ষা রাখে। আর অগ্নিহোত্র প্রভৃতি বৈদিক যাগাদি কর্মই মীমাংসামতে ধর্ম। এটাই বেদের অর্থ বা প্রতিপাদ্য। অতএব ধর্ম শব্দের অর্থ হচ্ছে- বেদার্থ। এবং এই বেদার্থই বিচারের বিষয়। তবে এখানে ধর্ম শব্দটি প্রমানাদিরও উপলক্ষণ বটে। অর্থাৎ শুধু ধর্মই বিচার্য্য নয়, প্রমাণ ও প্রমেয়াদিও বিচার্য্য। তাই, ধর্মজিজ্ঞাসা কর্তব্য- এ কথা জানার পরেই ধর্ম কী, তার লক্ষণ বা স্বরূপ কী- এই প্রশ্নও জাগে। যেহেতু লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারাই সকল বস্তুর অস্তিত্ব স্থির করতে হয়, তাই আচার্যরা বলেন-
এ প্রেক্ষিতে আবারো মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনির প্রথম সূত্রটি স্মরণ করা যেতে পারে-
‘অথাতো ধর্ম্মজিজ্ঞাসা’ বা সন্ধি-ভেঙে বললে- ‘অথ অতঃ ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা’।
.
এখানে- ‘অথ’ শব্দটির অর্থ- আনন্তর্য্য। বেদাধ্যয়নের অনন্তর। ‘অতঃ’ শব্দের দ্বারা ত্রৈবর্ণিকের অধিকার স্থির করা হইয়াছে। বিচার ব্যতীত প্রকৃত অর্থের নির্ণয় হইতে পারে না বলিয়া ধর্ম্মজিজ্ঞাসা তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। ‘জিজ্ঞাসা’ পদে ‘জ্ঞা’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান এবং ‘সন্’ প্রত্যয়ের অর্থ ইচ্ছা। জ্ঞান ইচ্ছানিষ্পাদ্য নহে। কেহ ইচ্ছা করিলেই তাহার জ্ঞান হয় না। ইচ্ছাও কর্ত্তব্য, অর্থাৎ ক্রিয়ানিষ্পাদ্য নহে। কোনও ক্রিয়ার দ্বারা ইচ্ছা জাগ্রত হয় না। অতএব ‘ধর্ম্মজিজ্ঞাসা’ পদস্থিত ‘জিজ্ঞাসা’ শব্দের লাক্ষণিক অর্থ স্থির করা হইয়াছে- বিচার।’- (সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-২০)।
.
উল্লেখ্য, সকল বিচারই বিচার্য্য বিষয়ের অপেক্ষা রাখে। আর অগ্নিহোত্র প্রভৃতি বৈদিক যাগাদি কর্মই মীমাংসামতে ধর্ম। এটাই বেদের অর্থ বা প্রতিপাদ্য। অতএব ধর্ম শব্দের অর্থ হচ্ছে- বেদার্থ। এবং এই বেদার্থই বিচারের বিষয়। তবে এখানে ধর্ম শব্দটি প্রমানাদিরও উপলক্ষণ বটে। অর্থাৎ শুধু ধর্মই বিচার্য্য নয়, প্রমাণ ও প্রমেয়াদিও বিচার্য্য। তাই, ধর্মজিজ্ঞাসা কর্তব্য- এ কথা জানার পরেই ধর্ম কী, তার লক্ষণ বা স্বরূপ কী- এই প্রশ্নও জাগে। যেহেতু লক্ষণ এবং প্রমাণের দ্বারাই সকল বস্তুর অস্তিত্ব স্থির করতে হয়, তাই আচার্যরা বলেন-
‘মানাধীনা মেয়সিদ্ধির্মানসিদ্ধিশ্চ লক্ষণাৎ।’
অর্থাৎ : প্রমাণের দ্বারা প্রথমত প্রমেয় বস্তুটির অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় এবং লক্ষণের দ্বারাই বস্তুর প্রামাণ্য সিদ্ধ হয়।
.
তার মানে দাঁড়ালো এই,- যেকোনও অজ্ঞাত বস্তুর স্বরূপ জানতে হলে সেই বস্তুটির লক্ষণই প্রথমত জানতে হয়। স্বরূপ জানার পর সেই বস্তুবিষয়ে প্রমাণ প্রয়োগ করা চলে। এ প্রেক্ষিতে ধর্মের লক্ষণ বা স্বরূপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু আপত্তি উত্থাপিত হয়। যেমন-
‘লক্ষ্য বস্তুর লোকপ্রসিদ্ধ আকৃতিকেই সাধারণতঃ লক্ষণ বলা হয়। লক্ষণ সকল সময়েই অসম্ভব, অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষ হইতে মুক্ত থাকিবে। যেহেতু ধর্ম্ম সাধারণ লৌকিক বস্তু নহে, সেইহেতু তাহার কোন লক্ষণও থাকিতে পারে না। ধর্ম্মের রূপ প্রভৃতি নাই বলিয়া তাহা প্রত্যক্ষের বিষয়ই নহে। কোন হেতুর সাহায্যে অনুমান করিবারও উপায় নাই। কারণ, অনুমান করিতে গেলেও হেতুটির প্রত্যক্ষ হওয়া চাই এবং হেতু ও সাধ্যের সহাবস্থানরূপ ব্যাপ্তির জ্ঞান থাকা চাই। অপ্রত্যক্ষ বস্তু বিষয়ে ব্যাপ্তিজ্ঞানাদি হইতে না পারায় ধর্ম্ম অনুমান প্রমাণের বিষয়ও হইতে পারে না। শব্দ প্রমাণও এইস্থলে সম্ভবপর নহে। অপ্রসিদ্ধ অলৌকিক বস্তু শব্দের দ্বারা কথিত হইলেও শব্দার্থের সঙ্গতিজ্ঞানের অভাবে তাহা শব্দপ্রমাণের বিষয় হয় না। গলকম্বলাদিবিশিষ্ট প্রাণী যদি কাহারও প্রত্যক্ষ বা অনুমানের বিষয়ই না হইত, তবে ‘গো’ শব্দটি যে সেই প্রাণীর বাচক, তাহা শব্দপ্রমাণের দ্বারা জানা যাইত না। অতএব ধর্ম্ম বস্তুটি লক্ষণ ও প্রমাণের বিষয়ীভূত হয় না বলিয়া তদ্বিষয়ে বিচারের কথাই উঠিতে পারে না।’- (সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-২১)।
.
এসব আপত্তি নিরসনকল্পে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে বলেন-
তার মানে দাঁড়ালো এই,- যেকোনও অজ্ঞাত বস্তুর স্বরূপ জানতে হলে সেই বস্তুটির লক্ষণই প্রথমত জানতে হয়। স্বরূপ জানার পর সেই বস্তুবিষয়ে প্রমাণ প্রয়োগ করা চলে। এ প্রেক্ষিতে ধর্মের লক্ষণ বা স্বরূপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু আপত্তি উত্থাপিত হয়। যেমন-
‘লক্ষ্য বস্তুর লোকপ্রসিদ্ধ আকৃতিকেই সাধারণতঃ লক্ষণ বলা হয়। লক্ষণ সকল সময়েই অসম্ভব, অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষ হইতে মুক্ত থাকিবে। যেহেতু ধর্ম্ম সাধারণ লৌকিক বস্তু নহে, সেইহেতু তাহার কোন লক্ষণও থাকিতে পারে না। ধর্ম্মের রূপ প্রভৃতি নাই বলিয়া তাহা প্রত্যক্ষের বিষয়ই নহে। কোন হেতুর সাহায্যে অনুমান করিবারও উপায় নাই। কারণ, অনুমান করিতে গেলেও হেতুটির প্রত্যক্ষ হওয়া চাই এবং হেতু ও সাধ্যের সহাবস্থানরূপ ব্যাপ্তির জ্ঞান থাকা চাই। অপ্রত্যক্ষ বস্তু বিষয়ে ব্যাপ্তিজ্ঞানাদি হইতে না পারায় ধর্ম্ম অনুমান প্রমাণের বিষয়ও হইতে পারে না। শব্দ প্রমাণও এইস্থলে সম্ভবপর নহে। অপ্রসিদ্ধ অলৌকিক বস্তু শব্দের দ্বারা কথিত হইলেও শব্দার্থের সঙ্গতিজ্ঞানের অভাবে তাহা শব্দপ্রমাণের বিষয় হয় না। গলকম্বলাদিবিশিষ্ট প্রাণী যদি কাহারও প্রত্যক্ষ বা অনুমানের বিষয়ই না হইত, তবে ‘গো’ শব্দটি যে সেই প্রাণীর বাচক, তাহা শব্দপ্রমাণের দ্বারা জানা যাইত না। অতএব ধর্ম্ম বস্তুটি লক্ষণ ও প্রমাণের বিষয়ীভূত হয় না বলিয়া তদ্বিষয়ে বিচারের কথাই উঠিতে পারে না।’- (সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা দর্শন, পৃষ্ঠা-২১)।
.
এসব আপত্তি নিরসনকল্পে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে বলেন-
‘চোদনালক্ষণোহর্থো ধর্ম্মঃ।’- (মীমাংসাসূত্র-১/১/২)
অর্থাৎ : চোদনা লক্ষণ অর্থাৎ চিহ্ন বা জ্ঞাপক যার সেই বিষয়ই ধর্ম।
এই সূত্রটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার শবরস্বামী বলছেন-‘ক্রিয়ায়ঃ প্রবর্ত্তকং বচনং চোদনা।’- (শাবরভাষ্য)অর্থাৎ : ক্রিয়ার প্রবর্তক বচনের নাম ‘চোদনা’। তার মানে, প্রবর্তনা বা নিবর্তনার বিধায়ক বেদবাক্য হলো চোদনা লক্ষণ শব্দে বোঝানো হচ্ছে- যার দ্বারা লক্ষিত বা জ্ঞাপিত হয়। চোদনা লক্ষণ যার, তা-ই চোদনালক্ষণ। জৈমিনির এই সূত্রে ধর্মের লক্ষণ এবং চোদনার প্রামাণ্য, দুই-ই বলা হয়েছে। ‘চোদনাই লক্ষণ, অর্থাৎ প্রমাণ যার’, তা-ই চোদনালক্ষণ। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একমাত্র চোদনাই ধর্ম বিষয়ে প্রমাণ। আবার ‘চোদনা লক্ষণ প্রমাণই যার’ এরকম অর্থ করলে বোঝা যায়, চোদনা প্রমাণই, অপ্রমাণ নয়। এই উভয় অর্থই সূত্রকারের অভিমত বলে ভাষ্য ও ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন। ভট্টপাদ তথা কুমারিল ভট্ট শ্লোকবার্ত্তিকে প্রামাণ্য বিচার করতে গিয়ে ‘চোদনা’ অর্থাৎ বেদবাক্যই যে ধর্মবিষয়ে প্রমাণ- তা স্থাপন করেছেন। বলা হয়- সূত্রে ‘অর্থ’ শব্দের দ্বারা অনর্থ বা অনিষ্টের হেতুকে বারণ করা হয়েছে। অনর্থের হেতুভূত কর্ম বেদবিহিত হলেও ধর্ম নয়। অতএব বলতে হবে- যেখানে ধর্মত্ব আছে, সেখানে চোদনালক্ষণত্ব আছে। ধর্ম হচ্ছে ব্যাপ্য আর চোদনালক্ষণ ব্যাপক। মূলত বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মীমাংসাশাস্ত্রে এইসব বিচারের আয়োজন হয়েছে।
৩.১ : প্রমাণ
…
মীমাংসা দর্শনে প্রমাণত্ব আলোচনার মূলে প্রকৃত উৎসাহ আসলে বেদের প্রামাণ্য প্রতিপন্ন করা। মীমাংসকদের প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো বেদ অপৌরুষেয় এবং নিত্য। অবশ্য তাঁদের কাছে বেদ বলতে বেদের কর্মকাণ্ডই, অর্থাৎ যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকর্মের বিধি-নিষেধ এবং বিধি-নিষেধের প্রশংসা বা অর্থবাদ। কিন্তু মীমাংসকরা এটা অনুভব করেছিলেন যে, বহির্জগতের যাথার্থ্য সিদ্ধ না হলে যাগযজ্ঞ অর্থহীন হবার আশঙ্কা আছে। ফলে তাঁরা ভাববাদ খন্ডন করে বাহ্যবস্তুবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। যেহেতু ভাববাদীরা ভাববাদের সমর্থনে প্রধানতই প্রমাণাশ্রিত যুক্তির উপর নির্ভর করেন, তাই ভাববাদ-খন্ডনে মীমাংসকরা প্রমাণতত্ত্বের বিচারে প্রবিষ্ট হতে বাধ্য হয়েছেন।
সাধারণভাবে প্রমাণতত্ত্বের আলোচনায় প্রথমে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন ওঠে- প্রমার লক্ষণ কী, প্রামাণ্যের ব্যাখ্যা কী, ভ্রমের ব্যাখ্যা কী ? ফলে মীমাংসকদের পক্ষেও এই মৌলিক প্রশ্নগুলি বিচারের প্রয়োজন হয়েছিলো। ভারতীয় দর্শনে বাহ্যবস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণতত্ত্বের বিশেষ আলোচনা মূলত ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়েরই। তাই প্রমাণতত্ত্বের বিষয়ে ন্যায়-বৈশেষিকদের সঙ্গে মীমাংসকদের মতের তুলনামূলক আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মতের মিলও যেমন আছে, আবার গভীর পার্থক্যও রয়েছে।
প্রমার করণকে প্রমাণ বলা হয়। এ বিষয়ে নৈয়ায়িক ও ভাট্ট-মীমাংসকরা একমত। কিন্তু প্রশ্ন হলো- প্রমা কী ? ‘প্রমা’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো প্রকৃষ্ট জ্ঞান। ‘প্র’-পূর্বক ‘মা’ ধাতুর অর্থ প্রকৃষ্ট জ্ঞান, অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান। মীমাংসক কুমারিল ভট্ট প্রমাত্বের লক্ষণে দেখাতে চোদনাসূত্রের ৮০নং শ্লোকবার্তিকে বলেন-
‘তস্মাদ্ দৃঢ়ং যদুৎপন্নং নাপি সংবাদমৃচ্ছতি।
জ্ঞানান্তরেণ বিজ্ঞানং তৎপ্রমাণং প্রতীয়তাম্ ।।’ -(শ্লোকবার্তিক-৮০)
অর্থাৎ : যে জ্ঞান দৃঢ়ভাবে উৎপন্ন হয় এবং অন্যজ্ঞানের দ্বারা সংবাদ প্রাপ্ত হয় না, সেই জ্ঞানই এইমতে প্রমাণ বা প্রমা।
সহজ কথায়, ভাট্ট মতে, যে জ্ঞানে কোন অজ্ঞাত বা অনধিগত বিষয়ের জ্ঞান হয় এবং যে জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয় না তাই প্রমা। পূর্বে অজ্ঞাত কোন বিষয় সম্পর্কে সম্যক-পরিচয় হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান। এই যথার্থ জ্ঞান অন্য কোন জ্ঞানের দ্বারা বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে না। অতএব, ভাট্ট-মীমাংসা মতে প্রমার লক্ষণ যাথার্থ্য এবং অনধিগতত্ব। অনধিগতত্ব মানে অভিনবত্ব। অর্থাৎ কুমারিল-মতে প্রমার বিষয় অভিনব হতে হবে। পূর্বানুভূত বিষয়ের জ্ঞান প্রমা নয়। প্রাভাকর-মীমাংসক শালিকনাথ মিশ্র তাঁর প্রকরণপঞ্চিকায় ভাট্টসম্মত প্রমার লক্ষণে বলেছেন-
‘দৃঢ়ং অবিসংবাদি অগৃহীতার্থ গ্রাহকং প্রমাণম্’। -(প্রকরণপঞ্চিকা)
অর্থাৎ : যে দৃঢ় জ্ঞান অবিসংবাদি ও অগৃহীতার্থগ্রাহী বা অজ্ঞাত, তাই প্রমাণ।
‘অজ্ঞাতো যঃ তত্ত্বার্থঃ’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : অজ্ঞাত পদার্থের তত্ত্বার্থজ্ঞানই প্রমাণ।
‘অজ্ঞাত’ পদটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নারায়ণ ভট্ট আরো বলেন-
‘অজ্ঞাতপদেনাত্র জ্ঞাত-বিষয়য়োঃ স্মৃত্যনুবাদয়োর্নিরাসঃ।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : ‘অজ্ঞাত’ পদের দ্বারা স্মৃতি ও অনুবাদকে লক্ষ্য প্রমার বহির্ভূত করা হয়েছে।
ভাট্ট-মতে পূর্বানুভূত বিষয়ের জ্ঞান প্রমা নয়। অনুভবের যা বিষয় হয়, অনুভবজন্য স্মৃতিরও তাই বিষয় হয় বলে স্মৃতি জ্ঞাতবিষয়ক, অজ্ঞাতবিষয়ক নয়। অতএব, স্মৃতিকে প্রমা বলা যায় না, কেননা তার বিষয় পূর্বানুভূত। শ্লোকবার্ত্তিকের নিরালম্বনবাদে ভট্টপাদ কুমারিলভট্ট বলেন-
‘স্বপ্নাদিপ্রত্যয়ে বাহ্যং সর্ব্বদা ন হি নেষ্যতে।
সর্ব্বত্রালম্বনং বাহ্যং দেশকালান্যথাত্মকম্ ।।
জন্মন্যেকত্র ভিন্নে বা তথা কালন্তরেহপি বা।
তদ্দেশো বান্যদেশো বা স্বপ্নজ্ঞানস্য গোচরঃ।।’- (শ্লোকবার্ত্তিক-নিরালম্বনবাদ)
অর্থাৎ :
স্বপ্নজ্ঞান হচ্ছে পূর্বানুভূত বাহ্য পদার্থবিষয়ক জ্ঞান। স্বপ্নজ্ঞানের বিষয় ইহজন্মে অনুভূত না হলেও অবশ্যই পূর্বতন কোন জন্মে অনুভূত। যে-কোন জন্মে, যে-কোন স্থানে এবং যে-কোন কালে অনুভূত বিষয়ই আমাদের স্বপ্নজ্ঞানের বিষয় হয়ে থাকে।
একই কারণে ভাট্টরা অনুবাদকেও প্রমা বলেন নি। এক শব্দের পরিবর্তে অন্য শব্দের কথনকে বা এক ভাষার পরিবর্তে ভিন্ন ভাষার কথনকে অনুবাদ বলে। অনুবাদের বিষয় সব সময় পূর্বজ্ঞাত, অজ্ঞাত নয়। তাই অনুবাদ প্রমা নয়। ন্যায়-বৈশেষিক এবং প্রভাকরও স্মৃতিকে প্রমা বলে গ্রহণ করেন নি। প্রাভাকর-মতেও স্মৃতির লক্ষণ অনুভূতি, তাই স্মৃতি প্রমা নয়। প্রাভাকর-মীমাংসক শালিকনাথ মিশ্র তাঁর প্রকরণপঞ্চিকায় এ বিষয়ে বলেন-
‘প্রমাণমনুভূতিঃ বা স্মৃতেরন্যা ন সা স্মৃতিঃ।
ন প্রমাণং স্মৃতিঃ পূর্বপ্রতিপত্তিব্যপেক্ষণাৎ।।’- (প্রকরণপঞ্চিকা)
অর্থাৎ : স্মৃতির লক্ষণ অনুভূতি এবং তা পূর্বাপ্রতিপত্তি বা পূর্বানুভব সাপেক্ষ বলে স্মৃতি প্রমা নয়।
তবে প্রাভাকররা অনধিগতত্ত্বকে প্রমার লক্ষণ বলে স্বীকার করেন নি। অন্যদিকে, ন্যায়-বৈশেষিক মতে প্রমার লক্ষণ হলো যথার্থ অনুভব। কিন্তু স্মৃতিরূপ জ্ঞান নিশ্চয়াত্মক হলেও তা প্রমা নয়, কেননা তা অনুভব নয়। ন্যায়মতে, যে বিষয় পূর্বে কোন প্রমাণ দ্বারা অধিগত বা অনুভূত হয়েছে সেই বিষয়ের সংস্কারজন্য যে স্মরণজ্ঞান, তাই স্মৃতি। কিন্তু সেস্থলে সেই স্মরণের করণ পূর্বানুভবের যা কারণ, তা-ই সে-বিষয়ে প্রমাণ হওয়ায় পৃথক প্রমান স্বীকার অনাবশ্যক।
অন্যদিকে আবার মীমাংসামতে ধারাবাহিক জ্ঞান বা দীর্ঘক্ষণ ধরে একই বিষয়ের জ্ঞানকে প্রমা বলে স্বীকার করা হয়। ধারাবাহিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তৃতীয় ইত্যাদি পরবর্তী ক্রমাত্মক জ্ঞানের প্রমাত্ব অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে মীমাংসকদের বক্তব্য হলো, ধারাবাহিক জ্ঞানস্থলে প্রবাহক্রমে উৎপন্ন জ্ঞানগুলি হুবহু একই বিষয়ক হয় না। এক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয়স্বরূপ ঘটের উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেন, ধারাবাাহিক স্থলে উত্তরোত্তরক্ষণে উৎপাদ্যমান জ্ঞানগুলিতে জ্ঞায়মান ঘটটি যে যে ক্ষণে বিদ্যমান সেই ক্ষণও বিষয়ীভূত ঘটের বিশেষণরূপে ভাসমান হয়। প্রত্যেকটি প্রত্যক্ষই সেই সেই ক্ষণবিশিষ্ট বিষয়কে প্রকাশ করে। ঘটবিষয়ক ধারাবাহিক জ্ঞানস্থলে কেবল ঘটই প্রত্যক্ষ হয় না, যে কালে অর্থাৎ যে ক্ষণে ঘটটি বিদ্যমান সেই কাল বা ক্ষণটিও ঘটটির বিশেষণরূপে জ্ঞানের বিষয় হয়। ঘটটি বস্তুত এক হলেও দ্বিতীয়াদি ক্ষণের জ্ঞানের বিষয় তৎক্ষণবিশিষ্ট যে ঘট, তা প্রথম ক্ষণের জ্ঞানের বিষয় না হওয়ায় ধারাবাহিকস্থলে দ্বিতীয়াদি প্রত্যেকটি জ্ঞান অনধিগত বস্তুবিষয়ক হয়। পার্থসারথি মিশ্র তাই তাঁর শাস্ত্রদীপিকায় এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে বলেছেন-
‘ধারাবাহিকেষু অপি উত্তরোত্তরোষাম্ কালান্তরসম্বন্ধস্য অগৃহীতস্য গ্রহণাৎ যুক্তম্ প্রামাণ্যম্ ।’- (শাস্ত্রদীপিকা)
অর্থাৎ : ধারাবাহিকভাবে উৎপন্ন উত্তরোত্তর জ্ঞান কালান্তরসম্বন্ধের কারণেই অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান হিসেবে তা প্রমাণ। (মুক্ত-তর্জমা)
পারিভাষিক অর্থে ‘প্রমাণ’ মানে ‘প্রমার করণ’। ন্যায়শাস্ত্রে করণ এবং কারণের মধ্যে প্রভেদ করা হয়-‘ব্যাপারবৎ অসাধারণং কারণং করণম্’।অর্থাৎ : যে-অসাধারণ কারণের সক্রিয়তার ফলে একটি নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি তাকে করণ বলা হয়।এই অর্থে ‘প্রমার করণ’ বা ‘প্রমাণ’ মানে প্রত্যক্ষ অনুমানাদি যথার্থজ্ঞানের উৎস। প্রত্যক্ষই প্রত্যক্ষ-প্রমার কারণ, অনুমানই অনুমানমূলক প্রমার কারণ, ইত্যাদি। কিন্তু ‘প্রমাণ’ শব্দটি সবসময় শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। অনেক সময় প্রমা বা যথার্থজ্ঞান অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে প্রমার যে-যথার্থত্ব বা সত্যতা, তাকে বলা হয়েছে প্রামাণ্য বা প্রমাত্ব। একইভাবে অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্বকে বলা হয়েছে অপ্রামাণ্য।
৩.২ : প্রমাণের প্রকারভেদ
…
প্রমা ও প্রমাণের প্রকার বা সংখ্যা নিয়ে ভারতীয় দর্শনে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত। চার্বাকপন্থী লোকায়ত সম্প্রদায় কেবল ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষজ্ঞানকেই যথার্থ বলে মানেন। বেদবিরোধী আস্তিক বৈশেষিক এবং বেদবিরোধী নাস্তিক বৌদ্ধ দর্শনে প্রত্যক্ষের পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রমাণ হিসেবে অনুমানকেও স্বীকার করা হয়। আরেক প্রমাণদ্বৈবিধ্যবাদী শব্দাদ্বৈতী পাণিনিদর্শনে অনুমানের বদলে স্থান দেয়া হয়েছে আগম বা শব্দপ্রমাণকে। আবার সাংখ্যদার্শনিকদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বেদান্তীদের অধিকাংশ সম্প্রদায় অনুমানকে না ছেঁটে আগম বা শব্দপ্রমাণকে জায়গা করে দিয়ে ত্রিবিধ প্রমাণ স্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে ত্রিবিধ প্রমাণ হলো- প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং আগম বা শাব্দপ্রমাণ। এদিকে উপমান অর্থাৎ সাদৃশ্যের জ্ঞানকে যুক্ত করে নৈয়ায়িকরা স্বীকার করেন চতুর্বিধ প্রমাণ- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং আগম বা শাব্দপ্রমাণ।
মীমাংসার দুই প্রসিদ্ধ সম্প্রদায় কুমারিল ভট্ট প্রবর্তিত ভাট্টপ্রস্থান এবং প্রভাকর মিশ্র কর্তৃক প্রবর্তিত প্রাভাকর-প্রস্থানে ন্যায়সম্মত চারটি প্রমাণের সাথে অর্থাপত্তি নামে পঞ্চম একটি প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনেও এই পঞ্চবিধ প্রমাণ স্বীকৃত- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ বা আগম এবং অর্থাপত্তি। তবে এই পঞ্চবিধ প্রমাণের সাথে কৌমারিল বা ভাট্ট-মীমাংসকেরা ষষ্ঠ প্রমাণ হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন অনুপলব্ধি বা অভাবপ্রমাণকে। অর্থাৎ ভাট্টমীমাংসক মতে প্রমাণ ছয় প্রকার- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ, অর্থাপত্তি এবং অনুপলব্ধি। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, মীমাংসা দর্শনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় এই দর্শনে সর্বাপেক্ষা দৃঢ় প্রমাণ হলো শব্দপ্রমাণ বা বেদ।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ