ওয়ার্মহোল ও টাইম মেশিন - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

ওয়ার্মহোল ও টাইম মেশিন

আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখেছি, কালের  বিবর্তনে ‘সময়’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টেছে। বিংশ শতকের শুরুতেও মানুষ পরম সময়ের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো ঘটনা কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়েই ঘটতে পারে [১] এবং যে কোনো ভালো ঘড়ি দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ের পরিমাপ একই দেখাবে। কিন্তু দেখা গেল, দর্শক যেদিকেই যান, আলোর বেগ সব সময় একই থাকে। এর ফলে সময়ের পরম ধারণা ভেঙে গেল। আমরা পেলাম আপেক্ষিক তত্ত্ব। একই ঘটনার সময়ের পরিমাপ বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রত্যেক দর্শক তার নিজের ঘড়িতে অন্যদের থেকে ভিন্ন সময় পাবেন। ফলে সময় একটি একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি নির্ভর করছে কে মাপছেন তার উপর।  কিন্তু এত কিছুর পরেও সময়কে রেল লাইনের পথের মতো সোজা মনে করা হচ্ছিল, যেখানে আপনি শুধু যে কোনো এক দিকেই যেতে পারেন। কিন্তু কেমন হবে যদি রেল লাইনের মধ্যে লুপ (চক্র বা ফাঁস) বা শাখা-প্রশাখা থাকে, যাতে চাইলে ট্রেন সামনেও এগিয়ে যেতে পারে আবার চাইলে পেরিয়ে আসা স্টেশনে আবার ফিরেও আসতে পারে। সোজা কথায়, কেউ কি চাইলে ভবিষ্যৎ বা অতীতে যেতে পারে? দি টাইম মেশিন উপন্যাসে এইচ জি ওয়েলস এই সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখেছেন। একই কাজ করা হয়েছে আরও বহু সায়েন্স ফিকশনে। অতীতে দেখা গেছে সায়েন্স ফিকশনের অনেক কিছুই বাস্তবে সম্ভব হয়েছে, যেমন সাবমেরিন, চন্দ্র ভ্রমণ ইত্যাদি। তাহলে টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা আসলে কেমন?
time travel👈বাস্তবিকতা
টাইম মেশিন। [টাইম মেশিনে বসে আছেন দুই লেখক]
টাইম ট্র্যাভেল করে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে আমরা এমন একটি টাইম মেশিন বানাতে পারি যেটা আমাদেরকে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেবে। টাইম মেশিনে চেপে বসুন, একটু অপেক্ষা করুন, নেমে দেখবেন পৃথিবীতে আপনার নিজের চেয়ে অনেক বেশি সময় পার হয়েছে। এই মেশিন বানানোর মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এখনো আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু আমরা জানি এটা বানানো সম্ভব, কী কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তাও জানা। আমাদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত টুইন প্যারাডক্সের সুবিধা নিয়ে এমন একটি মেশিন বানানো যেতে পারে। কৌশল হল, আপনি রকেটে করে উড়াল দেবেন। এটি গতি বৃদ্ধি করে আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছবে। কিছুক্ষণ এভাবে ভ্রমণ করে ফিরে আসুন (কত সময় এভাবে চলবেন তা নির্ভর করে আপনি কতটুকু ভবিষ্যতে যেতে চান তার উপর।) আপনি নিশ্চয়ই এতে অবাক হবেন না যে আপনার টাইম মেশিন একই সাথে একটি মহাকাশযানও [২]। পুরো সময়টা আপনি এই টাইম মেশিনের ভেতরেই থাকবেন। বের হয়ে আপনি দেখবেন আপনার নিজের চেয়ে পৃথিবীতে বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আপনি চলে এসেছেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা কি পেছনে যেতে পারব? অর্থ্যাৎ, আমরা কি অতীতে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করতে পারব?
পদার্থবিদ্যার সূত্র ব্যবহার করে অতীতে ভ্রমণ করার সম্ভাবনা সবার আগে খুঁজে পান কার্ট গোদেল। তিনি ১৯৪৯ সালে আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের একটি নতুন সমাধান বের করেন। এ থেকে দেখা গেল যে নতুন ধরনের একটি স্থান- কাল পাওয়া যাচ্ছে। আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে  অনেকগুলো গাণিতিক মডেল বের করা যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এর সবগুলো সমাধানই আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে প্রযোজ্য। যেমন, এদের প্রারম্ভিক অথবা প্রান্তীয় শর্তগুলো ভিন্ন হয়। এই মডেলগুলো যা বলছে তা বাস্তব পর্যবেক্ষণের সাথে মিলিয়ে নিয়ে আমরা বুঝতে পারব যে এগুলো আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে চলবে কি না।
গোদেল ছিলেন একজন গণিতবিদ। একটি গাণিতিক প্রমাণের জন্য তিনি খুব বিখ্যাত। তিনি প্রমাণ করেন যে সব সঠিক বক্তব্য প্রমাণ করা সম্ভব নয় (অর্থ্যাৎ, কিছু কথা এমন থাকবে যা সঠিক, কিন্তু তা প্রমাণ করা যাবে না)। এমনকি আপনি যদি সব সঠিক বক্তব্যের মধ্যে কাটছাঁট করে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, যেমন পাটিগণিতের সবগুলো টপিকও প্রমাণ করতে চান, তবুও তা সম্ভব হবে না। অনিশ্চয়তা নীতির মতোই হয়ত গোদেলের এই ইনকমপ্লিটনেস থিওরেম  বা অপূর্ণাঙ্গতার উপপাদ্য (incompleteness theorem)  মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অর্জন ও পূর্বাভাস তৈরিতে বিধি- নিষেধ আরোপ করছে। আইনস্টাইন ও গোদেল দুজনেরই জীবনের শেষের মুহূর্তগুলোতে গবেষণার স্থান ছিল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি। এ সময় গোদেল সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। গোদেলের প্রস্তাবিত স্থান- কালের মজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি বলছে যে পুরো মহাবিশ্বই আবর্তিত হচ্ছে বা ঘুরছে।
 পুরো মহাবিশ্বই আবর্তিত হচ্ছে- এই কথার মানে কী? আবর্তিত হবার মানে হল, কোনো স্থির প্রসঙ্গ বিন্দুর উপস্থিতি যাকে কেন্দ্র করে বস্তুটি ঘুরবে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, ‘কিসের সাপেক্ষে ঘুরছে?’ উত্তরটা হবে একটু গুরুগম্ভীর। মূলত ছোট্ট লাটিম বা জাইরোস্কোপের মুখ যেদিকে থাকে, দূরের বস্তুগুলো মহাবিশ্বের মধ্যে সেদিকে মুখ করে ঘুরবে। গোদেলের স্থান- কালে গাণিতিকভাবে এতে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। আপনি যদি পৃথিবী থেকে অনেক দূর ভ্রমণ করে আবার ফিরে আসেন, তবে সম্ভাবনা আছে যে আপনি পৃথিবীতে ফিরে আসবেন রওনা দেবার আগের কোনো সময়ে!
নিজের সমীকরণ থেকে এই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বলে আইনস্টাইন খুব হতাশ হয়েছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব কখনো টাইম ট্র্যাভেল বা সময় ভ্রমণের সুযোগ রাখবে না। কিন্তু যদিও গোদেলের সমাধান আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকেই এসেছে, তবু এটি আসলে আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে খাটবে না। কারণ হল, পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানি যে আমাদের মহাবিশ্ব ঘুরছে না (আবর্তন করছে না), বা করলেও তা খুব নগণ্য। অন্য দিকে আমাদের মহাবিশ্বের মতো গোদেলের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিতও হচ্ছে না। কিন্তু তারপর আইনস্টাইনের সমীকরণের পেছনে লেগে থাকা বিজ্ঞানীরা দেখলেন, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দ্বারা অনুমোদিত অন্য স্থান- কাল দিয়ে ঠিকই সময় ভ্রমণ করে অতীতে যাবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আবার মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ এবং হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মতো মৌলের আধিক্য প্রমাণ করছে যে সময় ভ্রমণের পরিবেশ তৈরির হওয়ার মতো মহাবিশ্বের শুরুতে যে বক্রতা প্রয়োজন, তা ছিল না। প্রান্তহীনতার প্রস্তাবনাও (আগে উল্লিখিত) যদি সঠিক হয়, তাহলে তাত্ত্বিকভাবেও একই ফলাফল আসবে। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে: সময় ভ্রমণের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিয়ে যদি মহাবিশ্বের যাত্রা না হয়ে থাকে, তাহলে কি পরে আমরা স্থানীয় কোনো অঞ্চলের স্থান- কালকে বাঁকিয়ে তার সুযোগ তৈরি করতে পারব?
আবার যেহেতু স্থান ও কাল একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, তাই শুনতে হয়ত অবাক লাগবে না যে অতীতে ভ্রমণের সমস্যা ও আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যাওয়া যাবে কি না তা আসলে একই সমস্যা । সময় ভ্রমণের সাথে আলোর চেয়ে বেশি বেগে যাওয়ার ব্যাপারটি যে একই সূত্র গাঁথা তা বোঝা সহজ: আপনি যদি সময় ভ্রমণ করে অতীতেই চলে যান, তাহলে আপনি আপনার সম্পূর্ণ ভ্রমণের জন্যে প্রয়োজনীয় সময়টুকুকে ইচ্ছেমতো কমিয়ে আনতে পারবেন।  এর অর্থ হবে আপনি ভ্রমণ করবেন অসীম গতিতে। কিন্তু আমরা দেখব, উল্টোটাও কাজ করে। আপনি যদি অসীম গতিতে ভ্রমণ করতে পারেন, তাহলেও আপনি অতীতে যেতে পারবেন। একটি ছাড়া অপরটি সম্ভব নয়।
সায়েন্স ফিকশন লেখকরা আলোর চেয়ে বেশি গতির বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি ভাবেন। সমস্যা হল, আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে যে আমরা যদি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরের আমাদের নিকটতম (সূর্যের পরে) নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরিতে একটি মহাকাশযান পাঠাই, তাহলে এর অভিযাত্রীরা তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ফিরে আসতে অন্তত আট বছর পার করবে। আর যদি গন্তব্য হয়  আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র, তাহলে এর ফিরে আসতে সময় লাগবে অন্তত ১ লক্ষ বছর। গ্যালাক্সিব্যাপী যুদ্ধের কাহিনি লেখার জন্যে বিষয়টা মোটেই সুখকর নয়। কিন্তু এখানেও আপেক্ষিক তত্ত্বের কাছে আরেকটি উপায় আছে। এর সাথেও সম্পর্ক রয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচিত টুইন প্যারাডক্সের। পৃথিবীবাসীদের তুলনায় মহাকাশ অভিযাত্রীদের সময় অনেক কম অতিবাহিত হবে বলে মনে হওয়া সম্ভব। কিন্তু মহাকাশযাত্রা থেকে ফিরে এসে আনন্দের খুব বেশি উপলক্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ দেখা যাবে পৃথিবীতে আগে যারা ছিল তাদের কেউ বেঁচে নেই, মরে গেছে হাজার হাজার বছর আগেই। এ কারণে পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করতে সায়েন্স ফিকশন লেখকদেরকে ধরে নিতে হয়েছে যে কোনো এক সময় আমরা আলোর চেয়ে দ্রুত চলার উপায় আবিষ্কার করব। এই লেখকদের অধিকাংশই বুঝতে অক্ষম যে আপনি যদি আলোর চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারেন, তাহলে আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে আপনি অতীতেও যেতে পারবেন।
ইংরেজিতে এ রকমই একটি পঞ্চপদী ছড়া আছে, যার বাংলা হয় এ রকমঃ
বলব এক বুদ্ধিমতী তরুণীর গল্প
আলোর বেগও যার কাছে ছিল স্বল্প
আপেক্ষিক বেগ নিয়ে,
এক দিন গেলেন হারিয়ে,
আর ফিরে এলেন তার আগের রাতে
 এই ছড়ার সূত্রও আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথেই গাঁথা। এটি বলছে যে কোনো ঘটনার সময়ের পরিমাণ যেমন সবার কাছে একই নাও হতে পারে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটনার ক্রমও দর্শকদের কাছে একই রকম নাও হতে পারে। যেমন, যদি দুটো ঘটনা ‘ক’ ও ‘খ’ এতটা দূরে ঘটে যে একটি রকেটকে ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে যেতে হলে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে, তাহলে ভিন্ন গতিতে ছোটা দুজন দর্শকের একজন বলবেন ‘ক’ আগে ঘটেছে, আরেকজন বলবেন, না, ‘খ’ আগে ঘটেছে। মনে করুন যে ‘ক’ ঘটনাটি হল ২০১২ অলিম্পিক গেমসের ফাইনালের ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা। আর ‘খ’ ঘটনাটি হল প্রক্সিমা সেন্টোরির সংসদের ১০০,০০৪ তম মিটিং। মনে করুন পৃথিবীতে থাকা কোনো দর্শকের কাছে মনে হবে ‘ক’ আগে ঘটেছে, তার পরে ঘটেছে ‘খ’। আরো মনে করুন, পৃথিবীর সময় অনুসারে ‘খ’ ঘটেছে এর এক বছর পরে, ২০১৩ সালে। যেহেতু পৃথিবী ও প্রক্সিমা সেন্টোরি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরত্বে আছে, এই দুটো ঘটনা আগের শর্ত পূরণ করবে। ‘ক’ ঘটনাটি ‘খ’ এর আগে ঘটলেও ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে যেতে আপনাকে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে। এর ফলে, পৃথিবী থেকে বিপরীত দিকে যেতে থাকা প্রক্সিমা সেন্টোরির একজন দর্শকের কাছে ঘটনার ক্রম উল্টো মনে হবে। তিনি দেখবেন, ‘খ’ ঘটনাটি ‘ক’ এর আগে ঘটেছে। এই দর্শক বলবেন, আপনি আলোর চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারলে ‘খ’ ঘটনা থেকে ‘ক’ তে আসতে পারবেন। আসলে আপনি যদি সত্যিই খুব দ্রুত চলতে পারেন তাহলে পৃথিবীতে দৌড় প্রতিযোগিতা শেষ হবার আগেই প্রক্সিমা সেন্টোরি গিয়ে খেলা নিয়ে বাজি ধরতে পারেন। আপনি জিতবেনই কারণ আপনিতো খেলার ফলাফল জেনেই এসেছেন!
আলোর গতিকে হারাতে গেলে কিন্তু ভীষণ মুশকিলে পড়তে হয়। আপেক্ষিক তত্ত্ব বলছে যে কোনো রকেটের গতি আলোর গতির কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হলে রকেটের ক্ষমতা ক্রমেই বাড়াতে হয়। আমাদের কাছে এর পরীক্ষিত প্রমাণ আছে। তা অবশ্য রকেট দিয়ে করা নয়, করা হয়েছে ফার্মিল্যাব বা সার্নের (ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর নিক্লিয়ার রিসার্চ বা সংক্ষেপে CERN) কণা ত্বরকযন্ত্রে মৌলিক কণিকা ব্যবহার করে। কোনো কণিকার বেগ আলোর বেগের ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত করা সম্ভব। কিন্তু যত বেশিই জ্বালানি ব্যবহার করা হোক না কেন, আলোর বেগকে কোনো ক্রমেই অতিক্রম করানো যায় না। একই কথা খাটবে মহাকাশযানের ক্ষেত্রেও। রকেটের ক্ষমতা যতই হোক, এর গতি বাড়িয়ে আলোর গতির ওপরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অথচ সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে যদি আলোর চেয়ে বেশি গতি পাওয়া যায়। ফলে, দেখা যাচ্ছে দ্রুত গতির মহাকাশ ভ্রমণ ও অতীতে ভ্রমণ- দুটোই ভেস্তে যাচ্ছে।
কিন্তু উপায় আছে আরেকটি। আপনি হয়ত স্থান- কালকে বাঁকিয়ে ‘ক’ ও ‘খ’ ঘটনার মধ্যে কোনো শর্টকাট পথ বানিয়ে ফেলতে পারেন। এর একটি উপায় হবে ‘ক’ ও ‘খ’ এর মাঝখানে ওয়ার্মহোল তৈরি। নাম থেকেও বোঝা যাচ্ছে, ওয়ার্মহোল হচ্ছে অনেক দূরের প্রায় সমতল দুটো অঞ্চলের মাঝে স্থান- কালের একটি সরু সুড়ঙ্গ। এটা অনেকটা এ রকম যেন আপনি কোনো উঁচু পাহাড়-শ্রেণির এক পাশের পাদবিন্দুতে আছেন। স্বাভাবিক উপায়ে অন্য পাশে যেতে হলে আপনাকে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে অপর পাশ দিয়ে নামতে হবে। কিন্তু যদি পাহাড়ের এপাশ থেকে ওপাশে একটি বিশাল ওয়ার্মহোল থাকে তাহলে আর তা করতে হবে না। আমাদের সৌরজগতের কাছ থেকে প্রক্সিমা সেন্টোরি পর্যন্তও একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করা বা খুঁজে বের করার কথা কল্পনা করা যেতে পারে। ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে দূরত্ব মাত্র কয়েক মাইল হতে পারে, যদিও সাধারণ হিসেবে পৃথিবী ও প্রক্সিমা সেন্টোরি ২০ লক্ষ কোটি দূরত্বে অবস্থিত। আমরা ১০০ মিটার দৌড়ের খবরটি ওয়ার্মহোল দিয়ে পাঠাতে পারলে ওদের কংগ্রেসের মিটিং হবার বেশ আগেই এটি ওখানে পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পৃথিবীর দিকে আসা একজন দর্শকও সেই ওয়ার্মহোল দিয়ে প্রক্সিমার সেন্টোরির মিটিং থেকে অলিম্পিক রেসের আগে আগে পৌঁছে যেতে পারবেন। ফলে, আলোর চেয়ে বেশি গতির মাধ্যমে অর্জিত সময় ভ্রমণের মতোই ওয়ার্মহোলও অতীতে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ওয়ার্মহোল। [ওয়ার্মহোল যদি থাকে তবে তা দুটো দূরবর্তী স্থানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করবে।]
 স্থান- কালের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ওয়ার্মহোল থাকার ভাবনাটি সায়েন্স ফিকশন লেখকদের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে খুব সম্মানজনক জায়গা থেকে। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন ও ন্যাথান রোজেন একখানা গবেষণাপত্র লেখেন। এতে তাঁরা দেখালেন যে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধান থেকে ওয়ার্মহোল পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা অবশ্য এটাকে ওয়ার্মহোল না বলে ব্রিজ বা সেতু বলেছিলেন। জিনিসটি আইনস্টাইন- রোজেন ব্রিজ নামে খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু এর ভেতর দিয়ে একটি মহাকাশযানকে পেরিয়ে যেতে হলে যেটুকু সময় দরকার এটি তত বেশি সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। ওয়ার্মহোলটি গুটিয়ে যেতে যেতে মহাকাশযানের স্থান হবে সিঙ্গুলারিটিতে। কিন্তু ধারণা করা হয়, কোনো উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা হয়ত একটি ওয়ার্মহোলকে সময় ভ্রমণ করার মতো যথেষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে পারে। এটা করতে হলে, অর্থ্যাৎ, সময় ভ্রমণের জন্যে স্থান- কালকে বাঁকাতে হলে দেখা যায়, প্রয়োজন হয় নেগেটিভে কার্ভেচার বা ঋণাত্মক বক্রতার। ঋণাত্মক বক্রতা দেখতে ঘোড়ার জিনের পৃষ্ঠের মতো। সাধারণ বস্তুতে শক্তির ঘনত্ব ধনাত্মক হওয়ায় এর স্থান- কালের মধ্যে পাওয়া যায় ধনাত্মক বক্রতা। যেমন, কোনো গোলকের পৃষ্ঠ। অতএব, স্থান- কালকে বাঁকিয়ে অতীতে যেতে হলে প্রয়োজন এমন পদার্থ, যার শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক।
বিভিন্ন রকম বক্রতা।
শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হবার মানে কী? শক্তি হচ্ছে টাকার মতো। আপনার কাছে যদি পজিটিভ ব্যালেন্স থাকেতাহলে আপনি তা অনেকভাবে ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু একশো বছর আগের পুরাতন সূত্র অনুসারে, আপনার ব্যালেন্সের চেয়ে বেশি টাকা আপনি উঠাতে পারবেন না। এভাবে এই পুরাতন সুত্রগুলো শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হওয়া মেনে না নিয়ে অতীতে ভ্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আগের অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করা হয়েছে যে পুরাতন সূত্রগুলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাতে রাজত্ব ছেড়ে দিয়েছে, যার ভিত্তি হল অনিশ্চয়তা নীতি। কোয়ান্টাম সূত্রগুলো খুব উদার। এই সূত্রগুলো আপনাকে দুই একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যালেন্সের চেয়ে কিছু বেশি টাকা উঠাতেও বাধা দেয় না, অবশ্য যদি মোট ব্যালেন্স পজিটিভ থাকে। অন্য কথায়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রের মাধ্যমে কোনো কোনো জায়গায় শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হতে পারে, যদি অন্য কোনো জায়গার শক্তির ধনাত্মক ঘনত্ব তা পুরণ করে দেয়, যাতে শক্তির মোট পরিমাণ ধনাত্মকই থাকে। অতএব, স্থান- কালকে বাঁকানো যাবে বলে যেমন আমরা বিশ্বাস করি, তেমনি একে বাঁকিয়ে সময় ভ্রমণ করা যাবে বলেও বিশ্বাস করার মতো কারণ রয়েছে।
ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাস অনুসারে একটি নির্দিষ্ট কণিকার দৈর্ঘ্যের স্কেলে সময় ভ্রমণ হচ্ছে। ফাইনম্যানের কৌশল অনুসারে, একটি সাধারণ কণিকার ক্ষেত্রে সময় বেয়ে সামনে যাওয়া আর একটি প্রতিকণিকার (যার চার্জ কণিকার বিপরীত, বাকি সব একই) ক্ষেত্রে পেছনে যাওয়া একই কথা। তাঁর দেখানো গাণিতিক হিসাব অনুসারে, আপনি এক জোড়া কণিকা ও প্রতিকণিকার একই সাথে সৃষ্টি ও পরে ধ্বংস হবার ঘটনাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারেন। এটি হল, কণিকা আসলে মাত্র একটিই, যা স্থান- কালের আবদ্ধ চক্র বেয়ে চলছে। এই চিত্র বুঝতে হলে প্রথমে গতানুগতিক উপায়ে ভাবুন। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, ধরুন ‘ক’ সময়ে একটি কণিকা ও প্রতিকণিকা তৈরি হল। দুটিই সময় বেয়ে সামনে যাচ্ছে। এর পরে অন্য কোনো সময় ‘খ’ তে পৌঁছে দুটো কণিকার দেখা হল, আর সাথে সাথে দুটোই ধ্বংস। ‘ক’ এর আগে এবং ‘খ’ এর পরে এদের কোনোটিই ছিল না। ফাইনম্যান বলছেন, এই ঘটনাকে আরেকভাবে দেখার সুযোগ আছে। ‘ক’ সময়ে একটি মাত্র কণিকাই সৃষ্টি হয়েছে। এটি সময় বেয়ে চলতে চলতে ‘খ’ তে পৌঁছে আবার ‘ক’ সময়ে ফিরে এল। একটি কণিকা ও একটি প্রতিকণিকা একই সাথে সময় বেয়ে সামনে যায়নি, বরং একটি মাত্র কণিকাই চক্রাকারে ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে এবং উল্টো পথে চলাচল করেছে। বস্তুটি যখন সময় বেয়ে সামনে যাচ্ছে (‘ক’ থেকে ‘খ’), তখন একে আমরা কণিকা বলছি। আর এটি যখন পেছনে চলছে (‘খ’ থেকে ‘ক’), তখন একে দেখে মনে হচ্ছে একটি প্রতিকণিকা সময় বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফাইনম্যানের দৃষ্টিতে প্রতিকণিকার ব্যাখ্যা। [প্রতিকণিকাও আসলে এমন একটি কণিকা, যা সময় বেয়ে পেছনে চলে। ফলে ভার্চুয়াল কণিকা ও প্রতিকণিকার একটি জোড়াকে স্থান- কালের আবদ্ধ চক্রে একই কণিকার গতি মনে করা যায়।]
 এই ধরনের সময় ভ্রমণের প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। যেমন ধরুন, কণিকা বা প্রতিকণিকার কোনো একটি (ধরুন প্রতিকণিকা) ব্ল্যাক হোলে পড়ে গেল। এর ফলে আরেকটি গেল একা হয়ে, এটি ধ্বংস হবার মতো কোনো সঙ্গীকে খুঁজে পাচ্ছে না। হতাভাগা কণাটিও ব্ল্যাক হোলে পড়ে যেতে পারে, আবার ব্ল্যাক হোলের খুব কাছ থেকে পালিয়েও [৪] আসতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে দূর থেকে মনে হবে কণিকাটি ব্ল্যাক হোল থেকে বের হয়ে এসেছে। ব্ল্যাক হোল থেকে আসা বিকিরণকে আপনি আরেকটি ভিন্ন কিন্তু সমতুল্য উপায়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন। দুই কণিকার মধ্যে যেটি ব্ল্যাক হোলে পড়ে গেছে (আমরা ধরে নিয়েছিপ্রতিকণিকা) তাকে আমরা ব্ল্যাক হোল থেকে সময় বেয়ে পেছনে চলা একটি কণিকা বলতে পারি। এটি যখন সেই জায়গায় পৌঁছে, যেখানে কণিকা বা প্রতিকণিকা একই সাথে উৎপন্ন হয়েছিল, তখন এটি ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়ে সময় বেয়ে সামনে চলতে থাকে এবং ব্ল্যাক হোল থেকে পালিয়ে আসে। অথবা যদি দুটোর মধ্যে কণিকাটি ব্ল্যাক হোলে পতিত হয় তাহলে আপনি একে এমন একটি প্রতিকণিকা বলতে পারেন, যা ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে সময় বেয়ে পেছনে চলছে। তাই ব্ল্যাক হোলের বিকিরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, আণুবীক্ষণিক জগতে কোয়ান্টাম তত্ত্ব অতীতে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে।
অতএব, আমরা প্রশ্ন করতেই পারি যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কি এই অনুমতি দেয় যে ভবিষ্যতের উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা শেষ পর্যন্ত একটি টাইম মেশিন বানাতে পারব? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, হ্যাঁ, দেওয়া উচিৎ। ফাইনম্যানের সামষ্টিক ইতিহাসকে সামগ্রিক বা সম্পূর্ণ ইতিহাস ধরা হয়। অতএব, এতে সেই ইতিহাসও থাকবে, যাতে স্থান- কাল এত বেশি বক্র যে অতীতে চলে যাওয়া সম্ভব। যদিও পদার্থবিদ্যার পরিচিত কোনো সূত্র সময় ভ্রমণকে উড়িয়ে দিচ্ছে না, তবু এমন কিছু বিষয় আছে যা একে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
একটি প্রশ্ন এ রকম: যদি অতীত ভ্রমণ সম্ভবই হয় তাহলে কেউ ভবিষ্যত থেকে ফিরে আসেনি কেন? কেন ফিরে এসে আমাদেরকে বলেনি কীভাবে এ কাজ করা হল? আমাদের মতো কম উন্নত জাতির কাছে সময় ভ্রমণের গোপন রহস্য ফাঁস করা কেন বোকামী হবে তার অনেকগুলো ভালো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাব যদি ভবিষ্যতেও না পাল্টায়, তাহলে বিশ্বাস করা কঠিন যে ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুক এই তথ্য ফাঁস করে দেবে না। কেউ কেউ অবশ্যই বলবেন যে বিভিন্ন সময় দেখা যাওয়া ইউএফও (Unidentified  Flying Object বা অচেনা উড়ন্ত বস্তু) এলিয়েন বা ভবিষ্যতের আগন্তুকদের প্রমাণ বহন করে। (যদি এলিয়েনরা উপযুক্ত সময়ে এখানে আসতেও চায়, তবু নক্ষত্রদের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব তাতে তাদেরকে আলোর চেয়ে জোরে ছুটতে হবে। ফলে, দুটো সম্ভাবনা সম্ভবত একই হয়ে যাচ্ছে) ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুক দেখা না যাওয়ার আরেকটি কারণ সম্ভবত অতীত নির্দিষ্ট, কারণ আমরা এটি দেখে ফেলেছি, এবং এও দেখেছি যে এতে ভবিষ্যত থেকে ফিরে আসার মতো প্রয়োজনীয় বক্রতা নেই। অন্য দিকে ভবিষ্যৎ হচ্ছে অজানা এবং উন্মুক্ত। ফলে তাতে হয়ত প্রয়োজনীয় বক্রতা থাকতে পারে। এর অর্থ হবে হয়ত যেকোনো টাইম ট্র্যাভেল শুধু ভবিষ্যতের দিকেই হতে পারে। স্টার ট্রেক মুভি সিরিজের ক্যাপ্টেন ক্লার্ক ও স্টারশিপ এন্টারপ্রাইজের বর্তমানে উপস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমরা ভবিষ্যতের কোনো আগন্তুককে কেন দেখিনি এটা তার ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু আরেকটি সমস্যা থেকেই যাবে। আমরা কি অতীতে গিয়ে ইতিহাস বদালতে পারব? ইতিহাস কিন্তু এখানে সমস্যা করবে। মনে করুন কেউ অতীতে গিয়ে নাৎসি সরকারকে পরমাণু বোমার কৌশল বলে দিল, অথবা ধরুন কেউ ফিরে গিয়ে দাদার দাদার দাদাকে মেরে ফেলল, মৃত্যুর আগে বেচারা দাদা কোনো সন্তানের বাবা হবারও সুযোগ পাননি। এই প্যারাডক্সকে [৫] (পরস্পর বিরোধী ঘটনা) অনেকভাবেই বলা যায়। কিন্তু সবগুলো আসলে একই অর্থ বহন করে। আমরা যদি অতীতকে বদালাবার ক্ষমতা পাই, তাহলে বৈপরিত্যে জড়িয়ে পড়ব।
সময় ভ্রমণের প্যারাডক্সের দুটো সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। প্রথমটিক বলা যায় ধারাবাহিক ইতিহাস (consistent history) পদ্ধতি। এটি বলছে যে স্থান- কালের বক্রতা অতীতে যাবার সুযোগ করে দিলেও সেখানে গিয়ে যা ঘটবে তা হবে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনেই। এই মত অনুসারে, আপনি শুধু তখনই অতীতে যেতে পারবেন যখন ইতিহাস থেকে দেখা যাবে যে আপনি অতীতে গিয়েছিলেন এবং আপনার দাদার দাদার দাদাকে খুন করেননি বা এমন কিছু করেননি যাতে আপনার বর্তমান ইতিহাস সৃষ্টিতে বাধা পড়ে। এছাড়াও আপনি অতীতে গেলেও এর আগের ইতিহাস বদলাতে পারবেন না, শুধু পর্যবেক্ষণ করেই যেতে পারবেন। এই মত অনুসারে, অতীত নির্দিষ্ট। আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না।
আপনি অবশ্য বলতে পারেন যে স্বাধীন ইচ্ছা আসলে একটি ভ্রম। যদি পদার্থবিদ্যার আসলেই কোনো পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কাজকর্মও নির্ধারণ করবে। কিন্তু সূত্রটি আমাদের মতো জটিল প্রাণীদের ক্ষেত্রে এত জটিল্ভাবে কাজ করে যে তা হিসাব করে বের করা সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রভাবের কারণে এতে কিছু দৈব ঘটনা থাকবে। সুতরাং আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা থাকার একটি অর্থ এমন হতে পারে যে আমরা আসলে জানি না এই সূত্রগুলো কী করবে। কিন্তু একজন মানুষ যদি রকেটে করে ভ্রমণ করে তার রওনা দেবার আগের কোনো সময়ে ফিরে আসে তাহলে আমরা বলতে পারব সে কী করবে, কারণ এটা ইতিহাসে লেখা আছে। অতএব, এই পরিস্থিতিতে সময়ের অভিযাত্রীর আসলেই কোনো স্বাধীন ইচ্ছা থাকবে না।
সময় ভ্রমণের প্যারাডক্সের আরেকটি সমাধানকে বলা যেতে পারে বিকল্প ইতিহাস (alternative history) তত্ত্ব। এই মত অনুসারে, সময়ের অভিযাত্রীরা অতীতে গিয়ে আগের ইতিহাসের বদলে বিকল্প ইতিহাসে প্রবেশ করবেন, যা আগের ইতিহাস থেকে ভিন্ন হবে। এখানে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, আগের ইতিহাসের ধারবাহিকতা বা সীমাবদ্ধতা মানতে হবে না। স্টিভেন স্পিলবার্গ তার ব্যাক টু দি ফিউচার মুভিতে এই ধারণা ব্যবহার করে মজা করেছেন। মুভিতে মারটি ম্যাকফ্লাই অতীতে গিয়ে তার মা- বাবার সম্পর্ককে আরো সুখকর করে তুলেছেন।
রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম তত্ত্বে সামষ্টিক ইতিহাস দিয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন (নবম অধ্যায়) তার সাথে বিকল্প ইতিহাসের মিল আছে। এটি বলছে যে মহাবিশ্বের ইতিহাস একটি নয়, এতে সম্ভাব্য সব রকম ইতিহাস তাদের নিজস্ব সম্ভাবনা নিয়ে টিকে আছে। তবে ফাইনম্যানের প্রস্তাবের সাথে বিকল্প ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ফাইনম্যানের সমষ্টিতে প্রত্যেকটি ইতিহাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্থান- কাল ও তার ভেতরের সব কিছু অন্তর্ভূক্ত। স্থান- কাল এতটা বক্র হতেও পারে যে রকেট নিয়ে অতীতে চলে আসা যাবে। কিন্তু রকেট একই স্থান- কালের মধ্যেই থাকবে এবং তার ফলে তার ইতিহাসও একই হবে যাতে করে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। ফলে দেখা যাচ্ছে ফাইনম্যানের প্রস্তাবনা আসলে বিকল্প ইতিহাসের বদলে ধারাবাহিক ইতিহাসের পক্ষ নিচ্ছে।
এই সমস্যাগুলো আমরা এড়াতে পারি ঘটনাপঞ্জি সংরক্ষণ তত্ত্বের  (chronology protection) মাধ্যমে। এর বক্তব্য হচ্ছে, ম্যাক্রোস্কোপিক বা বড় সাইজের বস্তুরা যাতে কোনো তথ্য অতীতে নিতে না পারে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো তাতে কড়া নজর রাখে। এই তত্ত্বের কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু একে সত্য মনে করার পক্ষে যুক্তি আছে। যুক্তি হল, যখন স্থান- কালকে বাঁকিয়ে অতীতে যাওয়া সম্ভব করে তোলা হবে, তখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের হিসাব- নিকাশ থেকে দেখা যায় কণিকা বা প্রতিকণিকারা আবদ্ধ চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে। এতে করে শক্তির ঘনত্ব এত বেশি হয় যে স্থান- কালের বক্রতা হয়ে পড়ে ধনাত্মক, যার ফলে যে বক্রতার মাধ্যমে সময় ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল সেই বক্রতা আর থাকে না। এটা আসলেই ঘটে কিনা তা নিশ্চিত না হবার কারণে সময় ভ্রমণের দুয়ার এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু এর পক্ষে বাজি ধরা ঠিক হবে না, কারণ আপনার প্রতিপক্ষ হয়ত ভবিষ্যত জেনে ফেলে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে যাবে!
 [অনুবাদকের নোটঃ
১। অর্থ্যাৎ, কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটতে যে সময় লাগবে, তার পরিমাণ যে কোনো দর্শকের কাছে একই মনে হবে।
২। টাইম মেশিনকে সব সময় মহাকাশযানই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এখানে বিশেষ উদাহরণটি এ রকম দেওয়া হয়েছে বলে এর কথা বলা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, আপনি যদি পৃথিবীর পৃষ্ঠেও সোজা কোনো রেল লাইন বানিয়ে এতে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ট্রেন চালিয়ে দেন তাতেও একই ঘটনা ঘটবে। বিষয়টি বেগের সাথে জড়িত, কোনো নির্দিষ্ট স্থান, যেমন মহাকাশের সাথে নয়। স্থানের সাথে সম্পর্ক আছে অন্যভাবে, যা আমরা পরে দেখব।
৩। কারণ সময় ও গতি গুণ করে দূরত্ব পাওয়া যায়। এখন একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের ক্ষেত্রে, সময় যদি কম হয় গতিতো বেশি হতেই হবে। আর সময় যেহেতু ইচ্ছে মাফিক কম করা যাচ্ছে, গতিও তাহলে ইচ্ছে মাফিক বড়ো হবে। যেমন ধরুন, আমরা ৪ আলোকবর্ষ দূরের প্রক্সিমা সেন্টোরিতে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। সাধারণ হিসাবে এই ভ্রমণ শেষ করতে ৮ আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে ৮ বছরের আগে আমাদের ফিরে আসার কথা নয়। ধরুন, আমরা রওনা দিলাম ২০১৬ সালে। ২০২০ সালে ওখান থেকে ফিরতি পথে রওনা দিলে ফিরে আসার কথা ২০২৪ সালের পরে। কিন্তু অতীতে ভ্রমণ করে আমরা ফিরে এলাম ২০১৭ সালে। তার মানে ২০২০ সালে ওখান থেকে নির্গত কোনো আলোক রশ্মির চেয়েও  দ্রুত চলে এলাম আমরা। এভাবে আমরা যত বেশি অতীতে আসব, আলোর বেগকে তত বেশি বড় ব্যবধানে পরাজিত করা হবে।
৪। ব্ল্যাক হোল থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না- এই কথা একেবারে চূড়ান্ত নয়। এই বইয়ের অন্যতম লেখক ড. হকিং ই আবিষ্কার করেন, কোয়ান্টাম সূত্রের কল্যাণে ব্ল্যাক হোল থেকে কিছু কণা বের হতেও পারে। তাঁর নাম অনুসারেই এই প্রক্রিয়ার নাম হকিং বিকিরণ (hawking radiation)।
৫। একে বলা হয় গ্র্যান্ডফাদার প্যরাডক্স। দাদার কোনো সন্তান হবার আগেই কেউ যদি অতীতে গিয়ে তার দাদাকে মেরে ফেলেন, তাহলে তার বাবার জন্ম হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাহলে তিনি এলেন কোথেকে? এভাবেই সময় ভ্রমণ করতে গেলে মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন প্যারাডক্সের।
৬। খালি চোখে দৃশ্যমান- এমন সাইজের জিনিসকে ম্যাক্রোস্কোপিক বলা হয়।]


No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ