মীমাংসকরা উপমানকে একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে মনে করেন। তাদের মতে উপমানকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। পূর্বে দেখা কোনো বস্তুর সঙ্গে বর্তমান প্রত্যক্ষীভূত কোনো বস্তুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করে যখন সিদ্ধান্ত করা হয় যে পূর্বে দেখা ও বর্তমানে স্মৃত বস্তুটি বর্তমানে প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সাদৃশ, তখন সেই জ্ঞানের প্রণালীকে উপমান বলে। বলা বাহুল্য, সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় উপমানকে পৃথক প্রমাণরূপে স্বীকার করেন নি। চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, বৈশেষিক ও সাংখ্য সম্প্রদায় উপমানকে পৃথক প্রমাণের মর্যাদা দেননি। মীমাংসা, বেদান্ত ও ন্যায় সম্প্রদায় উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণের মর্যাদা দিলেও উপমানের স্বরূপ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে ন্যায় ও মীমাংসা সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
কোন একটি প্রমাণের স্বাতন্ত্র্য প্রতিপাদনের জন্য সেই প্রমাণের স্বরূপ, বিষয় ও উৎপাদক এই তিন বিষয়ে বৈলক্ষণ্য প্রদর্শন করা প্রয়োজন। সুতরাং উপমানের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণের জন্য উপমান যে স্বরূপত, বিষয়গত এবং করণগত ভিন্ন তা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। বিজাতীয় প্রমাই বিজাতীয় প্রমাণকে প্রতিপন্ন করতে পারে। ফলে যাঁরা উপমানকে পৃথক প্রমাণের মর্যাদা দেন, তাঁরা তা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করেছেন। মীমাংসক নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে মীমাংসাসম্মত উপমানের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-
কোন একটি প্রমাণের স্বাতন্ত্র্য প্রতিপাদনের জন্য সেই প্রমাণের স্বরূপ, বিষয় ও উৎপাদক এই তিন বিষয়ে বৈলক্ষণ্য প্রদর্শন করা প্রয়োজন। সুতরাং উপমানের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণের জন্য উপমান যে স্বরূপত, বিষয়গত এবং করণগত ভিন্ন তা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। বিজাতীয় প্রমাই বিজাতীয় প্রমাণকে প্রতিপন্ন করতে পারে। ফলে যাঁরা উপমানকে পৃথক প্রমাণের মর্যাদা দেন, তাঁরা তা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করেছেন। মীমাংসক নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে মীমাংসাসম্মত উপমানের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন-
‘দৃশ্যমানার্থসাদৃশাৎ স্মর্যমাণার্থগোচরম্ ।
অসন্নিকৃষ্টসাদৃশ্যজ্ঞানং হি উপমিতির্মতা।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : পূর্বদৃষ্ট অসন্নিকৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্যবশতঃ স্মরণের মাধ্যমে পূর্ব-অজ্ঞাত দৃশ্যমান বস্তুর সাদৃশ্যজ্ঞানই উপমিতি।
একটি উদাহরণের সাহায্যে উপমানের এই স্বরূপ প্রকাশ করা যেতে পারে। কোন ব্যক্তি স্বগৃহে বা অন্যত্র যদি ‘গরু’ নামক প্রাণী প্রত্যক্ষ করার পর কালান্তরে কোথাও একটি গবয় বা নীলগাই প্রত্যক্ষ করে, তাহলে সে তখন গবয়গত গোসাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে গোগত গবয়সাদৃশ্য উপলব্ধি করে। তার এই উপলব্ধির আকার হলো, ‘পূর্বদৃষ্ট গরু প্রত্যক্ষীভূত গবয়সদৃশ’। এরূপ উপলব্ধিই উপমিতি। তাই নারায়ণ ভট্ট বলেন-
‘গবয়স্থিতসাদৃশ্যদর্শনং করণং ভবেৎ।
ফলং গোগতসাদৃশ্যজ্ঞানমিত্যবগম্যতাম্ ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : গবয়টিকে দেখেই যে গবয়ে গরুর সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ হয়, ফলে পূর্বদৃষ্ট গরুটিতে তার যে গবয়সাদৃশ্যের জ্ঞান হয়, তা-ই উপমিতি।
মীমাংসামতে উক্ত গোগত গবয়-সাদৃশ্য প্রতীতি যেমন প্রত্যক্ষাত্মক হতে পারে না, কারণ ঐ জ্ঞানের উৎপত্তিক্ষণে গরু উপস্থিত থাকে না, তেমনি ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পদজ্ঞানেরও কোন অবকাশ না থাকায় ঐ প্রতীতি অনুমিতি ও শাব্দবোধও হতে পারে না। সুতরাং এক্ষেত্রে গরু কেবলমাত্র স্মৃতিরই বিষয় হতে পারে। অথচ প্রত্যক্ষীভূত গবয় প্রাণীতে পূর্বদৃষ্ট গরুর সাদৃশ্য প্রত্যক্ষতঃ জেনে তার ফলস্বরূপ স্মৃত গরুতে প্রত্যক্ষীভূত গবয়ের সাদৃশ্যজ্ঞান একটি অনধিগত ও তত্ত্বার্থজ্ঞান। মীমাংসামতে অনধিগতত্ব ও তত্ত্বার্থত্বই প্রমার লক্ষণ। গোগত গবয়সাদৃশ্যরূপ প্রতীতি প্রত্যক্ষ, অনুমিতি বা শাব্দবোধের অতিরিক্ত হওয়ায় এবং তা প্রমা লক্ষণান্তর্গত হওয়ায় ‘উপমিতি’ নামক স্বতন্ত্র প্রমা স্বীকার করতে হয়। এইরূপ প্রমার করণই উপমান।
নৈয়ায়িকরাও উপমানকে একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করেন, কিন্তু মীমাংসকদের উপমানের ব্যাখ্যা নৈয়ায়িকদের ব্যাখ্যার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
‘গ্রামীণস্য প্রথমতঃ পশ্যতো গবয়াদিকম্ ।
সাদৃশ্যধীর্গবাদীনাং যা স্যাৎ সা করণং মতম্ ।।’
অর্থাৎ : কোন আরণ্যক ব্যক্তি গ্রামবাসী ব্যক্তিকে বললো, গরুর মতো একপ্রকার প্রাণী অরণ্যে দেখা যায়, তাকে বলে গবয়। পরে কখনও বনে গেলে গ্রামীণ লোকটি যখন গরুর মতো প্রাণিবিশেষ দেখতে পায়, তখন গবয়ে গরুর সাদৃশ্যের যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তা-ই উপমান, অর্থাৎ উপমিতিরূপ প্রমিতির কারণ।
ন্যায়মতে সংজ্ঞা হতে সংজ্ঞার যে জ্ঞান সেটাই হচ্ছে উপমান। কিন্তু মীমাংসামতে পূর্বে প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সঙ্গে বর্তমান প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সাদৃশ্যজ্ঞানই হলো উপমান। কুমারিল ভট্ট ও প্রাভাকর মিশ্র উভয়ই প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সঙ্গে স্মৃত বস্তুর সাদৃশ্য জ্ঞানকেই উপমান বলে স্বীকার করেছেন।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ