বিধি ও অর্থবাদ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

বিধি ও অর্থবাদ

মীমাংসা-মতে যজ্ঞকথাই বৈদিক সাহিত্যের প্রাণবস্তু; অথএব বৈদিক সাহিত্যে এমন কিছুই থাকতে পারে না যা-কিনা যজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে অবান্তর। বেদের সংহিতা (মন্ত্র), ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এসব মিলিয়ে বেদের অনেক ভাগ বলা হলেও প্রধানত বেদের দুই ভাগ- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ।
প্রাচীন মীমাংসকরা মন্ত্র শব্দের সঠিক সংজ্ঞা দেননি; কিন্তু সাধারণভাবে তাঁদের মতে বেদের যে-অংশ বিধির নির্দেশক নয় তবুও বৈদিক দেবতাদির নাম প্রভৃতি নির্দেশ করে যে-বাক্যগুলি যজ্ঞকর্মের সহায়ক সেগুলিকেই মন্ত্র বলে। মন্ত্র কাকে বলে- এই জিজ্ঞাসার উত্তরে মাধবাচার্য বলছেন-  
‘যাজ্ঞিকানাং সমাখ্যানং লক্ষণং দোষবর্জ্জিতম্’।- (বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ)
অর্থাৎ : গুরুশিষ্যপরম্পরায় মীমাংসকসম্প্রদায় বেদের যে অংশকে মন্ত্র বলে অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করছেন, সেই অংশকে মন্ত্র বললেই মন্ত্রের যথার্থ লক্ষণ বলা হয়।
.
মন্ত্র সম্বন্ধে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর মীমাংসাসূত্রে বলেন-
‘তচ্চোদকেষু মন্ত্রাখ্যা’।- (মীমাংসাসূত্র-২/১/৩২)
অর্থাৎ : যে-সকল শ্রুতি অনুষ্ঠেয় পদার্থের নিমিত্ত প্রযুক্ত, সেগুলিকে মন্ত্র বলে।
.
ভট্টপাদ কুমারিল বলেছেন- যে-সকল শ্রুতিবাক্যের অন্তে ‘অসি’ বা ‘ত্বা’ আছে, যে-বাক্যে আমন্ত্রণ, স্তুতি, সংখ্যা, পরিবেদন ইত্যাদি রয়েছে- সেইসব বাক্য সাধারণত মন্ত্র। আর শাস্ত্রীয় পরিভাষায় বলা হয়েছে-  
‘মন্ত্রাণাং প্রয়োগসমবেতার্থস্মারকত্বম্’।
অর্থাৎ : মন্ত্রগুলি অনুষ্ঠানের সাথে সমবেত-সম্বন্ধে যুক্ত এবং স্মারক।
বিভিন্ন যাগযজ্ঞে প্রযোজ্য মন্ত্রের সমাবেশ সংহিতায়। মন্ত্র ছাড়া বেদের বাকি সব অংশই ব্রাহ্মণ। মহর্ষি জৈমিনি তাঁর সূত্রগ্রন্থে ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে শুধু বলেছেন-
‘শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ।’- (মীমাংসাসূত্র-২/১/৩৩)
অর্থাৎ : মন্ত্রাতিরিক্ত বেদভাগে ব্রাহ্মণশব্দ প্রযুক্ত হয়।
.
মূলত, মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ ভিন্ন বেদে অন্য কিছু নেই- এটা প্রকাশ করাই জৈমিনির অভিপ্রায়। বেদের  ব্রাহ্মণ-অংশ বিধিমূলক বৈদিক ক্রিয়াকর্মের নির্দেশক। বিবিধ যজ্ঞের বিধান রয়েছে বিত্বায়কবাক্যবহুল ব্রাহ্মণে। কোন্ যজ্ঞবিশেষে কোন্ মন্ত্রবিশেষের ‘বিনিয়োগ’ হবে তার বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেদের এই ব্রাহ্মণ-অংশে এমন অনেক বাক্য আছে যার মধ্যে কোন বিধির নির্দেশ নেই; ব্রাহ্মণ-অংশের এ-জাতীয় বাক্যকে মীমাংসকরা দু-ভাগে ভাগ করেন- অর্থবাদ এবং নাম-ধেয়।  তাই মীমাংসাশাস্ত্রে বিচার্য বিষয়ের দিক থেকে বেদের ভাগগুলি হলো- মন্ত্র, বিধি, নামধেয় এবং অর্থবাদ। আবার মন্ত্রকে বাদ দিয়ে বেদের বিধি, নিষেধ, নামধেয় ও অর্থবাদ এই চতুর্বিভাগও প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বিচার্যের দিক থেকে বেদকে সরাসরি দুটি ভাগে ভাগ করেন- বিধি এবং (বাদবাকি সব) অর্থবাদ।
বিধি
কোন কর্মে প্রবর্তনার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত বাক্যের নাম বিধি। অর্থাৎ যে বেদবাক্য কোন কিছু বিধান করে তাকে বলা হয় বিধি। ভাষ্যকার শবরস্বামী বলেছেন-
‘অপ্রাপ্তে শাস্ত্রমর্থবৎ’। (শাবরভাষ্য)
অর্থাৎ : যে-বেদভাগ অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞাপক, তাকে বিধি বলা হয়।
.
বিধির লক্ষণে মীমাংসক লৌগাক্ষি ভাস্কর তাঁর ‘অর্থসংগ্রহ’ গ্রন্থে বলেন-
‘তত্রাজ্ঞাতার্থজ্ঞাপকো বেদভাগোবিধিঃ।’- (অর্থসংগ্রহ)
অর্থাৎ : বেদের যে ভাগ অজ্ঞাত অর্থের জ্ঞাপক তাই বিধি।
এখানে ‘অজ্ঞাত’ বলতে বোঝায় অন্য প্রমাণের দ্বারা পূর্বে অপ্রাপ্ত। বস্তুত বিধির বিষয় প্রত্যক্ষাদি অন্য কোন মৌলিক প্রমাণের দ্বারা লভ্য নয়। অথচ এই বিষয় যথার্থ ও প্রয়োজনের দিক থেকে মূল্যবান। একমাত্র বেদবাক্যই এই বিষয়ের জ্ঞাপক। তাই বিধির লক্ষণটিকে এভাবেও বলা হয় (সূত্র: সুখময় ভট্টাচার্য্য, পূর্ব্বমীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৭)-   
‘প্রমাণান্তরানধিগতার্থ বিষয়ত্বং বিধিত্বম্’।
অর্থাৎ : অন্য প্রমাণের দ্বারা যা জানা যায়নি, সেই বিষয়ের যা জ্ঞাপক, তা-ই বিধি।
তাই বলা যায়, যে বেদবাক্য অন্যান্য লৌকিক প্রমাণের দ্বারা অপ্রাপ্ত বা অলভ্য বিষয়ের জ্ঞাপক তাকেই বলা হয় বিধি। যেমন, বেদে বলা হচ্ছে- ‘অগ্নিহোত্রম্ জুহুয়াৎ স্বর্গকামঃ।’ অর্থাৎ, স্বর্গকামনায় অগ্নিহোত্র হোম বা যজ্ঞ করতে হবে।
এই তথ্য অন্য কোন প্রমাণের দ্বারা পূর্বে জানা যায়নি। অথচ এই হোমের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। একমাত্র বেদবাক্যের দ্বারা এ তথ্য জানা যায়। এজন্য এরূপ বেদবাক্যকে বলে বিধি। বিধি কর্তব্যজ্ঞানে পালন করতে হয়। তাই বলা হয়-
‘বিধীয়তে কর্তব্যতয়া বোধ্যতে অনেন ইতি।’
অর্থাৎ : যার দ্বারা কর্তব্যরূপে বিধানের জ্ঞান পাওয়া যায় তাকেই বিধি বলা হয়।
বিধি বা বিধায়কবাক্য দুধরনের হতে পারে- প্রবৃত্তিমূলক বা প্রবর্তনামূলক এবং নিবৃত্তিমূলক বা নিবর্তনামূলক। সাধারণত প্রবর্তনামূলক বিধায়কবাক্যকেই বিধি বলা হয়। অর্থাৎ বিধি হলো প্রবৃত্তিমূলক। অন্যদিকে নিবৃত্তিমূলক বিধায়কবাক্যকে ‘নিষেধ’ বলা হয়।
স্বর্গসুখাকাঙ্ক্ষী যেমন প্রবর্তনামূলক বিধিবাক্য শুনে যাগযজ্ঞাদি কর্মে প্রবৃত্ত হয় তেমনি নিষেধবাক্য শুনে নরকাদি কষ্টভোগ পরিহারের জন্য নিষিদ্ধ কর্ম বা বস্তুভোগ থেকে নিবৃত্ত হয়। তাই বলা যায়, অনিষ্ট হেতুজনক কর্ম থেকে নিবৃত্তির বিধানকেই বলা হয় নিষেধ। অর্থসংগ্রহকার লৌগাক্ষি ভাস্করের ভাষ্যে-
‘পুরুষস্য নিবর্তকং বাক্যং নিষেধঃ।’- (অর্থসংগ্রহ)
অর্থাৎ : পুরুষের উদ্দেশ্যে নিবর্তকবাক্য হলো নিষেধ।
বিধি ও নিষেধ উভয়েরই লক্ষ্য ইষ্টসাধনতা। উভয়প্রকার বাক্যই কর্তব্যবোধক। বিধিবাক্য অভিলক্ষিত সুখপ্রাপ্তির প্রযোজক, আর নিষেধবাক্য অভিলক্ষিত দুঃখপরিহারের প্রযোজক। নিষেধের মাধ্যমে অনিষ্ট কর্ম থেকে পুরুষকে নিবৃত্ত করা হয়। নিষেধবাক্য অমান্য করলে ফল হয় নরকাদি কষ্টভোগ। সাধারণত ‘নঞ্’ শব্দ প্রয়োগে এই নিষেধকে বোঝানো হয়। যেমন- ‘ন কলঞ্জং ভক্ষয়েৎ’ অর্থাৎ, ‘কলঞ্জ ভক্ষণ করবে না।’
কলঞ্জ হলো বিষপ্রয়োগে নিহত পশু বা পাখির মাংস। এই ধরনের মাংস খাওয়া নিষেধ আছে। যদি কেউ এই নিষেধবাক্যের অবমাননা করে তাহলে তাকে যে দুঃখ পেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই বলা যায়, অনিষ্ট হেতুজনক কর্ম থেকে মানুষকে নির্বৃত্ত করার বিধানই হলো নিষেধ। বিধি ও নিষেধের মধ্যে পার্থক্য নির্ণায়ক হিসেবে ন্যায়সুধাগ্রন্থে বলা হয়েছে-  
‘ফলবুদ্ধিপ্রমেয়াধিকারিকারিবোধক ভেদতঃ।
পঞ্চধাত্যন্তভিন্নত্বাদ্ ভিদো বিধিনিষেধয়োঃ।।’- (ন্যায়সুধা)
অর্থাৎ : বিধি ও নিষেধের ফল, বুদ্ধি, প্রমেয়, অধিকারী ও বোধকের অত্যন্ত প্রভেদ রয়েছে। এই পাঁচপ্রকার অত্যন্ত প্রভেদ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বিধি ও নিষেধ অত্যন্ত ভিন্ন।
.
এই পাঁচপ্রকার অত্যন্ত প্রভেদ হলো-
বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের ফল সুখরূপ স্বর্গাদি, আর নিষিদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠানের ফল দুঃখরূপ নরকাদি।
বিধিবাক্য শুনলে কর্তব্যতা-বুদ্ধি, আর নিষেধবাক্য শুনলে অকর্তব্যতা-বুদ্ধি জাগে।
বিধিরূপ প্রমাণের প্রমেয় কর্মে প্রবৃত্তি, আর নিষেধরূপ প্রমাণের প্রমেয় কর্মে নিবৃত্তি।
স্বর্গাদির অভিলাষী ব্যক্তি বিধিবাক্যের অধিকারী, আর আসক্তিবশত নিষিদ্ধ কর্মে প্রবৃত্তিমান ব্যক্তি নিষেধবাক্যের অধিকারী।
নিষেধবোধক নঞাদি পদ না থাকলে বাক্য বিধির বোধক হয়, আর নিষেধবোধক নঞাদি পদ থাকলে বাক্য নিষেধের বোধক হয়।
অতএব, বিধি ও নিষেধ পরস্পর অত্যন্ত ভিন্ন।
.
নামধেয়
কতকগুলি শ্রুতিকে আপাতদৃষ্টিতে গুণবিধি বা বিনিয়োগবিধি বলে মনে হয়, কিন্তু সেইসব শ্রুতিযুক্ত প্রকরণের আলোচনায় বোঝা যায়, বাস্তবিক সেগুলি অপূর্ববিধি বা উৎপত্তিবিধি। অর্থাৎ শ্রুতিগুলি এক-একটি যাগের নামমাত্র প্রকাশ করে থাকে। মীমাংসাশাস্ত্রে সেইসব শ্রুতি নামধেয়-বিভাগে গৃহিত হয়েছে। যেমন- ‘জ্যোতিষ্টোমেন যজেত স্বর্গকামঃ’ এই শ্রুতিতে জ্যোতিষ্টোম শব্দে কী বুঝায় ? যদিও শব্দটি ‘ঈত’ প্রত্যয়ের ভাবনারূপ (উৎপাদনা-রূপ) অর্থে করণত্ব-সম্বন্ধে, সাধ্যত্ব-সম্বন্ধে বা ইতিকর্তব্যতারূপে অন্বিত হয় না, যদিও শব্দটি মন্ত্র, অর্থবাদ বা নিষেধস্বরূপ নয়, তবুও যাগরূপ ধাত্বর্থের স্বরূপের প্রকাশক বলে জ্যোতিষ্টোম শব্দের সার্থকতা আছে।
শুধু ‘যজেত’ বললে সামান্যত নিখিল যাগের কথাই মনে হয়। বিশেষ্য-বিশেষণরূপে যাগের নাম না জানলে অনুষ্ঠান করা চলে না। অতএব নাম জানতেই হবে। এ কারণে জ্যোতিষ্টোম একটি যাগের নামধেয় বা সংজ্ঞা। নাম জানা না থাকলে যাগের সঙ্কল্প করা চলে না। ‘আমি অমুক যাগ করবো’- এরূপ সঙ্কল্প করে যজমান স্বয়ং দীক্ষিত হবেন এবং ঋত্বিক প্রমুখ যাজককেও বরণ করবেন।
.
নামধেয় স্বীকারের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আপোদেব বলেছেন-  
‘নামধেয়ানাং বিধেয়ার্থ পরিচ্ছেদকতয়া অর্থবত্ত্বম্’।
অর্থাৎ : বিধেয় কর্মকে অপর বিধেয় কর্ম থেকে পৃথক করাই নামধেয় স্বীকারের সার্থকতা।
.
অর্থবাদ
‘অর্থবাদ’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ হলো প্রশংসা বা নিন্দাসূচক বাক্য। অর্থসংগ্রহকার লৌগাক্ষি ভাস্কর বলেছেন-
‘প্রাশস্ত্য-নিন্দা-অন্যতরপরং বাক্যং অর্থবাদঃ।’- (অর্থসংগ্রহ)
অর্থাৎ : প্রশংসাসূচক ও নিন্দাসূচক বাক্যের যে কোনটিকেই অর্থবাদ হলা হয়।
নিছক বর্ণনামূলক বা প্রশংসামূলক বা অলঙ্কারমূলক বাক্যগুলিকেই অর্থবাদ বলে। যেমন- ‘সোহরোদীৎ তদ্রুদ্রস্য রুদ্রতম্’ অর্থাৎ, তিনি রোদন করেছিলেন, এ কারণে তাই রুদ্রের রুদ্রত্ব -(তৈত্তিরীয় সংহিতা-১/৫/১)। কিংবা, ‘প্রজাপতি নিজের বপা ছিঁড়িয়া মেদমাংস খণ্ডিত করে অগ্নিতে আহুতি দিয়েছিলেন’-(তৈত্তিরীয় সংহিতা-২/১/১), ‘বায়ু দ্রুততম দেবতা’-(তৈ:স:-২/১/১) ইত্যাদি যে-সব বাক্য সেগুলি কোন কর্মের প্রতিপাদক বা বিধি নয়; এগুলি নিছক প্রশংসা বা অর্থবাদ। অর্থ মানে প্রয়োজন, বাদ মানে বলা। অর্থাৎ সপ্রয়োজনীয় উক্তি। কিন্তু ধর্মপ্রতিপাদক বিধিগুলিও তো সপ্রয়োজন। তাহলে অর্থবাদের সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায় ?
.
বিরুদ্ধবাদী পূর্বপক্ষ আপত্তি উত্থাপন করে হয়তো বলতে পারেন, অর্থবাক্যকে প্রমাণ বললে কোন কোন বিধিবাক্য অপ্রমাণ হয়ে পড়ে। যেমন শ্রুতি আছে- ‘তরতি মৃত্যুং তরতি পাপ্মানং তরতি ব্রহ্মহত্যাং যোহশ্বমেধেন যজতে য উ চৈনমেবং বেদ’- অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অশ্বমেধযজ্ঞ করেন এবং যিনি অশ্বমেধের এইপ্রকার স্বরূপ জানেন, তিনি মৃত্যু অতিক্রম করেন, পাপ থেকে মুক্ত হন, ব্রহ্মহত্যা থেকে মুক্তি পান।
পূর্বপক্ষবাদীরা বলেন, যিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন, তিনি অবশ্যই বেদের অশ্বমেধ-প্রকরণ অধ্যয়ন করেছেন। অধ্যয়ন থেকেই যদি ফল পাওয়া যায়, তবে ‘অশ্বমেধেন যজেত’ বিধিটি নিশ্চয়ই অপ্রমাণ হবে। কোন্ বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর বিপুল আয়াসসাধ্য অশ্বমেধ-যজ্ঞ করতে যাবেন ? ভাষ্যকার শবরস্বামী  বলেছেন-
‘অর্কে (অক্বে) চেন্মধু বিন্দেত কিমর্থং পর্ব্বতং ব্রজেৎ।
ইষ্টস্যার্থস্য সংসিদ্ধৌ কো বিদ্বান্ যত্নমাচরেৎ।।’
অর্থাৎ : সহজলভ্য আকন্দ গাছেই (‘অক্ব’পাঠ থাকলে গৃহকোণ বুঝতে হবে।) যদি মধু পাওয়া যায়, তবে মধুর নিমিত্ত পর্বতে কেন যাবে ? অভীষ্ট বিষয় অনায়াসে সিদ্ধ হলে কোন্ বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর অধিক শ্রম করতে চান ?
.
এছাড়া আপত্তি উঠতে পারে, বিধি ও নিষেধ নিজেই কর্মনিয়ন্ত্রক হওয়ায় অর্থবাদের প্রয়োজন কী ? অর্থবাদগুলি কোন কর্মের প্রতিপাদক নয় বলে এগুলি অনর্থক- অতএব অপ্রমাণ।
উত্তরে (মীমাংসাসূত্র: ২/১/৭-১৮) বলা হয়েছে, অর্থবাদগুলি অনর্থক বা নিষ্প্রয়োজন নয়। কেননা, প্রত্যক্ষ বা অনুমানসিদ্ধ ফল বিষয়েই পুরুষের স্বতঃসিদ্ধ অনুরাগ স্বাভাবিক, তাই এ-জাতীয় ফল-লাভের উপায়ের প্রতি পুরুষ স্বভাবতই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু যজ্ঞফল সর্বদা প্রত্যক্ষগম্য বা অনুমানসিদ্ধ নয়; তাই সে-বিষয়ে বিধিবাক্য শুনে ফলে উপায়স্বরূপ যজ্ঞে পুরুষের প্রবৃত্তি উৎপন্ন হলেও সে প্রবৃত্তি বলবতী হয় না। এবং শ্রমসাধ্য যজ্ঞানুষ্ঠান কষ্টমাত্র সার হতে পারে এই আশঙ্কায় বিধির শক্তি যে প্রবৃত্তি উৎপাদন করা তাও কুণ্ঠিত হতে পারে। অতএব অর্থবাদগুলিতে যজ্ঞফলের প্রশংসা বা প্রশস্ততা করলে পুরুষের প্রবৃত্তি বলবতী হবে এবং পুরুষের শক্তি বলবতী হলে বিধিশক্তিও অব্যাহত থাকবে। এই কারণে অর্থবাদগুলি বিধিশক্তির উত্তেজক বা উত্তম্ভক। অর্থবাদ মন্ত্রগুলি যজ্ঞীয়বিধান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো স্বতন্ত্র তাৎপর্য বা সার্থকতা নেই।
এভাবে মীমাংসকরা অর্থবাদগুলির- অর্থাৎ ব্রাহ্মণাংশের নিছক বর্ণনামূলক বা অলঙ্কারমূলক বাক্যগুলির- যজ্ঞের দিক থেকে একটা তাৎপর্য করবার প্রচেষ্টা করেন। তাঁদের দাবি হলো, প্রতিটি অর্থবাদই কোনো-না-কোনো বিধির সঙ্গে সংযুক্ত এবং উক্ত বিধির প্রশংসাই অর্থবাদটির উদ্দেশ্য। যেমন, একটি বিধি হলো- ‘অভ্যুদয়কামী ব্যক্তি বায়ুদেবতার উদ্দেশ্যে শ্বেত ছাগ বধ করিবে’-(তৈত্তিরীয় সংহিতা-২/১/১)। পরক্ষণেই অর্থবাদ হিসেবে বলা হয়েছে- ‘বায়ু বড় ক্ষিপ্রতম দেবতা’-(তৈ:স:-২/১/১)। অর্থাৎ দুটো বাক্যের ফলাফল- ‘যেহেতু বায়ুদেবতা বড় ক্ষিপ্রতম, এই কারণে বায়ু যে-যজ্ঞের দেবতা তাহার ফলও অতি ক্ষিপ্রই হইয়া থাকে’। এই অর্থবাদ শুনলে আলোচ্য যজ্ঞের প্রবৃত্তি তীব্র হয়ে উঠবে। অতএব বিধিমূলক না হলেও অর্থবাদগুলি বিধির সহায়ক। বস্তুত অর্থবাদ বিধি ও নিষেধের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিধি-নিষেধের সঙ্গে যুক্ত হয়েই অর্থবাদ সার্থকতা লাভ করে। একেই বলে বিধির সঙ্গে অর্থবাদের ‘একবাক্যতা’ (মীমাংসাসূত্র-১/২/১)। এ বিষয়ে মহর্ষি জৈমিনির সিদ্ধান্তসূত্রটি হলো-  
‘বিধিনা ত্বেকবাক্যত্বাৎ স্তুত্যর্থেন বিধীনাং স্যুঃ।’- (মীমাংসাসূত্র)
অর্থাৎ : বিধিবাক্যের সাথে অর্থবাদবাক্যের একবাক্যতা হয় বলে বিধিবিহিত কর্মসমূহের স্তুতি অর্থাৎ প্রশংসারূপ প্রয়োজনসাধনে অর্থবাদগুলি সফল হয়ে থাকে।
মীমাংসকরা বলেন, বিধিবাক্যের প্রশংসা ও নিষেধবাক্যের নিন্দা যদি পৃথকভাবে না করা হয় তাহলে বিধি ও নিষেধ পালনে শৈথিল্য দেখা দিতে পারে। স্বাভাবিক আসক্তিবশতই মানুষ কর্মে প্রবৃত্ত হয়। বিধিবাক্য উপদিষ্ট কর্মসম্পাদনে প্রবৃত্ত করে এবং নিষেধবাক্য নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিবৃত্ত করে। কিন্তু এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি যদি প্রশংসিত না হয় এবং এর বিপরীত কার্যক্রম যদি নিন্দিত না হয় তাহলে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি নিরুৎসাহিত হয়। এ কারণেই অর্থবাদের প্রয়োজন। অর্থবাদ প্রশংসা ও নিন্দার মাধ্যমে উপদিষ্ট কর্ম সম্পাদনে ও নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিবৃত্তিতে মানুষকে প্রবৃত্ত করে। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির উত্তেজকরূপে তাই অর্থবাদের প্রয়োজন স্বীকার করতে হয়। তাই এটাও বলতে হয়, বিধিবাক্য বা নিষেধবাক্য দ্বারা প্রতিপাদিত বিষয়ের যথাক্রমে প্রাশস্ত্য ও নিন্দা ছাড়া অর্থবাদের স্বতন্ত্র বা স্বকীয় কোনো প্রয়োজন নেই। এ কথার সুর ধরে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর দর্শন-দিগদর্শন গ্রন্থে (পৃ-১৪৬) বলেন- ‘জৈমিনির মতে আরুণি ও যাজ্ঞবল্ক্যের সমস্ত গভীর দর্শন যজ্ঞ প্রতিপাদক বিধির অর্থবাদ, এ ছাড়া তার আর কোনো সার্থকতা নেই।
আবার, অর্থবাদ একধরনের অতিশয়োক্তিমূলক বাক্য; তার দ্বারাই অর্থবাদ বিধিকে পুষ্ট করে। বলা যায় এটি এক ধরনের অলঙ্কার স্বরূপ। প্রাচীন সাহিত্যে বা কবিকৃতিতে অলঙ্কারের বীজস্বরূপ অতিশয়োক্তির অভাব নেই। উপমা অলঙ্কারের আশ্রয় নিয়ে কবি যখন বলেন ‘চাঁদের মতো মুখ’, তখন নিশ্চয়ই বলতে চান না যে মুখটি চাঁদের মতো গোলাকৃতি, কিংবা মুখে আছে চাঁদের ‘চরকাবুড়ি’র মতো কিছু কলঙ্কচিহ্ন। বাড়িয়ে বলা সন্দেহ নেই, তবে কবি হয়তো এর মধ্য দিয়ে বলতে চান যে মুখটি স্নিগ্ধতা এবং আহ্লাদকত্বে চন্দ্রতুল্য। অত্যন্ত স্নিগ্ধ এবং আনন্দদায়ক। এই অতিশয়োক্তি যে দোষের কিছু নয় বরং আবশ্যকই তা সংস্কৃতজগতের খ্যাতনামা প্রাচীন আলঙ্কারিক দণ্ডী কিংবা অভিনবগুপ্তের ঘোষণাতেই প্রমাণ পাওয়া যায়-
‘অলঙ্কারান্তরাণামপ্যেকমাহুঃ পরায়ণম্ ।
বাগীশমহিতামুক্তিসিমামতিশয়াহ্বয়াম্ ।। (দণ্ডী : কাব্যাদর্শ-২/২২০)
অর্থাৎ : ব্যাপক অর্থে অতিশয়োক্তি বা বাড়িয়ে বলা সমস্ত অলংকরণের সাধারণ চরিত্র।
লৌকিক বা কাব্যিক জগতের মতো বৈদিক রাজ্যেও অর্থবাদ এই অলংকরণের দায়িত্বই পালন করে। কেননা, মানুষ পুরুষার্থ লাভের আকাঙ্ক্ষায় বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এইসব ক্রিয়াকাণ্ডে আলস্য দেখা দিলে তা দূর করার জন্য এবং ক্রিয়াকাণ্ডে পুনঃপ্রবৃত্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রশংসাত্মক বাক্য এবং নিন্দাত্মক বাক্য। তাই অলঙ্কারধর্মী এসব প্রশংসাত্মক বাক্য ও নিন্দাত্মক বাক্য প্রবর্তনামূলক ও নিবর্তনামূলক প্রবৃত্তির উদ্বোধক হয়ে বিধি ও নিষেধ পালনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। আর এ-কারণে বিচারমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে মীমাংসা-মতে, বেদের কিছু বিধিবাক্য ব্যতীত সমস্তই অর্থবাদ।
তবে অর্থবাদকে কেবল প্রশংসাত্মক ও নিন্দাত্মক বাক্য বলা হলেও মীমাংসাসম্মত অর্থবাদের মূলত চারটি প্রকারভেদ আছে, যথা- স্তুতি, নিন্দা, পরকৃতি, পুরাকল্প।
স্তুতি : বিধেয় কর্মের প্রশস্তির মাধ্যমে বিধেয় কর্মে প্রবৃত্তির জন্য যাজ্ঞিককে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে যে মন্ত্র বিজ্ঞাপিত তা-ই স্তুতিমূলক অর্থবাদ। অর্থবাদ বিধি নয়, তবে তা বিধিকে পুষ্ট করে। মীমাংসক শবরস্বামী স্তুতিমূলক অর্থবাদ বোঝাতে আকর্ষণীয় লৌকিক বিজ্ঞাপনী দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এভাবে-
‘যেমন ধরুন, দেবদত্তের এই গরুটি কিনুন, গরুটি বহুক্ষীরা (প্রচুর দুধ দেয়), স্ত্র্যপত্য (এর বাছুরগুলিও সবই স্ত্রী) অনষ্টপ্রজা (এর একটি সন্তানও নষ্ট হয়নি)। গরুটি কেনা কর্তব্য- এই বিধির সঙ্গে গরুর গুণপনার কীর্তনের দ্বারা ক্রেতাদের কেনার প্রবৃত্তি অনেকটা বেড়ে যাবে।’- (শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-১/২/২০)
গৌড়মীমাংসক ভবদেব ভট্ট তাঁর ‘তৌতাতিত-মত-তিলক’ গ্রন্থে স্তুতিমূলক অর্থবাদের যে লৌকিক উদাহরণটি দিয়েছেন তা সামাজিক দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ-
বাজারে দাস বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে, চিৎকার করে বলা হচ্ছে- ‘এই ক্রয়যোগ্য পুরুষমানুষটি সাধারণ পুরুষমাত্র নয়, এ এক মত্তহস্তী।’- (সূত্র: হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃ-৩৯)।
এরকম বিজ্ঞাপনী দৃষ্টান্ত বর্তমানকালেও অহরহ আমাদের দৃষ্টিতে বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। তবে বেদের স্তুতিমূলক অর্থবাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতার (২/১/১) প্রজাপতি ও বায়ুদেবতার আখ্যানটিকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়-
‘সৃষ্টির পূর্বে প্রজাপতি একাই ছিলেন, তিনি কামনা করলেন- প্রজা ও পশু সৃষ্টি করবো। তিনি শরীর থেকে বপা ( মেদ) উদ্ধৃত করে অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন, তা থেকে শৃঙ্গরহিত অজ (ছাগ) উৎপন্ন হলো। তাকে তার অনুরূপ দেবতাকে অর্পণ করে তিনি প্রজা ও পশু লাভ করেন। যে ব্যক্তি প্রজা (সন্তান-সন্ততি) ও পশু কামনা করবে, সে প্রজাপতির উদ্দেশে শৃঙ্গরহিত অজ অর্পণ করবে। প্রজাপতিকে তার ভাগ দিয়ে সেবা করলে প্রজাপতি প্রজা ও পশু উৎপন্ন করে থাকেন।’- ( তৈত্তিরীয়-সংহিতা-২/১/১)
‘ঐশ্বর্যকামী ব্যক্তি বায়ুদেবতার জন্য শ্বেতবর্ণ পশু সংগ্রহ করবে। বায়ু ক্ষিপ্রগামী দেবতা। শ্বেত পশু তার অত্যন্ত প্রিয় বলে তা তার নিজের ভাগ। যে তার ভাগের দ্বারা বায়ুর সেবা করে, তাতে বায়ু তুষ্ট হয়ে তাকে ঐশ্বর্য দেয়, তার অনুগ্রহে সে ঐশ্বর্য লাভ করে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ যারা, তারা বায়ুকে অতিক্ষিপ্র বলে থাকে। সে উগ্র দেবতা যজমানকে দগ্ধ করতেও সমর্থ। লোকে দেখা যায় বায়ু অতি দ্রুত প্রবাহিত হলে জাজ্বল্যমান অগ্নি গৃহাদি দগ্ধ করে- এজন্য অগ্নির দ্বারা বায়ুর দাহকত্বের কথা বলা হয়েছে। তা পরিহার করবার জন্য নিষুৎ নামক অশ্ব যুক্ত বায়ুর সেবা করবে। রথে যুক্ত নিষুৎ নামক অশ্বগুলি বায়ুর ধারক, তারা ধীরে চলে বায়ুকে সংযত করতে পারে। এরূপ নিষুৎ যুক্ত বায়ুর হবি প্রদানের দ্বারা যজমানও ধৈর্যলাভ করে অবিনষ্ট হয়ে ঐশ্বর্যলাভ করে, সে ঐশ্বর্য তাকে দগ্ধ করে না। নিষুৎযুক্ত বায়ুর অনুগ্রহে ধৈর্যযুক্ত যজমান নিজ পুরুষদের সংযত ও দ্রব্যাদি অবিনষ্টভাবে পালন করতে সমর্থ হয় জন্য তার মনে সন্তাপরূপ প্রদাহ হয় না। গ্রামলাভের কামনা করে নিষুৎ-যুক্ত বায়ুর সেবা করবে। বায়ু প্রজাগণকে নাকে দড়ি বেঁধে ঘুড়ায়ে থাকে। যারা নিষুৎ-যুক্ত বায়ুকে তার ভাগের ( শ্বেতপশুর) দ্বারা সেবা করে, বায়ু তুষ্ট হয়ে প্রজাদের যজমানের অধীন করে দেয়। এতে যজমান গ্রামে আধিপত্য লাভ করে। নিষুৎ-যুক্ত বায়ুকে তার ভাগ দিলে, গ্রামস্থ সকল প্রজা যজমানের অনুরক্ত হয়, কখনও কেউ তার বিরক্ত হয় না। অপত্যকামনায় নিষুৎ-যুক্ত বায়ুর সেবা করবে…।’- ( তৈত্তিরীয়-সংহিতা-২/১/১)
উপরিউক্ত বেদমন্ত্র প্রসঙ্গে মীমাংসক কুমারিল ভট্টের ব্যাখ্যা হলো, প্রজাপতি নামক কোনো দেবতা কোনোদিন নিজ উদরের মেদপিণ্ড ছিন্ন করে যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দেননি। আপনাকেও তা করতে বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে প্রজাপতির উদ্দেশ্যে শৃঙ্গহীন ছাগ বলি দাও। তা হলে সন্তানসন্ততি ও পশুসম্পদের কামনা পূর্ণ হবে। এটাই গল্পের সার কথা।
একইভাবে, বায়ু সবচেয়ে দ্রুতগামী দেবতা বলে আপনাকে বায়ুবেগে ছুটতে বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, সাংসারিক সমৃদ্ধি (ভূতি) কামনা করলে বায়ুর উদ্দেশ্যে শ্বেত ছাগ বলি দাও। বায়ু দেবতার স্তুতির দ্বারা আসলে এই যজ্ঞ-কর্মটির প্রশংসা করা হচ্ছে। এগুলো বেদের স্তুতিমূলক অর্থবাদ।
নিন্দা : নিষিদ্ধ কর্মের নিন্দাত্মক বিজ্ঞাপনের দ্বারা নিষেধ্য কর্ম থেকে নিবৃত্তির জন্য যাজ্ঞিককে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে যে মন্ত্র বিজ্ঞাপিত তা-ই নিন্দামূলক অর্থবাদ। যেমন- ‘সোহরোদীৎ তদ্রুদ্রস্য রুদ্রতম্’ অর্থাৎ, তিনি রোদন করেছিলেন, এ কারণে তাই রুদ্রের রুদ্রত্ব’- ( তৈত্তিরীয়-সংহিতা-১/৫/১), এই বাক্যটি একটি নিষিদ্ধ কাজের নিন্দাসূচক অর্থবাদ। পুরো অর্থবাদটি একটি উপাখ্যান। উপাখ্যানটি কেবল গল্পরূপে উপভোগ্য নয়, যাজ্ঞিক যজমানদের তুলনায় তুখোড় সংসার-বুদ্ধিরও পরিচায়ক। যজুর্বেদের গল্পটি এরূপ-
‘দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিলো। দেবগণ জয় লাভ করে অসুরদের মণিমুক্তা প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ ধন রক্ষার জন্য অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন; কারণ যদি কোন প্রকারে অসুরদের জয় হয় তবে এ ধন তাদের বিপদে কাজে লাগবে। অগ্নি সে ধন আত্মসাৎ করবার ইচ্ছায় তা নিয়ে পলায়ন করলো। পুণ্যবান দেবগণ অসুরদের জয় করে অগ্নির পিছু ধাওয়া করে বল পূর্বক সে ধন পেতে ইচ্ছা করেছিলো। তাতে অগ্নি রোদন করতে লাগলো। রোদন করেছিলো বলে রুদ্রের রুদ্রত্ব অর্থাৎ রোদন করার জন্য তখন থেকে অগ্নির নাম রুদ্র হয়েছিলো। অগ্নির অশ্রুবিন্দু মাটিতে পড়ে রজত বা রূপায় পরিণত হলো। অগ্নির বেদনার অশ্রুতে গড়া বলেই রূপা যজ্ঞে দক্ষিণার অযোগ্য। দিলে সারাবছর ধরে তার গৃহে গৃহপরিজনকে রোদন করতে হবে।’- ( তৈত্তিরীয়-সংহিতা-১/৫/১)
গল্পের আসল কথাটি হলো, যজ্ঞে দক্ষিণা হিসেবে কখনো রূপা বা রূপার জিনিস দান করবে না, ‘তস্মাত্ বর্হির্ষি (যজ্ঞে) রজতং ন দেয়ম্’। কুমারিল ভট্ট তার ব্যাখ্যা করলেন- ‘যজমান খুব উদার হতে পারেন। কিন্তু এভাবে ধন দান করলে তার পরিবারবর্গকে কষ্ট পেতে হবে, ‘রোদন’ কথাটির এই হলো তাৎপর্য।’- (তন্ত্রবার্তিক, মীমাংসাসূত্র-১/২/১০)
.
প্রশ্ন উঠতে পারে, অগ্নি বা রুদ্র নামক কোনো দেবতা কোনদিন রোদন করে রুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়নি, তার চোখের জল গড়িয়ে রূপাও গড়ে ওঠেনি। এসব মিথ্যা কাহিনীর সাথে যজমানের ঘরে রোদনের রোল ওঠার সম্পর্ক কী ?
উত্তরে মীমাংসক শবরস্বামী বলেন, নিছক গল্প হিসেবে এসব কথা মিথ্যা ঠিকই। কিন্তু কথাগুলি গৌণ অর্থে গ্রহণ করতে হবে। ব্যাকরণ রুদ্ ধাতুর ( রোদন করা) পরে রক্ প্রত্যয় যৌগ করে রুদ্রশব্দের ব্যুৎপত্তি দেখানো হয়েছে। এই কল্পিত ব্যুৎপত্তির মূলে রয়েছে কল্পিত বৈদিক উপাখ্যানটি। অগ্নির রুদ্রনাম-প্রাপ্তি হলো গল্পের বিষয়বস্তু, কিন্তু গল্পের তাৎপর্য নয়। অগ্নি রোদন করেছিলো আশঙ্কিত ধনহানির দুঃখে। ধনহানি সকল গৃহপরিজনের দুঃখের কারণ। যদি উদার দানবীর হয়ে যজ্ঞের দক্ষিণা রূপে রূপার মতো মূল্যবান দ্রব্য দান কর তাহলে তোমার ঘরে সারাবছর ধরে ধনহানিজনিত দুঃখের রোদন চলবে। তাই যজ্ঞে রজত দক্ষিণা দিও না।
.
উপাখ্যানের আসল লক্ষ্য এই নিষেধ। বিষয়বুদ্ধিহীন উদার দাতার অতিদানের নিন্দা দ্বারা অভিজ্ঞ সংসারী লোকের বিষয়বুদ্ধিও প্রশংসা করা হয়েছে। তাই এ অর্থবাদের প্রেক্ষিতে কুমারিল মন্তব্য করছেন-
‘বৃত্তান্তপর্সবসায়ী চ বেদস্তত্র প্রামাণ্যম্ অপ্রতিপদ্যমানঃ স্তুতৌ সত্যত্বান্ নান্যত্র অন্বেষণমহতি ইতি নিষ্প্রয়োজনোপাখ্যান-সত্যতয়া নার্থঃ।… ন তদ্গতে সত্যাসত্যত্বে কিঞ্চিদ্ দুষয়তঃ।’- (তন্ত্রবার্তিক- ১/২/১০)
অর্থাৎ : বৈদিক কাহিনিগুলির তাৎপর্যার্থটা সত্য। গল্পের বাস্তব সত্যতার অন্বেষণ ও গবেষণা নিষ্প্রয়োজন। গল্পের সত্যাসত্যে কিছু আসে যায় না।
ভাষ্যকার শবরস্বামীও বলেছেন-
‘ন নিন্দা নিন্দ্যং নিন্দিতুৎ প্রযুজ্যতে, কিং তর্হি নিন্দিতাদিতরৎ প্রশংসিতুম্’।
অর্থাৎ : সকল নিন্দাবাক্যই যে কোন কিছুকে নিন্দা করবার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়, তা নয়। একের প্রশংসার উদ্দেশ্যেও অপরকে নিন্দা করা হয়।
.
প্রসঙ্গত, ব্যাকরণ দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ভর্তৃহরি তার বাকপদীয় গ্রন্থের দ্বিতীয় কাণ্ডে অর্থবাদ প্রসঙ্গে লৌকিক উদাহরণসহ যে মন্তব্য করেছেন তা উল্লেখযোগ্য-
‘প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তির প্রয়োজনে প্রকল্পিত স্তুতিনিন্দাকে নিপুণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি অসত্য বলেই মনে করেন’- (বাকপদীয়-২/৩১৯)। তাই, ‘বাঘের নাম করে যেমন বাচ্চাকে নিবৃত্ত করা হয়, তেমনি (নিষিদ্ধ কর্ম থেকে নিবৃত্ত করার জন্য) এতে বিপদ ঘটবে বলে বলা থাকে, যদিও এ বিপদটা সত্য নয়’- (বাকপদীয়-২/৩২১)। এ প্রেক্ষিতে ভর্তৃহরির শাস্ত্রীয় উদাহরণটিও উপভোগ্য- ‘যজ্ঞের পিঠা যে দাঁত দিয়ে কামড়ে খাবে তাকে সাপে কামড়াবে।’- (বাকপদীয়-২/৩২৩)।
.
পরকৃতি : কোনো মহাপুরুষের কৃতকর্ম বর্ণনা করাকে পরকৃতি বলে। যেমন, ‘অগ্নির্বা অকাময়ত্’- অর্থাৎ, অগ্নি কামনা করেন। এই অর্থবাদ-বাক্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, অতীতে স্বয়ং অগ্নিদেবও অগ্নিদৈবত যাগ করেছিলেন। অতএব আগ্নেয়যাগ অতি প্রশস্ত। ‘অপর কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি অমুক কর্ম করেছেন’- এধরনের অর্থবাদবাক্যই পরকৃতি।
.
পুরাকল্প : পুরাকল্প হলো প্রাচীন যুগের কীর্তিকাহিনী। স্তুতি ও নিন্দা দ্বারা যেমন বিধির পুষ্টি হয়, তেমনই প্রাচীন যুগের কীর্তিকাহিনী দ্বারাও বিবিধ পুষ্টি হয়। প্রাচীন কালের কথা যেমন, ‘পুরা ব্রাহ্মণা অভৈষ্ণুঃ’- অর্থাৎ, প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণরা ভয় করতেন। বাল্মীকি, দ্বৈপায়ন প্রমুখ ঋষিগণ বেদমূলক উপাখ্যানই রচনা করেছেন। তাঁদের বুদ্ধিপ্রতিভা বেদবিরুদ্ধা নয়। বিভিন্ন অধিকারীর নিমিত্ত বিভিন্ন উপাখ্যান রচিত ও পল্লবিত হয়েছে। তাই কুমারিল ভট্টও তন্ত্রবার্ত্তিকে এ কথাই বলেছেন-
‘ইহ কেচিদ্ বিধিমাত্রেণ প্রতিপদ্যন্তে।’
‘নাতিবোপাখ্যানেষু তত্ত্বাভিনিবেশঃ কার্য্যঃ।’ (তন্ত্রবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : অর্থবাদমাত্রই কোন-না-কোন বিধির স্তাবক বা নিন্দক। তাই উপাখ্যানভাগের প্রতি শব্দে তাৎপর্য্য অনুসন্ধান করতে নেই। অতিরঞ্জিত অংশ শুধু অর্থবাদ।

বেদের অধিকাংশই যে নিরর্থক নয় তা মীমাংসায় বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তাই জৈমিনি একদিকে বেদের অনাদি অপৌরুষেয়তা প্রমাণ করবার জন্য বলেছেন বেদের কোন ইতিহাস নেই, অন্যদিকে তেমনই পরকৃতি ও পুরাকল্পের সংযোজনে ইতিহাসকে প্রায় মেনেও নিয়েছেন। এই আপত্তির উত্তরে মীমাংসার বক্তব্য হলো, এই ইতিহাস নিত্য অর্থাৎ যাজ্ঞবল্ক্য ও জনক অনিত্য ইতিহাসের একবারের ঘটনা নন, দিবারাত্রির মতোই, অনাদিকাল ধরে যাজ্ঞবল্ক্য ও জনক জন্মগ্রহণ করছেন, যাঁদের কথা বেদের এক অংশ শতপথ ব্রাহ্মণের শেষ খণ্ডে- বৃহদারণ্যকে- বারবার লেখা হয়েছে। তবে এগুলি সবই অর্থবাদের অন্তর্ভুক্ত।
[পরের পর্ব : অপূর্ব-বাদ]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ