প্রমেয় পদার্থ - ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম্মতত্ত্ব

ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান, ধর্ম গ্রন্থ কি , হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়, ইসলাম খ্রীষ্ট মত বিষয়ে তত্ত্ব ও সনাতন ধর্ম নিয়ে আলোচনা

धर्म मानव मात्र का एक है, मानवों के धर्म अलग अलग नहीं होते-Theology

সাম্প্রতিক প্রবন্ধ

Post Top Ad

স্বাগতম

প্রমেয় পদার্থ

মীমাংসা দর্শন মতে, সমস্ত বস্তুই হয় প্রমাণ অথবা প্রমেয়ের অন্তর্গত। এই মতে, প্রমাণ হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের করণ বা উপায়, আর প্রমেয় হলো যথার্থ জ্ঞানের বিষয়। আর প্রমেয়ভূত মূল বিষয়কে বলা হয় পদার্থ।
এখানে উল্লেখ্য, বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী মীমাংসকরা প্রধাণত বেদের প্রামাণ্য বা স্বতঃসিদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দার্শনিক বিচারের আওতায় এসে ভাববাদ খন্ডনে বাহ্যবস্তুবাদী ন্যায়-বৈশেষিকদের মতো যেমন প্রমাণতত্ত্বের নানা মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন ও বিচার করতে বাধ্য হয়েছেন, তেমনি তাঁরা প্রমেয়ভাবে ন্যায়-বৈশেষিকদের বাহ্যবস্তুবাদসম্মত বহির্জগতের ব্যাখ্যাও বহুলাংশেই গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তাঁরা বস্তু যেসব মৌলিক উপাদান দ্বারা গঠিত হয় সেসবের শ্রেণীবিন্যাস করার পাশাপাশি বৈশেষিকদের পরমাণুবাদও গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু মীমাংসকদের পরমাণুবাদ বৈশেষিকদের মতো সূক্ষ্ম নয়।
বৈশেষিক মতে, কোনো বস্তুকে বিভাগ করতে করতে শেষ পর্যন্ত যে-সর্বসূক্ষ্ম অংশের কথা স্বীকার করতে হবে তারই নাম পরমাণু। বস্ত্র সূত্র-গঠিত, সূত্র অংশু গঠিত, অংশু তদংশ গঠিত- এভাবে অবয়বী-অবয়ব বিভাগের যেখানে শেষ বা বিশ্রাম তারই নাম পরমাণু। পরমাণুর আর অবয়ব নেই, পরমাণুতেই ক্ষুদ্রতা বিশ্রান্তির বা বিভাগ নিবৃত্তির শেষ। পরমাণু অতীন্দ্রিয়; ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সূক্ষ্মতম অংশের নাম ত্রসরেণু। দুটি পরমাণুর সংযোগে একটি দ্ব্যণুক সৃষ্টি হয় এবং তিনটি দ্ব্যণুকের সংযোগে একটি ত্রসরেণু সৃষ্টি হয়। বলা হয়,- ‘গবাক্ষরন্ধ্রে সূর্যকিরণের মধ্যে গতিশীল সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যে রেণু দেখা যায়, তারই নাম ত্রসরেণু’।
তবে মীমাংসকদের পরমাণুবাদ এতো সূক্ষ্ম বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তাঁদের মতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ত্রসরেণুই বস্তুর সূক্ষ্মতম অংশ, অতএব এগুলিকেই পরমাণু বলা হবে। এর চেয়ে সূক্ষ্ম কোনো অংশের কথা কল্পনামাত্র। মীমাংসকেরা এভাবেই পরমাণুবাদ গ্রহণ করেছেন।
পদার্থ
উপলব্ধির বিষয় হিসেবে জগতে বহু বস্তু প্রতীত হয়, ন্যায়-বৈশেষিকেরা এগুলিকে ‘পদার্থ’ নামে কয়েকটি মূল শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যা জ্ঞেয়, যা প্রমেয় এবং যা অভিপ্রেয় তা-ই পদার্থ। বৈশেষিক মতে সমস্ত পদার্থকেই প্রথমত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়- ভাবপদার্থ ও অভাবপদার্থ। ভাবপদার্থ ছয় প্রকার- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়। এর সঙ্গে অভাব সংযুক্ত করে মোট সপ্ত পদার্থের উল্লেখ করা হয়।
জৈমিনি’র মীমাংসাসূত্রে পদার্থের উল্লেখ নেই। শবরভাষ্যে (১০/৩/৪৪) দ্রব্য, গুণ, কর্ম ও অবয়বের উল্লেখ থেকে অনুমান হতে পারে যে শবরস্বামী চারটি পদার্থ স্বীকার করেছিলেন। তবে শবরের কাছে পদার্থের আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেনি। কিন্তু প্রভাকর ও কুমারিল বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব বিষয়ে ন্যায়-বৈশেষিকদের সাথে একমত হয়েছিলেন বলেই তাদের কাছে ন্যায়-বৈশেষিক প্রতিপাদ্য পদার্থ-তত্ত্ব সবিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিলো। তবে বহির্জগতের বস্তুগুলিকে ঠিক কয়টি পদার্থের অন্তর্গত করা হবে- এ বিষয়ে উভয়ে একমত নন।
প্রভাকরের মতে প্রমেয় পদার্থ আটটি- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, জাতি বা সামান্য, সমবায় বা পরতন্ত্রতা, শক্তি, সাদৃশ্য এবং সংখ্যা। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি বৈশেষিক স্বীকৃত। কিন্তু প্রভাকর বৈশেষিকদের অভাব এবং বিশেষ পদার্থ স্বীকার করেন নি। তার পরিবর্তে শক্তি, সাদৃশ্য এবং সংখ্যা নামের তিনটি পদার্থের উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে কুমারিল ভট্ট প্রভাকরের এই তিনটি নতুন পদার্থ স্বীকার করেন নি; এবং তিনি বৈশেষিক প্রতিপাদ্য বিশেষ এবং সমবায়ও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে কুমারিল-মতেও অভাব একটি পদার্থ। অতএব ভাট্টমত বিচারে পদার্থ মোট পাঁচ প্রকার- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, জাতি বা সামান্য এবং অভাব। ভাট্ট-মীমাংসক নারায়ণ ভট্ট বলেছেন-
‘বয়ং তাবৎ প্রমেয়ন্তু দ্রব্যজাতিগুণাস্ত্রয়ঃ।
অভাবশ্চেতি পঞ্চৈতান্ পদার্থানাদ্রিয়ামহে।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : তাবৎ প্রমেয়পদার্থ পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত- দ্রব্য, জাতি, গুণ, ক্রিয়া এবং অভাব।
প্রভাকর অভাব বলে কোনো স্বতন্ত্র পদার্থের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, অভাব অতিরিক্ত পদার্থ নয়, অভাব অধিকরণ স্বরূপ। যেমন অন্ধকারে আলোর অভাব। অন্ধকার দ্রব্য নয়, তা অধিকরণ স্বরূপ। প্রভাকর বৈশেষিকদের বিশেষ নামের পদার্থ প্রত্যাহার করেছেন। তাঁর যুক্তি হলো, আকাশ পরমাণু প্রভৃতি নিত্যবস্তুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করবার উদ্দেশ্যেই বৈশেষিকরা বিশেষ বলে পদার্থ স্বীকার করেন; কিন্তু গুণের সাহায্যেই এই পার্থক্য নির্ণয় সম্ভব, তাই বিশেষ বলে স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ স্বীকারের প্রয়োজন নেই। অপরপক্ষে, শক্তিকে একটি স্বতন্ত্র পদার্থ বলতে হবে। কেননা, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুতেই শক্তি বিদ্যমান- যেমন অগ্নির মধ্যে শক্তি বিদ্যমান বলেই তার পক্ষে দহনকার্য সম্ভব। এই শক্তি প্রত্যক্ষগোচর নয়, কিন্তু অনুমানসিদ্ধ। প্রভাকর স্বীকৃত সংখ্যা নামের স্বতন্ত্র পদার্থ-বিষয়ে প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের পরবর্তী দার্শনিকেরা মতভেদ প্রকাশ করেছেন। যেমন প্রকরণ-পঞ্চিকায় বলা হয়েছে, সংখ্যা একটি গুণ; তাকে স্বতন্ত্র পদার্থ বলা যায় না। প্রভাকরের মতে সংখ্যা গুণ হতে পারে না। সংখ্যা একটি স্বতন্ত্র পদার্থ। গুণের মধ্যেও সংখ্যা থাকতে পারে যেমন ‘দুরকমের গন্ধ’, ‘তিন রকমের স্পর্শ’। প্রভাকরের মতে সাদৃশ্যও একটি স্বতন্ত্র পদার্থ। প্রত্যক্ষ দ্বারা সাদৃশ্যের জ্ঞান হয় না। অনুমান ও উপমান দ্বারা সাদৃশ্যের জ্ঞান হয়। প্রভাকর বৈশেষিক সম্মত সমবায়ের নাম দেন ‘পরতন্ত্রতা’।
অন্যদিকে কুমারিল ভট্ট সমবায়কে স্বতন্ত্র পদার্থ বলে গ্রহণ করার বিরোধিতা করেছেন। বৈশেষিক-মতে সমবায়-সম্বন্ধ নিত্য, কিন্তু তা হতে পারে না। তাঁর মতে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যেই সম্বন্ধ থাকে। অবিচ্ছেদ্য বস্তুর মধ্যে সম্বন্ধকে সমবায় বলে। যেমন জাতি ও ব্যক্তির মধ্যে সম্বন্ধ সমবায়-সম্বন্ধ; কিন্তু ব্যক্তির সঙ্গে এই সম্বন্ধের উৎপত্তি এবং ব্যক্তির বিনাশের সঙ্গে এই সম্বন্ধও বিনষ্ট হয়।
কুমারিল শক্তি, সাদৃশ্য ও সংখ্যাকে পদার্থ বলে মনে করেন না। শক্তি ও সংখ্যা কুমারিলের মতে পদার্থ নয়, দ্রব্যের গুণ। সাদৃশ্য হলো দুই বা ততোধিক বস্তুর বৈশিষ্ট্য।
দ্রব্য
পরিমাণরূপ গুণের আধারকেই ভাট্টরা দ্রব্য বলেছেন। অর্থাৎ যার পরিমাণ আছে এবং যা গুণের আধার তাকে দ্রব্য বলে। পরিমাণ ও গুণ সকল দ্রব্যেই থাকে এবং দ্রব্য ভিন্ন কোন পদার্থে থাকে না। ভাট্ট-মতে দ্রব্য এগারোটি- ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ বা জল, তেজ, মরুৎ বা বায়ু, ব্যোম বা আকাশ, কাল, দিক্, আত্মা, মন, শব্দ ও অন্ধকার। এদের মধ্যে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও অন্ধকার সাবয়ব দ্রব্য অর্থাৎ প্রত্যক্ষের বিষয়। পরমাণু তাদের অবয়ব। যাবতীয় যৌগিক পদার্থ পরমাণু দ্বারা গঠিত।
.
পৃথিবী- গন্ধবতী পৃথিবী। পার্থিব বিষয়- পর্বত, বৃক্ষ প্রভৃতি। পৃথিবী আরো দুইপ্রকার- শরীর ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়। আত্মার সুখদুঃখভোগের আধার হচ্ছে শরীর। শরীর চতুর্বিধ- মনুষ্যাদির শরীর জরায়ুজ, পতঙ্গাদির শরীর অন্ডজ, মশকাদির শরীর স্বেদজ এবং বৃক্ষাদির শরীর উদ্ভিজ্জ। ইন্দ্রিয়ের আয়তন বা আধার না থাকায় প্রভাকর উদ্ভিজ্জ শরীর স্বীকার করেন না। স্মৃতি ও পুরাণাদির বচনের সাথে বিরোধ হয় বলে ভাট্ট-সম্প্রদায় এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করেননি। তাঁরা বলেন, বৃক্ষাদিরও সুখদুঃখাদির অনুভব আছে বলে ইন্দ্রিয়েরও কল্পনা করতে হবে।
.
জল- স্বাভাবিক দ্রবত্বের অধিকরণ জল। নদী, সাগর প্রভৃতিও রসনেন্দ্রিয় জলস্বরূপ। তেজঃ- উষ্ণস্পর্শরূপ গুণের অধিকরণ তেজঃ। সূর্য অগ্নি প্রভৃতি, সুবর্ণাদি এবং নয়নেন্দ্রিয় তেজঃস্বরূপ। উদ্ভূতরূপ স্পর্শ অগ্নি প্রভৃতিতে, অনুদ্ভূত স্পর্শ নয়নেন্দ্রিয়ে এবং অভিভূত স্পর্শ সুবর্ণাদিতে রয়েছে। উদ্ভূত শব্দের অর্থ প্রকাশিত বা অনুভবযোগ্য। বলবৎ পার্থিবাদি অংশের দ্বারা সুবর্ণাদির তেজঃ অভিভূত। বায়ু- রূপরহিত অথচ স্পর্শবান বায়ু। ত্বক্ বায়বীয় ইন্দ্রিয়। বায়ু ত্বগিন্দ্রিয়গ্রাহ্য। অতএব প্রত্যক্ষগম্য।
.
পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও অন্ধকার- এই পাঁচটি দ্রব্য অবয়ববিশিষ্ট। এইগুলির অবয়ব পরমাণু। তবে মীমাংসক কথিত পরমাণু ন্যায়-বৈশেষিকসম্মত পরমাণু নয়। ভাট্টমতে পরমাণুর চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। পরমাণু অতীন্দ্রিয় বস্তু নয়। নারায়ণ ভট্ট বলেন-  
‘জালরন্ধ্রবিসরদ্রবিতেজো জালভাসুরপদার্থবিশেষান্ ।
অল্পকানিহ পুনঃ পরমাণুন্ কল্পয়ন্তি হি কুমারিলশিষ্যাঃ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ :
উন্মুক্ত জানালার ছিদ্র দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করলে সেই রশ্মিতে যে-সকল অতি সূক্ষ্ম কণিকা লক্ষ্য করা যায়, কুমারিলশিষ্যগণ সেগুলিকেই পরমাণু বলে কল্পনা করেন।
আকাশ, কাল, দিক্, আত্মা, মন ও শব্দ এই ছয়টি দ্রব্য নিত্য, নিরবয়ব ও সর্বব্যাপী। এই দ্রব্যগুলিকে অনুমানের দ্বারা জানা যায়। তাদের প্রত্যক্ষ হয় না। কুমারিলের মতে অন্ধকার দ্রব্য, কারণ অন্ধকারের গুণ ও ক্রিয়া আছে। চোখের দ্বারা অন্ধকারের জ্ঞান লাভ হয়। নৈয়ায়িকরা অন্ধকারকে দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করেন না, কারণ তাঁদের মতে তমঃপদার্থ হলো আলোকের অভাব।
শব্দ- গুণ নয়, দ্রব্য। ধ্বনির দ্বারা শব্দ প্রকাশ হতে থাকে। শব্দ শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রাহ্য। নৈয়ায়িকমতে শব্দগুণের আশ্রয়রূপে আকাশের অনুমান করতে হয়, কিন্তু এই মতে শব্দ আকাশের গুণ নয়। ভাট্ট-মতে বর্ণাত্মক শব্দ সর্বগত বিভু দ্রব্য।
আত্মা- কুমারিলমতে আত্মা চৈতন্য বা জ্ঞানের আশ্রয় এবং মানস প্রত্যক্ষের বিষয়। আত্মা এক নিত্য দ্রব্য। আত্মা শরীর ভেদে ভিন্ন। তা দেহ ইন্দ্রিয়াদির অতিরিক্ত সত্তা। আত্মার বিশেষ গুণগুলি হলো বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ প্রভৃতি। নারায়ণ ভট্টের কারিকায় বলা হয়েছে-
‘স চ দেহেন্দ্রিয়জ্ঞানসুখেভ্যো ব্যতিরিচ্যতে।
নানাভূতো বিভুর্নিত্যো ভোগস্বর্গাপবর্গভাক্ ।।’
অর্থাৎ : দেহ, ইন্দ্রিয়, জ্ঞান, সুখ প্রভৃতি থেকে আত্মা ভিন্ন। আত্মা বহু, সর্বব্যাপী ও নিত্য। সুখদুঃখ-ভোগ, স্বর্গ এবং অপবর্গ (মুক্তি) আত্মারই হয়ে থাকে।
.
মন- মন হলো অন্তরিন্দ্রিয়, যার মাধ্যমে আত্মার গুণগুলি প্রত্যক্ষ হয়। দেহের দ্বারা মন সীমিত। কুমারিলের মতে মন অন্তরিন্দ্রিয়, বিভুপরিমাণ ও অস্পন্দ। প্রভাকরমতে ও ন্যায়-বৈশেষিকমতে মন অণুপরিমাণ। মন স্পন্দহীনও নয়, মন চঞ্চল।
জাতি
প্রভাকর ও কুমারিল উভয়েই জাতি বা সামান্যকে স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকার করেন। এই মতে জাতি ব্যক্তিতে বর্তমান, নিত্য ও প্রত্যক্ষযোগ্য। ব্যক্তির বাইরে জাতির অস্তিত্ব নেই। জাতি ব্যক্তিতে বর্তমান, জাতি নিত্য এবং ব্যক্তি থেকে ভিন্ন এবং অভিন্ন উভয়ই। জাতির সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ হলো তাদাত্ম্য। জাতি সর্বগত ও ব্যক্তিগত উভয়ই। তবে ব্যক্তিই জাতির ব্যঞ্জক। মানমেয়োদয় গ্রন্থে জাতি সম্বন্ধে নারায়ণ ভট্ট বলেন-  
‘জাতির্ব্যক্তিগতা নিত্যা প্রত্যক্ষজ্ঞানগোচরা।
ভিন্নাভিন্না চ সা ব্যক্তেঃ কুমারিলমতে মতা।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : জাতি ব্যক্তিতে অবস্থিত, নিত্য এবং প্রত্যক্ষের বিষয়। জাতি এবং জাতিমান্ এই উভয়ের মধ্যে ভেদ এবং অভেদের উপস্থিতি রয়েছে। কুমারিলমতে ব্যক্তি জাতি থেকে ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয়।
.
গুণ
যা কর্মভিন্ন, অবান্তর জাতিবিশিষ্ট এবং উপাদান কারণ থেকে ভিন্ন, তাই গুণ। বৈশেষিক-মতে গুণ চব্বিশ রকমের, যথা- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধর্ম, অধর্ম এবং শব্দ।
কিন্তু মীমাংসক প্রভাকরের মতে গুণ বাইশ রকমের- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, শব্দ এবং ধর্ম। প্রভাকর সংখ্যা ও অধর্মকে গুণ হিসেবে স্বীকার করেন না। তাঁর মতে সংখ্যা একটি স্বতন্ত্র পদার্থ, তা গুণ হতে পারে না। প্রভাকর অধর্মকেও গুণ স্বীকার করেন না। অধর্ম হলো ধর্মের অভাব, অধিকরণ স্বরূপ। প্রভাকর স্বীকৃত বাকি সব গুণের বৈশিষ্ট্য বৈশেষিক ব্যাখ্যার অনুরূপ।
অন্যদিকে কুমারিল বৈশেষিক সম্মত শব্দ, ধর্ম ও অধর্মকে গুণ থেকে প্রত্যাহার করে অতিরিক্ত হিসেবে ধ্বনি, প্রাকট্য ও শক্তিকে গুণ বলে সংযোজন করে চব্বিশটি গুণ স্বীকার করেছেন। এই চব্বিশটি গুণ হলো- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধ্বনি, প্রাকট্য এবং শক্তি।
কুমারিল শব্দ, ধর্ম ও অধর্মকে গুণ বলে স্বীকার করেন নি। তিনি ধ্বনি, প্রাকট্য ও শক্তিকে গুণ বলে স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, ধ্বনি বায়ুর গুণ এবং নিত্য শব্দের প্রকাশক। বস্তু প্রাকট্যের আশ্রয় স্বরূপ। বস্তুর জ্ঞান হবার পর সেই বস্তুর গুণ হলো প্রাকট্য। শক্তি কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নয়, শক্তি দ্রব্যের গুণ। দ্রব্য, গুণ, সামান্য ও কর্মকে আশ্রয় করে শক্তির উদ্ভব হয়। ভাট্ট-মতে শক্তি দুই প্রকার- লৌকিক ও বৈদিক। লৌকিক শক্তি অর্থাপত্তির সাহায্যে জানা যায় এবং বৈদিক শক্তি বেদের মাধ্যমে জানা যায়। শক্তি প্রত্যক্ষ করা যায় না, কার্য থেকে এর অনুমান করে নিতে হয়। কিন্তু প্রভাকরের মতে শক্তি ও সংখ্যা গুণ নয়, স্বতন্ত্র পদার্থ।
.
রূপ- শুধু চক্ষুরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ। পৃথিবী, জল, তেজ ও তমোরূপ দ্রব্যে বর্তমান বিশেষগুণ। রূপ প্রধানত পাঁচ প্রকার- শুক্ল, কৃষ্ণ, পীত, রক্ত ও শ্যাম।
রস- কেবল রসনেন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ। পৃথিবী ও জলে অবস্থিত বিশেষগুণ। রস ছয়প্রকার- মধুর, তিক্ত, অম্ল, কষায়, কটু ও লবণ।
গন্ধ– কেবল ঘ্রাণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীস্থিত বিশেষগুণ। গন্ধ তিনপ্রকার- সুগন্ধ, দুর্গন্ধ ও সাধারণগন্ধ। জলাদিতে যে গন্ধের প্রতীতি হয়, তার কারণ জলের সাথে পার্থিব ভাগের সম্বন্ধ।
স্পর্শ- কেবল ত্বগিন্দ্রিয়গ্রাহ্য। পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ুতে অবস্থিত বিশেষগুণ। স্পর্শ তিনপ্রকার- শীত, উষ্ণ ও অনুষ্ণাশীত।
সংখ্যা- একত্বাদি ব্যবহারের হেতুভূতগুণ, যা সকল দ্রব্যে অবস্থিত। অতএব এক থেকে পরার্ধ পর্যন্ত  সংখ্যা সাধারণগুণ।
পরিমাণ- দ্রব্যের মানব্যবহারের হেতুভূত সকল দ্রব্যে অবস্থিত সামান্যগুণ। অণু, মহৎ, দীর্ঘাদিভেদে পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। পরমাণুগত পরিমাণ অণু, গগনাদিগত পরিমাণ মহৎ এবং অপর দ্রব্যগত পরিমাণ দীর্ঘ হ্রস্ব ইত্যাদি।
পৃথকত্ব- ভেদব্যবহারের হেতুভূতগুণ পৃথকত্ব সকল দ্রব্যে অবস্থিত সামান্যগুণ।
.
গুরু প্রাভাকর-মীমাংসকরা অনিত্য দ্রব্যে পৃথকত্ব স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন, পদার্থের স্বরূপই হচ্ছে ভেদ। অনিত্য বস্তু প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে অন্য বস্তু থেকে তার ভেদও প্রত্যক্ষসিদ্ধ। সেখানে অতিরিক্ত ব্যাবর্তক কোন ধর্মের কল্পনা নিরর্থক। অদৃষ্ট বস্তুও স্বরূপ প্রত্যক্ষগম্য নয় বলে ব্যাবর্তক ধর্মের কল্পনা করা যেতে পারে। আত্মা প্রত্যক্ষগম্য হলেও যেহেতু সর্বগত, অর্থাৎ বিভু, তাই ব্যাবর্তক ধর্ম স্বীকার করতে হয়।
.
সংযোগ- সকল দ্রব্যে অবস্থিত সামান্যগুণ। নিত্য সর্বব্যাপী দ্রব্যদ্বয়ের সংযোগও নিত্য। যেমন- আকাশ ও কালের সংযোগ। অনিত্য সংযোগ তিনপ্রকার- অন্যতরকর্মজ, উভয়কর্মজ এবং সংযোগজ। গাছ ও পাখির সংযোগ পাখির কর্ম থেকে উৎপন্ন বলে তা অন্যতরকর্মজ সংযোগ। দুটি ষাঁড়ের লড়াইকালীন সংযোগ উভয়ের কর্ম থেকে উৎপন্ন। হাত ও ঘটের সংযোগ থেকে দেহ ও ঘটের সংযোগ উৎপন্ন হয়। এই সংযোগ পূর্বসংযোগ থেকে উৎপন্ন।
বিভাগ- যেসব দ্রব্য বিভু অর্থাৎ সর্বব্যাপী নয়, সেসব দ্রব্যে অবস্থিত বিশেষগুণ। সংযোগের মতো বিভাগও অন্যতরকর্মজ প্রভৃতি তিনপ্রকার বলে স্বীকার করা হয়েছে।
পরত্ব ও অপরত্ব- এই দুটি বিশেষগুণ শুধু দিক্ ও কাল এই দুইটি গুণের আশ্রয়। দূরস্থিত বস্তুতে পরত্ব এবং নিকটস্থ বস্তুতে অপরত্বের প্রতীতির হেতু দিক্ । বৃদ্ধের পরত্ব এবং যুবকের অপরত্ব প্রতীতির হেতু কাল।
.
বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন- এই ছয়টি হচ্ছে আত্মা বা জীবের বিশেষগুণ। সুখাদি পাঁচটি গুণ মানস প্রত্যক্ষের বিষয়। বস্তুর প্রকাশ বা প্রাকট্যের অন্যপ্রকারের উপপত্তি হয় না বলে অর্থাপত্তি-প্রমাণের বলে বুদ্ধি-নামক গুণের কল্পনা করতে হয়।
প্রভাকর ও শঙ্করাচার্য্যওে মতে বুদ্ধি স্বয়ংপ্রকাশ। নৈয়ায়িকমতে বুদ্ধি প্রত্যক্ষগম্য। কুমারিলমতে বুদ্ধি চারপ্রকার- যথার্থ, অযথার্থ, স্মরণ ও অনুবাদ।
সুখ- অনুভববেদ্য। সুখ তিনপ্রকার- ঐহিক সুখ, স্বর্গসুখ ও মোক্ষসুখ। ঐহিকসুখ দুঃখমিশ্রিত, স্রক্চন্দনাদিজন্য। স্বর্গসুখ স্থানান্তরে ভোগ্য এবং দুঃখরহিত। এই দুইপ্রকারের সুখের কারণ ধর্ম। মোক্ষসুখ হলো কৈবল্যমুক্তি।
দুঃখ- অনুভববেদ্য। দুঃখ দুইপ্রকার- ঐহিক ও পারত্রিক। রোগাদিজনিত দুঃখ ঐহিক। রৌরব মহারৌরবাদি নারকীয় দুঃখ পারত্রিক। এই উভয়প্রকার দুঃখের কারণ অধর্ম।
ইচ্ছা- একপ্রকার আশংসা। দ্বেষ- শত্রুবিষয়ক ভাববিশেষ। প্রযত্ন- শরীরাদিতে কর্মোৎপত্তির হেতুভূত গুণ।
.
গুরুত্ব- পতনের অসমবায়ী কারণ। শুধু পৃথিবী ও জলে অবস্থিত বিশেষগুণ। স্নেহ- জলে অবস্থিত বিশেষগুণ। স্নিগ্নত্বাদি জ্ঞানের বিষয় হলো স্নেহ।
দ্রবত্ব- পৃথিবী, জল ও তেজে অবস্থিত বিশেষগুণ। দ্রবত্ব দুইপ্রকার- স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক। জলস্থিত দ্রবত্ব স্বাভাবিক। জলসংযোগবশত এবং ঘৃত জতু প্রভৃতিতে অগ্নিসংযোগবশত নৈমিত্তিক দ্রবত্ব উৎপন্ন হয়। তেজঃ-পদার্থ সুবর্ণাদিতেও অগ্নিসংযোগবশত দ্রবত্বের উৎপত্তি হয়ে থাকে। অতএব পৃথিবী ও তেজের দ্রবত্ব নৈমিত্তিক।
সংস্কার- দুইপ্রকার, লৌকিক ও বৈদিক। লৌকিক সংস্কার তিনপ্রকার- বেগ, ভাবনা ও স্থিতস্থাপক। বেগ পৃথিব্যাদি পাঁচটি দ্রব্যে অবস্থিত ক্রিয়ার হেতু বিশেষগুণ। ভাবনা শুধু আত্মার বিশেষগুণ। পূর্বের অনুভব ভাবনার হেতু। ভাবনার কার্য হচ্ছে স্মৃতি। স্পর্শগুণবিশিষ্ট দ্রব্যে অবস্থিত বিশেষগুণ স্থিতস্থাপক সংস্কার। দীর্ঘকাল সোজা করে বেঁধে রাখলেও বাঁধন ছেড়ে দিলেই কুকুরের লেজ পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ পুনরায় বক্রভাব ধারণ করে। গাছের ডালকে টেনে নামালেও ছেড়ে দিলেই ডাল পূর্বস্থানে উঠে যায়। এতে বুঝতে হবে- কুকুরের লেজ এবং গাছের ডাল প্রভৃতিতে স্থিতস্থাপক সংস্কার রয়েছে। বৈদিক সংস্কার প্রোক্ষণ, অবহনন প্রভৃতি ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন। এই সংস্কার দ্রব্যে অবস্থিত বিশেষগুণ। কেউ কেউ বলেন- এই সংস্কার শক্তিরই অন্তর্গত।
ধ্বনি- বায়ুর গুণ এবং শব্দের অভিব্যঞ্জক।
.
প্রাকট্য- বিষয়ের ব্যবস্থাপক। সকল দ্রব্যে অবস্থিত সামান্যগুণ। সংযুক্ত-তাদাত্ম্য-সন্নিকর্ষের বলে প্রাকট্যের প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। প্রাকট্য দ্রব্যে অবস্থিত হলেও তাদাত্ম্য পরম্পরায় জাতি, গুণ এবং কর্মেও থাকে এবং এগুলির অভাবেও থাকে। যেহেতু এগুলিও প্রত্যক্ষের বিষয় হয়, তাই আচার্য্যরা বলেন-  
‘প্রাকট্যাশ্রয়ো বিষয়ঃ।’
অর্থাৎ- বিষয়ের লক্ষণ হচ্ছে- প্রাকট্যের আশ্রয়।
প্রভাকর বলেন, যে-জ্ঞানে যে-বস্তুটি প্রতিভাত হয়, সেই বস্তুটিই সেই জ্ঞানের বিষয়। আর কুমারিল-সম্প্রদায়ের মতে- লৌকিক ব্যবহারে বলা হয়- ‘ঘটটি প্রকাশিত’, ‘ঘটটি প্রকটিত’ ইত্যাদি। এধরনের ব্যবহার ভ্রান্তিমূলক নয়। এসব ব্যবহার থেকেই প্রকাশবিশিষ্ট বস্তুর কথা বোঝা যায়। বস্তুতে অবস্থিত এই বিশেষভূত প্রকাশপদার্থই প্রাকট্য। বস্তুর জ্ঞানই প্রাকট্য তা বলা যায় না, আত্মনিষ্ঠ জ্ঞান ঘটাদি বস্তুতে থাকতে পারে না। অতীত এবং অনাগত কালের বস্তুতেও প্রাকট্য রয়েছে।
.
শক্তি- শক্তিত্বজাতিবিশিষ্ট এবং দ্রব্য, গুণ ও কর্মে অবস্থিত গুণবিশেষ। শক্তি দুইপ্রকার- লৌকিক ও বৈদিক। লৌকিক শক্তি অর্থাপত্তি-প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। যেমন, অগ্নির দাহিকা শক্তি। বৈদিক শক্তি একমাত্র বেদগম্য। যেমন, যাগাদিতে স্বর্গাদিসাধকতা শক্তি। অগ্নি প্রভৃতির দাহকতাশক্তি প্রভৃতি দ্রব্যগত। হিংসাদির নরকপাত-সাধকতারূপ শক্তি কর্মগত।
নৈয়ায়িকরা শক্তি স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে অগ্নি এবং অগ্নির দাহকতাশক্তি অভিন্ন। প্রভাকরমতে শক্তি অন্যতম পদার্থ। শক্তি অনুমানগম্য। কিন্তু কুমারিল-সম্প্রদায় এই সিদ্ধান্তে গৌরব-দোষ প্রদর্শন করেন। আপত্তি উঠতে পারে যে, দ্রব্য ব্যতীত অপর পদার্থে শক্তিরূপ গুণ তো থাকা সম্ভবপর নয়। কুমারিল-সম্প্রদায়ের মতে ‘গুণাশ্রয়ো দ্রব্যম্’- এই লক্ষণ মানা হয় না। অতএব গুণ ও কর্মেও শক্তি অবস্থিত।
.
নৈয়ায়িকরা ধ্বনি, প্রাকট্য ও শক্তিকে গুণপদার্থ বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা ধর্ম এবং অধর্মকেও আত্মাতে অবস্থিত বিশেষ গুণ বলেছেন। বরং কুমারিলমতে ধর্ম ও অধর্ম গুণপদার্থ নয়, প্রধানত কর্মপদার্থ। ধর্ম ও অধর্ম শব্দে কেউই আত্মার বিশেষগুণকে বুঝেন না। নারায়ণ ভট্ট বলেছেন-
‘লোকপ্রয়োগগম্যা হি শব্দার্থাঃ সর্ব্ব এব নঃ।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : মানুষের প্রয়োগ দেখেই আমরা সকল শব্দার্থ জানতে পারি।
.
শ্রেয়ঃ-সাধনই ধর্ম। অর্থাৎ যা কল্যাণের হেতু তাই ধর্ম, আর যা অকল্যাণের হেতু, তাই অধর্ম। ‘অগ্নিহোত্র থেকে স্বর্গলাভ হয়’- ইত্যাদি ক্ষেত্রে শ্রুতি কোনরূপ আত্মনিষ্ঠ গুণের কথা বলেননি। অতএব ধর্মাধর্ম আত্মনিষ্ঠ গুণ হতে পারে না।
.
প্রভাকরমতে অপূর্বই ধর্ম। কুমারিল এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। লোকসমাজে দেখা যায়, যাঁরা যাগযজ্ঞাদি সৎকর্মের অনুষ্ঠান করেন, তাঁদেরকে ধার্মিক বলা হয়, আর যারা সুরাপানাদি অসৎকর্মের অনুষ্ঠান করেন, তাদেরকে অধার্মিক বলা হয়। শ্রুতিতেও দেখা যায় যে, যজ্ঞরূপ অনুষ্ঠানকেই বলা হয়েছে ধর্ম।
প্রভাকরের কথিত অপূর্ব অপর কোন পদার্থ নয়, গুণও নয়। ফলের উৎপাদক যাগাদির শক্তিমাত্রকেই অপূর্ব বলা হয়। অতএব উল্লিখিত চব্বিশটিই গুণপদার্থ। চব্বিশের কমও নয়, বেশিও নয়।
কর্ম
কর্ম হলো সংযোগ ও বিভাগের কারণ। কর্ম প্রত্যক্ষযোগ্য এবং অ-বিভূদ্রব্যে আশ্রিত। মানমেয়োদয় গ্রন্থে উক্ত হয়েছে-  
‘অবিভুদ্রব্যমাত্রস্থং প্রত্যক্ষং চলনাত্মকম্ ।
বিয়োগযোগয়োর্মূলং কর্ম্ম কর্ম্মবিদো বিদুঃ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : সর্বব্যাপী দ্রব্য ছাড়া অপর সকল দ্রব্যে অবস্থিত, চল অর্থাৎ গমনরূপ, সংযোগ ও বিয়োগের হেতুভূত হচ্ছে কর্ম। কর্ম প্রত্যক্ষগম্য। কর্মবিদগণ এভাবেই কর্মকে জানেন।
ন্যায়-বৈশেষিকের মতো মীমাংসা-মতেও কর্ম পঞ্চবিধ- উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন, প্রসারণ ও গমন।
অভাব
প্রাভাকর-মীমাংসকরা অভাবকে স্বতন্ত্র পদার্থ স্বীকার না করলেও ন্যায়মত অনুসরণ করে ভাট্ট-মীমাংসকরা অভাবকে স্বতন্ত্র পদার্থ বলেছেন। অনুপলব্ধি-প্রমাণের দ্বারা অভাবরূপ পদার্থ সিদ্ধ হয়। অভাব দ্বিবিধ- সংসর্গাভাব ও অন্যোন্যাভাব। সংসর্গাভাব আবার তিন প্রকার- প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব ও অত্যন্তাভাব। দুগ্ধে দধির অভাব হচ্ছে প্রাগভাব। যেহেতু দধি তখনও উৎপন্ন হয়নি। দধিতে দুগ্ধের অভাব প্রধ্বংসাভাব। যেহেতু দুগ্ধ তখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বায়ুতে রূপের অভাব হচ্ছে অত্যন্তাভাব। ঘটাদিতে পটত্বাদির অভাব অন্যোন্যাভাব। ভাট্টরা অভাবকে অনুপলব্ধি নামক ষষ্ঠ প্রমাণযোগ্য বলেছেন। কিন্তু প্রভাকর অভাব পদার্থ স্বীকার করেন না। বলা হয়-
‘অভাবাখ্যঃ পদার্থস্তু নাস্তীত্যাহ প্রভাকরঃ।
ঘটাদ্যভাবস্তৎপক্ষে কেবলং ভূতলং মতম্ ।।’
অর্থাৎ : প্রভাকর বলেন, অভাব নামে কোন পদার্থ নেই। তাঁদের মতে ‘ভূতলে ঘটের অভাব’ বললে কেবল ভূতলকেই বোঝা যায়।
.
প্রাভাকরমতে অভাব ভাবপদার্থেরই অন্তর্গত এবং অধিকরণস্বরূপ। ভট্ট-মতাবলম্বিরা এবং নৈয়ায়িক-সম্প্রদায় প্রভাকরের এই সিদ্ধান্তে নানা দোষ প্রদর্শন করেছেন।
প্রভাকরসম্মত শক্তি, সাদৃশ্য ও সমবায়ের পৃথক পদার্থতা ভট্টসম্প্রদায় খণ্ডন করেছেন। তাঁরা বলেন, শক্তি ও সংখ্যা গুণপদার্থেরই অন্তর্গত। গরুতে যে গবয়ের সাদৃশ্য, তাও পৃথক পদার্থ নয়। গবয়স্থিত গুণের অনেকগুলির অবয়ব গরুতেও রয়েছে বলেই গরুতে গবয়সাদৃশ্যের প্রতীতি জন্মে। সাদৃশ্যকে পৃথক একটি পদার্থ স্বীকার করলে ‘গবয়ের সাথে গরুর অধিক সাদৃশ্য আছে, শূকরের অল্প সাদৃশ্য আছে’- এসকল প্রতীতি হতে পারে না। যেহেতু প্রভাকরমতে সাদৃশ্যের অধিকত্ব বা অল্পত্ব মানা হয় না। পরিমাণের ভেদবশত অধিকত্ব ও অল্পত্বের প্রতীতি হয়, তাও বলা চলে না। কারণ দ্রব্য ব্যতীত কোথাও পরিমাণ থাকে না। অতএব সাদৃশ্য দ্রব্যাদি পদার্থেরই অন্তর্গত।
অবয়ব ও অবয়বী, গুণ ও গুণী, জাতি ও জাতিমান্, ক্রিয়া ও ক্রিয়াবানের মধ্যে তাদাত্ম্য (অভেদ) সম্বন্ধই কুমারিলসম্মত। অতএব সমবায়কেও পৃথক পদার্থরূপে স্বীকারের প্রয়োজন নেই।
[পরের পর্ব : তত্ত্ববিদ্যা- নীতি ও ধর্মতত্ত্ব]

No comments:

Post a Comment

ধন্যবাদ

বৈশিষ্ট্যযুক্ত পোস্ট

যজুর্বেদ অধ্যায় ১২

  ॥ ও৩ম্ ॥ অথ দ্বাদশাऽধ্যায়ারম্ভঃ ও৩ম্ বিশ্বা॑নি দেব সবিতর্দুরি॒তানি॒ পরা॑ সুব । য়দ্ভ॒দ্রং তন্ন॒ऽআ সু॑ব ॥ য়জুঃ৩০.৩ ॥ তত্রাদৌ বিদ্বদ্গুণানাহ ...

Post Top Ad

ধন্যবাদ