চাঁদহীন পরিষ্কার রাতের আকাশের দিকে তাকালে সবার আগে আপনার চোখে পড়তে পারে শুক্র (শুকতারা), মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ।[১] এছাড়াও থাকবে অনেক অনেক নক্ষত্র। এসব বস্তুরা বাস্তবে আমাদের সূর্যের মতো হলেও আমাদের থেকে বহু দূরে অবস্থিত। আমরা এদেরকে স্থির ধরে নিলেও পৃথিবী সূর্যের চারদিকে কক্ষপথের বিভিন্ন অবস্থানে থাকার সময় এদের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বাস্তবে কিন্তু এরা মোটেই স্থির নয়। আসলে এদের মধ্যে যারা তুলনামূলকভাবে আমাদের কাছে, তাদের নড়াচড়াই শুধু আমরা টের পাই। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে বলে আমাদের নিকটবর্তী তারকারা আরও দূরের তারকাদের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন করে২। একটি উন্মুক্ত রাস্তা দিয়ে চলার সময় দূরের দৃশ্যপটের তুলনায় কাছাকাছি থাকা গাছগুলোর আপাত অবস্থান পরিবর্তনের সাথে একে তুলনা করা যায়। যে গাছগুলো যত কাছে, তারা অবস্থান তত বেশি বদলে যাচ্ছে বলে মনে হয়। অবস্থানের এই আপাত পরিবর্তনকে বলা হয় প্যারালাক্স (চিত্র দেখুন)। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এর মাধ্যমে (প্যারালাক্স) এই নক্ষত্রদের দূরত্ব সরাসরি বের করতে পারি।
[রাস্তা দিয়ে চলুন, অথবা মহাশূন্যে- আপনার চলার সাথে সাথে কাছের এবং দূরের বস্তুর আপেক্ষিক অবস্থান বদলে যায়। এই পরিবর্তন কাজে লাগিয়ে বস্তুর আপেক্ষিক দূরত্ব বের করা যায়।]
প্রথম অধ্যায়েই আমরা বলেছি, (সূর্যের পরে) আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টোরি প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটি ২৩ লক্ষ কোটি মাইলের সমান। আমরা খালি চোখে যেসব তারা দেখি তাদের অধিকাংশই আমাদের কয়েকশ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত। সে তুলনায় আমাদের সূর্য মাত্র ৮ আলোকমিনিট দূরে (আলো আট মিনিটে যত দূর যায়) আছে। দৃশ্যমান তারকাদেরকে পুরো আকাশে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও একটি বলয়ের মত অংশে এদের সংখ্যা খুব বেশি। এর নাম মিল্কিওয়ে। ১৭৫০ সালের দিক থেকেই কিছু জ্যোতির্বিদ বলছিলেন যে মিল্কিওয়েকে এরকম দেখা যাওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, দৃশ্যমান তারাদের অধিকাংশ একটি চাকতির মত বিন্যাসের মধ্যে অবস্থান করছে। এটি হচ্ছে বর্তমান সর্পিল ছায়াপথের (spiral galaxy) একটি উদাহরণ।
কয়েক দশক পরে জ্যোতির্বিদ স্যার উইলিয়াম হার্শেল এই ধারণা নিশ্চিত করেন। এ কাজ করতে তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম করে বহু নক্ষত্রের অবস্থান ও দূরত্বের তালিকা তৈরি করতে হয়েছিল। তবু এই ধারণা পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পেল মাত্র বিংশ শতকের শুরুর দিকে। বর্তমানে আমরা জানি, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের ব্যাস প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ। এটি ধীরে ধীরে আবর্তনও করছে। এর সর্পিল বাহুতে থাকা নক্ষত্রগুলো কয়েকশ মিলিয়ন বছরে একবার এর কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরে আসে। আমাদের সূর্য একেবারেই সাধারণ মানের একটি নক্ষত্র। মাঝারি আকারের হলুদ এই নক্ষত্রটি ছায়াপথের একটি সর্পিল বাহুর ভেতরের দিকের প্রান্তে অবস্থিত। এটা নিশ্চিত যে এরিস্টটল ও টলেমির সময় থেকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরাতো তখন পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসিয়ে রেখেছিলাম!
মহাবিশ্বের আধুনিক ধারণার সূচনা ঘটে মাত্র ১৯২৪ সালে, আমেরিকান জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবলের হাত ধরে। তিনি দেখালেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র ছায়াপথ (গ্যালাক্সি) নয়। তিনি (টেলিস্কোপের মাধ্যমে) আরও অনেকগুলো ছায়াপথ খুঁজে পেলেন, যাদের মাঝে আছে বিশাল ফাঁকা স্থান। এসব ছায়াপথের উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্যে পৃথিবী থেকে এদের দূরত্ব বের করা প্রয়োজন। সমস্যা হল এরা এত দূরে দূরে অবস্থিত যে আমাদের নিকটস্থ তারকাদের মতো এদের কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ে না, দেখতে একেবারেই স্থির মনে হয়। তাই এদের দূরত্ব মাপতে প্যারালাক্স কোন কাজে আসল না। ফলে এদের দূরত্ব মাপতে তাঁকে আশ্রয় নিতে হল পরোক্ষ উপায়ের ওপর। নক্ষত্রের দূরত্ব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট তথ্য হল এর উজ্জ্বলতা। কিন্তু নক্ষত্রের আপাত উজ্জ্বলতা (আমরা একে যত উজ্জ্বল দেখি) শুধু এর দূরত্বের উপরই নির্ভর করে না, এটি কতটুকু আলো বিকিরণ করছে (দীপ্তি) তার উপরও নির্ভর করে। নিকটে অবস্থিত একটি অনুজ্জ্বল তারাও দূরের যে- কোনো ছায়াপথের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের চেয়ে উজ্জ্বল দেখাবে। তাই আপাত উজ্জ্বলতা থেকে দূরত্ব বের করতে হলে নক্ষত্রের দীপ্তিও জানা চাই।
নিকটস্থ তারকাদের ক্ষেত্রে প্যারালাক্স কাজে লাগিয়ে দূরত্ব বের করে ফেলা যায় বলে আপাত উজ্জ্বলতা থেকেই এদের দীপ্তি বের করা যায়।
হাবল দেখলেন, নিঃসৃত আলোর ধরনের উপর ভিত্তি করে নিকটস্থ নক্ষত্রদেরকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা সম্ভব। একই প্রকারের নক্ষত্রগুলোর দীপ্তি সব সময় একই রকম থাকে। এরপর তিনি যুক্তি দেখালেন যে যদি আমরা দূরের গ্যালাক্সিতেও নিকটস্থ নক্ষত্রদের মতো একই ধরনের নক্ষত্র খুঁজে পাই তবে আমরা ধরে নিতে পারি তাদের দীপ্তিও একই হবে। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে আমরা সেই গ্যালাক্সির দূরত্বও বের করতে পারি। এভাবে একই গ্যালাক্সির অনেকগুলো নক্ষত্রের দূরত্ব বের করে যদি আমরা সব সময় একই দূরত্ব পাই, তবে ভরসা রাখতে পারি যে হিসাব ঠিক আছে। এই উপায় অবম্বন করে হাবল নয়টি আলাদা গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করতে সক্ষম হন।
এখন আমরা জানি খালি চোখে আমরা যে নক্ষত্রগুলো দেখি তা সব নক্ষত্রের একটি সামান্য অংশ। আমরা প্রায় পাঁচ হাজার নক্ষত্র খালি চোখে দেখি। এটা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরই প্রায় ০.০০০১ শতাংশ মাত্র। আধুনিক টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা দশ হাজার কোটির বেশি গ্যালাক্সি দেখতে পাই। প্রত্যেকটি গ্যালাক্সিতে আবার গড়ে প্রায় দশ হাজার কোটি তারকা আছে। একটি তারকাকে যদি একটি লবণের কণা মনে করা যায় তাহলে খালি চোখে দৃশ্যমান সব তারকাকে একটি চায়ের কাপে রেখে দেওয়া যাবে, যেখানে মহাবিশ্বের সব তারকাকে রাখতে হলে ১০ মাইলের চেয়ে বড়ো ব্যাসের একটি গোলক লাগবে।
তারকারা বহু দূরে থাকার কারণে এদেরকে আলোক বিন্দুর মতো দেখায়। আমরা খালি চোখে এদের আকার- আকৃতি বুঝতে পারি না। কিন্তু হাবল দেখলেন, তারকাদের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন টাইপ। আলো দেখেই আমরা এদের পার্থক্য ধরতে পারি। নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন যে সূর্যের আলো ত্রিভুজাকৃতির এক খণ্ড প্রিজমের মধ্যে দিয়ে পার হলে রঙের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে, রংধনুতে যেমন দেখা যায় সেভাবে। একটি নির্দিষ্ট আলোক উৎস থেকে আসা বিভিন্ন রঙের আপেক্ষিক তীব্রতাকে বলে বর্ণালী (Spectrum)। একটি নির্দিষ্ট তারকা বা গ্যালক্সির দিকে টেলিস্কোপ তাক করে রেখে সেই তারকা বা গ্যালাক্সির আলোর বর্ণালী দেখা সম্ভব।
এই আলো দেখে আমরা এর তাপমাত্রাও জানতে পারি। ১৮৬০ সালে জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ কার্শফ উপলদ্ধি করেন যে যেমনিভাবে উত্তপ্ত হলে কয়লা জ্বলে ওঠে তেমনি যে-কোনো বস্তু, এমনকি তারকারাও উত্তপ্ত অবস্থায় আলো বা অন্যান্য বিকিরণ নির্গত করবে । বস্তুর এই জ্বলে ওঠার কারণ হচ্ছে এর অভ্যন্তরে থাকা পরমাণুর তাপীয় গতি। এই ঘটনার নাম ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ (যদিও আলো বিকিরণকারী বস্তুরা দেখতে কালো নয়)। কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের বর্ণালী থেকে পাওয়া তথ্যে ভুল হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাপমাত্রা বদলাবার সাথে সাথে এর ধরন বদলাতে থাকে। ফলে উজ্জ্বল বস্তু থেকে আসা আলো থার্মোমিটারের মতো কাজ করে। আমরা বিভিন্ন তারকার যে বর্ণালী দেখি তার ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। এই বর্ণালী তারকাটির তাপীয় অবস্থার সব নাড়ি- নক্ষত্র উন্মুক্ত করে দেয়।
[একটি নক্ষত্রের আলোর বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে এর তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলের উপাদান বের করা যায়।]
ভালো করে দেখলে নক্ষত্রের আলো আমাদেরকে আসলে আরও তথ্য দেয়। আমরা দেখি যে নির্দিষ্ট কিছু রঙ এখানে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিত রঙগুলো কী হবে সেটা আবার বিভিন্ন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে ভিন্ন। যেহেতু আমরা জানি যে প্রতিটি রাসায়নিক মৌল স্বতন্ত্র ধরনের এক গুচ্ছ রঙ শোষণ করে, তাই তারকার বর্ণালীতে অনুপস্থিত রঙের সাথে তুলনা করে আমরা বলে দিতে পারি ঐ তারকার বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান আছে।
[শুধু তারকারাই নয়, সকল বস্তুই এর আণুবীক্ষণিক উপাদানগুলোর তাপীয় গতির কারণে বিকিরণ নিঃসরণ করে। বিকিরণের কম্পাঙ্কের বিন্যাস থেকে বস্তুর তাপমাত্র বলা সম্ভব।]
১৯২০ এর দশকে জ্যোতির্বিদরা অন্যান্য গ্যালাক্সির নক্ষত্রদের বর্ণালী দেখা শুরু করে অবাক হয়ে গেলেন। আমাদের গ্যালাক্সির মতোই এখানেও অনুপস্থিত রঙের প্যাটার্ন একই রকম, তবে এরা একই আপেক্ষিক হারে বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে সরে যাচ্ছে।
পদার্থবিদরা রঙ বা কম্পাঙ্কের এই সরে যাওয়াকে ডল্পলার ইফেক্ট বলেন। শব্দের ক্ষেত্রে এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আপনি যদি রাস্তায় চলা একটি গাড়ির দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে এটি যখন কাছে আসে তখন এর ইঞ্জিন বা হর্নের শব্দ তীক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে, আবার এটি যখন আপনাকে ক্রস করে দূরে সরে যায় তখন এর শব্দের তীক্ষ্ণতা কমে যায়। ইঞ্জিন বা হর্নের শব্দ একটি তরঙ্গ, যেখানে ক্রমান্বয়ে তরঙ্গের চূড়া ও খাঁজ সৃষ্টি হয়। একটি গাড়ি যখন আমাদের কাছে আসে, এর প্রত্যেকটি পরবর্তী চূড়া নির্গত করার সময় এটি আগের চেয়ে আমাদের বেশি কাছে থাকে। পরপর দুটি তরঙ্গচূড়ার মধ্যবর্তী দূরত্বকে বলা তরঙ্গদৈর্ঘ্য। তাহলে স্থির থাকলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যেমন হত, গাড়ি কাছে আসার সময় তা তার চেয়ে ছোট হবে। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হবে, চূড়া ও খাঁজ তত বেশি সৃষ্টি হবে, যার ফলে আমাদের কানে শব্দের তীক্ষ্ণতা বা কম্পাঙ্ক জোরালো হবে। উল্টো দিকে, গাড়ি আমাদের থেকে দূরে সরে গেলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হয়ে যাবে বিধায় আমাদের কানে এর কম্পাঙ্ক ছোট হবে। গাড়ি যত দ্রুত চলবে, এই প্রভাবও তত বাড়বে। কাজেই, ডপলার ইফেক্টের সাহায্যে আমরা গতি মাপতে পারি। আলো বা বেতার তরঙ্গও একই আচরণ করে। সত্যি বলতে, পুলিশও ডপলার ইফেক্টের সাহায্যে গাড়ির গতিবেগ মাপে। এক্ষেত্রে তারা কাজে লাগায় প্রতিফলিত বেতার তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য।
চতুর্থ অধ্যায়েই আমরা বলেছি, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুবই ক্ষুদ্র। এর পাল্লা হল এক সেন্টিমিটারের চল্লিশ ভাগ থেকে শুরু করে থেকে আট কোটি ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত। আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যই আমাদের চোখে আলাদা আলাদা রং হিসেবে ধরা পড়ে। সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো থাকে লাল প্রান্তের দিকে এবং ছোটগুলো নীল প্রান্তের দিকে। এবার আমাদের থেকে নির্দিষ্ট দূরের একটি আলোক উৎস, যেমন একটি নক্ষত্রের কথা চিন্তা করুন, যা থেকে শুধু একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যেরই আলো আসছে। এটি নিজে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্গত করবে আমরাও ঠিক সেটাই দেখতে পাব। এবার মনে করুন আলোর উৎসটি দূরে সরতে লাগল। শব্দের মতোই এ ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়ো হয়ে যাবে এবং এর বর্ণালী লাল দিকে সরে যাবে।
মিল্কিওয়ের বাইরে আরও গ্যালাক্সির উপস্থিতি প্রমাণ করার পরের বছরগুলোতে হাবল এদের বর্ণালী দেখে দেখে দূরত্ব বের করার কাজে লেগে গেলেন। সেই সময় বেশির ভাগ মানুষ মনে করত গ্যালাক্সিরা এলোমেলোভাবে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করবে। সেজন্যে হাবলও আশা করেছিলেন, তিনি গ্যালাক্সিদের লাল সরণ (তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল দিকে সরে যাওয়া) যত দেখবেন নীল সরণও সেই পরিমাণ দেখবেন। কাজেই বেশির ভাগ গ্যালাক্সির বর্ণালীর সরণ লালের দিকে দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। এদের প্রায় সবাই আমাদের থেকে দূরে সরছে! ১৯২৯ সালে হাবল এর চেয়েও অবাক করা তথ্য প্রকাশ করেন। গ্যালাক্সিদের লাল সরণও এলোমেলোভাবে হচ্ছে না, বরং এটা আমাদের থেকে তাদের দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক। এর অর্থ হচ্ছে, একটি গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত, সেটি তত দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ আগের ধারণা ভুল, মহাবিশ্বের আকার স্থির বা অপরিবর্তনশীল নয়। এটি আসলে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ছে।
[একটি তরঙ্গ উৎস দর্শকের দিকে এগিয়ে গেলে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায়, আর দর্শক থেকে দূরে সরলে হয়ে যায় বড়ো। এটিই ডপলার প্রভাব।]
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আবিষ্কার বিংশ শতকের বিরাট এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব। অতীতে ফিরে তাকালে একটু অবাকই হতে হয়, আগে কেউ কেন এভাবে চিন্তা করেনি। নিউটনসহ অন্যদের বোঝা উচিত ছিল একটি স্থির মহাবিশ্ব হবে অস্থিতিশীল। কারণ সবগুলো নক্ষত্র ও ছায়াপথ মিলিতভাবে একে অপরের উপর যে মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করবে তাকে ঠেকানোরতো কেউ নেই। কাজেই, কোনো এক সময় যদি মহাবিশ্ব স্থির থেকেও থাকে, তবু এর পক্ষে স্থির হয়ে বসে থাকা অসম্ভব ছিল। কারণ সবগুলো নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে মহাবিশ্ব পরক্ষণেই সঙ্কুচিত হতে শুরু করত।
এমনকি মহাবিশ্ব যদি মোটামুটি ধীর গতিতেও প্রসারিত হত, তবু মহাকর্ষের প্রভাবে এক সময় এর প্রসারণ থেমে যেত এবং অবশেষে শুরু হত সঙ্কোচন। কিন্তু যদি মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট হারের চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয়, তাহলে মহাকর্ষ কখনোই একই প্রসারণ থামানোর মত শক্তিশালী হতে পারবে না। এর ফলে এটি চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে রকেট নিক্ষেপ করলে যা ঘটে তার সাথে এর কিছুটা মিল আছে। রকেটের গতি যদি একটু কম হয় অভিকর্ষ একে থামিয়ে দেবে এবং এটি নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু রকেটের গতি যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় (সেকেন্ডে প্রায় সাত মাইল), তাহলে একে থামানোর শক্তি মহাকর্ষের হবে না। এর ফলে এটি পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে।
ঊনিশ, আঠারো বা এমনকি সতেরো শতকের শেষের দিকেই নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে মহাবিশ্বের এই আচরণ অনুমান করা যেত। কিন্তু স্থির মহাবিশ্বের ধারণা সবার মনে এতটা বদ্ধমূল হয়ে আসন গেঁড়েছিল যে এই ধারণা টিকে থাকল বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত। এমনকি আইনস্টাইনেরও স্থির মহাবিশ্বের উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল। ১৯১৫ সালে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করার সময় নিজের তত্ত্বকে সেই বিশ্বাসের সাথে মিলানোর জন্যে তিনি কিছুটা গোঁজামিলের আশ্রয় নেন। তিনি তাঁর সমীকরণে মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological constant) নামে একটি রাশি আমদানী করেন। নতুন এই মহাজাগতিক ধ্রুবকের প্রতিক্রিয়া ছিল মহাকর্ষের বিপরীত। অন্যান্য বলের মতো এই বলের জন্যে কোনো উৎসের প্রয়োজন নেই, বরং এটি স্থান- কালেরই পরতে পরতে মিশে আছে। নতুন এই বলের প্রভাবে স্থান- কাল নিজে থেকেই প্রসারিত হবার প্রবণতা লাভ করে। মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করে আইনস্টাইন এই প্রবণতার শক্তিকে ভারসাম্যে নিয়ে আসেন। তিনি দেখলেন যে তাঁর পক্ষে মহাবিশ্বের সকল পদার্থের পারস্পরিক আকর্ষণকে ব্যালেন্স করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে পাওয়া গেল স্থির মহাবিশ্ব। কিন্তু পরে তিনি মহাজাগতি ধ্রুবকটি প্রত্যাহার করেন এবং একে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে অভিহিত করেন। একটু পরই আমরা দেখবো, আসলে এটি যোগ করে তিনি সম্ভবত ঠিক কাজটিই করেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন হতাশ হয়েছিলেন এ জন্যে যে তিনি তাঁর বিশ্বাস ধরে রাখতে গিয়ে তাঁর তত্ত্বের (যা বলছিল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে) ইঙ্গিতটিও এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন ব্যক্তি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ইঙ্গিতকে ঠিকই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। যখন আইনস্টাইন ও অন্যরা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের গতিশীল মহাবিশ্বের ইঙ্গিত এড়ানোর উপায় খুঁজছিলেন, সেই সময়েই রুশ গণিত ও পদার্থবিদ অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান সেই গতিশীলতার ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে নেমে পড়লেন।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে ফ্রিডম্যান খুব সরল দুটো অনুমান প্রস্তাব করলেন। এক, আমরা যে দিকেই তাকাব, মহাবিশ্বকে একই রকম দেখব এবং দুই, যদি আমরা মহাবিশ্বকে অন্য কোথাও থেকেও দেখি তবুও এই কথা সত্য হবে। এই দুটি ভাবনা মাথায় রেখে ফ্রিডম্যান সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধান বের করলেন এবং দেখালেন, মহাবিশ্বকে স্থির মনে করা অনুচিত। প্রকৃতপক্ষে, হাবলের আবিষ্কারের কয়েক বছর আগেই ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান তাই অনুমান করলেন, যা পরে হাবল পর্যবেক্ষণ করলেন।
মহাবিশ্ব সব দিকে একই রকম দেখায়- এই অনুমান বাস্তবে পুরোপুরি সঠিক নয়। যেমন আমরা বলেছি, রাতের আকাশে কিছু তারা একটি স্বতন্ত্র বলয় গঠন করে, যাকে আমরা মিল্কিওয়ে বলি। কিন্তু যদি আমরা দূরের গ্যালাক্সির দিকে তাকাই তবে আমরা দেখবো যে সব দিকেই তারার সংখ্যা প্রায় সমান। মহাবিশ্বে আসলেই সব দিকে প্রায় একই রকম দেখায়। শর্ত হল চিন্তা করতে হবে গ্যালাক্সিদের মত বড় দূরত্বের মাপকাঠিতে এবং ছোট দূরত্বের পার্থক্যে ছাড় দিতে হবে। মনে করুন আপনি একটি জঙ্গলের মধ্যে আছেন, যেখানে বিভিন্ন গাছপালা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এক দিকে তাকিয়ে আপনি হয়ত দেখবেন, সবচেয়ে কাছের গাছটি আছে এক মিটার দূরে। আরেক দিকে তাকালে সবচেয়ে কাছের গাছটিকে হয়ত তিন মিটার দূরে পাওয়া যাবে। অন্য আরেক দিকে হয়ত দুই মিটারের মধ্যে অনেকগুলো গাছ পাওয়া যাবে। জঙ্গলটিকে সব দিকে একই রকম মনে হচ্ছে না। কিন্তু আপনি যদি এক মাইলের মধ্যের সব গাছ নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে এই পার্থক্যগুলো আর থাকবে না। দেখা যাবে যে আপনি যেদিকেই তাকান, জঙ্গলের চেহারা একই রকম।
[বনের গাছগুলো সুষম হারে বিন্যস্ত থাকলেও নিকটস্থ গাছগুলোকে দেখে তা বোঝা যায় না। একইভাবে আমাদের আশেপাশে তাকালে মহাবিশ্বকে সুষম (সব দিকে একই রকম) মনে হয় না। কিন্তু বড় দৈর্ঘ্যের স্কেলে চিন্তা করলে আমরা যেদিকেই তাকাই একই রকম দেখি।]
সত্যিকারের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ফ্রিডম্যানের অনুমানটি একটি মোটামুটি ধারণা প্রদান করে। এর প্রমাণ হিসেবে তারকাদের সুষম বিন্যাসের ব্যাপারটি অনেক দিন ধরে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আরো পরে ঘটা একটি ইতিবাচক দূর্ঘটনা ফ্রিডম্যানের অনুমানের নতুন একটি দিকে উন্মোচিত করে। এতে দেখা যাচ্ছে, ফ্রিডম্যানের অনুমান মহাবিশ্ব সম্পর্কে খুব নিখুঁত চিত্র তুলে ধরছে। ১৯৬৫ সালে দুইজন আমেরিকান পদার্থবিদ আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নিউ জার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবে কাজ করছিলেন। টেস্ট করছিলেন খুবই সংবেদী একটি মাইক্রোওয়েভ ডিটেকটর। মাইক্রোওয়েভ হল আলোর মতোই এক ধরনের তরঙ্গ, তবে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় এক সেন্টিমিটার। ডিটেকটরে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি নয়েজ পাওয়া যাচ্ছে দেখে পেনজিয়াস ও উইলসন চিন্তিত হলেন। ডিটেকটরে পাখির মল খুঁজে পাওয়া গেল। ঝামেলা হওয়ার মতো অন্যান্য কারণগুলোও খতিয়ে দেখা হল। কিন্তু এগুলোর কোনোটা করেই উলেখযোগ্য কোনো ফল আসল না। অদ্ভুত এই নয়েজটি দিনে-রাতে সমানে পাওয়া যাচ্ছে। আবার এটি বছরের যে-কোনো সময়ই পাওয়া যাচ্ছে, অথচ পৃথিবীর আবর্তন ও সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণনের কারণে একেক সময় ডিটেকটরের মুখ একেক দিকে তাক করা ছিল। কাজেই তাঁরা বুঝলেন, এই নয়েজ সৌরজগৎ শুধু নয়, গ্যালাক্সিরও বাইরে থেকে আসছে। এটি মহাকাশের সব দিক থেকে সমানভাবে আসছে বলে মনে হল। এখন আমরা জানি, আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন, এই নয়েজের খুব বেশি তারতম্য কখনোই হয় না। ফলে নিজেদের অজান্তেই পেনজিয়াস ও উইলসন ফ্রিডম্যানের প্রথম অনুমানের একটি দারুণ উদাহরণ হাতে পেয়ে গেলেন। অর্থ্যাৎ, মহাবিশ্ব সব দিকে একই রকম।
এই মহাজাগতিক নয়েজের উৎস কী তাহলে? পেনজিয়াস ও উইলসন যখন তাদের ডিটেকটরের নয়েজ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন তার প্রায় একই সময়ে কাছাকাছি এলাকায় আরও দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ মাইক্রোওয়েভ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এরা হলেন প্রিনস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বব ডিক ও জিম পিবলস। তাঁরা জর্জ গ্যামোর (যিনি এক সময় অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যানের ছাত্র ছিলেন) একটি প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন। প্রস্তাবনাটি ছিল যে আদি মহাবিশ্ব নিশ্চয় খুব বেশি উত্তপ্ত ও ঘন ছিল, যা উত্তপ্ত অবস্থায় সাদা আলোতে জ্বলজ্বল করছিল। ডিক ও পিবলস বললেন, আদি মহাবিশ্বের এই বিকিরণ আমাদের আজও দেখার কথা। কারণ এর খুব দূরের অংশ থেকে আসা আলো আমাদের কাছে এইমাত্র এসে পৌঁছাবে। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে এতে মারাত্মকভাবে লাল সরণ ঘটবে। এর ফলে এটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান আলোর বদলে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ হিসেবে আসবে। ডিক ও পিবলস এই বিকিরণ খোঁজ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এটা জানতে পেরে পেনজিয়াস ও উইলসন বুঝলেন তারা এটাই পেয়ে গেছেন। এই অবদানের জন্যে ১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরস্কার পান (বিষয়টি ডিক ও পিবলসের জন্যে অবশ্যই একটু কষ্টকর, গ্যামোর কথা আর নাইবা বললাম।
আমরা যেদিকেই দেখি তার সব দিকে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখা যায়- এই কথা থেকে প্রথমে মনে হতে পারে আমরা মহাবিশ্বের বিশেষ কোনো জায়গায় আছি। বিশেষ করে মনে হতে পারে যে আমরা যদি সব গ্যালাক্সিকে আমাদের থেকে দূরে সরতে দেখি তার অর্থ হচ্ছে আমরা নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছি। কিন্তু ব্যাখ্যা আছে আরেকটিও। অন্য যে-কোনো গ্যালাক্সি থেকে দেখলেও সব দিকে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। আমরা আগেই বলেছি, এটাই ছিল ফ্রিডম্যানের দ্বিতীয় অনুমান।
দ্বিতীয় অনুমানের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কয়েকশ বছর আগে এ ধরনের অনুমান গির্জা মেনে নিত না। গির্জার নীতিমালা ছিল যে আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্রের একটি বিশেষ জায়গায় আছি। কিন্তু বর্তমানে প্রায় উল্টো কারণে আমরা ফ্রিডম্যানের অনুমানে বিশ্বাসী। একটু উদার মনোভাব দেখানো-এই আর কি! অর্থ্যাৎ, যদি মহাবিশ্বকে আমাদের চারদিকে একই রকম মনে হত, কিন্তু অন্য কোনো স্থান থেকে একেক দিকে একেক রকম লাগত, তবে তা বড় একটি ব্যাপার হত।
ফ্রিডম্যানের মডেল অনুসারে গ্যালাক্সিরা সরাসরি একে অপরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। একটি বেলুনে কিছু দাগ দিয়ে ধীরে ধীরে ফোলানোর সাথে একে তুলনা করা যায়। বেলুন বড়ো হতে থাকলে যে কোনো দুটি দাগের দূরত্ব বেড়ে যায়। কিন্তু প্রসারণের কেন্দ্র বলা যাবে এমন কোন বিন্দু নেই। উপরন্তু, বেলুনের ব্যাসার্ধ বাড়ছে বলে বেলুনের যে দাগগুলো যত দূরে আছে সেগুলো তত দ্রুত সরতে থাকবে। যেমন ধরুন প্রতি সেকেন্ডে বেলুনের ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হচ্ছে। আগে যে দুটি দাগ এক সেন্টিমিটার দূরে ছিল এখন তারা থাকবে দুই সেন্টিমিটার দূরে (বেলুনের পৃষ্ঠের উপর দূরত্ব মাপলে)। তাহলে এদের আপেক্ষিক বেগ হবে সেকেন্ডে এক সেন্টিমিটার। কিন্তু ধরুন, অপর দুইটি দাগ আছে দশ সেন্টিমিটার দূরে। তাহলে এখন তারা থাকবে বিশ সেন্টিমিটার দূরে। সুতরাং, তাদের আপেক্ষিক বেগ হবে সেকেন্ডে দশ সেন্টিমিটার। একইভাবে ফ্রিডম্যানের মডেল অনুসারে, যে কোনো দুটি গ্যালাক্সির দূরে সরার গতি তাদের দূরত্বের সমানুপাতিক। তাই তিনি অনুমান করলেন, কোনো গ্যালাক্সির লাল সরণ আমাদের থেকে এর দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক হবে। হাবলও তাই পেলেন। এই মডেলের সাফল্য এবং হাবলের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর পরেও পাশ্চাত্য বিশ্বে এই মডেল দীর্ঘ দিন ধরে অজানা থেকে যায়। শেষে ১৯৩৫ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ হাওয়ার্ড রবার্টসন ও ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার ওয়াকার একই রকম মডেল আবিষ্কার করেন। মহাবিশ্বের সুষম প্রসারণ সম্পর্কে হাবলের আবিষ্কারই ছিল তাঁদের আবিষ্কারের ভিত্তি।
[মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে সবগুলো গ্যালাক্সি একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সময় যেতে যেতে ফুলে ওঠা বেলুনের মত বেশি দূরত্বে থাকা গ্যালাক্সিরা কাছের গ্যালাক্সির চেয়ে দ্রুত সরে যায়। কাজেই, যে কোনো গ্যালাক্সির একজন দর্শক দেখবেন, একটি গ্যালাক্সি যত দূরে আছে তা তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।]
ফ্রিডম্যান মহাবিশ্ব সম্পর্কে কেবল একটিমাত্র মডেল তৈরি করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর অনুমান সঠিক হলে আইনস্টাইনের সমীকরণ অনুসারে সম্ভাব্য সমাধান পাওয়া যায় তিনটি। অর্থ্যাৎ, ফ্রিডম্যানের মডেলেরই তিনটি আলাদা দিক আছে। মহাবিশ্বের থাকতে পারে তিনটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য।
প্রথম সমাধানে (যা ফ্রিডম্যান নিজে বের করেন) মহাবিশ্ব যথেষ্ট ধীরে প্রসারিত হচ্ছে, যার ফলে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে প্রসারণের গতি এক সময় কমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত থেমে যাবে। এরপর গ্যালাক্সিরা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসবে, সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে মহাবিশ্ব। দ্বিতীয় সমাধানে মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে যে মহাকর্ষীয় টান কখনোই একে থামাতে পারবে না, গতি একটু কমবে যদিও। আরেকটি সমাধান বলছে মহাবিশ্ব এমন একটি যথেষ্ট দ্রুত গতিতে প্রসারিত হচ্ছে যাতে সঙ্কোচন শুরুই না হতে পারে। গ্যালাক্সিরা যে গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে তা কমে যাচ্ছে, কিন্তু কখনোই তা শূন্য হবে না।
প্রথম ধরনের ফ্রিডম্যান মডেলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এটি অনুসারে মহাবিশ্ব অসীম নয়। কিন্তু আবার এর কোনো সীমানাও নেই। মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে স্থান গোলাকার হয়ে নিজের উপরই বেঁকে আছে। একে পৃথিবীর পৃষ্ঠের সাথে তুলনা করা যায়। এটি অসীম নয় ঠিকই, কিন্তু এর কোনো সীমানাও নেই। আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো দিকে যেতে থাকেন, আপনি কখনোই অভেদ্য কোনো বাধার মুখে পড়বেন না, বা প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকবে না। শেষমেশ পৌঁছে যাবেন সেখানেই, যেখান থেকে শুরু করেছিলেন।
প্রথম মডেল অনুসারে স্থানের চরিত্র এমনই। অবশ্য পৃথিবীর পৃষ্ঠের দুই মাত্রার বিপরীতে এখানে মাত্রা আছে তিনটি। মহাবিশ্বকে পুরো একবার ঘুরে এসে আগের জায়গায় পৌঁছার বিষয়টি সায়েন্স ফিকশনে ভালো মানায়, বাস্তবে এর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, দেখানো যায় যে আপনি পুরোটা ঘুরে ফিরে আসার আগেই মহাবিশ্ব গুটিয়ে গিয়ে জিরো সাইজ হয়ে যাবে। এর সাইজ এত বড় যে পুরোটা ঘুরে আসতে হলে আপনাকে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলতে হবে। কিন্তু তা অসম্ভব, যার ফলে আপনি ফিরে আসার আগেই মহাবিশ্ব শেষ হয়ে যাবে। ফ্রিডম্যান মডেলের দ্বিতীয় অংশেও বক্র স্থানের কথা আছে। এর চিত্র অবশ্য ভিন্ন। ফ্রিডম্যান মডেলের তৃতীয় অংশটিতেই কেবল বড়ো মাপের দৈর্ঘ্যে মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল (যদিও বড় ভরের বস্তুদের আশেপাশে স্থান বক্রই থাকবে)।
ফ্রিডম্যানের কোন মডেলটি সঠিক? এক সময় কি মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হবে, নাকি চিরকাল এর প্রসারণ চলতেই থাকবে?
প্রশ্নটার উত্তর যে এতটা জটিল তা আগে বিজ্ঞানীরা আগে বুঝতে পারেননি। এই প্রশ্নের মৌলিক উত্তর নির্ভর করে দুটি জিনিসের উপর- মহাবিশ্বের প্রসারণের বর্তমান হার এবং বর্তমান গড় ঘনত্ব (একটি নির্দিষ্ট আয়তনে যে পরিমাণ পদার্থ উপস্থিত)। বর্তমানে প্রসারণের হার যত বেশি হবে, তাকে থামাতে তত শক্তিশালী মহাকর্ষের প্রয়োজন হবে। এর জন্যে গড় ঘনত্বের মানও হতে হবে বেশি। যদি ঘড় ঘনত্ব একটি নির্দিষ্ট সঙ্কট মানের (যা নির্ভর করে প্রসারণের হারের উপর) বেশি হয়, তাহলে মহাকর্ষীয় টানের প্রভাবে প্রসারণ থেমে গিয়ে পতন শুরু হবে। এটাই হল ফ্রিডম্যানের প্রথম মডেল। যদি গড় ঘনত্ব সঙ্কট মানের চেয়ে কম হয়, তাহলে প্রসারণ থামানোর মতো যথেষ্ট মহাকর্ষীয় টান থাকবে না। কাজেই, মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। এটা হল ফ্রিডম্যানের দ্বিতীয় মডেল। আর গড় ঘনত্ব যদি সঙ্কট মানের ঠিক সমান হয় তবে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার চিরকাল ধরে কমতে থাকবে। এটি দ্রুত একটি নির্দিষ্ট সাইজের কাছাকাছি হতে থাকবে, কিন্তু কোনো দিনই সেই সাইজ পর্যন্ত পৌঁছবে না। এটা হল ফ্রিডম্যানের তৃতীয় মডেল।
এর মধ্যে কোনটি ঘটবে? ডপলার প্রভাবের সাহায্যে আমরা অন্যান্য গ্যালক্সিদের আমাদের থেকে দূরে সরার বেগ মাপতে পারি। এর মাধ্যমে প্রসারণের বর্তমান হার জানা যাবে। খুব নির্ভুলভাবে এর মান বের করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল, গ্যালাক্সিদের দূরত্বের খুব বেশি সঠিক হিসাব জানা নেই। এদের দূরত্ব আমরা সরাসরি মাপতে পারি না। আমরা শুধু জানি যে প্রতি বিলিয়ন বছরে মহাবিশ্ব ৫ থেকে ১০ শতাংশ প্রসারিত হয়। অন্য দিকে মহাবিশ্বের বর্তমান গড় ঘনত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরও অস্পষ্ট। কিন্তু আমরা আমাদের ও অন্যান্য গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ তারকা দেখি তাদের মোট ভর মহাবিশ্বের প্রসারণ থামানোর জন্যে যথেষ্ট নয়, প্রসারণের হারকে যতটা সম্ভব ছোট ধরে নিলেও। ভর উপস্থিত আছে প্রয়োজনীয় ভরের একশ ভাগের মাত্র এক ভাগ।
কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়। আমাদের গ্যালাক্সিসহ অন্যান্য গ্যালাক্সিতে বিপুল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটারও আছে। এদেরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রদের কক্ষপথের উপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাবের কারণে এর উপস্থিতি আঁচ করা যায়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সম্ভবত আমাদের মিল্কিওয়ের মতো সর্পিল গ্যালাক্সিগুলোর বাইরের দিকে অবস্থিত নক্ষত্রগুলোর বেগ। এ নক্ষত্রগুলো যে তীব্র গতিতে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তাতে গ্যালাক্সির নক্ষত্রদের মোট মহাকর্ষীয় টান এদেরকে কক্ষপথে ধরে রাখতে পারার কথা নয়৩।
উপরন্তু বেশির ভাগ গ্যালাক্সিকে গুচ্ছ গুচ্ছ (Cluster) আকারে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাই একইভাবে গ্যালাক্সিদের গতির প্রকৃতি দেখে আমরা এদের মাঝখানে আরও বেশি ডার্ক ম্যাটার আছে ধরে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ সাধারণ বস্তুর তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু এই সব ডার্ক ম্যাটার যোগ করেও আমরা প্রসারণ থামানোর মতো প্রয়োজনীয় ভরের দশ ভাগের মাত্র প্রায় এক ভাগ ভর পাই। কিন্তু মহাবিশ্বে আরেক ধরনের ডার্ক ম্যাটারও থাকতে পারে, যা সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। আমরা এখনও এটি শনাক্ত করতে পারিনি। তবে এটি পাওয়া গেলে মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব আরও অনেক বেশি হতে পারে। নিউট্রিনো নামে এক ধরনের মৌলিক কণিকা আছে। এরা সাধারণ পদার্থের সাথে কোনো ক্রিয়া করে না বলে এদেরকে শনাক্ত করা খুব কঠিন (সম্প্রতি নিউট্রিনো নিয়ে পরিচালিত একটি পরীক্ষায় পানির নিচে ব্যবহৃত একটি ডিটেকটরের পঞ্চাশ হাজার টন পানির প্রয়োজন পড়ে)। আগে মনে করা হত এদের ভর নেই বলে এরা মহাকর্ষীয় আকর্ষণও অনুভব করে না। কিন্তু কয়েক বছর আগে পরিচালিত অনেকগুলো পরীক্ষায় দেখা গেছে এদের সামান্য ভর আছে যা আগে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদি ভর থেকে থাকে, তবে তা ডার্ক ম্যাটারের একটি রূপ হতে পারে। নিউট্রিনোর এই ভরের কথা হিসাবে ধরলেও মহাবিশ্বের প্রসারণ থামানোর মতো প্রয়োজনীয় ভরের চেয়ে অনেক কম ভর পাওয়া যায়। এ কারণে সম্প্রতি পদার্থবিদরা আপাতত ফ্রিড্যমানের দ্বিতীয় মডেলটির ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
এরপর পাওয়া গেল নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ। গত কয়েক বছরে গবেষকদের কয়েকটি দল পেনজিয়াস ও উইলসনের আবিষ্কৃত মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণের তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছেন। এই তরঙ্গের যে সাইজ, তাতে এ থেকে মহাবিশ্বের বড়ো মাপের কাঠামো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রিড্যমানের তৃতীয় মডেলের মতোই এর ইঙ্গিত সমতল মহাবিশ্বের পক্ষে। একে ব্যাখ্যা করার মতো সাধারণ বস্তু ও ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়াতে পদার্থবিদরা আরেক ধরনের বস্তুর কথা ভাবছেন। এর নাম ডার্ক এনার্জি।
সম্প্রতি আরও কিছু পর্যবেক্ষণ জটিলতা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখা গেছে যে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে। ফ্রিডম্যানের একটি মডেলেও এই কথা নেই। এটি খুবই অবাক করা ব্যাপার, কারণ মহাবিশ্বের ঘনত্ব কম হোক বা বেশি- বস্তুর উপস্থিতিতিতো প্রসারণ কিছুটা কমাবেই। আর তাছাড়া মহাকর্ষতো কেবল আকর্ষণই করে (বিকর্ষণ নয়)। প্রসারণ হার বেড়ে যাওয়াকে বোমার বিস্ফোরণের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু এখানে বিস্ফোরণের পর দুর্বল হবার বদলে বোমার প্রতিক্রিয়া আরও শক্তিশালী হচ্ছে। কোন সেই শক্তি যা ক্রমেই দ্রুততর গতিতে মহাবিশ্বকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর উত্তর নিশ্চিত করে কেউ জানে না। কিন্তু আইনস্টাইন যে মহাজাগতিক ধ্রুবক (ও তার অ্যান্টিগ্র্যাভিটি ইফেক্ট বা বিপরীত মহাকর্ষ প্রভাব) নিয়ে এসে ঠিকই করেছিলেন এটা তার পক্ষে প্রমাণ হতে পারে।
প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি ও নতুন ধরনের উপগ্রহ টেলিস্কোপের কল্যাণে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে ক্রমশ নতুন নতুন বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারছি। ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের কী হবে তা সম্পর্কে এখন আমাদের জ্ঞান বেশ ভালো: মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হবে এবং প্রসারণের হার ক্রমাগত বাড়বে। সময়ও চলবে চিরকাল পর্যন্ত, তবে যারা ব্ল্যাক হোলে পড়ে যাবার মতো বোকামী করবে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার কী খবর? এর শুরু কীভাবে হল, প্রসারণইবা শুরু হয়েছিল কী করে?
অনুবাদকের নোটঃ
১। এদের সবাই অবশ্য একসাথে একই রাতে নাও থাকতে পারে।
২। একই কারণে গ্রহরা যেহেতু আরও অনেক বেশি কাছে, তাই দূরের তারকাদের তুলনায় এদের নড়চড়া খুব বেশি চোখে পড়ে।
৩। কোনো বস্তু অন্য বস্তুর চারপাশে কক্ষপথে টিকে থাকে দুটো বলের প্রভাবে। একটি হল, কেন্দ্রীয় বস্তুটির মহাকর্ষীয় টান। অপরটি হল বস্তুটির কক্ষপথের বেগ, যা কেন্দ্রবিমুখী বলের যোগান দেয়। মহাকর্ষ বল একমুহূর্তের জন্যে অনুপস্থিত হলে অপর বলটির প্রভাবে কক্ষপথ থেকে বস্তুটি নাক (স্পর্শক) বরাবর বাইরে ছিটকে যাবে। এখন এক্ষেত্রে গ্যালাক্সিদের বাইরের দিকের নক্ষত্ররা যে গতিতে ঘুরছে তাতে কেদ্রীয় মহাকর্ষ এদেরকে কক্ষপথে ধরে রাখতে পারার কথা নয়।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ