প্রত্যক্ষের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়ে প্রায় সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই প্রত্যক্ষকে পরা-প্রমাণ বা প্রমাণ-জ্যেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। মীমাংসকদের মতে বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষই প্রত্যক্ষ জ্ঞান।
প্রত্যক্ষ্যের লক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে মানমেয়োদয়কার নারায়ণ ভট্ট বলেন-
‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজং জ্ঞানং প্রত্যক্ষম্’। -(মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সন্নিকর্ষের মাধ্যমে উৎপন্ন জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষজ্ঞান।
ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যেহেতু বিষয়েরই সন্নিকর্ষ হয়, তাই ইন্দ্রিসন্নিকর্ষ বলতে ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষকেই বোঝানো হয়েছে। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে যে ইন্দ্রিয়ের ভূমিকাই প্রধান, সে কথা নৈয়ায়িক বা অন্যান্য দর্শন সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষলক্ষণেও ব্যক্ত হয়েছে। একমাত্র জৈনদর্শন সম্প্রদায়ই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানকে পরোক্ষজ্ঞান বলে মনে করেন। অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ই ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লব্ধ জ্ঞানকে সরাসরি বা সাক্ষাৎ জ্ঞান বলে মনে করেন। নব্য-নৈয়ায়িকেরা প্রত্যক্ষজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়কে করণ বলেছেন। মীমাংসা সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষের লক্ষণেও ইন্দ্রিয়ের প্রাধান্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্য’ প্রত্যক্ষজ্ঞানের ব্যবর্তক ধর্ম। অর্থাৎ ‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্যত্ব’ সকল প্রকার প্রত্যক্ষের সাধারণ ধর্ম। এই ধর্ম প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কোন জ্ঞানের থাকে না। জ্ঞানের আরো অনেক ধর্ম আছে। কিন্তু একমাত্র ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্যত্বই প্রত্যক্ষকে অন্যান্য প্রকার জ্ঞান থেকে পৃথক করে। এজন্যে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষজন্যত্বই প্রত্যক্ষের যথার্থ লক্ষণ।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাভাকর-মীমাংসক সম্প্রদায় সাক্ষাৎ প্রতীতিকে প্রত্যক্ষ বলেছেন। প্রাভাকরেরা ত্রিপুটীপ্রত্যক্ষবাদী। এই মতে প্রত্যক্ষে কেবল বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় না, বিষয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞান এই তিনের একত্র প্রত্যক্ষ হয়। এরূপ প্রত্যক্ষকেই ত্রিপুটীপ্রত্যক্ষ বলে। প্রাভাকরদের ভাষ্যে, অহংবিত্তি, বিষয়বিত্তি ও স্বসম্বিত্তি যখন একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়, তখনই তাকে ত্রিপুটীপ্রত্যক্ষ বলা হয়। বলা হয়, প্রত্যক্ষজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় তিনটি একই সঙ্গে যেরূপ প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হয়, অনুমানাদির ক্ষেত্রে সেরূপ হয় না। অনুমানাদির ক্ষেত্রে জ্ঞেয় অংশটি পরোক্ষভাবে প্রকাশিত হয়। জ্ঞেয় অংশটির প্রকাশরীতির পার্থক্যই প্রত্যক্ষের সঙ্গে অন্যান্য জ্ঞানের পার্থক্য গড়ে তোলে। প্রাভাকরমতে জ্ঞান অংশটি সর্বদাই স্বপ্রকাশ। প্রকাশাত্মক জ্ঞান নিজের প্রকাশের জন্য পর-নির্ভর হলে অনবস্থা দেখা দেয়। তাই জ্ঞানকে স্বপ্রকাশই বলতে হয়।
ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো মীমাংসা মতেও প্রত্যক্ষজ্ঞান দুই প্রকার- নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। এই প্রকারভেদ মীমাংসা ও ন্যায় দর্শনে সমভাবে স্বীকৃত হলেও, এই দ্বিবিধ প্রত্যক্ষের স্বরূপ বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনকি স্বসম্প্রদায়ভুক্ত বিভিন্ন দার্শনিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কুমারিল ও প্রভাকর উভয়েই প্রত্যক্ষের এই দুটি স্তরকে স্বীকার করেন।
নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ : নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো বস্তুর নিছক অনুভূতি। বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যখন সন্নিকর্ষ ঘটে প্রথমে বস্তু সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট চেতনা জন্মে। এই অস্পষ্ট চেতনাই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষে শুধু বস্তুর অস্তিত্বে জ্ঞান মাত্র হয়। বস্তুটির জাতিধর্ম, বিশেষ গুণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় না। ফলে তা প্রকাশোপযোগী জ্ঞান নয়। মানমেয়োদয়কার নারায়ণ ভট্ট মীমাংসাসম্মত নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-
‘ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষানন্তরমেব দ্রব্যাদি-স্বরূপমাত্রাবগাহিশব্দানুগমশূন্যম্ যৎ সম্মুগ্ধজ্ঞানং জায়তে তৎ বিশিষ্টকল্পনাভাবাৎ নির্বিকল্পকমিত্যুচ্যতে।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষের অনন্তর দ্রব্যাদির স্বরূপমাত্রের শব্দানুগমশূন্য যে মুগ্ধ বা অব্যক্ত জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই নির্বিকল্পক জ্ঞান; বিশিষ্টকল্পনাশূন্য বলে এই জ্ঞানকে নির্বিকল্পক জ্ঞান বলা হয়।
উপরিউক্ত লক্ষণ অনুযায়ী নির্বিকল্পকজ্ঞান হলো- প্রথমত, দ্রব্যাদির স্বরূপমাত্রের জ্ঞান। দ্বিতীয়ত, নির্বিকল্পকজ্ঞান শব্দানুগমশূন্য জ্ঞান। তৃতীয়ত, নির্বিকল্পকজ্ঞান মুগ্ধ বা অব্যক্ত জ্ঞান। এবং চতুর্থত, নির্বিকল্পকজ্ঞান বিশিষ্টকল্পনাশূন্য জ্ঞান।
সবিকল্পক প্রত্যক্ষ : নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে যে অব্যক্ত জ্ঞান জন্মে, তার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের অতীত জ্ঞানের ভিত্তিতে অর্থাৎ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে বস্তুটির যখন ব্যাখ্যাযোগ্য জ্ঞান হয় অর্থাৎ বস্তুটির জাতি, ধর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতির সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় তখন তাকে বলা হয় সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। মানমেয়োদয়কার নারায়ণ ভট্ট সবিকল্পক প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-
সবিকল্পক প্রত্যক্ষ : নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে যে অব্যক্ত জ্ঞান জন্মে, তার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের অতীত জ্ঞানের ভিত্তিতে অর্থাৎ নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে বস্তুটির যখন ব্যাখ্যাযোগ্য জ্ঞান হয় অর্থাৎ বস্তুটির জাতি, ধর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতির সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় তখন তাকে বলা হয় সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। মানমেয়োদয়কার নারায়ণ ভট্ট সবিকল্পক প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-
‘যত্তু তদনন্তরং শব্দস্মরণসহকৃতং জাত্যাদিবিশিষ্টবস্তুবিষয়ং রক্তোহয়ং ঘটোহয়ং ইত্যাদি ব্যক্তবিজ্ঞানং তৎ সবিকল্পকম্ ।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : নির্বিকল্পক জ্ঞানের অনন্তর শব্দস্মরণ সহযোগে জাত্যাদিবিশিষ্ট বস্তুর ব্যক্তজ্ঞান হলো সবিকল্পকজ্ঞান, যেমন- এটা ঘট, ঘটটি রক্তবর্ণ ইত্যাদি।
জ্ঞান প্রকাশস্বভাব। বস্তুকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করাই জ্ঞানের কাজ। দ্রব্যাদি প্রত্যক্ষের প্রথমক্ষণে যে অব্যক্ত নির্বিকল্পকজ্ঞান উৎপন্ন হয়, তার পরক্ষণেই দ্রব্যাদি পদার্থ দ্রব্য, গুণ, কর্ম, জাতি ও নাম এই পঞ্চবিকল্পযুক্ত হয়ে আবির্ভূত হয়। বিষয়ের এই বিশিষ্টজ্ঞানই সবিকল্পক প্রত্যক্ষ।
নারায়ণ ভট্ট-প্রদত্ত লক্ষণ থেকে সবিকল্পক প্রত্যক্ষের যে বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত হয়েছে, তা হলো- প্রথমত, সবিকল্পকজ্ঞান দ্রব্যাদির বিশেষ জ্ঞান। দ্বিতীয়ত, সবিকল্পকজ্ঞান শব্দস্মরণসহকৃত জ্ঞান। তৃতীয়ত, সবিকল্পকজ্ঞান পদার্থের ব্যক্তজ্ঞান। এবং চতুর্থত, সবিকল্পকজ্ঞান জাত্যাদিবিশিষ্ট বস্তুবিষয়ক জ্ঞান।
অতএব, মীমাংসকদের মতে নির্বিকল্প ও সবিকল্প একই বস্তুর প্রত্যক্ষের দুটি স্তর। প্রথম স্তরটি নির্বিকল্পক এবং দ্বিতীয় স্তরটি সবিকল্পক। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ ছাড়া সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হয় না। তাই প্রত্যক্ষের লক্ষণ সম্বন্ধে বিস্তৃত বিচারের পর ভট্টপদ কুমারিল ভট্ট তাঁর শ্লোকবার্ত্তিকে বলেছেন-
‘বিশেষণে তু বোদ্ধব্যে যদালোচনমাত্রকম্ ।
প্রসূতে নিশ্চয়ং পশ্চাত্তস্য প্রামাণ্যকল্পনা।।’
‘সম্মুগ্ধং বস্তুমাত্রন্তু প্রাগ্গৃহ্ণাত্যবিকল্পিতম্ ।
তৎসামান্যবিশেষাভ্যাং কল্পয়ন্তি মনীষিণঃ।।’- (শ্লোকবার্ত্তিক)
অর্থাৎ :
সর্বত্রই বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হলে প্রথমত অনিশ্চয়াত্মিকা একপ্রকার বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। সেই বুদ্ধি শুধু আলোচনারূপা। বস্তুটিও তখন সম্মুগ্ধ অর্থাৎ অনিশ্চিতরূপেই জ্ঞানগোচর হয়ে থাকে। সেই বুদ্ধি থেকেই পরে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির উদয় হয়। (এখানে আলোচনাই হলো প্রমাণ, আর পরবর্তী নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান তার ফল অর্থাৎ প্রমিতি।)
তবে মীমাংসকেরা ন্যায়সম্মত যৌগিক-প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন না। ন্যায়মতে যোগীরা অতীত, ভবিষ্যৎ, দূরবর্তী এবং অতি সূক্ষ্ম বস্তু অলৌকিক শক্তি দ্বারা প্রত্যক্ষ করতে পারেন বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু মীমাংসদের মতে এ সব ক্ষেত্রে যেহেতু বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ বা সন্নিকর্ষ সম্ভব নয় সেহেতু এদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান কোন অলৌকিক শক্তির সাহায্যে সম্ভব নয়।
ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষ
ভাট্ট-মীমাংসামতে ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ তিন প্রকার- সংযোগ, সংযুক্ত-তাদাত্ম্য এবং সংযুক্ত-তদাত্ম্য-তাদাত্ম্য। ভাট্ট-মীমাংসামতে ন্যায়সম্মত সমবায় সম্বন্ধ স্বীকৃত নয়। ন্যায় সম্প্রদায় ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করেন, যথা- সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায়, সংযুক্ত-সমবেত-সমবায়, সমবায়, সমবেত-সমবায় এবং বিশেষণতা। ভাট্টসম্মত তিন প্রকার সন্নিকর্ষ মূলত ন্যায়সম্মত ষড়বিধ সন্নিকর্ষের প্রথম তিনটির অনুরূপ। আর নামাকরণের ক্ষেত্রে ভাট্ট-মীমাংসায় কেবলমাত্র সমবায়ের পরিবর্তে ‘তাদাত্ম্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ ভাট্টরা সমবায় সম্বন্ধ স্বীকার করেন না, তার পরিবর্তে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ স্বীকার করেন।
পৃথিব্যাদি দ্রব্যের প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ হয় ভাট্ট-সম্প্রদায় তাকে ন্যায় সম্প্রদায়ের মতো সংযোগ সন্নিকর্ষ বলে থাকেন। আর দ্রব্যগত জাতি, গুণ ও কর্মের প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ হয় তা হলো সংযুক্ত-তাদাত্ম্য সন্নিকর্ষ। আবার জাতি, গুণ ও কর্মে স্থিত সত্তা, রূপত্ব ও কর্মত্ব প্রভৃতি জাতির প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ তাকে সংযুক্ত-তদাত্ম্য-তাদাত্ম্য সন্নিকর্ষ বলা হয়।
ভাট্টমতে শব্দ যেহেতু দ্রব্য, সেহেতু তার প্রত্যক্ষ সংযোগ সন্নিকর্ষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই ন্যায়সম্মত সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করার প্রয়োজন হয় না। একই কারণে সমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করাও ভাট্টমতে নিষ্প্রয়োজন। অভাব পদার্থ যেহেতু ভাট্টমতে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, অনুপলব্ধি নামক স্বতন্ত্র প্রমাণগ্রাহ্য, তাই বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকার করারও কোনো প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে প্রাভাকর-মীমাংসক সম্প্রদায় যেহেতু সমবায় স্বীকার করেন, সেহেতু তাঁরা সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায় এবং সমবায়, এই তিনপ্রকার সন্নিকর্ষ স্বীকার করেন। প্রাভাকররা যেহেতু গুণ ও কর্মগত জাতি স্বীকার করেন না, সেহেতু সংযুক্ত-সমবেত-সমবায় স্বীকার করার প্রয়োজন হয় না। আবার প্রাভাকরমতে শব্দত্ব ও অভাব অস্বীকৃত বলে সমবেত-সমবায় ও বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকৃত নয়।
.
তবে মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনি প্রত্যক্ষের সূত্র করেছেন-
ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষ
ভাট্ট-মীমাংসামতে ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ তিন প্রকার- সংযোগ, সংযুক্ত-তাদাত্ম্য এবং সংযুক্ত-তদাত্ম্য-তাদাত্ম্য। ভাট্ট-মীমাংসামতে ন্যায়সম্মত সমবায় সম্বন্ধ স্বীকৃত নয়। ন্যায় সম্প্রদায় ষড়বিধ লৌকিক সন্নিকর্ষ স্বীকার করেন, যথা- সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায়, সংযুক্ত-সমবেত-সমবায়, সমবায়, সমবেত-সমবায় এবং বিশেষণতা। ভাট্টসম্মত তিন প্রকার সন্নিকর্ষ মূলত ন্যায়সম্মত ষড়বিধ সন্নিকর্ষের প্রথম তিনটির অনুরূপ। আর নামাকরণের ক্ষেত্রে ভাট্ট-মীমাংসায় কেবলমাত্র সমবায়ের পরিবর্তে ‘তাদাত্ম্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ ভাট্টরা সমবায় সম্বন্ধ স্বীকার করেন না, তার পরিবর্তে তাদাত্ম্য সম্বন্ধ স্বীকার করেন।
পৃথিব্যাদি দ্রব্যের প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ হয় ভাট্ট-সম্প্রদায় তাকে ন্যায় সম্প্রদায়ের মতো সংযোগ সন্নিকর্ষ বলে থাকেন। আর দ্রব্যগত জাতি, গুণ ও কর্মের প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ হয় তা হলো সংযুক্ত-তাদাত্ম্য সন্নিকর্ষ। আবার জাতি, গুণ ও কর্মে স্থিত সত্তা, রূপত্ব ও কর্মত্ব প্রভৃতি জাতির প্রত্যক্ষে যে সন্নিকর্ষ তাকে সংযুক্ত-তদাত্ম্য-তাদাত্ম্য সন্নিকর্ষ বলা হয়।
ভাট্টমতে শব্দ যেহেতু দ্রব্য, সেহেতু তার প্রত্যক্ষ সংযোগ সন্নিকর্ষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই ন্যায়সম্মত সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করার প্রয়োজন হয় না। একই কারণে সমবেত-সমবায় সন্নিকর্ষ স্বীকার করাও ভাট্টমতে নিষ্প্রয়োজন। অভাব পদার্থ যেহেতু ভাট্টমতে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য নয়, অনুপলব্ধি নামক স্বতন্ত্র প্রমাণগ্রাহ্য, তাই বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকার করারও কোনো প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে প্রাভাকর-মীমাংসক সম্প্রদায় যেহেতু সমবায় স্বীকার করেন, সেহেতু তাঁরা সংযোগ, সংযুক্ত-সমবায় এবং সমবায়, এই তিনপ্রকার সন্নিকর্ষ স্বীকার করেন। প্রাভাকররা যেহেতু গুণ ও কর্মগত জাতি স্বীকার করেন না, সেহেতু সংযুক্ত-সমবেত-সমবায় স্বীকার করার প্রয়োজন হয় না। আবার প্রাভাকরমতে শব্দত্ব ও অভাব অস্বীকৃত বলে সমবেত-সমবায় ও বিশেষণতা সন্নিকর্ষ স্বীকৃত নয়।
.
তবে মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনি প্রত্যক্ষের সূত্র করেছেন-
‘সৎসম্প্রয়োগে পুরুষস্য ইন্দ্রিয়াণাং বুদ্ধিজন্ম তং প্রত্যক্ষমনিমিত্তং বিদ্যমানোপলম্ভনত্বাৎ।’- (মীমাংসাসূত্র-১/১/৪)।
অর্থাৎ : বিদ্যমান বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ হলে প্রমাতা পুরুষের যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তা প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষ অনিমিত্ত, অর্থাৎ ধর্মের জ্ঞাপক প্রমাণ নয়, যেহেতু তা বিদ্যমান বস্তুরই উপলব্ধির হেতু।
.
বস্তুত এই সূত্রে মহর্ষি প্রত্যক্ষের লক্ষণ বলেন নি। লক্ষণ হওয়া চাই অসম্ভব, অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষ থেকে মুক্ত। শুক্তিতে রজতভ্রম, রজ্জুতে সর্পভ্রম প্রভৃতি স্থলেও সৎসম্প্রয়োগজন্যত্ব রয়েছে, অথচ সেসব ভ্রমজ্ঞান যথার্থ প্রত্যক্ষ নয়, বরং প্রত্যক্ষাভাস। সেইসব ভ্রমজ্ঞানে সৎসম্প্রয়োগজন্যত্বের অতিব্যাপ্তি ঘটে। ভাষ্যকার শবরস্বামীর মতে, মহর্ষির এরূপ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে- অভিজ্ঞগণের ব্যবহারে প্রসিদ্ধ যে প্রত্যক্ষ, তাতে সৎসম্প্রয়োগজন্যত্ব অবশ্যই অপেক্ষিত। কিন্তু অবিদ্যমান ধর্ম প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না- একথাই সূত্রের আসল তাৎপর্য।
No comments:
Post a Comment
ধন্যবাদ